জ্বলো চিতাবাঘ (১৯৮০:১৩৮৬)

জ্বলো চিতাবাঘ (কাব্যগ্রন্থ)
হুমায়ুন আজাদ

সৌন্দর্য

রক্তলাল হৃৎপিণ্ডে হলদে ক্ষিপ্র মৃত্যুপ্রাণ বুলেট প্রবেশ;
 অগ্নৎপাতমগ্ন দ্বীপ, চিতার থাবায় গাঁথা ব্যাধ ও হরিণ।
সবুজ দাবাগ্নিদগ্ধ ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের নষ্টভ্রষ্ট দেশ,
 শল্যটেবিলে শোয়া সঙ্গমসংযুক্ত ছাতা আর শেলাইমেশিন।
ধাতুর দুর্দান্ত ক্রোধে কম্পমান হাহাকারভরা দেওদার বন,
 নুহের প্লাবনে ক্ষিপ্ত কালোমেঘ-বমিকরা কেশরফোলানো সিন্ধু।
গলিত চাঁদের তলে ধর্ষিতা কিশোরীর মণিজ্বলা ঝলোমলো স্তন :
 সর্বব্যাপী অন্ধকারে অন্তিম আলোর উৎস টলোমলো যুগ্ম অশ্রুবিন্দু।

*

শত্রুদের মধ্যে

আমার অন্ধ অন্যমনস্ক পা পড়তেই রাগী গোখরার মতো ফুঁসে উঠলো দিগন্ত-মেঘের-দিকে-ব’য়ে-যাওয়া লকলকে একটা লাউডগা,
শেষ-সংকেত-উদ্যত দোলকের মতো, রক্তভরা শিরা লক্ষ্য ক’রে,
দোলাতে লাগলো ভয়ঙ্কর কারুকার্যমণ্ডিত প্রতিশোধস্পৃহ মারাত্মক ফণা।

একটি প্রফুল্ল ধানগাছ, বাল্যস্বপ্নে সারারাত হানাদার ডাকাত সর্দারের
 ছোরার ঝকঝকে ঝিলিকের সমান তেজে ও ক্ষুধায় ও উৎসাহে
আমূল, বসিয়ে দিলো, হৃৎপিণ্ডের দূরতম রক্ত-মাংস-ও স্বপ্ন-কোষ পর্যন্ত,
ফসলভারাতুর উজ্জ্বল সোনালি তীক্ষ্ণ সাংঘাতিক ব্লেড।

একটি বর্ণাঢ্য বাঘের সৌন্দর্যে-স্বপ্নে-ক্রোধে দিগন্তের পুব পার থেকে
 অভ্র-বন্যা ভেদ ক’রে আমার ঘাড়ের ওপর
 লাফিয়ে পড়লো টকটকে লাল একটা হিংস্র গোলাপ।

দিগন্তের পশ্চিম প্রান্তে, শির লক্ষ্য ক’রে, বিজ্ঞানমনস্ক শত্রু
ছুঁড়ে দিলো তার স্বয়ংক্রিয় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র সূর্যাস্ত।
বাল্যপ্রেমিকার মারাত্মক ওষ্ঠের মতো
কেঁপে উঠলো পদ্মদিঘি।

পাতাবাহার বুকের ভীষণ কাছে নিঃশব্দে বাড়িয়ে ধরলো সবুজ পিস্তল।

শেষ নিশ্বাসের আগে চোখে পড়লো খেজুরের ডালে
আটকে আছে চাঁদ : বাল্যে খেলা-শেষে-ভুলে-ফেলে-আসা
মেলা-থেকে-কেনা হাল্কা বেলুন!

*

প্রেমিকার মৃত্যুতে

খুব ভালো চমৎকার লাগছে লিলিআন,
মুহুর্মুহু বিস্ফোরণে হবো না চৌচির।
তরঙ্গে তরঙ্গে ভ্রষ্ট অন্ধ জলযান
এখন চলবে জলে খুব ধীর স্থির।
অন্য কেউ ঢেলে নিচ্ছে ঠোঁট থেকে লাল
মাংস খুঁড়ে তুলে নিচ্ছে হীরেসোনামণি;
 এই ভয়ে কাঁপবে না আকাশপাতাল,
থামবে অরণ্যে অগ্নি আকাশে অশনি।

আজ থেকে খুব ধীরে পুড়ে যাবে চাঁদ,
 খুব সুস্থ হ’য়ে উঠবে জীবন যাপন।
অন্নে জলে ঘ্রাণে পাবো অবিকল স্বাদ,
 চিনবো শত্রুর মুখ, কারা-বা আপন।
 বুঝবো নিদ্রার জন্যে রাত্রি চিরদিন,
যারা থাকে ঘুমহীন তারা গায় গান।
রঙিন রক্তের লক্ষ্য ঠাণ্ডা কফিন;
খুব ভালো চমৎকার লাগছে লিলিআন।

*

নৌকো

শক্ত শালের নৌকো, বাতায় গুড়ায় পেশি ফুলে আছে তরুণ ঘোড়ার;
 পালগুড়া ধ’রে আছে বায়ুমন্ত্র, গতিপ্রগতিতে কাঁপে সম্মুখ গলুই
দীর্ঘ জলে ভেসে যায় শিল্পময় তীক্ষ্ণ তীব্র ক্ষিপ্র রুইমাছ।
 জল, ঢল চারপাশে, ঢেউয়ের মতোন নৌকো নৌকোর মতো ঢেউ চলে
 গলিত অম্বরতলে, জলস্তম্ভ দিগ্বলয় ক্রমে ক্রমে আসছে দখলে।
মাল্লার আত্মার মতো তরুণ শালের নৌকো এই জল ভেদ ক’রে
নিবিষ্ট শরের মতো ছুটে যায় অন্য জল মুখে।

তোমার বান্ধব ঝড়, সমুদ্ৰাধিরাজ, বায়ুবাত্যাঘূর্ণি দৈনিক গৌরব;
নীল, গাঙচিল, ফেনার মাল্য নিত্য প্রসাধন। স্বেচ্ছানির্বাসিত
নৌকো, ঘোলা জল আর মরা তট থেকে, স্ফীত পাল শক্ত পালগুড়া
 বাতায় নির্ভর করে নির্বাসিত গায়কগায়িকাসহ জলকে স্বদেশ ক’রে
ভাসছে ভূধরে। ঢেউয়ের মতোন নৌকো ঢেউয়ের ভেতরে চলে ছুটে।

নৌকো ভাসে সমুদ্রের মাঝখানে, একা, দূর তটে মাটি ঝরে টুটে।

*

সবুজ সাবমেরিন

আমার কবিতা, তোমার জন্যে লেখা, ধাতব লাল
নগ্ন, এবং নিদ্রাহীন
সামনে এগোয়, পাথর ভেঙে আর তুষার ঠেলে
দূরপাল্লার সাবমেরিন;
কেউ ব’সে আছে ভেতরে মগ্নলোকে, চোখের মণি
স্বপ্ন খাচ্ছে ভীষণ নীল,
গোপন কবিতা তোমার বক্ষে ওঠে–উত্তেজিত
বিবস্ত্র, আর অশ্লীল!

মাতাল কবিতা তোমার ওষ্ঠে ত্বকে ছড়ানো চুলে
তীক্ষ্ণ স্তনে বসায় দাঁত,
কেঁপে ওঠে দূর গোপন বস্তুরাশি, মাংসে নাচে
অক্টোবরের তৃতীয় রাত,
তাপে গলে তামা লোহা ও রৌপ্য সোনা, জমছে দ্যাখো
সঙ্গীত-ঢালা এক দ্বিনাট্য,
 আমার কবিতা, তোমার জন্যে লেখা, যতিবিহীন
অভদ্র, আর অপাঠ্য!

সমকালচ্যুত, অশীল স্বপ্নে গাঁথা কবিতা সেই
জীবনের চেয়ে অবাস্তব
কামনায় কাঁপে, কঠিন অঙ্গে তার খচিত রাত
ওষ্ঠে বিদ্ধ অসম্ভব;
মাতাল মনীষী ব্যাপক বক্ষে ক্ষুধা, শরীর তার
ব্রোঞ্জের মতো বস্ত্রহীন,
অজর কবিতা তোমার মাংসে ঢোকে তুষার ঠেলে
সবুজ রঙের সাবমেরিন!

*

পোশাকপরিচ্ছদ

হ্যাঙারে টাঙানো দুটো, ভুল-শব্দে-ডাকা, ঝকঝকে রঙিন পোশাক :
জীবন ও মৃত্যু। জীবন, আমার ট্রাউজার; মৃত্যু, সিল্কের স্বাদভরা তারাপরা
নৈশ-পাজামা। সারাদিন পরে থাকি বাস্তবখচিত ট্রাউজার, রাত্রে স্বাদ নিই
 পাজামার; এবং কখনো অ্যাভেনিউর তীব্র মধ্যে দাঁড়াই পাজামা প’রে,
সারারাত পরে রই টাওয়ার-মিনার-ব্যাংক-স্ট্রিট-জন্ম-হত্যা-বাস্তবতা-ঝলকিত
ব্যাপক ট্রাউজার। দক্ষ দর্জির হাতে শিহরণময় বৈদ্যুতিক যন্ত্রে তৈরি
বাস্তবমণ্ডিত, ঢোলা, পকেটখচিত, নাইলনের সমর্থ সুতোয় ও জিপে গাঁথা
 সাম্প্রতিক, অভিনব জীবন-ট্রাউজার। কিন্তু পরার পরেই ভয়ংকর ঠাসাঠাসা
 লাগে, উরুতে ক্রন্দন ও সম্মিলিত ব্যর্থতা বাজে, পাছায় ভীষণ টান লাগে, আর
 রাস্তায় বেরুতে-না-বেরুতেই টাশটাশ ছেঁড়ে জিপ, তৎপর তন্তু, নাইলন ও
 কার্পাসের প্রসিদ্ধ প্রতিভা। রঙিন রক্তের চাপে বাস্তবতা ছিঁড়ে দেখা দেয়
 অবাস্তব, পরাবাস্তব, নীলবাস্তব, লালবাস্তব, পদ্মবাস্তব, স্বপ্নবাস্তব,
 জ্যোৎস্নাবাস্তব, সোনিয়াবাস্তব আন্ডারওয়ার! ঝরে উরু, পাছা, জংঘা ও
 অস্থি থেকে সূর্যাস্তের মতো বিশ্ববিদ্যালয়, সোনার স্বপ্নের মতো ব্যাংক,
 বস্তুর মতো অভিনেত্রী, গায়িকার মতো পদ্য, পল্লীর মতোন রাজধানি,
সুরের মতোন নর্তকী, ও জুনকোর জাপানি ওষ্ঠের মতো একবিন্দু স্বপ্ন।
কখনো-বা পরতে চেয়েছি রাজনীতির মতো লুঙ্গি, সুনীতির হাফপ্যান্ট,
 ধর্মের মতো শালোয়ার, একনায়কের ঢ্যাবঢেবে খাকি, কিন্তু সব ছিঁড়েফেড়ে
ভেসে ওঠে স্বপ্নের আন্ডারওয়ার। সাধারণত, অনভ্যাসবশত, পাজামা পরি না
রাতে, এমন কি গ্যালিক ঠাণ্ডায়ও আমি সারারাত ঘুমিয়েছি পাজামাবিহীন
সামান্য উত্তেজনায় দুই খণ্ড হ’য়ে গেছে লর্ডস-এ তৈরি পাজামা।
মৃত্যু পরার দিনেও হয়তো ফেটে পড়বে সেই শাশ্বত সিল্ক–দেখা দেবে
অমৃত্যু, লালমৃত্যু, পরামৃত্যু, জ্যোৎস্নামৃত্যু, চন্দ্ৰাস্তরাজিয়ামৃত্যু আন্ডারওয়ার

*

সান্ধ্য আইন

কী আর করতে পারতে তুমি, কি-বা করতে পারতাম আমিই তখন?
চারদিকে ছড়ানো সন্ধ্যা আর তার হিংস্র নীতিমালা;
একটা মুমূর্ষ পাখি থেকে থেকে চিৎকার করছিলো তীক্ষ্ণ সাইরেনে।
 নিষেধ রাস্তায় নামা, বাইরে চোখ ফেলা; তুমি-আমি, সে-সন্ধ্যায়,
কী আর করতে পারতাম পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া?

কিছুই ধরতে না-পেরে, কাঁপছিলো সমস্ত শহর, প’ড়ে যাচ্ছিলে তুমি
মাটির বাড়ির মতো, আমি ধ’সে পড়ছিলাম শহিদ মিনার।
বাইরে ছড়ানো সন্ধ্যা আর তার হিংস্র নীতিমালা : কী আর করতে
পারতাম আমরা পরস্পরকে দৃঢ়-তীব্র আলিঙ্গনে ধ’রে রাখা ছাড়া?

তখন শরাইখানা বন্ধ, অপেক্ষাগারে জলের একটা ফোঁটাও ছিলো না।
 তোমার পায়ের পাতা থেকে উঠে আসছিলো ঝকঝকে লাল তৃষ্ণা,
আমার মগজের নালি বেয়ে নেমে আসছিলো সুদীর্ঘ বোশেখি পিপাসা।
 কী আর করতে পারতাম আমরা, সাইরেন-ঘেরা নির্জন সন্ধ্যায়,
পরস্পরের ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে রক্তের গভীরতম কুয়ো থেকে
মেদিনীর সবচেয়ে ঠাণ্ডা জল অবিরাম পান করা ছাড়া?

শয্যা দূরের কথা, দশদিগন্তে নড়োবড়ো একখানা বেঞ্চও ছিলো না।
 চারদিকে ছড়ানো রাত্রি, সান্ধ্য আইন, রাইফেল, হিংস্র নীতিমালা।
স্যাঁৎসেঁতে মেঝে একনায়কের মতোই পাষণ্ড : কী আর করতে পারতাম
আমরা, রাজিয়া, পরস্পরের শরীরকে জাজিম করে সারাঘর তাপে ভ’রে
সারারাত প্রথমবারের মতো সত্যিকার অবিচ্ছেদ্য ঘুম যাওয়া ছাড়া?

*

পাপ

হ’তে যদি তুমি সুন্দরবনে মৃগী
অথবা হংসী শৈবাল হ্রদে বুনো,
মাতিয়ে শোভায় রূপভারাতুর দিঘি
হ’তে যদি তুমি তারাপরা রুই কোনো
তাহলে এখন হতো না ব্যর্থ উভয় মাংসকোষে
যেই ক্ষুধা জ্বলে, অস্থিতে ঢুকে দাউদাউ করে ফোঁসে।

আমরা হতাম যদি আকাশের চিল
চার ডানাভরা সোনারুপো কারুকাজ,
অথবা হতাম প্রেমের ছোবলে নীল
হিংস্র কোব্রা, শানকি বা দুধরাজ
তাহলে এখন দুই দেহভরা শরীরী উত্তেজনা
ব্যর্থ হতো না কালো কংক্রিটে কস্তুরী এক কণা।

যদিবা হতাম রঙধনুমাখা মাছি
 স্বপ্নবিদ্ধ, পাতার আড়ালে, চুপে
তাহলে দেখতে আমি ঢুকে বসে আছি
তোমার আর্দ্র দশলাখ লোমকূপে
আমাদের প্রেম ব্যর্থ হতো না এমন শরীরী দিনে
চারদিক-ঘেরা অ্যাভেনিউ স্ট্রিট ড্রেন আর ডাস্টবিনে।

তোমার মাংস কয়লার মতো জ্বলে,
আমার অস্থি পুড়েপুড়ে ঝরে ছাই,
তোমাকে ফাড়ছে হিংস্র করাত কলে
আমার রক্তে এক ফোঁটা লাল নাই
বইছি দুজনে স্বপ্নেমাংসে অশ্লীল অভিশাপ
 আর কিছু নয় ব্যর্থতাভরা মানুষ হওয়ার পাপ।

*

শ্লোগান

ফিরছে সবাই, ধারাজলে সুখী খড়কুটো, ফিরছে সবাই।
তৃপ্ত উজ্জ্বল মুখ, সিল্কের নরম ঢেউ, মসৃণ বিহ্বল চুল
 ঠেকিয়ে প্রফুল্ল মেঘে, বেহালার সুর ঢেলে ধাতুতে কংক্রিটে
ব্যর্থতার স্পর্শহীন বিশাল ব্যাপক জনমণ্ডলি ফিরে যাচ্ছে ঘরে।
 পতাকাখচিত সুখ দোলে চারপাশে, বাতাসে ঝলকে ওঠে সেতারের সোনা তান।
যা কিছু চেয়েছে তারা : ঘুম, কুসুম, দু-চোখে নদীর রেখা,
উজ্জ্বল ধানের গুচ্ছ, ওষ্ঠে পাখির মাংস, পুলকিত স্ত্রীসঙ্গম
সবই পেয়েছে।
 মেঘ ফিরে যাচ্ছে, কলসি বোঝাই তার পাললিক জল;
জ্যোৎস্নাভারাতুর চাঁদ যায়, নীল থেকে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে মাখন আঁচল;
পাখি ফেরে, ঠোঁট থেকে গলে পড়ে সুরের শ্রাবণজল রিকশার বনেটে;
 বাস্তব তরুণ ফিরছে অবাস্তব তরুণীর হাত ধরে;
জলরাশি, যাচ্ছে আপন শহরে,
শহর, আপন পল্লীতে;
বৃদ্ধ, ফিরে যাচ্ছে যৌবনে;
বর্ণমালা, জলতরঙ্গের মতো মৌলিক ধ্বনিতে;
জনমণ্ডলি ফিরে যাচ্ছে আপন কুলায় সময়াস্তের দুর্ভাবনা ভুলে।
 ক্ষেত, ফিরে যাচ্ছে ফলন্ত তরঙ্গরাশি শ্রোণিভারে দোলাতে দোলাতে;
 নৌকো, তম্বীস্তনের মতো পাল কাপে মৌশুমি বাতাসে;
সবাই ফিরছে ঘরে সুখী তৃপ্ত সুন্দর মায়াবী।
আমি একা, শূন্য বৃক্ষ, দাঁড়িয়ে রয়েছি ঠাণ্ডা শূন্যতার মুখোমুখি,
শূন্যতা পেরিয়ে মূল পৌঁছে শূন্যে, ডাল নড়ে শূন্যের প্রহারে;
আমার উত্তরে কাপে শূন্যলোক, দক্ষিণে শূন্যের ভূভাগ,
পশ্চিমে ডুবছে লাল শূন্য, পুবে উঠে আসে ধবধবে ভয়াল শূন্যতা।
আমি একা শ্লোগানমুখর, কম্পমান সর্বলোক, অর্থাৎ শূন্যতা।

*

স্নান

সময়ের মতো উষ্ণ তুষারের মতো শুভ্র নদী বয় জীবনের মতো
পলিমাটিলোকে, দাঁড়িয়ে রয়েছি তীরে গাছ এক আমার শরীর,
ঝরে পড়ি প্রথম পল্লব, শ্বেতস্রোতে চিরকাল স্নানে আছি অবিরত

যেনো মাছ পরিস্রুত জলে, নীল ঝর্না ঝরে নিসর্গের গুপ্ত স্নানঘরে
কিশোরীর মতো আছি যৌবনের জলঘরে আগন্তুক স্বপ্নজলতলে।
সবচে বিশুদ্ধ জল শোভাময় প্রবাহিত ধাতু আর বস্তুর ভেতরে

স্নানে রত আছি বস্তুতে ধাতুতে, নিয়ত ঝরছে জল অলৌকিক কলে
 প্লাবিত দ্রবিত রাত্রি, স্পন্দিত পাথর, ঝরঝর ঝরে অনন্ত নির্ঝর
 প্রত্যহ করছি স্নান রৌদ্রময় দুঃখী ক্ষুব্ধ উষ্ণ শুদ্ধ জনতার জলে

তার ঢেউয়ে যেনো জনপদ্ম দীর্ঘমূল। যেনো অনন্ত গভীরমুখি নুড়ি
পাথরের নেমে যাচ্ছি স্নানরত অতল জলেতে, যেমন করেছি স্নান
শৈশব চাঁদের তলে জ্যোৎস্নায় তোমার দেহের জলে, জলদ কিশোরী,

স্নানে রত আছি তোমার স্মৃতিতে, শূন্য সময়ের রুক্ষ রুগ্ন পদতলে
কোলাহলে কলরোলে, সময়ের ময়লা ধুই চিরকাল ক্ষিপ্র দুই হাতে,
অনন্ত স্নানার্থী আমি জল ঢালি দেহবিশ্বে স্নানরত সময়ের জলে।

*

ঘণ্টাধ্বনি ঘুমের ভেতরে

ঢং ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজে ধীরস্বরে সমুদ্রের পরপারে ঘুমের ভেতরে
আটত্রিশ মাস ধরে রেশমমসৃণ ধ্বনি কপোতের কোমল আদরে
গ’লে পড়ে পাতা নড়ে বেণুবনে বঙ্গদেশে শীতলক্ষা হাম্বারের জলে
 করুণ পদ্মের মতো কেঁপে ওঠে সৌরলোক অন্ধ বোবা চোখের কমলে।
জেনেছি মোমের প্রীতি, শাদা ত্বক, সিল্ক চুল, গ্রীবা, বাহু, অ্যাংলোস্যাক্সন
স্তন–নিবিড় স্থাপত্যকলা–হেলেনিক করাঙ্গুলি, ককেশীয় মন,
 ম্যান্ডারিন লীলালাস্য, মৃত ভাষা ঠুকরে খায় মিনারের শাদা কবুতর
ডিং ডং রেশমি ধ্বনি সকল ছাপিয়ে ওঠে আটত্রিশ মাস ধরে ঘুমের ভেতর।
 নিশিরে শিশিরে ভরে তোমার নামের স্বরে, নিষ্প্রাণ বস্তুর মধ্যে ক্রিয়া
 রত নস্টালজিয়া, ঘণ্টা ও ধ্বনিকে ভেদ করে রাখে মূঢ় ইউরোপ-এশিয়া।

*

পরাবাস্তব বাঙলা

স্বপ্ন থেকে অবাস্তব পথ খুঁজে
একটা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে আস্তে ঢুকলে ভেতরে
দশটা জল্লাদ সাজালো তোমাকে কালো রক্তে বিবাহোৎসবে
 বস্তু-বাস্তবতা-জ্যোৎস্না-রঙের বদলে দুললো স্বপ্ন-মাংস-ব্যাংক ওষ্ঠ–পদ্ম–হরিণ–সূর্যাস্ত–মানুষ–জন্তুর সামনে তোমার বিকল্প চেহারা। আমি লাল
 হৃৎপিণ্ডের সাথে তোমার মুখের রূপ মেলাতে মেলাতে মিলিয়ে ফেললাম চিন্তাব্যতিরেকে একজোড়া বিশাল কদর্য হিংস্র কালো বুটের সঙ্গে। কখনোবা এক
জোড়া দুমড়ানো খাকি মোজার সঙ্গে। তুমি ছাপ্পান্নো হাজার
বর্গমাইলব্যাপী একজোড়া কালো বুট,
 দৈত্যের দু-কাঁধের স্বর্ণপদক।

তোমার নিতম্বে আপাদমস্তক
নগ্ন খেলা করে একটা বন্দুক আর দুটো শিরস্ত্রাণ,
তোমাকে গণ্ডারগর্ভ করার জন্যে পাখি-ডাকা-ভোরে
দেগে ওঠে একুশটা হিংস্র কামান।

রাইফেলের নির্দেশে তুমি ফোঁটাচ্ছো
সামরিক পদ্ম, সাইরেনে কেঁপে নামাচ্ছো
বর্ষণ, নাচছো বৃষ্টিতে চাবুকের শব্দে, এক ম্যাগজিন
ভর্তি হলদে বুলেট পাছায় ঢুকলে তুমি জন্ম দাও নক্ষত্ৰস্তবকের
মতো কাঁপাকাঁপা একটা ধানের শীষ। প্রকাশ্য রাস্তায় তুমি একটা লজ্জিত রিকশা ও
দুটো চন্দনা পাখির সামনে একটা রাইফেল–একজোড়া বুট-তিনটা শিরস্ত্রাণের সঙ্গে
 সঙ্গম সারো;–এজন্যেই কি আমি অনেক শতাব্দী ধরে স্বপ্নবস্তুর
ভেতর দিয়ে ছুটে-ছুটে পাঁচশো দেয়াল-জ্যোৎস্না-রাত্রি
 ঝরাপাতা নিমেষে পেরিয়ে বলেছি, ‘রূপসী, তুমি,
 আমাকে করো তোমার হাতের গোলাপ।’

*

আধঘণ্টা বৃষ্টি

আধঘণ্টা বৃষ্টিতে, বিক্রমপুরের আঠালো মাটির মতো, গললো সূর্যাস্ত,
আলতার মতো ঝরে গেলো বটের ঝুরির তলে সঙ্গমরত দুটি কালো মোষ।
অ্যাভেনিউর সর্বোচ্চ টাওয়ারটির প্রতিদ্বন্দ্বী, আমার প্রথম ছাত্রীর মতো
 উল্লাস-উদ্যমশীল, আমগাছটির একটি চঞ্চল পাতা কেঁপে কেঁপে গলে
আমার শুষ্ক ঠোঁটে ঝরে পড়লো চুম্বন-শিহর-ঢালা একফোঁটা উজ্জ্বল সবুজ।
আকাশ, নীলের ভাণ্ড, থেকে উছলে পড়লো শাদা ট্রাউজারে একরাশ নীল,
 অস্ত গলে এক ভরি কাঁচা সোনার আংটি এসে লাগলো শূন্য মধ্যমায়।
 আধঘণ্টা বৃষ্টিতে, হরিণের মাংসের মতোন, গললো গোলগাল চাঁদ,
জ্যোৎস্নার মতো গলে গেলো কার্নিশে মুখোমুখি একজোড়া শাদা কবুতর।
 বঙ্গোপসাগরে ঢেউয়ের সঙ্গে মিশলো দিগন্তপ্রলুব্ধ একটা জাহাজ,
 আর তার প্রতিদ্বন্দী রমনার কালো জলে আগুনের মতো রাজহাঁস।
 ওষ্ঠে পাতার সবুজ, ট্রাউজারে নীল, মধ্যমায় অস্ত-গলা সোনার আংটি
পরে পৃথিবীর একমাত্র ভাসমান জাহাজের মতো ঢেউ-ভরা ঘরে ঢুকে দেখি :
 শাহানা শয্যায় গলে ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ ঘূর্ণি-জ্বলা ভয়ঙ্কর নদী হয়ে আছে।

*

থাবা

সবুজ তরুর পাশে জ্বলন্ত অঙ্গার লাল দীপ্র থাবা জ্বলে।
অদ্ভুত ভীতিতে কাঁপে জলস্থল; সৌধাবলি নগ্ন পদতলে
ভয়ার্ত চিৎকারসম পড়ে আছে। বেজে যায় পাথরের ধাতব রাগিনী
থাবা মেলে আছো তুমি সর্বলোক অপরূপা অভিচারী অদৃশ্য বাঘিনী।

তোমার অদৃশ্য থাবা সর্বগ্রাসী, অলৌকিক লাল গ্রন্থ, প্রতিটি অক্ষরে
মরুঝড় অগ্নুৎপাত, কাগজের মতো ছিঁড়ো ধাতু-লোহা-শব্জি-পুষ্পরে।

অত্যন্ত ভেতরে জ্বলে বাক্যমালা–দাবানলে পোড়ে নরলোক।
 বৃক্ষের ব্যুৎপত্তি শিখি, পাঠ করি কিসে সারে মাংসের অসুখ
 পাখি আর পশুদের মানুষের, স্বপ্নের নির্মাণ নিয়ে করি গবেষণা,
যতো দিন কবি আছে ততো দিন জেগে রবে অচেনা প্রেরণা।
 তোমার আগুনে গাছে ফুল ফোটে তোমার আদরে জলে বয় দীর্ঘ নদী
তোমার দংশনে মাটি অরণ্যের শোভা পায় দক্ষিণের সমুদ্র অবধি;
তোমার দহনে ওষ্ঠ প্রেম শেখে, রক্তমাংস শেখে নর্মক্রিয়া
 থাম ওঠে সভ্যতার; জন্ম নেয় ভারত, মিসর, সিন্ধু, মেসোপটেমিয়া।

নদী ও মাটির বাক্য পথেপথে, চতুর্দিকে জল ও স্থলের প্রতীক,
চোখের চিত্রকল্প দৃষ্টি জুড়ে, বিশেষণপুঞ্জ ধ্যানী গভীর স্বাপ্নিক;
পাপ ও পুণ্যের তুমি যুগ্মশয্যা, আলিঙ্গনে সলোমন-শাবা
ব্যাপক মেদিনী ভ’রে দগদগে পুষ্পের মতো চিরকাল মেলে আছো থাবা।

*

পাড়াপ্রতিবেশী

‘কেমন আছেন?’, বলে স্মিতহাস্যে ডান হাত মেলে দেন প্রবীণ অশথ
দু-যুগের প্রতিবেশী, আদাব জানাই আমি। ‘কী চমৎকার এই ভোরবেলা!’,
উড়ে আসে প্রজাপতি, সড়ক শুধায়, ‘কেমন কেটেছে দিন বিভুঁই বিদেশে?’
 গাছের শাখার মতো সিগ্ধ জাতসাপ জানালায় কেশে যায়, ‘স্লামালেকুম,
একটু সামনে যাবো, কথা হবে ফেরার সময়।’ সামনের চিলতে বাগানে
উদ্দাম শিশুর মতো বল নিয়ে খেলা করে কালো মাছি ঝরা ফুল কাঠের পুতুল।
 খয়েরি পিয়ন আসে ডাক নিয়ে নক্ষত্রের মতো ঢালে বন্ধুদের চিঠি
পত্রোত্তরে কুশল শুধায় মঙ্গল বৃহস্পতি শুক্র, বহু দিন প্রবাসী বন্ধুরা।
হঠাৎ হরিৎ হয়ে বেজে ওঠে টেলিফোন, ‘হ্যালো, হুমায়ুন, বাল্যকাল থেকে
পদ্মার ইলিশ বলছি, ভালো আছি আমরা সবাই। তোমার কুশল বলো,
 ভালো আছে তোমার সতীর্থ নদী, রুই মাছ, কালো জলে গাছের ছায়ারা।’
 কড়া নড়ে, সন্ধ্যার আড্ডায় ডাকে পাশের বাসার স্নিগ্ধ শ্রীমতি প্রকৃতি।

*

এসকেলেটর

ক্রমশ নামছি নিচে, পিছে পড়ে আছে পিরিচে ফলের মতো চাঁদ,
যে-কোনো প্রস্থানে যার মুখ বাল্যস্মৃতিসম মনে পড়ে মানুষের;
হাঁটুতে নির্ভর করে হেলে আছে নড়োবড়ো ঘরের মতো সভ্যতা,
যে-কোনো প্রস্থানে যার থাম ভেঙে পড়ে, জমে ওঠে ইট কাঠ মল
 অন্দরে ও রাজপথে; এ-সবের তলে তাজা প্রাগৈতিহাসিক ঘাস
 অন্তিম দীপের মতো ঢালে সংগোপনে অতীন্দ্রিয় সুস্থ পরিমল।

দুই ঠোঁটে জমেছে প্রভূত ময়লা এতো দিন, যেনো প্রতিদিন
পরম তৃপ্তির সাথে করেছি আহার মলমূত্র, নর্দমার
প্রবাহিত স্রোত থেকে ব্যঙ্গ ওষ্ঠে লেহন করেছি মৃত্যু, পুণ্যলোভী
প্রত্যেক চুম্বন সঞ্চয় করেছে ব্যাধি দুরারোগ্য ক্ষতস্থল থেকে।

পাতালের প্রেম এই সিঁড়ি, মসৃণ মায়াবী, পবিত্র নামছে নিচে
আমাকে বহন করে, অদৃশ্যের সুস্থলোক থেকে ডানা মেলে
পাখির ঝাঁ^কের মতো বয়ে আসে সুস্থ বায়ু আঙুলের স্পর্শ
নিরাময় রাখে আঁকাবাঁকা চুলে, স্বাস্থ্যে, ভেতরে মেলেছে দল শাদা
শতদল, সম্মুখে স্বাস্থ্যল নদী পিপাসার, বাঁয়ে স্বাস্থ্যকর জল।

নানা তরুবর মুকুলিত হয়, আমি সেই নীলছোঁয়া তরু,
সঞ্চারিণী পল্লবিনী স্তবকবিনম্রা, তুমি আজ ফিরে গেছো ঘরে
পদচিহ্ন রেখে গেছো কালস্রোতে অমলিন, প্রতিটি পুষ্পেপল্লবে,
. অবিনাশী এক বিন্দু কালো অশ্রু ফেলে গেছো এসকেলেটরে।

সৎ হচ্ছি সুস্থ হচ্ছি নামছি যত নিচে, নবোদগত অঙ্কুরের মতো
 বস্তু ও বাক্যের পত্রে লাগে বিশুদ্ধতা, কথোপকথন হয়ে ওঠে
 প্রার্থনার শুদ্ধ স্তব, যেনো কোনো দিন গদ্য ও বস্তুকে ধরি
 নি আমার কণ্ঠে, পাখিরে দিয়েছে সুর এ-কণ্ঠের সবুজ অরণ্য
 থেকে সুর পেতে, সৌরসুর গীত হবে অন্ধকারে একটি ঝঙ্কারে।

*

প্রেম

যেদিকে ইচ্ছে পালাও দু-পায়ে, এইটুকু থাক জানা :
চারদিকে আমি
কাঁটাতারে ঘিরে সাস্ত্রী বসিয়ে পেতে আছি জেলখানা।

কুকুর যেমন সব-ক’টি দাঁতে গেঁথে রাখে প্রিয় মাংস,
গেঁথে রাখি দাঁতে
 তোমার শরীর এবং রূপের অধো-আর-উর্ধ্বাংশ।

পশ্চিমে গেলে দেখবে তোমার অতুলনীয় স্বাস্থ্য
খেতে ছুটে আসে
একটি বিশাল ডোরাকাটা বাঘ–শিক্ষিত সূর্যাস্ত।

উত্তরে খুঁড়ে গভীর কবর জেগে আছি মিটমিট
মাটির তলায়
সুস্বাদু ওই মাংসের লোভে শবাহারী কালো কীট।

দক্ষিণে গেলে দেখবে দুলছে একটি ব্যাপক সিন্ধু
আমার অন্ধ চোখ-থেকে-ঝরা একফোঁটা জলবিন্দু!

*

তোমার সৌন্দর্য

তোমার তৃতীয় চিঠি পাটিগণিতের পাঁচশো পৃষ্ঠার ডাকবাক্সে পাওয়ার
পাঁচ দিন পর, মাত্র ষাট গজ হেঁটে, পাঁচটা লেটার-স্টারের
ভয়ংকর ঝলকানি পনেরো বছরের দুর্দান্ত বর্বর লাল রক্তে গেঁথে
তোমার ও সন্ধ্যার ও বিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশকের মুখোমুখি দাঁড়ালাম।
একফোঁটা তলহীন জল তোমার গোলাপি গণ্ডে, লাল তিলটার পাশে,
তোমার ও সমগ্র বিক্রমপুরের মতো টলমল করছিলো।
দেখে মনে হলো তুমিই
সুন্দর।

বন্য বাতাসে, যেনো রঙিন রুমাল, ঝলমলালো আমাদের ষোলো বছর।
সূর্যাস্তরঞ্জিত পদ্মাপারের নারকেলগাছগুলোকে আমূল শিউরে দিয়ে একটা
মোগলাই তলোয়ারের মতোন মারাত্মক ঝকঝকে জিহ্বা
ঘজঘজ করে যখন ঢোকালে মুখে, মনে হলো
তুমিই সৌন্দর্য।

সমস্ত দুপুর কাঁপলো থরোথরো, বাড়িটা ট’লে পড়লো তেতলা মাতাল।
সিল্ক খুলে মেলে দিলে গুপ্ত সিল্ক–মুখে গুঁজে দিলে
 সোনাভরা লাল তিল-পরা স্বপ্ন-সিল্ক
 মনে হলো তুমি পৃথিবীর
অন্তিম সৌন্দর্য।

পৃথিবীর একমাত্র সন্ধ্যাবেলা যখন হনন করলে তোমাকে-আমাকে
জন্মান্ধ দু-চোখ অন্ধ দেখলাম তুমি আততায়ীর
তীক্ষ্ম ছুরিকার ঝিলিকের চেয়েও
সুন্দর।

যেদিন আমাকে তুমি ক্ষিপ্ত লাভার মুখে ছুঁড়ে ফেলে চলে গেলে
তাকে দিলে স্বর্ণখনি, সবচে স্বর্ণাঢ্য ভূমি খুঁড়েখুঁড়ে
 যখন ঢুকলো সে তোমার ব্যাপক দীর্ঘ
 সোনার খনিতে, তোমার মুখের
শিহরণ জংঘার আন্দোলন
 দেখে মনে হলো এতো
সৌন্দর্য আমি
কখনো
দেখি
নি।

*

উত্থান

জাগলো বীরেরা! হয়ে ছিলো যারা প্রতারিত পর্যুদস্ত পরাজিত
 ক্রীতদাস, সেই স্বতোজ্জ্বল শক্তিমান রূপোচ্ছল বস্তুপুঞ্জ
 সরালো আঙুলে কালো পর্দা চোখ থেকে, ছিঁড়ে বাহু-জংঘা-গ্রীবা
ও কোমর থেকে ঝকঝকে সোনালি শেকল জাগলো সূর্যাস্তের চেয়ে
 সুন্দর, সূর্যোদয়ের চেয়ে ভয়াবহ বলিষ্ঠ বীরেরা! দেখলো,
বাঁ-পাশে চাবুক হাতে সারিসারি অসুস্থ মানুষ, ডানপাশে নষ্ট রুগ্ন
 মুমূর্ষ প্রকৃতি। সপ্রতিভ স্বাস্থ্যবান স্বপ্নভারাতুর অমর মেধাবী
বস্তুপুঞ্জ–মানুষ ও নিসর্গের মিলিত চক্রান্তে পরাভূত,
 নিন্দিত শোষিত–উঠলো স্বপ্নে-মাংসে বাস্তব-অবাস্তব ক্ষুধাসহ,
দেখলো চারপাশে প্রফুল্ল মাংস শজি রক্তিম দ্রাক্ষা ও অঢেল পানীয়।
মাইক্রোফোন সমবেত শ্রোতার সামনে সুখে সবুজ শব্জির মতো
মুখে পুড়লো সুস্বাদু বক্তাকে; ক্যামেরা জিহ্বায় নিলো তাজা পনিরের
মতো মডেলের নির্বস্ত্র শরীর; জাজিম হা-খুলে লাল-ভেজা মুখে,
 দগ্ধ কাবাবের মতো, রাখলো সঙ্গমসংযুক্ত দম্পতিকে;
টেলিভিশন গোগ্রাসে গিলে ফেললো পুলকিত দর্শকমণ্ডলি;
 চেয়ার চুয়িংগামের মতো খসখসে জিভে চুষতে লাগলো শিক্ষক ও
রূপসী ছাত্রীকে। শহর পল্লী ও অরণ্যের সব ফ্ল্যাট গৃহ ও কুটির
স্বপ্নখোর পেটের ভেতরে নিঃশব্দে জীর্ণ করতে লাগলো
অধিবাসীদের; উড়ে চলে গেলো প্লেন শাড়ি-স্যুট-ওষ্ঠ-ত্বক
 গাউন-শোভিত যাত্রীদের উল্লাসে হজম করে গাঢ় নীলিমার
মাংস খেতে-খেতে এক হাজার মাইল বেগে স্বপ্নের উদ্দেশে।
টাওয়ার লাল ওষ্ঠ মেলে সূক্ষ্ণ সৌন্দর্য ছড়িয়ে বস্তুতে-বাতাসে
খেতে লাগলো পৌরসভার সবুজশোভিত পার্ক, পুস্তক হীরের
দাঁতে আস্তে কাটতে লাগলো তার প্রেমতপ্ত লাল পাঠিকাকে;
 একটি মহান উজ্জ্বল ট্রাক সুন্দরবনের বর্ণাঢ্য বাঘের মতো
গোধূলিকে সৌন্দর্যে সাজিয়ে লাফিয়ে পড়লো হরিণের মতো
ভীরু বাঙলাদেশের সবচে সুন্দর কৃষ্ণচূড়া গাছের ওপর।
 ফাল্গুনের কুয়াশা-নেশা-লাল রঙ-তীব্র তরুণীর স্পর্শে জ্বলে
ধ্যানী শহিদ মিনার পান করলো রঙিন পুষ্পস্তবক,
ভোরভারাতুর পুষ্পদাতাদের,–শহরের প্রতিটি রাস্তার মোড়ে
দ্বীপপুঞ্জে ব’সে স্বপ্নিল পেশল ট্রাম ভীষণ উল্লাসে ছিঁড়েফেড়ে
খেতে লাগলো নির্জন নিসর্গদাস কবির সবুজ মাংস,
 হলুদ মস্তিষ্ক, ধূসর হৃদয়। অভিসারে যাবে বলে নগরীর
সর্বোচ্চ টাওয়ার বুকে গাঁথলো মতিঝিলের প্রখ্যাত শাপলা,
এবং প্রবেশ করলো তার ইস্কুলগামিনী পঞ্চদশী প্রেমিকার
 দিগ্বলয়ের মতো জিন ঠেলে স্বপ্নের সুড়ঙ্গ-পথে; অ্যাভেনিউ
হীরণ অঙ্গের মতো স্ফীত প্রসারিত দীর্ঘ হতে হ’তে দুই হাতে
সরিয়ে সোনালি পাড় অন্তর্বাস প্রবেশ করলো তার চন্দ্রাস্তের মতো
লাস্যময়ী, চৌরাস্তায় অপেক্ষমান, ষোড়শী প্রেমিকার উষ্ণ তীব্র
 ত্রিকোণ মন্দিরে। স্বপ্ন-পরা বাতিস্তম্ভ দূরে দোলায়িত চাঁদটিকে
তার উদ্ভিন্নযৌবনা বাল্যপ্রেমিকার ব্লাউজ-উপচে-পড়া স্তন ভেবে
 বাড়ালো দক্ষিণ হাত দিগ্বলয়ে, বাঁ-হাত বাড়িয়ে দিলো পুব দিকে
দ্বিতীয় স্তনের আশায়। মোহন প্রেমিক ট্রাক প্রেমিকার দেহ ভেবে ব্রিজ
থেকে মৃত্যু-ভয়-ব্যথা অবহেলা করে ঝাঁপিয়ে পড়লো পদ্মায়;
নৈশ রেলগাড়ি স্টেশনে অপেক্ষমান তরুণীর উজ্জ্বল উরুকে তার
স্বপ্নে-হারিয়ে-যাওয়া রেল ভেবে ঝেঁকেঝেঁকে কেঁপেকেঁপে নীলে মেঘে
বাঁশি বাজাতে বাজাতে ছুটে গেলো পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য
প্রান্তের উদ্দেশে। পাথর-টুকরো হীরকের গালে ঠোঁট রেখে
ঘুমিয়ে পড়লো। তখন বাঁ-দিকে কাঁপে সারিসারি অসুস্থ মানুষ,
ডানে কাঁপে, মৃত্যুর ভীতিতে নীল, রুগ্ন নষ্ট মুমূর্ষ প্রকৃতি।

*

নৈশ বাস্তবতা

নীল জল ঝরে অবিরল যেনো ব্যালকনি থেকে কেউ মেলে দিচ্ছে শাড়ি
কবিতার জন্ম হয় ষোলোটি সরল বাক্যে স্থিরাস্থির ছয়টি ছবিতে
 ভূমধ্যসাগরি আলো সরবে রটিয়ে দেয় শেষ হয়ে গেছে মহামারি
 গোলগাল চাঁদ আর চারকোণা আলো নিয়ে খেলা করে কিন্নর কবিতে
চতুর্দিকে চিরায়ু চাঁদের তলে জ্বলে যায় জড় ও জান্তব
মেরুদণ্ডের মতো ধরে আছে মেদিনীরে এই রাত্রি পবিত্র বাস্তব

জ্বলে কালো আলো নীল আলো শুয়ে আছে লাল আলো কাত হয়ে আছে
 বঙ্গ থেকে অর্ধেক গোলার্ধ ভরে ভেসে আসে মাছ আর শৈশবের স্বর
 বস্তুর ঠোঁট স্বপ্নের লাল ঠোঁটে দৃশ্যের ডান হাত সঙ্গীতের কোমরের কাছে
 সামনে ছড়ানো পথ দ্রুতগামী এসকেলেটর
গোপন শেকড় বেয়ে বাক্য হয়ে আসে নদী পল্লবের কোমল বাতাস
বস্তু ও স্বপ্নের সন্ধি বাম পাশে ডান পাশে সুর আর ছবির সমাস

*

ধর্ষণ

মা, পৌষ-চাঁদ-ও কুয়াশা-জড়ানো সন্ধ্যারাত্রে, শাদা-দুধ সোনা-চাল
মিশিয়ে দু-মুখো চুলায় রান্না করছিলেন পায়েশ; চুলোর ভেতরে
আমকাঠের টুকরো লাল মাণিক্যের মুখের মতোন জ্বলছিলো।
সেই আমার প্রথম রঙিন ক্ষুধার উদগম
 মায়ের পাশেই বসে
 সারাসন্ধ্যা ধর্ষণ করলাম একটা লাল আগুনের টুকরোকে।

মাধ্যমিক পরীক্ষার সাত দিন পর দেখলাম পদ্মার পশ্চিম পারে নারকেল
গাছের আড়ালে সূর্যাস্ত খুলছে তার রঙিন কাতান।
সূর্যাস্ত, আমার মেরিলিন, জাগালো আমাকে
 টেনে এনে তাকে নারকেল গাছের আড়ালে আসন্ধ্যা ধর্ষণ করলাম,
পদ্মার পশ্চিম প্রান্ত রক্তে ভেসে গেলো।

অনার্স পড়ার কালে কলাভনের সম্মুখ থেকে আমার অধরা বাল্যপ্রেমিকার
মতো ছুটে-যাওয়া একটা হলদে গাড়িকে ষাট মাইল বেগে ছুটে
পাঁচ মাইলব্যাপী ধর্ষণ করলাম।

একাত্তরে পাকিস্তান নামী এক নষ্ট তরুণী আমাকে দেখালো তার
বাইশ বছরের তাজা দেহ, পাকা ফল, মারাত্মক জংঘা
চৌরাস্তায় রিকশা থেকে টেনে প্রকাশ্যেই ধর্ষণ করলাম;
 বিকট চিৎকারে তার দেহ রক্তাক্ত ও দুই টুকরো হয়ে গেলো।

*

ভূতভবিষ্যৎ

সামনে এগোই, পেছনে চিৎকার কাঁপে শূন্যতার স্তরেস্তরে
‘আয়, ফিরে আয়।’

এগোই সম্মুখে : পঁচিশ কিলোমিটার দূরে ভূমিকম্পগ্রস্ত টাওয়ারের
 মতো হেলে আছে জরাজীর্ণ ব্রোঞ্জের দিগ্বলয়, কাত হয়ে আছে
 ভয়াবহ ফাটল-ধরা সূর্যাস্ত; কয়েক মাইল দূরে পশ্চিম আকাশের
অন্ধ কোণে, বারবার আন্দোলিত হয়ে এদিকে-ওদিকে,
 উড়ছে সময়ের কালো ঝড়ে অসহায় শাদা সেই পাখির পালক।

সামনে এগোই, পেছনে চিৎকার বাজে শূন্যতার স্তরেস্তরে
‘আয়, ফিরে আয়।’

এগোই সম্মুখে : বিবস্ত্র দণ্ডায়মান মধ্যপথে যোনি-ও জরায়ু-হীন,
পাথরের সমান ক্ষুধার্ত, অন্ধ এক নারী; অনাগত মানুষের
শোভাময় মমিপুঞ্জ দুই পাশে গণ্ডারের মতোন নিঃসঙ্গ এক
দুঃস্বপ্নদ্রষ্টা বিজন জলসাঘরে ঝাড়লণ্ঠনের মতো শত চোখে জ্বেলে
রাখে স্বর্ণকঙ্কালের নর্তকী-শরীর থেকে খসে-পড়া ঝলকিত নাচ।

সামনে এগোই, পেছনে চিৎকার জ্বলে শূন্যতার স্তম্ভেস্তম্ভে
‘আয়, ফিরে আয়।’

এগোই সম্মুখে : একনায়কের সশস্ত্র সান্ত্রীর মতো শুষ্ক স্বপ্নশূন্য
গাছপালা, মৃত্যু-ঢালা দুর্বোধ্য নিস্তল পরিখার মতো নদনদী,
দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো পর্বতপুঞ্জ আশ্চর্যকৌশলে ঘিরে ফেলে চতুর্দিক,
 অথচ সান্ত্রী-পরিখা-দেয়াল পেরিয়ে অত্যন্ত সুদূরে ওড়ে
 স্বপ্ন-ও আলো-পরা গভীর গোপনবাসী একবিন্দু আলোকিত পাখি!

সামনে এগোই, পেছনে চিৎকার রটে শূন্যতার স্তরেস্তরে
‘আয়, ফিরে আয়।’

ফিরবো পেছনে? সম্মুখে তবু তো দোলে ভাঙা দিগ্বলয়, বিভগ্ন সূর্যাস্ত,
অসহায় পাখির পালক, স্বর্ণকঙ্কালের নাচ, যোনি-ও জরায়ু-হীন
ক্ষুধার্ত ভেনাস, দুঃস্বপ্ন-ধাতব শুষ্ক গাছপালা, সাস্ত্রী-পরিখা আর
ভয়াবহ দুর্ভেদ্য প্রাচীর পেছনে একাধিপত্য করে শূন্যতা,
আর তার স্তরেস্তরে পুঞ্জিভূত আর্ত, শূন্য, মুমূর্ষ চিৎকার।

*

মাতাল

মাতাল হয়ে আছি করছি শুধু পান
সুদূরে নিকটে যা-কিছু চলছে, জ্বলছে :
স্তব্ধ বাড়িঘর, নদীতে নীল শব,
হংসসারিকা, এবং ভেতর টলছে;
 চোলাই করি চোখে গোপন ঘরে বসে
দৃশ্যসুরের মজ্জার থেকে মদ্য,
পুলিশ থেকে দূরে গাছের অতি কাছে
যেনো ধরণীতে কখনো ছিলোনা গদ্য।
 ঝরছে নীল মদ, ঝরছে রাজপথে
মাতাল মত্ত হাজার আঁখির মধ্যে,
 গলছে গাড়িঘোড়া, শ্লোগান গলে যায়,
অন্য পোশাকে পরিচিতি দেয় ছদ্মে।
 সুপার মার্কেটে দুধেল তরুণীরা।
করে বিকিরণ কামের তীব্র রশ্মি,
বক্ষে ধূলো ওড়ে যেনো-বা মরুভূমে
তেলচকচকে খরমসৃণ অশ্বী।
কেবল মদ ঝরে, মেদিনী মদময়
জাহাজের বাঁশি, দুর্ঘটনার শব্দ,
বাহুর তলে লোম আর্ল ভিজে রস
মদ্যমাতাল সবগুলো বঙ্গাব্দ।
তোমার চোখে মদ ঝরছে অবিরাম
বাহু ও বিছানা, মৈথুনহীন নিঃস্বার
স্বপ্নে দেখা ছবি, বাল্যে পড়া পাঠ,
অস্থিমাংস-ফেটে-পড়া দ্রাক্ষার
ঝরায় গাঢ় মদ, গভীর নীল মদ,
যেনোবা উর্বশী ভেঙেছে মদের পাত্রি,
এসেছে টেলিফোন আমাকে যেতে হবে
ডেকেছে নিশীথ,–স্বপ্নমাতাল রাত্রি,
 সবাই বসে আছে, অধীর বসে আছে
নিহত কবিদের নবমেঘনীল বৃত্ত,
কে তুমি ডেকে যাও, গোপন টেলিফোনে
তুমি কি প্রিয়তম মৃত্যু না লাল নৃত্য?

*

পতনের আংটি

পাখি আর বাঁশরির সোনারুপো ধাতুদের গোপন ইচ্ছার
পরিণতি পূর্ণসুর, আগুনে-আশ্রয়ে উজ্জ্বল মুদ্রা অলঙ্কার।
 কেবল মতন দিলে, নিজ মধ্যমার থেকে বহু যত্মে খুলে
পরালে দুর্লভ আংটি পতনের, আমার আঙুলে।
বেদনা বেঁধালে ত্বকে, বল্কলে, শুষ্ক গূঢ় মূলে।

*

ঠিক সময়ে আগুন নেভানো হয়েছিলো

দক্ষ বিদ্যুৎ-মিস্ত্রি ঠিক সময়ে মূল সুইচ বন্ধ করে দিয়েছিলো বলে
 টাওয়ারের চল্লিশ তলায় হঠাৎ বিকল-পাগল-অধোগামী
সদ্য আমদানি-করা চকচকে লিফট্রটি রক্ষা পেয়েছে।
 তিনজন লাফিয়ে পড়েছে নিচে, পাঁচজনের হলদে মগজ
পাত্র-ভাঙা ঘিয়ের মতোন ছিটকে পড়েছে কার্পেটে।
 ঝকঝকে কার্পেটটি নোংরা হওয়া ছাড়া আর কোনো ক্ষতি হয় নাই।

লঞ্চ উদ্ধারকারী একটি জাহাজ অবিলম্বে চাঁদপুরে পৌঁচেছিলো বলে
বিদেশি মুদ্রায় কেনা আলহামরা আক্রোশী অক্টোপাসের
 পায়ের থেকেও হিংস্র ঘোলাটে জলের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছে।
তিন দিন পর একশো লাশ ভেসে উঠেছে স্বেচ্ছায়, পঞ্চাশটা আটকে ছিলো
 ইঞ্জিনের সাথে পরস্পরের বাহুতে ও পায়ে আলিঙ্গনে গেঁথে,
 চুড়ি-পরা একটা মুঠোতে শক্তভাবে ধরা ছিলো
পদ্মের ডাঁটের মতো ছোট্ট একটা বাহু,
দশটা জোয়ান ও একটা জাপানি যন্ত্র সেই মুঠো খুলতে পারে নি;
যোগাযোগ মন্ত্রীর দুস্তম্ভব্যাপক হাসি জানিয়েছে কোনো ক্ষতি হয় নাই।

টিভি টাওয়ার থেকে ন্যাংটো লাফিয়ে পড়েছে দুই জোড়া লম্বাচুল :
একটি গায়ক ও তিনজন কবি;
 পুলিশের কৌশলে প্রধানমন্ত্রীর তৃতীয় স্ত্রীর
 উদ্বোধন-করা জাপানি ট্রান্সমিটারটির কোনো ক্ষতি হয় নাই।

অণ্ডকোষে কড়া লাথি খেয়ে চৌরাস্তায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে
 সত্য; কোনো ক্ষতি হয় নাই।

নিয়নখচিত পার্কে বকুল গাছের তলে
তিনটা তরুণ গুণ্ডা ধর্ষণ করেছে চাঁদজ্বলা তারাপরা এক কিশোরীকে,
 তার মধ্যমার হীরের আংটি থেকে বাঁ-উরুর লাল তিলটির সবই রক্ষা পেয়েছে;
 কোনো ক্ষতি হয় নাই।

আমার প্রথম ছাত্রী আহার করেছে লাল মৃত্যু, কোনো ক্ষতি হয় নাই।

ঢং ঢং ঘণ্টা পিটিয়ে লাল গাড়িগুলো
চারদিক থেকে ওদের ইস্কুলে পৌঁচেছিলো বলে
হেডমিসট্রেসের পেটিকোট থেকে সোনারঙ নেমপ্লেট সব কিছু রক্ষা পেয়েছে
বাইশটা বাচ্চা মুরগির ঠ্যাংয়ের মতোন ভাজাই হয়েছে
কিন্তু ঠিক সময়ে, বারোটা পঞ্চান্ন মিনিটে, আগুন নেভানো হয়েছিলো বলে
ইস্কুল পৌরসভা রাষ্ট্র ও সভ্যতার কোনো ক্ষতি হয় নাই।

*

থীবী

নগরের নৈত কোণায়, লাল থাবা মেলে, কেশর ঠেকিয়ে মেঘে,
পা রেখে দেশের সকল শব্জিতে পদ্মে, কালো চোখ জ্বেলে, আছে জেগে
চতুষ্কোণ দারুণ মর্মট। লাস্যময়ী তরুণীর গর্ভে রুগ্ন হয়
প্রথম সন্তান, প্রেমিকার জরায়ুতে প্রেমিকের মধু রোগে ক্ষয়
হয় প্রবাহিত হতে হতে; পুষ্পপ্রিয়, শান্ত মালির চোখের
ফুলদানিতে শুষ্ক হয়ে ঝরে বিবর্ণ গোলাপ, শ্রমী কর্মিষ্ঠ লোকের
দেহ বিকলাঙ্গ হয় অকস্মাৎ, পাকা ধানের গুচ্ছে অপরিমিত
ফলে রোগবীজ; রুগ্ন হয় ইলিশ বোঝাই নদী, রুই কবলিত
দিঘি; জীর্ণ হয় রসময় বৃক্ষ, নগরীর রূপসীরা–অদ্বিতীয়;
 দুষ্ট, মারাত্মক ব্যাধি, অভিচারী, নিজেকে সর্বত্র করে তোলে প্রিয়।
 কী যে অভিচারী এই রোগ, অনায়াসে স্থান পায় তরুণ মজ্জায়,
 রক্তে, মাংসকোষে, এবং তাদের দেহ তুলে দেয় মুমূর্ষ শয্যায়,
সে-তরুণ, দেহে যার প্রতিভার দীপ্র শিখা রক্ত হয়ে জ্বলে,
কালব্যাধি খুঁড়ে খায় তাকে, অন্ধকার পায় তার চোখের বদলে,
থীবীতে তরুণ নেই আলিঙ্গনে, চুম্বনিমগ্ন থরোথরো স্তনে
 দয়িতার; তারা, যুবকেরা, সব আজ শয্যারত চিকিৎসাভবনে
আরোগ্য দুর্লভ জেনে। তারুণ্য ও ব্যাধি অভিন্নবোধক; রুগ্ন থীবী,
অসুস্থ প্রদীপমালা রাজপথে, রুগ্ন পাখিদের উডডীন পৃথিবী।

*

তুমি তো যাচ্ছো চ’লে

তুমি তো যাচ্ছো চলে আমাকে কিছু দাও।
দাও বিষ করি পান, রক্ত করে রেখে দিই রক্তনালিতে;
 প্রত্যহ বইবো দেহে সে-দুর্লভ উপহারস্মৃতি।

তুমি তো যাচ্ছো চলে আমাকে কিছু দাও।
 বিষাক্ত ছোবল দাও উদ্বেলিত হৃৎপিণ্ডে;
 মরণে সজীব করে রেখে দিই অপ্রাপণীয় চুম্বনের দাগ।

তুমি তো যাচ্ছো চলে আমাকে কিছু দাও।
দাও ঘৃণা তীব্রতম, মর্মে প’শে জীর্ণ করি
সব পুষ্প, শিল্পকলা–সভ্যতার হস্তশিল্প–অব্যয় মাধুরী।

তুমি তো যাচ্ছো চলে আমাকে কিছু দাও।
 যদি পারো দাও জ্যোৎস্না ব্যালকনিতে,
 জীবনের মাংসকোষে, কালের বিরুদ্ধে স্থির ধ্রুবতারা
 করে রাখি অমৃতা তোমাকে।

*

কবির মুদ্রা

শব্দ, কবির মুদ্রা, রহস্যজ সাম্রাজ্যের আদি ও অন্তিম স্বর্ণ,
কিনে নিচ্ছি হে কিশোরী তোমার চুম্বন, যুবতী তোমার আলিঙ্গন।
তোমার ত্বকের মতো অপার্থিব গুল্মময় অজর সোনালি বর্ণ

জ্বলছে মুদ্রার সোনায়। এ-পিঠে খচিত সাম্প্রতিক অস্থির মশাল
অন্তর্লোকে তুমি দাও স্বর্ণআভা, জ্বলে ওঠে সময়ের কালো অশ্রুজল,
ও-পিঠে আলোক ঢালে তোমার টিপের মতো ধীর স্থির মহাকাল।

রহস্যের অর্থনীতি, কী যে পণ্য মেলেছে সময় সৌরবিপণীতে;
কিনে ফিরি সময়ের পাখিদের স্বর, দুই করতলে ছলোছলো
জলের আলাপ, তুমি শুয়ে আছো কামময় সব শব্দের স্মৃতিতে।

কিনেছি গভীর রাত সবচে সুগন্ধি পুষ্প তোমার ভালোবাসার
অন্তরঙ্গ অভিধান, তোমার দেহের চাপে ফেটে পড়ে এই দেহ
 ভেঙে পড়ে অলৌকিক ব্যাকরণ করুণ রক্তিম চারু বাঙলা ভাষার।

মুদ্রাবিনিময় করি সাম্প্রতিক অন্ধকারে তবু সকল সম্ভাব্য
সময়ের সাথে, আমাদের চতুষ্পর্শ্বে গাঢ় দুঃসময়, তাই,
‘তুমি’-ই আমার অন্ধকালে স্বরচিত এক শব্দের মহাকাব্য।

*

স্বরাষ্ট্র

ধাতুতে নির্মিত, ধাতু আর শোভাময় ধাতু; চতুর্ধারে
ধাতুর উৎসব। সবুজ মাংসের মাছ, রূপভারাতুর
লতাগুল্ম নেই; মধ্যরাতে চৌরাস্তায় স্বপ্নাঢ্য ধাতুর
ঝর্নাস্রোতে গুচ্ছগুচ্ছ সোনা ঘিরে ধরে গোলাপি তামারে।

ইস্পাতশাণিত নদী, ধাতব চাঁদের ব্রোঞ্জের জ্যোৎস্নায়
পারদপ্রতিম জলে একটি মর্মর পদ্ম,–দীপ্ত, স্থির
নর্তকীশরীর থেকে খসে শুদ্ধ হীরকখচিত নাচ
স্থির হয়ে ছুঁয়ে আছে তন্বী নর্তকীর স্বর্ণের শরীর।

বিমল স্ফটিক বাহু ঢেউয়ে এগিয়ে আসে, মেলে ধরে
অবিনাশী ব্রোঞ্জের কঠিন কোমল আলিঙ্গন,
 রৌপ্যের মসৃণ চুল ঢাকে মাঠ পাহাড় আকাশ,
দুই ওষ্ঠ ঢেলে দেয় ব্যাপক অশান্ত তীব্র অভ্রের চুম্বন।

রুপো ছানে সারাদিন তন্ময় ভাস্কর, শক্ত ধাতু থেকে
 ন’ড়ে ওঠে শুভ্র বাহু নীল চোখ, কালো পর্দা ফাড়ি
দক্ষিণ দিগন্তে ঘষে ঠোঁট ঠেকিয়ে ধাতব স্তনরেখা
সামনে দাঁড়ায় নগ্ন কুমারী রৌপ্যের এক নারী।

ধাতুর ঝঙ্কার শুধু শোনা যায়, সর্বত্র কেবল ঝলে
 লোহা-সোনা-রুপো আর ব্রোঞ্জের রূপ, ধাতব বাতাস,
পলি নেই লতাগুল্ম নেই, ধাতুমগ্ন লাবণ্যপুরীতে
 স্ফটিকে রচিত দুঃখ দস্তায় বাঁধানো ব্যাপক আকাশ।

*

ব্যক্তিগত নিসর্গ

চিরস্থির জ্বলো, নিসর্গপ্রদীপ, মুহূর্তও হোয়ো না আনমনা
কালের বাতাসে। অপার্থিব মেলে দাও নীলছোঁয়া ডানা।
তোমাতেই করি স্বপ্নের ছন্দোবিশ্লেষ, বস্তুর পর্বগণনা।

*

ব্যাধি

দিগ্বলয়সম পদ্ম, নিসর্গের শাদা পেন্ডুলাম, আন্দোলিত হয়
 দীর্ঘ সরোবরে, আমার যা বাল্যকাল। ঢেউ, লাল নীল পীত, বয়
 পাখির স্তবকে শৈশবকুসুমগুচ্ছে নীলিমায়। ভেঁপুর বাঁশরি
বাজে সারাক্ষণ। মারবেলের রঙিন গতির মতো, উড়ন্ত সুন্দরী
 লাল বেলুনের, পদ্মের দোলার দীর্ঘ মৃদু কম্পমান উদ্বেলিত
জলযান চালিয়ে সে আসে, অকস্মাৎ আমার ভুবন প্রদীপিত।
কেবল অসুস্থ আমার শরীর, সুস্থ আর সব। আমি, ও শিরিন,
 পাখিগুচ্ছ বিকেলের মাঠ, সকলেই স্বাস্থ্যবান উজ্জ্বল রঙিন,
 রুগ্ন শুধু এক বন্ধু, আমার শরীর। দেহ যবে অসুস্থ, শৈশবে,
মেলে দিই করতল, নীলিমাসদৃশ, ঝরন্ত পাতার কলরবে
পকেটে মুঠোতে জমে রৌদ্রকণা, পড়ন্ত তারকাপুঞ্জ, স্বপ্নে আসে
পরীরা সঙ্গীতময়, ঘুমোয় আমার সঙ্গে, সমুদ্রশয্যায় ভাসে,
উলঙ্গ, নৌকোর মতো, নগ্ন দেহ পরীদের। পেয়ারার মতো তুলে
 নিই পরীর পেয়ারাস্তন, গোপন সোনালি চুল জড়াই আঙুলে,
 কাটি শাদা দাঁতে। ডুবে থাকি মাখনের স্বাদে। মনে হয় জানে যাদু
সবে, শয্যাপাশে শিরিনের দেহখানি আপেলের মতোন সুস্বাদু।
সবুজ পল্লব দোলে বনময়, ঝরে তারাপুঞ্জ বিশ্বশাখা হতে;
শিরিন, পল্লব এক, পড়ে রয় আমার দীর্ঘ ললাটের পথে।

শৈশবে যখন স্বাস্থ্য রুগ্ন, সুস্থ ছিলো সারাবিশ্ব আমার জগতে।

সুস্থ যদি এখন শরীর, ভয়াবহ ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে থাকি আমি,
ও আমার আত্মা, সমগ্র ভূভাগ। সুস্থতা নেই দিবসের
সূর্যতলে, রাত্রির চাঁদের নিচে জলেস্থলে। স্বপ্নে আসে না পরীরা।
স্বপ্নও ভাসে না অন্ধ চোখে। প্রকাশ্য রাস্তায় দিবালোকে, যত্রতত্র
সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করি কিশোরীকুমারী, যেনো আমি কফিনের থেকে
তুলে আনি কুষ্ঠরোগগ্রস্ত এক-একটি শরীর। এখন সর্বদা
রুগ্ন বোধ হয় সব কিছু : ছাত্র, গ্রন্থ, দর্শনার্থী, সেবিকা, ফলফুল,
ঐতিহ্য, সভ্যতা। এক অসুস্থ সভ্যতা, দুরারোগ্য, পড়ে আছি,
 নর্দমার তটদেশে, পাশের বস্তিতে নাচে আধন্যাংটো বিকৃত রুগ্ন পরীরা।

*

অন্ধ রেলগাড়ি

অন্ধ রেলগাড়ি বধির রেলগাড়ি অন্ধ রেল বেয়ে চলছে দ্রুত বেগে
দু-চোখে মরা ঘুম আকাশে মরা মেঘ সঙ্গে মরা চাঁদ অন্ধ আছি জেগে
অন্ধ বগিগুলো ক্লান্ত হয়ে গেছে এগিয়ে চলে তবু অন্ধ প্রতিযোগী
 চলছে ট্র্যাক বেয়ে জানে না কোথা যাবে নষ্ট রেলগাড়ি অন্ধ দুররোগী

অন্ধ কাল ধরে নষ্ট রেলগাড়ি চলছে আঁধি ব’য়ে অন্ধ বুকে তার
অন্ধ ফুল দোলে অন্ধ বাঁশরিতে নষ্ট আলো লাগে অন্ধ তারকার
দিয়েছি সঁপে ফল মাংস তারা চাঁদ রুগ্ন কালো হাতে অন্ধ চালকের
অন্ধ জেগে আছি বন্দী হয়ে আছি অন্ধ চন্দ্র ও অন্ধ আলোকের

কেবল ঘুম ওড়ে মাছির মতো কালো অন্ধ দুই চোখে পুঁজের ধারাপাত
অন্ধ রেলগাড়ি জানে না কোন দিকে যাচ্ছে নিয়ে তাকে অন্ধ কালো রাত
 কেবল ব্রিজ ধসে কেবলই ব্রিজ ধসে কেবল ধসে পড়ে সাধের যতো
সব কীর্তি পূজনীয় মান্য সভ্যতা অন্ধ কাল ভরে কাকের কলরব।

অন্ধ রেলগাড়ি দীর্ঘ রাত বেয়ে অন্ধ বেগে চলে অন্ধ লাইন্সম্যান
অন্ধ বাতি ধরে অন্ধ এক লোক রুগ্ন আমাদের ভূতলে টেনে নেন
 বধির জেগে আছি অন্ধ দুই চোখে ঝলকে ওঠে তবু স্বপ্নশাদা পাখা
জেনেছি রেলগাড়ি আগত ভাঙা ব্রিজে বন্ধ হবে তার অন্ধ কালো চাকা

*

লাল ট্রেন

গ্রামগঞ্জ পার হয়ে হুইশলে কাঁপিয়ে দেশ আসে লাল ট্রেন লাল চাঁদ
পাহাড় পাতাবাহার যমুনা পদ্মার পতাকা উড়িয়ে মানুষ আকাশ মাছ
পুষ্প তালতমাল বাঁশরির মশাল জ্বালিয়ে আসে লাল অমোঘ অর্কেস্ট্রা
প্রতীক্ষায় যার উৎকণ্ঠিত মানুষ ফসল মাটি কবিতার প্ল্যাটফর্ম যুগযুগ ধরে

লাল ট্রেন আসে এঁকেবেঁকে দীপ্ত ট্রেন আসে দেখেদেখে ভাঙা ঘর রাঙা
 চর উঁচু ইমারত দেখে আসে অবলীলায় পর্বত নৈশলাল হুইশলে জ্বলে
 অগ্নি ঝরে ঝরে নীলিমা তারকা চাঁদ মানুষ বস্তুর মাথায় বাহুতে বক্ষে
 লাল ট্রেন পালে হাওয়ালাগা লাল নৌকো পদ্মায় গঙ্গায় কালো যমুনায়

লাল ট্রেন ভাত হয় পাতে লাল ট্রেন কাঁথা হয় রাতে লাল ট্রেন প্রেমিকের
 বিশাল চুম্বন প্রেমিকার নাভির তলাতে লাল ট্রেন কবিতা ট্রাক্টর দীপ্র
ট্রেন অকস্মাৎ হয়ে যায় ঘর লাল ট্রেন রাজপথে আশ্চর্য শ্লোগান নিমেষেই
 লাল ট্রেন হয়ে যায় গান চাঁদ তারা পার হয়ে হুইশলে কাঁপিয়ে মেঘ আসে

লাল ট্রেন
 আসে লাল
 ট্রেন আসে
 লাল ট্রেন

*

শহর

দুলছে বাস্তব : পারদের মতো পদ্মপাতা; আমি তাতে শাদা জল ফোঁটা
 এদিকে-সেদিকে আন্দোলিত; হঠাৎ ছলকে পড়ি অবাস্তব স্বপ্ন-ঘুমে
 বস্তুর মাথায়। এক বিন্দু গাঢ় মধু জড়ো হই তন্দ্রাতুর শহর-কুসুমে;
সিল্কের অন্ধকার-পরা এই রম্য রাত্রি, সদ্য ঠাণ্ডা ঘুম-থেকে-ওঠা।
জলে গলে যাচ্ছে বাতিস্তম্ভ সময়ের; নীল ঢেউয়ে দোলে বাড়িঘর
বস্তি স্বপ্নের টাওয়ার বাস ও আকাশ। ভিখিরির দাঁতে গোলগাল চাঁদ
আর ভাঙা পাউরুটি, মাংসে ঢুকছে তার স্বপ্ন ও বস্তুর সঙ্গমের স্বাদ;
 সময়জীর্ণ পদ্মের কানে মাতাল মাইক্রোফোন ঢালে শৈশবের স্বর।

জুনকোর দেহ ভাসে শ্যামল মেঘেল শূন্যে, ওষ্ঠ থেকে লাল রূপকথা
 ঝরে পড়ে; মাথার ওপরে ওড়ে পাখির স্তবক, নগ্ন আর্দ্র রূপসীরা,
ফেটে পড়ে কংক্রিটে একাকী দীপ্ত সঙ্গীহীন গোলাপের শিরা-উপশিরা;
আমার ত্বকের তলে কিশোরী ঘুমায়–রক্তে সন্ধ্যার সিঁড়ির অভিজ্ঞতা।
মানুষেরা দ্যাখে চোখে তাদের ক্ষতের মতো দগ্ধ স্থির শাদা চাঁদ ভাসে
দ্বীপপুঞ্জে যানবাহনের শিরে; বস্তুপুঞ্জে ঝলে যৌথস্মৃতির উল্লাস
নিয়ে রক্তমাংসে বসবাসী বাস্তবতা; স্বপ্ন-ভরাক্রান্ত ব্যাপক আকাশ
বেলুনচঞ্চল উড়ে চলে যায় পতঙ্গপাবকজ্যোৎস্নাখচিত আকাশে।

শহরের ঠোঁটে ঠোঁটে রাখি, দু-পায়ে শহর ক্রমে জড়ায় আমাকে,
ঢেউয়ে দুলি সারারাত, আমার দেহের তলে শহরও দুলতে থাকে।

*

দ্বীপ

গভীর মায়ানদী নীরবে ব’য়ে চলে জলের শতো ঠোঁটে
আনে সে পলিমাটি, গোপন মায়ানদী গোপনে ব’য়ে চলে।
সুদূরে যাবে বলে কেবলি ব’য়ে চলে, ক্ষণিক কোনোখানে
 যাপে না অবসর। চলছে কালভর বিদেহী মায়ানদী
অচেনা মনোলাকে, সাগর অভিমুখে বইছে মনোনদী।

আনে সে লাল নীল স্মৃতির গাঢ় মিল ধ্বনির ধূলোকণা
মনোজ জলে ভেজা অজর পলিমাটি দুরূহ দূরগামী।
ধ্বনিরা মিলে যায় যেনোবা সহবাসে রয়েছে প্রেমিকেরা
চাঁদের বিছানায়। একটি নদী বয় বাক্য বুকে বয়
 জলের স্নেহভরা মায়াবী পলিমাটি চলছে মোহানায়।

জাগছে মায়াদ্বীপ গভীর মোহানায় মনের মোহনায়
সাগরে ঢেউ ওঠে পলিরা ফেটে পড়ে দ্বীপটি ভেঙে যায়।
নদীটি পুনরায় নীরবে বয়ে চলে শব্দ পলি নিয়ে
অমোঘ মোহানায়। উঠছে মনোদ্বীপ নিবিড় নীল হয়ে
 পাখিরা ছুঁড়ে দেয় সুরের ঘরবাড়ি দ্বীপের সীমানায়।

জমেছে পরিপাটি ধ্বনির পলিমাটি অযুত কাল ধরে
 মনের মোহানায়, শব্দরাজি ঝলে সোনালি বালুকায়।
 কালের কালো জল রয়েছে ঘিরে তারে, ক্রমশ জাগে দ্বীপ
আমার জল ভরে। মায়াবী সেই নদী কেবলি নিয়ে আসে
কাতর পলিমাটি, গড়ছে মায়াদ্বীপ–কবিতা মনোময়।

*

হাতুড়ি

প্রত্যেক অক্ষরে নাচে ধ্বংসরোল আর
পরিশ্রমী হাতুড়ির ধাতব টংকার
 বাজে প্রতি শব্দে; ধ্বংসসৃষ্টি লেখি প্রসারিত সময়ের সকল পৃষ্ঠায়।
প্রতিটি কবিতা জীর্ণ সভ্যতার
ইট খোলে দুই হাতে, শূন্য অন্তঃসার
সময়ের মাঠ জুড়ে নতুন সভ্যতা তোলে শ্রমিকের সহজ নিষ্ঠায়।

*

গাছ

শঙ্খ-সমুদ্রের মতো দেয়ালে নতুন চর জেগেছে একটি আজ
 লতার মতোন নদী সারা রাত মুখে করে এনেছে হলুদ পলিমাটি
বাঁধ দিয়ে দিয়েছিলাম ভৌগোলিক
 তারই মধ্যে জেগে উঠেছে আমার নতুন চর
চরের গাঙচিলপ্রান্তে ভোরে রোপণ করেছি একটি গাছ
 গাছ হয়ে ধীরে ধীরে গাঙচিল ছুঁয়ে ডাল মেলছে আমার শরীর

*

মুখ তুলে ধরি

বেশ্যার রঙচঙে মুখ বলে মনে হয় বাগানের ফষ্টিনষ্টি গোলাপরাশিকে
কাল অবেলায়। যেনো প্রফুল্ল সংসার পেতে আছে রূপজীবিনীরা জীবনের
বিস্তৃত প্রাঙ্গণে, সকলের প্রসারিত বারান্দায়। দোলা দেয় বাহু তুলে
বুক খুলে, কেবল নাচতে থাকে জীবনের চোখের ওপর। জঘন্য অশ্লীল লাগে
অজাচারী সেই দৃশ্য, যেনো প্রকাশ্যে সঙ্গমরত দেশের নন্দিত রানী আর
 কুৎসিত রাজারকুমার। ঘৃণায় ফেরাই মুখ লাল রঙ পুষ্পশালা থেকে,
 তুলে ধরি এই মুখ অতীন্দ্রিয় আগ্রহে কালজিৎ শিল্পের দিকেই।

এবং একদা বিবমিষা আনে শিল্পকলা, পরাবাস্তব স্বপ্নের
 অন্ত্রিতন্ত্রি গলনালি বেয়ে, মহাকাল ভাসিয়ে কেবল জাগে তীব্র
বমনেচ্ছা, হলুদ বমিতে ভাসে কালের কুটিরশিল্প আসবাব
 পত্র, সভ্যতার সকল গ্যালারি। ভেজা কাগজের মতোই ফেলনা
হয়ে ওঠে গুহাচিত্র, কালের বাঁশরি, রবীন্দ্রনাথের বর, সেই
ক্ষণে মহাকালের সকল গীতশালে বাজে তীব্র বমনের স্বর;
তখন তোমার দিকে, প্রেম, আমি দুঃখময় মুখ তুলে ধরি।

প্রেম তুমি কৃষিকাজ জানো না বলেই সমগ্র ভূভাগব্যাপী
মাথা তোলে দারুণ ছত্রক, বাড়ে পুলকিত আগাছার ঝাড়,
 একটি বিশাল নদী সৌরমরুভূমে নিরর্থক বয়ে আনে
জল, আমি হই আদিকর্মী, দিব্য কৃষকের আদিম লাঙল;
 পরম মেধায় আমি সভ্যতার মাঠে মুখ তুলে ধরি।
পুষ্পপ্রেমকৃষিশিল্পমেধা, সভ্যতার সকল প্রদীপ
 স্বচ্ছতা হারায় কোনো কোনো ভয়াবহ নিষ্ঠুর সন্ধ্যায়;
 প্রদীপআগ্রাসী সেই কালো সাঁঝে আমি এ-জীবনমুখি মুখ
সারাক্ষণ নিদ্রাহীন ধরে রাখি জীবনের দিকে।

*

অনুজের কবরপার্শ্বে

বুকে গাঁথা কালো ছুরি অন্তিম শত্রুর, ঘুরি নিরাশ্রয় নানাবিধ পথে
গন্তব্যবিহীন। থামি নি কখনো বিশ্রামের আকাঙখায়, কোথাও জগতে
 নেই, নেই অস্রোপম পবিত্র নিষ্পাপ স্থল, মেদিনীর বক্ষদেশে নেই।
অথচ হলুদ এই শোকাকুল মৃত্তিকার পাশে এলে এ-পৃথিবীকেই
পুনরায় পরিসুত শুদ্ধ মনে হয়। কালের অজস্র মাটি জমে বুকে
 থামি, যেনো, থেমে আছি সৌরকেন্দ্রে আজীবন বহমান কালস্রোত রুখে।
জ্বলি, কবরের পাশে, তোমার মুখের সেই শৈশবের প্রীতরেখা খুঁজে,
 রুদ্যমান স্থির অশ্রুবিন্দু হয়ে, ক্ষয়ে মিশে যাই মগ্ন তোমার সবুজে।

*

একাকী কোরাস

কেবল কবিই বেরুতে পারে নিরুদ্দেশে;
 নীলিমামাতাল লাল নৌকো নিয়ে অধীর উম্মাদ সব চিরনিরুদ্দেশ
 নাবিকের মতো, ছুঁড়ে ফেলে নকশাকম্পাশকাঁটা, বেরিয়েছি
 গন্তব্যবিহীন। যদিও সময় আজ উপযুক্ত নয় সমুদ্রযাত্রার।
 নাবিকেরা দলেদলে সমুদ্রভীতিতে ভোগে : সৈকত-নীলিমা-ঢেউ
সবই শুনেছে তারা লোকজশ্রুতিতে। স্বপ্নেও তাদের
সমুদ্র রূপান্তরিত হয় সুশান্ত ডোবায়–নরম শয্যার কথা মনে পড়ে;
আর্ত চিৎকারের মতো সর্বাঙ্গ জড়িয়ে ধরে সামুদ্রিক অসুস্থতা।
 সহচর নৌকো, উদ্দেশ্যশূন্যতার মহাকবি, আর আমি
ভেসে যাই স্বপ্নজলে; দূর তীর ঘিরে আছে ১৯৭৯টি স্বপ্নের অভাব।
সদ্ভাব হয় নি কারো সাথে, মাটির ভেতরে গেছি
সরল শিকড় হয়ে গোপন রসের ধারা মুখে;
ওই পাললিক মাটি বাড়িয়েছে মড়ার হাড়ের মতো শুষ্ক ডাল,
নিষ্প্রাণ ছোবার মতোন সব কিমাকার ফুল।
আমি গূঢ় মহাদেশে কালো জলধারা খুঁজে ব্যথিত স্বরের মতো
 সাজিয়েছি আমার রোদন।
সমগ্র ভূভাগব্যাপী মলবাহ, পুনরাবৃত্ত মল, আর মলের শোধন।

তোমার স্বরের চাপে কাঁপে যবনিকা
 বিশাল প্রদীপ জ্বলে সীমাশূন্যতায়
 তোমার শাণিত হাসি আগুনের শিখা
দাউদাউ জ্বলে উঠে ইশারা জানায়

একটি বিষাক্ত ক্ষত ক্রমশ বাড়ছে দ্রুত, ঢেকে দিচ্ছে নিসর্গনীলিমা :
 গোপন অঙ্গের ক্ষত যে-রকম ক্রমে বাড়ে গ্রাস করে সমগ্র শরীর।
 হলদে ময়লা পুঁজ করছে দখল শরীর-ভূভাগ।
 বান্ধবেরা, দয়িত ও দয়িতারা, সন্তান, স্বপ্নেরা, পুলক, বৃক্ষরা,
ছাত্ররা, রাষ্ট্রপতি, বিচারপতিরা, মূল-ও উপ-পতি ও
–পত্নীরা, অধ্যাপক, সচিবেরা, কেরানি, আচার্য ও
 উপাচার্যরা, দালাল, জনতা, নেতারা, কবিতা, পাঠ্য-ও
অপাঠ্য-পুস্তক, যাদু ও বিজ্ঞান, শ্রমিকেরা, কৃষকেরা,
একটি বিশাল ক্ষতে ঢুকে যাচ্ছে, পুঁজ হয়ে গলিত মাংসের
থেকে ঝরছে প্রত্যহ। ভিখিরি যেমন বিশুদ্ধির প্রত্যাশায়
 রৌদ্রে তুলে ধরে সংগোপন ক্ষত, জিহ্বায় শোষণ
 করে ক্ষতস্থল, প্রয়োজন স্বপ্ন-রৌদ্রের শোষণ।

এদেশ বদলে যাবে, বদলে দেবে শ্রমিকেরা, অতীন্দ্রিয় ছাপ্পান্নো হাজার
বর্গমাইল শুদ্ধতা পাবে মিলিত মেধায়। পরিশুদ্ধি পাবে সব কিছু,
পদ্যপুঞ্জ পুনরায় উঠবে কবিতা হয়ে, পরিশুদ্ধ পাঁচটি স্তবকে
শুদ্ধি পাবে সমগ্র রবীন্দ্রকাব্য, একটি ধ্বনিতে ছেঁকে তোলা হবে ঐশী
গীতবিতানের স্বরমালা। যেতে হবে অপেক্ষমান যেখানে ভয়াল মৃত্যু,
 নয়তোবা বিশাল বিজয়। জমে যাই তীব্র শীতে জ্বলে উঠি তীক্ষ্ণ
 উত্তাপে আমার সামনে কোনো মধ্যপথ ছিলো না থাকবে না।

উত্তাল উদ্দাম জল, জলরেখা; বিশাল পদ্মের ন্যায় দিগ্বলয়;
ক্ষয় হয়ে গেছে তীর দৃষ্টি থেকে,
রহস্যপ্রসবা টেনে নেয় আমাদের।
একটি অদৃশ্য পাখি সঙ্গ দেয়, ডানায় বহন করে
সামুদ্রিক ঢেউ। শরীর-সমুদ্র-ঢেউ এভাবে মিলিত আজ
রক্তে গেঁথে নিচ্ছি সমুদ্রসাগর : চিরদিন
 দুলে যাবে সমগ্র শরীরে।
নৌকো ছুটে চলে মহাদেশ সাড়া দেয় জলের অতলে।
 জ্বলে ওঠে রহস্যপ্রদীপ : বস্তুর ভেতরে দৃশ্য স্বপ্নের নির্মাণ;
ফোটে রহস্যকুসুম : শত দলে নৃত্যরত পদ্মের মতোন পদধ্বনি;
 পাখা মেলে রহস্যশাবক : ডানার পালকে কাঁপে সমুদ্রের স্বর।
 অবলীলায় আঙুল গাঁথে শূন্যতার সাথে শূন্যতাকে,
অর্ধেক শিখায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মহাকাল,
মহাকবি নৌকো ছোটে, একটি অদৃশ্য হাত
 বিশাল আকাশ জুড়ে মেলে দেয় স্তরেস্তরে দিগন্তের পাল।

*

সবুজ জলোচ্ছ্বাস

ভেদ করে বস্তুর বিমল ত্বক সময়নিমগ্ন শির শহরের উঠছি শূন্যের দিকে
আস্বপ্নশরীর এক জলোচ্ছ্বাস সবুজ রঙের, জনতারণিত কংক্রিটের শক্ত বেদীমূলে,
 ফোটাই আঙুলে স্পর্শে পল্লবের পাতালে-লুকোনো সোনা, শাদা-লাল-হলুদ ঊর্মিকে
 ছড়াই সৌগন্ধ্যচূর্ণ কালস্তরে সবুজ খামের শোভাময় অন্তর্লোক, স্তর, ভাঁজ খুলে খুলে

তোমার উদ্দেশে অশ্রুভারাতুর বিরহী পাথর। এ-স্ট্রিট প্রবহমান অনন্তের কূল
 যে-নদীর স্রোত তার ঢুকেছে স্মৃতিতে, পাথুরে ভূভাগপ্রিয় জল বয়ে যায় অতল নিভৃতে
বস্তুর প্রাণীর শোকী সময়ের। নিশ্চিত জেনেছি–আমি এক ভুল বৃন্তে আন্দোলিত ফুল,
 তবুও সৌগন্ধ্যে মাতে রক্তমাংস, এবং একটি পদ্মের দোলা কিছুতে থামে না ধমনিতে।

ইস্পাতে ধাতুতে সময়ের চিৎকারে থাকি বস্তু ও প্রাণীর সংগোপন সকল ক্ষরণে
অনশ্বর সাক্ষ্য হ’য়ে, গড়াই ভবিষ্যে-ভূতে সময়ের সহযাত্রী ধাবমান নৈসর্গিক চাকা,
 উড্ডীন সকল স্তম্ভে সময়ের সকল চূড়োয়, শিশুর জন্মোৎসবে বৃদ্ধের মরণে
পল্লবে সবুজ জলস্তম্ভে,–প্রত্যেক কালের দীপ্ত ব্যক্তিগত নিজস্ব রঙিন মৌলিক পতাকা।

*

কবি

ওপড়ানো হলো চোখ; দশ নখে ছিঁড়ে ফেলা হলো নীলমণি;
অন্ধকার উঠলো জ্বলে কোটরের চার পাশে, সর্বলোক ভরে;
 ছড়ালো বিবিধ রোগব্যাধি যকৃতে ও পিত্তাশয়ে; সমস্ত লাবনি
খুঁটে খায় ক্যান্সার, যক্ষ্মা, সিফিলিস, রক্তচাপ, গনোরিয়া, জ্বরে;
 হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে নিলো কাক, চিল, শকুনের পাল;
যৌনাঙ্গ পীড়ন করে নেয়া হলো ভাণ্ড ভ’রে মধু, বিষ, জীবন, মরণ;
কামপ্রেম ক্ষান্ত হলো; আলো নেই আঁধি ফেলে জাল
 কবি : রচিত হয় সেই ক্ষণে, এই তার জীবনধরন।

*

সেও আছে পাশে

যখন ঝনঝন বাজে–! টিন-দস্তা-পেতল-শেকল!–সমস্ত আকাশে।
 যতোই পালিয়ে থাক, বুঝি, বজ্রবিদ্যুৎ এড়িয়ে পেরিয়ে
 রৌপ্য-চাঁদ অভ্র-বন্যা চন্দ্রাস্ত-সূর্যাস্ত তুষারের সাথে সেও আছে পাশে!

যখন কমলাগন্ধ, ভয়াবহ লাল ওষ্ঠে সাংঘাতিক কারুকার্যমণ্ডিত হাসি
 তছনছ ছড়িয়ে যায় ডানা-মেলা বাসে,
টের পাই নৌকোর মাস্তুল দেখে, যতোই আড়াল যাক, সেও আছে পাশে।
 যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে লাল অন্ধকার উডডীন জাহাজে, শুকোয় রাংতার মতো
ঝলকিত কলকব্জা মূর্খ বালকের ত্রাসে,
 অবিরাম অস্ত দেখে চারদিকে পল্লবে পাথরে, বুঝি, সেও আছে পাশে।

যখন সূর্যাস্ত বল্লমের মতো গেঁথে থাকে স্রোতে-ভাসা নামহীন লাশে,
মাটি জল নিসর্গের বাড়তি সৌন্দর্য দেখে
 বুঝি ওই নিষ্প্রাণ বস্তুর সাথে, যতোই সুদূর যাক, সেও আছে পাশে।

যখন হঠাৎ দেখি আমার বধির চোখে এক ফোঁটা কালো জল
 কেউ রেখে চলে গেছে জানুয়ারি মাসে,
জন্মান্ধ দু-চোখ অন্ধ, বুঝি, রক্ত-তাপ-মুমূর্ষার সাথে সেও আছে পাশে।

*

অর্ধাংশ

যদি পুষ্প সুস্থ হয় পত্রপুঞ্জে জড়ো হয় ব্যাধির প্রকোপ
 সারারাত সৌরলোক ভরে। যদি রাতে জ্বলে মাধবীর রূপ
 দিনে তার ভস্ম ওড়ে শুধু। যখন চুম্বন ওষ্ঠে ঢালে সুখ
সঙ্গম রটিয়ে দেয় আমি এক উপদংশী ধর্ষণকামুক।
 অর্ধাংশ অসুস্থ থাকে, যদি সুস্থ থাকে রক্তমাংসের শরীর
আত্মার অসুস্থ রক্তে ভেসে যায় সভ্যতা, ও মাটি পৃথিবীর।

*

শালগাছ

তখন ছিলাম ছোটো,
চোখেমুখে এসে পড়তো অন্যান্য গাছের বুড়ো ডালপালা।
স্বপ্নে-শিরে খসে পড়তো মরা পাতা, শুকনো বীজ,
হাড়ের মতোন শক্ত পোক-খাওয়া শাখা।
শিশিরঅবাক চোখে চাইতাম, চারপাশে বিছানো বিস্ময়!
 সামনে দাঁড়ানো ছিলো, বেশ উঁচু, একটা হিজল;
ক্ষণেক্ষণে ভাবতাম ওর মতো হতে পারি যদি!
একটা বামন তরু–কী রকম রগড় করতো–যেনো সমকালে
পৃথিবীর কোনো বনে ওর মতো আর কেউ নেই।
একদিন দেখলাম : কী-একটা গাছের চুড়োয় ঢেউ খেলছে
 লাল-নীল-সবুজ-হলুদ; কিন্তু সেই রঙিন উজান
ভাটায় গড়ালো আস্তে দু-দিন যেতেই।
সামনে আঁধার, পেছনে আঁধার, বাঁয়ে অন্ধকার,
 ডানে অন্ধকার; চারপাশে গাছের আঁধার।
 কখনো চোখের মণিতে ঢুকতো আঁধারের বিপরীত
সোনার পানিতে গলছে তরল আঁধার, গলে গলে রুপো হচ্ছে
 আবার গলানো লাল মাণিক্য হয়ে রাত্রি নামছে।
সোনা-জল-ঢালা সেই অদেখা সোনাকে মনে মনে ডাকলাম–সূর্য!
 তারপর অন্ধকার নিজের মুখের রূপে ধুয়ে ফেললো এক নারী;
 স্বপ্নে ডাকলাম–চাঁদ!
তরুণ শালের কোঁড়া গাছের আঁধার ভেদ করে হিজল-বামন ছেড়ে
সোনা ও নারীর দিকে বাড়তে লাগলাম।
পাগল বাতাস এলো–আর সে-বাতাসে ভেসে এলো স্বপ্ন
কে যেনো বসলো ডালে–কেঁপে উঠলাম আশিরশেকড়
সে আমার আদিশিহরণ!
কে এসে বসেছিলো?–জানি না। তাকে ডাকলাম : পাখি!
সে উড়ে যাওয়ার কালে যে-জল ছড়িয়ে গেলো,
 তাকে আমি আজো বলি–সুর!
বামন গাছটা এর মাঝে হাঁটুর তলায় পড়ে গেছে,
 মাঝেমাঝে কুড়োয় সে আমার একটি-কী দুটো ঝরাপাতা।
হিজল তাকায় কেমন করুণ দু-চোখে।
এক মোহিনী–ডেকেছিলাম সঞ্চারিণী লতা
 গোপনে রক্তের মধ্যে ঘুমভরা ছোঁয়া ঢেলে
বেয়ে উঠতে লাগলো আমার হৃৎপিণ্ডের দিকে;
হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি এসেই মোহিনী লীলায় ফুটিয়ে দিলো
 রঙ–সে-রঙিন লাস্যকে আমি বলি–ফুল!
 মোহিনীর রূপ থেকে চোখ তুলে ওপরে তাকিয়ে দেখি নীল!
আন্দোলিত নীলের ভেতর থেকে ভেসে ওঠে একখণ্ড রক্তমাণিক্য
মধ্যমায় পরে নিই,
 দিনান্তে ধোয়ার জন্যে ছুড়ে দিই নীলেজলে;
 পুনরায় পরিশুদ্ধ ভোরে এসে বসে সে আমার আংটিতে।
 টের পেয়েছিলাম অনেক আগে মূল-শেকড়টি বেড়ে বেড়ে
গিয়ে পড়েছে এক মধুঝর্নার বক্ষস্থলে।
 যতোই গভীরে যাই, মধু;
 যতোই ওপরে যাই, নীল!
 শিকড় চালাই, মাটির গভীর থেকে মধুর গভীরে;
শিখর বাড়াই, মেঘের ওপর থেকে নীলের ওপরে।
 আমার সঙ্গী সেই বুড়ো ও বামন গাছগুলো আজকাল
 ঝরে যাচ্ছে
 মরে যাচ্ছে
আমি শুধু মধু থেকে নীলে নীল থেকে মধুর ভেতরে
ছড়াচ্ছি নিজেকে।

*

উন্মাদ ও অন্ধরা

‘হুমায়ুন আজাদ, হতাশ ব্যর্থ শ্রান্ত অন্ধকারমুখি;
উৎফুল্ল হয় না কিছুতে–প্রেমে, পুষ্পে, সঙ্গমেও সুখী
হয় না কখনো; আপন রক্তের গন্ধে অসুস্থ, তন্দ্রায়
 ধ্বংসের চলচ্চিত্র দেখে, ঘ্রাণ শুঁকে সময় কাটায়;
 ওকে বাদ দেয়া হোক, নষ্ট বদমাশ হতাশাসংবাদী।’
–এ-আঁধারে উম্মাদ ও অন্ধরাই শুধু আশাবাদী।

*

ছেঁড়া তার

শান্তিকল্যাণ ঝরে, পতঙ্গেপল্লবে সুখ ঢেলে দিচ্ছে দয়াময় চাঁদ;
 নিটোল হীরকখণ্ড সমস্ত উজাড় করে বিতরণ করে দেহজ্যোতি;
সমস্ত অমর আজ, কেটে গেছে পৃথিবীর চিত্ত থেকে অসম্ভব অমা।

মরের রক্তের মধ্যে শতস্রোতে ঢুকে যাচ্ছে অমরার আমোদআহ্লাদ;
সর্বত্র সুষম ছাঁচে নিজস্ব ভাস্কর্য রচে জ্যোতির্ময় বিশুদ্ধ স্থপতি।
 প্যাঁচা থেকে ইঁদুরের লাল রোমে সুষমা সুষমা আজ চারদিকে সুষমা সুষমা।

আমি শুধু গাঁথা তার হিংস্র নখে : পরিশুদ্ধ মাণিক্যখচিত অর্কেস্ট্রার
 অনাহত ঐকতানে বেসুরো রোদনরত আহৃৎ আহত ছেঁড়া তার।

*

বন্যা

আবার এসেছে বন্যা, চারদিক জমজমাট হয়ে উঠবে পুনরায়।
সুখপাঠ্য হয়ে উঠবে অপাঠ্য দৈনিকগুলো,
গদশ্রান্ত সাংবাদিকদের পিচ্ছিল কলম থেকে
 নিষ্ক্রান্ত হবে অভাবিত চিত্রকল্পমণ্ডিত কবিতাআক্রান্ত গদ্য,
সরকারি সম্পাদকের সুখ্যাত সৌন্দর্যবোধ
অবিনশ্বর করে রাখবে অফসেটে ছাপা চিত্রাবলি।
আবার এসেছে বন্যা, বাঙলাদেশে শিল্পের মৌশুম।
বিশ্ব স্থিরচিত্র প্রতিযোগিতায় যে-ছবিটি প্রথম পদক পাবে
আগামী বছর, আশাহি পেন্টাক্সে সেটি
তুলে আনবেন শিল্পপ্রাণিত কোনো বাঙালি ফটোগ্রাফার,
 শহরের সবচে অপাঠ্য দৈনিকটি, আগামী মাসেই,
টেলেক্সে লণ্ডনে দেবে লাইনো মেশিন অর্ডার।
টেলিভিশন পুনরায় বোধ করবে কবিতার প্রয়োজন,
 ক্যামেরার মুখোমুখি বসবে আসর, হয়তো আমিই হবো
বন্যা ও কবিতার পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণকারী
দুর্দান্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ গম্ভীর উপস্থাপক,
এবার কেবলমাত্র ক্যামেরামুখ কবিদেরই
আমন্ত্রণ জানাবে প্রযোজক।
 আবার এসেছে বন্যা, আবার দেখতে পাবো পথেপথে
শোকভারাতুর সেবিকাপুঞ্জের ক্ষুধাহর, আশ্রয়-ইশারাভরা
 পদ্মার ঢেউয়ের মতো ঢেউভরা মেদ,
 আনন্দমুখর হবে সন্ধ্যাগুলো –দয়াবতী প্রধান বেশ্যার নাচ
 ওয়েসিসে, আন্তর্জাতিক কাঁপবে লাস্যময়ী গায়িকার
তীব্র শ্রোণিভারে।
আবার এসেছে বন্যা, ইতর গ্রাম্যলোক কাছে থেকে দেখতে পাবে
সুবেশ, সভ্যতা, কপ্টার, লাল ওষ্ঠ, বিলিতি কম্বল,
 সেবাময়ীদের উদ্ধত বক্ষ ও জংঘার নিপুণ আর
তীক্ষ্ণ আন্দোলন।
আবার এসেছে বন্যা, ক্ষমতার উৎস যারা তারা খুব কাছে থেকে
দেখতে পাবে ক্ষমতার পরিণতিদের, এবং বুঝতে পারবে
 ক্ষমতার পরিণতি কী-রকম শোকাবহ করুণ ব্যাপার।
 আবার এসেছে বন্যা, গৃহবন্দী রাজনীতিবিদদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার
 এইতো সুযোগ। এবং সুযোগ তার হ্যান্ডশেক, পচা গম,
 আণ্ডার সমান অশ্রুবিন্দু, দ্রোহীদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি
পাকা সিংহাসন।
আবার এসেছে বন্যা, বাঙলার সোনালি মৌশুম।

*

এক বছর

যখন ছিলাম প্রিয় প্রতিভাসৌন্দর্যপ্রেমে ভূলোকে ছিলো না কেউ আমার সমান।
তরুণ শালের মতো এই দেহ–ঝকঝকে, নীলছোঁয়া, প্রোজ্জ্বল, নির্মেদ
দু-চোখ জ্যোতিষ্কদীপ্র, কণ্ঠস্বরে লক্ষ লক্ষ ইস্পাহানি গোলাপের ঘ্রাণ,
 তোমার প্রশংসাধন্য ছিলো এমনকি লোমকূপে-জ’মে-থাকা সংগোপন স্বেদ।

আমার চুম্বন ছিলো পুনর্জীবন মন্ত্র, যার আমি নষ্ট বিশ্বে শেষ অধিকারী।
উদ্দাম পদ্মার চেয়ে ঢেউভরা আমার বাহুর ব্যাপ্ত ব্যগ্র আলিঙ্গন,
আমি শেষ সেনাপতি, কোষে যার আন্দোলিত হননে সুদক্ষ তরবারি।
মাংসের প্রত্যেক ছিদ্রে বন্যার মত্ততা ঢালে আমার প্রত্যেক আরোহণ।

অন্য কেউ প্রিয় আজ, আমি তাই, যদিও যৌবনজ্বলা, পৃথিবীর নষ্টতম লোক।
চুম্বন দুর্গন্ধময় আমার মুখটি এই শহরের সবচেয়ে নোংরা ছাইদানি,
 এই দেহ হাসপাতাল–চারদিকে যক্ষ্মা, জ্বর, উপদংশ-বিভিন্ন অসুখ।
 আশ্লেষে বর্বর আমি : মূর্খ চাষার মতো যেনোবা ঢেঁকিতে ধানভানি।

তুমিই সৌন্দর্য আজো দুই চোখে, তোমার ধ্যানেই মগ্ন আছি অহর্ণিশ,
 পরিমাপ করে যাই অনন্ত দ্রাক্ষার উৎস ঢালতে পারে কতোখানি বিষ।