জুয়া (১)
জুয়াখেলা পৃথিবীতে বহুকাল ধরে চলছে। মানুষের রক্তে বাজি ধরার একটা নেশা আছে। সব দেশে সব কালে জুয়াখেলা ছিল।
মহাভারতে দ্যূতক্রীড়ার কাহিনী আছে। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের একটিই মাত্র দোষ ছিল, তিনি সর্বস্ব এমনকী ধর্মপত্নী দ্রৌপদীকে বাজি রেখে অক্ষক্রীড়ায় মত্ত হয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রের সর্বনাশা যুদ্ধের সেই কারণ।
এই ঘটনার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হল, এমন যে সাংঘাতিক দ্যূতক্রীড়া সেটা শাস্ত্রসম্মত ছিল, রাজদরবারে প্রকাশ্যে খেলা হত।
সাধারণ মানুষ কিন্তু কখনও জুয়াখেলাকে অত সহজভাবে নেয়নি। জোচ্চোর নামে যে শব্দটি প্রচলিত আছে, সেটি জুয়া থেকে এসেছে, তার মানে হল জুয়াচোর অর্থাৎ যে ঠকায়, প্রবঞ্চক।
জুয়া খেলতে বারণ করেছিলেন মার্ক টোয়েন। তিনি বলেছিলেন, ‘জীবনে দু’রকম সময়ে জুয়াখেলা উচিত নয়, যখন তোমার পয়সা আছে এবং যখন তোমার পয়সা নেই।’ অর্থাৎ জীবনে কোনো সময়েই জুয়াখেলা উচিত নয়।
তবু মানুষ জুয়া খেলে। জুয়াখেলার নেশা তার রক্তের মধ্যে রয়েছে।
কালীপুজোর রাতে বোম্বাইতে, কাশীতে, কলকাতার বড়বাজারে কোটি-কোটি টাকা হাত-বদল হয় জুয়াখেলায়। সারারাত ধরে চলে সেই উত্তেজনা।
ঘরের কাছে কাঠমান্ডুতে দলে দলে টুরিস্ট যায় শুধু জুয়াখেলার জন্যে। খবরের কাগজে পরিষ্কার বিজ্ঞাপন থাকে— কোন হোটেলে উঠলে কত টাকা জুয়োর কুপন বিনামুল্যে পাওয়া যাবে।
আমেরিকার লা ভেগাসের প্রধান আকর্ষণই হল জুয়া। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ লোক যায় সেখানে নানারকম জুয়াখেলার টানে। প্যারিসের মন্টে কার্লোতেও জুয়াখেলার প্রচণ্ড ভিড়।
জুয়াখেলার নানারকম চেহারা।
তাস-পাশা-শতরঞ্জ থেকে ঘোড়দৌড়। কুকুরদৌড়, উটদৌড় এমন কী বৃষ্টি হবে কি হবে না আবহাওয়ার ভবিষ্যৎবার্তা বা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে হরদম বাজি ধরে জুয়াড়িরা। তার চেয়েও মারাত্মক কথা সেই বাজির টানাপোড়েনে, ওঠানামায় প্রকৃত প্রতিফলিত হয় বিশেষ রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির তৎকালীন জনপ্রিয়তা বা জয়ের সম্ভাবনা।
জুয়াখেলার গল্প অনেক। আগে ঘরসংসার দিয়ে শুরু করি।
ছেলে নতুন বিয়ে করেছে। একদিন বিয়ের কয়েক মাস পরে ছেলেকে মা বললেন, ‘হ্যাঁরে খোকা, তুই এসব কী করছিস?’
ছেলে বলল, ‘কী করছি মা?’
মা বললেন, ‘আমি শুনলাম তুই নতুন বউমাকে জুয়া খেলতে শিখিয়েছিস। তার সঙ্গে বসে সন্ধেবেলা জুয়া খেলিস।’
ছেলে বলল, ‘এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না মা।’
মা অবাক হয়ে বললেন, ‘সে কী? কেন?’
ছেলে বলল, ‘মা তোমার নতুন বউমাটি একটি পাকা চোর। আমার পকেটে যা টাকা থাকে সব তুলে নেয়। তাই জুয়াখেলা ধরিয়েছি। ওকে হারিয়ে ওর কাছ থেকে টাকাগুলো উদ্ধার করতে হয়।’
এ-ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ছেলের রীতিমতো আত্মবিশ্বাস আছে যে— সে বউকে হারাতে পারবে জুয়া খেলে।
কিন্তু জুয়া এত সহজ জিনিস নয়। শুধু আত্মবিশ্বাসে জুয়াখেলা জেতা যায় না। ভাগ্য লাগে, কিছুটা হিসেব লাগে এবং কখনও কখনও হাত সাফাইয়ের ব্যাপারটাও হয়তো থাকে।
সেই যে একদা এক জুয়াড়িকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আপনি ফ্ল্যাশ (Flash— তাসের বাজি) খেলে সব সময় জেতেন, কিন্তু রেস(Race— ঘোড়ার বাজি) খেলে এত হারেন কী করে?’
তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘কী আর করব? তাসের মতো রেসের ঘোড়াগুলোকে যে শাফ্ল করা যায় না।’
জুয়ার নেশা বড় কঠিন নেশা। এ-নেশায় কত রথী-মহারথী, রাজাবাদশা যে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।
বিলেতে, আমেরিকায় জুয়ার নেশার চিকিৎসা আছে। মনস্তত্ববিদেরা সেই চিকিৎসা করেন—যা খুবই ব্যয়বহুল।
এক প্রচণ্ড জুয়াড়ি এইরকম এক ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। বহু অর্থব্যয় করে বহু মাস পরে তাঁর উন্নতি দেখা দিল। একদিন ডাক্তার নিঃসন্দেহ হলেন যে রোগী দোষমুক্ত হয়েছে। ডাক্তার রোগীকে সেকথা জানালেন।
রোগী এ খবর শুনে আনন্দিত হয়ে বললেন, ‘তাহলে তো খুব সুখবর। চলুন একটা পানশালায় যাওয়া যাক, দু’পাত্র পানীয় খেয়ে ব্যাপারটা সেলিব্রেট করি।’
এতদিন ডাক্তারবাবু রোগীর কাছ থেকে বহু টাকা নিয়েছেন। তাঁর একটু সংকোচ হচ্ছিল, তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে তা যাব, কিন্তু আজকের খরচটা আমি বহন করব।’
রোগী বললেন, ‘তা কেন? সুস্থ হলাম আমি আর খরচ করবেন আপনি?’
এর পরেও ডাক্তারবাবু কী একটা আপত্তি করতে যাচ্ছিলেন, তখন রোগী বললেন, ‘ঠিক আছে। তর্ক করে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। এক প্যাকেট তাস হবে আপনার কাছে?’
এতদিন তাসের জুয়ার চিকিৎসা করা হয়েছে রোগীর, তাই ডাক্তারবাবু একটু আতঙ্কিত হয়ে বললেন, ‘তাস দিয়ে কী হবে?’
রোগী বললেন, ‘তর্ক মিটমাট হয়ে যেত।’
স্তম্ভিত হয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘কীভাবে?’
রোগী বললেন, ‘তাসের প্যাকেট থেকে দু’জনে দুটো তাস টানতুম। তারপরে যার তাসটা ছোট হত সেই দামটা দিত।’
সেদিন এই রোগীকে নিয়ে অসুখ সেরে যাওয়া সেলিব্রেট করতে ডাক্তারবাবু গিয়েছিলেন কিনা আমার জোকবুকে সে খবরটা নেই।