জীবন কাহিনি – ৮

জীবনবাবু গলদধর্ম হয়ে ঘুরছে। 

কোনোটাতেই ফল হয়নি! ব্যাগের ভিতর লাইফ ইনসিওরের ফর্ম, মহাভৃঙ্গরাজ তেল, ঋষিপ্ৰাপ্ত দৈবওষুধ—কোনোটাতেই বিশেষ কিছু হয়নি, হবেও না—এটাই বুঝেছে। 

তার শরীর রোদে-ঘেমে উঠেছে। 

ধুঁকতে ধুঁকতে বস্তির দিকে এগিয়ে আসে জীবনবাবু। এ সময় পাওনাদারদের খুব তাড়া বা সতর্ক দৃষ্টি থাকে না এদিকে। এই সুযোগে সে তাড়াতাড়ি করে ঢুকে পড়ছে। তবু স্নান করে একটু জিরোতে পারবে। 

আর হাঁটতে পারছে না জীবনবাবু। 

সকাল থেকে একটার পর একটা আঘাত তাকে মুষড়ে দিয়েছে। 

গদাই সরকার আজ তাড়িয়ে দিয়েছে তাকে কাছারি থেকে। বোধহয় টের পেয়েছে, বাসন্তী তাকে পছন্দ করে না। শুধু তাই নয়, গদাই-এর উপর একটা অত্যাচারও হয়ে গেছে—তা, ওর ব্যাণ্ডেজ-বাঁধা চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। ভাবে অসীমই এসবের মূল কিনা? 

সব আশা শেষ হয়ে গেছে তার। গদাই বিগড়ে গেলে এ বাড়িতে টেকা যাবে না। পিছনে শিকারি কুকুরের মতো ঘুরছে ওই আগা সাহেব। কোনো অসতর্ক মুহূর্তে ধরলে তার টুটি ছিঁড়ে দেবে। তার ওপর মুদি, পানওয়ালা তো আছেই। 

এদিকে যথাসর্বস্ব খুইয়ে ওই অসীমকে কেন্দ্র করে বাজি রেখেছিল—সেখানেও ঠকে গেছে, সর্বস্বান্ত হয়েছে জীবনবাবু। 

এমনি নিদারুণ ভাবে ঠকাবে তাকে ওই কালকের ছেলেটা কল্পনাও করেনি জীবনবাবু। একমাত্র পথ, এখান থেকে ওকে হটানো। ওকে দূর করে দিয়ে আবার গদাইচরণের কাছেই মাথা নিচু করতে হবে। ও যদি বিয়ে করতে চায় বাসন্তীকে, বিয়েই দেবে ওর সঙ্গে। বস্তিতে থেকে এত উঁচু নজর তার থাকলে চলবে না। তবু কোনো রকমে বাঁচতে পারবে সে। 

তেষ্টা পেয়েছে। জামাটা ঘামে নিজে গেছে জীবনবাবুর। 

কেড্‌স-এর জুতোটার অবস্থাও তেমনি। কড়ে আঙুল দুটো দুদিকে উঁকি মারছে। কলের জল খাবারও উপায় নেই। বাতি-হাঁড়ির লাইন লেগেছে সেখানে। মারামারিই বাধবে এইবার। 

জীবনবাবু ক্লান্ত দেহটাকে কোনোমতে বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে চলেছে ধুঁকতে ধুঁকতে।

বাড়ির কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল জীবনবাবু। 

দরজাটা বন্ধ। তালা ঝুলছে। তাকে এ বাড়িতে ঢুকতে দেবার কোনো ব্যবস্থাই করে যায়নি বাসন্তী। জীবনবাবু অসহায় রাগে কাঁপছে। 

হঠাৎ কার-হাসির শব্দে ফিরে তাকাল। 

কদম বুড়ি হাসছে। সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে জীবনবাবুর। 

কদম বুড়ি তবু শোনাতে ছাড়ে না; চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ওঠে, 

—দেখলাম যুগলে বেইরে গেল। 

জীবনবাবু কথাটা শুনেছে, হাসির খাদ-মেশানো ওই সুরে সারা মন তার বিষিয়ে ওঠে।

বাসন্তীকে একেবারে বিগড়ে দিয়েছে ওই বখাটে ছেলেটা। হাড়ে হাড়ে এটা বেশ বুঝেছে জীবনবাবু—খাল কেটে একটা কুমির ঢুকিয়েছে সে। 

এইবার তাকেই উৎখাত করে তবে সে ছাড়বে। 

কোনোরকমে দেহটাকে টেনে বাইরে নিয়ে এল জীবনবাবু। 

বৈকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। আবছা অন্ধকার জমেছে গাছপালার মাথায়। আনমনে চলেছে জীবনবাবু। আজ আর কোনো ভয়-ভাবনা তার নেই। আগা সাহেব ধরে ধরুক। গদাই সরকার যা পারে করুক। দুনিয়ায় কারো জন্যে আজ তার মায়া-মমতা নেই। দুনিয়ার ওপর সব মায়া-মোহ কেটে গেছে তার। চারিদিক থেকে শুধু ঠকছে, আর আঘাত পাচ্ছে। 

আগেকার সেই দিনটির কথা মনে পড়ে। অনেক দুঃখে, অনেক বেদনায় সেই রাত্রে নিজেকে শেষ করে দিতেই চেয়েছিল। 

তবু মন থেকে লোভের ছায়া মোছেনি। বাঁচতে চেয়েছিল—লোভী-মন কল্পনা করেছিল, একজনের মৃত্যুতে আবার সে নতুন জীবন পাবে। 

তাই ফিরে এসেছিল। কিন্তু আজ মনে হয়, মস্ত ভুলই করেছে সে সেদিন। 

আনমনে চলতে চলতে কখন যে এতখানি পথ এসে গেছে জানে না। 

লেকের গভীর খাদের দিকে এগিয়ে চলেছে জীবনবাবু। জায়গাটায় গাছগাছালির ভিড় খুব বেশি। এখনও বনের মতোই রয়ে গেছে এ জায়গাটা। রাতের আঁধারে লোকজনও কম আসে এদিকে, নিচে গভীর কালো জল! 

জীবনবাবু আজ সব জ্বালা জুড়োবে ওই জলের গহনে। 

বাসন্তী আর অসীম আবার নতুন করে বাঁচবার স্বপ্ন দেখে। বাসন্তী বলে ওঠে—বাড়িটা কেমন?

—ভালোই। 

নতুন বাসার স্বপ্ন দেখে বাসন্তী। 

একটি ছোট্ট-নীড় যেন। এই পরিবেশ থেকে দূরে আবার নতুন করে বাঁচবে তারা। অসীম বলে চলে, 

—কাজ বেশি করলে ওভার-টাইম পাব। তাছাড়া ভাবছি, কাজকর্ম একটু শিখে নিতে পারলে চাকরি না করে নিজেই একটা গ্যারেজ করব ওপারে, নিজের জায়গায়। 

—সত্যি! বাসন্তীও ওর সঙ্গে স্বপ্ন দেখছে। 

—ছোট্ট একখানা বাড়িও করব। 

কেমন ধাপে-ধাপে জীবনের দিনগুলো আজ তার কাছে পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে। তার মনের মাঝে চাপাপড়া একটা শক্তি আর সাহস আবার জেগে উঠে মাথা তুলছে ধীরে ধীরে। 

নিজের ওপর আস্থা খুঁজে পেয়েছে অসীম। 

বাসন্তীর হাতখানা ওর হাতে, লেকের কালো জলে পড়ছে তারার আলো। 

মৃদু ঢেউ-এর মাথায় একটা বিচ্ছুরিত সোনালি রেখায় সেটা কাঁপছে যেন। বাসন্তীর দু’চোখে সেই আলোর আভা। 

কোথায় কোন্ অসীমে তারা দু’জনে যেন হারিয়ে গেছে। 

অসীম বলে চলেছে, 

—বাঁচার সব আশা যেদিন হারিয়েছিলাম, সেদিন তোমার চোখে দেখলাম, বাঁচা যায়। সব কষ্ট-সয়েও বেঁচে থাকে মানুষ—আবার ঘর বাঁধে। 

হঠাৎ আব্‌ছা অন্ধকারে একটা ছায়া-মূর্তিকে দেখে থামল অসীম। 

কে যেন চুপিসারে ওদিকে একটা যজ্ঞিডুমুর গাছের অন্ধকারে দিকে এগিয়ে চলেছে। নীচে, অনেক নীচে লেকের গভীর জল। 

লোকটার মনে একটা মতলব আছে নিশ্চয়ই। 

অসীম তা টের পায়। একদিন সেও তো অমনি করে রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। 

আজও তো তার জীবনের একদিকে এমনি আলো, আর অন্যদিকে আঁধার জুড়ে আছে। তাই কেউ বাঁচে—কেউ ভুল করে জীবনটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। একদিন পুরনো একটা অব্যবহার্য বস্তু হিসাবে সেটাকে ফেলে কোথায় ফেরারি হয়ে যায়—আত্মহত্যা করে বসে। 

ওই ছায়ামূর্তির, দু’চোখে তেমনি কোনো নিবিড় হতাশার অন্ধকার। অসীম চকিতের মধ্যে উঠে গিয়ে লোকটার হাতখানা ধরে ফেলে। 

চমকে ওঠে জীবনবাবু হঠাৎ বাধা পেয়ে! 

মরতেই যাচ্ছিল সে। ঘৃণায়, লজ্জায়, অপমানে, জীবনের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে আজ এই চরম পথটা বেছে নিয়ে সে। সেদিন পারেনি, আজ পারতেই হবে তাকে। 

লাফ দিয়ে পড়বে সে লেকের অথৈ জলে। সাঁতার জানে না—কয়েকটা মিনিট মাত্র—কেমন ঠাণ্ডা দমবন্ধ-করা অনুভূতিটা মনে মনে কল্পনা করে সহনীয় করে তুলেছে জীবনবাবু। 

দিন-দিন, প্রতিদিন জীবনের অথৈ উত্তাল ঊর্মিমুখর সমুদ্রে হাত-পা ছুড়ে বৃথাই নাকানি-চুবানি খেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে, এমনি দমবন্ধ-করা একটা শীতল অনুভূতির অতলে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া অনেক, অনেক ভালো, অনেক শান্তির। 

হঠাৎ বাধা পেতেই ফিরে তাকাল জীবনবাবু। 

তারার আলোয় দু’জনে দু’জনকে চিনতে পারে। চমকে ওঠে জীবনবাবু। 

—তুমি! তুমি এখানেও এসেছ ছোক্রা—বাউণ্ডুলে কোথাকার! 

অসীম ওর স্বরে বিস্মিত হয়। জীবনবাবু আজ ভেঙে পড়েছে। অসহায় একটি মানুষ।

বলে চলেছে জীবনবাবু, 

—শান্তিতে বাঁচতেও দেবে না—মরতেও দেবে না আমায়? আজ আর বাঁচবার কোনো পথ নেই—তুমিই বাধ্য করেছ আমাকে এই পথ নিতে! পথ ছাড় এবার—আর নয়। 

অসীম ওর অভিযোগের জবাব দিতে পারে না। 

ওদের কথাবার্তা শুনে উঠে আসে বাসন্তী। জীবনবাবু ওকে এখানে দেখে চমকে ওঠে, অসহ্য-রাগে জ্বলছে একটি মানুষ। 

জীবনবাবু বলে চলেছে, 

—আমার সব আশা-ভরসা সব শেষ হয়ে গেছে, বাঁচার কোনো পথই নেই। আপনজন ও কেউ নেই যার ওপর ভরসা করতে পারি। 

বাসন্তী বলে ওঠে, 

—কি বলছ তুমি, বাবা! ভালো চাকরি পেয়েছে ও, নতুন বাসাও পাবে। 

জীবনবাবু মেয়ের দিকে তাকালো। কেমন লজ্জা-জড়ানো সুরে কথা বলছে বাসন্তী। তারার আলোয় দেখে, ওর দু’চোখে নতুন একটি আশার আলো। কি যেন ভাবছে জীবনবাবু? 

অসীম বলে ওঠে, 

—আমিও মরতে গিয়েছিলাম, সেদিন বাঁচিয়েছিলেন আপনি। দেখলাম দুঃখ-হতাশাই সব নয়, আজও এখানে মানুষ বেঁচে আছে। তাই চেষ্টা করছিলাম, না মরেও কীভাবে বাঁচা যায়। আজ একটা পথও পেয়েছি। 

কথাটা ভাবছে জীবনবাবু। বিস্ময়ে, বিস্ফারিত-চোখে ওদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ওদের কণ্ঠে আশার সুর। তারই সংক্রমণ লাগে ওর মনে। 

বাসন্তী বাবার হাতটা ধরেছে! 

পিছনে আঁধারে-ঢাকা মৃত্যুর স্তব্ধতা-ভরা ওই লেকের অতল জলরাশির বুকে বাতাস লেগেছে, গাছে-গাছে, পাতায়-পাতায় আঁধারে সুর উঠেছে। ওরই মাঝে ডাকছে দু’একটা রাতজাগা পাখি।

ওরা মৃত্যুর হতাশা-ভরা অন্ধকার থেকে মানুষের জগতে ফিরছে। আলোয়-ভরা ওই বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে আসে তিনটি প্রাণী। 

.

গদাই সরকার এখনও আশা ছাড়েনি। 

ও-বেলায় কাছারিতে জীবনবাবুকে শাসিয়েছিল, রাতের সেই সদ্য মারখাওয়া গরম মেজাজে। পরে বুঝেছে কাজটা ভাল করেনি, ওকে তাড়িয়ে দিলে তারই লোকসান। 

তাড়াতে হবে ওই ছোঁড়াটাকে। যদি না পারে, তখনই ঢুলিসমেত বিসর্জন দেবার কথা ভাববে।

বৈকাল বেলায় চুপ করে বসে আছে গদাই সরকার। গায়ের বেদনাটা তখনও ঠিক মরেনি, তবে কমেছে খানিকটা। পরেশ আর কালীচরণকে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকাল গদাইচরণ। কিন্তু কথা বলে না। 

কাল রাতে ওরা তাকে ইচ্ছে করেই মেরেছে, না ভুল হয়ে গেছে ওদের, ঠিক বুঝতে পারেনি এখনও। মুখ ভার করে থাকে সে। 

পরেশ এসে চুপ করে বসে ওর হাঁটু টিপতে থাকে। বলে, 

ব্যথাটা কমেছে সরকার মশাই? 

সরকার মশাই তবু নীরব। পরেশ আবার বলে ওঠে, 

—শ্লা—এখনও ডাঁট নিয়ে ফিরছে সরকার মশাই। কুলেপাড়ার মুখে চুনকালি দিয়ে যাবে! আর বুড়োও তো আউট, শেষকালে মেয়েটাকে নিয়েই ও ভাগবে কিনা কে জানে? গতিক সুবিধে বলে মনে হচ্ছে না। 

গদাই সরকার ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছে। 

পরেশই বলে চলে-বুড়োর বরাতে-দুঃখ আছে অনেক। 

গদাই সরকারের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। তার অজানতেই বলে ওঠে, 

—এখন তোরা যা পরেশ, পরে যা হয় জানাব। 

পরেশ একটু যেন মিইয়ে যায়। ভেবেছিল, এখনই কিছু হুকুম হবে, সেই সঙ্গে হাতেও আসবে কিছু, কিন্তু তা আর হল না! 

সরকার মশাই ওদের পাত্তাই দিল না। চুপ করে বের হয়ে এসে পথে নেমে পরেশ গজরায়, 

—বয়ে গেছে আমাদের। 

কিন্তু গদাই সরকার এখনও হাল ছাড়েনি। 

আজ সন্ধ্যায় একবার নিজে যাবে, বাসন্তীর সঙ্গে দেখা করে বুঝবে ব্যাপারটা। 

তাই বোধহয় এসেছে আবার। 

আঁধারে বস্তির এদিকে-ওদিকে ঘোরাঘুরি করছে। ওদের বাসার ওখানেও গেছিল, কিন্তু বাসন্তী নেই, দরজায় তালা-বন্ধ। 

কে জানে কোথায় গেছে? বেশ বুঝতে পেরেছে গদাই সরকার যে, পরেশের কথাই সত্যি! এ বাড়িতে তার জন্য কোনো ঠাঁই বোধহয় আর নেই। 

তবু দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে গদাই সরকার গায়ে-মাথায় চাদর জড়িয়ে হঠাৎ আঁধারে ওদের দু’জনকে এগিয়ে আসতে দেখে সরে দাঁড়াল। 

ফিরছে বাসন্তী আর অসীম। 

হাসি আর ওদের কথাবার্তার শব্দ শোনা যায়। গদাই একপাশে চুপ করে গা-ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওদের যেন দেখেও দেখে না তারা, পাশ দিয়ে চলে গেল নিজেদের কথায় মশগুল হয়ে।

চটে উঠেছে—অসহ্য-রাগে জ্বলছে গদাই সরকার। বস্তি থেকে বের হয়ে আসতে গলির মুখেই জীবনবাবুকে দেখে দাঁড়াল একবার! 

জীবনবাবু ফিরছে খুশি মনেই। 

হাতে একটা বড় পাউরুটি, মাটির ভাঁড়ে কিছু আলুর দম। আনমনে সিগারেট টানছে।

গদাই সরকারকে দেখে দাঁড়াল জীবনবাবু। 

এবার সেই হাত-কচলানো, দয়া চাওয়ার ভঙ্গি নেই ওর। 

মাথাটা উঁচু হয়েছে। শরীরে ক্লান্তি, মনের হতাশা সব দূর হয়ে গেছে, এ যেন অন্য কোনো মানুষ। 

গদাইচরণ বলে ওঠে কর্কশ-স্বরে, 

—এদিকে তো সব হছে, জোটে না শুধু বাড়ি ভাড়াই। অ্যা! 

জীবনবাবু বলে—হবে, সব হবে। মাসখানেক সময় দিন। 

দপ্ করে জ্বলে ওঠে গদাইচরণ, বলে, 

—মাসখানেক? 

জীবনবাবু সহজ সুরেই জবাব দেয়, 

—কোর্টে গেলে তার চেয়ে বেশি সময় পাব। অবশ কোর্টে যাবার দরকার হবে না! মাসখানেক পরই সব মিটিয়ে দিয়ে এই বস্তি ছেড়ে আমরা চলে যাব। আর শুনুন— 

গদাই থ’ হয়ে ওর কথাগুলো শুনছে। জীবনবাবু বেশ আইন-সিদ্ধ ভাবেই বলে চলেছে, 

—ভাড়া পান, ওই সময় এসে ভাড়া নিয়ে যাবেন রসিদ দিয়ে। এর মধ্যে কোনো রকম অসম্মানজনক কথা বললে বা অকারণে এলে আমিও ছেড়ে কথা কইব না, মানহানির মামলা করব। 

জীবনবাবু সিগারেটের ধোঁয়া ওর-মুখেই ছেড়ে দিয়ে সটান বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। তখনও কথার ধাক্কা সামলাতে পারেনি গদাই সরকার। থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

চমক ভাঙতেই হঠাৎ তার গতি বৃদ্ধি হয়ে গেল। হাতের কাছে জীবনকে পেলে ঘা-কতক দিয়েই দেবে যেন। সেটা আর হয়ে ওঠে না আপাতত। 

হনহন করে এগিয়ে যায় গলির মোড়ের ঐ চায়ের দোকানের দিকে, খোঁড়া পা নিয়ে গদাইচরণ।

এতবড় কথা বলে যাবে ওই জীবনবাবু গদাই সরকারকে, আর সেও মুখের সামনে ওর হাত-পা নাড়া সহ্য করবে? কখনোই তা হতে পারে না। গদাই সরকার ওই বদমাশ লোকটাকে মজাটা টের পাইয়ে দেবে। 

পরেশ দলবল নিয়ে চায়ের দোকানে বসে বিড়ি ফুঁকছে। আজ রোজগার-পাতি নেই, দেখছে কেমন করে সব শিকার জাল কেটে বের হয়ে যাচ্ছে। এমনি সময় হন্তদন্ত হয়ে চাদর-জড়ানো ওই গদাই সরকারকে লেংড়ে ঢুকতে দেখে অবাক হয়! 

গদাই সরকার পকেট থেকে কয়েকটা টাকা বের করে পরেশের সামনে ছিটিয়ে দিয়ে বলে ওঠে, 

—তোরা কি মরে গেছিস র‍্যা? কুলেপাড়ায় বাপের ব্যাটা কেউ কি নেই নাকি রে?

পিতার যোগ্য পুত্রের দল তখনই মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। বলে, 

–কেন দাদা? 

পরেশ বলে চলেছে, 

—গরিবের কথা বাসি হলে মিষ্টি লাগে সরকার মশাই। তখনই বলেছিলাম…. 

গদাই সরকার হাঁপাচ্ছে। দোকানদার ইতিমধ্যে চা তৈরি করে এনে ওর সামনে ধরেছে! কথা বলবার সামর্থ্য নেই আজ গদাইচরণের। 

 গরম চা-টা চক্‌চক্‌ করে খেয়ে চলেছে সে। একটু দম নিয়ে বলে ওঠে গদাইচরণ,

—কাল…কালই ভেল্কিবাজি লাগাচ্ছি। তোরা শুধু দেখবি, কোনো সমুন্ধি যেন টু-শব্দটি না করে।

পরেশ ভব্যিযুক্ত হয়ে শুনে চলেছে ওর কথাগুলো! 

একথা অনেকবার শুনেছে, এ-কাজ করেছেও অনেকবার ওরা। 

মাথা নেড়ে বলে—ঠিক আছে, তবে পুলিশ-ফুলিশ এনে হাঙ্গামা বাধাবে হয়তো। তবে পুলিশ টের পাবার আগেই ওসব ঝঞ্ঝাট শেষ করে ফেলব। 

গদাই সরকার তাতেই রাজি। বলে, 

—ঠিক আছে, তাই কবুল। দেখিস্, আর যেন ভুল না হয়। 

পানে-রাঙা জিভটা বের করে পরেশ মাথা চুলকে বলে ওঠে, 

—ছিঃ দাদা! ও-কথা বলে আর লজ্জা দেবেন না। 

.

রাত ঘনিয়ে আসে। 

নিশুতি জনহীন হয়ে যায় বস্তি অঞ্চল। গ্যাসের আলোটা নর্দমার ধারে একফালি রাস্তায় মিটমিট করে জ্বলছে। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত বস্তির বাসিন্দারা একটি দিনের ভার টেনে ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। 

.

ঘুমোচ্ছে আজ জীবনবাবু। 

সব চিন্তা তার কেঁটে গেছে, মেঘমুক্ত আকাশের মতো মনে একটা প্রশান্তি জেগেছে, কাজটা সে ভুল করেনি। 

এক ঢিলে দুই পাখি মরেছে। অসীমই এইবার সংসারের বোঝা টানবে, আর বসে-বসে দিন কাটাবে জীবনবাবু। তবু কাজকর্ম চেষ্টা করবে, যা হয় তাই-সই। নাহলেও ক্ষতি নেই। ওর জন্য উদগ্রীব হয়ে তাকে বসে থাকতে হবে না। 

বিয়ে-থা চুকিয়ে দিয়ে, বাসন্তীর দায় থেকেও নিশ্চিন্ত হবে জীবনবাবু। 

তাই ঘুম আসে। 

বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে এ বাড়ির তিনটি প্রাণীই। 

এতদিনের নিদ্রাহীনতার সব দুশ্চিন্তার শেষ হয়েছে জীবনবাবুর। 

.

সকাল বেলাতেই কাজে বের হয়ে যায় অসীম। 

সকালের সিফ্ট-ডিউটি, বাসন্তী একটু ভোরে উঠে উনুন ধরিয়ে চা আর খাবার করে দেয়। অসীমের মন্দ লাগে না এই জীবন। 

কাজের ভিড়ে অবকাশ মুহূর্তগুলো ভরে ওঠে। এই কাজের শেষে আবার ফিরে আসবে বাড়িতে। জীবনটা একটা আশ্বাস আর মাধুর্যের স্পর্শে-ভরা। হোক তা সামান্য, কিন্তু এর মূল্য অনেক। 

বাসন্তী বলে ওঠে, 

—অফিসের বন্ধুদের নিয়ে এসো না একদিন। একসঙ্গে চাকরি করো, ভাবসাব হয়েছে তো? 

হাসে অসীম। বাসন্তী আবার বলে, যতীনকে নিয়ে আসবে, শম্ভুকে ও 

অসীম বলে, আনব, আনব! নতুন বাসায় যাই। 

—সেই ভালো, এখানে থাকতে আর মন চাইছে না। 

বাসন্তীর কথায় হাসে অসীম। মিষ্টি একটু হাসি। সময় হয়ে গেছে, উঠে পড়ে। বাসন্তী ওর হাতে টিফিনের কৌটোটো এগিয়ে দেয়। ওটার কথা মনে ছিল না অসীমের। 

এখনও চাকরিটা ধাতস্ত হয়নি কিনা! 

.

বের হয়ে গেছে অসীম। 

সবে সকালের আলো ফুটে উঠেছে। জেগে উঠেছে বস্তির লোকজন। কলরব ও চ্যাঁচামেচি আর ছেলেপুলেদের কান্না আবার শুরু হয়। 

বাসন্তী স্নান সেরে নিয়েছে ইতিমধ্যে। 

জীবনবাবু আজ সকালে উঠে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বসতে পায়! 

হা-হা করে সারাদিন আর ঘুরতে হবে না পয়সার সন্ধানে রোদে-রোদে। আর লুকিয়েও বেড়াতে হবে না পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য—এইবার মানুষের মতো বাঁচবে সে।

চা খেয়ে বাজারের থলিটা হাতে নিয়ে আর পাঁচজনের মত বের হয়েছে জীবনবাবু। 

দেখেশুনে বাজার করে এনে তারপর বেরুবার কথা ভাববে সে। আজ প্রাণে তেমন তাড়া নেই। 

এরই মধ্যে; কান্ডটা ঘটে যায়। 

গদাই সরকার আজ রুদ্রমূর্তিতেই এসে হাজির হয়েছে এ বাড়িতে। আজ সে একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে। 

আজ কাঁচুমাচু করে ঢোকে না সে। একাও আসেনি, সঙ্গে আছে রায় বাড়ির পাইক-বরকন্দাজ, পেছনে আছে এ পাড়ার সেনাপতি ওই পরেশচন্দ্র এবং তার দলবল। 

সুতরাং বাধা দেবার কেউ নেই। 

তাই নির্মম ভাবে এসেই খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ে গদাইচরণ। 

বাসন্তীও ওকে দেখে হকচকিয়ে যায়। বলে, 

—আপনি! 

গদাই সরকার মিথ্যে মরীচিকার পিছনে ঘোরে না। হিসেবি লোক সে। তাই আজ মন থেকে সব মোহ-মুছে ফেলেছে। 

কঠিন কণ্ঠে জবাব দেয়, 

হ্যাঁ। এ বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে তোমাদের আজই। সেই বুড়োটা কোথায়? তোমার বাবা? 

—বাজারে গেছে। 

—বাজারেই থাকুক। তুমি বের হয়ে এসো। 

কিছু বলবার আগেই দেখে বাসন্তী, লোকজন এনে এটা-সেটা টেনে রাস্তায় বের করছে, আর তক্তপোশ, মাদুর, বিছানা ধরে ছুড়ে ফেলে দিল বাইরে। নানা কৌটা আর হাঁড়ি-কুড়িও বের করছে তারা। বাসন্তী তাদেরকে বাধা দিতে যায়। 

ধমকে ওঠে গদাই সরকার। বলে, 

—খবরদার যাবে না ওখানে। সোজা ঘরের বাইরে চলে যাও। 

বাসন্তী লোকটার দিকে ঘৃণা-ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এ ছাড়া আর করণীয় যেন কিছুই নেই। 

পরেশ-কালীচরণের দলও হাত লাগিয়েছে। টানাটানি করে তারা মালপত্রগুলো রাস্তায় বের করে দেয়। কতক লোকজন এদিক-ওদিক ঘাঁটি আগলাচ্ছে। 

পুলিশ টের পাবার আগেই ওদের উৎখাত করে দরজায় তালা লাগিয়ে দিতে হবে। তাহলেই কার্যসিদ্ধি। 

পথে দাঁড়িয়ে আছে বাসন্তী। মালতী, কদমপিসি ও আরও অনেক জুটেছে। মজা দেখতে বের হয়েছে অনেকেই। 

কদম পিসি বলে, 

—এত অনাচার কি সয় বাছা? তার জন্যে অন্য জায়গা আছে। 

গদাই সরকারও স্বীকার করে, 

—তাই তো এইসব করতে হচ্ছে। ভদ্রলোকের পাড়া- 

—ঠিক কথা! কদম বুড়ি সায় দেয়। 

বাসন্তী চুপ করে দৃশ্যটা দেখছে, শুনছে ওদের কথাগুলো মাথা নিচু করে। 

.

অসীম কারখানায় এসে যথারীতি কাজ শুরু করেছে। 

যতীন ও শম্ভু দুটো ট্রাক-এর মেরামতি নিয়ে ব্যস্ত। প্রায় কাজ হয়ে এসেছে, এরপরই ট্রায়াল দিতে বের হবে। ডেলিভারি দেবার আগে নিজেরাই গাড়ি চালিয়ে অবস্থা দেখেশুনে বুঝে তারপর ওরা ডেলিভারি দেয়। 

অসীমও ওদের সঙ্গে কাজে ব্যস্ত। 

হঠাৎ জীবনবাবুকে হন্তদন্ত হয়ে এদিক-ওদিক খুঁজে আসতে দেখে এগিয়ে যায় অসীম। 

সে অবাক হয়েছে! 

—আপনি? 

হাঁপাতে হাঁপাতে খবরটা বলতে থাকে জীবনবাবু, 

গদাই সরকার দিনের বেলায় তাদের বাড়ি চড়াও হয়ে লুটপাট শুরু করেছে। 

চমকে ওঠে অসীম। লোকটা এমনি শয়তান জানত সে। কিন্তু এতখানি সাহস হবে ওরা তা ভাবেনি! 

যতীন, শম্ভু আরও ক’জন সেখানে এসে জুটেছে। 

জীবনবাবু বলে চলেছেন,—ওরা বাসন্তীকেও অপমান করতে ছাড়বে না। 

যতীনই বলে ওঠে, 

—চলুন, দেখে আসি। 

কারখানার আরও কয়েকজন এগিয়ে আসে। এর বিহিত করবে তারা। দেখতে দেখতে ওরা তৈরি হয়ে পড়ে। 

অসীম ভাবতে পারেনি, তার সাহায্যে ওরা এগিয়ে আসবে। 

ওরা সবাই ট্রাকে উঠে পড়েছে। যতীন বলে ওঠে, 

—চল, দেখে আসি কুলেপাড়ার ওদের। গাড়িরও ট্রায়াল হয়ে যাবে সেই সঙ্গে। শম্ভু, তোর 

কোয়ার্টার তো খালি আছে? 

মাথা নাড়ে শম্ভু বলে—হ্যাঁ। 

—ঠিক আছে! 

দলবেঁধে ওরা সেই ট্রাকেই বের হয়ে পড়ল বেশ কয়েকজন! 

জীবনবাবু একটু ভরসা পায়, আজ আর একা নয় সে। অনেকেই আছে তার সঙ্গে। 

.

গদাই সরকার কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। 

বাসন্তী চুপ করে একটা তোরঙ্গের উপর বসে আছে পথের ধারে। বাবাও ফেরেনি, কেউ নেই তার পাশে। 

ওদিকে পরেশের দল কাজ শেষ করে ভাঁড়ে করে চা আর সিঙাড়া চিবোচ্ছে। গদাই সরকার তর্জন-গর্জন করে চলেছে বীরদর্পে। 

—কই সেই বুড়ো, কোথায় সে? 

এমন সময় ট্রাকটা এসে সেখানে থামে। হচকিয়ে যায় ওরা। 

ট্রাক থেকে নামছে যতীন, অসীম, আরও ক’জন লাফ দিয়ে। ড্রাইভারের পাশ থেকে নামছে জীবনবাবু। 

আজ রাতারাতি তার ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। 

বস্তির লোকজনও এতক্ষণ ব্যাপার দেখে ফিরে গিয়েছিল হঠাৎ ঘটনার দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হতে আবার তারা এসে জুটেছে।  

ছড়ানো-মালপত্র তুলছে ওরা লরিতে। 

পরেশের দলও নিস্পৃহ দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। 

গদাস সরকার এগিয়ে আসে। জীবনবাবুর সামনে দাবি জানায়, 

—আমার তিন মাসের বকেয়া ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তবে যাবে। 

জবাবটা দেয় যতীনই। 

—বাড়িতে থাকলে ভাড়া চাইতেন, বের করে দিয়েছেন, পুলিশে না গিয়ে চলে যাচ্ছি এই ঢের।

গদাই সরকার তবু শাসায়, 

—জানো, ছোক্রা এটা কুলেপাড়া। অ্যাই পরেশ— 

পরেশ ওদের দলবল দেখে ঘাবড়ে গেছে। বেশ বুঝেছে, ওরা পেশাদার হাতুড়ি-ঠুকিয়ে। গোলমাল শুরু হলেই পরেশের ক’জনকে বেমালুম সাবাড় করে দিয়ে যাবে। তাই পায়ে পায়ে সরে পড়ে ওরা। গদাই সরকারের কথা কানে যায়নি তাদের! 

একাই যেন পড়ে থাকে গদাই সরকার। 

ওর নাকের উপর দিয়ে চলে গেল লরিটা। বাসন্তী আর জীবনবাবু চলে গেল। ওই গাড়িতে চড়ে।

বেশ বুঝতে পারে গদাই সরকার, ওরা সবাই তাকে ঠকিয়েছে। পা-টা তখনও সারেনি। খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলেছে গদাইচরণ। বস্তিটা যেন ফাঁকা, শূন্য হয়ে গেছে আজ। 

বাসন্তী আর জীবনবাবু চলেছে লরিতে। 

অসীমও নতুন আশ্রয়ের সন্ধান পেয়েছে অনেক চেষ্টায়। 

জীবনবাবুও। 

এখানে পাওনাদারের ভয় নেই, আগা সাহাবের তাড়া নেই। শান্তিতে বাঁচবে এইবার। বাসন্তীর কাছে দিনের রোদটা বেশ মিষ্টি লাগে। কর্মব্যস্ত মহানগরীর দিকে তাকিয়ে থাকে সে। 

এরই মাঝে আবার সে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে, একজনকে কেন্দ্র করে। এ বাঁচায় তৃপ্তি আছে, আনন্দ আছে। 

মনে মনে তাই সুর জাগে। ঘন মেঘের ফাঁকে সূর্যের অরুণিমা ফুটে উঠেছে, তির্যক আলো-মাখা একটি বলিষ্ঠ রেখায়। 

(সমাপ্ত)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *