জুসেপ্পে গারিবলদি (১৮০৭–১৮৮২) – ইতালির জনক বলে যাঁর খ্যাতি
ইতালির জনক বলে যাঁর পরিচিতি, সেই মহান নেতা জুসেপ্পে গারিবলদি (Giuseppe Gariboldi) কী পরিমাণ জনপ্রিয় ছিলেন সত্যিকার অর্থেই তা এক বিস্ময়কর গল্প।
১৮৮২ সালের ৩ জুন যেদিন তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যু হয়, সেদিন সমগ্ৰ দেশ মুহূর্তে থমকে গিয়েছিল। গারিবলদির মৃত্যুসংবাদ যখন ইতালির রাজধানী রোমে পৌঁছয় তখন নাট্যশালার নৃত্যগীত, পথঘাটে চলন্ত সমস্ত যানবাহন, সরকারি-বেসরকারি সমস্ত কর্মশালা এবং জীবনযাত্রা মুহূর্তে থেমে গিয়েছিল।
নাট্যশালার অধ্যক্ষ সমবেত দর্শকবৃন্দকে এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষিতে অভিনয় স্থগিত রাখার ঘোষণা দিতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে শোকে এমনই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি কি বলবেন তা-ই স্মরণ করতে পারছিলেন না, তাঁর বাক্য স্ফুরিত হচ্ছিল না। তিনি নিজেই স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলেন।
ইতালির জাতির জনক গারিবলদির জন্ম একেবারেই এক গরিব পরিবারে ১৮০৭ সালের ২২ জুলাই। অথচ এই সাধারণ ঘরের সন্তানই একদিন আপন কৃতিত্বে, শৌর্যবীর্যে আরোহণ করেছিলেন দেশের সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে এবং স্বদেশ ইতালিকে অস্ট্রিয়ার শৃঙ্খলমুক্ত করে এনে দিয়েছিলেন মুক্তির স্বাদ।
বাল্যে গারিবলদির পিতামাতা এতটাই গরিব ছিলেন যে, তাঁরা শুধু অর্থের অভাবে সন্তানের সুশিক্ষার ব্যবস্থাও করতে পারেননি। তাই উচ্চশিক্ষা লাভ করা গরিবালদির হয়নি। ফলে বিদ্যালয়ের পাঠ ছেড়ে দিয়ে তিনি অল্পবয়সেই ঢুকে পড়েছিলেন নৌবাহিনীতে এবং ওই বয়সেই সাহস ও ধৈর্যের জন্য অর্জন করেছিলেন প্রচুর খ্যাতি। বাল্যকাল থেকেই তাঁর ছিল বড় হবার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা, আর ছিল দেশপ্ৰেম।
যে সময়কার কথা, তখন ইতালি ছিল পার্শ্ববর্তী বড় দেশ অস্ট্রিয়ার অধিকারে অস্ট্রিয়া চাইত ইতালিকে বিচ্ছিন্ন আর দুর্বল করে রাখতে। অস্ট্রিয়ার এই করাল গ্রাস থেকে স্বদেশভূমিকে মুক্ত করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল গারিবলদির।
এই সময়ই ইতালিতে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে একটি জাতীয় অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ইতালির জেনোয়াতে যে-কজন দেশপ্রেমিক বিপ্লবী এই ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন, গারিবলদিও ছিলেন তাঁদের অন্যতম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই বিপ্লব সফল হয়নি। এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরিণামে তাঁদের ওপরেও নেমে আসে চরম দুর্যোগ। গারিবলদি অন্যদের সাথে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। কিন্তু তিনি আত্মসমর্পণ না করে। গোপনে পালিয়ে গেলেন ফ্রান্সে।
সেই সময়টাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় এবং দুঃসাহসিক নানা ঘটনায় পরিপূর্ণ। আত্মগোপন করার জন্য তাঁকে সর্বক্ষণ থাকতে হতো ছদ্মবেশে। নানা নামে, নানা মূর্তি ও নানা পরিচয়ে। অবশেষে মার্সেইতে এসে জুটল কিছুটা নিরাপদ আশ্রয়। এখানে আসার পর তাঁর পরিচয় হয় ইতালির আরেক রাজনীতিবিদ মাতসিনির সাথে।
মাতসিনির সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে তাঁর জীবন আরেক নতুন দিকে মোড় নিতে শুরু করে। গারিবলদি মাতসিনির অনুপ্রেরণা এবং উদ্যোগেই নব্য-ইতালি গোষ্ঠীর সাথে মিশে গেলেন। এই গোষ্ঠীটিই মাতৃভূমি ইতালিকে অস্ট্রিয়ার আধিপত্যের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার এবং দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল।
এই সময় তিনি বাল্যশিক্ষার দৈন্যও কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করেন। তিনি দুবছর ধরে অঙ্ক ও বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে পারদর্শিতা লাভ করেন।
এর পরপরই কার্যক্ষেত্রে নেমে পড়ার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য মিশরীয় একটি যুদ্ধ- জাহাজে চাকরি নিয়ে মার্সেই থেকে চলে যান তিউনিসিয়ায়। কিন্তু স্বদেশমুক্তির যে বৃহত্তর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি তিউনিসিয়ায় গিয়েছিলেন, তা হলো না। ফলে তিউনিসিয়া ত্যাগ করে তিনি রিও ডি জেনেইরোতে চলে যান।
রিও ডি জেনেইরো এসময় সাধারণতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। তিনি এই নবপ্রতিষ্ঠিত সাধারণতন্ত্রের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। ঠিক এই সময় বুয়েনস আইরেসের সাথে সাধারণতন্ত্রের যুদ্ধ বাধে। সাধারণতন্ত্র গারিবলদিকে নৌসেনার অধিনায়কত্ব দান করে। যুদ্ধে তিনি এমন অভাবনীয় সব কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে লাগলেন যে, অনেকের ধারণা হতে হলো তিনি হয়তো কোনো মানুষ নন, অলৌকিক শক্তির অধিকারী কোনো অতিমানব। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নির্ভীক চিত্তে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে লাগলেন। অথচ আলৌকিকভাবে তাঁর রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারটি দেখেই লোক ধারণা হতো।
১৮৪৮ সালে ইতালিতে সংঘটিত হয় আরেকটি বিপ্লব। এই বিপ্লবই গারিবলদিকে আবার স্বদেশে ফেরার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু এবারেও তাঁর পক্ষে দেশে থাকা সম্ভব হলো না। তিনি স্বদেশপ্রেমিক স্বেচ্ছাসেবী যুবকদের নিয়ে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধে জয়ীও হয়েছিলেন। কিন্তু শেষে কতিপয় সহচরের বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রয়োজনীয় সাহায্যের অভাবে তিনি একটি যুদ্ধে হেরে যান। ফলে আবার দেশ ছেড়ে পালাতে হয় তাঁকে।
তিনি ইউরোপ ছেড়ে অবার চলে যান আমেরিকায়। সেখানে নানা তৎপরতার পাশাপাশি প্রতীক্ষা করতে থাকেন স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সুযোগের। এমন সময় দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে বেধে যায় যুদ্ধ। পেরুর সরকার গারিবলদিকে বরণ করে নেয় তাদের সেনাপতির পদে।
পেরুর যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর তিনি পরিবার-পরিজনসহ চলে যান ক্যাপরেরা দ্বীপে। এখানে তিনি প্রায় পাঁচ বছর অজ্ঞাতবাসে কাটান। রণক্ষেত্র ছেড়ে আত্মনিয়োগ করেন কৃষিকাজে।
এই সময় আবার ইতালিতে শুরু হলো জাতীয় জাগরণ সম্পৃক্ত আলোড়ন। দাসত্বের শৃঙ্খলে অবরুদ্ধ ইতালিবাসী আবার মুক্তির আশায় মাথা তুলে দাঁড়ায় অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে। গারিবলদির হৃদয় আবার শুনতে পেল মুক্তিপাগল স্বদেশবাসীর ডাক। তিনি ক্যাপরেরার নিরিবিলি শান্তির নীড় ছেড়ে আবার এলেন স্বাধীনতার রণাঙ্গনে।
ইতালি উদ্ধারের জন্য প্রকৃতিই যেন তাঁকে জাতীয় নেতা করে পাঠিয়েছিলেন। তাই জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সমগ্র ইতালিবাসী একবাক্যে তাঁকে তাঁদের সেনাপতি হিসেবে বরণ করে নিল। এরপর গারিবলদির নেতৃত্বেই নেপস্ এবং সিসিলিতে বিদ্রোহ হলো। তাঁর অনুগত হাজার হাজার দেশপ্রেমিক রেড শার্ট (Red Shirt) নামধারী সৈনিকদল সিসিলিতে অসামান্য কৃতিত্ব দেখাল। ফরাসি বংশোদ্ভূত রাজারা এ দুটো রাজ্যে রাজত্ব করছিলেন। গারিবলদির কাছে তাঁড়া খেয়ে তারা পালিয়ে গেলেন।
অল্পদিনের মধ্যেই ইতালির সব কটি রাজ্য একসাথে মিলিত হল এবং দ্বিতীয় ভিক্টর ইমানুয়েলকে ইতালির সমস্ত লোক রাজা বলে মেনে নিল। মূলত গারিবলদিই তাঁকে এই মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করলেন।
এই বিজয়ের মুহূর্তে গারিবলদির জনপ্রিয়তা ও দেশের ওপর তাঁর প্রভাব ছিল অপরিসীম। তিনি ইচ্ছে করলেই তখন নিজেকে সমগ্র ইতালির সমাট বলে ঘোষণা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এই নিংস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিক সমস্ত ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে আবার ফিরে এলেন তাঁর সিসিলি দ্বীপের নির্জনবাসে। এমন নিস্বার্থ বীর আর দেশপ্রেমিকের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে সত্যি বিরল।
শুধু তা-ই নয়, সম্রাট ভিক্টর ইমানুয়েলও তাঁকে অনেক পুরস্কার, পদ ও সম্মান দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেসবের কিছুই গ্রহণ করেননি।
সবকিছু প্রত্যাখ্যান করেও তিনি পেয়েছেন দেশবাসীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আজ ইতালির প্রতিটি নাগরিকের মনের সিংহাসনে গারিবলদি এক রূপকথার মহান নায়কের আসনে আসীন।