৪
অসীম বস্তির মুখ থেকে বের হচ্ছে, পরনে একটা ভালো প্যান্ট, আর হাওয়াই শার্ট। পরেশের সঙ্গে দেখা হতে দাঁড়াল সে। পরেশ জল-কলের ঝামেলা, মারামারি চুকিয়ে এবার মায়ের গালাগালি খেয়ে বাজারের চেষ্টায় বেরিয়েছে। টাকা-পয়সার জোগাড় থাকে না ওর। রাস্তায় বের হয়ে যেভাবেই হোক ওটা সংগ্রহ করে ওরা!
দু-চার টাকা যা হয়।
তেমন কোনো মক্কেলের আশাতেই পথে দাঁড়িয়েছিল পরেশ, অসীমকে দেখে এগিয়ে আসে।
—শুনছেন, ও দাদা!
অসীম দাঁড়াল ওর ডাকে। দেখে চিনতে পারে ওকে, এ-পাড়ায় সেই মুকুটহীন সম্রাট পরেশ চন্দর।
পরেশ এগিয়ে এসে সহজ ভাবেই হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
—গোটা দুয়েক টাকা দিন তো স্যার!…
যেন এতে তার দাবি আছে এবং এটা ওর ন্যায্য পাওনা।
অসীম একটু অবাক হয়! জানে, এই তাদের জুলুমবাজির শুরু। তাছাড়া টাকা দেবার মতো তেমন কিছু নেইও তার কাছে। বলে ওঠে অসীম,
—টাকা তো নেই দাদা!
পরেশ অবাক হয়—দুটো টাকা! অলি টু রুপিস, তাও নেই?
মাথা নাড়ে অসীম—থাকলে নিশ্চয়ই দিতাম।
বিরক্ত হয় পরেশ—ওকথা সবাই বলে—
অসীম কি জবাব দিতে গিয়ে থেমে যায়। জানে, ওদের কথার জবাব দিলে কথাই বাড়বে। তাই সরে গেল চুপ করে।
কানে ভেসে আসে পরেশের গজরানি।
—কাপতান! শ্লা—এইবার দোব একদিন এইসা টাইট করে। সুট-শার্ট-পরা হয়েছে, কড়া মাঞ্জা দিয়ে চলেছে, আর দুটো টাকা দেওয়া গেল না! ছ্যাঃ—
এমন সময় গদাইকে আসতে দেখে এগিয়ে যায় পরেশ। গদাইও অসীমকে দেখছে। বলে ওঠে ওর গতিপথের দিকে তাকিয়ে,
—কী রে পরশা?
পরেশ বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,
—আর বলবেন না সরকার মশাই, সব লাইলন হয়ে গেছে, শ্লা। বাইরে দেখুন কেমন চকর-মকর, ইদিকে ট্যাকে ছুঁচোর ডন মারছে। বাবুর ওই চিকনচাকনই স্যার, ভেতরে খড়গোঁজা! দিন না—দুটো টাকা সরকার মশাই।
গদাই সরকার হাসে
—সেদিনের ছোঁড়াটা না?
অসীমের দিকে তাকিয়ে থাকে গদাই। কি ভেবে পরেশের হাতে-দুটো টাকা বের করে এগিয়ে দেয়। ওটা তার নিজের কাজের জন্যই দেওয়া। টাকা দুটো পেয়ে পরেশ আজকের মত নিশ্চিন্ত হয়।
সরকার মশাইকে তাই এত খাতির করে ওরা!
লোকের দায়-দায়িত্ব বোঝে লোকটা।
সরকার মশাই অসীমের দিকে তাকিয়ে থাকে। জিজ্ঞাসা করে পরেশকে,
—এখনও যায়নি ছোঁড়াটা জীবনবাবুর বাড়ি থেকে? কে হয় ওদের?
পরেশ একটু ধাতস্থ হয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে জবাব দেয়,
—দাঁড়ান না, ওর ওখানে থাকা ঘুচোচ্ছি। শুনছিলাম, এমনি উটকো এসে জুটেছে ছোঁড়াটা, আপনজন’ কেউ নয় ওদের।
সরকার মশাই-এর মনে সেইটাই ভয়ের কথা হয়ে দাঁড়াল। ভাবে,
মেয়ের বয়সটা ভালো নয়, এই সময় অন্যজন আপন হতে দেরি লাগে না। নিজের টাক আর ভুঁড়ির দিকে তাকিয়ে একটু হতাশ হয় গদাইচরণ। চুল যে ক’গাছি আছে টাকের আওতা থেকে, তাতেও সাদা রং ধরেছে অনেক আগেই। জানে সরকার মশাই, জীবনবাবু তার হাতের মুঠোর মধ্যেই আছে। কয়েক মাসের ভাড়া বাকি পড়েছে তার, তাছাড়া ছোঁড়াটাকে কেন, দরকার হলে ঢুলিসুদ্ধ বিসর্জন দিতে পারে গদাই সরকার। জীবনবাবু সমেত ছোঁড়াকেও উৎখাত করতে ও পারে। তবু বাসন্তীর জন্যে ভয় হয়। ও কেমন হেঁয়ালি!
কিন্তু তাতে কাজ হাসিল হবে না।
ভালোমানুষের মতো গদাইচরণ বলে ওঠে,
—ওসব করিস না পরশা। পাড়ায় হাঙ্গামা বেধে যাবে।
পরেশ গজগজ করে। বলে,
—হাঁ, কেবল তোমার জন্যই করতে পারি না, গদাইদা।
গদাইচরণ খুশি হয় ওর কথায়। ওদের দিয়ে কাজ পাবে, তাই দায়ে-অদায়ে পোষে; টাকা দিয়ে সাহায্য করে।
সে সময় এলে তখন কথাটা ভাবা যাবে!
.
অসীম আজ নতুন উৎসাহ নিয়ে ঘুরছে দু’এক জায়গায়। এর আগেও এমনি ঘুরেছে, বিভিন্ন জায়গায়। যে দু’এক জায়গায় চাকরির সন্ধান পেয়েছিল, সেসব জায়গাতে আবার গেছে অসীম। চাকরি একটা তার চাই-ই।
সব আশা হারিয়ে যে একদিন তার প্রাণটা শেষ করতে গিয়েছিল, আজ নতুন করে আবার বাঁচতে চায় সেই অসীম।
দুপুর রোদ ডালহৌসি স্কোয়ারের জলে কেমন উজ্জ্বল একটু আভাস এনেছে। চারিদিকে ট্রাম-বাসগুলো তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে চলেছে। ঐ গতিবেগের সঙ্গে জড়ানো একটি জীবন।
নীরব ছন্দে ওই পথের পরিক্রমায় বের হয়েছে অসীম।
চারিদিকে একটা না একটা পথ বের করে কঠিন জীবনের পথে চলার চেষ্টা করে চলেছে মানুষ। খবরের কাগজওয়ালারা বসে আছে; ওদিকে কে ঘুরে-ঘুরে চিনেবাদাম বিক্রি করছে, এদিকে সারি-সারি গাড়ি—চারিপাশের বিরাট বাড়িগুলোর গহ্বরে কত মানুষ দৈনন্দিন সংগ্রাম করে চলেছে। বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম। সেই পথে আজ অসীমও এসে মিশতে চায়। জীবন-সংগ্রামে সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে টিকে থাকার জন্যে।
দু’এক জায়গায় আশ্বাসও পায় অসীম।
.
একজন ভদ্রলোক ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। দেখছেন চেহারাটা খুব খারাপ নয়। এই ঘরখানার অনুপাতে ও বেমানান নয়।
চারিদিকে কয়েকটা টেবিল আর চেয়ার-ছড়ানো। বাতাসে টাইপ-রাইটার মেশিনের শব্দ কানে ভেসে আসে; কোথায় যেন টেলিফোন বাজছে?
ভদ্রলোক কি ভেবে বলে ওঠেন,
—একটা দরখাস্ত রেখে যান। সামনের সপ্তাহের শেষদিকে আমাদের লোকের দরকার হবে। বাড়ির ঠিকানায় চিঠি দেব বা আপনিও এসে খবর দিতে পারেন, আট-দশদিনের মাথায়।
অসীম আশ্বাস পায় ওর কথায়। বলে ওঠে,
—একটু চেষ্টা করবেন স্যার! এই বাজারে
ভদ্রলোক কাজ করছিলেন, ওর কথায় কলম রেখে বলে ওঠেন,
—আশা করি নিতে পারব আপনাকে। আচ্ছা নমস্কার।
—নমস্কার।
বের হয়ে এল অসীম।
ডালহৌসি স্কোয়ারে তখনও বিকেলের আলো রয়েছে। লালদিঘির কালো জলের ওপরে মাথার আলোটুকু তখনও মোছেনি।
আজ যেন আবার সেই আলো অসীমের মনের আঁধার দূর করেছে। জি-পি-ওর বড় ঘড়িটা বাজছে গুরুগম্ভীর শব্দে। জীবনের অনেক মুহূর্তই ও চিহ্নিত করেছে। আজ যেন নতুন করে একটি পরম ক্ষণকে প্রতিষ্ঠা করে ওই শব্দটা।
ওই ঘড়ির সুরের রেশ ধরে গির্জার ঘড়িটা বাজছে একটানা সুরেলা শব্দে।
অসীম আর-একটা জায়গায় আশ্বাস পেয়েছিল ক’দিন আগে, তাদেরও সময় হয়ে এসেছে। আজই একবার সেখানে ঘুরে যাবে। একটা বিলেতি মোটর কারখানায় চাকরির আশা পেয়েছে সে—ওই মোটর-চালানো বিদ্যেটা দিয়ে এতদিন বেসাতি করেনি, দরকার হয় তাই করবে এবার।
পকেটে কত পয়সা আছে মনে মনে হিসাব করে নেয় অসীম। একটু ভরসা পায়। একবার ওইদিক হয়ে ঘুরে যেতে পারবে।
সামনেই দক্ষিণগামী ট্রামটা–সেকেন্ড ক্লাসে উঠে পড়ে সে।
তবু এতখানি হাঁটার পরিশ্রম এবং সময় বাঁচল।
ঘড়িতে পাঁচটা বাজেনি। কারখানায় ফোরম্যান সাহেবের দেখা হয়তো এখনও পেতে পারে। কি একটা নীরব শপথ নিয়ে অসীম বের হয়েছে; দমবে না আর, যেমন করে হোক পথ একটা বের করবেই—দুনিয়ায় চলার মতো একটা পথ।
.
জীবনবাবু বৈকালে বাড়ি ফিরেছে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরির পর। ক’দিন কাজকর্ম টুকটাক করছে। দু’একটা কেস-এর জন্য হাঁটাহাঁটি, ঘোরাঘুরি আবার শুরু করেছে। কিন্তু জীবনবাবুর মনে ওই যে নগদ একটা থোক টাকার স্বপ্ন ঢুকেছে, ওটাই সব কাজ বানচাল করে দিয়েছে। মাথায় দিনরাত ঘুরছে, কি করবে তারপর টাকাটা হাতে পেলে। এই হিসাব তার মন ভরিয়ে রেখেছে।
বাড়ি-ঘর করবে আবার। ভাবে, ব্যবসাটাকে জিইয়ে তুলবে না হয়। এইসব সাত-পাঁচ ভাবনায় আর কোনো কাজই হয়নি।
তারপর মাথায় এতগুলো নতুন দেনা চাপিয়েছে, যদি গড়বড় কিছু হয়ে যায়, কি হবে তাহলে! সে ভাবনাতেও রাতে ঘুম আসে না। তবে বের হয়। জীবনবাবু বাড়ি ফিরে দেখে অসীমের তখনও দেখা নেই।
সেই যে চাট্টিখানি নাকে-মুখে গুঁজে বের হয়েছে, আর দেখা নেই তারপর থেকে। ওর জন্য ভাবনায় পড়ে জীবনবাবু। বলে,
–ফেরেনি এখনও অসীম?
বাসন্তী জবাব দেয়—কই, না তো!
ফস্ করে চটে উঠতে গিয়েও পারে না জীবনবাবু। মুখ সামলে নিল। কে জানে, যদি বাসন্তী আসল-ব্যাপারটা কিছু জেনে ফেলে! তাই রাগ-বিরক্তি প্রকাশ না করে বলে ওঠে,
—দেখ দিকি, পইপই করে বল্লুম নতুন জায়গা, তা, বাবু বেরোলো তো এখনও ফেরার নাম নেই। দেখি—
বাসন্তী বলে ওঠে—কোথায় চললে এই সন্ধের মুখে?
জীবনবাবুর স্বস্তি নেই। গজগজ করে,
—দেখি, পরের ছেলেটা আবার গেল কোথায়!
গদাই সরকার কাল থেকে ওই ছোঁড়ার ব্যাপারে একটু ঘাবড়ে গেছে মনে মনে। মেয়েদের বিশ্বাস করে না সে।
এত বয়সে অনেক দেখেছে, শুনেছে ও।
সেইসঙ্গে ওই কথাটাও শুনেছে, আর নিজেও জেনেছে যে, মেয়েদের বিশ্বাস করা যায় না। শাস্ত্র-বাক্যও শুনেছে অনেকের কাছে।
বাড়িতেই তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে গদাইচরণ।
ঘরে বাইরে ওরা সবাই সমান। মাঝে-মাঝে মনে হয়, এসব ছেড়েছুড়ে চলে যাবে সোজা যেদিকে দু’চোখ যায়, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।
এখনও সেই চোখ-বাঁধা কলুর বলদের মতো ঘানির চারিপাশে ঘুরছে—ঘুরছে তো ঘুরছেই। শাস্তি আর পায়নি।
তেমনি ঘুরতে ঘুরতে এসেছে সতেরো নম্বর বাড়ির টিনের বাড়িটায় গদাইচরণ অনেক আশা নিয়ে।
আজ ট্যাক থেকে নগদ টাকা দিয়ে দু’খানা শাড়ি কিনেছে। মনে হয়, এবার ওর মুখে হাসি ফুটবে। সেদিন বলে এসেছিল, আজ তাই এখানে আসবার অজুহাতে সঙ্গে করে ও নিয়ে এসেছে সেটা
এক-পা, এক-পা করে এগিয়ে যায় গদাইচরণ খাপরায় ছাওয়া ঘরগুলোর পাশ দিয়ে সন্তর্পণে। ।কোনো জানলা খোলা থাকলে ও সাবধান হয়। কেউ জানে, কে আবার সেই রাত্রের মতো পানের পিচ দিয়ে রাঙিয়ে না দেয় সারা গা।
বাসন্তী বসে আছে দাওয়ায়।
ভাবনা হয় অসীমের জন্য। কে জানে, নতুন জায়গায় এসে কোথাও হারিয়ে গেল কিনা, হয়ত ফিরবে না আর?
দু’দিনের জন্য এসেছিল ছেলেটা, তাই ওকে ঠিক চিনতে পারেনি বাসন্তী। নিজের দুঃখ-দারিদ্র্য আর বঞ্চনার জ্বালা-ভরা মন নিয়ে সবকিছুকে দেখেছে সে। তাই জীবনের মাঝে যে একটু আনন্দের স্বাদ আছে, বেঁচে থাকার তৃপ্তি আছে, সেটা হঠাৎ আবিষ্কার করেছে বাসন্তী ওই অসীমের মাঝে। হয়তো এরই নাম ভালোবাসা।
জীবনের এতগুলো দিন অর্থহীন শূন্যতার মাঝেই কেটেছে। হঠাৎ কেমন একটা মাধুর্য খুঁজে পেয়েছে বাসন্তী অসীমের আসার পর থেকে, ওর সান্নিধ্যে এসে। তাই আজ মনে সুর জাগে। দুঃখ জাগে ওকে হারাবার।
আকাশে দু-একটা তারা ফুটেছে।
বস্তির নিমগাছে ডাকছে একটা রাতের পাখি।
গদাইচরণ দরজা খুলে ওদের ছোট্ট উঠোনে পা-দিয়ে অবাক হয়ে যায়। বাসন্তী গুনগুনিয়ে গান গাইছে :
ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে—
গদাইচরণ দাওয়ায় বসে খুঁটিতে হেলান দিয়ে দুচোখ বুজে বেশ মাথা নাড়ছে, আর হাঁটু দুলিয়ে তাল দিচ্ছে খুশি মনে।
হঠাৎ গান থেমে যেতেই চোখ খুলে তাকাল গদাইচরণ।
বাসন্তী দাঁড়িয়ে আছে কাছেই; তার দিকে বিরক্তি-ভরা দৃষ্টিতে কেমন যেন তাকিয়ে আছে। গদাইচরণ তাড়াতাড়ি সেই উদাস ভাব সামলে নিয়ে, পানের ছোপ লাগানো তরমুজের বিচির মতো দাঁতগুলো বের করে বলে ওঠে,
—বাঃ, বেশ গাইছিলে, খাসা গাইছিলে! তা, থামলে কেন বাসন্তী?
গদাই গদ্গদকণ্ঠে কথাগুলো বলে চলেছে –
ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে,—আহা!
বাসন্তী ওর ন্যাকামিতে রেগে ওঠে। একটু কড়া-সুরেই বলে, ভ্রমর নয়, গুবরে পোকা।
হাসছে গদাইচরণ।
—আপনি? হঠাৎ এই সময় যে? বাসন্তী প্রশ্ন করে।
গদাই হাতের শাড়ি দুটো কাগজের ভাঁজ থেকে খুলে বলে ওঠে—এই যে, দেখ দিকি কেমন মানাবে? আরে, যাকে যা মানায়। এই তো পরবার বয়স। রেখে দাও এ দুটো।
বাসন্তী কী ভাবছে?
জানে লোকটাকে, সাপের চেয়ে ধূর্ত, আর বাঘের চেয়ে-হিংস্র ওই লোকটা। এ এলাকার অনেকের মুখেই শুনেছে বাসন্তী, গদাই সরকারের অনেক কীর্তিকাহিনি, লোকটা পারে না হেন কাজ নেই। সবাই ওকে ভয় করে চলে।
তাই অযথা ওকে চটাতে গিয়েও পারে না বাসন্তী।
দেখেছে, ওরা এই বস্তি থেকে অনেককেই দারোয়ান আর গুণ্ডা দিয়ে, মালপত্র রাস্তায় ফেলে দিয়ে সরে পড়েছে।
ওদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদও করতে পারেনি।
জানে বাসন্তী নিজেদের অবস্থা। এখনও সেই অভাব, আর ঘরের ভাড়া সবই বাকি। তাই গদাই-এর অপমানটুকু চুপ করে সহ্য করে।
গদাইচরণ ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলে ওঠে,
—এত কি ভাবছ বাসন্তী?
—বাবার কাজকম্মও নেই, এদিকে আপনাদের ভাড়াপত্তর বাকি—
বাসন্তী অভিনয় করে চলেছে।
হাসে গদাইচরণ। এতক্ষণে সে নিজের প্রতিষ্ঠা, আর ক্ষমতা দেখাবার সুযোগ পায়। বলে ওঠে গদাইচরণ,
—তার জন্য ভাবতে হবে না বাসন্তী। রায়বাবুরা তো আর কিছু করবে না, করবার মালিক এই শর্মা। সে তো আর কিছু করছে না। তা, শাড়ি দু’খানা পছন্দ হয়েছে?
মাথা নাড়ে বাসন্তী।
গদাইচরণ বলে চলেছে উদাসকণ্ঠে,
—সেই যে মনের কথা বলছিলাম না! সে-কথা আর বলবার লোক পাই কোথায় বলো? ঘরে-বাইরে আমার শান্তি নেই। এ সময় মানুষ শান্তি চায়, সেবা-যত্ন চায়। এই ধর, একটু ভালোবাসা—
বাসন্তী হাসিতে যেন ফেটে পড়বে এবার, ওর গদগদ কথাগুলো শুনে। মুখে শাড়ির আঁচল দিয়ে হাসি চাপবার চেষ্টা করে সে!
গদাইচরণ ওকে দেখে আরও কাতরকণ্ঠে বলে ওঠে,
হাসছ? তার চেয়ে গলায় ওই আঁশবঁটিটা লাগিয়ে দাও; ব্যস! একেবারে শেষ হয়ে যাই। জ্বালা-যন্ত্রণাও জুড়োক।
বাসন্তী একটু সামলে নেয়,
—কই? হাসছি না তো? বলুন, কী বলছিলেন?
গদাই যেন ভরসা পায় ওর কথায়। বলে,
—বলব বলছ? দেখ, বাইরে থেকে লোকে গদাই সরকারকে দেখে হিংসে করে। বাড়ি, টাকা, দাপট সবই আছে, কিন্তু বুকের ভেতরটা কেউ দেখেছে? যেন খাঁ-খাঁ করছে। দিনরাত হু-হু করে বাসন্তী। তাই বলছিলাম, মানে তুমি আমার কথাটা একটু ভেবে দেখো।
বাসন্তী ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। বুড়ো লোকটার কথাগুলো যেন ওর সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরায়। কি একটা বলতে যাবে কড়া-কথা, হঠাৎ দরজা দিয়ে অসীমকে ঢুকতে দেখে থেমে যায়।
বুড়ো লোকটকে খ্যাংরা মেরে তাড়াবার ইচ্ছেটা আপাতত চেপে রইল বাসন্তী।
গদাই সরকার অসীমকে দেখছে।
দেখেই ওর সেই আবেগ আর বুকের জ্বালা সব যেন নিমেষের মধ্যে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে! অসীমই এগিয়ে এসে ওর কাছে দাঁড়াল।
—নমস্কার!
গদাই একটু হচকিয়ে কোনরকমে সামলে নিয়ে গুম হয়ে জবাব দেয়,—নমস্কার।
বেশ বুঝতে পারেন সে, ছোঁড়াটা এখানে দিব্যি জেঁকে বসেছে।
বাসন্তীর একটু আগের কথাবার্তাগুলো কেমন সুন্দর লাগছিল। তার হাসিটুকুও দেখেছে গদাইচরণ।
মনোরম সেই হাসি।
হঠাৎ সব হাসি কেমন কর্পূরের মতো উবে গেছে মেয়েটার মুখ থেকে, ওই ছেলেটা বাড়ি ঢুকতেই। বাসন্তী গম্ভীর হয়ে যায়। এসব ভালো লক্ষণ নয়।
গদাইচরণের পথ পরিষ্কারই থাকত, যদি না ওই ছোঁড়াটা কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসত। এসব ওই জীবনবাবুরই কীর্তি।
ঐ বুড়ো কোত্থেকে এনে জুটিয়েছে ছোঁড়াটাকে—পরেশও তাই বলেছে, আর এও জেনেছে ওর মতলব নাকি সুবিধের নয়।
বাসন্তী কেমন যেন চুপ করে গেছে।
এ সময় আর গদাই-এর কোনো কথা বলা যাবে না। তাই এখন উঠে পড়ে গদাইচরণ ক্ষুণ্ণ মনে।
—আচ্ছা, চলি এখন! আর তোমার বাবাকে একবার আমার ওখানে যেতে বলো।
গলা তুলে বলে চলেছে গদাইচরণ,
—নানা জনে নানা কথা বলে। জীবনবাবুর নাকি ভুরি-ভুরি রোজগার! বাজারেও খরচা করছেন দারুণ। এদিকে বাড়ি ভাড়া দেবার নাম নেই, মাসের পর মাস ভাড়া বাকি। কথাটা বাবুদের কানে গেলে কি হবে তা জানে তো? তাই সাবধান করে দিলাম। বাবুদের আর একজন বাজার সরকারের দরকার ছিল—যদি উনি যেতেন কথাটা বলে দেখতাম সেজবাবুকে!
বাসন্তীর কানে শেষের কথাগুলো গেল। ভাবে, ওটাই তো তাদের দরকার। ওই চাকরিটা।
মাথা নাড়ে বাসন্তী।
—বলব বাবাকে।
—তাই বোলো। গদাই সরকার গজগজ করে চলে গেল।
অসীম লোকটাকে দেখছিল এতক্ষণ ধরে। চলে যেতে বলে ওঠে,
— কে ও?
হাসে বাসন্তী, হাল্কা সুরে জবাব দেয়,
—ওকে চেনো না? উনি এ মুলুকের শাহানশাহ্—শ্রীযুক্ত গদাইচরণ! রায়বাবুদের সরকার তামাম বস্তির দণ্ড-মুণ্ডের একমাত্র মালিক।
অসীমের মনটা আজ খুশিই রয়েছে। সেই মোটরের কারখানায় বোধহয় দু’একদিনের মধ্যেই চাকরিটা হয়ে যাবে, ছোট সাহেব নিজে কথা দিয়েছেন। তাছাড়া, তার কথাবার্তায় আর কাজকর্মের একটু নমুনা দেখে খুশি হয়েছেন তাঁরা।
পা-রাখবার একটা জায়গা পেলে তারপর আবার অন্যত্র ভালো কোনো সুযোগের চেষ্টা করতে পারবে অসীম। উপস্থিত ওইখানে কাজটা পেলে আপাতত করবে সে।
বাসন্তী এগিয়ে আসে।
—থাক্ ওকথা। তোমার খবর কী বলো?
অসীম বলে ওঠে,
—ওরে, আশা নেই—
আশা, সে যে মিছে ছলনা।
আছে শুধু পাখা, নিবিড় তিমির মাখা,
আছে মহা অঙ্গন-–
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর! এখনি অন্ধ,
বন্ধ করো না পাখা।
—একটা গতি হবেই বাসন্তী দু-দশদিনের মধ্যে। দেখা যাক, এ কষ্টের শেষ হয় কিনা!
বাসন্তী মুখ নামিয়ে বলে,
—হবেই। সবকিছুরই শেষ আছে।
মাথা নাড়ে অসীম। বলে,
—Every cloud has a silver lining. যত ঘন মেঘই হোক না কেন, তার শেষ রোদের রেখাটুকু দেখা দিলে। দেখা যাক, এ মেঘের শেষ হবে কবে?
হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে জীবনবাবুকে ঢুকতে দেখে সরে গেল বাসন্তী। জীবনবাবু বাসন্তীকে দেখেই প্রশ্ন করে,
—গেছে লোকটা? ওই গদাইচরণ? উঃ, কি ধড়িবাজ লোক রে বাবা! এত কথা কি বলে যায় এখানে? অ্যাঁ!
বাসন্তী জবাব দেয়,
—একদিন তোমায় যেতে বলেছে।
জীবনবাবু মেয়েকে ধমক দেয়,
—কারো কেনা গোলাম নই যে, হুকুম করলেই যেতে হবে।
—বাড়ি ভাড়া ক’মাস বাকি? বাসন্তী বলে ওঠে।
একটু থতমত খেয়ে জীবনবাবু জবাব দেয়,
—বেশ তো, বাকি পড়েছে দিয়ে দেব। না পায় কোর্ট-ঘর করুক, মামলা লড়ব। ক’টা দিন যেতে দে—সব ব্যাটাকে দেখে নেব একহাত। এমন বস্তিতে আর থাকব নাকি? বুঝলি? একদিন এরকম বস্তির মালিকই হব। কি বল অসীম?
বাসন্তী, অসীম একটু হকচকিয়ে গেছিল ওর কথায় বীরত্বে। একটু সামলে নিয়ে জবাব দেয় অসীম,
—হ্যাঁ, তা তো বটেই!
—তবে? একটু তামাক সাজ বাসি।
বাসন্তী দু’জনের দিকে চেয়ে থাকে। কি ভেবে ও-কোণে বসে তামাক সাজতে থাকে বাসন্তী জীবনবাবু অসীমের কাছে এসে বসে। একটু চাপা-গলায় জিজ্ঞাসা করে,
—তাহলে বাবাজি? আজ তো ছ’দিন পার হয়ে গেল।
অসীম ওর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দেয়, একটু জোরের সঙ্গে বলে ওঠে,
—কিছু পয়সা-কড়ি থাকে তো দিন দিকি!
পয়সার কিছু দরকার অসীমের। এখানে-ওখানে যাতায়াত করে ঘোরাফেরার পর যদি জুটে যায় একটা চাকরি, তার চেষ্টা করতে হবে।
ওর কথায় জীবনবাবু পকেট হাতড়াতে থাকে।
জমানো যে-ক’টা টাকা ছিল, তাও শেষ হয়ে গেছে। হুড়হুড় করে এই ক’দিনে দরাজ হাতে খরচ করে সব ফুরিয়ে এসেছে জীবনবাবুর।
পকেট হাতড়ে নিজের আফিম খরচ বাবদ সামান্য কিছু রেখে, খুচরো সিকি, দু’আনি মিলিয়ে টাকা-খানেক দেড় ওর হাতে তুলে দেয় গুম্ হয়ে।
পয়সা ক’টা অনুমানে দেখেই বলে ওঠে অসীম,
—এই মাত্তর! তাহলে কী করে হবে?
জীবনবাবু ব্যস্ত হয়ে বলে,
—দোব বাবা, আরও দোব।
অসীম নিস্পৃহকণ্ঠে জবাব দেয়,
—ওটা না হলে কিন্তু কোনো কথাই থাকবে না।
চমকে ওঠে জীবনবাবু। অসীমের দিকে তাকিয়ে থাকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে। মহাবিপদে পড়েছে জীবনবাবু। অসীম বলে ওঠে
—কালই চাই আর কিছু টাকা। মানে, শেষবারের মতো একটু সিনেমা দেখব। এই ধরুন-–
জীবনবাবুর এত অভাব সত্ত্বেও ওকে টাকা দিতেই হবে। ওই তার ভবিষ্যৎ! তাকে চটানো যাবে না!
ও বিগড়ে গেলে তীরে এসে তরী ডুববে। তাই বলে ওঠে,
—দোব বাবা, দোব। সেখান থেকে হোক এনে দোব। কিন্তু ওই যে বললে-
—হ্যাঁ, ঠিক সাতদিন পরই আপনার কথা রাখব। খুশি হয় জীবনবাবু—বেশ, বেশ! মেয়েকে তাগাদা দেয়, তামাক সাজা হল? অ’ বাসি!
বাসন্তী হুঁকোটা এনে বাবার হাতে তুলে দেয়।
নিশ্চিন্তে চুপ করে হুঁকোয় গোটা কতক ভুরুক-ভুরুক করে টান দিয়ে বলে ওঠে জীবনবাবু,
— হ্যাঁ রে বাসি? তা, গদাই সরকার কী যেন বলছিল?
—একবার যেতে বলেছে। কি একটা খাতা-সরকারের কাজ আছে। বাসন্তী জবাব দেয়।
—খাতা-সরকারের কাজ! যাব বলছিস?
জীবনবাবু কী যেন ভাবছে!
দেখেছে, ওদের গদি-ঘরে উপুড় হয়ে পড়ে একদল লোক মস্ত জাবেদা খাতায় উকুন-ছারপোকার মতো সার দিয়ে দিনরাত কি সব লেখে, নাকে-চশমাটা ঝুলে পড়ে তাদের। পিঠ আর পেট এক হয়ে ধনুক বাঁকার মতো বেঁকে যায়।
ওই চাকরি করতে পারবে না জীবনবাবু। তাছাড়া ও-সবের দরকারও হবে না। কী ভাবছে যেন সে?
ওপাশে নতুন শাড়ি দু’খানা তখন পড়ে আছে। জীবনবাবুর চোখ এড়ায় না শাড়িগুলো।
বুঝতে পারে কোত্থেকে এসেছে ওগুলো। মনে মনে কি ভাবছে বুড়ো। চটে উঠতে গিয়েও পারে না।
কিন্তু টাকার দরকার। এখনও দু’চারদিন কাটাতে হবে তাকে। টাকা চাই-ই। আর সে-টাকার জোগাড় করতে হবে।
আবার আগেকার সেই দিন-চালানোর দুশ্চিন্তা—কালো মেঘের ছায়া তার মনের আকাশ ছেয়ে ফেলে। আবার আঁধার ঘনিয়ে আসে চারিদিকে।
এ আঁধারের শেষ নেই। কূল-তল নেই।
বাসন্তী খাবার জায়গা করছে। জীবনবাবু অসীমের দিকে তাকিয়ে থাকে, ও-ই তার একমাত্র ভরসা। ঘুরে-ফিরে একই কথাটা ওকে জানাতে চায় সে। অসীমকে কথাচ্ছলে বলে ওঠে জীবনবাবু,
–আজকাল ইলেকট্রিক ট্রেন বেশ জোরে চলে। আর তেমনি জবরদস্ত তার ইঞ্জিন। তাই
না?
অসীম ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কি যেন বলতে চায় বুড়ো! অসীম না জানার ভান করেই শ্ন করে,—কিছু বলছেন?
জীবনবাবু আমতা-আমতা করে বলে,
—না, এমনি বলছিলাম কথাটা। আজ রিষড়ে গেছিলাম একটা কেসের কাজে। দেখলাম, একটা গোরু একেবারে থেঁতলে গেছে নিমেষের মধ্যে, ওই ইঞ্জিনে কাটা পড়ে।
অসীমের ভালো লাগে না কথাগুলো। ওর কথাটা সহজ ভাবে নেবার চেষ্টা করলেও তা পারে না। মাঝে-মাঝে বেঁচে থাকা আর মরা, এই দুটোর মাঝে অতি সূক্ষ্ম ব্যবধানটা তার চোখে পড়েছে, তাই ভয় হয় অসীমের। এত কষ্টের মাঝেও আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখে, নিজেকে টিকিয়ে রাখবার জন্য অসীম আজ মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভালোবাসা, প্রীতি সবকিছু কুড়িয়ে সে বাঁচতে চায় নতুন করে।
তাই জীবনবাবুর ওই কথাগুলো যেন কান দিয়ে শুনতে চায় না অসীম।
উঠে গেল সে ঘরের ভিতরে কোনো কথা না বলে।
জীবনবাবু ওকে দেখছিল, এতদিন এই পরিবর্তনটা চোখে পড়েনি। আজ পরিষ্কার ভাবে ফুটে ওঠে যে, অসীম সহজভাবে কথাগুলো নেয়নি।
তাই বোধহয় সরে গেল।
কেমন একটু অবাক হয়েছে জীবনবাবু। অসীমের মুখে-চোখে, আর ওর কথাগুলোয় একটা বিরক্তির-ভাব ফুটে উঠেছে তাও নজর এড়ায় না। বাসন্তী বলে ওঠে, খাবার জায়গা করেছি বাবা!
—যাই। অ’ অসীম বাবাজি!
জীবনবাবু খাবার জায়গার দিকে এগিয়ে যায়। ডাকতে থাকে অসীমকে।
.