জ্বরের ঘোরে শোনা – সমরেশ বসু

জ্বরের ঘোরে শোনা – সমরেশ বসু

গোগোলের শরীর খারাপ। ঘরের মধ্যে খাটের বিছানায় শুয়ে আছে। পাশ ফিরে চোখ বুজে রয়েছে। মাথার বালিশের কাছে রয়েছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা ছোটদের জন্য লেখা গল্পের বই। আর একটা কিশোর-পত্রিকা। বাবা ঘণ্টাখানেক আগে অফিসে বেরিয়ে গেছেন। মায়ের এক বান্ধবী এসেছেন, রেখামাসি। মা তাঁর সঙ্গে বসার ঘরে বসে গল্প করছেন।

শরীর কেউ ইচ্ছে করে খারাপ করে না। মা’র ধারণা গোগোল বৃষ্টিতে ভিজে ইস্কুলে খেলতে গিয়ে ঠান্ডা লাগিয়েছে। আর তার জন্যই ওর জ্বর আর কাশি হয়েছে। অবিশ্যি জ্বর বা সর্দিকাশি কোনওটাই এমন কিছু বেশি নয়, জ্বর এখন অল্পই আছে। ওর নিজের সেই রকম ধারণা। কাশিটাও অল্পই আছে। আজ চার দিন ও ইস্কুল কামাই করে শুয়ে রয়েছে। শুয়ে থাকতে আর মোটেই ভাল লাগছে না। কিন্তু মা’র কড়া বারণ, চুপচাপ শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। গোগোল বুঝেছে, সবসুদ্ধ এক সপ্তাহ ইস্কুল যাওয়া হবে না। বন্ধুরাও কেউ বাড়ি নেই যে, ডেকে নিয়ে এসে গল্প করবে। সবাই এখন ইস্কুলে গেছে।

গোগোল মা’র কথায় বাধ্য ছেলের মতো চোখ বুজে শুয়ে ছিল। বাড়িতে নতুন কোনও বই বা পত্রিকাও নেই যে পড়বে, মাঝে মাঝে নীচে থেকে গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে আসছে। কোনও গাড়ি আসছে, অথবা বেরিয়ে যাচ্ছে। ওদের বিল্ডিংয়ের সামনে রাস্তা দিয়ে যাওয়া-আসা গাড়ির একটু-আধটু শব্দ শোনা যায়। আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না।

গোগোলের এক সময়ে একটু যেন তন্দ্ৰামতো এসেছিল। এই অবস্থায় ও শুনল, কোথায় ঠুকঠুক করে শব্দ হচ্ছে। শুনতে শুনতে ওর তন্দ্রা ভেঙে গেল, আর তখনই শব্দটাও থেমে গেল। কোথা থেকে শব্দটা আসছিল? ওদের নিজেদের ফ্ল্যাটেই কি শব্দ হচ্ছিল? বঙ্কিমদা কি কোনও ঘরের দেওয়ালে পেরেক বা কিছু পুঁতছিল?

গোগোল মিনিট খানেক কান পেতে থেকে, আবার চোখ বুজে অন্য পাশ ফিরে শুল। তন্দ্রার ঘোরে নয়, হয়তো জ্বরের ঘোরে ভুল শুনছে, ফ্ল্যাটের মধ্যে কোনও ঘরে পেরেক ঠুকলে আরও জোরে শব্দ হয়। কিন্তু ঠুকঠুক শব্দটা শোনা যাচ্ছিল খুব আস্তে আস্তে। গোগোলের মন থেকে ভাবনাটা চলে গেল। আবার একটু তন্দ্রার ঘোর এল। ওর কানে শব্দ ভেসে এল। কেউ যেন খুব আস্তে কোথাও করাত ঘষছে। শুনতে শুনতে আবার ওর তন্দ্রা ভেঙে গেল। কেউ কোথাও করাত চালাচ্ছে? শব্দটা যেন সেইরকমই শোনাচ্ছে। কাঠের ওপরে করাত চালাচ্ছে। নাকি লোহার ওপর কিছু ঘষছে? ভাবতে ভাবতেই শব্দটা থেমে গেল। কোথা থেকে শব্দটা ভেসে আসছিল? ওদের ফ্ল্যাটের মধ্যে নিশ্চয়ই নয়। ওপরের ফ্ল্যাটে শব্দ হচ্ছে কি? ওপরের ফ্ল্যাটটা ঠিক গোগোলদের মতোই। ওদের শোবার, বসবার, খাবার, রান্নাঘর আর বাথরুমের ওপর ওপরের ফ্ল্যাটেও একই রকম সব।

বঙ্কিমদা ঘরের মধ্যে ঢুকল। সে গোগোলদের বাড়িতে অনেক দিন আছে। গোগোলের জন্মের সময় থেকে। বঙ্কিমদা ওকে রীতিমতো শাসন করে। বাবা-মা’র সেই রকম নির্দেশ আছে। গোগোল জিজ্ঞেস করল, “বঙ্কিমদা, আমাদের ওপরের ফ্ল্যাটে কোনও কাজ হচ্ছে?”

“কী কাজ হবে?” বঙ্কিমদা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের ওপরে তো টুকাইদের ফ্ল্যাট।”

গোগোল তা জানে। টুকাই ওর বন্ধু। ওদের ফ্ল্যাটের নাম্বার বাষট্টি-এ। টুকাইদের ফ্ল্যাটে কি কোনও কাজ হতে পারে না? গোগোল বলল, “টুকাইদের ফ্ল্যাটে বোধহয় কিছু কাজ হচ্ছে।”

“কী সব আজেবাজে কথা বলছ?” বঙ্কিমদা কাঠের আলমারি খুলে কী যেন বের করে নিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “তোমার জ্বরটা বেড়েছে নাকি?”

গোগোল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন, জ্বর তো বাড়েনি।”

বঙ্কিমদার যেন বিশ্বাস হল না। খাটের কাছে এসে গোগোলের কপালে হাত দিয়ে দেখে, চোখ কপালে তুলে বলল, “এ কী, জ্বর তো বেশ ভালই রয়েছে। বেড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। তাই তুমি টুকাইদের ফ্ল্যাটে শব্দ শুনতে পাচ্ছ! কিন্তু ওদের ফ্ল্যাট তো খালি। কেউ নেই। ওরা কয়েক দিনের জন্য কলকাতার বাইরে কোথায় গেছে। জ্বরের ঘোরে ও-রকম অনেক কিছু শোনা যায়। চুপ করে শুয়ে থাকো।”

বঙ্কিমদা হাসতে হাসতে ঘরের বাইরে চলে গেল। গোগোলের মনে পড়ে গেল, তাই তো! টুকাইরা যে ওর মামাতো দিদির বিয়েতে কয়েকদিনের জন্য কৃষ্ণনগর গেছে। তা হলে কি ও ঠুকঠুক ঘঁসঘঁস কোনও শব্দ শোনেনি? নেহাতই জ্বরের ঘোরে ভুল শুনেছে? কথাটা ভাবতেই বেশ স্পষ্ট সেই ঠুকঠুক শব্দ আবার শোনা গেল! খুব আস্তে শব্দটা হচ্ছে। ঠিক যেন গোগোলের মাথার ওপরেই শব্দটা হচ্ছে। এখন তো ও আর তন্দ্রার ঘোরে নেই। রীতিমতো চোখ চেয়ে জেগে শুয়ে আছে। কোনও সন্দেহ নেই। শব্দটা হচ্ছে ওর মাথার ওপরে, ঘরের মেঝেয়। অথচ টুকাইদের ফ্ল্যাটে কেউ নেই!

গোগোল উত্তেজনায় উঠে বসল। আর তৎক্ষণাৎ শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল। কী রে বাবা! যেন ওপরে, তন্দ্রা ভাঙা আর উঠে বসার সঙ্গে শব্দ থেমে যাবার একটা যোগ আছে? ও মুখ তুলে তাকাল। সিলিং পাখা বন্ধ করা আছে। তাকিয়ে দেখে বোঝার কিছুই নেই। নিজেরই সন্দেহ লাগে, সত্যি শব্দটা শুনেছে কি না।

আবার আচমকা বেশ ভারী কিছু পড়ার একটা শব্দ হল। কিন্তু শব্দটা এ-ঘরের মাথার ওপরে মেঝেয় হয়নি। পাশের বা পশ্চিমের ব্যালকনির দিকে ঘরের মেঝেয় যেন শব্দটা হল। বেশ ভারী কিছু যেন হঠাৎ পড়ে গেছে। শব্দটা হল মাত্র একবার। আর কোনও শব্দ নেই।

গোগোল ওপরের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। মনেই হচ্ছে না, ওপরের কোনও শব্দ হয়েছে। সব চুপচাপ। কিন্তু শব্দ যে হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গোগোল ওর নিজের কানকে এতটা অবিশ্বাস করতে পারে না। আর এই শব্দের অভিজ্ঞতা ওর ছেলেবেলা থেকেই ভারী গোলমেলে। কাশ্মীরে পহলগামে বেড়াতে গিয়ে, একটা অদ্ভুত গাড়ির ভেতরে ইঁদুরের ঠুকঠুক শব্দ শুনে কী ভয়ংকর ঘটনাই না ঘটেছিল! বিরাট এক ব্যাঙ্ক-ডাকাতির ডাকাতরা আর টাকা সবই ধরা পড়েছিল। এই বাড়িরই ছ’তলায় ডাবুদাকে যখন চুরি করা হয়েছিল, গোগোল তখন সেই ফ্ল্যাটের ভেতরে একজনের গলার স্বর শুনতে পেয়েছিল। অথচ মহেশানিদের ফ্লাট তখন খালি ছিল। ডাবুদাকে সেই ফ্ল্যাটেই পাওয়া গেছল।

গোগোলের হঠাৎ মনে হল টুকাইরা ফিরে আসেনি তো? বঙ্কিমদা হয়তো জানে না। কথাটা মনে হতেই, ও খাট থেকে আস্তে আস্তে নামল। মা টের পেলে খুব রেগে যাবেন। আর ও কী করতে যাচ্ছে, সে-কথা তো মাকে বলাই যাবে না। ওকে বাবার ঘরে যেতে হলে, বসার ঘরের ওপর দিয়েই যেতে হবে। তবে বসার ঘরের মাঝখানে যেতে হবে না। বসার আর খাবার ঘরের পাশ দিয়ে বাবার ঘরে যাওয়া যায়। ও ঘরের দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে বসার ঘরের দিকে উঁকি দিল। মা আর রেখামাসিকে খানিকটা দেখা যাচ্ছে। দু’জনেই এত ব্যস্ত, এদিকে তাকাবার সময় নেই।

গোগোল ঘর থেকে বেরিয়ে, বাঁ দিকে ঘুরে বাবার ঘরের দরজায় চলে গেল। বঙ্কিমদা দেখলে মা জেনে যাবেন। ও বাবার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। বাবার ঘরেই টেলিফোনটা থাকে। টুকাইদের টেলিফোন নাম্বারও গোগোলের মনে আছে। ওর ধারণা টুকাইরা কৃষ্ণনগর থেকে ফিরে এসেছে, নইলে ওইরকম শব্দ হতে পারে না। ও টেলিফোনের কাছে গিয়ে রিসিভার তুলে ডায়াল করল। টুকাইদের ফ্ল্যাটে টেলিফোন বাজছে। এখন টুকাই ইস্কুলে গেছে। ওর বাবা অফিসে গেছেন। ওর মা বা দিদি টেলিফোন ধরতে পারেন। কিন্তু কেউ টেলিফোন ধরছেন না। বেজেই যাচ্ছে।

গোগোল রিসিভারটা চোখের সামনে তুলে দেখল। আবার কানে চাপল। সন্দেহ হল, ঠিক নাম্বার ডায়াল করেছিল তো? সন্দেহ হতেই, রিসিভার নামিয়ে রেখে আবার তুলল। ডায়ালের শব্দ হচ্ছে। টুকাইদের নাম্বারটা মনে মনে আউড়ে প্রত্যেকটি নাম্বার ধরে ধরে ডায়াল করল। রিং হচ্ছে। কিন্তু সেই একই ব্যাপার। বেজেই যাচ্ছে। কেউ লাইন ধরছে। না। গোগোল বেশ খানিকক্ষণ শুনে, হতাশ হয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল। হয় টুকাইদের টেলিফোন খারাপ আছে, গোগোল শুনতে পাচ্ছে, অথচ ওদের ফোনে বাজছে না। অথবা ওরা সত্যি সত্যি কৃষ্ণনগর থেকে ফেরেনি। তা হলে যে ভারী মুশকিল!

গোগোল পা টিপে টিপে আবার নিজের ঘরে ফিরে এল। খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করতে দেখলেই মা রেগে যাবেন। ও খাটের ওপর উঠে বসল! আর ভাবল, তবে শব্দগুলো কোথা থেকে এল? ও কি সত্যি ভুল শুনেছে? বসে না থেকে ও আবার শুয়ে পড়ল। এখন কোনও শব্দই শোনা যাচ্ছে না। ও শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইটা টেনে নিল। সব গল্পই পড়া। মাঝখান থেকে একটা পাতা খুলল। শরদিন্দুবাবুর গল্প একবার-দু’বারের বেশিও পড়া যায়।

পাতা মেলেও গল্প পড়া হল না। আবার শব্দ! করাত ঘষার শব্দ। খুব আস্তে শব্দটা শোনা যাচ্ছে। করাত যে কাঠের ওপর চলছে না, তা বোঝা যায়। টিন বা লোহার ওপরে খুব আলতো চেপে একটা কিছু চালানো হচ্ছে। আর শব্দটা স্পষ্ট ওর মাথার ওপরেই হচ্ছে। মিনিটখানেক শব্দটা হল। হঠাৎ ওপরের মেঝের ওপর ঠং করে একটা কিছু পড়ে যেন একটু গড়িয়ে গেল, তারপরেই আবার শব্দ বন্ধ। টুঁ শব্দটিও নেই।

গোগোল আবার উঠে বসল। এখনও কি ওর নিজের কানকে অবিশ্বাস করতে হবে? এও কি জ্বরের ঘোর? এর পরে ওর ওপরে যাওয়া ছাড়া। কী উপায় আছে? ওকে ওপরে গিয়ে দেখতে হবে, টুকাইরা আছে কি নেই। না থাকলে, শব্দ কেন হচ্ছে? কারাই বা শব্দ করছে? ইঁদুর, ছুঁচোতে ওই রকম শব্দ করতে পারে না। কিন্তু এ রকম জ্বর নিয়ে, যদি বা বাবার ঘরে যেতে পেরেছিল, ওপরে উঠতে পারবে কি? অবিশ্যি দরজা খুললেই লিফট। কিন্তু মা যদি দেখতে পান। ও ফ্ল্যাটের বাইরে এক পা-ও বেরোতে পারবে না। তা ছাড়া বেরোতে গিয়ে যদি মাথা ঘুরে পড়ে যায়?

“কী ব্যাপার গোগোল?” মা দরজায় উঁকি দিলেন, “বসে কী করছ? জ্বর-গায়ে তোমাকে আমি শুয়ে থাকতে বলেছি।”

গোগোল কিছু বলতে যাচ্ছিল। রেখামাসি ঘরে ঢুকে খাটের সামনে চলে এলেন। গোগোলের কপালে আর গলায় হাত দিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন, “এ কী, জ্বর তো বেশ ভালই রয়েছে। চোখও লাল দেখাচ্ছে। শুয়ে পড়ো গোগোল।”

“গোগোল সত্যি বড় অবাধ্য হয়েছে”, মা বললেন, “ইস্কুলে খেলতে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগিয়ে জ্বর করেছে। শুয়ে থাকতে বলেছি। দ্যাখ, উঠে বসে আছে।”

গোগোল বাধ্য হয়ে শুয়ে পড়ল। রেখামাসি বেরিয়ে গেলেন। মা রেখামাসিকে বাইরের ঘরের দরজায় এগিয়ে দিতে গেলেন। আর তখনই আবার ঠুকঠুক শব্দ শোনা গেল। ও কি জ্বরের ঘোরে শব্দ শুনছে? মা, বঙ্কিমদা, কারও কানেই কি এই হঠাৎ হঠাৎ শব্দ যাচ্ছে না? ভাবতে ভাবতেই ঠুকঠুক শব্দ থেমে গেল। গোগোল ওপরের দিকে তাকাল। কিন্তু সেই করাত চালাবার শব্দটা শোনা গেল।

মা রেখামাসিকে বিদায় দিয়ে ঘরে এলেন। খাটের সামনে গিয়ে গোগোলের কপালে হাত দেবার আগেই বললেন, “চোখ দেখেই অবস্থা বোঝা যাচ্ছে। সেই আগের মতোই একশো দুই জ্বর রয়েছে। আমি চান করে এসে থারমোমিটার দিয়ে দেখব। ওষুধও খাওয়াব। উঠবে না একদম। শুয়ে থাকবে।”

গোগোল তখন অবাক। মা ঘরে ঢোকামাত্র শব্দটা বন্ধ হয়ে গেছে। ও কিছু বলতে পারল না। মা যেমনি বেরিয়ে গেলেন, আবার শব্দটা শোনা গেল। কিন্তু শব্দ কি কেবল এ-ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে? মা বা বঙ্কিমদার কানে কি শব্দ যাচ্ছে না? কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে গোগোল উঠে বসল। খাট থেকে আস্তে আস্তে নামল। বুঝতে পারছে, ফ্ল্যাটের বাইরে যাওয়া হবে না। বঙ্কিমদা টের পাবে। একটা হইচই লেগে যাবে। ও আবার বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকল। টেলিফোনের রিসিভার তুলে একটা নাম্বার ডায়াল করল। সঙ্গে সঙ্গে ওপার থেকে একজন ভদ্রলোকের মোটা গম্ভীর স্বর ভেসে এল, “ইয়েস।”

“অমি বাতায়নী বিল্ডিং-এর বাহান্ন নম্বর ফ্ল্যাট থেকে বলছি।” গোগোল বলল।

ওপার থেকে ভদ্রলোক মোটা গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “কে কথা বলছেন আপনি? কোনও মহিলা?”

“না। আমি গোগোল বলছি।”

“তোমার গলার স্বরটা এ রকম নাকি নাকি শোনাচ্ছে কেন?”

“আমার জ্বর হয়েছে।”

“কী দরকার বলো।”

গোগোল ঘটনাটা বলল। ওপার থেকে মোটা গম্ভীর স্বর ভেসে এল, “জ্বরের ঘোরে এসব শুনছ। ঠিক আছে। যাও শুয়ে থাকোগে। ওসব শব্দ নিয়ে তোমাকে জ্বর-গায়ে আর মাথা ঘামাতে হবে না।”

গোগোল বুঝল, কিছুই হবে না। ও রিসিভার নামিয়ে রেখে টলতে টলতে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল।

গোগোল ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমোবার আগে, ও সেই শব্দ শুনেছিল। ঘুমটা ভাঙল প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ শুনে। শব্দটা ওর মাথার ওপরেই হয়েছে। তারপরেই ওদের কলিংবেল বেজে উঠল। আর ওপরেও তখন ধুপধাপ অনেক শব্দ শোনা যাচ্ছে। ও শুয়ে শুয়েই শুনল, বাইরের ঘরে অনেকের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। তার মধ্যে টেলিফোনে-শোনা সেই গম্ভীর স্বরও। তিনি তখন জিজ্ঞেস করছেন, “কই কোথায় গোগোল? ওর কাছে আমাকে একবার নিয়ে চলুন।”

মা’র সঙ্গে ঘরে ঢুকলেন উনিফর্ম-পরা একজন পুলিশ অফিসার। বেশ দশাসই তাঁর চেহারা। গোগোল তাঁকে চেনে। ওদের লোকাল থানার অফিসার-ইন-চার্জ। তিনি তাড়াতাড়ি খাটের কাছে এসে গোগোলের কপালে হাত দিলেন। বললেন, “ও যে ঘামছে। মিসেস চ্যাটার্জি, দেখুন তো জ্বরটা কি ছাড়ছে?”

মা এসে দেখলেন, গোগোল সত্যি ঘামছে। শিয়রের কাছে রাখা তোয়ালে দিয়ে গোগোলের জামার ভেতরে মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন, “এর মধ্যে তুমি আবার কী ঘটিয়েছ?”

“ঘটিয়েছে খুব মোক্ষম ঘটনাই।” থানার ওসি বললেন, “আপনারা শুনতে পাননি, আপনাদের মাথার ওপরের ফ্ল্যাটে চুপচাপ মস্ত ডাকাতি হয়ে যাচ্ছিল। একটা স্টিলের আলমারিকে পেট কাটার মতো, মাঝখান থেকে কেটে ফাঁক করে ফেলেছে। ভেতরে রয়েছে সোনার গহনা, নগদ টাকা। আরও অনেক কিছু। গোগোল জ্বরের ঘোরে যেটুকু শুনেছে, তাই আমাকে টেলিফোনে জানিয়ে দিয়েছে। জ্বরের ঘোরে হলেও, গোগোলের কানে যখন ঢুকেছে তখন আমি তো ছাড়তে পারিনি। খুব সময়মতো এসে পড়েছিলুম যা হোক।”

গোগোলের বুকের মধ্যে তখন ধকধক করছে। জিজ্ঞেস করল, “মা, আমি একটু উঠে বসব?”

“বোসো।” মা নিজেই গোগোলকে উঠে বসতে সাহায্য করলেন।

ঘরের মধ্যে তখন অন্যান্য ফ্ল্যাটের অনেক মহিলা, পুরুষ এসেছেন, ও-সি তাঁর টুপি খুলে বললেন, “গোগোল, জ্বরের ঘোরে তুমি আজ মস্ত বড় ডাকাতি ধরিয়ে দিয়েছ। তুমি সন্দেহ না করলে, কিছু ধরা পড়ত না। দাও, তোমার হাত দাও।”

গোগোল হাত বাড়াবার আগেই ও-সি তাঁর মস্ত বড় হাত বাড়িয়ে গোগোলের হাত ধরলেন, বললেন, “এবার তোমার জ্বর সেরে যাবে। পরে আবার আসব। এখন ডাকাত-মহাশয়দের একটা হিল্লে করি।”

গোগোলের দিকে সবাই অবাক মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলেন, গোগোল মায়ের কাঁধের কাছে মুখটা গুঁজে দিল। মা ওর মাথায় হাত দিলেন। জানালা দিয়ে তখন বিকেলের রোদ ঘরের মেঝেয় এসে পড়েছে।

২৩ ডিসেম্বর ১৯৮৭

অলংকরণ: অনুপ রায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *