জুজুর ভয়
।। এক ।।
বিশু পনেরোয় পা দিয়েছে, কিন্তু মন এখনও তার শিশুর মতো।
পড়াশুনোর নাম করলেই তার গায়ে আসে জ্বর, কিন্তু খেলাধুলো পেলে সে ভুলে যায় আহার এবং নিদ্রা। কেবলই কি খেলাধুলো? শহরতলিতে তাদের বাসা। সেখানে পরের বাগানে চুপিচুপি ঢুকে পাকা পাকা ফল চুরি করতেও সে মস্তবড়ো ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। কেবলই কি ফল চুরি? লুকিয়ে লুকিয়ে পরের পুকুরে মাছ ধরতেও তার মতো লায়েক ছেলে এ তল্লাটে আর দেখা যায় না।
কেবল খাবার আর শোবার সময়ে মনে পড়ে তার বাড়ির কথা। মাথার উপরে বিধবা মা ছাড়া আর কোনো অভিভাবক নেই, তাতেই হয়েছে তার সাপের পাঁচ পা! মায়ের বাধানিষেধ সে গ্রাহ্যের মধ্যেও আনে না।
এই হল বিশুবাবুর একটুখানি পরিচয়।
।। দুই ।।
সেদিন দুপুরবেলায় বিশু যখন মল্লিকদের বাগান থেকে পাঁচিল টপকে বেরিয়ে এল, তখন তার হাতে ছিল এক কাঁদি পাকা কলা।
এদিকে-ওদিকে তাকিয়েই দেখতে পেলে, পথের উপরে আবির্ভূত হয়েছে এমন এক মূর্তি, যার মাথায় আছে লাল পাগড়ি এবং মুখে আছে কালো দাড়ি।
পাহারাওয়ালা!
ছোটো-বড়ো কোনো চোরই যে পাহারাওয়ালাকে পছন্দ করে না, সেকথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বিশেষ করে এই লাল পাগড়ি এবং কালো দাড়ির উপরে বিশুর ছিল দস্তুরমতো জাতক্রোধ।
কারণ বড়ো সামান্য নয়।
গেল মাসে ঠিক এই বাগান থেকেই তার চ্যালা এবং স্যাঙাত নিমাইচাঁদ যখন প্রকাণ্ড একটি কাঁঠাল হস্তগত করে নিরাপদ ব্যবধানে সরে পড়ছিল, তখন এই ছাতুখোর পাহারাওয়ালাটাই তাকে ক্যাঁক করে ধরে থানায় টেনে না নিয়ে গিয়ে ছাড়েনি। এতবড়ো অত্যাচার সহ্য করা অসম্ভব।
এক লাফ মেরে বিশু অদৃশ্য হল পাশের কচুঝোপের আড়ালে এবং দৈবগতিকে সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে ঠেকল একখানা ইটের অর্ধাংশ।
বিশু ভাবলে, পাহারাওয়ালাটা নিশ্চয়ই তাকে দেখে ফেলেছে, নইলে পায়ে পায়ে কচুঝোপের দিকেই এগিয়ে আসছে কেন?
কিন্তু আসলে পাহারাওয়ালা তখন নিজের বাঁ হাতের তালুতে খৈনি রেখে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে মর্দন করতেই ব্যস্ত ছিল, বিশুর টিকিটি পর্যন্ত দেখতে পায়নি। গালের ভিতরে খৈনি গুঁজে সে নিজের মনেই অগ্রসর হতে লাগল।
আচম্বিতে ছুটে এল সেই ইষ্টকের অর্ধাংশ এবং পাহারাওয়ালা ভাবলে তার কপালের উপরে হল বিনা মেঘে বজ্রপাত! পরমুহূর্তে ধুলোয় লুটোতে লাগল তার লাল পাগড়ি এবং কালো দাড়ি।
।। তিন ।।
নিজেদের বাড়ির ভিতরে ছুটে এসে বিশু হাঁপাতে হাঁপাতে বন্ধ করে দিলে সদর দরজা।
মায়ের বিস্ময়ের সীমা রইল না। দুপুরবেলায় বিশুবাবুর প্রত্যাবর্তন! এ যে রীতিমতো অঘটন!
ব্যস্ত হয়ে মা শুধোলেন, ‘ও বিশু, তোর অসুখবিসুখ করেছে নাকি?’
—‘উঁহু!’
—‘তবে এমন সময়ে হঠাৎ বাড়িতে ফিরে এলি যে?’
—‘মা, এখন কিছুকাল আমি বাড়ির বাইরে এক পা বেরুব না।’
—‘বলিস কী রে! হঠাৎ তোর এতটা সুবুদ্ধি হল কেন?’
বিশু নাচারের মতো বললে, ‘বাইরে জুজুর ভয়!’
—‘জুজুর ভয়?’
বিশু ভূতলশায়ী লাল পাগড়ির কাহিনি মায়ের কাছে খুলে বললে।
এ যে শাপে বর! মা মনে মনে বললে, ‘হে মা কালী, হে মা দুর্গা, বিশুর এই ভয় যেন স্থায়ী হয়!’
মুখে বললেন, ‘এ যাত্রা যখন মানে মানে রক্ষা পেয়েছিস, তখন আর কখনও বাড়ির বাইরে যাবার নাম মুখেও আনিসনে!’
বিশু মুখভার করে বললে, ‘খুব কথাই তো বললে মা! অষ্টপ্রহর বাড়িতে বসে বসে করব কী? ধান ভানব?’
—‘ধান ভানবি কেন, বাড়িতে বসে বসে লেখাপড়া কর, ভালো ছেলে হ, আমাদের মুখ উজ্জ্বল হোক।’
।। চার ।।
একে একে তিন দিন কেটে গেল। বিশু দায়ে পড়ে বাড়িতেই বন্দি হয়ে থাকে এবং সময় কাটাবার জন্যে বাধ্য হয়ে বইটই নিয়ে নাড়াচাড়া করে। মায়ের আর আনন্দের সীমা নেই।
কিন্তু চতুর্থ দিনেই বিশুর প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। মাকে ডেকে বললে, ‘মা, একটা কাজ করতে পারো?’
—‘কী কাজ?’
—‘পাড়ায় পাহারাওয়ালাটাকে নিয়ে কোনো গোলমাল হয়েছে কি না, এ খবরটা জেনে আসতে পারো?’
মা বুঝলেন, ছেলের মন এরই মধ্যে উড়ুউড়ু করছে, গতিক সুবিধের নয়। মনে মনে আবার মা কালীকে স্মরণ করে বললেন, ‘হে মা, ছেলের মঙ্গলের জন্যে যদি দুটো মিছে কথা বলি, তাহলে দয়া করে আমার অপরাধ নিয়ো না!’
মা বেরিয়ে গেলেন এবং খানিকক্ষণ পরে ফিরে এসে সভয়ে বললেন, ‘খবর ভালো নয় বিশু!’
—‘কী হয়েছে মা, কী হয়েছে?’
—‘পাহারাওয়ালাটাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে, তার অবস্থা এখন যায় তখন যায়!’
বিশু রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করলে, ‘তারপর?’
—‘পুলিশের বিশ্বাস, পাড়ার কোনো দুষ্টু ছেলে এই কাণ্ড করেছে, তারা চারিদিকে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে!’
বিশুর বুক এমন দমে গেল যে, তার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরুল না।
—‘হ্যাঁ রে বিশু, পাহারাওয়ালাটা কি তোকে দেখতে পেয়েছিল?’
বিশু ক্ষীণস্বরে বললে, ‘বোধ হয় পেয়েছিল।’
—‘তাহলে উপায়?’
বিশু বললে, ‘কিন্তু সে তো আমার নাম জানে না, আমাকে চেনেও না। যদি বাড়ির ভিতর লুকিয়ে থাকি, তাহলে কেউ আমাকে ধরতে পারবে না।’
মা আশ্বস্ত হয়ে বললেন, ‘সেই কথাই ভালো বাবা! বাড়ির ভিতরে থাক, লেখাপড়া কর!’
।। পাঁচ ।।
হঠাৎ বিশুর মতিগতির পরিবর্তন দেখে পাড়াপড়শিরা বিস্মিত! লোকের মুখে মুখে বিশুর সুখ্যাতি!
কিন্তু সুখ্যাতি শুনে আর কত দিন চলে? দুই হপ্তা কাটতে না কাটতেই বিশুর চড়ুকে পিঠ আবার সড়সড় করে উঠল। আবার সে মাকে ডেকে বললে, ‘পাহারাওয়ালাটা কেমন আছে, কারুর কাছ থেকে সে খবরটা আর একবার নিয়ে আসতে পারবে?’
মা আবার খবর আনতে বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু মিনিট তিনেক পরেই ছুটতে ছুটতে ফিরে এসে চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘কী সর্বনাশ, কী সর্বনাশ!’
—‘কেন মা, কী হয়েছে?’
—‘ওরে বিশু, পাহারাওয়ালাটা মারা পড়েছে!’
বিশু আঁতকে উঠে বললে, ‘অ্যাঁঃ, বলো কী?’
মা কপালে করাঘাত করে বললেন, ‘আর বলি কী! তুই এইবার খুনের দায়ে পড়লি রে বিশু, আমার অদৃষ্টে কী আছে জানি না।’
বিশু বললে, ‘তোমার কোনো ভয় নেই মা, আমি যদি বাড়ির ভিতরে থাকি, কেউ আমার কিছুই করতে পারবে না।’
মা মনে মনে হেসে মনে মনেই বললেন, ‘ভগবান তোকে সুবুদ্ধি দিন, আর আমার মিছে কথা ক্ষমা করুন।’
।। ছয় ।।
এক মাস কেটে গিয়েছে, বাইরের পৃথিবীর কথা বিশুর কাছে এখন প্রায় অতীতের স্বপ্নের মতো হয়ে উঠেছে।
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় মা রান্নাঘরে বসে চাকি-বেলন নিয়ে পরোটা বেলছেন, এমন সময়ে বিশু হুড়মুড় করে এসে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মাটির উপরে বসে পড়ল। দারুণ আতঙ্কে তার দুই চক্ষু বিস্ফারিত!
মা সচমকে শুধোলেন, ‘ও কী বিশু, তোর মুখ-চোখ অমনধারা কেন?’
—‘আমি তাকে দেখেছি মা, সে আমাকে দেখা দিয়েছে!’
—‘তুই কাকে দেখেছিস রে, কে তোকে দেখা দিয়েছে?’
—‘সেই পাহারাওয়ালার ভূতটা।’
—‘তুই পাগল হলি নাকি?’
—‘না না, পাগল হইনি। অনেকদিন বাড়িতে বন্ধ থেকে থেকে প্রাণটা বড়ো হাঁপিয়ে উঠেছিল। আজ ভাবলুম সন্ধ্যার আবছায়ায় গা ঢেকে চুপি চুপি গলির মোড়টা পর্যন্ত একটু ঘুরে আসি। কিন্তু খানিকটা এগুতে না এগুতেই গলির ঠিক মোড়ে গ্যাসের আলোতে কাকে দেখলুম জানো?’
—‘কাকে?’
—‘সেই মরা পাহারাওয়ালার ভূতটাকে। হতভাগা মরে গিয়েও আমাকে ভুলতে পারেনি, ভূত হয়ে প্রতিশোধ নেবার জন্যে আবার আমাকে খুঁজতে এসেছে। হয়তো এখনই বাড়ির ভিতরে এসেই হাজির হবে। আমি এখন কী করি মা, কোথায় লুকোই বলো দেখি?’
বিশুকে তাড়াতাড়ি নিজের কোলের ভিতরে টেনে নিয়ে মা সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘কোনো ভয় নেই! পাহারাওয়ালারা রাস্তায় থাকে, তাদের প্রেতাত্মাও রাস্তা ছেড়ে কারুর বাড়ির ভিতরে ঢুকতে পারে না।’
সেইদিন থেকে বাড়িই হল বিশুর কাছে সুরক্ষিত দুর্গের মতো।
তার এই ভ্রান্তি কতদিন স্থায়ী হয়েছিল জানি না, কিন্তু জুজুর ভয়ে দায়ে পড়ে কিছুদিন পড়াশুনো করতে করতে শেষটা সত্যসত্যই লেখাপড়ায় তার মন বসে গেল।
___
বিদেশি গল্পের সামান্য ছায়া আছে।