জুড়ি দৃশ্য

জুড়ি দৃশ্য

প্রথম ধাক্কা

আমি যখন নেহাৎ ছোকরা তখন কলকাতায় প্রথম পড়তে আসি। নেহাৎ ছোকরা বলছি এই জন্যে যে, তখন আমি তেরো পেরিয়েছি, কিন্তু চৌদ্দতে পৌঁছই নি।

থাকতুম কায়ক্লেশে বৈঠকখানাবাজার রোডে একটি ভাড়া-বাড়িতে। বাড়িটা মন্দ নয়, কিন্তু ছোটো।

ছেলেবলা থেকে পাড়াগাঁয়ে যে বাড়িতে মানুষ হয়েছি, সে বাড়িতে ছিল দেদার পোড়ে জমি। সুতরাং বায়ুভুক আমাদের ভূমিশূন্য বাড়িতে কায়ক্লেশেই থাকতে হত।

বাবা তখন থাকতেন পশ্চিমে চাকরির খাতিরে।

একদিন বাবা না-বলা-কওয়া হঠাৎ এসে উপস্থিত হলেন। আমরা তাঁকে দেখে খুশি হলুম, কিন্তু একটু চমকে উঠলুম। আদালত খোলা-এ অবস্থায় তিনি এলেন কি করে ও কিসের জন্যে বুঝতে পারলুম না। শুনলুম রানীমার এক জরুরি তার পেয়ে বাবা তিন-চার দিনের জন্যে ছুটি নিয়ে এসেছেন। রানীমা ছিলেন আমাদের স্বজাত গেরস্তের মেয়ে, বাবার মাতৃস্থানীয়া। তাঁর জোর তলব তিনি অমান্য করতে পারেন না। আহারান্তে তিনি উত্তরবঙ্গের ট্রেনে চলে গেলেন আর পরদিনই ফিরে এলেন—রানীমার কাছে অজস্র ভৎর্সনা খেয়ে। এ কথা এখানে উল্লেখ করবার কারণ এই যে, বাবা হাসিমুখে ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু মন ভার করে। বাবার অপরাধ দাদাকে দ্বীপান্তরে পাঠিয়েছিলেন। রানীমার মতে বিলেত যাওয়াও যা, আন্দামান যাওয়াও তাই। কালাপানি পার হয়ে শুধু কুলাঙ্গাররা।

তার পরদিন সকালে বাবা বললেন, “আজ বিকেলে জয়ন্তীবাবুর সঙ্গে দেখা করে যাব।” পঁচিশ বৎসর পূর্বে তাঁর সঙ্গে বাবার শেষ দেখা।

জয়ন্তীবাবুর নাম আগে শুনেছি, কিন্তু তিনি কে, কি বৃত্তান্ত কিছুই জানতুম না। তিনি আমাদের দূরসম্পর্কীও কেউ নন। জয়ন্তীবাবু কায়স্থ, আমরা ব্রাহ্মণ। তিনি কলকাতার আদিবাসী, আমরা পদ্মাপারের বাঙাল।

বাবা কৈশোরে সেকালের হিন্দু কলেজে পড়তেন, তার পর প্রথম যৌবনে নিজেদের জমিদারি মামলা মোকদ্দমার তদ্‌বির হাইকোর্টে করতেন, এবং সেই সঙ্গে রানীমারও। জয়ন্তীবাবু ছিলেন বাবার বড়ো ইংরেজ ব্যারিস্টারের বাবু, সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে বাবার পরিচয় হয়। বাবা তাঁকে বড়ো ভালো লোক বলেই জানতেন। যদিও সেই মামলায় বাবা সর্বস্বান্ত হন, তবুও জয়ন্তীবাবুর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল। বিশ-পঁচিশ বৎসর তাঁর সঙ্গে দেখা হয় নি, তবুও বাবার মনে তাঁর সব পূর্বস্মৃতি জেগে উঠল। বোধ হয় রানীমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার ফলে।

জয়ন্তীবাবুর কোন্ রাস্তায় বাড়ি বাবা তার নাম জানতেন, কিন্তু বাড়ির নম্বর জানতেন না। বিকেলে আমি ঠিক গাড়িতে বাবার সঙ্গে শোভাবাজার স্ট্রীটে গেলুম। আমিই ছিলুম বাবার ইঁচড়ে-পাকা ছেলে, তাই আমিই হলুম তাঁর পথ-প্রদর্শক; যদিচ সে অঞ্চলে আমি পূর্বে কখনো যাই নি, পরেও নয়। এ কালে আমাদের পলিটিক্যাল নেতারা যেমন মুক্তি কোন্ পথে জানেন না, অথচ আমাদের মুক্তির পথ-প্রদর্শক হন!

বাবা একখানা বাড়ি দেখে বললেন, এই জয়ন্তীবাবুর বাড়ি। বাড়িটি বড়ো এবং কেতা-দুরস্ত। পাড়ার লোককে জিজ্ঞেস করে শুনলুম বাড়ি এককালে ছিল জয়ন্তীবাবুর, এখন হয়েছে অন্যের। জয়ন্তীবাবু শুনলুম বেঁচে আছেন, কিন্তু তিনি কোথায় থাকেন তা কেউ বলতে পারে না। পাড়ার একটি মুদি বলল, তাঁর ভাই কুলদাবাবু বিডন স্ট্রীটে থাকেন, তাঁর কাছে গেলেই জয়ন্তীবাবু কোথায় থাকেন জানতে পারবেন। মুদি- ভদ্রলোক অনুগ্রহ করে কুলদাবাবুর বাড়ির ঠিকানা বলে দিলেন। তার পর একটু হাসলেন। আমরা ফিরতি বেলায় কুলদাবাবুর বাড়িতে গেলুম। মস্ত দোতলা বাড়ি, বিডন পার্কের ঠিক উল্টো দিকে। সে তো বাড়ি নয়, ইটের পাঁজা।

আমরা তার সদর দরজা দিয়ে ঢুকে সামনে যাকে দেখলুম তাকে কুলদাবাবুর কথা জিজ্ঞেস করতে সে একতলায় একটি কামরা দেখিয়ে দিল। আমি ঘরে ঢুকেই চমকে উঠলুম। এমন এঁদো স্যাঁতসে্যঁতে ঘরে যে মানুষ বাস করতে পারে, আমার পূর্বে সে জ্ঞান ছিল না। ঘরখানার যেন গলিত কুষ্ঠ হয়েছে। দেয়াল থেকে চুন-বালি সব খসে পড়েছে, আর মধ্যে বড়ো বড়ো ফোস্কার মতো ফুলে উঠেছে। আর দুর্গন্ধ অসাধারণ। সেকালে কলকাতা শহরে ঢুকতেই যে পাঁচমিশেলী গন্ধ নাকের ভিতর দিয়ে পেটে ঢুকত আর গা পাক দিয়ে উঠত, সেই গন্ধ যেন এ ঘরে জমাট বেঁধেছে। হাওয়া সে ঘরে দক্ষিণের জানালা দিয়ে ঢুকতে পারে, কিন্তু বেরোবার পথ নেই। মেঝে কেন ভিজে, বুঝতে পারলুম না। বোধ হয় ইঁদুর ও ছুঁচোর প্রস্রাবে সিক্ত। মনে হল বাড়িটি রোগ ও মৃত্যুর ডিপো। এখানে মানুষ আসে মরতে, বাঁচতে নয়।

তারপর তাকিয়ে দেখি যে, ঘরের এক কোণে দড়ি দিয়ে ছাওয়া একটি মড়াফেলা খাটিয়ার উপর লাল খেরো-মোড়া ইটের মতো তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে একটি ত্রিভঙ্গ লোক শুয়ে কিম্বা বসে ভাবা হুঁকোয় কষে দম মারছেন। প্রথমেই নজরে পড়ল, লোকটা আগে ছিল সুপুরুষ, এখন হয়েছে সেই জাতীয় কুপুরুষ যাকে দেখলে লোক আঁৎকে ওঠে।

আমাদের পায়ের আওয়াজ শুনে লোকটি চোখ বুজে নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে “কে ও” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।

বাবা নিজের নাম বললেন। শুনে ভদ্রলোক উত্তর করলেন, “চৌধুরী মশায়! নমস্কার। ডান পাটা জখমী, তাই উঠে পায়ের ধুলো নিতে পারলুম না। মাফ করবেন। দাদার খোঁজে বোধ হয় এসেছেন?”

“হ্যাঁ, তাই।”

“মামলা করবার শখ এখনো আছে? দাদা তো আপনাকে সর্বস্বান্ত করেছেন। এখন আবার কি নিয়ে মামলা?”

“আমি সর্বস্বান্ত হয়েছি বটে, কিন্তু তার জন্যে দায়ী তো জয়ন্তীবাবু নন। তিনি ছিলেন অতি সৎ লোক।”

“আর সেই সঙ্গে ছিলেন অতি নির্বোধ। বোকা আর বজ্জাত দুই সমান সর্বনেশে জন্তু। দাদার সঙ্গে আমার তফাৎ কি জানেন? আমার রক্তে আছ এলকোহল ও দাদার আছে আফিং।”

“ভয় নেই, আমি ফের মামলার তদবির করতে আসি নি, এসেছি শুধু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি আছেন কেমন?”

“শুনেছি মন্দ নয়। তাঁকে দেখি নি।”

“দেখেন নি কেন?”

“দেখতে পাই নে বলে। আমি এখন অন্ধ।”

“চোখ হারালেন কবে?”

“আন্দামানে।”

“আপনি আন্দামানে গিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ, গিয়েছিলুম হাওয়া বদলাতে। আর সেখানে ছিলুম দশটি বৎসর। সম্প্রতি ফিরেছি, আর আছি এই রাজপ্রাসাদে।”

“এ ঘর তো রাজপ্রাসাদ নয়, অন্ধকূপ!”

“অন্ধের কাছে সবই Black-hole, মায় লাটসাহেবের নাচঘর।”

“তা ঠিক।”

“তাতে কোনো দুঃখ নেই। গতস্য শোচনা নাস্তি।”

“সেখানে দেখলেন কি?”

“নরক গুলজান।”

“আর?”

“দেশটা বিলেতের ছোটো ভাই।”

“অর্থাৎ?”

“সে দেশে জাতিভেদ নেই, বাল্যবিবাহ নেই, বহুবিবাহ নেই—আছে শুধু বিধবাবিবাহ। সব মেয়েরাই স্বয়ম্বরা হয়। বিয়ে সেখানে সেয়ানায় সেয়ানায় কোলাকুলি। যাঁরা দেশি সমাজকে বিলেতি সমাজ করতে চান—আন্দামান তাঁদের জ্যান্ত আদর্শ।”

“এ আদর্শ সমাজ থেকে আপনার কিছু লাভ হল?”

“লাভ হয়েছে এই যে, হারিয়ে এসেছি একটি পা, চোখ দুটি, মিষ্টি কণ্ঠ, মিষ্টি কথা আর ভগবানের বিশ্বাস।”

তারপর তিনি বললেন, “May I speak to you in English?”

“Certainly.”

“Can you lend me five rupees?”

“Of course.’

“Payable when able”

“That is understood.”

এর পর বাবা কুলদাবাবুকে পাঁচটি টাকা দিতে তিনি বললেন, “Thank “Thank you.”

নিমতলা ঘাটের সেই waiting-room থেকে বেরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম, এবং ভয়ে ভয়ে গাড়িতে উঠলুম জয়ন্তীবাবুর বাসায় যেতে হবে ভেবে। আমার পরিচিত সেই গলিটির মতো পচা ও নোংরা গলি কলকাতায় আর দ্বিতীয় ছিল না, এখনো বোধ হয় নেই। সে তো গলি নয়, একটি সুড়ঙ্গ বিশেষ। ঠিক গাড়ি সে রাস্তায় কি করে ঢুকতে পারল, বুঝলুম না।

ইংরেজিতে বলে, Where there is a will there is a way। কোচম্যান মিঞা দুপাশের বাড়িতে ধাক্কা খেতে খেতে আমাদের জয়ন্তীবাবুর বাসায় পৌঁছে দিল।

একটি দাড়িগোঁফওয়ালা ভদ্রলোক দুয়োরে এসে আমাদের উপরের ঘরে নিয়ে গেলেন।

ঘরে ঢুকেই আমার মনের মেঘ কেটে গেল। গলিটি যেমন কদর্য—ঘরটি তেমনি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ঘরে একখানি ধবধবে জাজিম পাতা, তার একটি কোণে একটি ভদ্রলোক একটি তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসে আছেন। তাঁর গলায় কাঠের মালা, নাকে তিলক, দাড়িগোঁফ কামানো, মাথায় চুল পাকা। এমন বিষণ্ণ অবসন্ন নির্বিকার মূর্তি কদাচ দেখা যায়। তিনি একটি বিদরির ফসিতে তামাক খাচ্ছিলেন। বাবা আমাকে আস্তে আস্তে বললেন, ইনিই জয়ন্তীবাবু।”

জয়ন্তীবাবা বাবাকে দেখেই বললেন, “নমস্কার চৌধুরীমশায়! বসুন। কোমরে বাত, তাই উঠে পায়ের ধুলো নিতে পারলুম না। মাফ করবেন। কেমন আছেন?”

“দেখতে তো পাচ্ছেন।”

“শরীর দেখছি ভালোই আছে, কিন্তু সেকালের সে রূপ নেই। কী তেজস্বী চেহারা ছিল আপনার, সে তেজ আর নেই।”

“তেজ-টেজ যা ছিল সব গেছে গভর্নমেন্টের নোকরি করে। তাইতে ছেলেদের বলেছি, কখনো সরকারের চাকরি করো না। ও যন্ত্রের ভিতর পড়লে একদম পিষে যাবে।”

“তা হলে আপনার এখনো কিছু আছে। আমি তো জানতুম, আমরাই আপনাকে সর্বস্বান্ত করেছি।”

“সর্বস্বান্ত অবশ্য হয়েছি; কিন্তু তার জন্যে আপনারা দায়ী কিসে?”

“আমরাই তো আপনাকে ও-মামলা compromise করতে দিই নি। যদিচ কুলদা আপস-মীমাংসা করতে বলেছিল।”

“সে যাই হোক, এখনো ফোঁটা দেবার মাটি আছে। এখন আপনার এ অবস্থা – বিপর্যয় ঘটল কি করে?”

“আমার বাসার ঠিকানা পেলেন কার কাছ থেকে?”

“আপনার ভাই কুলদার কাছে।”

“তার আস্তানায় গিয়েছিলেন কি?”

“হ্যাঁ, গিয়েছিলুম।”

“সে তো একটা বেশ্যা-ব্যারাক। কুলাঙ্গারটা আন্দামান থেকে ফিরে ঐ বাড়িতে ঢুকেছে এই বলে যে, old friends দের ছেড়ে আর কোথাও থাকতে পারবে না। তাকে আর কারোর স্থান দেওয়া অসম্ভব। আর কেউ স্থান দিলেও সে তা নেবে না। সে বলে, ভদ্রসমাজের অমানুষদের কারো পোষা কুকুর হয়ে থাকবে না। আন্দামান থেকে ও দুটি বিদ্যে শিখে এসেছে—চীৎকার করা ও গালিগালাজ দেওয়া, ইংরেজি ও বাঙলা-দু ভাষাতেই।”

“কুলদা তো ছিল অতি মিষ্টভাষী আর অতি ভদ্ৰ।”

“আর চমৎকার গাইয়ে অতি বুদ্ধিমান। আন্দামান থেকে ও হারিয়ে এসেছে দুটি চোখ, মিষ্টি কথা ও মিষ্টি কণ্ঠ। তবে দুষ্ট বুদ্ধি সমানই আছে।”

“আমাকে তো কোনো গালিগালাজ করলে না। শুধু কথা অতি চেঁচিয়ে বললে।”

“আপনার কাছে কিছু টাকা চায় নি?”

“চেয়েছিল পাঁচ টাকা, আমি তা দিয়েছি।”

“না দিলে আপনার বাপান্ত করত। ও টাকায় সে মদ কিনে খাবে। সে যাই হোক, ও নিজেও ডুবেছে, আমাদেরও ডুবিয়েছে। মদ, মেয়েমানুষে প্রথমে মশগুল হয়ে পড়ল, এর জন্য টাকা চাই। আর টাকা রোজগার করবার উপায় ঠাওরাল জাল-জুয়োচুরি, তাই করতে শুরু করল। ওর কথা ছিল, ডুবেছি না ডুবতে আছি—দেখি পাতাল কত দূর। শেষটায় পাতাল পর্যন্তই পৌঁছল, আর আমাকেও ডোবাল। তাই আমি আজ এখানে, আমার মেয়ের বাড়িতে। জামাই গরিব, কিন্তু অতি ভদ্র আর অতি ভালো লোক—স্কুলমাস্টার ও ঘোর ব্রাহ্ম। ঐ আমাকে প্রতিপালন করছে। স্কুল-মাস্টারিতে কিছু পায়, আমার মেয়ের হাতেও কিছু টাকা আছে—বিয়ের সময় আমারই দেওয়া। তাতেই চলে যায়।”

“আপনার কি পৈতৃক সম্পত্তি কিছুই নেই, ঐ বিদরির ফসিটি ছাড়া?”

“না, সব গেছে। আমি আফিং ধরেছি, তাই তামাক খেতে হয়। তাই সব গেছে, শুধু হুঁকোটি রেখেছি।”

এর পর আমরা তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলুম।

গাড়িতে আমরা উভয়েই চুপ করে রইলুম, সেদিনকার নতুন অভিজ্ঞতার ফলে।

বাবা বোধ হয় আমাকে অন্যমনস্ক করবার জন্য কথা পাড়লেন। তিনি বললেন যে, “আমাদের দেশের বাড়িতে দেদার রুপোর গুড়গুড়ি ছিল, কিন্তু জয়ন্তীবাবুর ঐ বিদরির- কাজ-করা অষ্টধাতুর মতো এমন সুন্দর ফরসি একটিও না। বাবা সেকালে অবিরাম হুঁকো টানতেন। একালে আমি যেমন অবিরাম সিগারেট টানি, অর্থাৎ একটি পুড়িয়ে আর-একটির মুখাগ্নি করি—। বাবাও অগ্নিহোত্রীর অগ্নির মতো কলকের আগুন নিবতে দিতেন না।”

আমি এ বিষয় কিছু উচ্চবাচ্য করলুম না, কেননা তখন আমার মনে বাবার পূর্ববন্ধুদের রূপ ও গুণ জাগছে।

কুলদাবাবুকে দেখে আমার হরিভক্তি উড়ে গিয়েছিল। জয়ন্তীবাবুকে দেখে সে ভক্তি ফিরে এল না। জয়ন্তীবাবু তিলক-কাটা একটি ছবি মাত্র। ফিকে জলরঙের ছবি, মানুষের আবরণে অর্থাৎ চামড়ার ছবি, মানুষের নয়। সে ছবি মনকে বিশেষ স্পর্শ করে নি। কিন্তু কুলদাবাবুর ছবি মানুষের চামড়ার ছবি নয়—চামড়ার পর্দা-মুখে মানুষের ছবি। আর দেহের মতো তার আত্মাও অন্ধ ও খঞ্জ-অথচ দুর্দান্ত। কি ভীষণ এই বেপরোয়া জীবটি! আমার মনে হয় যে আমরা সকলেই সমাজে যেন বাঁশবাজি করছি—একবার বেসামাল হলেই কুলদাবাবুর মতো পাতালে পড়ব।

এ দৃশ্য আমার মনকে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছিল, যার রেশ আজও আমার মনে আছে। আর সেই জন্যেই এই গল্প পড়ব।

দ্বিতীয় ধাক্কা

পূর্ব-বর্ণিত ঘটনার প্রায় তিন বৎসর পরে মানবজীবনে সিনেমার আর-একটি দৃশ্য হঠাৎ আমার চোখে পড়ে যা আমার মনে একটি গভীর ছাপ রেখে যায়। ব্যাপার কি ঘটেছিল সেই কথাটি আমি বলব।

প্রথম দৃশটি যখন দেখি তখন আমি হেয়ার স্কুলে এন্ট্রান্স ক্লাসে পড়ি। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটন ঘটে তখন আমি প্রেসিডেন্সিতে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ি।

ইতিমধ্যে আমি আধা-কলকাত্তাই হয়ে যাই, যদিও ভাষাতে নয়—ব্যবহারেও নয়। কারণ আমি পদ্মাপারের বাঙাল হলেও বাঙালে ভাষা বলতুম না, বলতুম নদে-শান্তি পুরের ভাষা। তখন আমাদের সে ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ছিল। তবে কলকাতার কথা শুনে শুনে মুখের ভাষার টানটোন যে কিছু বলদায়নি-এমন কথা বলতে পারি নে।

আধা-কলকাত্তাই হয়ে গিয়েছিলুম বলছি এই জন্যে যে, ইতিমধ্যে আমার জনকতক কলকাতার বন্ধুবান্ধব জুটেছিল; খুব বেশি নয়—পাঁচ-ছজন মাত্র। তাঁরা সকলেই ছিলেন সুবর্ণবণিক। বলা বাহুল্য যে, তাঁদের ভাষা ও রসিকতা আমাদের কাছে আগ্রাহ্য ছিল। কারণ তাঁদের ভাষা ছিল বিকৃত, আর রসিকতা যেমন বাসি তেমনি পাসে। ভাষার উপর অধিকার না থাকলে রসিকতা করা যায় না। আর আমার বন্ধুদের ভাষার পুঁজি খুব কম ছিল। এঁদের ভিতর একজন ছিলেন তিনি লেখাপড়ার কোনো ধার ধারতেন না, অপর পক্ষে ছিলেন গাইয়ে ও বাজিয়ে। তাঁর গলা ছিল হেঁড়ে, কিন্তু গাইতেন তালে ও মানে। আর তিনি বাজাতেন হার্মোনিয়াম সেতার এস্রাজ ও বাঁয়া- তবলা। তিনি ছিলেন যথার্থ সংগীতপ্রাণ।

কলকাতায় আসবার পূর্বেই আমার সংগীতের নেশা হয়। ফলে তিনি আমার ঘনিষ্ঠবন্ধু হয়ে উঠলেন। তাঁর সঙ্গে আমি বহু গানবাজনার আড্ডাতে হাজ্বরে দিতুম—এমন-কি, বস্তিতে খাপরার ঘরেও। সেই যাই হোক, তিনি একটি যুবককে আবিষ্কার করলেন—সে বেহালা বাজাত ভালো।

আমার বয়েস যখন ষোলো, এ যুবকটির বয়েস তখন বিশ কি একুশ। তিনি ছিলেন প্রিয়দর্শন, পরন-পরিচ্ছদে শৌখীন। জাতিতে ব্রাহ্মণ, কথাবার্তায় মিষ্টভাষী এবং ব্যবহারেও ভদ্র। আমি তাঁর নাম করব না, কেননা হয়তো তিনি এখনো বেঁচে আছেন, এবং সংগীত-জগতে গণ্যমান্য হয়েছেন। তিনি আমাকে ও আমার বন্ধুটিকে এক দিন তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন, ভালো করে তাঁর বেহালা শুনবার জন্যে। আমরা দুজনে দুপুর বেলা আহারান্তে তাঁর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেম। সে বাড়ি কোন্ রাস্তায় তা বলব না, কিন্তু সেটি একটি বিশিষ্ট ভদ্রপল্লী।

বাড়িটি বাইরে থেকে দেখতে একটু দৃষ্টিকটু। বাড়িটির গায়ের বালির আস্তর নেই, ইটগুলো সব দাঁত বার করে রয়েছে। দেখতে কেমন নেড়া-নেড়া লাগে। আমার বন্ধুটি পাঁচ মিনিট ধরে সজোরে সদর দরজার কড়া নাড়লেন। একটি হিন্দুস্থানী চাকর এসে আধা বাঙলায় আধা হিন্দুস্থানীতে জিজ্ঞেস করলে, “কাকে চান?” যাঁকে চাই তাঁর নাম করতে সে বললে, “ছনু বাবুকে? আচ্ছা, সামনে খাড়া রহো, হামি বাবুকে বুলিয়ে দিচ্ছি।” এই বলে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলে। এই চাকরটির সঙ্গে ছিল গা- ঢাকা দিয়ে একটি স্ত্রীলোক, দেখতে পরমা সুন্দরী—’জনু আঁচরে উজোর সোনা।’

কিছুক্ষণ পরে ছনু এসে উপস্থিত হলেন, আর মিনিট-পাঁচেক আমাদের যে রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে তার জন্য মাফ চাইলেন ও বললেন যে, “এ বাড়িতে আমি ছাড়া তো আর পুরুষ-মানুষ নেই, তাই বার-দুয়োরে খিল ও শিকল দিয়ে রাখতে হয়। যে চাকরটি দেখলে, ঐ বুলাকি আমাদের দরওয়ান বেহারা সব—আর কে আসে না আসে মাও তা দেখতে চান।”

এরপর ছনুবাবুর সঙ্গে আমরা উপরে গেলুম। যে ঘরে ঢুকলুম সেস যথেষ্ট প্রমাণই, কিন্তু সে ঘরে এক টুকরোও আসবাব নেই। তারপর তাকিয়ে দেখি, ঘরের ঠিক মাঝখানে একটি কাঠের চেয়ারের উপর একটি ভদ্রলোক জোড়াসন হয়ে বসে আছেন। লোকটির বর্ণ গৌর, নাক চোখ সব নিখুঁত, নধর দেহ অনাবৃত ও বুকে এক গোছা ধবধবে পৈতে। তিনি চোখ বুজে ছিলেন। মনে হল যেন স্বয়ং মহাদেব ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন।

আমরা ঘরে ঢুকতেই তিনি মহা চীৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, “কে ও?”

ছনু উত্তর করলে, “আমি।”

“কে—ছনু? তোমার সঙ্গে কে?”

“কেউ নয়।”

“দেখো, আমি কানা হয়েছি বলে তো কালা হই নি।”

“আমরা কানা হই নি কিন্তু কালা হব-দিবারাত্র আপনার চীৎকার শুনে।”

“কথা যে চেঁচিয়ে বলি, তার কারণ কেউ আমার কথায় কর্ণপাত করে না, কেউ আমার কথার উত্তর দেয় না। ও একরকম অরণ্যে রোদন। চোখ যে গেছে—সে একরকম ভালোই হয়েছে। তোমার মার আমি মুখদর্শন করতে চাই নে। ঐ পাপমূর্তি যাতে দেখতে না হয় ভগবান সেইজন্য আমাকে অন্ধ করেছেন।”

“দেখুন, বাইরের লোকের কাছে মার উপর আপনার আক্রোশ অত তারস্বরে প্রকাশ করবেন না।”

“তবে যে বললে, তোমার সঙ্গে কেউ নেই? আমি তিনজন লোকের পায়ের শব্দ শুনলুম। তোমার সঙ্গীরা কে?”

“আমার দুটি বন্ধু।?”

“ছোকরা?”

“হ্যাঁ।”

“এখানে এসেছে কি করতে?”

“আমার বাজনা শুনতে।”

“ভারি তো বাজাও! যন্ত্র তো বেহালা, যা সাহেবরা বাজাতে পারে— বাঙালিতে পারে না। আমাদের কব্জির সে শক্তি নেই। আমি আগে সুরবাহার বাজাতুম, আর শৌখীন বাজিয়েদের মধ্যে সেরা ছিলুম। বাজাও তো পিলু বারোয়া? বাজাও তো একটি নটনারায়ণ—আস্থায়ী, অন্তরা, আভোগ, সঞ্চারী পুরোপুরি?”

“আমি অবশ্য পিলু বাঁরোয়া বাজাই—কিন্তু নটের ঘরের অনেক রাগরাগিণীও বাজাই—যথা, কেদারা হাম্বীর ছায়ানট প্রভৃতি।”

“আর তোমার ঐ ছোকরা বন্ধুরা কোথায় শুদ্ধ মধ্যম ও কোথায় কড়ি মধ্যম লাগল ধরতে পারবে?”

“না পারলেও আশা করি সমগ্র রাগিণী শুনে মুগ্ধ হবে।”

“সত্য কথা বল্ ওরা তোর বোনদের গান শুনতে এসেছে। তোমার মা তো ছুঁড়ি দুটোকে তরফা-ওয়ালী বানাচ্ছেন!”

“এ কথা কেন বলছেন?”

“ভদ্রলোকের ঝি-বৌরা কি গান বাজনা করে?”

“আগে হয় তো করত না, এখন করে। আপনি তো এক যুগ এ দেশে ছিলেন না—এর মধ্যে সমাজের হালচাল অনেক বদলে গেছে।”

“তা যেন হল, কোন্ ভদ্রঘরে মুসলমান বাইজির ভেড়ুয়া সারঙ্গীওয়ালাকে মেয়েদের মাস্টার করে?”

“যারা দস্তরমত সংগীত শিক্ষা দিতে চায়, তারা করে। ওস্তাদমাত্রই তো মুসলমান। রমজানকে তো মা আনেন নি, আমি এনেছি।”

“সারঙ্গীওয়ালার কাছে বুঝি বেহালা শেখ?”

“কিছু কিছু শিখি বটে।”

“তুমি বুঝি কীর্তনওয়ালীদের বেহালাদার হবে?”

“যদি কপালে থাকে তো তাই হব।”

“মরুক গে ছুঁড়ি দুটো! এখন জিজ্ঞেস করি, তোমার বন্ধু ছোকরা দুটি কে?”

“দুজনেই ভদ্রসন্তান। একজন গান-বাজনার চর্চা করে—অপরটি কলেজে পড়ে।”

“বুঝেছি— তোমার মা ওঁদের ফাঁদে ফেলতে চান, মেয়েদের রূপ দেখিয়ে ও গান শুনিয়ে ঘাড়ে গছাতে চান। ওদের তো কেউ বিয়ে করবে না—তাই এই-সব জোটাচ্ছেন।”

“না, সে দুরভিসন্ধি তাঁর নেই। যেটি আমার সঙ্গী ও সংগীতচর্চা করে, সেটি সুবর্ণবণিক, উপরন্তু বিবাহিত। অপরটি ব্রাহ্মণ বটে—কিন্তু আমাদের সম্প্রদায় নয়, বারেন্দ্র।”

“তোমার মা কি জাত-টাত মানেন?”

“তিনি না মানলে ছোকরা তো মানে।”

“‘যার সঙ্গে যার মজে মন, কিবা হাড়ি কিবা ডোম’। ছোকরাটি দেখতে কেমন?”

“দেখতে বাঙাল। রঙ মেটে, নাক চাপা, চোখ তেরচা।”

এ কথা শুনে পাশের ঘরে দরজার কাছ থেকে কে যেন খিল খিল করে হেসে উঠল। তাকিয়ে দেখি, দরজার পাশে দুটি ছবি দাঁড়িয়ে আছে। সে ছবি যে কত সুন্দর, কত অপূর্ব, তা বলতে পারি নে।

এ হাসি শুনে চেয়ারস্থ ভদ্রলোক চীৎকার করে বললেন, “ও হাসে কে?”

ছনু বললে, “আপনার মেয়ে শ্যামু ও রামু।”

“ওরা তো আমার মেয়ে নয়, তোমার মার মেয়ে। আমার মেয়ে হলে কি অত নির্লজ্জ, অত বেহায়া হত! ও দুটোকে ওখান থেকে দূর করে দাও।”

ছনু বললে, “আমরাও যাচ্ছি। যেরকম চীৎকার করছেন, এর পর কাউকে না কাউকে গালিগালাজ শুরু করবেন।” এই বলে সে আমাদের পাশের ঘরে যেতে ইঙ্গিত করলে।

ছনুর বাবা একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, “প্রবাসে যাবার সময় আমার প্রধান দুঃখ ছিল—তোমার মাকে ছেড়ে যেতে হবে। আর প্রবাসে থেকে সেকালে কী ভালোবাসতুম ওকে! ফিরে এসে আমার প্রধান দুঃখ এই যে, তোমার মার আশ্রয়ে আমাকে থাকতে হচ্ছে ও তাঁর উচ্ছিষ্ট অন্ন খেতে হচ্ছে। নরকযন্ত্রণা লোকে ভোগ করে, দেহে নয়—অন্তরে। আমি এখন দিবারাত্র নরক ভোগ করছি। তুমি আছ বলে আমি বেঁচে আছি, নইলে আত্মহত্যা করতুম—যদি করতে পারতুম। মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকাও কঠিন, মরাও সোজা নয়।”

তাঁর এই শেষ কথাটি শুনে আমরা পা টিপে টিপে পাশের ঘরে গেলুম। সে ঘরে বসবার আসন ছিল, আমরা গিয়ে তাতেই বসে পড়লুম। ছনু বললে, “আমি ভারি দুঃখিত। তোমাদের ডেকে নিয়ে এলুম বেহালা শোনাতে— আর শোনালুম শুধু বিকট চীৎকার। উনি হচ্ছেন আমার পিতা, গিয়েছিলেন আন্দামানে বারো বৎসর পরে ফিরেছেন সম্প্রতি। চোখ দুটি হারিয়েছেন— আর শিখে এসেছেন শুধু চীৎকার করতে ও গালিগালাজ দিতে। বাবা ছিলেন একটা বড়ো ব্যাঙ্কের বড়ো কর্মচারী। শেষটায় ধরা পড়ল যে ব্যাঙ্কের পাঁচ-ছয় লাখ টাকা তহবিল তছরুপ করা হয়েছে। বাবা নিজের অপকর্ম স্বীকার করলেন না, কিন্তু বারো বছরের জন্য সাহেবরা তাঁকে আন্দামান পাঠালেন। আমাদের যা-কিছু সম্পত্তি ছিল ব্যাঙ্ক সব বেচে কিনে নিল। মা একটি ছেলে আর দুটি পাঁচ-ছ বৎসরের মেয়ে নিয়ে একরকম রাস্তায় দাঁড়ালেন। এমন সময় বুলাকির মুখে মা শুনলেন, বাবা তাঁর একটি অন্তরঙ্গ ধনী বন্ধুর নামে লাখ টাকার কোম্পানির কাগজ বেনামী করে রেখে গিয়েছেন। মা গিয়ে তাঁর শরণাপন্ন হলেন, আর তিনিও অনুগ্রহ করে সেই অর্জিত বা অপহৃত টাকা দিয়ে আমাদের ভরণপোষণ করছেন। বাবা যে চুরি করেছেন, এ কথা কখনো স্বীকার করেন নি; সুতরাং এই বেনামী ব্যাপারটাও স্বীকার করেন না। অতএব আমরা গ্রাসাচ্ছাদনের টাকা কোথা থেকে পেলুম-এই প্রশ্ন তাঁর মনে জাগছে। আর সেই জন্যই মার উপর তাঁর এত রাগ বাবার সঙ্গে এক বাড়িতে এখন থাকা অসম্ভব, কিন্তু আমি তাঁকে ছাড়তে কিছুতেই রাজি হলুম না। এই তো ব্যাপার।”

এরপর আমরা দুই বন্ধুতে আস্তে আস্তে সেখান থেকে চলে এলুম। আমার মন ভরে উঠল ছনুর মা’র প্রতি সন্দেহ-মিশ্রিত করুণায়—আর ছনুর প্রতি অবিমিশ্র শ্রদ্ধায়। আর মনে হল—আন্দামান-ফেরত বটে, কিন্তু কুলদাবাবুর তুলনায় তাঁর অবস্থা কত বেশি মর্মস্পর্শী!

তাঁর শেষ কয়টি কথা আজও ভুলি নি—”মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকাও কঠিন, মরাও সোজা নয়।”

শ্রাবণ ১৩৪৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *