জেহাদ এবং মোসাদ
[ইসরায়েল ভার্সেস র্যাডিক্যাল ইসলাম নিয়ে কিছু টুকরো কথা]
‘জেহাদ’ এবং ‘মোসাদ’ এই দুটো শব্দ আসলে এই বিশ্বের জীবন্ত ‘টম অ্যান্ড জেরি’। ২০০৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ‘দ্য গোস্ট’ ইমাদ মুঘানিয়ার মতো মাস্টার টেররিস্টকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিল মোসাদ। লেবাননের জেহাদি সংগঠন হিজবুল্লাহর হেড ইমাদ। একটা সময়ে এই ইমাদ মুঘানিয়া এফবিআই-এর মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে ওসামা বিন লাদেনকেও পিছনে ফেলে হয়ে গিয়েছিল ‘নম্বর ওয়ান’।
আর কাজ?
এই ব্যক্তি বেইরুট শহরে ২৪১ জন ইউএস মেরিন কম্যান্ডোকে একটি বোমা বিস্ফোরণে হত্যা করেছিল। শুধু তা-ই নয়, এই বিস্ফোরণ কাণ্ডে শত শত আমেরিকা, ইসরায়েলি, ফরাসি এবং আর্জেন্টিনিয়ান কম্যান্ডোর রক্ত বয়েছিল।
এরপর থেকেই ইসরায়েল নিজের লক্ষ্য স্থির করে নেয়— ইমাদকে মারতেই হবে। বার বার অসফল হয়। শেষে গিয়ে কাজ উদ্ধার হয় ২০০৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি।
আর এই পদক্ষেপ কিন্তু জেহাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল বা তার মোসাদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল না, না ছিল অন্তিম পদক্ষেপ। একদম প্রথম থেকেই ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়ে এসেছে ইসরায়েল। সম্ভবত প্রত্যেক ইসরায়েলি এই কথাটা জানে যে, ইসলামিক সন্ত্রাস যত মজবুত হবে, ততই ওই সন্ত্রাসবাদীরা ইসরায়েলে অবস্থিত নিজেদের মসজিদগুলোকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা প্রবল করে তুলবে।
ইসরায়েল তখনও এই যুদ্ধ থেকে পিছু হটেনি, যখন মিশরে অগুনতি জনতা তাহরির স্কোয়ারে জমায়েত হয়ে আমেরিকান ফ্ল্যাগ জ্বালিয়ে প্রতিবাদ জানানোর পরে ইসরায়েলি দূতাবাসে আক্রমণ করেছিল। সেদিন উন্মত্ত জনগণের দাবি ছিল একটাই— মিশর যেন ইসরায়েলের সঙ্গে করা শান্তিসন্ধি বাতিল করে দেয়।
এই ঘটনা এবং এরকম অনেক ঘটনা ঘটার পরে সারা বিশ্বে ইসরায়েলি নাগরিকেরা ইসলামিক মৌলবাদের নিশানায় এসে যায়। কিন্তু তবুও ইসরায়েল পিছু হটেনি। এক পা-ও নয়!
আজ ভারতে কিংবা বিশ্বের অন্যান্য দেশে ইসলামিক জেহাদের বিরুদ্ধে যে পরিবেশ গড়ে উঠছে, তার জন্য সাধুবাদ জানাতে হয় ইসরায়েলকেই। খুব নির্দিষ্ট ভাবে বললে সেই সাধুবাদের দাবীদার হল ‘মোসাদ’।
ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের উত্থানটাও বড় নাটকীয়। স্বল্প পরিসরে তা বোঝানো বড় কঠিন কাজ। কেবল এটুকুই বলা যায় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, জেহাদিরা মধ্যপ্রাচ্যের বেইরুট, দামাস্কাস, বাগদাদ, তিউনিশ-এর মতো ভৌগোলিক গুরুত্ব সম্পন্ন শহরগুলিকে নিজেদের গড়ে পরিণত করে তুলেছিল এবং ইউরেশিয়ার প্যারিস, রোম, অ্যাথেন্স তথা সাইপ্রাসের মতো শহরে/ দেশগুলিকে নিজেদের আক্রমণের লক্ষ্যস্থল করে তুলেছিল এই সন্ত্রাসবাদীদের দল।
কিন্তু ইসরায়েলের মোসাদ ইসলামিক সন্ত্রাসের সঙ্গে কখনো আপোষ করেনি। তাদের কোনো সুযোগ দেয়নি। গত শতাব্দীর সাতের দশক থেকে মোসাদ সেই যে জেহাদিদের শিকার করতে আরম্ভ করেছে, তা আজও জারি আছে
বিগত ৪০ বছর ধরে অবিরত লড়াই চালিয়ে ইসরায়েল কিন্তু ইসলামিক সন্ত্রাসবাদকে কয়েক দশক পিছিয়ে দিয়েছে। এতটাই ধাক্কা খেয়েছে সন্ত্রাসবাদ যে আগামী চার দশকেও তাদের ক্ষতি পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর ঠিক এই কারণেই দুনিয়ার বেশিরভাগ ইসলামিক রাষ্ট্র ইসরায়েলের নামও মুখে আনতে চায় না।
চলতি শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ইরানের হুকুমত বলেছিল, ‘আমরা ইসরায়েলকে এই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দেব!’ আর এই বাক্য উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ইরানের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। এতটাই ক্ষমতা ইসরায়েলের।
চলতি শতকের দ্বাদশতম নভেম্বর মাসের ১২ তারিখ। ইরানের তেহরানে একটি গোপন মিসাইল বেসে প্রবল বিস্ফোরণ ঘটল। ধ্বংস হয়ে গেল সেই গোপন ঠিকানা। ডজন ডজন মিসাইল মুহূর্তে পরিণত হল দগ্ধ লোহার টুকরোয়।
ওই মিসাইলগুলো কোন কাজে লাগত?
সমগ্র পাশ্চাত্য সমেত আমেরিকাকে নতজানু করার অস্ত্র ছিল ওই মিসাইলগুলোই। ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর সাহায্যেই ইরানের জেহাদি সরকার সারা বিশ্বকে ধুলিস্মাৎ করে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল।
মিসাইল বেসের ধ্বংসাবশেষে উদ্ধারকাজ চলল। স্থানীয় পুলিশ সতেরোটি শবদেহ উদ্ধার করে আনল।
কাদের শবদেহ?
ইরানের শ্রেষ্ঠ কম্যান্ডো বাহিনীর সদস্যদের।
আর ধ্বংসাবশেষের এক কোণ থেকে উদ্ধার হল ইরানের মিসাইলম্যানের মরদেহ। জেনারেল হাসান তেহরানি মুগহদ্দম। ইরানের তৎকালীন মিসাইল প্রোগ্রামের ইনচার্জ। রক্তাক্ত, নিথর দেহ নিয়ে পড়ে ছিল ইরানের ‘ফাদার অব শেহাব’।
‘শেহাব’ কী?
সেই সময়ে ইরানের সবথেকে দূর অবধি নিক্ষেপণের যোগ্য মিসাইলের নাম ছিল শেহাব।
অজস্র নষ্ট হয়ে যাওয়া মিসাইলের মধ্যে মুগহদ্দমের লাশ দেখে মনে হচ্ছিল এক পিতা নিজের কন্যাদের সঙ্গে নিষ্প্রাণ, রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
প্রাথমিক ভাবে সমগ্র বিশ্ব মনে করেছিল যে, এই হামলা জেনারেল হাসান তেহরানিকে হত্যা করার জন্যই করা হয়েছে। কিন্তু ভুল ভাবা হয়েছিল। সেই প্রমাদ নষ্ট হতে দেরিও হয়নি বেশি। সিআইএ, এফবিআই, র, আইএসআই, কেজিবি-এর মতো তাবড় গোয়েন্দা সংস্থা থাকতে এই জগতে কি কিছু চাপা থাকতে পারে? সেটাও আবার এমন এক সময়ে, যখন তাদের হাজার হাজার চোখ কৃত্রিম উপগ্রহ হয়ে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে।
এই উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন দুনিয়ায় সত্যি সত্যিই কিছু লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। অল্পকালের মধ্যেই সামনে এল আসল কথা— সলিড ফুয়েল নিয়ে যে রকেট এঞ্জিন কোনো নিউক্লিয়ার মিসাইলকে ৬,০০০ মাইল দূরত্ব অবধি পাঠাতে পারত, সেই এঞ্জিনটাকে নষ্ট করে দেওয়ার জন্যই আক্রমণ হয়েছিল।
নিউক্লিয়ার মিসাইল? ৬,০০০ মাইল?
হ্যাঁ, এটাই ইরান থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব।
ইরানের জেহাদি মাথারা আমেরিকার প্রধান শহরগুলোকে নিজেদের লক্ষ্যস্থলে রেখে বিশ্বের মহাশক্তি হয়ে ওঠার স্বপ্নকে লালন করে চলেছিল। কিন্তু ‘নভেম্বর ব্লাস্ট’-এর ফলে সেই পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যায়। ধাক্কা খায় ইরানের বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠার স্বপ্ন।
সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই ‘নভেম্বর অপারেশন’-এর প্রশংসা করল। আর এই অপারেশনকে সফল করে তোলার পিছনে ছিল একটাই দেশ—- ইসরায়েল। আরও নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, মোসাদ।
কিন্তু ইরানের নিশানায় ছিল আমেরিকা, আর অপারেশন ইসরায়েল চালাল কেন?
কারণ ইসরায়েলের রাষ্ট্রপতি ইরান সরকারের সেই বয়ানে রুষ্ট হয়েছিলেন, যেখানে বলা হয়েছিল যে বিশ্বের মানচিত্র থেকে ইসরায়েলের নাম মুছে দেওয়া হবে।
ইসরায়েলের খারাপ লেগেছিল এবং ইসরায়েলের খারাপ লাগলে কী হতে পারে তারপরিণাম সারা দুনিয়া দেখল।
কিন্তু পেরস এখানেই থামলেন না। পেরস, শিমোন পেরস, মানে ইসরায়েলের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি। উনি বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিলেন একজন ইসরায়েলির কাছে রাষ্ট্র মানে কী। কতটা হতে পারে একজন ইহুদির জেদ, তার আন্দাজ দিলেন সকলকে।
নিজেদের বড় বড় বচনের ফলেই ইরান নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনল। আর বিপদের নাম যখন ইসরায়েল, তখন বিষয়টা ভাবায় বইকি।
আরম্ভ হল বিভিন্ন পারমাণবিক পরীক্ষণ প্রকল্পকে নষ্ট করার মধ্যে দিয়ে যন্ত্রপাতি, ল্যাব ভাঙচুর হয়ে যেতে লাগল সকলের অজ্ঞাতসারে। নিহত হতে লাগল একের পর এক ইরানি বৈজ্ঞানিক। ইরানের সৈনিক সাজসরঞ্জামে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে থাকল। সেনার জন্য দরকারি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম তৈরির করার জন্য কাঁচামাল সরবরাহকারী সংস্থাগুলি মাল দেওয়া বন্ধ করে দিল। অনেকে পাততাড়িই গুটিয়ে বন্ধ করে দিল নিজেদের ব্যবসা। ইরানের সেনাদলের উচ্চপদস্থ আধিকারিক এবং বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্তাব্যক্তি তথা বিজ্ঞানীরা পরিবার সমেত অজ্ঞাত দেশের উদ্দেশে পাড়ি দিল।
সমগ্র ইরানের ইন্টারনেটে দৌড়াতে লাগল মারাত্মক ভাইরাস।
এতেও শান্ত হলেন না শিমোন পেরস। আর এভাবে চলতে চলতে এক সময়ে একটা এমন দিন এসেই পড়ল যখন এই ছদ্মযুদ্ধের পরিণাম অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল। এ ধরনের ছায়াযুদ্ধের ফলে যে কোনো রাষ্ট্রের সেনার মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকে। ইরানি সৈন্যদের সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটল 1
শেষমেশ, ইরানি সেনারা হরতাল করে দিল। এই সব ঘটনা ঘটাকালীন, ইসরায়েল একটাই জিনিস ভেবেছিল— তারা বানরের হাতে তরোয়াল দেখতে চায়নি। মানে, ইরানের মতো জেহাদি দেশের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র চলে আসুক তা তারা চায়নি।
আমেরিকা ইসরায়েলের এই কাজের কাছে ঋণী ছিল, আছে এবং থাকবে। ঋণী হয়ে থাকা উচিত সমগ্র বিশ্বের। মোসাদকে বা ইসরায়েলকে যত বড় কুর্ণিশি করা হোক না কেন তা তাদের কাজের তুলনায় কিছুই নয়। কাজটা প্ৰায় অসাধ্যই ছিল।
বিগত শতাব্দীর শীতযুদ্ধে (কোল্ড ওয়ার) যখন বিপক্ষের কোনো গুপ্তচর ধরা পড়ে যেত, তখন তাদের প্রাণে মারা হত না। বার্লিনের কোনো শীতক্ষেত্রের কুয়াশা ঢাকা একটি ব্রিজের দুই প্রান্তে দুই পক্ষ গিয়ে দাঁড়াত। এক এক করে নিজেদের অধীনে বন্দি গুপ্তচরের অদল বদল চলত। রাশিয়ান হোক বা আমেরিকান, ব্রিটিশ হোক বা জার্মান, প্রত্যেক পক্ষের গুপ্তচরেরা জানত যে, কোল্ড ওয়ারে ধরা পড়লেও প্রাণে মারা হবে না। কিন্তু মোসাদের গুপ্তচরেরা জানে যে, বিশ্বের যে কোনো শত্রু-দেশে ওদের ধরা পড়ার মানে একটাই, মৃত্যু। ইসলামিক কট্টরপন্থা, জেহাদের বিরুদ্ধে তাদের এই নজরদারি করার কাজের খেসারত একটাই, জেহাদির বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া।
তাই ইসরায়েলের কোনো কাজই সহজ ছিল না, সহজ হবেও না। তাদের এ ধরনের কাজের মূল্যায়ন স্বল্প পরিধিতে করতে পারা কার্যত অসম্ভব। দুরূহ। তবুও কিছুটা চেষ্টা করা হল। পাঠকদের পছন্দ হলে পরবর্তীতে ইসরায়েল নামক বেড়ালের বাঘ হয়ে ওঠার কাহিনিকে আরও বড় আকারে সামনে আনা হবে।
***
ইজরায়েল ওপর নতুন বই তাড়াতাড়ি আসুক