জোয়ারের দিন
টুপটাপ টুপটাপ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সারাদিন ধরে হচ্ছে। সারারাত ধরে হচ্ছে।
একেকবার থেমে যায় বৃষ্টি, তারপর আবার নামে। কখনও কখনও বিদ্যুৎ চমকায়। গুড় গুড় করে মেঘ ডাকে। যেন বা যাতায় মটর কিংবা অড়হর ভাঙাচ্ছে কেউ। তারপরই বৃষ্টির বেগ বাড়ে। টুপটাপ শব্দে বড় বড় ফোঁটা পড়ে। খানিক পর আবার কমে। কোত্থেকে যে দমকা একটা হাওয়া আসে। শো শো শব্দে গাছপালার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। আকাশে অবিরাম চলাচল করে মেঘ। ঈশান কোণ থেকে কালো বর্ণের মেঘ ওঠে আসে মধ্য আকাশে। সেই মেঘে কেবলই বৃষ্টি হয়।
এবারের বর্ষা খুব দ্রুত নেমে আসছে লোকালয়ে।
খালবিল উপচে জল ওঠে যাচ্ছে জমিতে। চোত বোশেখের খরায় শুকিয়ে যাওয়া মাটি জলে ডোবা পাটপাতার মতো কোমল হয়ে ওঠছে। দেখে মনে হয়, আবহমানকাল ধরে এরকম বৃষ্টিপাত হচ্ছে পৃথিবীতে। এখানে কখনও সূর্য ওঠেনি, নীল রোদ পড়েনি প্রান্তরে কিংবা রাতেরবেলা চাঁদ ওঠেনি, শুভ্র জ্যোৎস্না নামেনি চরাচরে। শুধুই বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
ইরফানের ঘরের খড়ের চালা ভিজে চপচপ করছে।
জায়গায় জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। সেই সব ফুটো দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে। ঘরের ভেতর। বড় একটা ফুটোর তলায় টিনের থালা পেতে রেখেছে পদ্মা। থেমে থেমে পড়ছে থালার ওপর। আর টুমটুম করে শব্দ হচ্ছে। ঘরের মেঝেও ভিজে ওঠেছে। স্যাঁতস্যাঁতে নরম মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। বর্ষা যে খুবই প্রবল হয়ে আসছে বোঝা যায়। দুপুরের পর পর পুরোনো মাথালটা মাথায় পরল ইরফান।
খালুই হাতে নিল। তারপর ঘর থেকে বেরুল। দরোজার বাইরে চালার সঙ্গে দড়ির আংটায় আড়াআড়ি ঝোলানো টেটাটা নামাতে নামাতে আকাশের দিকে তাকাল। দুপুর বেলায়ই কীরকম অন্ধকার হয়ে ওঠেছে চারদিক। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, আর তার পর পরই মেঘ ডেকে ওঠেছে।
আঙুলের ডগা বুলিয়ে টেটার ধার পরীক্ষা করল ইরফান। তারপর পদ্মাকে বলল, মেঘে কী ডাক ছাড়ে হুনছচ। কই মাছ উডব আইজ।
পদ্মা ভীতু গলায় বলল, ঠাডা পড়তে পারে। কাম নাই তুমার মাছ মারতে যাইয়া। আমাগোর কই মাছ লাগব না। পদ্মার কথা শুনে ঠা ঠা করে হেসে উঠল ইরফান। জোয়াইরা দিনে ঠাডা পড়ে না। জোয়াইরা মাছ ধরলে তর খারাপ লাগে হেইডা ক। আসল কতাডা ক বউ।
পদ্ম খানিক চুপ করে রইল। তারপর বলল, মাছের বড় সুখের দিন এইডা। তুমি কী নিঠুর গো। এই দিনের মাছ না মারলে কী অয়। মাছ না খাইলে কী অয়!
আবার শব্দ করে হাসে ইরফান। তুই অহন পোলাপান রইছস বউ! কতা কচ পোলাপানের লাহান। মাছের সুখের দিন দেইক্কা মাছ মারব না মাইনষে, মাছ খাইব না! ইরফানের ঘর ছাড়িয়ে বিশ তিরিশ কদম খোলা উঠোন। বৃষ্টিতে উঠোনের আটাল মাটি খুব পেছল হয়েছে। সেই পেছল মাটির উঠোন দিয়া অভ্যস্ত পায়ে হেঁটে যায় ইরফান। পেছন থেকে পদ্মা বলল, হাঁজে হাঁজে আইয়া পইড়। আইজ রাইতে আর মাছ মারতে যাইতে পারবা না।
ইরফান কথা বলে না। হাসে। তারপর উঠোন পেরিয়ে মাঠের দিকে নেমে যায়।
ধানপাটের জমিতে এখন গোড়ালি ডুবে যাওয়ার মতো জল। পাটপাতা বৃষ্টিতে ভিজে ঘন সবুজ হয়েছে কোন ফাঁকে। নদী থেকে খাল বেয়ে জল আসছে গ্রামে। অঞ্চলটা নিচু। খালডোবার সংখ্যা বেশি। বর্ষার মুখে মুখে অল্প সময়ে পুকুর ডোবা ভেসে জল ওঠে যায় মাঠে।
মাঠে নেমে ইরফান দেখতে পায় টুপ টুপ করে অনবরত বৃষ্টি পড়ছে জলের ওপর। বাতাসে ঝিলমিলিয়ে ঢেউ ওঠছে ফসলহীন বাজা জমিতে। কনকনে একটা শীত গড়িয়ে গড়িয়ে বয়ে যায়। এসময় পাট ক্ষেতে মাছ পাওয়া যাবে না। মাছেরা সব কেলি করে রাতেরবেলা। ছুটোছুটি করে অল্প জলে। সেকী উদ্দাম ছুটোছুটি!
মিয়াবাড়ির পুকুর থেকে জল নামছে পাশের নিচু জমিতে। এরকম জলের সঙ্গে ঝাঁকে ঝকে নামে পুঁটি মাছ। পুঁটি মাছের শরীরের দুপাশে লাল রঙের সির পড়ে এসময়। পেটভর্তি থাকে ডিম। আর শরীর কী নরম! কী তুলতুলে!
মিয়াবাড়ির ঘন গাছগাছালির ভেতর ছায়াঘন অন্ধকার জমে ওঠেছে। ঝিম মারা গাছপালা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। সর সর করে একটানা একটা শব্দ হচ্ছে। এক টুকরো কালো মেঘ পেটভর্তি ডিমের ভারে চলতে না পারা রয়না মাছের মতো ধীর ভঙ্গিতে ওঠে আসে মধ্য আকাশে। ফলে ছায়াঘন অন্ধকার আরো অন্ধকার হয়।
মাঠে না গিয়ে মিয়াবাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল ইরফান। জায়গাটা নিরিবিলি। কিছু ঝোপঝাড় আছে, লম্বা লম্বা আড়ালি দল আর বাকসা ঘাস আছে। এই ধরনের জঙ্গুলে জায়গায় শিংমাছ ওঠার সম্ভাবনা। শিংমাছগুলো সবসময় ওঠে। আট দশটা একসঙ্গে হয়ে খেলা করে। ক্যোৎ ক্যোৎ শব্দে চারদিক মাত করে ফেলে। তখন টেটা মারলে একসঙ্গে অনেকগুলো গাঁথা যায়। পেটের ভেতর ডিম থাকে বলে মাছগুলো কমজোরী। এখন বাচ্চা হবে তখন বাচ্চা হবে এমন মেয়েমানুষের মতো ধীর চলাচল তাদের। টেটা মারার পর অনায়াসে খালুইতে তোলা যায়।
মিয়াদের আম বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আকাশে মেঘের সেই গুড় গুড় ডাক আবার শুনল ইরফান। শুনে বুকের ভেতরটা খুশিতে নেচে ওঠত তার। বর্ষা শুরু হওয়ার পর গত কয়েকদিনে আজই প্রথম এরকম শব্দে মেঘ ডাকছে। আজ কই মাছ না ওঠে পারে না। মেঘের এরকম ডাকে উচ্ছলতা বাড়ে কই মাছের। মাথায় বিকার দেখা দেয়। কিছুতেই আর জলায় থাকতে পারে না। কানকো দুটোকে ল্যাংড়া খোঁড়া মানুষের
ক্রাচের মতো ব্যবহার করে ডাঙায় ওঠে আসে।
মিয়াবাড়ির গোমস্তা অখিলা বড় চালাক লোক। পুকুর থেকে চারদিক দিয়ে জল উপচাতে দেখে ছোট মতো নালা কেটে দিয়েছে এক জায়গায়। পুরো জলাটা নেমে আসছে, সেই নালা দিয়ে। সঙ্গে নামছে পুঁটি মাছের ঝাঁক। অখিলা সকাল থেকে একটানা সন্ধ্যে পর্যন্ত মাছ ধরে। খালুই খালুই পুঁটি মাছ। তিনটে খুঁটি দিয়ে ভেঁশালের মতো করে ছোট জাল পেতে দিয়েছে নালার মুখে। জল গড়িয়ে নামে জালের ভেতর দিয়ে আর মাছগুলো আটকে থাকে জালে। রুপোলি শরীরে লাফালাফি করে।
এসব ছোট মাছ ধরতে ভালো লাগে না ইরফানের।
পদ্মার জন্যে কাল পুঁটি মাছ দিয়েছিল অখিলা। সেই মাছ দেখে পদ্মা যে কী রকম আফসোস শুরু করল! পুটি মাছেরা ক্যামন শাড়ি ফিনছে দ্যাহ। এইডা বড় সুখের দিন ওগো। এই মাছটিরে তুমরা মার ক্যান?
পদ্মার কথা শুনে রাগ করেছিল ইরফান। তর যত সোয়াগের কতা বউ! মাছের ভালা সুময় দেইখ্যা, সুখের সময় দেইখ্যা আমরা মাছ মারুম না?
এখন অখিলাকে দেখে পদ্মার কথা মনে পড়ল ইরফানের। মনে পড়ে মেজাজ একটু খারাপ হল। মাছের ভালো সুময়, খারাপ সুময়ে মাইনষের কী যায় আহে! বনের বাঘে কি মাইষের সুখ-দুঃখ দেইখ্যা মানুষ খায়! বিলাইতে কি ইন্দুরের সুখ-দুঃখ দেইখ্যা ইন্দুর খায়। এইডা অইল গিয়া দুনিয়াদারির নিয়ম। একটা জীবে আরেকটারে খাইব। যার জোর বেশি হেয় খাইব কমজোরীগো।
ইরফানকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসল অখিলা। উদোম গায়ে লুঙ্গি কাছা মেরে বসে মাছ ধরছে সে। গন্ধরাজ ফুলের মতো থোকা থোকা পুঁটি মাছ তুলে রাখছে খালুইতে।
অখিলার মেষের মতো কালো শরীরে বৃষ্টির জল গড়াচ্ছে। হাসতেই অখিলার ঠোঁটের দিকে চোখ গেল ইরফানের। উনুনের পোড়া মাটির মতো রং ধরেছে ঠোঁটে। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে মাছ ধরেছে বলে এই অবস্থা। অখিলার হাসির জবাব না দিয়ে তার খালুইয়ের ভেতরটা উঁকি মেরে দেখল ইরফান। তারপর বলল, কী র্যা অখিলার পো, কতডি পাইলি?
আবার আগের মতো করে হাসল অখিলা। দুই খালুই থুইয়া আইছি মেবাই। অহন এইডা ভরলে যামুগা। ভারি শীত করে মেবাই।
কথা বলার ফাঁকে দাঁতে দাঁতে ঠুকে যায় অখিলার। হু হু করে কাঁপছে সে।
নালার মুখে পেতে রাখা জালের দিকে এক পলক তাকিয়ে ইরফান বলল, পুডি মাছ এত ধইরা কী করবি? হেরচে বাইত্তে গিয়া গুমা। কাম অইব।
অখিলা কথা বলে না। একটা মেটে সাপ এসে চোখের পলকে জড়িয়ে ধরে তার জালে। পুরো শরীরটা প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে উথালপাথাল করে জালটা। স্বচ্ছ জলের তলার পুঁটি মাছের চলাচল দেখা যাচ্ছিল। দেখে শব্দ করে হেসে ওঠল ইরফান। আর অখিলা হল মহাবিরক্ত।
বিড়বিড় করে গাল দিল সে। হুমুন্দির পুত হাপেই জ্বালাইয়া খাইল। পাঁচটা ছাড়াইলাম। একবার প্যাচাইয়া গ্যালে সহজে ছাড়ান যায় না। জাল ছিঁড়ে যায়।
ইরফান আর কথা বলে না। নালাটা ডিঙিয়ে দক্ষিণের জংলা মাঠে গিয়ে নামে। জায়গাটায় হাগড়া আড়ালি আর বাকসা ঘাসের জঙ্গল। জঙ্গলের কোমর অব্দি ডুবে গেছে। জলে। সেদিকে এগিয়ে গেল ইরফান। শব্দ পেলে মাছেরা সব ছুটে পালাবে। এজন্যে সাবধানে পা ফেলছিল সে।
মাছেরা খুব সচেতন জীব। মেয়েমানুষের মতো। মেয়েমানুষে যেমন চোখ দেখে পুরুষের মতলব টের পায়, মাছেরা তেমন সামান্য শব্দে ভয় পায়।
সাবধানে পা ফেলে ইরফান। পা তোলে।
এক জোড়া কোলা ব্যাঙ লাফ মেরে পালিয়ে গেল পায়ের কাছ থেকে। চমকে টেটা বাগিয়ে ধরল ইরফান। তারপর ব্যাঙ দেখে হেসে ফেলল। কোলা ব্যাঙরাও ডিম ছাড়ে এসময়। আধা জল আধা শুকনোয় পড়ে থেকে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর একটানা ডাকে ব্যাঙগুলো। খানিকক্ষণ পর পর কালো দানা দানা ডিম ছাড়ে জলে। মুহূর্তে জলের ভেতর ছড়িয়ে যায় ডিমগুলো।
মিয়াবাড়ির গাছপালা দমকা হাওয়ায় সাপের মতো শোঁ শোঁ শব্দ ছড়ায়। আকাশের তলায় এসে স্থির হয় কালো মেঘ। বিদ্যুৎ চমকায়। গুড় গুড় করে মেঘ ডাকে। তারপর বৃষ্টির তোড় বাড়ে।
মাথলাটা এক হাতে নেড়েচেড়ে ঠিক করে ইরফান। হিজল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে কোমর থেকে বিড়ি আর দেশলাই বের করে। বৃষ্টি এবং বাতাসের আঁচ বাঁচিয়ে কায়দা। করে বিড়ি ধরায়। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মিয়াদের পুকুরের দিকে তাকায়। বর্ষার জলে মিয়াদের পুকুরটা এখন টইটম্বুর। পুকুরের জলে পড়ছে বৃষ্টি। জলের ওপর পড়ছে জল। দেখে মনে হয়, অসংখ্য পোনামাছ পুট পুট করে ভাসছে পুকুরের জলে। একটা ছুঁই লেজ নেড়ে নেড়ে আস্তেধীরে সাঁতার কাটে। হু হু বাতাসটা বয়ে যায়। বাতাসে কনকনে একটা শীত ভাব।
বিড়ি টানতে টানতে হাঁটে ইরফান। বিড়ির ধোঁয়ায় বেশ একটা উত্তেজনা তৈরি হয় শরীরে। পায়ের তলায় শীতল জলের ছোঁয়া টের পাওয়া যায় না।
একটা ছোট ঝোপের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ইরফান। অল্প অল্প নড়ছে ঝোপটা। মুহূর্তে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠল ইরফানের চোখ। এটা আড়ালির ঝোপ। ভেতর কেমন খল খল শব্দ হচ্ছে। মুহূর্তে দেরি করল না ইরফান। খচ করে টেটা চালিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল ঝোপটা। বিড়িটা শেষাশেষি চলে এসেছে। হাতে আঁচ লাগে। সুখটান দিয়ে ফেলে দিল ইরফান। তারপর যত্ন করে টেটাটা টেনে তুলতে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে মুখটা হা হয়ে গেল ইরফানের। অস্ফুট একটা ভয়ার্ত শব্দ বেরিয়ে এল মুখ থেকে। টেটাটা অল্প একটু টানতেই শরীর দেখা গেছে জীবটার। কালোর ভেতর হলুদ ডোরাকাটা। গস্তি নাওয়ের কাছির মতো মোটা। হা করা মুখের ভেতর পেট ফোলা বড় সড় একটা রয়না মাছের অর্ধেকটা ঢুকে আছে। ঠিক ঘাড়ের কাছটায় ইরফানের টেটা গেঁথেছে। তবু বেশ ভয় পেল ইরফান। টেটা ছেড়ে সরে এল।
কী সাপ! জাতটাত নয় তো।
না, জাতসাপ তো মাছ খায় না। ঢোঁড়াটোড়া হবে!
মাছখেকো ঢোড়া সাপের কথা ভেবে সাহস পেল ইরফান। সাবধানে এগিয়ে গিয়ে টেটাটা টানল। যাই হোক, শালা ভালো করে গেঁথেছে। ছুটে কামড়াতে অন্তত পারবে না।
সাপটা ততক্ষণে প্রচণ্ড শক্তিকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। পুরো শরীর টেটার সঙ্গে পাচিয়ে উথালপাথাল করছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।
সাবধানে ঝোপের ভেতর থেকে টেটা বের করে আনল ইরফান। ইরফানের ভাবনাই ঠিক। একটা পুরোনো কালঢোঁড়া মাছ খেতে বেরিয়ে টেটায় গাঁথা পড়েছে।
কিন্তু সাপটাকে ছাড়ানো যায় কী করে। তাছাড়া তেঁড়ার মধ্যে এ জাতটা আবার খারাপ। কামড়ালে বিপদ আছে।
এসময় বেশ শব্দ করে মেঘ ডাকল। সেই ডাকে সাপের কথা ভুলে চারদিকে তাকাল ইরফান। তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চাপচাপ অন্ধকার জমে ওঠেছে। গাছপালায়। আগের সেই হাওয়াটা আবার হু হু করে বইতে শুরু করেছে। হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাছে কোথাও গলা ছেড়ে ডাকতে শুরু করেছে কোলা ব্যাঙ। বৃষ্টি কমে এসেছে।
মাঠের দিকটা এখনো ফরসা। কিন্তু অন্ধকার হতে দেরি হবে না। মাঠের দিকে তাকিয়ে কী ভাবল ইরফান। তারপর টেটা ফেলে রেখেই বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। সাপটা যদি একা একা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় তো ভালো, না হয় কাল সকালে এসে যা হোক ব্যবস্থা একটা করা যাবে। এখন অত বড় সাপ ঘটাতে যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া সন্ধ্যেও হয়ে আসছে। বাড়ি ফিরে সন্ধ্যেরাতে ছোটখাটো একটা ঘুম দিতে হবে। মাঝরাতে যেতে হবে বিলে। রাতের বেলা পশ্চিমের বিলে বোয়াল মাছ পীর ধরে। এই দিনে পীরের বোয়াল না মারলে সে আবার মাছ শিকার হল নাকি!
বাড়ি ফিরে ইরফান দেখতে পেল আবছা অন্ধকারে গোয়ালঘরে গরু বাঁধছে পদ্মা। বকনাটা হাম্বা করে চেঁচাচ্ছে। লেজ ঝাঁপটে মশা তাড়াচ্ছে। এই রকম বৃষ্টিবাদল অথচ মশার কমতি নেই, গরুগুলো রাতভর লেজ ঝাঁপটে তাড়ায়। এদিকে আঙিনার মাটি পচে ওঠেছে বৃষ্টিতে। একাকার কাদা। পা রাখা দায়। আটালে মাটির কাদা বড় পেছল। আর মাটিতে কেমন সোঁদা গন্ধ।
ইরফানকে শূন্য খালুই হাতে ফিরতে দেখে খুবই অবাক হল পদ্মা। হেসে বলল, টেডা কৈ? ইরফান কথা বলল না। ঘরের সামনে ফেলে রাখা থান ইট দুটোর ওপর দাঁড়িয়ে বদনার জলে পায়ের কাদা ছাড়াতে লাগল। পদ্মা ঘরে গিয়ে কুপি জ্বালল। এখন আর বৃষ্টি নেই। দমকা হাওয়াটা আছে। গাছপালায় শোঁ শোঁ শব্দটা হচ্ছে। শব্দটা এমন শুনে মনে হয়, যেনও ভয়ানক তেজী কোনও সাপ থেমে থেমে ফুঁসছে।
মাথালটা খুলে গামছায় শরীর মুছতে মুছতে ইরফান বলল, মনডায় কইছিল হিংয়ের পীর অইব। টেডা মারতেই দেখলাম কালঢোঁড়া। ওরে বাপ র্যা! হালার পুতে পাঁচ আতের কম লম্বা না। টেডা ভাইঙা হালাইতে চায়। টেডা হালাইয়া থুইয়া আইয়া পড়লাম।
ইরফানের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল পদ্মা। চোখ ড্যাব ড্যাব করে বলল, মাগো! তুমারে হাপেই খাইব একদিন।
পদ্মার কথা শুনে ঠা ঠা করে হাসে ইরফান। ভাত দে। খাইয়ালইয়া ঘুম দেই।
মাটির হাঁড়ি থেকে ভাত দেয় পদ্মা। কাঁঠাল কাঠের চওড়া একটা পিড়িতে দুপা ভাজ করে বসে গপাগপ ভাত খায় ইরফান। পদ্মা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। তারপর বলে, তুমি কী মানুষ গো। ডরভয় নাই পরানে।
ইরফান পদ্মার মুখের দিকে তাকায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পদ্মাকে দেখে। হাসে। তারপর কথা অন্যদিকে ঘোরায়। তর শরীরডায়ও তো জোয়ার লাগছে মনে অয়।
পদ্মা মাথা নিচু করে হাসে। তুমি আবার এই হগল দ্যাহনি!
ঢক ঢক করে জল খায় ইরফান। দ্যাহি র্যা! দেহি! হগলই দেহি।
মনে তো অয় না।
কী মনে অয় তোর!
মনে হয় চেক্কা মাছ ছাড়া আর কিছু দেহ না তুমি। কানে মাছের ঘাই ছাড়া আর কিছু হোনো না।
খাওয়া শেষ করে বিড়ি ধরাল ইরফান। তারপর টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল হোগলের বিছানায়। চিৎ হয়ে শুয়ে বিড়ি টানতে লাগল।
হারিকলডা আঙ্গাইয়া থো পদ্মা।
ইরফানের কথা শুনে মুখ ঝামটা মারে পদ্মা। না আউজ রাতে আর মাছ মারতে যাইতে পারবা না।
ইরফান কথা বলে না। নির্বিকার ভঙ্গিতে বিড়ি টানে। খুক খুক করে অকারণেই বার কয়েক কাশে। তারপর খাকিয়ে ওঠে। প্যাচাল পারিস না। আঙ্গাইয়া গো হারিকলডা। রাইতে আর তরে জাগামু না।
পদ্মা এক পলক ইরফানের মুখের দিকে তাকায়। মুখটা ম্লান হয়ে গেছে তার। কী এক অভিমানে ভরে গেছে বুক। পদ্ম আর কথা বলে না। কাঁচ পরিষ্কার করে কুপির সলতেয় হারিকেন জ্বালায়। ইরফান শুয়ে শুয়ে দেখে গোমড়া হয়ে গেছে পদ্মার মুখ। বউটা এরকমই। একটুতেই বাচ্চা মেয়ের মতো অভিমানী হয়ে ওঠে। গাল ফুলিয়ে মুখ গোমড়া করে। সহজে কথা বলে না।
কুপি নিভিয়ে হারিকেনটা বিছানায় পাশে রাখে পদ্মা। তারপর ইরফানের গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। কিন্তু কথা বলে না। শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ইরফান আস্তে করে জিজ্ঞাস করে, পলোডা কই রাখছস?
পদ্মা কথা বলে না। ইরফান সামান্য বিরক্ত হয়। আরে কথা কয় না ক্যা!
পদ্মা আস্তে করে বলল, গোয়াল গরে রাখচি।
তারপর আবার সব চুপচাপ। কেউ কোনও কথা বলে না। হারিকেন ম্লান আলো ছড়াচ্ছে। ঘরের ভেতর। বাইরে গাছপালায় বইছে সেই দমকা হাওয়া। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। গুড় গুড় করে ডাকছে মেঘ। কিন্তু বৃষ্টি নেই।
ইরফানের শরীরে ঘন হয়ে মিশে যায় পদ্ম। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে শোয় ইরফান। গুমাইয়া পড় বউ। পদ্মা যেন সে কথা শুনতে পায় না। ইরফানের পিঠে মায়ামমতা কিংবা অন্যরকম কোনও স্পর্শে হাত রাখে। আস্তে আস্তে হাত বুলায়। গুমাইলা?
ক্যাঁ।
ছকিনার পোলাপান অইব।
হাছা?
হ।
তারপর একটু থেমে স্বামীর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে পদ্মা বলল, আমাগো যদি একটা পোলাপান অইত!
ইরফান কথা বলে না। ঘুমে চোখ টানে তার। ব্যাপারটা টের পেয়ে পদ্মা কাঁদো গলায় বলল, আমারে ইট্টুও মায়া কর না তুমি।
ইরফান আওয়াজ দেয় না। ঘুমের ভান করে। পদ্মা দুহাতে জড়িয়ে ধরে তাকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস গলায় বলে, আমারে ইট্টু আদর কর না গো আইজ! আদর করলে আমারও পোলাপান অইব। তুমি দেইখো।
এবার বিরক্ত হয় ইরফান। রাগে গর্জে ওঠে। চুপ কর মাগী। খালি রঙ্গের প্যাচাইল। রাইতে মাছ মারতে যামু। তর লগে পিরীত করতে পারুম না অহন। গুমাইতে দে।
হঠাৎ করে মুখের ওপর যেন চড় মারল কেউ। থতমত খেয়ে গেল পদ্মা। খানিক চুপ করে রইল সে। তারপর গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগল। পদ্মার কান্না শুনতে শুনতে অবলীলায় ঘুমিয়ে পড়ল ইরফান।
.
দুপুর রাত চট করে ঘুম ভেঙে গেল ইরফানের।
কয়েকদিন এরকম অভ্যেস হয়ে গেছে। গভীর রাতে ঘুমের ভেতর কেউ যেন ডাক দিয়ে যায় তাকে। ওঠ ইরফান। বিলে মাছ ওঠছে। বোয়াল মাছে পীর ধরছে। দুনিয়া ভইরা গ্যাছে মাছে। মাছ মারতে যাবি না।
সেই ডাকে ঘুম ভেঙে যায় ইরফানের। বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে হু হু করে জোয়ারে বাতাসে আসে ঘরের ভেতর। বাতাসে মাছের আঁশটে গন্ধ পায় ইরফান। সেই গন্ধ বিড়ির নেশার মতো কাজ করে। লাফিয়ে ওঠে ইরফান।
আজও ঘুমের ভেতর ওরকম ডাক শুনল ইরফান। শুনে লাফিয়ে উঠল। তারপর হারিকেনটা উসকে দিল। বিড়ি ধরাল। পদ্মাকে দেখল কাত হয়ে ঘুমোচ্ছে। হারিকেনের আবছা আলোয় কান্নার চিহ্ন দেখা যায় পদ্মার চোখে। ঘুমোনোর আগে প্রচুর কেঁদেছে পদ্মা বোঝা যায়। পদ্মার মুখটা দেখে নিঃশব্দে হাসল ইরফান। তারপর হারিকেন হাতে ওঠে দাঁড়াল। না, পদ্মাকে জাগাবে না। টের পেলে বউডা আবার খ্যাচ খ্যাচ শুরু করবে। একলা ঘরে থাকতে ডর করে না আমার!
কিংবা জোয়ারের মাছ ধইর না। তোমার আল্লার কছম। এইডা বড় ভালা সুময় মাছেগো। এসব শুনলে হাসি পায় ইরফানের। কী সব পোলাপানের লাহান কথা! মাছের ডিম পাড়ব তাতে পদ্মার কী! দুনিয়ার বেবাক জীবেই তো হয় ডিম পাড়ে, নয় বাচ্চা বিয়ায়। এইডাই দুনিয়ার নিয়ম। এর লেইগা অত হায়আফসোস দয়া দরদ দেহানের কী অইল। ঝাঁপ সরিয়ে ঘর থেকে বেরুল ইরফান।
বাইরে দাঁড়িয়ে ঝাপটা আবার ঠিকঠাক করে লাগিয়ে দিল। তারপর আকাশের দিকে তাকাল। ম্যাটম্যাটে জ্যোৎস্না ওঠেছে এখন। আকাশে মেঘের চলাচল আছে। আমগাছের মাথায় পাতলা শাড়িতে মুখঢাকা সুন্দরী মেয়ের মতো চাঁদ দেখা যায়। মেঘ এসে বারবার ঢেকে দেয় চাঁদ। তখন আবছা আঁধার নামে। আর সাপের মতো শব্দ করে বয়ে যায় বাতাস।
উঠোনের আটাল মাটিতে পা টেনে টেনে গোয়ালঘরের দিকে যায় ইরফান। পদ্মার বুঝি তখুনি ঘুম ভাঙে! ঘরের ভেতর বিড়বিড় করে একাকী কথা বলার শব্দ পাওয়া যায়। তারপর অস্ফুট কান্নার। শুনে নিঃশব্দে হাসে ইরফান। বউডা অহনও পোলাপান রইছে। ঘুমের তালে কথা কয়, কান্দে। গোয়াল ঘরে ঢুকে পলোটা খোঁজে ইরফান।
গরুগুলো লেজ ঝাঁপটে মশা তাড়াচ্ছিল। বকনাটা অতিরিক্ত দাপাদাপি করছে। দেখে হারিকেনটা একটু উসকে দেয় ইরফান। চালার সঙ্গে লটকে রাখা পলোটা টেনে নামায়। তখুনি দমকা একটা হাওয়া ওঠে। গোয়াল ঘরের পেছনে, বাড়ির নামার দিকে ঘ্যাঙ্গর ঘ্যাঙ্গর ডাকে ব্যাঙ। এক হাতে ঘাড়ের ওপর দিয়ে পলোটা ধরে রেখে অন্য হাতে হারিকেন ঝুলিয়ে মাঠে নেমে যায় ইরফান। বুকের ভেতর বিশাল এক উত্তেজনা জোয়ারে জলের মতো দ্রুত ছড়িয়ে যায় তার।
মাঠে এখন গোড়ালি ডুবে যাওয়ার মতো জল ওঠে গেছে। সেই মাঠ দিয়ে ছপছপ শব্দে হেঁটে যায় ইরফান। পশ্চিমের বিল ছাড়া বোয়াল পাওয়া যাবে না। ধানপাটের ক্ষেতে পরী ধরতে ওঠে বোয়াল মাছ। একটা আর একটার গায়ে এমনভাবে লেগে থাকে দেখে দুটোকে একটা মাছই মনে হয়। কোৎ কোৎ করে কী যে শব্দ করে মাছগুলো তখন! মানুষ কাছে গেলেও পালায় না। যৌবন কী অদ্ভুত ক্ষমতায় ভুলিয়ে দেয় মৃত্যুভয়। টেটা দিয়ে পীরের বোয়াল মারা যায় না।
টেটা মারলে একটার বেশি গাঁথে না। পীরের বোয়াল মারতে হয় পলো দিয়ে। পলো দিয়ে আটকে দিতে হয়। তবে পলোতে বোয়াল আটকে সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে হাত দিলে কামড়ে হাত খেয়ে ফেলবে। বোয়াল মাছ এসময় পাগল হয়ে ওঠে। এ যেন দুরন্ত এক বিদ্রোহ মাছেদের! যৌবন বিদ্রোহ।
তবে বোয়ালের মন্ত্র ইরফানের জানা আছে। পলোর ভেতর ঘণ্টাখানেক আটকে রাখলে নরম হয়ে যায় মাছ। তখন ভয় থাকে না। নির্বিঘ্নে তুলে আনা যায়।
ইরফানের পায়ের শব্দে তখন ছোট ছোট মাছ ছুটে পালাচ্ছিল।
লাফিয়ে সরে যাচ্ছিল। ঘাসবনে চুটপুট শব্দ হচ্ছিল। খোলা মাঠে মাঠে জলো বাতাস গড়িয়ে যাচ্ছিল। মরা জ্যোৎস্না ছিল স্থির হয়ে। আকাশপ্রান্তর ছাপিয়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। থেকে থেকে ডাকছিল জোয়ারের মেঘ। কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছিল না। রাত কী রকম আশ্চর্য এক গভীরতায় মগ্ন হয়েছিল। দূরের ছাড়া বাড়ির সামনে টিমটিমে আলো দেখা যাচ্ছিল। বোঝা যায়, মাছে ধরতে বেরিয়েছে কেউ। দেশ ভরে গেছে মাছে। মানুষেরা সব মনের সুখে সেই মাছ ধরছে। অথচ পদ্মা কী অদ্ভুত মানুষ! জোয়ারে মাছ ধরতে মানা করে!
ছাড়া বাড়িটা বাঁয়ে রেখে বিলের দিকে এগোয় ইরফান।
বিলের প্রান্ত থেকে ক্রমশ জমাট হতে শুরু করেছে পাটক্ষেত। ঘন আঁধার ঘাপটি মেরে বসেছে পাটক্ষেতের ভেতর। পাতলা জ্যোৎস্নাটা বোঝাই যায় না। আস্তেধীরে হাঁটে ইরফান। তার পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছুটে যায় ছোটবড় নানা রকমের মাছ। সেই স্পর্শে মনে মনে আফসোস করে ইরফান। ইস টেডাটা আনলে কামের কাম অইত। ডুলা আনলে। কামের কাম অইত। মাছে বিল ভইরা গেছে। হেই মাছ মাইরা ডুলা ভইরা হালান যাইত।
পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে সরু আল পথ এখন জলে ডোবা। ঘন পাটগাছের চাপে পথের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। তবু সেই পথ ঠাওর করে হাঁটে ইরফান। এত রাতে বিলে কেউ আসে না মাছ মারতে। ভয় পায়। জোয়ারে বোয়ালের সঙ্গে ভূতের আছর থাকে। কপালে সিঁদুর রং টিপ পরা অতিকায় বোয়াল মাছ মরীচিৎকার মতো পথ ভুলিয়ে গভীর জলায় ডুবিয়ে মারে মানুষকে।
পাটক্ষেত এখন গভীর ঘুমের মতো মগ্ন। অথচ কান পাতলে আশ্চর্য রকমের এক শব্দ পাওয়া যায়। নৈঃশব্দের ভেতরেও এক রকম শব্দ থাকে। এ সেই শব্দ।
কিন্তু পাটক্ষেত এমন নিঃসাড় কেন?
ততক্ষণে বিলের মাঝামাঝি চলে এসেছে ইরফান। কিন্তু বোয়ালের পীর কিংবা তার কোনও আভাস পর্যন্ত পাচ্ছে না। বোয়ালদের আজ হল কী! এরকম রাতে পীর ধরতে ওঠেনি কেন! দূরের চটানে শেয়াল ডাকে। চটানের নামায় অল্প জলে শেয়ালদের চলাচল টের পাওয়া যায়। ইরফান নিশি পাওয়া মানুষের মতো হাঁটে। পায়ের কাছে চেলামাছ তিরতির করে। বিল থেকে জলো বাতাস ওঠে আসে। বিড়ির নেশা পায়, কিন্তু বিড়ি ধরায় না ইরফান। পদ্মার কথা ভাবে। পদ্মাও যেন এক জোয়ারের মাছ। পীর ধরতে চায়!
তখুনি খলখল করে শব্দ হয় পাটক্ষেতের ভেতর।
সঙ্গে সঙ্গে শিকারি বেড়ালের মতো কান খাড়া হয়ে যায়। ইরফানের। ছোট মাছ শিকারের সময় যেমন হঠাৎ করে স্থির হয় বড় মাছ, তেমন করে স্থির হয়ে দাঁড়ায় ইরফান। এই শব্দ বোয়ালের পীর ধরার শব্দ। কাঁধ থেকে পলো নামিয়ে হাতে নেয় ইরফান। হারিকেনটা শূন্যে তুলে বেড়ালের মতো নিঃশব্দে এগোয় শব্দের উৎস খেয়াল করে। কিন্তু কাছাকাছি গিয়ে আর শব্দ পায় না! স্থির হয়ে দাঁড়ায় ইরফান। কান খাড়া করে শব্দের জন্যে। আলতো বাতাসে পাটের পাতা শরীর ছুঁয়ে খেলা করে যায়। কাছাকাছি শব্দ হয় আবার। একটানা খল খল শব্দ। আগের মতোই এগিয়ে যায় ইরফান। কিন্তু কাছাকাছি গিয়ে স্থির করতে পারে না। কোথায় হচ্ছে শব্দ। আবার দাঁড়ায়। কান পাতে। চোখ তীক্ষ্ণ করে। এবার শব্দ হয় ইরফানের ডান দিকে। সে এগিয়ে যায়। মাছ দেখে না। আবার দাঁড়ায়। আবার শব্দ হয়। এবার শব্দটা হয় ইরফানের পেছনে। মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ায় ইরফান। পেছন দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু মাছ দেখে না। উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
এক সময় সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে অসংখ্য বোয়ালের খল খল শব্দ শুনতে পেল ইরফান। পেয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। এক পা সামনে এক পা পেছনে ডানে। বাঁয়ে চারদিকে চরকাবাজির মতো ঘুরতে শুরু করল সে। কিন্তু একটাও মাছ দেখতে পেল না। শুধু মাছের অবিরাম খল খল খল শব্দ। এক সময় মরা চাঁদের তলায় ঘন কালো মেঘ এসে স্থির হল। খাড়া হয়ে আঁধার নামল বিলে। এবং মাছের শব্দ ক্রমশ সরে যেতে লাগল দূরে। ইরফান সেই শব্দ খেয়াল করে এগিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু সে যত এগোয় তত সরে যায়। বিড়ির নেশার মতো তীব্র এক নেশায় পেয়ে বসে ইরফানকে। ইরফান এগোয়, শব্দ সরে যায়। ইরফান এগোয়, জল ক্রমশ গম্ভীর হয়।