1 of 3

জ্বর

জ্বর

প্রথমটা অসিত বুঝতে পারেনি, শুধু সমস্ত শরীরে কীরকম একটা অস্বস্তি লাগছিল। কন্ডাক্টরকে পয়সা দিতে গিয়ে বুঝতে পারল, তার জ্বর এসেছে। একটা পাঁচ টাকা তুলে বলল ভবানীপুর!

দু-চারটে কৌতূহলী চোখ তার দিকে তাকাল। কন্ডাক্টর দার্শনিকের মতো নির্লিপ্ত গলায় বললে, ভবানীপুর যাবে না, এ-ট্রাম আলিপুর যাচ্ছে!

আশ্চর্য! অসিত জানলা দিয়ে তাকাল। ময়দানের মধ্য দিয়ে ট্রাম মেল-ট্রেনের মতো স্পিডে ছুটছে, চারদিক অন্ধকার শীতের বাতাস। এতক্ষণ তার চোখে পড়েনি, অথচ জানলা দিয়ে বাইরেই তো সে তাকিয়ে ছিল। কিছু ভাবছিল কি? কী ভাবছিল মনে নেই।

আচ্ছা আলিপুরই দিন একটা!লজ্জায় বলে ফেলল।

হ্যাঁ, জ্বর আসছে, অসিত বুঝতে পারল। কিন্তু আমি আলিপুর যাচ্ছি কেন এত রাত্রে, কী করে বাড়ি ফিরব? কিছু ভাবতে ভালো লাগে না, সমস্ত শরীরে যেন লক্ষ-লক্ষ সূচ ফুটেছে, পাথরে শব্দ করে ছুরি ঘষলে যেরকম হয়, বাতাসের ছোঁয়ায় সেইরকম লাগছে।

বেশ বসে ছিল, হঠাৎ অসিতের মাথাটা ঠক করে জানলার কাঠে ঠুকে গেল। কপালের একটা ধার কেটে গিয়েছে। ইস, রক্ত পড়ছে। যাক, ভাগ্যিস কেউ দেখেনি। রক্ত ঝরঝর করে জামায় পড়ছে, ফর্সা জামা-কাপড় সব নষ্ট হয়ে গেল। রক্ত যে থামেই না, অসিত তাড়াতাড়ি কপালে হাত দিল।

, রক্ত নেই তো। কপালের একটা কোণ কেটেছে ঠিকই, সামান্য, রক্ত ঝরঝর করে পড়ছে না। আমি তা হলে এতক্ষণ ভুল ভাবছিলাম। জ্বর হলে মানুষ ভুল বকে, ভুল ভাবেও বুঝি, না, আমি কিছু ভুল ভাবব না, আমি—।

ট্রামের একটি লোক হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, আরে কী হল ভদ্রলোকের! ঘটাং করে ট্রামটা মাঠের

মাঝখানে থেমে গেল। অসিত কখন দুমড়ে বেঞ্চির নীচে পড়ে গিয়েছে। জনকয়েক উৎসাহী ব্যক্তি হই-হই করে উঠলেন।

আ-হা-হা, জ্বরে একেবারে গা পুড়ে যাচ্ছে। এই নিয়ে কেউ ট্রামে-বাসে ওঠে।

নেশা-টেশা করেছে কিনা, কয়েকজন জিগ্যেস করলেন। তার মধ্যে দু-একজন নিজেরাই নেশাচ্ছন্ন।

ট্যাক্সি, ট্যাক্সি! ধরাধরি করে অসিতকে ট্রাম থেকে নামান হল। হাঁক পড়ল ট্যাক্সির জন্য। ততক্ষণে অসিতের চৈতন্য এসেছে। আমি ঠিক আছি, এবার আমি নিজেই যেতে পারব, হঠাৎ একটু মাথাটা–

না না, ট্যাক্সি করে চলে যান। এই অবস্থায়—

রাত্রি দশটা বেজে গিয়েছে, নির্জন ময়দান, তবু হঠাৎ একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। ট্যাক্সিতে দুজন যুবক-যুবতী ছিলেন, ব্যাপার শুনে তাঁরা সৌজন্য করে ট্যাক্সি ছেড়ে দিলেন।

ঠিকানা বলতে পারবেন তো মশাই?  

হ্যাঁ, ভবানীপুর, ফকির সেন স্ট্রিট।

অসিতকে সবাই ট্যাক্সিতে তুলে দিলেন। ঝাঁকুনি দিয়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দিতেই অসিতের যেন স্বাভাবিক জ্ঞান ফিরে এল। আমি কোথায় যাচ্ছি, আমার তো কিছু হয়নি। ট্যাক্সি করে যাব, আমার এমন পয়সা কোথায়। ট্যাক্সির মিটারে যেন আট-আনাটা লাফাচ্ছে, এক্ষুনি বদলাবে।

রোককে, গাড়ি থামাও ড্রাইভার। পকেট থেকে একটা আধুলি বার করে দিল অসিত, আমি হেঁটেই যাব।

পা টলে যাচ্ছে, মাথাটা ভয়ানক ভারী—শরীরের পক্ষে দুর্বিষহ বলে মনে হচ্ছে। তা হোক, আমার ফুসফুসে পোকা নেই, আমার কখনও কোনও কঠিন অসুখ করেনি। জ্বর যতই বাড়ুক—তা আবার সেরে যাবেই, আমি হেঁটেই যাব। তা ছাড়া, আজ আমাকে প্রমাণ করতে হবে, আমি অন্যদিনের মতোই সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ।

কিছুক্ষণ সিধে হাঁটল অসিত। দেখল সামনে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। অন্ধকারের মধ্যেই সেই বিশাল, শ্বেত অট্টালিকা কীরকম রহস্যময় দেখাচ্ছে। লোকজন নেই, অনেক দূরে বীটের পুলিশের জুতোর খটখট শব্দ শোনা যাচ্ছে।

ওঃ, পথ ভুল করেছি। অসিত বাঁ-দিকে ফিরে আবার হাঁটতে আরম্ভ করল। এত রাতে মেসের দরজানা বন্ধ হয়ে যায়। কাল মেসের চার্জ মিটিয়ে দিয়ে অন্য একটা ভালো মেসে চলে যাবে। কাল কত কাজ। কিছুক্ষণ হেঁটে সামনে চোখ তুলল। সামনে আবার সেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, সেই বীটের পুলিশের জুতোর শব্দ। দূর ছাই, অসিত একেবারে পিছনে ফিরে হাঁটতে আরম্ভ করল। অনেকক্ষণ। তারপর সামনে আবার সেই শ্বেত অট্টালিকা। আবার ডানদিকে ফিরল, পিছন ফিরল, বাঁ-দিকে গেল, সামনে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। পরিশ্রান্ত হয়ে অসিত রাস্তার ওপর। সোজা হয়ে দাঁড়াল। কালো চকচকে ঝকঝকে রাস্তা সামনে পিছনে যতদূর দেখা যায়। নিজের হাতটা একবার কপালে ছোঁয়ালে; হাত আর কপাল দুটো যেন উষ্ণতায় পাল্লা দিচ্ছে। আজকে। আবার সে সঙ্গে কোনও গরম কাপড় আনেনি। কীই-বা আনত। সেই নীল রাপারটা তো আর ওখানে গায়ে দিয়ে যাওয়া যেত না। হঠাৎ সে তার পায়ে কোনও জোর পেল না। কিছু ভাববার আগেই ঘুরে পড়ে গেল পথের ওপর।

ঘনঘন নিঃশ্বাস বইছে। সমস্ত শরীরে যেন চাপ-চাপ বাতাস। দু-একবার ওঠবার চেষ্টা করল অসিত। কিন্তু শরীর থেকে মনটা যেন আলাদা হয়ে গিয়েছে। শরীরের ওপর তার আর কোনও কর্তৃত্ব নেই। সেই অবস্থাতেও বাঁচার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠল। টেবিলের ওপর আলপিন দিয়ে। গেঁথে রাখা ছারপোকাটা পর্যন্ত বাঁচার জন্য কী তীব্র চেষ্টা করে। খোলা রাস্তার ওপর দিয়ে প্রমোদবিলাসী কোনও মোটরকার হয়ত প্রচন্ডবেগে এসে তাকে থেঁতলে দিয়ে যাবে। অসিত উঠতে পারল না, কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টায় গড়াতে-গড়াতে রাস্তার একপাশে গিয়ে পড়ে রইল।

মাথার উপরে ঝকঝকে নীল শীতের আকাশ! কয়েকটা পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম তারা উঠেছে। শিরশিরে বাতাস, গাছের পাতার শব্দ। দূরে মিষ্টি আওয়াজে গির্জার ঘণ্টা বাজল। এগারটা। চার পাশে শান্ত প্রকৃতি, কোথাও কোনও অসামঞ্জস্য নেই। শুধু অসিত জ্বরে বেহুশ হয়ে রাস্তার। একপাশে পড়ে রইল। প্রায় মিশে রইল ঘাসের সঙ্গে।

বেশ কিছুক্ষণ পর একটি মেয়ে এইদিকে হেঁটে আসতে লাগল, একা। মেয়েটি হচ্ছে সেই জাতের মেয়ে, যারা পুলিশকে দু-চার আনা ঘুষ দিয়ে সাজগোজ করে ময়দানে একা ঘুরে বেড়ায়। কোনও রসিক ভদ্রলোকের সন্ধান পেলে তার কাছ থেকে আগামী দিনের খাওয়ার খরচটা জোগাড় করে নেয়। মেয়েটি গুনগুন করে কী-যেন একটা গান করছে, একঘেয়ে কান্নার মতো শোনাচ্ছে। আওয়াজটা, জুতোয় একটা হিল বোধহয় ভেঙে গিয়েছে—একটা পা টেনে-টেনে আসছে, খস খস-খুট করে শব্দ হচ্ছে রাস্তায়। হঠাৎ মেয়েটির চোখ পড়ল অসিতের দিকে। দেখেই মেয়েটি ভয়ে কেঁপে উঠল। তারপর খুব জোরে-জোরে পা চালিয়ে সোজা চলে গেল অনেকদূর পর্যন্ত, একবারও পিছনে তাকাল না। মিনিটপনেরো পর মেয়েটি আবার ফিরে এল। গান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জুতোর শব্দ না করে পা টিপে টিপে আসছে। একেবারে অসিতের কাছে এসে দাঁড়াল। কুকুর যেমন গন্ধ শুকে সব বোঝে, মেয়েটি প্রায় সেইরকমভাবে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করল।

তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল অসিতের পাশে, কপালে হাত দিয়ে দেখল, না, মরেনি। নেশা-টেশা করেছে বোধ হয়।

মেয়েটি বিনা দ্বিধায় অসিতের বুক-পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। একটা টাকা আর দু-এক আনা খুচরো পয়সা, একটা কমদামি ফাউন্টেন পেন। মেয়েটা বিরক্তিতে মুখে একটা ভঙ্গি করল, আর ঠিক এইসময় অসিত কী যেন বলে উঠল। গলার আওয়াজ স্পষ্ট নয়। অনেকটা বিড়বিড় করে অসিত বলল, আমার কোনও দোষ নেই, রানী। আপনি—তুমি আমাকে ভুল বুঝো না।

আ মরণ, মেয়েটি ধমকে উঠল, নালা-নর্দমায় শুয়েও রাজা-রানীর স্বপ্ন।

অসিত আবার বলে উঠল, অসম্ভব, ছিঃ, এ-কাজ কি আমার পক্ষে–না, না।

মেয়েটা উঠল। কী ভেবে একটাদু-আনি ফেরত রেখে গেল অসিতের বুকপকেটে। তারপর চলে যেতে-যেতে শুনল, আমি এদের মতো ধনী নই। তা বলে কি আমার–

আবার একা দুমড়ে শুয়ে রইল অসিত। আরও কী যেন বলতে লাগল বিড়বিড় করে। জ্ঞান নেই। সে কথা বলছে না, যেন তার বুকের মধ্যে থেকে অন্য কেউ।

আরও কিছুক্ষণ পর মাঠের মধ্য দিয়ে একটা জীপ গাড়ি আসতে লাগল। পুলিশের গাড়ি সার্চলাইট ফেলে দেখছে, মাঠের মধ্যে সন্দেহজনক কিছু আছে কি না। আলোয় ধুয়ে গেল মাঠটা। ঘুরতে-ঘুরতে আলোটা অসিতের শরীরের ওপর এসে থেমে গেল। আলোটা স্থির রেখে শব্দ করতে-করতে গাড়িটা সোজা এগিয়ে আসতে লাগল সেদিকে, থামল হাতদশেক দূরে। জনচারেক লোক লাফিয়ে নেমে ছুটে এল সেদিকে। কাছে এসে দাঁড়াল, একজন বলে উঠল, আগে ভালো করে দেখে নিন, ছুঁয়ে-টুয়ে ফেলবেন না।

একজন খাকি পোশাক-পরা ঘাড়ছাঁটা খোঁচা-খোঁচা চুল, খুব কাছে এসে টর্চ ফেলে দেখল ভালো করে, পায়ের খোঁচা দিয়ে দেহটা একবার উলটে দেখল, কোথাও কিছু নেই।

একজন খস করে শব্দ করে বিড়ি ধরিয়ে বলল, বিষ-টিষ খাওয়াবার ব্যাপার না!

খাকি পোশাক হাঁটু মুড়ে বসে অসিতের নাকের কাছে হাত রাখল। ভয়ানক গরম এবং দ্রুত নিঃশ্বাস রইছে।

হঠাৎ অসিত আবার বলে উঠল, আমি কেন এলাম, এখানে আমার আসা উচিত হয়নি, এদের মধ্যে আমাকে, আমি—

খাকি-পোশাক বলল, ভয়ানক জ্বর হয়েছে দেখছি, ভুল বকছে।

আমার নাম অসিত মজুমদার, আমার চাকরি নেই:টাকার অভাবে আমি…কিন্তু এরকম কাজ…আমাকে—

ও মশাই, এ যেন জীবনী শোনাচ্ছে! হাতের বিড়িটা আরেকজন অন্ধকারে ছুড়ে দিয়ে বলল, চলুন, ছেড়ে দিন, এসব হাসপাতালের কেস। আমাদের এখনও সাউথের দিকটা দেখা বাকি আছে! আওয়াজ করে জিপটা চলে গেল।

আমি না খেয়ে মরতে পারি, কিন্তু আমি ভদ্রলোক…।

অসিতের জ্ঞান হল খুব ভোরে। চোখ মেলে চারদিক দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসল। এখন সে হাঁটতে পারছে, কিন্তু জ্বর একটুও ছাড়েনি। চোখ-মুখ যেন ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সমস্ত শরীরে ভয়ানক উষ্ণ রক্তস্রোত। পকেটে হাত দিয়ে একবার পয়সাগুলোর উদ্দেশ পেল না, বিরক্ত লাগল। তাড়াতাড়ি কোমরে হাত দিল, না, ঠিক আছে। হঠাৎ মনে পড়ল, কালকের। সন্ধ্যেবেলাটা স্বপ্ন নয়। হাঁটতে-হাঁটতে হাজরা রোডের মোড়ে এসে দাঁড়াল অসিত, ভোর থেকে সকাল হচ্ছে। একটা পানওয়ালা ঘড়িতে চাবি দিচ্ছে, ছটা বাজে। খুব অস্বস্তি লাগল অসিতের। মনে হচ্ছে আশপাশের সমস্ত লোক তাকে দেখছে। নিজেকে এত রুগণ, এমন পরাজিত আর কোনওদিন মনে হয়নি তার।

একটু পরে বেঁটে ছাতা হাতে নিয়ে খুব মন্থর পায়ে একটি মেয়ে এগিয়ে আসতে লাগল সেদিকে, বাস-স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল। সুন্দরী, বাইশ-তেইশ, সকালের মেয়ে-স্কুলের টিচার। তবে চেহারা দেখলে অনুমান করা খুব শক্ত নয় যে, বড়লোকের মেয়ে, পড়াশুনো শেষ করে বিয়ে হওয়ার আগের সময়টুকু শখ করে স্কুলে পড়ায়। মেয়েটির সমস্ত মুখের মধ্যে দুটোই সবচেয়ে সুন্দর, হঠাৎ দেখলে কাজল দিয়ে আঁকা মনে হয়।

অসিত কাছে এগিয়ে এসে বলল, রানী, আপনাকে একটা কথা বলতে এলাম।

রানী চমকে ফিরে তাকাল, ভুরু দুটি বিস্ময়ে বক্র করে বলল, একী, কী চেহারা হয়েছে আপনার! ব্যাপার কী?  

না, এসব কিছু না, একটা কথা বলতে এলাম।

জামা-কাপড়ের কী অবস্থা, রাত্রে কী হয়েছিল? কাল অত তাড়াতাড়ি আপনি চলে গেলেন কেন না বলে? আমি শঙ্করকে বললুম, তোমার মাস্টার মশাই কোথায়? ও কিছুই জানে না।

ওসব কথা থাক, অন্য সময়। এখন আমি যা বলব, তাই শুনে আপনি চিৎকার করে উঠবেন না, বা দয়া করে বিসদৃশ কিছু করবেন না। পরে আপনি পুলিশে খবর দিতে পারেন। আমি এইটা, অসিত জামার নীচ থেকে বার করল, এই সোনার হারটা কাল আপনাদের বাড়ি থেকে চুরি করেছি।

রানী একটু ফ্যাকাশে ধরনের হাসল। কী খোঁজাই খুঁজেছি কাল রাত্রে, বাড়ির কাউকে বলিনি। আপনি এমন ঠাট্টা করতেও পারেন।

না, ঠাট্টা নয়, অসিত রানীর চোখ থেকে একবারও চোখ সরাল না, এর জন্য অনেকটা আপনিই দায়ী। আপনার জন্মদিনের উৎসবে আপনি আমাকে নেমন্তন্ন করেছিলেন কেন? আমি আপনার ছোট ভাই-এর মাস্টার; তাকে নেমন্তন্ন করা চলে না।

ছিঃ, আপনি এসব কী বলছেন! আপনার চোখ-মুখ ভীষণ লাল দেখাচ্ছে, আপনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন, এখন বাড়ি যান।

না, শুনুন। আপনার জন্মদিনের পার্টিতে নানা উপহার এনেছে সকলে, এসেছে আপনার দাদার বন্ধুদু-তিনটি হবু আই সি এস, হবু ডাক্তার। আমি কী উপহার দেব! মাসের সাতাশ তারিখ! মনে-মনে ভাবলুম, আপনাকে একদিন ব্রাউনিঙ-এর কবিতা বুঝিয়ে ছিলাম, গ্যেটের জীবনী শুনিয়েছিলাম একদিন। তাকে কি উপহার বলা যায় না? না, যায় না। ঘরের সকলে হাসছে, গল্প করছে, আমি এক কোণে চুপ করে বসে আছি, আমি এদের মধ্যে কেউ নই, আমি শুধুই শঙ্করের মাস্টার। হঠাৎ আমি জানি না, কীসের ওপর বা কার ওপর যেন আমি ভয়ঙ্কর রেগে গেলুম।

হারটা আপনার গলা থেকে খুলে আমার জুতোর তলায় চাপা পড়ে যায়। অত্যন্ত ভারী হার, কাল গলায় পড়েছিলেন, অস্বস্তিতে নাড়াচাড়া করছিলেন দু-একবার। একবার নীচু হয়ে চায়ে চিনি। মেশাতে গিয়ে খুলে পড়ে যায়। জুতোর তলায় চেপে আমি ভাবলুম, আমি যে কিছু উপহার আনিনি—সেই অপমানের একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে হারটা চুরি করা। আপনাদের প্রচুর আছে, একটা হার-এর জন্য আপনাদের গায়ে সামান্যও আঁচড় লাগবে না, অথচ আমার মেসের তিন মাসের চার্জ মেটানো যাবে, ইউনিভার্সিটির মাইনে দেব, পরীক্ষার ফী দেব…। আপনার মামাত ভাই যখন মুভি ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখাবার জন্য সকলকে পাশের ঘরে ডাকল, তখন আমি হারটা পকেটে তুলে নিলাম।

অসিত চুপ করল। কিছুক্ষণ দুজনেই স্তব্ধ। মিহি ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে, অসিতের তপ্ত শরীরে ভয়ঙ্কর অস্বস্তি লাগছে। একটু সরে এসে দুজনে বাস-স্ট্যান্ডের শেডে এসে দাঁড়াল। অসিত হারটা রানীর হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।

রানী এতক্ষণ বাদে বলল, আপনি এত ভেবে ওটা নিয়েছিলেন, তবে আবার ফেরত দিতে এলেন কেন?  

সেইখানেই আমার হেরে যাওয়া। আমার যুক্তি ঠিক ছিল, মনের মধ্যে কোনও অন্যায়-বোধ ছিল না, নিজেকে চোর কিংবা অপরাধী মনে হয়নি। তবু হঠাৎ কাল অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আজ সকালে হঠাৎ এখানে চলে এসেছি। দয়া করে এখন আমার ওপর আর করুণা দেখাবার চেষ্টা করবেন না। আপনি একথা সকলকে জানিয়ে দিতে পারেন, পুলিশে খবর দিতে পারেন।

আপনাকে আমি একটি কথা বলতে চাই। রানী বলল, যদি–

না, এখন আর কিছু বলবেন না আমাকে। আপনার বাস আসছে, স্কুলের দেরি হয়ে যাবে।

হোক দেরি। শুনুন…

অসিত ততক্ষণে পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করেছে। যতদূর পর্যন্ত রানী তাকে দেখতে পাবে, ততক্ষণ সে একবারও পিছন ফিরল না, তারপর বাঁ-দিকে মোড় ঘুরে গেল। তার মনে পড়ল, কাল রাত্রে সে কীরকম পড়ে গিয়েছিল ময়দানের মধ্যে। ভিজে ঘাস, শিরশিরে বাতাস, মাথার ওপর চকচকে নীল আকাশ। হঠাৎ অসিত অনুভব করল, তার গা কেমন ভিজে-ভিজে, কুলকুল করে ঘাম বয়ে যাচ্ছে সারা দেহে। জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *