জুয়া

জুয়া

তখন আমি পুরোপুরি বেকার যে হিসেবে আমরা বেকার বলে থাকি আর শতকরা আশি ভাগ বাঙালি ছেলেকে।

যদিও শুনেছি, যে কাজ করে তাকে কোনও কারণেই বেকার বলা যায় না। কিন্তু বাংলায় একটি মুখের মতো বিশেষণ আছে তার। নিকামাইয়ের দরজি। যার মানে, কাজ আছে, কিন্তু রোজগার নেই।

রোজগার না থাকলেই বেকার। বনের মোষ তুমি যত খুশি তাড়াতে পার। অবশ্যই বনের মোষ তাড়াচ্ছিলাম না সেই স্বাধীনতা পাওয়ার পরের বছরগুলিতে। কিন্তু কাজ করতাম। তাতে পয়সার সঙ্গে কদাচিৎ দেখাসাক্ষাৎ হত। সেই দেখাসাক্ষাৎটা আরও মর্মান্তিক। লোকে বলে বটে, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। কানা মামা যাদের আছে, তারাই একমাত্র জানে, সেই অকর্মণ্য অন্ধ জীবটিকে নিয়ে। কী দুর্ভোগই ভাগ্নেদের ভুগতে হয়। তাকে নিয়ে না করা যায় ঘর। তাকে ঘরে রেখে না যাওয়া যায়। বাইরে।

কদাচিৎ পয়সার সঙ্গে সাক্ষাৎটা আমার সেই রকমের ভোগান্তি ছিল। কারণ, তা দিয়ে আমার ইজ্জত বাঁচত না। পেটের ক্ষুধা পেটেই থেকে যেত।

এরকম অবস্থায়, একদিন বিকেল ঘেঁষে এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছিলাম। বাস করে এক শিল্প এলাকায়। যেখানে যাব সেখানে কয়েক মাইলব্যাপী শিল্প এলাকার কারখানা, বস্তি বিস্তীর্ণ, তেলকালি ধুলি-ধূসর মানুষের ভিড় এবং আবর্জনা ছড়ানো অঞ্চলের পর, প্রায় পা ধুয়ে ওঠার মতো মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, নিরিবিলিতে থাকতে পারা মানুষের তল্লাট। সেটাও তল্লাটের মানুষের যোগ্যতারই প্রমাণ বোধ হয়। অপরাধ নয় নিশ্চয়।

প্রায় মাইল পাঁচেক পথ। বাসে যাওয়াই আমার পক্ষে সুবিধে ছিল। কিন্তু দশ পয়সার জায়গায় সাত পয়সা ছিল আমার সম্বল। অতএব, সদর ছেড়ে, শহরের পিছনের নির্জন কর্ড রোড ধরে হেঁটেই। চললাম।

নির্জন বলতে গাড়ি ঘোড়ার কথাই বলছি। জন অর্থাৎ মানুষ ঠিকই আছে সে পথের আশেপাশে। তবে কম। অনেক কম। স্বাভাবিক কারণ, শহরের পিছন দিক। তা ছাড়া জলাজংলা জমি পুবের সীমানায়। আর তারই ধার ঘেঁষে রেললাইন। মাঝে মাঝে কিছু বস্তি, মোষের খাটাল আর অবাঙালি বেকার শ্রমিকদের কিছু চাষবাস। কোথাও ভিড়ের একটু বাড়াবাড়িও আছে। শহরের সদর রাস্তার সঙ্গে যেখানে কর্ড রোডের সরাসরি যোগাযোগ হয়েছে, সেইসব মোড়গুলির কাছে ভিড় বেশি। ঘর দোকানপাট সেরকম জায়গাতেই আছে। সেরকম জায়গাতেই সিনেমা কিংবা মজুর ইউনিয়নগুলির পোস্টার মারা আছে। তা ছাড়া ভাগাড়ের কাছ ঘেঁষে, বিরাট ধাঙড় বস্তির এলাকাটায় শুয়োরে মানুষে ভিড় কম বাড়ায়নি। যদিও কাগজ কলের রাবিশের ডাঁই এবং গাছপালা বাঁশঝাড় সব মিলিয়ে, সদর রাস্তার তুলনায় কর্ড রোডকে নিরালাই বলা চলে।

মেথর ধাঙড় বস্তিটার পর রাস্তাটা আবার পশ্চিমে বাঁক নিয়ে সেই সদর সড়কে গিয়েই মিশেছে। বাঁক নেয়ার পর থেকেই, গোটা কয়েক রেল সাইডিং। একটি বড় পুকুর। যে পুকুরটা বস্তিবাসী মানুষ, মোষ ও ধোপাদের এক্তিয়ারে। যদিও একটি নোটিশবোর্ড পুকুরপাড়ে পোঁতা আছে এই বলে, এতদ্বারা সর্বসাধারণকে জানানো যাইতেছে, এই পুকুরে…ইত্যাদি।

পুকুরের পর থেকেই রাস্তাটা বেশ জনবহুল হয়ে উঠেছে। বস্তি এবং দোকানপাটের সংখ্যা অনেক বেশি।

যাই হোক। আমি যাচ্ছিলাম প্রায় বিকেল ঘেঁষে। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে কয়েক পশলা। তাতেও আকাশে খুব আশ্বাস নেই। পুবদিক থেকে গোটা কয়েক মেঘের বড় বড় চাংড়া উঁকি দিয়েই শুধু ক্ষান্ত নেই। থাবা বাড়িয়ে দিয়েছে পশ্চিমের ঈষৎ রক্তাভ বুক ঘেঁষে। কারখানার চিমনিগুলির মুখে। মুখে কালো ধোঁয়ার সঙ্গে কালো মেঘ মিশেছে কোথাও। বাতাসটাও ভেজা ভেজা আর ভারী। কিছুক্ষণ আগের বৃষ্টিতে পথঘাট এখনও ভেজা।

লোকটিকে আমি দেখতে পেলাম ধাঙড় বস্তি পেরিয়ে, পুকুর আর সাইডিং-এর মাঝামাঝি জায়গায়। জায়গাটা কাঁচা আর ভেজা বলে, আপাতত তার আসনের কাজ একটি বড় কচু পাতাতেই সারতে হয়েছে। তাকে ঘিরে জনকয়েক কচি ছেলেমেয়ে। দশ বারো বছরের ছেলেমেয়ে। শহরের সদরে অন্দরে যারা পোড়া কয়লা, কাগজ, লোহালক্কড়, কাঁচ কুড়িয়ে বেড়ায়, ছেলেমেয়েগুলি সেই দলের, দেখলেই চেনা যায়। তার কিছু কিছু চিহ্নও এরা বহন করছিল। দু-একজন বয়স্ক লোক যে না ছিল তা নয়। তারা খুব প্রসন্ন নয় ওই কচুপাতার আসনে অধিষ্ঠিত লোকটির ওপর, বোঝা যাচ্ছিল তাদের চোখমুখের ভাব দেখে।

যে লোকটিকে ঘিরে এই জটলা, তার কালো চেহারায় বয়স অনুমান করা কঠিন। চুলে যদিও পাক ধরেনি এবং গোঁফ জোড়া কালোই, কিন্তু এত ভাঁজ এবং রেখার ছড়াছড়ি, সহসা তাকে বয়স্ক বলেই। মনে হয়। ছেঁড়া জামাটায় সে কাঁচের বোতাম গলা অবধি বন্ধ রেখেছে। পরনের কাপড়টি অবশ্য উরুতের ওপরে উঠেছে। খালি পায়ের নখগুলিতে নরুণ ছোঁয়ানো হয়নি বোধহয় কয়েক যুগ। শুধু চুলগুলিই তার গলিত আলকার মতোই নিপাটে আঁচড়ানো।

মোটা ভ্রূর তলায় তার সুগভীর কোল বসা চোখ। সে চোখে একটি ধূর্ত-চকিত তীক্ষ্ণতা। যদিও তার শুকনো বিমর্ষ আর ক্লান্ত মুখের সঙ্গে দুটির কোনও মিল নেই। ধূর্ত চকিত চোখে সে সকলের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। মাঝে মাঝে, রাস্তার আশেপাশে লক্ষ করছে ত্রস্ত শেয়ালের মতো। উত্তেজনা অনুসন্ধিৎসাও রয়েছে তার চোখে। কিন্তু তার মুখ কামাই নেই। কেবলি বলে চলেছে, লাক টেস, লাক টেস। ভাতী কী খে বাবা, ভাতী কী খে। যা দেবে তার ডবল মিলবে। এক আনাতে দু আনা, দু আনাতে চার আনা, চার আনাতে আট আনা। কিসম! কিসম! দুনিয়া ঘুমতা, মেরা কাঁটা ভি ঘুমতা। শও সে খেলো বাবা! এখানে লাক্ টেস্ করো, দুনিয়ায় তোমার ভূতভবিষ্যৎ জানতে পারবে।

দেখলাম লোকটার সামনে গোলাকার কাঠের চাকি। সাদা রং, আর ঘড়ির মতো তার ধারে ধারে সমান মাপে, এক দুই তিন করে কুড়িটি দাগ দেওয়া ঘর। মাঝখানে ঘড়ির কাঁটার মতোই একটি কাঁটা। তার দুটি মুখ। কাঁটাটিকে ধরে লাট্টর মতো ঘুরিয়ে দিচ্ছে সে এক একবার, আর ওই কথাগুলি বলছে। কাঁটার চারপাশে গোল করে লেখা আছে, নাগা সিংকো দুনিয়া কি চাক্কি। তার সঙ্গে একটি অলৌকিককর আরোপ করা আছে ক্রশ চিহ্নের মতো মানুষের হাড় এঁকে।

একেবারে অপরিচিত নয় আমার কাছে ব্যাপারটা। নাগা সিং-এর দুনিয়ার চাকাটা একটি জুয়ার চাকা আসলে। ওই কুড়িটি ঘরের যে কোনও একটায় খেলোয়াড় পয়সা রাখতে পারে। তারপর কাঁটাটি ঘুরিয়ে দেওয়া হবে। কাঁটাটি ঘুরতে ঘুরতে যদি ঠিক পয়সা রাখার ঘরটায় এসে থামে, তবে ডবল পয়সা পাওয়া যাবে। অন্যথায়, দুনিয়ার চাকার মালিকের থাবায় গিয়ে উঠবে।

লোকটির নাম নাগাসিং, এটা বোঝা গেল। দাঁড়াবার যদিও প্রয়োজন ছিল না, তবু একটু কৌতূহল হল।

দেখালাম ছাইধুলো মাখা বাচ্চাগুলি বিক্ষুব্ধ হতাশায় নাগাসিং-এর দুনিয়ার চাকার কাঁটায় আর পরস্পরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, ইতিমধ্যে তারা কিছু হেরেছে। আর বিশেষ ভরসা পাচ্ছে না।

নাগা সিং আমার দিকে তাকাল সন্দিগ্ধ চোখে। আপাদমস্তক দেখল চোরা তীক্ষ্ণ চোখে। তারপর দূর রাস্তার দিকে। বুঝলাম, আমাকে সে সন্দেহ করছে পুলিশের লোক বলে। কারণ তার দুনিয়ার চাকার লাইসেন্স নেই নিশ্চয়। থাকলে সে এ শহরের এই পিছনে চলে আসত না। তাকাত না ওরকম করে।

আমার সম্পর্কে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে আবার সে বাচ্চাগুলির দিকে ফিরে তাকাল। তাদের হাতের দিকে, জামার পকেট এবং ট্যাঁকের দিকে শেয়ালের মত ধূর্ত তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে সে আবার বলে উঠল, চলে যাব, এবার চলে যাব। দুনিয়া ঘুরছে, মানুষ ঘুরছে। দুনিয়ার চাকায় হরবখত্ জুয়া চলছে। ক্রোর ক্রোর রূপায়া। এখানে দু চার পয়সা ফেকো, আপনা তকদির দেখে যাও। ভামতীকী-খেল, ঘোররে চাকা ঘোর, ঘোর রে কাঁটা ঘোর।

সামনেই যে ডোরাকাটা হলদে গেঞ্জি গায়ে ষণ্ডা মতো লোকটি দাঁড়িয়েছিল, সে বলল, কী রে শালা ভাগবি এ মহল্লা থেকে, না টান মেরে ফেলে দেব সব?

নাগা অমায়িকভাবে হাসল জোড় হাতে। তাতে আমি দেখলাম, তার সব কটি দাঁতও নেই। যদিও বুড়োদের মতো তার দাঁতগুলি ক্ষয়িষ্ণু মনে হল না। বলল, আর একটু হুজুর, আর একটুখানি।

আসলে বাচ্চাগুলিই নাগার শিকার। তাদের শেষ পয়সা কটি টেনে বার করতে পারাটাই তার আসল জুয়া। আর বাচ্চাগুলির কাছে দুনিয়ার চাকার কাঁটাটাই জুয়া।

শেষ পর্যন্ত একটা বছর দশেকের মেয়ে চাকায় পয়সা তুলে দিল। আমি নাগার হাতের দিকে লক্ষ করলাম। যদিও মোটেই বোঝবার উপায় নেই, কাঁটা ঘোরাবার মধ্যে তার কোনও চালাকি আছে।

মেয়েটি পয়সা দিয়েছিল বারো নম্বর ঘরে। কাঁটাটা ঘুরতে ঘুরতে দাঁড়াল পাঁচ নম্বরে। হেরে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে আর একটি ছেলে পয়সা বাড়িয়ে দিল। দেখাদেখি আরও দুজন। তিনজন তিন ঘরে। কাঁটাটির অবশ্য দুটি মুখ দুদিকে।

ষণ্ডা লোকটা বাচ্চাগুলির দিকে ফিরে রেগে বিরক্ত হয়ে বলল, শালা যত গর্দা এসে ভিড়েছে।

অর্থাৎ আবর্জনা এসে ভিড়েছে।

এবারও নাগা সিং-এরই জয়। বাচ্চাগুলি বোধ হয় নিঃশেষ হয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে, আমি পা বাড়ালাম। কিন্তু জীবনে সেই আমাকে প্রথম একটি খেয়ালে চেপে ধরল, খেলা যাক।

ফিরে দাঁড়ালাম। পকেটে সাত পয়সা আছে। আমাকে ফিরতে দেখেই সেই প্রকাণ্ড চেহারার লোকটা বিরক্তিতে বার কয়েক থু থু ফেললে। ভাবলে বোধ হয়, এবার একটা নতুন গর্দা।

নাগা সিং-এর গর্তে বসা চোখে সন্দেহের আলোছায়া। আমি দুটি পয়সা দিলাম চাকায়। বাচ্চারা ঘিরে এল নতুন উৎসাহে। তারা নিঃশেষ হলেও, না দেখে যেতে পারছে না।

পয়সা দিয়ে আমি বললাম, ঠিক করে ঘোরাও।

 নাগা ঠোঁট উলটে গোঁফ মুচড়ে বলল, দু পয়সার খেলা, তার আর ঠিক বেঠিক। ভিগ মাংগা হিন্দুস্থান, এই দেশে এর বেশি আর কী হবে।

কাঁটা ঘুরল। আজকের বিকেলে বোধ হয় এই প্রথম পরাজয় নাগার। আমি জিতলাম। নিজের পয়সা দুটি পকেটে রেখে, জেতা পয়সা দুটিই আবার রাখলাম।

কাঁটা ঘুরল, এবার নাগার জিত। নাগা সিং হা হা করে হেসে উঠে বলল, বড়ে জুয়া খেলনেবালা। দু পয়সা পেয়েছে, অমনি পকেটে ঢুকিয়েছে। আরে বাবা, ধোকে কি নিউ পর ইমারৎ নহি বনতে।

অর্থাৎ মিথ্যের ভিতে প্রাসাদ গড়া যায় না। তা তো বটেই। নাগা সিং-এর এ দুনিয়ার চাকাটা একটা খাঁটি সত্যের ভিত বটে।

তবু আমি পয়সা বার করলাম। বললাম, ঠিক মতো ঘোরাও।

–হুঁকুম করছ?

না খাঁটি কাজ করতে বলছি।

–আরে আমি নাগা সিং। নাগা সিং, সারা এলাকার লোক জানে। জোচ্চুরি করলে কবে আমাকে। লোকে ভাগিয়ে দিত। তোমার মতো ছিঁচকে পকেটমার নই আমি।

–পকেটমার?

তবে? তোমার ও পয়সা কি রোজগারের পয়সা নাকি? তোমার মুখ দেখে বুঝি না? কোনও বাচ্চা না হয় জেনানার আঁচল মেরে নিয়ে এসেছে।

কী করে বুঝলে?

–নইলে এত কম পয়সা কেন?

রাগারাগি বৃথা। কেন না, খুব সহজে নাগার বিশ্বাস আমি নষ্ট করতে পারব না। বললাম, আচ্ছা, তাই হল, এবার ঘোরাও কাঁটা। ঠিক মতো ঘোরাবে।

আবার ঠিক মতো? যা ঘোরাব, ঠিক ঘোরাব। কেন, ভগবান যখন কাঁটা ঘোরায় আসমানে বসে, তখন তাকে গিয়ে বলতে পার না, ঠিক মতো ঘোরাও। তার বলে নয়, যত চোখ রাঙানি, চাকাওলাকে।

কাঁটা ঘুরল। হেরে গেলাম।

এবার পুরো পাঁচ পয়সাই দিলাম। চা ধূমপানের আশা ছেড়েই। কাঁটাটা ঘুরতে ঘুরতে যেখানে এসে থামবে মনে করলাম, সেটা আমার পয়সার তিন ঘর বাদে। কিন্তু কাঁটাটা থামল না। বোধ হয় বাতাসেই আর একটা পাক খেল খুব ধীরে ধীরে যেন দম আটকে দেখলাম ভাগ্য আমারই সুপ্রসন্ন।

নাগা পাঁচটা পয়সা ছুঁড়ে দিল আমাকে। আমি পুরো দশ পয়সাই চাপালাম। নাগার ভ্র জোড়া ছুঁচলো হয়ে উঠল। বলল, হ্যাঁ? আচ্ছা! বুকের পাটা আছে দেখছি।

কিন্তু নাগা ঘুরে বসার তাল করছে। অর্থাৎ বাতাস আটকাতে চাইছে। সে একটু পুবদিকে ঘুরে বসল। আমি পয়সার ঘর বদলালাম।

নাগা আমার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হানল। আমি হাসলাম ঠোঁট টিপে।

উত্তেজিত বাচ্চাগুলি আমার চারপাশে। ষণ্ডা লোকটা এবার বলল, শালা রাস্তার গর্দা।

তা হতে পারি। কিন্তু নাগার সঙ্গে আখেরি খেলাটা খেলে যেতে হবে। এ খেলায় অন্য বুদ্ধির দরকার নেই। লোহার কাঁটাটার ওজন এবং আকৃতিটা বোঝা দরকার। আর ক্ষীণ বাতাসটুকুও কোনও কোনও সময় সহায় হতে পারে। তা ছাড়া চাকাটা যে মাটিতে বসানো আছে, তার সামান্য উঁচুনিচুটাও দৃষ্টি দিয়ে না মেপে নিলে চলে না। ও সবের ওপরেই হার-জিত নির্ভর করে।

কাঁটা ঘুরল। নাগা যেন বাতাস আটকাবার জন্যেই দু হাত ছড়িয়ে দিল অনেকখানি। কিন্তু বাতাস আটকাবার জন্যেই, এবারও নাগার ভাগ্য অপ্রসন্ন। আরও পাঁচ আনা তাকে হারতে হল। বাচ্চাগুলি চিৎকার করে উঠল উল্লাসে।

নাগা চিৎকার করে ওদের থামিয়ে দিল। আমি পয়সাগুলি তুলে নিলাম। পাঁচ আনা এসেছে আমার হাতে।

নাগা ঠোঁট উলটে বলল, ভাগবে এবার, না?

না।

বলে আমি পুরো পাঁচ আনাই চাপালাম আবার। এবার নাগাও বিস্মিত। সন্দেহে তার চোখগুলি ছোট হয়ে এল। একবার যেন দ্বিধা করল কাঁটা ঘোরাতে। কিন্তু না ঘুরিয়ে তার উপায় নেই। তাকে বাচ্চাগুলি ছাড়বে না।

প্রবল উত্তেজনার মধ্যে সহসা যেন সশব্দে হাউয়ের মতো জ্বলে উঠল বাচ্চাগুলি। নাগা আবার পরাজিত। যদিও সে চাকাটা ঘুরিয়ে ঠিক করে বসিয়ে নিয়েছিল।

দশ আনা। তখন নাগার চোখের সব আলো আমারই চোখে। পয়সাগুলি হাতে নিয়ে, আমার বুকেও একটু দূরলোভানির হাতছানির ইশারা শুনতে পেলাম। সাত পয়সা থেকে দশ আনা? আশ্চর্য রোজগার।

আমি চাকাটা ভাল করে লক্ষ করে, আবার দশ আনাই রাখলাম নাগা হাসল। দেখলাম কয়েকটি দাঁতহীন সেই হাসির ভাঁজে ভাঁজে আর তার অন্ধকার চোখে জেদের কোনও ছায়া নেই। বলল, কোথায় থাকা হয়?

বললাম, সে খোঁজে কী দরকার। কাঁটা ঘোরাও।

তবু?

 আমি এলাকার নাম বললাম।

–ও! কী করা হয়?

এ সব আত্মীয়তা আমার ভাল লাগছে না। বললাম, বেকার। কাঁটা ঘোরাও।

কিন্তু নাগা আর কাঁটা ঘোরায় না। আমার সঙ্গে বাচ্চাগুলিও চেঁচাতে লাগল, ঘোরাও, জলদি ঘোরাও। আজ হাতে পাওয়া গেছে।

আমি বাচ্চাগুলিকে বললাম, কে কত হেরেছিস?

একজনের তিন পয়সা, একজনের নপয়সা, আর দুজনের চার পয়সা করে। আমি বললাম, ঠিক আছে। তোদের পয়সা আমি ফিরিয়ে দেব, দাঁড়া। বাচ্চাগুলি এক মুহূর্তে অবাক হয়ে, ব্যাঙাচির মতো লাফাতে লাগল আনন্দে।

নাগা তখন নিজের ট্যাঁকের পয়সা গুনছে। ফুটো তামার আর হলদে পেতলের কতগুলি পয়সা। ঘামে আর ময়লায় বিবর্ণ কতগুলি নামমাত্র মূল্যের মুদ্রা। সেগুলি গুনতে লাগল নাগা। গুনে দেখল দশ আনা এক পয়সা তার আছে আর। হেরে গেলে, একটি পয়সা নিয়ে ফিরতে হবে তাকে। মস্ত বড় জুয়াড়ি বটে। মূলধন মেলা-ই।

নাগা আবার হাসল। খোশামোদের চেয়েও করুণ হাসি। বলল, কাল আসবে নাকি এদিকে?

-কেন?

–তা হলে কালকেই খেলো, আজ আর থাক।

আমার সঙ্গে বাচ্চারাও চেঁচিয়ে উঠল। আজ অনেক দিনের শোধ। কাঁটা আজ অন্যদিকে ঘুরছে। আজ কিছুতেই তাকে ছাড়া হবে না। দেখা গেল, এবার ষণ্ডা লোকটাও এগিয়ে এসেছে। সে আমাদেরই পক্ষ নিয়ে বলল, খবরদার জোচ্চোর, ও সব বলে পালাতে পারবিনে। যতক্ষণ পয়সা আছে, খেলতে হবে তোকে।

নাগা নিরুপায়। আমরাও ছাড়ব না। অগত্যা কাঁটা ঘোরাতে হল তাকে। লাট্টর মতো পাক খেতে খেতে কাঁটাটা যতই ধীর হয়ে আসছে, দেখলাম ততই নাগার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসছে প্রায়। একটি রুদ্ধশ্বাস নিস্তব্ধতা। নাগা তার কোমরের ট্যাঁকটা জোর করে ধরে আছে। যদিও কাঁপছে মুঠিটা।

আমিও দম বন্ধ করে ছিলাম। কাঁটাটা আস্তে আস্তে থামল। আমার পয়সার ঘর থেকে দুঘর পেরিয়ে।

দেখলাম, নাগার নিশ্বাসটা তবুও পড়ছে না। দুনিয়ার চাকাটার দিকে সে করুণ আর কৃতজ্ঞ হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। সে যেন কাঁদছে প্রায়।

আমরা হতাশ মুখে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। দেখলাম, বাচ্চাগুলি আমার দিকে ঠিক ভূতের মতো তাকিয়ে আছে। ওরা ভূত কি আমি ভূত, ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু ওদের দিকে তাকাতে সাহস হল না আমার আর। আমি উঠে পা বাড়ালাম।

শুনতে পেলাম সেই ষণ্ডা লোকটার গলা, শালা রাস্তার গর্দা।

নাগা সিং বলে উঠল, দুনিয়ার চাকা, দুনিয়ার চাকা, লাক টেস করো, লাক টেস৷

আবার কবে দেখা হবে হে?

আমি আর কোনও জবাব দিলাম না।

জুয়া

তখন আমি পুরোপুরি বেকার যে হিসেবে আমরা বেকার বলে থাকি আর শতকরা আশি ভাগ বাঙালি ছেলেকে।

যদিও শুনেছি, যে কাজ করে তাকে কোনও কারণেই বেকার বলা যায় না। কিন্তু বাংলায় একটি মুখের মতো বিশেষণ আছে তার। নিকামাইয়ের দরজি। যার মানে, কাজ আছে, কিন্তু রোজগার নেই।

রোজগার না থাকলেই বেকার। বনের মোষ তুমি যত খুশি তাড়াতে পার। অবশ্যই বনের মোষ তাড়াচ্ছিলাম না সেই স্বাধীনতা পাওয়ার পরের বছরগুলিতে। কিন্তু কাজ করতাম। তাতে পয়সার সঙ্গে কদাচিৎ দেখাসাক্ষাৎ হত। সেই দেখাসাক্ষাৎটা আরও মর্মান্তিক। লোকে বলে বটে, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। কানা মামা যাদের আছে, তারাই একমাত্র জানে, সেই অকর্মণ্য অন্ধ জীবটিকে নিয়ে। কী দুর্ভোগই ভাগ্নেদের ভুগতে হয়। তাকে নিয়ে না করা যায় ঘর। তাকে ঘরে রেখে না যাওয়া যায়। বাইরে।

কদাচিৎ পয়সার সঙ্গে সাক্ষাৎটা আমার সেই রকমের ভোগান্তি ছিল। কারণ, তা দিয়ে আমার ইজ্জত বাঁচত না। পেটের ক্ষুধা পেটেই থেকে যেত।

এরকম অবস্থায়, একদিন বিকেল ঘেঁষে এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছিলাম। বাস করে এক শিল্প এলাকায়। যেখানে যাব সেখানে কয়েক মাইলব্যাপী শিল্প এলাকার কারখানা, বস্তি বিস্তীর্ণ, তেলকালি ধুলি-ধূসর মানুষের ভিড় এবং আবর্জনা ছড়ানো অঞ্চলের পর, প্রায় পা ধুয়ে ওঠার মতো মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, নিরিবিলিতে থাকতে পারা মানুষের তল্লাট। সেটাও তল্লাটের মানুষের যোগ্যতারই প্রমাণ বোধ হয়। অপরাধ নয় নিশ্চয়।

প্রায় মাইল পাঁচেক পথ। বাসে যাওয়াই আমার পক্ষে সুবিধে ছিল। কিন্তু দশ পয়সার জায়গায় সাত পয়সা ছিল আমার সম্বল। অতএব, সদর ছেড়ে, শহরের পিছনের নির্জন কর্ড রোড ধরে হেঁটেই। চললাম।

নির্জন বলতে গাড়ি ঘোড়ার কথাই বলছি। জন অর্থাৎ মানুষ ঠিকই আছে সে পথের আশেপাশে। তবে কম। অনেক কম। স্বাভাবিক কারণ, শহরের পিছন দিক। তা ছাড়া জলাজংলা জমি পুবের সীমানায়। আর তারই ধার ঘেঁষে রেললাইন। মাঝে মাঝে কিছু বস্তি, মোষের খাটাল আর অবাঙালি বেকার শ্রমিকদের কিছু চাষবাস। কোথাও ভিড়ের একটু বাড়াবাড়িও আছে। শহরের সদর রাস্তার সঙ্গে যেখানে কর্ড রোডের সরাসরি যোগাযোগ হয়েছে, সেইসব মোড়গুলির কাছে ভিড় বেশি। ঘর দোকানপাট সেরকম জায়গাতেই আছে। সেরকম জায়গাতেই সিনেমা কিংবা মজুর ইউনিয়নগুলির পোস্টার মারা আছে। তা ছাড়া ভাগাড়ের কাছ ঘেঁষে, বিরাট ধাঙড় বস্তির এলাকাটায় শুয়োরে মানুষে ভিড় কম বাড়ায়নি। যদিও কাগজ কলের রাবিশের ডাঁই এবং গাছপালা বাঁশঝাড় সব মিলিয়ে, সদর রাস্তার তুলনায় কর্ড রোডকে নিরালাই বলা চলে।

মেথর ধাঙড় বস্তিটার পর রাস্তাটা আবার পশ্চিমে বাঁক নিয়ে সেই সদর সড়কে গিয়েই মিশেছে। বাঁক নেয়ার পর থেকেই, গোটা কয়েক রেল সাইডিং। একটি বড় পুকুর। যে পুকুরটা বস্তিবাসী মানুষ, মোষ ও ধোপাদের এক্তিয়ারে। যদিও একটি নোটিশবোর্ড পুকুরপাড়ে পোঁতা আছে এই বলে, এতদ্বারা সর্বসাধারণকে জানানো যাইতেছে, এই পুকুরে…ইত্যাদি।

পুকুরের পর থেকেই রাস্তাটা বেশ জনবহুল হয়ে উঠেছে। বস্তি এবং দোকানপাটের সংখ্যা অনেক বেশি।

যাই হোক। আমি যাচ্ছিলাম প্রায় বিকেল ঘেঁষে। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে কয়েক পশলা। তাতেও আকাশে খুব আশ্বাস নেই। পুবদিক থেকে গোটা কয়েক মেঘের বড় বড় চাংড়া উঁকি দিয়েই শুধু ক্ষান্ত নেই। থাবা বাড়িয়ে দিয়েছে পশ্চিমের ঈষৎ রক্তাভ বুক ঘেঁষে। কারখানার চিমনিগুলির মুখে। মুখে কালো ধোঁয়ার সঙ্গে কালো মেঘ মিশেছে কোথাও। বাতাসটাও ভেজা ভেজা আর ভারী। কিছুক্ষণ আগের বৃষ্টিতে পথঘাট এখনও ভেজা।

লোকটিকে আমি দেখতে পেলাম ধাঙড় বস্তি পেরিয়ে, পুকুর আর সাইডিং-এর মাঝামাঝি জায়গায়। জায়গাটা কাঁচা আর ভেজা বলে, আপাতত তার আসনের কাজ একটি বড় কচু পাতাতেই সারতে হয়েছে। তাকে ঘিরে জনকয়েক কচি ছেলেমেয়ে। দশ বারো বছরের ছেলেমেয়ে। শহরের সদরে অন্দরে যারা পোড়া কয়লা, কাগজ, লোহালক্কড়, কাঁচ কুড়িয়ে বেড়ায়, ছেলেমেয়েগুলি সেই দলের, দেখলেই চেনা যায়। তার কিছু কিছু চিহ্নও এরা বহন করছিল। দু-একজন বয়স্ক লোক যে না ছিল তা নয়। তারা খুব প্রসন্ন নয় ওই কচুপাতার আসনে অধিষ্ঠিত লোকটির ওপর, বোঝা যাচ্ছিল তাদের চোখমুখের ভাব দেখে।

যে লোকটিকে ঘিরে এই জটলা, তার কালো চেহারায় বয়স অনুমান করা কঠিন। চুলে যদিও পাক ধরেনি এবং গোঁফ জোড়া কালোই, কিন্তু এত ভাঁজ এবং রেখার ছড়াছড়ি, সহসা তাকে বয়স্ক বলেই। মনে হয়। ছেঁড়া জামাটায় সে কাঁচের বোতাম গলা অবধি বন্ধ রেখেছে। পরনের কাপড়টি অবশ্য উরুতের ওপরে উঠেছে। খালি পায়ের নখগুলিতে নরুণ ছোঁয়ানো হয়নি বোধহয় কয়েক যুগ। শুধু চুলগুলিই তার গলিত আলকার মতোই নিপাটে আঁচড়ানো।

মোটা ভ্রূর তলায় তার সুগভীর কোল বসা চোখ। সে চোখে একটি ধূর্ত-চকিত তীক্ষ্ণতা। যদিও তার শুকনো বিমর্ষ আর ক্লান্ত মুখের সঙ্গে দুটির কোনও মিল নেই। ধূর্ত চকিত চোখে সে সকলের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। মাঝে মাঝে, রাস্তার আশেপাশে লক্ষ করছে ত্রস্ত শেয়ালের মতো। উত্তেজনা অনুসন্ধিৎসাও রয়েছে তার চোখে। কিন্তু তার মুখ কামাই নেই। কেবলি বলে চলেছে, লাক টেস, লাক টেস। ভাতী কী খে বাবা, ভাতী কী খে। যা দেবে তার ডবল মিলবে। এক আনাতে দু আনা, দু আনাতে চার আনা, চার আনাতে আট আনা। কিসম! কিসম! দুনিয়া ঘুমতা, মেরা কাঁটা ভি ঘুমতা। শও সে খেলো বাবা! এখানে লাক্ টেস্ করো, দুনিয়ায় তোমার ভূতভবিষ্যৎ জানতে পারবে।

দেখলাম লোকটার সামনে গোলাকার কাঠের চাকি। সাদা রং, আর ঘড়ির মতো তার ধারে ধারে সমান মাপে, এক দুই তিন করে কুড়িটি দাগ দেওয়া ঘর। মাঝখানে ঘড়ির কাঁটার মতোই একটি কাঁটা। তার দুটি মুখ। কাঁটাটিকে ধরে লাট্টর মতো ঘুরিয়ে দিচ্ছে সে এক একবার, আর ওই কথাগুলি বলছে। কাঁটার চারপাশে গোল করে লেখা আছে, নাগা সিংকো দুনিয়া কি চাক্কি। তার সঙ্গে একটি অলৌকিককর আরোপ করা আছে ক্রশ চিহ্নের মতো মানুষের হাড় এঁকে।

একেবারে অপরিচিত নয় আমার কাছে ব্যাপারটা। নাগা সিং-এর দুনিয়ার চাকাটা একটি জুয়ার চাকা আসলে। ওই কুড়িটি ঘরের যে কোনও একটায় খেলোয়াড় পয়সা রাখতে পারে। তারপর কাঁটাটি ঘুরিয়ে দেওয়া হবে। কাঁটাটি ঘুরতে ঘুরতে যদি ঠিক পয়সা রাখার ঘরটায় এসে থামে, তবে ডবল পয়সা পাওয়া যাবে। অন্যথায়, দুনিয়ার চাকার মালিকের থাবায় গিয়ে উঠবে।

লোকটির নাম নাগাসিং, এটা বোঝা গেল। দাঁড়াবার যদিও প্রয়োজন ছিল না, তবু একটু কৌতূহল হল।

দেখালাম ছাইধুলো মাখা বাচ্চাগুলি বিক্ষুব্ধ হতাশায় নাগাসিং-এর দুনিয়ার চাকার কাঁটায় আর পরস্পরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, ইতিমধ্যে তারা কিছু হেরেছে। আর বিশেষ ভরসা পাচ্ছে না।

নাগা সিং আমার দিকে তাকাল সন্দিগ্ধ চোখে। আপাদমস্তক দেখল চোরা তীক্ষ্ণ চোখে। তারপর দূর রাস্তার দিকে। বুঝলাম, আমাকে সে সন্দেহ করছে পুলিশের লোক বলে। কারণ তার দুনিয়ার চাকার লাইসেন্স নেই নিশ্চয়। থাকলে সে এ শহরের এই পিছনে চলে আসত না। তাকাত না ওরকম করে।

আমার সম্পর্কে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে আবার সে বাচ্চাগুলির দিকে ফিরে তাকাল। তাদের হাতের দিকে, জামার পকেট এবং ট্যাঁকের দিকে শেয়ালের মত ধূর্ত তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে সে আবার বলে উঠল, চলে যাব, এবার চলে যাব। দুনিয়া ঘুরছে, মানুষ ঘুরছে। দুনিয়ার চাকায় হরবখত্ জুয়া চলছে। ক্রোর ক্রোর রূপায়া। এখানে দু চার পয়সা ফেকো, আপনা তকদির দেখে যাও। ভামতীকী-খেল, ঘোররে চাকা ঘোর, ঘোর রে কাঁটা ঘোর।

সামনেই যে ডোরাকাটা হলদে গেঞ্জি গায়ে ষণ্ডা মতো লোকটি দাঁড়িয়েছিল, সে বলল, কী রে শালা ভাগবি এ মহল্লা থেকে, না টান মেরে ফেলে দেব সব?

নাগা অমায়িকভাবে হাসল জোড় হাতে। তাতে আমি দেখলাম, তার সব কটি দাঁতও নেই। যদিও বুড়োদের মতো তার দাঁতগুলি ক্ষয়িষ্ণু মনে হল না। বলল, আর একটু হুজুর, আর একটুখানি।

আসলে বাচ্চাগুলিই নাগার শিকার। তাদের শেষ পয়সা কটি টেনে বার করতে পারাটাই তার আসল জুয়া। আর বাচ্চাগুলির কাছে দুনিয়ার চাকার কাঁটাটাই জুয়া।

শেষ পর্যন্ত একটা বছর দশেকের মেয়ে চাকায় পয়সা তুলে দিল। আমি নাগার হাতের দিকে লক্ষ করলাম। যদিও মোটেই বোঝবার উপায় নেই, কাঁটা ঘোরাবার মধ্যে তার কোনও চালাকি আছে।

মেয়েটি পয়সা দিয়েছিল বারো নম্বর ঘরে। কাঁটাটা ঘুরতে ঘুরতে দাঁড়াল পাঁচ নম্বরে। হেরে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে আর একটি ছেলে পয়সা বাড়িয়ে দিল। দেখাদেখি আরও দুজন। তিনজন তিন ঘরে। কাঁটাটির অবশ্য দুটি মুখ দুদিকে।

ষণ্ডা লোকটা বাচ্চাগুলির দিকে ফিরে রেগে বিরক্ত হয়ে বলল, শালা যত গর্দা এসে ভিড়েছে।

অর্থাৎ আবর্জনা এসে ভিড়েছে।

এবারও নাগা সিং-এরই জয়। বাচ্চাগুলি বোধ হয় নিঃশেষ হয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে, আমি পা বাড়ালাম। কিন্তু জীবনে সেই আমাকে প্রথম একটি খেয়ালে চেপে ধরল, খেলা যাক।

ফিরে দাঁড়ালাম। পকেটে সাত পয়সা আছে। আমাকে ফিরতে দেখেই সেই প্রকাণ্ড চেহারার লোকটা বিরক্তিতে বার কয়েক থু থু ফেললে। ভাবলে বোধ হয়, এবার একটা নতুন গর্দা।

নাগা সিং-এর গর্তে বসা চোখে সন্দেহের আলোছায়া। আমি দুটি পয়সা দিলাম চাকায়। বাচ্চারা ঘিরে এল নতুন উৎসাহে। তারা নিঃশেষ হলেও, না দেখে যেতে পারছে না।

পয়সা দিয়ে আমি বললাম, ঠিক করে ঘোরাও।

 নাগা ঠোঁট উলটে গোঁফ মুচড়ে বলল, দু পয়সার খেলা, তার আর ঠিক বেঠিক। ভিগ মাংগা হিন্দুস্থান, এই দেশে এর বেশি আর কী হবে।

কাঁটা ঘুরল। আজকের বিকেলে বোধ হয় এই প্রথম পরাজয় নাগার। আমি জিতলাম। নিজের পয়সা দুটি পকেটে রেখে, জেতা পয়সা দুটিই আবার রাখলাম।

কাঁটা ঘুরল, এবার নাগার জিত। নাগা সিং হা হা করে হেসে উঠে বলল, বড়ে জুয়া খেলনেবালা। দু পয়সা পেয়েছে, অমনি পকেটে ঢুকিয়েছে। আরে বাবা, ধোকে কি নিউ পর ইমারৎ নহি বনতে।

অর্থাৎ মিথ্যের ভিতে প্রাসাদ গড়া যায় না। তা তো বটেই। নাগা সিং-এর এ দুনিয়ার চাকাটা একটা খাঁটি সত্যের ভিত বটে।

তবু আমি পয়সা বার করলাম। বললাম, ঠিক মতো ঘোরাও।

–হুঁকুম করছ?

না খাঁটি কাজ করতে বলছি।

–আরে আমি নাগা সিং। নাগা সিং, সারা এলাকার লোক জানে। জোচ্চুরি করলে কবে আমাকে। লোকে ভাগিয়ে দিত। তোমার মতো ছিঁচকে পকেটমার নই আমি।

–পকেটমার?

তবে? তোমার ও পয়সা কি রোজগারের পয়সা নাকি? তোমার মুখ দেখে বুঝি না? কোনও বাচ্চা না হয় জেনানার আঁচল মেরে নিয়ে এসেছে।

কী করে বুঝলে?

–নইলে এত কম পয়সা কেন?

রাগারাগি বৃথা। কেন না, খুব সহজে নাগার বিশ্বাস আমি নষ্ট করতে পারব না। বললাম, আচ্ছা, তাই হল, এবার ঘোরাও কাঁটা। ঠিক মতো ঘোরাবে।

আবার ঠিক মতো? যা ঘোরাব, ঠিক ঘোরাব। কেন, ভগবান যখন কাঁটা ঘোরায় আসমানে বসে, তখন তাকে গিয়ে বলতে পার না, ঠিক মতো ঘোরাও। তার বলে নয়, যত চোখ রাঙানি, চাকাওলাকে।

কাঁটা ঘুরল। হেরে গেলাম।

এবার পুরো পাঁচ পয়সাই দিলাম। চা ধূমপানের আশা ছেড়েই। কাঁটাটা ঘুরতে ঘুরতে যেখানে এসে থামবে মনে করলাম, সেটা আমার পয়সার তিন ঘর বাদে। কিন্তু কাঁটাটা থামল না। বোধ হয় বাতাসেই আর একটা পাক খেল খুব ধীরে ধীরে যেন দম আটকে দেখলাম ভাগ্য আমারই সুপ্রসন্ন।

নাগা পাঁচটা পয়সা ছুঁড়ে দিল আমাকে। আমি পুরো দশ পয়সাই চাপালাম। নাগার ভ্র জোড়া ছুঁচলো হয়ে উঠল। বলল, হ্যাঁ? আচ্ছা! বুকের পাটা আছে দেখছি।

কিন্তু নাগা ঘুরে বসার তাল করছে। অর্থাৎ বাতাস আটকাতে চাইছে। সে একটু পুবদিকে ঘুরে বসল। আমি পয়সার ঘর বদলালাম।

নাগা আমার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হানল। আমি হাসলাম ঠোঁট টিপে।

উত্তেজিত বাচ্চাগুলি আমার চারপাশে। ষণ্ডা লোকটা এবার বলল, শালা রাস্তার গর্দা।

তা হতে পারি। কিন্তু নাগার সঙ্গে আখেরি খেলাটা খেলে যেতে হবে। এ খেলায় অন্য বুদ্ধির দরকার নেই। লোহার কাঁটাটার ওজন এবং আকৃতিটা বোঝা দরকার। আর ক্ষীণ বাতাসটুকুও কোনও কোনও সময় সহায় হতে পারে। তা ছাড়া চাকাটা যে মাটিতে বসানো আছে, তার সামান্য উঁচুনিচুটাও দৃষ্টি দিয়ে না মেপে নিলে চলে না। ও সবের ওপরেই হার-জিত নির্ভর করে।

কাঁটা ঘুরল। নাগা যেন বাতাস আটকাবার জন্যেই দু হাত ছড়িয়ে দিল অনেকখানি। কিন্তু বাতাস আটকাবার জন্যেই, এবারও নাগার ভাগ্য অপ্রসন্ন। আরও পাঁচ আনা তাকে হারতে হল। বাচ্চাগুলি চিৎকার করে উঠল উল্লাসে।

নাগা চিৎকার করে ওদের থামিয়ে দিল। আমি পয়সাগুলি তুলে নিলাম। পাঁচ আনা এসেছে আমার হাতে।

নাগা ঠোঁট উলটে বলল, ভাগবে এবার, না?

না।

বলে আমি পুরো পাঁচ আনাই চাপালাম আবার। এবার নাগাও বিস্মিত। সন্দেহে তার চোখগুলি ছোট হয়ে এল। একবার যেন দ্বিধা করল কাঁটা ঘোরাতে। কিন্তু না ঘুরিয়ে তার উপায় নেই। তাকে বাচ্চাগুলি ছাড়বে না।

প্রবল উত্তেজনার মধ্যে সহসা যেন সশব্দে হাউয়ের মতো জ্বলে উঠল বাচ্চাগুলি। নাগা আবার পরাজিত। যদিও সে চাকাটা ঘুরিয়ে ঠিক করে বসিয়ে নিয়েছিল।

দশ আনা। তখন নাগার চোখের সব আলো আমারই চোখে। পয়সাগুলি হাতে নিয়ে, আমার বুকেও একটু দূরলোভানির হাতছানির ইশারা শুনতে পেলাম। সাত পয়সা থেকে দশ আনা? আশ্চর্য রোজগার।

আমি চাকাটা ভাল করে লক্ষ করে, আবার দশ আনাই রাখলাম নাগা হাসল। দেখলাম কয়েকটি দাঁতহীন সেই হাসির ভাঁজে ভাঁজে আর তার অন্ধকার চোখে জেদের কোনও ছায়া নেই। বলল, কোথায় থাকা হয়?

বললাম, সে খোঁজে কী দরকার। কাঁটা ঘোরাও।

তবু?

 আমি এলাকার নাম বললাম।

–ও! কী করা হয়?

এ সব আত্মীয়তা আমার ভাল লাগছে না। বললাম, বেকার। কাঁটা ঘোরাও।

কিন্তু নাগা আর কাঁটা ঘোরায় না। আমার সঙ্গে বাচ্চাগুলিও চেঁচাতে লাগল, ঘোরাও, জলদি ঘোরাও। আজ হাতে পাওয়া গেছে।

আমি বাচ্চাগুলিকে বললাম, কে কত হেরেছিস?

একজনের তিন পয়সা, একজনের নপয়সা, আর দুজনের চার পয়সা করে। আমি বললাম, ঠিক আছে। তোদের পয়সা আমি ফিরিয়ে দেব, দাঁড়া। বাচ্চাগুলি এক মুহূর্তে অবাক হয়ে, ব্যাঙাচির মতো লাফাতে লাগল আনন্দে।

নাগা তখন নিজের ট্যাঁকের পয়সা গুনছে। ফুটো তামার আর হলদে পেতলের কতগুলি পয়সা। ঘামে আর ময়লায় বিবর্ণ কতগুলি নামমাত্র মূল্যের মুদ্রা। সেগুলি গুনতে লাগল নাগা। গুনে দেখল দশ আনা এক পয়সা তার আছে আর। হেরে গেলে, একটি পয়সা নিয়ে ফিরতে হবে তাকে। মস্ত বড় জুয়াড়ি বটে। মূলধন মেলা-ই।

নাগা আবার হাসল। খোশামোদের চেয়েও করুণ হাসি। বলল, কাল আসবে নাকি এদিকে?

-কেন?

–তা হলে কালকেই খেলো, আজ আর থাক।

আমার সঙ্গে বাচ্চারাও চেঁচিয়ে উঠল। আজ অনেক দিনের শোধ। কাঁটা আজ অন্যদিকে ঘুরছে। আজ কিছুতেই তাকে ছাড়া হবে না। দেখা গেল, এবার ষণ্ডা লোকটাও এগিয়ে এসেছে। সে আমাদেরই পক্ষ নিয়ে বলল, খবরদার জোচ্চোর, ও সব বলে পালাতে পারবিনে। যতক্ষণ পয়সা আছে, খেলতে হবে তোকে।

নাগা নিরুপায়। আমরাও ছাড়ব না। অগত্যা কাঁটা ঘোরাতে হল তাকে। লাট্টর মতো পাক খেতে খেতে কাঁটাটা যতই ধীর হয়ে আসছে, দেখলাম ততই নাগার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসছে প্রায়। একটি রুদ্ধশ্বাস নিস্তব্ধতা। নাগা তার কোমরের ট্যাঁকটা জোর করে ধরে আছে। যদিও কাঁপছে মুঠিটা।

আমিও দম বন্ধ করে ছিলাম। কাঁটাটা আস্তে আস্তে থামল। আমার পয়সার ঘর থেকে দুঘর পেরিয়ে।

দেখলাম, নাগার নিশ্বাসটা তবুও পড়ছে না। দুনিয়ার চাকাটার দিকে সে করুণ আর কৃতজ্ঞ হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। সে যেন কাঁদছে প্রায়।

আমরা হতাশ মুখে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। দেখলাম, বাচ্চাগুলি আমার দিকে ঠিক ভূতের মতো তাকিয়ে আছে। ওরা ভূত কি আমি ভূত, ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু ওদের দিকে তাকাতে সাহস হল না আমার আর। আমি উঠে পা বাড়ালাম।

শুনতে পেলাম সেই ষণ্ডা লোকটার গলা, শালা রাস্তার গর্দা।

নাগা সিং বলে উঠল, দুনিয়ার চাকা, দুনিয়ার চাকা, লাক টেস করো, লাক টেস৷

আবার কবে দেখা হবে হে?

আমি আর কোনও জবাব দিলাম না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *