1 of 2

জুলেখা – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

জুলেখা – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সে আমার হাফপেণ্টুল পরা সময়ের কথা, যখন প্রবীণদের মনে হত একেকটি দুর্দান্ত দৈত্য এবং দিনের নির্দোষ বৃক্ষলতা সূর্যাস্তের পর নির্দয় রহস্যে ভরে যেত। চারপাশে ঘটত অনেক সন্দেহজনক ঘটনা। ভয় করতাম অনেক কিছুকেই। আর সেই ভয় থেকে আমাদের রক্ষা করত যে, তার নাম ছিল কালু। কালু ছিল একটা কালো রঙের দিশি কুকুর। তার ছোট্ট শরীরটা ছিল যেন একটা সাইরেনযন্ত্র। সে আমাদের বাড়ি আসার পর থেকে দরমার মুর্গিচুরি বন্ধ হয়েছিল। তাই প্রথমদিকে তাকে ছিঘেন্না করা হলেও পরে সে আদরযত্ন পেতে শুরু করেছিল।

বাড়ির আয়তনের তুলনায় আমাদের সংসারটা ছিল ছোটই। বাবা, মা, আমি আর, জুলেখা নামে একটি মেয়ে, এই চারজন মোটে মানুষ। একটা গাইগরু, তার বাছুর আর একদঙ্গল মুর্গি, যাদের মাথায় ছড়ি ঘোরানোর জন্য ছিল এক তাগড়াই মোরগ, জুলেখা যার নাম দিয়েছিল বাদশা।

জুলেখার ডাকনাম ছিল জুলি। আমার সেই হাফপেণ্টুলের বয়সে জুলি শাড়ি ধরেছিল। আমার জন্মের পাঁচ বছর আগে জুলির বয়স ছিল মোটে দুই। প্রতি শীতে উত্তরের পদ্মা-এলাকা থেকে যে গরিব মানুষেরা দল বেঁধে রাঢ় এলাকায় ভাত খাওয়ার লোভে ছুটে আসত, তারা নিজেদের বলত ‘মুসাফির’ এবং অন্নের জন্য সেই অভিযানকে তারা বলত ‘সফর’। সেবার মাঘ মাসের এক বৃষ্টির রাতে দলছাড়া হয়ে এক মুসাফির মা ও তার দু বছরের মেয়ে আমাদের দলিজঘরের বারান্দায় আশ্রয় নেয়। ভেদবমি হয়ে মা শেষরাতে মারা গেল, আমার দয়ালু দাদু তার সদ্‌গতি করেন। বাচ্চা মেয়েটি আমাদের বাড়িতেই থেকে যায়। অতটুকু মেয়ের চুলের বহর লক্ষ করে দাদু তার নাম রাখেন ‘জুলেখা’—কেশবতী।

কী অবিশ্বাস্য বিশাল ছিল তার চুল! সেই চুলের বিশালতা আমাকে ভীষণ টানত। জুলির চুল ধরে আমি ঝোলাঝুলি করতাম। চুলের ভেতর লুকিয়ে পড়ে মাকে দিতাম কুকি। খিড়কির ছোট্ট পুকুরে সেই চুল ধরেই আমি সাঁতার কাটা শিখেছিলাম। আসলে জুলি হয়ে উঠেছিল আমার ক্রীড়াভূমি। সে শুয়ে থাকলে তার ওপর দিয়ে লংজাম্প হাইজাম্প খেলতাম। গাছে ওঠার জন্য সে ছিল আমার নির্ভরযোগ্য সিঁড়ি। নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে তার চেয়ে ভাল বুড়ি কল্পনা করা যায় না। আর এমনি করে দিনে দিনে তার শরীরের অনেকটা আমার চেনা হয়ে গিয়েছিল। আসলে জুলি ছিল আমার বহুবার পড়া ভূতের গল্পের বই, যার গল্পটা পুরনো হয়ে গেলেও ভূতটা রহস্য দিয়ে বারবার কাছে টানে।

জুলি অনেক গল্প জানত। তার কাছেই রাতে আমাকে শুতে দেওয়া হত। জুলি চাপা গলায় গল্প শোনাত। তবে শর্ত ছিল আমাকে ক্রমাগত হুঁ দিয়ে যেতে হবে। হুঁ বন্ধ হলেই সে ডাকত, ‘অঞ্জু! ঘুমোলে?’ তারপর খোঁচাখুঁচি করে জাগানোর চেষ্টা ব্যর্থ হলে বলত, ‘না শুনলে আমার কী?’ গল্পটা ভাল না লাগলে আমার এই ছিল চালাকি। কিন্তু কোনো-কোনো রাতে টের পেতাম তার গল্প বলার মুডই নেই। খাপছাড়া করে একটুখানি শুনিয়েই আমাকে কাছে টেনে পিঠে হাত রেখে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলত, ‘ঘুমোও। ভোরে ইস্কুলে যেতে পারবে না। তখন ভাবীজী মুখ করবেন।’

সে মাকে বলত ভাবীজী, বাবাকে বলত ভাইজান। একরাতে সে আমাকে খুব কাছে টেনে নিলে তার বুকের অদ্ভুত কোমলতা আমাকে চমকে দিয়েছিল। আমি সেই কোমলতা হাত বাড়িয়ে খোঁজার চেষ্টা করতেই সে পিঠে থাপ্পড় মেরে ফিসফিসিয়ে উঠেছেল: ‘ছিঃ! আমি তোমার ফুফু (পিসি) হই না?’

আমি তো ভীষণ—ভীষণ অবাক। নাস্তিক বাবার ঔদাসীন্যে আমার খৎনা দিতে দেরি হয়েছিল। খৎনা দেওয়ার পর বালিশে হেলান দিয়ে আমাকে বসিয়ে রাখা হলে জুলি আমার মুখে সেদ্ধ ডিম গুঁজে দিচ্ছিল আর সান্ত্বনা দিচ্ছিল, ‘কেঁদো না! কালই ঘা শুকিয়ে যাবে।’ সে আমাকে দু’হাতে তুলে নিয়ে খিড়কির ঘাটে জলে নামিয়ে হাতের তালুতে জল ঠেলে-ঠেলে ক্ষতস্থানে ঢেউয়ের ঝাপটানি দিত। দ্রুত ঘা সেরে যাওয়ার জন্য এটাই ছিল প্রচলিত পদ্ধতি। মাঝে মাঝে আঁচল টেনে কামড়ে ধরে সে লজ্জারও ভান করত। সে ঘাটের কাঠে বসে থাকত এবং কিছুই দেখছে না এমন ভঙ্গিতে হাসি চাপত। কখনও সে সাবধানে ঘায়ের অবস্থা পরখ করে বলত, ‘আর দুটো দিন।’

ঘা শুকিয়ে সব স্বাভাবকি হয়ে গেলেও সে বলত, ‘লাগছে না তো?’ ব্যথা করছে না শুনে সে ফোঁস করে যে নিঃশ্বাসটি ফেলেছিল, এতকাল পরেও তা কানে লেগে আছে। তার কাছে আমার লজ্জার কিছু ছিল না।

এই জুলি বাড়ির যে-সব কাজ করত, তা বাঁদিরাই করে থাকে। কিন্তু তাকে বাড়ির মেয়ের মতোই দেখা হত। তার বিয়ের বয়স বাড়ছিল দেখে বাবা ভেতর-ভেতর পাত্র খুঁজতেন। কোনো পাত্রই পছন্দ হত না মায়ের। মা ছিলেন খুব খুঁতখুঁতে মেয়ে। বলতেন, ‘যে ঘরেই ওর জন্ম হোক, খানদানী বাড়িতে মানুষ হয়েছে। মুনিশখাটা ঘরে গিয়ে থাকতে পারবে? কষ্ট হবে না?’

বাবা রাগ করে বলতেন, ‘কোন খানদানী ঘরের ছেলে ওকে বিয়ে করবে? লেখাপড়া জানে?’

মা দ্বিগুণ রেগে গিয়ে বলতেন, ‘শেখাওনি কেন লেখাপড়া? কর্তব্য ছিল না তোমার?’

বাবা দমে গিয়ে বলতেন, ‘তুমি শেখালেই পারতে। অল্পস্বল্প একটুখানি হলেও অন্তত—’

মা একই সুরে বলতেন, ‘আমি তোমার সংসার সামলাব, না কাউকে ক খ শেখাব—ভারি আমার বলেছ!’

তবে দু’জনেই দেখতাম ভীষণ পস্তাতে শুরু করেছিলেন ওকে লেখাপড়া শেখানো হয়নি বলে। জুলেখা ওই সময়টাতে খুব আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কাতর চোখে তাকিয়ে সে আঙুল খুঁটত। একদিন আড়ালে আমাকে চুপিচুপি বলেছিল, ‘জানো অঞ্জু, আমার বিয়ের কথা হচ্ছে? আমি কিন্তু বিয়েই করব না দেখবে।’

‘কেন জুলি?’ অবাক হয়ে জিগ্যেস করেছিলাম ওকে। ‘কেন তুমি বিয়ে করবে না?’

জুলি আস্তে বলেছিল, ‘আমি কারুর বাড়ি থাকতে পারব না। আমার খুব কষ্ট হবে।’

‘বিয়ে কী জুলি?’

জুলিও খুব অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ দু’হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। ফিসফিস করে বলেছিল, ‘তুমি ছাড়া আর কারুর পাশে আমি শুতে পারব না। আমার লজ্জা করবে খুব।’

‘বিয়ে করলে পাশে শুতে হয়? সত্যি বলছ।’

‘হুঁ। সে গম্ভীর হয়ে বলেছিল। ‘পাশে শোবার জন্যই তো বিয়ে।’

‘কেন পাশে শুতে হয়, জুলি?’

অমনি জুলি আমার পিঠে থাপ্পড় মেরে বলেছিল, ‘বলতে নেই। ছি। আমি তোমার ফুফু হই না?’

তারপর যত দিন যাচ্ছিল, জুলির বিয়ে কেন্দ্র করে যেন একটা সমস্যা মাথাচাড়া দিচ্ছিল। প্রায়ই দেখতাম বাবার সঙ্গে মায়ের কথা কাটাকাটি চলেছে। মা খেপে গিয়ে বলেছেন, ‘মেয়েটা তোমার গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে তো? ওকে যেমন করে হোক, না তাড়িয়ে শান্তি নেই। নইলে কোন্ আক্কেলে তুমি ওই আধবুড়ো ল্যাংড়া-ভ্যাংড়া লোকের বাড়ি ঠেলতে চাইছ?’

বাবা বলেছেন, ‘কী মুশকিল। বদরু তো খানদানী ঘরের ছেলে। মিলিটারিতে বাবুর্চির চাকরি করত। জাপানিদের গুলি লেগে একটা পা জখম হয়েছিল। রীতিমতো সরকারি পেন্সন পাচ্ছে। এদিকে খাসি কেটে হাটবারে ভালই কামাচ্ছে। তুমি ওকে ল্যাংড়া-ভ্যাংড়া বলে ঠাট্টা কোরো না। দুনিয়া চরে খায় বদরুদ্দিন।’

বদরুর একটা পা ছিল না। সে ক্র্যাচে ভর করে হাঁটত। হাটবারে তাকে দেখতাম রাস্তার ধারে ছোট্ট একটা নিমগাছের ডালে রক্তাক্ত খাসি ঝুলিয়ে ছাল ছাড়াচ্ছে। তার চেহারায় একটা নিষ্ঠুরতা ছিল। অথচ সে যখন হাসত, তখন তাকে ভদ্রলোক দেখাত। সম্ভবত সে যুদ্ধের সময় ফ্রণ্টে ছিল এবং যেন নিজেও যুদ্ধ করেছে সেইটাই বোঝাতে চাইত চেহারায় একখানা নিষ্ঠুরতা চাপিয়ে। বাসে বা ট্রেনে নাকি তাকে ভাড়া দিতে হত না। বাসে বা ট্রেনে চাপার সময় সে তার মিলিটারি উর্দিটি গায়ে চড়াত, আর তখন তার সেই বহিরঙ্গের নিষ্ঠুরতাটা যেন ভয়াল হয়ে উঠত।

এমন একটা লোকের পাশে গিয়ে জুলিকে শুয়ে থাকতে হবে, ভাবতেই রাগে দুঃখে আমার কান্না পাচ্ছিল। আমি জুলির আরও কাছ ঘেঁষে থাকছিলাম। বাড়ির পেছনে ছোট্ট পুকুরটার পাড়ে আমাদের বাগান ছিল। জনহীন দুপুরবেলায় সেই বাগানে আমরা গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতাম। আর কালুও ছিল আমাদের সেই ষড়যন্ত্রের এক শরিক। আমরা দু’জনে কালুকে খুব প্ররোচনা দিতাম, বদরুর বাকি পা-খানাও যেন সে কামড়ে খেয়ে ফেলে। কোথাও বদরুকে দেখামাত্র চুপিচুপি কালুকে লেলিয়েও দিয়েছি। কিন্তু কালু হতচ্ছাড়া ওকে যেন প্রাক্তন যোদ্ধা ভেবেই সম্মান জানাত লেজ নেড়ে। ক্রমশ কালুর ওপর আস্থা খুইয়ে একদিন জুলি মাথার ওপরকার লম্বাটে একটা ডাল দেখিয়ে বলেছিল, ‘ল্যাংড়া বদরু আসুক না বিয়ে করতে। এসে দেখবে আমি ওখান থেকে ঝুলছি। এক হাত জিভ বের করে চুল এলিয়ে—’ বলে সে সত্যি জিভ বের করে একটা ভয়ানক ভঙ্গী করেছিল।

আমার ভীষণ খারাপ লেগেছিল। বলেছিলাম, ‘ধুস! বিচ্ছিরি দেখাবে।’

‘দেখাবেই তো। দেখে বদরুর বিয়ের সাধ ঘুচে যাবে।’

একটু ভেবে বলেছিলাম, ‘উঁহু। ওকে বিশ্বাস নেই। তবু বলবে বিয়ে করব।’

জুলি হেসে অস্থির। ‘আর কী করে করবে? তখন আমি তো মরে গেছি।’

সঙ্গে সঙ্গে তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছিলাম। ফুঁপিয়ে উঠে বলেছিলাম, ‘না, না।’ আর জুলি সেই জনহীন দুপুরবেলার বাগানে আমাকে বুকে চেপে নিঃশব্দে কতক্ষণ ধরে কান্নাকাটি করেছিল। কালু আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে ব্যথিতভাবে লেজ নাড়ছিল। হঠাৎ মুখ তুলে তাকে দেখে মনে হয়েছিল, দৈত্যদের পৃথিবীতে আমার আর জুলির মতো কালুও এত অসহায়!

বাবা আমার কোমলহৃদয়া মাকে যখন অনেকটা নুইয়ে ফেলেছেন, গন্ধে গন্ধে খোঁজ নিতে এসে পড়েছে হুরমতি নামে এক নাচুনি—যার বগলে সবসময় একটা ঢোলক আটকানো, এমনকি পাশের বাড়ির হাতেমের বউ এসে হলুদ বাটার জন্যে শিলনোড়া চাইছে, সেই সময় একদিন ডাকপিওন একটা পোস্ট-কার্ড দিয়ে গেল।

বাবা পোস্ট-কার্ডটা হাতে করে বাড়ি ঢুকে ঘোষণা করলেন, ‘ডেপুটিসাহেব আসছেন।’ সঙ্গে সঙ্গে একটা হিড়িক পড়ে গেল। মা দৌড়ে গিয়ে পোস্ট কার্ডটা ছিনিয়ে নিয়ে প্রায় চিক্কুর ছাড়লেন, ‘ভাইজান আসছেন। ভাইজান আসছেন।’ তারপর বড় বড় চোখে চিঠিটা দম আটকানো ভঙ্গীতে পড়ে নিয়ে ছুটোছুটি শুরু করলেন। ‘জুলি! ও জুলি! শিগগির হাসুর মাকে খবর দে। আর শোন, ছোট্টু বলে আসবি।’ জুলি পা বাড়াতেই ফের চিক্কুর ছাড়লেন, ‘অ্যাই বাঁদরমুখী! আরও শোন্। পর মেলে দিলে সব কথা না শুনেই।…’

আমার মায়েরা ছিলেন সাত বোন এক ভাই। মা সবার ছোট, আর ভাইটি সবার বড়। সেই ভাই ছিলেন ইংরেজ আমলের এক পরাক্রান্ত ডেপুটি। চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর তাঁর একটাই বাতিক ছিল, পালাক্রমে বোনদের খোঁজখবর নিতে যাওয়া। তিনি ছিলেন বিপত্নীক এবং ছেলেরাও ছিল লায়েক। মেয়েদের পাত্রস্থ করে ফেলেছিলেন জীবনের সুদিনে। তারা দেশভাগের পর পাকিস্তানে চলে যায়। ফলে বোনদের প্রতি তাঁর স্নেহের মাত্রা ছিল প্রগাঢ় ও বিপুল। ট্রেন থেকে নেমে এলেও যেমন গতিবেগ ঘোচে না, রিটায়ার করার পরও তাঁর দেহমন থেকে তেমনি আমলাতন্ত্রের গতিবেগটি ঘোচেনি। পালে বাঘ পড়ার মতো এসে পড়তেন বোনেদের বাড়িতে। আমার বাবা ছিলেন স্কুলমাস্টার। গ্রামের স্কুলে ইন্সপেক্টর আসার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। তিনি তাঁর ডেপুটি শ্যালককে বাইরে বাইরে ঠাট্টা করলেও ভেতরে-ভেতরে খুব সমীহ করে চলতেন। কারণ ওই জাঁদরেল প্রাক্তন আমলার দরুন গ্রামে তাঁর প্রভাব বাড়ত। বাবা বলতেন বটে, ‘নাও। ডেপুটিসাহেব ট্যুরে বেরিয়ে পড়েছেন, কিন্তু তাঁর ন্যালাভোলা বাড়ি আর অগোছাল সংসারকে ব্যস্তভাবে সাজিয়ে ফেলতে মায়ের সঙ্গে পাল্লা দিতেন।

আমার ডেপুটিমামা ডিসিপ্লিনের খুব পক্ষপাতী ছিলেন। পান থেকে চুন খসলে চটে যেতেন। তাগড়াই আর ফর্সা পাঠান চেহারার মানুষ। কাঁচাপাকা একরাশ চুলদাড়ি। পরনে সাদা ঢোল পাঞ্জাবি-পাজামা, পায়ে কালো পামশু। হাতে সারাক্ষণ একটা বেতের মোটা ছড়ি। উত্তরোত্তর ধর্ম তাঁকে যত টানছিল, তত শরীর থেকে অসংখ্য চোখ গজিয়ে উঠছিল যেন। ডিসিপ্লিন, পরিচ্ছন্নতা, আদবকায়দা এসব জিনিসের দিকে অসংখ্য সেই চোখে লক্ষ রাখতেন এবং প্রত্যেকটির পেছনে শাস্ত্রীয় সমর্থন দাঁড় করাতেন।

তিনি আসছেন শুনে আমাদের বাড়িতে সাজো-সাজো রব পড়ে যেত। সদর দরজার চটের পর্দাটা বদলানো হত। দেয়াল, সিলিং, মেঝে ঝাড়পোঁছ করে তকতকে রাখা হত। উঠোনের ইঁদারাতলায় তৈজসপত্রের পাহাড় জমিয়ে হাসুর মা বালি আর ছাই দিয়ে আড়ংধোলাইয়ে লেগে যেত। মা জুলিকে নিয়ে কোমরে আঁচল জড়িয়ে কাজে নামতেন। মাঝে-মাঝে কী করতে হবে, খুঁজে না পেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতেন। শোবার ঘরের সব দেয়াল ঢেকে ছবি লটকানো মায়ের শখ। পত্রিকা থেকে রঙিন ছবি ছিঁড়ে নিয়ে বাবাকে বাঁধিয়ে আনতে বলতেন শহর থেকে। ডেপুটি ভাইজানের অনেকগুলো ফুটোও বাঁধিয়ে এনে জায়গামতো লটকেছিলেন। সেই ঘরে মাকে অন্যরকম দেখাত। স্বপ্নাচ্ছন্ন এক মুসলিম যুবতী, বাইরের পৃথিবীতে যার পা ফেলা বারণ, সে বাইরের পৃথিবীর রূপরসশব্দগন্ধস্পর্শ অনুভব করার জন্য নিজের ঘরে তাকে প্রতিফলিত করতে চাইত। সেই মাথাকোটা আকুলতার ছাপ মায়ের চোখে ফুটে উঠতে দেখতাম। ওটাই ছিল তাঁর শ্বাস ফেলার জগৎ। কিন্তু ডেপুটিমামা এলেই ওই জগৎটাকে ফেলে রেখে তাঁকে বেরুতে হত। ডেপুটিমামার আবির্ভাবে মায়ের মধ্যে বহু সূক্ষ্ম পরিবর্তনও আমি লক্ষ করতাম। গলার স্বর কত খাদে নামানো যায়, আগে থেকে তাই প্র্যাকটিস করতেন। কারণ ডেপুটিমামার শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা অনুসারে, মুসলিম স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর বাড়ির বাইরে পৌঁছানো বারণ। শাড়িটিও শরিয়ত মতে পরা চাই। তাই প্রচণ্ডভাবে গায়ে জড়ানোর ফলে মায়ের হাঁটাচলার অসুবিধে হত। কিন্তু উপায় নেই। আছাড় খেয়ে পড়লে জুলি হাসি চাপতে পারত না। তাকে বকতে গিয়ে মাও হেসে ফেলতেন। তবে ওই সময়টাতে মাকে বড় সুন্দর দেখাত। ভক্তিমতী, পরিচ্ছন্ন, নম্রস্বভাব আর লাজুক। আমি হঠাৎ-হঠাৎ মাকে মুখ তুলে দেখে আর যেন চিনতেই পারতাম না।

আর আমার উদাসীন স্বভাবের বাবা মানুষটিও বদলে যেতেন। পরিষ্কার কাপড়-জামা পরতেন। হাবেভাবে আভিজাত্য ফোটানোর চেষ্টা করতেন। মধুর কণ্ঠস্বরে আমাকে ও জুলিকে তুমি বলে সম্ভাষণ করতেন। আসলে ডেপুটিমামার জন্য বাড়িজুড়ে একটা থমথমে পবিত্রতা, ছিমছাম একটা স্নিগ্ধতা ফুটে উঠত। একটু তফাতে দাঁড়িয়ে দেখলে পুরনো একতলা জীর্ণ বাড়িটাকেও মনে হত বড় গম্ভীর আর সম্রমউদ্রেককারী। তাই বারবার বাড়িটাকে তফাত থেকে দেখতে যেতাম এবং মুগ্ধ হতাম।

আমাদের সাদামাটা সংসারকে এভাবেই সম্ভ্রান্ত করে তুলতেন ডেপুটিমামা। পাড়াজুড়েও তাঁর আসার আগেই তখন হিড়িক: ‘ডিপ্‌টিসাহেব আসছেন! ডিপ্‌টিসাহেব আসছেন!’ প্রবীণেরা এসে খবর নিয়ে যেতেন কখন তাঁর শুভপদার্পণ ঘটবে। স্টেশনে গরুর গাড়ি পাঠানোর দায়িত্ব তাঁদেরই কেউ নিতেন। কেউ পাঠিয়ে দিতেন ধামাভরা পোলাওয়ের চাল। কেউ দিয়ে যেতেন এক বয়াম ঘি—এমনকি মোরগ পর্যন্ত।

এসব উপহারসামগ্রী তাদের সেন্টিমেন্ট রক্ষার জন্য এবং ডেপুটিসাহেবের মুখ চেয়েও ফিরিয়ে দেওয়া হত না। তখন তাঁর সম্ভ্রমের পালিশে সারা মুসলমানপাড়া ঝলমলিয়ে উঠেছে। এর একটা বিশেষ কারণও ছিল। একসময়ে স্বদেশী আন্দোলনের ঠেলায় ইংরেজ সরকার মফস্বলের আমলাদের তথাকথিত ‘গঠনমূলক’ কাজে লেলিয়ে দিতেন। ডেপুটিমামার দেহ-মনে যে গতিবেগের কথা বলেছি, এই গঠনমূলক কাজের ব্যাপারটা ছিল তার অন্তর্ভুক্ত। তবে রিটায়ার করার পর ধর্ম এবং অন্যান্য কারণে তাঁর তৎপরতা একান্তভাবে মুসলিম সমাজমুখী হয়ে ওঠে, যাকে তিনি বলতেন ‘কওমি খিদ্‌মত’ অর্থাৎ জাতির সেবা। আমাদের গ্রামের মুসলিমদের মধ্যে জিন্নাসাহেবের দ্বিজাতিতত্ত্বকে তত বেশি খাওয়ানোর ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও (কারণ ডেপুটিমামা রাজনীতি অপছন্দ করতেন এবং ইংরেজদেরই ভাবতেন দেশের ত্রাণকর্তা) শেষ পর্যন্ত কওমি রেজারেকশান-গোছের একটা উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। মসজিদে মাইনেকরা মৌলবী রেখে বালকবালিকাদের ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল তাঁরই উপদেশে। ছোটখাট বিবাদের ফয়সালা তাঁর পথ চেয়ে বসে থাকত। লোকেরা বলাবলি করত, ‘এবার ডেপুটিসাহেব এলেই গহর আর এরাদুর কাজিয়াটা মিটে যাবে।’ কিংবা ‘ইনু যে তার গরিব ভাগ্নের হক মেরে খাচ্ছে, সেটারও একটা আস্কারা হয়ে যাবে।’ ডেপুটিসাহেব এসে মসজিদে ভাষণ দিয়ে লোকগুলোকে এমন উত্তেজিত করে ফেলতেন যে তারা গঠনমূলক কাজের খোঁজে পিলপিল করে বেরিয়ে পড়ত ঝুড়ি-কোদাল-কাটারি নিয়ে, রাস্তা মেরামতে লেগে যেত। ডোবা-পুকুর থেকে কচুরিপানা সাফ করে ফেলত। মাঠের ইদগার সংস্কারে মেতে উঠত। সরকারের কাছে তাদের হয়ে দরবার করারও সুবিধে ছিল তাঁর। আর এসবের ফলে ডেপুটিসাহেব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। হয়তো গ্রামের লোকেরা ভাবত একবার ডেপুটি হলে মানুষ সারা জীবনই ডেপুটি থেকে যায়। জুলি চুপিচুপি আমাকে বলত, ‘জানো অঞ্জু, ডিপ্টিভাইজান মেজেস্টরের হাকিম ছিল? শুনে আমার তো হাত-পা কাঁপছে তখন থেকে।’

‘হাত-পা কাঁপছে কেন?’

জুলি চোখ বড় করে বলত, ‘মেজেস্টরের হাকিম কি যে-সে?’

হেসে অস্থির হয়ে বললাম, ‘মেজেস্টরের হাকিম কী বলছ তুমি? মামুজী তো ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।’

জুলি আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলত, ‘ও মা! তাই বুঝি? আমি ভাবি মেজেস্টরের হাকিম।’

জুলির অজ্ঞতা দেখে অবাক হতাম না। আমার পড়ার বইয়ের পাতা খুলে সে অন্ধের চোখ দিয়ে দেখত। তার স্বাসপ্রশ্বাস যেন আটকে যেত আবেগে। একবার একটা ছবির ভেতর সেই প্রথম মানুষের মুখ চিনতে পেরে তার শরীর জুড়ে থরথর আনন্দের উচ্ছ্বাসও আমি দেখেছিলাম। তারপর থেকেই যেন সে মায়ের শোবার ঘরের দেয়ালে মায়ের মতোই একটা পৃথক জগৎ আবিষ্কার করতে শিখেছিল। সুযোগ পেলেই সে আমাকে সাথী করে নিয়ে ওঘরে ঢুকত। একটার পর একটা ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়াত। আমি বুঝিয়ে দিতে গেলে সে কাঁধে চাপ দিয়ে ফিসফিসিয়ে উঠত, ‘চুপ করো তো!’ তারপর ডেপুটিমামার ছবির সামনে গিয়ে তাঁকে চিনতে পেরেই জিভ কেটে মাথায় কাপড় চড়িয়ে ঘোমটা দেওয়ার ভঙ্গী করত। এটা মেয়েদের শরিয়তি শালীনতার রীতি।

ডেপুটিমামা এলে তাঁকে জলের গ্লাস, চায়ের কাপপ্লেট, পানমশলার রেকাবি এসব পৌঁছে দিতে হত জুলিকে। সে প্রচুর ঘোমটা টেনে এবং প্রচণ্ডভাবে শাড়িটাকে শরীরে লেপটে মাথাটা সামনে ঝুঁকিয়ে এগিয়ে যেত দলিজঘরে। দলিজঘরে বাইরের লোক থাকলে সে দরজার এধারে পর্দার আড়াল থেকে ভিতু কণ্ঠস্বরে নিয়ে যাওয়া জিনিসটার নাম উচ্চারণ করত। অথচ ওইসব লোকের সামনে মাথা খুলে অগোছাল শাড়ি পরেই সে ঘোরে।

ডেপুটিমামা অনেক সময় শুনতে পেতেন না কথার খেয়ালে। তখন তাকে দাঁড়িয়ে থাকতেই হত আর মাঝে মাঝে মৃদুস্বরে জিনিসটার নাম আওড়াতে অথবা আস্তে করে কাসতে হত। তবু ভেতর থেকে সাড়া না এলে সে বিব্রতমুখে আমাকে খুঁজত। তখন আমি গিয়ে তার মুশকিল আসান করতাম।

ডেপুটিমামা প্রথম জুলির বয়সের দিকে বাবা ও মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। বলে গিয়েছিলেন, ‘মেয়েটা বিয়ের লায়েক হয়েছে। আফটার অল পরের মেয়ে। ওকে আর ঘরে রেখো না।’ পরের বার এসে জুলিকে দেখে ফের বলেছিলেন, ‘এখনও ওর বিয়ে দাওনি? আবদুল্লা! হুস্না! তোমরা আগুন নিয়ে খেলছ। হুঁশিয়ার!⋯’

জুলি সেই কথা আড়ি পেতে শুনেছিল। তার ক্ষোভ হয়েছিল। কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেনি। কিছুদিন পরে কালুর সঙ্গে বাগানে লুকোচুরি খেলছি, জুলি পেয়ারাগাছে ঠেস দিয়ে বুড়ি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কালুর আগে আমি বুড়ি ছোঁয়ামাত্র ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম। খাপ্পা হয়ে বললাম, ‘ফেলে দিলে আমাকে?’

জুলি গাল ফুলিয়ে বলল, ‘ছুঁয়ো না আমাকে। জানো না আমি আগুন। হাতে ফোস্কা পড়বে?’

রাগটা সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল। এমন মজার কথায় না হেসে পারা যায় না। আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। ‘আগুন? নাও—পোড়াও! পোড়াও আমাকে।’ আমি ওর শরীরকে ওতপ্রোতভাবে খামচে টানাটানি করে, এমনকি ওর বুকে ঢুঁ মারার মতো মাথা গুঁজে এবং ওর বিশাল চুল ধরে ঝুলোঝুলি করে বলতে থাকলাম, ‘আগুন? আগুন তুমি? বলো আগুন?’

জুলি ধপাস করে পা ছড়িয়ে বসে কেঁদে ফেলল। তখন অপ্রস্তুত হয়ে সরে গেলাম। কালু আমার পাশে এসে দাঁড়াল। বৃক্ষতলে এলোচুলে শোকাকিনী জুলির দিকে দু’জনেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম।

সে রাতে জুলি কোনো গল্প বলছিল না। উঠোনে একবার কালু সন্ধিগ্ধ কণ্ঠস্বরে ডেকেই চুপ করে গেল। পেছনের তালগাছটায় খড়খড় শব্দ হতেই আমি ভাবলাম, একটা পরী আকাশপথে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে তালগাছের মাথায় বিশ্রাম নিতে নেমেছে এবং সেটা টের পেয়েই কালু আস্তে ঘেউ করে উঠেছে। ভয়ে জুলির কাছ ঘেঁষে গেলাম। সে চিত হয়ে শুয়েছিল। হঠাৎ ঘুরে আমাকে বুকে টেনে নিল।

তো সেবার বসন্তকালে যখন ল্যাংড়া মিলিটারি বদরুর সঙ্গে জুলির বিয়ের কথা মোটামুটি ঠিকঠাক হয়ে এসেছে, সেই সময় ডেপুটিমামার আবির্ভাব ঘটল।

জুলি যেমন, তেমনি আমিও বুঝতে পেরেছিলাম, জুলির আর উদ্ধারের আশা নেই। বিশেষ করে বদরু সে-বেলা নিজেই এসে খাসির মাংস দিয়ে গেল। তার চেহারার নিষ্ঠুরতাটা ঘষেমেজে কোমল দেখাচ্ছিল। ডেপুটিমামাকে যখন অভ্যর্থনা করে গরুর গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছে, তখন তাকে মিলিটারি পোশাকে দেখে আমি শিউরে উঠলাম। ডেপুটিমামা তাকে চিনতে পেরে বললেন, ‘কী বদরুদ্দিন, কেমন আছ?’

বদরু একপায়ে সোজা হয়ে খট করে স্যালুট ঠুকল এবং বলল, ‘ভাল আছি স্যার! আপনি ভাল তো!’

দ্রুত আমার মাথায় ভেসে এল বাগানের আমগাছের সেই ডালটার কথা—কিছুদিন থেকে লম্বা ছড়ালো সেই ডাল খুব জ্যান্ত হয়ে জুলিকে খুঁজছিল। সবকিছু ফেলে বাগানে ছুটে গেলাম। ডাকলাম, ‘জুলি! জুলি!’ কালুও ভয়ার্ত স্বরে একবার ঘেউ করে ডাকল। খুঁজে না পেয়ে বাড়ি ফিরে দেখি, জুলি বারান্দার তক্তাপপাশে গালিচা বিছোচ্ছে। বাড়ি ঢুকে ডেপুটিমামা আগে ওখানে এসে বসবেন। ‘নাস্তা-পানি’ খাবেন। তারপর যাবেন দলিজঘরে। সেখানে প্রবীণদের ভিড় জমবে। ইজিচেয়ারে বসে তাঁদের সঙ্গে বাক্যালাপ করবেন ডেপুটিমামা। ছড়িটি পাশে ঠেকা দেওয়া থাকবে।

জুলির চোখে চোখ পড়লে সে একটু হাসল। হাসতে পারল দেখে অবাক লাগছিল। তারপর চমক খেলাম তার কপালে কাচপোকার টিপ দেখে। সেদিন সারা দুপুর খিড়কির পুকুরে তাকে একটা কাচপোকা ধরতে সাহায্য করেছিলাম ভেবে একটু পস্তানিও হল। আর সে সুন্দর করে চুল বেঁধেছে, গত ইদের ডোরাকাটা শাড়িটা বের করে পরেছে। মায়ের ভঙ্গীতে খোঁপায় ঘোমটা আটকে রেখেছে (মুসলিম কুমারীদেরও ঘোমটা দেওয়া নিয়ম)। সে কি জানে না ল্যাংড়া মিলিটারিটা সেজেগুজে দলিজঘরের সামনে এসে পৌঁছেছে? আমি ওকে কথাটা জানিয়ে দেব ভাবলাম, কিন্তু সুযোগই পেলাম না। ডেপুটিমামা দরাজ গলায় ডাকতে ডাকতে বাড়ি ঢুকছিলেন, ‘অঞ্জু! অঞ্জু কোথা রে?’ আমাকে দেখে ভুরু কুঁচকে একটু হেসে বললেন, ‘হ্যাল্লো মাই বয়! কত বড়টি হয়ে গেছ তুমি! চেনাই যাচ্ছে না—অ্যাঁ!’

প্রথা অনুসারে এগিয়ে গিয়ে পদচুম্বন করলে মাথা স্পর্শ করে আশীর্বাদ করলেন। এবার মায়ের পালা। মা পদচুম্বন করে উঠেছেন, হঠাৎ আমার পেছন থেকে কালুর সাইরেন শুরু হয়ে গেল। সে এই প্রথম ডেপুটিমামাকে দেখছে।

কালুকে বাবা তাড়া করলেন। কিন্তু তার চেঁচামেচি বন্ধ হল না। এমনকি আমিও তাকে বকে দিলাম। তবু সে গ্রাহ্য করল না। খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে চিক্কুর ছাড়তে থাকল।

ডেপুটিমামার মুখে বিরক্তি ফুটে উঠেছিল। কিন্তু তখন কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পরে বারান্দার তক্তাপোশে গালিচায় বসে কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘অঞ্জুর কোন ক্লাস হল এবার?’

‘ক্লাস সিক্স্।’

‘মাশ আল্লাহ্‌! শাবাশ।’ ডেপুটিমামা মিটিমিটি হেসে চাপা স্বরে বললেন, ‘কুকুরটা কার?’

শুনতে পেয়ে মা ঝটপট বললেন, ‘কারুর না। কোত্থেকে এসে জুটেছে। রাত্তিরে বাড়ি পাহারা দেয় বলে—’

হাত তুলে মাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বলো তো অঞ্জু, আমার একটা কুকুর আছে ইংরেজিতে কী?’

ভেবেচিন্তে বললাম, ‘মাই হ্যাজ এ ডগ।’

ডেপুটিমামা অট্টহাস্য করে বললেন, ‘আবদুল্লা! হুস্না! শোনো তাহলে—মাই হ্যাজ এ উগ!’

বাবা ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘সারা দিন পড়াশোনা নেই—খালি কুকুর নিয়ে খেলা। আই হ্যাভ এ ডগ।’

ডেপুটিমামা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আবদুল্লা, তুমি তো আবার এথিস্ট্। খোদাতালা মানো না, নমাজ পড়ো না। তোমাকে বলা ভুল। হুস্না, তুমি শোনো!’

মা ঘোমটা একটু টেনে উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, ‘বলুন ভাইজান।’

‘ইসলামী শাস্ত্রে আছে, কুকুর পোষা না-জায়েজ (অসিদ্ধ)। বিল্লির ঝুটো বরং পাক, কিন্তু যে-বাড়িতে কুকুর থাকে, সে-বাড়িতে রাতবিরেতে ফেরেশতা (দেবদূত) ঢোকেন না।’

বাবা ফিক করে হেসে বললেন, ‘খোদা তো সব দেখতে পান। ইন্সপেকশনে লোক পাঠানোর দরকারটা কী?’

ডেপুটিমামা চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘তোমাকে বলিনি। তুমি তো নামে মুসলমান, ভেতরে হিন্দু।’

বাবা বললেন, ‘সে কী! আমাকে তো এথিস্ট্ বললেন এক্ষুনি! আবার হিন্দু বানিয়ে দিলেন?⋯’

বাবা তাঁর এই ডেপুটি শ্যালকের জন্য গর্বিত ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে তর্ক করতে ছাড়তেন না। তর্কটা অনিবার্যভাবে ইংরেজিতে পৌঁছে যেত। তখন একটা আশ্চর্য আবহাওয়ার সঞ্চার ঘটত বাড়িতে। মা মুখ টিপে হেসে কাজ করে বেড়াতেন, কিন্তু কান থাকত সেদিকেই। জুলি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। আমি গর্বিত মুখে লক্ষ রাখতাম। বাড়িটাকে আরও সম্ভ্রমে গম্ভীর করে তুলত ইংরেজি ভাষা। মা মাঝে মাঝে ফিসফিস করে বলতেন, ‘কোন সাহসে লাগতে যাওয়া? ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন—তার সঙ্গে! এ কি স্কুলমাস্টারি?’

তবে শেষপর্যন্ত বুঝতে পারতাম একজন প্রাক্তন ডেপুটি আর এক স্কুলমাস্টারের তর্কটা নিছক শ্যালক-ভগ্নিপতির আড্ডাবিলাস। অবশ্য দলিজে যখন এই ব্যাপারটা ঘটত, তখন সেটা আমাদের পরিবারের গভীরতর খানদানীরই প্রতীক হত এবং প্রভাব ফেলত। লোকেরা হাঁ করে দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত।

কিন্তু স্কুলমাস্টারের নাস্তিক্য সম্পর্কে প্রাক্তন ডেপুটির বিশ্বাস এমন পাকাপোক্ত ছিল যে সেজন্য আমাকেও একবার ভুগতে হয়েছিল। সেবার তর্কের শুরু আমার নাম নিয়ে।

ডেপুটিমামা বলেছিলেন, ‘ছেলের নাম তো মরহুম সন্-বাবাজী রেখে গেছেন। তুমি হলে হিন্দু নামই রাখতে।’

বাবা বলেছিলেন, ‘ভেবে দেখলে ওটা হিন্দু নামও। অঞ্জুমান আর অংশুমান একই।’

ডেপুটিমামা বাঁকা হেসে বলেছিলেন, ‘হুঁ, বেঅকুফের কানে একইরকম শোনাবে বটে!’

বাবা জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘ভাইজান! আমি বলছি শুনুন। অঞ্জুমান ফার্সিতে হল জ্যোতিষ্ক—সাইনিং স্টার। আর সংস্কৃতে—’

‘তোমার মাথা। অঞ্জুমান বা আঞ্জুমান হল সভা—মজলিশ।’

‘আহা, সে তো যোগরূঢ়ার্থে। অঞ্জুমান হল জ্যোতিষ্ক আর আঞ্জুমান জ্যোতিষ্কমণ্ডলী।’

‘যোগ-ফোগ আমি বুঝি না!’

‘না বোঝাটাই তো আপনাদের সমস্যা।’ বাবা দুঃখিত মুখে বলেছিলেন। ‘ফার্সি অঞ্জুমান আর সংস্কৃত অংশুমান একই শব্দ। অংশুমান মানেও যা অংশু বা কিরণ ছড়ায়। আসলে প্রাচীন যুগে ইরান আর ভারতের লোকেরা একই ভাষায় কথা বলত। ফার্সিতে যা নমাজ, সংস্কৃতে তাই নমস্।’

ডেপুটিমামা থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আগড়ম বাগড়ম ছাড়ো! ছেলের খৎনা দিয়েছ?’

মা তো আড়ি পেতে বেড়াতেন। ঝটপট বলেছিলেন, ‘করে দিয়েছি ভাইজান! সে তো পাঁচ বছর বয়সেই।’

‘আমাকে দাওয়াত করো নাই!’

‘আপনি তো তখন কুমিল্লায় পোস্টেড।’ বাবা বলেছিলেন। ‘মনে করে দেখুন, চিঠি গিয়েছিল।’

ডেপুটিমামার সন্দেহ কিন্তু ঘোচে নি। সেদিনই দুপুরবেলা দলিজঘরে আমাকে ডাক দিয়েছিলেন। দুপুরের খাওয়ার পর বাড়ি তখন নিঃসাড়। সেদিন ছিল ছুটির দিন। বাবা ভাতঘুম দিচ্ছেন। মা খিড়কির দোরে গিয়ে বসেছেন আর জুলি তাঁর চুলে চিরুনি চালিয়ে উকুন খোঁজার ভান করছে। আমি উঠোনের কোনায় লেবুতলায় একটা খেলা খুঁজছি। এমন সময় দলিজঘর থেকে চাপা গম্ভীর ডাক ভেসে এল, ‘অঞ্জু! কাম হেয়া!’

ভেতরে গেলে আবছা আলোয় ডেপুটিমামা ফিসফিস করে হেসে বললেন, ‘তোর সত্যি খৎনা হয়েছে?’

লজ্জায় কাঠ হয়ে বললাম, ‘হুঁউ।’

‘কাছে আয়।’

যাচ্ছি না দেখে ধমক দিলেন। তখন কাছে গেলাম। ডেপুটিমামা ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘ফাঁস না বোতাম?’

বুঝতে পারছি না দেখে আমার জামা তুলে বললেন, ‘ফাঁস!’ তারপর একটানে ফিতের ফাঁসটা খুলে আমার হাফপেণ্টুল নামিয়ে দিলেন এবং ক্ষুদে জিনিসটাকে নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘অল রাইট! ফাঁস আটকে ফ্যাল। আর এই নে বখশিস। খেল্গে, যা।’

বখশিসটা একটা অবিশ্বাস্য আধুলি এবং আমার হাফপেণ্টুলের বয়সে তার প্রচুর দাম। তবে লজ্জায় এ কথা কাউকে বলিনি। জুলি, যার কাছে আমার গোপনীয় কিছু ছিল না, তার কাছেও না।⋯

ল্যাংড়া-মিলিটারি বদরুর সঙ্গে জুলির বিয়ের কথা চলার সময় ডেপুটিমামা এসে সামান্য একটা প্রাণী কালুকে শত্রু ভেবে বসবেন, কল্পনাও করি নি। কালু ছিল আমার সারাক্ষণের সঙ্গী। সে আমার সঙ্গে স্কুলেও যেত। যতক্ষণ স্কুলে থাকতাম, তার আনাচে-কানাচে অপেক্ষা করার ইচ্ছে থাকত। কিন্তু বোর্ডিংয়ের রান্নাঘরের কাছে আড্ডা দিত যারা, তারা তাকে পছন্দ করত না। তাড়া করে আমাদের পাড়ায় ঢুকিয়ে রেখে যেত। স্কুল থেকে ফেরার সময় তার সঙ্গে ঠিকই দেখা হয়ে যেত কবরখানার কাছে। বাড়ি ফিরে তাকে না দেখতে পেলে আমি অস্থির হব, কালু জানত। আর জুলিও কালুকে ভীষণ ভালবাসত। আমি, জুলি ও কালুর একটা পৃথক জগৎ ছিল। সেখানে আমরা তিনজন পরস্পর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম, কেউ কাউকে ছেড়ে থাকব না। ডেপুটিমামা এসে যখন ফতোয়া জারি করলেন, কালুকে তাড়াতে হবে, আমার ও জুলির মুখ শুকিয়ে গেল।

আমরা সে-বেলা বাগানে গিয়ে চুপিচুপি পরামর্শ করলাম, কীভাবে কালুকে বাঁচানো যায়। তবে জুলি বলল, ‘কথাটা কিন্তু সত্যি। রাত্তিরে কালু চ্যাঁচায় কেন অত, এতদিনে বুঝলাম, জানো অঞ্জু?’

‘কেন, জুলি? ফেরেশতা আসে বলে? ফেরেশতা কেমন বলো তো?’

জুলি জানত। বলল, ‘তোমার বইয়ে লেখা নেই? সাদা ফিট্ কাপড়-পরা। মাথায় সাদা পাগড়ি। আঁধারে যেন জ্বলে।’

‘কেন আসে?’ আসলে আমি রাগ করে কথা বলছিলাম। ‘আসবার দরকারটা কী?’

‘বাড়ির মানুষ ভাল না মন্দ তাই দেখতে।’

‘আমরা তো ভাল।’

‘ভালই তো। আমরা কি ল্যাংড়া হারামির মতো খারাপ? আমরা কি কারুর গলায় ছুরি চালাই?’

খুব অবাক লাগছিল, ডেপুটিমামা আর কালু দু’জনেই তাহলে রাতের আগন্তুক ফেরেশতাকে দেখতে পায়, আর কেউ পায় না! পেলে তো কবে সেকথা বলত। মা না, বাবা না, জুলি না, পাশের বাড়ির হাতেম না—এমনকি মৌলবীসাহেবও না। আমাদের বাড়ি ওঁর খাওয়ার পালা পড়লে কালু ওকে দেখে কত চেঁচামেচি করেছে। তবু তো উনি বলেন নি কালু রাতের ফেরেশতাকে বাড়ি ঢুকতে দেয় না? ডেপুটিমামার এই অসামান্য ক্ষমতা আমাকে ওঁর সম্পর্কে আরও ভয় পাইয়ে দিল। সেই বয়সে প্রবীণেরা এমনিতেই দৈত্যের মতো উঁচু আর বলবান, ডেপুটিমামাকে তাঁদের চেয়েও উঁচু আর ক্ষমতাশালী দেখতে পেলাম। জুলি ও আমি ভেবে-ভেবে কিছুই ঠিক করতে পারলাম না কালু বেচারীকে কীভাবে রক্ষা করব।

প্রথম রাতেই ডেপুটিমামা কালুর চিৎকারে খেপে গিয়েছিলেন। সকালে চোখমুখ লাল করে বললেন, ‘হারামি কুত্তা সারারাত ঘুমোতে দেয় নি। ওর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। হি মাস্ট বি পানিশ্ড!’ তাঁর ইংরেজি গর্জনে বাড়ি গমগম করছিল। আর কালুও কেন কে জানে, ওঁকে দেখে খেপে গিয়েছিল। সারাক্ষণ চেঁচামেচিতে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিল। কিছুতেই তাকে শান্ত করতে পারছিলাম না। যতবার তাকে বাগানে ঠেলে দিই, বাড়ি ঘুরে সে দলিজঘরের কাছে যায় আর চিৎকার করে। বেলা বাড়তে বাড়তে দলিজঘরের সমাবেশে ডেপুটিমামার ফরমান জারি হল। তারপর আঁতকে উঠে দেখলাম, জোয়ানমদ্দ একদঙ্গল লোক পরোয়ানা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। মা চুপ করে থাকলেন। শুধু বাবা বোকার মতো হেসে বললেন, ‘কোনো মানে হয়? ভাইজানের যত বয়স হচ্ছে, তত যেন পাগলামিটা বেড়ে যাচ্ছে। ঘরে ছবি থাকলেও নাকি ফেরেশতা ঢোকে না। তার বেলায় তো উচ্চবাচ্য নেই?’ মা অমনি চোখ কটমটিয়ে বললেন, ‘থামো তুমি!’

লোকগুলোর হাতে লাঠি, বল্লম, চটের থলে, প্রকাণ্ড ঝুড়ি পর্যন্ত। আরেকবার দলিজঘরের সামনে কালু চেঁচাবার জন্য গিয়ে পড়তেই তারা হইহই করে তাকে তাড়া করল। আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম। জুলি এসে আমাকে টেনে ঘরে ঢোকাল। আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘পারবে না। কালু খুব চালাক। ডেপুটিসাহেব কদিন আর থাকবেন? চলে গেলেই কালু বাড়ি ফিরবে দেখো।’

তখন দূর থেকে দৈত্যদের বিকট চিৎকার ভেসে আসছিল। চিৎকার আরও দূরে মিলিয়ে গেলে জুলি আমার চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ছিঃ। কাঁদে না! তুমি এখন বড় হয়েছ। কাঁদা মানায় না তোমার। এই দ্যাখো না, আমার মাথার সমান হয়েছে তোমার মাথা। সে আমার গালে গাল ঠেকিয়ে উচ্চতা দেখাল। তারপর আমাকে অবাক করে আমার গালে চুমু খেল। তারপর সেই আবছা আঁধারে ভরা ঘরে আমার শরীর নিয়ে সে যা সব করতে থাকল, তা তার সান্ত্বনারই প্রকাশ।

তারপর আর কালুকে দেখতে পাইনি। পাড়ায় না, তার প্রিয় ভ্রমণক্ষেত্র কবরখানাতেও না, গ্রামে না—কোথাও না। আমার জীবন থেকে কালু হারিয়ে গেল চিরদিনের মতো। কেউ আমাকে বলতে চাইত না কালুর কী হল। কিন্তু শুধু কালু না, পাড়ায় ফেরেশতা ঢুকবে না বলে লোকেরা পাড়ার সব কুকুরের পেছনে লেগেছিল। এভাবে কুকুর-শূন্য হওয়ায় ফেরেশতারা নিশ্চিন্তে লোকেদের বাড়ি ঢোকার সুযোগ পেয়েছিলেন। বেগতিক দেখে মন্দ লোকেরাও ভাল সাজার চেষ্টা করে থাকবে। শুধু মূর্গিচোর কিনুর কথা আলাদা। একরাতে কিনু এসে মায়ের দরমা থেকে ‘বাদশা’কে নিয়ে গেল। বাড়িতে চুপিচুপি হাহাকার পড়ে গেল। বাদশাকে মা তাঁর ডেপুটি ভাইজানের বিদায়-ভোজের জন্যই নাকি রেখেছিলেন, অন্যদের ওপর ছড়ি ঘোরানো তম্বি করার জন্য নয়। জুলি আমাকে আড়ালে বলেছিল, ‘এই তো শুরু হল। আরও কত কী হবে। দেখি না ডেপুটিসাহেবের ফেরেশতা কাকে বাঁচায়।’

তবে একথাও ঠিক যে ফেরেশতা বাড়ি ঢোকায় জুলি তাঁকে নালিশ জানানোর সুযোগ পেয়েছিল। আমাকে শুনিয়েই ফিসফিসিয়ে বলত, ‘বাবা ফেরেশতা। আর যার সঙ্গেই হোক, ওই ল্যাংড়া ভ্যাংড়ার সঙ্গে যেন আমার বিয়ে না হয়।’

এই শুনতে শুনতে একরাতে আমি ওকে বলে ফেললাম, ‘জুলি। আমি যদি বড় হতাম, আমিই তোমাকে বিয়ে করে ফেলতাম।’

শোনামাত্র আমার মুখে হাত চেপে জুলি সেই পুরনো ধুয়ো তুলে বলে উঠল, ‘ছিঃ! আমি তোমার ফুফু হই না?’

কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ করে অবাক হয়েছিলাম। বদরুর সঙ্গে বিয়ের কথাটা কেন যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে। তাহলে সত্যি কি রাতের ফেরেশতা বাগড়া দিয়েছেন জুলির প্রার্থনায় মন গলে গেছে বলে?

এবার ডেপুটিমামা অন্যবারের চেয়ে বেশিদিন ধরে আছেন। গোড়াতেই বলেছি, আমার সেই বয়সে চারপাশে ঘটত সন্দেহজনক সব ঘটনা, যার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারতাম না। বাড়িতে যেন তেমন কিছু ঘটছিল। মায়ের মুখে থমথমে ভাব। বাবার সঙ্গে ফিসফিস করে কীসব আলোচনা করেন। বাবা গম্ভীর মুখে বেরিয়ে যান। বেশিরভাগ সময় বাইরেই কাটান। মা কাজ করতে করতে হঠাৎ থেমে আস্তে ডাকেন, ‘জুলি, শুনে যা।’ কিন্তু জুলি কাছে গেলে বলেন, ‘থাক। পরে বলব। দ্যাখ তো, ভাইজান চা-ফা খাবেন নাকি? আর শোন্, ওঁর গেঞ্জি ময়লা হয়েছে বলছিলেন। চেয়ে নিয়ে আয়।’

এক সন্ধ্যায়, তখন বসন্তকাল, মা নমাজ পড়তে বসেছেন, বাবা গেছেন হিন্দুপাড়ায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে, ডেপুটিমামা গেছেন মসজিদে, আমি পড়তে বসব কি না ভাবছি, জুলি আমার হাত ধরে খিড়কি দিয়ে বাগানে টেনে নিয়ে গেল। তারপর শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘ও অঞ্জু! জানো কী হয়েছে?

‘না তো। কী হয়েছে জুলি?’

‘ভাবীজী তার ভাইজানের সঙ্গে আমার বিয়ে লাগিয়েছে।’

প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, ‘মামুজীর সঙ্গে?’

‘চুপ চুপ।’ জুলি আমার মুখে হাত চাপল। ‘ভাবীজী বলছে, ভাল থাকবি। উনি একা থাকেন। দেখাশোনার কেউ নেই। ডেপুটিসাহেবের বউ হবি। মান বাড়বে।’

জুলি ধরা গলায় বলতে থাকল ফের, ‘ভাবীজী বলছে, ডেপুটিসাহেবের ছেলেমেয়েরা তো সব পাকিস্তানে আছে। জমিজমার ভাগ নিতে কেউ আসবে না। সব তুই পাবি।’ জুলি হু-হু করে কেঁদে উঠল। ‘সব আমি পাব—ঘরবাড়ি, জমি, সম্পত্তি। ছপ্পর খাটে পা ঝুলিয়ে আমি বাঁদির বেটি বেগম সেজে বসে থাকব।’

মা ডাকছিলেন, ‘জুলি! জুলি!’ মায়ের কণ্ঠস্বর চাপা এবং স্নেহে কোমল। জুলি চোখ মুছে আস্তে আস্তে চলে গেল। সন্ধ্যার বাগানে আমি একা দাঁড়িয়ে। আমগাছটা থেকে মুকুলের মউ-মউ গন্ধ অন্ধকারে। সারাদিন যেসব পাখি ডাকাডাকি করে, তারা চুপ করে আছে, যেন কিছু ঘটতে চলেছে। আর যে বৃক্ষলতা এমন অন্ধকারে নির্দয় রহস্যে ভরে ওঠে, তাদের সব রহস্য ফর্দাফাঁই হয়ে গেছে। তাদের নিষ্ঠুরতাও জুলির ব্যর্থ প্রণয়কামী ল্যাংড়া মিলিটারিটার মতো কোমল হয়ে ভিজে যাচ্ছে—আমি নিঃশব্দে কাঁদছিলাম। ইচ্ছে করছিল তুমুল চেঁচামেচি করে বলে দিই, জুলি আমার। একদিন বড় হয়ে আমিই তাকে বিয়ে করব।⋯

সে-রাতে বিছানায় শুয়ে আশ্চর্যভাবে আবিষ্কার করলাম, কালু তাহলে ঠিকই চিনেছিল। যে প্রাণী অন্ধকার রাতের ফেরেশতাদের দেখতে পায়, সে দৈত্য চেনে এবং তার পকেটে লুকিয়ে রাখা কালো সিন্দুকটিও টের পায়।

জুলি আমাকে সে রাতে আদরে আদরে অস্থির করে ফেলছিল। সে আমার গালে ঠোঁট রেখে ফিসফিস করে অনর্গল কথা বলছিল। সে বলছিল, ‘শিগগির-শিগগির তুমি বড় হয়ে ওঠ। সোনার ছেলেটা! তুমি যদি বড় হতে, কে সাহস পেত আমাকে বিয়ে করার?’ সে দু’হাতে আমার মুখটা আঁকড়ে ধরে আবেগে ছটফট করে বলছিল, ছোটবেলাকার মতো আমার নাক চুষে দাও। আমার গাল কামড়ে খেয়ে ফেলো।’ আমি চুপচাপ দেখে সে কাত হয়ে চুল খুলে সেই চুল ছড়িয়ে আমাকে ঢেকে দিতে দিতে বলছিল, ‘আমার এই চুলগুলো তুমি কত ভালবাসো! এই নাও, তোমাকে চুল দিয়ে লুকিয়ে রাখলাম। ফেরেশতা এসে শুধোবে, অঞ্জু কোথায় গেল, তার নাম লিখব খাতায়? আমি বলব, পারো তো খুঁজে নাও। সে কী মজা হবে বলো তো?’ তারপর সে আমার মাথাটা টেনে আমাকে চুলের তলায় লুকিয়ে দিল।⋯

আমার দয়ালু দাদু দু’বছরের অনাথ মেয়েটির বিস্ময়কর চুলের বিশালতায় মুগ্ধ হয়ে তার নাম রেখেছিলেন জুলেখা—কেশবতী।

সেই কেশবতী চুলে স্বাধীনতার প্রথম সুগন্ধ টের পেয়েছিলাম। যে-সুগন্ধ অবশেষে এক বসন্তকালের বাগানে সন্ধ্যার অন্ধকারকে মাতিয়ে আমার তুচ্ছ একরত্তি জীবনের রন্ধ্র দিয়ে ঢুকে চোখ ফাটিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল শিশিরের ফোঁটার মতো। ভিজিয়ে দিয়েছিল রহস্যের নিষ্ঠুরতাগুলিকে।

জুলির কাছেই পেয়েছিলাম স্বাধীনতার প্রথম সুঘ্রাণ। বলেছিলাম, ‘আমাকে বড় হতে দাও।’

কিন্তু দৈত্যের মতো পরাক্রান্ত এক প্রাক্তন ডেপুটি প্রথমে কালুকে পরে জুলিকে আমার জীবন থেকে মুছে দিলে আমি বাকি জীবনের জন্য একলা হয়ে গেলাম।⋯

১৩৯২ (১৯৮৫)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *