জীবিকা
যা লিখছি, তাকে ঠিক গল্পই বলা যাবে কি না আমি জানিনে। এবং অতিশয়োক্তি না করেও বলতে পারি, বাংলাদেশের একটি বিশিষ্ট কলেজে, সাহিত্যসভার আমন্ত্রণে, আমি বক্তৃতার কোনও কথাই খুঁজে পাইনি। এই গল্পটিই বলেছিলাম। এক বাঙালি শিল্পীর চরিত্র-চিত্রণও সেটা বলা যায়।
আজই বিশেষ করে কেন সে কথা মনে পড়ল, সেটাও আমার নিজের কাছে খুব বিচিত্র লাগছে। শুধু বিচিত্র বলছি কেন। বরং বলাই ভাল, এটা আমার স্পর্ধা কি না, সে সংশয়ও আছে। আজ ষোলোই সেপ্টেম্বর। গত পরশুদিন ভারতের উপরাষ্ট্রপতি, আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয়, পণ্ডিত, দার্শনিক ডাঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ যে কলেজে গিয়েছিলেন, বছর ছয়েক আগে সে-কলেজেই আমি গিয়েছিলাম। আমার যাওয়াটা এত তুচ্ছ যে, এ রাজকীয় ঘটনার সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। শিয়ালদহ থেকে বহরমপুর স্টেশন পর্যন্ত, সমস্ত মানুষই ১৪ই সেপ্টেম্বর তা প্রত্যক্ষ করেছেন। করাই স্বাভাবিক। এবং কৃষ্ণনাথ কলেজে উপরাষ্ট্রপতি যা বলেছেন, তা আমাদের ভিতরের অবচেতন অনুভূতিরই কথা। গোটা ভারতের ভিতরের সত্যকে এমন করে উদঘাটন করা। তেমন যোগ্যতা যে আমার কানাকড়িও নেই, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবু যে কৃষ্ণনাথ কলেজে তাঁর উপস্থিতির সংবাদ পড়ে আমার সে-কাহিনী মনে পড়ে গেল, সেটা আসলে, আমার তুচ্ছ উপস্থিতিতে আজ আমি অনেক গৌরবান্বিত বোধ করছি। আমি পাশের জেলার প্রতিবেশী বন্ধু হিসেবেই গিয়েছিলাম। আমি সেই অগণিত সাধারণেরই একজন, অসাধারণের ছিটেফোঁটা স্পর্শ পেলেও নিজেকে যে যুক্ত করে গৌরব করতে চায়।
আর এই ভেবেও আফসোস হচ্ছে, সেই গল্প বলার ঝোঁকটা কখনও কাটাতে পারলাম না। আমি তো ধার করেও ছুটি, দেশ কাল এবং সাহিত্যের ওপরে পাণ্ডিত্যপূর্ণ কথা বলতে পারতাম। কিন্তু কথাই আছে, স্বভাব যায় না মলে।
আজ আবার সেই তুচ্ছ গল্পটিরই পুনরাবৃত্তি করছি। আমার ঝুলিতে এই তুচ্ছতাটুকু ছিল। তাই তুলে, উপরাষ্ট্রপতির পায়ে দিই আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে।
কী মাস সেটা, তাও মনে নেই। তবে ক্ষণে বর্ষা, ক্ষণে রোদ, মুর্শিদাবাদের সবুজে সেদিন আলোছায়ার বিচিত্র খেলা। আর বাংলাদেশ, তার বিচিত্র রূপের কথা বলতে গেলেই গলার কাছে একটি আশ্চর্যজনক আনন্দদায়ক বেদনা যেন সব রুদ্ধ করে দিতে চায়। রানির মতো ধনরত্নের সত্যিই তো কোনও বৈশিষ্ট্য তার নেই। মা বলে ডাকতে গেলে কি এমনি হাসি কান্নায় সব ভরে ওঠে? আর আমরা, আমরা এই কয়েক কোটি ভাইয়েরা আমাদের মায়ের থেকে কি কম বিচিত্র?
কয়েকজন ছাত্র বন্ধুর সঙ্গে প্রস্তাব হয়ে গেল, দুপুরেই বহরমপুর থেকে মুর্শিদাবাদের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া হবে। এবং সেটা ঘোড়ার গাড়িতে। যে কখনও অমন করে যায়নি, তাকে কেমন করে বোঝাব, সে-যাওয়াটা কী? পালকি গাড়ি আমাদের ছুটল সেই পথ ধরে, যে পথে বহু ঐতিহাসিক যাত্রার পদচিহ্ন এখনও খুঁজলে পাওয়া যাবে।
কিন্তু ইতিহাস থাক। মাইলের পর মাইল জুড়ে অমন পদ্মফুলের বিল আর কোথাও দেখিনি। কিন্তু সে পদ্ম থাক, বিল থাক। সেদিন হাজারদুয়ারির প্রাঙ্গণে তার দেখা পেলাম।
একদিকে গঙ্গা, আর একদিকে প্রান্তর জুড়ে বৃদ্ধ ইতিহাসের অবনত মাথা। ইংরেজদের তৈরি পোষানবাবের প্রাসাদের মধ্যে আছে জাদুঘর। দেখতে যাবার আগে, একটি জংধরা কামানের গায়ে হাত দিলাম। ভাবলাম, এ কামানটি হয়তো একদা বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। ঠিক সেই সময়েই শুনতে পেলাম, ও কামানটা বেইমানের কামান বাবু। ওটা আমাদের নয়।
সেই ভরাট প্রায় সুরেলা গলা শুনে চোখ তুলে তাকালাম। একটি মাঝারি লোক। হয়তো চাষি। পরনে একটি এক-রং লুঙ্গি। গায়ে বোতামখোলা ময়লা হাফ শার্ট। হাতে একটি বোধহয় হাঁড়ি, মুখে সরা ঢাকা, নতুন একখানি গামছা দিয়ে বাঁধা। বয়স বুঝি পঁয়ত্রিশের মতো। উশকো খুশকো চুল। দুটি ভাসাভাসা সুন্দর চোখ। দৃষ্টিতে কোথাও তীক্ষ্ণতা নেই, তীব্রতা নেই। একটি আশ্চর্য গভীরতা আছে।
জিজ্ঞেস করলাম, কী বললেন?
কাছে এল লোকটি। বলল, বলছি কী বাবু, এ কামানটা সিরাজের কামান নয়। এটা কী বাবু, জানেন? এটা হল আপনার সিরাজ-মারা কামান, ইংরাজের দেওয়া তাঁবেদার নবাবের কামান। বুঝলেন কি না বাবু? আপনি হয়তো উলটা ভেবে বসে থাকবেন, তাই বললাম। বাবু। টো বেইমানের কামান।
লোকটি আমার চোখের দিকে তাকাল। দুটি কথা বলল, আর মুহূর্তে আমার মনোহরণ করল। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি জানেন?
একটি আশ্চর্য সুর তার গলায়। ইতিহাসের ব্যথিত হাসিটি দেখলাম তারই ঠোঁটে। বলল, জানব না বাবু? জন্মে ইস্তক তো এই দেখছি। এই যে মোকাম দেখছেন এখন জাদুঘর, আর এই যে কামান দেখছেন, এ যে বাবু বেইমানির পুরস্কার।
অবাক লাগল লোকটির কথা শুনে। তার কথার উচ্চারণ ও সুর খাঁটি মুর্শিদাবাদি। অনেকটা বুঝি বাউলের গানের মতো। লিখে তাকে ব্যক্ত করা যায় না। আর তার বলার মধ্যে কেমন একটি করুণ হাসিভরা বিষণ্ণতা।
তারপরই সে জিজ্ঞেস করল, কোথা থেকে আসছেন আপনারা বাবু? সবচেয়ে যেটা সোজা, সেটাই বললাম, কলকাতা।
সে বলল, ভাল করেছেন বাবু এসে। একটু দেখেন সব ঘুরে ফিরে। আসছেন তিন চারজন, সব ঘুরে ফিরে দেখে যান। একটা কথা বলব বাবু?
.
এই অনুমতি চাওয়ার মধ্যে একটি সুন্দর গ্রামীণ আভিজাত্য ছিল। আর কী মিষ্টি তার বলার ধরন। নাম কী এর? মনোহর?
বলুন।
বলছি কী যে, আপনার পকেটে দেখছি কলম রয়েছে। আমার পোস্টকার্ডে একখানি ঠিকানা লিখে দিতে পারবেন ইংরেজিতে?
নিশ্চয়।
পকেটে হাত দিয়ে সে পোস্টকার্ডখানি বার করে বললে, না, মানে, আবার বিরক্ত হবেন কি না, তাই ভাবলাম। আপনার বন্ধু জাদুঘরে যাবার টিকিট কাটতে গেলেন তো। যদি দেরি হয়ে যায়। না হয় ফিরে এসেই লিখে দেবেন।
আমি হাত বাড়িয়ে বললাম, না। দিন লিখে দিচ্ছি।
পোস্টকার্ডখানি কামানের ওপর রেখে লিখতে গিয়েও কেন যেন পারলাম না। কামানটা বেইমানের। এ কথাটি বার বার মনে হতে লাগল। তাই সামনের দেয়ালের দিকে অগ্রসর হতে গেলাম, লোকটির গা ঘেঁষে।
লোকটি যেন একটু চমকে উঠেই, হাঁড়িটা সরিয়ে নিল। আমি তাকালাম। সে হাসল। বলল, সাবধানের তো মার নাই বাবু, কার নসিবে কখন কী থাকে, তা কি বলা যায়?
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন বলুন তো?
সে বলল, না ভয় কিছু নয়। এই হাঁড়িটার কথা বলছি। মুখ আমি সরা দিয়ে ঢেকে রেখেছি। গামছা দিয়ে বেঁধেছি। তা ছাড়া আসল বস্তুটি আছেন আমার কাছে। কোনও ভয় নাই।
কী আছে আপনার ওই হাঁড়িতে?
–একখানা কালী গোখরো বাবু।
আমার গাটা যেন কেমন করে উঠল। আমি বললাম, কালী গোখরো?
–হ্যাঁ বাবু। খবর ছিল কিনা কাল রাতে, ওই গঙ্গার ওপারে এক গাঁয়ে। বাইরের থেকে উনি একজনের ঘরে গিয়ে বসেছিলেন। সারারাত এয়াঁর সঙ্গে ঝুটোপুটি লড়াই গেছে বাবু। তবে মা ধরা দিলেন ভোরবেলা। এই ধরে নিয়া আসছি। বিষ ঝাড়াই না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস নাই। তাই সাবধান হলাম একটু।
ইতিমধ্যে জাদুঘরে যাবার তাড়া দিল বন্ধুরা। যদিও তারাও লোকটির সঙ্গে আলাপে ভিড়ে পড়েছিল।
লোকটি বলল, নিন, ঠিকানাটা লিখে দিন বাবু একটু কষ্ট করে। লিখুন জনাব ইদ্রিস শেখ। গ্রাম। পোস্ট অফিস জেলা।
লিখতে লিখতেও আমার মনটা কালী গোখরোর দিকেই চলে গেছে। ঠিকানা লিখে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি সাপ ধরেন বুঝি?
সে বলল, সব সময় নয় বাবু। এক গুরুর সঙ্গ করেছিলাম, বিদ্যেখানি জানা আছে। তা বাবু। বিদ্যের কথায় না আছে, যত করিবে দান তত যাবে বেড়ে? মানুষের বিপদ-আপদের কথা শুনলে তো চুপ করে থাকা যায় না। থাকা যায় কি বাবু?
বললাম, না। কিন্তু আমি আপনার কালী গোখরো দেখব।
–দেখবেন বাবু?
–হ্যাঁ, দেখান না একটু।
–হাজারবার দেখাব বাবু আপনাকে।
বলেই সে যেন কেমন মুগ্ধ স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে তাকাল আমার দিকে। বলল, বাবু, একটা কথা বলব?
আমার যেমন মন ঠিক সেই ভেবেই পকেটে হাত দিলাম। পয়সা, নিশ্চয় পয়সা। বললাম, বলুন।
সে বলল, আপনাকে আমার বড় ভাল লেগেছে বাবু।
আমি মুঠো করে পয়সা তুললাম, যাতে সে দেখতে না পায়। কিন্তু সেও পকেট থেকে একটি সরু গাছের ডাল বার করল। বলল, বাবু, এটা আপনাকে দিলাম, আপনাকে আমার বড় ভাল লেগেছে।
–এটা কী?
ইনিই সব বাবু। সংসারে মনসার ভয়টা বাবু ছোট মনে করবেন না। কিন্তু এটি সঙ্গে থাকলে, আপনার কোনও ভয় নাই। এটি রাখেন আপনি বাবু, আপনাকে দিলাম। মনসা আপনার কখনও কিছুটি করতে পারবে না। খালি একটি কথা বাবু, মনে করে রাখবেন, বুঝলেন?
কী?
–সেটা হল কি বাবু, সব জীবের একটি জীবধর্ম আছে তো? আছে না বাবু?
—-আছে।
মা মনসারও জীবধর্ম আছে। সেইটে মনে রাখবেন, ওয়াঁর জীবধর্মের বেলায় ও ওষুধটি আপনি কাজে লাগাবেন না। তা হলে জীবের দুঃখু হয়। হয় না বাবু?
–হ্যাঁ, হয়।
তাই বলছিলাম কী যে, যেখানেই মনসা বিপদ ঘটাবেন, সব জায়গায় আপনি যেতে পারবেন। কিন্তু ধর্ম বজায় রেখে যাবেন বাবু। এ ওষুধ সঙ্গে নিয়ে যাবেন, রুগিকে ছোঁয়াবেন, বেটে খাওয়াতেও পারেন। বিশ্বাস অবিশ্বাস বাবু আপনার হাতে। আর একটা কথা বলি বাবু?
বলুন।
–বিপদের কথা শুনলে যাবেন না। ডাকলে যাবেন। আপনার মা আছেন বাবু?
—আছেন।
-মায়ের হাতে একটু দুধ খেয়ে যাবেন।
যদিও মনসা নিয়ে আমার মনে কোনও কুসংস্কার নেই, সাপকে আমি সাপের মতোই হিংস্র দেখি। তবু লোকটির কথার মধ্যে যেন একটি জাদু ছিল। অবিশ্বাস করেও, তাকে আমি বিদ্রূপ করতে পারলাম না। তার কথার মধ্যে যেন কী ছিল।
দুধ খাওয়ার কথায় আমি বললাম, কেন?
সে বলল, বাবু, মায়ের বাড়া কে আছেন সংসারে। তাঁর হাতের দুধ খেলে বাবু সব লড়াইয়ে জয় হয়। এটা জানবেন।
জাদুঘরের টানটা ভুলতে পারছিলাম না। কিন্তু চলেই বা যাই কেমন করে? আমার মন তো মানে না। কারণ লোকটি দু চোখ মেলে যে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বললাম, এই ওষুধের জন্য আপনাকে কী দিতে হবে?
সে মস্ত বড় জিভ বার করে হাসল। বলল, আরে বাবা! কী বলেন বাবু। অমন পাপ কখনও করতে আছে? ওটা আমাদের সাপুড়ে ধর্মে বারণ। ও বিষহরির দান। ও কি কিছু দিয়ে পাওয়া যায় বাবু? আপনাকে আমি দিলাম। আপনাকে আমার বড় ভাল লেগেছে বাবু।
কেন? মুর্শিদাবাদের এ ধ্বংসাবশেষ দেখতে আসা অনেক মানুষের মধ্যে, আমাকেই কেন ভাল লাগল? কিন্তু সেকথা জিজ্ঞেস করতে পারলাম না।
লোকটি নিজেই তাড়াতাড়ি বলল, যান বাবু, জাদুঘর দেখে আসেন। সিরাজের তলোয়ারখানা দেখবেন বাবু। আলিবর্দির চারনলা পিস্তল দেখতে চাইবেন কিন্তু।
তা তো দেখবই। কিন্তু লোকটি শুধু দান করেই চলে যাবে। বললাম, আপনি কালী গোখরো দেখালেন না তো?
অমায়িক হেসে বলল, জাদুঘর দেখে আসেন বাবু, কালী-গোখরো আপনাকে না দেখিয়ে বাড়ি যাব না। আমি থাকব আপনার জন্য।
মনটা আমার খারাপ হয়ে গেল। হয়তো লোকটি এখনও কিছুই খায়নি। তার মুখটি কেমন করুণ দেখাচ্ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসা তার চোখের মধ্যে আমি যেন একটি লুকোনো কান্না দেখতে পেলাম। কেন, কে জানে। আমাকে যেন সে কেমন একটি বেদনাদায়ক সম্মোহনে বেঁধে ফেললে।
বললাম, না না, আপনি কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন। আপনি
সে বলল, বাবু, বাড়ি আমার কাছেই। যখন খুশি যেতে পারব। আপনি ঘুরে আসেন। একটু এদিক ওদিক যেতে পারি। এখানকার কাউকে জিজ্ঞেস করবেন, দুলাল আলি কোথা গেল, বলে দেবে।
দুলাল আলি?
–হ্যাঁ বাবু। আমার নাম।
যেন মিলিত হিন্দু মুসলমানের নাম বলে আমার মনে হল। বললাম, এমন নাম তো কখনও শুনিনি।
দুলাল আলি হাসল। বলল, আমার বড় ভায়ের নাম কালআলি। আমরা দু’ভাই। বাবার নাম কেষ্টআলি। তবে জাদুঘর থেকে বেরিয়ে যদি কাউকে আমার কথা জিজ্ঞেস করেন, সে যদি বলে, কোন দুলাল আলি যে গান গায়?’ তবে বলবেন, হ্যাঁ।
দুলালের ভাসা ভাসা চোখ দুটিতে লজ্জা চাপতে দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম, গান জানেন বুঝি আপনি?
দুলাল বলল, বলতে লজ্জা করে বাবু। কিছু মনে যেন করবেন না। আপনাকে আমার বড় ভাল লেগেছে। আপনাকে যদি সময় থাকে, তবে আপনাকে একখানি গান শোনাব বাবু। শুনবেন তো?
আমি বললাম, নিশ্চয়; আপনি বসুন তা হলে, আমি ঘুরে আসছি।
হাঁ বাবু যান, ঘুরে দেখে আসেন। আর মোহনলালের তলোয়ারখানিও দেখে আসবেন বাবু। বললে দেখাবে, না বললে হবে না। মোহনলালের তলোয়ার না দেখলে, জীবন বেরথা বাবু।
দুলাল আলি সত্যি জাদু করল। তাকে পিছনে রেখে দিয়ে জাদুঘরের টান কমে গেল আমার। যদিও তার কথা অনুযায়ী সব জিনিসই দেখলাম। কিন্তু আলিবর্দি, সিরাজ, মোহনলাল, মিরজাফর, ক্লাইভ আজ থাক। প্রায় দেড়ঘণ্টা পরে, প্রাসাদ ঘুরে যখন বাইরে এলাম, ভাবলাম, দুলাল আলি এতক্ষণ নিশ্চয় চলে গিয়েছে।
কিন্তু সে একটি বেঞ্চিতে শুয়ে ছিল। যেন আমার পায়ের শব্দ চিনে ফেলছিল। উঠে বসে, সেই মনোহরণ হাসিটি হাসলে। বললে, দেখলেন বাবু?
–হ্যাঁ।
এবার কোথায় যাবেন?
আপনার গান শুনব, আপনার কালীগোখরো দেখব।
দুলাল আলি হেসে বলল, চলেন তা হলে ওই মাঠের মাঝখানটিতে গিয়ে বসি।
বন্ধুদের সঙ্গে দুলালকে নিয়ে গঙ্গার ধার ঘেঁষে মাঠে গিয়ে বসলাম।
দুলাল বলল, আগে গেয়ে নিই বাবু, কেমন? ইচ্ছে বাবু অনেক ছিল। রাত পোহালে পেটের চিন্তা, তাই ওস্তাদের ঘর করেও গানের লাইনে যেতে পারলাম না। যাই হোক, শোনেন।
ভৈরবী সুরে একটি প্রেমের গান গাইল সে।
আমি ছাড়িতে পারি না
এ বড় বেদনা।
সখি তোমারো যাতনা
রাখিতে পার না
হৃদয় বড় অকুলানো হে।
গানের শেষে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না, বিয়ে করেছেন?
দুলাল সলজ্জ হেসে বলল, বাবু অন্যায় করেছি, মন মানেনি, তাই দু’সন হল ও আকামখানি করেছি।
–আকাম কেন?
–আকাম নয় বাবু? কাল রাতে তাঁকে কাঁদিয়ে বেরিয়েছি। এখনও তার চুলোয় কাঠ পড়েনি।
বলতে বলতেই সে হাঁড়ির নতুন গামছা খুলে, সরা তুলে নিল। মুহূর্তে যেন একটি কালো কুচকুচে আগুনের শিখা ফুঁসে উঠল। কালী গোখরোই বটে। আমরা সবাই প্রায় লাফ দিয়ে সরে গেলাম।
দুলাল চিৎকার করে বলল, আইরে মা মনসা, অমন করিস কেন লো?
বলে সরা দিয়ে সাপের মাথাটি নামিয়ে দিল। সাপটি মাথা নামিয়ে নিল হাঁড়ির মধ্যে। তারপরে আমার দিকে ফিরে, প্রায় মধুর স্বরে ডাকল, আসেন বাবু, আপনি আসেন।
আমার সারা গায়ে যেন কালো কুচকুচে সাপটার স্পর্শ লাগছিল। আমি বললাম, থাক না, এখানেই তো বেশ আছি।
দুলালের দু চোখে সম্মোহন। তার সেই ভাসাভাসা চোখ দুটিতে জাদু ফুটিয়ে বলল, কোনও ভয় নাই আমার বাবুর। আমি আছি না? আসেন।
গেলাম পায়ে পায়ে। সে তার পাশটি দেখিয়ে বলল, বসেন আমার কাছে। আমি তার গা ঘেঁষে। বসলাম। দুলাল প্রায় আমার কানে কানে বলল, বাবু, আপনাকে আমার বড় ভাল লেগেছে। আমি আপনাকে আর একটি দ্রব্য দেব। আপনি নেবেন তো?
-কী দ্রব্য?
–নেবেন তো?
নেব।
তখন দুলাল তার পকেট থেকে ছোট একটি থলি বার করে, তার ভিতর থেকে যেন কী একটি জিনিস খুঁটে বার করল। বলল, হাত পাতেন বাবু।
হাত পাতলাম। সে আমার হাতে কী একটি জিনিস দিয়ে বলল, একবার দেখে মুঠ করেন।
দেখলাম। বুঝলাম না কিছুই। অতি ক্ষুদ্র একটি জিনিস। জিজ্ঞেস করলাম, কী এটা?
দুলাল বলল, দেখতে কেমন জিনিসটি দেখেছেন বাবু? শিবলিঙ্গের মতন নয়?
দেখলাম, সত্যি তাই। প্রায় হুবহু একটি খুব ছোট, শিবলিঙ্গেরই মতো জিনিসটি। কিন্তু পাথর নয়, কোনও ধাতু নয়, মাটি নয়। এটা কী?
দুলাল বলল, বাবু এটি শিবফল। এর নাম শিবফল। অর্জুনের ফুলের ভিতরে ইনি থাকেন। এ পাওয়া কঠিন। সব সাপুড়ের কাছে যাবেন না। মনসার অব্যর্থ ওষুধ, এর ওপরে আর কিছু নাই জানবেন। কিন্তু এর একটা নিয়ম আছে বাবু, সেটা দয়া করে, কষ্ট করে মানবেন। মানবেন তো বাবু?
কী সেটা?
–মা মনসার একটু পুজো দেবেন বাবু। মনে যা-ই থাক, এক বারটি ডেকে একটু পুজো দেবেন। বলবেন, তুমি আমায় দিয়েছ, আমি তোমাকে দিলাম। তোমার আমার এই রফা।
বলেই সে হাঁড়িতে একটা খোঁচা দিল। আবার সেই কালো আগুনের শিখা ফুঁসে লকলকিয়ে উঠল আমার বুক পার হয়ে।
আমি সরে যাচ্ছিলাম। দুলাল বলল, যাবেন না বাবু, একটুখানি পেত্যয় করেন। এই নাগিনীর মাথায় আপনি শিবফলের হাত রাখেন।
আমার বুকের রক্ত তখন হিম। গলা শুকিয়ে কাঠ। বললাম, পারব না ভাই।
–পারবেন বাবু। আপনি আমার বাবু, আমি আছি না? আপনাকে যে জিনিস দিয়েছি, আপনার কোনও ভয় নাই। বিষ দাঁত ওর ভাঙা হয় নাই বাবু, ওর জিভে বিষ আছে। তবু বলি, আপনি হাতখানি রাখেন ওঁয়ার মাথায়। একবার দেখেন।
আমি দুলালের চোখের দিকে তাকালাম। সেই সম্মোহনের হাসি। আমি হাত এগিয়ে নিয়ে গেলাম সেই উদ্যত, সদ্যধরা কালী গোখরোর মাথায়। স্পর্শ করলাম। আর মনে হল আমার শিরদাঁড়ায় যেন কিলবিলিয়ে কিছু নামছে।
দুলাল বলল, দেখেন বাবু।
দেখলাম সাপটি ফণা গুটিয়ে হাঁড়িতে নামছে। দুলাল আমার হাতটি ধরে, হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে, চেপে ধরল একেবারে সাপটির মাথায়। প্রায় যেন চুপিচুপি বলল, কোনও ভয় নাই। কোনও ভয় নাই। আপনি বলেন, বলেন, আমার হাতে কী আছে, তুমি দেখ।’ বলেন বাবু।
আমি বললাম।
দুলাল আবার বলল, বলেন, মা, আমি তোর পুজো দেব।’
তখন আমার হাতের তলায় কালী গোখরো কিলবিল করছে। আমি বললাম।
দুলাল বলল,বাবু, কোনও ভয় নাই। একটা নিয়ম হল পুজোর কথাটি বলতে হয়। কত পুজো দেব, সেটাও মাকে বলে দেন। যা আপনার মন চায়। এক পয়সা, দু পয়সা, যা মন চায়।
কেন জানি না; তখন আমার মনটা কেন যেন নিঃশঙ্ক হয়ে গেছে অনেকখানি। বললাম টাকা দেড়েক দেব।
দুলালের ভাসা ভাসা চোখ দুটি হাসিতে ভরে উঠল। বলল, জানি আমি, বাবুর আমার দিল অনেক বড়।
আমি হাত তুলে নিলাম। আমর বন্ধুরা উৎকণ্ঠিতভাবেই হাসছিল। আমি দুলালের চোখের দিকে তাকালাম। আমি দেখলাম আমার সামনে এক অসামান্য শিল্পী। এক আশ্চর্য কথার জাদুকর। কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকের ঘরে বসে ওই কথাশিল্পী কোনওদিন তার বইয়ের সংস্করণের হিসেব করবে না। কিন্তু চিরদিন মনোহরণ করবে। এমন অধ্যবসায় আমরা কতটুকু দেখেছি। বেইমানের কামান দিয়ে দুলাল শুরু করেছিল, এখন দেখলাম, দুলালের চোখের ওপরে এক অসহায় আর্ত ক্ষুধার্ত শিল্পীকে।
বললাম, পুজো আর কে দেবে? টাকাটা আপনি নিন, আপনি পুজো দেবেন। দুলালের দুটি ভাসা-চোখে অপার আলো। বলল, আপনি বললে তো আমি না করতে পারব না বাবু।
টাকা দেড়টি তার হাতে দিয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় হলাম। আমি জানি বুদ্ধির দরবারে আমি একটু ইমোশনাল। দুলালের হাসিটি তখন প্রায় কান্নায় রূপান্তরিত হচ্ছে এবার যে তার ঘরের চুলোয় আগুন জ্বলবে, সেই জন্যে।
আমার বন্ধুরা আমাকে অনুসরণ করল। একটু দূরেই লুঙ্গি পরে খালি গায়ে একটি লোক দাঁড়িয়েছিল। দেখলাম তার মুখে বাঁকা হাসি, চোখে বিদ্রূপ। সে বলল, দুলালের মনসার পুজো দিলেন বাবু?
-হ্যাঁ।
–আর বললে বুঝি, সদ্য ধরে নিয়ে আসা বিষদাঁতওয়ালা কালী গোখরো?
–হ্যাঁ।
–শালা, সেই বুড়ি সাপটা দেখিয়ে চিরদিন এক খেলাই দেখিয়ে গেল। জমি নেই, জিরেত নেই, এখন ওই হয়েছে পেশা!
আমরা লোকটার কাছ থেকে সরে গেলাম। জমি নেই, জিরেত নেই, তাই দুলাল এখন কথার জাদুকর। দুলালকে আমি শিল্পী বলেই জানি। আর এই ভূমিহীন কৃষক দুলালকে দিয়ে আমি আজ নতুন করে উপরাষ্ট্রপতির বাণীর সারমর্মটুকু বুঝলাম, আমাদের দেশের সংকট বাইরে নয়, ভিতরেই।
হ্যাঁ ভিতরেই, এমন কী আমাদের এই বাংলার ভিতরেও; এই দুলালের মতো মানুষেরা যখন আছে।