জোনস

জোনস

এক সময় এই জায়গাটায় অনেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বাস ছিল৷ তাদের মধ্যে অধিকাংশই হয় অস্ট্রেলিয়া, নয় অন্যত্র এখন চলে গেছে৷ যে স্বল্প ক’জন আছে তাদেরও বয়স হয়েছে অনেক৷ বিদেশ থেকে পাঠানো ছেলেমেয়েদের টাকাতেই তাদের কোনওরকমে চলে৷ যেরকম চলে তা না চলারই মতো৷ অধিকাংশরই বয়েস হয়েছে অনেক, তবুও জায়গাটা খুব স্বাস্থ্যকর বলে অধিবাসীদের বয়স বোঝা যায় না৷ এঁরা বলেন, ‘‘হেয়ার উই হ্যাভ ওনলি দ্য এয়ার অ্যান্ড ওয়াটার৷’’

আমি এক সাহেবের একটি বাংলো ভাড়া নিয়ে এখানে থাকছি কিছুদিন হল৷ এখানের কিছু কিছু বাসিন্দার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে৷ তাঁদেরই মধ্যে কেউ কেউ আমার কাছে আসেন মাঝে মাঝে৷ আমার বাবরচি যা রান্না করে, তাই তাঁরা খুব ভালোবেসে খান৷ তাঁদের খাওয়ার ধরন দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে বাড়িতে রোজই সুখাদ্য তাঁরা খান না৷ আমার বাড়ির কাছেই থাকতেন মিসেস কিং৷ তাঁর স্বামী কয়েক বছর আগে মারা গেছিলেন৷ অপরূপ সুন্দরী মহিলা ছিলেন৷ বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে কখনও কখনও তাঁর সঙ্গে দেখা হত৷ সুন্দর করে সেজে, রোদ এড়াবার জন্য মাথায় টুপি পরে তিনি গুটি গুটি পায়ে হেঁটে স্থানীয় কোনও মানুষের বাড়ির দিকে যেতেন৷ দেখা হলেই আমি তাঁকে উইশ করতাম৷ উনি আমাকে উইশ ব্যাক করতেন৷ কখনও কখনও আমার মালির বউকে দিয়ে তাঁকে কেকের অর্ডার করতাম৷ বাড়িতে অসম্ভব ভালো কেক বানাতেন তিনি৷ এবং অর্ডার মতো কেক বানিয়ে রাখতেন৷ আমার মালির বউ গিয়ে টাকা দিয়ে সেই কেক নিয়ে আসত৷

আমি যাচ্ছিলাম ক্লাবের দিকে৷ ওখানে যেমন একটি চার্চ ছিল, তেমন একটি ক্লাবও ছিল৷ দুইয়েরই অবস্থা ছিল তখন অত্যন্ত ভগ্নপ্রায়৷ ক্লাবে খাওয়া-দাওয়া বিশেষ কিছু পাওয়া যেত না৷ একজনই বেয়ারা ছিল, তার নাম ছিল হালিম৷ সে কিন্তু খুব ভালো ওমলেট বানাত৷ সে গঞ্জে ওমলেট খাওয়ার মতো সচ্ছল মানুষও তখন বিশেষ ছিল না৷

সেদিন আমি যখন বেরোই তখন বেশ দেরি হয়ে গেছিল৷ শালবনের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা লালমাটির রাস্তা উঁচু-নীচু পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে৷ দু’পাশে তিতির কান্নার মাঠ৷ সময়টা বৈশাখের মাঝামাঝি৷ কিছুদিন আগে থেকেই আমার চোখ দুটি প্রায় খারাপ হয়ে গেছে, তাই লেখালিখি যা করার সব দিনমানেই করতাম৷ এখন আমাকে হাতে লাঠি নিয়ে চলতে হয় চোখের কারণে৷ ক্লাবের সিঁড়ি দিয়ে ক্লাবের বারান্দাতে বেতের চেয়ার টেনে নিয়ে আমি বসলাম৷ কারণ স্টিভেনসের আসবার কথা ছিল এই ক্লাবেই৷ এবং কথা ছিল ওর গাড়িতে চড়িয়ে আমাকে ব্রিগেডিয়ারের বাড়িতে নিয়ে যাবে৷ ব্রিগেডিয়ারের বাড়ি অনেক দূরে৷ সেখানে অন্ধকার নেমে এলে আমার চোখের এই অবস্থায় পৌঁছানো একেবারেই অসম্ভব৷ হালিমকে কফি বানাতে বলে আমি স্টিভেনসের অপেক্ষায় রইলাম৷ আমার চোখের সামনে হাজারো পাখির কলকাকলির মধ্যে সূর্যটি পশ্চিমে পাহাড়ের আড়ালে ডুবে গেল৷ তখনই পুরো অন্ধকার হল না৷ এক আশ্চর্য হলুদরঙা মায়াবী আলো, সেখানকার লালমাটির রাস্তা এবং সবুজ শালবনকে পরম আদরে ঢেকে দিল৷ পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যাতারাটি উঠল নিঃশব্দে এবং তার নীলাভ দ্যুতি ছড়িয়ে যেতে লাগল৷ স্টিভেনস কিন্তু এল না, কেন এল না তা সেই জানে৷ কিন্তু এ কথাও সে জানত যে অন্ধকার হয়ে গেলে আমি এক পাও চলতে পারি না৷ আমার কটেজে ফিরতে গেলেও প্রায় এক মাইল রাস্তা আমাকে যেতে হবে লাঠি ঠকঠকিয়ে৷ স্টিভেনস আসবে এ আশাতে আমি তখনও হালিমের বানানো কফির কাপটি সামনে করে বসে থাকলাম যতক্ষণ না কৃষ্ণপক্ষের গাঢ় অন্ধকার সামনের পথ, শালবন এবং এ বাংলোটি ও আমাকে সুদ্ধু কালো চাদরে ঢেকে নিল৷ অদূরেই একটা কোটরা হরিণ যার ইংরেজি নাম বার্কিং ডিয়ার, ব্যাক-ব্যাক-ব্যাক ডাকতে ডাকতে গভীর জঙ্গলের দিকে ঢুকে গেল৷

হালিম উদ্বিগ্ন গলায় জিগেস করল, ‘‘কিসিকা ইন্তেজারি মে থে আপ, সাহাব?’’

আমি বললাম, ‘‘স্টিভেনস সাহেবের জন্য৷’’

হালিম বলল, ‘‘উনকা শাস কি আজ আচানক মৌত হো গিয়া মন্দার মে৷ উনকো যাতে হুয়ে দেখা হাম করিফ চার বাজে৷’’

আমি বুঝলাম যে অত্যন্ত ভদ্রলোক ও দায়িত্বসম্পন্ন স্টিভেনস কেন কথা দিয়েও কথা রাখতে পারেনি৷ কিন্তু আমি এখন হেঁটে ফিরি কী করে! সঙ্গে টর্চও আনিনি৷ আনলেও সেই আলোতে আমি পথ চলতে পারতাম না, আমার চোখের এমনই অবস্থা৷

হালিম আমাকে অসহায় দেখে বলল, ‘‘ম্যায় চলু কেয়া আপ কে সাথ, লন্টন লে কে?’’

বললাম, ‘‘আজ জুম্মাবার হ্যায়৷ তুমহারা ক্লাব মে কুছ সাহাব-মেমসাহাব লোগ তো জরুর আয়েগা, তুম ক্যাইসে যাওগে ক্লাব ছোড়কে?’’

হালিম বলল, ‘‘হাঁ, উ বাত ভি তো সহি হ্যায়৷’’

ব্রিগেডিয়ারের বাড়ি সে রাতে আর যাওয়া হবে না তা বুঝতে পেরে নিজের কটেজের দিকে ফিরে যাওয়ার জন্যে আমি লাঠি হাতে ক্লাবের সিঁড়ি বেয়ে এগোতে চেষ্টা করলাম৷ আর দেরি করলাম না এই ভেবে যে কৃষ্ণপক্ষের রাত, রাত যত বাড়বে, অন্ধকার তত গাঢ় হবে৷ হালিম সিঁড়ির নীচ অবধি এসে আমাকে পথে নামিয়ে দিল৷

আমি বললাম, ‘‘টর্চ হ্যায় হালিম?’’

হালিম বলল, ‘‘নাহি হুজুর৷ গরিব আদমি হাম, হামারে পাস টর্চ কাঁহাসে আয়েগা? ক্লাব কা দোঠো লন্টন হ্যায়, আপ এক লে কে যাইয়ে৷ কাল ভেজবা দিজিয়ে গা মালি সে৷’’

বললাম, ‘‘নেহি, নেহি, লন্টন লে কে ম্যায় চল নেহি সাকুঙ্গা৷’’

হালিমকে তো না করে দিলাম৷ কিন্তু দু’পা এগিয়েই বুঝতে পারলাম যে আমার লাঠি আমাকে কোনও সাহায্যই করতে পারবে না৷ এবং আজ হয়তো আমার পথের ওপর পড়েই মৃত্যু হবে৷ এ বয়সে পড়ে যাওয়া মানেই যমের কোলে যাওয়া৷ কিন্তু আমি নিরুপায়৷ ওপরে চেয়ে দেখলাম আকাশ ভরা তারা অন্ধকার রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করছে৷ দিনের বেলায় এরা কোথায় যে থাকে৷ রবীন্দ্রনাথের কবিতা মনে পড়ল—‘‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে৷’’ ঈশ্বরের ওপরে নিজের ভাগ্য ছেড়ে দিয়ে আমি এক পা এক পা করে লাঠি ঠকঠকিয়ে সামনে এগোবার চেষ্টা করলাম৷ দশ-পনেরো পা যেতে যেতেই প্রায় দু’বার পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল৷ এমন সময় সে অন্ধকারের মধ্যে এক অন্ধকারতর মূর্তি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘‘আর ইউ মেম্বার অব দিস ক্লাব স্যার?’’ আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘‘ইয়েস৷ বাট হু আর ইউ?’’ সেই মূর্তি বলল, ‘‘আই অ্যাম জোন্স৷’’ তাকে জিগেস করলাম, ‘‘ডু ইউ রিসাইড হেয়ার?’’

মূর্তি বলল, ‘‘নো৷ আই হ্যাভ কাম হেয়ার টু স্পেন্ড আ উইক উইথ মাই আন্ট৷’’ তারপর বলল, ‘‘ইউ সুড নট হ্যাভ কাম ইন দ্য ডার্কনেস অল অ্যালন৷ আ ফল অ্যাট দিস এইজ ইস অলওয়েস ফ্যাকাল৷’’ তারপর কিছুক্ষণ থেমে থেকে বলল, ‘‘মাই ফাদার ওয়াজ অ্যাজ ওল্ড অ্যাজ ইউ অ্যান্ড হি ডায়েড দ্য আদার ডে বাই ফলিং ওন দ্য ফুটপাথ ইন পার্ক স্ট্রিট৷’’ আমি বললাম, ‘‘ক্যালকাটাস পার্ক স্ট্রিট?’’

জোন্স বলল, ‘‘ইয়েস স্যার৷’’ তারপর সে বলল, ‘‘হ্যাভ ইউ হার্ড অফ ভিক্টর ব্রাদার্স?’’

আমি বললাম, ‘‘ইয়েস, দ্যাট ইস ওয়ান অফ দ্য ওলডেস্ট অক্সানিয়াস অব ক্যালকাটা৷’’

জোনস বলল, ‘‘আই অ্যাম ওয়ান অফ দি প্রপাইটার্স অফ ভিক্টর ব্রাদার্স৷’’ তারপরই বলল, ‘‘কাম, গিভ ইয়োর রাইট হ্যান্ড টু মি অ্যান্ড হোল্ড ইয়োর স্টিক টু দ্য লে হ্যান্ড৷ আই ক্যানট লিভ ইউ ইন দ্য জাংগল রোড ইন দিস ডার্কনেস৷’’ তারপর বলল, ‘‘হাও ফার ইস ইয়োর কটেজ?’’ বললাম, ‘‘অ্যাবাউট হাফ আ মাইল ফ্রম হেয়ার৷’’ কিছুটা এগিয়ে রাস্তাটা খুব উঁচু-নীচু এবং বড়ো বড়ো পাথরে ভর্তি৷ জোনস আমার গলাটা ওর ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘‘নাও আই অ্যাম হোল্ডিং ইউ, ইউ ক্যানট ফল, আই উইল গো আপ টু ইয়োর কটেজ৷’’

অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু তবুও দেখলাম, জোনস বেশ লম্বা-চওড়া এবং যুবক৷ লম্বায় সে প্রায় আমারই মতো৷ আমি বিড়বিড় করে বললাম, ‘‘ইস ভেরি নাইস অব ইউ টু হ্যাভ কেপট মি কোম্পানি৷ নোবডি হেল্পস আননোন পার্সন ইন দিস ফ্যাশন৷ ইউ আর আ এক্সেপশানল ইয়ং ম্যান, নোবডি বিহেভস লাইক ইউ দিস ডেজ৷’’

সে বলল, ‘‘ইটস মাই প্লেজার স্যার৷’’

আমার কটেজের দরজায় পৌঁছোতেই কটেজের বারান্দা থেকে প্যাট গ্লাসকিন আমাদের পায়ের শব্দ শুনে তার টর্চ হাতে করে পথের দিকে এগিয়ে এল৷ সে নিজেও তো ক্লাচ নিয়ে চলাফেরা করে, যুদ্ধে তার পা কাটা গেছিল৷ তবুও সে আমার বাড়ির কেয়ারটেকার, তাই তাকে তো আসতেই হবে৷ কাঠের গেটের ওপর হাত রেখে আমি জোন্সের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘‘মে গড ব্লেস ইউ জোনস৷ নাও ইউ নো মাই কটেজ, প্লিজ ড্রপ ইন অ্যাট দিস ওয়ানস সো লং ইউ আর স্টেয়িং হেয়ার৷ প্লিজ অ্যালাও মি টু গিভ ইউ আ ট্রিট৷’’

জোন্স একটা ফুলহাতা সোয়েটার পরেছিল৷ আমি অন্ধ মানুষ, অন্ধকারে রং চিনতে পারলাম না৷ ‘‘গুড নাইট স্যার’’ বলে সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল৷ প্যাট কাছে এসে আমার বাঁ হাতটা ধরল এবং আমায় জিগেস করল, ‘‘হাও কুড ইউ কাম অল অ্যালন ইন দিস ডার্কনেস?’’

আমি বললাম, ‘‘আই ওয়াজ নট অ্যালন৷ ডিডনট ইউ হিয়ার জোন্স? হু কেম টু সি মি অফ৷’’

প্যাট বলল, ‘‘ইউ মাস্ট বি ড্রিমিং, দেয়ার ইস নো ওয়ান উইথ ইউ৷’’ আমি প্যাটকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘‘ডিডনট ইউ সি হিম? অলমোস্ট সিক্স ফিট টল গাই অ্যান্ড আ ভেরি গুড সামারিটান৷’’

প্যাট বলল, ‘‘দেয়ার হ্যাজ নো জোনস ইন দ্য গানজ৷ ওনলি ওয়ান জোনস আই ইউজ টু নো হু হ্যাজ রিলেশন অব মিসেস মিনেজিস৷ বাট হি ডায়েড অ্যাবাউট টেন ডেজ ব্যাক হোয়াইল কামিং ফ্রম রাঁচি ওন হিজ মোটর সাইকেল৷ ইট ওয়াজ আ হরাইবল অ্যাকসিডেন্ট৷’’

আমি স্থাণুর মতো আমার কটেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ অনেক কথা দলা পাকিয়ে আমার গলার কাছে উঠে এল, কিন্তু বলতে পারলাম না কিছুই৷ বাঁ হাতে লাঠি ধরে, ডান হাতটা প্যাটের হাতে রেখে আমি আস্তে আস্তে আমার কটেজের দিকে এগিয়ে গেলাম৷



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *