রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

জোসেফ স্ট্যালিন (১৮৭৯–১৯৫৩) – সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়েনের ‘লৌহমানব’

জোসেফ স্ট্যালিন (১৮৭৯–১৯৫৩) – সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়েনের ‘লৌহমানব’

একদা লৌহমানব বলে বিশ্বে যাঁর খ্যাতি ছিল, যাঁকে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ শ্রদ্ধা করত, ভয় করত এবং হয়তো ঘৃণাও করত অনেকে, সেই বিতর্কিত বিশাল ব্যক্তিত্ব আর কেউ নন, রুশ নেতা জোসেফ স্ট্যালিন (Joseph Stalin )।

অথচ তিনি ছিলেন এক ক্রীতদাসের পুত্র। মালিকের জমি বিক্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পূর্বপুরুষেরাও জমির সঙ্গে বিক্রি হয়ে যেতেন। অথচ এই বংশেরই এক সন্তান জোসেফ স্ট্যালিন হয়েছিলেন গোটা বিশ্বের এক-ষষ্ঠাংশ ভূখণ্ডের মহাশক্তিধর শাসক।

জোসেফ স্ট্যালিনের জীবনের একটাই ছিল সবচেয়ে বড় আদর্শ—শ্রদ্ধা করো, ভয় করো, কিংবা ঘৃণা করো, কিন্তু কেউ যেন তাঁকে এড়িয়ে যেতে না পারে। দেশের ওপর সাধারণ মানুষের রাজত্ব কায়েম করা এবং সাধারণ মানুষকে দেশ শাসনের যোগ্যতর করে তোলা, এটাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র মূলমন্ত্র।

জোসেফ স্ট্যালিনের জন্ম ১৮৭৯ সালে জর্জিয়ার রাজধানী টিফ্লিসের কাছাকাছি ছোট্ট একটি শহর গোরিতে।

আমেরিকায় ক্রীতদাসপ্রথা রহিত হবার তিন বছর আগেই রাশিয়ার জার সম্রাট দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ভূমিজাত ক্রীতদাসপ্রথা উচ্ছেদ করেন। তাই স্ট্যালিনের জন্মলগ্নে তাঁর পিতামাতা মুক্তজীবনের অধিকারী ছিলেন।

স্ট্যালিনের বাবার নাম ছিল ভিসারিয়ন ডি জুগাসভিলি। মায়ের নাম ছিল একাতেরিনা। স্ট্যালিনরা ছিলেন চার ভাইবোন। তবে তাঁর পরের সব ভাইবোনেরই ঘটে অকালমৃত্যু। স্ট্যালিন ছিলেন চতুর্থ সন্তান।

স্ট্যালিনের বাবা ছিলেন মাতাল এবং বদমেজাজি মানুষ। তাঁর যখন মাত্র দশ বছর বয়স, তখন তাঁর বাবার মৃত্যু হয়।

স্ট্যালিনের বাল্যজীবন ও শিক্ষা শুরু হয় এক নোংরা পরিবেশে। বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে একজন মুদি ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তোলা। কিন্তু মা চাইতেন, তাঁর ছেলে আরও লেখাপড়া করে মানুষ হোক, অন্তত এই অভিশপ্ত নোংরা জীবন থেকে মুক্তি লাভ করুক। মায়ের ইচ্ছে ছিল তাঁর ছেলে যেন একজন পাদরি হতে পারে।

তাই অনেক চেষ্টা-তদ্বির করে মা তাঁকে বৃত্তির ব্যবস্থা করে একটি ধর্মীয় স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। স্ট্যালিন পাদরি হওয়ার জন্য ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগলেন।

কিন্তু একদিন কেমন করে যেন সব গোলমাল হয়ে গেল। তখন তাঁর মাত্র বছর পনেরো বয়স। এ সময় একটি বই তাঁর হাতে এস পড়ে। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লব সৃষ্টিকারী বই কার্ল মার্কস রচিত ‘ক্যাপিটেল’ (Capital) বা ‘পুঁজি’।

এই বইটি স্ট্যালিনের মনকে এমন নাড়া দিল যে, তিনি তৎক্ষণাৎ মার্কসপন্থি লোকদের সাথে গোপন তৎপরতায় মেতে উঠলেন। এই পুস্তকের জাদুমন্ত্রে তিনি এমনই মুগ্ধ হয়ে গেলেন যে, সর্বসাধারণের কল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করলেন। ঘোষণা করলেন তিনি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

তখন থেকেই স্ট্যালিনের মনে এই প্রত্যয় জন্ম নিল যে, দরিদ্র ও মানবেতর জীবনযাপনকারী কৃষক-শ্রমিকদের জীবনের মানোন্নয়ন করতে হলে বিপ্লবের পথ ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

এদিকে বৈপ্লবিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়ার পরই পাদরিরা তাঁকে স্কুল থেকে বের করে দেন। পরবর্তী ২৫ বছর তিনি স্বীয় লক্ষ্য ও আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য দিনরাত কাজ করে যান। দিনের পর দিন কাটান তিনি এখানে-সেখানে। এর মধ্যে আট বছর কাটান কারাবাসে।

কিন্তু এত দুর্ভোগের পরও তিনি পার্টির কাজে এতটুকু শৈথিল্য প্রদর্শন করেননি। এই সময়ই তিনি পিটার্সবার্গ থেকে গোপনে একটি বিপ্লবী পত্রিকাও প্রকাশ করেন।

স্ট্যালিন এমনই বিপ্লবপ্রিয় ছিলেন যে, তিনি নিজের জীবনেরও পরোয়া করতেন না। ১৯০৫ সালের বিপ্লব ব্যর্থ হলে লেনিন ও ট্রটস্কি রাশিয়া ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে পলায়ন করেন। কিন্তু স্ট্যালিন জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও দেশ ছেড়ে পালালেন না। রুশ পুলিশ তাঁকে খোঁজার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে লাগল। ধরতে পারলে তারা সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করত।

দেশের বাইরে বসে পলাতক নেতা লেনিন কমিউনিস্ট সাহিত্য রাশিয়ার অভ্যন্তরে পাচার করতেন। এগুলো লেখা থাকত সিগারেটের প্যাকেটে। এসবই আমদানি করা হতো মদের পিঁপার মধ্যে লুকিয়ে। স্ট্যালিন এই প্রবন্ধগুলোই তাঁর গোপন পত্রিকায় ছেপে প্রকাশ করতেন। এ ছিল এক ভয়াবহ দুঃসাহসের কাজ।

স্ট্যালিনকে ছয়বার সাইবেরিয়ায় পাঠানো হয়। কিন্তু এর মধ্যে পাঁচ বারই তিনি ফিরে আসতে সক্ষম হন। জেল, জুলুম, বেত্রাঘাত, প্রাণে মারার হুমকি—কোনোকিছুই তাঁকে স্বীয় আদর্শ এবং লক্ষ্য থেকে টলাতে পারেনি। এসব বরং তাঁর বিশ্বাস ও মনোবলকে আরও দৃঢ় করে তুলতে সহায্যে করেছে।

ষষ্ঠবারে তাঁকে গ্রেফতার করে পাঠানো হয় সাইবেরিয়ায়—পৃথিবীর শীতলতম স্থানে। সেটা এমনই এক ভয়ংকর স্থান যে, সেখান থেকে পালিয়ে আসা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই সেখানে কাউকে আটকে রাখার প্রয়োজন হয় না। কারণ, সেখান থেকে কেউ পালিয়ে জীবন নিয়ে আসতে গেলেই ঠাণ্ডায় জমে নির্ঘাত মারা যাবে।

কিন্তু দুর্গম অঞ্চলের বন্দিশালার নরকে থেকেও তিনি নিজের আদর্শ ত্যাগ করেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, কোনো-না-কোনো উপায়ে তিনি এখান থেকে পালাতে সক্ষম হবেনই।

অবশেষে ১৯০৫ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় সাধারণ ক্ষমার অধীনে তিনি মুক্তি লাভ করেন।

স্ট্যালিন কিন্তু তাঁর আসল নাম নয়। এটা তাঁর ছদ্মনাম! আসল নাম ছিল উওসেফ ভিসারিওনোভিচ জুগাসভিলি। স্ট্যালিন শব্দের অর্থ লোহার দ্বারা গঠিত। আসলেও তিনি ছিলেন লৌহমানব। একমাত্র স্ট্যালিনের অনমনীয় মনোভাবের জন্যই চরম দুঃসময়ে ও বলশেভিক পার্টির মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারেনি।

বিপ্লবী স্ট্যালিনের ব্যক্তিগত জীবন খুব সুখের ছিল না। তাঁর প্রথম স্ত্রী ক্যাথেরিন ছিলেন একেবারেই একজন সাধারণ গৃহিণী। বিপ্লবী আদর্শের কণামাত্রও তাঁর মধ্যে ছিল না। স্বামীর এমন পলাতক জীবন, যার পেছনে সর্বক্ষণ পুলিশ ঘুরঘুর করে, সারা বছরে দুচার দিনের বেশি ঘরে থাকেন না, তাও রাতের আঁধারে লুকিয়ে আসেন, এমন স্বামীর ঘরের দুঃসহ জীবন তাঁর পছন্দ হয়নি। তিনি মাত্র চার বছর জীবিত ছিলেন। তবু ক্যাথেরিন তাঁকে পুত্রসন্তান দান করেছিলেন।

স্ট্যালিন দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন ৪০ বছর বয়সে। এই স্ত্রীও বেশি দিন বাঁচেননি। কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বিয়ের মাত্র ক’বছরের মধ্যেই। এ ঘরে স্ট্যালিনের এক কন্যা ও এক পুত্রের জন্ম হয়।

রাশিয়ায় পুরোপুরি বিপ্লব শুরু হয় ১৯১৭ সালের ৩ মার্চ থেকে এবং শেষ হয় ১৯১৭ সালের ৭ অক্টোবরে।

বিপ্লবের অবসান হলে নতুন সরকারের প্রধান হন লেনিন। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯২৪ সালে, তার পরই নেতৃত্ব হাতে আসে স্ট্যালিনের।

কিন্তু রাশিয়ার একচ্ছত্র শাসক হওয়া সত্ত্বেও তিনি জার সম্রাটের রাজপ্রাসাদে বাস করতেন না। তিনি থাকতেন শাহী মহলের পাশের একটি ক্ষুদ্র বাড়িতে—যেখানে জার সম্রাটের এক ভৃত্য বাস করত। তিনি একেবারেই সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। কখনও কোনো কাজে আত্মজাহির করতেন না। লোক দেখানো কার্যকলাপকে তিনি ঘৃণা করতেন। রাশিয়ায় সেকালে অনেক বিদেশি কূটনীতিক ছিলেন, যাঁরা বছরের পর বছর রাশিয়াতে অবস্থান করেও স্ট্যালিনের সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ পাননি।

স্ট্যালিন সম্পর্কে রুশ বিপ্লবের জনক লেনিন বলতেন; এই পাচক বড্ড গরম খাবার সামনে এনে দেন।

স্ট্যালিন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাজিবাহিনীর বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত উপায়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। নয়তো হিটলারকে পরাজিত করতে মিত্রবাহিনীকে আরও অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হতো। স্ট্যালিন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় শুধু স্বদেশের স্বাধীনতাই রক্ষা করেননি, সেইসাথে গণতন্ত্র এবং প্রায় গোটা বিশ্বের সকলকেই রক্ষা করেছিলেন হিটলার বাহিনীর হাত থেকে। স্ট্যালিনের লালবাহিনী যদি বীরত্বের সাথে অসীম ত্যাগ স্বীকার করে এগিয়ে না আসত, তা হলে মানব সভ্যতার যে কী দশা হতো তা ভাবলেও আজ হৃৎকম্প হয়।

বিপ্লবের পর স্ট্যালিন রাশিয়ার লোকদের এত কাজ দিয়েছিলেন যে, সেখানে একটি লোকও বেকার ছিল না। রাশিয়ার প্রতিটি লোক কাজ পেয়েছিল, খেতে পেয়েছিল এবং লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিল।

এই মহান বিপ্লবীর দেহাবসান হয় ১৯৫৩ সালের ৬ মার্চ। তিনি ছিলেন বিশ্বের একজন অসামান্য শক্তিধর বিপ্লবী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *