1 of 2

জ্ঞান দিতে দিতে অজ্ঞান

জ্ঞান দিতে দিতে অজ্ঞান

মানুষ মানুষকে জ্ঞান দিতে দিতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। একসময় এইরকম ছিল, মানুষ বলতে পারত, যাক বাবা, হাঁপ ছেড়ে বাঁচা গেল, কিছুক্ষণের জন্যে শান্তি!

শান্তি কেন বউদি?

অফিসে চলে গেল। সন্ধে সাতটা পর্যন্ত শান্তি। এখন যত পারুক জ্ঞান দিক। এটা সেকেলে কথা। সমস্ত মানব-প্রাণী এখন স্যাটেলাইট-এর আঁটোসাঁটো বাঁধনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াজড়ি অবস্থা। উলজড়ানো পমেরিয়ান। লোমওয়ালা দুষ্টুমিষ্টি কুকুর। সেকালের মিসিবাবাদের পাস টাইম ছিল, উল আর কাঁটা। নাকের ডগায় ন্যাজাল চশমা। মাথায় ফিরিঙ্গি খোঁপা। বাকেট চেয়ারে গাউন পরে বসে আছেন। পায়ের কাছে উলের গোলা। হাতে জোড়া কাঁটা। আদুরে। কুকুর উলের গোলা নিয়ে খেলছে। উলটে-পালটে, ডিগবাজি খেয়ে, মুখে নিয়ে ছুটছে এ-কোণে, ও-কোণে। শেষকালে জড়াজড়ি। কসমিক তরঙ্গে জড়িয়ে গেছি আমরা। দূরে কিন্তু কাছে। বুক পকেটে জগৎ। প্রত্যেককেই দেওয়া আছে লং-রোপ। ছিপের মাছ। লাটাইয়ের ঘুড়ি।

শান্তি কোথায়! বেজে উঠল ফোন সংগীত। শান্তি, অশান্তি সংগীতেই বেজে ওঠে। সে ইট উইথ ফ্লাওয়ারস-এর মতো, সে ইট ইন মিউজিক। তিনি বাড়িতে নয় গাড়িতে; কিন্তু বাড়ির সঙ্গে যোগসূত্র পটাং হয়নি।

গৃহিণী খুব মোলায়েম গলায় টানা সুরে বললেন, হ্যালোওও।

ওদিক থেকে এল বোমা, গিজারটা দয়া করে অফ কোরো। এ মাসে পাঁচ হাজার বিল এসেছে। এর পর হাঁড়ি শিকেয় উঠবে।

পাশে যে ভদ্রলোক তাঁর কানেও ফোন। কথা বলছিলেন তিনিও। বলে উঠলেন, ওই শোনো, পাঁচ হাজার টাকা বিল। কার? ভদ্রলোক জিগ্যেস করলেন, আপনার নাম?

সুব্রত।

ভদ্রলোক বললেন, সুব্রতবাবু। তারপর ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, আমার স্ত্রীকে একটু দাবড়ে দিন তো। কিছুতেই পাখা বন্ধ করে না!

আমি?

হ্যাঁ, আপনার পার্সোনালিটি সাংঘাতিক, প্রেম করে বিয়ে তো, আমারটা ধকে গেছে। আপনার নিশ্চয় সম্বন্ধ করে?

প্রেম।

অ্যাঁ—তাহলে? পার্সোনালিটি মেনটেন করছেন কী করে?

এখন ঝগড়ার ফেজ চলছে, তিন দিন বাক্যালাপ বন্ধ। মোবাইলে ঝাড় দিই। ময়দানের কাছে গিয়ে আবার একটু দোব।

এবারের ইস্যু?

বাথরুমে যে-আংটিটা পড়ে আছে, সেটা কার?

উঃ, মশাই, সব মেয়েই কি এক?

হ্যাঁ, ছানা এক, ছাঁচ আলাদা।

কে আগে কথা বলবে, আপনি?

নো, সে বলবে।

কবে বলবে?

হয়ে এসেছে। এই হ্যালো দিয়ে বুঝতে পারি। টেস্ট। গান জানেন?

জানব না! ছাত্রীকেই তো বিয়ে করেছি।

মরেছে! গানের মাত্রার মতো হ্যালোতে যে ও আছে, সেটার মাত্রা যত বাড়বে বুঝতে হবে হয়ে এসেছে। হ্যালোঃ-ঘোঁত। ধোঁয়া বেরোচ্ছে। হ্যালো-ও-ও-ও-তিন মাত্রা, চার মাত্রা, নিবে আসছে।

এই শক্তিশালী, নীল রশ্মি বিচ্ছুরণকারী ক্ষুদ্র যন্ত্রটি আমাদের হাটে-হাঁড়ি-ভাঙা অবস্থা করে দিয়েছে। সব গোপনীয়তার অবসান। পেটিকোট পরা অবস্থা। সকলেই কথা বলছে। অনবরত বলছে। বক্তাকে দেখা যায়। কালোয়াতদের মতো একটা হাতে কান চাপা। শ্রোতা অদৃশ্য। বক্তার মুখচোখের ভাব দেখে বোঝা যায়, ও-প্রান্ত থেকে ডিজিটাল, বাক্যস্রোতে কী আসছে— অমৃত না হলাহল।

আগে লোক ফর্দ হাতে বাজারে যেত, এখন মোবাইল পকেটে। পকেটে রাখলে মেরে দিতে পারে, তাই বাঁ হাতে। ডান হাত এই জগতের আলু-পটলে, বাঁ হাত মহাতরঙ্গের মহাবিশ্বে। সামনে ঝুঁকে ডোরাকাটা পটল বাচ্ছেন, হঠাৎ বেজে উঠল নানা সুরে। হ্যালো। হ্যাঁ বলো! পটল নেবো না। তাহলে? মুখী কচু। কচু, কচু কচু তো! আর কী? জোরে বলো। আঃ, কল ড্রপ করছে! পাশের ভদ্রলোকও বেজে উঠলেন। আঃ, থামান না মশাই! আপনি থামান না। কচু তো হয়ে গেছে! হলে কী হবে। আর একটা কী বলছে যে!

বলতে দিন, ওদের বলার শেষ নেই। কে বলে, মেয়েরা অবলা। বলে, বলে শেষ করে দিলে। এক-একটি শাবল।

আমরা তাহলে কী?

কুড়ুল। সারা জীবন কাঠ কেটে চলেছি।

শ্রাদ্ধ হচ্ছে। পুরোহিতমশাই আসনে। সামনে মাথাকামানো যজমান। আশি মাইল স্পিডে মন্ত্রপাঠ চলেছে। পূর্বপুরুষরা জড়াজড়ি করে আসছেন, যাচ্ছেন। এইবার পিণ্ডোৎসর্গ। সরু সরু কুশ পাতা জায়গাটিতে তিল-মাখানো পিণ্ড-গোলকটি অদ্ভুত কায়দায় গড়িয়ে দিতে হবে।

তার ওপর পড়বে কনুই দিয়ে গড়িয়ে আসা জল। টেকনিক্যাল ব্যাপার।

পুরোহিতমশাই তাঁর সেলফোনটি যজমানের হাতে দিয়ে বললেন, অন করা আছে। হেঁকে বলল, পিতা গ্রহণ করুন। মহাকাশে ছড়িয়ে গেল বার্তা, আমাদের চটকানো পিণ্ডি গ্রহণ করুন, করুন, করুন…। করুণ নিবেদন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *