জোয়ার

জোয়ার

বোটের সুকান ধরে বসে আছি।

ডেকের ওপরের সারেঙের ঘরে বসে নীচের ইঞ্জিনঘরের আওয়াজ শোনা যায় না। ডিজেলে-চলা শক্তিমান ইঞ্জিন। প্রপেলারটা ঘুরছে একটানা, ‘গুট-গুট-গুট-গুট-গুট’ শব্দ করে। পেছনে দু-পাশে জলে ব্যাকওয়াশ চলছে। দুটি কোনাকুনি ঢেউ বোটের পেছন থেকে উঠে দু-পাশের গরান-গেঁওর জঙ্গলে গিয়ে পৌঁছোচ্ছে।

এখন রাত্তির। কৃষ্ণপক্ষ। আগামীকাল কালীপুজো।

অন্ধকারের সুন্দরবনে এলে বোঝা যায় যে, তারাদেরও আলো আছে। তারাও আলো দেয়। গাছের ছায়ানিবিড় ঘোর কালো জলে এক-একটি তারা এক-একটি সবুজ প্রদীপের মতো জলের আয়নায় দপ দপ করে। সার্চলাইটটা জ্বালাতেই হয় না। কেবল বাঁক নেওয়ার সময় মাঝে মাঝে জ্বেলে নিই। কখনো-সখনো কুমিরের চোখ জলের ওপর কাঠের আগুনের মতো জ্বলে ওঠে।

বেশ লাগে। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। চোখে-মুখে-চুলে হাওয়া এসে উথাল-পাতাল করছে। ঘণ্টায় সাত-আট মাইল চলেছি, এই ছোটোবোটের পক্ষে ভালোই স্পিড স্রোতের উলটে মুখে চলেছি এখন। আমার সাহেবের হুকুম, রাত বারোটা অবধি একটানা চলে একেবারে চামটার খালে গিয়ে নোঙর করতে হবে।

চামটার খালটা আমার আদৌ পছন্দ নয়। এখানের কোন খালই-বা পছন্দ। ইঞ্জিনম্যান নটবর আর খালাসি ঘেটো আর অছিমুদ্দি কেউই পছন্দ করে না। আর কেনই-বা করবে? প্রতি বছর কত যে মৌলে, বাউলে, জেলে মরছে বাঘের হাতে তার কী ঠিক আছে এখানে।

খালে ঢুকলেই এখানে ঝমটি পোঁতা আছে দেখতে পাওয়া যায়। জলের পাশে সরু সরু ডাল পুঁতে সেই ডালের ডগায় একফালি ন্যাকড়া বেঁধে দিয়ে যায় হতভাগ্যদের সঙ্গীরা সেখানে, বাঘে যে মানুষ নিয়েছে, সেই সম্বন্ধে অন্য জেলে মৌলে বাউলেদের সাবধান করে। জলে নোঙর করা নৌকো থেকে পর্যন্ত নিয়ে গেছে বাঘ কত যে লোককে সাঁতরে এসে, তার ইয়ত্তা নেই। ওরা ভয়ে বাঘের নামোচ্চারণ পর্যন্ত করে না। বলে, ‘জানোয়ার বড়ো ভীষণ—ড্যাঙ্গায় পা দিয়োনি মোটে।’

আচ্ছা পাগল এই আমার সাহেব।

বড়োলোক মাত্ররই শখ থাকে জানি। কিন্তু বড়োলোক আমার বহু দেখা আছে। এমন বিদঘুটে শখের সাহেব আমি দেখিনি। মেয়েদের নিয়ে এমন সোঁদরবনের মতো জায়গায় কেউ বেড়াতে আসে? পাগল আর কাকে বলে!

মেমসাহেব, কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন।

মেমসাহেবকে আমার বেশ লাগে। এত বড়োলোকের বউ, এমন সুন্দর ইংরেজিতে শত সাহেব-মেমের সঙ্গে কথা বলেন; অথচ মুখে এমন একটি বাঙালি কমনীয়তা যে কী বলব। কালোরঙা একটি শাল জড়িয়েছেন গায়ে। উদলা ডেকের ওপরে হেমন্তের আকাশ থেকে হিম পড়ছে।

চেঁচিয়ে বললাম, সাবধানে পা ফেলবেন মেমসাহেব। একে অন্ধকার, তায় হিমে ভেজা আছে ডেক।

মেমসাহেব কাঠের সিঁড়িটা বেয়ে সাবধানে উঠতে উঠতে বললেন, ঠিক আছে।

ডেকে উঠে উনি আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন।

বললেন, স্যামুয়েল, তুমি বিকেলে চা খেয়েছ তো?

হ্যাঁ মেমসাহেব।

ছেলেবেলায় পাদরিসাহেবদের কাছে লেখাপড়া শিখেছিলাম কিছুদূর। ইংরেজিটা কাজ চালানোর মতো বলতে পারি। তাই বহাল করেছেন সাহেব আমায়। অনেকসময়ে সাহেব নিজে আসেন না, ওঁর সাহেবসুবো অতিথিদের নিয়ে আমার নিজেরই আসতে হয়। ইংরেজি বলতে পারি বলেই মাঝিমাল্লারা এই স্যামুয়েল সারেংকে এত খাতির করে। আমার এই ‘ছুটি’ বোট ছোটো হলে কী হয়! এর ইজ্জতই আলাদা! মাতাল, গোসাবা, বাসন্তী, হেড়োভাঙার জলে কি সোঁদরবনের খালে খালে যেই এই বোট দেখুক-না-কেন, সেই সম্ভ্রম করে। সবাই জানে, এ ইয়াংকি সেনের বোট। এ বোট ভাড়া খাটে না। আমার সাহেবের রকম-সকম আমেরিকান সাহেবদের মতো বলে তাঁর আড়ালে তাঁকে সবাই অয়ন সেন না বলে ইয়াংকি সেন বলে ডাকে। সাহেব নিজেও তা জানেন। তবে কে কী বলল, তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন এমন চরিত্র আমার সাহেবের নয়।

মেমসাহেব সবসময় কী যেন একটি সেন্ট মাখেন। অন্য কেউ হলে জাপটে ধরে সুকানের ওপর ফেলে জমিয়ে চুমু খেতাম। কিন্তু মেমসাহেবের সম্বন্ধে ওসব কথা মনেও আনা যায় না।

তা ছাড়া, কেন জানি না, আমার সাহেব-মেমসাহেবকে আমি শ্রদ্ধা করি।

সাহেবও উঠে এলেন। সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবি পরে আছেন। গায়ের রং কালো হলে কী হয়, এমন সুপুরুষ বড়ো-একটা চোখে পড়ে না। তীক্ষ্ণ নাক আর উজ্জ্বল চোখে সবসময় ঝকঝক করেন।

ডেকে উঠেই বললেন, স্যামুয়েল, কোথা দিয়ে চলেছি?

—ভরকুণ্ডার খাল স্যার।

—চামটা কতদূর?

—পাঁচঘণ্টা লাগবে স্যার।

এমন সময় কেবিন থেকে মেমসাহেবের ছোটোবোন মিলিদিও উঠে এলেন।

এসেই বললেন, এখানেই থাকা যাক-না অয়নদা, এ রাতের মতো।

সাহেব বিনাদ্বিধায় ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন স্যামুয়েল, এখানেই নোঙর ফ্যালো। আজ রাতে আমরা এখানেই থাকব।

সামনেই সুবিধেমতো জায়গা দেখে ঘণ্টা বাজালাম। নটবর ইঞ্জিন নিউট্রাল করল ঘণ্টা শুনে। খালাসিরা নোঙর ফেলল। ইঞ্জিন রিভার্স করে নোঙর ঠিক লাগল কি না দেখে নেওয়া হল।

এ জায়গাটা আমার ভালো জানা নেই। রাতে এখানে থাকিনি কখনো। শুধু জানি যে, এ ভরকুণ্ডার খাল। দিনের বেলায় এ খাল বেয়ে বোট চালিয়ে যেতে যেতে কেওড়া গাছের তলায় তলায় হরিণের পাল চরতে দেখেছি। যেখানে নোঙর করলাম, ভাটি লাগলে সেখানে ঠিক কতখানি জল থাকবে সেটাই ভাববার কথা। বোটের কোনো প্রান্ত ডাঙায় উঠে গেল, তো বাঘও বোটে এসে উঠতে পারে।

সাহেব খালি বলেন, আমার মোটরবোটেও উঠে আসবে এতবড়ো ওভারস্মার্ট সুন্দরবনের বাঘ হয়নি এখনও!

কী জানি বাবা। ভরসাই-বা কোথায়। মামা এসে ধরলে ধরবে আমাকে, নটবরকে, নয়তো খালাসিদের। বাঘ তো আর কেবিনে ঢুকবে না।

বোট নোঙর করা হয়ে গেলে আর ইঞ্জিনের ঝমঝমানি রইল না। বোটের খোলে সড়সড়-সিরসির করে জোয়ারের জলে-ভাসা কাঠকুটো লাগছে।

মিলিদিদি বললেন, অয়নদা, কুমির গা ঘষছে না তো বোটের সঙ্গে?

সাহেব বললেন, বিচিত্র নয়। তুমি আছ, খবর পেয়েছে বোধ হয়।

মিলিদিদি বললেন, However, they don’t rub on the wrong side. do they?

সাহেব কিছু বললেন না।

মেমসাহেব আগেই নীচে গেছিলেন।

আমি সারেঙের ঘর ছেড়ে বোটের পেছনে চলে গেলাম।

মিলিদিদির সঙ্গে সাহেবের এই আদিখ্যেতা আমার ভালো লাগে না। মিলিদিদি মোটে পাত্তা দেন না ওঁকে। সেটা সাহেব নিজেও জানেন অথচ যেন লাজলজ্জাহীন বোমভোলানাথ। বুঝতে পারি, তাঁর এই ব্যবহারে মেমসাহেব ও মিলিদিদি দু-জনেই বিব্রত বোধ করেন। দু-জনেই কোনো কোনো সময়ে সাহেবকে সমানভাবে ঘৃণা করেন। অথচ সাহেব ওঁদের দু-জনকেই ঠিক সেই একই পরিমাণ ভালোবাসেন।

যদি আমার বুদ্ধি বলে কিছু থেকে থাকে তো পরিষ্কারই বুঝতে পাই যে, মিলিদিদি সাহেবকে ভালোবাসেন। কিন্তু সেটা কী ধরনের ভালোবাসা, তা ঠাহর করতে পারি না।

আমি সারেং, জোয়ার-ভাটা বুঝি। লগি দিয়ে নদীতে চড়া আছে কি না ঠাহর করতে পারি। কিন্তু এসব বোঝা আমার কর্ম নয়।

সাহেব আমার একেবারেই পাগলাসাহেব। নিজের জগতে বাস করেন। অবুঝের মতো যা চাইবার নয় তাই চান। মিলিদিদিকে ফিসফিস করে বলেন, মিলি, তোমাকে আমি এই রাতের স্তব্ধতার মতো ভালোবাসি।

মিলিদিদি মৌরলা মাছের মতো ছিটকে গিয়ে বলেন, দিদিকে বলুন এসব কথা। আমাকে বলবেন না। আমি আপনাকে ভালোবাসি না।

এরকম অনেক কথা আমি হেন স্যামুয়েল সারেং আড়ি পেতে শুনেছি। অন্য লোকেদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। সত্যি কথা বলতে কী, সাহেবের জন্যে আমার আজকাল দুঃখ হয়। মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে বোধ হয়। এর চেয়ে অফিসে যখন থাকেন তখন ভালো থাকেন। অফিস থেকে বেরুলেই অন্ধকারে জোনাকির আলো জ্বালার মতো মিলিদিদির জন্যে পাগল হয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করতে চান।

যাক গে, মরুক গে! কী হবে আমার মনিবের কথা ভেবে, বড়োলোকদের বাতিকের কথা ভেবে! নিজের কথা ভাবারই সময় পাই না।

নটবরের কাছে গিয়ে বললাম, বের কর বোতলটা।

নটবর বলল, ওসব ঝামেলি কোরো না স্যামুয়েলদা, সাহেবের মেজাজ গতিক ভালো লয়। এট্টুকানি চুপ মেইরে বোসো দিকিনি।

রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে বোটের মাথায় বিছানা পাতলাম আমি। একটুকরো ত্রিপল দিয়ে ছইয়ের মতো বানিয়ে নিলাম। হাওয়া না থাকলে বেশ মশা লাগে। গরমও লাগে। নটবর আর খালাসিরা বোটের পেছনে রান্নাঘরের পাশেই শুয়েছে।

সাহেবদের কেবিনটা এমন-কিছু বড়ো নয়। দু-দিকে দু-টি বার্থ— রেলের কামরার মতো। একটিতে সাহেবের বিছানা হয়, অন্যদিকে মেমসাহেব ও মিলিদিদির। কেবিনের লাগোয়া বাথরুম। ছোটো হলেও সবকিছুই আছে। কমোড আছে। বেসিন আছে। চান করার শাওয়ার আছে। বাথরুমের জন্যে আলাদা একটি মিষ্টিজলের ট্যাঙ্ক লাগানো আছে বোটের মাথায়। নোনাজলে মেমসাহেবরা চান করতে পারেন না। সাবান মাখলে সাবান তুলতে একঘণ্টা লাগে—সারা গা মাথা চ্যাটচ্যাট করে নুনে।

রাত এখন কত হবে কে জানে? চারিদিক নিথর নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে টিটিপাখি (সাহেবরা যাকে Did you do it বলেন) বাঁ-দিকের পাড়ে ডেকে বেড়াচ্ছে। একবার জলের কাছে আসছে, একবার ফিরে যাচ্ছে। জঙ্গলে নিশ্চয়ই কোনো জানোয়ার দেখে থাকবে।

এখনও জোয়ার দিচ্ছে। রাত বারোটা নাগাদ ভাটার জল নামা শুরু হবে। এখানে জোয়ার-ভাটার জল আঠারো কুড়ি ফিট ওঠা-নামা করে। ভাটার সময় যেখানে মাটি দেখা যায়, খোলা জায়গা দেখা যায়; কেওড়ার শুলো দেখা যায়; লাল-সবুজ-হলুদ নানারঙের নানা কাঁকড়া আর স্যালামাণ্ডারকে যেখানে ঘিনঘিনে কাদায় হাঁটতে দেখা যায়, জোয়ারে সেসব কিছুই ডুবে যায়। এমনকী অত উঁচু সাদাবাণী গাছের গোড়াও ডুবে যায়। তখন সমস্ত সুন্দরবনকে মনে হয় একটি বিরাট ভাসমান উদ্ভিদের বন।

কেবিনে মেমসাহেবদের নড়াচড়ার শব্দ শুনছি। চুড়ির রিনঠিন, সিল্কশাড়ির খুশির খসখস।

সাহেব একবার কাশলেন। কে একজন উঠে বাথরুমে গেলেন। জোরে জোরে দু-বার ফ্লাশটা টানলেন। ওটা কাজ করছে না। শব্দটা জলের ওপরে নিস্তব্ধ রাতে অনেক দূর গড়িয়ে গেল।

আবার সব চুপচাপ। অনেকক্ষণ। ঘুম আসছে না।

সাহেবের গলা পেলাম।

—মিলি ঘুমিয়েছ?

—না।

—দিদি ঘুমিয়েছে?

—জানি না।

—আমার পাশে এসে শোবে একটু, প্লিজ।

—না।

—এসো-না বাবা। পাশে শুলে একটু কী হয়? তোমাকে একটু জড়িয়ে শুয়ে থাকব। তোমার কপালে হাত বুলিয়ে দেব। শোবে না?

—না। একেবারেও না। আপনি ভীষণ অসভ্য হয়েছেন।

—মানে?

—আপনি যা বোঝেন।

এমন সময় মেমসাহেবের গলা শুনলাম।

—কী হচ্ছে কী? ন্যাকামির একটা সীমা আছে। লজ্জা বলে তোমার কি কিছু আছে?

সাহেব অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললেন, লজ্জার কী আছে? এত ভালোবাসি, আর পাশে একটু শুতে পারে না? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?

শেষের দিকে আবেগে সাহেবের গলা ভারী হয়ে এল।

মেমসাহেব আবার ধমকালেন, চুপ করো তো। ঘুমুতে দাও। তোমার ন্যাকামি আর সহ্য হয় না। জলে কি ডাঙায় নামার উপায় নেই, নইলে পালিয়ে বাঁচতাম। কী বলিস রে মিলি?

পরিবেশ হালকা করার জন্যে মেমসাহেব রসিকতা করলেন।

কিন্তু এই রসিকতা, হালকা হাসির পেছনে কোনো গভীর অভিমান আছে বলে মনে হল আমার। সেটা সাহেবের না মেমসাহেবের না মিলিদিদির তা বুঝতে পারলাম না।

এমনসময় নটবর উঠে এসে বসল আমার পাশে।

বলল, স্যামুয়েলদা বড্ড গরম নাগতিচে মাইরি। চলো, জালিবোটে গে শুই দু-জনায়।

বললাম, মামা চারিধারে ঘোরাঘুরি করছে। কী দরকার তোর জালিবোটে শুয়ে? যেখানে শুয়ে আছিস শুয়ে থাক। নইলে আমার কাছেই এসে শো।

নটবর বলল, শালা ঘেটো এমন ঘসর-ঘসর করি দাদ চুলকোয় যে, ওর পাশে ঘুমোয় কার সাদ্যি। পরানটা ভালো লাগতিচে না গো, একটা ছিগারেট খাওয়াও দিকিনি।

আমার একটা চারমিনার সিগারেটে আগুন ধরিয়ে নটবর গান ধরল ভাটিয়ালি সুরে, ‘ও সুন্দর জরিনা রে, তোমারে না দেখলে মোর অঙ্গ যায় জ্বলে…।’

আমি ধমকে বললাম, তোর সাহস তো কম নয়। সাহেবরা জেগে আছেন।

ও জিব কেটে থেমে গেল।

নটবর নেমে গেল একতলায়।

জলের কুলকুলানি শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টেরও পাইনি।

* * * *

রাত কত হবে জানি না। কী এক অজানা অচেনা অস্বস্তিতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল একটু আগে কোনো শব্দ শুনলাম। ঝপ করে জলে কিছু পড়ার শব্দ।

জালিবোটটা বোটের পেছনে বাঁধা ছিল। সেটা বোটের সঙ্গে ধাক্কা খেলে যেমন শব্দ হয় তেমনি শব্দ। তারপর ভাবলাম, হয়তো ভুল শুনলাম।

বিছানায় উঠে বসলাম। গা-টা ছমছম করতে লাগল। এমন কখনো হয়নি। এতবার এসেছি সুন্দরবনে। অন্ধকারে দু-পাশের জল আর জঙ্গলের প্রভেদ বোঝা যায় না। আকাশে ভোরের শুকতারাটা জ্বলজ্বল করছে দেখলাম। আর কোনো পরিবর্তন নেই। কুলকুল করে জল চলেছে, সেই কুলকুলানি শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু।

ভাটা শেষ হয়ে জোয়ার শুরু হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হল। মনে হল, আবছা কালো ও গাঢ় ধূসরে মেশানো কুমিরের গায়ের মতো অন্ধকার তীর বোট থেকে বেশি দূরে নেই।

কীসের শব্দ শুনলাম বোঝবার চেষ্টা করছি, এমন সময় ঘেটো খালাসির বুকফাটা আর্তনাদ শুনলাম, সাহেব—স্যামুয়েলদা, নটবরকে জানোয়ারে নে গেল গো।

কোনো সারেং আমার মাথার মধ্যে টুং-টুং-টুং করে অবিরাম ঘণ্টি বাজাতে লাগল কিন্তু আমার মগজের ইঞ্জিনম্যান কোনো কাজ করল না। ইঞ্জিন স্টার্ট পর্যন্ত করল না।

কী ঘটে গেল বুঝতে বা বোঝবার চেষ্টাও করতে পাচ্ছিলাম না।

যন্ত্রচালিতের মতো একলাফে সারেঙের কেবিনে উঠে সার্চলাইটটা জ্বেলে চতুর্দিকে ঘুরিয়ে দেখবার চেষ্টা করলাম।

প্রথমে কিছুই দেখতে পেলাম না। তারপর আবার ভালো করে ঘুরোতেই দেখলাম— নটবরের হলদে জামার ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরো ডাঙার কেওড়ার শূলোয় ছিঁড়ে ছিঁড়ে আটকে আছে। জালিবোটের ভেতরে ওর কাঁথা আর বালিশটা পড়ে আছে। কাদামাখানো বাঘের একটি পায়ের ছাপ এবং কাদার দাগ লেগে আছে কাঁথাটাতে।

ততক্ষণে নীচের কেবিনে শোরগোল পড়ে গেছে।

সাহেব রাইফেল নিয়ে ডেকে উঠে এসেছেন। ঘেটো আর অছিমুদ্দি দু-জনেই ডেকে উঠে এসেছে।

কাঁদতে কাঁদতে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘেটো যা বলল, তার মর্মার্থ হচ্ছে; নটবর ওদের কথা না শুনে জালিবোটে একা একাই শুতে গেছিল সেই প্রথম রাতেই। একটু আগে শব্দ শুনেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসে ঘেটো দেখে যে, বাঘ নটবরকে মুখে করে সাঁতরে চলে যাচ্ছে। তারপর সে ডাঙায় উঠে জঙ্গলের ভেতরে চলে গেল।

যতক্ষণ বাঘকে দেখা গেছে ততক্ষণ ও মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে পর্যন্ত পারেনি। কোনো দৈব অভিশাপে ও যেন বোবা হয়ে গেছিল। বাঘ দৃষ্টির আড়ালে যাওয়ামাত্র ও চিৎকার করে উঠেছে।

সাহেব নিরুপায় হয়ে রাইফেল নিয়ে ডেকে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর সাত বছরের পুরোনো ইঞ্জিনম্যান নটবরকে তিনি বোটে থাকা সত্ত্বেও বাঘে নিয়ে গেল!

নেবে না? বেশ হয়েছে। হারামজাদাকে বললাম, বাহাদুরি করিস না। তা নয়, বেশি বেশি। অথচ এই অন্ধকারের শেষরাতে একহাঁটু কাদা ভেঙে শূলো বাঁচিয়ে হ্যাঁতাল আর গরানের ঝোপে ঢুকতে যাওয়া মানেই বাঘ যে দেশে নিয়ে গেছে তাকে, সেই অদেখা দেশে যাওয়া। তাতে কোনো ভুল নেই। পৃথিবীতে এমন কোনো শিকারি জন্মায়নি, যে অমাবস্যার শেষরাতে সবে ভাটি দেওয়া সুন্দরবনে কাদার মধ্যে সবে মানুষ নেওয়া বাঘকে অনুসরণ করে হ্যাঁতাল গরানের বনে ঢুকতে পারে। সে যদি বাঁচে, তাকে বনবিবিই বাঁচাবেন।

বাবা দক্ষিণ রায়ের ওপর বড়ো ভক্তি ছিল নটবরটার। ইঞ্জিনঘরের কুলুঙ্গিতে বনবিবিরও মূর্তি রেখেছিল অছিমুদ্দি। সুন্দরবনে এলেই ওরা পুজো করত।

কিছুই হল না। এখন নিরুপায়। সকাল না হওয়া অবধি কিছুই করার নেই। বাসন্তীতে একবার একটি বাঘে-ধরা জেলের মৃতদেহ দেখেছিলাম। আমরা যেমন কই-মাছের মাথা চিবিয়ে খাই, তেমনি করে মাথাটা চিবিয়েছিল। নটবরের মুখটা মনে পড়ল। ভাবতে পারি না। ইস! নটবর!

কুড়ি-পঁচিশ মিনিট বাদেই আলো ফুটল পুবে। সাহেব সেই যে ডেকে এসে আমার পাশে চুপ করে বসেছিলেন, কোনো কথা বলেননি। কেবল পুবে তাকিয়েছিলেন। কখন আলো ফুটবে সেই আশায়।

আকাশটা ফর্সা হতেই বললেন, ঘেটো জালিবোটে দাঁড় লাগা, আমি একাই যাব।

মিলিদিদি ডেকে উঠে এসেছেন।

ওঁরা সকলেই ঘটনার অভাবনীয়তায় ও আকস্মিকতায় আমাদের কথা একেবারে ভুলে গেছেন। মিলিদিদি গোলাপিরঙা একটি সিল্কের নাইটি পরে আছেন। বুকে ও কাঁধে কুঁচি তোলা। ভোরের রোদ্দুর মিলিদিদির চুলে, গ্রীবায়, কাঁধে এসে পড়েছে। মিলিদিদিকে একেবারে বনবিবির মতো দেখাচ্ছে। এক-এক বার লম্বা গলার কোনো দূরদেশি বিষণ্ণ সাদা রাজহাঁসের মতো মনে হচ্ছে।

মিলিদিদি সাহেবের হাত জড়িয়ে বললেন, না-গেলে হয় না, অয়নদা? নটবর— বেঁচে তো নেই-ই তবে? না-গেলে হয় না?

সাহেব উত্তর দিলেন না। নীরবে মাথা নাড়লেন।

মিলিদিদি বললেন, হয় না কেন?

তারপর কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, খুব হয়। আপনি যদি নটবরের মতো….

বলেই, কথাটা আর শেষ করতে পারলেন না। সাহেবের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে ঝরঝর করে নীরবে কাঁদতে লাগলেন।

মেমসাহেব কোনো কথা বললেন না, জল-ভরা চোখে সাহেবের দিকে চেয়ে রইলেন।

সাহেব নীচে চলে গেলেন। পায়জামা-পাঞ্জাবি ছেড়ে আসতে।

কেন জানি না, আমার হঠাৎ সাহেবের মতো সাহসী হতে ইচ্ছা করল। ভালোবাসায় অধীর, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এই দু-টি নারীকে দেখেই আমি মুহূর্তে নটবরের কথা ভুলে গেলাম। বললাম, সাহেব, আমিও যাব আপনার সঙ্গে।

সাহেব নীচে থেকেই বললেন, না। তুমি যাবে না। তোমার কিছু হলে বোট চালিয়ে এঁদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে কে? কেউ যাবে না সঙ্গে। আমি একাই যাব।

সাহেব রাইফেল নিয়ে জালিবোটে উঠতে গেলেন। একবারও ওঁদের দিকে চাইলেন পর্যন্ত না। বোটে ওঠবার আগে মিলিদিদি সাহেবকে প্রায় জড়িয়ে ধরে আমাদের সকলের সামনেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

মেমসাহেব কাতর গলায় বললেন, সোনা, না গেলেই কি নয়? আমার বড়ো ভয় করছে।

সাহেব মেমসাহেবের কাঁধ চাপড়ে বললেন, কোনো ভয় নেই। নটবরের কথা একবার ভাবো লিলি, ছি ছি! তোমরা কী হলে বলো তো?

সাহেবকে দেখে তখন আমার ভারি গর্ব হল। মনিবের মতো মনিব বটে! মরদের মতো মরদ।

শিকারের পোশাকে আমি আমার সাহেবকে রাজার মতো দেখি। কী করে পারলাম জানি না, আমি সাহেবকে হুকুম করলাম, আপনি একা যেতে পারবেন না। অছিমুদ্দি আপনাকে জালিবোট নিয়ে ড্যাঙায় পৌঁছে দিয়ে আসুক—আপনি আওয়াজ দিলে আবার গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসবে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে জোয়ার পুরো হয়ে যাবে। জোয়ার ভরা হলে জঙ্গল থেকে আপনি জালিবোটে এসে একা একা পৌঁছোতেই পারবেন না। আমার কথা একবার শুনুন সাহেব, আমি চিরদিন আপনার কথা শুনে এসেছি।

সাহেব মুখ তুলে আমার চোখের দিকে চাইলেন।

তারপর অছিমুদ্দিকে বললেন, চল রে।

অছিমুদ্দি দাঁড় বেয়ে সাহেবকে ডাঙায় নিয়ে গেল। সাহেব আমাদের চোখের সামনে নামলেন। রাইফেলটা বগলের তলায় ফেলে, খালি পায়ে, একহাঁটু কাদা ভেঙে ভেঙে যেদিকে নটবরের হলুদ শার্টের টুকরো কেওড়ার শূলোর ওপর দেখা যাচ্ছিল সেদিকে এগিয়ে চললেন। তারপর হ্যাঁতালের ঝোপের আড়ালে কেওড়া গাছের ছায়ায় হারিয়ে গেলেন।

অছিমুদ্দি জালিবোটটাকে নিয়ে বোটে ফিরে এল।

সেই মুহূর্তে আমাদের বোটের ঘড়ির স্টপওয়াচ কে যেন বন্ধ করে দিল। আমরা সবাই বোবাদৃষ্টিতে জঙ্গলের দিকে চেয়ে রইলাম। অনামা-অজানা মৃত্যুর মর্মান্তিক প্রতীক্ষায়।

ভালো করে রোদ উঠল। রোদের তেজ বাড়ল। কিন্তু মেমসাহেব বা মিলিদি কেউই ডেকে নামলেন না। মিলিদি মাঝে মাঝে হাত-মুখ ঢেকে নি:শব্দে কাঁদতে লাগলেন। সমস্ত বোটের জীবন যেন কার অমোঘ অভিশাপে স্তব্ধ হয়ে গেল।

একঘণ্টা কখন কেটে গেল জানি না।

জোয়ারে জল বাড়ছে, বাড়ছে তো বাড়ছেই, আমার ভয় করতে লাগল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সাহেব ফিরতে না পারলে জোয়ারের জল সর্বত্র ঢুকে যাবে। এই জলে, শূলো বাঁচিয়ে, হাঙর-কুমিরের দাঁত বাঁচিয়ে, খাল-নালা বাঁচিয়ে সাহেব ফিরে আসতেই আর পারবেন না, যতক্ষণ-না সেই বিকেলের দিকে ভাটি শেষ হয়। অতএব সাহেবের যে কী হল কিছুই জানা গেল না। জানা যাবে না।

বড়োই অস্বস্তিতে পড়লাম। জীবনে এমন অস্বস্তিতে কখনো পড়িনি। মেমসাহেবের সামনেই একটা সিগারেট ধরালাম। মাথা ঠিক রাখতে পারছি না।

মেমসাহেব শুধোলেন, জোয়ার পুরো হতে আর কত দেরি স্যামুয়েল?

কাঁপা কাঁপা গলায় বিরসমুখে বললাম, আর আধঘণ্টা খানেক।

কেউ কোনো কথা বলছেন না আর। জোরে জোয়ারের জল ঢুকছে খালগুলোতে; সুঁতি খালে। পারসে মাছ ধরার আশায় মাছরাঙাগুলো ছোঁ মেরে মেরে পড়ছে সুঁতি খালের মুখে মুখে। একটা কার্লু তীক্ষ্ণ অলক্ষুণে গলায় ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। সমস্ত সমুদ্র উজাড় করে জল ঢুকছে জঙ্গলে। আস্তে আস্তে ভাসিয়ে নিচ্ছে, ভারশূন্য করে দিচ্ছে যেন জঙ্গলকে।

সময় আর কাটছে না। একটি একটি মিনিট কাটছে আর আমাদের বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে।

হঠাৎ সমস্ত জল-জঙ্গল কাঁপিয়ে গগনভেদী এক প্রচন্ড গর্জন শুনলাম বাঘের। সমস্ত ঝোপঝাড় যেন কেঁপে উঠল। মনে হল, জলে যেন ঢেউ খেলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গেই একটি গুলির শব্দ।

রাইফেলের গুলির গুমগুমানি জল বেয়ে কোথায় কোথায় ছড়িয়ে গেল। পরক্ষণেই ওই জলজ নিস্তব্ধতাকে আরও বেশি ভয়াবহ বলে মনে হল।

আর কোনো গুলি হল না, আর কোনো শব্দ হল না।

হঠাৎ অমন আমেজ-ভরা রোদ্দুরটা ঠাণ্ডা মেরে গেল। ভীষণ শীত শীত করতে লাগল আমার।

আরও দশ মিনিট কেটে গেল।

মেমসাহেবের মুখটি শুকিয়ে ছোটো হয়ে গেছে। চোখের কোণে জল শুকিয়ে আছে। ফিসফিস করে মেমসাহেব মিলিদিকে বললেন, তুই এত খারাপ কেন রে মিলি? অয়নদা তোকে এমন করে ভালোবাসে, আর তুই এমন নিষ্ঠুরতা করিস।

আমি?

মিলিদিদি জল-ভরা চোখ বড়ো বড়ো করে শুধোলেন।

মেমসাহেব আবার বললেন, তুই যে অমন করিস, আজ যদি তোর অয়নদা আর না ফেরে।

মিলিদিদি মেমসাহেবের মুখ চাপা দিয়ে বললেন, ওরকম করে বোলো না দিদি, বোলো না।

তারপর ফিসফিসে গলায় বললেন, কেন নিষ্ঠুরতা করি, তা কি তুমি জানো না?

মেমসাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, জানি।

কিন্তু তুই-বা আমাকে এত ছোটো ভাবিস কেন? তার ভালোবাসা যদি একজনকে দিয়েই ফুরিয়ে না গিয়ে থাকে, তাহলে তুই তাকে ভালোবাসলে আমার অভিযোগ কীসের?

মিলিদিদি ধরা গলায় বললেন, দিদি, লোকে বলবে তোমার সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। যে অয়নদা তোমার, তাকে আমি কেড়ে নিয়েছি।

মেমসাহেব স্বগতোক্তির মতো বললেন, তোর অয়নদাকে কেউ কেড়ে নেবে, এ ভয় আমার নেই। সে এই জোয়ারের মতোই গতিমান। সে নিজে যখন চলে, তার চারপাশের সব কিছুকে সে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাকে কেড়ে নেবে, এমন শক্তিমতী এখনও জন্মায়নি কেউ।

তারপর একটু হেসে বললেন, আমাকে একটা কথা দিবি মিলি?

—কী দিদি?

ফিরে আসুক তোর অয়নদা, শুধু ফিরে আসুক; সে যা চাইবে তাই দিবি, তাই করবি, আমাকে যদি তুই সত্যিকারের ভালোবাসিস। কখনো তাকে দুঃখ দিয়ে ফেরাবি না, কখনো না। কথা দে মিলি, কথা দে।

মিলিদিদিও যেন ভুলে গেছেন যে আমরা সকলেই আশপাশে আছি।

মিলিদিদি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি কি চাই না দিদি? কিন্তু লোকে আমাকে খারাপ বলবে। লোকে আমাকে বুঝবে না।

মেমসাহেব বললেন, কাঁদলে হবে না মিলি—কথা দিতে হবে। কথা দে আমাকে।

বলতে বলতে মেমসাহেব মিলিদির হাত ধরে বললেন, লোকের কথা দিয়ে কী করব বল? আমাদের এই তিন-জনের জগতে আমরা তিন-জনেই সুখী হব। সুখী থাকতে চাই। সে কেবল ফিরে আসুক, ফিরে আসুক। অয়নদাকে আর কখনো দুঃখ দিস না মিলি।

অছিমুদ্দি উদবিগ্ন গলায় বলল, গতিক তো সুবিধের লাগতিচে না গো স্যামুয়েলদা। জোয়ার তো পুরো হল! সায়েব তো এলেন না।

তক্ষুনি আমাদের সকলেরই মনে সেই পুরোনো ভয়টা উঁকি দিল। জিভটা নুন নুন লাগতে লাগল।

এমনি সময়ে হঠাৎ বোট থেকে প্রায় দেড়শো-দুশো গজ দূরে উজোনে, যেখানে ডাঙা খুব উঁচু; কতগুলো সাদাবাণী গাছের ভিড়, যেখানটা জোয়ারে ডোবেনি, ডোবে না কখনো; সেখান থেকে সাহেবের তীক্ষ্ণস্বর শুনলাম—‘স্যামুয়েল, স্যামুয়েল! বোট খুলে এখানে নিয়ে এসো।’

দেখলাম, সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। কাঁধে নটবরের ফর্সা রোগা আধখানা রক্তাক্ত শরীর নিয়ে। একহাতে মৃতদেহটাকে ধরে আছেন, অন্যহাতে রাইফেল।

যত তাড়াতাড়ি পারি নোঙর তুলে, ইঞ্জিন স্টার্ট দিলাম।

জোয়ারের খুব টান। কালীপুজোর জোয়ার। গুট-গুট-গুট-গুট করে বোট এগিয়ে চলল।

সাহেবের কাছে পৌঁছে যতখানি পারি বায়ে ভিড়িয়ে নোঙর করলাম বোট। অছিমুদ্দিই ইঞ্জিনম্যান এবং খালাসি দুইয়ের কাজ করছে।

সমস্ত বোটে একটা খুশির জোয়ার বয়ে গেল।

নটবরের উলঙ্গ আধখানা মৃত শরীরের মতো বীভৎস দৃশ্য কোনোদিন দেখব বলে ভাবিনি।

মেমসাহেব ও মিলিদিদি দৌড়ে নীচে চলে গেলেন সে দৃশ্য সইতে না পেরে।

জালিবোটে করে সাহেব উঠে এলেন নটবরকে নিয়ে।

অছিমুদ্দি বোটটা বেঁধে রাখল।

সাহেব উঠেই আমাকে বললেন, যত জোরে পারো এই জোয়ার ধরে চলে চলো। যত তাড়াতাড়ি মসজিদবাড়ি পৌঁছোনো যায়, দেরি হলে লাশ পচে যাবে।

নটবরকে আমার পাশে বোটের ছাদে শুইয়ে ওর কাঁথাটা দিয়ে ঢেকে দিলাম। তারপর সুকান ধরে বসলাম।

সাহেব বললেন, বাঘটা তখনও নটবরের ওপরেই বসে ছিল, আমাকে দেখামাত্র চার্জ করল। মারতে অসুবিধা হয়নি।

ইঞ্জিন টপ গিয়ারে ফেলে সুকান ধরে বসে থাকলাম।

জোয়ারে ভেসে চলেছি।

আমার হঠাৎ মনে হল, এ জোয়ার রোজকার জোয়ার নয়। এই এক জোয়ারে অনেক কিছুই ভাসিয়ে নিয়ে গেল। এই জোয়ারেই ভেসে মসজিদবাড়ি পৌঁছোব, নটবরের বাড়ি।

সাহেব নীচে চলে গেলেন, ডেকে পায়ের কাদা ও গায়ের রক্ত ধুতে।

কেবিনে নেমেই, এই নিথর নিস্তব্ধ মৃত্যুর পরিবেশ বদলাবার জন্যে জোরে জোরে বললেন, মিলি, আমি মরিনি। বেঁচে এলাম, আজ আমাকে একটু চুমু খাবে?

মিলিদি বললেন, সবসময় এসব কথা ভালো লাগে না।

মেমসাহেব ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, ন্যাকামির একটা সীমা থাকা উচিত। সবসময় তোমার ন্যাকামি ভালো লাগে না।

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না।

সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, আচ্ছা বাবা, আচ্ছা।

আমি ভাবলাম, এই জোয়ার সাধারণ জোয়ার নয়।

এ জোয়ারে আমার বুদ্ধিশুদ্ধি, জ্ঞানগম্মিও সব ভেসে গেল।

ভাবলাম, নটবরের মতো, সাহেবও আমার মরে গেলেই ভালো হত।

যাক গে, নটবরের ডবকা বউটার চোখের জলের জোয়ারে অন্তত কোনো ফাঁকি থাকবে না। আশা করা যায়।

সে জোয়ার এখন কী দিয়ে বাঁধি, তাই ভাবছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *