জীবন-জিজ্ঞাসা

জীবন-জিজ্ঞাসা

জীবনরহস্যের কোনো হদিশ পেলাম না ভাই, দুঃখ করছিল আমার বন্ধু সোমনাথ ডাক্তার : সারাজীবন ধরে এত চেষ্টা করেও।

তোমাদের পাবার তো কথা নয়, তার খেদোক্তিতে আমি বাধা দিই- ওতো আমাদের…লেখকদেরই একচেটে এলাকা ভাই! তলিয়ে যাবার ভয় থাকলেও, ওর গভীরে আমরাই তো ডুব দেব…থই না পেলেও…থ হয়ে গেলেও। তোমাদের কারবার তো জীবন্মতদের নিয়েই। জীবনসংশয়ের সঙ্গেই তো যতো সম্পর্ক তোমাদের।

জীবনরহস্য মানে দীর্ঘ জীবনের রহস্য। বলে সে প্রাণীমাত্রের আদিমতম প্রাণের কথাটি প্রাঞ্জল করে—কী করে দীর্ঘ জীবন লাভ করা যায়, অনেকদিন বেঁচে থাকা যায়—সেই সমস্যার কথাই আমি বলছিলাম।

ও, এই কথা! বলে আমি হাঁফ ছাড়লাম।

অবশ্যি কিছু কিছু কিনারা যে পাওয়া না গেছে তা নয়। মিতাহারী মিতাচারী হলে মানুষ দীর্ঘকাল বাঁচে, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সেটা প্রকাশ পেয়েছে। আহার-বিহারে সংযমীদের অকালমৃত্যুর আশঙ্কা ঢের কম। এই মিতাহারের কথাটাই ধরা যাক না…মিতাহার মানে পরিমিত আহার…

মিতাহারের কথায় আমার দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল।

সত্যি, পরীর মতই মেয়ে ছিল বটে মিতা। কিন্তু ওই মিতাহারের চেষ্টাতেই…পরিমিত পরিমাণেই, বলতে কি…

হ্যাঁ, মিতাহারী হবার সুযোগ পেলে আমি দীর্ঘজীবী…আরো একটু দীর্ঘজীবী হতে পারতাম হয়ত। এই যৎকিঞ্চিৎ জীবনে যে কটা দিন বেঁচেছি তার ভেতরেই আরো একটু বেশি দিন বাঁচা যেত, অনেক দিন অনেক রাত আরো অনেক বেশি জীবন্ত হতো, সেই তঙ্গভাগনীকে ক্ষণকালের জন্যেও সঙ্গিনীরূপে পেলেও এই এক জীবনেই অনেক জীবন-যাপন করা যেত, এই জনমেই জন্ম-জন্মান্তর লাভেরও কোনো অন্তরায় ছিল না। কিন্তু মিতালীর মুখপাতেই যেভাবে চডচিত হতে হলো মনে পড়ায় এতদিন পরেও দীর্ঘনিঃশাস পড়ল আমার।

মিতাহারের কথা তো বলছ! আমি ফোঁস করে উঠলাম। কিন্তু মিতাচার কিরূপ অম্লমধুর জানতে যদি! আঙুর ফলের মতই ভারী টক ভাই! ওর talk পর্যন্তই ভালো, তার বেশি এগুলেই মারাত্মক।

সেই বিপজ্জনক আচার-ব্যবহারের কথা স্মরণ করে এতদিন পরেও আমি শিউরে উঠি।

সে হাতের কাগজের একটা অংশে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল–আজকের এই খবরটা পড়েছ? এইটে পড়েই ওই দীর্ঘজীবনের প্রশ্নটা আমার মাথায় উঠেছে আবার নতুন করে।

খবরটায় নজর দিলাম—খবরের মত খবর বটে।

একালের এক দীর্ঘজীবী মানুষ—গতকাল ভট্টপল্লীর শ্রীভট্টশালী মহাশয়ের ১০৬তম জন্মাৎসব হয়ে গেল। তাঁর নিজের বিবেচনায় তার বর্তমান বয়স ১০৯ বছর, প্রাথমিক গণনার ভুলহেতু তিন বছর বাদ পড়ে গেছে..

ইস! লোকটা নিজের জীবনটাকে নিয়ে নয়-ছয় করেছে। খবরটা পড়ে আমি বিরক্তি প্রকাশ করি—অ্যাদ্দিন ধরে বেঁচে থেকে কী যে হয়! বুড়ো হয়ে বেঁচে থাকার কি কোন মানে আছে?

আরে, আজ যদি আমরা দীর্ঘজীবনের কিনারা করতে পারি তো কাল দীর্ঘ যৌবনলাভের কিনারে গিয়ে পৌঁছব, তা জানো? বলল সোমনাথ : চলে যাই ভাটপাড়ায়। ভদ্রলোকের ইনটারভিউ নিইগে। জীবনরহস্যের যদি কোন হদিশ পাওয়া যায় তার থেকে।

ভাটপাড়ায় পা দিয়েই একজনের কাছে শ্রীভট্টশালীর বাড়ির ঠিকানাটা শুধালাম।

অ্যাঁ? ভট্টশালার বাড়ি খুঁজছেন নাকি আপনারা? লোকটা যেন খেঁকিয়ে উঠল কেমন।

ভট্টশালা। তার মানে। আমরা তো হতবাক।

এক নম্বরের বদলোক মশাই। আমারা ওকে ভট্টশালাই বলি। শ্রীশ্রী ভট্টশালা।

এমন কথা বলছেন কেন? সোমনাথ একটু মৃদু প্রতিবাদ জানায় : এত দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে রয়েছেন—উনি তো আপনাদের ভট্টপল্লীর গৌরব মশাই।

গৌরব! গৌরবই বটে লোকটার মুখভঙ্গি দেখবার মতই খেয়ে না খেয়ে অ্যান্দিন ধরে খালি বেঁচেই রয়েছেন, এ ছাড়া আর কী করেছেন উনি? শুনি তত একবার?

কিছুই করেননি? ভদ্রলোকের কথায় আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী কী করা উচিত ছিল উক্ত ভট্টশালীর মনে মনে তাই খতাই। সুদীর্ঘকাল ধরে কেবল বেঁচে থাকাটা কি কোন কথাই নয়?

দীর্ঘজীবনবাবুর কথা আর বলবেন না। এই কথা বলে বিষবৎ আমাদের পবিত্যাগ করে চলে যায় লোকটা।

ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত আমরা ভট্টশালী মশায়ের আটচালায় গিয়ে পৌঁছলাম।

চতুম্পাঠীতেই বসেছিলেন ভট্টশালী। নমস্কার করেই কথাটা পাড়া গেল-কলকাতাব থেকে আসছি আমরা। আজকের কাগজে খবরটা পডেই ছুটে এলাম, আপনার দীর্ঘজীবনলাভের কারণগুলো আমরা জানতে চাই যদি দয়া করে আমাদের জানান…

আমি একজন ডাক্তার। ইনি লেখক।

আজ্ঞে হ্যাঁ। দীর্ঘজীবনলাভের যদি কোনো শর্টকাট থাকে… সঙ্গে সঙ্গে আমারও অনুযোগ।

আসুন আসুন। বসুন আপনারা। আমাদের অভ্যর্থনা করে বললেন ভট্টশালী। —দেখুন, দীর্ঘজীবনের রহস্য কিছু নেই। দীর্ঘজীবনলাভের সোজা পথ হচ্ছে সহজ পথ। জীবনের আঁকা বাঁকা চোরা গলিতে না যাওয়া-ভুল পথগুলো এড়িয়ে চলা। সর্বদা সোজা পথে চলবেন—সেইটেই হচ্ছে সহজ পথ। সহজভাবে জীবন-যাপন কবলেই দীর্ঘায়ু হওয়া যায়। মিতাহার, মিতাচার, আহার-বিহারে সংযম, নিদ্বিয় নিশ্চিন্ত জীবন—এইগুলিই দীর্ঘায়ুলাভের সহায়ক। সংযত জীবন-যাপন কবলে যে পরমায়ু বাডে সেকথা আর না জানে কে?

আজ্ঞে, আমিও সেই কথাই বলছিলাম আমার বন্ধুকে, এই মিতাচারের কথাই। এখন আপনিও আবার সেই কথাই বলছেন। দ্বিরুক্তি করল সোমনাথ।

দেখুন আমি আজীবন নিরামিষাশী, জীবনে মদ্যমাংস স্পর্শ করিনি, কোনো নেশাভা নেই আমার, কিছুর জন্যেই কৈানো উদ্বেগ দুশ্চিন্তা নেইকো, মনে হয় এই সবই হয়ত আমার দীর্ঘজীবনলাভের হেতু হবে। বলে তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন : তবে আমার এ আর কী দীর্ঘজীবন। আমার চেয়েও দীর্ঘতরজীবী ব্যক্তি এই অঞ্চলেই রয়েছেন। এই ভট্টপল্লীতেই।

বলেন কী! কই তাঁর খবর তো…

পাবেন কী করে, তিনি কখনো নিজের পরমায়ু কারো কাছে প্রকাশ করেন না। কিন্তু আমি তো জানি। এইটুকুন বয়স থেকে দেখে আসছি তাঁকে।

তার বয়স কত এখন? আমি জানতে চাই।

তিনি তো বলেন চুরাশী। ভট্টশালী বললেন, কিন্তু তাঁর এই চুরাশীই আমি চুরাশী বছর ধরে শুনে আসছি। আমার আট বছর বয়সে যেমনটি তাঁকে দেখেছিলাম, এখন এই একশো আটের পৈঠা পেবিয়েও ঠিক তেমনটিই দেখছি তাঁকে। কোনো বৈলক্ষণ্য নেই। কিছুমাত্র না। ডবোল আশী পার করে দিয়েও তিনি…

বলেন কী! শুনেই আমি আঁতকে উঠি : ডবোল আশীর চুড়ায় চুর হয়ে বসে আছেন—তার চিরকালের চুরাশীতে? আশীআশীকরেও আসেননি এতদিনেও! আর্ম! দীর্ঘজীবনের চূড়ান্ত যদি বলতে হয় তো বোধকরি এইটেই তার পরাকাষ্ঠা।।

শুধু তার চুলগুলো পেকেছে কেবল। বলে ভট্টশালী নিজের বক্তব্য সম্পূর্ণ করলেন।

এক চুলের তফাত মাত্র! আমার টিপপনি কাটলাম।

নামটি কী তাঁর? সোমনাথ শুধায়।

কেউ তাঁর নাম জানে না। কাউকে বলেনও না তিনি। তবে আমরা সবাই তাকে যোগেন্দ্রজী বলে থাকি। ঐ নামেই ডাকি আড়ালে। যোগবলেই তার এহেন দীর্ঘজীবন—আমাদের এই ধারণা।

হিন্দুস্থানী সাধক-ফাধক বুঝি?

না না, সাধক-ফাধক নয়। হিন্দুস্থানীও না। সাধারণ বাঙালী ভদ্রলোক। তবে ওঁর দীর্ঘজীবনের কোন কিনারা করতে না পেরে, হয়ত তান্ত্রিক ক্রিয়া-টিয়া যোগ-টোগ কিছু করে থাকেন, এই ধারণায় সবাই ওঁর ওই নাম দিয়েছে। এই আর কি! বলেন শ্রীভট্টশালী : তাহলেও তার কাছে যান না একবার। হয়ত এখানে আসাটা আপনাদের সার্থক হতে পারে তাহলে। যে গুহ্য রহস্যের সন্ধানী আপনার তাঁর চাবিকাঠি হয়ত তার কাছেই রয়েছে।

গেলাম তাঁর কাছে।

যোগেনবাবুকে দেখে কিন্তু চুরাশী দূরে থাক, চৌষট্টির বেশি বলে মনে হয় না কিছুতেই। নাদুস-নুদুস দেহ-স্বাস্থ্যখানা রেখেছেন মন্দ না। পঁয়ষট্টি দেবার এখনো কোনো লক্ষণ নেই, তার বেশ দেরি আছে বলেই মনে হয়।

এখানকার একজন বলছিলেন— কথায় কথায় ভট্টশালীর কথাটা পাড়া গেল——যে আপনি নাকি চুরাশীবছর ধরে চুরাশীতেই রয়ে গেছেন, দেখতেও রয়েছেন সেই একরকমটিই প্রায়, বয়স নাকি আপনার বাড়ছে না আদপেই।

শুনে তিনি হো হো করে হাসলেন। বললেন—দেখুন, অস্তিত্বের একটা স্থিরবিন্দু আছে—তাকে ঈশ্বরই বলুন আর অজ্ঞেয়ই বলুন—তার সঙ্গে কোনরকমে যুক্ত হতে পারলে—সময় তখন আপনার থেকেই স্তব্ধ হয়ে যায়। অস্তিত্বের সেই বিন্দুমাত্রায় বিন্দুমাত্রই অবস্থিতি থাকে কেবল। দেশকালাতীত ত্রিশূন্যে কি বয়স বাড়ে? আপনাদের বিজ্ঞানও কি এই কথায় সায় দেয় না? কিন্তু আমরা তো আর তা পারি না, সেই কেন্দ্রবিন্দুর থেকে প্রকৃতির বশীভূত হয়ে প্রবৃত্তির বশে ক্রমাগত বৃত্ত টেনে টেনে বৃত্তান্তরে গিয়ে পড়ি—তখন তার অনিবার্য পরিণামে নানান পরিণতি এসে দাঁড়ায় স্বভাবতই। সেই বৃত্ত-বৃত্তান্তই আমাদের এই ধারাবাহিক জীবদ্দশা।

কিছু না বুঝেও আমি ঘাড় নাড়ি—কেন এমনটা হয় মশাই?

নিছক মায়া বাড়াতে গিয়েই। আবার কী?

তিনি কিন্তু আপনার যোগবলের কথাও বলছিলেন। সোমনাথ বলল।

যোগবলের চেয়ে বড় হচ্ছে বিয়োগবল। যোগ হচ্ছে বিধাতার। মানুষের নয়। কেন না যোগানদার তিনিই। আমাদের সব কিছুই বিয়োগান্তক। ভগবতী দশ হাতে আমাদের যুগিয়ে যাবেন, আর আমরা দশ দিকে ত বিলিয়ে যাব। যাবার রাস্তা পরিষ্কার না এলে আসার পথ বন্ধ। উত্তরে বাতাস ঘরে ঢুকতেই পারবে না যদি না আমরা দক্ষিণের জানালাটা খুলে রাখিবাইরে যত ঝড়ই বয়ে যাক না কেন। তার কৃপায় উত্তরণ তখনই সম্ভব যখন দক্ষিণার দ্বার মুক্ত থাকবে আমাদের। ধন, ঐশ্বর্য, অর্থসামর্থ্য, স্নেহ ভালবাসা যাই বলুন—সবই আমাদের অপরকে দিয়ে দিয়ে পেতে হবে না দিয়ে পাওয়ার কোনো উপায় নেইপেয়েছি কি না সত্যিই, দিলে পরে তবেই তো সেটা টের পাই। পুঁজি করে রাখলে সেটা পুঁজ হয়ে থাকে—তার থেকেই যতো আধিব্যাধি—কি দেহের—কি সমাজের—কি রাষ্ট্রের…তামাম দুনিয়ার।

কিন্তু তার সঙ্গে বয়স না বাড়বার সম্বন্ধটা কী? সোমনাথ শুধায়।

বয়স বাড়ে ঠিকই, কিন্তু তার কোনো দাগ পড়ে না কেবল। বহতা নদী যেমন, তার কি কোনো বয়স আছে? পর্বতশীর্ষে তার জলযোগ আর ঘাটে ঘাটে জল বিলিয়ে সমুদ্রগর্তে গিয়ে সেই জলবিয়োগ—যেমন পাওয়া তেমনি তার দেওয়া—এই জন্যেই সে ফুরোয় না কখননা, অফুরন্ত, কানায় কানায় ভরা সব সময়—সময়ের কি কোনো ছাপ আছে তার গায়?

কিন্তু ঐ মায়া বাড়ানোর কথাটা বললেন যে… আমি ওঁকে মনে করিয়ে দিই তখন। শূন্যবিন্দুর থেকে যে-বৃত্তই টানি—যে বৃত্তিতেই যাই না, সবই তো শূন্যাকার। শূন্যর থেকে শূন্যেরই সৃষ্টি হয় বৃত্তাকার ধারণ করলেও তা শূন্যবিন্দুরই সমষ্টি মাত্র। সবই শূন্যকার, মায়া। ফাঁকি ফক্কিকার। উপনিষদের সেই বিখ্যাত বচনটা বদলে নিয়ে হয়ত বলা যায়—শূন্যমদঃ শূন্যমিদং শূন্যাৎ শূন্যমদুচ্যতে। শূন্যস্য শূন্যমাদায় শূন্যমেবাবশিষ্যতে।

কিন্তু ঐ বৃত্তাকার? সোমনাথ তর্কে প্রবৃত্ত।

সবই হচ্ছে আমাদের দানবৃত্ত—আত্মদানের প্রবৃত্তি। শূন্য তো আসলে পূর্ণ-ই, অলরাউন্ডার, সম্পূর্ণ। শূন্যের আত্মপ্রসার থেকেই তো বৃত্ত। তাই নিছক মায়া হলেও, যে কোনো বৃত্তিই, তা আমাদের কলাবৃত্তিই হোক যৌন প্রবৃত্তিই হোক, দেহদানই কি আর স্নেহদানই কি, সবই আমাদের নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া ছাড়া তো কিছু নয়। যেতে যেতে দেওয়া, দিতে দিতে যাওয়া—পেয়ে পেয়ে দেওয়া আর দিয়ে দিয়ে পাওয়া—সব বৃত্তের সব বৃত্তিই সেই এক বৃত্তান্ত।

দেওয়ার কথাটা যা বলেছেন সায় দেয় সোমনাথ ডাক্তার : না দিলে তো ব্রিবনে কিছুই মেলে না মশাই। না হৃদয়, না ভিজিট।

আসলে মেলা মানেই তো দেওয়া নেওয়া, আদানপ্রদান। মেলাই কথার ওপর আমার এক কথা।।

আর এ সমস্তই আমাদের মায়া বাড়ানো মাত্র। যোগেনবাবু যোগ দেন : মায়া তো ব্রহ্মের সম্প্রসারণ ছাড়া কিছু নয়; ব্রহ্মের নানারূপে নানন বৃত্তিলাভ। ব্রহ্মের আত্মদান। আপনাকে দেওয়া। আর সেই আত্মদানে তাঁর আত্মচরিতার্থত। তাঁর এই দানযোগে যদি আমরা ঠিক ঠিক যোগদান করতে পারি তাহলে এর সব কিছুই শূন্যমাত্ৰ হলেও, শেষ ফল সেই শূন্য হলেও, সেই শূন্যতার মধ্যেই আমরা পূর্ণতার স্বাদ পাব। দেশকালপাত্রের সীমানা উপচে সেই পরিতৃপ্তি। বলে তিনি নিঃশ্বাস ফ্যালেন : আর ভেবে দেখুন, ভূয়ো হলেও সেই স্বাদটুকুই তো আমার–জীবনের সহস্র যন্ত্রণা, হাজার বিষাদের মধ্যেও।

তত্ত্বকথার এই সব গোঁজামিলের গর্তে আর মাথা না গুজে সোমনাথ তার ডাক্তারি সত্তায় ফিরে আসে এবার। –আচ্ছা, এই দীর্ঘজীবনে কি কোনো অসুখবিসুখ করেনি আপনার? জিজ্ঞেস করে বসে হঠাৎ।

করেনি আবার? শরীরম ব্যাধিমন্দিরম। কোন অসুখটা করেনি। যে অসুখ একবার এসেছে সে আর যায়নি, যেতে চায়নি, খুঁটি গেড়ে বসেছে এই দেহে। কোন অসুখটা নেই বলুন আমার? বাত আছে, হাঁপানি আছে, ডায়াবিটিসও চাগাড় দেয় মাঝে মাঝে, উচ্চরক্তের চাপ তো রয়েইছে—আর এর কোনোটাই ভূয়ো নয়। ভূয়োদশী ব্যক্ত করেন : তবে হ্যাঁ, রক্তচাপ থাকলেও, বক্তের সেই চাপল্যটা ততটা নেই আর।

অ্যাতো অসুখ আছে আপনার? আমি হতবাক হই। কিন্তু কই, দেখে তো তা মনে হয় না মোটেই।

অসুখও যেমন আছে তেমনি তার ওষুধও রয়েছে যে! সবই আছে তবে প্রশমিত হয়ে আছে।

কী করে দমিয়ে রেখেছেন এত সব অসুখ? আমার প্রশ্ন।

ওষুধ খেয়ে—আবার কী করে? অসুখের আঁচ পেতেই ওষুধ খাই, শরীরকে বেশি তোগাই না। সুখভোগে অরুচি না থাকলেও অসুখভোগে আমার নিতান্ত অনীহা। আমার দেহে অসুখ আর ওষুধের সহাবস্থান– বলে তিনি সোমনাথের দিকে কটাক্ষ করেন—আপনারা ডাক্তাররা অসুখ হলে তার পরে ওষুধ দিয়ে তা সারান, আর আমি, অসুখের সম্ভাবনা দেখলেই ওষুধ খেয়ে তাকে সরিয়ে রাখি। আমার ঐ দেরাজটার দিকে চেয়ে দেখুন না একবার! এফিড্রিন, অ্যাড্রিনালিন, প্যাথিডিন, ইসিড্রেকস উইথ অ্যাডেলফিন, ইনসুলিন, আর যতো রাজ্যের ভিটামিন–এ বি সি ডি থেকে ঈ পর্যন্ত কী নেই?

সোমনাথ সেদিকে তাকাল না। মার কাছে মামার বাড়ির গল্পের মত ডাক্তারের কাছে ওষুধের তত্ত্ব ব্যাখ্যানা তার ভালো লাগল না বোধহয়। আচ্ছা, এবার আমরা আসি তাহলে। বলে সে উঠে পড়ল। নমস্কার ঠুকে বিদায় নিলাম আমরা।

ফিরে এলাম ফের সেই ভট্টশালীর সমীপে।

কী বললেন যোগেনবাবু? শুধালেন শ্রীভট্টশালী।

আসল কথা ফাঁস করলেন না কিছু। জানাল সোমনাথ : তবে আমাদের জ্ঞান দিলেন বটে বহুত।

উনি ঐ রকমই। মচকান তো ভাঙেন না। সহাস্যে বললেন ভট্টশালী: কারো কাহে ভাঙেন না কিছু কখননা। ওঁর রহস্য উনিই জানেন কেবল।

কিন্তু জীবনরহস্যের আসল কথাটা তো… সোমনাথ বলতে যায়।

আসল কথা আপনারা আমার কাছে শুনুন। বাধা দিয়ে তিনি বললেন—দীর্ঘজীবন যদি পেতে চান তো আমার পথ ধরুন। সংযত জীবনযাপন করুন, নেশা-ভাও করবেন না, বিড়ি-সিগ্রেট খাবেন না, মদ ছোঁবেন না কখনো…

এমন সময় সদর রাস্তার দারুণ একটা সোরগোল তাঁর কথার মাঝখানে এসে বাধা দিল।

ঐ যে ভট্টশালা! ভট্টশালা! ভট্টশালা কিঞ্জয়।

নিজের জয়ধ্বনি শুনেই কি না কে জানে, উনি মুখ বিকৃত করে সদুপদেশ বিতরণে ক্ষান্ত হলেন।

ব্যাপার কী? জানতে চাইলাম আমরা।

ও কিছু না। আমার বাবা আসছেন।

অ্যাঁ? আপনার বাবা? অবাক হয়ে যাই আমরা : উনি বেঁচে আছেন এখনো?

আছেন বলে আছেন! রীতিমতন সজীব। ওঁর জ্বালায় আমরা তো বটেই, পাড়াপড়শী—ভাটপাড়ার ইতরভদ্র সবাই অস্থির। বলে তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন—আরো কতোকাল জ্বালাবেন কে জানে!

ওঁব নামটি কি আমরা জানতে পারি?

শ্রীশ্রীভট্টশালী। আমার শ্রী একটা, ওঁর দুটো শ্রী—উনি নিজেই এটা নিয়েছেন। কিন্তু মশাই, শ্রীশ্রী না বলে ওঁকে বিশ্রী বলাই উচিত বরং। পাড়ার ছোঁড়ারা ওঁকে ভট্টশালা বলে খ্যাপায়। এককালের ভারতবিশ্রুত মহামহোপাধ্যায় জীবন ন্যায়রত্নমশায়ের এই দশা—তার ছেলে হয়ে নিজের চোখে আমায় দেখে যেতে হলো…

তাঁর খেদোক্তি শুনতে হয় আমাদের…পিতৃনিন্দা মহাপাপ জানি, কিন্তু ওঁর যা আচাব ব্যবহার…আমরা মুখ দেখাতে পারি না লোকসমাজে। বলা উচিত নয়, কিন্তু হেন নেশা নেই যা ওঁর নেইকো। বিড়ি সিগ্রেট তো মুখে লেগেই আছে। তা ছাড়া গাঁজা আফিং চরস গুলি ভাঙ কিছু বাদ যায় না। কোকেন পেলেও খেতে ছাড়বেন না উনি…

তাহলে তো ওঁর জীবনটাই নিতে হয় সব আগে। সোমনাথকে আমি উসকালাম : জীবন সম্বন্ধে জীবনবাবুর বক্তব্যটাই জানা দরকার আমাদের।

বাইরের সেই হলাটা ক্রমেই আরো বেড়ে চলল।

সারা পাড়া জ্বালাতে জ্বালাতে ফিরছেন এখন উনি সেই ভাটিখানার থেকে…

টলতে টলতে ঘরের ভেতরে এসে ব্যক্ত হলেন একদা ভারত-বিক্ষত শ্রীশ্রীভট্টশালী মশায়। আমাদের কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ না দিয়েই নিজের বক্তব্য-প্রকাশে আপনার থেকেই তিনি সোচ্চার হয়ে উঠলেন—

সভাপতিমশায়, সমবেত জনমণ্ডলী ও বন্ধুগণ! আমি প্রতিবাদ করছি…ঘোরতর প্রতিবাদ করছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনারা শুনুন সবাই। আমার প্রতি কী দারুণ অন্যায় আচরণ করা হয়েছে কান পেতে আপনারা শুনুন একবার।

আমরা তটস্থ হয়ে দাঁড়ালাম উৎকীর্ণ হয়ে….

হ্যাঁ, আমি…আমি এহেন অসদাচরণের প্রতিবাদ করি। আপনারা বলবেন আমি কেন প্রতিবাদ করছি। কিন্তু প্রতিবাদ ছাড়া আমি আর কী করতে পারি? আমি বলব যে প্রতিবাদ ছাড়া আমি আর কিছুই করতে পারি না। সেই কারণেই আমি প্রতিবাদ করছি। শুনুন তাহলে আপনারা…আমার প্রতিবাদটা শুনে রাখুন সবাই…আমি ভাটিখানার মালিকের কাছে একের এক চেয়েছি, বলেছি তুমি আমায় একের এক দাও। সে আমাকে একের এক দিয়েছে…আমি একের এক খেয়েছি কিন্তু…কিন্তু…কিন্তু…।

বলতে বলতে এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় তাঁর সারা মুখ যেন কেমনধারা হয়ে যায়-–

কিন্তু ও আমাকে সত্যি সত্যি একের এক দেয়নি, আমি একের এক খাইনি, বলুন আপনারা, আমি একের এক খেয়েছি কি? আপনারাই বলুন একবার?…।

তিনি জিজ্ঞাসু নেত্রে আমাদের দিকে তাকান। ন্যাযরত্ন মশায়ের ন্যাযেব কূটতর্কে সবাই আমরা বিড়ম্বিত বোধ করি।

না, খাইনি। প্রকৃতপক্ষে আমি একেব এক খাইনি। প্রমাণ চান তাব? একেব এক যে কী বস্তু নিশ্চয় তা আপনাদেব অজানা নয়…

আমার জানা ছিল না। একের এক-টা কী হে? সোমনাথকে আমি শুধালাম। এমন কী চীজ?

একশা নম্বর ওয়ান-এর এক বোতল। সোমনাথ জানাল—মা, নদেব পরিভাষায় ঐ একের এক।

একশা নম্বর ওয়ান? তাহলে তো উনি বমি করে এখনি সব একশা কববেন। বলে আমি আঁতকে উঠে ওঁর সামনে থেকে সরে দাঁড়াই।

তার প্রমাণস্বরূপ আমি বলি… বলতে থাকেন ন্যায়রত্ন–সত্যি সত্যি একের এক খেলে আমি এরকম দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পারতাম না। আপনারা বলবেন প্রতিবাদ না করে তাহলে আমি কী করতাম? আমি বলব একের এক খেলে আমি এইরকম কবে মাটিতে পড়ে যেতাম সটান…

বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ধড়াস করে পড়ে গেলেন মেজেয়। আর উঠলেন না। তারপর আর কোনো উচ্চবাচ্য নেই তব।

সোমনাথ ডাক্তার তাড়াতাড়ি গিয়ে তার নাড়ি টিপে দেশে স্টেথিসকোপ বসিয়ে বুক পরীক্ষায় লাগলো।

বাধা দিলেন শ্রীভট্টশালা আপাতত হবে না ওকে। কিছু হয়নি ওর। মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে পড়েছেন মাত্র। দিনে দশবার উনি অমন পড়ছেন, উঠছেন, আবার ছুটছেন ওই ভাটিখানার দিকে। একের এক না হলে তাঁর একদণ্ড চলে না।

একবাক্যে উভয় ভট্টশালীকে নমস্কার জানিয়ে আমরা ভট্টশালার থেকে বের হলাম।

সোমনাথ চুপ। আমিও। ওর চোখে নির্বাক জিজ্ঞাসা—??? (জীবনের একি রহস্য?)

আমার চোখে তার অবাক জবাব!!! (জীবন-রহস্যই বুঝি এই ভাই!)

কিন্তু একের এক কি সে পেয়েছিল? জীবনরহস্যের সব কিছু ছাপিয়ে জীবনন্যায়রত্নের সেই প্রশ্নটাই যন কানে বাজতে থাকে আমাদের।

জীবনজিজ্ঞাসার সেই প্রশ্নমীমাংসা কোথায়? হায়রে, তা কি কখনো পাওয়া যায়। সেই একের একটিকে। সেই মাতাল করা তাকে? মিতা-কে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *