জ্ঞানপথ

জ্ঞানপথ

শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন: নানা জ্ঞানের নাম অজ্ঞান। … এক ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন, এই নিশ্চয় বুদ্ধির নাম জ্ঞান। (১-১৮-২) যাঁরা উপনিষদ্‌-চর্চা করেন, তাঁরা জানেন যে, সমস্ত উপনিষদের মূল বক্তব্য এই যে, এক আত্মা—এক আত্মাই সর্বভূতে বিরাজ করছে। আমাদের দেশের অত্যন্ত অজ্ঞ হিন্দুও এই কথাটা জানে। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়, আকাশে চন্দ্র রয়েছে—তার ছায়া খাল-বিল-ডোবা-পুকুর-সমুদ্র—নানা জায়গায় পড়েছে। মনে হচ্ছে যেন বহু চাঁদ—কিন্তু আসলে ‘বহু’ নয়, ‘এক’। ‘একধা বহুধাশ্চৈব দৃশ্যতে জলচন্দ্রবৎ’। ঠিক তেমনি এক আত্মা, এক ব্ৰহ্ম—বিভিন্ন নাম রূপের জন্য ‘বহু’ বলে মনে হচ্ছে। এই ‘মনে হচ্ছে’ কথাটা মনে রাখতে হবে। আসলে ‘বহু’ নয়, আসলে ‘এক’—‘বহু’ বলে মনে হচ্ছে শুধু। এই ‘মনে হওয়া’টা ভুল। জ্ঞানপথের লক্ষ্য সেই ভুলটা দূর করা। ‘বহু’ দেখব না আমি, ‘এক’ দেখব—এমনকি ‘দুই’ পর্যন্ত নয়। যাঁরা ভক্তিপথে চলেন, তাঁরা ‘দুই’ দেখেন। ‘ভক্ত’ আর ‘ভগবান’ এই দুজন। কিন্তু জ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে সেটাও অজ্ঞান। কোন দ্বৈতবুদ্ধি থাকা চলবে না। এক আত্মা, এক ব্ৰহ্ম। অখণ্ড সচ্চিদানন্দ। এ ছাড়া আর কিছু নেই। শ্বেতাশ্বতর-উপনিষদে বলছে: ‘একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ’—সর্বভূতে তিনি গভীরভাবে নিহিত আছেন। তিনি ‘সর্বব্যাপী’। ‘সর্বভূতান্তরাত্মা’—সকলের অন্তরাত্মা তিনি। অথচ ব্যবহারিক জগতে আমরা কিন্তু ‘বহু’ দেখি। কতরকমের মানুষ—কেউ লম্বা, কেউ বেঁটে, কেউ সুন্দর, কেউ সুন্দর নয়, কারও খুব বুদ্ধি, কেউ বা একেবারে নির্বোধ। এই বিশেষণগুলিকে ‘উপাধি’ বলা হচ্ছে। ব্রহ্ম ‘নিরুপাধিক’—তাঁর কোন উপাধি নেই। তাঁর উপর এই ‘উপাধি’গুলো যেন আরোপ করা হয়েছে। যার ফলে এক ব্ৰহ্ম বহু হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছেন। শাস্ত্রে বলছে যে, ‘মায়া’র জন্য এরকম হচ্ছে। মায়ার জন্যই উপাধি, মায়ার জন্য আমরা ‘এক’কে ‘বহু’ দেখছি, মায়ার জন্যই আমরা বুঝতে পারছি না যে, আমরাও সেই ব্রহ্ম।* মায়ার সম্বন্ধে আমাদের শাস্ত্রে ‘অনির্বচনীয়’, ‘অঘটনঘটনপটীয়সী’—এইরকম সব বিশেষণ দেওয়া হয়েছে। মায়ার কোন ব্যাখ্যা নেই। কেন এই মায়া এল বলা যায় না। আছে—এই পর্যন্ত। আছে, স্বীকার করে নিতে হবে।

জ্ঞানপথে যিনি চলেন, তাঁর সবসময় চেষ্টা এই মায়াজাল ছিন্ন করা। ভক্তিপথে যিনি যাচ্ছেন, তিনিও মায়া স্বীকার করেন। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অন্য। মায়াকে তিনি অনুনয়-বিনয় করে বলেন: দয়া করে তুমি পথ ছেড়ে দাও, কিংবা তাঁর ইষ্টকে তিনি বলেন: মায়া তো তোমারই, তুমি কৃপা করে তোমার মায়ার হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর। কিন্তু জ্ঞানপথে যিনি যাচ্ছেন, প্রথম থেকেই তাঁর মনোভাব ‘যুদ্ধং দেহি’। বিচারের খড়্গ তাঁর হাতে। তা দিয়ে তিনি মায়াজাল ছিন্ন করবেন। প্রথম থেকেই তিনি বলেন: ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা।

জগৎটা মিথ্যা কি করে হল? এই যে চোখের সামনে জগৎ দেখছি—এত পরিষ্কার, এত স্পষ্ট—একে বলব মিথ্যা? মিথ্যা এই অর্থে যে, পরিবর্তনশীল। ‘জগৎ’ শব্দটা এসেছে ‘গম্‌’ ধাতু থেকে। ‘গম্‌’ অর্থাৎ চলা। ‘সংসার’ শব্দটা এসেছে ‘সৃ’ ধাতু থেকে। ‘সৃ’ অথাৎ সরে যাওয়া। এই জগৎ বা সংসার—এ চলছে, সরে যাচ্ছে—প্রতিনিয়ত এর পরিবর্তন হচ্ছে। যা পরিবর্তনশীল তা কখনও সত্য হতে পারে না। আমরা তাকেই সত্য বলি যা ‘ত্রিকাল-অবাধিত’। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ তিনকালেই যা একরকম আছে। এই বাড়িটা এখন আছে, কিন্তু একশ বছর আগে ছিল না, আবার একশ বছর পরেও হয়তো থাকবে না। কাজেই এই বাড়িটা সত্য নয়। আমার এই শরীরটা একশ বছর আগে ছিল না, আবার কয়েক বছর পরেও হয়তো থাকবে না। কাজেই এই শরীরটা সত্য না। তাজমহল অনেকদিন আগে তৈরী হয়েছে, আরও বহু যুগ হয়তো পৃথিবীতে থাকবে, কিন্তু এক হাজার বছর আগে তো এই তাজমহল ছিল না— কাজেই তাজমহল সত্য নয়। এইভাবে দেখলে দেখা যাবে, জগতের কোন কিছুই সত্য নয়। তবুও জগৎটাকে সত্য বলে মনে হয় কেন? মায়া বা অজ্ঞানের জন্য। বেদান্তে বলে: জগৎটা হচ্ছে ‘রজ্জুসৰ্পবৎ’ বা ‘রজতশুক্তিবৎ’। আলো-অন্ধকার মেশানো একটা জায়গায় একটা দড়ি পড়ে আছে। ভাবলাম, সাপ; ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। কিংবা, একটা ঝিনুক পড়ে আছে, আলোয় চকচক করছে। ভুল করে ভাবলাম, রুপে বুঝি। জগৎটাকেও আমরা এরকম ভুল করে সত্যি ভাবছি। মায়ার জন্য এরকম হচ্ছে। মায়ার দুটো শক্তি— আবরণী আর বিক্ষেপী শক্তি। প্রকৃতপক্ষে জগৎ বলে কিছু নেই, ব্ৰহ্মই শুধু আছে। কিন্তু মায়ার জন্য ব্রহ্মের স্বরূপটা আবৃত হয়ে যাচ্ছে—ঠিক যেমন অন্ধকারের জন্য দড়িকে দড়ি বলে চিনতে পারছি না বা ঝিনুককে ঝিনুক বলে বুঝতে পারছি না। এটা হয় মায়ার আবরণী শক্তির জন্য। আর মায়ার বিক্ষেপী শক্তির জন্য পরিদৃশ্যমান জগৎটাকে দেখছি, যা নেই তাকে দেখছি, যা সত্য না তাকে সত্য বলে ভাবছি। যেমন, সাপ ছিল না—অথচ সাপ দেখছিলাম, রুপো ছিল না অথচ রুপো দেখছিলাম। তবে এই যে ভুল দেখছিলাম, এই ‘ভুল দেখাটা’ সম্ভব হয়েছে এর পেছনে একটা সত্যবস্তু আছে বলেই। ‘দড়ি’ আছে বলেই সাপ দেখতে পেরেছি, ঝিনুক ছিল বলেই তো ভুল করে রুপো দেখেছিলাম। তেমনি এই যে পরিদৃশ্যমান জগৎ, এটাই প্রমাণ যে এর পেছনে একটা সত্যবস্তু আছে। এর পেছনে একটা ‘অধিষ্ঠান’ আছে। সেই অধিষ্ঠানই সত্য। তাঁকে আমরা বলি ব্রহ্ম বা আত্মা বা সচ্চিদানন্দ , কখনও বা বলি শুধু ‘তৎ’। অর্থাৎ ‘সেই’—‘That’। তাঁর সম্বন্ধে তো কিছু বলা যায় না—সেইজন্য বলা হচ্ছে ‘সেই’—‘তৎ’। জ্ঞানপথের লক্ষ্য এই ‘ত্রিকাল-অবাধিত’ সত্যকে জানা। জানা যে আমিই সেই সত্য। ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’। ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’। আমিই ব্ৰহ্ম, আর সবকিছুই সেই ব্ৰহ্ম। এই হচ্ছে জ্ঞান।

হিন্দুরা মুক্তিপিপাসু। কিন্তু জ্ঞান না হলে মুক্তি নেই। শঙ্করাচার্য বলছেন: ‘কুরুতে গঙ্গাসাগরগমনং, ব্রতপরিপালনমথবা দানম্‌। জ্ঞানবিহীনে সর্বমনেন, মুক্তির্ন ভবতি জন্মশতেন’—লোকে গঙ্গাসাগরে যায়, কত রকম ব্রত পালন করে, দানধ্যান করে। এর দ্বারা সবরকম পুণ্যই হয়তো হবে, কিন্তু জ্ঞান যদি না হয় তাহলে শতজন্মেও মুক্তি হবে না। মুক্তি কি? এখন আমি ‘অজ্ঞান’ আছি, অর্থাৎ আমিই যে ব্রহ্ম সেটা ভুলে আছি। এর ফলে বাসনায় তাড়িত হয়ে ভাল-মন্দ নানারকম কাজ আমি করে যাচ্ছি, আর সেই কর্মফল ভোগ করার জন্য বারবার আমাকে জন্মগ্রহণ করতে হচ্ছে; জন্মমৃত্যুর চক্রে ঘুরপাক খেতে হচ্ছে। মুক্তির অর্থ—এই চক্রের বাইরে যাওয়া—জন্মমৃত্যুর মধ্যে আমি যে যাতায়াত করে চলেছি, এই যাতায়াত বন্ধ করা। এটা সম্ভব হবে একমাত্র জ্ঞান হলে। কারণ, একমাত্র জ্ঞানই পারে কর্মবীজ ধ্বংস করতে। আমি আত্মহত্যা করলাম, তাহলেই কি আমার মুক্তি হয়ে গেল?—না। আবার আমি জন্মাব। কারণ, কর্মবীজটা রয়ে গেছে। যখন আমার জ্ঞান হবে, আমার স্বরূপটা যখন আমি জানতে পারব, তখন আমার কর্মবীজ ধ্বংস হবে, তখনই আমার মুক্তি হবে। ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন: কুমোরেরা হাঁড়ি রৌদ্রে শুকতে দেয়। দেখ নাই, তার ভিতর পাকা হাঁড়িও আছে, কাঁচা হাঁড়িও আছে? গরু-টরু চ’লে গেলে হাঁড়ি কতক কতক ভেঙ্গে যায়। পাকা হাঁড়ি ভেঙ্গে গেলে কুমোর সেগুলিকে ফেলে দেয়, তার দ্বারা আর কোন কাজ হয় না। কাঁচা হাঁড়ি ভাঙ্গলে কুমোর তাদের আবার লয়; নিয়ে চাকেতে তাল পাকিয়ে দেয়, নূতন হাঁড়ি তৈয়ার হয়। (২-১৩-১) ‘কাঁচা হাঁড়ি’ অর্থাৎ যার জ্ঞান হয়নি; ‘পাকা হাঁড়ি’ অর্থাৎ যার জ্ঞান হয়েছে। জ্ঞান যতক্ষণ হয়নি ততক্ষণ বারবার ‘কুমোরে’র হাতে যেতে হবে, অর্থাৎ জন্মগ্রহণ করতে হবে। কিন্তু জ্ঞানলাভ হ’লে আর এ সংসারে আসতে হয় না। পৃথিবীতে বা অন্য কোন লোকে যেতে হয় না। (ঐ) বলছেন: সিদ্ধ ধান পুঁতলে কি হবে? আর গাছ হয় না। মানুষ জ্ঞানাগ্নিতে সিদ্ধ হ’লে তার দ্বারা আর নূতন সৃষ্টি হয় না, সে মুক্ত হয়ে যায়। (ঐ) পঞ্চদশীতে আমরা এই উদাহরণটা পাচ্ছি—‘ভর্জিতানি তু বীজানি সন্ত্যকার্য্যকরাণি চ। বিদ্বদিচ্ছা তথেষ্টব্যাহসত্ত্ববোধান্ন কাৰ্য্যকৃৎ’—বীজটা ভাজা হয়ে গেলে তা থেকে আর গাছ হয় না। তেমনি মুক্তপুরুষের ইচ্ছা বা বাসনাও। সেই বাসনার জন্য তাঁকে কোন কর্মফল ভোগ করতে হয় না। কর্মবীজটা তাঁর ধ্বংস হয়ে গেছে। গীতাতেও বলছে:

যথৈধাংসি সমিদ্ধোহগির্ভস্মসাৎ কুরুতেহর্জন।

জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা॥

—আগুন যেমন কাঠকে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে, তেমনি জ্ঞানের আগুনও শুভ-অশুভ সমস্ত কর্ম ভস্মীভূত করে ফেলে।

তবে ‘প্রারব্ধ’ কর্মটা কিন্তু ভোগ করতেই হয়। তিন রকমের কর্ম আছে, ‘সঞ্চিত’, ‘প্রারব্ধ’ আর ‘ক্রিয়মাণ’। আমি ইহজন্মে এবং গত জন্মগুলোতে ভাল-মন্দ অনেক কাজ করেছি। সেই কাজের ফল সমস্ত জমা হয়ে আছে। ‘প্রারব্ধ’ কর্ম হচ্ছে সেই কাজ যা ফল দিতে শুরু করেছে। আর এখনও যেসব কাজ ফল দেওয়া শুরু করেনি, ভবিষ্যতে করবে—সেই কাজগুলিকে বলা হচ্ছে ‘সঞ্চিত’ কর্ম। আর ‘ক্রিয়মাণ’ কর্ম হল জ্ঞানলাভের আগে পর্যন্ত এই জন্মে আমি যা কিছু করব। জ্ঞান হলে ‘সঞ্চিত’ এবং ‘ক্রিয়মাণ’ কর্ম নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ‘প্রারব্ধ’টা থেকে যায়। ‘প্রারব্ধ’ কর্ম ভোগের দ্বারা ক্ষয় হয়। সেইজন্য জ্ঞানলাভ করবার সঙ্গে সঙ্গেই শরীর ত্যাগ হয় না। যতদিন না ‘প্রারব্ধ’ ভোগ শেষ হয় ততদিন শরীর থাকবে। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়, একটা চাকাকে কিছুদূর ঠেলে ছেড়ে দিলাম। এখন আর ঠেলছি না, কিন্তু চাকাটা তবুও কিছুদূর পর্যন্ত চলবে। তেমনি, জ্ঞানলাভ করলেও যতদিন না ‘প্রারব্ধ’ কর্মের ভোগ শেষ হয়, ততদিন শরীরটা থাকে। একে বলে ‘জীবন্মুক্ত’ অবস্থা। ‘জীবন্‌ এব মুক্তঃ’ অথাৎ জীবিত অবস্থাতেই মুক্ত।

ঠাকুর বলছেন: জ্ঞানের পথ বিচারের পথ। (জ্ঞানী) নেতি নেতি এই বিচার করে। ব্রহ্ম এ নয়, ও নয়; জীব নয়, জগৎ নয়। (১-২-৩)—এই বিচার করে সে। শাস্ত্রে বলছে, জ্ঞানপথে যে চলবে তার ‘নিত্য-অনিত্য-বস্তু-বিবেক’ থাকতে হবে। সংসারে নিত্য-অনিত্য মিশে আছে। বোঝা কঠিন কোন্‌টা নিত্য কোন্‌টা অনিত্য। মায়ার জন্য নিত্যকে অনিত্য মনে হয়, অনিত্যকে নিত্য মনে হয়। জ্ঞানপথে চলতে হলে অনিত্য থেকে নিত্যকে তফাৎ করতে জানতে হবে। কিরকম? না, হাঁসের মতো। ‘হংসস্য চ বিবেকোহস্তি জল-দুগ্ধ বিভাগয়োঃ’।হাঁসের সম্বন্ধে শোনা যায় যে, জল-দুধ একসাথে মিশিয়ে হাঁসকে খেতে দিলে হাঁস নাকি শুধু দুধটা খায়—জলটা ছেড়ে দেয়। জ্ঞানপথে যে চলছে, সে সবসময় অনিত্যকে বর্জন করে নিত্যবস্তুকে চিনে নেবে। সংসারে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে, কত বৈচিত্র্য দেখছি চারপাশে—এ সবকিছুর মধ্যে একটি বস্তু আছে যা অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত। সেই নিত্যবস্তু বা ব্রহ্মকে সবসময় আমি ধরে থাকব, তা বাদ দিয়ে সবকিছুকে বর্জন করব। কিভাবে নিত্য-অনিত্য চিনতে হবে আগেই বলেছি। নিত্য হচ্ছে সেই বস্তু যা চিরকাল আছে। সংসারের কত জিনিস আমাকে আকর্ষণ করে। একটা জিনিসের দিকে ছুটে গেলাম, তখন আমি ভাবছি সেটাই নিত্য। তারপর বিচার করে দেখলাম, এ চিরস্থায়ী নয়, অতএব নিত্য নয়। তাকে তখন আমি বর্জন করলাম। আবার হয়তো আর একটা জিনিসের দিকে ছুটলাম, সেটাও বিচার করে দেখলাম নিত্য নয়—তখন তাকেও বর্জন করলাম। এই হচ্ছে ‘নেতি নেতি’ বিচার। ‘নেতি’ অর্থাৎ ‘ন ইতি’—এটা নয়। এটা নিত্য নয়, ওটা নিত্য নয়—এরকম করে করে বাদ দিয়ে সব শেষে একটা জিনিস পাওয়া যাবে সেটা নিত্য। তাকেই আমরা বলছি ব্ৰহ্ম। ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন; ধর, অন্ধকার ঘরে বাবু শুয়ে আছে। আর একজন ঘরে ঢুকে তাকে খুঁজছে। কথা বলছে না, হাতড়ে হাতড়ে খুঁজছে। কৌচে হাত দিয়ে ভাবছে—এই কি বাবু?—না, এ বাবু নয়। জানলায় হাত দিয়ে ভাবছে—এই কি বাবু?—না, এও বাবু নয়। এইভাবে হাতড়াতে হাতড়াতে যখন বাবুর গায়ে হাত পড়ল, তখন আর কাউকে বলে দিতে হল না, সে নিজেই বুঝতে পারল যে, এ-ই বাবু; যাকে খুঁজছিলাম, এ-ই সেই লোক।

আমাদের শ্রুতিতে বলছে: নিত্যবস্তু বাইরে নয়, আমারই ভিতরে। ‘তত্ত্বমসি’—তুমিই সেই। যদি এক কথায় বলতে হয়, তাহলে সমস্ত জগতের প্রতি এই হচ্ছে ভারতবর্ষের বাণী। ‘নিত্য’ বলে কিছু যদি থাকে, শাশ্বত কিছু যদি থাকে, তাহলে তা বাইরে নয়—তোমারই ভিতরে। ‘খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে’। তুমিই সেই শাশ্বত বস্তু, তুমিই সেই ব্ৰহ্ম। নিজের মধ্যে তুমি তাঁকে ‘আবিষ্কার’ কর। তার জন্য কি কি করতে হবে? ‘শ্রবণ’ ‘মনন’ আর ‘নিদিধ্যাসন’। প্রথমে ‘শ্রবণ’ চাই। অর্থাৎ প্রথমে ব্রহ্মজ্ঞ গুরুর কাছে গিয়ে আত্মতত্ত্ব শুনতে হবে। ‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি’—অস্ত্রের দ্বারা আত্মাকে ছিন্ন করা যায় না। ‘নৈনং দহতি পাবকঃ’—আগুন আত্মাকে পোড়াতে পারে না। ‘ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ’—জল একে ভেজাতে পারে না, বা বাতাস একে শুষ্ক করতে পারে না। ‘অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে’—এই আত্মাকে অব্যক্ত, অচিন্ত্য এবং অবিকারী বলা হয়। ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’—শরীরের বিনাশ হলেও আত্মার কখনো বিনাশ হয় না। এইভাবে আত্মতত্ত্ব বর্ণনা করে গুরু আমাকে বলে দেবেন: তুমিই সেই আত্মা—‘তত্ত্বমসি’। ‘শ্রবণ’ হল, এবারে আমি ‘মনন’ করব অথাৎ গুরু যা বলে দিলেন সেটা ভাল করে ধারণা করতে চেষ্টা করব। গুরু আমাকে যা বলে দিয়েছেন তার সঙ্গে মিলিয়ে বিচার করে আত্মাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। বাইরের জগৎটাকে প্রথমে বিচার করলাম, দেখলাম যে সেটা অনিত্য। সেটা বর্জন করলাম। এবার আমি ‘অন্তঃপুরে’ এসেছি, নিজের মধ্যে নিজেকে খুঁজছি। আমার হাতিয়ার কিন্তু ঐ ‘নেতি নেতি’ বিচার। আমি দেহ নই, বুদ্ধি নই, মন নই—এগুলির একটাও আমি নই। কারণ, এগুলির ক্ষয় আছে, বৃদ্ধি আছে, বিকার আছে। এগুলি আমার স্বরূপ নয়। এগুলিকে বর্জন করে আমি আরও গভীরে চলে যাচ্ছি। নিজের উপরে নিজে যেন অস্ত্রোপচার করছি। ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন: এ যেন পেঁয়াজের খোসা একটার পর একটা ছাড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।

শঙ্করাচার্যের ‘নির্বাণষট্‌কম্‌’-এ দেখা যায় এই বিচার:১০

ওঁ মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে।

ন চ ব্যোমভূমির্ন তেজো ন বায়ুশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোহহং শিবোহহম্‌॥

—আমি মন নই, বুদ্ধি নই, অহঙ্কার নই, চিত্ত নই। আমি কান, জিভ, নাক কিংবা চোখও নই। আমি আকাশ নই, ভূমি নই, ‘তেজ’ অথাৎ আগুন নই, বায়ুও নই। এ সব কিছুই নই আমি। ‘নেতি নেতি নেতি’। আমি কি তাহলে? চিদানন্দরূপ শিব আমি। বলছেন: ‘ন চ প্রাণসংজ্ঞো’—তোমরা যাকে প্রাণবাযু বল, তা আমি নই। ‘ন বৈ পঞ্চবায়ুঃ’—প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান, উদান—এই পাঁচটিকে পঞ্চপ্রাণ বা পঞ্চবায়ু বলে। আমি এই ‘পঞ্চবায়ু’ও নই। এমনকি অস্থি, মজ্জা, রক্ত, শ্লেষ্মা, কফ প্রভৃতি যে ‘সপ্ত ধাতু’ আছে, তাও আমি নই। ‘চিদানন্দরূপঃ শিবোহহম্‌’—সচ্চিদানন্দস্বরূপ শিব আমি। সেই আমার স্বরূপ। আর এ সবকিছু ‘আমার’ উপর আরোপিত কতগুলি জিনিস। এইভাবে ‘মনন’ চলছে। পর পর ছয়টি শ্লোকে শঙ্করাচার্য বলে যাচ্ছেন, আমি এই নই, আমি সেই নই। আমার রাগ-দ্বেষ নেই, আমার মৃত্যু নেই, ভয় নেই, পিতা নেই, মাতা নেই, আমার বন্ধু বা মিত্র বলে কেউ নেই, আমার কেউ গুরু নয়, কেউ শিষ্যও নয়। ‘অহং নির্বিকল্পো নিরাকাররূপঃ’—আমি নির্বিকল্প, নিরাকার। আমার কোন বিকল্প নেই, কোন আকারও নেই। ‘বিভুত্বাচ্চ’—সর্বব্যাপী আমি। সবকিছুতে অনুস্যূত হয়ে আছি। ‘ন চাসঙ্গতং নৈব মুক্তিঃ’—আমি ছাড়া তো আর দ্বিতীয় কিছু নেই—তাই আমার কোন ‘সঙ্গ’ বা আসক্তি নেই। আর আমার মুক্তি বলেও কিছু নেই। কারণ, ‘বন্ধন’ থাকলে তো মুক্তির কথা ওঠে। ‘বন্ধন’ জিনিসটাই ভ্রান্তি। আমি যেখানে একা আছি সেখানে বন্ধনের প্রশ্নই ওঠে না। কে আমাকে বাঁধবে? কাজেই মুক্তির কথাও ওঠে না। চিরমুক্ত আমি। ‘ন মেয়’—আমাকে কেউ পরিমাপ করতে পারে না। ‘চিদানন্দরূপঃ শিবোহহং শিবোহহম্‌’। সচ্চিদানন্দস্বরূপ শিব আমি।

এইভাবে, আমার স্বরূপটা কি সে-সম্বন্ধে খুব পাকাপাকি একটা ধারণা করে নিলাম আমি। কিন্তু তা হলেই তো আর হবে না। এখনও পর্যন্ত আমি বুদ্ধি দিয়ে তত্ত্বটাকে ধরেছি। কিন্তু উপলব্ধি হয়নি। এবার আমাকে ‘নিদিধ্যাসন’ করতে হবে অথাৎ ‘আমি ব্রহ্ম’ এই ধ্যান করতে হবে। ধ্যান যখন খুব গভীর হবে, তখন মন-বুদ্ধি এগুলি লয় পেয়ে যাবে, ধ্যান-ধ্যেয়-ধ্যাতা এক হয়ে যাবে। একটুও ‘অহং’ নেই আর। নুনেব পুতুল সমুদ্রের জলে মিশে গেছে। আমার তখন ব্রহ্ম-উপলব্ধি হয়েছে। নির্বিকল্প সমাধি হয়েছে। ঠাকুর বলছেন: সমাধি না হলে ঠিক জ্ঞান হয় না।(২-২৪-৭) সমাধি অথাৎ নির্বিকল্প সমাধি। জ্ঞানপথের চরম অবস্থা এই নির্বিকল্প সমাধি। সমাধি হ’লে তাঁর সঙ্গে এক হওয়া যায়। আর অহং থাকে না। (ঐ) তখন ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ দর্শন হয়। (১-৩-৬) সব বিচার তখন থেমে গেছে। ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন: যতক্ষণ কলসী ভর্তি হয়নি ততক্ষণ ভক্‌ভক্‌ করে শব্দ হয়—বাতাসটা বেরিয়ে যায়। কলসী পূর্ণ হ’লে, কলসীর জল পুকুরের জল এক হ’লে আর শব্দ থাকে না। (১-৩-৪) আবার বলছেন; নেমন্তন্ন বাড়িতে যখন সবাই খেতে বসেছে, প্রথম প্রথম কত হৈ-হল্লা—ভাত নিয়ে এস, ডাল নিয়ে এস—। যেই একটা একটা করে খাবার পাতে পড়তে থাকে, অমনি শব্দও কমতে থাকে। যখন দই পড়ল তখন শুধু—‘সুপ্‌সুপ্‌’ শব্দ। খাওয়ার শেষে নিদ্রা—একটুও শব্দ নেই তখন। তেমনি পূর্ণ জ্ঞান হ’লে মানুষ চুপ হ’য়ে যায়। (ঐ) যত বিচার সব জ্ঞান হওয়ার আগে পর্যন্ত। জ্ঞান যখন হল, সমাধি হল, তখন সব বিচার স্তব্ধ। তখন ঐ কলসীর জল আর পুকুরের জল এক হয়ে গেছে। জীব আর ব্রহ্ম একাকার হয়ে গেছে। বেদান্তসারে বর্ণনা আছে:১১ ‘আনন্দৈকরসমখিলভেদপ্রতিভাসরহিতমখণ্ডং ব্রহ্মাবতিষ্ঠতে’। সমস্ত ভেদবুদ্ধি দূর হয়ে গেছে। ব্রহ্মের সাথে এতটুকুও ভেদ নেই, ভেদের একটু ‘প্রতিভাস’ বা ছায়া পর্যন্ত নেই। ‘অখণ্ডং ব্রহ্মাবতিষ্ঠতে’—অখণ্ড ব্রহ্ম আছেন শুধু, আর কিছু নেই। জীব ব্রহ্মে বিলীন হয়ে গেছে। আর কি? ‘আনন্দ-একরসম্‌’—আনন্দধারা বয়ে চলেছে। সেই আনন্দে ছেদ নেই কোন। জাগতিক আনন্দে ছেদ আছে। কিন্তু ব্রহ্মানন্দ নিরবচ্ছিন্ন। কাউকে সেই আনন্দের কথা বুঝিয়ে বলা যায় না। শুধু নীরবে আস্বাদন। ঠাকুর বলছেন: যে ঘি খায়নি তাকে কি করে বোঝাব, ঘি খেতে কেমন? বড়জোর বলা যেতে পারে—কেমন ঘি? না, যেমন ঘি। ব্রহ্মানুভূতির আনন্দও সেরকম। অপরিমেয় আনন্দ। যখনই তা ভাষায় প্রকাশ করতে যাওয়া হয়, তখনই যেন তাকে সীমিত করে ফেলা হয়। শুধু বলা যেতে পারে, অতুলনীয় আনন্দ। জাগতিক কোন আনন্দ সেই আনন্দের উপমা হতে পারে না। যিনি ব্রহ্ম উপলব্ধি করেন, সেই আনন্দে তিনি বুদ হয়ে থাকেন। ঠাকুর বলছেন: ব্রহ্মকে তিনি বোধে বোধ করেন। কিন্তু তিনি যে কি, মুখে বলতে পারে না। (ঐ) কারণ, যিনি ‘বাক্যমনাতীত’ তাঁকে কেউ ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না।

ঠাকুর বলছেন: জ্ঞানপথ—বড় কঠিন পথ। (১-৩-৬) কারণ, আমাদের দেহবুদ্ধিটা সহজে যেতে চায় না। আমি সচ্চিদানন্দ স্বরূপ, আমি সুখ-দুঃখের অতীত, আমি ইন্দ্রিয়ের বশ নই, এ সব কথা মুখে বলা খুব সোজা। কাজে করা, ধারণা হওয়া বড় কঠিন। কাঁটাতে হাত কেটে যাচ্ছে, দর্‌ দর্‌ ক’রে রক্ত পড়ছে, অথচ বলছি, কই কাঁটায় আমার হাত কাটে নাই, আমি বেশ আছি। এ সব কথা বলা সাজে না। (১-১৫-২) সেইজন্য জ্ঞানপথ সকলের জন্য নয়। সাধারণের জন্য ভক্তিপথ। হ্যাঁ, আমার মনে কামনা-বাসনা আছে, মনটা আমার মলিন হয়ে রয়েছে। কিন্তু ভগবানের দিকে মন দিলে ধীরে ধীরে আমার সব মলিনতা দূর হয়ে যাবে। জোর করে করতে হবে না, আপনা-আপনিই আমার মনটা সংযত হয়ে আসবে। কিন্তু জ্ঞানপথে তা হবে না। জ্ঞানীরা বলে, আগে চিত্তশুদ্ধি হওয়া দরকার। আগে সাধন চাই, তবে জ্ঞান হবে।(ঐ) চিত্তের অশুদ্ধি কি? অহংকার। অহংকার মানে গর্ব না—‘আমি’-বুদ্ধি। যে ‘আমি’ খণ্ডিত ‘আমি’, ব্ৰহ্ম থেকে বিযুক্ত ‘আমি’—সেই ‘আমি’ই অহংকার। ঠাকুর একে বলছেন, ‘কাঁচা আমি’ বা ‘ছোট আমি’। কখনও বলছেন, ‘অবিদ্যার আমি’। এই ‘অবিদ্যার আমি’টাই হচ্ছে চিত্তের ময়লা। এই ময়লাটা যেন জ্ঞানকে আবরণ করে রেখে দিয়েছে। জ্ঞানের সম্বন্ধে বলা হয় যে, স্বয়ং-প্রকাশ। আকাশে যেমন সূর্য সবসময় আছে, কিন্তু মেঘে ঢাকা থাকলে তা দেখা যায় না, তেমনি, আমার মধ্যে জ্ঞানসূর্য চিরকাল জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু তার উপরে ঐ ময়লার যেন একটা আবরণ পড়েছে, যার জন্য তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। জ্ঞানপথে চলতে হলে আগে সাধনভজন করে মনের ময়লাটাকে কমিয়ে আনতে হবে। ঠাকুর বলছেন; এদের মত কি জান? আগে সাধন চাই। শম, দম, তিতিক্ষা চাই। (১-৬-১) আমাদের শাস্ত্র অনুযায়ী সবাই বেদান্ত শোনবার অধিকারী নয়। পাত্র-অপাত্র বিচার করতে হয়। সবার যোগ্যতা নেই বেদান্তশিক্ষা গ্রহণ করবার। এমন লোককে বেদান্ত উপদেশ দিতে হবে, যে শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসন তিনটেই করবে। শুধু শুনবেই না, শুনে সেটাকে ঠিক ঠিক ধারণা করবে, ধারণা করে নিজের জীবনে প্রতিফলিত করতে পারবে। শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের ঠিক প্রথম সূত্রের ভাষ্যেই এই নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলছেন: সে-ই বেদান্ততত্ত্ব শোনার অধিকারী যে ‘সাধনচতুষ্টতিসম্পন্ন’। ‘সাধনচতুষ্টতি’ অর্থাৎ চার রকমের সাধন। কি কি? প্রথম হচ্ছে, ‘নিত্যানিত্যবস্তুবিবেক’। নিত্যকে অনিত্য থেকে আলাদা করে নিতে হবে। ঠাকুর যেমন বলছেন; বালি আর চিনি মেশানো আছে—পিঁপড়ে তার মধ্যে থেকে শুধু চিনিটা নিয়ে বালি ছেড়ে দেয়। তেমনি, সংসারে নিত্য-অনিত্য মেশানো আছে। তার মধ্যে থেকে নিত্যটা নিয়ে অনিত্যকে বর্জন করতে হবে। এ-সম্বন্ধে আমরা আগে আলোচনা করেছি। দ্বিতীয় হচ্ছে: ‘ইহামুত্রফলভোগবিরাগঃ’। ইহলোকে এবং পরলোকে যে-কোন-রকম ফল ভোগ করার আকাঙ্ক্ষা দূর করতে হবে। এই জীবনে আমি কিছু চাচ্ছি না, আবার মৃত্যুর পরে আমি স্বৰ্গভোগ করব কিংবা দেবলোক বা অন্য কোন লোকে যাব তাও আমি কামনা করছি না। এই হচ্ছে ‘ইহামুত্রফলভোগবিরাগঃ’ অর্থাৎ তীব্র বৈরাগ্য। ব্রহ্ম-উপলব্ধি ছাড়া আর কোন বাসনা নেই। তৃতীয় হচ্ছে: ‘ষট্‌সম্পদ’। অর্থাৎ ঐ শম, দম, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান এবং শ্রদ্ধা। এগুলিকে সম্পদ বলা হচ্ছে। ‘শম’ অর্থাৎ অন্তরিন্দ্রিয়ের নিগ্রহ। মনটাকে বহির্মুখী হতে দেব না আমি। ‘দম’ অর্থাৎ বহিরিন্দ্রিয়ের নিগ্রহ। আমার ইন্দ্রিয়গুলিকে আমি বহির্বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হতে দেব না। ‘উপরতি’ মানে বাসনা-ত্যাগ। ‘তিতিক্ষা’ অর্থাৎ সহিষ্ণুতা। আমরা সাধারণত গরমে কষ্ট পাই, আবার শীতেও কাতর হয়ে পড়ি। যার ‘তিতিক্ষা’ আছে, শরীরের কষ্টতে সে কখনও কাতর হয় না। ‘সমাধান’ কাকে বলে? শাস্ত্রবাক্য মনোযোগ দিয়ে শোনার নাম ‘সমাধান’। আর ‘শ্রদ্ধা’র অর্থ হচ্ছে বিশ্বাস। গুরুবাক্যে বিশ্বাস, গুরু যে বেদান্তের কথা বলেছেন তাতে বিশ্বাস, নিজের উপর বিশ্বাস—এই হচ্ছে ‘শ্রদ্ধা’। স্বামীজী খুব জোর দিয়েছেন এই ‘শ্রদ্ধা’র উপরে। বলছেন: সবচেয়ে দরকার নিজের উপর বিশ্বাস।—এই ‘ষট্‌সম্পদ’ চাই, আর চাই ‘মুমুক্ষুত্ব’ বা মুক্তির জন্য তীব্র ব্যাকুলতা। কি রকম ব্যাকুলতা? মাথায় যদি সত্যি সত্যি আগুন জ্বলে তখন যেভাবে আমি আগুন নিভানোর জন্য জলের দিকে ছুটে যাব, মুক্তির জন্য তেমনি ব্যাকুলতা নিয়ে আমাকে গুরুর কাছে ছুটে যেতে হবে।* তবেই গুরু আমাকে বেদান্ততত্ত্ব শেখাবেন।—এতগুলি শর্ত যদি পূর্ণ হয় তবেই আমাকে জ্ঞানপথের অধিকারী হিসেবে গণ্য করা হবে, না হলে নয়। সেইজন্যেই ঠাকুর বলেছেন যে, বড় কঠিন পথ। সর্বসাধারণের জন্য নয়। খুব পবিত্র, খুব পুরুষকারসম্পন্ন না হলে এ পথে চলা যায় না।

ঠাকুরকে একজন প্রশ্ন করছেন; মহাশয়! জ্ঞান হয়েছে তা কেমন করে জানবো? (১-১২-৪) বাস্তবিক, জ্ঞান হলে এ প্রশ্ন আর ওঠে না। যার জ্ঞান হয়েছে তার মনে আর কোন সংশয় থাকে না। সংশয় থাকলেই বুঝতে হবে যে, জ্ঞান হয়নি। আমি যদি কারও কাছে গিয়ে বলি যে, ‘আমার বোধহয় ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে’—তাহলেই বুঝতে হবে যে ‘বোধহয়’ না, নিশ্চয়ই আমার ব্রহ্মজ্ঞান হয়নি। যাঁর ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে, তাঁকে যদি এই ত্রিভুবনের সবাই বলে ‘হয়নি’ তবুও তাঁর বিশ্বাস টুটবে না। ‘বেদাহমেতম্‌’—আমি জেনেছি এঁকে। সে এমন একটা অভিজ্ঞতা যে, সেখানে কোন ‘কিন্তু’ নেই, কোন দ্বিধা নেই। ঠাকুর বলছেন: জ্ঞান হলে তাঁকে আর দূরে দেখায় না। তিনি আর তিনি বোধ হয় না। তখন ইনি! (ঐ) তিনি তখন আমার নিকটতম। কারণ আমার মধ্যেই তিনি। বলছেন: হৃদয় মধ্যে তাঁকে দেখা যায়। (ঐ) নিজের ভিতরে আমি তাঁকে দেখছি। ‘অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষো মধ্য আত্মনি তিষ্ঠতি’১২—খুব সূক্ষ্মরূপে আমাদের মধ্যে তিনি বিরাজ করছেন। ‘তমাত্মস্থং যেহনুপশ্যন্তি ধীরাস্তেষাং শান্তিঃ শাশ্বতী নেতরেষাম্‌’১৩ —যাঁরা তাঁকে নিজেদের মধ্যে দেখতে পান, তাঁরাই শাশ্বত শান্তি লাভ করেন, অন্যেরা নয়। এই যে বলা হল, জ্ঞানলাভ হলে মানুষ নিঃসন্দিগ্ধ হয়, তার কারণ আমি তখন নিজেকে দেখছি ‘তিনি’। নিজেকে তো আমি অবিশ্বাস করতে পারি না। একটা বস্তু যতক্ষণ দূরে আছে ততক্ষণ আমি তাকে সন্দেহ করতে পারি যে, সত্যিই এটা এরকম তো, সত্যিই এরকম একটা বস্তু আছে তো? কিন্তু যখন সেই বস্তুটা সম্পূর্ণ আমার আয়ত্তের মধ্যে চলে এসেছে, তখন আর তার সম্বন্ধে কোন সন্দেহ থাকে না। এও ঠিক তাই। শাস্ত্রে তুলনা দিচ্ছে ‘করামলকবৎ’। আমার হাতে একটা আমলকী আছে। যতক্ষণ সেটা আমি পাইনি—ততক্ষণ আমার মনে নানারকম প্রশ্ন ছিল, সেটা পাওয়ার জন্য চাঞ্চল্য ছিল। এখন আমলকীটা আমি হাতের মুঠোয় পেয়েছি—এখন আমার আর কোন চাঞ্চল্য নেই, কোন প্রশ্ন নেই। সমস্ত জগৎ যদি এক হয়ে বলে যে, না, তোমার কাছে কোন আমলকী নেই, তাতেও আমার কোন যায় আসে না। কারণ, আমি তো জানি যে, আমার হাতে আমলকীটা আছেই। তেমনি, ব্রহ্মজ্ঞান যাঁর হয়েছে তিনিও নিঃসন্দিগ্ধ হন। অন্যে স্বীকৃতি দেবে, তারপরে তিনি বুঝতে পারবেন যে তাঁর জ্ঞান হয়েছে—তা নয়। তাঁর কাছেই তার প্রমাণ। তিনি নিজেই ঠিক ঠিক জানতে পারেন যে, তাঁর ব্রহ্ম-উপলব্ধি হয়েছে। কারণ, নিজের ভিতরে তিনি তাঁকে ‘সাক্ষাৎ’ করেছেন। ‘ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ!’১৪ —তাঁর সমস্ত বাসনা-বন্ধন তখন ‘ভিন্ন’ হয়েছে, দূর হয়েছে; সমস্ত সংশয় ছিন্ন হয়ে গেছে।

ব্ৰহ্মজ্ঞপুরুষের যে অনুভূতি, সে তো তাঁর নিজস্ব বস্তু। অন্যের পক্ষে সে সম্বন্ধে কোন ধারণা করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁর চালচলন, কথাবার্তায় এমন কিছু বাহ্যলক্ষণও ফুটে ওঠে, যা থেকে বোঝা যায় যে, তিনি অসাধারণ। কি কি সেই লক্ষণ? একটা লক্ষণ হচ্ছে, তাঁর অহংকার দূর হয়ে গেছে। ঠাকুর বলছেন: কি রকম জানো? ঠিক দুপুর বেলা সূর্য ঠিক মাথার উপর উঠে। তখন মানুষটা চারিদিকে চেয়ে দেখে, আর ছায়া নাই। তাই ঠিক জ্ঞান হলে—সমাধিস্থ হলে—অহংরূপ ছায়া থাকে না। ঠিক জ্ঞান হবার পর যদি অহং থাকে, তবে জেনো, ‘বিদ্যার আমি’ ‘ভুক্তির আমি’ ‘দাস আমি’। সে ‘অবিদ্যার আমি’ নয়। (২-২৪-৭) অর্থাৎ ‘কাঁচা আমি’টা দূর হয়ে গেছে। যে ‘আমি’টা ছোট আমি, খণ্ডিত আমি—সেটা নেই। ‘বিরাট আমি’টা রয়েছে শুধু। জ্ঞানপথেই হোক আর ভক্তিপথেই হোক, লক্ষণ কিন্তু ঐ একটা ‘কাঁচা আমি’ দূর হয়ে গেছে। নিরহঙ্কার হবে সে। একজনের সম্বন্ধে শুনছি সে সিদ্ধপুরুষ, অথচ তাকে খুঁটিয়ে দেখে বুঝছি যে তার খুব অহংকার—এ কখনও হতে পারে না। কারণ, অহংকারটাই অজ্ঞান। জ্ঞান হওয়া মানেই অজ্ঞান চলে গেছে। কাজেই অহংকার তখন থাকতে পারে না। আলো আর অন্ধকার একসাথে থাকতে পারে না। হ্যাঁ, শরীরটা যখন আছে তখন কিছুটা ‘আমি’ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সে ‘আমি’ ‘কাঁচা আমি’ বা ‘অবিদ্যার আমি’ নয়—‘বিদ্যার আমি’। সেই ‘আমি’ তখন আর কোন ক্ষতি করতে পারে না। ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন: দড়ি পুড়িয়ে ফেললেও দড়ির আকারটা থাকে, কিন্তু তা দিয়ে আর বাঁধা যায় না। জ্ঞান হওয়ার পর যে ‘আমি’ থাকে তা ঐ ‘পোড়া দড়ি’র মতো। সেই ‘আমি’ তখন আর বন্ধনের কারণ হয় না। সেইজন্য জ্ঞানী হন সর্বপাশমুক্ত। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়—এগুলি হচ্ছে পাশ। ঠাকুর বলতেন: পাশবদ্ধ জীব আর পাশমুক্ত শিব। আমরা সবাই পাশবদ্ধ—তাই আমরা জীব। কিন্তু জ্ঞানী যিনি—তিনি পাশমুক্ত। আমাদের নিয়মকানুনের সঙ্গে তাঁর নিয়মকানুন মেলে না। শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখছি যে, তিনি পাশমুক্ত। মাঝে মাঝে পরনের কাপড়টা খুলে বগলে রেখে দিয়ে বেড়াচ্ছেন—ছোটছেলেরা যেমন করে। ঘরভর্তি লোক, কিন্তু তাঁর কোন সঙ্কোচ নেই। আর আশ্চর্য ব্যাপার, যাঁরা সেখানে বসে আছেন, তাঁরাও কিছু মনে করছেন না। একটা শিশু যদি সামনে দিয়ে উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ায়, আমরা কি কিছু মনে করি? এও যেন ঠিক তাই—একটা শিশু যেন সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একদিন বরিশালের বিখ্যাত অশ্বিনী দত্ত উপস্থিত আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রথমটা চেষ্টা করলেন কাপড়চোপড় সামলে রাখতে—কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারলেন না, দিগম্বর হয়ে পায়চারি করতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পরে খেয়াল হয়েছে—এরা কিছু মনে করছে না তো? জিজ্ঞেস করছেন: তোমরা আমাকে অসভ্য ভাবছ না তো? অশ্বিনী দত্ত বলছেন: না, না, অসভ্য ভাবব কেন! আপনি খুব সভ্য। তাঁর যখন সাধক-অবস্থা তখনও মাঝে মাঝে রাত্রে বেলতলায় গিয়ে উলঙ্গ হয়ে বসে ধ্যান করতেন। হৃদয় একদিন তাঁকে খুঁজতে গিয়ে দেখেন যে, পৈতে আর কাপড় পড়ে রয়েছে, মামা তাঁর উলঙ্গ হয়ে বসে ধ্যান করছে। হৃদয় তো খুব চটে গেছেন: এ আবার কোন্‌ দিশি ধ্যান? পৈতে পর্যন্ত ফেলে দিয়েছ। ব্রাহ্মণ সন্তান তুমি—এটা সবসময় তোমার গায়ে থাকা দরকার। ঠাকুর বলছেন: দেখ, এগুলো পাশ—বন্ধন। এগুলো সব দূর করতে হবে। আট রকমের পাশ আছে—‘অষ্টপাশ’ বলা হয়। ঠাকুর বলছেন: লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, জাতি, অভিমান, গোপন ইচ্ছা এ সব পাশ। (১-৮-৩) এ ছাড়াও ‘কুল’ একটা পাশ। ‘আমি অমুক বাড়ির ছেলে’, ‘অমুক পরিবারে আমার জন্ম’—এ একটা বন্ধন। আর আছে ‘শীল’। আমি সমাজে আছি, আমাকে কয়েকটা শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে—এও আর একটা পাশ। এ সব গেলে জীবের মুক্তি হয়। (ঐ) যাঁর ব্ৰহ্মজ্ঞান হয়েছে, সর্বপাশমুক্ত তিনি। ‘জ্ঞাত্বা দেবং মুচ্যতে সর্বপাশৈঃ’১৫— তাঁর সব পাশ মুক্ত হয়ে গেছে, সমস্ত বন্ধন তাঁর দূর হয়ে গেছে। তিনি তখন ‘কেবল’। একা আছেন তিনি। তিনি দেখছেন যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই, আর সেইজন্যই তিনি সর্বপাশমুক্ত। কারণ, ‘দুই’ থাকলেই লজ্জা-ঘৃণা-ভয় এসবের প্রশ্ন ওঠে। যখন আমি একা আছি তখন এসবের প্রশ্নই ওঠে না। আর কি? তিনি ‘আপ্তকামঃ’—সমস্ত কাম্যবস্তু তিনি লাভ করেছেন। বৃহত্তমকে লাভ করেছেন। তাই আর সবকিছু তাঁর কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে। ‘আত্মরতিঃ’—নিজের মধ্যেই নিজে আনন্দে ডুবে আছেন। তখন তিনি ‘শান্তো নিরিন্ধন ইবানলঃ’১৬— ইন্ধনশূন্য আগুনের মতো শান্ত। আগুনে প্রচুর ‘ইন্ধন দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ কাঠ দেওয়া হয়েছে। কাঠ যতক্ষণ আছে, আগুন খুব জ্বলছে। যখন সমস্ত কাঠ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তখন আর আগুন নেই—শান্ত। যতক্ষণ আমার কামনা-বাসনা আছে, ততক্ষণ তার জ্বালায় আমি জ্বলছি। ব্ৰহ্মজ্ঞান যখন হয়েছে, তখন আমার বাসনা দগ্ধ হয়ে গেছে, তখন আমি শান্ত—আমার সব চাঞ্চল্য দূর হয়ে গেছে। ‘অদ্বয়ানন্দরসানুভূতৌ ন বাস্‌তি বন্ধ্যে ন চ দুঃখগন্ধঃ’১৭—তখন আমি অদ্বয় আনন্দরস অনুভব করছি। তাই কোন বন্ধন নেই আমার, দুঃখের গন্ধও নেই অর্থাৎ লেশমাত্র দুঃখও নেই আর। নিজের মধ্যে আমি আনন্দের উৎস আবিষ্কার করেছি। সেই আনন্দে ডুবে আছি সবসময়। আমার আনন্দ জগতের কোন কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। ‘অনপেক্ষ’ আমি।—এই হচ্ছে মুক্তপুরুষের লক্ষণ। সেইজন্য দেখা যায় যে, মুক্তপুরুষ সংসারে থাকেন সম্রাটের মতো। বাইরে তিনি হয়তো নিঃস্ব—কিন্তু তাঁর হাবভাব, চালচলন দেখে মনে হয়, তিনি যেন সম্রাট। বস্তুত, তিনিই জগতের সম্রাট। আমরা সবাই জগতের বশ, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যে-ধনী, সে-ও তাই। জগতের বশ নন একমাত্র তিনি, যিনি ব্রহ্মকে জেনেছেন। ‘নির্গচ্ছতি জগজ্জালাৎ পিঞ্জরাদিব কেশরী’—পিঞ্জরমুক্ত সিংহের মতো তিনি জগৎ-জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে পড়েছেন। ‘অভীঃ’ তিনি। এ জগতের কাউকে বা কোন কিছুকে তিনি ভয় পান না। আলেকজাণ্ডার ও একজন সন্ন্যাসীর গল্প আছে। অর্ধেক পৃথিবী জয় করে আলেকজাণ্ডার ভারতে এসেছেন। ভারতবর্ষও জয় করেছেন। ভারতবর্ষে এসে তিনি এক সন্ন্যাসীকে দেখেছেন। নিঃস্ব সন্ন্যাসী—কিন্তু ব্ৰহ্মজ্ঞ তিনি। আলেকজাণ্ডারের তাঁকে ভাল লেগেছে, বললেন: তোমাকে আমি আমার দেশে নিয়ে যাব। অর্থাৎ গ্রীসে নিয়ে যাবেন। সেই সন্ন্যাসী রাজি নন। আলেকজাণ্ডার প্রথমে তাঁকে অনেক লোভ দেখালেন, শেষে ভয় দেখালেন: যদি তুমি না যাও, আমি তোমাকে হত্যা করব। তখন ‘হো হো’ করে হেসে উঠেছেন সেই সন্ন্যাসী! বলছেন: তুমি এত বড় মিথ্যে কথা এর আগে আর কখনও বলনি। আমাকে তুমি হত্যা করবে? কি করে করবে? তুমি তো জড়-জগতের সম্রাট। আমি জড় নই, আমি চৈতন্যস্বরূপ। আমার তুমি সম্রাট নও—আমার দেহটাকে তুমি হয়তো হত্যা করতে পার, কিন্তু আমাকে পার না।—‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।’

মুক্তপুরুষ জগৎটাকে কিরকম ভাবে দেখেন? তাঁদের দৃষ্টি তখন ‘মায়ানির্মুক্ত’। আমাদের দৃষ্টি মায়ামুগ্ধ—কিন্তু তাঁদের দৃষ্টি ‘মায়ানির্মুক্ত’। ঠাকুর বলছেন: ও তো আমাদের ‘হরে’। ‘হরি’ একজনের নাম, তাকে সবাই ডাকে ‘হরে’ বলে। সে বহুরূপী সেজে একজনকে ভয় দেখাতে গেছে। বহুরূপী দেখে প্রথমটা সে হয়তো একটু ভয় পেয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ সে তাকে চিনতে পেরে চেঁচিয়ে উঠেছে: ও তো আমাদের ‘হরে’। ‘হরে’ এখন যতই ভয় দেখাক না বহুরূপী সেজে, আর সে ভয় পাবে না। কারণ, তাকে সে চিনে ফেলেছে। তেমনি ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ মায়ার স্বরূপটা জেনে গেছেন। মায়া তাঁকে আর মুগ্ধ করতে পারবে না। এই ‘মায়ার সংসার’ তাঁকে আর বাঁধতে পারবে না। এর প্রকৃত রূপটা তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। গীতাতে ভগবান বলছেন:১৮ সে তখন ‘দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ’ —দুঃখে সে উদ্বিগ্ন হয় না, ‘সুখেষু বিগতস্পৃহঃ’ —সুখের প্রতিও তার কোন স্পৃহা নেই। আর ‘রাগদ্বেষবিযুক্তঃ’ সে—সংসারের কোন কিছুর প্রতি তার ‘রাগ’ বা আকর্ষণ নেই, কোন কিছুর প্রতি তার ‘দ্বেষ’ বা বিকর্ষণও নেই। ঠাকুরের কথায়, বিদ্যামায়া আর অবিদ্যামায়ার পারে চলে গেছে সে। ‘পুণ্যপাপে বিধূয় নিরঞ্জনঃ পরমং সাম্যমুপৈতি’১৯ —পুণ্য, পাপ সব ধুয়ে গেছে। সে তখন ‘নিরঞ্জন’—কোন অঞ্জন বা মলিনতা নেই। পরম সাম্যাবস্থায় সে উপস্থিত হয়েছে। সমস্ত দ্বন্দ্বের অতীত সে। ভাল-মন্দ, পাপ-পুণ্য, শুচি-অশুচি—এসবের ভেদ তার চোখে দূর হয়ে গেছে। তার মানে কি সে পাপ কাজও করতে পারে? মন্দ জিনিসও করতে পারে? তা নয়। ঠাকুর বলছেন: জ্ঞানী কারু অনিষ্ট করতে পারে না। বালকের মত হয়ে যায়। লোহার খঙ্গে যদি পরশমণি ছোঁয়ান হয়, খড়্গ সোনা হয়ে যায়। সোনায় হিংসার কাজ হয় না। (তেমনি) বাহিরে হয় ত দেখায় যে, রাগ আছে কি অহংকার আছে, কিন্তু বস্তুতঃ জ্ঞানীর ও সব কিছু থাকে না।(২-১৩-১) ভুলেও তখন সে অন্যায় করতে পারে না। যা কিছু সে করে তাতেই লোকের কল্যাণ হয়। তাঁদের চিন্তার ফলেই জাগতের কল্যাণ হয়। তাঁদের ‘দ্বন্দ্বাতীত’ বলা হচ্ছে এইজন্য যে, দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত বস্ততেও তাঁরা সমদৃষ্টি করেন। এক আত্মাকে তারা সর্বভূতে প্রত্যক্ষ করেন। ‘আত্মন্যেবাত্মানং পশ্যতি সর্বমাত্মানং পশ্যতি’২০—নিজের মধ্যে যে আত্মাকে দেখেন, সেই আত্মাকেই তারা সবার মধ্যে দেখতে পান। বিশ্বসংসারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। তখন তারা পাপী এবং পুণ্যাত্মার মধ্যে কোন তফাৎ করতে পারেন না। ‘বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি শুনি চৈব শ্বপাকে চু পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ’২১ —বিদ্যা ও বিনয় সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গরু, হাতি, কুকুর এবং চণ্ডাল এদের সবাইকে ব্ৰহ্মজ্ঞ পুরুষ সমান চোখে দেখেন। এদের মধ্যে কোন ভেদ তারা করতে পারেন না।

ঠাকুর গল্প করছেন একজন সাধুর কথা। দক্ষিণেশ্বরে যখন তিনি আছেন তখন একদিন সেখানে একটি সাধু এল—দেখতে পাগলের মতো, নোংরা জামাকাপড়, কুকুরের সাথে বসে খাচ্ছে। অথচ মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে যখন সে স্তব পাঠ করল তখন ঠাকুর দেখতে পেলেন সমস্ত মন্দিরটা যেন গমগম করে উঠল, মা যেন সেই স্তব শুনে প্রসন্ন হয়ে উঠলেন। ঠাকুর তখন হৃদয়কে বললেন: ওরে হৃদে, এ যে-সে পাগল নয়, এ জ্ঞানী, মুক্তপুরুষ। শুনেই হৃদয় তাঁকে দেখতে ছুটল। সাধুটি তখন মন্দির থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। হৃদয়ও তার পিছু পিছু যাচ্ছে আর বলছে: কি করে জ্ঞান হবে বলে দিন, কি করে জ্ঞান হবে বলে দিন। লোকটি ফিরেও তাকাচ্ছে না—হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ পরে সে পিছনে তাকিয়ে বলল: যখন ঐ গঙ্গার জল আর নর্দমার জল এক বলে বুঝবি, তখনই জ্ঞান হবে। অর্থাৎ সমদর্শন হবে যখন। রামপ্রসাদ বলছেন: ‘শুচি অশুচিরে লয়ে দিব্য ঘরে কবে শুবি?’ যার জ্ঞান হয়েছে, সে সেই ‘দিব্যঘরে’ শুয়েছে। দুটি একেবারে বিপরীত বস্তুকেও সে সমান চোখে দেখছে। সমস্ত দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে চলে গেছে। এই হচ্ছে জ্ঞানীর লক্ষণ। কোন নিয়ম তার জন্য নেই। কোন সমাজ নেই তার। নিজের ভাবে সে আছে। ঠাকুর যেমন সাধুদের সঙ্গে একসাথে খেতে বসেছেন। সাধারণত সাধুরা যখন একসাথে খেতে বসেন, প্রথমে নানারকম মন্ত্রতন্ত্র পাঠ করেন, তারপর সবাই একসঙ্গে খাওয়া শুরু করেন। ঠাকুর কি করছেন? খাবার পাতে দেওয়া হয়েছে, আর সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া শুরু করেছেন। অন্য সাধুরা বলাবলি করছে: এ কে রে বাবা? কোন্ দিশি সাধু এ? কিচ্ছু জানে না তো!—মুক্তপুরুষের এরকমই লক্ষণ। কোন সামাজিক নিয়ম তাঁর জন্য নয়। এমনকি দেখা যায়, যে আচার-বিচারগুলো সাধনার অবস্থায় তিনি খুব মেনে এসেছেন সেগুলিও তখন আর তিনি সবসময় মেনে চলেন না। তাঁর যা ইচ্ছা। নিয়মের বশ নন তিনি। নিয়মই তাঁর বশ। সেসবের ঊর্ধ্বে চলে গেছেন তখন। একটা উদাহরণ: আহার। আহার সম্বন্ধে আমাদের শাস্ত্রে বলা হয় যে, আহার শুদ্ধ হতে হবে। প্রথমত, আহারটা এমন হবে যা আমার শরীরের কোন ক্ষতি করবে না; উত্তেজক হবে না। দ্বিতীয়ত, তার মধ্যে কোন ময়লা জিনিস-টিনিস পড়লে চলবে না। তৃতীয়ত, যে আমাকে খেতে দিচ্ছে, সে যদি শুদ্ধ মনে না দেয়, তাহলেও আহারটা অশুদ্ধ হয়ে গেল। সেই খাবার খেলে আমার ক্ষতি হবে। ক্ষতি মানে শুধু শারীরিক ক্ষতি না, আমার সাধকজীবনের ক্ষতি। কিন্তু জ্ঞানলাভ যখন কেউ করে গেল তখন আর এত বিচারের দরকার নেই। ঠাকুর বলছেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে জ্ঞানীর পক্ষে কিছুতেই দোষ নাই। (২-১৬-১) ঠাকুর সাধারণত এইসব নিয়মকানুন মেনে চলেছেন, কিন্তু আবার কখনও কখনও নিজেই সেই নিয়ম ভেঙে ফেলেছেন। নিজেই বলছেন যে, কেশব সেনের কাছে গেছিলাম ‘নব-বৃন্দাবন’ দেখতে। ওরা লুচি, ছক্কা খেতে দিল। কে এনে খেতে দিল কিছুই বিচার করলাম না—বেশ খেয়ে নিলাম। আবার আর এক দিনের ঘটনা। একজনের বাড়িতে গেছেন, নরেন্দ্রনাথও সঙ্গে আছেন। গৃহস্বামী নিজে হাতে এনে তাঁকে জল দিল, সেই জল তিনি খেতে পারলেন না। অথচ জলে কোন ময়লা পড়েনি, ভাল জল। নরেন্দ্রনাথ খোঁজ নিয়ে জানলেন যে, গৃহস্বামী লোকটি ভাল নয়। তাই সেই জল ঠাকুর খেতে পারেননি। অর্থাৎ যখন ‘ভক্ত-ভগবান’ এই ভাব নিয়ে আছেন তখন ঐ বাছ-বিচার রাখছেন। কিন্তু যখন জ্ঞানের ভাবে আছেন, তখন বাছ-বিচার খসে পড়ছে। কেন জ্ঞানীর পক্ষে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে বিচারের দরকার নেই। কারণ, জ্ঞানী মনে করে না যে, সে নিজে খাচ্ছে। গীতার মতে জ্ঞানী আপনি খায় না, কুণ্ডলিনীকে আহুতি দেয়।, (ঐ) ঠাকুর একদিন দক্ষিণেশ্বরে খাচ্ছেন, গোলাপ-মা কাছে বসে দেখছেন: ঠাকুর যেমনি খাবার মুখের কাছে ধরছেন, অমনি তাঁর ভিতর থেকে একটা সাপ বেরিয়ে এসে সেই খাবার গ্রহণ করছে। বারবার তিনি এরকম দেখছেন। তখন ঠাকুর বলছেন: বল দেখি, আমি খাচ্ছি, না কে খাচ্ছে? গোলাপ-মা যা দেখেছেন, বললেন। ঠাকুর খুশি হয়ে বললেন: ঠিক বলেছ, ঠিক বলেছ। তুমি বলেই বুঝতে পেরেছ। অর্থাৎ ঐ হচ্ছে কুণ্ডলিনী সাপ। ঠাকুর ঐ কুণ্ডলিনীতে আহুতি দিচ্ছিলেন, সেটাই দেখেছিলেন গোলাপ-মা। জ্ঞানী তাই করে। খাওয়ার সময় সে মনে করে: সর্পাকারা কুণ্ডলিনী তার আহুতি গ্রহণ করছে। সে মনে করে না যে, সে খাচ্ছে। মনে করে; শরীরটা খাচ্ছে। আমি কিছু খাচ্ছি না। আমি ব্ৰহ্ম, আমি নিস্ক্রিয়—আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণা নেই।* দক্ষিণেশ্বরে দেখা যেত, ঠাকুরের কাছে যেসব যুবক-ভক্ত আসতেন, তাঁদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে ঠাকুর খুব নজর রাখতেন। সব জিনিস, সবার দেওয়া জিনিস তাঁদের খেতে দিতেন না। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ ব্যতিক্রম। তাঁকে সব খেতে দিতেন। বলতেন: ওর তাতে দোষ হয় না। ওর ভিতর জ্ঞানাগ্নি জ্বলছে। ও যা খাবে তাই ভস্ম করে দেবে।

প্রশ্ন হল: জ্ঞানপথে যখন কেউ চলছে তখন তো সে জগৎটাকে বর্জন করে এগিয়ে যাচ্ছে। জগৎটা মিথ্যা, স্বপ্নবৎ—এই বিচার করে সে চলছে। কিন্তু তার যখন জ্ঞান হয়ে গেল, তখন তিনি এই জগৎটাকে কি চোখে দেখছেন? তখনও কি তিনি এই জগৎটাকে মিথ্যা বলছেন? —না। জগৎ তখন তাঁর কাছে সত্য। কারণ, তিনি তখন ব্রহ্মদৃষ্টিতে এই জগৎকে দেখছেন। জগৎকে ‘জগৎ’ হিসেবে যদি দেখি, তাহলে মিথ্যা। কিন্তু যদি ব্রহ্মরূপে দেখি, তাহলে জগৎ সত্য। ঠাকুর একেই বলছেন, বিজ্ঞান। বলছেন: জ্ঞানের পর বিজ্ঞান। ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা—এই উপলব্ধির নাম জ্ঞান। আর ‘ব্রহ্মময়ং জগৎ’—জগৎ ব্রহ্মময়—এই উপলব্ধির নাম বিজ্ঞান। বলছেন; প্রথমে ‘নেতি’ ‘নেতি’ বিচার করে ছাদে পৌঁছিতে হয়। (১-৬-৩) ছাদে যখন উঠছি, তখন ছাদই আমার কাছে একমাত্র সত্য। সিঁড়িকে তখন আমি সত্য বলে মনে করছি না। কিন্তু ছাদে পৌঁছনোর পর দেখা যায় ছাদও যে জিনিসে তৈয়ারি—ইট, চুণ, শুরকী—সিঁড়িও সেই জিনিসে তৈয়ারি। তখন দেখে ব্ৰহ্মই জীব-জগৎ সমস্ত হয়েছেন। (ঐ) তখন যে জগৎকে তিনি বর্জন করেছিলেন, তাকেই তিনি পরমপ্রেমে আলিঙ্গন করেন। এই হচ্ছে বিজ্ঞান। তখন কাউকে তিনি ঘৃণা করতে পারেন না। কারণ, জগতের সবকিছুকে তিনি নিজের মধ্যে দেখছেন আর নিজেকেও তিনি সবার মধ্যে দেখছেন। ‘যস্তু সর্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি, সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে’।২২কি করে তিনি অন্যকে ঘৃণা করবেন? নিজেকে কি নিজে আমি ঘৃণা করতে পারি? নিজেকে কি কখনও আঘাত করি? আমি তো তখন দেখছি আমিই আছি সর্বভূতে— ঘৃণ্যতম যে পাপী তার মধ্যেও আমি, আমাকে যে আঘাত করে, কষ্ট দেয়, তার মধ্যেও আমি। কাজেই, তাদেরও আমি ভালবাসি। আর এটা যে আমি কোন পরিকল্পনা করে বা চিন্তা করে করি তা নয়। ভাল না বেসে আমি পারি না তখন। জ্ঞান লাভ করার আগে পর্যন্ত আমার মধ্যে যে ভালবাসা, সেই ভালবাসা হয়তো আরোপিত। আরোপিত এই অর্থে যে, সবাইকে নির্বিচারে তখন ভালবাসতে পারি না। অনেক সময় নিজেকে বোঝাতে হয়: না, এরকম তোমার করা উচিত না, একেও তোমার ভালবাসা উচিত।—বিচার করে ভালবাসি তখন। কিন্তু জ্ঞান লাভ করার পরে যখন সর্বভূতে নিজেকে দেখছি, তখন আমার মধ্যে যে প্রেম, সেই প্রেম স্বতোৎসারিত। কোন কিছুই সেই ভালবাসার প্রবাহ রুদ্ধ করতে পারে না।

জ্ঞানপথে যাঁরা চলেন তাঁরা একটু শুষ্ক হন, এই আমাদের ধারণা। কিন্তু দেখা যায় যে, জ্ঞান শেষ পর্যন্ত প্রেমে পর্যবসিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের অনেক সাধুকে দেখেছি, প্রথম জীবনে তাঁদের বাইরে খুব কঠোর একটা আবরণ, ভক্তসঙ্গ বিশেষ পছন্দ করেন না। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁদের মধ্যেই আবার ভালবাসার বিকাশ দেখা গেছে। কত লোক তাঁদের সংস্পর্শে এসে শান্তি পেয়েছে। আমরা জানি, শঙ্করাচার্য অদ্বৈতবাদী। তাঁর মেধার কথাই সকলে বলি—তাঁর হৃদয়বত্তার কথা বলি না। কিন্তু তাঁর জীবনীতে দেখা যায়, বুদ্ধদেব যেমন একটা ছাগলের প্রাণরক্ষার জন্য নিজের জীবন দিতে গেছিলেন, শঙ্করাচার্যও তেমনি একজন তান্ত্রিকের মনোবাসনা পূর্ণ করবার জন্য নিজের জীবন দিতে গেছিলেন। তাছাড়া, তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি যে এত কাজ করলেন, ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পদব্রজে ঘুরে বেড়ালেন; কত ভাষ্য, কত শ্লোক রচনা করলেন, ভারতবর্ষের চাব প্রান্তে চারটে মঠ স্থাপন করে হিন্দুধর্মকে নতুন করে বেঁধে দিলেন—এই কষ্ট তো তিনি তাঁর নিজের জন্য করেননি, করেছেন আমাদের জন্য। কাজেই, তাঁর মধ্যেও প্রেম ছিল—মানুষকে তিনিও ভালবাসতেন। আর চৈতন্যদেবের প্রেমের কথা তো অতি পরিচিত। দ্বারে দ্বারে তিনি হরিনাম বিলোচ্ছেন। উঁচু-নীচু সবাইকে আশ্রয় দিচ্ছেন, জগাই-মাধাই-এর মতো মানুষকেও উদ্ধার করছেন। কিন্তু তাঁর ভিতরে ছিল জ্ঞান। অদ্বৈতপন্থী সাধু তিনি। তাঁর সেই অদ্বৈতজ্ঞানেরই বাইরে প্রকাশ হয়েছে প্রেমে।

ঠাকুর তাঁর সন্তানদের মধ্যে বাবুরাম মহারাজ সম্বন্ধে বলেছিলেন যে, ওর ভাব হবে না—জ্ঞান হবে। অর্থাৎ জ্ঞানমার্গের সাধক তিনি। অথচ তাঁর মধ্যে পরবর্তীকালে আমরা যে প্রেমের বিকাশ দেখেছি, তার কোন তুলনা হয় না। তাঁর ভালবাসার আকর্ষণে দলে দলে লোক ছুটে আসত। তিনি পূর্ববঙ্গে প্রচার করতে গেছিলেন। যেখানে গেছেন, মাতিয়ে দিয়েছেন লোককে। তিনি যখন ফিরে আসছেন পূর্ববঙ্গ থেকে, তখন সেখানকার মুসলমানরাও কাঁদছে, আর বলছে: ওরে, আমাদের পীব চলে যাচ্ছে, আমাদের পীর চলে যাচ্ছে। স্বামীজী তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘প্রেমানন্দ’—এই নাম সার্থক হয়েছিল তাঁর জীবনে।

স্বামীজীর নিজের জীবনেও দেখি তাই। প্রথমে তো ঠাকুরের কাছে নির্বিকল্প সমাধি চাইলেন। বললেন: ওসব কাজ-টাজ করতে পারব না। শুকদেবের মতো সমাধিস্থ হয়ে থাকব সবসময়। ঠাকুর তিরস্কার করলেন তাঁকে। আবার ঠাকুরের কৃপায় নির্বিকল্প সমাধিও হল তাঁর। পরে সেই স্বামীজীর মধ্যেই দেখছি কী প্রেম! বলছেন: আমি লোকের কল্যাণের জন্য বারবার জন্মগ্রহণ করতেও রাজী আছি। একদিন তুরীয়ানন্দজী গেছেন স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করতে। স্বামীজী আছেন বলরাম বসুর বাড়িতে। তুরীয়ানন্দজী গিয়ে দেখেন: স্বামীজী আপন মনে বারান্দায় পায়চারি করতে করতে গান গাইছেন: ‘দরদ না জানে কোই, ঘায়ল কী খত ঘায়ল জানে, আওর না জানে কোই।’ গুনগুন করে এই গানটা গাইছেন আর কাঁদছেন। জগতের লোক দুঃখে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে—তাই কাঁদছেন স্বামীজী।২৩তুরীয়ানন্দজী নিঃশব্দে দেখছেন পেছন থেকে—স্বামীজী জানেন না সেটা। এই তুরীয়ানন্দজীকেই স্বামীজী বিদেশ যাওয়ার আগে বলেছিলেন: হরিভাই, আমি ধর্ম-টর্ম কিছুই বুঝি না—কিন্তু আমার হৃদয়টা খুব বড় হয়ে গেছে, আমি অপরের দুঃখে দুঃখবোধ করতে শিখেছি।২৪পরে তুরীয়ানন্দজী বলেছিলেন: স্বামীজীকে দেখে আমার তখন মনে হচ্ছিল, স্বামীজীর হৃদয়টা যেন জগতের দুঃখে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। তাঁর হৃদয়টা যেন একটা প্রকাণ্ড কড়াই—আর তাতে তিনি এমন একটা মলম তৈরি করতে চেষ্টা করছেন, সমস্ত জগতের দুঃখ যাতে দূর হয়ে যেতে পারে। আর একদিন স্বামীজী শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে বেদান্ত ব্যাখ্যা করছেন। গিরিশ ঘোষও আছেন সেখানে। স্বামীজী বেদান্তের চিন্তায় একেবারে ডুবে গেছেন, এমন সময় গিরিশ ঘোষ বলে বসলেন: তোমার ওসব বেদান্ত-টেদান্ত বুঝি না। অমুক জায়গায় অমুক না খেয়ে মারা গেছে, অমুক জায়গায় এই হয়েছে, অমুক জায়গায় এই অন্যায় হয়েছে। তোমার বেদান্ত এ-সম্বন্ধে কি করছে বল আমাকে। শুনে স্বামীজীর বেদান্তবিচার বন্ধ হয়ে গেল, চোখ জলে ভরে উঠল, কান্না চাপার জন্য ছুটে বাইরে চলে গেলেন তিনি। তখন গিরিশ ঘোষ শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে বললেন: দেখছিস, কী বিরাট প্রাণ! তোদের বিবেকানন্দকে এই কারণেই শ্রদ্ধা করি।২৫ এই প্রেম কোথা থেকে পেয়েছিলেন স্বামীজী? তিনি তো সপ্তর্ষির ঋষি, ধানসিদ্ধ জ্ঞানী মহাপুরুষ, কি দরকার ছিল অনিত্য জগৎকে এত ভালবাসার? ভালবাসছেন, কারণ, সর্বভূতে এক ব্রহ্মকে দেখছেন।

তীর্থরাম নামে লাহোরের এক অঙ্কের অধ্যাপক স্বামীজীর সংস্পর্শে এসেছিলেন। স্বামীজী যখন চলে যাচ্ছেন, তখন তাঁকে একটা ঘড়ি উপহার দিলেন তীর্থরাম। স্বামীজী ঘড়িটা তাঁর পকেটে ফিরিয়ে দিলেন, বললেন: ‘I shall wear it here in this pocket.’ —তুমি আর আমি আলাদা নই, তুমি ব্যবহার করলেই আমার ব্যবহার করা হবে। তীর্থরাম তখন বললেন: ‘Swamiji, give me a message.’ স্বামীজী সেই ঘড়িটা বের করলেন তীর্থরামের পকেট থেকে, ঘড়িতে তখন ঠিক একটা বেজেছে। ঘড়িটা দেখিয়ে স্বামীজী বললেন: ‘That’s the message’—ঐ ‘এক’ই আমার বাণী। সর্বত্র এক সত্তা রয়েছে, সেই ‘এক’কে সবার মধ্যে দেখতে চেষ্টা কর। পরবর্তীকালে সেই তীর্থরাম সন্ন্যাসী হয়েছিলেন, নাম নিয়েছিলেন স্বামী রামতীর্থ। পাশ্চাত্যে বেদান্ত প্রচার করতে গেছিলেন। তিনি যখন বক্তৃতা শুরু করতেন, তখন সম্বোধন করতেন: ‘My own self in the form of ladies and gentlemen’— আমিই আছি আপনাদের মধ্যে, আমাকে সম্বোধন করে আমি বলে যাচ্ছি।২৬স্বামীজীর সেই ‘message’ তিনি মনে রেখেছেন। বস্তুত, এই একত্বদর্শনই জ্ঞানপথের চরম লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্যে যখন পৌঁছয় তখনই জ্ঞানী প্রেমিক হয়ে যায়।

একটা বড় বিতর্ক আছে যে, শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্ত ছিলেন না জ্ঞানী ছিলেন? অনেকে বলেন যে, তিনি ভক্ত ছিলেন। কারণ, প্রধানত যে-বইয়ের মধ্যে তাঁর উপদেশ পাই, সেই ‘কথামৃতে’ ভক্তির কথাই বেশি করে বলা আছে। জ্ঞানের কথাও আছে, তবে কম। সেইজন্য অনেকে মনে করেন, শ্রীরামকৃষ্ণ জ্ঞানী নন, ভক্ত। তাঁর শিষ্যরা তাঁকে বড় করবার জন্য প্রমাণ করতে চান তিনি জ্ঞানমার্গী ছিলেন। ম্যাক্সমূলারও এক জায়গায় ঐ ভুল করেছেন। তিনিও বলেছেন: রামকৃষ্ণ প্রধানত ভক্ত ছিলেন, জ্ঞানমার্গী ততটা ছিলেন না। * কিন্তু একথা ঠিক নয়। এ সম্পর্কে একটা ঘটনা বলি। খুব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা— কারণ, স্বামীজী এবং শ্রীশ্রীমা এর সাথে জড়িয়ে আছেন। হিমালয়ে আলমোড়া থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে মায়াবতী বলে একটা জায়গা আছে। স্বামীজী যখন ইউরোপে তখন আল্পস পাহাড়ে খ্রীষ্টানদের একটা মঠ দেখে তাঁর খুব ভাল লাগে, তিনি বললেন: আমার ইচ্ছে হয়, আমাদেরও এরকম একটা মঠ থাকে হিমালয়ের উপরে। ঘটনাক্রমে পরে মায়াবতীতে ঐ আশ্রম হল। সমুদ্র থেকে প্রায় সাত হাজার ফুট উঁচুতে জায়গাটা। খুব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য চারদিকে। স্বামীজীরই ইংরেজ-শিষ্য ক্যাপ্টেন সেভিয়ার ঐ জায়গাটা কিনে দিয়েছিলেন। স্বামীজীর নির্দেশ ছিল: এই আশ্রমে যেন মূর্তিপূজা বা কোনরকম দ্বৈতসাধনা না হয়। তিনি চেয়েছিলেন অন্তত এই একটা আশ্রম থাকবে রামকৃষ্ণ মিশনের, যেখানে শুধু অদ্বৈতসাধনা হবে। কিন্তু আশ্রম তৈরি হবার পর কয়েকজন সাধু মিলে সেখানে একটা আলাদা ঠাকুরঘর করেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি রেখেছেন, নিয়মিত ফুল, ধূপধুনা ইত্যাদিও দেওয়া হয়। তাঁরা সম্ভবত ভেবেছিলেন: স্বামীজী বলেছেন বটে, তবে ঠাকুরের ছবি রাখলে তিনি নিশ্চয়ই রাগ করবেন না। কারণ, শ্রীরামকৃষ্ণই তো তাঁর সর্বস্ব। আর রামকৃষ্ণ মিশনে শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি থাকবে না, এ কি হয়? এদিকে ক্যাপ্টেন সেভিয়ার যখন মারা গেলেন, তখন স্বামীজী মায়াবতীতে ছুটে এলেন। মিসেস সেভিয়ার সেখানে আছেন, তাঁকে ‘মা’ বলে ডাকতেন স্বামীজী, তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য তিনি সেখানে এলেন। মায়াবতী আশ্রমে এসে তাঁর নজরে পড়ল ঐ ঠাকুরঘরটি। তিনি খুব বিরক্ত হলেন: এ কী! অদ্বৈত-আশ্রম, এখানে ঠাকুরঘর থাকবে কেন? যাঁরা ঠাকুরঘর করেছিলেন, তাঁরা বেগতিক দেখে ঠাকুরঘর তুলে দিলেন। কিন্তু মনে খুব লেগেছে তাঁদের। তাঁদের একজন সব জানিয়ে শ্রীশ্রীমাকে একটা চিঠি লিখলেন: মা, স্বামীজীর ইচ্ছায় ঠাকুরের ছবি সরিয়েছি। কিন্তু মনে বড় দুঃখ পেয়েছি। এখন আপনি বিচার করুন। —এ থেকে বোঝা যায়, রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে মায়ের স্থান কোথায়! স্বামীজীর কথাও পর্যন্ত চুড়ান্ত মনে করা হচ্ছে না। মা যা বলবেন, তাই শেষ কথা। মা উত্তর দিলেন: নরেন যা করেছে, ঠিকই করেছে। ঠাকুর অদ্বৈতবাদী ছিলেন, তোমরাও অদ্বৈতবাদী।

বস্তুত, শ্রীরামকৃষ্ণ যদি ভক্তির কথা বেশি বলেও থাকেন, তাহলেও তিনি অদ্বৈতবাদী। সাধারণের জন্য তিনি ভক্তিপথের উপরেই বেশি জোর দিচ্ছেন। কারণ, ভক্তিপথ সহজ পথ, সর্বসাধারণের পথ। কিন্তু মূলত তিনি অদ্বৈতবাদী। তবে সেই অদ্বৈতবাদের সঙ্গে দ্বৈতবাদের কোন বিরোধ নেই। দ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ সবকিছুকে তিনি সত্য বলে গ্রহণ করেছেন। এগুলি যেন সিঁড়ির বিভিন্ন ধাপ। সবশেষ ধাপ হচ্ছে অদ্বৈতবাদ। দ্বৈতবাদ বা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ গিয়ে শেষ পর্যন্ত অদ্বৈতবাদে পর্যবসিত হয়েছে। এটাই শ্রীরামকৃষ্ণের বিশেষত্ব। তাঁর মধ্যে সব পথ সব মতবাদের সমন্বয় হয়েছে। ভক্তিমার্গেরসাধনা শেষ করার পর তিনি জ্ঞানমার্গে সাধনা করলেন। তিনি যে পরিকল্পনা করে একটার পর একটা সাধনা করে যাচ্ছিলেন তা নয়। দেখা যাচ্ছে যে, একজনের পর একজন গুরু এসে যাচ্ছে। জ্ঞানমার্গে সাধন করার সময়েও দেখা গেল যে তোতাপুরী এলেন দক্ষিণেশ্বরে। ঠাকুরকে তিনি চিনতেনও না, ঠাকুবকে বেদান্ত শেখাবেন, এমন কোন ইচ্ছাও আগে থেকে তাঁর ছিল না। তিনি তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। বেড়াতে বেড়াতে দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে এসে উঠেছিলেন। তিন দিনের বেশি তিনি কোন জায়গায় থাকতেন না। ঠিক করেছিলেন এখানেও তিন দিন থেকে চলে যাবেন। কিন্তু দক্ষিণেশ্বরে এসেই ঘাটের কাছে ঠাকুরকে দেখে তিনি চমকে উঠলেন: এ তো খুব ভাল আধার! বেদান্ত-সাধনের ঠিক ঠিক অধিকারী। নিজে যেচে ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি বেদান্ত-সাধন করবে? ঠাকুর বললেন: আমি কিছু জানি না, আমার মা সব জানেন। মা যদি বলেন, তাহলে শিখব। ‘মা’ মানে স্বয়ং জগদম্বা। মা বললেন যে, হ্যাঁ, শেখ। তোমাকে শেখানোর জন্যই ইনি এখানে এসেছেন। তারপরে নির্দিষ্ট দিনে বিরজাহোম করে তোতাপুরী তাঁকে সন্ন্যাস দিলেন। সন্ন্যাসের পর শুরু হল বেদান্তশিক্ষা। তোতাপুরী ঠাকুরকে বললেন: মনকে নির্বিকল্প করে নামরূপের গণ্ডি ছাড়িয়ে চলে যাও। কিন্তু মুস্কিল হল তাঁর ‘মা’কে নিয়ে। যতই ধ্যান করতে চেষ্টা করেন ততই ‘মা’ এসে তাঁর মন জুড়ে দাঁড়ায়। পর পর তিন দিন এরকম হল। তৃতীয় দিন তোতাপুরী একটা কাচের টুকরো তাঁর দুই ভ্রূর মাঝে বিঁধিয়ে দিয়ে বললেন: এইখানে মনকে গুটিয়ে আন। তাই করলেন তিনি। মায়ের মূর্তি মনে দেখা দেওয়া মাত্র ‘জ্ঞান-অসি’ দিয়ে সেই মূর্তি দ্বিখণ্ড করে ফেললেন। আর কোন বিকল্প রইল না মনে। হুহু করে নামরূপের গণ্ডি ছাড়িয়ে কোথায় চলে গেলেন তিনি। নির্বিকল্প সমাধিতে ডুবে গেলেন। যে নির্বিকল্পভুমিতে পৌঁছতে তোতাপুরীকে চল্লিশ বছর কঠোর সাধনা করতে হয়েছিল, তিন দিনে শ্রীশ্রীঠাকুর সেখানে পৌছে গেলেন। পর পর তিন দিন তিনি নির্বিকল্প সমাধিতে ডুবে রইলেন। তারপর মন্ত্র উচ্চারণ করে তোতাপুরী তাঁকে আবার সাধারণ-ভূমিতে নামিয়ে আনলেন। এরপর ঠাকুর প্রায় ছ’মাস নির্বিকল্পভূমিতে ছিলেন। ছ’মাস পরে তিনি শুনলেন যে ‘মা’ তাঁকে বলছেন; তুই ভাবমুখে থাক। তারপর ধীরে ধীরে তাঁর শরীরটা নির্বিকল্পভূমি থেকে নেমে এল।

‘ভাবমুখে থাকা’ সম্বন্ধে লীলাপ্রসঙ্গে খুব বিস্তৃত আলোচনা আছে। ভাবমুখে আছেন অর্থাৎ অদ্বৈতভূমি আর দ্বৈতভূমির ঠিক সীমারেখায় দাঁড়িয়ে আছেন। যখন নির্বিকল্পভূমিতে আছেন তখন তাঁর মধ্যে একটুও ‘আমি’ নেই, জীব জগৎ কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই তাঁর কাছে। কিন্তু যখন ‘ভাবমুখে’ আছেন তখন ‘আমি’ আছে— সেই আমি ‘বিরাট আমি’ এবং দেখছেন যে জীব জগৎ সব তিনিই হয়েছেন, তিনিই সবকিছু। তিনি যে বলছেন ‘বিজ্ঞান’ বা তিনি যে বলছেন ‘অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বেঁধে যা ইচ্ছা কর’—এই হচ্ছে সেই অবস্থা। তিনি তো এমন কিছু বলেননি, যা তিনি উপলব্ধি করেননি। অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বেঁধে তিনি ছিলেন। ‘আঁচলে বাঁধা’ অর্থাৎ প্রতিদিনকার জীবনে সেটা প্রয়োগ করা। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অদ্বৈততত্ত্বকে প্রয়োগ করা। স্বামীজী যে বলেছিলেন, বনের বেদান্তকে ঘরে আনবেন, ঠাকুরকে দেখেছিলেন বলেই একথা বলতে পেরেছিলেন। ঠাকুরকে দেখে তিনি বুঝেছিলেন যে, বেদান্তের তত্ত্বকে প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োগ করা যায়। জগৎকে বর্জন করার দরকার নেই, অনিত্য বলে উপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই, ব্রহ্মের প্রকাশ হিসেবে একে স্বীকার করে নেওয়া যায়। ঠাকুরের জীবনে দেখছি, সমস্ত জীবজগতের সঙ্গে তিনি নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছেন। দেখছেন: তিনিও যা, জীবজগৎও তা; তিনিও ব্রহ্ম, জগৎও ব্রহ্ম। ব্রহ্ম সত্য, জগৎও সত্য। ঘাসের উপর দিয়ে কে হেঁটে যাচ্ছে, তাঁর মনে হচ্ছে তাঁর বুকের উপর দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় অধীর হয়ে উঠছেন। মাঝনদীতে নৌকার মধ্যে একজন আর একজনের পিঠে চড় মেরেছে। ঠাকুর চিৎকার করে উঠেছেন যন্ত্রণায়! পিঠে লাল দাগ পড়ে গেছে—যেন তাঁর পিঠেই কেউ মেরেছে। সামান্য একটু উদ্দীপনাতেই তিনি নির্বিকল্প-ভূমিতে চলে যাচ্ছেন, আবার নেমে এসে দেখছেন সব ‘তিনি’। তাঁর সেই শেষ অসুখের সময়—তিনি রয়েছেন কাশীপুরে। গলায় ক্যানসার, অসহ্য যন্ত্রণা। অথচ মুখ আনন্দে জ্বলজ্বল। যেন তাঁর শরীর নয়, অন্য কারও শরীরে ব্যাধি হয়েছে। বলছেন: কি দেখছি জান? শরীরটা যেন বাঁখারিসাজান কাপড়মোড়া, সেইটে নড়ছে। ভিতরে একজন আছে বলে তাই নড়ছে।(২-২৭-৪) আবার বলছেন: একটা চামড়া ঢাকা অখণ্ড, আর এক পাশে গলার ঘা-টা পড়ে রয়েছে। (ঐ) পরিষ্কার দেখছেন, শরীর থেকে তিনি আলাদা। শরীরটা কষ্ট পাচ্ছে, তাঁর কিছু না। তিনি শরীর নন, অখণ্ডসচ্চিদানন্দ। বলছেন: শরীরটাকে দেখছি একটা খোল। আর এই খোলের ভেতরে-বাইরে এক ব্ৰহ্ম বিরাজ করছে। সচ্চিদানন্দ কেবল একটা খোল আশ্রয় করে এই খোলের অন্তরে বাহিরে রয়েছেন! (ঐ) এই অসুখের সময় স্বামীজী একবার তাঁকে ধরে বসেছিলেন: মা তো আপনার কথা শোনেন, আমাদের দিকে তাকিয়ে মাকে একবার বলুন যাতে আপনার অসুখটা সারিয়ে দেন, যাতে একটু আপনি খেতে পারেন। এঁদের পীড়াপীড়িতে মাকে বললেন সেকথা। মা দেখিয়ে দিলেন: কেন, এই যে এত মুখে খাচ্ছিস? এতেও তোর হচ্ছে না? ঠাকুর বলছেন; মার এই কথা শুনে আমি আর লজ্জায় মুখ খুলতে পারলাম না। শ্বেতাশ্বতর-উপনিষদে আছে:২৭ ‘সর্বতোহক্ষিশিরোমুখম্’। যত প্রাণী জগতে আছে, তাদের সকলের চোখ, মাথা ও মুখ আসলে সেই ব্রহ্মেরই। ব্ৰহ্মকে যিনি জানেন, তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান। ‘ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি’।২৮তিনি তখন দেখেন, সব চোখই তাঁর চোখ, সব মুখই তাঁর মুখ। ঠাকুরের জীবনে আমরা সেটাই দেখছি। জগতের সকলের দুঃখে তিনি দুঃখবোধ করছেন, নিজের অসহ্য শারীরিক কষ্টের মধ্যেও ধর্মপ্রসঙ্গ করে যাচ্ছেন। তিনি যেন নিশ্চিন্তে শরীরত্যাগও করতে পারছেন না। যাবার আগে প্রিয়তম শিষ্য নরেন্দ্রনাথকে জগতের কাজে উৎসর্গ করে যাচ্ছেন। শ্রীশ্রীমাকে বলে যাচ্ছেন: শুধু কি আমারই দায়, তোমারও দায়। নিজের ‘দায়’ তাঁর উপর অর্পণ করে যাচ্ছেন। বলছেন: আমার মুক্তি নেই। আবার আসতে হবে আমাকে। —জগতের প্রতি কেন তাঁর এত ভালবাসা? কারণ, সর্বভূতে তিনি নিজেকে দেখছেন। জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ তিনি, তাই তিনি প্রেমিকশ্রেষ্ঠও।

আকর-তালিকা

 । অমৃতবিন্দু-উপনিষদ্‌, ১২

 । শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্‌, ৬/১১

 । চর্পটপঞ্জরিকাস্তোত্র, শঙ্করাচার্য, ১৭

 । পঞ্চদশী, ৭/১৬৪

 । গীতা, ৪/৩৭

 । শিবপুরাণ, জ্ঞানসংহিতা, ৫ম অধ্যায়, ৭

 । গীতা, ২/২৩

 । ঐ, ২/২৫

 । ঐ, ২/২০

১০। নির্বাণষট্‌কম্‌, শঙ্করাচার্য, ১, ২, ৬

১১। বেদান্তসার, ১১৯

১২। কঠোপনিষদ্‌, ২/১/১২

১৩। ঐ, ২/২/১৩

১৪। মুণ্ডকোপনিষদ্‌, ২/২/৮

১৫। শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্‌, ৪/১৬

১৬। বিবেকচূড়ামণি, ৩৩

১৭। ঐ, ৩১৯

১৮। গীতা, ২/৫৬, ৬৪

১৯। মুণ্ডকোপনিষদ্‌, ৩/১/৩

২০। বৃহদারণ্যকোপনিষদ্‌, ৪/৪/২৩

২১। গীতা, ৫/১৮

২২। ঈশোপনিষদ্‌, ৬

২৩। যুগনায়ক, ১ম খণ্ড, ১৩৮৪, পৃঃ ৪২১-২২

২৪। ঐ, পৃঃ ৪২১

২৫। বাণী ও রচনা, ৯ম খণ্ড, ১৩৮৪, পৃঃ ৩৯

২৬। Prabuddha Bharata, 1975, April & May, pp. 171, 214

২৭। শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্‌, ৩/১৬

২৮। মুণ্ডকোপনিষদ্‌, ৩/২/৯

* ‘মায়ামাত্ৰমিদং দ্বৈতং অদ্বৈতং পরমার্থতঃ’ —পরমার্থত অর্থাৎ আসলে এক সত্তা, মায়ার জনা দুই বলে মনে হচ্ছে। [মাণ্ডুক্যকাবিকা (আগম প্রকরণ), ১৭]

* দীপ্তশিরা জলরাশিমিব’। (বেদান্তসার, ৩১)।

* এ প্রসঙ্গে ব্যাসদেব ও গোপীদের গল্প স্মরণীয়। দ্রষ্টব্য: ‘কর্মের ফল আকাঙ্ক্ষা ক’রবে না।’

* Ramakrishna: His Life and Sayings. F. Max Mueller. Edited by Nanda Mookerjee, 1978, p. 69

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *