1 of 2

জীবন মৃত্যু

জীবন মৃত্যু

মাস-কয় আগে বাংলা দেশের সব সংবাদপত্রেই এই খবরটি বেরিয়েছিল:

কলকাতার নিকটবর্তী কোনো গ্রামের শ্মশানপ্রান্ত দিয়ে যেতে যেতে পুলিশের এক কর্মচারী সবিস্ময়ে দেখলেন, শ্মশানের এক চিতার উপরে কয়েকজন শবদাহকারী দমাদম লাঠির আঘাত করছে।

কৌতূহলী পুলিশ কর্মচারী কাছে ছুটে গিয়ে শুনলেন, একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহে অগ্নিসংযোগ করবামাত্র সে জ্যান্ত হয়ে চিতার উপরে উঠে বসেছে এবং তাই মড়াকে দানোয় পেয়েছে বলে লাঠির বাড়ি মারা হচ্ছে।

পুলিশ ভূত মানে না, কারণ আইন ভূতকে অস্বীকার করে। পুলিশ কর্মচারী স্ত্রীলোকটিকে উদ্ধার করে আহত অবস্থায় কলকাতার মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে সে কয়েকদিন বেঁচে ছিল। তারপর রোগ ও মৃত্যুকে একেবারে ফাঁকি দিয়ে, জ্বলন্ত চিতাকেও এড়িয়ে অভাগী শেষটা আবার মারা পড়ল নির্বোধ মানুষেরই লাঠির আঘাতে।

যাঁরা খবর রাখেন তাঁরা জানেন যে, এরকম ঘটনা অসাধারণ হলেও অনেকবার ঘটেছে। এদেশে মৃত্যুর অল্পক্ষণ পরেই শব পুড়িয়ে ফেলা বা কবর দেওয়া হয় বলেই এরকম ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা। কারণ শ্বাস রুদ্ধ হওয়াই সব সময়ে মৃত্যুর প্রধান লক্ষণ নয়, মানুষের শ্বাস অস্থায়ী ভাবেও রুদ্ধ হতে পারে। এর একাধিক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত পাওয়া গিয়েছে পাশ্চাত্য দেশে— মৃত্যুর কয়েকদিন পরে যেখানে শবকে কবরে রাখা হয়। বিশ্ববিখ্যাত লেখক এডগার অ্যালেন পো এ সম্বন্ধে কয়েকটি সত্য ঘটনার উল্লেখ করেছেন, আমরা এখানে তিনটি তুলে দিলুম।

১৮১০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে এমন এক সত্য ঘটনা ঘটে, যা উপন্যাসের চেয়ে আশ্চর্য।

ভিক্টোরাইন লাফোর্কেড কেবল সুন্দরী নয়, নামজাদা সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে। তাকে বিবাহ করবার জন্যে সবাই লালায়িত।

জুলিয়েন হচ্ছে সাহিত্যিক। সে-ও সেই মেয়েটিকে বউ করতে চায় এবং লাফোর্কেডও তাকে পছন্দ করে। কিন্তু ধনী ও কুলিন নয় বলে শেষ পর্যন্ত জুলিয়নের সঙ্গে তার বিবাহ হল না।

রেনেল নামে এক ধনবান লোকের সঙ্গে সুন্দরী লাফোর্কেডের বিয়ে হয়ে গেল।

বিয়ে সুখের হল না। রেনেল বউয়ের দিকে ফিরেও চাইত না এবং তাকে নানারকম যন্ত্রণাও দিতে শুরু করলে।

চার বছর পরে লাফোর্কেডের অসুখ হল এবং সে মারা পড়ল। যে গ্রামে সে জন্মেছিল তার দেহ সেইখানে নিয়ে গিয়ে কবরস্থ করা হল।

জুলিয়েনও তার মৃত্যুর সংবাদ পেলে। সে তখনও মনে মনে লাফোর্কেডকে ভালোবাসত, কাজেই শোকে পাগলের মতো হয়ে উঠল। স্থির করলে, যেমন করে হোক লাফোর্কেডের একটা কোনো স্মৃতিচিহ্ন সে সংগ্রহ করবেই! অন্তত তার মাথা থেকে কেটে নেওয়া একগুছি চুল।

এই উদ্দেশ্য নিয়ে এক রাত্রে সে লুকিয়ে গোরস্থানের ভিতর গিয়ে ঢুকল এবং লাফোর্কেডের কবর খুঁড়ে কফিনের ডালা খুলে ফেললে!

নিঝুম রাত। অন্ধকারের বুক ছ্যাঁদা করে জুলিয়েনের লণ্ঠনের আলো শবদেহের মুখের উপরে গিয়ে পড়বামাত্র মড়া ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালে!

এতদিন পরেও নিশ্চয় করে বলা যায় যে, সেই দৃশ্য দেখে জুলিয়েনের সর্বাঙ্গ দারুণ আতঙ্কে শিউরে উঠেছিল! কেবল লাফোর্কেডকে অত্যন্ত ভালোবাসত বলেই সে পালিয়ে যেতে পারলে না!

আসল কথা একটু পরেই বোঝা গেল। লাফোর্কেড মরেনি। তার নিশ্বাস পড়ছে না দেখেই তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল।

জুলিয়েন তখন লাফোর্কেডের প্রায় অচেতন দেহ কফিন থেকে তুলে নিয়ে গেল। তারপর গোপনে চিকিৎসা ও সেবা করে তাকে আবার সুস্থ সবল করে তুললে। তারপর দুজনে পালিয়ে গেল আমেরিকায়।

সেইখানেই দীর্ঘ বিশ বছর কেটে গেল।

জুলিয়েন ও লাফোর্কেডের চেহারা গেছে বদলে। দুজনেই আন্দাজ করলে, এতদিন পরে দেশে ফিরে গেলে আর কেউ তাদের চিনতে পারবে না!

তারা ফ্রান্সে ফিরে এল এবং দৈবগতিকে রেনেলের সঙ্গে লাফোর্কেডের একদিন মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। রেনেল তখনই তাকে চিনতে পারলে! সে ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গেল বটে, কিন্তু লাফোর্কেডকে নিজের বউ বলে দাবি করতে ছাড়লে না।

কিন্তু লাফোর্কেড আর সেই নিষ্ঠুর অত্যাচারী স্বামীর কাছে ফিরে যেতে রাজি হল না।

রেনেল করলে নালিশ। আদালতেই এই অদ্ভুত ব্যাপারটা প্রকাশ পেলে।

বিচারক রায় দিলেন, আইন যাকে মৃত বলে মেনে নিয়েছে, এতদিন পরে তার উপরে স্বামী বলে রেনেলের কোনো দাবিদাওয়া থাকতে পারে না।

আইনে মৃত কিন্তু দুনিয়ার জীবন্ত লাফোর্কেড তখন আবার রেনেলের হাত ছাড়িয়ে জুলিয়েনের সঙ্গে চলে গেল।

তারপর দ্বিতীয় ঘটনা।

লিপজিকের এক পুরাতন সাময়িক পত্রে প্রকাশ: পল্টনের এক বিপুলবপু সেনানী, দুরন্ত ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। যদিও তিনি অসাধারণ বলবান ছিলেন, তবু তাঁর মাথার খুলি গেল ফেটে। ডাক্তারদের অনেক চেষ্টাতেও তাঁর জ্ঞান হল না। কয়েকদিন পরে তাঁর নিশ্বাস-বায়ুও বন্ধ হয়ে গেল। ডাক্তাররা পরীক্ষার পর তাঁকে মৃত বলে স্থির করলেন। এক বৃহস্পতিবারে সেনানীকে কবর দেওয়া হল।

দু-দিন পরে, অর্থাৎ রবিবারে জনৈক শ্রমিক গোরস্থানে বসেছিল। হঠাৎ সে শুনতে পেলে, মাটির তলায় একটা কবরের ভিতর থেকে বিষম হুটোপুটির শব্দ হচ্ছে!

শ্রমিক ভয়ে আঁতকে উঠে সেখান থেকে লম্বা দৌড় মারলে এবং লোকজন ডেকে এই অসম্ভব খবর দিলে।

প্রথমে কেহই তার কথায় বিশ্বাস করতে রাজি হয় না। তারপর শ্রমিকের জেদ দেখে সবাই শাবল কোদাল নিয়ে যথাস্থানে—অর্থাৎ সেই সেনানীর কবরের কাছে গিয়ে হাজির হল।

কবর খুঁড়ে দেখা গেল, সেনানীর মৃতবৎ দেহ উপবিষ্ট অবস্থায় রয়েছে এবং কফিনের ডালা ভাঙা! দেখলেই বোঝা যায়, মড়া জ্যান্ত হয়ে ধাক্কা মেরে ডালা ভেঙে উঠে বসে বাতাসের অভাবে অজ্ঞান হয়ে গেছে!

সকলের চেষ্টায় সেনানীর জ্ঞান ফিরে এল। তিনি তখন নিজের মুখেই তাঁর যোঝাযুঝি ও যন্ত্রণার কথা খুলে বললেন এবং একথাও জানালেন যে, মাথার উপর দিয়ে লোকজনের আনাগোনার শব্দ শুনে তিনি তাদের কাছে নিজের অস্তিত্ব জানাবারও চেষ্টা করেছিলেন।

কিন্তু সেনানীর নবজীবন ব্যর্থ হল। কারণ প্রবন্ধের প্রথমেই উক্ত বাঙালি মেয়েটির মতন তিনিও দ্বিতীয় বার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানেই।

তৃতীয় ঘটনা ঘটে লন্ডনে, ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে। এই ঘটনাটি নিয়ে বিলাতে তখন বিষম উত্তেজনার সাড়া পড়ে গিয়েছিল।

এডওয়ার্ড স্টেপলটন ছিলেন একজন অ্যাটর্নি। তাঁর টাইফাস জ্বর হয়েছিল এবং সেই সঙ্গে তাঁর দেহের কতকগুলো অজানা লক্ষণ ডাক্তারদের মনে কৌতূহল জাগ্রত করেছিল।

স্টেপলটন মারা পড়লেন। ডাক্তাররা নিজেদের কৌতূহল চরিতার্থ করবার জন্যে শব ব্যবচ্ছেদ করতে চাইলেন, কিন্তু আত্মীয় বন্ধুরা অনুমতি দিলেন না। মৃতদেহ সমাধিস্থ হল।

সে সময়ে বিলাতে লাশ-চোরদের ভারী উপদ্রব ছিল। এখানকার মতন তখনকার ডাক্তাররা ও চিকিৎসা বিদ্যালয়ের ছাত্ররা ব্যবচ্ছেদ করবার জন্যে সাধু উপায়ে শব সংগ্রহ করতে পারতেন না। কাজেই তাঁদের অবৈধ উপায় অবলম্বন করতে হত। তাঁরা শব পেলে মূল্য দিতেন এবং লাশ-চোররা অর্থলোভে গোপনে শব এনে তাঁদের কাছে বিক্রি করত। তারা কবর খুঁড়ে মড়া চুরি করে আনত এবং সেসুযোগ না পেলে জ্যান্ত মানুষ খুন করে তারও মৃতদেহ নিয়ে আসত! শেষটা এই উদ্দেশ্যে এত নরহত্যা হতে থাকে যে, ডাক্তারদের বৈধ উপায়েই শব সংগ্রহ করবার অনুমতি দেওয়া হয়।

বর্তমান ক্ষেত্রেও ডাক্তাররা লাশ-চোরদের আশ্রয় নিলেন। সমাধিস্থ হবার পর তৃতীয় রাত্রে তারা স্টেপলটনের মৃতদেহ গোর খুঁড়ে চুরি করে আনলে।

ডাক্তাররা শব নিয়ে পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হলেন। মৃতদেহে তখনও পচ ধরেনি দেখে একজন পরামর্শ দিলেন বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্র বা ‘গ্যালভ্যানিক ব্যাটারি’ ব্যবহার করতে।

তাই করা হল। প্রথমটা বিশেষ কোনো ফল ফলল না। রাত শেষ হয়ে আসছে দেখে শব ব্যবচ্ছেদ করবার প্রস্তাব হল। চোরাই মড়া, সকালের আগেই তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে হবে।

ইতিমধ্যে একজন ছাত্র নিজের এক অনুমান সত্য কি না পরখ করবার জন্যে মৃতদেহের বুকের মাংসপেশিতে ছ্যাঁদা করে ব্যাটারি চালিয়ে দিলে।

পরমুহূর্তেই ভয়ানক ব্যাপার! মৃতদেহ শোয়ানো ছিল শব ব্যবচ্ছেদের টেবিলের উপরে। আচম্বিতে সেই কয় দিনের বাসি মড়া ধড়মড় করে টেবিলের উপরে উঠে বসল, তাড়াতাড়ি মেঝেয় নেমে পড়ল, চারিদিকে অস্বস্তি ভরা চোখে তাকিয়ে দেখল এবং তারপরে—কথা কইলে! জড়িয়ে জড়িয়ে কী যে বললে বোঝা গেল না। কথা কয়েই সে আবার মেঝের উপরে দড়াম করে পড়ে গেল!

থমথমে নিশুত রাতে, শব ব্যবচ্ছেদাগারে, তিন দিন কবরবাসী একটা মড়া যদি উঠে দাঁড়িয়ে কথা কয়, তাহলে দর্শকদের মনের অবস্থা কীরকম হয় সেটা সকলে একবার ভেবে দেখুন।

ডাক্তাররা ভয়ে আড়ষ্ট! সকলেই একেবারে বোবা! তাঁরা ডাক্তার, মড়া ঘাঁটতে অভ্যস্ত ও দলে ভারী, তাই হয়তো আর্তনাদ করে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন না এবং তাড়াতাড়ি নিজেদের সামলে নিয়ে বুঝতে পারলেন যে, স্টেপলটন কবরে গিয়েও মারা পড়েননি।

তখনই ‘ইথারে’র সাহায্যে স্টেপলটনের মূর্ছা ভাঙানো হল। তারপর কিছুদিন ধরে গোপনে তাঁর চিকিৎসা করে যখন বোঝা গেল যে, স্টেপলটনের আর কোনো অমঙ্গলের ভয় নেই, তখন তাঁকে আবার বাড়িতে ফিরে যেতে দেওয়া হল। যমালয়ের মানুষকে লোকালয়ে ফিরে আসতে দেখে স্টেপলটনের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মুখচোখ কেমনধারা হয়েছিল, এতদিন পরে সেটা বলবার উপায় নেই।

এর চেয়েও আশ্চর্য হচ্ছে স্টেপলটনের নিজের কথা।

তিনি বলেন, ‘বাইরে আমাকে অজ্ঞানের মতো দেখালেও আমি একবারও জ্ঞান হারাইনি। সমস্ত গোলমেলে বলে বোধ হলেও, নিজের অবস্থা আমি আন্দাজ করতে পারছিলুম। যখন থেকে ডাক্তার আমাকে মৃত বলে সাব্যস্ত করে গেলেন এবং আমাকে গোর দেওয়া হল, তখন থেকে শব ব্যবচ্ছেদাগারে আমার দাঁড়িয়ে উঠে পড়ে যাওয়া পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারই আমি সচেতন অবস্থাতেই বুঝতে পেরেছি। ডাক্তাররা আমার কথা বুঝতে পারেননি, কিন্তু সে কথাগুলি হচ্ছে—‘ডাক্তার, আমি বেঁচে আছি’! আমার দারুণ আতঙ্ক হয়েছিল, ডাক্তাররা যদি জীবিত অবস্থাতেই আমাকে কাটতে শুরু করে দেন!’

কয়েক দিন পরে সমাধিস্থ মৃত দেহেও যদি আবার জীবন সঞ্চার হয়, তাহলে ভারতবর্ষে আজ পর্যন্ত মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই যে সংখ্যাতীত শব দাহ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কত হতভাগ্য জীবন্তে পুড়ে মরেছে সে হিসাব কে করতে পারে? একথা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *