জোড়া পাপী

জোড়া পাপী

প্রথম পরিচ্ছেদ 

একদিন বৈশাখের রৌদ্রসিক্ত মধুময় প্রভাতে জনমানব-সমাকীর্ণ ধূলিপূর্ণ মহানগরীর একটি থানার কোন নিভৃত প্রকোষ্ঠে বসিয়া আমার এক বন্ধুর সহিত একটা রহস্যপূর্ণ হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে কথা কহিতেছিলাম, এমন সময়ে সহসা টেলিফোনের ঘণ্টা টুং টং করিয়া আকুল আহ্বান করিল। তাড়াতাড়ি চেয়ার হইতে উঠিয়া আমি সেই যন্ত্রের নিকট গমন করিলাম এবং অনুচ্চস্বরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি কে?”

উত্তর হইল “আপনি কে আগে বলুন?” 

আমি নিজের নাম বলিলাম। 

উত্তর হইল, “আমি পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট। চিৎপুর রোডের উপর একটা ভয়ানক হত্যাকাণ্ড হইয়াছে। এখনই একজন সুদক্ষ গোয়েন্দার প্রয়োজন। অপর কোন বিচক্ষণ ডিটেকটিভ উপস্থিত না থাকায় আপনাকেই উহার তদন্ত করিতে যাইতে হইবে। একজন কনেষ্টবলের নিকট অন্যান্য সংবাদ লিখিয়া আপনার থানায় পাঠাইলাম। সে পৌঁছিবামাত্র আপনি গমন করিবেন। প্রথম হইতে তদন্ত না হইলে খুনিকে ধরা যাইবে না। আপনি প্রস্তুত হউন, অধিক বিলম্ব করিবেন না।” 

বন্ধুর সহিত যে বিষয়ের কথোপকথন হইতেছিল, তাহা স্থগিত রাখিয়া দুঃখিতান্তঃকরণে বন্ধুবরকে বিদায় দিলাম। তিনিও থানা হইতে বাহির না হইতে হেড আপিস হইতে সেই কনেষ্টবল আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার নিকট যে পত্র ছিল, তাহা গ্রহণ করিয়া একবার পাঠ করিলাম। বুঝিলাম, অতি প্রত্যূষে ট্রাম লাইনের ঠিক মধ্যে একটি সুন্দরী যুবতীর মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। রমণীকে দেখিয়া ভদ্রঘরের মেয়ে বলিয়াই বোধ হয়। আপনি সেই স্থানে এখনই গমন করিয়া ওই অনুসন্ধানে লিপ্ত হউন। 

মুহূৰ্ত্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া তখনই থানা হইতে বহির্গত হইলাম; এবং একখানি সেকেণ্ড ক্লাস ভাড়াটীয়া গাড়িতে আরোহণ করিয়া অবিলম্বে কাৰ্য্যস্থানে গমন করিলাম। 

গাড়িখানি যখন ঘটনার স্থলে আসিল, তখন বেলা প্রায় আটটা, সেই স্থানে গিয়া দেখিলাম, লোকের ভয়ানক ভিড় হইয়াছে। তাহার মধ্যে স্থানীয় থানার ইনস্পেকটারবাবুও আছেন। 

থানার ইনস্পেকটারবাবু আমার পরিচিত। আমার সহিত তাঁহার বেশ সদ্ভাবও ছিল। এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য আমাকে নিযুক্ত দেখিয়া তিনিও আন্তরিক আনন্দিত হইলেন; এবং আমাকে সেই শবদেহ দেখাইলেন। 

শবদেহ পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, উহা তখনও বিকৃত হয় নাই; গুরুতর আঘাতে উহার নাক, মুখ ও চোখ যেন ছেঁচিয়া গিয়াছে, বক্ষঃস্থল যেন ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। পীনোন্নত পয়োধরযুগলের মধ্যস্থ স্থান যেন একেবারে দমিয়া গিয়াছে। মুখ ও নাসিকা দিয়া অনেক রক্ত বাহির হইয়াছে। 

রমণীকে দেখিয়াই সত্য সত্যই ভদ্রঘরের মেয়ে বলিয়া বোধ হইল। রমণী যুবতী এবং সত্যই অনিন্দ্যসুন্দরী। কিরূপে কোন্ সময়ে এই কাণ্ড ঘটিল জিজ্ঞাসা করায় ইনস্পেকটরবাবু উত্তর করিলেন “বেলা ছয়টার সময় একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ি চিৎপুর রোড দিয়া উত্তর মুখে যাইতেছিল। গাড়িখানি কিছু আস্তে আস্তেই যাইতেছিল। ঠিক সেই সময়ে একখানি ট্রামগাড়ি অতি দ্রুতবেগে দক্ষিণ দিক হইতে উত্তর দিকে যাইতেছিল। ট্রামখানি যখন কিছুদূর দক্ষিণে ছিল, সেই সময়ে সহসা সেই ভাড়াটীয়া গাড়ীর দরজা খুলিয়া গেল এবং নিমেষ মধ্যে ওই সুন্দরী রমণী যেন গতিশীল ট্রামের সম্মুখে নিক্ষিপ্ত হইল। ট্রামখানি সাত আট হাত দূরে ছিল, কিন্তু চালক অত্যন্ত বিচক্ষণ থাকায় সে একেবারে গাড়ির গতিরোধ করিল। সকলেই ভাবিয়াছিল, রমণী বাঁচিয়া গেল। কিন্তু যেরূপ বলে সে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, তাহাতে তাহাকে আর কেহ জীবিত অবস্থায় দেখিতে পায় নাই। পতনমাত্রেই তাহার মৃত্যু হইয়াছিল। ইত্যবসরে পথে লোকে লোকারণ্য হইয়া গেল; এবং সেই ভাড়াটীয়া গাড়ির ভিতর হইতে এক যুবক সহসা সকলের অগোচরে কোথায় যে পলায়ন করিল, তাহা কেহই বলিতে পারিল না। ভাড়াটীয়া গাড়িখানি অগত্যা ধৃত হইয়া থানায় আনীত হইয়াছে। ট্রামগাড়ির নম্বর এবং কণ্ডাক্টার ও চালকের নাম ও নম্বর সমস্তই লিখিত আছে। প্রয়োজন হইলেই তাহারা আসিয়া হাজির হইবে।” 

ইনস্পেকটারবাবুর কথা শুনিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কে সেই ভাড়াটীয়া গাড়ির ভিতর ছিল, তাহা কি জানিতে পারিয়াছেন? এত লোকের চক্ষে ধূলি দিয়া সে কেমন করিয়া পলায়ন করিল বলিতে পারেন?” 

ইনস্পেকটারবাবু বলিলেন “আমি কোচম্যানকে ডাকিতে পাঠাইতেছি। তাহার মুখে সকল কথা শুনিলে এ রহস্য অনেকটা বুঝিতে পারিবেন। সেই স্থানে উপস্থিত লোকদিগের মধ্যে কেহই গাড়ির ভিতরে কোন লোককে দেখে নাই। কিন্তু কোচম্যান বলিতেছে, একজন পুরুষ ও একজন রমণী তাহার গাড়িতে ছিল। সেইজন্যই অনুমান হইতেছে, লোকটা সকলের অগোচরে পলায়ন করিয়াছে।” 

কিছুক্ষণ পরে কোচম্যান আসিয়া উপস্থিত হইল। আমাকে দেখিয়াই সে ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। একে বৃদ্ধ, তাহাতে জীর্ণ শীর্ণ, আমি তাহাকে অভয় দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “কোথা হইতে সওয়ারি লইয়াছিলে?” 

সভয়ে হস্ত যোড় করিয়া কোচম্যান বলিল “আজ্ঞে হাওড়া ষ্টেসন হইতে।” 

আ। কোথায় যাইতেছিলে? 

কো। বাগবাজারে। 

আ। কয়জন সওয়ারি ছিল? 

কো। আজ্ঞে দুইজন, একজন পুরুষ আর একজন স্ত্রীলোক। 

আ। যিনি মারা পড়িয়াছেন, সেই স্ত্রীলোক কি তোমার গাড়িতে ছিল? 

কো। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। পুরুষটি কোথায়? 

কো। আজ্ঞে সে কথা বলিতে পারিলাম না। যখন আমার গাড়ি হইতে স্ত্রীলোকটি পড়িয়া যায়, তখন আমার এত ভাবনা হইয়াছিল যে, অপর কোন কথা আমার মনোমধ্যে স্থান পায় নাই! বলিতে পারি না, কোন্ সময়ে বাবু আমাদের চক্ষে ধূলি দিয়া পলায়ন করিয়াছেন। 

আ। পথে আর কোথাও তোমার গাড়ি থামাইয়াছিলে? 

কো। আজ্ঞে না। বাবু আমাকে সেরূপ করিতে বলেন নাই। 

কিছুক্ষণ চিন্তার পর আমি পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলাম “বাবুর নাম ধাম তোমার জানা আছে?” 

কোচম্যান ঈষৎ হাসিয়া বলিল “না হুজুর! আর কখনও তাহাকে দেখিয়াছি বলিয়া বোধ হয় না। বাবু বোধ হয় কোন দূর দেশ হইতে আসিয়াছেন।” 

আ। বাবুর সঙ্গে কোন জিনিষপত্র ছিল না? 

কো। ছিল বৈ কি! সমস্তই ত থানায় জমা আছে। 

ইনস্পেকটারবাবু কিছুদূরে বসিয়াছিলেন। কোচম্যানের কথায় সায় দিয়া বলিলেন “হাঁ, একটা ট্রাঙ্ক ও একখানা কম্বলমোড়া একটা বালিস। সম্ভবতঃ বিছানা গাড়ির চালে ছিল, সেগুলি আমারই নিকট আছে। বলেন ত এখানে আনিতে আদেশ করি।”

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

আমার ইঙ্গিত পাইয়া ইনস্পেকটারবাবু তখনই একজন কনেষ্টবলকে সেই সকল দ্রব্য আনয়ন করিতে আদেশ করিলেন। আদেশমাত্র সে ওই সকল দ্রব্য লইয়া আমার নিকটে আসিল এবং আমার সম্মুখে রাখিয়া প্রস্থান করিল। 

আমি তখন অতি মনোযোগের সহিত উহাদিগকে পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। ট্রাকটির চাবি বন্ধ ছিল; সুতরাং সহজে খুলিতে পারিলাম না। অগ্রে অপর চাবি দিয়া খুলিতে চেষ্টা করিলাম, কিন্তু খোলা গেল না। অগত্যা উহাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিবার আদেশ দিলাম। কথামত ট্রাঙ্কটি তখনই ভাঙ্গিয়া ফেলা হইল। ভিতরে খানকয়েক কাপড়, তিনটা জামা, একখানা শাল ও দুইখানা বিছানার চাদর ছিল। আমি প্রত্যেক জিনিষটি তন্ন তন্ন করিয়া পরীক্ষা করিলাম; মনে করিয়াছিলাম, বাবুর নাম ও তাঁহার বাড়ীর সন্ধান পাওয়া যাইবে, কিন্তু ট্রাঙ্কের ভিতরে যে সকল দ্রব্য পাওয়া গেল, তাহাতে আমার অভিপ্রায় সিদ্ধ হইল না। 

ট্রাঙ্কটি বন্ধ করিয়া বিছানাটি পরীক্ষা করিলাম, বালিস, কম্বল, বালিসের ওয়াড় প্রভৃতি একে একে সকলগুলিই বিশেষ করিয়া দেখিলাম, কিন্তু তাহাতেও কোন ফল হইল না। 

বিছানার সঙ্গে একখানি পাখা ছিল। আর আর সকল দ্রব্য দেখিবার পর সেই পাখাখানি আমার নয়ন গোচর হইল। আমি তখনই উহা গ্রহণ করিলাম, এবং বিশেষ সতর্কতার সহিত ইহার উভয় দিক লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ দেখিবার পর আমার অভিপ্রায় সিদ্ধ হইল। পাখার একটি কোণে অতিক্ষুদ্র করিয়া “নরেন্দ্রনাথ মুখো,  হাটখোলা” এই কয়টি কথা লেখা ছিল। আন্তরিক আনন্দিত হইয়া আমি ওই নাম ও ঠিকানা মনে করিয়া রাখিলাম এবং পাখাখানিও পুনরায় যথাস্থানে রক্ষা করিলাম। ইনস্পেকটারবাবুও আমার এই নূতন আবিষ্কারের বিষয় জানিতে পরিলেন না। আমিও তখন সে কথা আর কাহাকেও বলিতে সাহস করিলাম না। 

আরও কিছুক্ষণ ইনস্পেকটারবাবুর সহিত কথা কহিয়া আমি কোচম্যানকে বিদায় দিলাম। তাহার মুখেই শুনিয়াছিলাম, গাড়িখানি হাওড়া ষ্টেসনের নিকটস্থ হোসেন আলি নামক সর্দ্দারের আস্তাবলে থাকে! 

এখন কি প্রকারে যে এই খুনের আস্কারা করিব, তাহার কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। কিরূপে কাহার দ্বারা রমণী সেই গতিশীল গাড়ি হইতে নিক্ষিপ্ত হইলেন, কে তাহার সঙ্গে ছিল? তিনিই বা কোথায়, কেমন করিয়া পলায়ন করিলেন, এই সকল প্রশ্নের কোন সদুত্তর করিতে পারিলাম না। 

পাখার উপর যে লোকের নাম লেখা ছিল, রমণীর সহিত তাহার সম্বন্ধ কি? তিনিই কি রমণীকে হত্যা করিবার সংকল্প করিয়া ওইরূপে ফেলিয়া দিয়াছিলেন? 

এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিয়া ভাবিলাম, যতক্ষণ না সেই লোকের সন্ধান করিতে পারিতেছি, ততক্ষণ এই খুনের আস্কারা করিতে পারিব না। এই স্থির করিয়া আমি ইনস্পেকটারবাবুর নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

আমার হঠাৎ মনে পড়িল, কলিকাতায় যেমন হাটখোলা আছে, ফরাসডাঙ্গা চন্দননগরে সেই প্রকার একটি স্থানকে হাটখোলা বলে। বাবুটির নাম নরেন্দ্রনাথ মুখো, ব্রাহ্মণ-সন্তান। যদি কলিকাতার হাটখোলায় তাঁহার বাড়ী হইত, তাহা হইলে তিনি হাওড়া স্টেসন হইতে আসিবেন কেন? যখন তিনি হাওড়া ষ্টেসন হইতে গাড়ি ভাড়া করিয়াছিলেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই কোন দূরদেশ হইতে আসিয়াছেন। আর যদি কলিকাতার হাটখোলাতেই তাঁহার বাড়ী হয় এবং তিনি নিজ বাড়ীতেই প্রত্যাগমন করিতেছিলেন, তাহা হইলে কোচম্যানকে বাগবাজারে লইয়া যাইতে বলিবেন কেন? সুতরাং কলিকাতার হাটখোলায় যে তাঁহার বাড়ী নহে তাহা স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম। 

চন্দননগরে যে হাটখোলা আছে তাহাও গঙ্গার তীরে। নরেন্দ্রনাথ কি তবে সেই স্থান হইতেই আসিতেছিলেন? যে রমণী তাঁহার সঙ্গে ছিল, যিনি খুন হইয়াছেন, তাঁহারই বা পিত্রালয় কোথায়? বাগবাজারের কোন্ স্থানে গাড়ি লইয়া যাইবার কথা ছিল, কোচম্যান নিশ্চয়ই সে কথা জানিত না। নতুবা সে নিশ্চয়ই উহা ব্যক্ত করিত। 

এই প্রকার নানা চিন্তায় প্রায় এক ঘণ্টা কাল অতীত হইল। বেলা প্রায় চারিটা বাজিল। আমি অগত্যা চন্দননগরে গিয়া নরেন্দ্রবাবুর সন্ধান লইতে মনস্থ করিলাম। নিকটেই টাইমটেবল ছিল— দেখিলাম, সাড়ে চারিটার সময় একখানি ট্রেন ছাড়ে। সত্বর প্রস্তুত হইয়া একজন কনেষ্টবলকে একখানি সেকেণ্ড ক্লাস গাড়িভাড়া করিয়া আনিতে বলিলাম। 

একবার ভাবিলাম, পুলিশের বেশেই চন্দননগরে যাত্রা করিব, কিন্তু পরক্ষণে আমার মতের পরিবর্ত্তন হইল।—ছদ্মবেশেই যাইতে স্থির করিলাম। তদনুসারে একজন ভদ্রলোকের বেশ ধরিয়া গাড়িতে আরোহণ করিলাম এবং গাড়ি ছাড়িবার দশ মিনিট পূর্ব্বে হাওড়া ষ্টেসনে উপস্থিত হইলাম। তখনই একখানা সেকেণ্ড ক্লাসের টিকিট কিনিয়া যথাস্থানে গিয়া উপবেশন করিলাম। যথা সময়ে গাড়ি হাওড়া স্টেসন ত্যাগ করিয়া অতি দ্রুতবেগে অগ্রসর হইতে লাগিল এবং একে একে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাত আটটি ষ্টেসন ছাড়িয়া একেবারে শ্রীরামপুরে গিয়া থামিল। 

সন্ধ্যার সময় গাড়িখানি চন্দননগর ষ্টেসনে আসিয়া উপস্থিত হইল। ষ্টেসনে নামিয়া একজন রেলওয়ে কুলিকে হাটখোলার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। পরে তাহারই নির্দ্দিষ্ট পথে যাইবার জন্য মনস্থ করিলাম। 

ষ্টেসন হইতে বাহির হইতেছি, এমন সময় একজন যুবক আমার নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল “মহাশয় কি হাটখোলায় যাইবেন?”

সহসা এক অপরিচিত যুবকের মুখে ওই প্রশ্ন শুনিয়া আমি বিস্মিত হইলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি কেমন করিয়া সে কথা জানিতে পারিলেন?” 

ঈষৎ হাসিয়া যুবক বলিল “আপনি যখন সেই কুলিকে জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন, আমি তখন তথায় দাঁড়াইয়া ছিলাম। আপনি তাহাকে হাটখোলার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন সেই জন্যই আমার অনুমান, আপনি ওই স্থানেই যাইতে ইচ্ছা করেন।” 

যুবকের কথায় আমি আন্তরিক লজ্জিত হইলাম, আমি যখন হাটখোলার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তখন আমার কথাগুলি কিছু উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারিত হইয়াছিল, সুতরাং সে কথা যে নিকটস্থ লোকেরা শুনিতে পাইবে তাহাতে আর আশ্চৰ্য্য কি? 

এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি যুবককে বলিলাম “হাঁ মহাশয়, আমি হাটখোলায়ই যাইব। আপনার বাড়ী কোথায়?” 

যু। আমার বাড়ী অত দূরে নয়—পালপাড়া।

আ। সেখান হইতে হাটখোলা কতদূর?

যু। প্রায় অৰ্দ্ধ ক্রোশ। 

আ। আর এখান হইতে? 

যু। প্রায় দেড় ক্রোশ। 

আমি চমকিত হইলাম। ভাবিয়াছিলাম, হাটখোলা নিকটেই হইবে; কিন্তু দেড় ক্রোশ পথ দূর শুনিয়া বড়ই চিন্তিত হইলাম। ভাবিলাম, এতটা পথ পদব্ৰজে যাওয়া বড় সহজ নহে। যুবককে জিজ্ঞাসা করিলাম “ষ্টেসনে গাড়ি নাই কেন? এখানে কি ভাডাটীয়া গাড়ি পাওয়া যায় না?” 

যুবক বলিল “কেন পাওয়া যাইবে না? আজ বোধ হয় কোন কারণ বশতঃ এখানকার গাড়িগুলি ভাড়া হইয়া গিয়াছে। তাই ষ্টেসনে গাড়ি দেখা যাইতেছে না। কিন্তু আপনার যদি বিশেষ প্রয়োজন হয় নিকটেই আস্তাবল আছে। সেখানে অন্ততঃ দুই তিনখানি গাড়ি পাইবেন। তবে ভাড়া বোধ হয় কিছু বেশী লাগিবে।” 

আ। কি করিব? রাত্রে শেষে কোথায় যাইতে কোথায় যাইব? আপনি যদি একখানি গাড়িভাড়া করিয়া দেন, তাহা হইলে বড় উপকৃত হই। আর আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে আপনিও অনায়াসে তাহাতে যাইতে পারিবেন। 

যু। আপত্তি কিছুই নাই। আপনি এই দোকানে বসুন, আমি শীঘ্রই একখানি গাড়িভাড়া করিয়া আনিতেছি। এই বলিয়া যুবক পার্শ্বস্থ একখানি দোকান প্রদর্শন করিল, এবং তখনই তথা হইতে প্রস্থান করিল। আমিও নির্দ্দিষ্ট দোকানে গিয়া উপবেশন করিলাম। 

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল। সাঁজের আঁধার সমস্ত পৃথিবীকে গ্রাস করিয়াছিল। একে কৃষ্ণপক্ষ, তাহার উপর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় অন্ধকারের মাত্রা দ্বিগুণ হইয়াছিল। সহরে যেমন গ্যাসের আলোক থাকে, চন্দননগরে সেরূপ নাই। মধ্যে মধ্যে এক একটা কেরোসিনের আলোক মিট মিট করিয়া জ্বলিতেছিল। তাহাদের ক্ষীণ আলোকে পল্লিগ্রামের পথ দিয়া কলিকাতাবাসীর যাতায়াত করা যে কি কষ্টকর, তাহা ভুক্তভোগীমাত্রেই অনুভব করিতে পারেন। অনেক দিন পূর্ব্বে আমি আর একবার চন্দননগরে গিয়াছিলাম। কিন্তু সে রাত্রে নহে। রাত্রিকালে সেই অপরিচিত স্থানে কোথায় বাস করিব, তাহাও সহসা স্থির করিতে পারিলাম না। 

যে যুবক আমার জন্য গাড়ি আনিতে গিয়াছিলেন, তিনি আমার সহিত যে প্রকার ব্যবহার করিতেছেন, তাহাতে তাঁহাকে সজ্জন বলিয়াই বোধ হইল। নতুবা পরের জন্য তিনি সেই রাত্রে অত কষ্ট করিতে স্বীকার করিবেন কেন? 

সে যাহা হউক, সেই দোকানে বসিয়া আমি নানাপ্রকার চিন্তা করিতেছি, এমন সময় একখানা গাড়ি লইয়া সেই যুবক প্রত্যাগমন করিলেন। আমি তখনই দোকানদারের নিকট বিদায় লইয়া গাড়ির উপর আরোহণ করিলাম। যুবক গাড়িতেই ছিলেন, আমাকে উঠিতে দেখিয়া অবতরণ করিতেছিলেন। আমি বাধা দিয়া তাঁহাকে সেই গাড়িতে যাইতে অনুরোধ করিলাম। তিনি অনেকবার আমার কথা কাটাইলেন কিন্তু আমার নির্ব্বন্ধাতিশয় দর্শনে অবশেষে সম্মত হইয়া আমার পার্শ্বে উপবেশন করিলেন। কোচম্যান হাটখোলার দিকে শকট চালনা করিল। 

কিছুদূর গমন করিলে পর আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার নাম কি? যিনি এই বিপদে আমার এত সাহায্য করিলেন, তাঁহার নাম না জানিতে পারিলে মনে বড় দুঃখ হইবে।” 

ঈষৎ হাসিয়া যুবক বলিলেন “আমার নাম পীতাম্বর চক্রবর্ত্তী।”

আ। পালপাড়াতেই আপনার বাড়ী? 

পী। আজ্ঞে হাঁ-পুরুষানুক্রমে ওইখানেই বাস করিয়া আসিতেছি।

আ। আপনার পিতামাতা বর্তমান? 

পী। আজ্ঞে না, তাঁহারা বহুদিন হইল স্বর্গে গমন করিয়াছেন। 

আ। তবে আপনিই এখন অভিভাবক? 

পী। আজ্ঞে না, আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আছেন। 

আ। উভয়ের একই সংসার? 

ঈষৎ হাসিয়া যুবক উত্তর করিলেন “আজ্ঞে হাঁ, এখনও ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই হয় নাই। সহরে যেমন ইচ্ছা করিলেই লোকে স্বতন্ত্র হইতে পারে, পল্লিগ্রামে সেরূপ হয় না। এখানকার লোকদিগের কিছু চক্ষুলজ্জা আছে বলিয়া বোধ হয়।” 

আ। আপনারা তবে দুই ভাই? 

পী। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। আপনার সন্তান-সন্ততি কি?

পী। একটি পুত্র ও একটি কন্যা।

আ। আর আপনার জ্যেষ্ঠের? 

পী। তিনি নিঃসন্তান। 

আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম “সেইজন্যই আপনারা এখনও এক সংসারে আছেন। যদি কখনও আপনার জ্যেষ্ঠের পুত্র সন্তান জন্মে, তখন আমার কথার যাথার্থ্য বুঝিতে পারিবেন।” 

যুবকও হাসিয়া বলিলেন “তাঁহার আর সে আশা নাই—তিনি গৃহশূন্য!”

আ। যদি আবার দারপরিগ্রহ করেন? 

যু। সে বয়সও নাই। 

আ। তাঁহার বয়স কত? 

যু। প্রায় পঞ্চাশ বৎসর। 

আমি হাসিয়া বলিলাম “এত বেশী বয়স হয় নাই। ব্রাহ্মণ-সন্তান মুমূর্ষু অবস্থাতেও বিবাহ করেন শুনিতে পাওয়া যায়। আপনার দাদা এখন ওইরূপ বলিতেছেন বটে, কিন্তু ভবিষ্যতে তাঁহার মতিগতি কি হইবে কে জানে? 

যু। তিনি আমারই পুত্রকে পোষ্যপুত্ররূপে গ্রহণ করিয়াছেন। 

আ। সে কি! পোষ্যপুত্রের প্রয়োজন কি? আপনার পুত্রই ত আপনাদের উভয় ভ্রাতার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হইবে। 

যু। কারণ আছে। দাদার স্ত্রী তাঁহার পৈতৃক বিষয়ে উত্তরাধিকারিণী হইয়াছিলেন। সম্পত্তি নিতান্ত সামান্য নহে, প্রায় বিশ হাজার টাকা হইবে। তিনি যখন ওই সম্পত্তি গ্রহণ করেন, তখনই আমার পুত্রকে পোষ্যপুত্ররূপে লইয়াছিলেন এবং তাহারই নামে সেই সমস্ত বিষয় উইল করিয়া দেন। 

এইরূপ কথাবার্তায় গাড়িখানি পালপাড়ায় আসিয়া উপস্থিত হইল। কোচম্যান উপর হইতে বলিল “বাবু, পালপাড়ায় কাহার বাড়ীতে যাইব?” 

আমি যুবকের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি আর আমার জন্য কষ্ট করেন কেন? তবে কোচম্যানকে ভাল করিয়া বলিয়া দিন, যেন সে ভবিষ্যতে কোনরূপ গোলযোগ না করে।” 

আমার কথা শুনিয়া যুবক কি চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন “কেমন করিয়াই বা আপনাকে একা ছাড়িয়া দিই। আপনার সহিত আলাপ করিয়া পরম আপ্যায়িত হইয়াছি। যেখানে আপনি যাইতেছেন তাহা কি আপনার পরিচিত? আপনি কি পূর্ব্বে আর কখনও সেখানে গিয়াছিলেন?” 

যুবকের প্রশ্নে সহসা আমার মুখ দিয়া সত্য কথাই নির্গত হইল। আমি বলিলাম “আজ্ঞে না।” 

যু। যদি বিশেষ প্রয়োজন না থাকে, তাহা হইলে আজ রাত্রে কেন আমাদের বাড়ীতেই আসুন না। ব্রাহ্মণের বাড়ীতে একরাত্রি বাস করিলে কোন ক্ষতি হইবে না বোধ হয়। কথায় কথায় আপনার নাম পর্য্যন্ত জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম। 

আমি নাম বলিলাম; কিন্তু প্রকৃত নাম গোপন করিলাম। পদবীর পরিবর্তন করিলাম না। 

আমার কথা শুনিয়া যুবক সাগ্রহে বলিলেন “তবে আর কি ‘ব্রাহ্মণস্য ব্রাহ্মণো গতিঃ’ আপনি যখন ব্রাহ্মণ, তখন আর আমাদের বাড়ীতে যাইতে আপত্তি কি?” 

আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “আপত্তি কিছুই নাই, তবে কাজটা কিছু জরুরি -আজ আমায় সেখানে যাইতেই হইবে।” 

কিছুক্ষণ চিন্তার পর যুবক বলিলেন “বেশ কথা—কিন্তু আজ ত আর আপনি স্বস্থানে ফিরিতে পারিবেন না? আপনি কোথা হইতে আসিতেছেন?” 

আ। কলিকাতা। 

যু। তবে ত এ রাত্রে কলিকাতা প্রত্যাগমন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। এখন রাত্রি প্রায় আটটা, হাটখোলা গিয়া কাৰ্য্য শেষ করিয়া স্টেসনে ফিরিতে অন্ততঃ দশটা বাজিয়া যাইবে। তখন ত আর গাড়ি পাইবেন না। এখান হইতে রাত্রি সাড়ে নয়টার সময় কলিকাতায় শেষ ট্রেন যায়। 

আমিও চিন্তিত হইলাম। সেই রাত্রে কেমন করিয়া একা অপরিচিত স্থানে বাস করিব, তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। পরে যুবকের বাড়ীতেই সে রাত্রি বাস করিতে স্থির করিলাম। তাঁহাকে বলিলাম “যদি আর ট্রেন না থাকে, তাহা হইলে অগত্যা আমাকে এখানে থাকিতে হইবে। এই অপরিচিত স্থানে আপনি আমার যেরূপ উপকার করিতেছেন, তাহাতে আপনার অনুরোধ রক্ষা না করা নিতান্ত মূর্খের কার্য্য। কিন্তু যে কার্য্যের জন্য এতদূর আসিয়াছি অগ্রে তাহা শেষ না করিয়া আপনার বাড়ীতে যাইতে পারিব না।” 

আমার কথায় যুবক অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন। তিনি আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞাসা করিলেন “হাটখোলায় কাহার বাড়ীতে যাইবেন?” 

যুবকের কথায় ও কাৰ্য্যে আমি এত সন্তুষ্ট হইয়াছিলাম যে, তাঁহার নিকট সে কথা গোপন করিতে ইচ্ছা রহিল না। আমি বলিলাম “হাটখোলায় নরেন্দ্রনাথবাবুর বাড়ীতে যাইব। আপনার সহিত তাঁহার আলাপ আছে কি?” 

কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া যুবক উত্তর করিলেন “আজ্ঞে না, চিনিতে পারিতেছি না। আমাদের বাড়ী হইতে হাটখোলা অনেকটা দূর। হাটখোলার সকল লোকের সহিত আমাদের আলাপ থাকা একপ্রকার অসম্ভব। তবে আমিও আপনার সঙ্গে যাইতেছি, উভয়ে মিলিয়া শীঘ্রই উহার সন্ধান করিতে পারিব।” 

আমি আন্তরিক প্রীত হইলাম এবং ক্রমাগত হাটখোলার দিকে যাইতে লাগিলাম। কোচম্যান উপর হইতে বলিল “বাবু, বড় দুৰ্য্যোগ—আপনাদের ছাতাটা একবার দিন। ঝড় উঠিয়াছে, এখনই বৃষ্টি আসিবে।” 

উভয়েরই নিকট ছাতা ছিল–আমি আমার ছাতাটা কোচম্যানকে দিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে একবার আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। দেখিলাম, একখানি ভয়ানক কৃষ্ণবর্ণ মেঘ সমস্ত আকাশ ছাইয়া ফেলিয়াছে। একটিও তারকা নয়ন গোচর হইল না। এতক্ষণ প্রকৃতি নিস্তব্ধ ছিল – গাছের পাতাটি পর্যন্ত নড়ে নাই। সহসা দূর হইতে একপ্রকার সোঁ সোঁ শব্দ উত্থিত হইল। দেখিতে দেখিতে পথের ধূলিকণা মেঘাকারে উড়িতে লাগিল, মধ্যে মধ্যে দামিনী চমকিতে লাগিল, সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক গৰ্জ্জনও হইতে লাগিল। মড় মড় শব্দে বৃক্ষের বড় বড় শাখাগুলি ভাঙ্গিতে লাগিল। প্রকাণ্ড মহীরুহ সকল দুলিতে দুলিতে ভূমিসাৎ হইতে লাগিল। ক্রমে দুই এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়িতে লাগিল। 

কোচম্যান ঝড়ের সময় অতি কষ্টে শকট চালনা করিয়াছিল। কিন্তু যখন বৃষ্টির প্রকোপ বৰ্দ্ধিত হইল, তখন সে অশ্বরজ্জু সংযত করিয়া এক প্রকাণ্ড আম্রবৃক্ষের তলায় আশ্রয় গ্রহণ করিল। সৌভাগ্যক্রমে গাড়িতে যে দুইটা লণ্ঠন ছিল, তাহারা কখনও নির্বাপিত হয় নাই। একটি গাড়ির বাহিরেই রহিল, অপরটি গাড়ির ভিতরে লইলাম। চারিদিকে ভয়ানক অন্ধকার, আর সেই মুষলধারে বর্ষণের মধ্যে আমরা তিনটি মানব এক নিবিড় আম্রবৃক্ষের তলায় আশ্রয় লইয়া কত কি ভাবিতে লাগিলাম। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

সুখের পর দুঃখ আর দুঃখের পর সুখ এ জগতের ইহাই এক চিরন্তন প্রথা। নিরবচ্ছিন্ন সুখ যেমন কাহারও অদৃষ্টে ঘটে না, নিরবচ্ছিন্ন দুঃখও তেমনই কাহাকেও ভোগ করিতে হয় না। পর্যায়ক্রমে সুখ-দুঃখ না আসিলে লোকে সুখের প্রয়াসী হয় না এবং দুঃখ তত কষ্টকর বলিয়া বোধ হয় না। দুঃখ আছে বলিয়াই সুখের এত আদর-সুখের জন্য লোকে এত লালায়িত। 

কিছুক্ষণ ভয়ানক অশান্তির পর প্রকৃতি ক্রমেই শান্তমূর্তি ধারণ করিল। যে আকাশ এতক্ষণ দুর্ভেদ্য নিবিড় জলদজালে আবৃত ছিল, দেখিতে দেখিতে তাহা পরিষ্কার হইল। সেই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেঘমালা কোথায় অদৃশ্য হইল। আকাশে অগণন তারকারাজি শোভা পাইতে লাগিল। যে পবন এতক্ষণ সংহার-মূর্ত্তি ধারণ করিয়া দিক্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া শন্ শন্ শব্দে প্রকাণ্ড মহীরুহ ধ্বংস করিতেছিল, প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেও শান্ত হইল—প্রবল প্রভঞ্জন মূর্ত্তি ত্যাগ করিয়া মলয়মারুত মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিল। কোচম্যান পুনরায় শকট চালনা করিল। 

জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, সেখান হইতে হাটখোলা যাইতে হইতে আরও এক কোয়ার্টার সময় লাগিবে। পল্লিগ্রামের পথ, সেইমাত্র মুষলধারে বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, পথে আলোকের অভাব ইত্যাদি নানা কারণে আরও অধিক সময় লাগিবার সম্ভাবনা দেখিয়া আমার সঙ্গী সেই যুবক অতি বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন “মহাশয়, আজ রাত্রিও অনেক হইল, তাহার উপর এই দুর্যোগ, কেন এত কষ্ট স্বীকার করিবেন? যখন আজ আপনাকে এখানেই থাকিতে হইল, তখন কাল প্রাতেই সেখানে গিয়া সেই বাবুর সহিত দেখা করিবেন।” 

যুবকের কথাই যুক্তিসঙ্গত বলিয়া বোধ হইল। এতক্ষণ সেই ঝড়বৃষ্টি সহ্য করিয়া মনে মনে বড়ই বিরক্ত হইয়াছিলাম। ভাবিতেছিলাম, কি কুক্ষণেই সেদিন কলিকাতা ত্যাগ করিয়াছি। কিন্তু স্বয়ং সে কথা ব্যক্ত করিতে লজ্জা বোধ করিতেছিলাম। এখন যুবকের কথা শুনিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “এখান হইতে আপনার বাড়ী কতদূর?” 

যু। প্রায় অৰ্দ্ধ ক্রোশ; কিন্তু যখন এতদূর আসিয়াছি তখন আর আপনাকে আমাদের বাড়ীতে যাইতে হইবে না। নিকটেই আমার এক বন্ধুর বাড়ী আছে। তিনি বেশ সঙ্গিতসম্পন্ন অথচ দেবদ্বিজে তাঁহার বেশ ভক্তিও আছে। যদি আপনার অমত না হয়, তাহা হইলে আজ রাত্রে সেইখানেই বাস করা যাউক। 

আ। এখান হইতে কতদূর? 

যু। এই বাগানের পরবর্ত্তী বাগানে তাঁহার প্রকাণ্ড অট্টালিকা, তিনি সেখানে একাই বাস করেন। আ। সস্ত্রীক? 

যু। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। আপনিও কি আজ রাত্রে সেখানে থাকিবেন? 

যু। সে আপনার ইচ্ছা, যদি আপনি এখানে একা থাকিতে ইচ্ছা না করেন, তাহা হইলে অদ্য আমাকেও থাকিতে হইবে। 

আ। কিন্তু আপনার বাড়ীতে কি মনে করিবেন, তাঁহারা আপনার জন্য না জানি কতই উদ্বিগ্ন হইবেন। 

যুবক হাসিয়া বলিলেন “আজ্ঞে না, আমি একজন ভৃত্যকে বাড়ী পাঠাইয়া দিব। তাহার মুখে তাঁহারা সকল কথাই জানিতে পারিবেন।” 

আমি সম্মত হইলাম। তখন সেই যুবকের পরামর্শমত কোচম্যানের ভাড়া মিটাইয়া দিয়া তাহাকে বিদায় দিলাম। পরে আমরা দুইজনে মন্থরগমনে সেই অন্ধকারময় পথ দিয়া পরবর্ত্তী উদ্যানের দিকে গমন করিলাম এবং অনতিবিলম্বে এক প্রকাণ্ড উদ্যানের ফটকে প্রবেশ করিলাম। 

ফটকের দুই পার্শ্বে দুইটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহ ছিল। সম্ভবতঃ ঘর দুইখানি দ্বারবান্দ্বয়ের বাসস্থান। আমরা উভয়ে উদ্যানে প্রবেশ করিবামাত্র একজন জিজ্ঞাসা করিল “কোথায় যান বাবু! কাহাকে খুঁজিতেছেন?” 

আমার সঙ্গী সেই যুবক যেন বিরক্তির সহিত বলিয়া উঠিলেন “সারদাবাবু বাড়ীতে আছেন? আমাকে কি চিনিতে পার নাই রামসদয়?” 

যে লোক প্রশ্ন করিয়াছিল, যুবক যাহাকে রামসদয় বলিয়া সম্বোধন করিলেন, যুবকের কথায় অত্যন্ত লজ্জিত হইল। অতি বিনীত ভাবে বলিল “কেও, পীতাম্বরবাবু! এই দুর্যোগে আপনি এখানে? আপনাকে চিনিতে পারি নাই ক্ষমা করিবেন।” 

যুবক সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “তোমার বাবু কোথায়?” 

রা। তিনি উপরেই আছেন। এতক্ষণ নীচে ছিলেন, ভয়ানক ঝড়বৃষ্টি, উপরে গিয়াছেন। 

যু। একবার ডাকিয়া দাও আর নীচেকার বৈঠকখানার দরজা খুলিয়া দাও। 

রা। আপনিও উপরে যান, আজ কেন ও কথা বলিতেছেন? 

যু। আমি একা হইলে তোমায় কষ্ট দিতাম না। আমার সঙ্গে একজন বাবু আছেন দেখিতেছ না। 

রামসদয় তখনই যুবকের আদেশ পালন করিল। 

কিছুক্ষণ পরেই একজন সম্ভ্রান্ত যুবক স্বহস্তে একটা প্রজ্বলিত হ্যারিকেন ল্যাম্প লইয়া আমাদের নিকট আগমন করিলেন, এবং আমার সঙ্গীকে দেখিয়া শশব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হে পীতাম্বর! এই দুর্যোগে এখানে কেন?” 

যুবক সকল কথাই ব্যক্ত করিলেন। পরে বলিলেন “বাবুকে আজ রাত্রের মত তোমার বাড়ীতে আশ্রয় দিতে হইবে। আমাদের বাড়ীতেই ইঁহাকে লইয়া যাইতেছিলাম কিন্তু সেও ত এখান হইতে অনেক দূর। এই দুর্যোগে রাত্রিকালে পল্লিগ্রামের পথ দিয়া এতটা পথ যাওয়া বড় সহজ কথা নহে। সেইজন্যই অগত্যা তোমার আশ্রয়ে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।” 

তিনি বলিলেন, “তুমিও কেন আজ এখানে থাক না—আমি একজন ভৃত্য তোমার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিতেছি।” যুবক সম্মত হইলেন। তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন “বাবুরও ইচ্ছা সেইরূপ।” 

তিনি সাগ্রহে বলিলেন, “আমার পরম সৌভাগ্য যে, আজ রাত্রে তোমাদের মত দুইজন ব্রাহ্মণ আমার গৃহে অতিথি।” 

এই বলিয়া তিনি তখনই নীচেকার বৈঠকখানার দ্বার খুলিয়া আমাদিগকে বসিতে অনুরোধ করিলেন। আমরাও তাঁহার কথামত কার্য্য করিলাম। তখন তিনি আমাদের আহারাদির বন্দোবস্ত করিবার জন্য উপরে গমন করিলেন। 

কিছুক্ষণ উপবেশন করিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “বাবুর কি সন্তান সন্ততি নাই?” 

যুবক বলিলেন “আজ্ঞে হাঁ, আছে বৈ কি? দুইটি কন্যা, একটি পুত্র। কন্যা দুইজনেই বিবাহিত; উভয়েই এখন শ্বশুরালয়ে। পুত্রটির বয়স পাঁচ বৎসরের অধিক নহে, সে হয় ত এখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে।” 

আ। এই বাবুরই নাম কি সারদাচরণ? 

যু। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। ব্রাহ্মণ-সন্তান? 

যু। আজ্ঞে হাঁ—কিন্তু তত্রাপি দেবদ্বিজে অশেষ ভক্তি। বিশেষ বয়োজ্যেষ্ঠ ও গুণী লোকের সম্মান রক্ষা করিতে তিনি মুক্তহস্ত। 

আ। বাড়ীতে বাবুর স্ত্রী ব্যতীত আর কোন রমণী আছেন? 

যু। এক দূর-সম্পর্কীয় বিধবা ভগ্নী—বলিতে গেলে তিনিই সংসারের গৃহিণীস্বরূপ। তাঁহার বিনানুমতিতে কেহ কোন কার্য্য করিতে সাহস করেন না। 

এই প্রকার কথোপকথন হইতেছে, এমন সময়ে সারদাচরণ তথায় আগমন করিলেন এবং কিছুক্ষণ অন্যান্য কথাবার্তার পর আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন “আপনার ন্যায় লোকের উপযুক্ত আহারাদি সংগ্রহ করা আমার ক্ষমতার বহির্ভূত। আজ আপনার বিশেষ কষ্ট হইতেছে দেখিতেছি।” 

আমি হাসিয়া বলিলাম “অমন কথা বলিবেন না, আমার এই সঙ্গীর মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে আপনাকে পরম সৌভাগ্যবান বলিয়াই বোধ হয়। আপনি যদি আমার ন্যায় দরিদ্রের আহার দিতে না পারিবেন, তবে পারিবে কে? সামান্য শাকান্ন হইলেই আমি পরম পরিতুষ্ট হইয়া থাকি।” 

সারদাচরণও হাসিতে হাসিতে বলিলেন “আহারের জন্য ভাবি না, কিন্তু সত্যই আজ আপনার শয়নের বড় কষ্ট হইবে।” 

আমি বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “কেন—এই বৈঠকখানায় স্বচ্ছন্দে শয়ন করিয়া রাত্রিযাপন করিব। আপনার কোন চিন্তা নাই। যেমন করিয়াই হউক, যখন আপনার আশ্রয়ে আসিয়া পড়িয়াছি, তখন আমার কোন কষ্ট হইবে না।” 

সারদাবাবু বলিলেন “আপনি অতি সজ্জন, তাই ও কথা বলিতেছেন। কিন্তু আপনাকে কেমন করিয়া এই বৈঠকখানায় শয়ন করিতে বলিব। উপরে দুই তিনটি ঘর আছে—তাহারই একটিতে আপনি শয়ন করিবেন। তবে ঘরগুলি প্রত্যহ ব্যবহার হয় না বলিয়া কিছু অপরিষ্কার।” 

বাধা দিয়া আমি বলিলাম “সেজন্য আপনার কোন চিন্তা নাই—আমার জন্য আপনি ব্যস্ত হইবেন না। আমাকে বন্ধু মনে করিবেন। বাস্তবিকই আজ এই ভয়ানক বিপদে আপনার সাহায্য পাইয়া আপনাকে পরম বন্ধু বলিয়া মনে করিতেছি।” 

সারদাবাবু হাসিলেন– কোন উত্তর করিলেন না। তখন অন্যান্য কথা আরম্ভ হইল। কথায় কথায় জানিতে পারিলাম, সারদাচরণের পুত্রটি পীড়িত। 

কিছুক্ষণ পরে সারদাচরণ বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন এবং অনতিবিলম্বে ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত হইয়াছে। 

আমরা উভয়েই গাত্রোত্থান করিলাম এবং তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে উপরে উঠিলাম। সিঁড়ি হইতে উঠিয়া সম্মুখেই একটি অনতিক্ষুদ্র দালান দেখিতে পাইলাম। তাহারই মধ্যস্থলে আর একটি হ্যারিকেন ল্যাম্প জ্বলিতেছিল। তাহার সম্মুখে তিনখানি থালে নানাপ্রকার খাদ্যদ্রব্য সজ্জিত রহিয়াছে। সারদাবাবু অগ্রে আমাকে, পরে পীতাম্বরকে এক একখানি আসনে বসিতে অনুরোধ করিলেন এবং স্বয়ং অবশিষ্ট আসনে উপবেশন করিলেন। 

কলিকাতায় বনিয়াদী বড়লোকেরা সচরাচর রাত্রে যেরূপ আহার করিয়া থাকেন, সারদাবাবু আমাদের জন্য সেই সকল আহার্য্যের আয়োজন করিয়াছিলেন। আমি বাস্তবিকই ক্ষুধাৰ্ত্ত হইয়ছিলাম, পরম পরিতোষ সহকারে সেগুলির সদ্ব্যবহার করিলাম। 

আহারাদি সমাপ্ত হইলে আমরা পুনরায় নীচে আসিলাম। সারদাচরণও আমাদের সহিত আসিলেন। কিছুক্ষণ গল্প-গুজবের পর অধিক রাত্রি হওয়ায় সকলেই গাত্রোত্থান করিলাম। সারদাচরণ আমাকে শয়ন-গৃহে লইয়া গেলেন, পীতাম্বরও সেই গৃহে শয়ন করিবেন বলিয়া আমাদের অগ্রে অগ্রে যাইতে লাগিলেন। 

সারদাচরণ যে গৃহে আমাদিগকে লইয়া গেলেন, সেই ঘরখানি বেশ বড়। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে পনর কিম্বা ষোল হাতের কম নহে। ঘরের মধ্যে দুইখানি খাটের উপর দুইটি শয্যা ছিল। একটি টেবিলের উপরে এক আলোকাধার হইতে মিট্‌ মিট্‌ করিয়া আলোক জ্বলিতেছিল। সেই সামান্য আলোকে ঘরখানি প্রায় অন্ধকারময় বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সারদাচরণ আমাদিগকে সেই শয্যা দেখাইয়া দিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন, যেন শয়নের পূর্ব্বে আলোক নির্ব্বাপিত করা হয়। 

পীতাম্বরের অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়াছেন। আমিই তাঁহাকে অগ্রে শয়ন করিতে অনুরোধ করিলাম। তিনিও তখনই খাটের উপর গিয়া শয়ন করিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে আমিও আলোক নির্ব্বাপিত করিয়া অপর খাটখানির নিকট গমন করিলাম। আমরা যাইবার পূর্ব্বেই খাট দুইখানির উপর শয্যা রচিত হইয়াছিল। প্রত্যেক বিছানার উপর একটি করিয়া মসারিও ফেলা ছিল। 

মসারির দরজা খুলিয়া আমি যখন শয্যায় শয়ন করিলাম, তখনই আমার মস্তক বিঘূর্ণিত হইল; আমি সহসা যেন এক অন্ধকূপের মধ্যে পড়িয়া গেলাম এবং নিমেষ মধ্যে হতচেতন হইয়া পড়িলাম। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

কতক্ষণ যে সেই অবস্থায় পড়িয়া ছিলাম, বলিতে পারি না, কিন্তু যখন আমার জ্ঞান সঞ্চার হইল, তখন বুঝিতে পারিলাম, আমার সর্ব্বাঙ্গে ভয়ানক বেদনা হইয়াছে, মুখ ও ললাটে হাত দিয়া দেখিলাম, তখনও সেই সকল স্থান হইতে রক্ত ঝরিতেছে। 

কিছুক্ষণ সেই ভাবে পড়িয়া থাকিয়া ভাবিলাম, কেন এমন হইল? পীতাম্বর কে? কেনই বা সে ষ্টেসন হইতে আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিতেছে? পূর্ব্বে তাঁহার কথাবার্তা শুনিয়া অত্যন্ত পরোপকারী বলিয়া মনে করিয়াছিলাম; কিন্তু এখন তাঁহাকে একজন ভয়ানক বিশ্বাসঘাতক দস্যু বলিয়া বোধ হইল। সারদাচরণই বা কে? উভয়ের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনপ্রকার ষড়যন্ত্র ছিল। নতুবা দুইটি শয্যার মধ্যে পীতাম্বর যে শয্যায় শয়ন করিল, সেটির ত কোনরূপ গোলযোগ ছিল না, সে ত অনায়াসে আমার সাক্ষাতে শয্যায় গিয়া শয়ন করিল। আর আমিই বা পড়িলাম কেন? শয্যাটি এরূপ ভাবে রচিত হইয়াছিল যে, আমি শয়ন করিবামাত্র একেবারে অন্ধকূপে পতিত হইব। কি ভয়ানক কৌশল! কি অদ্ভুত রহস্য!! কি ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতকতা!!! 

একটি একটি করিয়া অনেকগুলি দিয়াশলাই পোড়াইলাম, কিন্তু সে স্থান হইতে বহির্গত হইবার কোন উপায় দেখিতে পাইলাম না। ভাবিলাম, এইরূপেই কি আমার জীবন শেষ হইবে? যেমন করিয়া পারি, সেখান হইতে উদ্ধার হইবে, মনে মনে এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিলাম। 

কথায় বলে, ইচ্ছা থাকিলে পথ পাওয়া যায়। কথাটা মিথ্যা নহে। অনেক চেষ্টার পর, আমি দেখিলাম, সম্মুখে এক অতি সঙ্কীর্ণ পথ। দাঁড়াইতে চেষ্টা করিলাম, পারিলাম না। আরও কিছুক্ষণ সেই স্থানে পড়িয়া রহিলাম, পরে অনেক কষ্টে বসিয়া বসিয়া সেই পথে গমন করিলাম। প্রত্যেক পদবিক্ষেপে আমার পদদ্বয় কদমাক্ত হইতে লাগিল, পচা দুর্গন্ধ যেন চতুর্গুণ বৃদ্ধি হইল, আমার বমি হইবার উপক্রম হইল; কিন্তু আমি কিছুতেই পশ্চাৎপদ হইলাম না। 

অল্প অল্প করিয়া কিছুদূর অগ্রসর হইলে পর, সহসা শীতল বায়ু আমার দেহ স্পর্শ করিল। এতক্ষণ সেই দুর্গন্ধ ও একপ্রকার উত্তপ্ত বায়ুর মধ্যেই ছিলাম, শীতল বায়ু সেবনে মনে স্ফূর্ত্তি হইল। আমি উৎসাহিত হইয়া আরও অগ্রসর হইতে লাগিলাম। 

এইরূপে আরও খানিক দূর গমন করিয়া একটি ভাঙ্গা দরজা আমার নয়নপথে পতিত হইল। প্রজ্বলিত দিয়াশলাই-এর কাটীর সাহায্যে আমি সেই দ্বারের নিকট উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, একটা প্রকাণ্ড নারিকেল বৃক্ষ ভাঙ্গিয়া সেই দ্বারে পতিত, সম্ভবতঃ সেই পতনশীল নারিকেল বৃক্ষের ভরেই দরজাটি ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। 

দ্বার উন্মুক্ত দেখিয়া আমি নিমেষ মধ্যে তথা হইতে বহির্গত হইলাম। দেখিলাম, আমি একটা উদ্যানের ভিতর আসিয়া পড়িয়াছি। বাগানটি কাহার? যে বাগানে আমার এই দুর্দ্দশা হইয়াছিল, সেখান হইতে কতদূরে আসিয়া পড়িয়াছি? তখন রাত্রিই বা কত? কোথায় যাইলে অবশিষ্ট রাত্রিটুকু নির্বিবাদে অতিবাহিত করিতে পারিব? এই সকল প্রশ্ন তখন আমার মনোমধ্যে উদিত হইতে লাগিল। আমি আর আলোক জ্বালিতে সাহস করিলাম না। কোনরূপে সেই বাগান হইতে বহির্গত হইয়া এক সরকারী পথে উপস্থিত হইলাম, এবং সেই পথ দিয়া ক্রমাগত পূৰ্ব্বমুখে যাইতে লাগিলাম। 

প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টা কাল এই প্রকারে গমন করিবার পর, আমি গঙ্গাতীরে উপস্থিত হইলাম। নিকটেই স্নানের জন্য একটি ঘাট, আমি সেই ঘাটের এক নিভৃতস্থানে গিয়া উপবেশন করিলাম এবং কত কি চিন্তা করিতে লাগিলাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

কোন কাৰ্য্য দেখিয়া তাহার ফল অনুমান করা যায় না। এই যে কিছুক্ষণ পূর্ব্বে ভয়ানক ঝড় ও বৃষ্টিতে না জানি কতই কষ্ট ভোগ করিলাম এবং মনে মনে ঈশ্বরকে শত শত গালি দিলাম, তাহার ভিতর মঙ্গলময় যে আমার উদ্ধারের উপায় করিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহা কি তখন জানিতে পারিয়াছিলাম? তখন কি জানিতাম যে, সেই ঝড়ে নারিকেল বৃক্ষটি পড়িয়া যাইবে এবং সেই পতনে ওই অন্ধকূপের সুড়ঙ্গদ্বার ভাঙ্গিয়া যাইবে? কখনও না। তাই বলিতেছি, মঙ্গলময়ের কার্য্য সমস্তই মানবের মঙ্গলের জন্য। আমরা সামান্য প্রাণী, তাঁহার কার্য্যের কি বুঝিব? 

দেখিতে দেখিতে রাত্রি প্রভাত হইল। ঊষার আলোক প্রকটিত হইবামাত্র আমি মখাদি প্রক্ষালন করিলাম। যে যে স্থানে ক্ষতবিক্ষত হইয়া গিয়াছিল, গঙ্গার জলে সেই সকল স্থান উত্তমরূপে ধৌত করিলাম এবং কাপড় ভাল করিয়া পরিধান করিয়া বসিয়া রহিলাম। 

কিছুক্ষণ পরেই এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ একখানি নামাবলী গায়ে দিয়া হরিনাম করিতে করিতে ঘাটে আগমন করিলেন। বৃদ্ধ হইলেও ব্রাহ্মণের বেশ ক্ষমতা ছিল। তাঁহার শরীর বেশ দৃঢ় ও সবল বলিয়া বোধ হইল। ঘাটে আসিয়া ব্রাহ্মণ আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন এবং আমাকে অপরিচিত দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়ের বাড়ী কোথায়? এত প্রত্যূষে স্নান করিতে আসিয়াছেন?” 

ব্রাহ্মণের মিষ্ট কথায় আমি তাঁহার নিকটে যাইলাম। পরে অতি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম “আমি স্নান করিতে আসি নাই, আর আমার বাড়ীও চন্দননগরে নহে। নরেন্দ্রনাথ মুখো নামে একজন লোকের সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে আমি কলিকাতা হইতে এতদূরে আসিয়া পড়িয়াছি। কিন্তু যৎপরোনাস্তি চেষ্টা করিয়াও তাঁহার কোন সন্ধান পাইতেছি না।” 

আমার কথায় ব্রাহ্মণ আরও বিস্মিত হইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন “কে নরেন—হাটখোলার নরেনবাবু?” শশব্যস্ত হইয়া আমি বৃদ্ধের কথায় সায় দিলাম। বলিলাম “আপনি যথার্থই অনুমান করিয়াছেন। যদি তিনি আপনার পরিচিত হন, তাহা হইলে দয়া করিয়া আমাকে তাঁহার বাড়ী দেখাইয়া দিলে উপকৃত হইব।” 

ব্রাহ্মণ হাসিয়া বলিলেন “সে কি কথা! আমার স্নান শেষ হইলে যখন বাড়ী যাইব, তখন আপনিও আমার সঙ্গে যাইবেন। নরেনবাবুর বাড়ী আমাদেরই বাড়ীর নিকট। আশ্চর্য্য এই যে, আপনি এত চেষ্টা করিয়াও তাঁহার ন্যায় সজ্জনের সন্ধান পাইলেন না।”

এই বলিয়া ব্রাহ্মণ স্নানার্থে গমন করিলেন, আমিও তাঁহার অপেক্ষায় সেই স্থানে বসিয়া রহিলাম। 

প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টা কাল গঙ্গাগর্ভে থাকিয়া ব্রাহ্মণ ঘাটে উঠিলেন। পরে সেখানে আহ্নিক জপ প্রভৃতি সমাধা করিয়া আমার নিকটে আসিয়া বলিলেন “এইবার চলুন।” 

প্রায় অৰ্দ্ধ ক্রোশ পথ গমন করিবার পর এক প্রকাণ্ড দ্বিতল অট্টালিকার সম্মুখে তিনি দণ্ডায়মান হইলেন এবং আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন “ইহাই নরেনবাবুর বাড়ী।” 

ব্রাহ্মণের কথা শেষ হইতে না হইতে একজন গৌরকান্তি হৃষ্টপুষ্ট প্রৌঢ় সেই অট্টালিকার দ্বার উদ্ঘাটন করিলেন, এবং সম্মুখেই আমার সমভিব্যাহারী ব্রাহ্মণকে দেখিয়া অতি বিনীত ভাবে বলিলেন “আজ আমার সুপ্রভাত, নতুবা এই প্রাতে আপনার ন্যায় সাধুব্যক্তির শ্রীচরণ দেখিতে পাইব কেন?”

বাধা দিয়া ব্রাহ্মণও হাসিতে হাসিতে বলিলেন “উভয়তঃ, প্রত্যূষে আপনার ন্যায় সজ্জনের সহিত সাক্ষাৎ হওয়া সামান্য ভাগ্যের কথা নহে। এখন ও সকল কথা ছাড়িয়া দিন, এই বাবু আপনার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন।” এই বলিয়া ব্রাহ্মণ প্রস্থান করিলেন। নরেন্দ্রনাথ আমার নিকট আসিয়া অতি নম্র ভাবে বলিলেন “মহাশয়ের নাম?” 

আমি প্রকৃত নাম না বলিয়া আর একটি নাম বলিলাম কিন্তু পদবীর পরিবর্তন করিলাম না। 

“কোথা হইতে আসা হইতেছে?” 

“কলিকাতা।” 

“কি জন্য?” 

সে সকল কথা সকলের সমক্ষে বলা উচিত নহে।” 

“তবে আসুন, বাড়ীর ভিতরে আসুন।” 

এই বলিয়া আমাকে লইয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন এবং নীচের একখানি ঘরে বসিতে অনুরোধ করিলেন। নরেন্দ্রবাবুকে দেখিয়া এবং তাঁহার সহিত কথাবাৰ্ত্তা কহিয়া তাঁহাকে অতি সজ্জন বলিয়াই বোধ হইল। তিনি যে সেই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডে যোগদান করিবেন, তাহা আমার বিশ্বাস হইল না। কিন্তু একবার প্রবঞ্চিত হইয়া তাঁহার ন্যায় দেব চরিত্রের উপরেও সন্দেহ জন্মিল। ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “আপনার একখানি পাখা আমার হস্তগত হইয়াছে। তাহাতে আপনার নাম ধাম লেখা আছে। সেই লেখা দেখিয়া আমি এতদূরে আসিয়া আপনার সন্ধান পাইয়াছি।” 

নরেন্দ্রনাথ অধিকতর আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “আমার পাখা? আমার এক প্রজা আমায় দুইখানি করিয়া তালপাখা দিয়া থাকে। আমি প্রতিবারই উহাদের উপর নিজের নাম ধাম লিখিয়া থাকি। কিন্তু আমার পাখা আমাদের বাড়ীতেই ত আছে।” 

আমি বলিলাম “আপনি অনুগ্রহ করিয়া একবার দেখিয়া আসুন, আপনার পাখা ঘরে আছে কি না?” 

নরেন্দ্রনাথ তখনই বাড়ীর ভিতর গমন করিলেন এবং অনতিবিলম্বে প্রত্যাগমন করিয়া বলিলেন “না মহাশয়! দুইখানি পাখার মধ্যে একখানি রহিয়াছে–অপরখানি আমার স্ত্রী এক দূর-সম্পর্কীয়া ভগিনীকে দিয়াছেন। সম্ভবতঃ সেই পাখাখানিই আপনি দেখিয়া থাকিবেন।” 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “তাঁহার বাড়ী কোথায়?” 

ন। চন্দননগরে। 

আ। এখান হইতে কতদূর? 

ন। অধিক দূর নহে—প্রায় এক ক্রোশ হইবে। 

আ। তাঁহার স্বামীর নাম? 

ন। কেশবচন্দ্র শৰ্ম্মা। 

আ। তাঁহার সহিত এখন সাক্ষাৎ হইতে পারে? 

ন। সে কথা ঠিক বলিতে পারিলাম না। একবার আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসি। 

এই বলিয়া তিনি ভিতরে গেলেন। ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন “না মহাশয়, তাঁহার সহিত আর এখানে দেখা হওয়া অসম্ভব, তিনি পরশ্ব রাত্রের ট্রেনে কলিকাতায় গিয়াছেন।” 

আ। সস্ত্রীক? 

ন। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। তবেই হইয়াছে, তাঁহার স্ত্রী আর এ জগতে নাই। 

আমার কথায় বাধা দিয়া নরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন “সে কি! কি ভয়ানক সংবাদ দিতেছেন? বাড়ীতে জানিতে পারিলে এখনই যে একটা তুমুল কাণ্ড হইবে!” 

নরেন্দ্রবাবুকে আর কোন কথা গোপন করা যুক্তিসিদ্ধ মনে করিলাম না। কেবল গত রাত্রের কথা ছাড়া আর সকল কথাই একে একে ব্যক্ত করিলাম। 

নরেন্দ্রনাথ অতি মনোযোগের সহিত আমার সকল কথা শুনিলেন। পরে অতি বিষণ্ণ ভাবে উত্তর করিলেন “এ সেই কেশবেরই কার্য্য! বিবাহ করিয়া অবধি সে একদিনের জন্য স্ত্রীকে সুখী করে নাই। যতদিন বিবাহ হয় নাই, ততকাল সে একপ্রকার ছিল কিন্তু বিবাহের পর তাহার স্বভাব পরিবর্ত্তিত হইল। এদিকে পাড়ার লোকেও তাহাকে একঘরে করিল। একদিন শুনিলাম, সৌদামিনীকে লোকে উড়ের মেয়ে বলিয়া যৎপরোনাস্তি নিন্দা করিতেছে। এবং সেইদিন হইতে সৌদামিনী কিম্বা কেশব আর কোথাও নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে যায় না।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “সত্যই তিনি উৎকলবাসীর কন্যা?” 

নরেন্দ্রনাথ ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন “আজ্ঞে না—তাঁহার পিতা বহুদিন উড়িষ্যায় বাস করিয়াছিলেন, এই অপরাধে তাঁহাকে জাতিচ্যুত হইতে হইয়াছিল।” 

আ। কেশববাবু কি তাহার কোন প্রতিবাদ করেন নাই? 

ন। কিছুমাত্র না—তিনি স্বয়ংই ওই কথা লোকের নিকট বলিয়া বেড়াইতেন। 

আ। আমাকে কেশবচন্দ্রের বাড়ীটা দেখাইয়া দিন। 

নরেন্দ্রনাথ সম্মত হইলেন। অনেকদূর যাইবার পর নরেন্দ্রনাথ অনতিদূরে একখানি ক্ষুদ্র অট্টালিকা প্রদর্শন করিয়া বলিলেন “ওই যে কেশবচন্দ্র দরজায় দাঁড়াইয়া?” 

আমি সেইদিকে গমন করিলাম এবং কেশবচন্দ্রকে সবলে ধারণ করিয়া বলিলাম “কি মহাশয়! আমাকে চিনিতে পারেন?” 

আমার কণ্ঠস্বরে কেশব চমকিত হইলেন, তিনি আমার আপাদমস্তক লক্ষ্য করিলেন। পরে অতি বিমর্ষভাবে বলিয়া উঠিলেন “কি সৰ্ব্বনাশ, আপনি এখনও জীবিত আছেন?” 

আমি সে কথা গ্রাহ্য করিলাম না। সম্মুখেই একগাছি বড় দড়ী দেখিতে পাইয়া তাহার সাহায্যে কেশবকে উত্তমরূপে বন্ধন করিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম “এখন আপনার বন্ধু কোথায় বলুন। কেন না তিনিও আমার জীবন সংহার করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। বিশেষতঃ তাঁহার উদ্যানে যে মানুষ মারা কল আছে, তাহা ভাঙ্গিয়া না ফেলিলে আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে না।” 

দেখিত দেখিতে সেই স্থানে লোকে লোকারণ্য হইল। সমাগত সকলেই কেশবের বিপক্ষ বলিয়া বোধ হইল। তাহারা সকলেই কেশবকে নানাপ্রকার গালি দিতে লাগিল। 

কেশব কোনমতেই তাঁহার বন্ধুর কথা বলিলেন না। কিন্তু তাহা জানিতে আমার বিশেষ কষ্ট হইল না। উপস্থিত লোকদিগের মধ্যে একজন আমায় সাহায্য করিতে স্বীকৃত হইলেন। তিনি তখনই থানা হইতে কয়েকজন কনেষ্টবল লইয়া একেবারে সারদাচরণের উদ্যান-বাটিকায় গমন করিলেন এবং সহসা তাঁহাকে ধৃত করিয়া বন্দী করতঃ আমার নিকটে আনয়ন করিলেন। 

তখন দুই বন্দী লইয়া আমি থানার দারোগার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম এবং বন্দীদ্বয়কে তাঁহার জিম্মায় রাখিয়া ও তাঁহাকে সমস্ত ঘটনা বলিয়া তাঁহার নিকট বিদায় লইলাম। 

দারোগা সাহেব অতি ভদ্রলোক। তিনি সত্বর বন্দীদ্বয়কে কলিকাতায় প্রেরণ করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন। 

সময়মত দারোগাবাবু উভয়কেই কলিকাতায় আনয়ন করিলেন ও এখানকার প্রধান কর্ম্মচারীর সহিত পরামর্শ করিয়া সারদাচরণের নামে হত্যা করিবার উৎযোগ এই অভিযোগ উপস্থিত করিলেন। পরে অনুসন্ধানে দারোগাবাবু সারাদচরণের সমস্ত লীলা প্রকাশ করিয়া দিলেন। তাঁহার স্ত্রী পুত্র কেহই ছিল না, একজন বেশ্যা লইয়া তিনি ওই বাগানে বাস করিতেন। সারদাচরণের দলের সমস্ত লোকই ধৃত হইয়া উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হইল। 

কেশবচন্দ্র পরিশেষে সমস্ত কথা স্বীকার করেন ও কহেন, লোক গঞ্জনায় ও জাতিচ্যুত হওয়ার নিমিত্তই তিনি গাড়ির ভিতরেই তাঁহার স্ত্রীকে হত্যা করেন ও পরিশেষে চলিত ট্রামের সম্মুখে তাহাকে ফেলিয়া দিয়া, গাড়ি হইতে অবতরণ পূর্ব্বক ভিড়ের ভিতর লুকাইয়া পড়েন। কিন্তু সেই স্থান হইতে পলায়ন করেন না। আমি যখন পাখা পরীক্ষা করি, তিনি দেখিতে পান এবং আমি কোন্ পথ অবলম্বন করি, তাহাই লক্ষ্য করিতে থাকেন। পরিশেষে আমি যে ট্রেনে চন্দননগরে গমন করি, তিনিও সেই ট্রেনে গমন করিয়া আমার অগ্রেই ষ্টেসন হইতে বাহির হইয়া পড়েন। পরিশেষে কৌশল করিয়া আমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া, আমাকে যে উপায়ে হত্যা করিতে প্রবৃত্ত হন, তাহা পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন। 

যথাসময়ে কেশবচন্দ্রের বিচার হয়, বিচারে তিনি চরম দণ্ডে দণ্ডিত হন। 

সম্পূর্ণ 

[ চৈত্র, ১৩১৬ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *