2 of 2

জোছনার আড়ালে – অমিতকুমার বিশ্বাস

জোছনার আড়ালে – অমিতকুমার বিশ্বাস

কিডা? কিডা ওইহানে?

না—তো, কেউ নেই!

মনের ভুল? হতেই পারে। এরকম তো আকছারই হয়। এই গদ্যগ্রামের সুবিশাল বাঁশবনে এমন তো মনে হওয়া স্বাভাবিক, বিশেষ করে সন্ধের পর—পর।

ঝিঁঝির তীব্র থেকে তীব্রতর ক্রন্দনে ফালাফাল হতে থাকে বাঁশবনে চুঁইয়ে পড়া জোছনার নীল শরীর। আলো—আঁধারির ছায়াছবি নির্জন বনপ্রান্তরে। হাতে টর্চও নেই আজ, থাকলে প্রশ্নের উত্তর ঠিক পেয়ে যেত মাধো।

মাধো, এ—পাড়াগাঁয়েরই ছেলে। রূপমতীর ওপর বাঁশের সাঁকো পার হলেই এই বিস্তীর্ণ বাঁশবন, ওপাশে ওঁদের বাড়ি।

গাঁয়ের নাম মালিপোতা। সেই সকালবেলা কাজে বেরোয় আর ফেরে সন্ধে পার হলে। দু—একদিন বেশ রাতও হয়। বাবা—মা মাঝে মাঝেই বকাবকি করেন, এট্টু আগে ফিরতি পারিস নে?

মাধো রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে। মালিপোতা থেকে মতীগড়ে যায় সাইকেল চেপে, পাঁচ—ছ মাইল ঠেঙিয়ে। পান্তা খেয়ে শান্ত হয়ে গাঁয়ের সুবোধ ছেলে ছোটে, রোজ।

বয়স এই আঠারো কিংবা উনিশ। এই বাঁশেদের ঘন রাজত্ব তাঁকে পার হতেই হয়। দিনের বেলাতেই কেমন গা ছমছম করে, আর রাতের বেলা তো কোনো কথাই নেই। বিশেষ করে জোছনা রাতে এই ছমছম ভাবটা ক্রমশ বেড়ে যায় যেন।

বাবার কথায় সে কেবল হাসে। বিরক্ত হন তাঁরা, রেগেও যান হয়তো।

দুই

তিলির মাঠে অলিম্পিক সার্কাসের তাঁবু পড়েছে। হেমন্তের শুরুতে বাঘ, সিংহ, হাতি, ভালুক, জলহস্তী ইত্যাদি আরও নানান ধরনের পশুপাখি নিয়ে ঝোলাগুড় আর পিঠেপায়েসের মতো বেশ জমে উঠেছে জায়গাটা। কচিকাঁচাদের ভিড় খুব, কৌতূহলও। ভিড় কম নেই বড়োদেরও। রীতিমতো উৎসব পড়ে গেছে। তাঁবুর বাইরে সে এক বিশাল মেলা যেন। জেনারেটার চালিয়ে আলোয় আলোয় শরতের প্রতিমার মতো ঝলমল করছে বিদ্যুৎহীন জনপদ। সারাবছর রোদ—ঝড়—বৃষ্টি—ধুলোয় মলিন গ্রামের বধূটি আজ হঠাৎ—ই যেন রূপসী হয়ে উঠেছে।

সার্কাস এখানে এই প্রথম। মতীগড়ে প্রতি বছর না হলেও, মাঝে মাঝেই আসে। এ—মাসটা পুরো কাটিয়ে দলটি ফিরে যাবে কলকাতা।

তিলির মাঠ মাত্র তেরো মিনিটের সাইকেল—পথ পালিপোতা থেকে, সেখানেই সার্কাস। মাধোর খুব ইচ্ছে সেখানে যাবে, সঙ্গে লতিফও। ওঁরা কখনো বাঘ কিংবা সিংহ দেখেনি নিজের চোখে। এবারে সে সুযোগ এল তবে অবশেষে। কথা হল আগামী মঙ্গলবার দু—জনে কাজ থেকে ফিরে এসে সরাসরি মাঠে চলে যাবে নাইট শো—তে।

লতিফ তাঁর সঙ্গেই কাজ করত। মাঝে মাঝেই একটা কথা লতিফ বলত, যা মাধোর কাছে কিছুটা হলেও রহস্যময় ঠেকেছিল,

—হুনকাবড়া, হুনকাবড়া!

লতিফ নাকি বাঁশবনে হুনকাবড়া—কে দেখেছে!

—হেইডা কী?

—জিন!

—জিন?

—হ!

তিন

বোলিদাপুকুর থেকে ভোরে খবর আসে মাধোর ছোটদাদু খুব অসুস্থ। জায়গাটা তো এখান থেকে চোদ্দো—পনেরো মাইল তো হবেই। এখন বাস পাওয়া যাবে না, তাই সাইকেল নিয়েই হন্তদন্ত হয়ে মাধো ছোটে সেখানে। বাবা—মা বেলা হলে বাসে রওনা দেবেন।

মাধোর কাছে ছোটদাদু মানেই এক রোমাঞ্চকর শৈশব। মামাবাড়িতে সে সবথেকে আদর পেয়ে এসেছে এই মানুষটির কাছ থেকেই। মাটির ঘরে থাকা নিঃসন্তান এই মাটির মানুষটি মাধো ও তাঁর মামাতো ভাই পুটলু—কে গোরুর গাড়িতে চড়িয়ে নিয়ে গেছেন চুন্নিখালের বিলে। বিলের এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চুন্নিখাল। খালটি কিছু দূর গিয়ে মিশেছে রূপমতীর সঙ্গে।

ছোটদাদুর কথায় তাঁদের শৈশবে নাকি চুন্নিখালে খুব শাঁকচুন্নির উৎপাত ছিল। সন্ধ্যার পর খাল থেকে শাঁকচুন্নি উঠে এসে উঁচু কোনো গাছে উঠে উঁকি দিত গৃহস্থের বাড়ি। আর কোনো নববধূকে খোলা চুলে দেখলেই চুল বেয়ে প্রায়ই উঠে আসত বধূটির ঘরে। কিছুদিন সংসারে থাকার পর নানাভাবে ক্ষতি করত সেই পরিবারকে। শেষে শাঁকচুন্নির উৎপাতে বিরক্ত হয়ে পাঁচগাঁয়ের ওঝারা মিলে তাকে গ্রাম থেকে দূরে খালের পাশের শতাব্দী প্রাচীন বটগাছের সঙ্গে মন্ত্রবলে বেঁধে রাখে। সেই থেকে খালের নাম চুন্নিখাল।

বটগাছটা এখনও আছে, দাদুর জমির পাশেই। আকাশের শাখাপ্রশাখা থেকে খসে পড়া অজস্র জারুল ফুলের নীচে দাঁড়িয়ে, শুকিয়ে আসা চুন্নিখালের পাশে দাঁড়িয়ে, বিপুল বিল আর ধানখেতের পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত প্রকাণ্ড অপদেবতার মতো বিকেলের সকল রোদ্দুর শুষে নিচ্ছে যেন প্রাচীন বৃক্ষরাজ। তার ঝুলন্ত শেকড়েই হয়তো সেইসব ওঝাদের মন্ত্র লেগে আছে আজও। আজও হয়তো শাঁকচুন্নির হাত—পা সমস্ত শরীর বাঁধা ওই মন্ত্রেই। শিশু মাধো দূরে দাঁড়িয়ে ভাবে আর চোখ বড়ো বড়ো করে হাত নেড়ে তাঁর থেকে কিছু ছোটো পুটলু—কে সাবধান করত, যেন আর কয় পা ওদিকে রাখলেই শাঁখচুন্নির বিষনজরে পড়তে হবে।

সদ্য জমিতে কেটে রাখা পাকা ধান গোরুগাড়িতে বোঝাই করে তার উপর দু—জনকে চড়িয়ে দিয়েছেন ছোটদাদু, আর নিজে গাড়োয়ানের জায়গায় বসে পাঁচন হাতে সারাটা আঁকাবাঁকা পথ চলতে চলতে শুনিয়েছেন এই খালবিলের কত কত আজবসা কিস্যা। দাদুর ছোটোবেলার গল্প। জিন—পরি—ভূতপেতনির গল্প। জলজঙ্গলে ঘেরা এই বিল যেন একসময় ছিল এইসব অশরীরীদের সাম্রাজ্য। ধানের বিশাল গোছার ওপর চড়ে খরখরে শুকনো জমির ওপর গোরুর গাড়ির চাকায় তৈরি হওয়া স্বল্প জীবনের মতো অল্প দিনের রেখাপথ দিয়ে আসবার সময় গাড়িটির তালে তালে তাঁরাও দুলত বেশ, মাঝে মাঝে ভয়ও পেত, এই বুঝি বটগাছ থেকে ছাড়া পেয়ে শাঁকচুন্নি তাঁদের ঘাড়ে চেপে বসে! ভয়ে একজন আর—একজনের হাত চেপে ধরত অজান্তে, তবু গল্পের প্রতি তাঁদের কৌতূহল একটুও কমত তা না যেন। ছোটদাদু বলেই চলতেন, মাঠের মধ্যে গোরুগাড়ির চাকার মতো আঁকাবাঁকা সুরে, রহস্য করে, তোদের ভয় নাই ভাই, শাঁকচুন্নি কহনও পুলাপানরে ধরে নাই।

দাদু দু—একদিনের মধ্যে সুস্থ হতেই ঘরে ফেরে মাধো।

চার

লতিফ সেদিন একাই কাজে যায়। ফেরে বেশ রাতে। ছাদ—ঢালাই ছিল। ঢালাইয়ের পর খুব খাওয়াল বাড়িওয়ালা। ছাদ দিলে গৃহস্থেরা এমন খাওয়ায় এ—দেশে। তাই রাত।

ফেরার সময় নাকি রূপমতীর দিকে কাউকে হেঁটে আসতে দেখেছে লতিফ। হাঁটতে হাঁটতে লোকটা নেমে গেল বুক জলে!

—মাছ চোর?

—আরে না। আমি চিনিনি বুঝি! ওডা ছিল হুনকাবড়া। আব্বার মুখি শুনিচি। চান্দের আলোয় পষ্ট দ্যাকলাম বুক জলে নেমি গেলো!

—ধুত্তোর! গাঞ্জা খাইচিলিস?

—আরে না! আল্লাহ কসম।

এর ক—দিন পর লতিফের ধুম জ্বর। ভয়ে? হতেই পারে।

জ্বর একটু কমলেই সে আবার ছুটল কাজে। মাধোও গেল। আর চলার পথে তাঁর কথার বিষয় একটাই, হুনকাবড়া। এই অবস্থায় কাজে যেতে বারণ করল মাধো, কিন্তু বসে থাকলে অভাব যে বাঘের ভয়ে জিরাফ—মায়ের মতো সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানের পেছনে লাথি মারে কষে!

অসুস্থ বলেই লতিফকে সেদিন নীচের কাজ দেওয়া হয়েছিল। নীচের কাজটা ছিল একটু কম খাটুনির। কিন্তু দুপুরের টিফিন সারার পর হঠাৎ লতিফকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না দেখে সব্বাই এদিক—ওদিক খুঁজতে লাগল। কেউ একজন বলল, তাঁকে রাস্তার পাশে শিরীষ গাছটার নীচে বসে একা—একা হাসতে দেখেছে। তারপর হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে সে। তাঁকে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করতেই দৌড়ে পালিয়ে যায়!

কিন্তু কোথায়?

ঠিক সেই মুহূর্তে নতুন ছাদ থেকে দুম করে নীচে কিছু একটা পড়ার শব্দ!

সবাই সেদিকে ছোটে।

লতিফ!

রক্তাক্ত!

মিস্ত্রিদের রিকশাভ্যানে হাসপাতালে নিয়ে যেতে—না—যেতেই প্রশ্বাস থেমে গেল চিরতরে। দুপ করে মাটির প্রদীপ নিভে গেল মৃদু হাওয়ায়। নিভে যাওয়া প্রদীপের রক্তলেপা মাথাটা মাধোর কোলে। মুখে শেষবারের মতো একটাই অস্পষ্ট আওয়াজ, হুং—ক্যা—ব…!

কেউ না বুঝলেও মাধো বুঝেছিল লতিফের অসমাপ্ত কথাটা!

কথাটা আজও মাধোর কানে বেজে চলেছে। সেদিন রাতেই দুই বন্ধুর সার্কাসে যাবার কথা ছিল। জীবন—মরণের ট্রাপিজ ছেড়ে প্রিয়জনেদের দেশ ছেড়ে সে এখন অনন্ত মৃত্যুর দেশে মৃতদের সঙ্গে অন্য ট্রাপিজে মেতে উঠেছে হয়তো! এক বৈশাখী দমকা হাওয়ায় সুবিশাল আমগাছটা ফুলো আমসহ ভেঙে পড়ে অনিশ্চিত জীবনের উঠোনে! খই ভাজার ঝাঁঝরি থেকে বাইরে লাফিয়ে পড়া খইয়ের মতো অলক্ষ্যে হারিয়ে যায় লতিফের জীবনপাখি।

ঘটনা বা দুর্ঘটনাটিকে অনেকেই আত্মহত্যা বলে মেনে নিয়েছে। কিন্তু একমাত্র মাধো জানে এ নিছক আত্মহত্যা নয়।

লতিফ চলে যাবার পর মাধোর ভিতরে কিছু পরিবর্তন এসেছে। সে আর আগের মতো রাত করে ফেরে না। সন্ধের আগেই যে করেই হোক ঢুকে যায় ঘরে।

কিন্তু আজ সেতুর মুখে অবনিমাস্টারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই চারিদিক কেমন ঘোর হয়ে আসে। আর ফেরার সময় বাঁশবনের আলো—আঁধারির মধ্যে কাকে যেন নদীর দিকে হাঁটতে দেখে মাধোর বুকটা ধড়াস করে ওঠে!

তবে কি…

পাঁচ

পরদিন খুব সকালে উঠেছিল মাধো। কাজে বের হবার আগে সে মালোপাড়ায় এক চক্কর দিয়ে আসে। সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় দিনুর। দিনু তাঁর পুরোনো বন্ধু। দিনুর বাবা এক সময়ের বড়ো শিকারি। কথায়—কথায় লতিফের প্রসঙ্গ ওঠে। ওঠে হুনকাবড়ার প্রসঙ্গটাও। হুনকাবড়ার কথাটা শুনতেই চমকে ওঠে দিনু, কারণ সে হুনকাবড়ার কথা শুনেছে তাঁর দাদুদের মুখে। দাদুদের সময়ের কেউ কেউ নাকি দেখেছিল। তবে দাদুরা কিংবা তাঁর বাবা, এমনকী সে নিজে কখনো দেখেনি। এখানেই নাকি ঘুরে বেড়ায় এই প্রেতাত্মা। একবার কাউকে দেখা দিলেই ভবলীলা ঘনিয়ে আসে তারা! এমনই তো কথা প্রচলিত এখানে।

দিনুর কথাটা শুনে আঁতকে উঠল মাধো। সে তাহলে কাল রাতে কাকে দেখল? লতিফও কি সেদিন রাতে কিছু দেখেছিল…? তবে কি তাঁরও ভবলীলা ঘনিয়ে এল? বুকের মধ্যে প্রচণ্ড জোরে কী এক ভীষণ বিস্ফোরণ হয়। কীসের…? আর দাঁড়ায় না সেখানে। সোজা বাড়ি ফিরে কাজে ছোটে। সারাটা পথ দুশ্চিন্তার শেকড়বাকড় তাঁকে চেপে ধরে চুন্নিখালের প্রাচীন বটের মতো। ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত শাঁকচুন্নি ছাড়া পেয়ে তাঁকে যেন মাকড়সার মতো জালে বেঁধে খিলখিল করে হাসছে অবিরাম! শুধু সান্ত্বনার মতো ছোটদাদুর কথাটা কানে বাজে, তোদের ভয় নাই ভাই, শাঁকচুন্নি কহনও পুলাপানরে ধরে নাই।

কিন্তু এ তো শাঁকচুন্নি নয়, হুনকাবড়া!

কাজ থেকে বিকেলেই ফেরে সেদিন। বিকেলের রুগণ রোদ্দুরের নীচে বাঁশপাতা—অন্ধকারে দুটো পলাতক শেয়াল ছাড়া তেমন কিছু পড়ে না তাঁর চোখে। ঝিঁঝি ও শেয়াল ডাকে, কাছে—দূরে, আতঙ্কের আবহ ছড়িয়ে। আর আছে রূপমতীর অসংখ্য ব্যাঙেদের ডাক। রোদ্দুরের তেজ কমে এলেই তারা আসর বসায় সারাটা বছর।

এভাবে কয়েকটা দিন কেটে যায়। জীবনের ইরেজার মুছে দেয় মৃতদের! লতিফও মুছে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। এখন তাই মাঝে—মাঝে রাতেও ফেরে মাধো।

ছয়

হঠাৎ খবর রটে যায় মালিপোতায় বাঘ ঢুকেছে। এমনিতে হুনকাবড়ার ভয়ে লোকজনের গা হিম করা অবস্থা। তাঁরা কেউ রাতে নাম নিতে চায় না। নাম নিলেই নাকি সে পিছু ধায়। শেষমেষ পরিণতি ভয়াবহ!

বাঘের খবরে রাতের ঘুম যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও ছুটে পালিয়ে গেল গাঁয়ের লোকজনের। রশিদ আলি, ডালু মণ্ডলের মতো দু—একজন দূর থেকে বাঘটিকে নীলকুঠির দিকে হেঁটে যেতে দেখেছে দুপুরের দিকে। গর্জনও শুনেছে কেউ কেউ। গ্রামের দু—একটি ছাগল নিয়ে গেছে বলেও মোড়লের কাছে অভিযোগ করেছে ইদ্রিশ মণ্ডল। বাঘের পায়ের ছাপও দেখা গেছে রূপমতীর তীরে।

গ্রামে একটা থমথমে পরিবেশ। বাঘের খোঁজ চলল। গ্রামের লোকজন দা—কাঁচি—শাবল—বল্লম—মশাল—লাঠিসোঁটা নিয়ে দলবেঁধে চিরুনি—তল্লাশি চালিয়েও বাঘের টিকি খুঁজে পেল না।

সবাই যে—যার কাজে গেল। কিন্তু রয়ে গেল আতঙ্ক। একদিকে হুনকাবড়া আর অন্যদিকে বাঘ। তাই মাধো—কে এখন সকাল—সকাল খুব সাবধানে ফিরতে হয়। পারলে সঙ্গী নিয়ে। সেতুর মুখে অপেক্ষা করতে হয় কেউ ওইপথে যাবে কিনা।

সেদিন আবার রাত হল মাধোর। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে কাউকে না—পেয়ে রাম নাম করতে করতে ফিরছে সে। হঠাৎ বাঁশবনে জোছনার আড়ালে কাউকে দেখতে পেল সে।

…কিডা? কিডা ওইহানে?

লোকটা পালাচ্ছে। মাধো পিছু নিল। চোর না—তো? লোকটা নীলকুঠির কাছে এসেই হারিয়ে গেল। মাধো নীলকুঠির সামনে এসে একা দাঁড়িয়ে। হঠাৎ একটা বাঘের গর্জন। সম্বিৎ ফিরল তাঁর।

গর্জনটা নীলকুঠি থেকে?

না তাঁর মনেই বেজে উঠল?

কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। মনে হল পেছনের ঝোপ থেকে আসছে। মাধো দিকবিদিক শূন্য হয়ে দৌড়ে ঢুকল নীলকুঠিতে। ফাঁকা ঘর। ভাঙা ছাদ থেকে চাঁদের আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। একটা বিশালাকার সাপ হেঁটে যাচ্ছে মেঝে বরাবর। সেদিকে নজর যেতেই কেঁপে উঠল মাধো। না না, সাপ না, দড়ি, মোটা দড়ি পড়ে আছে বোধহয়, নইলে তাঁকে গিলে খেত নির্ঘাত!

হঠাৎ দুটো আগুন—চোখ মাধোর সামনে, ক্রমশ এগিয়ে আসছে…

পা—দুটো বরফের মতো শীতল আর নিশ্চল যেন, কোনো সাড় নেই! খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে, কান্না করতেও, মৃত্যুর মুখ দেখে যেমনটা মানুষ শেষবার কেঁদে ওঠে অসহায় শিশুর মতো! কিন্তু চিৎকার বা কান্না সব যেন থমকে আছে কণ্ঠে।

হঠাৎ—ই যেন পায়ে রক্তস্রোত অনুভব করে মাধো। আর এখানে একমুহূর্ত নয়। পিছন দিকে ছোটে। আমবন, বাঁশবন পার হয়ে ছুটছে সে পাগলের মতো। জীবন ছুটছে হাতে মাটির প্রদীপ নিয়ে! পালা পালা মাধো…! পিছু নিয়েছে মৃত্যুদানব, এক্ষুনি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেবে আলো।

সামনে চেনা কাউকে দেখতে পেয়ে ধড়ে প্রাণ আসে মাধোর। ডাকে। কিন্তু কে সে? দিনু? রশিদ? না লতিফ?

লতিফ? লতিফ কেন?

লোকটা উত্তর না দিয়ে ইছামতীর দিকে এগোতে থাকে ক্রমশ। সেও পেছন পেছন ছোটে, নিজের অজান্তেই। নদীর জলে নেমে যায় লোকটা, মাধোও, এক ঘন ঘোরের মধ্যে!

লোকটা বুক জলে। মাধোও হাঁটুজল ছাড়িয়েছে। লোকটা আস্তে আস্তে ডুবে গেল রূপমতীর জলে। আর মাধো…

পেছন থেকে আচমকা কেউ একজন হ্যাঁচকা টান দেয়, আর অমনি মুখ থুবড়ে পাড়ের কাদায় এসে পড়ে মাধো। মাটিতে মুখ গুঁজে গোঙাতে থাকে, অ অ অ অ অ ও ও ও ও…। লালা পড়ে গাল বেয়ে।

সাত

সকালে পুলিশ আর বনদপ্তরের লোকজন ঘোরাফেরা করছে বাঁশবনে। চারিদিকে খোঁজ খোঁজ।

মাধোর জ্ঞান ফেরে। দিনু বন্দুক হাতে পাশে বসে। বাঘের তল্লাশি চলছে। বাবার বন্দুক হাতে নিয়ে দিনু রাতে বেরিয়েছিল, তাই রক্ষে। রক্ষে বাঘের মুখ থেকেও।

নীলকুঠি ঘিরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কোথায় বাঘ?

কোথাও নেই।

নেই নেই নেই!

আছে কেবল একরাশ আতঙ্ক, হুনকাবড়া আর বাঘের ভ্যাবসা গন্ধ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *