জীবন কাহিনি – ৭

জীবনবাবু সকালে উঠেই রান্নাঘরে ঢুকে দেখে, হালুয়ার কণামাত্র অবশিষ্ট নেই। এমন তেজি হালুয়ার প্লেটটা পড়ে আছে শূন্য হয়ে। 

জীবনবাবু চমকে ওঠে ব্যাপারটা দেখে। 

কিছু বলবার উপায় নেই। 

বেশ বুঝেছে, কুকুর-বিড়ালও যদি ওটা খায় তাদেরও রেহাই নেই; একটা মারাত্মক কাণ্ড বেধে যাবে। 

বাসন্তীকে বের হয়ে আসতে দেখে সরে গেল ওদিকে জীবনবাবু। ওর দৃষ্টির-অগোচরে নিজের ঘরে ঢুকে ব্যস্তসমস্ত হয়ে এগিয়ে যায় সে। ওপাশে জীর্ণ কেওড়া-কাঠের নড়বড়ে তক্তপোশে শুয়ে আছে অসীম। 

চুপিসারে এগিয়ে এদিক-ওদিক চেয়ে অসীমের নাকের কাছে হাতটা ধরে একটু আশা ভরেই ভাবে, যদি সব কিছু শেষ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই। 

মুখে একটা আনন্দের আভা ফুটে ওঠে। তেমনি নিশ্বাসের কোনো স্পর্শ নেই বলেই মনে হয়। সব থেমে গেছে হয়তো! 

অসীমের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সকালের দিকেই। 

উঠি-উঠি করেও ওঠেনি, চোখ-বুজে শুয়ে-শুয়ে ভাবছিল। 

আর ক’টা দিন কাটাতে পারলেই চাকরিটা পেয়ে যাবে। তারপর একটা বাড়িও দেখবে, এখান থেকে চলে যাবে তারা। 

কেমন একটা মিষ্টি আবেশে মন ভরে ওঠে তার। হঠাৎ এমনি সময় চুপিচুপি জীবনবাবুকে ঢুকতে দেখে মট্‌কা মেরে পড়ে থাকে অসীম চোখ-বুজে। 

জীবনবাবু কেমন সাবধানি পদক্ষেপে তার বিছানার দিকে এগিয়ে এসে ওর নাকের সামনে হাত রেখে কি দেখতে থাকে! 

অসীমও দমবন্ধ করে রেখেছে। 

সারা দেহটায় কোথাও এতটুকু নড়াচড়া নেই। 

জীবনবাবু খুশি হয়ে ওঠে, যাক্, এতদিন কাজ শেষ হয়েছে, কথা রেখেছে অসীম। বিছানা চাদরটা সটান মাথা পর্যন্ত ঢেকে অসীমকে বিছানায় রেখে বার হয়ে আসে সে। 

কি ভাবছে জীবনবাবু! এরপর সৎকার করতে হবে। 

হুঁকোটায় কলকে দিয়ে জুতসই করে বসে টানবার আয়োজন করে। একটু ধূমপান না করলে এসব চিন্তার জট-ছড়ানো যাবে না। 

বাসন্তী বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। 

বুড়ো জীবনবাবু বলে ওঠে, 

—লেকের ওপাশে কাঠাকয়েক জায়গা পাচ্ছি, ভাবছি কিনে নেব। 

বাসন্তী অবাক হয়! জানে, আজ আনলে কাল খেতে পাই না। এ হেন লোক সকাল বেলাতেই দশহাজার টাকার কথা কইছে। কে জানে, ওঁর মাথাটা বিগড়ে গেল কিনা? 

অভাবের চাপে এমনও তো হয়! বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে বাসন্তী। জীবনবাবু বলে ওঠে, 

—হ্যাঁ, কিনবই। এভাবে বস্তিতে থাকা যায়? জানিস, অ্যাইসা দিন নেহি রহেগা। 

বাসন্তী চা-এর কেটলিটা এনে নামিয়েছে। বাবার হাতে তুলে দেয় চায়ের কাপটা। জুতসই করে জীবনবাবু সবে পেয়ালায় চুমুক দিয়েছে, হঠাৎ অসীমকে সশরীরে বের হয়ে আসতে দেখে আঁতকে ওঠে। 

সব আশায় ছাই দিয়ে দিব্যি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে মূর্তিমান। ও যেন মৃত্যুঞ্জয়—নীলকণ্ঠও বলা যেতে পারে। 

জীবনবাবুর হাত থেকে পেয়ালাটা শানবাঁধানো উঠোনে পড়ে দুটকরো হয়ে যায়। বাসন্তী অবাক হয়ে বাবার দিকে চেয়ে থাকে। জীবনবাবু হুঁকোটা নামিয়ে উঠে দাঁড়াল। 

—বাবা! 

বাসন্তীর কথায় সাড়া দিল না জীবনবাবু। আলনা থেকে জামাটা টেনে সটান মাথা গলিয়ে নিয়ে চটিটা খুঁজছে। 

—কোথায় যাবে? বাসন্তী প্রশ্ন করে। 

জীবনবাবু মেয়ের কথায় ফোঁস করে উঠে বলে, 

—যমপুরীতে, জাহান্নামে যাব। 

বীরদর্পে বের হতে যাবে জীবনবাবু, হঠাৎ দরজার কাছে এসেই থমকে দাঁড়ায়। মূর্তিমান আগা সাহেবই খুঁজে খুঁজে বস্তির ভিতরে হানা দিয়েছে। জীবনের সঙ্গে শুভদৃষ্টি হতে-হতে রয়ে গেছে। 

.

জীবনবাবু কপাটটা বন্ধ করে দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নাল-বাঁধানো জুতোর শব্দ তুলে এগিয়ে আসছে আগা সাহেব। তাদের বাড়ির সঠিক সন্ধান সে জানে না, তাই হাঁটতে হাঁটতে বস্তির ভিতরের দিকে চলে যেতেই জীবনবাবু দরজাটা খুলে সোজা বাইরের দিকে দৌড় মারে। 

আগা সাহেব তখনও বস্তির মাঝে জীবনবাবুর সন্ধান করে চলেছে—এ দীবন! দীবনবাবু হো! 

জীবনবাবুর কানে তখনও সেই ডাক ভেসে আসে, যেন কোনো যমদূত তাকে হেঁকে হেঁকে ফিরছে। ওকে এড়িয়ে থাকবে আর ক’দিন! কোন্ অসতর্ক মুহূর্তে একেবারে খপ্ করে ধরে ফেলবে এবং তারপরের ঘটনা খানিকটা অনুমান করে নেয় জীবনবাবু। 

সেদিনের ষণ্ড-মহারাজের সিঙের গুঁতো আজও ভোলেনি আগা সাহেব। সেই শোধ তুলবে আজ। 

এই বিপদ থেকে একমাত্র রক্ষা করতে পারে ওই গদাই সরকার, তাকে দিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে। 

অসীম এখন ওর ঘাড়ে চেপে বসেছে। ওর আহার-আশ্রয় জোগাবার দায়িত্ব এখন জীবনবাবুরই। শুধু তাই নয়, মেয়েটার কচি মাথাটাও সে বিগড়ে দিয়েছে। আজ জীবনবাবুই যেন বাড়ির কেউ নয়। 

খাল কেটে কুমির এনেছে। মনে হয়, টাকার আর দরকার নেই। মানে মানে আপদ বিদায় হলেই বাঁচে। কিন্তু ওকি সহজে যাবে! অসীম এখানে শিকড় গেড়ে বসেছে। জীবনবাবু এক-একটা চাল সে সমূলে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। দিব্যি টিকে আছে বহাল তবিয়তে, মরবার নাম পর্যন্ত করে না বকাটে—ছেলেটা। 

জীবনবাবুর পথে বের হবারও কোনো উপায় নেই। চারিদিক থেকে পাওনাদাররা যেন মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরবে। মুড়ির দোকানদার, পানবিড়িওয়ালা, মুদি—ওদের চোখ যেন রাস্তার ওপরই পড়ে থাকে। 

জীবনবাবু ওদের এড়াতে যাবে তো ড্রাইং-ক্লিনিং-এর মালিক পথ আগলায়। 

জীবনবাবু বলে,–দোব বাবা, সব মিটিয়ে দোব। 

ধৌতগারের মালিক আশু বেশ কড়া-স্বরেই শাসায়, 

—এইবার ওসব বকেয়া মিটিয়ে না দিলে তোমাকেই আড়ং-ধোলাই দিয়ে দোব। আড়ং-ধোলাই বোঝ তো? 

জীবনবাবু ওর-হাত এড়িয়ে গলিটার দিকে এগিয়ে চলেছে! খোলা ড্রেন, ওদিকে খোলা টালি, নয়ত টিনের ছাওয়া বস্তি। বিশেষ শ্রেণির এলাকা এটা। 

হঠাৎ গলির মুখেই দাঁড়িয়ে আছে আগা সাহেব। লালচে দাঁতগুলো আকর্ণ বিস্তার করে হাসছে নিষ্ঠুর পৈশাচিক আনন্দে 

—ক্যা দীবন? অ্যাঁ! 

শিয়াল যেন এইবার খপ্ করে ছাগলের কণ্ঠনালী টিপে ধরবে। ঠিক সেই মুহূর্তেই জীবনবাবু দৌড় শুরু করেছে। শীর্ণ লোকটা দৌড়াচ্ছে, পিছনে পিছনে ভারী নাল-বাঁধানো জুতোর শব্দ তুলে তাড়া করেছে সেই দৈত্যটা। মাথায় পাগড়ির প্রান্তদেশ উড়ছে হাওয়ায়। 

জীবনবাবু পথ না পেয়ে সামনেই একটা বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা কলরব ওঠে। 

খুপরি-খুপরি ঘর, মাঝখানে একটু উঠোনের মত। 

ঘরে ঘরে পসারিণীদের আশ্রয়। সকালবেলায় মেয়েরা সবে উঠে চা-জল খাবার জোগাড় করছে আর হাসাহাসি করছে, এমন সময় তাড়া খেয়ে জীবনবাবুকে ঢুকতে দেখে কলরব করে ওঠে তারা। 

বাড়িওয়ালি মাসিও বিশালদেহ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, হাতে তার পরিত্যক্ত একটা নারকেলের ঝাঁটা—সজোরে সেটা নিক্ষিপ্ত হয়েছে দু’জনের দিকে। সরে গেছে জীবনবাবু, ঝাঁটা গিয়ে সাঁ-করে পড়েছে আগা সাহেবের মুখে। 

সে আঘাত সামলাবার আগেই রণক্ষেত্রে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে বাড়িউলি 

—কোন্ ড্যাগরা রে? বলি, এখানে কি করতে এসেছিস ঘাটের-মরা? 

আগা সাহেব দু’চোখ মেলে তখনও জীবনকে খুঁজছে। জীবন এই সুযোগে ওপাশের সরু গলি দিয়ে সরে পড়েছে। 

ধরা পড়েছে আগা সাহেব। 

ওই দেবভাষা ঠিক বুঝতে পারে না সে। জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে বাড়িউলির দিকে।

পরিত্যক্ত ঝাঁটাটা ফের তুলে নিতে আগা সাহেব পায়ে-পায়ে বের হয়ে আসে। বাড়িউলি তখনও গজরাচ্ছে। 

—কোথায় এসেছ জানো না? ঝেঁটিয়ে বিষ ঝেড়ে দোব। সৌরভীর বাড়িতে হাঙ্গামা বাধাতে এয়েছ? পীরের কাছে মামদোবাজি! 

আগা সাহেব আমতা আমতা করে বলে, 

—দীবনবাবু তো বাগলো। 

সৌরভী তখনও গর্জন করছে,—জীবনবাবু তো বাগলো! মারব ঝাঁটা, বেরো বলছি! 

এসব দেখে মেয়েরাও হাসাহাসি করছে। সাত-সকালেই বেশ বিচিত্র এক কাণ্ড দেখছে তারা। এদিকে অনেক লোকজন জুটে গেছে। আগা সাহেব মাথা নিচু করে বের হয়ে গেল এ-বাড়ি থেকে। 

জীবনবাবু একদমে ততক্ষণে বহুদূর এসে পড়েছে। 

হাঁপাচ্ছে, সারা গা-দিয়ে ঘাম ঝরছে। রাস্তার ধারে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একটু সামলে নিয়ে আবার চলতে থাকে। 

চারিদিকের এই সমূহ বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে একটিমাত্র লোক, সে ওই গদাই সরকার। তার আশ্রয়েই যাবে সে। 

জীবনবাবু রায়বাবুদের কাছারি বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। 

বিশাল সীমানা জুড়ে বাড়িটা; পেছনে তিনমহল প্রাসাদ এদিক থেকে ওদিক অবধি চলে গেছে।

সামনের দিকের চত্বর, পূজামণ্ডপ—চারিপাশে টানা বারান্দার গাছে ছোট-বড় ঘরগুলোয় আমলা, পাইক-পেয়াদা-বরকন্দাজরা থাকে। ওদিকে মস্ত টিনের চালার গ্যারেজ। 

দেউড়িতে ঢুকল জীবনবাবু দুরুদুরু বুকে। সেখানে নানা লোকজনের ভিড়। ওপাশে তক্তপোশ-পাতা ঘরে বসে আছে গদাইচরণ, সেই দিকেই এগিয়ে চলে জীবনবাবু। 

হঠাৎ দরজার কাছে যেতেই কার চিৎকারে থামল সে। 

গদাই সরকার গোঁ-গোঁ করে কিসব বলছে! ঠিক চেনা যায় না তাকে, তক্তপোশের এক কোণে একটা চাদর জড়িয়ে পিঠে দুটো বালিশ দিয়ে বসে আছে গদাইচরণ। নাকে-কপালে ব্যান্ডেজ, মুখ-চোখ ফুলে উঠেছে। বাঁ-হাতে একটা কাপড়ের ফালি দিয়ে গলার সঙ্গে ঝোলানো। 

জীবনবাবু কিছু বলবার আগেই গদাই সরকার তাকে দেখেছে। বেশ কঠিন সুরেই বলে ওঠে,

–ওরে, সতেরো নম্বরের আদায় সরকারকে ডাক। পাইক-পেয়াদা নিয়ে যাবে। তারপর জীবনকে বেশ ব্যঙ্গের সুরে বলে ওঠে গদাইচরণ, 

—হঠাৎ কী মনে করে? সেই নগদ হাওলাতের পঞ্চাশ টাকা দিয়ে যেতে হবে আজই।

জীবনবাবু এখানে এসেই বুঝতে পারে, কেমন বেসুরো-বেতালা হাওয়া বইছে এখানে। তবু চেষ্টা করে একটু দরদভরা কণ্ঠে, 

—হঠাৎ আপনার শরীর খারাপ হয়েছে শুনলাম। 

গদাইচরণ মাথা নাড়ে। ওসব ছেঁদো কথায় আজ ভুলবে না সে। কঠিন স্বরে বলে ওঠে গদাই, 

—না, ভালোই আছি। বকেয়া ভাড়া কবে পাব শুনি? 

জীবনবাবু আমতা আমতা করে। বলে, 

—একটু হাতটান চলছে। 

ফোঁস করে ওঠে গদাইচরণ, 

—দানছত্র খুলিনি মশাই। তিনদিনের মধ্যে যদি ভাড়ার টাকা জমা না দেন, আমরা জবর-দখল করব। আর পঞ্চাশ টাকা না পেলে গলায় গামছা দিয়ে—। 

জীবনবাবু বেশ বুঝেছে, কেমন যেন সব ওলট-পালট হয়ে গেছে, নইলে এমন পাকা ঘুঁটি কেঁচে যায়! শুনেছিল সে, সরকার মশাই নাকি বেশ দিলদরাজ লোক। নিজেও দেখেছে, বাসন্তীর সঙ্গে ওকে অন্য সুরে কথা বলতে। 

কিন্তু আজ এমন অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছে সেই সরকার মশাই যে, কথা বলা যায় না তার সঙ্গে! শুধু তাই নয়, ও, যা বলছে তা করতেও পারে। 

দু’হাত জোড় করে অনুনয় করে জীবনবাবু বলে, 

—সরকার মশাই! 

কিন্তু ভবি ভোলবার নয়, গদাই সরকার কাছারিতে বসলে সিংহ হয়ে ওঠে। সিংহের গর্জনে চারিদিক কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছাড়ে। 

—ওসব কথা ছাড়ুন মশাই, এখন যান দিকি। আর হ্যাঁ, তিনদিন সময় দিলাম, তারপর গদাই সরকারের খেল দেখাব! আমাকে ধাপ্পা দেবে এতবড় মরদ এখনও তল্লাটে জন্মায়নি। 

জীবনবাবু বের হয়ে আসে মাথা নিচু করে। 

বেশ বুঝেছে এখানে আর চালাকি চলবে না। সবই হত, কিন্তু গোল বাধিয়েছে ওই ফক্কর ছোঁড়াটাই। ওই অসীমই নিশ্চয়ই কিছু বলেছে গদাই সরকারকে। বাসন্তীর মাথাটাও বিগড়ে দিয়েছে, ও হয়তো কিছু বলেছে আর তারপর থেকেই চটে উঠেছে সরকার মশাই। 

জীবনবাবুর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে ওই অসীম আর বাসন্তীর ওপরই। 

দু’জনে মিলে এইবার তাকে পাগল করবে। বাইরে বের হবার উপায় নেই। জীবনবাবু যেন পেঁচা—হঠাৎ পথ ভুলে দিনের আলোয় এসে পড়েছে, আর রাজ্যের যত কাক-চিল তার পেছনে লেগেছে, আর সে বেচারা লুকোবার জন্য গাছের কোটর খুঁজছে। 

জীবনবাবুর অবস্থাটা ঠিক ওই পেঁচার মতোই। 

আজ সে এর একটা হেস্ত নেস্ত করবে। এমনি করে তার সর্বনাশ ঘটাবে ছেলেটা, সে আর চুপ করে সহ্য করবে না। 

বেলা ক্রমশ বাড়ছে। 

কর্মব্যস্ততা শুরু হয়েছে চারিদিকে। সারা এলাকার লোক চাট্টিখানি নাকে-মুখে গুঁজে ছুটছে অফিসের দিকে। সবাই কাজে ব্যস্ত, করণীয় কাজে সকলেরই কিছু আছে, নেই শুধু তারই।

আজ তার বয়স হয়েছে। জীর্ণ শরীরটা টেনে রোদের মধ্যে ধুঁকতে ধুঁকতে ফিরছে জীবনবাবু, আর ততোধিক ছাতাটা মেলে পাওনাদারের শ্যেনদৃষ্টিকে আড়াল দিয়ে। 

মাঝে মাঝে ঝুলন্ত লোকের কলরবমুখর দু’একটা বাস বেগে এগিয়ে যায়, আর ওই বাতাসের ঝাপটায় তার ছাতাটাই বোধহয় উল্টে যাবে। বড় রাস্তা ছেড়ে বস্তির গলিতে ঢুকল সে। 

রোদে আর চারিদিকের ওই অত্যাচারে কেমন অতিষ্ঠ আর মরিয়া হয়ে উঠেছে জীবনবাবু।

বাড়িতে ফিরেই বাসন্তীকে দেখে জিজ্ঞাসা করে, 

—সেই লাটসাহেবের বাচ্চাটা কোথায়? 

বাসন্তী বাবার কথা শুনে একটু অবাক হয়। রোদে তেতে-পুড়ে ঢুকেছে বাবা। বাসন্তী বলে ওঠে, 

—বেরিয়ে গেছে, কি কাজ আছে বলে গেল। 

গজগজ করে জীবনবাবু বলে, 

—কাজ! রাজকার্য করছেন; আপদ যতসব। কি বলা হয়েছে ওই গদাই সরকারকে, অ্যাঁ? অবাক হয় বাসন্তী বাবার কথায়। মনে মনে ভাবে, কই, তেমন তো কিছু বলিনি। কালই তো এসেছিল লোকটা। ওকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না সে। মহা-শয়তান লোকটা। ইচ্ছে করলেও কড়া কথা কিছুই বলতে পারেনি। বলে ওঠে বাসন্তী, 

—কই, কিছুই তো বলিনি। 

—বলিসনি? 

—কেন বলতে যাব? কাল রাত্রেই তো এসেছিল, চা-সুজি খেয়ে গেল। 

অবাক হয়ে যায় জীবনবাবু! ধপ্ করে দাওয়ায় বসে পড়ে। 

—সুজি খেয়ে গেল? সেই হালুয়াটা? সব! 

— হ্যাঁ। 

জীবনবাবু ব্যাপারটা ঠিক যেন ঠাওর করতে পারে না। আধভরিটাক আফিমই ছিল কৌটাতে; সবটাই ঢেলেছিল সে ওই হালুয়া। কি সাংঘাতিক কাণ্ড হতে হতে রয়ে গেছে! বেশ বুঝতে পারে জীবনবাবু, ওই বাসন্তী আর অসীম দুজনেই একটা ষড়যন্ত্র গড়ে তুলেছে তার বিরুদ্ধে। আজ জীবনবাবু ওদের দুজনকেই বুঝিয়ে দিতে চায়, এ বাড়ির কর্তা জীবনবাবুই, ওরা কেউ নয়। অসীম তো ফাল্গু। 

ওই ছোঁড়াটাকে এইবার বিদেয় করবে। ঝকমারি করেছিল সে, ফাঁকি দিয়ে মোটা টাকা আদায় করবার ফন্দি করে। তার জন্য এত দাম দিতে হবে এ কল্পনা সে আদৌ করেনি। 

গদাই সরকারকে হাতে রাখলে তবু এখানে কিছুদিন টিকতে পারবে সে। তাই আজ সেই পথেই এগিয়ে যেতে চায় জীবনবাবু। বলে ওঠে, 

—কথাবার্তা ভাবছি পাকাপাকিই করে ফেলব। গদাই সরকারও ঝুলোঝুলি করছে। তাছাড়া পাত্র হিসেবে সে মন্দই-বা কি? দু’খানা বাড়ি; নগদ টাকা-পয়সা সবই আছে। না হয় একটু বয়স বেশি। তা, তুইও তো আর কচি খুকিটি নোস। 

বাসন্তী বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওঁর কথাগুলো যেন ঠিক বিশ্বাস করতে মন চায় না। বাসন্তীর দু’চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। এ যেন এক চরম সর্বনাশের অন্ধকার। 

অসীমের কথা মনে পড়ে বাসন্তীর। 

তার তুলনায় ওই বুড়ো গদাই সরকার একটি মূর্তিমান শয়তান। তাকে বিশ্বাস করা যায় না। মনে মনে ওর কথায় শিউরে উঠেছে বাসন্তী। জীবনবাবু বলে চলেছে, 

—তোর একটা গতি হলে ‘ব্যোম ব্যোম’ করে পথে বেরিয়ে পড়ব, ব্যস! বাসন্তী বলে ওঠে,

—এতই যদি বোঝা হয়ে থাকি, আর কিছু না পারো কিছুটা আফিম কিনে দাও, সব জ্বালা  জুড়িয়ে যাবে তোমার 

—আফিম! 

কথাটা শুনে চমকে ওঠে জীবনবাবু। 

বাসন্তী বলে ওঠে, 

—হ্যাঁ, আফিম! মরতেও তো পারব ওটা খেয়ে। 

—মরা এত সোজা! তাহলে সবাই মরত। 

.

বিরক্ত হয় জীবনবাবু! মরার কথায় আর বিশ্বাস করতে চায় না সে। ঢের হয়েছে, ঢের দেখেছে, মানুষ শত দুঃখে-কষ্টের মাঝেও বেঁচে থাকতে চায়। মরার কল্পনা করাই বাতুলের লক্ষণ। নইলে যে মরতে চেয়েছিল, একদণ্ডও যে এই পৃথিবীতে থাকতে চায়নি, সেই অসীমও আজ আর মরতে চায় না। মরণকে এখন ভয় করে সে। 

নইলে যে জীবনটাকে ক্ষণিকের ভুলে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল, তাকে, আবার ভালোবাসতে পারে! দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে একটা অচেনা লোকের বাড়িতে থেকে, তাদের অন্নে প্রতিপালিত হয়ে, বেঁচে থাকবার শক্তি আহরণ করে নেয়! তাই বাসন্তীর কথায় বিরক্তি-ভরা কণ্ঠে বলে ওঠে জীবনবাবু, 

—থাম, থাম, মরছে সবাই! ওই শালা কুকুরই মরে, মানুষ মরে না। শত দুঃখেও সে বাঁচবার পথ খোঁজে—বেঁচেও থাকে। 

হঠাৎ বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনেই জীবনবাবু থেমে যায়। ইশারা করে বাসন্তীকে দরজার দিকে গিয়ে ব্যাপারটা দেখতে বলে সে রান্নাচালার মধ্যে গিয়ে ঢোকে। ইশারায় জানিয়ে দেয় বাসন্তীকে, যে যেন আগন্তুককে না জানায় যে জীবনবাবু বাড়িতে আছে। রান্নারচালা থেকে উঁকি-ঝুঁকি মারে জীবনবাবু। 

বাসন্তী অনুমান করে বাবার অবস্থাটা। মনে মনে অনুতাপও হয় বাবার জন্যে। 

বাসন্তী দরজাটা খুলে দাঁড়ায়। তাগাদায় এসেছে গোবর্ধন মুদি। ছাতা বগলে, মাথায় একটা গামছা-জড়ানো। বাঁ-বগলে লাল খেরো-বাঁধানো খাতা। খখনে গলায় বলে ওঠে, 

—বাবু আছে? 

বাসন্তী একটু ইতস্তত হয়ে জবাব দেয়, –না, নেই। 

গোবর্ধন মুদি খখনে গলায় বলে ওঠে, 

—তা তো থাকবেই না। কখনই-বা বাড়িতে থাকে? কথাটা তোমাকেই বলে যাই, ও-বেলায় আসব। কোর্টঘর তো অনেক করেছি। অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করতে হয় তাও করব। ভদ্দরলোক! খুব ভদ্দরলোক যা হোক। যা গিলিয়েছি গলায় গামছা দিয়ে ওগলানো করাব। 

গোবর্ধন মুদি হন্হন্ করে ফিরে যেতেই জীবনবাবু রান্নার চালাঘর থেকে বের হয়ে আসে। বলে ওঠে অসহায় কণ্ঠে, 

—বাড়িতেও থাকতে দিবি না আমাকে? 

বাসন্তী বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। বুড়ো বলে ওঠে, 

—ও-বেলায় আবার নেমন্তন্ন করে গেল। শুনলি তো? 

বাসন্তী বাবার দিকে অসহায়-দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একটু সামলে নিয়ে বলে, 

—এখন চান-খাওয়া তো করো। 

—বেশ, এখন তাই করি। তারপর আবার দেখি যদি কিছু হয়! আর ছোঁড়াটাকে বলে দিস, আমরা নিজেরাই খেতে পাই না, এখানে ভিড় না করে ও এবার পথ দেখুক। 

.

দুপুর গড়িয়ে গেছে। অসীমের মনে আজ আনন্দের ঢেউ। 

অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে গেছে। কাল থেকেই চাকরিতে যোগ দিতে হবে। মাইনে আপাতত দুশো টাকা, পরে আরও বাড়বে। এমনি করে হঠাৎ চাকরিটা পেয়ে যাবে ভাবতে পারেনি অসীম। 

তাহলে এবার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। 

সংসারে আপনজন বলতে কেউ নেই। অনেক চেষ্টাও করেছিল বাঁচবার, কিন্তু সেদিন কোনো পথ পায়নি। সব পথই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। 

আজ নিজের চেষ্টায় সামান্য ওই মিস্ত্রির বিদ্যেটাকেই এমনি করে কাজে লাগাতে পারবে ভাবেনি অসীম! এ-পথে চেষ্টাও করেনি কাজ পাবার। হঠাৎ ফন্দিটা মাথায় আসে। 

সেই উৎসাহ জুগিয়েছে বাসন্তীই। 

অসীম দেখেছে, প্রয়োজনের গুরুত্বের উপর মানুষের বাঁচার, টিকে থাকার চেষ্টা নির্ভর করে। বাঁচার তাগিদে প্রাণপাত চেষ্টা করে মানুষ। নইলে এই কারখানায় এসে জুটবে কেন সে? 

জীবনের অতীত দিনগুলো আজ তার মনে ভিড় করে আসে, এককালে সবই ছিল তাদের।

বাড়ি, লোকজন-আত্মীয়-স্বজন-বিষয়-সম্পদ সবকিছুই ছিল। তখন থেকেই গাড়ির নেশাটা পেয়ে বসেছিল তাকে। শখ করে গাড়ি চালাতে শেখে; সময়ে অসময়ে গাড়ির বনেট খুলে মিস্ত্রিদের কাজকর্ম দেখত সে। পরে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করে নিজের গরজেই। কয়েক বৎসর পড়েছেও; হঠাৎ এমন সময় অসীমের বাবা মারা গেলেন। আর সেই সঙ্গে এক ফুৎকারে যেন সব আলোগুলো নিভে গিয়ে সব ওলট-পালট হয়ে গেল। ঘনিয়ে এলো অতল অন্ধকার তার চারিদিকে। 

পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। 

বাবার যে এত ঋণ, এত বোঝা ছিল, তা জানতেও পারেনি অসীম। সেই ঋণের জন্যই একে-একে সব বিষয়-সম্পত্তি চলে গেল। 

অনেক চেষ্টা করেছে অসীম। দেখেছে আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই তাকে নিঃশেষে ঠকিয়ে পথের ভিখারি করে ছেড়েছে। 

কয়েকদিনের মধ্যেই অসীমের চোখের সামনে দুনিয়ার, রূপ বদলে যায়। বহু বেদনায় সে আবিষ্কার করে, এতবড় পৃথিবীতে সে সম্পূর্ণ একা, নিরাশ্রয় একটি জীর! 

বাঁচবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোনো পথই ও পায়নি! তাছাড়া সারা—মন জুড়ে রয়ে গেছে একটা বিতৃষ্ণা আর ঘৃণা, এই পৃথিবীর এখনকার মানুষগুলো ঠগ্‌… জোচ্চর। 

তাই সেদিন মরতেই গিয়েছিল সে গঙ্গায় 

কিন্তু মরণের মুখে দাঁড়িয়ে সে দেখেছিল, মৃত্যুকে নিয়েও ছলনার এক চক্রান্ত। তার মৃত্যুর বিনিময়ে বাঁচবে অন্যজন। জীবজগতের কঠিন সংঘাত, শুধু বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম নগ্নভাবে ফুটে ওঠে তার সামনে। ঘৃণা হয়, মায়াও হয়। 

ক’দিন বাঁচতে রাজি হয়েছিল বুড়ো জীবনবাবুর কথায়। 

ওইখানেই হঠাৎ বেঁচে থাকার প্রয়োজন, আর অর্থটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে। এত কষ্টের মধ্যেও মানুষকে বাঁচতে দেখে অসীম অনুভব করে, বাঁচার যুদ্ধে হার মেনে ভয়ে মরতে গিয়েছিল সে ভীরু-কাপুরুষের মতো 

চারিপাশে দুর্বার জীবন-সংগ্রামে হার মেনেও বহু মানুষ হারেনি, আবার নতুন উদ্যমে বাঁচবার স্বপ্ন দেখেছে, দিনরাত পরিশ্রম করছে। হেরে গিয়ে এ দুনিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়াটা অপরাধ, অপরাধ-ভীরুতা আর কাপুরুষতা। মনের দিকে থেকে বাঁচতে সাড়া পেয়েছিল অসীম। 

বাসন্তীকে কেমন যেন ভাল লেগেছিল অসীমের, প্রাণে সারা পেয়েছিল। তাই এই পৃথিবীতে বাঁচার যোগ্যতা দেখতে চেয়েছিল। 

তাই নতুন উদ্যমে টিকে থাকার জন্য সেও উঠে পড়ে লেগেছে। 

প্রয়োজনের তাগিদে পথও খুঁজে পেয়েছে সে। 

মস্তবড় কারখানা। এখানে নতুন গাড়ির যন্ত্রপাতি এনে অকেজো পুরনো যন্ত্রপাতি পাল্টানো হয়। একদিকে লম্বা শেড-এর নিচে মেরামতির কাজও চলেছে। 

আকাশ-বাতাসে ওঠে হাতুড়ির শব্দ। 

ওদিকে ওয়েলডিং-এর জোরালো আলোয় দীপ্তি উঠেছে—কর্মব্যস্ত জায়গাটা ভালো লাগে অসীমের। 

দুর্বার যুদ্ধ করে মানুষ এখানে রুজি-রোজগার করে। কোথাও হার-মানার চাপা কান্নার অস্তিত্ব নেই। কঠিন জীবন, তার চেয়ে কঠিন মানুষের সংগ্রাম এখানে। ওই কাজের ভিড়ে আজ নিজের ঠাঁই খুঁজে পেয়েছে অসীম। 

ফোরম্যান ওকে মেশিনঘরে কাজ দিয়েছে। 

দরকার হলে গাড়ির নীচে শুয়ে পড়ে কোনো নাট-বল্টু টাইট করতে হয় স্লাইরেঞ্চ দিয়ে। বাতাসে তেলকালির, পোড়া মোবিলের গন্ধ ওঠে। তবু ভালো লাগে জায়গাটা, আর এই কাজটাও।

টিফিনের সময় আজ দেখে সে, ওদিক থেকে একটি ছোক্রা মিস্ত্রি ডাক দেয় ওকে।

—সবে নতুন এসেছ তাই না? 

মাথা নাড়ে অসীম ওর কথায়। 

মর্নিং সিটের চাকরি, ছেলেটি এগিয়ে আসে। ওর বাকি কাজগুলো নিজের হাতেই করে দেয় সে। 

হাসে ছেলেটি! বলে, নতুন কিনা, তাই একটু অসুবিধে হচ্ছে। দু’চারদিন গেলে আর কোনো অসুবিধে হবে না। চলো, টিফিন করে আসি। 

টিফিনের ঘণ্টা বাজছে। 

কাজের মধ্যে ওই একটু অবসর। যে-যার কাজ ছেড়ে শেডগুলো থেকে বের হচ্ছে। কেউ-বা শেডের বাইরে রাস্তার উপর টালি-খোলার চালার নিচে চায়ের দোকানের দিকে চলেছে, অনেকে আবার কোম্পানির সীমানার মধ্যেই একটা মাঝারি শেডে গিয়ে ঢুকছে। 

অসীম দাঁড়াল, কি করবে ভাবছে। 

হঠাৎ চাকরিতে এসে আজই লেগে গেছে। পয়সা-কড়িও তেমন নেই সঙ্গে, আর খাবার-দাবারও আনেনি, তাই ওখানে যেতে ইতস্তত করছে। 

ছেলেটির নাম যতীন। সে ওকে দাঁড়াতে দেখে বলে ওঠে, 

—হল কী তোমার? 

অসীমের ব্যাপারটা বুঝতে পারে যতীন। বলিষ্ঠ কঠিন পেশীবহুল চেহারা, কারখানার সকলেই প্রায় চেনে তাকে। বয়সও বেশি নয়, কালো প্যান্ট আর ময়লা শার্টের উপর একটা নীল অ্যাপ্রন-চাপানো। অবশ্য অ্যাপ্রনের নীল রং আর ঠিক চেনা যায় না তেল-কালিতে। এত কাজের মধ্যেও হাসিখুশি ভাব তার মিলোয়নি। যেচে সেই-ই অসীমের সঙ্গে পরিচয় করেছে, ওর হাতের কাজ নিজে হাতে করে শিখিয়ে দিচ্ছে ওকে। অসীমের থমকে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে সে। তাই হাসে যতীন। বলে, 

—খাবার আনোনি তো! তাতে কী হয়েছে! এসো, ও ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সেই-ই টেনে নিয়ে যায় অসীমকে। 

ছায়া-ঘেরা একটা পরিবেশ। কারখানার মধ্যে এখনও এখানে সবুজের রং লেগে আছে। একটা টলটলে জলেভরা পুকুর—কয়েকটা ছায়াঘন পুরানো বট, আম-বকুলগাছ রয়েছে। এখনও পাখি ডাকে এখানে গাছের ছায়ায়। 

যতীন বের করে একটা কৌটো থেকে খানকয়েক পরোটা আর আলু-চচ্চড়ি, ওপাশে বেগুনভাজা এনেছে একটি ছেলে। যতীন তার কৌটো থেকে দুটো বেগুনভাজা তুলে আনে। আরও ক’জন এসে গোল হয়ে বসেছে পুকুরের ধারে বাঁধানো ঘাটের ছায়াঘন জায়গাতে। জলযোগ-পর্ব চলছে। 

ওদের দলে প্রথম দিন এসে মিশে গেছে অসীম। যেন অনেক দিনের হারানো বন্ধুর একজন আবার ফিরে এসেছে বহুদিন পর। 

অসীমের খিদেও লেগেছিল, পেটে কিছু পড়তে সেই জ্বালাটা কমেছে। মনে হয়, জীবনে এতদিন অনেক কিছুই চেনেনি, জানেওনি। একটা কোথাও সুর আছে, নইলে এত কাজ, এত কাঠিন্যের মাঝেও গাছের সবুজ রং টিকে থাকে, মনের মাঝে এই ভালোবাসা-প্রীতির সুর জাগে মানুষের! 

যতীন একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে বিড়ি টানছে, ওদিকে ট্রাকের ড্রাইভার বিশালদেহী কন্দর্পনারায়ণ গামছা পেতে নাক ডাকাচ্ছে। টিফিনের মাঝে ওই একটু ঘুমিয়ে নেয়। যতীনই প্রশ্ন করে, 

—কাজটা কেমন লাগছে? 

হাসে অসীম, যতীনকে কি করে বোঝাবে, পায়ের নিচে এই মাটি পাবার কত প্রয়োজন ছিল তার! তাই অসীম জবাব দেয়—মন্দ কি! 

যতীন মাথা নাড়ে,—তা সত্যি। চলে তো যাচ্ছে অনেকেরই। বাড়িতে কে, কে আছেন?

আন্তরিকতার সুরে প্রশ্ন করেছে ওকে যতীন। একই পরিবারের একজন খবর নিচ্ছে অন্যজনের।

অসীম ওর দিকে তাকিয়ে কি ভেবে জবাব দেয়, 

—আপন বলতে কেউ নেই, দূর-সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকি।

টিফিনের সময়টুকু শেষ হয়ে আসছে। ঘণ্টা বাজছে। 

আবার সেই কাজের ডাক। 

শেষ হবে সেই বৈকালে। 

আজ নতুন চাকরি বলে টিফিনের পরই ছাড়া পেয়েছে অসীম। যতীনই ছুটিটা করে দেয়। বের হয়ে এল অসীম গেটের বাইরে। 

আজ প্রথম অনুভব করে, জীবনে তার করণীয় একটা কাজ সে পেয়েছে। এতদিন পথে পথে ভেসে-বেড়ানো দুঃখ আর হতাশা ভুলে আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে 

কাজকর্ম ভালো করে শিখে নিয়ে আবার তার নিজের ওখানে ফিরে যাবে অসীম। যে জায়গাটুকু এখনও আছে তার দাম কম নয়; সেইটারই কিছু বিক্রি করে দিয়ে দরকার হয় নিজেই একটা গ্যারেজ তৈরি করে গাড়ি মেরামতের কাজ শুরু করবে। 

এতদিন যে সামান্যটুকুও চোখে পড়েনি, আজ সেইটুকু আশার আলোয় বৃহত্তর হয়ে ফুটে উঠেছে, ভরসা এনেছে সারা মনে। 

বাঁচার বিশাল জগতে প্রবেশের এতটুকু পথরেখার সন্ধান পেয়েছে অসীম। 

এই আনন্দের খবরটা তাই বাসন্তীকে দেবার জন্যই সে আজ আসছে উৎফুল্ল হয়ে 

ওরা কারখানা থেকে বের হয়ে বাসে উঠেছে। 

পার্ক সার্কাস অঞ্চলের পরিষ্কার নতুন রাস্তার ধারে গাছে-গাছে ফুটেছে গোলমোহর ফুলগুলো, ঘন সবুজ পত্রাবরণে হলুদের সাড়া এনেছে। ওগুলো হাওয়ায় নড়ছে, মাঝে মাঝে ঝরে পড়ে দু’একটা ফুল। বৈকালের রোদের রঙে এত আলো, এত মিষ্টি-রং আছে এর আগে টের পায়নি অসীম। 

ওদের বস্তির কাছে এসে সে থামল। এই জায়গাটা ছেড়ে যাবে তারা। ঘোলা-পচা নর্দমা, থিক-থিক করছে ময়লা, বাতাসে একটা চাপা দুর্গন্ধ। তবু জায়গাটার ওপর কেমন মায়া পড়ে গেছে। 

বস্তির মুখে পরেশ, হাতকাটা কালীকে দেখে অসীম দাঁড়াল। তারাও দেখছে অসীমকে। ছোঁড়াটা কাল খুব ঠকিয়েছে তাদের। এ পাড়ায় এসে তাদেরই বুকের উপর বসে কেমন ঠকিয়ে চলেছে তাদের দিন দিন। 

আজ অসীমই পকেট থেকে সিগারেট বের করে এগিয়ে দেয় তাদের। বলে—নিন পরেশবাবু।

পরেশ নেবে না ভেবেছিল, কিন্তু পরেশবাবু বলে ডাকাতে মনটা একটু নরম হয়। সিগারেটটা নিয়ে ধরাল পরেশ। 

কি ভেবে বলে ওঠে পরেশ—গোটা দুই টাকা দেখি! 

পরেশ হাতের আঙুল নেড়ে ব্যাপারটাকে একটু ত্বরান্বিত করতে ইশারা করে। ওটা যেন পাওয়ার দাবি আছে তার। 

সিনেমায় চলে যাবে ওটা পেলে। অসীমের কাছে যা আছে তা সামান্যই। আগামও দিতে চেয়েছিল কোম্পানি, তা নেয়নি সে। বলে ওঠে, 

—টাকা তো নেই! 

পরেশ গুম হয়ে যায়। চাপা-পড়া রাগটা যেন এবার ঠেলে উঠবে। বলে ওঠে অসীম,

—কাজকর্ম করুন না একটা, কাজের লোক আপনারা। 

পরেশ দপ্ করে জ্বলে উঠতে উঠতে রয়ে গেল। অসীম যেন ইচ্ছে করেই তাদের টাকা তো দিলই না, উল্টে উপদেশ দিয়ে জুতো মেরে চলে গেল। 

পরেশ গজগজ করে, 

—লেক্‌চার দিতে এসেছে শা—ওর খাই না পরি? কেলো! 

কালীচরণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিল, কাল থেকে কেবল ঠক্‌ছে তারা। গদাই সরকারও চটে রয়েছে তাদের ওপর। সেই রাত-ডিউটির বকেয়া টাকা তো দেয়নি, উল্টে বেহিসাবি কাজের জন্য রেগে আগুন হয়ে আছে। ওস্তাদের কথায় তবু মাথা নেড়ে বলে ওঠে কালী, 

—বড্ড গ্যাস হয়েছে ব্যাটার। সামান্য দুটো টাকার জন্য, ব্যাটা আমাদের ডাউন করে গেল।

পরেশ সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে বলে ওঠে, 

—দেখাচ্ছি মজা ব্যাটাকে। সতেরো নম্বর থেকে আউট করে দোব, না পারি আমার নামে একটা কুত্তা পুষবি। চল— 

কালীচরণকে টেনে নিয়ে চলেছে পরেশ। সরকার মশাই-এর খবর নিতে হবে একবার, আর অসীমকেও উৎখাত করতে হবে এখান থেকে, তা গদাই সরকার কিছু দিক আর নাই দিক। তার নাকের উপর ওই ছোঁড়াটা হাত নেড়ে উপদেশ দিতে আসবে, এটা পরেশের কাছে অসহ্য-ঠেকে। ওই উপদেশ তারা কারোর কাছে চায় না। বাকি আর সব কিছু চায় তারা। 

বাসন্তী অসীমকে এ সময় ফিরতে দেখে একটু অবাক হয়। সারাদিন খায়নি। কোথায় ক’দিন ঘোরাঘুরি করছে। বাবার কথাবার্তাতেও একটা বিরক্তি ভাব ফুটে উঠেছে। 

অসীম যে এদের মাঝে একটা বোঝার মতো হয়ে উঠেছে, তাও বুঝেছে বাসন্তী। কিন্তু মুখ-ফুটে ওকে চলে যাবার কথা বলতে পারেনি। 

মনে কোথাও নিবিড় ব্যথা বাজে ওকথা বলতে। অসীম চলে যাবে আর আসবে না, এই চিন্তা করতেও মনের গহনে একটা নিবিড় ব্যথা অনুভব করেছে বাসন্তী। ঠিক এমনতর বেদনাবোধ কারও জন্য ছিল না, এ তার মনের সদ্য জেগে ওঠা কোনো নতুন সত্তা,—যে ভালোবাসে, আর হারাতে চায় না। নতুন করে বাঁচতে চায় এই পরিবেশ থেকে দূরে—এই সারা দিন-রাত্রির অভাবের গণ্ডীর বাইরে, অন্যত্র কোনো শান্তির নীড় রচনা করতে চায় বাসন্তী। 

অসীম সেই অন্য জগতের আহ্বানই এনেছে তার-মনে। 

ওকে ঢুকতে দেখে এগিয়ে আসে বাসন্তী। 

—এত দেরি হল যে? 

অসীমের জামা-প্যান্টে তেল-কালির দাগ দেখে একটি অবাক হয় বাসন্তী! 

—কী ব্যাপার? ওসব কী? কোথায় গেছিলে? 

হাসে অসীম। 

নির্জন দুপুরে বস্তির কোলাহল এখন থেমে গেছে। শুকনো বাতাসে নিমগাছের পাতায় শির-শির শব্দ ওঠে। 

বাসন্তীর হাতখানা ওর-হাতে। বাসন্তী কেমন যেন চমকে ওঠে! ওর কালো দু’চোখের তারায় একটা শিহরন খেয়ে যায়। বাসন্তী স্থির হয়ে ওর হাতখানা সরিয়ে নেয়। 

তাকিয়ে থাকে অসীমের দিকে। 

—চাকরি পেয়ে গেলাম আজ থেকেই। মোটামুটি খুব একটা খারাপ নয় চাকরিটা। অসীম বলে।

চাকরির কথা শুনে বাসন্তী অবাক হয়। তাই খুশিতে ফেটে পড়ে। বলে, 

—চাকরি পেয়েছ? 

—হ্যাঁ। মাইনেও মন্দ নয়, দরকার হলে কোয়ার্টারও দেবে বলেছে। 

—বাসাও দেবে, বল কি? মাইনে— 

বাসন্তী অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। দু’চোখে ওর খুশির আভা ফুটে উঠেছে।

একটু সামনে নিয়ে বেশ শাসনভরা কণ্ঠে বলে বাসন্তী, 

—যাও, ওসব বদলে হাত-মুখ ধুয়ে নাও। কিছু খাবে না? 

অসীমও খুশি হয়েছে। বৈকালের মিষ্টি রোদটুকুকে আজ উপভোগ করতে চায় সে। আরও পাঁচজনের মতো তারও বেঁচে থাকবার অধিকার আছে, সেইটাই বুঝে নিতে চায়। তাই বলে ওঠে, 

—তা নিচ্ছি, তুমিও তৈরি হয়ে নাও। আজ বেরোবো দু’জনে। বাইরে কোথাও চা-টা খেয়ে নেওয়া যাবে। 

বাসন্তীও এই বস্তির বন্দিপুরী থেকে মুক্তি চায় মনে মনে। তাই ওর ডাকে সাড়া দেয় অধীর-আগ্রহে। বলে, 

—বেশ চল। 

সেও এতবড় শহরের মাঝে একটু খুশির বাতাসে হারিয়ে যেতে চায়। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *