জোকার

জোকার

কণিকা গুম হয়ে খাটের ওপর বসে আছে।

রতনের মা ঘরের আলো জ্বালিয়ে চা দিয়ে গেছে। কণিকা গরম চা খায় না। কলেজজীবনে গরম চা খেতে গিয়ে একবার বিচ্ছিরিভাবে তার মুখ পুড়ে যায়। তারপর থেকে গরম চায়ে তার অ্যালার্জি।

আজ অবশ্য সে গরম চা খাচ্ছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সকাল থেকে কণিকাকে যেসব ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে তাতে ঠান্ডা-গরম ভেদাভেদ করবার মতো মনের অবস্থা তার থাকার কথা নয়।

বিল্টু ঘরে ঢুকল। তার পায়ে সাদা কেডস, তাতে লাল বর্ডার। ছাই রঙের হাফপ্যান্টের ওপর রতনের মা তাকে একটা নীল রঙের টি-শার্ট পরিয়ে দিয়েছে। টি-শার্টের বুকে আজকাল হাবিজাবি লেখা থাকে। বিল্টুর টি-শার্টে কিছু লেখা নেই। শুধু একটা পাল তোলা নৌকোর ছবি। বুকে নৌকোর ছবি নিয়ে ক্লাস ফোরের বিল্টুকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এক বুক সমুদ্র নিয়ে সে এসে দাঁড়িয়েছে। বিল্টু তার মায়ের মতো লম্বা নাক, বাবার মতো অল্প ঘন চুল এবং দিদিমার মতো ফরসা রং পেয়েছে। রতনের মা সুযোগ পেলেই বিল্টুর ফরসা গালে পাউডার লাগিয়ে দেয়। এতে বাড়তি কোনও লাভ হয় না। তবু সে দেয়। তার বিশ্বাস, ফরসা রং ধরে রাখার জন্য পাউডার একটা দরকারি জিনিস।

বিল্টু মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসল। ছোটদের এই হাসির নাম ‘মন ভাল করে দেওয়া হাসি।’ কণিকার মন মোটেই ভাল হল না। বিল্টু যে-কাজ করেছে তাতে মন ভাল হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। সে ছেলের জন্য কড়া শাস্তির কথা ভেবে রেখেছে। তবে তাতে খুব কিছু হবে বলে কণিকার মনে হয় না। বড় ধরনের কোনও ব্যবস্থা প্রয়োজন।

বিল্টু হাসিমুখে বলল, ‘মা, আমি পার্কে খেলতে যাচ্ছি।’

‘না, যাবে না।’

‘কেন যাব না? বিকেল হয়ে গেছে তো।’

‘হোক। সকাল, বিকেল, রাত যা ইচ্ছে হোক। তুমি খেলতে যাবে না।’

বিল্টু অবাক হয়ে গেল। সে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘তা হলে আমি কখন খেলব?’

কণিকা মুখ ঘুরিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘আগামী সাতদিন তোমার খেলাধুলো বন্ধ। প্রয়োজন হলে দিন আরও বাড়তে পারে।’ মায়ের ধমকে বিল্টুর চোখে জল এসে গেল। আজ ক্লাস টিচারের সঙ্গে দেখা করে আসার পর থেকে মা তার সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করছে। কেন করছে? সে তো পরীক্ষায় ভাল করেছে। অঙ্কে একশোর মধ্যে পঁচানব্বই পেয়েছে। মাত্র পাঁচ নম্বরের জন্য মা নিশ্চয় এত কঠিন শাস্তি তাকে দেবে না। কণিকা কড়া গলায় বলল, ‘এখানে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করবে না। আমার মাথা ধরেছে। কান্না দেখলে ব্যথা বেড়ে যাবে।’

বিল্টু চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, ‘আমি কি অঙ্ক করব মা।’

কণিকা বলল, ‘না, তুমি কিছুই করবে না। তুমি শুধু এখান থেকে চলে যাবে।’

বিল্টু ফোঁপাতে ফেঁপাতে চলে গেলে কণিকা বুঝতে পারে জিভে কেমন একটা জ্বালাজ্বালা ভাব হচ্ছে। গরম চায়ে জিভ কি পুড়ে গেল? গেলে যাক। যে-ঘটনা ঘটেছে তার কাছে মুখ পোড়া কিছু নয়। সে মোবাইলে সুজয়কে ধরল।

সুজয় জটিল একটা সমস্যার মধ্যে রয়েছে। তার টেবিলে পুরো এক বছরের ফাইল ছড়ানো। সামনে একটা ফ্যাক্স। হেড অফিস দুপুরে মুম্বই থেকে এই ফ্যাক্স পাঠিয়েছে। ফাইলে নাকি বড় ধরনের গোলমাল দেখা গেছে। হিসেব মিলছে না। প্রডাকশনের সঙ্গে স্টকের বিস্তর ফারাক দেখা দিয়েছে। অথচ ঘটনা একেবারে অন্য রকম হওয়ার কথা। স্টকের হিসেবে এমনভাবে জল দেওয়া হয়েছিল যে ধরা পড়বার কোনও সুযোগ থাকার কথা নয়। এর জন্য স্টক ম্যানেজার সুহাস মল্লিকের বাড়িতে গত এক বছর ধরে হিসেব করে নিয়মিত ঢাকা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। জলের টাকা। তা হলে কী হল? কেউ কি খোঁচাল? কে খোঁচাল?

বাড়ির নম্বর দেখে বিরক্ত মুখে সুজয় মোবাইল ধরল। বলল, ‘আবার কী হল? তুমি একটা সামান্য বিষয় নিয়ে এত টেনশন করছ কেন কণিকা?’

‘সামান্য বিষয়! বাবা হয়ে তুমি এটাকে সামান্য বিষয় বলছ!’

সংসারের স্বাভাবিক নিয়মেই এই মহিলাকে সুজয় যথেষ্ট সমঝে চলে। সে তাড়াতাড়ি বলল, ‘ঠিক আছে, বলছি না। কিন্তু এই অসামান্য বিষয়টা নিয়ে তুমি দয়া করে আর চিন্তা কোরো না। ছোট ছেলে, ও তো আর বিরাট ভেবেচিন্তে কিছু করেনি।’

‘ছোট ছেলে! দশ বছর হতে চলল, বিল্টুকে তুমি ছোট ছেলে বলছ? মিনুর বয়স কত হয়েছে? আট, বড়জোর সাড়ে আট। ছোড়দা, ছোট বউদি এখন থেকেই যে মিনুকে আমেরিকায় পাঠানোর জন্য তৈরি করছে সে খবরটা রাখো? রবিবার রবিবার দুপুরে লুকিয়ে টালিগঞ্জের একটা কোচিং ক্লাসে নিয়ে যাচ্ছে। জানো সে কথা? তোমার দাদা চেপে গেলে কী হবে, সেজদির কাছ থেকে আমি সব খবরই পাই। সেই গোপন কোচিংয়ের নাম শুনবে? নাম হল শর্ট কাট টু ইউ এস এ। আমি একদিন সামনে দিয়ে ঘুরে পর্যন্ত এসেছি।’

সুজয় হতাশ হয়ে চেয়ারে হেলান দিল। আজ মনে হচ্ছে জরুরি কোনও কাজ করা যাবে না। সে বলল, ‘ঠিক আছে, তুমিও বিল্টুকে ওখানে ভরতি করে দাও। অসুবিধের তো কিছু নেই৷ রবিবার তো। আমি গাড়িতে নিয়ে যাব না হয়। এখন তুমি শান্ত হও কণিকা। বি কুল।’

শান্ত হওয়ার প্রস্তাবে কণিকা আরও রেগে গেল। ঝাঁঝিয়ে বলল, ‘কী বলছটা কী! শান্ত হব? ছেলে পরীক্ষায় খাতায় রচনা লিখে আসবে— আমি বড় হয়ে সার্কাসে যোগ দেব, আর মা শান্ত হয়ে টিভি দেখবে? দুপুরে তোমাকে ফোন করে বললাম না, ক্লাস টিচার মিস ম্যানটিং আজ আমায় ডেকে পাঠিয়ে কী যা-তা বললেন? বলিনি তোমায়?’

কলমটাকে টেবিলের ওপর ছুড়ে সুজয় বলল, ‘বলেছ। বিস্তারিত বলেছ কণিকা।’

কণিকা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘মনে হচ্ছে না তো বলেছি। বললে তুমি এভাবে আমাকে শান্ত হওয়ার কথা বলতে পারতে না। আর তা ছাড়া আবার শুনলেই বা ক্ষতি কী? মিস ম্যানটিং তো তাঁর নিজের ছেলের ভালর জন্য কিছু বলেননি, বলেছেন তোমার ছেলের ভালর জন্য। সুতরাং তোমার বারবার শোনা উচিত। নাকি শোনার মতো তোমার সময় নেই? কে আছে সামনে? সেই বুক দেখানো ছোট জামা পরা স্টেনো মেয়েটা নাকি? কী যেন নামটা মেয়েটার, মালবিকা না কী যেন? কীসের তাড়া এত তোমার?’

মালবিকা যে ছোট জামা পরে এ-কথাটা মিথ্যে নয়। ছোট জামার কারণে তার শরীরের কিছু কিছু অংশ বিপজ্জনকভাবে দেখা যায় এটাও সত্যি। কিন্তু আজ মালবিকা ছোট জামা পরে অফিসে আসেনি। সে আজ পরেছে ছোট স্কার্ট। সে জিনিস ছোট জামার থেকেও ভয়ংকর। ঠিক কতটা ভয়ংকর তা জানার জন্য সুজয় ঠিক করেছিল, আজ সন্ধেবেলা অফিসের পর মালবিকাকে নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের কোনও রেস্তোরাঁতে বসবে। শালা হেড অফিসের ফ্যাক্স সব গোলমাল করে দিয়েছে। তার ওপর এখন শুরু করেছে কণিকা। সুজয় তার টাইয়ের ফাঁস আলগা করতে করতে ক্লান্ত গলায় বলল, ‘ছিঃ কণিকা, কী বলছ এসব? মালবিকা খুবই ভাল মেয়ে। যাক তুমি মিস ম্যানটিংয়ের কথা বলো। সত্যি তো, দরকারের কথা বেশিবার শুনলে ক্ষতি নেই।’

কণিকা ফোঁস ধরনের একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘উনি বললেন, বি অ্যালার্ট মিসেস বোস। আর কেউ এরকম লেখেনি! এখন থেকে এসব লো লেভেলের ভাবনাচিন্তা যদি ছেলের মাথায় আসে তা হলে বড় হয়ে কী হবে? আপনারা সময় দিন। নিশ্চয় আপনার ছেলে কোনও ব্যাড কম্পানি পাচ্ছে। বদ সঙ্গ।’

সুজয় আবার চেষ্টা করল। সে গলা নামিয়ে বলল, ‘ছেলেমানুষ কত হাবিজাবি কল্পনা করে। বিল্টুও বোধহয় সেরকম কিছু করেছে। সে কেন সার্কাস দলে যাবে কণিকা? আমাদের বাপ চোদ্দোপুরুষ যা কখনও করেনি, সে কাজ সে কেন করতে যাবে? এই ভাবনাটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে নাকি?’

সুজয়ের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে কণিকা বলে চলল, ‘দুপুরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কী স্বপ্ন দেখলাম জানো? দেখলাম বিরাট একটা স্টেজ। সেখানে ট্রাপিজের খেলা চলছে। বাজনা বাজছে। আর মুখে রং মেখে জোকার সেজে বিল্টু ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে দেখে সবাই হাসছে। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হল, স্বপ্নের মধ্যে আমিও সকলের সঙ্গে হাসতে শুরু করলাম! ভেবে দ্যাখো একবার, জোকার ছেলেকে দেখে মা হাসছে! উফ! এমন সময় রতনের মা আমাকে ঠেলে তুলে চা দিল, বলল, বউদি, আপনি হাসেন কেন? মজার স্বপ্ন দেখছেন নিশ্চয়? ভাল করেছেন বউদি। বেশ করেছেন। আমাদের গ্রামে নিয়ম হল, ভোরে দ্যাখা কান্নার স্বপ্ন, আর দুপুরে পাওয়া হাসির স্বপ্ন সত্যি হবেই হবে। কোনও চিন্তা করবেন না, দেখবেন আপনার স্বপ্নও সত্যি হবে। ভাবো একবার। ভেবে দ্যাখো, বলছে, আমার স্বপ্ন সত্যি হবে! আমার কী মনে হয় জানো?’

সুজয় গভীর হতাশার সঙ্গে বলল, ‘না, জানি না।’

‘আমার মনে হয়, মিস ম্যানটিং বদসঙ্গ বলতে রতনের মায়ের কথাই বলেছেন। বাড়ির কাজের লোকেরাই ছেলেপিলেকে খারাপ করে। সে হয়তো ওইসব আজেবাজে জিনিস ছেলেটার মাথায় ঢুকিয়েছে। কাল সকালে উঠেই রতনের মাকে বিদায় করে দেব ঠিক করেছি। তুমি তাড়াতাড়িই বাড়ি এসো, ওর একুশ দিনের মাইনে হিসেব করতে হবে।’

মোবাইল অফ করে পুরো এক গেলাস জল খেল সুজয়। ফাইলগুলো সরিয়ে রাখল। হিসেবের গোলমাল ফাইলে নেই। গোলমাল যেখানে আছে সে জায়গাটায় পৌঁছোতে হবে। হারামজাদা স্টক ম্যানেজারটার বাড়ি কোথায় যেন, ল্যান্সডাউন না আনোয়ার শা? সুজয় গাড়ির চাবি নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

কণিকা চুল বেঁধেছে, শাড়ি বদলেছে। এমনকী সে টিভিও খুলেছে। এই মুহূর্তে তার মন খানিকটা শান্ত। সুজয়ের টেলিফোন ছেড়ে দিয়েই সে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে ফেলেছে। রতনের মাকে ডেকে একুশ দিনের মাইনের হিসেব করতে বলেছে। সেই সঙ্গে তাকে বলেছে, ‘কিছু মনে কোরো না রতনের মা, তোমাকে ছাড়তে খুবই খারাপ লাগছে। তবে তুমি জেনে রেখো এই সিদ্ধান্ত আমাদের সিদ্ধান্ত নয়, সিদ্ধান্ত মিস ম্যানটিংয়ের। বিল্টুর ক্লাস টিচার মিস ম্যানটিংকে তো তুমি চেনো না। খুবই কড়া ধাঁচের মহিলা। তুমি বাপু আজ রাতেই জিনিসপত্র গুছিয়ে রওনা হয়ে পড়ে।’

রতনের মা কথা শুনে বলল, ‘একটা কথা বলব বউদি? এটা আপনে ঠিক করেননি। ছেলেটাকে বিকেলে খেলতে যেতে দেননি। বেচারি কান্নাকাটি করে। আমাদের গ্রামে বলে, ছোট ছেলেদের কঠিন শাস্তি দিলে তারা বিগড়ে যায়?’

কণিকা গম্ভীর মুখে খাটে বসতে বসতে শান্ত গলায় বলল, ‘কাঁদুক রতনের মা। তুমি বিল্টুকে বিরক্ত কোরো না, ওকে কাঁদতে দাও। এখান না কাঁদলে বাকি জীবন ওকে লোক হাসাতে হবে। মা হয়ে সেটা কি আমি হতে দিতে পারি?’

রতনের মা ভুরু কুঁচকে কণিকার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। মানুষটাকে পাগলামিতে ধরল নাকি? হতে পারে। সন্ধেবেলাটা মোটেও ভাল সময় নয়। পাগলামি এবং ভূতেরা এই সময়টায় মানুষ ধরবে বলে ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়ায়। তাদের গ্রামে এরকম অজস্র উদাহরণ আছে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তার অনেক কাজ। বিল্টুর দুধ গরম করতে হবে। তারপর জিনিসপত্র গোছানো আছে। রাতের দিকে কি ট্রেন আছে? থাকলে ঠিক আছে না থাকলে বিপদ। স্টেশনে থাকতে হলেই চিওির। তবে থাকতে হলে থাকবে। তাড়িয়ে দেওয়া বাড়িতে সব করা যায়, রাত কাটানো যায় না।

স্টেশনে নয়, রতনের মাকে বাড়িতেই রাত কাটাতে হল। কারণ, একটু পরেই এ-বাড়িতে বড় অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল।

রতনের মা যখন দোতলায় উঠে এল তখন সে হাঁপাচ্ছে।

কণিকা চাপা গলায় বলল, ‘তুমি দরজা খুললে কেন?’

রতনের মা ঢোঁক গিলল। আমতা আমতা করে বলল, ‘এটাই ঠিক কাজ হয়নি বউদি। ভুল হয়ে গেছে। বডড ভুল হয়ে গেছে। আমি তখন একতলায় রান্নাঘরে। বিল্টুর দুধে চকোলেট গুললাম। চামচ দিয়ে নাড়লাম, কিন্তু তারপর আর কিছুতেই মনে করতে পারলাম না চিনি দিলাম, না দিলাম না। একবার মনে হয়, দিলাম, পরক্ষণেই মনে হয় দিলাম না। ট্রেন ধরার তাড়ায় সব কেমন গোলমাল হয়ে গেছে। এমন সময় কলিংবেল বাজল। আমি ভাবলাম, দাদাবাবু। তখন আমি দুধে আবার এক চামচ চিনি দিলাম। দিয়েই মনে পড়ে গেল, আরে আগেই তো দিয়েছি। তখন ফের বেলের আওয়াজ। একবার নয়, দু’বার। দুধের গেলাস হাতে নিয়েই বসার ঘরে গেলাম। আলো জ্বাললাম। দুধের গেলাস টেবিলে রেখে দরজা খুললাম।’

কণিকা চাপা ধমক দিয়ে বলল, ‘রাখো তোমার সাতকাহন। তারপর কী হল সেটা বলে!’

রতনের মা একটু এগিয়ে এল। গলা নামিয়ে বলল, ‘তারপর আর কী হবে, লোকটা সুড়ুত করে ঢুকে পড়ল।’

‘ঢুকে পড়ল! অ্যাঁ, বলছ কী রতনের মা, একটা অচেনা অজানা লোক ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল!’

‘সেটাই তো বলছি। শুধু ঢুকে পড়ল না বউদি, হাতের তেলচিটে সুটকেসটা সোফার ওপর রাখল।’

‘সুটকেস! সুটকেস এনেছে নাকি?’ কণিকার চোখ বড় হয়ে গেছে।

রতনের মা উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘শুধু সুটকেস নয় বউদি, কাঁধে তাপ্পি মারা একটা ঝোলাও রয়েছে। মনে হয় ওতে কম্বল টম্বল আছে। মুখ ফিরিয়ে আমাকে বলল, এটা সুজয়বাবুর বাড়ি না? আমি বললাম, হ্যাঁ। লোকটা বলল, ভবানীপুরে বাড়ি খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন দেখছি। সুজয়বাবু আছেন? আমি বললাম, না, উনি অফিসে আছেন। তবে বউদি আছেন। ডাকব?’

কণিকা বলল, ‘উফ রতনের মা, তুমি বললে আমি আছি?’

রতনের মা মাথা নামিয়ে বলল, ‘ওইটাই ভুল হয়ে গেল। বড্ড ভুল হয়ে গেল বউদি।’

কথা বলতে বলতে কণিকা ফোনটা কাছে টেনে নিয়েছে। সুজয়কে মোবাইলে ধরবার চেষ্টা করছে। ধরা যাচ্ছে না। মোবাইল অফ। সুজয় কি মিটিংয়ে আছে? সে রতনের মায়ের উদ্দেশে বলল, আর কী ভুল করেছ তুমি জানতে পারি?’

‘আর বেশি করিনি বউদি। আমি যখন বললাম, বউদিকে ডাকব? দোতলায় টিভি দেখছে। লোকটা হেসে বলল, থাক দরকার নেই। তুমি বরং পাখাটা চালিয়ে দাও। এক কাপ চা করো দেখি। চিনি বেশি দেবে। তারপর তুমি তোমার বউদিকে গিয়ে বলে, শিবচরণ এসেছে। আজ থাকবে। গরম ভাত আর পোস্তবাটা খাবে। বাড়িতে পোস্ত আছে তো? তাড়াহুড়োর কিছু নেই, না থাকলে গিয়ে নিয়ে আসবে। তারপর লোকটা টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, এই দুধের গেলাসটা কার? আমি বললাম, বিল্টু। লোকটা কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে গেলাসটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, বিল্টুর বয়স কত? আমি বললাম, জানি না। ক্লাস ফোরে পড়ে। ইংলিশ মিডিয়াম। লোকটা হাসল। তারপর নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল, তাই হবে। ক্লাস থ্রি-ফোরই তো হবে। দশ-এগারো বছর আগের ঘটনা। কত দিন হয়ে গেছে।’

কণিকা অবাক গলায় বলল, ‘দশ-এগারো বছর! কী ঘটনা?’

‘সেটা তো জানি না বউদি। জিজ্ঞেস করে আসব?’

কণিকা রতনের মায়ের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। বলল, ‘না, তুমি যাও।’

মোবাইল যখন বাজল সুজয় তখন গড়িয়াহাটের মোড়ে গাড়ি চালাচ্ছে। তার মেজাজ খুব খারাপ। মল্লিক হারামজাদা চাপ দিয়েছে। গোলমাল চেপে দেওয়ার জন্য সে আরও টাকা চায়। তার কাছে খবর আছে, কোম্পানি বিষয়টাকে নিয়ে নাকি অনেক দূর এগোবে। ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারি, প্রয়োজনে পুলিশে ডায়েরি পর্যন্ত হতে পারে। বোঝা যাচ্ছে, বাজে কথা। এনকোয়ারি পর্যন্ত গড়ালে ওই মল্লিকও ছাড় পাবে না। তবু উপায় নেই। রেগে গেলে চলবে না। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। টাকাটা কমাতে হবে।

আবার মোবাইলে বাড়ির নম্বর দেখে মনে মনে ভীষণ রেগে গেল সুজয়। নরম গলায় বলল, ‘আবার কী হল কণিকা? মিস ম্যানটিং এসেছেন নাকি?’

কণিকা এক নিশ্বাসে সব ঘটনাই জানাল। দুই, সুটকেস, দশ বছর আগের ঘটনা, পাখা বাড়ানো, গরম ভাত, পোস্তবাটার অর্ডার— সব। তারপর কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘আমার ভীষণ ভয় করছে। তুমি থানা থেকে ঘুরে এসো।’

থানার কথায় সুজয় বিরক্ত হল। বলল, ‘বোকার মতো কথা বোলো না কণিকা। হুট বলতে থানা-পুলিশ করা যায় না। হয়তো সত্যি ওই নামের কাউকে আমরা চিনতাম! শিবপ্রসাদ না শিবনাথ কী বললে যে? ওই একই হল, শিবচরণ। এত ঘাবড়ানোর কিছু হয়নি। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি। তুমি নীচে গিয়েছিলে? লোকটাকে তুমি দেখেছি? কীরকম দেখতে?’

‘তা তো জানি না। দাঁড়াও রতনের মাকে ডাকছি।’

‘আসলটাই জানো না দেখছি। থাক, তোমাদের আর কিছু করতে হবে না। আমি গিয়ে দেখছি।’

ফোন নামিয়ে রতনের মাকে ভাল কণিকা, ‘লোকটাকে দেখতে কেমন?’

রতনের মা উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘দেখতে খুবই খারাপ। গায়ে বড় বদখত গন্ধ। ঘরের বাইরে থেকেও ভক করে নাকে লাগে, কালাকুলা আর বেঁটেপানা। মাথার চুলগুলো কেমন যেন ঝাঁকড়া ধরন। চোখগুলোও ভাল নয়। গোল গোল। সব থেকে খারাপ হল বউদি, নাকের পাশে ইয়া বড় একটা জড়ুল ঝোলে। ভাবসাব দেখলে হাসি লাগে। মনে হয়, সার্কাস পার্টির জোকার।’

কণিকা চমকে উঠল। রতনের মা কী বলছে? সে কি ভুল শুনল? নিশ্চয় ভুল শুনল। ফিসফিস করে বলল, ‘কী মনে হয় বললে?’

রতনের মা এতক্ষণ বাদে একমুখ হাসল। বলল, ‘জোকারের মতো বউদি। একদম জোকারের মতো। আমাদের গ্রামে সার্কাস আসত। বেঁটেবুটে জোকারগুলো লাফিয়ে ঝাঁফিয়ে কী কাণ্ডটাই না করত!’

কণিকার মনে হচ্ছে, পায়ের তলায় মাটি থরথর করে কাঁপছে। সে কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে হিসহিসে গলায় বলল, ‘চুপ করে রতনের মা। বিল্টু কোথায়?’

রতনের মা মাথা নামিয়ে বলল, ‘আপনে ওকে বকাঝকা করবেন না বউদি। চা দেওয়ার সময় দেখে এলাম বিল্টু নীচে জোকারপানা লোকটার সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করে। আহা, ছেলেমানুষ, ও ভালমন্দের বোঝে কী?’

কণিকা খাটের ওপর বসে পড়ল।

বিল্টু খুব উত্তেজিত। উত্তেজিত হওয়ারই কথা। সে কল্পনাও করতে পারে না, কেউ তাদের বসার ঘরের সোফার হাতলে তেলচিটচিটে গামছা, বেগুনি রঙের ডোরাকাটা লুঙ্গি আর হলুদ রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি মেলে দিতে পারে। উত্তেজনার চোটে বিল্টু নিজেকে আর পরদার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে পারেনি। ঘরে ঢুকে পড়েছে।

বেঁটে লোকটা আড়চোখে বিল্টুকে দেখেছে কিন্তু কথা বলেনি। সুটকেস থেকে নানা ধরনের জিনিস বের করে মায়ের প্রাণের থেকেও প্রিয় কাচের টেবিলটায় সাজিয়ে সাজিয়ে রাখছিল। তার মধ্যে দু’-একটা জিনিস বিল্টু চিনতে পেরেছে। একটা সর্ষের তেল ভরতি শিশি, দুটো দাঁত-ভাঙা চিরুনি, একটা ফুরিয়ে যাওয়া মতো পেস্টের টিউব, একটা বাঁকা টুথব্রাশ। জিনিসগুলো সাজানোর সময় মানুষটা মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছিল আর মিটিমিটি হাসছিল। এর সঙ্গে লোকটা একটা অদ্ভুত কাজ করছিল। মোটা মোটা বিচ্ছিরি ভুরু দুটো নাচাচ্ছিল। তবে দুটো ভুরু একসঙ্গে নয়। একবার এপাশেরটা, একবার ওপাশেরটা। ভুরু নাচের সঙ্গে লোকটার নাকের পাশের বড় ভুলটাও নাচছিল। বিল্টু মুগ্ধ। এমন ভুরু নাচানো মানুষ সে আগে কখনও দেখেনি।

লোকটা এবার মুখ তুলে বলল, ‘বিল্টুবাবু, তুমি কি আমার সঙ্গে গল্প করতে চাও?’

বিল্টু খানিকটা দূরে একটা আলমারি ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। এই আলমারিটা পুতুলে ভরতি। মায়ের খুব শখের। ভেতরে চাপা একটা আলো আছে। অন্ধকার ঘরে যখন সেই আলো জ্বালানো হয়, মনে হয় আলমারি নয়, ওটা পুতুলের একটা আলাদা পৃথিবী। পুতুলের আলমারির পাশে দাঁড়ানো ফুটফুটে বিল্টুকেও একটা পুতুলের মতো লাগছে। লোকটার কথা শুনে বিল্টু দু’পাশে মাথা নাড়ল। লোকটা গম্ভীর গলায় বলল, ‘ঠিকই বলেছ। আমিও তোমার সঙ্গে গল্প করতে চাই না। তা হলে এক কাজ করি, এসো দু’জনে মিলে ঝগড়া করি।’

বিল্টু হেসে ফেলল। এরকম মজার কথা সে কখনও শোনেনি। সে বলল, ‘তোমার সঙ্গে কথা বলব না।’

লোকটা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘কেন বলবে না?’

‘বাঃ তোমাকে কি আমি চিনি যে কথা বলব? যাকে চিনি না তার সঙ্গে কথা বললে মা রাগ করবে।’

‘ঠিকই করবে। কিন্তু বিল্টুবাবু, তুমি আমাকে চিনবে কী করে? আমিও যে তোমাকে চিনি না।’

‘তাতে কী হয়েছে? তুমি তো আমার বাবা-মাকে চেনো।’

‘না, তাদেরও চিনি না। তারাও আমাকে চেনে না। তারা শুধু আমাকে জানে।’

বিল্টুর মজা আরও বেড়ে গেল। এ আবার কেমন কথা রে বাবা! চেনে না, কিন্তু জানে! সে এগিয়ে এসে সোফার হাতলের ওপর বসল। সোফার থেকে সোফার হাতলের ওপর বসতে তার সবসময়ই ভাল লাগে। তার এই অভ্যেসের জন্য মা ভীষণ রাগ করে। গত রবিবার এর জন্য তাকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। বাবা বলল, ‘এটা কী কণিকা? হাতলে বসেছে বলে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? আমরা ছোটবেলায় এরকম কত করেছি।’

মা বলল, ‘তোমাদের ছোটবেলা আর আমার ছেলের ছোটবেলা একরকম হবে ভাবলে কী করে? সোফাটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল ম্যানার্স। যে বড় হয়ে বিলেত আমেরিকা যাবে, এখন থেকেই তাকে ম্যানার্সটা মনে রাখতে হবে। বিল্টু, হাত নামাচ্ছ কেন? ঠিকমতো কান ধরো।’

এই মুহূর্তে বিল্টুর আর সেই শাস্তির কথা মনে নেই। সে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি আমার কে হও? মামা?’

লোকটা অবাক হয়ে বলল, ‘মামা! কেন, মামা হব কেন?’

বিল্টু চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আমাদের ক্লাসের জয়কে চেনো? জয়ের মামা সুইডেনে থাকে। একদিন রাতে ওরা সবাই ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ শোনে দরজায় দুম দুম শব্দ। জয়ের বাবা খুব ভয় পেয়ে গেল। ভাবল, ডাকাত এসেছে। দরজা এই একটুখানি ফাঁক করে দেখল, ডাকাত নয়, মামা দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে ইয়া বড় একটা সুটকেস। তখন খুব মজা হল। বাড়িসুদ্ধ সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়ল। রাত জাগতে হয়েছিল বলে জয় পরদিন স্কুলেই আসতে পারল না। হি হি।’

‘সুটকেস হাতে কেউ এলেই বুঝি সে মামা হয়। বাঃ ভাল বলেছ তো বিল্টুবাবু। এটা আমার জানা রইল। তবে আমার সুটকেসটা তো জয়ের মামার মতো ঢাউস সুটকেস নয়। তার আমি সুইডেন থেকে ও আসিনি। আমি এসেছি তাহেরপুর থেকে। তাহেরপুর কোথায় তুমি কি জানো? না জানলেও চলবে। আসল কথাটা হল, মামা তো দূরের কথা, আমি তোমাদের কেউ নই। তবে তোমার সঙ্গে আমার আবছা আবছা একটা রক্তের সম্পর্ক আছে। রক্তের সম্পর্ক কী বোঝো? বোঝে না তো? আমিও বুঝি না। যাক, ওসব শক্তি কথা বুঝে কাজ নেই। শক্ত কথা শুনলেই আমার আবার কেমন পেট ভরে যায় আর খুব ঢেঁকুর ওঠে। এই দ্যাখো শুরু হয়ে গেছে।’ সত্যি সত্যি লোকটা পেট ফুলিয়ে হুপুস হুপুস শব্দ করে ঢেঁকুর তোলার ভান করতে লাগল। বিল্টু ফের হেসে ফেলল। লোকটা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘বিল্টুবাবু, তুমি তো বড্ড অল্পতে হাসো দেখছি। মনে হচ্ছে, আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে কেলেঙ্কারি হবে। তুমি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে।’

‘না খাব না। গড়াগড়ি খেলে জামা-প্যান্ট নোংরা হয়ে যাবে। মা খুব বকবে।’

‘তুমি এত মা বকবে, মা বকবে করছ কেন? তোমার মা বুঝি খুব রাগী?’

‘হ্যাঁ, খুব রাগী। আমাকে বকে, আবার শাস্তিও দেয়। আজও দিয়েছে।’

‘আজও দিয়েছে? সেকী, কেন?’

‘তা তো জানি না। তবে শাস্তিটা জানি। সাত দিন খেলা বন্ধ।’

‘খেলা বন্ধ! কেন, খেলা বন্ধ কেন?’

‘সেটা জানি না। বাবা ফিরলে জানতে পারি, আবার না-ও জানতে পারি।’

‘ওরে বাবা! তোমার মা দেখছি ভীষণ রাগী মানুষ!’

লোকটার ভয় পাওয়ার ভঙ্গি দেখে বিল্টু মজা পেল। বলল, ‘মা তোমাকেও বকবে।’

‘এই রে, আমাকে? আমাকে বকবে কেন?’

‘বাঃ বকবে না? কাউকে চেনো না, তাও তুমি আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছ, তারপর ফ্যান চালাতে বলেছ, তারপর চা খেতে চেয়েছ।’

লোকটা এবার দুলে দুলে হাসতে লাগল। সেই অবস্থায় সুটকেস হাতড়ে একটা বিড়ির বান্ডিল আর দেশলাই বের করল। বিড়িতে আগুন লাগিয়ে লম্বা করে টান দিল। তারপর অনেকটা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, তা হলে খুব মুশকিল হল বিল্টুবাবু। এরপর আমি যা যা করব ভেবে রেখেছি সেগুলো জানলে তোমার মা তো রেগে একেবারে আগুন হয়ে যাবে। মাথা দিয়ে এরকমভাবে ভসভস করে ধোঁয়া বেরোবে।’

বিল্টু চোখ গোল করে লোকটার দিকে ঝুঁকে পড়ল। তার মায়ের মতো রাগী মানুষের মাথা থেকে ধোঁয়া বের করে দেবে এমন লোকের দিকে না ঝুঁকে থাকা যায়? সে বলল, ‘তুমি কী করবে?’

লোকটা এবার সোফার ওপর ভাল করে পা গুটিয়ে বসল। তারপর হাত নেড়ে বলল, ‘এরপর আমি তোমাদের এই মাসিকে আর এক কাপ চা বানাতে বলব। এবারের চা-টা হবে চিনি ছাড়া চা। চা খেতে খেতে আমি ভাল করে ঘষে ঘষে তেল মাখব। তেল না মাখলে আমি আবার চান করতে পারি না। ভাল কথা, তোমাদের বাড়িতে কুয়ো আছে? টিউবওয়েল হলেও চলবে। নেই? এই রে, এইটা তো মুশকিল হল। কুয়ো বা টিউবওয়েলের ঠান্ডা জল মাথায় না ঢাললে আমার যে রাতে ঘুম হবে না। কী হবে তা হলে? এইজন্য আমি কিছুতেই কলকাতায় আসতে চাই না। কলকাতায় কুয়ো নেই। তুমি কি কখনও কুয়োর জলে চান করেছ বিল্টুবাবু?’

বিল্টু অবাক হয়ে গেছে। লোকটা বলে কী? বিল্টু সারাবছর গরম জলে স্নান করে। বাজে লাগলেও সপ্তাহে সাত দিন সাবান, তিন দিন শ্যাম্পু তাকে মাখতেই হবে। কুয়ো, টিউবওয়েল এসব কী বলছে লোকটা? সে সোফার হাতল থেকে নেমে লোকটার কাছে ঘেঁষে বসল। বলল, ‘আমি তো বাথটবের জলে স্নান করি।’

লোকটা বলল, ‘ইস, বাথটবের জল আবার জল নাকি? কুয়োর জলের আর এক নাম হল ম্যাজিক-জল। এই জল যদি তুমি দু’বালতি মাথায় ঢালো না দেখবে কী কাণ্ড হয়। তুমি একদম বদলে গেছ। তখন দেখবে, দেখতে শুনতে তুমি সেই বিল্টুই আছ বটে, কিন্তু সেটা অন্য আর একটা বিল্টু। সেই বিল্টুকেও মা বকে কিন্তু সে আগের বিল্টুর মতো ভয় পায় না। হাসি পেলে গড়াগড়ি দিয়ে হাসে।’ কথা শেষ করে লোকটা আবার মিটিমিটি হাসতে লাগল। বলল, ‘কোনও চিন্তা নেই বিল্টুবাবু। তোমার বাবা-মা আমাকে একটুও বকবেন না। কারণ, ওঁরাই আমাকে নেমন্তন্ন করেছেন। আসতে বলেছেন, খেতে বলেছেন, পারলে ক’টা দিন ওঁদের সঙ্গে থাকতেও বলেছেন। আসবার আগে ভাবলাম, ক’টা দিন তো আর পারব না, তবে অত করে বলেছেন, ভদ্রলোক মানুষ, একটা রাত না হয় কাটিয়েই আসব। তা এখন তোমার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হওয়ার পর মনে হচ্ছে দুটো দিন হয়তো থাকতেই হবে। নইলে তুমি যদি রাগ করো। রক্তের সম্পর্ক রেগে গেলে আবার খারাপ। হা হা। তবে নেমন্তন্নটা একটু পুরনো হয়ে গেছে এইটা যা চিন্তার। তা প্রায় দশ বছর হয়ে গেল।’

দশ বছর হোক, কুড়ি বছর হোক, একশো বছর হোক। বিল্টর কিছু এসে যায় না। সে খুশি হল। এই মজার মানুষটাকে বাবা-মা নেমন্তন্ন করেছে। ক’দিন থাকতেও বলেছে! দারুণ হবে। সে ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি এতদিন আসোনি কেন?’

লোকটা এই প্রথম বিল্টুর গায়ে হাত দিল। পিঠে হাত রেখে বলল, ‘কী করে আসব বাবা! আমি যে ছুটি পাই না।

‘ছুটি পাও না! কেন রবিবার তো ছুটি।’

‘দুর বাকা ছেলে, সার্কাসে কাজ করলে কি রবিবার ছুটি হয়?’

বিন্টু লাফিয়ে উঠল। বলল, ‘উরেব্বাস! তুমি সার্কাসে কাজ করো!’ লোকটা বিন্টুকে কোলের কাছে টেনে বসাল। বিল্টুর গা শিরশির করছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে চোখ বড় বড় করে বলল, ‘সার্কাসে তুমি কী করো? সিংহের খেলা দেখাও?’

লোকটা হেসে উঠল। বলল, ‘না না, অত বড় সার্কাস নয় বিল্টুবাবু। গ্রামদেশের ছোটমোট সার্কাস। বাঘ সিংহ নেই। দুটো রোগা রোগা ঘোড়া আছে। খানকয়েক টিয়াপাখি আর চারটে হনুমান আছে। আমি রং-টং মেখে জোকারের খেলা দেখাই। লাফাই ঝাঁপাই ডিগবাজি খাই। দড়ির ওপর কয়েক পা হাঁটতেও হয়। কাল সকালে রং-টং মেখে বিন্টুবাবুকে না হয় কয়েকটা দেখিয়ে দেওয়া যাবে। আর বিল্টুবাবু যদি খুব বায়না করে তা হলে তাকে দু’-একটা খেলা শিখিয়ে দেওয়া যেতে পারে। হা হা।’

বিল্টুর চোখ আরও বড় হয়ে গেল। সে বলল, ‘তুমি জোকার।’

কণিকা পা টিপে টিপে দোতলা থেকে নেমে এল। তারপর নিঃশব্দে পরদার আড়াল থেকে যা দেখল, তা সে দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না। একটা বামন ধরনের কদাকার লোকের গা ঘেঁষে বসে আছে বিল্টু। লোকটার কাছ থেকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে সে ভুরু-নৃত্য শিখছে। একবার ডান, একবার বাঁ, তারপর আবার ডান…।

বাইরে সুজয়ের গাড়ির হর্ন বাজল।

বাড়িতে সিগারেটের অনুমতি না দিলেও কণিকা স্ট্যাটাসের কারণে হুইস্কির অনুমতি দিয়েছে। তবে দুটো শর্ত আছে। এক নম্বর, দোতলার ঘরে বিল্টু ঘুমিয়ে পড়লে খেতে হবে। দু’নম্বরটা হল, কিছুতেই সপ্তাহে তিন দিনের বেশি নয়। আজ একটা শর্ত পূরণ হয়েছে, একটা হয়নি। বিল্টু ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু এটা নিয়ে সপ্তাহে চার দিন বাড়িতে মদ খাওয়া হয়ে গেল।

সুজয় প্রথম হুইস্কিটা ছোট নেয়, আজ বড় করে ঢালল। লম্বা চুমুক দিয়ে সোফায় হেলান দিল।

কণিকা সোফায় বসেনি, সে পুতুল আলমারির কাছে মোড়া টেনে বসেছে। মুখে ক্রিম লাগাচ্ছে। এই মোড়া সাধারণ মোড়া নয়, জাপানি মোড়া। ভাঁজ করলে মোড়া বেঁটে হয়ে গিয়ে পিঁড়ির আকার নেয়। কণিকার মেজকাকা টোকিও থেকে এনে দিয়েছে। ক্রিমটাও তাই। বাইরের, একেবারে খোদ ইতালির। সারাদিন এই ক্রিমের কোনও কাজ নেই। কাজ শুরু করে গভীর রাতে। ত্বকের ভেতরে।

‘ইস, কী বলে তুমি সোফাটায় হেলান দিচ্ছ? নোংরা লোকটা ওখানে এতক্ষণ বসে ছিল। কালই লোক ডেকে ওগুলোকে রোদে দেবে।’

সুজয়ের সামনে টেবিলের ওপর মোবাইল রাখা। সাধারণত এত রাতে সে মোবাইল বন্ধ করে দেয়। আজ দেয়নি। স্টক ম্যানেজার হারামজাদাটা এখনও ফোন করল না। না করলে মুশকিল আছে। বুঝতে হবে অ্যামাউন্টটা বাড়াচ্ছে। শুয়োরের বাচ্চা। সুজয় গেলাসে আবার একটা লম্বা চুমুক দিল।

ঝড় চলে যাওয়ার পর যেমন একটা থমথমে অবস্থা হয়, কণিকার মুখের অবস্থাও সেরকম। তবে জাপানি মোড়ায় বসে এবং ইতালির ক্রিম মেখে সে খুব দ্রুত স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। বলল, ‘তুমি অত হড়বড় করে গিলছ কেন?’

সুজয় আবার চুমুক দিল। বলল, ‘কই, না তো! হড়বড় করব কেন? একটা সিগারেট ধরাব কণিকা? প্লিজ, ওনলি ওয়ান।’ কণিকা ঠোঁট বেঁকাল। সুজয় সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘একটা জিনিস ঠিক হল না।’

কণিকা চোখ তুলে বলল, ‘কী ঠিক হল না?”

‘জোকারটাকে রাতে খাইয়ে বিদায় করা উচিত ছিল।’

‘পাগল হলে নাকি? রাতে খাওয়াব ? যে আমার ছেলেকে ভুরু-নৃত্য শেখাচ্ছে তাকে আমি রাতে খাওয়াব ? তা হলে তো ঘরের মধ্যে দড়ি টাঙিয়ে বিল্টুকে দড়ি-হাঁটা শেখাত। দ্যাখো, দশ বছর আগে একটা ভুল নিজে করেছ বলে আমাদেরও সেই ভুলে তাল দিতে হবে?’

মদ খেলে সুজয় আর স্ত্রীকে ততটা ভয় করে না। সে অবাক গলায় বলল, ‘ভুল! ভুলের কী আছে? সেদিন রক্ত জোগাড় করতে না পারলে ভুল না ঠিক বেরিয়ে যেত কণিকা। রাত তখন কত ছিল তোমার মনে আছে? মনে থাকবে কী করে, তুমি নার্সিংহোমের বেডে তখন কাতরাচ্ছ। নার্সিংহোম থেকে ফোন এল, এক্ষুনি সিজার করতে হবে। মা-বাচ্চা দু’জনের অবস্থাই খারাপ। তখনও আমার গাড়ি হয়নি। উফ, কী সাংঘাতিক অবস্থা। কোনওরকমে ট্যাক্সি জোগাড় করে ছুটলাম।’

ক্রিম মাখা শেষ করে কণিকা চুল বাঁধতে শুরু করেছে। মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘ছুটে কী করলে? জোকারের রক্ত নিয়ে এলে!’

সুজয় গেলাসে আর একটা পেগ ঢালতে ঢালতে বলল, ‘পাগলের মতো কথা বোলো না। আমি কী করে বুঝব জোকারের রক্ত ? যদি বুঝতে পারতাম কখনওই আনতাম না। ব্লাড ব্যাঙ্কের লোকটাকে বলতাম, ভাই, আপনাদের কাছে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের রক্ত আছে? নিদেনপক্ষে ব্রিটেনের রয়্যাল ফ্যামিলির কারও হলেও চলবে। থাকলে তাই দিন, নইলে বাদ দিন।’

কণিকা ঝাঁঝিয়ে বলল, ‘মাতলামি করতে হবে না। দু’দিন পরে ন্যাকামি করে আবার ওখানে গিয়ে চিঠি লিখে এসেছিলে কেন? সেটাও কি না জেনে?

সুজয় গেলাসে পরপর দুটো চুমুক দিল। একটা সোজা ঢালল। বলল, ‘হ্যাঁ, এইটা বলতে পারো বাড়াবাড়ি হয়েছিল। তবে সেক্ষেত্রে তোমার উৎসাহও কম ছিল না। ছেলে হওয়ার আনন্দে তুমি বলেছিলে, ইস, যার রক্তে ছেলেটা বেঁচে গেল তাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত জানানো হল না।’

‘বাবা, তুমি দেখছি আজেবাজে কথাগুলো সব মনে রেখেছ!’

‘মনে রাখিনি। আজ মনে পড়ে যাচ্ছে। দু’লাইনের চিঠি ছিল। তবে আবেগ একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। লেখা ছিল— আপনার রক্তে আমার স্ত্রী রক্ষা পেয়েছেন এবং সুন্দর একটি পুত্রের জন্ম দিয়েছেন। আপনি কে আমরা জানি না। তবু যদি কোনওদিন এই চিঠি হাতে পান, নীচের ঠিকানায় দয়া করে যোগাযোগ করবেন। আপনি যদি কলকাতার বাইরের কেউ হন তা হলে ক’টা দিন আমার বাড়িতে থেকে গেলে আমি এবং আমার স্ত্রী খুশি হব।’

‘চিঠিটা মুখস্থ করে রেখেছ?’

‘রাখিনি। সন্ধেবেলা জোকারটা ছেড়া হলদে হয়ে যাওয়া কাগজটা বের করে দেখাল কিনা! মনে পড়ছে, ব্লাড ব্যাঙ্কের লোকটা চিঠি দেখে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। আমাকে খাতির করে ম্যানেজারের ঘরে নিয়ে গেল। ম্যানেজার ভদ্রলোক সব শুনে চা খাওয়ালেন। বললেন, কাজটা একেবারে অসম্ভব। গ্রুপ, ব্যাচ, তারিখ মিলিয়ে ডোনারকে পাওয়া খুব শক্ত। তারপর দেখার আছে, তোনার কোনও ক্যাম্পে রক্ত দিয়েছিল, নাকি প্রফেশনাল। একটাই পয়েন্ট, আপনার স্ত্রীর রক্তের গ্রুপটা আনকমন। এই গ্রুপের রক্ত এলে আমরা ডোনারের আলাদা লিস্ট রাখি। সেটা একবার দেখব। আমরা খুব চেষ্টা করব যাতে প্রপার ডোনারের হাতে এই চিঠিটা পৌঁছে দেওয়া যায়। তবে না দিতে পারলেও ক্ষতি নেই। আপনারা এই চিঠিটা লিখে একটা খুব বড় মনের পরিচয় দিলেন। আপনি এবং আপনার স্ত্রী যদি অনুমতি দেন, তা হলে এটাকে ফ্রেম দিয়ে বাঁধিয়ে আমরা আমাদের কাউন্টারে দেয়ালে ডিসপ্লে করব। মাইরি বলছি কণিকা, কথাটা শুনে বুকের কাছটা কেমন যেন করছিল ! কেমন কেমন যেন একটা। সেদিন তোমাকে সে-কথা বলেওছিলাম।’

‘না বললানি। বললেও ওসব পচা সেন্টিমেন্ট নিয়ে মাতামাতি করা আমার স্বভাবে নেই। তুমি কিন্তু মাতাল হয়ে যাচ্ছ। এবার থামাও। জোকারটারও বলিহারি। দশ বছর ধরে চিঠিটা আঁকড়ে রেখে দিলি! অ্যাঁ! শুধু রেখে দিলি না, ঠিকানা খুঁজে খুঁজে চলেও এলি! আমার কী মনে হয় জানো? আমার মনে হয় লোকটার বাজে কোনও ফন্দি ছিল। রাতে হয়তো চুরিটুরি করে পালাত। বলা যায় না বিল্টুকেও হয়তো—। তুমি একবার পুলিশে খবর দিয়ে রাখলে পারতে।’

মোবাইল বেজে উঠল। জিনিসটা হাতের কাছেই আছে, ধীরে সুস্থে হাত বাড়ালেই হত। তবু সুজয় হড়বড় করল। কনুইতে লেগে মদের গেলাস উলটে পড়ল কাচের টেবিলে। কণিকা কড়া চোখে তাকিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

ফোন ধরে সুতায় উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে এবং প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি চিৎকার করে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো মল্লিক। আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি। ভেরি গুড। খুব ভাল। পাঁচেই সব মিটে যাবে? বাঃ বাঃ। আমি জানতাম তুমি ইচ্ছে করলেই পারবে মল্লিক। স্টকের হিসেবে গোলমাল ঠিক করতে স্টক ম্যানেজার পারবে না তো কে পারবে? হা হা।’ সুজয় হাসিমুখে সোফায় বসল। গেলাস সোজা করল। বোতল থেকে হুইস্কি ঢালল। তারপর আবার কথা শুরু করল, ‘একদিন তা হলে দু’জনে পার্ক স্ট্রিটে বসি মল্লিক? ঠিক আছে শনিবারই হতে পারে।’ তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘আরে বাবা, চিন্তা কোরো না, থাকবে, থাকবে। আমি বললে মালবিকা থাকবে না, হতে পারে? না না, আজ যেতে পারিনি। যাব কী করে? তোমার ওখানে গেলাম, তারপর সোজা ব্যাক। আর বোলো না মল্লিক, বাড়িতে এসে দেখি সে এক কাণ্ড। ড্রইংরুমে একটা জোকার বসে আছে। আরে না না, তোমার-আমার মতো জোকার নয়, সত্যিকারের জোকার, রিয়েল জোকার। শর্ট হাইট, ফানি লুকিং। বলছিল, রাতেও থাকবে। কোনওরকমে ভুজুংভাজুং দিয়ে তাড়ালাম। বললাম রাতের ফ্লাইটেই মুম্বই যেতে হবে। হেড অফিস থেকে ফ্যাক্স এসেছে। ফ্যামিলিকেও নিয়ে যাব। শনিবার ডিটেলসে বলব। গুড নাইট মল্লিক। থ্যাঙ্ক ভেরি মাচ। এতক্ষণে হালকা লাগছে। গুড নাইট।’

দোতলায় ওঠবার সময় পা ফেলায় একটু ভুল হল সুজয়ের। সামান্য টাল খেল। সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে আছে রতনের মা! এত রাতেও জেগে আছে সে। তার বাড়ি ছাড়া হয়নি। কণিকা তাকে বলেছে, ‘এখন তোমাকে যেতে হবে না। বিল্টুর ক্লাস টিচারকে আমি বুঝিয়ে বলব।’ যেতে না হলেও রতনের মা’র মনটা ভাল নেই। কালোকুলা মানুষটারে না খাইয়ে তাড়ানো একেবারেই উচিত হয়নি। তাদের গ্রামে বলে, অতিথিকে না খাইয়ে বিদায় দিলে বাড়ির বড়দের কিছু হয় না, কিন্তু ছেলেপিলের অমঙ্গল হয়। সুজয়ের টাল খাওয়া দেখে সে বলল, ‘সাবধানে ওঠেন দাদাবাবু।’ সুজয় মনে মনে হাসল। ওঠা কি কখনও সাবধানে যায় ? উঠতে হয় দড়ির ওপর দিয়ে। ইস, জোকারটার কাছ থেকে জিনিসটা শিখে নিলে হত। ওয়াকিং অন দ্য রোপ। দড়ির ওপর হাঁটা।

রাতে শুয়ে পড়ার পর কণিকা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘অ্যাই, ঘুমিয়ে পড়লে? একটা কথা বলো তো, আচ্ছা, বিল্টুর শরীরে কি তা হলে জোকারের রক্ত রয়েছে? সেই জন্যই ও স্কুলের খাতায় সার্কাসের কথা লিখে এল?’

পাশ ফিরতে ফিরতে সুজয় হেসে উঠল, ‘কণিকা, মদ খেলাম আমি, আর তুমি মাতাল হয়ে গেলে। হা হা।’

হাসতে হাসতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *