1 of 2

জেন্টলম্যান – রঞ্জন

জেন্টলম্যান – রঞ্জন

কথাটা মনে পড়ল সেদিন সকালে বাথরুমে। একটু অদ্ভুতভাবে।

হাতে আমার ট্রুথব্রাশ, সামনে টুথপেস্টের টিউব। মাসের শেষ, তাই টিউব প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। যখন ভর্তি থাকে তখন আস্তে আমি ওটার লেজের দিকে চাপ দিই আর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে প্রায় এক ইঞ্চি পরিমাণ টুথপেস্ট। কম নয়, ‘বেশি নয়। কিন্তু যে টিউব তার অন্তিম অবস্থায় পৌঁছেছে তার সাধ্য নেই অমন মিতাচারী হবার। তাই আমার ফুরিয়ে আসা টিউব সম্বন্ধে যখন আমার মনে সন্দেহ ছিল আধ ইঞ্চি পেস্টও তার অভ্যন্তরে আছে কিনা তখন স্বভাবতই আমি ওটার গলা টিপলুম জোরে—আর অমনি বেরিয়ে এলো প্রয়োজনাতিরিক্ত টুথপেস্ট, প্রায় দু’ ইঞ্চি। অপচয় হলো।

কিন্তু আমার ততক্ষণে মাজনের কথা মনে ছিল না। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল অজিত ঘোষের মুখ। ওর দশা হয়েছে আমার ওই টুথপেস্ট টিউবটার মতো। সবই প্রায় ফুরিয়ে গেছে। বাকি যা আছে তা মাথায় এসে উঠেছে। ওর আর সাধ্য নেই হিসেবী হবার। মাথার দিকে একটু টিপলে বেরিয়ে আসে বেহিসেবী দু’ ইঞ্চি।

অজিত ঘোষের টিউব যখন ভর্তি ছিল তখন আমি ওকে জানতুম না। আমি ছাড়া প্রায় সবাই জানতো। আজও কলকাতায় এমন প্রধান ব্যক্তি—অফিসে, ক্লাবে—অল্পই আছেন যাঁদের সঙ্গে অজিত অন্তরঙ্গ নয়! ম্যাকিনলে কোম্পানির নাম্বার ওয়ান মিস্টার উইলিয়াম আর্চারকে অজিত বিল্ বলে ডাকে অনায়াসে। ওয়াল্টার হ্যারিসন কোম্পানির বড় সাহেব আর সবায়ের কাছে অ্যাণ্টনি ক্যাম্পবেল হতে পারে, অজিতের কাছে অনেক দিন থেকে সে টোনি বয় মাত্র। এর কারণ বোঝাও শক্ত নয়, কেননা অজিত ঘোষ প্রথম সারির একটি ম্যানেজিং এজেন্সির অফিসে প্রবেশ করেছিল এমন দিনে যখন ওইসব চাকরিতে অল্প ভারতীয়েরই প্রবেশাধিকার ছিল। সরকারি চাকরিতে আই সি এস বা আই পি যেমন একদিকে আর আজকালকার আই এ এস অপর দিকে, অজিতের সঙ্গে স্বরাজোত্তর নেতাজী সুভাষ স্ট্রিটের কালো সাহেবদের ব্যবধান ততখানি বা তার চেয়েও বেশি। অজিত শুধু য়ুরোপীয়ান কভেনান্টেড অ্যাসিস্ট্যাণ্ট ছিল না, তার নিয়োগ হয়েছিল বিলাতে, যার নাম বোধ হয় হোম অ্যাপয়ণ্টমেণ্ট।

অজিতের অধিকার ছিল এই চাকরিতে। ওর পিতামহ ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম, ওর বাবা ছিলেন স্বল্পসংখ্যক ভারতীয় আই এম এস-দের অন্যতম। ওর নিজের শৈশব কেটেছে ইংল্যাণ্ডে কোনো দ্বিতীয় শ্রেণীর পাবলিক স্কুলে—ছুটি কাটাতে সুইটজারল্যাণ্ডে বা দক্ষিণ ফ্রান্সে, পিতামহী ও পরে মায়ের সঙ্গে। প্রথমে কাজ করেছিল হোম অফিসে, পরে বদলি হয় প্রথম করাচি শাখায়, পরে বম্বেতে এবং সব শেষে কলকাতায়। এটা অজিতের কাছে শোনা নয় ; যাঁরা জানেন বলেন, অজিত এতদিনে ওর কোম্পানির ডিরেক্টর হতো নিশ্চয়ই। এখন ওর জায়গায় অন্য ভারতীয় আছেন।

এত কথা বলার প্রয়োজন ছিল এইটে বোঝাতে যে এত উপরে ছিল বলেই অজিতের পরবর্তী পতনে এত শব্দ হয়েছিল—আজও এ সম্বন্ধে গল্প শোনা যায় এ-মহলে ও-মহলে। এত উপর থেকে পড়েছে বলেই ওর নিজের আঘাত লেগেছিল এত বেশি।

বাইরে থেকে অনেকের কাছেই অজিত-পতন আকস্মিক বলে মনে হয়েছিল। অত বড় বাড়ি একদিনে ধসে যায় না। নিচে থেকে তার ভিত ক্ষয়ে যাচ্ছিল অনেক দিন থেকেই, কিন্তু অজিতের বাইরের জীবনযাত্রায় বিশেষ কোনো পরিবর্তন কেউ দেখতে পায়নি। রেসে অজিতকে দেখা গেছে আগেকার মতো। তফাত যদি কেউ লক্ষ করতো তবে শুধু দেখা যেতো যে অজিত আগের চাইতে একটু বেপরোয়া এবং দুটো রেসের মধ্যে সে বারে যেন একটু বেশি সময় কাটাচ্ছে। ক্যালকাটা ক্লাবে আগেও অজিতের নিত্য উপস্থিতির কথা সবাই জানতো। দু’য়েকজন ছাড়া কেউই লক্ষ করেনি যে অজিত আগে কেউ ডাব্‌ল্ চাইলে তাকে বর্বর মনে করতো, এখন সে নিজেই ডাব্‌ল্ ছাড়া নেয় না। তারও কিছুদিন পরে বারম্যান জিজ্ঞাসা করেছিল : “আজ জিন্ কেন সাহেব?”

অজিত একটু থেমে জোরে হেসে উত্তর দিয়েছিল, “আজ সুবেসে জিন্ পিতা থা, ইসি লিয়ে। ঔর এক।”

অজিতের সমৃদ্ধিতে এই সামান্য ফাটল তার থ্রী হান্ড্রেড ক্লাবের বন্ধুরাও লক্ষ করেনি। সেখানে তার প্রতাপ যেমন ছিল তেমনি আছে। বন্ধুদের দৃষ্টি সন্ধ্যার সামান্য পরেই আচ্ছন্ন না হলে তারা দেখতো, অজিত বারোটার পরে কীরকম যেন অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। একটা প্রচ্ছন্ন কিন্তু অপ্রতিরোধ্য অস্থিরতা ওকে যেন সজোরে দমিয়ে রাখতে সর্বক্ষণ চেষ্টা করতে হচ্ছে। কারো চোখে পড়েনি এ সব। তারা ভেবেছে, এমন হয় সবায়েরই। কেউ কোনো দিন বা কয়েক দিনের জন্য বেশি খায়, তারপর কম। অজিত যে মাসের পর মাস ওই অধিক পানের পর্যায়ে থেকে গেছে তা বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি তার প্রধান কারণ তার উদারতা অক্ষুন্ন ছিল। ঠিক আগেকার মতো সে সই করেছিল বন্ধুদের জন্য। দেড়টা দুটোর সময় কেউ বাড়ি যাবার কথা বলতো, অজিত তাকে গায়ের জোরে ধরে রাখতো। অজিত যে সত্যি তার সঙ্গ চায় না, শুধু নিঃসঙ্গতাকে ভয় পায়, এটা সঙ্গীদের মনে না হলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না নিশ্চয়ই।

দিনের বেলায় অজিত অফিসের কাজ করতো। এই কাজের গুণাগুণে যদি কোনো তারতম্য ঘটে থাকে তা বাইরের লোকের জানার কথা নয়। দু’চারজন সহকর্মী লক্ষ করেছিল, অজিত বেশিরভাগ দিন বাইরে লাঞ্চ খাচ্ছে। কেউ মন্তব্য করেনি কেননা এমন হওয়া একেবারে বিস্ময়কর নয়। অজিতকে কিছুটা এন্টারটেইন করতেই হয়। দু’চারজন কেরানী লক্ষ করে থাকবে, অজিত লাঞ্চের পরে একটু বেশি মেজাজ গরম করে। বলা বাহুল্য, তাদের কারো সাহস ছিল না এ নিয়ে কথা বলবার। শুধু নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছে, ঘোষসাহেব যেন আজকাল মাত্রা একটু চড়িয়ে দিয়েছে, দিনের বেলায়ও। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া যাক, অজিতের পতনের পরে কেরানীরা এই সময়কার ঘটনাগুলির উপর অনেক কল্পনার প্রলেপ দিয়ে অনেক রসাল কাহিনী রচনা করেছে। কেরানীদেরও দোষ দেয়া উচিত হবে না, তার বন্ধুরাও পরবর্তী কালে প্রচুর কাহিনী রচনা করে তার অনুপস্থিতিতে পরিবেশন করে পরিতৃপ্তি লাভ করেছে।

কিন্তু আবার আগের কথায় ফিরে আসা যাক। রেসে বেশি হেরেই হোক বা স্টক এক্সচেঞ্জে বেশি লোকসান দিয়েই হোক, অজিতের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমেই অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠল। অফিসের কাজে মন বসাতে পারে না। বাইরে টাকা রোজগারের প্রাণান্তকর চেষ্টায় অজিত এমন কয়েকটা কাজ করতে বাধ্য হলো যা কিছুদিন আগেও পাবলিক স্কুলের সন্তান অজিত ঘোষের পক্ষে একান্তই অভাবনীয় ছিল। এমনি সময় তার সর্বনাশ সম্পূর্ণ করবার জন্য তার স্ত্রী জয়া কলকাতা ছেড়ে চলে গেল দিল্লীতে তার বাবার কাছে। অজিতের দশা হলো সেই নৌকোর মতো যা থেকে মাঝি লাফিয়ে পড়ে সাঁতরে গেছে পাড়ের দিকে।

জয়াকে দোষ দেবার অধিকার আমার নেই। আমি তাকে কখনো দেখিওনি। আমি শুধু ঘটনার বর্ণনা করেছি নৌকোর উপমা দিয়ে, মাঝিকে দোষ দিতে নয়। এর পরেই অজিত কয়েকদিন আর অফিসে গেল না। টেলিফোনে একবার খবর পর্যন্ত দিল না। অফিস থেকে যখন টেলিফোন এসেছিল তখন সে বাইরে। অফিসেও ইতিমধ্যেই খবর কিছু কিছু পৌঁছল বড় সাহেবের কানে। তিনি প্রথমে এসব গ্রাহ্য করেননি। অজিত তাঁর প্রিয়পাত্র। সাহেবের নেশা রাগ্‌বির আর রাগার খেলতে অজিত ছিল উৎসাহী ও পারদর্শী। কিন্তু ক্রমে সাহেব অধৈর্য হলেন। আরো খবর নিয়ে বিব্রত হলেন। এখন তিনি করবেন কী? বরাবর তিনি ভালো রিপোর্ট দিয়ে এসেছেন অজিত সম্বন্ধে। এখন কী করে ফিরিয়ে নেবেন সব কথা? অথচ কিছু ব্যবস্থা না করেও উপায় নেই। ক্রমে অজিতের দুর্নাম উপচে পড়বে কোম্পানির নামে। তার আগেই অজিতকে নিয়ে একটা কিছু করা দরকার। কিন্তু কী করে? এদিকে দেখাও নেই অজিতের।

এই দিনগুলির ইতিহাস একটু অস্পষ্ট। শুধু এই জানি যে কয়েকদিন পরে বড় সাহেব একটি চিঠি পান অজিতের। অজিত পদত্যাগ করেছে। পদত্যাগপত্রের সঙ্গে একটি ব্যক্তিগত চিঠিতে লিখেছে : সে এখন বিপদে পড়েছে। কিন্তু এই বিপদ নিয়ে সে কোম্পানিকে বিব্রত করবে না, তার সাহেবকে তো নিশ্চয়ই নয়। তাই পদত্যাগ। তাড়াতাড়ি গৃহীত হলে বাধিত হবে। তাছাড়া প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকাটা একটু তাড়াতাড়ি পেলে সুবিধা হয়।

সাহেব যতটা দুঃখিত হলেন প্রায় ততটাই আশ্বস্ত হলেন। কোনো একটি ভারতীয় অ্যাসিস্ট্যাণ্ট যেন কী বলতে গিয়েছিল অজিতের সম্বন্ধে। সাহেব ধমকে বললেন, “আই অ্যাম সরি ফর অজিত। বাট ডোণ্ট্ ফরগেট, টু দি লাস্ট্ হি হ্যাজ্ প্লেড্ দি গেম্। ইন্ রিজাইনিং লাইক্ দিস্ হি হ্যাজ এগেন অ্যাক্টেড্ অ্যাজ্ এ জেন্টলম্যান। হি হ্যাজ্ ডান ইকস্যাক্টলি হোয়াট্ হিজ স্কুল উড্ হ্যাভ্ উইশড্।”

“জেন্টলম্যান” —এই কথাটা অজিতের সম্বন্ধে আমি যে কতবার শুনেছি, তার ইয়ত্তা নেই। এই পাবলিক স্কুলের তৈরি জেন্টলম্যানের কথা আমি ইংরেজি উপন্যাসে প্রবন্ধে পড়েছি। অজিতের সঙ্গে দেখা হতে তাই আমার কৌতূহল স্বভাবতই জাগরিত হল। প্রত্যক্ষ পরিচয় হোক জেন্টলম্যানের সঙ্গে। যদি কেউ বলে এটা আমার জন্মগত স্নবারির অন্যতর পরিচয়, তবে সে ভুল করবে। জেন্টলম্যান কথাটা খাস বিলাতেই বিদ্রুপের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন তাকে দেখা যায় প্রধানত কার্টুনে বা হাসির গল্পে। দ্বিতীয়ত, আমার সঙ্গে অজিতের দেখা হয় তখনই যখন তার জেন্টলম্যানত্ব অন্তিমে এসে উঠেছে—সেই আমার টুথপেস্টের টিউবের মতো।

খাতে খাতে বলি। অজিত তখন ক্যালকাটা ক্লাবে পোস্টেড—বাকি কেউ বলে আড়াই হাজার, কেউ সাড়ে তিন। থ্রী হান্ড্রেড ক্লাবে তার প্রবেশ নিষেধ। প্রথম কারণ বাকি—হাজার ছয়েক। আর দ্বিতীয় কারণ, শেষ দিনে সে মত্তাবস্থায় মারামারি করেছিল। কোন রাণার সঙ্গে। অজিতের স্বাস্থ্য সহস্র রজনীর লক্ষ অমিতাচারেও ভেঙে পড়েনি ; নাক ভেঙেছে রাণার। ক্লাবে ক্লাবে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। আর অল্প কয়েকদিনের মধ্যে সব ক্লাবের সব দরজা বন্ধ হয়ে গেল অজিতের মুখের উপর।শুধু ক্লাবগুলির নয়, অনেক বন্ধুর বাড়িরও। অজিত তখন একা। সঙ্গী খোঁজে আপন বদ্ধ শ্রেণীর বাইরে ; সেখানে জেণ্টলম্যান নেই, ভদ্রলোক আছে।

কিন্তু ক্লাস-ওয়ার থাক। অজিতের জেণ্টলম্যানত্বের পরিচয় আমি খুব স্পষ্টভাবে কখনো পাইনি, কিন্তু ওকে আমার খারাপ লাগতো না। ওর ব্যবহারে একটা স্বাভাবিক সৌজন্য ছিল। ও বিলাতী হোটেলে গিয়ে এমনভাবে অর্ডার দিতো যেন হোটেলের মালিকই অজিত ঘোষ। বেয়ারারা ওকে দেখে বুঝতে ও সাহেবের জাত, আদেশ দিয়েই ওর অভ্যাস। বেয়ারা পছন্দ করে এই জাতকে। এরা আট আনা বকশিশ দিয়ে যে সেলাম পায় তা নবাগতদের জোটে না দ্বিগুণ বকশিশ দিলেও। দ্বিতীয়রা বেশি বকশিশ দিলে তারা ভাবে, নতুন কিনা, আমাদের কিনতে চায় টিপ্‌স্ দিয়ে, বোকা কোথাকার। অজিতের আরো গুণ ছিল। ও গল্প জানতো ভূরি ভূরি। ইংরেজিতে যাকে স্মাটি গল্প বলে তার স্টক ছিল ওর বিরাট, ওর নির্ভুল উচ্চারণে সেই সমস্ত কাহিনী বলে ও হাসাতে পারতো সবাইকে। আমাকেও। মোদ্দা কথা আমি ওকে পছন্দ করতুম। পছন্দ করতুম এতদূর পর্যন্ত যে, ও যে দু’তিনবারে আমার কাছ থেকে প্রায় শ’ দুয়েক টাকা ধার করেছে তা ধার দেবার সময় আমার আদৌ মনে হয়নি।

পরে জেনেছি, আমি অজিতের একমাত্র উত্তমর্ণ নই। মাসের পরে মাস চলে গেছে অজিত ধার তো শোধ দেয়ইনি, তার উল্লেখ মাত্র করেনি কোনো দিন। সমস্ত বিষয়টাই যেন অশ্লীল, ভালগার। টাকা-পয়সা নিয়ে আলোচনা করবে যাদের টাকা-পয়সা নেই, এই মধ্যবিত্ত বা নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা। জেণ্টলম্যান তার সঙ্গে পর্যন্ত টাকা রাখে না, কেননা তার সই গ্রাহ্য হয় সর্বত্র। অজিতের এই অবস্থা ঘুচে গেছে অনেক কাল, কিন্তু অভ্যাসটা যায়নি। এদিকে আমারও ওই শ’ দুয়েক টাকার আসন্ন কোনো প্রয়োজন ছিল না। তাই তাগাদা দিইনি। তবু ভালো লাগতো না। যার পকেটে পয়সা নেই, সে কেন রোজ রোজ অন্যের পয়সায় মদ খাবে? যার নিজের সাধ্য নেই অন্যের আতিথ্য ফিরিয়ে দেবার, সে কেন গ্রহণ করবে সকলের আতিথ্য?

ইতিমধ্যে একদিন কার কাছে যেন শুনলুম যে অজিত গত শনিবার রেসে গিয়েছিল এবং সেখানে তিনশো না অমনি কত টাকা হেরে এসেছে। এমন খবরে আমার খুশি হবার কথা নয়। আমি তাই অজিতের এক ভূতপূর্ব বন্ধুকে বললুম—বস্তুত সে-ই আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল অজিতের সঙ্গে—“অজিত আমার কাছ থেকে দুশো টাকা ধার করেছিল বেশ কয়েক মাস আগে। সেটা ফিরিয়ে না দিয়ে হি হ্যাজ্ নো বিজনেস্ টু গো অ্যাণ্ড্ লুজ্ মনি অ্যাট দি রেসেস্।”

বন্ধু বলল, “তোমার তো মাত্র দুশো টাকা। আরো কতজনের কাছে ওর কত ধার তার ঠিকানা নেই। হয়তো হঠাৎ হাতে পেয়েছিল শ’তিনেক টাকা। সে ওর ধারের সিন্ধুতে বিন্দুমাত্র। তাই নিশ্চয়ই ভেবেছে, রেসে গিয়ে ওই টাকাটা বাড়ানো যাক, অন্তত দু’চারজনের দেনা শোধ করে নতুন ধার নেবার পথ করা যাবে।”

আমার তখন ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল। আমি সোজা আমার টেলিফোনের কাছে গিয়ে অজিতকে ডাকলুম।

“হ্যালো।”

“ঘোষ হিয়ার।”

সেই গলা, যেন অজিত এখনো অমুক কোম্পানির সবচেয়ে সিনিয়র ভারতীয় অ্যাসিস্ট্যাণ্ট। আমার নাম আমি ঘোষণা করলুম।

অজিত বলল, “ওহো! যুগ যুগ ধরে তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি। তারপর, কী খবর? আজ সন্ধ্যায় কী করছ?”।

সন্ধ্যায় অজিতের সঙ্গে সাক্ষাতের অর্থ আমার অজানা ছিল না। আমি তাই একটু ইতস্তত করে বললুম, “তা অনেক দিন দেখা হয়নি। কিন্তু, কিন্তু তোমার সঙ্গে একটু দরকার ছিল। আমার—”

অজিত আমার কথা শেষ হতে দিল না। বলল, “আজ সন্ধ্যায় বাড়ি থাকবে? আমি চলে আসব, এই ধরো এইটিশ্, কী বলো?”

আমি একটু নিরাশ হলুম, কিন্তু সাধারণ সৌজন্য বিনিময়ের পরে সম্মতি জানিয়ে টেলিফোন রেখে দিলুম। মনে মনে স্থির করলুম, সন্ধ্যায় অজিত এলে সকল সঙ্কোচ শিকায় তুলে টাকাটা দাবি করব। অজিতের বন্ধুর কাছে ফিরে এসে বললুম, “দি সেম ওল্ড অজিত। অ্যাণ্ড ভেরি ক্রাফটি টু! আমাকে কথাটা তুলতেও দিল না।” অজিতের বন্ধু বলল, “না, ও বুঝেছে তুমি ধারের কথাটা বলতে সঙ্কোচ করছ। তোমার ওই এম্‌ব্যারাসমেণ্ট বাঁচাবার জন্যই তোমাকে বলতে দেয়নি। আজ সন্ধ্যায় এসে অন্তত কিছু টাকা তোমায় নিশ্চয়ই দিয়ে যাবে। ভুলো না, অজিত ইজ এ জেণ্টলম্যান।”

জেণ্টলম্যান! আমার বিরক্তি বাড়ল।

অজিত এলো সেই সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে। আমার একটু দেরি হয়েছিল ফিরতে। কিন্তু আমার বেয়ারার সঙ্গে অজিতের দোস্তি। আমি এসে দেখি বেয়ারা বাড়ি নেই, আমার বসবার ঘরে অজিত আরামে বসে আছে। মাথার উপরের পাখাটাই শুধু খোলেনি, কাছের আরেকটাও। মুখে সিগারেট; সামনে আমার সিগারেটের টিন খোলা, তাই বুঝতে কষ্ট হয় না কার সিগারেট পুড়ছে। বুঝে কষ্ট হয়।

আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে অজিত বলল, “আমি একটু পাঠিয়েছি তোমার বেয়ারাকে।” তারপর, বেশ কিছু সময় নিয়ে, সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে, যোগ করল, “তেমার ফ্রিজে দেখলুম একদম বরফ নেই। আমি বাবলুকে টেলিফোন করে দিয়েছি কিছু বরফ দিতে।”

অজিত এমন স্বাভাবিক স্বরে কথা বলছিল, এমন স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে চলাফরা করছিল যে, আমি তাকে প্রায় ঈর্ষা করলুম। আমি কেন এমন স্বাভাবিক হতে পারিনে? এতটুকু এদিক থেকে ওদিক হলে কেন আমার ভাবনার শেষ থাকে না? কোথাও একটা বিল দিতে দেরি হলে কেন ভেবে মরি? অথচ অজিতকে দেখো। তারই অন্যতম উত্তমর্ণের সঙ্গে কী অবিশ্বাস্য স্বাভাবিকতার সঙ্গে ব্যবহার করছে। আমারই বাড়িতে এসে এমনভাবে কথা বলছে যেন বাড়িটা আসলে ওরই। আমিই যেন আগন্তুক। শুধু তাই নয়, আমার সন্দেহ হলো, আমিই ওর কাছ থেকে টাকা ধার করেছি না ও আমার কাছ থেকে? আমার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ মত সত্ত্বেও মুহূর্তের জন্য নিজের কাছে কবুল না করে পারলুম না—না, পাবলিক স্কুলের শিক্ষা সম্বন্ধে বর্তমান প্রগতিশীল মত যাই হোক না কেন, সেখানে ওটা তোমার মনে চিরকালের মতো গেঁথে দেয়া হয় যে তুমি দুনিয়ার মালিক। তুমি কারো চেয়ে হীন নও, হেয় নও। প্রভুত্বে তোমার জন্মগত অধিকার। নেতৃত্বে তোমার দাবি প্রশ্নাতীত। আর সব মানুষ ‘মেন’, তুমি অফিসার। এই গুণ সওদাগরী অফিসে যেমন দেখা যাবে, তেমনি দেখা যাবে ক্লাবে, আবার ঠিক তেমনি দেখাতে হবে বার্মার জঙ্গলে বা ডুবন্ত জাহাজে।

এই ডুবন্ত জাহাজের সঙ্গে অজিতের তৎকালীন অবস্থার সুস্পষ্ট সাদৃশ্য তার নিজেরও অজানা ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু সে যে ক্যাপ্টেন তাতে কারো সন্দেহ করবার উপায় ছিল না। অজিতকে এমন “মাস্টার অব দি সিচুয়েশন” আমি অনেক দিন দেখিনি। আমার তাই টাকার সামান্য প্রশ্ন উত্থাপন করবার কথা মনেও এলো না। আমি প্রায় হেসে বললুম, “কী ব্যাপার, য়ু সীম টু বি ফুল্ অব বীন্‌স্।”

“হোয়েন হ্যাভ্ আই নট্ বীন?” কথাটা বলে অজিতেরই মনে হলো, একটু সংশোধন চাই। বলল, “মাঝে কয়েকটা মাস বাদে।” আবার অট্টহাস্যে যোগ করল, “কিন্তু সে সব শেষ হয়ে গেছে। অনেকদিন আমার কোনো পার্টি হয়নি। গত জন্মদিনে আমি কাউকে খাওয়াইনি। তুমি আমায় খাইয়েছিলে। আজ আবার একটা গ্র্যাণ্ড পার্টি হবে—যেমন এক সময় হতো ক্যালকাটা ক্লাবে বা থ্রী হান্ড্রেড প্রায়। ওহো, তোমাকে তো বলাই হয়নি! দেবদান—দেবদান অব্ ছত্তিশগড়—হো হো—রাত তিনটের সময় আমি ওকে বডিলি তুলে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিলুম। বর্ধমানকে জিগেস করো, আমার অন্য একটা ফেমাস্ পার্টিতে রুণুর কী অবস্থা হয়েছিল। রুণু অব্ সেরাইগাঁও।”

এগুলি অজিতের পক্ষে চাল নয়। সত্যি ওর অতীতের এমন সহস্র পার্টির স্মৃতি ওর মনে এখনো গাঁথা হয়ে আছে। এখন গায়ে একটা বুশ শার্ট, পরনে খাঁকি ট্রাউজার্স, কিন্তু জুতো পুরনো হলেও চক্‌চকে। অনেকগুলি ভালো অভ্যাস ওর সুদিনের সঙ্গে বিদায় নেয়নি, দুর্দিনের উপহাস হয়ে বেঁচে আছে। আমি ওর স্মৃতিমন্থনে বাধা দিয়ে বললুম, “আজকের পার্টি মানে? কোথায়? কাকে কাকে বলেছ?”

“এইখানে। রাইট হিয়ার। আমার ফ্ল্যাটের চেহারা এখন এমন নয় যে, ভদ্র কাউকে ডাকতে পারি। তাই তোমার এখানে আসতে বলেছি—এখনি এসে পড়বে। হয়তো এখন যে লিফ্‌টটা উঠছে সেইটেতেই দু’চারজন আসছে।”

অবাক কাণ্ড! আমার বাড়িতে অজিতের পার্টি! একবার অনুমতি নেবার কথা ওর মনে হয়নি। ওই যে আগেই বলেছি, অজিত পাবলিক স্কুলের সন্তান! ও পৃথিবীর মালিক। আমি শুধু একবার বললুম, “একটু আগে বলতে হয়। কোনো ব্যবস্থা নেই, আয়োজন নেই।”

অজিত বলল, “আমি তোমার বেয়ারারের সঙ্গে সব ঠিক করে ফেলেছি। মায় খাবার পর্যন্ত।” ঘড়ি দেখে বলল, “সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। বাবলু শুড হ্যাভ বীন হিয়ার উইথ দি হুইস্কি বাই নাউ!”

অজিতের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বাবলু এলো ; তার পিছনে লিফট্‌ম্যান আনল একটা পরিচিত আকার ও ছাপের কাঠের বাক্স। অজিত জিজ্ঞাসা করল, “সোডা কোথায়?”

“লীভ্ ইট মী, বস্। লিফটেই আছে।” বাবলুর ওই অভ্যাস। যে ওকে খাওয়াবে তাকেই বস্ বলবে। ও বাঙালী হলেও লাহোরে পড়েছে, তাই অনেকগুলি পাঞ্জাবী অভ্যাস ওর চরিত্রে এসে গেছে। কিন্তু অজিতকে অনেকদিন কেউ ‘বস’ বলেনি, বাবলুও না। অজিতের ভালো লাগল।

ধারের কথাটা আমার তখন ঠিক মনে ছিল না বোধ হয়, কিন্তু ভালো আমার লাগছিল না। কী দরকার ছিল এই পার্টির? তা ছাড়া অজিতের পার্টি সম্বন্ধে আমি যা জানতুম, তাতে অস্বস্তি বাড়ছিল বই কমছিল না। নিজের বাড়িতে ওরকম পার্টি হয়, ভাড়াটে ফ্ল্যাটে নয়। আমার ডানদিকের ফ্ল্যাটে থাকেন একটি ফিরিঙ্গি পরিবার, ভদ্রলোক ক্যাথলিক অ্যাসোসিয়েশনের উৎসাহী কর্মী। আমার বাঁদিকের ফ্ল্যাটে থাকেন মদ্র এক বড় চাকুরে, রেলওয়ের বোধ হয়। তাঁর বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে যে শব্দ কানে আসে, তা আমোদের নয়, পুজোর ঘণ্টার। এঁরা সব কী বলবেন?

কিন্তু আমার কিছু করবার উপায় ছিল না। ইতিমধ্যে অজিতের দশজন বন্ধু এসে হাজির হয়েছিলেন। ছয় বোতল হুইস্কি এসে গিয়েছিল। পর্যাপ্ত সোডা। যাঁরা জলের সঙ্গে খান, তাঁদের জন্য জল। বরফ। খাবার। একজন অতিথি ছিলেন সঙ্গীতে উৎসাহী। তিনি এসেই আমার রেডিওটা খুলে দিয়েছিলেন। আরেকজন অতিথি ছিলেন নিজে গায়ক। তিনি হিন্দী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ধরেছিলেন। কথারও কমতি ছিল না, বলা বাহুল্য। সব মিলিয়ে তাই হচ্ছিল, যা এমন পার্টিতে হয়ে থাকে।

অজিত নিজেকে অবহেলা না করে অভ্যাগতদের দেখাশোনা করছিল। কিন্তু কথা বলছিল না বেশি। পাঁচ বোতল যখন শেষ হয়ে গেছে, তখন রাত সাড়ে দশটা। যারা যেতে চাইল অজিত তাদের বাধা দিল না। হাসতে হাসতে “গুড বাই” বলল। গৃহস্বামী হিসাবে আমি আমার কর্তব্য সম্পন্ন করলুম লিফ্‌ট্ পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দিয়ে এসে। একে একে সবাই গেলে বাকি রইল অজিত, তার এক বন্ধু (যার নামটা আমি ঠিক ধরতে পারিনি), আর আমি। আর সর্বশেষে বোতলের সিকি বা তারও কম। অজিত পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে হাতের উপর হাত রেখে বলল, “আই থিংক ইট হ্যাজ বীন এ ফাইন পার্টি, ডোন্ট য়ু এগ্রি?”

আমি আন্তরিক সম্মতি জানালুম। অজিতের বন্ধুও। লোকটি দেখতে একটু বোকা-বোকা। বেশি কথা বলে না।

এবার অজিত তার বন্ধুর দিকে চেয়ে বলল, “নাউ ফর এ স্পট অব বিজনেস।”

আমার তখন ব্যবসায় সংক্রান্ত কথায় কিছুমাত্র কৌতূহল ছিল না। আমি তখন ক্লান্ত। তাই নীরব রইলুম। তা ছাড়া কথাটা আমাকেও বলা নয়।

অজিত বলল, “তার আগে একটা লাস্ট ড্রিংক হোক।”

আমি জানতুম, আপত্তি বৃথা। তাই গেলাস এগিয়ে দিলুম। অজিত তিনটে গ্লাসে সমানভাবে ভাগ করে শেষ হুইস্কি পরিবেশন করল। বলল, “নাউ ফর দি রিচুয়্যাল।”

অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের বলতে হবে না অনুষ্ঠানটা কী। অজিত একটা দেশলাই ধরিয়ে কাঠিটা শূন্য বোতলে ফেলে দিতেই হুস করে শব্দ হলো, জানা গেল ভিতরে খাঁটি জিনিস ছিল। পর পর ছ’টা বোতলের এই সশব্দ ময়না-তদন্তে আমি আবার আমার নিষ্পাপ প্রতিবেশীদের কথা ভাবছিলুম। কিন্তু অনুষ্ঠানের যে একটা প্রতীকমর্ম ছিল, তা আমার জানবার কথা নয়।

সবশেষে অজিত আবার চেয়ারে বসল সোজা হয়ে, বলল, “নাউ ফর দি বিজনেস।”

অজিতকে তখন দেখে আবার মনে হলো, সত্যি সে একদিন বড় বিলাতী অফিসে বিভাগীয় বড় সাহেব ছিল। চাকরি গেছে, কিন্তু আর সবকিছু বজায় আছে। সেই বিশাল চেহারা, সেই গম্ভীর স্বর, সেই ইংরেজি অ্যাকসেন্ট।

“কানু, আমার বন্ধু বিশেষ অবশিষ্ট নেই।”

পানে মানুষ একটু ভাবপ্রবণ হয়। ভদ্রলোক বললেন, “বেশি আছে কি না জানিনে, তবে একজন নিশ্চয়ই আছে।”

“নেমলি?”।

“মী।”

“ভেরি ওয়েল। আমার একটা অনুরোধ রাখবে?”

“নিশ্চয়ই।” ভদ্রলোক ব্যবসায়ী। তাই সতর্কতার সঙ্গে একটু পরে যোগ করলেন, “নিশ্চয়ই, এনিথিং রিজনেবল্।”

“যদি বলি, কারো কারো কাছে অনুরোধটা পুরোপুরি রিজনেবল্ না-ও মনে হতে পারে?”

“লুক অজিত, য়ু নো, আমি পাঁচপুরুষ বড়লোক নই। আমি নিজে গত বিশ-বাইশ বছরে কী করেছি, তা আন্দাজ করা তোমার পক্ষে নিশ্চয়ই অসম্ভব নয়। তারপর কিছু টাকা গেছে ব্যারাকপুরের বাড়িটায়। অতএব আমার সঙ্গতির মধ্যে যা সম্ভব—আমার যা যা কমিটমেণ্ট আছে—তা আমি নিশ্চয়ই করব।”

“ডোণ্ট গেট মি রং। আমার অনুরোধে তোমার আর্থিক ক্ষতি হবে না আশা করি।”

“না না, আমি তা ভাবিনি। আমি শুধু—”

অজিত হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, “আচ্ছা, আমার স্বাস্থ্যটা কেমন আছে? এত অনিয়ম ও অমিতাচারের পরেও?” বলে অজিত একবার তার রাগবি-খেলা কব্জি ঘোরাল। বুকের ছাতি স্ফীত হলো। সত্যি ওর স্বাস্থ্যটা দেখার মতো।

বন্ধু কানু তারিফ করে বলল, “চমৎকার স্বাস্থ্য। আমি বলব, এ ওয়ান্।”

“গুড!”

অজিত এক চুমুকে তার গেলাস শেষ করে বলল, “এই চিঠিটা নাও। সীল করা আছে। এরই মধ্যে আমার অনুরোধ আছে; কিন্তু আরেকটা অনুরোধ আছে, কাল অফিসে যাবার আগে এটা খুলতে পারবে না।”

কানু হেসে বলল, “দ্যাটস ফানি! কাল কেন?”

অজিত রহস্যটা হাল্কা করে বলল, “শুধু এই জন্য যে, অফিসে যাবার আগে আমার অনুরোধ সম্বন্ধে কিছু তুমি করতে পারবে না।” হেসে যোগ করল, “আমি জানি, তোমার চেকবই তুমি বাড়িতে রাখো না।”

কানু এবার আর হাসল না। তার মনে সন্দেহ ছিল না—আমারও না—যে অজিত আরো একটা ধার চইছে। অজিতের সম্বন্ধে এমন কথা ভাবাই কি স্বাভাবিক নয়? কানু বলল, “আচ্ছা, কথা দিলুম, কাল অফিসে যাবার আগে তোমার চিঠি খুলব না।”

এর কিছুক্ষণ পরেই কানু বিদায় নিল। আমি ক্লান্ত বলে ক্ষমা চাইলুম, লিফ্‌ট্ পর্যন্ত গেলুম না। অজিত যেমন ছিল, তেমনি বসে রইল। আমি ভাবছিলুম, এবার উঠলে তো হয়। আমার কাল অফিস আছে।

অজিত বলল, “যদি কিছু মনে না করো, আই’ল হ্যাভ এনাদার ড্রিংক। হ্যাভ য়ু গট্ সাম হুইস্কি ইন দি হাউস?”

কিছু ছিল। অজিতের এমন আতিথেয়তার পরে তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করব কী করে? কিন্তু আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল। বললুম, “তুমি নিজেই বের করে নাও, প্লীজ, আমি উঠতে পারছি না।”

অজিত ধন্যবাদ দিয়ে উঠল। নিজের গেলাসে যা ঢালল তার নাম পাতিয়ালা পেগ্! আমি দেখেও দেখলুম না। অজিত বলল, “এবার তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।”

“বলো।”

“তোমাকে একটা পোস্ট-ডেটেড চেক দেবো, ফর দি ফুল অ্যামাউন্ট। আর তুমি আমায় এখন গোটা দুয়েক টাকা দেবে, ফর দি ট্যাক্সি। বাবলু আমার চেঞ্জটা ফিরিয়ে দিতে ভুলে গেছে।”

আমি অফিসের ট্রাউজার্স পরেই বসে ছিলাম। পকেট থেকে ক্লান্ত হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে আমি অজিতকে দিলুম।

অজিত একটা সীল-করা খাম আমার হাতে দিয়ে বলল, “এই নাও। এটা অবশ্য চেক নয় ঠিক, বরং হুণ্ডি বলতে পারো। পরশু সকালে টাকাটা পাবে, কার কাছে ইত্যাদি সব লেখা আছে এর মধ্যে। তার আগে খুলো না কিন্তু।”

আমি বললুম, “দ্যাটস অল রাইট।”

অজিত উঠলে আমি বললুম, “গুড বাই।”

অজিত বলল, “গুড বাই।”

আমি লিফটের কাছে গিয়ে হঠাৎ কী মনে করে জিজ্ঞাসা করলুম, “আচ্ছা, এই কানু কে? একে আগে দেখেছি বলে তো মনে হয় না।”

“না। তুমি বোধ হয় দেখনি।”

“কী করে? কোন্ অফিসে?”

“না, ও চাকুরে নয় তোমার মতো। ওর নিজের বড় ব্যবসা আছে, যদিও নাম-করা নয়। ব্যবসা এক্সপোর্টের।”

আমি আর কিছু জানতে চাইলুম না। বললুম, “গুড নাইট।”

লিফটে নামতে নামতে অজিত বলল, “গুড বাই।”

এবার ফিরে আসা যাক আমার বাথরুমে। সেই যেখানে আমার টুথপেস্টের টিউবে চাপ দিয়ে অজিতের কথা মনে হয়েছিল।

পরপ্রভাতে আমার মাথা ধরেছিল। আমি স্নান সেরে অফিসে গেলুম। তারও পরের দিন অজিতের চিঠি খুলে দেখলুম :

“আমার বন্ধু কানাই গুপ্তকে এই চিঠি দেখালে সে তোমাকে দুশো পঞ্চাশ টাকা দেবে। রসিদ দিতে হবে না। ঋণ এতদিন শোধ দিতে পারিনি বলে ক্ষমা চাইছি। আরো অনেকের কাছেই আমার এই রকমের ধার আছে, মোট প্রায় হাজার কুড়ি। মোটামুটি এই রকম অঙ্কই কানাই দেবে বলে আশা করছি। আমার স্বাস্থ্য ভালো।

“আরেকটা অনুগ্রহ চাইব। তুমি টাকা পেয়েই সন্তুষ্ট থাকবে। আর কিছু জানতে চাইবে না। আমার কী হলো তাও নয়, তাহলেই আমার জন্য বন্ধুত্বের পরিচয় দেবে। কানাই কেন টাকা দেবে তাও নয়, তাহলেই তোমার বন্ধুর অন্তিম উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানো হবে।

“না। যাবার আগে তোমার কাছে সত্য গোপন করব না। কানাই এক্সপোর্টের ব্যবসা করে। কী রপ্তানি করে শুনলে তুমি শিউরে উঠবে, কিন্তু সেন্টিমেন্টাল হয় না। এর চেয়ে নৃশংস ব্যবসাও আছে, শুধু সেগুলোতে আড়াল আছে আর আমার বন্ধুর বেলায় তা নেই। সে মানুষ মারে না। মরা মানুষের শব চালান দেয় বিদেশের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার জন্য। আমি ব্যবস্থা করেছি কাল বিকালের মধ্যে আমার শব ওর কারখানায় যাবে। ওর এজেন্ট আমার ফ্ল্যাটে আসবে ভোর চারটেয়, তাই তোমার পার্টি থেকে দুটোর আগে আমায় বেরুতেই হবে।

“কানাইকে লেখা চিঠিতে দুটি শর্ত করেছি। এক, আমার সমস্ত দেনা ও শুধবে। তাতে ওর লাভের মার্জিন যদি একটু কম থাকে, তাহলেও। আমি জানি ও আমার কথা রাখবে, আমার মান রাখবে।

“দুই, আমি ওকে বলেছি আমার শরীর হার্ড কারেন্সির বদলে ও আমেরিকায় পাঠাবে না। আমার আশা, ও আমার এ অনুরোধও রাখবে। আমার বাসনা ছিল দক্ষিণ ফ্রান্সে মরা। একটু সংশোধিত আকারে সে বাসনা পূর্ণ হতে চললো।

“পৃথিবীকে আমি ভোগ করেছি। তাই এমন নিমকহারামি করব না যে বলব যেতে কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু খুব বেশি খেদ নেই। সান্ত্বনা, দুর্নাম নিয়ে বিদায় নিচ্ছি না। বলল, আমি ভদ্রলোক ছিলুম।”

এই গল্পে সে কথাটাই বলা রইল।

১৩৬২ (১৯৫৫)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *