জোড়া সাপ

জোড়া সাপ

সেবার আমি বেড়াতে গিয়েছিলাম কাশীতে, আমার ছোটমাসির বাড়িতে। আমার ছোটমেসোর বদলির চাকরি, সেইজন্য আমার খুব মজা হয়েছিল। ছোটমেসো একটা নতুন জায়গায় বদলি হয়ে যান, আর আমি অমনি সেখানে বেড়াতে যাই। এইভাবে আমার মুসৌরী, দেরাদুন, পুণা, তেজপুর, বিশাখাপত্তনম এই সব ভালো ভালো জায়গা দেখা হয়ে গিয়েছিল।

আমার ছোটমেসোকে আসলে বলা উচিত বিরাট মেসো। কারণ তাঁর চেহারাটা ঠিক ভীমের মতন। তেমনি বাজখাঁই তাঁর গলার আওয়াজ আর সাহসও সাংঘাতিক। কেউ ভয়ে তাঁর সঙ্গে দ্বিতীয় বার শেকহ্যান্ড করে না। তিনি এমন বজ্রমুষ্টিতে হাত চেপে ধরেন যে তারপর তিনদিন ব্যথা থাকে। আমার ছোটমাসি আবার তেমনি ভীতু। টিকটিকি, আরশোলা কিংবা মাকড়সা দেখলেই ছোটমাসি প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অবশ্য আমার সেই বিরাট মেসোও যে পৃথিবীতে একটা জিনিসকে খুব ভয় পান, তার প্রমাণ পেয়েছিলাম সেবার কাশীতে।

ছোটমাসিরা বাড়ি নিয়েছিলেন বেনারস স্টেশনের উল্টোদিকে একটা নতুন পাড়ায়। পাড়াটা সবে তৈরি হচ্ছে। মাঠের মধ্যে উঠছে নতুন বাড়ি। মাঠগুলো ঝোপঝাড়ে ভরা। খুব বড় বড় ইঁদুর আছে সেইসব মাঠে। এক—একটা ইঁদুরের অন্তত দু’কিলো—তিন কিলো ওজন হবে।

কাশীতে বড্ড ফেরিওয়ালার উৎপাত। সারা দিনে কত রকম ফেরিওয়ালা যে আসে, তার ঠিক নেই। কাচের চুড়ি, ছাগলের দুধ, লুধিয়ানার কম্বল, পুরনো ঘি, কাঠের পুতুল, আচার এসব নানারকম জিনিস বিক্রি করতে ফেরিওয়ালা আসে। এ ছাড়া বাঁদরের নাচ, ভল্লুকের নাচ দেখাবার লোকও আসে।

একদিন এলো একটি মেয়ে সাড়ে। এর আগে আমি কখনো মেয়ে সাপুড়ে দেখিনি। বেশ গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারার মাঝবয়সী একজন মেয়ে, সঙ্গে গেরুয়া রঙের কাপড়ে মোড়া তিনটে সাপ ভর্তি ঝোলা, আর সেই মাঝখানটা বেলুনের মতন ফোলানো বাঁশি। সেই বাঁশি সে অনেকক্ষণ ধরে বাজালো আমাদের বাড়ির সামনে। তারপর বললো, সাপ খেলা দেখবো গো! এ বাঙালি মাঈজী!

আমরা যে বাঙালি, সেকথা সে কী করে বুঝলো কে জানে। বোধ হয় চিংড়ি মাছ রান্নার গন্ধ পেয়েছিল।

ছোটমাসি বারান্দায় বেরিয়ে এসে মুখঝামটা দিয়ে বললেন, না, দেখবো না! পরশুই তো একজন সাপুড়ে এসে খেলা দেখিয়ে গেল। আমরা কি রোজ রোজ বাঁদরের নাচ ভল্লুকের নাচ, আর সাপের নাচ দেখবো নাকি?

মেয়ে সাপুড়েটি অনেক কাকুতি—মিনতি করলো, কিন্তু মন গললো না ছোটমাসির!

তখন সাপুড়েনী বললো, বড় পিয়াস লেগেছে, এক বর্তন পানি দেবে মাঈজী?

কেউ জল চাইলে ‘না’ বলা যায় না! ছোটমাসি জল আনতে গেলেন আর সাপুড়েনীটি তার ঝাঁপিগুলো নামিয়ে আমাদের বারান্দায় এসে বসলো।

ছোটমাসি এক জগ জল এনে দিলেন। সাপুড়েনী জগটা মুখের কাছে উঁচু করে ধরে ঢক ঢক করে প্রায় অর্ধেকটা জল খেয়ে নিল। তারপর ঝাঁপিগুলোর মুখ খুলে সাপগুলোর গায়ে ছিটিয়ে দিল খানিকটা। অমনি একটা হলদে—কালো ডোরা—কাটা সরু সাপ সুড়ুৎ করে বেরিয়ে এসে মেঝের ওপর কিলবিল করতে লাগলো! ছোটমাসি ভয় পেয়ে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে চ্যাঁচাতে লাগলেন, শিগগির ওকে বিদায় কর।

সত্যি কথা বলতে কি, অত কাছে একটা সাপ দেখে আমারও একটু একটু ভয় করছিল। একমাত্র ভয় পেলো না ছোট মাসির দেড় বছরের বাবলু। সে খল খল করে হেসে বলতে লাগলো, সাপ ধরবো! সাপ ধরবো!

বাজারের মাছওয়ালারা যেমনভাবে শিঙ্গিমাছ ধরে, সাপুড়েনী সেই রকম অবহেলার সঙ্গে সাপটার মাথা চেপে ধরে সেটাকে আবার ঝাঁপিতে পুরে দিল। তারপর উটেরা যেমনভাবে গন্ধ শোঁকে সেই রকমভাবে ঠোঁট আর নাক কুঁচকে রেখে বললো, মাঈজী, তুমহার কোঠীর পাশে মাঠে সাঁপ আছে, পাঁচঠো রূপীয়া দো, সাঁপ ধরে দেবো।

ছোটোমাসি খিল খিল করে হেসে উঠলেন। আমিও হাসলাম। এ বাড়ির চাকর শুকদেবও হাসলো। কারণ, ঠিক দু’দিন আগেই আমাদের উল্টোদিকের বাড়িতে সাপ খেলা দেখাতে এসে একজন সাপুড়ে ঠিক এই কথা বলেছিল। আর মাত্র দু’টাকা চেয়ে সে বাড়ির সিঁড়ির তলা থেকে দুটো সাপ ধরে দিয়েছিল। ওই সব সাপুড়েরা মনুমেন্টের মাথা থেকেও যখন—তখন সাপ ধরে দিতে পারে। উল্টোদিকের বারান্দা থেকে আমরা স্পষ্ট দেখেছিলাম সাপুড়েটার আলখাল্লার নিচে কোমরে জড়ানো ছিল দুটো সাপ, সেই দুটোই খুব কায়দা করে বার করলে, ম্যাজিশিয়ানরা যেভাবে টুপির ভেতর থেকে খরগোশ বার করে।

আমাদের সকলের একসঙ্গে হাসি শুনে সাপুড়েনীটি একটু ঘাবড়ে গেল বোধ হয়। আর বেশি উচ্চবাচ্য করলো না। ঝাঁপিগুলো তুলে নিয়ে চলে গেল। ছোটমাসি বারান্দাটা ফিনাইল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেললেন।

খানিকটা দূরে বেশ কিছুক্ষণ পেট ফোলানো বাঁশিটার আওয়াজ শোনা গেল। বোধহয় সাপুড়েনী আর কোনো বাড়িতে খেলা দেখাবার সুযোগ পেয়েছে।

পরের রবিবারে ছোটমেসো আমাদের সারনাথ ঘুরিয়ে নিয়ে এলেন। ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল। তারপর ছোটমাসির শোবার ঘরে বসে আমরা চা খাচ্ছি, রেকর্ড প্লেয়ারে ওস্তাদ গুলাম আলী খাঁর গান বাজছে, এমন সময় হঠাৎ আলো নিভে গেল, আর গুলাম আলীর গলাটা বিশ্রী মোটা হয়ে থেমে গেল।

আমরা কলকাতার ছেলেরা যখন—তখন আলো নিভে গেলে আর অবাক হই না। ছোটমাসি বললেন, দুর ছাই! ছোটমেসো বললেন, এই শুরু হলো জালাতন!

কারুরই অবশ্য মোমবাতি খোঁজবার উৎসাহ হলো না! সেদিন পাতলা পাতলা জ্যোৎস্না ছিল। জানলা দিয়ে তার একটু আলো এসে পড়েছে। আমরা সেই আবছা অন্ধকারেই বসে বসে চা খেতে লাগলাম। অন্ধকারে আর যাই অসুবিধে হোক, খাবার খেতে কোনো অসুবিধে হয় না। হাতের বিস্কুটটা ঠিক মুখেই চলে আসে, সেটা আমরা ভুল করে কানে গুঁজে দিই না।

তিনজন মিলে নানা রকম গল্প করছিলাম। একসময় আমার চোখে পড়লো, মেঝেতে কী যেন চকচক করছে। মনে হলো খানিকটা জল পড়ে আছে, তার ওপর এসে পড়েছে চাঁদের আলো। এখানে জল এলো কি করে? তারপর মনে হলো, জলটা যেন নড়ছে। তারপর আর কিছুই মনে হলো না। আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, সাপ!

আমি ছোটমাসিকে ভয় দেখাবার জন্য অনেক সময় মিছিমিছি বলি, ছোটমাসি, তোমার পায়ের কাছে একটা আরশোলা! ছোটমাসি সেইরকমই কিছু একটা ভেবে চেয়ারেই বসে রইলেন। ছোটমেসো স্প্রিংয়ের মতন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সাপ? কোথায়?

ওই যে সামনেই।

একথা বলেই আমি ছোটমাসির হাত ধরে ঝটকা টান মেরে ছুটলাম। আমি আর ছোটমাসি চলে এলাম বসবার ঘরে। আর শোবার ঘরের পেছনে একটা ছোট ঘরে গিয়ে ঢুকলেন ছোটমেসো। দড়াম করে বন্ধ করে দিলেন দরজা। ততক্ষণে আমরা সাপটার দু’বার ফোঁস ফোঁস আওয়াজ শুনতে পেয়েছি।

দারুণ ভয় পেয়ে ছোটমাসি ধপাস করে সোফার ওপর বসে পড়তে যাচ্ছিলেন, বোধ হয় অজ্ঞান হয়েই যেতেন, কিন্তু তক্ষুণি আবার উঠে চিৎকার করে বললেন, বাবলু! বাবলু রয়েছে যে ঘরের মধ্যে!

সত্যিই তো। সারনাথ থেকে ফেরবার পথেই বাবুল ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাকে কোলে করে এনে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল খাটে। বাবুল তো সেখানেই ঘুমিয়ে রয়েছে।

এরপর দেখলাম, ছোটমাসি আর ছোটমেসোর একদম উল্টো ব্যবহার। দারুণ সাহসী ছোটমেসো ঘরের দরজা আর খুললেনই না, সেখান থেকে চেঁচিয়ে বললেন, কী হলো? সাপটা গেছে? কত বড় সাপ?

আর যে ছোটমাসি আরশোলা দেখলেই মূর্ছা যান, তিনি তক্ষুণি ছুটে আবার সেই সাপের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। আমি ছোটমাসির হাত চেপে ধরলাম। বিছানার ওপর ঘুমিয়ে থাকা বাবলুকে হয়তো সাপটা না কামড়াতেও পারে, কিন্তু ছোটমাসি ঘরের মধ্যে ঢুকলে নির্ঘাৎ কামড়াবে।

আমাদের চ্যাঁচামেচি শুনে শুকদেও ছুটে এলো আর সে চট করে একটা টর্চ জোগাড় করে ফেলল। টর্চের আলোটা যাতে সে সাপটার মুখের ওপর না ফেলে তাই আমি টর্চটা হাত থেকে নিয়ে নিলাম। যতদূর জানি, সাপ কানে শুনতে পায় না, তাই আমাদের চিৎকার সে গ্রাহ্য করতে নাও পারে, কিন্তু চোখে আলো ফেললে নিশ্চয়ই রেগে যাবে। আলোটা একটু তেরছাভাবে ফেলে দেখলাম, সাপটা একটা বিরাট ফণা তুলে লেজের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে আর এদিক ওদিক মুখ ঘোরাচ্ছে। সাপটা অন্তত চার হাত লম্বা, মাঝে মাঝে জিভ বার করছে চিরিক—চিরিক করে। দেখলেই বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে।

ছোটমাসি চেঁচিয়ে উঠলেন, সুনীল, শিগগির সাপটাকে মার।

কিন্তু বললেই কি আর অত বড় সাপটাকে মারা যায়? কাছে এগোলেই যদি লাফিয়ে এসে কামড়ায়? সত্যি কথা বলতে কি, ভয়ে আমার বুক কাঁপছিল। আমি বাঘ, ভল্লুক, ভূতের চেয়ে সাপকে বেশি ভয় পাই। তবু ঘরের মধ্যে বাবলু রয়েছে, একটা কিছু করতেই হবে।

আমি বললাম, শুকদেও, লাঠি কোথায়, লাঠি?

শুকদেও দৌড়ে গিয়ে একটা ডান্ডা নিয়ে এলো।

সাপটা কী করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে জানি না। কিন্তু এখন সে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে মনে হয়! সাপেরা সিমেন্টের মেঝে পছন্দ করে না। ফণা তোলা অবস্থায় একটুখানি চলতে গিয়েই চটাং চটাং করে পড়ে যাচ্ছে। তাতে রেগে উঠে আরও বড় ফণা তুলছে।

সাপটাকে তক্ষুণি মারবার বদলে, ওটা যদি কোনো রকমে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতো, তাহলে আমরা বাঁচতুম। কিন্তু সাপটা একটা উল্টো কাজ করলো। সেটা আমাদের দিকেই খানিকটা এসে একটা দরজার পাশে লুকিয়ে পড়লো। চৌকাঠের সঙ্গে লেগে থাকা তার খানিকটা লেজ আমরা তখনো দেখতে পাচ্ছি। সর্বনাশ! এবার তো আমরা ঘরেও ঢুকতে পারব না। বাবলু যদি ঘুম ভেঙে হঠাৎ খাট থেকে নেমে আসে!

ওপাশের বন্ধ ঘর থেকে ছোটমেসো আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কী হলো, সাপটা গেছে?

ছোটমাসি বললেন, না! তুমি বেরিয়ো না একদম।

ছোটমাসি তারপর আরও সব অসীম সাহসিক কাজ করতে লাগলেন। রান্নাঘর থেকে কেরোসিনের টিনটা এনে প্রায় দরজার চৌকাঠ পর্যন্ত এগিয়ে অনেকখানি কেরোসিন ছিটিয়ে দিলেন ঘরের মধ্যে। তারপর একগাদা খবরের কাগজ পাকিয়ে তাতে কেরোসিন ঢেলে রান্নাঘরের উনুনে ছুঁইয়ে আগুন জ্বেলে আনলেন। তারপর সেই খবরের কাগজের মশালটা ছুঁড়ে দিলেন সাপটার গায়ে। গায়ে আগুন লাগতেই সাপটা দরজার পাশ থেকে বেরিয়ে আবার ফণা তুললো আর সেই আগুনে ঘরের মধ্যের কেরোসিনও জ্বলে উঠলো দাউ দাউ করে।

ছোটমাসির উপস্থিত বুদ্ধি সাংঘাতিক বলতে হবে। ঘরের মধ্যে আগুন জ্বলছে বলে সাপটা আর ঘরের মধ্যে গেল না, চৌকাঠের সামনে কিলবিল করতে লাগলো।

এই সময় এই হট্টগোলে বাবলু জেগে উঠলো। ডেকে উঠলো, মা—

ছোটমাসি প্রায় পাগলের মতন হয়ে গিয়ে কেঁদে চিৎকার করে বললেন, ‘বাবলু, বাবলু, খাট থেকে নামিস না।

ঠিক সেই সময় শুকদেও সাপটার গায়ে একটা ডাণ্ডা কষালো।

কিন্তু লাঠি দিয়ে সাপ মারা খুব সোজা কথা নয়। মারটা খেয়ে সাপটার বিশেষ কিছু হলো না, সে চৌকাঠ ছাড়িয়ে এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। সাপ দারুণ জোরে ছুটতে পারে এক—এক সময়, কিংবা লাফাতেও পারে। সেই মুহূর্তে সাপটা আমাদের একজনকে ছোবল মারতে পারতো। কিন্তু শুকদেও তক্ষুণি ডাণ্ডা দিয়ে সাপটাকে মেঝের সঙ্গে চেপে ধরলো।

তখন দেখলাম শুকদেওর কী দারুণ সাহস আর গায়ের জোর! সিমেন্টের মেঝেতে একটা সাপকে চেপে ধরে থাকা কি সোজা কথা? সাপের গাটাই তো তেলতেলে!

আমি এক লাফে তিন পা পিছিয়ে গিয়েছিলাম। আবার এগিয়ে এলাম। সাপটা নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য ভীষণভাবে ছটফট করছে। শুকদেও চেপে ধরে আছে ঘাড়ের কাছটা। আর সাপটার লেজটা একটা চাবুকের মতন ছটাস ছটাস করে পড়ছে মেঝেতে। এক—একবার চেষ্টা করছে লাঠিটাকে পাকিয়ে ধরবার জন্য।

শুকদেও চেঁচিয়ে উঠলো, দাদাবাবু, আভি উসকো মারিয়ে!

দেখলাম, শুকদেওর মুখে ঘাম জমে গেছে, দাঁতে দাঁত চেপে আছে। সাপটার নিশ্চয়ই খুব গায়ের জোর। শুকদেও বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারবে না। ছোটমাসি সবটা কেরোসিন ছড়িয়ে দিলেন মেঝেতে, আবার কাগজ জ্বেলে ছুঁড়ে দিলেন সেখানে। এখন সাপটার সব দিকেই আগুন তবু কিন্তু পুড়ছে না সহজে, ছটফট করে যাচ্ছে সমানে!

আমি কী দিয়ে সাপটাকে মারবো? হাতের কাছে কোনো জিনিস নেই। একটা চেয়ার ছুঁড়ে মারলে কি কোনো লাভ হবে? কিছুই ঠিক করতে পারছি না। যদি শুকদেওর হাত পিছলে যায়, যদি সাপটা আগুন পেরিয়ে আসে…

ছোটমাসি বললেন, সুনীল, শিল—নোড়াটা নিয়ে আয়।

কিন্তু তার আগেই সাপটা শুকদেওর লাঠির তলা থেকে পিছলে বেরিয়ে এলো। তারপর আগুনের শিখা ছাড়িয়ে ফণাটা তুলে আমাদের দিকে তাকালো। শুকদেও সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের গতিতে ডান্ডাটা দিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে মারলো সেই ফণাটার ওপর। তাতেই ফণাটা ছাতু হয়ে গেল, সাপটা নেতিয়ে পড়লো আগুনের ওপর। শুকদেও তখনও দমাদম করে পেটাতে লাগলো এক জায়গায়। সাপটা আর নড়লো না।

ছোটমাসি আগুন ডিঙিয়ে গিয়ে বাবলুকে কোলে তুলে নিলেন।

আমি আর শুকদেও ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম মাটিতে। সারা ঘরে সাপ পোড়ার বিশ্রী গন্ধ। বমি এসে যাচ্ছে প্রায়। শুকদেও আবার আগুন থেকে লাঠি দিয়ে বার করে আনলো সাপটাকে। আগুনে ঝলসে সাপটা যেন হঠাৎ মোটা হয়ে গেছে।

এতক্ষণ পরে বেরুলেন ছোটমেসো। তিনি সাপটাকে দেখে বললেন, বাবা, এত বড় সাপ? সাপকে বিশ্বাস নেই, ওরা অনেক সময় মটকা মেরে থাকে!

তিনি শুকদেওর হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে সেই মরা সাপকেই মারলেন কয়েক ঘা। ছোটমাসি বললেন, হয়েছে, হয়েছে! এবার ওটাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে এসো।

ছোটমেসো বললেন, রাস্তায় ফেলবে কি? বৃষ্টির জল লাগলে সাপ আবার বেঁচে যায়।

সে আর কি করা যাবে! শুকদেও আর আমি গিয়ে অনেকটা দূরে সাপটাকে ফেলে দিলাম মাঠের মধ্যে। নিশ্চিন্ত হবার জন্য দুটো থান ইট দিয়ে আরও কয়েকবার ঠুকে দিলাম ওর মাথা। নাঃ, সাপটা মরে গেছে নিশ্চিত।

সেদিন আর সারারাত প্রায় ঘুমই হলো না বলতে গেলে। ছোটমাসির ধারণা হলো, সাপটার বিষ নিশ্চয়ই ঘরের মধ্যে পড়েছে। দুটো ঘরে একবার ফিনাইল একবার ডেটল ছড়িয়ে খুব করে ধোওয়া—মোছা হলো। তারপর বহুক্ষণ জেগে আমরা অনবরত ওই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম। সত্যি খুব জোর একটা ফাঁড়া গেছে। ছোটমাসি বার বার ছোটমেসোকে ঠাট্টা করে বলতে লাগলেন, তুমি কি দরের বীরপুরুষ বোঝা গেছে। আমরা তিনজন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সাপটা মারলাম। আর তুমি দরজা বন্ধ করে বসে রইলে?

ছোটমেসো বললেন, আহা, তোমরাই তো আমাকে বেরুতে বারণ করলে।

ছোটমাসি বললেন, থাক থাক! সব বোঝা গেছে। তোমার তখন গলা কাঁপছিল। এ বাড়িতে আর থাকবো না। তুমি অন্য বাড়ি খোঁজ।

সাপটা মারার ব্যাপারে আমি যদিও বিশেষ কিছুই করিনি, তবু ছোটমাসি যে আমাকে কৃতিত্বের খানিকটা ভাগ দিলেন, তাতে আমি খুশিই হলাম।

পরদিন সকালে উঠে দেখে এলাম যে মাঠের মধ্যে মরা সাপটা একই জায়গায় পড়ে আছে। বেঁচে উঠে পালায়নি।

ব্যাপারটা কিন্তু এখানেই শেষ হলো না। আমাদের সাপ মারার কাহিনিটা পাড়া—প্রতিবেশীদের মধ্যে ছড়িয়ে গেল। অনেকে এ পাড়ায় সাপের কথা শুনে দারুণ অবাক হলো। অনেকে আমাদের সাহসের প্রশংসা করলো, আর অনেকে আমাদের ভয়ও দেখালো খুব। প্রত্যেক সাপেরই একটা করে জুটি থাকে। একটাকে মারলে অন্যটা এসে প্রতিশোধ নেয়।

এরকম একটা কথা আমরা শুনে আসছি বটে, কিন্তু ঠিক বিশ্বাস হয় না। আমরা তো মরা সাপটা ফেলে এসেছি বেশ খানিকটা দূরে মাঠের মধ্যে। ওই সাপটার যদি একটা জুটি থাকেও তবু সে এই বাড়ি খুঁজে খুঁজে আসতে পারবে? সাপের কি এত বুদ্ধি থাকে? সাপের বুদ্ধির তো তেমন গল্প শুনিনি, বরং সাপ সম্পর্কে এমন অনেক কিছু শোনা যায় যেগুলি আসলে বাজে কথা। যেমন লোকে বলে দুধ—কলা দিয়ে সাপ পোষা! কিন্তু সাপ আসলে দুধও খায় না, কলাও খায় না।

তবু উল্টো দিকের বাড়ির দারোয়ান বললো, খুব সাবধান বাবুজী! আমাদের গাঁওতে এই জন্য কেউ সাপ মারে না। একটা সাপকে মারলেই অন্য সাপ এসে বদলা নিয়ে যায়। আমরা এক চাচাতো ভাইকে সাপে কেটেছিল…

আমরা তার কথা অবিশ্বাস করে উড়িয়ে দিলাম। তবু ভেতরে ভেতরে একটু ভয় রয়ে গেল। ভয় জিনিসটা একবার মনের মধ্যে ঢুকলে আর সহজে যায় না। আমার কথা বলতে বলতে প্রায়ই খাটের তলা কিংবা ঘরের কোণগুলো খুঁজে দেখি ভালো করে। সন্ধের পর সব জানলা বন্ধ থাকে।

এদিকে ছোটমাসি পরদিন সব্জীমণ্ডী থেকে ঘুরে এসে চোখ বড় বড় করে বললেন, ত্রিবেদীজীর বউ কি বললে জানিস? আমার মুখে সাপ মারার কথা শুনে বললেন, মরা সাপের লেজ দিয়ে নাকি তীব্র গন্ধ বেরোয়। অন্য সাপ সেই গন্ধ শুঁকে বোঝে কোন জায়গায় ওই সাপটাকে মারা হয়েছিল।

আমি বললাম, কোনো বইতে তো এরকম কথা লেখা নেই!

ছোটমাসি ঝংকার দিয়ে বললেন, যারা বই লেখে, তারা বুঝি সব জানে? মানুষের থেকে জন্তু—জানোয়ারেরা অনেক কিছু বেশি বোঝে। তুই বলতে পারিস, কোথাও ভূমিকম্প হবার দু’দিন আগে সেখানকার মুরগীগুলো বেশি ছটফট করে কেন?

আমি বললাম, তাহলে বেনারস শহরে কি সাপ কিলবিল করছে নাকি?

ছোটমাসি বললেন, সেদিন দেখলি তো অত বড় সাপটা! একটা থাকলে দুটো থাকতে পারে না? যাই হোক, এ বাড়িতে আর আমি থাকছি না। যদি পারি, কাল—পরশুর মধ্যেই উঠে যাবো।

ছোটমাসি খুব তাড়া দিতে লাগলেন ছোটমেসোকে বাড়ি খোঁজার জন্য। তিনি অন্তত তিনতলার ফ্ল্যাট চান।

ঠিক চারদিনের দিন সত্যিই এলো দ্বিতীয় সাপটা। একদম দিনের বেলা।

দুপুরবেলা খাওয়া—দাওয়ার পর ছোটমাসি আর আমি বসে গল্প করছি। খাটের ওপর খেলা করতে করতে একটু আগে ঘুমিয়ে পড়েছে বাবলু। একটু বাদেই ছোটমাসির চোখে ঘুম চলে আসবে, তখন আমি আমার ঘরে চলে যাবো বই পড়তে, তার আগেই দেখতে পেলাম সাপটাকে। ঘরের বাইরের দেয়ালের পাশে যে হাসনাহানা গাছটা রয়েছে, সেটা থেকে একটা সাপ জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে মুখ বাড়ালো। একদম আমাদের চোখের সামনে!

ছোটমাসি আর আমি এত অবাক হয়ে গেছি যে প্রথমে একটাও কথা বলতে পারলাম না। সাপটা জানলার শিকে লেজ পাকিয়ে দু’এক মুহূর্ত ঘরের মধ্যে চেয়ে রইলো, তারপর দেয়াল বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে পারলো না, ছপাৎ করে পড়ে গেল ঘরের মধ্যে।

‘ওরে বাবা বলেই ছোটমাসি আর আমি এক দৌড়ে পালালাম। তারপরই আবার দু’জনে ফিরে এলাম দরজার কাছে। ঠিগ আগের দিনের মতন অবস্থা। ঘরের মধ্যে সাপ, খাটের ওপর ঘুমিয়ে আছে বাবলু! সাপটাও ঠিক একরকম, হাত চারেক লম্বা, মাথার উপরে একটা পায়ের ছাপের মতন।

আজ ছোটমেসো বাড়িতে নেই, শুকদেও একটু আগে বেরিয়ে গেছে। খাওয়া—দাওয়ার পর সে একটু ঘুরে আসতে যায় রোজ।

একই রকম বিপদ থেকে কি পর পর দু’বার বাঁচা যায়! ছোটমাসি সেদিনকার মতন আর সাহস দেখাতে পারলেন না, একেবারে যেন ভেঙে পড়লেন। ‘ওরে বাবা গো!’ ‘ওরে বাবা গো!’ হাঁপাতে হাঁপাতে আর কাঁদতে কাঁদতে এই কথাই বলতে লাগলেন বার বার! আমি ছোটমাসিকে শক্ত করে ধরে আছি, হঠাৎ ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেই সাংঘাতিক কাণ্ড হবে।

সাপটা খাটের একটা পায়ার সঙ্গে লেজ জড়িয়ে মাথাটা ঘোরাচ্ছে এদিক ওদিক। মাঝে মাঝে ফণাটা সামান্য উঁচু করে আমাদের দেখছে। ওকে দেখেই আমার গা যে কাঁপছে। শুনেছিলাম মানুষ যেমন সাপকে ভয় পায়, তেমনি সাপও ভয় পায় মানুষকে। সহজে মানুষের কাছে আসে না। কিন্তু এই সাপটার একটুও ভয় পাবার লক্ষণ নেই! ঠিক যেন খেলা করছে।

মেল ট্রেনের চেয়েও তাড়াতাড়ি চিন্তা করে যাচ্ছি, কি করে সাপটাকে মারবো। সেদিনকার মতন কেরোসিন ছড়িয়ে পুড়িয়ে মারার উপায় নেই। সাপটা ইচ্ছে করলেই খাটের নিচে লুকোতে পারে। শুকদেও—র মতন ডাণ্ডা হাতে নিয়ে ওর কাছে যেতেও সাহস পাচ্ছি না। যদি একবার ফসকায়? তারই মধ্যে একবার ভেবে নিলাম, সাপটা যখন প্রতিশোধ নিতে এসেছে তখন কাকে কামড়াবে? ছোটমাসিকে না শুকদেওকে? আমাকে কামড়ানো উচিত নয়। কারণ আমি তো আগের সাপটাকে ঠিক মারিনি। পরের মুহূর্তেই ভাবলুম, ছিঃ, আমি কি স্বার্থপর!

ছোটমাসির চিৎকারে বাবলু জেগে গিয়ে খাটের ওপর উঠে বসলো। আমরা দু’জনেই একসঙ্গে বললাম, বাবলু, নামিসনি। সাপ! সাপ! নামিসনি!

বাবলু বললো, কোথায় সাপ?

খাটের নিচে! নড়িস না, একটুও নড়িস না।

বাবলু খাটের পাশে ঝুঁকে সাপটাকে দেখলো। সাপটাও দেখলো বাবলুকে। সাপটা এত বড় যে অনায়াসেই অতটা ফণা উঁচু করে ছোবল মারতে পারতো বাবলুকে। আমরা শিউরে উঠে বললাম, সরে যা বাবলু, সরে যা!

বাবলু ওইটুকুনি ছোট ছেলে, সে চ্যাঁচানিতে ঘাবড়ে গেল। প্রথমে সে কেঁদে উঠলো অ্যাঁ অ্যাঁ করে! তারপর হঠাৎ পা ঝুলিয়ে খাট থেকে নেমে পড়তে গেল।

চরম বিপদের সময় মানুষের মাথায় ঠিক একটা বুদ্ধি এসে যায়। আমি এতক্ষণ যা ভাবিনি তাই করে ফেললাম। ছোটমাসিকে পেছন দিকে ঠেলে ফেলে দিয়ে আমি ঘরের মধ্যে ঢুকে এলাম। একটানে আমার গা থেকে জামাটা খুলে ছুঁড়ে দিলাম সাপটার দিকে। সাপটা রাগ করে জামাটার ওপরে ছোবল মারতে গিয়ে তার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে গেল। তার রাগী ফোঁস ফোঁস শব্দ শোনা যেতে লাগলো শুধু। আমি এক হাতে বাবলুকে ধরে ফেলে চেঁচিয়ে বললাম, ছোটমাসি, লাঠি আনো! শিগগির, লাঠিটা—

কিন্তু আনতে হলো না। তক্ষুণি রাস্তায় শুনতে পেলাম প্যাঁ পোঁ বাঁশির আওয়াজ। সাপ খেলানো বাঁশি। আমি এবার আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম, ছোটমাসি—

তার আগেই ছোটমাসি ছুটে গেলেন রাস্তার দিকে।

সেই মেয়ে সাপুড়েটি আসছিল। ছোটমাসি গিয়ে তার হাত ধরে ব্যাকুলভাবে বলতে লাগলেন, শিগগির আও, কামরামে একঠো সাপ…তুম পাকড়ো, তুমকো দশ টাকা…বিশ টাকা দেগা…

কাঁধের ঝাঁপি নামিয়ে ছুটে এলো সাপুড়েনী। জামটার কাছে গিয়ে বসে পড়ে বাজাতে লাগলো তার বাঁশিটা। একটু বাদেই জামার ভেতর থেকে ফস করে যেই সাপটা ফণা উঁচু করলো অমনি সাপুড়েনীটি দারুণ রেগে গিয়ে বললো, আরে কালুয়া!

সাপুড়েনীটি বাঁশিটা ডান দিকে বাঁ দিকে নাড়তে লাগলো আর সাপটাও মাথা দোলাতে লাগলো সেই সঙ্গে। তারপর সে এক ফাঁকে খপ করে ধরে ফেললো সাপটার মাথা। বকুনি দিয়ে বললো, আরে কালুয়া! বদমাশকা বাচ্চা!

আমরা অবাক।

সাপুড়েনীটি সাপটাকে ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, কালসে হামি ঢুঁড়ছি এই সাপটাকে। বদমাশটা যে কখন ভেগে গেল!

ছোটমাসি বললেন, অ্যাঁ?

বাবলুও কান্না থামিয়ে চোখ গোল গোল করে তাকালো।

সাপুড়েনী একগাল হেসে বললো, হ্যাঁ মাঈজী, কাল এই রাস্তার উধারে এক কোঠিতে খেলা দেখালাম, তার মধ্যে কখন এই বদমাশটা ভেগে গেল!

সাপুড়েনী এই মাত্র উপকার করলো সেটা ভুলে গিয়ে দারুণ রেগে গেলেন ছোটমাসি, চোখ পাকিয়ে বললেন, অ্যাঁ? তুই সাপ ছেড়ে দিয়েছিস এ পাড়ায়? আর একটু হলে আমার ছেলেকে কামড়াতো! তোকে আমি পুলিশে দেবো!

সাপুড়েনীটি বললো, ইসকো তো বিষ নেই আছে! এই দেখিয়ে না।

সে একটা হাত মুঠো পাকিয়ে সাপটার মুখে মারতে লাগলো বার বার। সাপটা কামড়ালো না, মুখটা ফিরিয়ে নিতে লাগলো। শুধুই তাই নয়, বাইরে এসে সাপুড়েনী সাপটাকে মাটিতে ছেড়ে দিতেই সে সরসরিয়ে ঢুকে গেল একটা ঝাঁপির মধ্যে। তখন আর সন্দেহ রইলো না যে সেটা সত্যিই পোষা সাপ।

ছোটমাসি তবু বললেন, তোকে এক পয়সাও বখশিশ দেবো না! তোর সাপ কেন আমার ঘরে ঢুকবে? আর একটু হলে আমি হার্টফেল করেছিলাম। উঃ। এখনো বুক ধড়াস ধড়াস করছে।

কিন্তু আমার একটা খটকা লাগলো। একই রকম সাপ কয়েক দিনের মধ্যে ওই একই ঘরে ঢুকে পড়লো? দ্বিতীয়টা তাহলে প্রতিশোধ নিতে আসেনি? আমি সাপুড়েনীকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার ক’টা সাপ পালিয়ে গিয়েছিল?

সে অবাক হয়ে বললো, কাঁহে বাবু? এই একঠো।

আমি বললাম, তোমার দুটো সাপ হারায়নি? ঠিক বলছো; তাহলে কয়েকদিন আগে আমাদের বাড়িতে আর একটা সাপ এসেছিল কি করে? ঠিক এইরকম সাপ?

সাপুড়েনী চোখ কপালে তুলে বললো যে, সেকথা তো সে জানে না! সে কসম খেয়ে বলছে, তার এই একটা মাত্র সাপই হারিয়েছিল। তাও কাল সন্ধেবেলা। চারদিন আগে তো সে বেনারসে ছিলই না। সে চলে গিয়েছিল রামনগর। তাছাড়া এরকম আর একটা সাপ আসবে কি করে? এ তো পাহাড়ী জাতের সাপ, এ তো এখানে পাওয়া যাবে না। তাকে যতই বলি যে ঠিক ওই রকম একটা সাপ আমরা সত্যিই মেরেছি, সে অবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা দোলায়। এর মধ্যে শুকদেও এসে পড়েছে। আমি বললাম, শুকদেও, মাঠের মধ্যে ওকে সেই মরা সাপটা দেখিয়ে দাও তো।

শকুদেও সাপুড়েনীকে নিয়ে গেল মাঠের মধ্যে। সাপটা সেখানে নেই! না থাকতেই পারে, চারদিন কেটে গেছে, এর মধ্যে কাক চিল শকুনি খেয়ে ফেলেছে নিশ্চয়ই। সাপুড়েনীটি হেসে হেসে মাথা দোলাতে লাগলো। আমরা তাকে মাত্র পাঁচ টাকা বখশিশ দিয়ে বিদায় করে দিলাম।

ব্যাপারটা একটু রহস্যময় রয়ে গেল।

সন্ধেবেলা ছোটমেসো বাড়ি ফেরার পর সবিস্তারে সব বলা হলো তাঁকে। তিনি প্রথমে বিশ্বাস করতে চান না। পর পর দুটো সাপ একই ঘরে? যাক, তিনি নতুন বাড়ি দেখে এসেছেন, সামনের রবিবারই সেখানে চলে যাওয়া হবে।

ছোটমাসি বললেন, দুপুরে তখন কেউ ছিল না। তবু ভাগ্যিস সুনীলটা ছিল, ওই তো সাহস করে জামাটা ছুঁড়ে দিয়েছিল, নইলে কী যে হতো! আমার তো মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল একেবারে।

ছোটমেসো হেসে বললেন, হুঁ, একে তো পোষা সাপ, তার ওপর বিষ নেই, তার সামনে যাওয়া আর এমন কি? আমি থাকলে ওটাকে খপ করে ধরে ফেলতাম।

ছোটমাসি বললেন, তখন কি আমরা জানতাম যে ওটার বিষ নেই কিংবা পোষা?

ছোটমেসো বললেন, ও দেখলেই বোঝা যায়। তোমরা তো সাপ চেনো না, আমি চিনি। জীবনে কত সাপ দেখেছি!

কিছু না বুঝে বাবলুও হাসতে লাগলো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *