জুনু আপা

জুনু আপা 

অতি সংক্ষিপ্ত পত্র। 

—তোদের সাথে বোধ হয় আর দেখা হবে না। একবার ছুটী পেলে দেখা দিয়ে যাস। 

এনভেলাপের ভেতর টুকরো কাগজের উপর মাত্র কয়েকটা কথার আঁচড়। নীচে নাম-সই আছে—তোর জুনু আপা। 

সারাদিন স্কুলের পর বিকালে একটু অবসর থাকে। সন্ধ্যার পর আবার টিউসানী আরম্ভ হয়! নূতন মাষ্টারী পেয়ে এই জায়গাটা বেশ লেগেছিল। গাঁয়ে লোকজন আছে। আলাপ-বিনিময়ের মানুষও পাই। তার উপর আছে প্রকৃতির অকৃপণ ঐশ্বর্য্য। 

অবাক হলাম, জুনু আপা আমার ঠিকানা জানে কি? পাঁচ বছর তার সাথে সব বাঁধন ছিঁড়ে গেছে। বিয়ের আগেও সে আমাদের বাড়ীতে ছিল। তারপর সাত বছর, পাঁচ বছর আমার সঙ্গে দেখা নেই। 

পুরানো দিনের নানা কথা উঁকি মারে। 

বাড়ীর কোন লোক আজ জুনু আপার নাম করে না। ঘরের দেওয়ালে রেশমী সুতায় সিল্কের কাপড়ের উপর লেখা ছিল, জনুরা খাতুন। একদিন মা ফ্রেম-করা নামটা পর্য্যন্ত পুড়িয়ে দিলেন। সেদিন জুনু আপার নাম আমার কানেও গরম সীসা ঢেলে দিত! অথচ আমাদের কত আপন সে। বয়সে বারো বছরের ব্যবধান। তাই ভয় করতাম তাকে। সব-সময় নয়। না-হোলে আমাদের এমন আপা দুষ্প্রাপ্য ছিল। জুনু আপার মা ছিলেন দূর-সম্পর্কীয় খালা। ছোট-বেলায় মা-মরা, তাই আমাদের বাড়ীতেই মানুষ। দূরাত্মীয় তা-কে বলা চলে না। সে ব্যবধান পার হোয়ে আরো নিকটতর সহোদরা-রূপে আমরা জুনু আপাকে পেয়েছিলাম। 

ছেলে-বেলায় আমাদের অ অ আ ক খ শেখানোর ভার ছিল তার উপর। ধমক দিত না সে কাউকে, কিন্তু এমন চালে কথা বলত, আমরা ভয়ে চুপ বসে থাকতাম। আবার হাসির পালা শুরু হোলো, কেউ পাল্লা দিতে পারত না জুনু-আপার সঙ্গে। শুধু হাসি নয়, পরিবেশ-রচনার কৌশলও ছিল তার অপরূপ। 

একদিন পড়ায় মন ছিল না। ইতর… ইষৎ—বলে-বলে মুখ দিয়ে ফেনা উঠে গেছে। শেষে জুনু আপা বলে, বানান করো, “অচল”। 

—জুনু আপা—। একটু ভয়ার্ত্তস্বরে ডাকি 

কি, আমার মাথা? 

পরে আবার সে বলে, বানান করো “অচল”। 

পৃথিবীর চলৎ-শক্তি তখন থেমে গেছে, আমার ঠোঁট ত দূরের কথা। গুম্ করে একটা কিল পড়ল পিঠের উপর। সারাদিন পড়ায় মন ছিল না। শাস্তি এত দেরীতে আসে? 

চোখ দিয়ে ছাই পানিও বেরোয় না। কারণ আমরা জানি, আমাদের চোখে পানি দেখলে জুনু আপার নরম হোতে আর বেশী বিলম্ব হয় না। তখন হিমালয় পাহাড় গলে বরফ হোতে থাকে। গুম্ হোয়ে বসে রইলাম। নিঝুম পাগলা, চুপ-শয়তান, বোবা-ঢেঁকি, আরো এই জাতীয় খেতাবে জুনু আপা আমাদের মহারাজাধিরাজের মর্য্যাদা দিতে কসুর করেনি। আজ গোঁ ধরে বসে রইলাম। সব অচল। বানান চালাতে চেষ্টা করেও অচল হোয়ে পড়েছি। 

জুনু আপা ঘর ছেড়ে চলে গেল। ভয় আরো বাড়ে। কারণ লক্ষণটা আজ ভাল নয়। সাঁঝ পহর। বেগতিক দেখে দৌড়ে পালানোও বিপদ। জুনু আপা বোধ হয় আব্বার কাছে নালিশে গেল! কচি হাড় আর মাস থেঁতলে ছাড়বেন তিনি। 

দশ মিনিট গেল। জুনু আপা নিরুদ্দেশ। আব্বা বোধ হয়, বেহেস্তে গেছেন। এতক্ষণেও কেউ এলো না। চটি জুতার পটপট আওয়াজ শোনা গেল। 

—আস্‌সালামো আলায়কুম। 

আমরা চোখ ছানা-বড়া করে চেয়ে দেখলাম। একি! এমন সময় বৈঠকখানার ভেতর পীর-সাহেব নাজেল হোলেন কোথা থেকে! মাথায় পাগড়ী, গায়ে আচকান, পরনে শাদা তহবন। 

আমাদের মুখে জবাব আসে না। কুঁচো ছেলে পাঁচজন চুপ হোয়ে বসে আছি। 

পীর সাহেব মোটা গম্ভীর কণ্ঠে কোরানের আয়াৎ পড়েন। তারপর মোনাজাতের সময় তিনি বলেন, হাত জোড় করো। পড়ো, আল্লাহুম্মা আমীন। 

মোনাজাতের সময় আল্লাহুম্মা আমিন পড়ছি। মোনাজাত খতমের জন্য আমরা দুই হাত মুখ আর চোখের উপর তুলেছি। মোনাজাত খতম হোলো। চেয়ে দেখি, পীর সাহেব নেই। কেউ কোথাও নেই। 

ভয়ে আমরা চীৎকার করে উঠলাম। জ্বীন—জ্বীন—। মা, আরো অনেকে ছুটে গেলেন। জ্বীনের গল্প বহু শুনেছি মার কাছ থেকে। ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। সে দিন সন্ধ্যায় জুনু আপা আমাদের একটা জ্বীনের গল্প বলেছিলেন। এক ভদ্রলোক রাত্রে সস্ত্রীক মাঠে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। পথে সে দেখে একটা কালো কুকুর তার স্ত্রীর দিকে তৃষার্ত্ত-নয়নে চেয়ে আছে। স্ত্রীকে সে বলে, “কুকুরটা তোমার দিকে এমন চেয়ে আছে—যেন আমিই চেয়ে আছি।” স্ত্রী হেসে বলেছিল, “তোমাদের মত কুকুরেরা মেয়েদের দিকে তাকায় না। ফেঁতি কুকুরের দিকে চেয়ে দেখে।” স্বামী চটে গিয়ে বলে, “এই কুত্তা চেয়ে আছিস কেন, নিয়ে যা।” অতঃপর ঝড় উঠল। লোকটা দেখল, একদল কুকুর তার স্ত্রীকে পিঠে করে তেপান্তরের দিকে ছুটে চলেছে। তারপর স্ত্রী-উদ্ধারের সে আর-এক কাহিনী। জ্বীনের বাদশা কুকুর সেজে, কখন-কখন অন্য জানোয়ারের বেশে ঘুরে বেড়ায়। 

মা আমাদের বুকের কাছে নিয়ে বল্লেন, ভয় পেয়ো না, ওরা বাতাসে মিলিয়ে যায় কিনা। 

তারপর খাওয়ার পালা। রান্না-ঘরে গিয়ে আমরা অবাক। পীর সাহেব এক দিকে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। আবার আমরা কাঁপতে থাকি। 

মা বলে, ভয় নেই। দ্যাখোতো বাবা পীর সাহেব, আমার ছেলের ইলেম আছে না কি?

পীর সাহেব দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে, বি এ পাশ করবে। খুব সুন্দরী বউ হবে তোমার।

আচ্ছা, বাবা পীর সাহেব, আমার ছেলের গায়ে একটু দোয়াফুঁক পড়ে দাও। 

পীর সাহেবের কাছে আমরা কেউ যেতে রাজী নই। মা ছাড়বে না। তার আচকানের পাশে ভয়ে ভয়ে বসে থাকি। একটু পরে এলো ছোট সালাউদ্দীন। আমার চাচাত ভাই, সে-ও সঙ্গে ছিল। সে ভয় পায় না সহজে। পীর সাহেবের কাছে বসে সে বলে, পীর সাহেব তোমার দাড়ীটা একবার দেখি। বলার সঙ্গে সঙ্গে সে হাত দিয়েছে। দাড়ী খসে পড়লো। আমরা তখন হো হো শব্দে চীৎকার করে উঠেছি—ওরে জুনু আপা। 

মা, চাচি আরো বাড়ীর মেয়েরা খাবার ঘরে হাজির হোলো। এত হাসি। পেটে খিল ধরার উপক্রম। 

মার জন্য বুকে কত রকমের ভয় সেঁধিয়েছিল, জুনু আপা তা মুছে দিতেন। সে-দিন সারা রাত্রি তার পাশে শুয়ে আমার ঘুম আছিল না। মুখ টিপে-টিপে শুধু হাসছিলাম। 

সলিম, ঘুমো। হাসলে আমি আবার রাগ করব। 

মার চেয়ে জুনু আপাকে আরো বেশী ভালো লাগে। তার তিরস্কার র্ভৎসনা কেউ আমরা গায়ে মাখিনি কোন দিন। 

আরো কতো না দিনের স্মৃতি। 

মা কি আব্বা মারধোর করলে সান্ত্বনার আশ্রয় ছিল জুনু আপা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তার বুকের কাছে বহু-রাত্রি ঘুমিয়ে পড়েছি। আমাদের ছোট ভাই-বোনের জন্য তার মমতার সীমা ছিল না। একটু বড় হোলে অন্যান্য ভাই-বোনেরা মার কাছ ছাড়া হোত। জুনু আপার নৈকট্য এত মধুর। তার মুখখানা ছিল গোল–গাল। চোখ দুটো ডাগর, কানের দিকে ভুরুর সাথে টানা। উজ্জ্বল গৌর-তনু। আমাদের স্মৃতির সাথে জড়িত স্বপ্নের মত তার মুখ-খানা মনে হয়। সাত বছর আগে প্রদীপের ম্লান আলোয় অশ্রু—ভারাক্রান্ত, শেষ বারের মত দেখা 

বহুদিন পরে তার আকস্মিক আহ্বান। চিঠির সমতল থেকে চোখ ফেরাতে কষ্ট হোলো। জুনু আপা তার ঠিকানা একপাশে লিখে দিয়েছে। আমাদের সঙ্গে তার আত্মীয়তার বন্ধন কেটে গেলেও, মায়া—মমতার নিগড় তেমনি অটুট আছে। কয়েকটা অক্ষরের আঁচড়, শৃঙ্খলের বজ্র-সূত্র যেন। 

সারা অবেলার আকাশ সমষ্টি বিষণ্ণতায় আমার চোখে ধরা দিল। একদা-উধাও জুনু আপা আমার খবর রাখে! সংসারে তার নাম করা পর্যন্ত বিশেষ অপরাধ। বহু সন্ধ্যায় নানা অনুসঙ্গে আপার কথা ভেসে উঠেছে, তবু চুপ করে থাকতে হোয়েছে। সবাই বাবার শাসনের ভয় রাখে। অথচ কতটুকু তার অপরাধ? শিশু বয়সে অপরাধ ওজনের কোন মানদণ্ড ছিল না, আজও সারল্যের প্রতিচ্ছবি-রূপে আপাকে মনে পড়ে। কতটুকু তার অপরাধ?—

আমাদের বাড়ী সংলগ্ন একটা উঠান ছিল। তার সংলগ্ন কলা-বনে ঘেরা বাস্তু। এইটা ছিল ঢেঁকি—চালা। ধান, আটা কোটার জন্য ব্যবহৃত হোত। চার দিকেই পাট-কাঠির বেড়া, উপরে খড়ের চাল। মাঝখানে ঢেঁকি। দুপুর বেলা জুনু আপাকে ফাঁকি দিয়ে এখানে আমরা লুকোচুরি খেলতাম। বেশ লাগে জায়গাটা। খেলার জন্য নিরাপদ। কারণ মুরব্বীরা কেউ মেয়ে-মহলের এদিকে পা বাড়ায় না। সন্ধ্যায় কলাবনে বাদুড় এসে বসত। কলা-বাদুড়েরা ভারী পাজি। কলা পাকার আগেই বাদুড়ের নখের আঁচড়ে কলার কাঁদি ভরে যেত। আমরা তাই ছোট ইট ঢেলা নিয়ে বহু সন্ধ্যায় ওঁৎ পেতে থাক্তাম। একপাশে লুকিয়ে তখন বাদুড়ের উপর ঢেলা-চালা বেশ সহজ। বাদুড় অবশ্য কোন দিন আমার ঢেলায় মরেনি। তবে উড়ে পালাত। প্রথমে দেখতাম বাদুড় উড়ে এসে ঝুপ-শব্দে কাঁদির উপর বসল। ঝুলে-ঝুলে নখ বাড়িয়ে কাঁদির উপর বিচরণের দক্ষতা অদ্ভুত বাদুড়ের। বাদামী-ধূসর রঙ, তার উপর কাল নিরীহ চোখ মেলে বাদুড়গুলো আবার অকারণে ঝুলে। খুব কাঁচা কলার কাঁদির উপর বেশীক্ষণ থাকা এদের পোষায় না। অনেক সময় তাই বাদুড় মারার চেয়ে বাদুড়ের ঝুলন-লীলা দেখে আনন্দের সীমা থাকত না। কিন্তু বেশীক্ষণ ধৈর্য্যও থাকত না। হঠাৎ ঢেলা ছুঁড়তাম এলোপাতাড়ি। কলা পাতার উপর দুড়দাড় শব্দ উঠত। পাড়ার নিচে থমকে-থাকা গোধূলির অন্ধকারে বালক বয়সের সেই নেশা। একদিন এমনি নেশায় কাউকে কিছু না বলে একাই এসেছি ঢেঁকি-চালার কাছে। হঠাৎ চোখ পড়ল ঢেঁকির উপর। সাঁঝ হোতে বেশী বাকী নেই। কলাপাতার জাল ছিঁড়ে সূর্য্যাস্তের আলো শুধু ভীরু নম্রতায় পৃথিবীর ফাঁক ভরে আছে। ঢেঁকির উপর একদিকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জুনু আপা। গোধূলির আবছা আলোয় চেনা গেল না, আর একজন কে তার সম্মুখে দাঁড়িয়েছিল। অকস্মাৎ আলিঙ্গনে-বাঁধা জুনু আপার মুখ চুম্বনে চুম্বনে সে ছেয়ে দিল। তার কাঁধে হেলিয়ে পড়েছে কালো চুলের অরণ্য-ভরা জুনু আপার মাথা। ভয়ে কেমন যেন মিইয়ে গিয়েছিলাম সে-দিন। বালক বয়সে এই দৃশ্যের কোন হদিস ছিল না আমার কাছে। তবু বহুদিন আমার চোখে ভেসে উঠত গোধূলির অন্ধকারে প্রাণবিনিময়ের এই ছবি। অর্থ-হীনতায় তার রহস্য গভীর দাগ রেখে গেছে আমার পাঁজরের পরতে পরতে আজও। হঠাৎ আমি ডেকেছিলাম, জুনু আপা। কে ছিল জুনু আপার সম্মুখে? আজ সে আমার অপরিচিত নয়। সেদিন জুনু আপা হঠাৎ একাকী পরিত্যক্ত অবস্থায় চোখের পানি মুছে আমার দিকে চেয়েছিলো।—কিরে সন্ধ্যায় এদিকে কি করতে এলি? আমি জবাব দিয়েছিলাম, কিন্তু সহজে নয়। অসহজ আবহাওয়ায় জুনু আপা স্বাভাবিক হোতে পারেনি আমাকে সে বলেছিলো, তোকে একটা বাদুড় ধরে দোব কাল। আমার আনন্দের অবধি ছিল না। কিন্তু জুনু আপার চোখের দিকে চেয়ে আমার উৎসাহ নিভে গেল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে কাঁদছে। অনেকক্ষণ পরে অন্ধকারে তারই সাথে বাড়ী ফিরেছিলাম। ওলট-পালট আরম্ভ হয় আমার মনের চারিদিকে। ঘুণাক্ষরে কিন্তু আমার কোন কথা কেউ জানত না। রহস্যের গোলক ধাঁধায় বহুদিন ঘুরেছি। যৌবনের সরস-বসন্তে শুধু জুনু আপার সে-দিনের অশ্রুর ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছিলাম। 

তারপর কয়েকদিন আপার মুখে উজ্জ্বল হাসি ছিল না। ডাগর চোখের কোণে বিষণ্ণতা জমাট বেঁধেছিল। সুঠাম শরীরে তার গম্ভীর মূর্ত্তি মনে হোত, যেন কাজল পয়স্বিনী-ভরা শ্রাবণের আকাশ—শুধু অশ্রু-বর্ষণের প্রতীক্ষায় রয়েছে। 

শীতের দিনে তার কাছটা ছিল আমাদের আসর। লেপ সরে যেত কারো গা থেকে, কারো বুক থেকে, সব খবরদারী ছিল তার নখাগ্রে। সেই কয়েকদিন তার কাছে শুয়ে জমত না কিছুই। জুনু আপা আর বেশী কথা বলে না। রূপ-কথা কেউ শোনে না তার মুখ থেকে। দীর্ঘ-নিঃশ্বাস ফেলে একদিন ঘুমানোর আগে সে বলেছিল : লক্ষ্মী ভাইটী, তোরা বড় হোলে দুনিয়ার অনেক অবিচার দূর করতে শিখিস। আমাকে বুকের কাছে টেনে কচি মুখে চুমু খেয়েছিলেন তারপর। 

তার দীর্ঘশ্বাসের বার্তা হয়ত বুকে আর ঢেউ তোলে না। 

তার চুমুর ভিজে দাগ, আমার গণ্ডদেশে আজও যেন আঁকা রয়েছে। 

.

জুনু আপার বিয়ের দিন আমি বাড়ী ছিলাম না। স্কাউট-ছেলেদের সঙ্গে অনেক দূর বন-ভোজনে বেরিয়েছিলাম। 

বিয়ের দু’মাস আগেকার কথা, আমার আবছা মনে পড়ে। জুনু আপা আজকাল বড় গম্ভীর। আর আমাদের পড়ার ভার তার উপর নেই। উপর ক্লাসে উঠেছি বছর বছর। বিদ্যার তরল পারদে আমরা সবাই অতি-মসৃণ শরীর, তাই জুনু আপার হাত থেকে ধীরে ধীরে পিছলে পড়ছি। তারও কোন খেয়াল নেই আমাদের দিকে। জুনু আপার বিয়ে নিয়ে আব্বার সঙ্গে মার একটা কথা হোয়েছিল। আব্বা জুনু আপাকে ভালবাসতেন, আমরা যেমন বাস্তাম। আরো জুনু আপার উপর ভালোবাসা ছিল একজনের। তার রূপ স্বতন্ত্র। আমাদের বড় চাচাতো ভাই জসিম। তিনি কলেজে পড়তেন। একান্নবর্তী পরিবার নয় আমাদের। সম্পত্তি বহুদিন আগেই ভাগ হোয়ে গিয়েছিল। মার সঙ্গে জসিমের মা বড় চাচির আদৌ বনি–বনা ছিল না। হিংসুটে অবহেলায় দু’জন পরস্পর-কে চেয়ে দেখত। এমন ক্ষেত্রে মার কাছ থেকে কোন প্রস্তাব চাচির কাছে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। নচেৎ বাবা মনে একটা গোপন আশা পোষণ করেছিলেন। জুনু আপা চির দিনের মত বধূ-রূপে তাদের বাড়ীতে থাকতে পারে। জসিম কোন আপত্তি করবে না। 

সেদিন দুপুরে টিফিনের সময় বাবার ঘরের পাশ দিয়ে গুড়ি মেরে দহলিজের পথে চলেছি। মার খখনে গলার আওয়াজ শোনা গেল। কৌতূহলী বালকের মত একবার থমকে দাঁড়ালাম। 

মার গলা ফেটে পড়ছে : তোমার জন্যই এত হেনস্থা (হীনতা) স্বীকার। আমার লাভটা কী হোলো?

বাবা মৃদুকণ্ঠেই বলছেন : কেন? জসিমের মা যদি কথা না শোনে, অপমানিত হোয়েছ, স্বীকার করছি। তার জন্য গোটা গাঁ-য়ে ঢিঢি করতে হবে? 

—না হবে না। আমার মা-মরা বোনঝি। তার উপর দরদ আমার নেই, তোমার আছে? আগেই বলেছিলাম জসিমের মা রাজী হবে না। তার কলেজে পড়ুয়া ছেলে। সোনা-দানা আবে ঘরে, অনাথ মেয়েকে গলায় ঘণ্টার মত ঝুলিয়ে কী তার লাভ আছে? 

—চেঁচিয়ো না, ও-সব আমার ভাল লাগে না। 

—তা তোমার ভাল লাগবে কেন? বড়-জা। তাই তেরো বছর বয়সে কনে সেজে এসেছিলাম, কেঁচো হোয়ে আছি আজ পৰ্য্যন্ত। ও-সব আমি সহ্য করব না। 

—সহ্য করবে না ত যা-ইচ্ছে তাই করো। 

বাবার মেজাজ এবার কড়া। কান পেতে শুনলাম, তার কণ্ঠস্বর আর স্বাভাবিক নয়। 

—আমার কপালে এই ছিল সারা জীবন। আমার নিজের বড় ছেলে যদি বেঁচে থাকত, তা হোলে এত তোষামুদী—

শেষের দিকে মায়ের গলা ভারী হোয়ে এসেছিল। মৃত পুত্রের উদ্দেশ্যে তিনি কান্না শুরু করেছেন। সেদিন আমি কৌতূহল নিবৃত্ত করতে বাধ্য হোয়েছিলাম। বাবা যদি হঠাৎ বাইরে আসেন, রক্ষা থাকবে না। 

কয়েক দিন ধরে বাড়ীর আবহাওয়া থমথম করছে। যে কোন মুহূর্তে ঝড় উঠতে পারে। আব্বা—মার কোন কথা হয় না। বিস্বাদিত পরিবেশে আমাদেরও ভাল লাগে না। জুনু আপা অন্য গৃহ-কোণ আলোকিত করার উদ্দেশ্যে নূতন পাড়ি দিবে একাকিণী। ইস্কুল, লেখা-পড়া, খেলাধুলার মধ্যে আর বোধ হয় কোন আনন্দ থাকবে না। কিশোর মনে নালিশ ছিল অনেকের বিরুদ্ধে, সাহস ছিল না। জুনু আপার খোঁজ সব-সময় পাওয়া যায় না। আমাদের উপর তার কর্তত্ব চলে গেছে। আমরাও তাই দূরে সরে গেছি। 

সন্ধ্যায় পড়ার ঘরে আমি একা। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ হোলো। সম্মুখে জুনু আপা! তার মুখের দিকে চাওয়া যায় না। কালো ছায়া পড়েছে গম্ভীর মুখের উপর। তবু ভারী সুন্দর মনে হয় জুনু আপাকে। আমার সম্মুখে চেয়ারে বসলেন তিনি। 

—সেলিম, পড়া-শুনা করছ? 

চেতনা যেন উটের মত ঝড়ো-নিঃশ্বাসের গন্ধ পায়। অন্য দিন এই প্রশ্নে আলাপ শুরু হোত না।

—হ্যাঁ, জুনু আপা। 

বইয়ের খোলা পাতার দিকে আমার চোখ নেই। অলক্ষিতে বুবুর দিকে চোখ ফেরাই। বিষণ্ণ—গম্ভীর, ধীর একটি প্রতিমূর্ত্তি আমার সম্মুখে উপবিষ্ট। 

—কি দরকার, বুবু? 

—কিছু নয়। কিছু নয়। তার অস্পষ্ট শব্দ আমার কানে। জুনু আপা চেয়ার থেকে উঠে পড়েছে। আমি কিছু বলার আগেই, তার ছায়া বন্ধনোন্মুখ দরজার উপর দেখা গেল। 

জুনু আপা চলে গেল। 

সাংসারিকতার দাগ নির্ম্মর্ম তীরের মত চেতনায় রুধির সাক্ষর রেখে যায়। কিশোর হোলেও পৃথিবীর অনেক কিছুর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে। চুপচাপ পড়ার ঘরে একা বসে রইলাম। জানালার ফাঁক দিয়ে হ্যারিকেনের আলো বাইরে ঠিকরে পড়ছে। আমার পড়ার ঘরের পাশে ছিল একটা ঝাকড়া কলম-পেয়ারার গাছ। তার ছায়ায় বহুদূর অন্ধকার। আলোয় শুধু গুঁড়িটা দেখা যায় পেয়ারা গাছের। তারপর প্রতিবেশীদের পর্দ্দাশ্রয়ী তাল-পাতার বেড়া। সেদিক ঘন অন্ধকার। কোন পতঙ্গ আজ ডাক ছড়ায় না অন্ধকারে। পাতার অরণ্যে বুনো হাওয়ার মির্ম্মির শব্দ হয় শুধু। 

দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলাম। জুনু আপা আবার এসেছেন। খালি চেয়ার পূর্ণ হল নিমেষে। জুনু আপার দিকে চাওয়ার সাহস হয় না আমার। 

—সলিম।

—জী, আপা। 

—এদিকে চেয়ে দ্যাখ। 

ভয়ে ভয়ে আপার দিকে চোখ মেলে ধরি। 

—একটা কাজ করবি? 

তার স্বর অশ্রু-ভারাক্রান্ত। রাঙা নাক, গণ্ডদেশ যেন কেঁপে কেঁপে উঠছিল। হয়ত এখনি কান্না শুরু করবেন। সংক্রামক যে জুনু আপার অশ্রু। কিশোর মনে কৌতূহলের প্রবৃত্তি যে ছিল না, তা নয়; কিন্তু জুনু আপার সম্মুখে তার দুঃখই বড়ো হোয়ে ধরা দিয়েছিল আমার কাছে। 

—পারব, বুবু। 

—আমার মা ভাই-বোন কেউ ছিল না! তোরাই আমার সব। তোকে সব চেয়ে বিশ্বাস করি। ব্যাপারটা ভাল করে উপলব্ধির বয়স ছিল না তখন। জুনু আপার বলবার ভঙ্গী আর কণ্ঠস্বর আমার সমগ্র কারুণ্য স্রোতায়িত করেছিল সেদিন। 

—পারব, বুবু। আমাকে বলো। 

আপা একটা ইনভেলাপ বের করেছিল তার ব্লাউজের ভিতর থেকে। নীল রঙ্গের সাধারণ খাম।

—এ-টা তোর বড় ভাইকে দিয়ে আসবি লুকিয়ে। 

কোন দিন জসিম ভাইকে নামে ডাকত না জুনু আপা। টেবিলে মাথা গুঁজে সে শুয়ে পড়ল। আমার সঙ্গে যেন আর বলার কোন কথা নেই। 

দহলিজের এক কোণে ঘড়িটা টিটীক করছে। দুরুদুরু বুকে দুয়ারের বাইরে গেলাম। শুধু জুনু আপার জন্য। প্রহর-রাত্রেই আমার ভারী ভয় লাগে। সে দিন শুধু বাবার ভয় ছিল। নচেৎ এতটুকু শঙ্কার আঁচড় ছিল না মনে 

একই আঙিনার একটেরে বড়-চাচিদের বাড়ী। জসিম ভাইয়ের পড়ার ঘর, শোয়ার ঘর এক। ধীরে সন্তর্পণে অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়েছি। অন্ধকার আঙিনায় এই টেরে যাওয়ার প্রয়োজন কী—কারো সাথে দেখা হোলে হয়ত আর যাওয়া ঘটবে না। পরনের কালো হাফ-প্যান্ট আমাকে সেদিন সাহায্য করেছিল।

জসিম ভাইয়ের ঘরের পাশেও আবার থমকে দাঁড়াতে হোলো। তার ঘরে কে যেন বক্তৃতা করছে। উৎকর্ণ হোয়ে শুনলাম। বড় চাচি—হ্যাঁ, বড় চাচিরই গলা। 

—না, তা হোতে দেব না। অমন হা-ঘরের মেয়ে আমার বৌ হোয়ে আসুক, তা আমি চাই না। ওদের জাত-পাতের খবর জানিস? আমার একটা ছেলে। মা-বাপ-খোয়া মেয়ে আমার দরকার নেই।

ভাইয়ের মৃদুকণ্ঠের কোন কথাই শোনা গেল না। বড় চাচি আবার বলছেন : শহরে থেকে তোদের এই রুচি? এই পাড়াগেঁয়ে মেয়ে পছন্দ! আজ চোখের নেশায় সব ভাল লাগছে। দু-দিন বাদ বাদুড়—চোষা কলার মত নৰ্দ্দমায় ফেলে দিবি। 

সময়ের পদক্ষেপ আমার বুকে স্পন্দিত হয়। বেশীক্ষণ দেরী করা আমার সাজে না। তবু জুনু আপার জন্য-। আবার শোনা গেল : বেশ, যদি আমার কথা না মানিস, বউ নিয়ে একা সংসারে থাক্। আমার যেদিকে চোখ যাবে, বেরিয়ে যাব। 

আমি একটা চারা লিচু গাছের তলায় ঘুপ্‌টী মেরে দাঁড়িয়ে। এক ঘণ্টা কেটে গেলো। জসিম ভাইয়ের ঘরে যাওয়ার সাহস পাই না। দজ্জালের মত বড় চাচি খাড়া রয়েছেন ভেতরে। 

দু’ঘণ্টা পরে চিঠি হাতে ফিরে এলাম। জুনু আপা তেমনি শুয়ে আছেন। টেবিলের উপর তার মুখ গোঁজা। শুধু একরাশ চুল এলোমেলো, উপর থেকে দেখা যায়। 

ধীরে ডাকলাম, জুনু আপা। 

কোন জবাব আসে না। নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায় তার। বড় বিপন্ন, বড় পরিশ্রান্ত, বেচারী! বোধ হয়, ঘুমিয়ে পড়েছে। আবার কেউ পড়ার ঘরে এসে পড়তে পারে। 

—জুনু আপা। 

টেবিলের উপর থেকে মুখ তুলে তিনি আমার দিকে তাকালেন। ঘুম-ক্লান্ত তার মুখ যেন কত অপরিচিত! চূর্ণ-কুন্তলে গালের এক পাশ ঢেকে গেছে। দুই চোখ সূর্য্যের আলো-লাগা পদ্ম-কুঁড়ির মতো এইমাত্র উন্মীলিত। চেনা যায় না আমাদের জুনু আপাকে। ব্যাকুলতার তীব্রতায় কি যেন বলার আশ্বাসে তার ঠোঁট কাঁপলো মাত্র একবার। 

—জুনু আপা! 

সামান্য কৈফিয়তের পর অপরাধীর মত মাথা হেঁট করে চিঠি তাকে ফিরিয়ে দিলাম। 

অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল জুনু আপা স্থানু প্রতিমার মত। ব্লাউজের ভেতর চিঠি পুরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি তার পেছনে। আঙিনার একপাশে হাসনু হেনার গাছ। জুনু আপার নিজের লাগানো। তীব্র গন্ধে বুক ভরে যায়। জুনু আপার বুক কি ভরে উঠে না? 

আঙিনার ফালি অন্ধকার পার হোয়ে ঘরের দাওয়ায় পা দিতে হয়। আপার সঙ্গে কথা-বলার সুযোগ থাকে না। ভয়ে ভয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে : আপা, তোমার কাছে থাকতে দেবে না? 

—না। 

একটু পরে আবার জুনু আপা বলে : আমার জন্যে তোর কষ্ট হয়? 

—হয় না বুঝি। 

খামাখা জবাব। জুনু আপার দুঃখের সঙ্গে আমার কোন পরিচয় ছিল না। শুধু তার বাইরের অবয়ব মন মুষড়ে দিয়েছিল, উবে গিয়েছিল কৌতূহলের নেশা। 

সেই রাত্রি আমারও সহজে ঘুম আসে না। জানালার ধারে আপা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে নিশুত রাত। চাঁদ ছিল আকাশে। ঠাণ্ডা নৈশ হাওয়ার অলস সঞ্চরণে বুনো ফুলের গন্ধ জড়িয়ে থাকে। তবু সব-কিছু মুমূর্ষু রোগীর মত আত্মীয়দের মুখে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে দিয়ে যায়। 

একটু ঘুমোও না, বুবু 

জুনু আপা আমার পাশে বসে বলে, তুই ঘুমো। কাল ইস্কুল আছে, আমার ঘুম আসে না।

—কেন, আপা? 

হৃদ্যতার সাড়া পায় জুনু আপা আমার কণ্ঠে। 

—বড় হোলে তুই বুঝবি। আজ কিছুই বুঝবি না। 

দীর্ঘ নিশ্বাস অন্ধকারে গুঞ্জরিত। হল্কা শিখার কাছে বাতাস ছুটে যায়। মানুষের বুকের আগুনের কাছে দীর্ঘ-শ্বাসের হাওয়া সান্ত্বনার প্রলেপ টানে। জুনু আপা-কে মমতা-সিক্ত করার যেন কেউ নেই। আর দীর্ঘশ্বাসও শোনা যায় না। 

ভোর বেলা জেগে উঠেছি। বাইরের আকাশে সবে মাত্র আলোর শিহরণ জাগছে। জুনু-আপার বুক ঘেঁষে শুয়েছিলাম। সে উঠে দাঁড়িয়ে আছে জানালার কাছে। আঁচলটা মেঝের উপর লুটিয়ে পড়েছে। আপা চেয়ে আছে, বোধ হয় আকাশের দিকে; হয়ত বনের পাতার ক্রোড়-লগ্ন তরল অন্ধকারের দিকে। 

সন্ধ্যার ইতিবৃত্ত হঠাৎ আমার মনে পড়ে। জুনু আপা শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। 

—জুনু আপা। 

—কিরে এত সকালে উঠে পড়েছিস আজ। আর একটু ঘুমো না, লক্ষ্মী। স্নিগ্ধ কণ্ঠ জুনু আপার। ঝড় যেন কেটে গেছে। পৃথিবীতে আবার শান্ত দিন ফিরে এসেছে। 

—জন আপা! 

আমার সন্দেহ কাটে না, তাই আবার ডাকি! 

সে আমার কাছে এসে বসে। বলে : কিরে, কি বল না? কোন জবাব আসে না মুখে। একটু থেমে বলি, তোমার শরীর আজ ভাল, জুনু আপা? 

—আমার শরীর খুব ভাল। এখন বেশ ভাল আছি। আমার নরম চুলে জুনু আপা আঙুল ফেরায়।

—আমার শরীর ভাল নয়, তুই জানিস? 

—তোমাকে দেখে বোঝা যায়। 

জুনু আপা হঠাৎ চুপ করে থাকে। 

‘না, কিছু কষ্ট নেই’। তার কণ্ঠ আবার ভারী হোয়ে আসে। ঝর্ণা-স্রোতের মত সহস্র তরঙ্গ-ভঙ্গে আলো ঠিকরে পড়ছে কামরায়। পুবের দিকে চোখ ফেরাই। নিদ্রিত নৈশ পৃথিবী আবার জেগে উঠেছে। 

জুনু আপা চেয়ে আছে লালিমা-আলোকিত দূর মাঠের দিকে। চোখ তার ঘুম জানে না। 

সকালে শুনলাম, জসিম ভাই ভোরের ট্রেণে সদরে চলে গেছে। দুপুর বেলা আবার জুনু আপার সাথে দেখা হোলো। তার চোখ-মুখে বিষণ্নতার কোন ছায়া নেই। আমার সঙ্গে হাসির গল্প করলে সে অনেক্ষণ। তার মধ্যে অন্যান্য অকৃত্রিমতা আজ নিখোঁজ—আমার মত কচি-বয়সের কিশোরও তা বুঝতে পারে। 

রান্না ঘরে মার নানা সাহায্য করতে দেখলাম জুনু আপাকে। আমারও মন হাল্কা হোয়ে আসে। কেবলমাত্র স্নেহের তাগিদেই জুনু আপার অভাব-অভিযোগের দিকে এত চোখ পড়ে বেশী। না-হোলে, সেদিন কতটুকু বোধ-শক্তি ছিল আমার। 

তার কয়েকদিন পরে জুনু আপার বিয়ে হোয়ে গেল। স্কাউট সঙ্গীদের জুলুম আমাকে ঘর-ছাড়া করেছিল। 

.

এক বছর ঘুরে গেছে। সন্ধ্যায় পড়ার ঘরে বসে আছি। সড়কের উপর ঘোড়ার গাড়ী যেন দরজার সোজাসুজি এসে থামল; একটু উৎকর্ণ হোয়েছি। কড়া-নাড়া শোনা গেল। 

তাড়াতাড়ি দরজা খুলে অবাক হোলাম। জুনু আপা! জুনু আপা আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। আব্বা একটা নীল ওড়না কিনে দিয়েছিলেন তাকে। ওড়না পরা, চটুল-চোখ, হাসি-মুখ জুনু আপা। তার শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা আমাদের সঙ্গে আর কোন আত্মীয়তা রাখবে না, আগে জানিয়ে দিয়েছিল। তাই অবাক হোতে হয়। 

—এই লক্ষ্মী, যা, আমার ট্রাঙ্ক আছে গাড়ীতে, নিয়ে আয়। আদেশ পালনে এগিয়ে যাই। সম্রাজ্ঞীর মত ঝল্‌মল-বনা গৰ্ব্বস্ফীত পদক্ষেপে জুনু আপা অন্দরে ঢুকে পড়েছে ততক্ষণ। 

নেশা লাগে সারা সন্ধ্যা। এক বছরে মানুষের মনের বহু হদিস শিখেছি। জুনু আপাকে তাই অদ্ভুত লাগে। 

পরদিন বাড়ীর আবহাওয়া আবার থমথমে। মার কাছে শুনলাম, জুনু আপা শ্বশুর বাড়ী থেকে পালিয়ে এসেছেন। তালাক নিয়ে পালিয়ে আসা! সে নিজেই নাকি জোর করে তালাক নিয়েছে। 

মা-আব্বা কেউ ভাল চোখে দেখে না জুনু আপাকে। তবু তার মুখে বিষাদের কোন ছায়া ফেরে না। 

মার কাছে জুনু আপা বলেছে : মানুষের সঙ্গে তোমরা আমার বিয়ে দাওনি। অমানুষ, দুশ্চরিত্রের সঙ্গে আমি সংসার বাঁধতে পারি না। তোমাদের ফাই ফরমাস খেটে, এক মুঠো ভাত কি আমার জুটবে না? 

গোলক ধাঁধার মত সংসারের বিচিত্র পটক্ষেপ! কিশোর মনে নানা রহস্য জাগায়। 

এক বছর পরে আবার নাটক অভিনীত হোতে থাকে আমাদের সংসার ঘিরে। ঢেঁকি-চালার আলো—অন্ধকারে বাদুড়-শীকারের লোভ বোধ হয় কোনদিন আর জাগবে না। আর একবার দেখেছিলাম, ছায়া—ঘন অন্ধকারে জুনু আপা দাঁড়িয়ে আছেন। তারই সম্মুখে জসিম ভাই। আজ কৌতূহলের নেশাটাই বড়। আড়চোখে চেয়েছিলাম দুই জনের দিকে। সেদিন কেন জানি না খুব হাসি পেয়েছিল। মানুষের ঠোঁটে এত মধু সঞ্চিত থাকে! 

কয়েকদিন পর সকালে হঠাৎ আকাশ থেকে পড়লাম যেন। জুনু আপা আমাদের বাড়ী ছেড়ে চলে গেছে। তার সূচনা আব্বা-আম্মার ভর্ৎসনা-বিকৃত কণ্ঠেই দেখেছিলাম। জুনু আপার জন্য দুঃখ। বাড়ী—ছাড়ার প্রয়োজন ছিল, জানি। কিন্তু এত স্বার্থপর সে। আমাদের দিকে চাওয়ার কোন প্রয়োজন তার ছিল না? সঙ্গীদের মুখে অনেক কটু-ইঙ্গিত শুনে আমার অভিজ্ঞতার সীমানা বহুদূরে প্রসারিত হোয়েছিল। জুনু আপা নাম, আমার কানেও সেদিন গরম সীসা ঢেলে দিত। বাড়ীর তে-সীমানায় তার নাম কেউ মুখে আন্ত না। 

.

এই তোমার নূতন বাড়ী, জুনু আপা? 

চারিদিকে চোখ মেলে চাই। ভিটার উপর উঠতে পৈঠা অতিক্রম করতে হয়। দূর্ব্বা ঘাসে ঢাকা। মাথার উপর হুমড়ি খাওয়া ছোট ছোট গাছ। সাপের ভয় পদে পদে। কয়েক পা এগিয়ে এসে ভাঙা দেউড়ীর ফটক পেয়েছিলাম। এদিকের থাম ভাঙা; তার উপর হাজার জংলা লতার গাছ। আর একদিকের অবস্থা সেইরূপ। শুধু দুটো থাম। উপরে তোরণের কোন চিহ্ন নেই। পথই পথ চেনায়। একটু অগ্রসর হোয়ে দেখেছিলাম, একটা ছোট কোঠা বাড়ী। জীর্ণ, পুরাতন; ক্ষয়ের প্রত্যেকটী উপসর্গ করুণ হোয়ে ফুটেছে। দোতালা বাড়ীটা। নীচে চাতালের আশেপাশে জঙলা দুটো লোহার খুঁটির মাঝখানে একটা বাঁশের বেড়া। ফটকও সেটা। জুনু আপার নাম ধরে ডাকা মাত্র সে বেরিয়ে এসেছিল। 

বেড়ার ওপারে তার অভিনন্দনের হাসি বিদ্যুতের মত খেলে যায়। 

—এসো, ভাই। 

—এই তোমার বাড়ী? এ-তো জঙ্গল। 

বাড়ীর কম্পাউণ্ড একদিন প্রশস্ত ছিল। চারিদিকে আরো ঘরের চিহ্ন রয়েছে। এখন অরণ্যের দিশা জাগে শুধু। চতুর্পার্শ্বে বাঁশবন ও নানা রকমের গাছ। মাঝে মাঝে সৌখিন ফুলের গাছও দেখা গেল। ঝুম্‌কো-লতার ফুল ফুটেছে একটা গাছ ভরে। 

ফটকের বেড়া খোলার আগে জুনু আপা বলে, আমার চিঠি পেয়েছিলি? 

জবাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জুনু আপার দিকে আমি চেয়ে থাকি। প্রৌঢ়ত্বের ছাপ পড়েনি এখনও দেহে, তবে উঁকি দিতে শুরু করেছে। তার হাসি আমার চোখে এড়ায়নি। হাসার সময় মনে হয়, একজন অষ্টাদশী তরুণীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। নিটোল জুনু আপার স্বাস্থ্য। তবে তার শরীর আরো বেড়েছে। নাতি-দীর্ঘতার জন্য বেশী স্বাস্থ্য-পুষ্ট মনে হয় জুনু আপাকে। 

ফটক খুলে সে বলে, জঙ্গলে এসেছো। দুদিন রাজা হোয়ে থেকে যাও। 

আবার হাসি। সেই পুরানো দিনের ঝঙ্কার জাগে। 

—আমি কি শেয়াল? বলতে-বলতে তার সঙ্গে ঘরের দাওয়ায় ঢুকে পড়ি। পূর্বদিকে দাওয়ার রেলিং ছিল। তার ভগ্নাবশেষের সঙ্গে বাখারী জুড়ে দেওয়া হোয়েছে। কি একটা অচেনা লতার নীল-পাতা দেখা যায় ফাঁক দিয়ে। 

দুয়ার খোলা ছিল। জুনু আপা বলে, সাবধান। এখানটা অন্ধকার। দরজার সামনে ঢালু জায়গা। ঠিক করে পা ফেলিস। ঘরটা বসে গেছে কি না। 

বোঝা গেল, বসুমতী কোন এক ভূমিকম্পের দমকে ইটের দেওয়াল অনেকখানি গ্রাস করেছে। ঘরটী সুপ্রশস্ত। কিন্তু কেবল ধ্বংসের নিঃশ্বাস চারিদিকে। একটা শাল কাঠের বীম অনেকখানি ঝুলে পড়েছে। ভূমিকম্পের আর এক দমকে হয়ত বসুমতী কিছু গ্রাস করবে, হয়ত বাসিন্দারাও রক্ষা পাবে না। ওই ঘরটার এক কোণে চৌকি ফেলা। মাদুর বিছানো তার উপর। একদিকে মাচায় হাঁড়িকুড়ি তৈজস-পত্র। উত্তরের জানালা খোলা। সেদিকে বেশি আলো আসে না। পূর্বদিকের জানালা থেকে আলো আসে, তবে খুব স্পষ্ট নয়। মেঝের উপর সিমেন্ট আছে বলে বিশ্বাস করা যায় না। 

একটা পিদিমে আলো জ্বেলে জুনু আপা বলে, তুই একটু বস। উপরটা ঠিক করে আসি, তোকে নিয়ে যাব। 

একা-একা চুপচাপ বসে-থাকা। চোখ কৌতূহলী নেশা মেটায়। উত্তরের জানালার সম্মুখে উবু হোয়ে বসে বাইরের দিকে চেয়ে থাকি। বাঁশবন আর পুরানো দেউড়ীর ভগ্নাবশেষ শুধু ইতঃবিক্ষিপ্ত। পুবদিকে খানিক ফাঁকা জায়গা পড়ে রয়েছে। লতা-লাউয়ের গাছ একটা চোখে পড়ল। সূৰ্য্যমুখী লঙ্কা ফুটেছে আলোর দিকে পা বাড়িয়ে। মাথা গাছের অরণ্যে ডুবিয়ে দিয়েছে। একটা সরু পথ পাশে—বোধ হয় ঘাটে পৌঁছবার পথ। আশে-পাশে ধূলিসাৎ ঘরের মাটী অথবা পাকাবাড়ীর ইট। ভিটের সন্নিকটে কোন প্রতিবেশীর বাড়ীও বোধ হয় নেই। চৌকির উপর বসে-বসে প্রেতায়িত মনে হয় নিজকে। যেন কোন প্রেত-প্রেতিনীর উপনিবেশে হাজির হোয়েছি। 

জুনু আপা নেমে এসে বলে, আয় উপরে আয়। একটা মাত্র কামরা দোতলায়। ভূমিসাৎ দেউড়িরই একটী অংশ। কালের উপসর্গ ইটের পাঁজরে দেখা যায়। তবু পরিপাটী-সাজানো কামরা। একটা পুরাতন পালং পড়ে আছে এক কোনে। পাশে ভাঙা টেবিল। টেবিলের উপর কাচের ‘জাম’ গেলাস প্রাচীন বনেদী মুসলমানের পরিচয় বহন করছে। আরো বই-পত্র, কয়েকটা কাচের তসবিহ টেবিলের উপর ছড়ানো। 

—জুনু আপা। তুমি খুব নামাজ পড় বুঝি? ছ’টা তসবিহ এখানে। মৃদু কণ্ঠের জবাব আসে : ওর। আমার একটা হোলেই চলে। উনি আসর-মগরিব-ফজর ওয়াক্ত হিসেবে এক একটা রঙের তসবিহ ব্যবহার করেন। 

—উনি কোথায় গেছেন? 

ম্রিয়মান জুনু আপা বলে : তুমি আসবে জানে। তাই বাজার করতে গেছে। 

ঘরের ভেতর দিয়ে উপরে যাওয়ার সিঁড়ি। এত ফাটলে ভরা! তাই জিজ্ঞেস করলাম, জুনু আপা রাত্রে উপরে উঠতে ভয় হয় না? 

—না, ভাই। আমার গা-সওয়া হয়ে গেছে। 

মুখ নীচু করে জুনু-আপা। আবার বলতে থাকে : আমি জানতাম, তুই খবর দিলে আসবি। আর কেউ আসবে না। তুই চিরদিন আমার লক্ষ্মী-ভাই ছিলি। 

জুনু বিবি, জুনু বিবি। হঠাৎ ডাক শোনা গেল। 

মাথায় কাপড় টেনে আপা বলে, বোস। উনি এসেছেন, নীচে দুয়ার খুলে দিয়ে আসি। 

একটু পরে উপরে উঠে এলো জুনু-আপা। তার পেছনে আর একজন প্রৌঢ় মানুষ। মুখে সাদা দাড়ি, পরনে সাদা তহবন। উজ্জ্বল শ্যাম–কৃষ্ণ রং। মুখটা সজীব মনে হয় তবু। 

—আস্‌সালাম আলায়কুম। 

—আলায়কুম আস্‌সালাম। 

—জুনু বিবি। এই তোমার ভাই। সেই দূর-সম্পৰ্কীয় শালা। দুশালা? 

গ্রাম্য-রসিকতার সঙ্গে পরিচয় নেই। অসোয়াস্তি লাগে। আপা মুখে কাপড় দিয়ে হাসে। আমিও শেষে হাসি চেপে রাখতে পারি না। 

—শহরে থাকো, ভাই। গরীবদের কুঁড়ে ঘরে এসেছ। হাজার শুকুরিয়া। 

—খাবার তৈরি করো। ভাই সাহেবত রোজা রাখেন নি। আপা নীচে নেমে গেল। 

আধ-ঘণ্টার আলাপে আপন হোয়ে গেলাম। মালেক সাহেবকে যে কোন লোকের ভাল লাগবে। দীল-খোলা মানুষ। বংশের অধঃপতনের কাহিনী সবিস্তারে বলে গেলেন। পঞ্চাশের উপর বয়স। আপার কাছে তাকে বেমানান দেখায়। তবু মনে কোথায় খটকা লাগে না। 

একবার নীচে নেমে গেলেন মালেক সাহেব। ঘরের ছোট বারান্দা আছে উত্তর দিকে। কাঠের পাটাতন। রেলিং নেই। পড়বার ভয় ছিল, তবু বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিজন অরণ্য মনে হয় গ্রাম। আশে-পাশে কোন বস্তি নেই। মাঠের পর মাঠ, বক্ষ-জোড়া ক্ষুদ্র বন-সহ, ধূ ধূ করছে। 

নির্ব্বাসিতের জীবন জুনু-আপার। এই জানালায় দাঁড়িয়ে জুনু আপা হয়ত কত চোখের পানী ফেলে। কেউ সাক্ষী থাকে না তার। বন্ধ্যা, ধূসর মরু-জীবন। অথচ এই জীবনে কত কিছু না বিকাশের সম্ভাবনা ছিল। প্রাণদায়িনী সঙ্গিনী, পুত্র-বৎসল জননী, স্নেহ-উৎসধারিণী ভগিনী, সেবা-পরায়ণা রমণী। সব মুছে গেল। সংসারের সামগ্রিক ক্ষতি কেউ উপলব্ধি করে না। মানুষের চেতনায় তার ছায়া পড়ে না। 

একটু পরে আবার উপরে এলেন মালেক সাহেব। 

—চলো ভাই, একটু বেড়িয়ে আসি। 

বাইরে কোথাও বেড়ানোর উদ্দেশ্য নয়। ভিটের উপর পায়চারী। মালেক সাহেব প্রাচীন ইতিবৃত্ত বলতে থাকনে। উর্ধ্বস্তনদের মহিমা-বর্ণনায় তার দুই চোখ উজ্জ্বল হোয়ে উঠে। নেশা আছে তার প্রাচীন গাথা আবৃত্তির জন্য। 

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটি। মাথার উপর ঝুমকো লতার ডাল নুয়ে পড়ে। সরিয়ে দিই অরণ্যের অভিনন্দন দুই হাত দিয়ে। মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গা আছে। তার মধ্যে নানা ফুলের গাছ সযত্নে লাগানো। মালেক সাহেবের কৃষি-পনা। 

সরু পথটা সকালে দেখেছিলাম। ঘাটে যাওয়ার গলি। সেই দিকেও বেড়াতে গেলাম। শালের ভাঙা কড়ি-কাঠ, চূর্ণ ইট, মাটীর স্তূপের কোল ঘেঁষে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যেতে হয়। ভিটার ঢালু পথে নেমে যেতে চোখে পড়ল, কয়েকটা কুল গাছের সারি। তারপর ভাঙা সানের সিঁড়ি আরম্ভ হোয়েছে। ঘাট দেখলাম। সানের বদলে কয়েকটা তালগাছের গুঁড়ি ফেলা রয়েছে। খড়ি-বন হাঁটুজল পর্যন্ত বিস্তৃত। জীব-জন্তুর ভয় হয় না জুনু আপার? ওই পথে দিনে কত না বার সে হাঁটে। 

মালেক সাহেব বলেন, রাত-বিরেত ঘাটে আসতে হয়। আমার ভয় হয়। তোমার জুনু আপা কিছু ভয় করে না। একটা ভাঙা হারিকেন হাতে সে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করে। 

—এমন বিজন জায়গা, আপনারও ভয় নেই। বাস তুলে কোথাও যান না কেন?

—সাত পুরুষের ভিটা, ভাই-সাহেব। আব্বার রুহ্ বরদোয়া করবে। আর বংশের কিবা আছে।

আরো কাহিনীর অবতারণা করেন মালেক সাহেব। বংশ গৌরব তার রক্তের সঙ্গে মিশে রয়েছে। আন্‌মনা হোয়ে যান মাঝে মাঝে। জংলা গাছের পাতার দিকে চেয়ে থাকেন। 

ছমছম করে গা। ত্রস্ত, আমার মন কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত হোয়ে পড়ে। বন জঙ্গল আর ভাল লাগে না। 

জুনু আপা ঘাটের পথে নেমে গেলো। আমরা পৈঠা বয়ে উঠতে লাগলাম। 

নীচে জলের আলোড়ন শোনা গেল। 

মালেক সাহেব একটা ইট কুড়িয়ে বলেন, এর সোনালি ঝকঝকে রং ছোট-বেলায় দেখেছি। আজ তার চেহারা, দ্যাখো। আল্লার দুনিয়া শুধু খোলস ছাড়ছে। মানুষের খোলস ছাড়ে না। পাপ ঢুকলে আর কী থাকবে? এই ঘরে আমার বড় ভাই বাইজী নিয়ে থাকত। আগে শহরে বাইজী নাচাত। আব্বার মরবার দু-দিন আগে বাইজী সাদী করে নিয়ে এলো। আর বাঁচা কষ্টকর ছিল তাঁর পক্ষে। এই বাড়ীর ইট মানুষের গরম নিঃশ্বাসে আজ ধসে পড়ছে। ওই পাশে ছিল কাচারী ঘর। কত চাষীর লাশ গুম করা হোয়েছে খড়ি-বনে। গাঁয়ের চাষীর কোন যুবতী মেয়ের বোধ হয় ইজ্জত নিয়ে বিয়ে হয়নি। তাদের আহাজারী বৃথা হবে, ভাই। আল্লা আছে এখনও দুনিয়ায়। বড়-ভাই আর চাচারা, সবাই এক গোঠে 

চরতেন। গোনাহ মাফ করবেন আল্লাহ? 

দুপুরের আলো বাঁশ-বনের ফাঁকে ঝরে পড়ে। ইমারতের কন্দরে লোক-ক্ষয়ের জীবাণু পাখা মেলছে চারিদিকে। তারই পাখনা-ধ্বনি যেন বাজতে থাকে। 

অতীতের চারণ আমার সম্মুখে। 

.

বিকালে ঝড় উঠলো। উপরের কোঠাঘরে আমরা তিনজন বসে। বাঁশ-বনে বাতাসের তাণ্ডব শুরু হয়। ঘর-দুয়ার কাঁপতে থাকে। মুখে কোন কথা সরে না। 

মালেক সাহেব আমাদের অভয় দিয়ে বলেন, ভয় পেয়ো না, ভাই। চারিদিকে বাঁশ-বন। ঝড়ে এ—ঘর পড়বে না। ভূমিকম্পে কিছুটা গ্রাস করেছে। আর একটা ভূমিকম্প। কোঠাবাড়ীটা মাটির তলায় মিশে গেলেও মাটীর অভিমান ভাঙবে না। পাপের ক্ষয়-কীট ঘুনে ঘুনে আজ ঠাঁই নিয়েছে। 

জুনু আপা ভাঙা পালঙের একদিকে মাথা হেঁট করে বসে থাকে। ঘোমটায় ঢাকা মুখ। তার মনের হদিস তাই নেপথ্যে আড়াল। আমারও কথা বলার উৎসাহ থাকে না। 

একটা ঝাপ্টা এলো পূর্বদিক থেকে। খড়খড়ি-গুলো যেন এখনি হুম্‌ড়ি খেয়ে পড়বে আমাদের উপর। ঝঞ্ঝা উঠে চারিদিক থেকে। সমস্ত ঘরের আসবাবপত্র প্রলয়ের সূচনায় মানুষের মতই কাঁপছে। আর এক দমক হাওয়া এলো। নিঃশ্বাস বুজে অসহায়ের মত জুনু আপার দিকে তাকাই। না, আর ঝাপ্টা এলো না। ঝড় ক্রমশঃ মন্দীভূত হয়। 

বাতাসের প্রকোপ কমে গেলো ধীরে ধীরে। এখনও সামান্য বেলা আছে। মেঘ ছিঁড়ে রোদ্দুর উঠেছে দিগন্তের মাঠ প্লাবিত করে। 

বাইরে এলাম দুলা-ভাইয়ের সঙ্গে। হাঁফ ফেলছে ধরিত্রী। ঠাণ্ডা বাতাসে আবার নব-জীবনের গান।

দেউড়ীর ফটকের সম্মুখে একটা ঝুমকো লতার গাছ শিকড়-শুদ্ধ উল্টে গেছে। দুলা-ভাইয়ের আপশোষের সীমা থাকে না। তখনই একটা বাঁশ যোগাড় করে আনলেন তিনি। আমিও সাহায্য করলুম। 

—অনেক কুঁড়ি ধরেছে, ভাই। ফলে-মূলে আমার পেয়ারের গাছটা নষ্ট হোতে দেব না। 

হাতে, গায়ে কাদা লেগেছে তাঁর। তিনি ডোবায় সাফ হোতে গেলেন। আমি দাঁড়িয়ে থাকি এই বিজন বন-ভূমির বুকে। এখানেও মানুষের শিল্পী-আত্মা জীবন-সংগ্রামের তীব্র নিষ্পেষণের মধ্যে মরে যায়নি। যুগ-যুগ ধরে বেঁচে আছে মানুষের আত্মা। তাই না উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আলো সমাজের কর্মী, সেবক, মানব-প্রেমিকদের হাতছানি দিয়ে ঘর ছাড়া করে। 

এতদিনে হয়ত ঝুমকো লতার গাছে ফুলের জোয়ার এসেছে। দুলা ভাই সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাঁর পূর্ব—পুরুষদের গ্লানি পঙ্কিল জীবনের পাতা উল্টে চলেছেন এক-এক করে। 

.

পরদিন তিনি সকালে গৃহস্থালির কি এক কাজে বাইরে গেলেন। নিচে পাকের ঘরে জুনু আপা ব্যস্ত। একা উপরে মন বসে না। নেমে এলাম আপার নিকট। 

—কি রে, নিচে এলি। বসে বসে ধোঁয়া খা’ তবে। জুনু আপা হাসে। 

তক্তপোষের উপর বসে থাকি কয়েক মিনিট। 

—আচ্ছা আপা, দুলা ভাই বেশ ভাল-মানুষ? 

—ভাল মানুষ বললে কিছু বলা হয় না। অনেক জায়গায় আশ্রয় ছেড়ে এখানেই রয়ে গেলাম চির—জন্মের মত। শুধু দয়ার বন্ধনের জন্য। 

—খুব দয়ালু ইনি? 

—দয়ালু বৈকি। কোথাও মাথা গুঁজে মানুষের মত থাকতে পেলাম না। এখানে ঠাঁই পেলাম। আগে ত ঐ তক্তপোষের উপর, তুই যেখানে বসে, আমার ঘরে পেতেছিলাম। তারপর নিজেই সিঁড়ি বেয়ে কত রাত দুরু-দুরু বুকে উঠে গেছি, আবার নেমে এসেছি শুধু দয়ালু প্রাণের জন্যে। একদিন সাহস করে বিছানায় গিয়ে বসেছিলাম। পরদিন আমাদের নেকা হোলো। তুই হয়ত কত খারাপ ভাবছিস। তা ছাড়া উপায় ছিল না। নেমক হারামী আমি করতে পারি না—

কৃতজ্ঞতার জন্য জুনু আপা এত দূর এগিয়ে গেলেন! মানুষের বুকে প্রেম নেই? জুনু আপা কি পাষাণের মূর্ত্তি তবে! 

—নিজেই উপরে গিয়ে পালং দখল করেছিলাম। সারা জীবন এই অন্ধকার ঘরে কাটিয়ে দিলেও উনি কোনদিন ডাকতেন না। ভালবাসার প্রতিদান কোথাও নেই। দয়ার প্রতিদানও উঠে গেলে দুনিয়া থেকে, পৃথিবী জঙ্গল হোয়ে যেত। 

খারাপ লাগে আমার। জুনু আপার জন্য তবু করুণা হয়। নির্ব্বাসিতের এই জীবন সে সুখেই অতিবাহিত করে নাকি! 

জুনু-আপা বলে : দেখলি না কেমন মানুষ। কোন খেয়াল নেই কিছুর। জমি-জায়গা আমার সামনে কত বিকিয়ে গেল। চাষীদের কাছ থেকে খাজনা পর্যন্ত চায় না। তারাও সুযোগ পেয়ে কিছুই দেয় না। বলে, পাপের প্রায়শ্চিত্ত হোক। 

—আর দু-বছর পরে তোমাদের চলবে কি করে? 

—তা কোনদিন ভাবিনি। 

চাষীদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করে সব খোয়াবেন, তাতে লাভ কী হবে? চাষীদেরও অভাব ঘুচবে না। উনিও খোয়ার হবেন। 

—তবে কী করতে পারে? জুনু-আপা জিজ্ঞেস করে। 

—দয়া দেখিয়ে কিছু হয় না। মনে সুখ হয়ত পাওয়া যায়। চাষীরা নিজেদের অধিকার দাবী করুক, তা-হোলেই সব ঠিক হোয়ে যায়। তারা যদি তা না বোঝে তাদের অধিকার তাদের জানিয়ে দেওয়া হোক। এ তো আত্মহত্যার সামিল। 

—জানি, আত্মহত্যা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গিয়েছিলাম এক রাত্রে। আমিও আত্মহত্যা করিনি কতদিন ভেবেছিলাম—ঐ আমার শেষ পথ। খোদার কাছে মুখ দেখাতে হবে, তাই আত্মহন্ত্রীর সাথেই নিজের জীবনকে বেঁধেছি। আর কি উপায় আছে? 

জুনু-আপার গলা শেষ-দিকে বুজে আসে। চুলোর হাঁড়ির দিকে, তার মুখ ফেরায় আপা। 

স্বচ্ছ হোয়ে আসে আমার কাছে সব রহস্যের কুয়াশা। আর বসে থাকতে পারি না সেখানে। বড় দুঃখ হয় জুনু আপার জন্য। পড়ার ঘরে একদিন জুনু আপাকে দেখেছিলাম। তার অন্তর কোনদিন নিঃসাড় হোতে পারে না। 

কোন কথা না বলে উপরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। 

.

ছোট ষ্টেশন। রেলের হুইশেল শোনা গেল। লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার শব্দ ভেসে আসে। এই মাত্ৰ ডিষ্ট্যান্ট সিগন্যাল পড়ল। তাড়াতাড়ি পা চালাই। পেছনে পড়ে রয়েছে গ্রাম। শুধু কী গ্রাম? আর কিছু নয়? 

.

অকস্মাৎ বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। অস্ফুট নীরবতায় কণ্ঠ দোলে : জুনু আপা, তোমাকে বিদায় দিতে পারি না। 

জুনু আপা, বিদায়! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *