জোড়াসাঁকোর সিংহ – পূর্ণেন্দু পত্রী
এবারে এক সিংহের গল্প৷
হিন্দু কলেজের একজন শিক্ষক একদিন দু-টি ছাত্রকে কী যেন বোঝাচ্ছেন৷ দু-টি ছাত্রই মনোযোগ দিয়ে শুনছে৷ এমন সময় একজন ছাত্র পিছন থেকে পাশের ছাত্রটির মাথায় সজোরে মারলে এক চাঁটি৷ ছেলেটি উঠল চমকে৷ ধমকে উঠলেন শিক্ষকমশায়৷
-‘একি! তুমি ওকে অকারণে চাঁটি মারলে কেন?’
ছাত্রটির সবিনয় উত্তর, ‘স্যার, আমি জাতিতে সিংহ৷ তাই নিজের স্বভাবটা ছাড়তে পারিনি৷’
চাঁটি খেয়ে সহপাঠী ছাত্রটি সম্ভবত কেঁদেছিল৷ চাঁটির স্বপক্ষে এমন অকপট স্বীকারোক্তি শুনে শিক্ষকমশায় সম্ভবত হেসেছিলেন৷
চাঁটি-মারা ছাত্রটি কিন্তু মিথ্যে কথা বলেনি৷ সে সিংহ পরিবারেরই ছেলে৷ বাবা নন্দলাল সিংহ৷ ডাকনাম সাতুবাবু৷ পেশায় দেওয়ান৷ অগাধ তাঁর বিষয়-সম্পত্তি৷ সুখের জীবন৷ সোনার সংসার৷ জোড়াসাঁকোয় বিরাট অট্টালিকা৷ সম্ভ্রান্ত বংশ৷
শান্তিরাম সিংহ বংশের আদি পুরুষ৷ ছিলেন মুর্শিদাবাদ আর পাটনার দেওয়ান৷ ছিল এমাথা-ওমাথা ছড়ানো বিরাট জমিদারি ওড়িশায়৷ কলকাতার হিন্দু সমাজে যেমন নাম-ডাক তেমনি মান-সম্মান৷ শান্তিরামের দুই ছেলে৷ প্রাণকৃষ্ণ আর জয়কৃষ্ণ৷ জয়কৃষ্ণের ছেলে নন্দলাল৷
আমরা যে সিংহের গল্প শুনতে বসেছি, তিনি এই নন্দলালেরই ছেলে৷ নাম কালীপ্রসন্ন৷ কিছুদিন হিন্দু কলেজের পড়ুয়া৷ পড়তে পড়তে যেই পা পড়ল তেরোয়, অমনি ডাক পড়ল বিয়ের পিঁড়িতে৷ বিয়ে হয়ে গেল মহা ধুমধামে৷ বাগবাজারের কনে৷ বেণীমাধব বসুর মেয়ে৷ ছেলের যখন বিয়ে, বাবা তখন পরলোকে৷ নন্দলালের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হরচন্দ্র ঘোষ৷ ছোটো আদালতের একজন বিচারক৷ তিনিই এখন বন্ধুর সংসারের অভিভাবক৷ কোনো খুঁত রাখলেন না বন্ধুর ছেলের বিয়েতে৷ নাচের আসর জমল বেশ কয়েকদিন ধরে৷ সাহেব-মেমসাহেবদের জন্যে নাচ-গান, খানাপিনার মজলিস৷ দেশীয় বাবুদের জন্যে তুমুল ভোজ৷ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের জন্যে দান-ধ্যান৷
বিয়ের পর বছর তিনেক মাত্র স্কুলে আসা-যাওয়া৷ তারপরই হিন্দু কলেজের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি৷ ছাত্র হিসেবে মোটেই ভালো নয়৷ কিন্তু লেখাপড়ায় আগ্রহী৷ তাই এখন থেকে বাড়িতে গৃহশিক্ষক রেখেই যা কিছু শেখা৷ মিস্টার কার্ক পেট্রিক শেখান ইংরেজি৷ এ ছাড়াও আছে বাংলা আর সংস্কৃতের শিক্ষক৷ তখন ইংরেজিরই দাপদাপট৷ ইংরেজি পোশাক, ইংরেজি চালচলন, ইংরেজি বুলিরই দাম বেশি৷ কালীপ্রসন্ন ইংরেজি শেখেন৷ কিন্তু তাঁর আসল টানটা মায়ের মুখের ভাষার দিকে৷ ঘুমোবার আগে, ঘুম পাড়ানোর জন্যেই ঠাকুমা শোনাতেন নানানরকম রূপকথা-উপকথা৷ মুখে মুখে আউড়ে যেতেন কবিকঙ্কন, কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাসের পয়ার৷ কালীপ্রসন্নর কান বড়ো সজাগ৷ একবার শুনলেই মুখস্থ৷ স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের কাছে সেই সব শুনিয়ে জুটত বাহবা৷ ঘরে এসে মাকে শোনালে জুটত সন্দেশ৷ বেশি সন্দেশ খেলে তোতলা হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে ছাদে উঠে কাকদের ও পায়রাদের ডেকে ডেকে নেমন্তন্ন খাওয়ানো চলত৷ কাক-পায়রারাও সবটা খেতে না পারলে তখন ডাক পড়ত মুঞ্জুরীর৷ মুঞ্জুরী হল সিংহি বাড়ির পোষা বেড়াল৷ দুধের মতো গায়ের রং৷ ক্ষীরের মতো মিষ্টি স্বভাব৷ কালীপ্রসন্নর বড়ো প্রিয় ছিল মুঞ্জুরী৷
কালীপ্রসন্নর যখন ষোলোয় পা, তখন স্ত্রী গেছেন মারা৷ ফলে আবার পরতে হল বিয়ের সাজ৷ আবার বরাসন, ছাঁদনাতলায় শুভদৃষ্টি আর বাসরঘর৷ এবারের কনে রাজা প্রসন্ননারায়ণ দেবের দৌহিত্রী, চন্দ্রনাথ বসুর একমাত্র মেয়ে৷ যে পরিবারে, যেরকম পরিবেশে জন্ম তাতে কালীপ্রসন্নর সাজপোশাক, স্বভাব-চরিত্র অন্যরকম হওয়ার কথা৷ দিনরাত ঘিরে থাকবে মোসাহেবের ঝাঁক৷ তারা থেকে থেকে স্তোত্র পাঠের মতো গুণগান গেয়ে যাবে৷ আর একদিকে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের জটলা৷ তাঁরা থেকে থেকে উচ্চারণ করবে, ক্ষণজন্মা, যোগভ্রষ্ট, আরও নানান রকম মুখরোচক স্তুতি৷ পরনে থাকবে লখনো ফ্যাশানের চুড়িদার পায়জামা, রামজামা, কোমরে দোপাট্টা, পায়ে নাগরা, মাথায় বাঁকা টুপি৷ অথবা সেপাই-পেড়ে ঢাকাই ধুতি, কোমরে রঙিন রুমাল, মাথায় এ্যালবার্ট তেড়ি, কাঁধে শাল, দশ আঙুলে হিরে-মুক্তোর দশটা আংটি৷ সামনে সোনার আলবোলা৷ ডান দিকে পান্না-বসানো ফুরসি৷ বাঁয়ে হিরে-বসানো টোপদার গুড়গুড়ি৷ পিছনে মুক্তো-বসানো পেঁচুয়া৷ মাথায় ঝাড়লন্ঠন, টানাপাখা৷ পায়ের নীচে জরির মছলন্দ৷ এদিকে আতরদান, ওদিকে গোলাপপাশ৷ এদিকে তামাক, ওদিকে গাঁজা৷ সকালে সং, রাত্রে হাফ-আখড়াই৷
এইভাবে তখনকার আর দশটা বড়ো মানুষের ঘরের ছেলের মতোই কালীপ্রসন্নর উচ্ছন্নে যাওয়ার কথা৷ কিন্তু কালীপ্রসন্ন হয়ে উঠলেন দৈত্যকুলের প্রহ্লাদ৷ তিনি চাইলেন বড়ো ঘরের ছেলে নয়, বড়ো দরের মানুষ হতে৷ নিজেকে গড়তে চাইলেন তখনকার সমাজের সেরা মানুষদের আদলে৷
যখন মাত্র তেরো বছর বয়স, গড়লেন এক সমিতি৷ নাম বিদ্যোৎসাহিনী সভা৷ সেখানে প্রবন্ধ পাঠ করেন তখনকার সেরা লিখিয়ে-পড়িয়ে মানুষেরা৷ যেমন প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, কৃষ্ণদাস পাল, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, অক্ষয়কুমার দত্ত৷ তখনকার সভায় বক্তৃতা বা রচনা পাঠ হত সাধারণত ইংরেজিতে৷ কালীপ্রসন্ন সে নিয়ম ভাঙলেন৷ তিনি পড়লেন বাংলা প্রবন্ধ৷
মারা গেছেন ডেভিড হেয়ার৷ তাঁর জন্যে স্মৃতিসভা করতে হবে৷ সকলের আগে কে উদ্যোগী? কালীপ্রসন্ন৷ বললেন, ‘সভা করার জায়গা নেই? আমার বাড়িতে হোক৷’
কলকাতায় তখন নাটকের চেহারাটা ভিখারির মতো৷ জেল্লা নেই, জৌলুষ নেই, শ্রী নেই, স্বাস্থ্য নেই৷ কালীপ্রসন্ন আর তাঁর বিদ্যোৎসাহিনী সভা উঠে-পড়ে লেগে গেল মরা নাটকে ভরা জোয়ার আনতে৷
১৮৫৭, ফেব্রুয়ারি মাস৷ সিমলার আশুতোষ দেবের বাড়িতে অভিনয় হয়ে গেছে শকুন্তলার৷ অভিনয় জমেনি৷ দু-মাস বাদে এপ্রিলে কালীপ্রসন্নর বাড়িতেই তৈরি হল নাটকের দল৷ অভিনয় হল, বেণীসংহার৷ দেশের মাথা-মাথা মানুষ এমনকী সাহেব-সুবোরাও ছুটে এল নাটক দেখতে৷ প্রশংসা পেল৷ তবে মাঝামাঝি ধরনের৷ কালীপ্রসন্ন এবার নিজে অনুবাদ করলেন, বিক্রমোর্বশী৷ বয়স তখন মোটে সতেরো৷ নভেম্বর মাসে অভিনয় হল সে-নাটক৷ কালীপ্রসন্ন নিজে নামলেন পুরুরবার ভূমিকায়৷ তাতে অভিনয় করেছিলেন আর একজন বিখ্যাত মানুষ৷ উমেশ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ভারতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি৷ নাটক দেখে মুখে মুখে, কাগজে কাগজে ধন্য ধন্য রব৷ স্যার সিসিল বিডন তখন ভারত সরকারের সেক্রেটারি৷ তিনি কালীপ্রসন্নর অভিনয় আর নাটক নিয়ে এই উদ্যমের জন্যে প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ দু-বছরে পর অনুবাদ করলেন আর একটা নাটক, মালতীমাধব৷
শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তখনকার কালের একজন পণ্ডিত মানুষ৷ ঠিক করলেন, একটা মাসিক পত্রিকা বের করবেন ইংরেজিতে৷ নাম হবে, ‘মুখার্জিস ম্যাগাজিন৷’ কিন্তু না-আছে টাকা, না-পয়সা৷ থাকার মধ্যে শুধু উদ্যম৷ কথাটা কানে এল কালীপ্রসন্নর৷ তিনি কিনে দিলেন ছাপার মেশিন৷
স্বদেশপ্রাণ বলতে সত্যিই যা বোঝায়, হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় তার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত৷ তাঁর কাগজ, ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’৷ নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গরিব প্রজাদের পক্ষ নিয়ে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-এর পাতায় পাতায় আগুন ছোটাতেন তিনি৷ সিপাহি বিদ্রোহের সময়ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন ভারতবাসীর স্বাধীন মতামত৷ এই হরিশ্চন্দ্র যেদিন মারা গেলেন, দেশের সাধারণ মানুষ চাষাভুষো কেঁদে উঠল ডুকরে৷ যেন মারা গেছে আপনজন কেউ৷ সাধারণ মানুষের বেদনা থেকে জন্ম নিল গান৷
‘অসময়ে হরিশ মল, লংঙের হল কারাগার৷’
হরিশ্চন্দ্রের মৃত্যুর পর ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-এর কী হবে, এই চিন্তায় সকলের কপালে যখন দুশ্চিন্তার রেখা, কালীপ্রসন্ন এগিয়ে এলেন সাহস করে৷ পাঁচ-শো টাকা দিয়ে কিনে নিলেন পত্রিকার স্বত্ব৷ পাঁচ হাজার টাকা দান করলেন হরিশ্চন্দ্রের স্মৃতিরক্ষার জন্যে৷ হরিশ্চন্দ্রের ত্যাগ আর তেজস্বিতার বিষয়ে নিজে লিখলেন ছোট্ট একটা পুস্তিকা৷
অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা লিখেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত৷ তাই নিয়ে সারা দেশে তোলপাড়৷ অল্প কিছু বিদ্বান মানুষ এই নতুনকে জানালেন স্বাগত৷ বাকিরা নিন্দায় মাতিয়ে তুলল আকাশ-বাতাস৷ কালীপ্রসন্নর রক্তে গোঁড়ামি নেই৷ নিজের বিদ্যোৎসাহিনী সভা থেকে আয়োজন করলেন মাইকেল সংবর্ধনার৷ লেখালেন অভিনন্দন পত্র৷ সমবেত হলেন দেশের সুধী মানুষেরা৷ ‘মহাকবি’ সম্বোধন করে কালীপ্রসন্নই প্রথম শিক্ষিত সমাজে পাকা আসন পেতে দিলেন মাইকেলের জন্যে৷
দীনবন্ধু মিত্র লিখেছিলেন ‘নীলদর্পণ’ নাটক, নীলকর সাহেবদের বীভৎস অত্যাচারে চাষিদের লাঞ্ছনা অপমানের জলজ্যান্ত ছাপ ফুটিয়ে৷ সে নাটককে ইংরেজরা যে দু-চক্ষে দেখতে পারবে না সে তো জানা কথাই৷ ইংরেজরা রাগে গরগর করবে জেনেও, মাইকেল মধুসূদন সেটাকে অনুবাদ করলেন ইংরেজিতে৷ পাদরি লং সাহেব সেটা বের করলেন ছেপে৷ তাতে আসল অনুবাদকের নাম ছিল না৷ নাম ছিল, এ নেটিভ৷ ইংরেজের আদালতে বিচার হল তার৷ জরিমানা এক হাজার টাকা৷ লং-এর মাথায় হাত৷ এত টাকা কোথায় পাবেন তিনি! যাঁরা লং-এর গুণমুগ্ধ ভক্ত, বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, তাঁদের মাথায় যেন বজ্রাঘাত৷ কী করে কারাবাস থেকে বাঁচাবেন লংকে! সেই দুঃসময়েই দেখা গেল এক বাঙালি যুবক আদালতের ভিড়ের ভিতর থেকে এগিয়ে আসছেন লং-এর দিকে৷ হাতে টাকার থলি৷ লোকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, কালীপ্রসন্ন৷ তিনি আগে থেকেই অনুমান করে নিয়েছিলেন কী ঘটবে৷ তাই কাউকে না জানিয়ে গোপনে টাকাপয়সা সঙ্গে নিয়ে হাজির ছিলেন আদালতে৷
কালীপ্রসন্নর জীবনে দেশপ্রেমের ঘটনা এক-আধটা নয়, অনেক৷ কিন্তু তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড়ো কীর্তি দুটো৷ এক হল, মহাভারতের অনুবাদ৷ মূল সংস্কৃত থেকে বাংলায়৷ এর পিছনে প্রবল উৎসাহ জুগিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর৷ দ্বিতীয়টা হল ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা৷’ এটা চলতি বা কথ্য ভাষায় লেখা সেকালের আশ্চর্য এক ইতিহাস, সামাজিক দলিল৷ এ বইয়ের জুড়ি নেই আর৷ বড়ো হয়ে পড়বে৷ দেখবে মহাভারতের মতোই অমৃত সমান৷
মাত্র তিরিশ বছরের জীবন৷ তাতেই কত কাজ৷ তিনটে-চারটে পত্রিকার সম্পাদক৷ গোটা পাঁচেক নাটক৷ নানা দিকে দান-ধ্যান৷ মহাভারতের অনুবাদ৷ অজস্র সভা-সমিতির উদ্যোক্তা৷ স্যার ওয়েলস নামের একজন ইংরেজ বাঙালিদের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছিল খারাপ রকমের৷ কালীপ্রসন্নই উঠে-পড়ে মিটিং ডাকলেন এর প্রতিবাদে৷ সই জোগাড় করা হল দশ লক্ষ লোকের৷ বরখাস্ত হতে হল ওয়েলসকে৷ ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লড়ায়ে নেমেছেন অনেকবার৷ তবু ইংরেজরা কালীপ্রসন্নকে সম্মান না দিয়ে পারেননি৷ অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট আর জাস্টিস অব পিস করেছিলেন কয়েকবার৷ কালীপ্রসন্ন সিংহ পরিবারে জন্মেছিলেন বলেই সিংহ নন৷ তিনিই নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন সিংহের বল-বিক্রমে৷ এবার তাঁর জীবনের সবচেয়ে মজার ঘটনাটা শোনো৷
কালীপ্রসন্নর আমলে এই কলকাতা শহরে এমন একদল ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বাস করতেন, যাঁরা যেকোনোরকম প্রগতির বিরুদ্ধে টিকি নাড়তে ওস্তাদ৷ কালীপ্রসন্ন যথার্থ জ্ঞানী ব্রাহ্মণদের কাছে মাথা নীচু করতে রাজি৷ কিন্তু নিছক টিকি-নাড়া টুলো পণ্ডিতদের উপর হাড়ে চটা৷ আর টিকি-নাড়া পণ্ডিতদের জব্দ করার জন্যেই নিজের বাড়িতে বানিয়েছিলেন একটা মিউজিয়াম৷ সেখানে কী থাকত শুনলে হেসে লুটোপুটি খাবে তোমরা৷ থাকত, সরু, মোটা, পাতলা, নধর, কুচকুচে, মুচমুচে, লম্বা, বেঁটে নানান রকমের টিকি৷ বড়ো বড়ো ব্রাহ্মণদের মাথা থেকে কেটে নেওয়া৷ প্রত্যেকটা টিকির গোছার গায়ে আঁটা থাকতো লেবেল৷ আর লেবেলের গায়ে লেখা থাকত কোন টিকির কত দাম৷ কালীপ্রসন্ন বড়ো বড়ো ব্রাহ্মণদের বাড়িতে ডেকে এনে যার যত দাম তা দিয়ে কিনে নিতেন এসব৷ দেখতে দেখতে এমন হল যে সারা দেশে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল, ‘টিকি কাটা জমিদার’৷ টুলো বামুনরা কালীপ্রসন্নর নাম শুনলে ভয়ে ঠকঠক! এই বুঝি ক্যাচ করে কেটে নিলে তাদের কত সাধের টিকিরত্নটি৷
এটা ফোলানো-ফাঁপানো গল্প৷ আসলে ঘটনাটা অন্যরকম৷ কালীপ্রসন্নর বাড়িতে কোনো একটা ব্রত পালনের দিন একজন ব্রাহ্মণকে দান করা হয়েছিল একটা গোরু৷ ব্রাহ্মণ বাড়ি যাবার পথে গোরুটা বিক্রি করে দিয়েছিল এক কসাইকে৷ বাতাসে উড়তে উড়তে সে খবরটা একদিন কানে পৌঁছোল কালীপ্রসন্নর৷ তিনি লোক পাঠিয়ে ডেকে আনলেন ব্রাহ্মণকে৷ আর রেগে গিয়ে নিজের হাতেই কেটে দিলেন তার টিকিটা৷
এই ঘটনাটাই নানা মুখে ঘুরে ঘুরে, ডালপালা ছড়িয়ে হয়ে উঠেছিল ‘টিকি মিউজিয়াম’৷