জ্ঞাতি-শত্ৰু

জ্ঞাতি-শত্ৰু

প্রথম পরিচ্ছেদ 

বেলা একটা বাজিয়া গিয়াছে। কিছুক্ষণ পূৰ্ব্বে গলদ ঘৰ্ম্ম হইয়া আমি আদালত হইতে ফিরিয়া আসিয়াছি এবং অফিস-ঘরে বসিয়া বিশ্রাম করিতেছি। নিৰ্ম্মল মেঘমুক্ত আকাশে দিনমণি প্রখর কিরণ বিকিরণ করিতেছে। সেই প্রচণ্ড মার্তণ্ডতাপে সহরের রাজপথগুলি জ্বলন্ত অগ্নিমূর্তি ধারণ করিয়াছে। অবসর বুঝিয়া, প্রভঞ্জন ভীমনাদে চারিদিকে প্রবাহিত হইতেছে। পবনের ভীম পরাক্রম সহ্য করিতে না পারিয়াই যেন রাজপথের ধূলিকণা সকল ক্রোধে অগ্নিকণা মূর্ত্তি ধারণ করিয়া চারিদিকে পলায়ন করিতেছে। পথে লোকসমাগম অতি বিরল। কেবল মধ্যে মধ্যে দুই একখানা তৃতীয় শ্রেণীর ভাড়াটীয়া গাড়ি দুই একটি আরোহী লইয়া মন্থরগতিতে নির্দ্দিষ্ট পথে গমন করিতেছে। 

এমন সময়ে একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ি থানার সম্মুখে আসিয়া স্থির হইল। আমার কৌতূহল জন্মিল। ভাবিলাম, বিশেষ বিপদ না হইলে কেহ আর সেই ভয়ানক রৌদ্রে থানায় আইসে না। বুঝিলাম, ব্যাপার গুরুতর। অফিস-ঘরের সম্মুখেই থানার ফটক। জানালা দিয়া দেখিলাম, এক যুবক সেই গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন এবং দ্বারস্থ কনেষ্টবলকে কি জিজ্ঞাসা করিয়া, তাহার সহিত অফিস ঘরের দরজার দিকে আসিতে লাগিলেন। 

কিছুক্ষণ পরেই কনেষ্টবল তাঁহাকে আমার সম্মুখে আনয়ন করিলেন। তিনি নমস্কার করিলে আমি তাঁহাকে বসিতে বলিলাম। তিনি তখনই আমার অনুরোধ রক্ষা করিয়া কাঁদকাদস্বরে বলিলেন, “মহাশয়! আমার সর্বনাশ হইয়াছে। আমার পিতৃস্থানীয় জ্যেষ্ঠকে কে হত্যা করিয়াছে।” 

অতি কষ্টে এই কথাগুলি বলিয়া যুবক মস্তক অবনত করিলেন। তাঁহার চক্ষু দিয়া দরদরিতধারে বাষ্পবারি বিগলিত হইতে লাগিল। আমি তাঁহার সে অবস্থায় কোন কথা জিজ্ঞাসা করা যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা করিলাম না। 

যুবকের বয়স অনুমান ত্রিশ বৎসর। তাঁহাকে দেখিতে গৌরবর্ণ ও সুপুরুষ। কিন্তু তাঁহার দেহের লাবণ্য ছিল না। চক্ষুদ্বয় প্রশস্ত হইলেও যেন কোটরগ্রস্ত, তাহার নিম্নে কালিমা-রেখা। ভ্রাতৃবিয়োগে তাঁহার এই প্রকার পরিবর্তন হইয়াছে কি না তাহা বুঝিতে পারিলাম না। যুবকের পরিধানে একখানি পালা কালাপেড়ে ধুতি, একটা আদ্দির পাঞ্জাবি জামা, একখানি চাদর। পায়ে এক জোড়া বার্ণিস করা জুতা। 

কিছুক্ষণ পরে যুবক কথঞ্চিৎ শান্ত হইলে আমি অতি মৃদু ভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম “কে আপনার জ্যেষ্ঠকে হত্যা করিয়াছে? কি হইয়াছে, সকল কথা পরিষ্কার করিয়া বলুন, আমি এখনই আপনার সহিত যাইতেছি।” 

আমার কথায় যুবক আমার মুখের দিকে চাহিলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়া বোধ হইল, তিনি যেন অনেকটা আশ্বস্ত হইয়াছেন। পরে অতি বিনীত ভাবে বলিলেন “আমার জ্যেষ্ঠ আজ বেলা দশটার পর মারা পড়িয়াছেন। লোকে বলিতেছে, তিনি ওলাউঠা রোগেই মারা পড়িয়াছেন। আমার কিন্তু সেরূপ মনে হয় না। আমার কেন, আমার ভ্রাতৃবধূর পৰ্য্যন্ত ভয়ানক সন্দেহ হইয়াছে।” 

যে ভাবে যুবক কথাগুলি বলিলেন, তাহাতে আমারও কেমন সন্দেহ হইল। ঘটনা কি? কিরূপ অবস্থায় যুবকের ভ্রাতার মৃত্যু হইয়াছে? কিছুই জানিলাম না, অথচ তাঁহার কথা শুনিয়াই কেমন সন্দেহ জন্মিল। জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার জ্যেষ্ঠের নাম কি?” 

যুবক উত্তর করিলেন “হরিসাধন বন্দ্যোপাধ্যায়।” 

আ। আপনার নাম? 

যু। শক্তিসাধন বন্দ্যোপাধ্যায়। 

আ। আপনাদের নিবাস কোথায়? 

যু। বাগবাজারে। 

আ। এ বৎসর চারিদিকেই কলেরার উপদ্রব। প্রতিদিন কতশত লোক ওলাউঠায় প্রাণ দিয়েছে। সহর বলিয়া বিশেষ কিছু জানিতে পারা যায় না। আপনার জ্যেষ্ঠও সেই পথে গিয়াছেন; ইহাতে আপনার সন্দেহ হইল কেন? 

যুবক আবার আমার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। পরে অতি মৃদুস্বরে বলিলেন “সকল কথা না বলিলে, আপনি আমার সন্দেহের কারণ বুঝিতে পারিবেন না। কিন্তু এখন তাহা বলিবার উপায় নাই।” 

আমি তাঁহার কথায় বিস্মিত হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম “কেন? উপায় নাই কেন?” 

যুবক অতি বিনীত ভাবে বলিলেন “হয় ত এতক্ষণ দাদার দেহ তীরস্থ করা হইয়াছে। হয় ত দাহকাৰ্য্যও সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। যদি তাহাই হইয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে প্রমাণের প্রধান উপায় থাকিবে না।” 

যুবকের কথা আমি ভাল বুঝিতে পারিলাম না। মনে মনে বিরক্ত হইলাম; কিন্তু রূঢ়ভাবে বলিলাম “আপনার মনের কথা কি পরিষ্কার করিয়া বলুন? আমাকে আপনি কি করিতে বলেন? কেমন করিয়া আপনায় সাহায্য করিব?” আমি যে আন্তরিক বিরক্ত হইয়াছি, তাহা যুবক আমার কথাতেই বুঝিতে পারিলেন। তিনি অতি বিনীত ভাবে বলিলেন “দাদার মৃত্যুতে আমার যথেষ্ট অপকার হইয়াছে। তিনি আমার পিতৃস্থানীয় ছিলেন। আমি তাঁহার অন্নে প্রতিপালিত। সেই কারণে তাঁহার সহসা মৃত্যুতে আমি একপ্রকার উন্মাদের মত হইয়া গিয়াছি। কি করিতেছি, কি বলিতেছি, কিছুরই স্থিরতা নাই। আমাকে ক্ষমা করুন—আমার সন্দেহ এই যে, দাদাকে কেহ বিষ খাওয়াইয়া হত্যা করিয়াছে। কিন্তু লোকে তাহা না বুঝিয়া তিনি কলেরায় মারা পড়িয়াছেন, এই প্রকার রাষ্ট্র করিয়াছে, আপনি এখন যাহা কর্ত্তব্য তাহাই করুন। আমার মস্তিষ্কের স্থিরতা নাই।” 

যুবকের শেষ কথায় তাঁহার পূর্ব্বের কথার অর্থ বুঝিতে পারিলাম। শশব্যস্তে জিজ্ঞাসা করিলাম “যদি আপনার এই সন্দেহ হইয়াছিল, তবে এতক্ষণ আমায় সংবাদ দেন নাই কেন? দশটার পর আপনার জ্যেষ্ঠের মৃত্যু হইয়াছে, আর বেলা এখন প্রায় দুইটা। লাস কি দাহ হইয়া গিয়াছে বোধ হয়?” 

আমার প্রশ্নে যুবক যেন চমকিত হইলেন। আমি তাঁহার মনোগত উদ্দেশ্য ভাল বুঝিতে পারিলাম না। কিন্তু তিনি তখনই আত্মসংবরণ করিয়া বলিলেন “আজ্ঞে না, দাহকাৰ্য্য বোধ হয় এখনও হয় নাই। তবে মৃতদেহ ঘাটে লইয়া গিয়াছে।” 

আ। কোন্ ঘাটে? 

যু। কাশী মিত্রের ঘাটে। 

আমি আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া তখনই কাশী মিত্রের ঘাটের রেজিস্ট্রারকে টেলিফোন করিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “হরিসাধন বন্দ্যোপাধ্যায় নামে কোন ভদ্রলোকের মৃতদেহ তীরস্থ করা হইয়াছে কি না? যদি হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার দাহকার্য আরম্ভ হইয়াছে কি না?” 

উত্তরে রেজিষ্ট্রার বলিলেন “লাস তীরস্থ হইয়াছে। দাহকার্য আরম্ভ হয় নাই, উদ্যোগ হইতেছে।” 

আমি পুনরায় টেলিফোনের সাহায্যে তাঁহাকে মৃতদেহ দাহ করিতে অনুমতি দিতে নিষেধ করিলাম কিন্তু যুবককে কোন কথা বলিলাম না। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

এই সকল কার্য্য শেষ করিয়া আমি যুবকের সহিত তাঁহার বাড়ী যাইতে প্রস্তুত হইলাম; এবং তাঁহার সহিত সেই ভাড়াটীয়া গাড়িতে আরোহণ করিলাম। কোচম্যান শকট চালনা করিল। 

কিছুদূর গমন করিলে পর আমি শক্তিসাধনবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার জ্যেষ্ঠের বয়স কত?” শক্তিসাধন অতি নম্রস্বরে উত্তর করিলেন “দাদা আমা অপেক্ষা দশ বৎসরের বড়। দাদার পর আমার আরও দুইটি ভ্রাতা ছিলেন, তাঁহারা উভয়েই অকালে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন।” 

আ। আপনার দাদা কি কর্ম্ম করিতেন? 

শ। আপাততঃ কোন কৰ্ম্মহ করিতেন না। নিজের যৎসামান্য সম্পত্তি আছে তাহাই দেখিতেন। 

আ। পৈতৃক সম্পত্তি? 

শ। আজ্ঞে না—দাদার উপার্জিত সম্পত্তি। জ্ঞাতিগণ মোকদ্দমা করিয়া আমাদের পৈতৃিক সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করিয়াছেন। আমি কিম্বা আমার জ্যেষ্ঠ আমাদের পৈতৃক সম্পত্তির এক কপদকও পাই নাই। 

আ। তবে ত আপনার দাদার যথেষ্ট শত্রু আছে দেখিতেছি। যখন জ্ঞাতিগণের সহিত আপনাদের বিবাদ, তখন তাঁহারাই যে আপনাদের শত্রু তাহা ত বেশ বোঝা যাইতেছে। আপনাদের জ্ঞাতিবর্গের বাড়ী কোথায়? 

শ। আজ্ঞে আমাদের বাড়ী হইতে প্রায় অর্দ্ধ ক্রোশ দূরে। তাঁহাদের বাড়ী শোভাবাজারের নিকট। 

আ। সেই বাড়ীই কি আপনাদের পৈতৃিক সম্পত্তি? 

শ। আজ্ঞে হাঁ-মোকদ্দমায় পরাজিত হইলে দাদা স্ব-ইচ্ছায় সে বাড়ী ত্যাগ করিয়াছিলেন। ঈশ্বরের কৃপায় তাঁহার কয়েকখানি ভাড়াটীয়া বাড়ী আছে। তিনি পৈতৃক বাড়ী ত্যাগ করিয়া বাগবাজারে নিজ বাটীতে আসিয়া বসবাস আরম্ভ করেন। 

আ। আপনি অবশ্য সেই বাড়ীতেই থাকেন? 

শক্তিসাধন কোন উত্তর করিলেন না দেখিয়া আমার সন্দেহ হইল। আমি তাঁহাকে পুনরায় ওই কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি সেবারেও কৌশলে আমার কথাটা চাপা দিলেন। আমি কারণ বুঝিতে পারিলাম না। আমার সন্দেহ যেন উত্তরোত্তর বাড়িতে লাগিল। আমি তখন তাঁহার দিকে চাহিয়া কিছু কর্কশ ভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি কোথায় বাস করেন? 

আমার প্রশ্নে যুবক চমকিত হইলেন। কিন্তু সেবার আর কথাটা চাপা দিতে পারিলেন না। তাঁহার মুখ আরক্তিম ভাব ধারণ করিল, তিনি মস্তক অবনত করিয়া বলিলেন “আজ্ঞে আমি কাশীপুরে বাস করি।” 

আমি স্তম্ভিত হইলাম। ভাবিলাম, ইহার ভিতরে কোন গূঢ় রহস্য আছে। পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম “তবে এই মাত্র যে বলিলেন, আপনার দাদাই আপনার অন্নদাতা ছিলেন? কথাটা ভাল বুঝিতে পারিলাম না।” 

লজ্জার হাসি হাসিয়া শক্তিসাধন উত্তর করিলেন, যদিও আমি কাশীপুরে বাস করি, তত্রাপি প্রতিদিন দুই বেলা দাদার বাড়ীতে গিয়া আহারাদি করিতম। আমাকে না খাওয়াইয়া দাদা কিম্বা তাঁহার স্ত্রী আহার করিতেন না। 

আ। আপনার বাড়ীতে কে থাকে? 

শ। আজ্ঞে আমি একাই থাকি। 

আমার সন্দেহ আরও বাড়িতে লাগিল। শক্তিসাধনবাবুর কথা আমি তখনও ভালরূপ বুঝিতে পারিলাম না। পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম “সে বাড়ীখান কাহার?”

লজ্জিত হইয়া অতি ধীরে ধীরে শক্তিসাধন বলিলেন “আজ্ঞে সেখানি ভাড়াটীয়া বাড়ী।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, কিছুক্ষণ পূর্ব্বে বলিয়াছিলেন যে, আপনার জ্যেষ্ঠের কয়েকখানি ভাড়াটীয়া বাড়ী আছে, তাঁহারই আয় হইতে তিনি পরিবারবর্গের ভরণ পোষণ করিয়া থাকেন। যদি তাহাই হয়, তবে আপনি কেন স্বতন্ত্র ভাড়াটীয়া বাড়ীতে থাকেন? বাড়ীর ভাড়া কত? 

শ। আজ্ঞে পনর টাকা মাত্র। 

আ। আপনি কি কার্য্য করেন? 

শক্তিসাধন লজ্জায় কোন উত্তর করিলেন না, মস্তক অবনত করিয়া রহিলেন। আমি পুনরায় প্রশ্ন করিলাম, তখন তিনি অতি কষ্টে উত্তর করিলেন “আজ্ঞে কোন কার্য্য করি না। আমি নিষ্কর্ম্মা-কেবল দাদার গলগ্রহ ছিলাম।” 

আ। বাড়ীভাড়াও তিনিই দিতেন? 

শ। আজ্ঞে হাঁ-তিনি প্রতি মাসে আমার ব্যয়ের জন্য কিছু করিয়া অর্থ দিতেন। 

আমি কিছুক্ষণ কোন কথা কহিলাম না। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি আপন জ্যেষ্ঠের সঙ্গে বাড়ীতে থাকেন না কেন? যখন তিনি আপনার সকল ভারবহন করিতেছেন, তখন তিনি আপনাকে এক বাড়ীতে রাখেন না কেন? শক্তিসাধনের মুখ সহসা পাংশুবর্ণ ধারণ করিল। তিনি সহসা কোন উত্তর করিলেন না। মস্তক অবনত করিয়া একমনে কি ভাবিতে লাগিলেন। 

এমন সময় কোচম্যানের চীৎকারধ্বনি আমাদের কর্ণ গোচর হইল। শক্তিসাধন চমকিয়া উঠিলেন এবং গাড়ি হইতে মুখ বাহির করিয়া তাঁহার জ্যেষ্ঠের বাড়ী দেখাইয়া দিলেন, কোচম্যান সত্বর নির্দ্দিষ্ট স্থানে গিয়া উপস্থিত হইল। আমি অগ্রে গাড়ি হইতে অবতরণ করিলাম, শক্তিসাধন পরে নামিলেন এবং কোচম্যানকে ভাড়া দিয়া আমাকে লইয়া বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

হরিসাধনবাবুর বাড়ীতে প্রবেশ করিবার পূর্ব্বেই অন্তঃপুরবাসিনী রমণীগণের হৃদয়-ভেদী ক্রন্দনের রোল আমার কর্ণ গোচর হইল। সে করুণ রোদন, সে মর্ম্মস্পর্শী আর্তনাদ শ্রবণ করিলে কাহার হৃদয় না দ্রবীভূত হয়? আমি অনেক কষ্টে অশ্রু সংবরণ করিতে সক্ষম হইয়াছিলাম। 

হরিসাধনবাবুর আধুনিক বসতবাটীখানি নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে, সমগ্র বাড়ী ও তাহার চতুষ্পর্শ্বস্থ ও মধ্যস্থ পরিমাণ প্রায় দশ কাঠা হইবে। বাড়িখানি দ্বিতল। একতলে বাহির মহলের একটি বৈঠকখানায় শক্তিসাধন আমাকে লইয়া গেলেন। 

ঘরখানি বড়! দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে বার-তের হাতের কম নহে। ঘরখানি রাস্তার ঠিক পার্শ্বে, উহার আটটি জানালা ও দুইটি দরজা। ভিতরে মেজের উপর ঢালা বিছানা। প্রথমে মাদুর, পরে সতরঞ্চ, তাহার উপর একটা প্রকাণ্ড লেপ, সর্ব্বোপরি দুগ্ধফেননিভ শুভ্র একখানি চাদর। 

শক্তিসাধন সেই বিছানার উপর বসিতে অনুরোধ করিলেন। বিছানার একপার্শ্বে দুইটি বৈঠকে দুইটি বাঁধান হুঁকা ছিল। একটি ব্রাহ্মণের, অপরটি শূদ্রের জন্য। আমরা উত্তরে বসিবামাত্র একজন ভৃত্য (বেয়ারা) এক কলিকা তামাকু লইয়া অগ্নিতে ফুৎকার প্রদান করিতে করিতে গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিল এবং বৈঠক দুইটিকে আমাদের নিকট আনয়ন করিয়া, হস্তস্থিত কলিকাটি ব্রাহ্মণের হুঁকার উপর বসাইয়া শক্তিসাধনের হস্তে দিয়া প্রস্থান করিল। 

শক্তিসাধন ভৃত্যের হস্ত হইতে হুঁকাটি গ্রহণ করিয়া আমাকে দিলেন। কিন্তু আমি ধূমপান করি না জানিতে পারিয়া বিশেষ লজ্জিত হইলেন। আমি তাঁহাকে বলিলাম “এখন যেজন্য এখানে আসিলাম, তাহার কি করিতেছেন? আপনার দাদার কিরূপে মৃত্যু হয় এবং কখনই বা তাঁহার রোগের সূত্রপাত হয় সমস্ত কথা প্রকাশ করুন।” 

শক্তিসাধন উত্তর করিলেন “পূর্ব্বেই বলিয়াছি, গত কল্য এ বাড়ীতে একটি ভোজ ছিল। নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণের আহারাদির পর আমরা কয়েকজন বিশেষ আত্মীয় ব্যক্তি দাদার সহিত একসঙ্গে আহার করিতে বসি। বেলা দুইটার পর আমাদের আহার শেষ হয়। আমিও এই বৈঠকখানায় আসিয়া একপার্শ্বে শয়ন করি। একঘণ্টার মধ্যেই অন্যান্য সকলে স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাগমন করেন। কেবল আমিই এই স্থানে ছিলাম। বেলা বারটার সময় শুনিলাম, দাদা বমি করিতেছেন। আমি তখনই বাড়ীর ভিতরে গমন করিলাম এবং ডাক্তারবাবুকে সংবাদ দিবার জন্য লোক প্রেরণ করিতেছিলাম, কিন্তু দাদা আমাকে স্বয়ং নিষেধ করিলেন। তিনি বলিলেন, গুরু আহার বশতঃই ওইরূপ বমি হইয়াছে, শীঘ্রই আরোগ্য হইবে। দাদার স্ত্রীও তখন তাঁহার কথায় সায় দিলেন। কিছুক্ষণ পরে দাদা নিদ্রিত হইয়া পড়িলে আমি এখান হইতে প্রস্থান করিলাম।” 

সমস্ত কথা শুনিয়া আমি শক্তিসাধনবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম “তাহার পর?” 

শ। রাত্রি দশটার পর এখানকার ভৃত্য আমার বাসায় সংবাদ দিল, দাদার অসুখ বৃদ্ধি হইয়াছে। আমি তখন নিদ্রিত ছিলাম, কাজেই আসিতে বিলম্ব হইল। যখন এ বাড়ীতে আসিলাম, তখন রাত্রি প্রায় বারটা। বাড়ীতে আসিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার অন্তরাত্মা শুখাইয়া গেল। দেখিলাম, দাদা অচেতন অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছেন, ডাক্তারবাবু অতি মনোযোগের সহিত তাঁহার নাড়ী পরীক্ষা করিতেছেন, আর বাড়ীর মেয়েরা রোদন করিতেছেন। আমাকে দেখিয়া দাদার স্ত্রী আরও কাঁদিয়া উঠিলেন। আমারও চক্ষে জল আসিল, আর তথায় দাঁড়াইতে পারিলাম না। ধীরে ধীরে বৈঠকখানায় আসিয়া বসিয়া পড়িলাম। এইরূপে রাত্রি শেষ হইল। দাদার আর চৈতন্য হইল না। ডাক্তারবাবু হতাশ হইয়া আটটার সময় বাড়ী ফিরিয়া গেলেন। দশটার মধ্যেই দাদা আমাদের সকলকে কাঁদাইয়া এ পৃথিবী ত্যাগ করিলেন। 

শক্তিসাধনের সকল কথা শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। ভাবিলাম, যখন ডাক্তারবাবু প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত এখানে থাকিয়া রোগীর চিকিৎসা করিয়াছেন, তখন শক্তিসাধন কেমন করিয়া সন্দেহ করিলেন যে, হরিসাধনবাবুকে কেহ বিষপ্রয়োগে হত্যা করিয়াছেন। ডাক্তারবাবু যখন সার্টিফিকেট দিতে কিছুমাত্র দ্বিধা করিলেন না, তখন তিনি যে তাঁহার মৃত্যুতে কোনপ্রকার সন্দেহ করেন নাই তাহা বেশ বুঝিতে পারা যায়। শক্তিসাধনের অনুমান মিথ্যা বলা যায় না, যতক্ষণ না হরিসাধনবাবুর মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করিয়া পরীক্ষা করা যাইতেছে। পরীক্ষান্তে প্রকৃত সংবাদ পাওয়া যাইবে। কিন্তু শক্তিসাধন হঠাৎ এরূপ সন্দেহ করেন কেন? স্বীকার করি, তিনি তাঁহার দাদার নিকট বসিয়া আহার করিয়াছিলেন। যদি তিনি কাহাকেও খাদ্যের সহিত বিষ মিশ্রিত করিতে দেখিয়া থাকেন, তাহা হইলে তিনি তখনই তাঁহাকে গ্রেপ্তার করেন নাই কেন? 

এই প্রকার চিন্তা করিয়া আমি শক্তিসাধনের দিকে চাহিলাম ও তাঁহার আপাদমস্তক বিশেষ করিয়া নিরীক্ষণ করিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম আপনার দাদাকে কেহ বিষপ্রয়োগে হত্যা করিয়াছে এ সন্দেহ কেন হইল? যখন সকলেই এমন কি আপনাদের পারিবারিক ডাক্তার পর্যন্ত বলিতেছেন যে, তিনি কলেরায় মারা গিয়াছেন, আর যখন বাস্তবিকই এ পল্লিতে ভয়ানক কলেরার উপদ্রব, তখন তিনিও যে রোগে মারা পড়েন নাই, এ অবিশ্বাস আপনার কেন হইল? শক্তিসাধন সহসা কোন উত্তর করিলেন না। তিনি মস্তক অবনত করিয়া একমনে কি চিন্তা করিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে বলিলেন “পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, জ্ঞাতিশত্রু আমাদিগকে পৈতৃিক সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করিয়াছেন। সেই শত্রুই মৌখিক প্রণয় দেখাইয়া আবার এখানে আসিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। কাল যখন আহার করিতে বসি, তখন তিনি দাদার ঠিক পার্শ্বেই বসিয়াছিলেন, আহার করিতে করিতে তিনি অনেকবার দাদার পাতে হাত দিয়াছিলেন, সেইজন্যই আমার সন্দেহ।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “সে কি! আহার করিতে করিতে তিনি এরূপ করিয়াছিলেন কেন?” শক্তিসাধন ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন “সে কথা কেমন করিয়া বলিব?” 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি তবে কাহাকে সন্দেহ করেন বলুন? আর কি উপলক্ষে এই ভোজন হইয়াছিল?” 

শ। দাদা একটা নূতন বিষয় ক্রয় করিয়াছেন, সেই কারণেই আনন্দ ভোজের আয়োজন। সন্দেহের কথা আর কি বলিব, আপনাকে ত সকল কথাই বলিলাম। 

আ। আপনারাও পূর্ব্বে নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন এবং নিশ্চয়ই সে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়াছিলেন? 

শ। আজ্ঞে না, আমি সে পাত্র নই; নিমন্ত্রিত হইয়াছিলাম, যাই নাই। 

আ। আপনার জ্যেষ্ঠ নিশ্চয়ই গিয়াছিলেন এবং সেখানে আহারাদি করিয়া তাঁহাদিগকে অপ্যায়িত করিয়াছিলেন। শক্তিসাধন সম্মতিসূচক উত্তর দিলেন। আমি আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না; ভাবিলাম, শক্তিসাধন এত কথা বলেন কেন? আহারের কথা উল্লেখ করায় বোধ হইতেছে, তিনি সেই জ্ঞাতি-শত্রুকে আহারের সময় বিষপ্রয়োগে তাঁহার জ্যেষ্ঠের প্রাণসংহার করিয়াছে বলিয়া সন্দেহ করিয়াছেন, হরিসাধন বিষপ্রয়োগে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন কি না, মৃতদেহ পরীক্ষা করিলেই জানা যাইবে। যদি বাস্তবিক তাহাই হয়, তাহা হইলে সেই জ্ঞাতিকেই সন্দেহ করিয়া গ্রেপ্তার করা সর্ব্বতোভাবে উচিত কিন্তু তাহাতে শক্তিসাধনকে প্রথমে ফরিয়াদী হইতে হয়। 

এই প্রকার চিন্তা করিয়া আমি শক্তিসাধনকে বলিলাম, আমি আপনার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়াছি। আপনি সে জ্ঞাতিকেই সন্দেহ করিয়াছেন। মনে করিতেছেন, তিনি আহার করিবার সময় আপনার জ্যেষ্ঠের কোন খাদ্যের সহিত কৌশলে বিষ মিশ্রিত করিয়া দিয়াছেন। 

আমার কথা শেষ হইতে না হইতে শক্তিসাধন চমকিয়া উঠিলেন, আরও দুই একবার তিনি এরূপে চমকিত হইয়াছিলেন বলিয়া আমি আর সে বিষয় গ্রাহ্য করিলাম না। ভাবিলাম, ভ্রাতৃবিয়োগে লোকটার মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে। 

কিছুক্ষণ কি ভাবিয়া তিনি বলিলেন, আপনি সত্যই অনুমান করিয়াছেন। আমারও ঠিক সেইরূপ সন্দেহ হইয়াছে। ঠিক এই সময়ে দুই তিনজন আত্মীয় অতিবিষণ্ণবদনে ঘাট হইতে ফিরিয়া আসিলেন। একজন এক ভৃত্যকে তখনিই পারিবারিক ডাক্তারবাবুর বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলেন। শুনিলাম, ডাক্তারের সার্টিফিকেট প্রয়োজন। 

ভৃত্যকে ডাক্তারের বাড়ীতে পাঠাইয়া দিয়া তাঁহারা সকলেই সেই বৈঠকখানায় প্রবেশ করিলেন। তখন শক্তিসাধনবাবু আমাকে নির্দেশ করিয়া বলিলেন যে, আমি তাঁহার জ্যেষ্ঠের আকস্মিক মৃত্যুতে সন্দেহ করিয়া অনুসন্ধানের জন্য সেখানে গমন করিয়াছি। তিনিই যে আমাকে সেখানে ডাকিয়া লইয়া গিয়াছিলেন, এ কথা তিনিও বলিলেন না, আমিও উল্লেখ করিলাম না। 

আমাকে দেখিয়া তাঁহারা আশ্চর্যান্বিত ও বিরক্ত হইলেন। ভাবিলেন, এই বিপদের সময় আমি তাঁহাদিগকে কষ্ট দিবার জন্যই সেখানে গমন করিয়াছি। 

কিছুক্ষণ পরে একজন জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনিই কি তবে ঘাটের রেজিষ্ট্রারবাবুকে দাহ করিবার অনুমতি দিতে নিষেধ করিয়াছেন? 

আমি বিষম ফাঁপরে পড়িলাম, কিছুক্ষণ ভাবিয়া সত্যকথা প্রকাশ করিতেই মনস্থ করিলাম, পরে বলিলাম, শক্তিসাধনবাবু তাঁহার জ্যেষ্ঠের মৃত্যুতে সন্দেহ করিয়া থানায় সংবাদ দিয়াছিলেন, তাঁহার মুখে যেরূপ শুনিলাম, তাহাতে সকলেরই সন্দেহ হওয়া উচিত। 

যিনি আমাকে প্রশ্ন করিয়াছিলেন, আমার উত্তর শুনিয়া আন্তরিক বিরক্ত হইলেন। কিছু কর্কশস্বরে শক্তিসাধনবাবুকে বলিলেন, তবে আপনারই এই কাজ? আপনিই এই দাহকার্যে ব্যাঘাত ঘটাইয়াছেন? 

এই কথা শেষ হইতে না হইতে ভৃত্য ডাক্তারবাবুকে লইয়া প্রত্যাগমন করিল। সকল কথা শুনিয়া তিনি ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, আপনারা মিথ্যা ভয় করিতেছেন। আমি স্বয়ংই ঘাটে যাইতাম, কিন্তু বিশেষ কার্য্যোপলক্ষে যাইতে পারি নাই। হরিসাধনবাবু কলেরায় মারা পড়িয়াছেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। আমি এখনই সার্টিফিকেট লিখিয়া দিতেছি। 

এই বলিয়া ডাক্তারবাবু তখনই একখানা সার্টিফিকেট লিখিয়া দিলেন। যাঁহারা ঘাট হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন, তাঁহারা কাগজখানি লইয়া পুনরায় তথায় গমন করিলেন। শক্তিসাধন আমারই নিকট বসিয়া রহিলেন। 

ডাক্তারবাবু প্রস্থান করিবার পূর্ব্বে আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি কেমন করিয়া জানিলেন, হরিসাধনবাবু কলেরায় মারা পড়িয়াছেন? শক্তিসাধনবাবুর সন্দেহ-কোন লোক বিষপ্রয়োগে তাঁহাকে হত্যা করিয়াছে।” 

ডাক্তারবাবু ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, ভ্রাতার প্রাণবিয়োগে বোধ হয় উঁহার মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়া গিয়াছে, নতুবা তাঁহার এরূপ সন্দেহ হইবে কেন? 

আ। আপনি কি দৃঢ়বিশ্বাস করেন যে, তিনি কলেরায় মারা গিয়াছেন? 

ডা। আজ্ঞে হাঁ। সন্দেহের কোন কারণ নাই। 

আ। কেন নাই? হরিসাধনবাবুর শত্রুর অভাব ছিল না। 

ডাক্তারবাবু হাসিয়া উঠিলেন, তিনি বলিলেন, হরিসাধনবাবুর শত্রু? না মহাশয়, আমার বোধ হয়, তাঁহার আর কোন শত্রু নাই। 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম, জিজ্ঞাসা করিলাম, তাঁহার জ্ঞাতি-ভ্রাতাগণ কি মোকদ্দমা করিয়া, তাঁহার পৈতৃক সম্পত্তি দখল করিয়া লন নাই? 

ডা। আজ্ঞে হাঁ, লইয়াছেন, কিন্তু এখন আর তাঁহাদের সহিত হরিসাধনবাবুর মনোমালিন্য নাই। রসময়বাবুর কন্যার বিবাহে জ্ঞাতি-ভ্রাতাগণের সহিত তাঁহার সদ্ভাব হইয়াছিল। এখন তাঁহারা আর হরিবাবুর শত্রু নহেন, বিশেষ বন্ধু বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। 

আ। আপনি সেরূপ মনে না করিলেও তাঁহার ভ্রাতা শক্তিসাধনবাবু সেরূপ ভাবেন না। তিনি বলিয়াছেন, তাঁহাদের জ্ঞাতি-ভ্রাতাগণ মৌখিক আলাপ রাখিয়া ভিতরে ভিতরে তাঁহার জ্যেষ্ঠের সর্ব্বনাশের চেষ্টায় ছিলেন। এখন সুবিধা পাইয়া কাৰ্য্য সিদ্ধি করিয়াছেন। 

ডাক্তারবাবু গম্ভীর ভাবে বলিলেন “শক্তিসাধনবাবুর এইরূপ অন্যায় সন্দেহের কোন কারণ নাই। কিন্তু যখন তিনি সন্দেহ করিয়া এই সকল কথা পুলিসের গোচর করিয়াছেন, তখন আপনারা অবশ্যই তাহার সন্ধান লইবেন। কিন্তু আমি যতদূর জানি, তাহাতে হরিসাধনবাবুর জ্ঞাতি-ভ্রাতাগণকে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিদোষী বলিয়াই মনে হয়।” 

এই বলিয়া ডাক্তারবাবু তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। আমি শক্তিসাধনের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার জ্যেষ্ঠের পুত্রাদি কয়জন?” 

শক্তিসাধন অতি বিনীত ভাবে উত্তর করিলেন “দাদার দুই তিনটি সন্তান হইয়াছিল কিন্তু কালের বিচিত্র গতি-একটিও জীবিত নাই।” 

আমি আরও আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “তবে আপনি এখানে থাকেন না কেন?” 

শক্তিসাধন কথাটা এবারও চাপা দিবার চেষ্টা করিলেন কিন্তু পারিলেন না। অবশেষে আমার নির্ব্বন্ধাতিশয় দেখিয়া অতিশয় লজ্জিত হইয়া বলিলেন “আমি জাতিচ্যুত হইয়াই স্বতন্ত্র বাস করিতেছি।” 

অত্যন্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলম “সে কি? আপনি জাতিচ্যুত হইলেন কেন?” 

শ। সে সকল কথা আমায় আর জিজ্ঞাসা করিবেন না। ব্রাহ্মণের সন্তান হইয়া নীচজাতির হস্তে আহার করিয়াছিলাম, এই অপরাধে জাতিচ্যুত হইয়াছি। 

আ। আজ-কাল অনেকেই ত ওইরূপ করিতেছেন? 

শ। হইতে পারে–মিথ্যা নয়, কিন্তু আমার জ্যেষ্ঠ একজন গোঁড়া হিন্দু ছিলেন। তিনি হিন্দুত্ব বজায় রাখিতে সদাই যত্ন করিতেন। 

আ। এ বাড়ীতে আপনার ত অংশ আছে? 

শ। আজ্ঞে না। 

আ। কেন? 

শ। ইহা দাদার স্বোপার্জিত সম্পত্তি। আমাদের পৈতৃিক সম্পত্তি জ্ঞাতিগণ কাড়িয়া লইয়াছে। 

আমি তখন আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। শক্তিসাধনকে লইয়া ঘাটে গমন করিলাম। দেখিলাম, রেজিষ্ট্রার সার্টিফিকেটখানি পুলিস সাহেবের নিকট পাঠাইবার উদ্যোগ করিতেছেন। আমাকে দেখিয়া অনেকটা আশ্বস্ত হইলেন এবং কি করিবেন জিজ্ঞাসা করিলেন। 

আমি তখন হরিসাধনের মৃতদেহ দেখিতে ইচ্ছা করিলাম। রেজিষ্ট্রার সসম্ভ্রমে আমাকে সেই মৃতদেহের নিকট লইয়া গেলেন। পরে নিকটস্থ কোন লোককে আবরণ উন্মোচন করিতে আদেশ করিলেন। 

হরিসাধনের মৃতদেহ দেখিয়া আমার সন্দেহ আরও বর্দ্ধিত হইল। সহজ অবস্থায় মারা পড়িলে মৃতদেহ যেরূপ থাকে, ইহার অবস্থা তদপেক্ষা অনেক বিকৃত। আমি রেজিষ্ট্রারকে ভাল করিয়া পরীক্ষা করিতে অনুরোধ করিলাম। রেজিষ্ট্রার একজন প্রবীণ লোক। বয়স প্রায় পঞ্চাশ বৎসর। প্রায় পঁচিশ বৎসর কার্য্য করিতেছেন। মড়া দেখিয়া তাঁহার বিষয়ে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি জন্মিয়াছে। যখন তিনি প্রথমে হরিসাধনের মৃতদেহ দেখিয়াছিলেন, তখন কি বুঝিয়াছিলেন বলিতে পারি না কিন্তু আমার অনুরোধে তিনি দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করিয়া অতি গম্ভীর ভাবে বলিলেন “আপনার অনুমান সত্য বলিয়া বোধ হইতেছে। পূর্ব্বে অন্যরূপ বুঝিয়াছিলাম, কিন্তু এখন আমারও বিশেষ সন্দেহ হইতেছে। ডাক্তারের সার্টিফিকেট পাইলেও আমি এ দেহ সৎকারের হুকুম দিতে পারিব না। ইহাকে পরীক্ষা করিতেই হইবে।” 

আমিও সেইরূপ পরামর্শ দিলাম। তখন রেজিস্ট্রার সেই মৃতদেহ পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে পাঠাইয়া দিলেন। আমিও আর সেখানে কালবিলম্ব না করিয়া রেজিষ্টারের নিকট বিদায় লইলাম এবং শক্তিসাধনকে লইয়া শ্মশান হইতে বহির্গত হইলাম। পথে শক্তিসাধনের বাসার সন্ধান জানিয়া লইয়া তাঁহাকে বিদায় দিয়া আমি একাই হাসপাতালের দিকে গমন করিলাম। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

পদব্রজে গমন করিবার পর আমি চিৎপুর রোডে আসিয়া ট্রামের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। এমন সময়ে হরিসাধনবাবুর কয়েকজন আত্মীয় ঘাট হইতে বাড়ীতে ফিরিতেছিলেন দেখিতে পাইলাম। যদিও তাঁহারা আমারই পার্শ্ব দিয়া গমন করিলেন, তত্রাপি তাঁহারা আমাকে দেখিতে পাইলেন না। 

আমি দেখিলাম, তাঁহারা সকলেই বিষণ্ণ, কেবল একজন শক্তিসাধনের নাম করিয়া কি বলিতে বলিতে যাইতেছিলেন। শক্তিসাধনের নাম শুনিয়া আমারও সন্দেহ হইল। আমি দূরে থাকিয়া তাঁহাদের পশ্চাদনুসরণ করিতে লাগিলাম। 

কিছুদূর যাইতে না যাইতে তিনি বলিলেন “এ শক্তিরই কাজ! যে লোক ব্রাহ্মণের সন্তান হইয়া সামান্য বাগ্দিনীর হাতে ভাত খাইতে পারে, তাহার অসাধ্য কি?” 

তাহার কথা শেষ হইতে না হইতে অপর ব্যক্তি বলিলেন, “না–না, অমন কথা মুখে আনিও না। যে ব্যক্তি দাদার অনুগত, দাদার অন্নে প্রতিপালিত, এত অত্যাচার উৎপীড়ন করিলেও যে দাদা আপন সন্তানের ন্যায় ভালবাসিতেন, সে লোক কেন সহসা সেই দাদাকে হত্যা করিবেন? নিজের পায়ে নিজে কেন কুঠার মারিবেন?” 

প্রথম ব্যক্তি উত্তর করিলেন “আমি সে কথা বলি নাই। আমি বলিতেছি যে, শক্তিসাধন রসময়বাবুর উপর অত্যন্ত বিরক্ত। তিনি অন্যায় করিয়া রসময়ের উপর সন্দেহ করিয়া এ কার্য্য করিয়াছেন।” 

দ্বিতীয় ব্যক্তি শশব্যস্তে জিজ্ঞাসা করিলেন “সত্য না কি!” 

প্র। আমি যখন ডাক্তারের সার্টিফিকেট আনিতে বাড়ীতে ফিরিয়া গিয়াছিলাম, তখন সেই পুলিস-কৰ্ম্মচারীর মুখে শুনিলাম যে, শক্তি রসময়বাবুর নামে বৃথা সন্দেহ করিয়া এই অভিযোগ করিয়াছেন। 

দ্বি। যদি ইহা সত্য হয়, তাহা হইলে উভয়ের পক্ষেই বড় ভাল হইবে না। পুলিস সহজে ছাড়িবে না। 

প্র। যদি হরিবাবুর মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া সেরূপ সন্দেহ না হয়, তাহা হইলে বোধ হয় আর কোন গোলযোগ হইবে না। পরীক্ষা শেষ না হইলে ত আর সৎকার করা হইবে না। 

আমি আর তাঁহাদের অনুসরণ করা যুক্তিসিদ্ধ মনে না করিয়া তাঁহাদের নিকটে গমন করিলাম এবং অতি বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনারাই কি হরিসাধনবাবুর মৃতদেহের সৎকার করিতে গিয়াছিলেন?” 

একজন অতি কর্কশ ভাবে উত্তর করিলেন “আজ্ঞে হাঁ কিন্তু আপনাদের জন্যই সেই কার্য্যে ব্যাঘাত পড়িল। একে বিপদ, তাহার উপরে এই প্রকার অশান্তি, এমন করিলে লোকে কেমন করিয়া সুস্থমনে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিবে?” 

আমি অতি মৃদুবচনে উত্তর করিলাম “এ বিষয়ে আমার দোষ কি? যাঁহার সন্দেহ হইয়াছে, তাঁহাকে বলুন। আমি যতক্ষণ সংবাদ না পাইয়াছি, ততক্ষণ কিছু আর পরীক্ষা করিতে আসি নাই। বিশেষতঃ যদি বাস্তবিকই তাঁহার সন্দেহ সত্য হয়, তাহা হইলে আর আপনাদের অসন্তোষের কারণ কি? বোধ হয় আপনারা কেহই ইচ্ছা করেন না যে, হত্যা করিয়া লোকে নিষ্কৃতি লাভ করে।” 

যে ব্যক্তি আমার সহিত কথা কহিতেছিলেন, তিনি বলিয়া উঠিলেন, “আজ্ঞে না–আমাদের কাহারও সেরূপ ইচ্ছা নয়। কিন্তু যাঁহার কথায় বিশ্বাস করিয়া আপনি এই কার্য্যে ব্যাঘাত ঘটাইলেন, তিনিও নিতান্ত সহজ লোক নহেন।” 

আ। কেন? 

লো। রসময়বাবুর উপর তিনি হাড়ে চটা। 

আ। স্বাভাবিক। রসময়বাবু তাঁহাদের পৈতৃিক সম্পত্তি কাড়িয়া লইয়াছেন। 

লোকটি আশ্চর্যান্বিত হইলেন। তিনি আমার মুখের দিকে চাহিয়া ব্যঙ্গস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাঁহাদের সম্পত্তি কিরূপ? সম্পত্তি ত হরিসাধনবাবুরই ছিল।” 

আ। তাহাতে কি শক্তিসাধনবাবুর অংশ ছিল না? 

লো। আজ্ঞে না—তিনি ভ্রাতার নিকট আপনার অংশের মূল্য লইয়া তাঁহাকেই সেই অংশ বিক্রয় করিয়াছিলেন।

আ। তবে তিনি হরিসাধনবাবুর বাড়ীতে যাতায়াত করিতেন এবং তাঁহারই অন্ন ধ্বংস করিতেন কেন? 

লো। হরিসাধনবাবু দয়া করিয়া তাঁহার ভরণ-পোষণের সমস্ত ব্যয় নির্ব্বাহ করিতেন। এমন কি, কিছু করিয়া মাসোহারাও দিতেন। হরিবাবুর মৃত্যুতে শক্তিবাবুর বিশেষ অপকার হইয়াছে সন্দেহ নাই। 

আ। তাঁহার ভ্রাতাই ত হরিসাধনের বিষয়ের উত্তরাধিকারী? 

লোকটা ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন “আজ্ঞে সে সকল কথা আমরা ভাল জানি না। হরিবাবুর কোন সন্তান জীবিত নাই।” 

আ। রসময়বাবু কে? 

লো। হরিবাবুর জ্ঞাতি ভাই। 

আ। তাঁহাদের নিবাস কোথায়? 

লো। হাটখোলায়। 

আমি আর কোন প্রশ্ন না করিয়া পুনরায় চিৎপুর রোডের মোড়ে আসিয়া ট্রামের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম এবং কিছুক্ষণ পরেই হাসপাতালে গিয়া উপস্থিত হইলাম। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

যখন হাসপাতালে উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা প্রায় ছয়টা। সূৰ্য্যদেব তখন পশ্চিম গগনে ঢলিয়া পড়িয়াছেন। তাঁহার প্রখর প্রচণ্ড কিরণ ক্রমেই শীতল হইয়া আসিতেছে। মৃদুমন্দ মলয়পবন ধীরে ধীরে প্রবাহিত হইতেছে। বায়সাদি বিহঙ্গমকুল একে একে কুলায়াভিমুখে গমন করিতেছে। সরকারী কিম্বা সওদাগরী আপিসের কেরাণিগণ দৈনিক কাৰ্য্য শেষ করিয়া অবসন্ন দেহে ধীরে ধীরে গৃহের দিকে অগ্রসর হইতেছে। সন্ধ্যা সমাগমে পুলিস-কৰ্ম্মচারিগণ সুসজ্জিত হইয়া শান্তিরক্ষার জন্য স্ব স্ব নির্দিষ্ট স্থানে গমন করিতেছে। 

হাসপাতালের সাহেবের সহিত আমার সদ্ভাব ছিল। আমার আগমন বার্তা পাইয়া তিনি তখনই আমাকে তাঁহার ঘরে ডাকিয়া পাঠাইলেন। আমি সত্বর তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম এবং যেজন্য সে সময়ে সেখানে গিয়াছিলাম, তাহা প্রকাশ করিলাম। 

আমার কথা শুনিয়া সাহেব তখনই সেই মৃতদেহের সন্ধান লইলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই আমাকে লইয়া অপর একটি ঘরে প্রবেশ করিলেন। 

ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, একজন সাহেব ডাক্তার হরিসাধনবাবুর মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করিয়া পরীক্ষা করিতেছেন। বড়সাহেবের সহিত আমাকে দেখিয়া তিনি মস্তকোত্তোলন করিলেন এবং ইংরাজি ভাষায় আমার সমভিব্যাহারী সাহেবকে বলিলেন “আমার বড় ভাল বোধ হইতেছে না। লোকটার পাকস্থলীতে আর্শেনিক দেখা যাইতেছে। আমার বোধ হয় কোন খাদ্যদ্রব্যের সহিত আর্শেনিক মিশ্রিত ছিল। ইনি সেই খাদ্য ভক্ষণ করিয়াছেন।” 

বড়সাহেব কোন উত্তর না করিয়া স্বয়ং পরীক্ষা করিলেন। পরে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আপনার সন্দেহ সত্য। লোকটা আর্শেনিক খাইয়া মারা গিয়াছে। যদি আপনি সময়ে দাহকার্য্যে বাধা না দিতেন, তাহা হইলে এ অদ্ভুত রহস্য আর কখনও উদ্ঘাটিত হইত না। আম শীঘ্রই রিপোর্ট পাঠাইয়া দিতেছি।” 

আমি আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলাম। ভাবিলাম, ইহার মধ্যে কোন গোপনীয় রহস্য আছে। যখন হরিসাধনবাবু বিষপ্রয়োগে মারা পড়িয়াছন, তখন কোন লোক যে তাঁহারই কোন আহার্য্য পদার্থের সহিত পূর্ব্বে বিষ মিশ্রিত করিয়া রাখিয়াছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। হরিসাধনবাবুর এমন কোন দুঃখ ছিল না, যাহাতে সেই আনন্দের দিনে তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করিবেন। 

এই প্রকার চিন্তা করিয়া আমি আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া হাসপাতালের বড়সাহেবকে শত শত ধন্যবাদ প্রদান করতঃ তাঁহার নিকট বিদায় লইলাম। 

পথে আসিয়া একবার ভাবিলাম, থানায় ফিরিয়া যাই। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে কাশীপুরে শক্তিসাধনের বাসায় যাইতে অভিলাষ জন্মিল। কিন্তু পুলিসের বেশে যাইলে পাছে নিষ্ফল হইতে হয়, এই ভয়ে আমি থানায় ফিরিয়া গেলাম এবং সেখানে গিয়া ছদ্মবেশ পরিধান করতঃ একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ি করিয়া কাশীপুরে গমন করিলাম। 

বাগবাজারের পোল পার হইয়া আমি শকট হইতে অবতরণ করিলাম এবং পদব্রজে অতি ধীরে ধীরে শক্তিসাধনের বাসার দিকে গমন করিলাম। পূর্ব্বেই তাঁহার নিকট হইতে তাঁহার বাসার সন্ধান পাইয়াছিলাম, সুতরাং আমায় বিশেষ কষ্ট পাইতে হইল না। 

যে বাড়ীতে শক্তিসাধন বাস করিতেন সেই বাড়ীখানি ক্ষুদ্র হইলেও দ্বিতল। বাহির হইতে এক মহল বলিয়াই বোধ হইল। বাহিরে সদর-দরজার ডানদিকে একখানি ক্ষুদ্র বৈঠকখানা ছিল কিন্তু সেঘরে তখন কোন লোকই ছিল না। 

আমি সহসা ভিতরে প্রবেশ করিতে সাহস করিলাম না। বাড়ীর একপার্শ্বে একটা প্রকাণ্ড মাঠ ছিল। সেই মাঠে তখন অনেক লোক সায়ংভ্রমণে নিযুক্ত ছিলেন। আমিও সেই অছিলা করিয়া মাঠে পায়চারি করিতে আরম্ভ করিলাম। কিন্তু মধ্যে মধ্যে শক্তিসাধনের বাড়ীর সদর দরজার দিকে লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। 

কিছুক্ষণ এইরূপে অতীত হইলে সহসা অট্টহাস্যধ্বনি আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। শব্দের গতি লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম, শক্তিসাধনবাবুর বাড়ী হইতেই সেই হাস্যধ্বনি উত্থিত হইতেছে। আমার অত্যন্ত সন্দেহ হইল। ভাবিলাম, যিনি ভ্রাতার আকস্মিক মৃত্যুতে একেবারে ম্রিয়মাণ হইয়া পড়িয়াছেন, তাঁহার বাড়ীতে এ প্রকার আনন্দের রোল কেন? তবে কি উহা শক্তিসাধনবাবুর বাড়ী নহে? 

এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি একজন ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করিলাম “মহাশয়! শক্তিসাধনবাবুর বাড়ী কোথায় বলিতে পারেন?” 

লোকটি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিলেন না। তিনি বলিলেন, তিনি সেখানকার অধিবাসী নহেন। সুতরাং শক্তিসাধনবাবুর সহিত তাঁহার পরিচয় নাই। আমি হতাশ হইলাম না; অপর এক ব্যক্তিকে ওই প্রশ্ন করিলাম। সৌভাগ্যক্রমে তিনি শক্তিসাধনের বন্ধু, তিনিই আমায় মাঠের পার্শ্বস্থ সেই বাড়ী দেখাইয়া দিলেন। 

আমি আর কোন কথা না কহিয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিলাম এবং প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে আবার সেই মাঠে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। তখন রাত্রি প্রায় সাড়ে সাতটা। মাঠ হইতে শক্তিসাধনের বাড়ীর একটি জানালা দেখিতে পাইলাম। জানালাটি একতলায় এবং অর্দ্ধোন্মুক্ত অবস্থায় ছিল। আমি অতি ধীরে ধীরে সেই জানালার নিকট যাইয়া পায়চারি করিতে আরম্ভ করিলাম। কিন্তু আমার লক্ষ্য ছিল, সেই জানালার দিকে। 

কিছুক্ষণ এইরূপ পায়চারি করিতে করিতে আবার সেই হাস্যধ্বনি আমার কর্ণ গোচর হইল। এবার আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, শক্তিসাধনের বাড়ী হইতেই সেই অট্টহাস্যধ্বনি উত্থিত হইতেছে। মনে বড় সন্দেহ হইল। আমি আর নিশ্চিন্ত ভাবে পায়চারি করিতে পারিলাম না। অতি সন্তর্পণে সেই জানালার নিকট গিয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। কিন্তু এমন ভাবে অপর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতে লাগিলাম, যেন কোন লোকের প্রত্যাশায় সেই স্থানে দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিতেছি। 

আমাকে ওইভাবে অপেক্ষা করিতে দেখিয়া দুই একজনের সন্দেহ হইল। কেহ কেহ কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। কিন্তু আমার উত্তর শুনিয়া সকলে হৃষ্টচিত্তে আপনাপন কার্য্যে প্রস্থান করিলেন। 

কিছুক্ষণ এইরূপে দাঁড়াইলে পর, আমি সেই ঘরের ভিতর হইতে বামাকণ্ঠে যেন কাহাকে বলিতে শুনিলাম “আমার দ্বারা ও কাজ হইবে না। তুমি ব্রাহ্মণের সন্তান, আমি বাগ্দিনী। কোন্ সাহসে আমি তোমায় রাঁধিয়া দিব? আমার কি পরকালের ভয় নাই?”

আবার সেই অট্টহাস্য। এবার কিন্তু পরিষ্কার বুঝিতে পারিলাম, শক্তিসাধনই ওই প্রকার অট্টহাস্য করিতেছেন। অট্টহাস্য করিয়া তিনি উত্তর করিলেন “যদি এতই পরকালের ভয়, তবে এ কার্য্যে হাত দিলে কেন?” 

কিছুক্ষণ কি ভাবিয়া রমণী আবার উত্তর করিল “দেখ শক্তিবাবু! দশ বৎসর বয়সে আমি বিধবা হই। তাহার কিছুদিন পর তোমায় দেখিতে পাই। তুমিও কেমন আমায় দেখিতে ভালবাসিতে, প্রায়ই আমাদের বাড়ীতে যাইতে, আমার মায়ের সহিত কথাবার্তা কহিতে। সেই অবধি আমাদের প্রণয় হয়। তাহার পর মা মারা পড়িল, তুমিই আমায় আশ্রয় দিলে। সেরূপ বিপদে পড়িয়া আমি জ্ঞান হারাইলাম এবং তোমাকেই মন প্রাণ সমর্পণ করিলাম। ইহাতে যদি পরকালে শাস্তি পাইতে হয়, সে শাস্তি সানন্দে গ্রহণ করিব, কিন্তু ইচ্ছা করিয়া কেন ব্রাহ্মণ-সন্তানকে আমার হাতের ভাত খাওয়াইব।” 

রমণীর কথা শুনিয়া শক্তিসাধন পুনরায় বলিলেন “তবে আমি আহার করিব কোথায়? যতদিন দাদা জীবিত ছিলেন, ততদিন তোমায় জেদ করি নাই।” 

রমণী কিছু দুঃখিত হইল, বলিল “তুমি এক কাজ কর,—নিকটে কোন হোটেলওয়ালার সহিত বন্দোবস্ত কর।” শক্তি আবার হাসিয়া উঠিলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন “সে একই কথা। তোমার হাতে খাওয়া আর কোন হোটেলে অন্নাহার করা একই কথা।” 

রমণী আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল “সে আবার কি কথা?”

শ। কেন? তুমি কি মনে কর, হোটেলওয়ালাগণ সকলেই ব্রাহ্মণ? কখনও নহে। এমন কি, যাহারা রন্ধন করে, তাহারাও ব্রাহ্মণ-সন্তান নহে। তবে আমি সকল হোটেলের কথা বলিতেছি না, কোন কোন স্থানে প্রকৃত ব্রাহ্মণ-সন্তান দ্বারাই পাক-কার্য্য সমাধা হইয়া থাকে। কিন্তু সেরূপ হোটেল এখন এখানে পাই কোথা? 

র। এত তাড়াতাড়ির প্রয়োজন কি? অন্বেষণ কর, শীঘ্রই সেরূপ হোটেলের সন্ধান পাইবে।

শ। তবে এই কয়দিন খাই কোথায়? 

র। কেন, তোমার দাদার স্ত্রী কিম্বা বাড়ীর কোন লোক কি তোমায় ওই সম্বন্ধে কোন কথা বলিয়াছেন?

শ। না–এখনও বলেন নাই বটে, কিন্তু শীঘ্রই ওই সকল কথা শুনিতে হইবে। শুনিবার আগেই নিজের বন্দোবস্ত করা ভাল নয় কি? 

রমণী কিছুক্ষণ কোন উত্তর করিল না। পরে জিজ্ঞাসা করিল “তোমার দাদা কি কোন উইল করিয়া যান নাই?”

শ। কই, সে সকল কথা ত এখনও শুনি নাই। 

র। নিশ্চয়ই তিনি উইল করিয়া গিয়াছেন। আর যখন তুমি তাঁহার সহোদর, তখন তিনি যে তোমার জন্য কোনপ্রকার বন্দোবস্ত করিয়া গিয়াছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। আর যখন তোমার দাদার কোন পুত্রাদি নাই, তাঁহার স্ত্রী-তোমায় যথেষ্ট স্নেহ করেন, তখন নিশ্চয়ই তিনি তোমার ভরণ-পোষণের বন্দোবস্ত করিবেন; অন্ততঃ তাঁহার বাড়ী হইতে অন্ন উঠিবে না। 

শক্তিসাধন অস্পষ্ট স্বরে বলিলেন “কিছুই জানি না। তবে দাদা যে আমার শত্রু ছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।” 

রমণী বলিল “ তোমার জাতিচ্যুতি করিয়া তোমার দাদা শত্রুতা করিয়াছেন বটে, কিন্তু তিনি যে আজীবন তোমায় প্রতিপালন করিলেন, তাহাও কি শত্রুতার পরিচায়ক? তিনি তোমায় জাতিচ্যুত করেন নাই—সমাজ জাতিচ্যুত করিয়াছেন। যাহা সমাজ করিয়াছে, তাহার জন্য তাঁহাকে দোষ দাও কেন?” 

শ। তিনিই আমার বিপক্ষে সাক্ষী না দিলে সমাজ আমাকে কখনও জাতিচ্যুত করিতে পারিত না। তাঁহা ভিন্ন, দাদা অন্য অনেক বিষয়ে আমাকে বঞ্চিত করিয়াছিলেন, সেইজন্যই আমার ভরণপোষণ ভার গ্রহণ করিয়াছিলেন। 

র। যাহাই হউক, এখন এ বিপদ ঘটাইলে কেন? সন্দেহ হইয়াছিল, পাঁচজনকে বলিলেই ত হইত, একেবারে থানায় খবর দিবার আবশ্যকতা কি ছিল? তুমি কি সত্যই রসময়কে বিষ দিতে দেখিয়াছ? 

বাধা দিয়া শক্তি উত্তর করিলেন “রসময় ভয়ানক লোক। বহুকাল হইতে তাহার উপর আমার আক্রোশ আছে। এই সুযোগে উহার স্কন্ধে দোষ চাপাইয়া উহাকে পুলিসের হস্তে সমর্পণ করিবার অভিপ্রায়েই এই কার্য্য করিয়াছি।” রমণী। যদি প্রমাণ না হয়, যদি সত্য সত্যই তোমার দাদা কলেরায় মারা পড়িয়া থাকেন, তাহা হইলে তোমার কি দুৰ্দ্দশা হইবে ভাবিয়া দেখিয়াছ কি? 

বাধা দিয়া শক্তি বলিয়া উঠিলেন “সে বিষয় নিশ্চিন্ত থাক্, দুর্গা। দাদা নিশ্চয়ই বিষপানে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন?” 

রমণী আর কোন কথা কহিল না। শক্তিও আর কোন উচ্চবাচ্য করিলেন না। রাত্রি প্রায় নয়টা বাজিল দেখিয়া আমি আর সেখানে অপেক্ষা করিলাম না, তখনই থানার দিকে ফিরিলাম। পথে একখানি ভাড়াটীয়া গাড়িতে আরোহণ করিয়া কোচম্যানকে থানায় লইয়া যাইতে আদেশ করিলাম। কিছু দূর যাইলে পর ভাবিলাম, রসময় কেমন লোক, না জানিলে এ রহস্য কিছুতেই বুঝিতে পারিব না। শক্তিসাধন সামান্যলোক নহে। যখন তিনি উপকারী জ্যেষ্ঠের মৃত্যুতে নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিতে উদ্যত, তখন তাঁহার অসাধ্য কৰ্ম্ম জগতে অতি বিরল। বিশেষতঃ, তিনি বহুকাল হইতে নীচ জাতীয়া রমণীর সহিত বসবাস করিয়া আসিতেছেন বলিয়া তাঁহার নিজের মনোবৃত্তি সকল নিস্তেজ হইয়া গিয়াছে, ব্রাহ্মণ-সন্তান হইয়া এবং উচ্চ-বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াও নানাবিধ নীচ কার্য্যে প্রবৃত্তি জন্মিয়াছে। সুতরাং তাঁহার কথায় কোনরূপে বিশ্বাস করা উচিত নহে। যতক্ষণ না বিশিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাইবে, ততক্ষণ রসময়বাবুর উপর কোনপ্রকার অনাচার করিতে দিব না। 

এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে আমি থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। পরে ছদ্মবেশ ত্যাগ করিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিতে মনস্থ করিলাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

পরদিন প্রাতঃকালে আমি পুনরায় শক্তিসাধনবাবুর বাড়ীতে গমন করিলাম। শুনিলাম, শক্তিসাধন অতি প্ৰষে তাঁহার জ্যেষ্ঠের মৃতদেহ সৎকারের জন্য শ্মশানে গমন করিয়াছেন। সুতরাং আমি তথায় আর কালবিলম্ব না করিয়া ধীরে ধীরে ঘাটের দিকে গমন করিলাম। 

আমাকে দেখিয়া শক্তিসাধন প্রফুল্ল হইলেন এবং তখনই আমার নিকটে আসিয়া বলিলেন “কেমন মহাশয়, আমার সন্দেহ সত্য হইল কি না?” 

আমি সহসা কোন উত্তর করিলাম না। যে ভাবে শক্তিসাধন ওই কথাগুলি বলিলেন, তাহাতে তিনি যে বিশেষ আনন্দিত হইয়াছেন, তাহা বেশ বুঝিতে পারিলাম। কিন্তু সে বিষয়ে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। কিছুক্ষণ পরে সকলের অগোচরে তাঁহাকে কোন নিভৃতস্থানে লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “যে ব্যক্তি আপনার দাদার আহারের সময় তাঁহার পাতে হাত দিয়াছিলেন, তাঁহার নাম কি বলিতে পারেন?” 

“তাঁহার নাম রসময় বন্দ্যোপাধ্যায়।” 

অনন্তর রমসয়বাবুর বাড়ীর ঠিকানা জানিয়া লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। 

বিনা কষ্টে আমি রসময়বাবুর বাড়ী গিয়া পঁহুছিলাম। তখন বেলা প্রায় আটটা। 

রসময়বাবুর বাড়ীখানি সুন্দর, প্রকাণ্ড ও ত্রিতল। বাড়ীতে লোকজন অনেক। সদর দ্বারে উপস্থিত হইবামাত্র একজন ভৃত্য আসিয়া আমার আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিল। আমার কথা শুনিয়া সে প্রস্থান করিল এবং তখনই রসময়বাবুকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় দ্বারদেশে প্রত্যাগমন করিল। 

আমাকে দেখিয়া রসময়বাবু অতি সমাদরে ত্রিতলের একটি বৈঠকখানায় লইয়া গেলেন। 

বৈঠকখানাটি বেশ সাজানো। আমি ভিতরে গিয়া একখানি চেয়ারে উপবেশন করিলাম। রসময়বাবু অপর একখানি চেয়ারে আমার সম্মুখে বসিলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়া আমার স্পষ্টই বোধ হইল যে, তিনি হরিসাধনবাবুর মৃত্যুতে অত্যন্ত শোকান্বিত হইয়াছেন। তাঁহার বিষণ্ন বদন দেখিয়া আমার আর এক সন্দেহ জন্মিল। আমি ভাবিলাম, রসময় হরিসাধনের জ্ঞাতি ভাই। ইনি তাঁহার মৃত্যুতে যেরূপ শোকাতুর হইয়াছেন, শক্তিসাধন আপন সহোদর হইয়া সেরূপ দুঃখিত নহেন কেন?” 

সে যাহা হউক, কিছুক্ষণ চিন্তার পর আমি রসময়বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম “এখন ত আপনার বিশ্বাস হইয়াছে যে, হরিসাধনবাবুকে কেহ বিষ প্রয়োগে হত্যা করিয়াছে?” 

একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া অত্যন্ত দুঃখিতভাবে রসময়বাবু বলিলেন “যখন সরকারী ডাক্তার হরিসাধনের মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া ওই কথা বলিয়াছেন, তখন আর আমাদের অবিশ্বাসের কারণ কি? কিন্তু আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইতেছি যে, শক্তিসাধন পূর্ব্বে এ কথা কেমন করিয়া জানিতে পারিল এবং কেই বা হরিসাধনের উপর এতদূর শত্রুতা করিল?” 

আ। কেন, আপনি কি তাহা জানেন না? 

আমার কথা শেষ হইতে না হইতে রসময়বাবু আন্তরিক রাগান্বিত হইলেন। তিনি অতি কর্কশ ভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার কথার তাৎপর্য কি? আপনার কথার ভাবে বোধ হইতেছে যে, আপনি কাহাকেও সন্দেহ করিয়াছেন।” 

রসময়ের কথায় আমি আন্তরিক লজ্জিত হইলাম। ভাবিলাম, কথাটা বলা ভাল হয় নাই। কিন্তু যাহা হইয়া গিয়াছে তজ্জন্য বৃথা অনুশোচনা করিলে কোন ফল হইবে না জানিয়া, অতি নম্র কথায় রসময়কে শান্ত করিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম “গতকল্য আপনি হরিসাধনের বাড়ীতে গিয়াছিলেন কি?” 

অতিশয় বিরক্তির সহিত রসময় উত্তর করিলেন “হাঁ, নিমন্ত্রিত হইয়া তাঁহার বাড়ীতে গিয়াছিলাম এবং একসঙ্গে বসিয়া আহার করিয়াছিলাম।” 

যেরূপ সরলভাবে রসময় ওই কথাগুলি বলিলেন, তাহাতে তাঁহার উপর কোনপ্রকার সন্দেহ হইল না। যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্যের সহিত বিষ মিশ্রিত করিয়া অপরের প্রাণসংহার করিয়াছে, সে কখনও সরল ভাবে সে কথার উল্লেখ করিতে পারে না; তাঁহার মনে কোননা কোনপ্রকার ভয়ের উদ্রেক হইবেই। কিন্তু যখন শক্তিসাধনবাবু তাঁহারই উপর সন্দেহ করিয়াছেন, তখন একবার ভাল করিয়া না দেখিয়া কোন কার্য্য করা উচিত নহে। এই ভাবিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “হরিসাধনবাবুর সহিত আপনার কেমন সদ্ভাব? শুনিলাম, আপনি তাঁহার অনেক ক্ষতি করিয়াছেন?” 

“কে আপনাকে এমন কথা বলিল? বুঝিয়াছি, ইহাও সেই শক্তিরই কার্য্য। লোকটা নীচ সংসর্গে থাকিয়া নীচ প্রকৃতি প্রাপ্ত হইয়াছে। যে ব্যক্তি অন্নদাতা জ্যেষ্ঠের নিন্দা করে, তাঁহাকে শত্রু বলিয়া পরিচয় দেয়, সে লোক সকল কথাই বলিতে পারে। কিন্তু হরিসাধন তেমন ছিলেন না। তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, আমি তাঁহাকে তাঁহার পৈত্রিক সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করি নাই বরং তিনিই এতদিন আমাদিগকে ওই স্বত্ব হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছিলেন। যখন বুঝিতে পারিলেন, তখন আর আমাদের মনোমালিন্য রহিল না। কাল তাঁহাদের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ ছিল, আমাদের উভয়ের মধ্যে এত সদ্ভাব যে, আমরা একপাতে দুইজনে আহার করিয়াছিলাম। শক্তিসাধন স্বচক্ষে এ ব্যাপার দেখিয়াছে। আমি সে কথার কোন উত্তর না দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি শুনিয়াছেন, হরিসাধনবাবুর পাকস্থলীতে আর্শেনিক পাওয়া গিয়াছে। তিনি বাস্তবিকই কলেরায় মারা পড়েন নাই।” 

রসময়বাবু আশ্চর্যান্বিত হইলেন; কিন্তু তাঁহার মুখ দেখিয়া তাঁহাকে ভীত বলিয়া বোধ হইল না। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলেন “মহাশয়। হরিসাধনের মৃতদেহের সৎকার হইয়া গিয়াছে কি?” 

আমি উত্তর করিলাম “এতক্ষণ বোধ হয় হইয়া গিয়াছে। অপরের দোষে তাঁহার মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করা হইয়াছিল। তাঁহার কি কোন সন্তান আছে?” 

র। আজ্ঞে না। শক্তিসাধনই তাঁহার মুখাগ্নি করিবার উপযুক্ত পাত্র, কিন্তু লোকটা জাতিচ্যুত হইয়াছে। সুতরাং তাঁহার স্ত্রীকেই ওই কার্য্য করিতে হইবে। 

আ। আর বিষয় সম্পত্তি? 

র। শক্তিসাধন কিছুই পাইবে না। 

আ। কেন? 

র। যাহাকে সমাজ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দেওয়া হইয়াছে, যে এখন একজন নীচ-জাতীয়া বেশ্যার সহিত বসবাস করিতেছে, সে কেমন করিয়া তাহার জ্যেষ্ঠের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হইবে? 

আ। শুনিয়াছি, হরিসাধনের স্ত্রী না কি শক্তিসাধনকে পুত্রবৎ স্নেহ করেন? 

র। আজ্ঞে হাঁ–সেইজন্যই বোধ হয় সে বাড়ী হইতে তাহার অন্ন উঠিবে না। 

এই কথা বলিয়া রসময়বাবু কি চিন্তা করিলেন। পরে আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “শক্তিসাধন কেমন করিয়া জানিতে পারিল যে, হরিসাধন বিষপানে মারা পড়িয়াছেন? তাহার হঠাৎ এই সন্দেহের কারণ কি?” 

আমি আর সকল কথা গোপন রাখা যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা করিলাম না। তাঁহাকে বলিলম “শক্তিসাধন আপনার উপরে সন্দেহ করিয়া আমাদিগকে সংবাদ দিয়াছিলেন। তিনি বলেন, আপনি কৌশলে কোন খাদ্যদ্রব্যের সহিত আর্শেনিক মিশ্রিত করিয়াছিলেন।” 

আমার কথায় বাধা দিয়া রসময়বাবু বলিয়া উঠিলেন “কি সর্বনাশ! সেই জন্যই বুঝি আপনিও প্রথমে আমার উপর সন্দেহ করিয়া সেই সকল অপ্রীতিকর কথা বলিয়াছিলেন?” 

আ। আমার অপরাধ কি? আমি যেমন শুনিয়াছিলাম, সেইমতই কার্য্য করিতেছি। 

র। তিনি কি আমাকে কোন খাদ্যদ্রব্যের সহিত বিষ মিশ্রিত করিতে দেখিয়াছিলেন? 

আ। আজ্ঞে না, স্বচক্ষে দেখেন নাই। তবে আপনাকে বারম্বার হরিসাধনবাবুর পাতে হাত দিতে দেখিয়াই ওই প্রকার সন্দেহ করিয়াছিলেন। 

র। আর সেই সন্দেহ করিয়া তিনি মৃতদেহ সৎকারে বাধা দিয়াছিলেন? 

রসময়বাবুর কথা শুনিয়া আমার চমক ভাঙ্গিল। আমি তাঁহার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিলাম না। কিন্তু তিনি পুনরায় আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন “যখন শক্তিসাধন থানায় সংবাদ দিতে সাহস করিয়াছিল, তখন কি কেবল সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া সেই গুরুতর কার্য্য করিয়াছিল? শক্তিসাধন সামান্য বালক নহে, তাহার বয়স প্রায় চৌত্রিশ বৎসর। সে কি জানিত না যে, তাহার কথা প্রমাণ করিতে না পারিলে তাহারই সর্ব্বনাশ হইবে। নিশ্চয়ই জানিত। সুতরাং সামান্য সন্দেহ করিয়া সে এই মহৎ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করে নাই।” 

রসময়বাবুর কথাগুলি আমার মনে লাগিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি কি বলেন তিনি স্বচক্ষে কোন ব্যাপার দেখিয়াই সংবাদ দিতে সাহস করিয়াছিলেন?” 

র। সে কথা আপনিই বুঝিয়া দেখুন। যদি সরকারী ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া বলিতেন, হরিসাধন কলেরায় মারা গিয়াছেন, তাহা হইলে কি আপনারা শক্তিকে সহজে ছাড়িয়া দিতেন? তাহার মিথ্যা কথার জন্য কি কোনপ্রকার শাস্তি দিতেন না?” 

আ। নিশ্চয়ই তিনি শাস্তি পাইতেন। কিন্তু এখন ত তাঁহার সন্দেহ সত্যে পরিণত হইয়াছে, এখন ত আর তাঁহাকে শাস্তি দেওয়া যাইতে পারে না। 

রসময়বাবু সে কথার কোন উত্তর করিলেন না। পরে ব্যঙ্গস্বরে বলিলেন “তিনি ত আমার নামেই দোষারোপ করিয়াছেন, যদি আপনার বিশ্বাস হয়, আপনি আমায় গ্রেপ্তার করুন। বিচারে যাহা হয় হইবে। কিন্তু বলিয়া রাখি, শক্তিসাধনকে সামান্য লোক মনে করিবেন না।” 

আমি শশব্যস্তে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তিনি কেমন লোক?” 

র। তিনি অন্নদাতা জ্যেষ্ঠকে সকলের নিকট শত্রু বলিয়া প্রকশ করিতে লজ্জিত হন না, তিনি কেমন লোক বুঝিয়া লউন। পূর্ব্বে তিনি এমন ছিলেন না, সম্প্রতি কেদার ডাক্তারের সঙ্গে মিশিতে আরম্ভ করিয়া তাঁহার এত পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে। 

আ। কেদার ডাক্তার! তাঁহার নিবাস কোথায়? 

র। শক্তিসাধনের বাড়ীর নিকটেই। আজ-কাল শক্তির সহিত তাঁহার বিশেষ প্রণয়। এখন বাজে কথা ছাড়িয়া দিন, যে কাৰ্যে আসিয়াছন, তাহা সিদ্ধ করুন। 

কিছুক্ষণ ভাবিয়া আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “রসময়বাবু! আমরা পুলিসের লোক বটে, কিন্তু আমাদেরও একটা কৰ্ত্তব্য আছে।” 

আমার কথায় বাধা দিয়া রসময়বাবু লজ্জিতভাবে বলিলেন “নিশ্চয়ই আছে। আমি সে ভাবিয়া আপনাকে কোন কথা বলি নাই। যখন শক্তিসাধন আমারই নামে অভিযোগ করিয়াছে, তখন আপনি কি করিবেন? মিথ্যা হইলেও আপনাকে এখন তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া কার্য্য করিতে হইবে।” 

আ। শক্তিসাধন আপনার নামে অভিযোগ করেন নাই, তাঁহার সে সাহাস নাই। কেবল সন্দেহ করিয়াছেন।

র। আপনি তবে এখন কি করিতে চান? 

আ। আপনার সাহায্য চাই! 

র। কোন্ কার্য্য? 

আ। প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করিতে। আপনারই মুখে শুনিলাম হরিসাধনবাবুর সহিত আপনার বড়ই সদ্ভাব ছিল। যদি তাহাই হয়, তাহ হইলে আপনারও নিশ্চিন্ত থাকা উচিত। 

রসময় মুখে কোন উত্তর করিলেন না। কিন্তু তাঁহার চক্ষুদ্বয় দিয়া দরদরিত ধায়ে অশ্রুজল বিগলিত হইতে লাগিল। তিনি যে সম্পূর্ণ নির্দোষী, সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ রহিল না। 

কিছুক্ষণ পরে শান্ত হইয়া রসময় অতি বিনীত ভাবে বলিলেন “আমি প্রাণপণে আপনার সাহায্য করিতে সম্মত আছি। যতক্ষণ না হরিসাধনের হত্যাকারীকে রাজদণ্ডে দণ্ডিত হইতে দেখিতেছি, ততক্ষণ আমিও নিশ্চিন্ত হইতে পারিব না। আপনি শক্তিসাধনের উপর একটু নজর রাখিবেন, তাহা হইলে শীঘ্রই সফল হইতে পারিবেন। তদ্ভিন্ন আপনার যখন যেরূপ সাহায্যের আবশ্যক হইবে, দয়া করিয়া আমায় সংবাদ দিলে আমি আপনার নিকট গমন করিব।” কথায় কথায় বেলা দশটা বাজিয়া গেল। আমি রসময়বাবুকে ধন্যবাদ দিয়া তাঁহার নিকট বিদায় লইলাম এবং থানায় প্রত্যাগমন করিলাম। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

বেলা একটার পর ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া পদব্রজেই শক্তিসাধনের বাড়ীর দিকে গমন করিলাম। ভাবিলাম, যখন শক্তিসাধনের সহিত ডাক্তারবাবুর এত আলাপ, তখন ইঁহার সাহায্যে হয় ত তাঁহাকে শীঘ্র পাওয়া যাইবে। এই চিন্তা করিয়া অগ্রে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে মনস্থ করিলাম এবং তখনই তাঁহার বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। 

শক্তিসাধন নীচেকার একটি ক্ষুদ্র গৃহেই বসিয়া ছিলেন, আমাকে দেখিয়াই রাগিয়া উঠিলেন এবং অতি কর্কশ স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুমি? এমন সময়ে এ বাড়ীতে কেন? সমস্ত দিনই কি ভিক্ষা দেওয়া যায়? ভিক্ষা করিবার কি সময় অসময় নাই?”

শক্তিসাধনের কথায় আমি আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলাম। ভাবিলাম, তিনি আমায় চিনিতে পারেন নাই বলিয়াই বাড়ী হইতে দূর করিয়া দিতেছেন। আমি কিন্তু তাঁহার কথায় রাগ করিলাম না। অতি বিনীত ভাবে বলিলাম “না মহাশয়, আমি ভিক্ষা করিতে এখানে আসি নাই। আপনার নিকটে কোন বিষয়ে সাহায্য প্রার্থনা করিতে আসিয়াছি।” 

শক্তিসাধন আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “আমার নিকটে? কিসের সাহায্য? আমার এখন সাহায্য করিবার সময় নাই। কাল আমার ভ্রাতৃবিয়োগ হইয়াছে, এখন আমার মন স্থির নহে।” 

আমি আরও বিনীত ভাবে বলিলাম “সামান্য দয়া করিলেই আমি উপকৃত হই। আমি বড় গরিব।” 

শ। কি করিতে হইবে বল? 

আ। আপনার সহিত ডাক্তারবাবুর বেশ আলাপ আছে জানি। আপনি যদি তাঁহাকে একবার আমাদের বাড়ীতে বিনা ভিজিটে যাইতে বলেন, তাহা হইলে একটি রমণী রক্ষা পায়। 

শক্তিসাধন আত্ম প্রশংসায় আন্তরিক আনন্দিত হইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন “ডাক্তারবাবু কে? কেদারবাবু?”

আ। আজ্ঞে হাঁ। 

শ। তোমার বাড়ী কোথায়? 

আ। আমাদেরবাড়ী বৰ্দ্ধমান জেলায়। এখানে জোড়াবাগানে বাসা। 

শ। ডাক্তারবাবু ত অনেক স্থানেই বিনা ভিজিটে গিয়া থাকেন। অক্ষম দেখিলেই তিনি ভিজিট ছাড়িয়া দেন। 

আ। আমিত তাহা জানিতাম না। আর তাহা হইলেও আমি যখন তাঁহার পরিচিত নহি, তখন কেমন করিয়া তাঁহাকে এ প্রকার অনুরোধ করিব? 

শক্তিসাধন তখনই গাত্রোত্থান করিলেন এবং আমাকে সঙ্গে লইয়া একখানি দ্বিতল অট্টালিকার দ্বারদেশে উপস্থিত হইলেন। দেখিলাম, সেই-ই ডাক্তারখানা। 

শক্তিসাধন আমাকে লইয়া বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিতে না করিতে একজন যুবক বলিয়া উঠিলেন, “কেও, শক্তিবাবু! এমন অসময়ে কেন?” 

শক্তিসাধন হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলেন “আর ভাই! তোমার কাছে আসিব, তাহার আর সময় অসময় কি? এখন এই লোকটির সঙ্গে একবার জোড়াবাগানে যাইতে হইবে।” 

এই বলিয়া শক্তিসাধন তাঁহার নিকটস্থ একখানি চেয়ারে উপবেশন করিলেন। আমি তাঁহাদের নিকট দাঁড়াইয়া রহিলাম। যে বেশে সেখানে গিয়াছিলাম, তাহাতে তাঁহাদের নিকটে বসিতে সাহস করিলাম না। 

দুই একটা অন্য কথা কহিয়া ডাক্তারবাবু আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “কাহার কি হইয়াছে বাবু?” আমি অতি বিনীত ভাবে উত্তর করিলাম, “আমাদের বাসার একটি স্ত্রীলোকের গাত্রে কি সব দাগ হইয়াছে। লোকে বলিতেছে, পারা ফুটিয়াছে। জোড়াবাগানের অনেকেই আপনাকে বিশেষ চেনে, তাঁহারাই আমাকে আপনার নিকটে আসিতে বলিয়াছিলেন। যদি দয়া করিয়া একটিবার দেখিয়া আসেন, তাহা হইলে সে রমণী এ যাত্রা রক্ষা পায়।” 

ডাক্তারবাবু তখন উপস্থিত দুই চারিটা রোগী দেখিয়া গাত্রোত্থান করিলেন, সদরদ্বারেই তাঁহার গাড়ি অপেক্ষা করিতেছিল। তিনিই অগ্রে তাহাতে আরোহণ করিলেন। পরে আমাকেও উঠিতে আদেশ করিয়া কোচম্যানকে শকট চালনা করিতে বলিলেন। 

কিছুদূর যাইলে পর ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন “যে স্ত্রীলোকটির পীড়া হইয়াছে, তিনি আপনার কে? আমি কেবল হাসিলাম, কোন উত্তর করিলাম না, তিনিও আর কেনো কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। বোধ হয় আমাকে হাস্য করিতে দেখিয়া রমণীকে আমারই আশ্রিতা বলিয়া মনে করিয়াছিলেন। 

আরও কিছুক্ষণ পরে তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন “পূর্ব্বে কোনপ্রকার চিকিৎসা হইয়াছিল কি?” 

আ। আজ্ঞে হাঁ, তবে কোন ডাক্তার দেখেন নাই। জোড়াবাগানেই একজন বৃদ্ধ আছেন, তিনি ওই প্রকার দুই একটা রোগের চিকিৎসা করেন। আমি তাঁহাকেই একবার দেখাইয়াছিলাম। 

ডা। তিনি কি ঔষধ দিয়াছিলেন? 

আমি ঈযৎ হাসিয়া বলিলাম, “কি ঔষধ জানি না। কাগজে কি লিখিয়া দিয়াছিলেন, তাহাও জানি না। কিন্তু যখন ঔষধটি কিনিতে যাই, তখন কাগজখানি পড়িয়া বলিয়াছিল, তাহাতে ‘আসে নি’ নামে কি বিষ আছে। বিষের নাম শুনিয়া আমি আর সে ঔষধ ক্রয় করি নাই।” 

আমার কথা শুনিয়া ডাক্তারবাবু হাসিয়া উঠিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন “কি বিষ? আসে নি? না যায় নি?” আমি যেন অত্যন্ত অপ্রতিভ হইলাম। লজ্জার হাসি হাসিয়া বলিলাম “আমরা সামান্য লোক, লেখাপড়া শিক্ষা করি নাই। আমাদের মুখ দিয়া কি সকল কথা ঠিক বাহির হয়? আমরা কি সকল কথা উচ্চারণ করিতে পারি? আপনি একজন বিখ্যাত ডাক্তার, নিশ্চয়ই আমার কথা বুঝিতে পারিয়াছেন। ওই নামে সত্যই কি কোন বিষ আছে?” 

“আছে বৈ কি! কিন্তু তাহার নাম আর্শেনিক, আসেনি নয়, বাঙ্গালায় উহাকে সেঁকোবিষ বলে।” 

“বাজারে পাওয়া যায়?” 

“যায় বৈ কি? কিন্তু সকলকে দেয় না।” 

“কেন? সেটা যখন ঔষধে ব্যবহার হয়, তখন দেয় না কেন?” 

ডা। অনেকে ওই বলিয়া ক্রয় করিয়া আত্মহত্যা করিয়াছে। এইজন্যই এখন আর ওই দ্রব্য সকলকে বিক্রয় করে না। সেদিন শক্তিসাধনের স্ত্রী দত্তের যন্ত্রণায় ভয়ানক কষ্ট পাইতেছিলেন। পূর্ব্বে আমি তাঁহাকে একবার ওই ঔষধের সাহায্যে যন্ত্রণা হইতে মুক্ত করিয়াছিলাম। শক্তিসাধন তাহা বেশ জানিতেন, সেদিন আমি কলিকাতায় ছিলাম না। সুতরাং সেই ঔষধের জন্য শক্তিবাবুকে অন্যান্য ঔষধালয়ে যাইতে হইয়াছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, সমস্ত দিন চেষ্টা করিয়াও, কলিকাতায় প্রায় সকল দোকানে ঘুরিয়াও, তিনি উহা ক্রয় করিত পারেন নাই। অবশেষে রাত্রি দশটার সময় আমি বাড়ীতে আসিলে আমার নিকট হইতে লইয়া যান। 

আমার কৌতূহল বর্দ্ধিত হইল। জিজ্ঞাসা করিলাম “তাঁহার স্ত্রীর যন্ত্রণার লাঘব হইয়াছিল?” 

ডা। নিশ্চয়ই তিনি সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হইয়াছিলেন। 

আ। এ কাণ্ড কবে হইয়াছিল? 

ডা। বেশী দিন নয়, তিন চারি দিনের অধিক হইবে না।

আ। আপনি তাঁহাকে প্রয়োজনমতই দিয়া ছিলেন?

ডা। না, তাহার অপেক্ষা কিছু বেশী দিয়াছিলাম। 

আ। কেন? 

ডা। যদি আবার প্রয়োজন হয়। 

আ। তবে বুঝি ওই ঔষধে দত্তরোগ একেবারে আরোগ্য হয় না? 

ডা। দন্তরোগ প্রায়ই একবারে যায় না। কেবল কিছুদিনের মত ভাল হয়, আর তদ্ভিন্ন ওই ঔষধ ব্যবহার করিলে তৎক্ষণাৎ যাতনার লাঘব হয়। 

আমি তখন ওই বিষয়ে আর কোন কথা না বলিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “শক্তিবাবুর সহিত আপনার বড় সদ্ভাব বলিয়া আমি আগে তাঁহারই নিকট গিয়াছিলাম। তিনি যদি আপনাকে অনুরোধ না করিতেন, তাহা হইলে আমি যে কোথা হইতে ভিজিট সংগ্রহ করিতাম বলিতে পারি না। শক্তিবাবু বড় দয়ালু।” 

ডাক্তারবাবু আমার কথায় সায় দিয়া বলিলেন “হাঁ, তিনি বাস্তবিক বড় দয়াবান। আর সেই জন্যই তাঁহার সহিত আমার এত আলাপ।” 

আ। শক্তিবাবুর দাদার স্বর্গলাভ হইয়াছে শুনিয়াছেন কি? 

ডা। হাঁ—শুনিয়াছি। 

আ। শুনিয়াছি, তাঁহার মৃতদেহের সৎকারের সময় না কি গোলযোগ হইয়াছিল? 

ডা। হাঁ-তাহাও শুনিয়াছি। 

আ। তবে কি সত্য সত্যই তিনি বিষ খাইয়া মারা পড়িয়াছেন? 

ডা। কেমন করিয়া জানিব! সরকারী ডাক্তার না কি তাঁহার পেটের ভিতর হইতে বিষ বাহির করিয়াছে? কিছুক্ষণ কোন কথা না কহিয়া পরে আমি অতি গোপনে বলিলাম “কতলোকে যে কত কথা বলিতেছে, তাহার স্থিরতা নাই। কেহ বলিতেছে, কোন জ্ঞাতিই তাঁহাকে হত্যা করিয়াছেন, কেহ বা বলিতেছে, শক্তিবাবুই তাঁহার দাদার কোন খাদ্যদ্রব্যের সহিত বিষ মিশাইয়া তাঁহাকে হত্যা করিয়াছেন। কাহার কথাই বা বিশ্বাস করি?”

আমার শেষোক্ত কথাগুলি শুনিয়া ডাক্তারবাবু স্তম্ভিত হইলেন। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলেন “সত্য না কি? শক্তির উপরে সন্দেহ করিতেছে?” 

আ। আজ্ঞে হাঁ, তাঁহারা বলেন, তিনি কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন যে, তাঁহার দাদার কোন খাদ্যদ্রব্যের সহিত বিষ মিশ্রিত ছিল? 

ডাক্তারবাবু ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলেন “এই কারণ? হরিসাধনের সহসা মৃত্যু হওয়ায় তাঁহার ভ্রাতা, স্ত্রী বা অন্য কোন আত্মীয়ের সন্দেহ না হইবে কেন? বিশেষতঃ আহারের পূর্ব্বে তিনি বেশ সুস্থ ছিলেন। আহার করিবার পরই রোগের সূত্রপাত হয়।” 

আমি অতি বিনীত ভাবে বলিলাম, “সন্দেহ হইতে পারে কিন্তু সন্দেহ করিয়া থানায় সংবাদ দিতে সাহস হয় কি? পুলিসের গোচর করা নিতান্ত সহজ কথা নহে। যদি প্রমাণিত না হইত, তাহা হইলে শক্তিবাবু সহজে নিষ্কৃত পাইতেন না। সকলেই বলিতেছে, তিনি ওই বিষয় নিশ্চয়ই জানিতেন। না জানিলে, কেবল সন্দেহ মাত্র করিয়া তিনি থানায় সংবাদ দিতে সাহস করিতেন না।” 

আমার শেষোক্ত কথাগুলি বলা ভাল হয় নাই। কেন না, ওই কথা শুনিয়া ডাক্তারবাবু আমাকে একবার ভাল করিয়া দেখিলেন। পরে কি ভাবিয়া বলিলেন “ তোমাকে যেন আর কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া বোধ হইতেছে। তোমার নাম কি বল দেখি? আর এই জোড়াবাগানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। তোমার বাসা কোথায় কোচম্যানকে বলিয়া দাও?” 

আমি দেখিলাম, সত্যই আমরা জোড়াবাগানে আসিয়া পঁহুছিয়াছি! বাস্তবিক সেখানে আমার কোন বাসা বাড়ী নাই। আমি ডাক্তারবাবুর মুখের কথা শুনিবার জন্যই এই উপায় অবলম্বন করিয়াছিলাম। এখন ডাক্তারবাবুর কথা শুনিয়া আত্মগোপন করিবার আবশ্যকতা বুঝিলাম না। ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “আপনাকে বৃথা কষ্ট দিলাম বলিয়া ক্ষমা করিবেন। কোন রোগী দেখাইবার জন্য আমি আপনাকে এখানে আনি নাই। যে কারণে এই কষ্ট স্বীকার করিলাম, তাহাতে সফল হইয়াছি।” 

আমার কথায় ডাক্তারবাবু আর একবার আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিলেন। পরে হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আপনাদের বাহাদুরী আছে। যেরূপ ছদ্মবেশ করিয়াছেন, তাহাতে কেহ যে আপনাকে চিনিতে পারিবে এমন বোধ হয় না। যাহা হউক, আপনাদের অসাধ্য কাৰ্য্য নাই। এখন আমাকে কি করিতে বলেন?” 

আ। আপনাকে প্রধান সাক্ষী হইতে হইবে। 

ডা। কেন? 

আ। আপনিই শক্তিবাবুকে আর্শেনিক দিয়াছিলেন। 

ডা। তাহাতে কি? বিশেষতঃ ওই বিষ আমি তাঁহার স্ত্রীর রোগের জন্য ব্যবহার করিতে দিয়াছিলাম। 

আ। সত্য কিন্তু শক্তিবাবু সে বিষ কৌশলে জ্যেষ্ঠের খাদ্যদ্রব্যের সহিত মিশাইয়া দেন, তাহাতেই তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। এখন আপনাকে কিছুক্ষণ ঘরে ফিরিতে দিব না, আপনাকে সাক্ষ্য দিতে হইবে। 

অনন্তর আমরা একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ি করিয়া থানায় ফিরিয়া গেলাম এবং সেখানে ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া পুনরায় শক্তিবাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

যখন শক্তিবাবুর বাড়ীর সদর দরজায় উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা একটা। দ্বারের সম্মুখে একজন মুটে মস্তকে একটা বোঝা লইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। তাহার মস্তকে কতকগুলি মাটীর মাল্সা, পাঁকাটী, কলাপাতা ইত্যাদি হবিষ্যের উপযোগী দ্রব্যাদি ছিল। 

আমি আর কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া সেই মুটেকেই জিজ্ঞাসা করিলাম “এখানে দাঁড়াইয়া কি করিতেছ বাপু?” আমার মিষ্ট কথা শুনিয়া মুটে সসম্ভ্রমে উত্তর করিল “যে বাবুর সঙ্গে এই সমস্ত জিনিস লইয়া আসিয়াছি, তিনি এই বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াছেন। আমি তাঁহার জন্যই এখানে দাঁড়াইয়া আছি।” 

আ। তিনি কতক্ষণ ভিতরে গিয়াছেন? 

মু। অনেকক্ষণ। 

আ। তোমাকে কোথায় যাইতে হইবে? 

মু। বাগবাজারে। 

আ। কোথা হইতে এই সকল দ্রব্যাদি ক্রয় করা হইয়াছিল? 

মু। শ্যামবাজারে। 

আ। তবে বাগবাজারে না গিয়া এদিকে আসিলে কেন? 

মু। বাবুর হুকুম-ইহার জন্য বাবু দুইটি পয়সা অধিক দিবেন বলিয়াছেন। 

এই প্রকার কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময়ে শক্তিসাধনবাবু তথায় আসিলেন। আমি তাঁহাকে দেখিবা মাত্র শশব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “কি মহাশয়! হরিসাধনবাবুর মৃতদেহের সৎকার করা হইয়াছে?” 

শক্তিসাধন অতি বিষণ্ণ বদনে উত্তর করিলেন “আজ্ঞে হাঁ—বেলা এগারটার সময় আমরা দাহকার্য শেষ করিয়াছি।”

আ। এই মুটিয়ার মাথায় যে সকল দ্রব্যাদি রহিয়াছে, উহা কি আপনিই কিনিয়া আনিলেন? 

শ। আজ্ঞে হাঁ। 

আমি ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি জাতিচ্যুত হইয়াছেন,—সমাজ আপনাকে জাতিচ্যুত করিয়াছে। তবে আবার আপনি সামাজিক কার্য্য করিতেছেন কেন?” 

শক্তিসাধনও ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলেন “সত্য, কিন্তু দাদার স্ত্রীর অনুরোধ।” 

আ। এ সকল দ্রব্যাদি কিনিতে যথেষ্ট অর্থব্যয় হইয়াছে। এ সকল ব্যয়ভার কে বহন করিলেন? 

“দাদার স্ত্রী।” 

“আপনি ত নিজ বাড়ীতেই হবিষ্য করিবেন?”

“আজ্ঞে না, দাদার বাড়ীতে।” 

“কেন? নিজ বাড়ীতে নয় কেন?” 

“এখানে করিলে আমাকে ভয়ানক পরিশ্রম করিতে হইবে। দাদার বাড়ীতে দাদার স্ত্রী সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া দিবেন।” 

“কেন? এখানে ত আপনার স্ত্রী আছেন?” 

“আমার স্ত্রী নাই। স্ত্রী জীবিতা থাকিলে কি আমার আজ এ দুৰ্দ্দশা হইত!” 

“তবে এ বাড়ীতে আপনার কে আছে?” 

শক্তিসাধন লজ্জায় মস্তক অবনত করিলেন। পরে অতি অস্পষ্ট ভাবে বললেন “এখানে যাহার সহিত বসবাস করিতেছি, তিনি আমার বিবাহতা পত্নী নহেন।” 

আমার প্রশ্নে তিনি যথেষ্ট লজ্জিত হইয়াছিলেন। কাজেই কথাটা চাপা দিবার অভিপ্রায়ে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার দাদার উইল পড়া হইয়াছে?” 

শক্তিসাধন হাসিয়া বলিলেন “উইল আছে কি না তাহাই জানি না।” 

এই সময়ে সেই মুটে বলিয়া উঠিল “বাবু, আরও কত দেরি?” 

আমি বিষম ফাঁপরে পড়িলাম। যে কার্য্যে গমন করিতেছি, তাহাতে শক্তিসাধনকে গ্রেপ্তার করাই উচিত। কিন্তু তখন ভদ্রলোকের সঙ্গে অপরের কতগুলি আবশ্যকীয় দ্রব্য থাকায়, তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে ইচ্ছা হইল না। 

মুটের তাড়নায় শক্তিসাধন আমার নিকট বিদায় লইয়া তাঁহার দাদার বাড়ীর দিকে গমন করিলেন। আমিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিলাম। বলিলাম, চলুন, আমারও সেইদিকে প্রয়োজন আছে। 

কোনপ্রকার সন্দেহ না করিয়া সেই মুটের সঙ্গে শক্তিসাধন তাঁহার জ্যেষ্ঠের বাড়ীর সদরদ্বারে উপস্থিত হইলেন এবং মুটেকে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিতে বলিয়া যেমন তিনি প্রস্থান করিতে উদ্যত হইলেন, অমনই আমি পশ্চাৎ দিক হইতে তাঁহার হস্তধারণ করিলাম। বলিলাম, “হরিসাধনবাবুকে হত্যা করিবার অপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করিলাম।” 

যখন দেখিলাম, শক্তিসাধন বল প্রয়োগ করিতেছেন, তখন পকেট হইতে হাতকড়ি বাহির করিয়া ক্ষিপ্রহস্তে পরাইয়া দিলাম। 

এই প্রকার গোলমালে হরিসাধনবাবুর বাড়ীর দরজার সম্মুখে একটা জনতা হইল। নানা লোকে নানা কথা কহিতে লাগিল। এমন সময়ে দুইজন কনেষ্টবল তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। এবং জনতার মধ্য আমাকে দেখিয়া তখনই উপস্থিত লোকদিগকে তাড়াইয়া দিল। পরে আমার নিকটে আসিয়া সুদীর্ঘ সেলাম করিল। আমি তখন তাহাদের উপর শক্তিসাধনের ভার অর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইলাম। 

শক্তিসাধনবাবুকে গ্রেপ্তার করিবার পর হরিসাধনের বাড়ীর ভিতর হইতে অনেক লোক বাহির হইলেন। কিন্তু কেহই আমার কার্য্যে কোনপ্রকার বাধা দিলেন না। 

শক্তিসাধনকে থানায় চালান দিবার চেষ্টা করিতেছি, এমন সময়ে এক প্রৌঢ় হরিসাধনবাবুর বাড়ীতে আগমন করিলেন। তিনি বাহিরে অনেক লোক-সমাগম এবং শক্তিসাধনকে তদবস্থায় দেখিয়া কিছুমাত্র আশ্চর্যান্বিত হইলেন না; বরং ঈষৎ হাসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “মহাশয়। কোন্ অপরাধে শক্তিসাধন ধৃত হইয়াছে জানিতে পারি কি?” 

আমি বলিলাম “হরিসাধনবাবুকে হত্যা করিয়াছেন, এই অপরাধে গ্রেপ্তার হইয়াছেন।” 

আমার কথা শুনিয়া তিনি বিস্মিত হইলেন না বরং আপনা-আপনিই বলিয়া উঠিলেন “আমিও ঠিক ওই সন্দেহ করিয়াছিলাম।” 

অনন্তর একখানি গাড়ি ডাকিতে আদেশ করিলাম। শকট আনীত হইলে পূর্ব্বোক্ত কনেষ্টবল দুইজনকে বন্দীর সহিত আরোহণ করিতে আদেশ করিলাম। 

তিনজনে শকটে আরোহণ করিলে আমি কনেষ্টবলদ্বয়কে যথাযথ পরামর্শ দিয়া থানায় পাঠাইয়া দিলাম। কোচম্যান শকট চালনা করিবামাত্র হরিসাধনবাবুর বাড়ীর অন্দর হইতে স্ত্রীলোকের ক্রন্দন-ধ্বনি আমার কর্ণ গোচর হইল। প্রথমে যখন এই বাড়ীতে আসিয়াছিলাম, তখন যাঁহার কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইয়াছিলাম, আজও তাঁহারই রোদনধ্বনি বলিয়া বোধ হইল। শক্তিসাধন অনেকবার বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার জ্যেষ্ঠের স্ত্রী তাঁহাকে পুত্রবৎ স্নেহ করিয়া থাকেন। এখন তিনিই যে শক্তিসাধনের জন্যই ক্রন্দন করিতেছেন তাহা বুঝিতে পারিলাম। 

আর বৃথা সময় নষ্ট না করিয়া আমি তখনই থানায় প্রত্যাগমন করিলাম। নানা কাৰ্য্যে অত্যন্ত ক্লান্ত হওয়ায় সেদিন আমি আর কোন কর্ম্মে হস্তক্ষেপ করিলাম না। 

পরদিন প্রাতঃকালে শক্তিসাধনের সহিত দেখা করিলাম। ভাবিয়াছিলাম, তাঁহাকে হত্যাকারী প্রমাণ করিতে কষ্ট পাইতে হইবে। কিন্তু বাস্তবিক সেরূপ হইল না। শক্তিসাধন সকল কথা স্বীকার করিলেন। হরিসাধনবাবুর জন্যই তাহাকে জাতিচ্যুত হইতে হইয়াছিল বলিয়া তাঁহার উপরেই শক্তির আক্রোশ ছিল; এবং আহারের পর যখন হরিসাধন পান করিবার জল চাহিয়াছিলেন, তখন শক্তিসাধন কৌশলে সেই জলের সহিত আর্শেনিক মিশ্রিত করিয়া জ্যেষ্ঠকে পান করিতে দেন। যে উপায়ে তিনি আর্শেনিক সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহাও গোপন করিলেন না। কেদার ডাক্তারের মুখে যাহা শুনিয়াছিলাম, তিনিও সেই কথা বলিলেন। 

কিছুদিন পরে শক্তিসাধনের বিচার হইল। বিচারে তাঁহার ফাঁসীই ধার্য্য হইল। 

সমাপ্ত 

[ মাঘ, ১৩১৬ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *