জৈন ধৰ্ম

জৈন ধৰ্ম

হিন্দুরা বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম ও চার্বাক দর্শনকে নাস্তিক্য দর্শন হিসেবে গণ্য করে—কারণ এরা কেউই বেদ-মাহাত্ম্যে বিশ্বাস করে না, সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে হিন্দুদের কল্পনাকেও পাত্তা দেয় না। প্রকৃতপক্ষে গুরুগম্ভীর কথাবার্তার আড়ালে বৈদিকধর্মের আড়ম্বর সর্বস্বতা ও ব্যাপক পশুবলি, এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মে ধর্মের অনুমোদন দিয়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তিকে (ব্রাহ্মণদের) অসীম ক্ষমতা ও সামাজিক প্রতিপত্তি দেওয়া আর গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষকে চিরস্থায়ীভাবে হতমান করে রাখা তথা ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য—এসবের প্রতিবাদী হিসেবে, সামাজিক প্রয়োজনে ও প্রতিক্রিয়ায় বৌদ্ধধর্ম ছাড়া ঐ একই সময়ে আরেকটি যে ধর্মমত গড়ে ওঠে সেটি হচ্ছে জৈনধর্ম।

তবে বৌদ্ধধর্মের মতো জৈনধর্ম আন্তর্জাতিক ব্যপ্তি লাভ করে নি। মূলত ভারতবর্ষেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। সামাজিক প্রয়োজন কমে আসায় ভারত ভূখণ্ডেও এই ধর্মবিলম্বী ব্যক্তির সংখ্য যথেষ্ট কম। বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ০.১ ভাগ মানুষ তথাকথিত জৈনধর্মাবলম্বী। এঁরা ভারতসহ পৃথিবীর মাত্র ১০টি দেশে ছড়িয়ে আছেন। ভারতীয়দের শতকরা ০.৪৮ ভাগ জৈন; অন্যান্য দেশেও এঁরা রয়েছেন আরো নগণ্য সংখ্যায়।

খ্রীষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বুদ্ধের সমসাময়িককালে জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত বর্ধমান মহাবীর জন্মগ্রহণ করেন (৫৪০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে)। ‘জিন’ কথাটি সংস্কৃত আর তার অর্থ বিজেতা। জৈনধর্মে ২৪ জন জিন-এর কথা বলা হয়, যাঁরা এই ধর্মের আধ্যাত্মিক চরিত্র। এঁরা পার্থিব বন্ধনগুলিকে জয় করেছেন। এঁদের তীর্থঙ্কর নামেও অভিহিত করা হয়, কারণ এঁরা ‘পুনর্জন্মে ভরা জীবননদীর উপর পবিত্র তীর্থ প্রতিষ্ঠা করেছেন’। বর্ধমান মহাবীর সর্বশেষ জীন। প্রথম জিন ছিলেন ঋষভনাথ, ২২তম অরিষ্টনেমিনাথ, ২৩তম পরেশনাথ—যিনি মহাবীরের তথাকথিত নির্বাণলাভের ২৫০ বছর আগে মারা যান। ‘জিন চরিত’ এঁদের জীবন ও উপদেশ নিয়ে লেখা। কিন্তু এটি চূড়ান্তভাবে লেখা হয় আনুমানিক ৪র্থ বা ৫ম শতাব্দী সময়কালে—(অনেকের মতে শুরু হয় খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে) ফলে অবশ্যম্ভাবীরূপে যথেষ্ট কল্পনা ও সংযোজন ঘটিয়ে এদের মাহাত্ম্যের কথা বলা হয়েছে। তবে সম্ভবত শেষ দুই ‘জিন’ ছিলেন ঐতিহাসিক চরিত্র।

বুদ্ধের মতো মহাবীরও রাজপুত্র ছিলেন (জ্ঞাতৃক উপজাতির) এবং ৩০ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করে নির্বাণলাভের জন্য কঠোরভাবে চেষ্টা করেন (এই চেষ্টা চলে ১২ বছর ধরে)। উভয়েই গাছের নিচে বসে মোক্ষলাভ করেন বলে বলা হয়। উভয়েই তথাকথিত নানা স্তূপ বা স্মৃতিচিহ্ন, চৈত্যবৃক্ষ, ধর্মচক্র, রত্নত্রয় এসবকে গুরুত্ব দেন এবং পরবর্তীকালে তাঁদের অনুগামীরা এসবকে পূজা করে। ইন্দ্র, ব্রহ্ম, যজ্ঞ ইত্যাদি হিন্দু চরিত্রগুলিও উভয় ধর্মেই অনুপ্রবেশ লাভ করে। কিন্তু হিন্দুধর্মের মত ঈশ্বর নির্ভরতা জৈনধর্মেও নেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও তার সমস্ত অংশ নিজস্ব সনাতন নিয়মে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলেছে, এ ক্ষেত্রে ঈশ্বরের ব্যাপারটি অপ্রাসঙ্গিক—এই বক্তব্যের বিচারেও জৈনধর্ম নাস্তিক ধর্ম। বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম,—প্রচলিত সংস্কার-বিরোধী এই উভয় ধর্মই প্রসার লাভ করেছিল মূলত শহরাঞ্চলের নিম্নশ্রেণীর মানুষকে কেন্দ্র করে।

তবে বৌদ্ধধর্ম থেকে জৈনধর্মের একটি বড় প্রভেদ হলো, জৈনধর্মে হিন্দুদের মতো কর্মফলে বিশ্বাস করা হয়। জন্মান্তরের কল্পনা তো বটেই, পরের জন্মে কে কীভাবে থাকবে তা আগের জন্মের কাজকর্মের উপর নির্ভর করে- -এমন নির্ভেজাল কল্পনাও জৈনধর্মে স্বীকৃত। তবে পশুবলি ও চতুর্বর্ণভেদ প্রথা জৈনধর্মে কঠোরভাবে অস্বীকৃত। জৈনধর্মে কঠোরভাবে এবং যান্ত্রিকভাবে জীবহত্যা বন্ধ করা তথা অহিংসার কথাও বলা হয়। যান্ত্রিক আচার হিসেবে এরই প্রতিফলন ঘটে মুখে কাপড় চাপা দেওয়া, বসার বা চলার আগে জায়গা ঝাঁট দেওয়া, কঠোর নিরামিষ আহার ইত্যাদির মধ্যে—পাছে ছোটো পোকা-মাকড়ও মারা পড়ে। একই সঙ্গে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে জীব ও অজীব এই দুভাগে ভাগ করা হয়, আর বলা হয় মানুষ তার জীবনের পূর্ণতা লাভ করতে পারে মূলত সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর জীবন-যাপনের ফলে। তাঁদের মতে জগতের সবকিছুরই একটি আত্মা আছে। আত্মাকে পবিত্র করে তোলাই জীবনের উদ্দেশ্য। পবিত্র আত্মা দেহমুক্ত হয়ে সুখের জগতে বাস করে। তবে জ্ঞানের দ্বারাই (যেমন ব্রাহ্মণদের তথাকথিত ব্রহ্মজ্ঞান) মানুষ তার জীবনের পূর্ণতা ও পবিত্রতা অর্জন করতে পারে—উপনিষদের এ ধরনের কথাবার্তাকে অস্বীকার করা হয়।

জৈনধর্মে অহিংসা বা প্রাণীহত্যা না করার ব্যাপারটা একটি বদ্ধ সংস্কার (obsession)-এ পরিণত হয়। এর ফলে কৃষিজীবী মানুষ একে অনুসরণ করার ক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়েন, কারণ চাষবাস করতে গেলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছোটখাট প্রাণীহত্যা, কীটপতঙ্গ হত্যা হবেই। এছাড়া যে সব পেশা প্রাণী হত্যার সঙ্গে যুক্ত, ঐ সব পেশার মানুষদের মধ্যেও জৈনধর্ম প্রসার লাভ করে নি। মূলতঃ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীদের মধ্যে এবং যারা টাকার লেনদেন করে, তাদের মধ্যে জৈনধর্মের জনপ্রিয়তা সৃষ্টির অন্যতম কারণ এটি—কারণ এ ধরনের পেশায় প্রাণীহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোন সংস্রব নেই। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে সমুদ্রোপকূলবর্তী যে সব ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সমুদ্রপথে ব্যবসাবাণিজ্য করত তাদের মধ্যে এটি গৃহীত হয়। তবে জৈনধর্মের মত বৌদ্ধধর্মও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যে বেশ কিছুটা জনপ্রিয় হয়। উভয়ের ক্ষেত্রেই এটি হওয়ার আরেকটি কারণ হল,—চতুর্বর্ণভেদ প্রথার বৈশ্য তথা ব্যবসায়ীরা ঐ সময়কালে অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর হয়েছিলেন; কিন্তু আর্থিক অগ্রগতি ঘটলেও সামাজিক ও আধ্যাত্মিকভাবে তাদের স্থান ছিল ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়েরও পরে—শূদ্রদের কাছাকাছি। এই অপমানকর অস্বস্তিদায়ক অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ তাঁদের সামনে খুলে দেয় জৈনধর্ম—যাতে এই ধরনের বিভেদের কোন স্থান ছিল না এবং যে ধর্ম অনুসরণ করে তাঁরা নিজেদের আর্থিক ক্ষমতা ও সামাজিক সম্মান উভয়ই বাড়াতে সক্ষম হন।

নিয়মকানুন, চিন্তাভাবনা যাই থাক না কেন, অন্য ধর্মের মতো জৈনধর্মেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বা ব্যক্তিত্বের সংঘাত হয়েছে, বিশেষ ব্যক্তিরা নিজেদের বিশিষ্ট মতামতকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। মহাবীরের জীবদ্দশাতেই তাঁর জামাই জমালী এ ধরনের একটি বিভাজনের নেতৃত্ব দেন। এরপর আরো সাতবার নানা ধরনের বিভেদ হয় এবং ৮০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ শিবভূতির নেতৃত্বে যে বিভাজন ঘটে তার থেকে শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর নামের দুই মূল উপদলের সৃষ্টি হয়। জৈন সন্ন্যাসীরা কোনো কাপড় পরবে,  না উলঙ্গ থাকবে—মূলত এই বিতর্কের উপর ভিত্তি করে এই বিভাজন ঘটে। দিগম্বর (অন্য নাম বোটিকা) সন্ন্যাসীরা পার্থিব লজ্জা ইত্যাদির উর্দ্ধে উঠে উলঙ্গ থাকেন, তাদের ভূষণ শুধু অম্বর বা আকাশ। এরা গোঁড়া জৈন। অন্যদিকে শ্বেতাম্বররা উদারপন্থী। (এইবিভাজনের নিয়ে মতভেদ রয়েছে, তবে যথাসম্ভব ৭৯-৮৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই তা ঘটে যায়।)

এই বিভাজনের আগেই কিছু কিছু রাজা জৈনধর্ম গ্রহণ করেন বা তার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বৌদ্ধধর্মের মতো এ ক্ষেত্রেও উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে শাসক হিসেবে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করা। অন্যান্য ধর্মের মতো জৈনধর্মেও কখনোই সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে দূর করার কথা বলা সম্ভব হয় নি। বরং প্রশ্রয়ই দেওয়া হয়েছে। শাসকগোষ্ঠীও তার সুযোগ নিয়ে ধর্মকে ব্যবহার করেছে। দ্বিতীয় খ্রীস্ট পূর্বশতাব্দী সময়কালে কলিঙ্গের রাজা খারবেল জৈনধর্ম গ্রহণ করেন। অশোকের নাতি, রাজা সম্প্রাতি-ও জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী সময়কালে কালকাচার্য জৈনধর্মের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অনুমান করা হয় ইনি বর্তমান ভিয়েতনামের আন্নাম অঞ্চলেও গেছিলেন। এঁর বোন ছিলেন সন্ন্যাসিনী। রাজা গদভিল্ল তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যান। এই রাজাকে উচ্ছেদ করতে কালকাচার্য পশ্চিমভারত ও উজ্জয়িনীতে শকদের আমন্ত্রণ করে আনেন।

শ্বেতাম্বর গোষ্ঠীর নেতা অর্থবজ্র এক সময় সন্ন্যাসীদের জন্য মন্দিরে স্থিতু হয়ে বসবাস করার কথা বলেন (চৈত্যবাস)। পরবর্তীকালে এর থেকে শ্বেতাম্বরগোষ্ঠীর মধ্যে নানা দুর্নীতি ও উচ্ছৃঙ্খলতার সৃষ্টি হয়। পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী সময়কালে দক্ষিণভারতের গঙ্গা, কদম্ব, চালুক্য (গুজরাট), রাষ্ট্রকূট ইত্যাদি সাম্রাজ্য জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করে। সপ্তম শতাব্দী সময়কালে গুজরাট ও রাজস্থানের শাসকগোষ্ঠী শ্বেতাম্বরের মতের অনুগামী হন। একাদশ শতাব্দী সময়কালে শ্বেতাম্বর গোষ্ঠীর সন্ন্যাসীরা আরো অজস্র ভাগ বা গচ্ছ-এ বিভক্ত হন। এ ধরনের ৮৪টি গচ্ছের উল্লেখ পাওয়া যায়—যার অল্পই বর্তমানে তার কিছু অনুগামীদের টিকিয়ে রেখেছে, যেমন খরতর, তপা, অঞ্চল গচ্ছ ইত্যাদি। দিগম্বররাও পরে বিভক্ত হয়— বিষপন্থী ও ১৬২৬ সালে বানারসীদাসের প্রতিষ্ঠিত তেরাপন্থী ইত্যাদি।

১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দে সৌরাষ্ট্রের একটি ক্ষুদ্র গ্রামে জন্মান শ্রীমদ্ রাজচন্দ্র। মাত্র ৩৩ বছরে মারা গেলেও এই নিষ্ঠাবান জৈন অহিংসার নীতির সারবত্তার কথা বলেন এবং সমস্ত সংস্কারের উর্ধে উঠে সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলেন। মহাত্মা গান্ধী জৈনধর্মের এই যান্ত্রিক অহিংসাবাদ ও রাজচন্দ্রের চিন্তাভাবনা দিয়ে প্রভাবিত হন। বেদের আমলের ব্যাপক পশুবলির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রয়োজনে ও প্রতিক্রিয়ায় দর্শন হিসেবে যে অহিংসবাদের জন্ম, আড়াই হাজার বছর পরে তাকে যান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করা হলো। তার ফল কী হয়েছে না হয়েছে তা নিয়ে নানা বিতর্ক চলবে। কিন্তু এটি স্পষ্ট যে, অধিকাংশ ধর্মাবলম্বীরাই শত শত বছর আগে বিশেষ নেতৃত্বদায়ী ব্যক্তি যা বলে গেছেন তাকে অন্ধভাবে অনুকরণ-অনুসরণ করার মধ্য দিয়েই এক আধ্যাত্মিক তৃপ্তি পান। কেন ঐ সব কথাবার্তা বলা হয়েছিল, কোন্ পরিবেশে, কোন্ প্রয়োজনে সে সবের সৃষ্টি, তা ভুলে গিয়ে নিজেদের গোষ্ঠীগত, ঐতিহ্যগত স্বাতন্ত্র রক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে ঐ সব কথাবার্তাকে চিরন্তন ধ্রুব হিসেবে ধরে রাখা হয়। প্রায় কোনো ধর্মই এর ব্যতিক্রম নয়, ব্যতিক্রম নয় আমাদের পরবর্তী আলোচ্য শিখধর্মের প্রসঙ্গটিও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *