জেরুসলম

জেরুসলম

আইস, সুশীল পাঠক, যুদ্ধবিগ্রহ তথা রাষ্ট্রপুঞ্জের বৈঠকে যে মেছোহাটার গালাগালি এবং দরকষাকষি হচ্ছে সেগুলো ভুলে গিয়ে পুণ্যভূমি জেরুসলমে তীর্থ করতে যাই।

অতি প্রাচীন নগর জেরুসলম। খ্রিস্টের দু হাজার বছর পূর্বে জেরুসলমফ মিশরীয়দের অধীনে ছিল। তখন তার নাম ছিল উরুসালিমু (শান্তিনিকেতন ত্রাণদুর্গ)। পরবর্তী রোমানযুগে রাজা হারিআন এর নাম দেন অ্যালিয়া কাপিলিনা। খ্রিস্টের দেড়শো বছর পর থেকে ইহুদিরা দলে দলে, কখনও রোমানদের দাসরূপে, কখনও-বা স্বেচ্ছায় জেরুসলমফ ত্যাগ করে।(১) ওই সময় থেকে সে নগরী আর ইহুদি ধর্মের কেন্দ্রভূমি হয়ে রইল না। সপ্তম শতাব্দীতে দ্বিতীয় খলিফা ওমরের আমলে যখন মক্কামদিনার আরবরা এ নগর দখল করে তখন শহরের ৯৫% বাসিন্দা খ্রিস্টান। এবারে প্রায় সকলেই ধীরে ধীরে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে। মক্কামদিনা ত্যাগ করে যেসব আরব এখানে আসে তাদের সংখ্যা ১%-ও হবে না। যে ৯৫% মুসলমান হয়ে যায় তারা যুগ যুগ ধরে জেরুসলমফ তথা প্যালেস্টাইনের (আরবিতে ফলতিন) আদিমতম বাসিন্দা (বস্তুত ইহুদিরা বাইরের থেকে এসে এদেশ জয় করে) এবং ইহুদি কর্তৃক যুগ যুগ ধরে নিপীড়িত হয়েও আপন ধর্ম ত্যাগ করেনি, পরবর্তী যুগে খ্রিস্টান হয়ে যায় এবং সর্বশেষে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিজয়ী সেনাপতি ইংরেজ লর্ড অ্যালেন্‌বি যখন প্যালেস্টাইনে প্রবেশ করেন(২) তখন সেখানে শতকরা ৮৫ মুসলমান, ১০ খ্রিস্টান ও ৫ জন ইহুদি। সে ইহুদিরা ততদিনে ধর্ম ছাড়া সর্ব বাবদে আরব হয়ে গিয়েছে– হিব্রু ভাষা বলতে পারে না, বলে আরবি। একাধিকজন কবিতা লিখে আরবি সাহিত্যে সেরা লেখকদের মধ্যে স্থান পেয়ে গিয়েছেন।

প্যালেস্টাইনে ইহুদি রাজত্ব কায়েম হয়ে ইজরেএল (আরবিতে ইসরাইল) নাম ধরার তেরো বছর পূর্বে, অর্থাৎ ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের বসন্তকালে আমি একদিন কুদস (জেরুমের আরবি নাম) শহরের নগরপ্রাচীরের বাইরে দূর যাত্রীর বাস-স্ট্যানডে দাঁড়িয়ে আছি, তোরঙ্গটি মাটিতে রেখে। বাসনা, যাব ন্যাজরিথ (নাজরেৎ, আরবিতে অর্থাৎ বর্তমান যুগে প্রচলিত নাম অন্-নসিরা –আদি যুগের খ্রিস্টানদের ওই নাম থেকে ন্যাজরিন নামে ডাকা হত। মুসলমানরা আজও ওদের সারা নামে পরিচয় দেয়) যেখানে প্রভু যিশু বাল্যকাল কাটান, মা মেরি (আরবিতে মরিয়ম) যে কুয়ো থেকে জল আনতে যেতেন সেটা নাকি তখনও আছে! আরও নাকি আছে, মা-মেরির রব জোসিফ-এর (আরবিতে ইউসুফ) ছুতোরের কারখানা। ইনি যিশুর পিতা নন। কারণ প্রভুর জন্ম হয়েছিল কুমারী-গর্ভে, পবিত্র আত্মা দ্বারা। নিউ টেস্টামেনট ও কুরান শরিফ, দুই-ই এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, মা-মেরির বর জোসিফ ব্ল্যাদা দিয়ে কাঠ পরিষ্কার করে কাঠে কাঠে জোড়া দিতেন, আর প্রভু যিশু মানুষের চরিত্র পরিষ্কার করে মানুষে মানুষে জোড়া দিতেন। যে স্যামারিটানদের প্রভু যিশুর গোষ্ঠী এবং তাঁর কট্টর ইহুদি সম্প্রদায়ের শিষ্যরা দু চক্ষে দেখতে পারে না তিনি করেছেন তাদের প্রশংসা– গুড স্যামারিটান। এই স্যামারিটানরাও ইহুদি, কিন্তু যেসব ইহুদিরা ইজরাএল সৃষ্টি করেছে এদের সঙ্গে স্যামারিটানদের দ্বন্দ্ব চলেছে প্রায় তিন হাজার বছর ধরে। জেরুসলমে প্রতিষ্ঠিত রাজা সলমনের (আরবিতে সুলেমান) মন্দির যে ইহুদির পরমেশ্বর আহভের (জেহোভা, ইলোহিম) পীঠস্থল একথা স্বীকার করেনি। আজ যেখানে নাবলুস শহর (বাইবেলের শেখেম) তারই পাশে গেরিজিম পাহাড়ের উপর ছিল তাদের আপন মন্দির।

একদা এই স্যামারিটান জাতি সংখ্যায়, খ্যাতি-প্রতিপত্তিতে মূল ইজরাএলিদের চেয়ে কোনও অংশে হীন ছিল না। তাবৎ ইহুদি যখন প্যালেস্টাইন পরিত্যাগ করে তখন শত অত্যাচার সহ্য করে দেশের মাটি কামড়ে ধরে এরা পড়ে থাকে। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্বগোত্রে বিবাহের ফলে এদের সংখ্যা কমতে কমতে এখন মাত্র চারশোতে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমি যখন পুণ্যভূমিতে যাই তখন দেখি খবরের কাগজে একটা তর্কবিতর্ক চলেছে। যদ্যপি আজ খবর-প্রতিষ্ঠানগুলো বলছেন, স্যামারিটানদের সংখ্যা আনুমানিক প্রায় চারশো, আমাকে কিন্তু তখন বলা হয়েছিল প্রায় আশি। খবরের কাগজে আলোচনা হচ্ছে, এই স্যামারিটানদের প্রধান রাববি-র (পণ্ডিত পুরোহিতের) একমাত্র জোয়ান ব্যাটা– ইনিই পরে প্রধান রাববি হবেন সোমত্ত হয়েছেন, এখন তাকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু হায়, কনে কোথায়? মাসিপিসিদের অর্থাৎ অগম্যাদের বাদ দিলে তিনি যে দুটি বধূকে বিয়ে করতে পারেন তাদের একটির বয়স ষাট এবং তিনি তারস্বরে চিৎকার করে বলছেন– আমাদের আইবুড়ো জাতকুলীন বৃদ্ধারা যা বলে থাকেন– তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে! এখন সাজব কনে বউ! কী ঘ্যান্না। কী ঘ্যান্না। এবং তদুপরি দ্রষ্টব্য, এই বৃদ্ধাকে বিয়ে করলে বংশরক্ষা হবে না, এবং এস্থলে সেইটেই সর্বপ্রধান উদ্দেশ্য।…দ্বিতীয় বধূটি বোবাকালা ইডিয়েট।… স্যামারিটানরা আড়াই হাজার বছর ধরে ইজরাএলিদের সঙ্গে বিয়েশাদি করেনি। এখনই-বা করে কী প্রকারে? এসব গুল-গ্যাস আমি শুনেছি প্রাচীন জেরুসলমের হেরোদ গেটের কাছের (এখানেই ভারতীয় হসৃপিস্– সরাইখানা, চট্টি যা খুশি বলুন– অবস্থিত) কাফে– আড্ডাতে। এর শতকরা ৯৯% পাঠক বাদ দিতে পারেন। মোদ্দাটুকু শুধু এই : যুবক রাববিপুত্রের জন্য বিবাহযোগ্য বধূ সে কুলে নেই।

অতএব স্থির হল, ওই জাতশত্রু ইজরাএলি ইহুদিদেরই কোনও মেয়ে বিয়ে কর। হাজার হোক, ওরা তো ইয়াহভে মানে, ধর্মগ্রন্থ পেনটাটয়েশ স্বীকার করে। খ্রিস্টান, মুসলমান তো আর বাড়িতে ভোলা যায় না।

ন্যাজরিথ যাবার পথে পড়ে স্যামারিটানদের নাবলুস; নিশ্চয়ই দেখে যেতে হবে। নিঃসন্দেহে যারা অন্তত তিন হাজার বছর ধরে ভিটের মাটি (ওহ! আর সে কী মাটি, বালি-পাথরে ভর্তি!) কামড়ে ধরে পড়ে আছে, তারা দ্রষ্টব্য বইকি।

***

সে আমলে প্যালেস্টাইনে চলত তিন রকমের বাস্। আরব বাস্, ইহুদি বাস্ আর স্টেট বাস্। কাটা ফালাইলেও ইহুদি চড়ত না আরবের বাস্ এবং ভাই ভাসা। দু দলেই চড়ত স্টেট বাস।

আত্মচিন্তায় নিমগ্ন আমার সামনে এসে হঠাৎ দাঁড়াল একখানি করকরে নতুন ট্যাকসি। আরব ড্রাইভারের পাশে দেখি গোটা পাঁচেক মেল-ব্যাগ। পিছনের সিটে জাব্বাজোব্বা পরা ইয়া মানমনোহর গলকম্বল দাড়িওলা দুই রাববি। এক রাববি পিছনের দরজা খুলে বার বার বলে যাচ্ছেন, উঠে পড়, উঠে পড়।

আমি ক্ষণে সালাম জানিয়ে, ক্ষণে জোড়-হাতে নমস্কার করে (এটা ভারতীয়দের পেটেন্ট মাল বিদেশি মাত্রই চেনে!), ক্ষণে ডান হাত বুকের বাঁ দিকের উপর রেখে ঝুঁকে ঝুঁকে ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, ট্যাকসিতে যাবার মতো কড়ি আমার গ্যাঁটে নেই। আমি যাব বাস-এ।

দুই রাববি যা বলেছিলেন– আহা কী সুন্দর অত্যুকৃষ্ট বিদগ্ধ নাগরিক আরবি ভাষাতে– তার তাৎপর্য কী উৎপাত, কী জ্বালাতন! উঠে পড়, উঠে পড়। আমরা কি কানা! দেখতে পাচ্ছিনে, তুমি ভিনদিশি? আমরা তো ট্যাসিটার সাকুল্যে পিছন দিকটা ভাড়া নিয়েছি। উঠে পড় উঠে পড়। কী মুশকিল! আড্ডা বাপু, তুমি বাস্-এ যে ভাড়া দিতে সে-ই না হয় আমাদের দেবে। (এই বেলা বলে নিই, পরে, বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও সেটা তারা নেননি।

কিন্তু ইয়া আল্লা, বসি কোথায়! গোটা তিনেক মোরগামুরগি কাক-মাক করছে, দু-তিন ঝুড়ি আলু-টমাটো-মটরশুটি কপি, দুখালুই ডিম, আর কী কী ছিল খোদায় খবর।

রাববিরা বরাব্বর বলে যাচ্ছেন, হয়ে যাবে, হয়ে যাবে।

এক রাববি কুণ্ঠিত কণ্ঠে বললেন, মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। তাই এতসব।

আমি চোখের তারা কপালে তুলে বললুম, বলেন কী মশাই! এই তিনটে আণ্ডা, গোটাকয়েক মুরগিতেই আপনাদের দেশে কন্যাপক্ষ খুশি হয়ে যায়! তাজ্জব! তাজ্জব!! আমাদের মোশয়, সিনাই পর্বত প্রমাণ মাল নিয়ে গেলেও হালাদের মুখে হাসি ফোটে না।

আমার জেবে একটা হাতির দাঁতের ডিম্বাকার নস্যির কৌটো ছিল। নস্যাভাবে সেটাতে রাখতুম মিশরীয় সুগন্ধি। সেইটা তুলে ধরলুম তাদের সামনে।

দুই রাববি আমাকে জাবড়ে ধরে চুমো খেতে লাগলেন।

বিস্তর কথাবার্তা হল। নাবলুস, ন্যাজরিথ গল্পের তোড়ে পেরিয়ে গিয়ে তখন পৌঁছে গিয়েছি গেলিলিয়ান লেক-এ।

দুই রাববি আমার মাথার উপর হাত রেখে বিস্তর মন্ত্র পড়ে গেলেন। তাদের আশীর্বাদের এক কণাও যদি সফল হয় তবে আমি ভারতবর্ষের রাজা হব।

————

১. পুণ্যনগরী জেরুস্লম যে ইহুদিদের একদিন ত্যাগ করে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে হবে সেকথা এর প্রায় ৮০০ বছর পূর্বে ইহুদি প্রফেটরা বার বার ভবিষ্যদ্বাণী করে ইহুদিদের সাবধান করেছেন। তারা কান দেয়নি; আচার-আচরণ বদলায়নি। এই বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ার নামই ডিসপারসেল, গ্রিক দিয়াসপরা।

২. ইংরেজ অ্যালেবি যখন জেরুসলমে প্রবেশ করেন তখন সে খবর একজন অস্ট্রেলিয়ান সৈন্যকে দিলে পর সে রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে বলে, তাই তো! প্রভু খ্রিস্টের জন্মকালে যেসব মেষপালককে দেবদূত সে সুসমাচার জানান, তাদের বংশধরদের একটু হুশিয়ার করে দিলে হয় না যে– ইংরেজ ভেড়ার পালে ঢুকেছে– মতলবটা ভালো নয়। শপ-লিফটার ইংরেজ শি-লিফটিঙেও যে কিছু কম যান না সে তত্ত্ব আউসি বিলক্ষণ জানত। তার হুশিয়ারি কিন্তু পরবর্তী যুগে টায় টায় ফলেনি। ইংরেজ যখন দেখল যে সে নেটিভদের সঙ্গে পেরে উঠবে না, তখন তাদের পিছনে ইহুদিদের লেলিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। আর ইহুদি যে শুধু ভেড়াগুলো মেরে দিল তাই নয়, নেটিভদের জর্ডনের হে-পারে (আমরা যেরকম বলি পদ্মার হে-পারে) খেদিয়ে দিল।  ৩. এ জায়গাটা ছিল জরডন এলাকায়। হালে ইজরাএল বাহিনী সেখানে পৌঁছে গেরিজিম মন্দিরের ভগ্নাবশেষের উপর ইজরাএলের জাতীয় পতাকা তুলতে গেলে স্যামারিটানদের সঙ্গে হাতাহাতির উপক্রম হয়। পরধর্ম বাবদে ইহুদিরা ঈষৎ অসহিষ্ণু এ তত্ত্বটি ইংরেজ জানত বলেই ইজরাএল রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় (১৯৪৮) তারা খ্রিস্ট-মুসলিম গির্জা মসজিদে ভর্তি প্রাচীন জেরুস্লম (ইহুদিদের বিশেষ কোনও স্থাপত্য এ শহরে আজ আর নেই, কারণ রাজা হাদরিয়ান শব্দার্থে এ নগরের উপর হাল চালিয়েছিলেন এবং ওই সময়ই ইহুদিকুল শেষবারের মতো জেরুস্লম পরিত্যাগ করে বলে পরবর্তী যুগে কিছু নির্মাণ করার সুযোগ পায়নি)। ইজরাএলের শত মিনতিভরা কাতর রোদনে কর্ণপাত না করে মুসলমান জর্ডনরাজকে দিয়ে দেন। হালের যুদ্ধের ফলস্বরূপ ইজরাএল যখন প্রাচীন জেরুস্লম অধিকার করে তখন এ যুগের ইংরেজ লেবার (অর্থাৎ ঐতিহ্যহীন অনভিজ্ঞ) সরকার কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। কিন্তু স্যামারিটানদের মন্দিরে ইজরাএলের ব্যভিচারের খবর ইংল্যন্ডে পৌঁছনো মাত্রই লেবার-বাবুদের কানে জল গেছে। নিরাপত্তা পরিষদে চিৎকার করে ইংরেজের ফরিনমন্ত্রী ব্রাউন একাধিকবার বলেছেন, ইহুদিকে প্রাচীন জেরুস্লম ছেড়ে দিতেই হবে। এই প্রাচীন নগরীর ভিতরে রয়েছে খ্রিস্টের বিরাট সত্যই অতি বিরাট সমাধি। সৌধ (হোলি সেপালকর), গেৎসিমেনের বাগান যেখানে প্রভু যিশুর দেহ থেকে স্বেদের পরিবর্তে রক্ত বেরোয়, মাউন্ট অলিভ এবং ভিয়া দলরসা যে পথ দিয়ে প্রভু ক্রুশ বহন করে বধ্যভূমিতে পৌঁছন। (মুসলমানদের হরমশরিফ, মসজিদ-উল-আকসা বাদ দিচ্ছি– এগুলোর জন্য ইংরেজের কোনও দরদ না থাকাই স্বাভাবিক)। ইজরাএলের সাতিশয় বিবেচক করুণ করে এগুলো সঁপে দিতে ব্রাউন হিম্মত পাচ্ছেন না। কিসের হাতে যেন কী সমর্পণ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *