জীবন, সমাজ ও সাহিত্য
কলাবিদেরা বলেন, যেখানে Photography-র শেষ; সেখান থেকেই চিত্রকলার শুরু। যেখানে কথার শেষ, সেখান থেকেই সুরের আরম্ভ। প্রয়োজন ছাড়িয়েই সৌন্দর্যের প্রতিষ্ঠা, নকশা অতিক্রম করেই সাহিত্যের সৃষ্টি। স্বাভাবিক ভঙ্গির অস্বীকৃতিতেই নৃত্যের উদ্ভব। কাজেই কলা মাত্রেই কৃত্রিম। তুচ্ছকে উচ্চ করে তোলা, ক্ষুদ্রকে বৃহৎ করা, কৌৎসিত্যে লাবণ্য দেয়া, সরলকে জটিল করা, ঋজুকে বক্র করে তোলা, সামান্যকে অসামান্যতা দেয়া, অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা কলা-শিল্পীর দান। যা নেই তা সৃজন করা, যা কাম্য তা পাইয়ে দেয়াই শিল্পীর দায়িত্ব। অতএব, স্বাভাবিকতায় শিল্প নেই। অতিক্রান্ত স্বভাবই শিল্পকলা। তাই শিল্পীমাত্রেই স্রষ্টা। এবং স্রষ্টা কখনো অনুকারক হতে পারেন না। অথবা কোনো অনুকারকই স্রষ্টার সম্মান পান না। অতএব সৃষ্টি মাত্রেই মৌলিক।
যা আছে তা নয়, যা থাকা উচিত, যা শ্রেয় কিংবা প্রেয়, এমনকি যা প্রয়োজন তার স্বপ্ন দেখা, অন্যের মনে সে-স্বপ্ন জাগিয়ে তোলাই শিল্পীর ব্রত। এই অর্থে সাহিত্যাদি কলা একাধারে জীবন স্বপ্নের উৎস, আধার ও প্রতিচ্ছবি। অতএব, শিল্পকলা চিরকালই জীবন-স্বপ্নের রূপায়ণ ঘটিয়েছে, জীবনের প্রয়োজনই মিটিয়েছে। কাজেই Art for arts sake বলে যে-বাজে কথাটা রটেছিল, তাতে না ছিল ইতিহাসের সমর্থন, না ছিল শিল্পবোধের পরিচয়।
কেননা মানুষের কোনো কর্ম বা আচরণ প্রয়োজন-নিরপেক্ষ হতে পারে না। এ প্রয়োজন অবশ্যই মানস অথবা ব্যবহারিক হবে। এ প্রয়োজন নিয়ম-নীতি-নিয়ন্ত্রণ মানে না এবং মানুষে মানুষে তা অভিন্নও নয়। এ প্রয়োজন স্কুল কিংবা সূক্ষ্ম, বাহ্য কিংবা আন্তর, বৈষয়িক কিংবা মানসিক, পার্থিব কিংবা আধ্যাত্মিক হতে পারে। তাই এ প্রয়োজন বিচিত্র ও বহু। মানুষের জীবনবোধ ও প্রয়োজনবুদ্ধি বিশ্বাস, সংস্কার, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অজ্ঞতা, বিস্ময়, কল্পনা, বোধ, বুদ্ধি, ভীতি, সাহস, ভাব-চিন্তা, উপলব্ধি, উপযোগবুদ্ধি, রূপচেতনা প্রভৃতি অনেক কিছুর উপর নির্ভরশীল। সেজন্যেই তা আপেক্ষিক। এগুলোর আনুপাতিক উপস্থিতি ও অভাবই মানুষের জীবনবোধে ও শ্ৰেয়োচেতনায় বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন দান করে। তাই কারো ভাল কারো কাছে মন্দ, একের কাছে যা অপরিহার্য, তা-ই অন্যের কাছে বিলাস মাত্র। ফলে সমাজে, সাহিত্যে, শিল্পে ও দর্শনে জীবনবোধের ও জীবনদৃষ্টির প্রকাশ বিচিত্র ও বহুধা। এজন্যেই শিল্প, সাহিত্য ও দর্শনকে জাতীয়, ধর্মীয়, নৈতিক কিংবা সামাজিক রূপ দেয়ার নির্দেশ দান নির্বুদ্ধিতায় পরিচায়ক। কেননা জীবনবোধ ও উপযোগবুদ্ধি ফরমায়েশে তৈরি হয় না। চেতনানুসারেই মানুষের ভাব-চিন্তা-কর্ম অভিব্যক্তি পায়। ফলে কেউ জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ, কেউ ধর্মীয় বোধে অনুপ্রাণিত, কেউ সমাজচিন্তায় বিব্রত, কেউবা জীবনের নৈতিক গুরুত্বে আস্থাবান। তাই সবাইকে নির্দেশে নিবর্ণ করার অভিপ্রায় শিল্পতত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান প্রজ্ঞা-মননের দৈন্যপ্রসূত। মানুষ মেশিন নয়, কাজেই তার কাছে অভিন্ন ভাব-চিন্তা-কর্মের পৌনপুনিকতা কিংবা অভীষ্ট রূপ বা ফল, আশা করা বাতুলের দিবাস্বপ্ন মাত্র।
অতএব শিল্পমাত্রেই প্রয়োজন প্রসূত। কলার উদ্ভবতত্ত্বেও পাই এ তথ্য। গান থেকেই সাহিত্যের বিকাশ। শ্রমসাধ্য যৌথ কর্মের অনুষঙ্গ হিসেবেই গানের উৎপত্তি। তেমনি যাদু ও সর্বপ্রাণতত্ত্বে আস্থাবান মানুষের বাঞ্ছা-সিদ্ধির অবলম্বন হিসেবে উদ্ভূত নৃত্য ও চিত্রকলা। এভাবে প্রয়োজনের কর্মের সঙ্গে সৌন্দর্যের ও আনন্দের যোগসাধন করে মানুষ কর্মে পেয়েছে উৎসাহ এবং শ্রম করেছে সুবহ। নৃত্য, গীত, বাদ্য ও চিত্র বা মূর্তি আজো তাই অনেকেরই উপসানা বা ধর্মাচারের অঙ্গ। যাদের উপাসনা ও কর্মপদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে, অথচ তারা নাচ, গান, বাজনা কিংবা চিত্র ও প্রতিমার আকর্ষণ হারায় নি, তাদের কাছেই এগুলো কেবল সৌন্দর্যবুদ্ধি ও রূপচেতনা প্রসূত আনন্দের অবলম্বন। তারাই Art for arts sake তত্ত্বের প্রবক্তা। আসলে আদি মানব সমাজে যা ছিল জীবন ও জীবিকার স্কুল অবলম্বন, তা-ই মানবীয় শক্তি ও মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় মানস প্রয়োজনে উন্নীত। সম্পর্ক হয়েছে দূরান্বিত, সম্বন্ধ সূত্র হয়েছে অদৃশ্য। ফলে জীবনপ্রয়াসের অনুষঙ্গ হিসেবে যা সৃষ্ট, তা-ই উত্তরকালে ব্যবহারিক জীবন-নিরপেক্ষ খেয়ালী মনের রূপ ও রসচর্চা বলে বিবেচিত। কিন্তু এ ধারণাও সত্য নয়, কেননা রূপকথায়ও দেখি ভাল মন্দর দ্বন্দ্ব। সেখানেও মন্দশক্তির প্রতীক দুবৃত্ত-দুয়োরানী, দৈত্য-রাক্ষস ও সাপ-বাঘের পরাজয় নিয়তি-নির্দিষ্ট। সেখানেও নৈতিক আদর্শ সর্বত্র বন্দিত। আদ্যিকালের গানে-গাথায়-ছড়ায়, রূপকথা-উপকতা-পুরাণকথায় ন্যায়-নীতিবোধ জাগানোর–মহৎ আদর্শ দানের প্রয়াস সর্বত্র লক্ষণীয়।
সেকালে সাধারণ্যে জীবন-চেতনার প্রসার ছিল না। জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও খাদ্যবস্তুর অভাব তখনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় নি। কেনা অসহায় মানুষের জীবন তখনো সর্ব ব্যাপারে দৈবানুগ্রহ-নির্ভর ও নিয়তি-নিয়ন্ত্রিত। সুখ-শোক, ভোগ-রোগ, ধন-দৈন্য, বিপদ-সম্পদ, আনন্দ-বেদনা প্রভৃতি তখনো দেবতার কৃপা ও দেবতার মার বলে বিবেচিত। কাজেই সমাজে মানুষের নৈতিক জীবন-সমস্যা ছাড়া অন্য সমস্যা সমাধানে হাত ছিল না মানুষের। এজন্যেই মানুষের মনন-চিন্তন ব্যক্তির নৈতিক জীবন উন্নয়নে ছিল নিয়োজিত। মধ্যযুগের ধর্ম ও সাহিত্যাদি কলা তাই ভাল-মন্দ, ভোগ-ত্যাগ, ন্যায়-অন্যায় ও পাপ-পুণ্যের ফল; ঘৃণা-হিংসা-দ্বেষ, ছলনা-ক্রতা-প্রতিহিংসা প্রভৃতির পরিণাম এবং প্রেম-প্রীতি-স্নেহ, ক্ষমা-সহিষ্ণুতা, ধৈর্য-অধ্যবসায়, উদারতামহত্ত্ব, শক্তি-সাহস প্রভৃতির মহিমা মাহাত্ম্যের বর্ণনায় ও চিত্রণে ছিল পরিপূর্ণ।
তারপর ক্রমে মানুষের জীবনধারা পাল্টে গেছে। এর কারণ অনেক। জনসংখ্যার বৃদ্ধি, শিক্ষার প্রসার, বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়া, যন্ত্রায়ত শিল্প, মুদ্রা বিনিময় রীতির বিস্তার, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশিক শোষণ, যন্ত্রবিজ্ঞানে অসম অধিকার, ভৌগোলিক অবস্থান, কৃষিজাত ও খনিজদ্রব্যের প্রাচুর্য ও অপ্রতুলতা প্রভৃতি নানা কারণে দেশে দেশে ও সমাজে সমাজে ধন-বৈষম্য ও তজ্জাত শক্তি বৈষম্য, দারিদ্র্য, শোষণ, কর্মকুশলতার অভাব প্রভৃতি নানা সমস্যা দেখা দেয়। অতএব এ যুগের মানবিক সমস্যা রাষ্ট্রিক কিংবা প্রশাসনিক নয়–মূলত অর্থনীতিক এবং ফলত সামাজিক।
আগের যুগে নিয়তি-নির্ভর মানুষের সামাজিক শৃঙ্খলা কিংবা বিপর্যয়ের কারণ ছিল ব্যক্তির নৈতিক চরিত্রের উন্নতি বা অবনতি। এ যুগে আর্থিক বৈষম্যই সামাজিক মানুষের দুঃখ-বেদনার মুখ্য কারণ। তাই এ যুগের নাচ-গান-চিত্র-সাহিত্য-দর্শন প্রভৃতি সমাজ ভিত্তিক। অন্যকথায় সমাজবদ্ধ মানুষের দুঃখ নিবারণ ও স্বাচ্ছন্দ্য আনয়ন লক্ষ্যেই এযুগে মানুষের শিল্প ও মনন প্রয়াস নিয়োজিত। অর্থাৎ মানুষের চিন্তা-ভাবনা পুরাতনকে স্বরূপে ও স্বস্থানে ধরে রাখার জন্যে নয়, পুরাতনের প্রয়োজন মতো বর্জন, শোধন ও নতুনের প্রতিষ্ঠার জন্যেই।
অতএব শিল্পীর দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উন্নয়ন ও প্রসারণ। পুরোনো সমাজকে ভেঙে-অতিক্রম করে নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন জাগানো, পরিকল্পনা প্রদান; চালু সংস্কৃতির মানোন্নয়ন ও নতুন সংস্কৃতি সৃজন; যে-ঐতিহ্য প্রগতির অন্তরায়, অনুপ্রেরণা দানে অক্ষম, তা পরিহার করে নতুন ঐতিহ্যের সন্ধান ও সৃজন প্রভৃতিই হবে শিল্পী, সাহিত্যিক ও দার্শনিকের আদর্শ, লক্ষ্য ও ব্রত।
চিত্র-শিল্পের ক্ষেত্রে য়ুরোপীয় activism, abstractism, surrealism প্রভৃতি চালু হয়েছে। সংগীতের মধ্যেও বিদেশী সুর-তাল-যন্ত্র গৃহীত হয়েছে সাদরে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে য়ুরোপীয় ভাল-মন্দ সবকিছুই নির্বিচারে আত্মসাৎ করছে সবাই–যদিও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার মৌখিক আস্ফালনও বাড়ছে সেই অনুপাতে। ভাবে ও আঙ্গিকে (In form and spirit) গত একশ বছরের বাঙলা সাহিত্য তো দেশী ভাষার আবরণে বিলেতি বস্তুই। ভাষার ক্ষেত্রেও আমরা য়ুরোপীয় শব্দের পরিভাষা নিয়েছি ও নিচ্ছি সংস্কৃত থেকেই। তবু আরবি-ফারসির জিগির ছাড়িনে। য়ুরোপীয় শব্দের পরিভাষা হিসেবে গৃহীত বলেই পুরোনো সংস্কৃত শব্দ নতুন তাৎপর্যে নতুন। কিন্তু আরবি-ফারসি শব্দের পুনর্ব্যবহারে নতুন ব্যঞ্জনা দুর্লভ। আমরা ভুলে যাই যে পুরোনো উপকরণে নতুন জিনিস তৈরি করলে তার রঙ বিশেষ খোলে না,–জৌলুস তো অভাবিত।
সাহিত্যে সমাজচিত্র দেয়া মানে যা আছে, কেবল তাই চিত্রিত করা নয়– যা হওয়া উচিত তারই সংকেত দেয়া–প্রেরণা দেয়া, নইলে রচনা নকশাই থেকে যায়। তেমনি ভাষা ও বাক-ভঙ্গি যেমনটি আছে তেমনটিই রক্ষার প্রয়াসেই লেখকের কর্তব্য সীমিত রাখলে চলে না, তার উন্নয়ন ও বিকাশের চেষ্টাও করতে হয়। সংস্কৃতিও যা আছে তা নয়, যা কাম্য তারই দিশা দান সাহিত্যিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
অতএব, দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির পরিচর্যা ও দেশের মানুষের জীবনের সঙ্গে শিল্পী সাহিত্যিকের জীবনের যোগসাধন মানে দেশের সমাজ-সংস্কৃতির বর্তমান স্বরূপ তুলে ধরা নয়, বাঞ্ছিত সমাজ-সংস্কৃতির রূপ এঁকে দেয়া। এজন্যে বাজ্জাল বিস্তার কিংবা কাল্পনিক অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টির ও চরিত্রাঙ্কনের প্রয়োজন নেই। বর্তমান সমাজ ও সংস্কৃতির অসঙ্গত, অসুন্দর ও অকল্যাণপ্রসূ দিক উদঘাটিত হলেই এ উদ্দেশ্য সহজেই সিদ্ধ হয়। প্রীতি ও প্রত্যয়ই এ কর্মে সাফল্যের সম্বল। কেননা প্রীতিহীন হৃদয় ও প্রত্যয়হীন কর্ম দু-ই অসার্থক।
যারা দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির অতীতরূপের ধ্যানে আসক্ত, কিংবা বর্তমান রূপের অনুরাগী ও অনুগত, তাঁরা জীবন-বিমুখ, প্রগতি-ভীরু। তাঁদের বুদ্ধি স্বল্প, দৃষ্টি ক্ষীণ ও বোধ অগভীর। শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে তেমন লোকের সংখ্যা যত কম হয়, ততই মঙ্গল।