জুকারবার্গের দুনিয়া

আমার এক শিশুশিল্পীর নাম রুদ্র। এখন সে শিশুশিল্পী থেকে বালক-শিল্পী হয়েছে। বয়স বেড়ে এগারো হয়েছে। একদিন সে আমাকে টেলিফোন করে বলল, ‘স্যার আংকেল (শিশুশিল্পীরা অন্যদের মতো আমাকে স্যার ডাকে না। স্যার আংকেল ডাকে), আপনি কি ফেসবুকে আছেন?’
থতমত খেয়ে আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, না। তুমি কি আছ?
রুদ্র উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘হ্যাঁ।’ আপনি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেই আপনাকে ফ্রেন্ড বানাব।
রুদ্রকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো হয়নি। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর প্রথম শর্ত ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট থাকা, তা আমার নেই। তবে সুখের ব্যাপার, আমার নামে সাতটি অ্যাকাউন্ট আছে। এই অ্যাকাউন্টগুলো আমার হয়ে সামাজিক সৌহার্দ্যবিষয়ক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সৌহার্দ্যবিষয়ক কর্মকাণ্ড হলো, মিথ্যা হুমায়ূন আহমেদ তরুণী মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সাহিত্য আলোচনা করছেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে বৃষ্টিস্নান এবং জ্যোৎস্নাস্নানের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।
এক তরুণী সেই হুমায়ূন আহমেদকে স্যার সম্বোধন করায় তিনি রাগ করে লিখলেন, ‘আমার মনের বয়স বাড়েনি। আমি চিরতরুণ। তুমি আমাকে ভাইয়া ডাকবে, কেমন?’
ফেসবুকের নামে আমরা কি ধীরে ধীরে এক অলীক জগতের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছি না? মিথ্যাকেই সত্য ভাবছি। এক ধরনের ডিজিটাল রোগের শিকার হচ্ছি। রোগটির নাম ডিলিউসন।
জীবনীগ্রন্থ সাহিত্যের একটি ধারা। জীবনীগ্রন্থকে বলা হয়_’অতি উত্তমরূপে ধোলাইকৃত আত্মকাহিনী।’ ফেসবুককে তাহলে কী বলা হবে? ভানের কথামালা?
অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশক মাজহারের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তাঁর একটি ছবি আছে। ছবিতে মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুলের এক যুবা পুরুষ। চুলের স্তূপ দেখলে যেকোনো নাপিত উল্লসিত হবে। সমস্যা হচ্ছে, মাজহারের মাথায় এখন অল্প কয়েকগাছি চুল। আধা ঘণ্টার মধ্যে চুলগুলো গুনে ফেলা যাবে।
আমার পরিচিত একজনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট পড়ে জানলাম, সে অবিবাহিত। তার শখ দেশভ্রমণ। পৃথিবীর নানা দেশ সে ভ্রমণ করেছে। চমৎকার একটি গাড়িতে হেলান দিয়ে সে একটি ছবি আপলোড করেছে। নিচে লেখা_আমার নতুন গাড়ি। যার কথা বলা হচ্ছে সে দুই সন্তানের জনক। তার বিদেশভ্রমণ আগরতলা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তার কোনো গাড়ি নেই।
এসব ফেসবুকের মূল উদ্দেশ্য কী? আমার কাছে পরিষ্কার না। স্বামী ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলবেন, স্ত্রী খুলবেন। দুজন দুজনের বন্ধু হবেন এবং ফেসবুকের মাধ্যমে গল্পগুজব করবেন?
আমরা শহরবাসী পাশের ফ্ল্যাটের মানুষজনকে চিনি না এবং তাদের চেনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ বোধ করি না। আমাদের আগ্রহ ফেসবুকের বন্ধু সংগ্রহে। আজব অবস্থা না? নতুন নতুন বন্ধু হচ্ছে, বাতিল হয়ে যাচ্ছে, আবার হচ্ছে।
তরুণ ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইবে_ফ্রয়েড সাহেবের তাই অভিমত। বাস্তবে বান্ধবী খোঁজার চেয়ে ফেসবুকে বান্ধবী খোঁজা ভালো। বিপদের আশঙ্কা কম। মেয়েরা আবার অপরিচিত ছেলেদের বন্ধু তালিকায় আনার চেয়ে মেয়েদের এই তালিকায় আনতে আগ্রহী। এখন উপায়?
উপায় আছে। ছেলেরা মেয়ে সেজে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলবে। এতেও যদি কিছু হয়।
উদাহরণ দেই_মেহের আফরোজ শাওনের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। একটি মেয়ে তার বন্ধু হওয়ার জন্য আবেদন করল, মেয়েটির চেহারা অপূর্ব সুন্দর। মায়াময় চোখ। মেয়েটিকে বন্ধু তালিকায় নেওয়ার পর শাওন আবিষ্কার করল ছবিটি এক বিখ্যাত তামিল অভিনেত্রীর। বলাই বাহুল্য, তামিল অভিনেত্রীর পেছনে লুকিয়ে আছে তরুণী সঙ্গলিপ্সু বিকারগ্রস্ত কোনো পুরুষ।
ওয়েবসাইট (ফেসবুকও ওয়েবসাইট) যে নোংরামি ছড়ানোর ডিজিটাল উপায়_তা এখন সবাই নিশ্চয়ই জেনে গেছেন। সেলিব্রেটিদের নোংরা ছবি ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়। সমকাল পত্রিকায় পড়লাম অ্যামেজিং ডটকম নামের ওয়েবসাইটের অ্যামেজিং আড্ডা বাংলাদেশের সেলিব্রেটির নোংরা ছবির আখড়া। যৌনকর্মকাণ্ড অতি নিজস্ব একটি ব্যাপার। যেহেতু এই পত্রিকায় নতুন প্রাণের সৃষ্টি হয় কাজেই প্রক্রিয়াটি পবিত্রও বটে। পবিত্র হলেও অবশ্যই গোপন। এমন একটি বিষয়ের ভিডিও কিভাবে হচ্ছে, কে জানে! তবে যেভাবে হচ্ছে, তাতে মনে হয় এক সময় নোংরা ভিডিও আপলোড করা একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়াবে। একজন আরেকজনকে বলবে, আমার নতুন একটা ভিডিও ক্লিপিং ওয়েবসাইটে এসেছে। দেখেছিস? না দেখলে আমার কাছে মাস্টার কপি আছে।
শাওনকে বললাম, ফেসবুকের ভালো বিষয় কোনটা বলে তোমার ধারণা?
সে বলল, ছোটবেলার বন্ধুদের আমি ফেসবুকে খুঁজে পাই। ওদের ছবি দেখি, ওদের ছেলেমেয়েদের ছবি দেখি। এত ভালো লাগে!
আমি বললাম, তোমার বন্ধুর তালিকায় কতজন আছে?
শাওন বলল, খুব কম।
খুব কম কত?
ছোটবেলার বন্ধু আর নতুন মিলিয়ে চার হাজার সাত শ।
আমি ‘খাইছে রে’ বলে আর্তচিৎকার করলাম।
শাওন বিরক্ত গলায় বলল, এমন করলে কেন? বন্ধুর সংখ্যা যত বেশি হবে তত ভালো। তুমি তোমার কোনো একটা চিন্তা বন্ধুদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারবে।
ভুল চিন্তা যদি হয়?
ভুল চিন্তা ছড়াবে। তবে ভুল চিন্তা ধরা পড়বে। বন্ধুরাই ধরিয়ে দেবে। শুদ্ধ চিন্তা প্রবাহিত হবে। ফেসবুকের মাধ্যমে অতি দ্রুত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা যায়।
কথাটা আমাকে মানতে হলো। গত ইলেকশনের সময় ফেসবুকের কারণে রব উঠেছিল_’যুদ্ধাপরাধীদের ভোট দেবেন না।’ ঘটনা সে রকম ঘটেছে। বর্তমান আরব বিশ্বের দিকে তাকালে ফেসবুকের ক্ষমতা টের পাওয়া যায়।
ফেসবুকের মতো নিরীহ একটি সফটওয়ারে অ্যাটম বোমা লুকিয়ে আছে। পৃথিবীর সব রাজনীতিবিদের সতর্ক হওযার সময় এসে গেছে।
ফেসবুকের জনক জুকারবার্গকে অভিনন্দন।

পাদটিকা
আমাকে নিয়ে একটি মজার ওয়েবসাইট আছে। নাম–হুমায়ূন আহমেদকে না বলুন। একদিন শাওন ওয়েবসাইট খুলে আমাকে দেখাল। আমি প্রভূত আনন্দ পেলাম। মনের আনন্দে সবাই আমাকে গালাগাল করে যাচ্ছে। ওয়েবসাইট দেখে জানলাম, আমার মৃত্যু বাংলাদেশের জন্য একটি শুভ ঘটনা বলে বিবেচিত হবে।
মৃত্যুতেও দেশের জন্য কিছু করতে পারব এটাও তো মন্দ না। কয়জনের সে সৌভাগ্য হয়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *