জীবন কাহিনি – ৩

গুনগুন সুর আসে তার মনে। 

বাসন্তী খাওয়া-দাওয়ার পর হেঁসেল তুলে থালা-বাসন মেজে সবে রান্নাঘরের একপাশের একটা জীর্ণ তক্তপোশে একটু গা-গড়ান দিচ্ছে, ক্লান্তিতে সারা গা-হাত-পা ভেঙে আসছে। দুপুরে একটু ঘুমোনো তার দৈনন্দিন কাজের অঙ্গ। 

সবে চোখ লেগেছে, হঠাৎ খবরটা শুনে একটু অবাক হয়। 

বস্তির মাঝে সুর বিশেষ ওঠে না, ওঠে ক্ষীণ চাপা-কণ্ঠে কান্না, না-হয় আর্তনাদ। এখানের বাতাসে ভারী হয়ে থাকে হতাশার সেই গুমোট ভাব। সেই জমাট পাথর ঠেলে উঠতে দেখে একটু অবাক হয়েছে সে! বিছানা থেকে উঠে বের হয়ে আসে বাসন্তী। 

পাশের ঘরে গান গাইছে অসীম। 

বেরোবার আয়োজন করছে, আর গুনগুন করে গান গাইছে। 

বাসন্তীর সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে। এখুনি ওই সুরের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। পাশের ঘরেই আছে মালতী, জল-কলের মিস্ত্রি ললিতের খাণ্ডার-বউ দুর্গাবতী—ওদিকে চির ছিদ্র-সন্ধানী মন নিয়ে বসে কদম পিসি। একখানাকে সাতখানা করে ডালপালা গজিয়ে ওরা প্রকাশ করবে চারিদিকে, কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত বাধাবে। 

এসব কথা অসীম জানে না, জানলেও বোধহয় তোয়াক্কা করে না। 

কিন্তু বাসন্তীকে করতে হয়। 

এগিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাসন্তী বলে ওঠে, 

—গান গাইবার জায়গা এটা নয়। 

অসীম মাথা নাড়ে 

— তবে? 

—ভদ্রলোকের বাড়ি। আপনাদের তে-মহলা প্রাসাদে যা ইচ্ছে, তাই করতে পারেন। এখানে আমাদের একটু সতর্ক হয়ে মান বাঁচিয়ে চলতে হয়। 

—গান গাইতেও মানা? 

বাসন্তী চড়া-স্বরে জবাব দেয়, 

—বললাম তো! 

অসীম চুপ করে চুলগুলো আঁচড়াতে থাকে। কোথায় যেন বের হবে একটু। 

বাসন্তী বাবার কথাটা ভোলেনি। নতুন মানুষ শহরে এসেছে, কোথাও যদি হারিয়ে যায়, পথ চিনে নাও ফিরতে পারে। 

তাই বলে ওঠে, 

—যাচ্ছেন কোথায়? 

—মাঠে-ময়দানে। প্রাণভরে গান গাইতে চলেছি। 

একটু হাসি আসে বাসন্তীর ওঁর কথায়। বহু কষ্টে হাসি চেপে বলে চলেছে—বেশি দূর যাবেন না। নতুন জায়গা, বাবাও বলছিলেন… 

অসীম কথা বলে না, ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। 

কি যেন ভাবছে বাসন্তী। একটু সহজ ভাবেই বলে ওঠে অসীম, 

—না, যাব না কোথাও। একটু ঘুরে আসছি। সারাদিন বাড়িতে বসে কেমন বিশ্রী লাগছে। বের হয়ে গেল অসীম। 

বাসন্তী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, বাড়িটা কেমন যেন শূন্য ফাঁকা বোধহয়। নিজের ওপরই কেমন রাগ হয়। 

ইচ্ছে করেই সে ওই ছেলেটিকে কেমন কড়াকড়া কথা শোনায় অকারণেই। 

কি ভেবে অসীমের ঘরটা সে গোছাতে থাকে। 

এদিক-ওদিক ছিটিয়ে পড়ে আছে জামা-কাপড় 

কি ভেবে ঝাঁটা এনে ঘরটা সাফ করতে থাকে, ওরই মধ্যে একটু ছিমছাম করে তুলতে চায় ঘরখানাকে। 

.

ফণী দালাল ঘোড়েল লোক। 

তার হাতে অনেক জায়গারই সন্ধান আছে, আর দামও তেমনি। জীবনবাবুকে নিয়ে জায়গা দেখতে বের হয়েছে সে। 

একটু উঁচু জমি হলে তো কথাই নেই। 

পাঁচ হাজার, সাত হাজার। আর একটা পানাপুকুরের কাছে এসে ফণী দালাল বলে ওঠে,

—এই যে দেখছেন, এর দাম একটু সস্তা হবে। চার হাজার টাকা কাঠা। 

জীবনবাবুর পা কাদায় পুঁতে গেছে। কোনরকমে জলকাদার হাবড় থেকে ঠেলেঠুলে উঠে দম নিতে-নিতে বলে, 

—এ তো পুকুর মশাই! 

হাসে ফণী দালাল, বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে, 

—পুকুর? তাই পড়তে পাচ্ছে না। আরো ভালো জমি চান, তাহলে ওই পাশে চলুন, তাও দেখাচ্ছি। 

হঠাৎ জীবনবাবু সামনে কাকে দেখে চমকে ওঠে। 

সাক্ষাৎ—শমন আর কি? এখানে ওকে দেখবে ভাবেনি। 

গদাই সরকার এই দিকেই আসছে ছাতা হাতে। 

শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব ঋতুতেই গদাই ছাতা হাতে নিয়ে বের হয়। 

রোদ যেন আদৌ সহ্য হয় না তার। মাথা ঘোরে। 

অবশ্য ওতে অনেকেরই উপকার হয়। 

জীবনবাবু ওকে দেখেই কোনরকম হাঁ-না করে সরে পড়ে। 

ফণী দালাল এমন শাঁসালো খদ্দেরকে বেমালুম ভেগে যেতে দেখে অবাকই হয়েছে।

—অ-মশাই, শুনছেন! অ-মশাই! অন্য জমি আছে, দেখে যাবেন? অ-মশাই!

জীবনবাবুর পিছন ফেরবার সময় নেই। ফাঁকা-মাঠ, জলা, আর কচুবন পার হয়ে দৌড়োচ্ছে।

ফণী দালাল তো অবাক! মনে মনে ভাবে, কে জানে, খদ্দেরটি বোধহয় জমির ওই আকাশ-ছোঁয়া দাম শুনে পালিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করছে। 

হাঁকা-হাঁকিতে গদাই সরকার ছাতার ব্যূহ থেকে মুখ বের করেছে, যেন খোলের ভিতর থেকে বুড়ো কাছিম গলা বের করে চারিদিক দেখছে। 

অদূরে দৌড়ে পালাচ্ছে জীবনবাবু। 

অবাক হয় গদাইচরণ! তাহলে জীবনবাবুও জমি কেনবার সন্ধানে ঘুরছে। 

এদিকে বাড়ির ভাড়া দেবার নাম নেই, পাত্তা পাওয়া যায় না বাড়িতে। আর সেই জীবনবাবুই কিনা এসেছে লেকের ধারে জমির দর করতে! 

ধরা পড়ে যেতেই ভয়ে পালাচ্ছে। 

ফণী দালাল গদাই সরকারকে দেখে দাঁড়াল। 

গদাই সরকার বলে ওঠে,—জমি দেখতে এসেছিল বুঝি লোকটা, না হে ফণী? 

ফণী আমতা-আমতা করে, 

—তাই তো বললে সরকার মশাই! 

গদাই সরকার মনে মনে রাগে ফুলতে থাকে। 

ওর অভাব-টভাব সব বাজে কথা। লোকটা এক নম্বরের ফেরেববাজ। গদাই তামাম কুলেপাড়া থেকে মানিকতলা ইস্তক লোক চরিয়ে খায়, তাকে কিনা ধাপ্পা দিয়ে পার পাবে ওই জীবনবাবু! 

পীরের কাছে মামদোবাজি! 

ছাতাটা রাগের চোটে ফটাস করে বন্ধ করে তক্ষুনি ওই সতেরো নম্বর বস্তির দিকে হন্‌হনিয়ে চলতে থাকে গদাই সরকার। মনে মনে বলে, 

আজ ওরই একদিন, কি আমারই একদিন। 

ভালো কথায় বললেই পারে, তাতে গদাই চটবে না, কিন্তু নিত্য ওই ধাপ্পাবাজি সইবে না সে।

ফণী দালাল ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। থ’ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে সে। এদিকে জীবনবাবুর পিছনে ধাওয়া করেছে তখন গদাইচরণ। 

সরকার একটা বোঝাপড়া করবে আজ। 

বেলা পড়ে এসেছে! সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার নেমেছে বস্তিতে। দু’একটা আলো টিমটিম করে জ্বলছে। 

জীবনবাবু আলো-আঁধারির মধ্যে এগিয়ে গিয়ে বাড়িতে ঢুকল। 

এখানে বিজলি-বাতি এখনো আসেনি। 

এঘরে-ওঘরে টেমি, না হয় মিটমিটে ধোঁয়াপড়া হ্যারিকেন জ্বলে। 

বাসন্তী বাবাকে ফিরতে দেখে ওর দিকে তাকাল। 

দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে জীবনবাবু রাত্রির নিভৃত আলো-আঁধারির মধ্যে এসে একটু যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। বলে ওঠে, 

—কই, কাপড়-চোপড় দে দিকি, একটু হাত-পা ধুয়ে নিই। সারাদিন যা ধকল গেছে!

বাসন্তী দড়ির আলনায় কাপড় খুঁজতে থাকে। 

কিন্তু পায় না। একখানা লুঙি, তাও ছিঁড়ে গেছে। দু’একখানা কাপড় যা ছিল, তা বাড়িতে পরবার জন্য নয়। 

বাসন্তী বলে ওঠে,–কাপড় তো নেই বাবা। বললাম লুঙি কেনো একটা। 

গজগজ করে জীবনবাবু,—আরে বাপু, না হয় তোর শাড়িই একখানা দে! এখন বাড়িতেই তো থাকব। লুঙি কেনো বলেই তো তুই খালাস। সব হবে, ক’টাদিন সবুর কর। 

বাসন্তী বাবার ওকথা অনেকদিন ধরে শুনে আসছে। 

সবুর করে করে সে অধৈর্য হয়ে উঠেছে। কোথাও কিছু না পেয়ে নিজের একটা শাড়িই এনে দেয়। 

জীবনবাবু তাই নিয়ে চটের পর্দা-ঘেরা বাথরুমে এসে ঢুকল। 

—একটু চা কর দিকি। উঃ, সারাদিন ঘুরছি তো ঘুরছিই ঘোড়ার মতো, তাও যদি রেসের ঘোড়া হতো। তারা খায় ভালো, তোয়াজে থাকে। আমি হলাম ছেকরা গাড়ির ফরে ঘোড়া। চাবুকের ভয়ে চলছি তো চলছিই। 

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পয়সার সাশ্রয়ের জন্যই কেরোসিন তেলের বেশি রেওয়াজ এখানে নেই! একটা কুপি জ্বলছে; বাইরের-দাওয়ায় আবছা অন্ধকার! 

বাসন্তী বাবার সামনে এনে দিয়েছে চা, আর কলাই ভাজা। জীবনবাবু ইতিমধ্যে কাপড় বদলে একটু নিশ্চিন্তে বসে চা-এ চুমুক দিয়ে চলেছে। বলে ওঠে—তা, অসীমকে দেখছি না যে? কোথায় গেল সে? অ্যাঁ! 

বাসন্তী কি যেন করছিল রান্নাঘরে! বাবার কথার জবাব দেয় না। ধমকে ওঠে জীবনবাবু,

—কথাটা কানে গেল না? বলি, অসীম কোথায়? ছেলেটা নতুন এসেছে কলকাতায় 

বাসন্তী এত দরদ-ভরা কণ্ঠে বাবাকে ওর খোঁজ নিতে দেখে বলে ওঠে, 

—সারাদিন ঘরে বসে আছে, রাজপুত্তুর তাই হাওয়া খেতে বের হয়েছেন। পেটের ভাত ক’টা হজম করতে হবে তো? এখুনি ফিরবে। 

একটু আশ্বস্ত হয় জীবনবাবু। বলে, 

—তাই বল। ও-সব কথা বলিস না তুই। দেখিস, ও যেন আবার রাগ-টাগ না করে।

একটু শীত-শীত পড়েছে। জীবনবাবু চায়ের কাপটা শেষ করে গায়ে শাড়ির আঁচলটা জড়িয়ে বিড়ি একটা ধরিয়ে একটু আমেজ করে টানছে। 

বেশ ভালোই লাগে। 

সারাদিনের কাজের পর এমনি একটু নিশ্চিন্ত শান্তিপূর্ণ জীবন তার কাছে একান্ত কাম্য বলে মনে হয়। 

একটি মেয়ে, তাকে ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে কাছেই রাখবে। সবই দিয়ে যাব ওদের! বাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি-ব্যবসা যা গড়ে তুলবে, সবই পাবে বাসন্তী। বিনিময়ে জীবনের যে ক’টা দিন সে বাঁচবে, ঐ ক’টা দিন শান্তি চায় সে, চায় একটু নিশ্চিন্ত ভাবে বাঁচার আশ্বাস। 

ফণী দালাল আশ্বাস দিয়েছে, সস্তায় জায়গা সে পাবে। 

একবার টাকাটা হাতে পেলে হয়, গদাই সরকারের নাকের ওপর রুপোর জুতো মেরে ঠাণ্ডা করে দেবে। এমনি চোরের মতো আর পালাতে হবে না তাতে দেখে। 

ওদিকে রাত হচ্ছে, অসীম তখনও ফেরেনি। 

সব ভরসা ওই ছেলেটির ওপর। ওদের ভবিষ্যৎ আর উন্নতির একমাত্র আশা ওই অসীম। তাকে এখনও ফিরতে না দেখে অধৈর্য হয়ে ওঠে জীবনবাবু। 

রাগ হয় মেয়ের ওপরই। গজরাতে থাকে সে। বলে, 

—তুই কিছুই দেখবি না! একটা নতুন ছেলে পথঘাট চেনে না, তাকে যেতে দিলি?

হঠাৎ বাইরে কড়াটা নড়ে ওঠে। 

অসীমই ফিরেছে বোধহয়। খুশি হয়ে এগিয়ে যায় জীবনবাবু দরজা খুলতে। 

হুড়কোটা খুলেই সামনে সাপ দেখার মতো চমকে উঠেছে। মুখের খুশিখুশি ভাব আকাশ-কুসুমের মতো যেন মিলিয়ে যায়। যাকে এড়াবার জন্য পালিয়ে এসেছে, সেই গদাই সরকারই যে সন্ধ্যার-অন্ধকারে এখানে এসে হানা দেবে স্বপ্নেও ভাবেনি জীবনবাবু। 

গলির গ্যাসের আলো পড়েছে গদাই-এর মুখে। 

দরজা খুলে দিচ্ছে কে, তা বেশ ভালো দেখতে পায়নি গদাই আঁধারে। কিন্তু দেখেছে জীবনবাবুই। 

কিন্তু বের হয়ে পালাবারও পথ নেই। 

নিমেষের মধ্যে পরনের শাড়িটা খপ্ করে গায়ে-মাথায় জড়িয়ে নিয়ে সরে আসে বাড়ির মধ্যে, গদাইও পিছু পিছু ঢুকছে। 

বাসন্তী দরজা খোলার শব্দ শুনে দাওয়ায় বের হয়ে এসে বাবাকে ওই অবস্থায় দেখে অবাক হয়। পিছনেই আসছে গদাই সরকার। ব্যাপারটা অনুমান করে নেয় বাসন্তী। 

ইশারায় নিষেধ করেছে জীবনবাবু, বাসন্তী যেন ওর কথা না জানায়। জানতে পারলেই এখুনি চিৎকার, অপমান, বকাবকি শুরু করবে গদাই সরকার। 

গদাই এগিয়ে এসে একেবারে দাওয়ায় উঠেছে। ও-ঘরে ঢোকবার পথও নেই যে জীবনবাবু সরে যাবে। অগত্যা অন্ধকার দাওয়ার এককোণে পিছন হয়ে বসল গুঁড়ি মেরে। 

গদাই সরকার সন্ধানী-দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক দেখছে। 

লোকটা গেল কোন্দিকে! 

বাসন্তী ব্যাপারটা সামলাবার জন্যই তাড়াতাড়ি কোত্থেকে আসন এনে পেতে আপ্যায়ন করে গদাই সরকারকে। 

—বসুন। 

গদাই তখনও সন্ধান করছে জীবনবাবু বাড়ি ফিরেছে কিনা? যদি ফেরে সে তবে গেল কোন্‌দিকে 

সে খবর পেয়েছে এ পাড়ার পরেশের কাছে যে, জীবনবাবু বাড়ি ফিরেছে। গদাই সরকার বাসন্তীর দিকে তাকিয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করে, 

—তোমার বাবা বাড়ি ফেরেননি? 

বাসন্তী জানে, এখুনি আসল কথা বললেই কেলেঙ্কারি বেধে যাবে। বাবার কাতর ভয়- মাখানো চাহনিও তার মনে পড়ে। কি ভেবে সহজভাবেই হাসি-ফুটিয়ে তোলে মুখে। জবাব দেয়, 

—বাবা! কই, না তো! সেই সকালে বেরিয়েছেন এখনও ফেরেননি। মাঝে মাঝে তাই খুব ভাবনায় পড়ি! 

গদাই ওপাশে শাড়ি-জড়ানো মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। 

বাসন্তী সামলাবার জন্যই গল্ করে বলে চলেছে, 

—দেখুন না,দেশ থেকে কে-এক দূর সম্পর্কের পিসিমা এসেছেন, কানের অসুখ দেখাতে। তা, বাবার কোনো হুঁশই নেই। কি যে করি? 

ওর অসহায় ভাবটুকু গদাই-এর মনে একটা মিষ্টি আবেশ আনে। ঘরে হেড়াম্বারূপী জগদ্ধাত্রীর তুলনায় এ কেমন মিষ্টি! আর তার তাকিয়ে সুন্দরীও। গদাই মায়াভরা কণ্ঠে বলে ওঠে, 

—বেশ তো! আমি না হয় শশী ডাক্তারকে বলে দোব। মেডিক্যাল কলেজ না কোথাকার কানের বড় ডাক্তার উনি, আমার খুবই চেনা-জানা। 

বাসন্তী তখনও ঢোক গিলছে। একদমে অনেকগুলো মিথ্যা কথা বলে ফেলেছে। সামলাবে কি করে তাই ভাবছে। 

গদাই মাথা নাড়ে। বলে, 

—তা, রোগটা কি? কানে শুনতে পান না? 

বাসন্তী মাথা নাড়ে, 

—মানে, হ্যাঁ। কিছুই শুনতে পান না। 

গদাই মনে মনে খুশি হয়,—তা ভালো। 

একটু এদিক-ওদিক দেখে গদাই গদগদ কণ্ঠে বলে চলেছে হাতের ছাতাটা নামিয়ে, 

—তোমার কোনো ভাবনা নেই বাসন্তী। মানে, জানো তো, নানান কাজে ব্যস্ত থাকি, তাই সময়মতো খোঁজ-খবর নিতে পারি না। তবু কি জানো, মনটা পড়ে থাকে এখানেই। হু-হু করে জ্বলে দিন-রাত! 

বাসন্তীর মুখ-চোখ কেমন অজানা ভয়ে আর লজ্জায়-বিবর্ণ হয়ে যায়। 

ওদিকে কাপড়-জড়ানো মূর্তিটা মাঝে-মাঝে নড়ছে, গদাই-এর এদিকে খেয়াল নেই। বাসন্তী ইশারা করে দেখায় গদাইকে, পিসিমা রয়েছেন। 

গদাই হাসছে। বলে ওঠে, 

—ধ্যাৎ, ওতো কানেই শোনে না। আর তাছাড়া মনের দুটো কথা কইবো তেমন মানুষই পাই না বাসন্তী, তাই তো এখানে আসতে মন চায়! 

বাসন্তী বলে ওঠে—রাত হয়ে গেছে অনেক। 

অর্থাৎ বাসন্তীও কেমন গদাইকে এড়াতে চায়। হাবভাবে এ কথাটাই বলতে চায় যে, গদাই গেলেই ও যেন খুশি হবে। 

গদাই মনে মনে খানিকটা টের পেয়েছে যে, এখানে সে ব্যর্থ হবে না। আপাতত একটু চেষ্টা করে ওর মন জয় করতে হবে। 

তার অভিজ্ঞতায় মন জয় করার একটা পথের সন্ধানও সে জানে। 

তাই বলে চলেছে, 

—দু’খানা শাড়ি দিলে কাল এই ভুবন স্টোর্স—সুন্দর কচিকলাপাতা আর ফিরোজা রং, তোমাকে মানাবে চমৎকার। 

বাসন্তী ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। গদাই আজ শুধু একটু ভূমিকা করে রেখেই উঠে পড়ল। সে জানে, ক্রমশ খেলিয়ে তুলতে হয় রুইমাছ, একটানে তুলতে গেলে জাল ছিঁড়ে বের হয়ে যাবে। 

—আচ্ছা, আজ চলি বাসন্তী। বাবাকে বলো, এসেছিলাম। 

মাথা নাড়ে বাসন্তী। আপদ বিদায় হলেই বাঁচে সে। গদাই তখনও দাঁড়িয়ে, যেন কথা বলেই সময়টা কাটাতে চায়। বলে, দেবে। 

—মানে, এই যে কাপড়ের কথা বললাম, রং-পছন্দ না হলে বলবে, ওরাই আবার বদলে 

বাসন্তী আমতা-আমতা করে। বলে, 

—কাপড় তো রয়েছে। আবার… 

গদাই দরদ-ভরাকণ্ঠে বলে ওঠে, 

—ভদ্রলোক বাড়তি শাড়ি দিয়ে গেল, ওগুলো তোমার জন্যই নিলাম, নয়তো আমি কি শাড়ি পরে কলাবউ সেজে বসে থাকব ঘরে! কি বল বাসন্তী? 

নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে থাকে গদাইচরণ! 

—আচ্ছা, আজ চলি বাসন্তী! কেমন? 

গদাই চলে যেতেই জীবনবাবু জ্যা-মুক্ত ধনুকের মতো সটান লাফ দিয়ে সোজা হয়ে উঠে 

গজরাতে থাকে। 

—ব্যাটার বড় বাড় বেড়েছে দেখছি! এতবড় সাহস? আর তুই কিছু বললি না বাসি? বলি, ভেবেছিস কী? 

বাসন্তী এতক্ষণ ওই জানোয়ারটার সঙ্গে অভিনয় করে হাঁপিয়ে উঠেছে। বাবার কথাগুলো প্রথমে যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বেদনাহত দৃষ্টি মেলে বাসন্তী বাবার দিকে চায়। কড়া কথা বলতে গিয়েও পারে না। তাই চুপ করে গেল বাসন্তী। 

.

অসীম কলকাতায় মানুষ। এ শহর এবং শহরতলির মধ্যে প্রতিটি এলাকায় মুকুটহীন একজন সম্রাট এবং তার সভাসদরা থাকবেই। এক-এক সীমানা নিয়ে এক-একটা রাজ্য। 

তাদের না চিনলেও তাদের স্বরূপটা খানিকটা চেনে অসীম। তাই এ-পাড়ায় এসে তাদেরই সন্ধান করে। 

ওদের হাতে রাখা দরকার। ওদের চক্রে ভিড়তে পারলে নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে তুমি যে কোনো এলাকায় রাজত্ব করতে পারো। আর, ওই রাজা-উজিরদের পিছনে রাজস্ব বাবদ তোমাকে মাঝে মাঝে চা-বিস্কুট ইত্যাদি কিছু খরচ করতে হবে, সেই সঙ্গে সিগারেটও চাই। 

ওই রাজা-উজিরদের দেখা যাবে পাড়ার চায়ের দোকানেই। না হয় আশপাশের রোয়াকে, না হয় কালভার্টের প্যারাপেটের উপর। সেইখানেই আসর জমিয়ে ওরা রাজ্যশাসন করে। 

কাকে উৎখাত করতে হবে, কোন্ বাড়িওয়ালা ভাড়াটের গোলমেলে কোন্ পথ নিলে সুবিধা হবে, কাকে ফলো করলে মজাটা জমবে, সেইসব মূল্যবান আলোচনা শুরু হয় এখানে—শেষ হয় খেলার মাঠ, না হয় সিনেমাতে। 

নতুন কাউকে দেখলেই তারা আলোচনা থামায়। লক্ষ্য করে তাকে। অসীম এদের হালচাল জানে, বোঝেও। 

তাই প্রথম দিন বস্তি থেকে বের হয়েই পরেশের দলকে খুঁজে বের করেছে সে। 

ওরা অবশ্য লক্ষ্য করেছে অসীমকে। এ পাড়ায় নতুন মুখ। 

অসীম’টালি-ছাওয়া একটা চায়ের দোকানের ভিতরে চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিল, ওদের কারোর সিগারেট ফুরিয়ে যেতে দেখে নিজের প্যাকেটটাই এগিয়ে দেয় সে। 

—নিন বড়দা। 

পরেশ একটু অবাক হয়! বলে, 

—ক্যাপস্টেন! আমরা তো দাদা ফোর ক্যাসেলের খদ্দের। 

একটু অবাক হয় অসীম! 

—ফোর ক্যাসল! 

ওর ক্যাপস্টেন ধরিয়ে নিয়ে বলে ওঠে পরেশ জুতসই একটা টান দিয়ে, 

—থ্রি ক্যাসেল জানেন তো? বিলিতি সিগারেট। তার চেয়ে এক ক্যাসেল ওপরে চারমিনার।

হাসতে থাকে অসীম। 

দেখাদেখি কয়েকজন আরও এসে বসেছে ওর টেবিল ঘিরে। হাতকাটা কালী, গিরিজা, তিনকড়ি, আরো অনেকে এসেছে। 

—চা দেখি পাঁচ কাপ, আর পাঁচটা মামলেট। 

অর্ডার দেয় অসীমই। সামান্য যা দু’পাঁচ টাকা পেয়েছে জীবনবাবুর কাছ থেকে, তা থেকেই দমকা খরচ করে বসে। 

ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। অসীম বলে ওঠে, 

—তাতে কি আছে? খান। নতুন এলাম ক’দিনের জন্যে এ-পাড়ায়, আপনাদের সঙ্গে পরিচয় হলো। 

দাঁত বের করে হাসে হাতকাটা কালী। বলে, 

—কি যে বলো দাদা? হাজার হোক, লোক চিনি আমরা। জীবনবাবুর ওখানে উঠেছেন তো? তা, বুড়ো হাড়কঞ্জুষ, আর তেমনি ওই মেয়েটা! কি ডাঁট? কথাই কয় না। আমি না হয় পাড়ার দু’কান-কাটা—হাতকাটা। কিন্তু এই শর্মাই একদিন এই সারা ফুলবাগানের মহড়া লিয়েছিল রায়টের সময়। 

চা-মামলেট আসতেই কথা বন্ধ করে ওরা হাত চালাতে থাকে। ওটা জুড়োতে দেওয়া ঠিক হবে না। 

অসময়ে গলিপথ দিয়ে গদাই সরকারকে যেতে দেখে ওরা তাকিয়ে থাকে। গদাই সরকার ওদের গুরুস্থানীয় ব্যক্তি। দায়-অদায়, বিপদ-আপদ, পুলিশ-হাঙ্গামা থেকে বাঁচতে ওই তাদের একমাত্র সহায়। অবশ্য গদাই-এর অনেক কাজেই লাগে তারা। 

একটু খুশিমনেই গদাই ওদের দেখে ঢুকল চায়ের দোকানে। অসীম তখন চা-মামলেটের দাম মিটিয়ে দিয়ে বের হবার জন্য তৈরি হচ্ছে। এই সুযোগে ওরাও ওর প্যাকেটের বাকি সিগারেট ক’টা বের করে ধরাতে থাকে। 

ওদের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেল অসীম। ওকে লক্ষ্য করছিল এতক্ষণ গদাই সরকার। 

কালী, পরেশের দল মাঝে মাঝে এমন কাপ্তেন পাকায়। দায়ে-অদায়ে পড়ে অনেকেই আসে ওদের কাছে। 

খাওয়া-দাওয়া থেকেই ওরা তার ঘাড়ে কোপ বসাতে শুরু করে। এ-সব জানে গদাই সরকার। নেহাৎ কৌতূহলবশেই জিজ্ঞাসা করে, 

—ওটি কে রে পরশা? 

সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলে ওঠে পরেশ, 

—নতুন আমদানি, সতেরো নম্বরে কোন্ এক আত্মীয় আছে! ওই যে, ওই পিলিপিলি সাহেব গো! সেই যে মেয়েটার বাবা, তাদেরই বাড়ি এসেছে ক’দিন। 

—আত্মীয়! একটু অবাক হয় গদাই সরকার! জীবনবাবুদের আত্মীয়! 

গদাইচরণ যাচাই করতে চায় কথাটা। 

—কেমন আত্মীয় রে? শাঁসালো মক্কেল নাকি? 

হাসে পরেশ। বলে, 

—কে জানে, কেমন আত্মীয়? তবে খাইয়ে গেল মামলেট চা, আর ক্যাপস্টেন সিগারেট। দিল্ আছে বলতে হবে ছোক্রার। 

গদাই সরকার কথা বলে না। কি যেন ভাবছে! সবই কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। 

একটার পর একটা ভাবনার খেই ধরে আনমনে সে কেমন জাল বুনে চলেছে। জীবনবাবুর হঠাৎ দিন-বদলের সঙ্গে ওর আবির্ভাবের কি যেন একটা অদৃশ্য সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়।

ছোঁড়াটার চেহারা, পোশক-আশাকও খুব খারাপ নয়। নিশ্চয়ই খরচপত্রও করে। এর জন্যই বোধহয় জীবনবাবু লেকের ধারে জমি দেখছে। কেমন যেন একটা সন্দেহের ছায়া ঘনিয়ে আসে গদাই সরকারের। 

বাসন্তীকে কেন্দ্র করে কি যেন একটা ভাবনার ছায়া ঘনিয়ে আসে গদাইয়ের মনে।

সরকার মশাইকে হঠাৎ এমন গুম হয়ে যেতে দেখে পরেশ একটু অবাক হয়। গলা-খাটো করে জিজ্ঞাসা করে, 

—তল্লাশি লোক চাই সরকার মশাই? 

গদাই সরকার জানে, তার কাছে পরেশের দলের টিকি-বাঁধা। মাথা নাড়ে গদাই সরকার। বলে, 

—একটু নজর রাখ দিকি, কি ব্যাপার? 

হাসে পরেশ—সব খবর নিশ্চয়ই পাবেন সরকার মশাই। 

কথা না বলে দোকান থেকে বের হয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে চলে গদাইচরণ। পরেশ হাসছে দোকানের নড়বড়ে চেয়ারে বসে। 

হাতকাটা কালী অবাক হয়। বলে, 

—হাসছ যে ওস্তাদ? 

পরেশকে ওরা ওই বলেই ডাকে। পরেশ হাসির ধাক্কাটা একটু সামলে নিয়ে বলে ওঠে,

—দিনকতক একটু ভালোই কাটবে, কি বল? 

—তার মানে? 

পরেশ আনমনে সিগারেট টানতে-টানতে জবাব দেয়, 

—শাঁখারির করাত কি, তা জানিস? যেতেও কাটে, আসতেও কাটে।.এই ছোঁড়াও আমাদের খাওয়াবে, আর সরকারেরও কিছু খসবে। 

—তার মানে? 

পরেশ ব্যগ্রকণ্ঠে বলে, 

—ওসব তুই বুঝবি না। ছাড় দিকি একটা সিগারেট! 

কালীচরণ কাটা হাত দিয়ে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দেয় পরেশের দিকে। পরেশ মনে মনে তখনও হাসছে। বলে ওঠে, 

—রোগে ধরেছে বুড়ো সরকার মশাইকে, বুঝলি? হোক বাবা, বর্বরস্য ধনক্ষয়ঃ। 

হাতকাটা কালী, গিরিজা ড্রাইভার বিষ্টু সকলেই কেমন একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওস্তাদের দিকে। 

অন্ধকারে অসীম পথ চিনে-চিনে এগিয়ে আসছে। 

একবার ঢুকেছিল, আর ঢোকেনি এ বাড়িতে। পরে গলিটার পাশে সারি-সারি খুপরি ঘর; পাশেই খোলা নর্দমা দিয়ে ময়লা জল বয়ে চলেছে। গোলক ধাঁধার মতো মনে হয় সমস্ত বস্তিটা। 

ঠিক ওদের বাড়িটাও ঠাওর করতে পারে না অসীম। সবই যেন একই রকম মনে হয়। কোথায় একটা মেয়ের চিৎকার কানে ভেসে আসে। হপ্তার দিন, কেউ হয়ত মদ খেয়ে এসে বউকে প্রহার শুরু করেছে। 

এদিকে কোথাও একটা ছেলে শীর্ণকণ্ঠে প্রাণপণে চিৎকার করে চলেছে, তাকে ছাপিয়ে ওঠে কোনো মায়ের কণ্ঠস্বর। 

—’এমন ছেলে যে কেন মরে না’ তারই ফিরিস্তি শুরু করেছ তার গর্ভধারিণী। ছেলেটা তবু বায়না ছাড়ে না। 

শত অভাব আর কষ্টের মাঝেও সে তীক্ষ্ণস্বরে তার বাঁচবার দাবি জানাতে চায়। এরই মাঝে কোথায় সুর উঠেছে। 

সিঙ্গল রিড হারমোনিয়াম টিপে প্রাণপণে তা থেকে সুর বের করার চেষ্টা করে কোন্ মেয়ে ফুল আর চাঁদের স্বপ্ন দেখছে, দমবন্ধ হয়ে আসা খুপরির মধ্যে। কোথাও আবছা অন্ধকারে একটু নারী-কণ্ঠের হাসির সুর মিলেছে ওই বেসুরো গানের পাশে। 

জীবনের এক বিচিত্র প্রকাশ এখানে। 

তবু এরা বেঁচে আছে—কেউ মরার কথাও ভাবেনি। এত দুঃখ-কষ্ট-অভাব সহ্য-করেও ওরা দিন কাটায়। ওরা আশা করে, এই দিনগুলো বদলাবে। এই নীরব শোভাযাত্রার ভিড়ে অসীমও যেন ক্ষণিকের জন্যও বাঁচার আশ্বাস পেয়েছে। 

তাই আনমনে এগিয়ে আসছে। 

হঠাৎ ওদের বাসার দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল অসীম। 

জীবনবাবু চড়া-সুরে মেয়েকে কি সব বলে চলেছে। 

আর বাসন্তী চুপ করে দাঁড়িয়ে বাবার কথাগুলো শুনছে। 

গদাই সরকার বের হয়ে যাবার পর থেকেই জীবনবাবু শুরু করেছেন বকাবকি। ধূর্ত ওই লোকটা তাহলে প্রায়ই এখানে আসে! 

তার অসাক্ষাতেই বাসন্তী হয়তো একটা চক্রান্ত করে চলেছে—বাসন্তী আর গদাই সরকার।

ওই ধূর্ত লোকটাকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না জীবনবাবু 

বাসন্তী বাবার মুখে কথাগুলো শুনে চলেছে। ক্রমশ তার সহ্যের সীমা অতিক্রম করবে এইবার।

জীবনবাবু বলে চলেছে, 

—নষ্টামির জায়গা পানি? শাড়ি-ভেটকিমাছ এসব কেন দেয়? তোর ওপর এত দরদ কেন ওই গদাই সরকারের? 

—বাবা! বাসন্তী অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। 

বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে বাসন্তী। দেনার দায়ে চুল বিক্রি করে বসে আছে। ভোর থেকে পাওনাদারের তাগাদার ভয়ে চোরের মতো পালিয়ে বেড়ায়, তার মুখে এসব নীতিকথা আর উপদেশ, ন্যায়-অন্যায়ের শাসন শুনে বাসন্তী আজ চাপা-রাগে ফেটে পড়ে। 

জীবনবাবুর চেহারাটা ক্রমশ অনেক কুৎসিত হয়ে উঠেছে। 

অভাব আর অনটনের মাঝেও সে ভালোভাবে সম্মান নিয়ে মাথা তুলে বাঁচতে চায়। সেই বাঁচার দাবিতেই কোথায় সিঁদ দিয়েছে গদাই সরকার। বলে ওঠে জীবনবাবু, 

—ধমকাচ্ছিস যে? ভাবছিস এইসব অনাচার আমি সহ্য-করব চুপ করে? দিন একদিন বদলাবেই। সবাইকে সেদিন ‘আই শ্যাল সি’। 

বাসন্তী অসহায়, রাগে-দুঃখে কাঁদছে। 

হঠাৎ অসীমকে ঢুকতে দেখে জীবনবাবু কেমন সহজ হয়ে ওঠে। অসীম বাসন্তীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কান্নাভেজা মুখে-ম্লান হ্যারিকেনের একফালি লালাভ আলো পড়ে ওকে কেমন রহস্যময়ী করে তুলেছে। 

সামান্য একটা শাড়ি পরনে, নিটোল হাতে দু’গাছি কাচের চুড়ি, তাতেই কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে বাসন্তীকে। 

বাসন্তী অসীমকে দেখে সরে গেল ঘরের মধ্যে। 

ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না অসীম। জীবনবাবুই বলে চলেছে, 

—একটু বকা দরকার, বুঝলে অসীম। ভদ্রভাবে কথাবার্তা বলতে জানে না। তোমার সঙ্গেও ঝগড়া করেছে শুনলাম। 

অসীম অবাক হয়—ঝগড়া করেছে আমার সঙ্গে; কই, না তো! 

—করেনি, করতে পারে, সে-কথাই বলছিলাম। 

অসীম ঠিক বুঝতে পারে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। জীবনবাবু একটু দম নিয়ে, কোণে 

রাখা হুঁকোটা তুলে কলকেটায় ফুঁ-দিতে থাকে। জ্বলন্ত টিকের লাল-আভা পড়ে মাঝে মাঝে ওর শীর্ণ মুখে টিকোলো নাকটা খাঁড়ার মতো যেন ঝুলে পড়েছে। 

একটু চুপ করে থেকে এদিক-ওদিক দেখে বলে ওঠে জীবনবাবু গলা নামিয়ে, —হ্যাঁ-হে! আজ তো দু’দিন হল? 

—আজ্ঞে! অসীম মাথা নাড়ে। 

নির্বিকার চিত্তে হুঁকোটা টানতে টানতে জীবনবাবু বলে ওঠে, 

—তাহলে আর পাঁচদিন? 

কথাটা ঠিক বুঝতে পারে না অসীম। বলে, 

—পাঁচদিন! কিসের পাঁচদিন? 

অবাক হয় জীবনবাবু। মুখ থেকে হুঁকোটা সরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ দুটো ক্রমশ বড় হয়ে উঠেছে। সবে দু’দিন আগে কথাটা বলেছিল হাওড়া ব্রিজে সেই ভোরবেলায়, মনে পড়ে অসীমের। বলে ওঠে, 

—ও! সেদিন ব্রিজের ওপর যা বলেছিলেম! সাতদিনের কথা! 

তার পরমায়ুর কথাই জানতে চায় বুড়ো। অসীমের কথায় মাথা নাড়ে জীবনবাবু। 

—যাক, মনে আছে তাহলে! 

ওকে সান্ত্বনা দেয় অসীম, 

—ওর জন্য ভাববেন না। ও-কথা ঠিকই থাকবে। 

—তাই যেন থাকে বাবা। দেখছ তো, সেই ভরসাতেই নানা জালে পা-দিয়েছি। মেয়েটার একটা গতিও হয়। আর এই বুড়ো বাবুটিও বেঁচে যাবে। ভগবান তোমার মঙ্গল করবেন বাবা। 

মাথা নাড়ে অসীম জীবনবাবুর কথায়। বলে ওঠে হালকা-স্বরে, 

—তা করতে পারেন। 

জীবনবাবু শান্ত হয়, নিশ্চিন্তও হয়। যাক, ছোক্বা তাহলে সাতদিনের মাথাতেই মরবে নির্ঘাৎ! মরুক! 

ওর সুমতি হোক। 

জীবনবাবু সহজ ভাবেই সব ব্যবস্থার কথা চুকে-বুকে যেতে খুশি হয়। হাঁক পাড়ে, 

—খাবার জায়গা কর, বাসি। দেখিস, অসীম বাবাজির খাবার যেন গরম থাকে। ও আবার ঠান্ডা খাবার খেতে পারে না। মানে, ওদের বাড়িতে ঠাকুর চাকরের তো অভাব নেই। বাবাজির এখানে এসে কষ্ট হচ্ছে; নেহাৎই খাতিরে আসা। 

বাসন্তী চুপ করে আসন পেতে কলাই-করা দুটো থালায় ভাত এনে নামিয়ে দেয়।

অসীম বাক্যব্যয় না করে খেতে বসে— গো-গ্রাসে গিলে চলে। 

প্রতিটি গ্রাসই যেন জীবনবাবুর মুখ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে সে। বাসন্তীর সামনে থেকেও ছিনিয়ে মুখে পুরছে অসীম। 

এবার নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয় তার। 

নিষ্কর্মার মতো চুপ করে বসে আছে, কোনো করণীয় কাজই যেন তার নেই। 

জীবনবাবু ওকে ভাত মাখতে দেখে বলে ওঠে, 

—খাও। রান্না তেমন ভালো হয়নি বুঝি? ভালো হবে কী করে? সারাজীবন রাঁধল তো আলুসেদ্ধ আর ভাত, মাছের কালিয়া রাঁধতে গেলে ধাত ছেড়ে যাবে না? তাছাড়া মন দিয়ে রাঁধতে হবে তো—এও একটা আর্ট। 

বাসন্তী একবার বেদনাহত দৃষ্টি মেলে বাবার দিকে তাকাল। 

সে চাহনি অসীমের দৃষ্টি এড়ায় না। বলে ওঠে অসীম, 

—না, না, রান্না খুব ভালো হয়েছে। 

মুখ নামিয়ে খেতে থাকে অসীম। 

রাত্রি নেমেছে। 

সারাদিন ধকলের পর জীবনবাবু বিছানায় একটু গা-এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। টো-টো করে সারাদিন ঘোরাঘুরির পর আবার দিন-আনা, দিন-খাওয়ার কথা চিন্তা করেই নাজেহাল হয়ে পড়েছে লোকটা। ক’টা দিন তবু যেমন করে হোক জুটিয়েছে খাবার। ওই সমস্যা সমাধানের একটা পথ পাবে এই ভরসাতেই ক’দিন ঘুম আসছে জীবনবাবুর। অন্তত প্রথম রাতেই ভাত-ঘু একটু আসে, ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে যেতেই কাশির দমক শুরু হয়। নিজে তো জাগবেই, বাড়ির আশপাশের ঘরের অনেকেরই ঘুম ভাঙায় বুড়ো। 

কদম পিসি তাই কলতলায় গজগজ করে, 

—খকখকে বুড়ো। রাত জেগে শুধু কাশবি যদি তবে পাহারাওলার চাকরি নিগে না?

রাত হয়ে আসছে। 

বস্তির মাঝে স্তব্ধতা নেমেছে। এত কোলাহল, কলরব, কান্না, জীবনের বিচিত্র সুরের ঐক্যতান থেকে গেছে। চোখে ঘুম নেমেছে। 

নেমেছে থমথমে আঁধার। 

বাসন্তী তখনও কাজ সারতে পারেনি। এঁটো থালা-বাসনগুলো তুলে নিজে যা-হোক চাট্টিখানি খেয়ে এঁটোমুখ ধুয়ে ওই ঠাঁইটুকু শুকুলে তবে পার্টি আর জিরজিরে কাঁথাখানা পেতে শোবার আয়োজন করবে বাসন্তী। 

কেরোসিনের টেমিটা জ্বলছে প্রচণ্ড লালাভ শিখায়। 

জানলার ওদিক থেকে দেখছে অসীম বাসন্তীর খাওয়া। 

হাঁড়িতে সামান্য যা চাট্টিখানি ভাত ছিল, তাই নিয়ে একটু কি যেন চচ্চড়ি দিয়ে কোনো রকমে আধপেটা খাওয়া যায় মাত্র। বাকিটুকু জল দিয়ে ভর্তি করে বাসন্তী হেঁসেলে তুলে ফেলে। 

চুপ করে কি ভাবছে অসীম! 

সারা বাড়িখানায় কেমন একটা থমথমে স্তব্ধতা। ওই আঁধার আর বুকজোড়া স্তব্ধতার রাজ্যে, এই নির্দয়-দুঃখ আর কঠিন বাস্তবের মাঝে ও যেন একজন রাজপুত্রের অভিনয় করে চলেছে। 

নিজের মনে নিজেরই কেমন যেন ব্যাপারটা অন্যায় বলে বোধহয়। 

অসীম বের হয়ে এসে দাওয়ায় দাঁড়াল। বাসন্তী ঘুপসি রান্নাঘরে ন্যাতা বুলিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে, এখনও শুকোয়নি মেঝেটা। জলে জ্যাবজ্যাব করছে। শোবার ঠাঁইও তার ওইটুকু ছাড়া নেই। 

অসীমকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হল বাসন্তী। 

অসীমই বলে ওঠে কৈফিয়ত দেবার সুরে, 

—ভেতরে গুমোট গরম, তাই বাইরে হাওয়ায় এলাম একটু। 

বাসন্তী ফস্ করে সোজা প্রশ্ন করে বসে, 

—গরিব লোকের বাড়িতে কেন এসেছেন? নিজেই অসুবিধে ভোগ করছেন। 

অসীম ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। একফালি উঠোনে এসে পড়েছে চাঁদের একটু আলো। 

বলে ওঠে অসীম, 

—নিজের চেয়ে তোমাদের অসুবিধেটাই বড় করে দেখছি। 

বাসন্তী জবাব দেয়, 

—তবে রয়েছেন কেন? দয়া করে চলে যান। বড়লোকের ছেলে, গাড়ি-বাড়ি- 

হাসে অসীম। বেদনা-ভরা সেই হাসি! 

একজন মানুষের সামনে আজ সে সত্য কথাই বলবে। এতদিন শুধু দূর থেকে দেখে এসেছে মানুষকে, পেয়েছে তাদের দেওয়া আঘাত আর অবহেলা। হতাশার আঁধারে মন তাই ভরে উঠেছে। আজ সে একজনের কাছে অন্তত মিথ্যা কথা বলবে না। 

বাসন্তী ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। অসীম বলে চলে, 

—পথের মানুষ আমি। ঘর নেই, আশ্রয় নেই, বাঁচারও কোনো ভরসা নেই। তোমার বাবাই পথ থেকে ডেকে এনে আশ্রয় দিয়েছে। 

বাসন্তী ওর দিকে তাকিয়ে অস্ফুট কণ্ঠে বলে ওঠে, 

—বড় লোক, বাড়ি-গাড়ি, বেনারসের জমিদারের ছেলে আপনি 

জবাব দেয় অসীম। বলে, 

—ওসব বাজে কথা। ওইসব না বললে তুমিই হয়তো বাবাকে বকতে, তাই বাধ্য হয়েই তোমার বাবা তোমাকে ও-কথা শুনিয়েছিল। 

বাসন্তী দাওয়াতে বসেছে ওর পাশেই। অজান্তেই মনের মাঝে গড়ে ওঠা সেই নীরব দুস্তর ব্যবধানটা ঘুচে গেছে। অসীম তাদেরই মতো একজন। 

বাঁচার ভরসা খুঁজতে এসেছে এখানে। 

বাসন্তী বলে ওঠে-পয়সার লোভে আপনাকে আশ্রয় দিয়েছে। 

—হয়তো তাই। ওটা ছাড়া আশ্রয়ও মেলে না, প্রীতি-ভালোবাসাও দুর্লভ। 

বাসন্তী ওর দিকে তাকাল। চাঁদের আলোয় আকাশ ভরে উঠেছে। নীল আকাশে দু’একটা সাদা মেঘের টুকরো পেঁজা-তুলোর মতো ভেসে চলেছে হাওয়ায় ভর করে। ওর কালো দু’চোখে কি রকম একটু নিবিড় মায়া-জড়ানো। অসীম ওর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, 

—বেশ, উনি যখন যেতে বলেছেন কালই চলে যাব। 

বাসন্তী হাসছে। ওর গালে দুটো টোল ফুটে উঠেছে। দিনের হাড়ভাঙা খাটুনি আর অভাব-অনটনকে ছাপিয়ে এক অপরূপ জেগে উঠেছে রাতের গভীর স্নিগ্ধ-মাধুর্য, আর নীরব আকুতি নিয়ে।

বলে ওঠে বাসন্তী, 

—যাবেন তো শুনলাম। কিন্তু কোথায় যাওয়া হবে তাই শুনি! 

—তার কোনো ঠিকানা নেই। পথে-পথেই ঘুরব, না হয় শেষ পর্যন্ত— 

সেই রাতের ছবিটা মনে পড়ে অসীমের। নিরাশ্রয়, নির্বান্ধব একটি মানুষ কোথাও বাঁচার সান্ত্বনা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত জীবনের উপর, মানুষের উপর, পৃথিবীর উপর নিদারুণ ঘৃণায় শেষ বিদায় নিতে গিয়েছিল। 

হঠাৎ সেই মানুষটি যেন আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। 

চাঁদের আলোয়-ভরা সুন্দর পৃথিবী—কোথাও ডাকছে রাতজাগা পাখি 

বাসন্তীর দু’চোখে নীরব ভালোলাগার একটি আমন্ত্রণ। 

বলে ওঠে বাসন্তী, 

—থাক, অত বীরত্বে আর দরকার নেই। বরং একটা কাজকর্মের চেষ্টা দেখুন। এত লোক যেমন করে বাঁচবার ভরসা পায়, আপনিও পাবেন। 

এই একটি মেয়েই যেন তাকে আশ্বাস দেয়, …বাঁচার আশ্বাস। 

মাথা নাড়ে অসীম। বলে,—দেখা যাক। 

হাসছে বাসন্তী—দেখা যাক নয়, দেখতেই হবে। 

বাসন্তী চুপ করে বসে আছে, অসীম তখনও কী ভাবছে? বলে ওঠে বাসন্তী, 

—যান, এবার শুয়ে পড়ুন। সারারাত কি চাঁদের আলো দেখেই কাটাবেন? 

হাসে অসীম—জানেন তো, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়; পূর্ণিমা চাঁদ, যেন ঝলসানো রুটি।

হাসে বাসন্তী—ঠিকই বলেছেন। আকাশে চাঁদ আছে কি নেই, এসব দেখতেও ভুলে যাই আমরা। 

এত দুঃখেও হাসি পায়। তাই হাসছে অসীম। 

দু’জনের মাঝে নীরব ব্যবধানটা যেন দূর হয়ে গেছে। 

.

ঘুমোচ্ছিল জীবনবাবু। 

বেশ নিশ্চিন্তে কেমন নিবিড় স্বপ্ন দেখছে! লেকের ধারে সুন্দর বাড়িটা উঠেছে।

জীবনবাবুর পোশাক-আশাকও বদলে গেছে এইবার। 

চুনট-করা ধুতি, গিলে চড়ানো পাঞ্জাবি পরে তদ্বির-তদারক করছে চারিদিক। নতুন বাড়িতেই বিয়ে দিচ্ছে মেয়ের। কলাগাছও বসানো হয়েছে দরজায়, দু’পাশে রয়েছে আম্রপল্লব আর মঙ্গলঘট। সানাই-এর সুর ওঠে বাতাসে। আলো, আর ওই সুর কেমন একটা বিচিত্র পরিবেশ গড়ে তুলেছে। 

টিংটিঙে ছেঁড়া প্যান্ট-পরা জীবনবাবু এ নয়, সে আজ পদস্থ লোক। দামি গাড়ি থেকে বর নামছে, কোনো মস্ত বড়লোকের ঘরে বিয়ে দিচ্ছে মেয়ের। জীবনবাবুও আজ এই বড়দের সমপর্যায়েই উঠেছে। বাড়ি-গাড়ি সবই করেছে সে। 

হঠাৎ কেমন যেন হাসির সুর ওঠে। 

ঘুম ভেঙে গেছে জীবনবাবুর। আবছা অন্ধকারে চারিদিকে চোখ মেলে দেখছে হকচকিয়ে কোথায় সেই বাড়ি! আলো, আর সানাই-এর সুর মিলিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে সব রোশনাই।

স্বপ্ন দেখছিল সে। আঁধারে বস্তি-বাড়ির টিনের ঘরে শুয়ে রাজ-প্রাসাদের স্বপ্ন দেখছিল। মেজাজটা বিশ্রী হয়ে ওঠে জীবনবাবুর। 

এমন সময় কানে ভেসে আসে বাইরে ওদের মিষ্টি হাসির শব্দ। 

হাসছে অসীম আর বাসন্তী উভয়েই। বেপরোয়া হাসি। 

বুড়ো চমকে উঠে এদিক-ওদিক তাকাল! 

কী যেন ভাবছে বুড়ো? 

ছোঁড়াটার বিছানা খালি। রাতদুপুরে উঠে বাইরে গিয়ে বাসন্তীর সঙ্গে রাতভোর হাসি-মশকরা হচ্ছে। উঠে সেও বাইরে যাবে কিনা ভাবছে, হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেয়ে বুড়ো বিছানায় মটকা মেরে পড়ে থাকে। বাইরে থেকে অসীম ঘরে ঢুকে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। বুড়ো রাগে গশগশ্ করছে। 

ঘুম আসছে অসীমের! ঘুমিয়ে পড়ে সে। 

বুড়োর চোখে তবু ঘুম নামে না। 

আঙুল গুণছে। বিড়বিড় করে আপন মনে কি বলে চলেছে জীবনবাবু। হিসাব করছে আর কটা দিন ছোঁড়ার পরমায়ু। 

সাতদিনের মধ্যে তিনটে দিন তো পার হতে চললো। অসীমের দিকে তাকিয়ে থাকে বুড়ো, ওই বিচ্ছু ছোক্রার উপরই সব কিছু নির্ভর করছে। 

ও মরলে তবে টাকা পাবে সে, বাঁচতে পারবে শান্তিতে। বাড়ি ঘর সব হবে। না মরলে সৰ্বনাশ! 

এ যেন মুরগি পোষা—মিঞা তাকে জিইয়ে রাখে, আদর করে খেতে দেয়। নধর পুরুষ্টু করে তোলে তাকে। তারপর একদিন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে নিজের রসনা-তৃপ্তি করে। এই পরম ক্ষণের জন্যই প্রস্তুতি চলে এতদিন। ওই ছেলেটাকেও যেন তার জন্যই পুষে রেখেছে জীবনবাবু। কে কাকে পুষছে কে জানে? 

ঘুম আসে না। দিনান্তে এক-আধটা বড়ি আফিম খায় জীবনবাবু। ওই একটা নেশা রয়ে গেছে। ঘুম না আসাতে উঠে পকেট হাতড়ে ছোট্ট কৌটাটি বের করে, একটা মটর-দানার মতো বড়ি গলায় ফেলে দিয়ে একটু জল খেয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করে। 

এবার ঝিমুনি আসে। 

রাত ঘনিয়ে ওঠে। চারিদিকে অন্ধকার। এই বস্তি-বাড়ির সকলের জ্বালাধরা জীবনে ওই একটু শান্তির আশ্বাস আনার সময়। 

.

আবার একদিন বাঁচার জন্য শক্তি আহরণ করে নেয় তারা এই অবকাশে। 

সকালের একফালি আলো নেমে এসেছে উঠানে। ওদিকে বস্তির টিনের বেড়ার গায়ে অযত্নে বর্ধিত একটা জুঁইগাছে ফুল ফুটেছে—বাতাসে তারই সৌরভ; পাখি ডাকছে গাছের ডালে বসে।

বস্তির মাঝে ইতিমধ্যেই কলরব শুরু হয়েছে। জলের বাতি আর হাঁড়ি বসানো নিয়ে হাঁকাহাঁকি চলেছে। 

অসীমের তবু কেমন ভালো লাগে এখানে। কি যেন ভাবছে সে? 

বেলা হতে বাসন্তী চা আর হালুয়া এনে রেখে দেয় অসীমের সামনে। বলে—চা!

বাসন্তীর কথার স্বরও কেমন বদলে গেছে। আগেকার সেই কর্কশ ক্যাটকেটে গলার স্বর আর নেই তার। ইতিমধ্যে স্নান সারা হয়ে গেছে। বদলে গেছে বাসন্তী—এ যেন অন্য কোনো মেয়ে। 

সে একটা নীল শাড়ি পরেছে মাথায় একরাশ সদ্যভেজা চুলগুলো পিঠের ওপর মেলা; মুখ-চোখে হাসির একটা সুন্দর আভা। 

অসীম বলে ওঠে ওর দিকে তাকিয়ে, -আবার হালুয়া কেন? 

হাসে বাসন্তী বলে, 

—বড়লোকের ছেলে। বেনারসের রহিস আদমি। ডালমে অঙ্গুলি ঢালকে দেখে গা কিনা ঘিউ হ্যায়—তব্‌ শোচেগা খায়েগা ক্যা নেই। 

হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে বাসন্তী। 

ধমকে ওঠে অসীম, 

—অ্যাই! ফের ওসব কথা বললে ভালো হবে না বলছি। 

বাসন্তী তখনও হাসছে। এবার হাসি থামিয়ে বলে ওঠে, 

—কই, খাও। 

অসীম বলে—তুমি খানিকটা নাও। এই যে- 

দু’জনেই একপ্লেট থেকে নিয়ে খেতে থেকে হালুয়া। 

অসীম এবার বলে—কাজ একটা জোগাড় করতেই হবে বাসন্তী। 

—তা চেষ্টা করলে নিশ্চয় পাবে। লেখাপড়া শিখেছ, কাজকর্মও জানো। 

অসীম কি বলতে গিয়ে থেমে গেল। মেয়েটা রীতিমতো বুদ্ধিমতী। ছেলেবেলা থেকেই সংসারের ভার নিয়েছে, কোনোমতে টেনেটুনে চালিয়েছে সংসারের বোঝাটা। এখন জ্ঞান বেড়েছে, চারিপাশে চোখ খুলে দেখছে। দেখেছে জীবনের অনেক বন্ধুর-পথ। 

প্রশ্ন করে অসীম, 

—তুমি ও-খবর কোথায় পেলে? 

হাসে বাসন্তী—তা, কিছুটা বোঝা যায় বৈকি। 

বুঝতে সে পেরেছে, এই বস্তির মাঝে যাদের দেখেছে বাসন্তী, অসীম তাদের থেকে স্বতন্ত্র। এখানে এদের চোখের চাহনিতে যে জ্বালা ফুটে ওঠে, অসীমের মধ্যে তা দেখেনি। ওর ব্যবহার ও মার্জিত। 

ঠিক সব কথা সে না বললেও বাসন্তী কিছুটা অনুমান করে নিয়েছে ওর সম্বন্ধে 

অসীম চুপ করে হ্যান্ডেল ভাঙা চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে থাকে। কি ভাবছে ও? বোধহয় বাঁচার পথই ভাবছে ও। 

.

জীবনবাবু বাজারে বের হয়েছে। 

ক্রমেই গোনা দিন শেষ হয়ে আসছে, সেই সঙ্গে কলসির জলও ফুরিয়ে আসছে। সামান্য কিছু টাকা, তাতে ক’দিনই বা চলবে। তাই নিঃশেষে ফুরিয়ে আসবার আগে থেকেই ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়। 

ক’দিন পর থেকেই চারিদিক থেকে পাওনাদারের দল তাকে ছেঁকে ধরবে। মুদির দোকানে বাকি, বাজারে এখানে-ওখানেও হাওলাত—জিনিস কেনা বাবদ বাকি, এ সবই আছে। সর্বোপরি আছে দুর্দান্ত আগা সাহেব। সব ভাবনাই শুরু হয় জীবনবাবুর। 

বাজারের মুখেই রোজ সকালে একটা কয়লার দোকানের সামনে খাটিয়ায় বসে থাকে আগা সাহেব। মাথায় জরির দানাদার পাগড়িটা খুলে আজও বসে রয়েছে সে। জীবনবাবুকে বাজারের থলি নিয়ে ওদিকে যেতে দেখে ছোট ছোট দাঁত বের করে কলপ লাগানো বাবরি চুল নেড়ে হাসে আগা সাহেব। 

—বালো আছো এ দীবন বাবো? 

ওকে দেখে কেমন ভয় করে জীবনবাবুর। দশাসই চেহারা, কয়েকদিন পরই ওকে দেনা মিটিয়ে দিতে না পারলে ওই হাসি-গর্জনে পরিণত হবে। সেই সঙ্গে হাতের বিশাল লাঠিটাও থাকবে। 

কোনো রকমে বের হয়ে গেল জীবনবাবু। 

ইতিমধ্যেই হিসেব শুরু করেছে বাজার করতে গিয়েও। তরকারি-পত্রের দামও এ-বেলা-ওবেলা বাড়ছে। উচ্ছে তো সোনার দর। সাধ করে আর পয়সা খরচ করে তেতো খেয়ে লাভ নেই। বস্তির ধারের নিমগাছের দু’চারটে পাতা হলেই রাজ্যিসুদ্ধ তেতো হয়ে যাবে। 

তাই পাঁচসিকে সের উচ্ছে চোখে দেখাই হল। ঝিঙে, তাও বাজারে জাতে উঠে গেছে। একটাকা সের।

যেন সবাই গলা-কাটবার জন সারবন্দি হয়ে বাজারে বসে আছে। 

মাছ কিছু না হলেই নয়। তবু ছেলেটা আছে বাড়িতে, ক’দিনই-বা খাবে সে। দুনিয়ার সব মায়া-কাটিয়ে পাড়ি দেবে আর ক’দিন পরই। শেষ খাওয়া খেয়ে যাক তবু, একটু মাছ বইতো নয়। 

কিন্তু মাছের বাজারে ঢুকে জীবনবাবু থ’ মেরে যায়। 

এখানে কোনো কথা বলা, দরদস্তুর করা যেন অপরাধ! যা দর বলছে—চার টাকা-পাঁচ টাকা তাই ফেলে দিয়ে কে আগে মাছ নেবে তারই জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে, মারামারি লেগে গেছে। 

তবে একটু দেখা যাক, এই মাছ পাঁচ টাকা সের! 

এখানে কথা বলা নিরাপদ নয়। ওই ঝক্‌ঝকে বঁটিটাই হয়ত গলায় লাগিয়ে দেবে। দয়া করে তা যদি নাও দেয়, এমন কথা শোনাবে যে, তার চেয়ে ওই নিদেন ঘটানোই ছিল ভালো। খদ্দের মানে-মানে সরে পড়তে পারলে বাঁচে। 

যাহোক, কিছু নিয়ে বাড়ির দিকে পা-বাড়াবে জীবনবাবু, কিন্তু হঠাৎ ওখানেই দেখা হয়ে যায় গদাই সরকারের সঙ্গে। 

গদাই সরকার দারোয়ান নিয়ে বাজারে তোলা আদায় করতে বের হয়েছে। ওর প্রতাপ এখানে অসীম। ওই মুখরা মাছওয়ালিরা, না হয় ফড়ের দল কিন্তু একধমকে একদম ঠাণ্ডা। 

এ হেন গদাই সরকার ওকে দেখে একটু বিনয়ের সঙ্গেই কথা বলে—তারিফ করে।

—ভালো আছেন? মাছ কিনতে এসেছেন বুঝি? 

আমতা-আমতা করে জীবনবাবু, কিন্তু তখনও লোকটাকে সে বুঝতে পারেনি। কে জানে, একটু মোলায়েম করে নিয়ে, পরে তারই ঘাড়ে জব্বর কোপ মারবে কিনা! তবু দাঁত বের করে হাসবার চেষ্টা করে জীবনবাবু। 

—হ্যাঁ। দেখছিলাম। 

গদাই সরকার কি ভেবে সামনের মাছওয়ালার ওখানে রাখা একটা মস্ত রুই মাছের মুড়ো আশমানে তুলে বলে ওঠে, 

—অ’ বসন্ত, এটা নিলাম। ভালো হবে তো? 

বসন্ত একবার জ্বলজ্বল করে তাকাল মুড়োটার দিকে, আর-একবার গদাই-এর দিকে। ঢোক গিলে মিনমিনে কণ্ঠে বলে, 

—নিন, ভালোই হবে। 

গদাই সরকার মুড়োটা জীবনবাবুর থলিতে চালান করে দিয়ে বলে ওঠে, 

—নিয়ে যান এটা। পরে দেখা হবে – নমস্কার। 

গদাই সরকার দারোয়ানকে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল, জীবনবাবুও সরে এল।

তার মনটা আজ কেমন ভালোই লাগে। 

লোকটাকে হাতে রাখতে পারলে কাজে লাগবে। এতদিন ওকে ঠিকমতো চেনেনি, তাই খেলাতেও পারেনি। 

জুতসই করে খেলাতে পারলে একটু নিশ্চিন্তেই থাকবে জীবনবাবু, বাড়ি-ভাড়াও লাগবে না দু’চারমাস, তাছাড়া এটা-সেটাও মিলবে। 

তবু একটা ভরসা পাবে। 

কিন্তু গদাই সরকার লোকটাকে মহা শয়তান বলেই তার মনে হয়, ধূর্ত একটা জীববিশেষ বাসন্তীর জন্য ভাবনা হয়। 

কাল রাত্রের সেই স্বপ্নটা যদি কোনোদিন সত্য হয়, জীবনবাবু তাহলে বর্তে যাবে। বাড়ি-ঘর হবে, ওই মেয়ের বিয়ে দেবে ভালো ঘরে। নিশ্চিন্ত হবে সেও। 

এইদিকে সে ফাঁকি দেবে না। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে জীবনবাবু।

বাড়িতে ঢুকেই দেখে অসীম বেরোবার জন্য তৈরি হচ্ছে। 

জীবনবাবু একটু চমকে ওঠে, যেন শিকার হাতছাড়া হয়ে যাবে। পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, 

—কোথায় যাচ্ছো বাবা? 

অসীম একটু বের হচ্ছে। দশটার মধ্যেই একবার বের হয়ে, দু’একটা জায়গার সন্ধান করে দেখবে কাজকর্মের। বুড়োর কথায় ফিরে তাকাল। বললে, 

—একটু ঘুরে আসি। 

—চা-টা খেয়েছ? বুড়ো ব্যস্ত হয়ে উঠে হাঁক-ডাক করে। 

—ও বাসি! বলি, কোনোদিকে তোর নজর নেই। জানিস না, কতবড় রহিস লোকের ছেলে, দয়া করে তোদের বাড়িতে নুন-ভাত খাচ্ছে। আর বাবাজি বের হবে তুই চা-টা দিসনি? 

বাসন্তী রান্নাঘরে মুখ-টিপে হাসছে অসীমের দিকে তাকিয়ে। 

বাবার গর্জন শুনে বলে ওঠে, 

—দিয়েছি বাবা। 

জীবনবাবু এঁটো কাপ আর শুকনো প্লেটটা দেখে বলে, 

—শুধু চা! হালুয়া কই? নিদেন দুটো মিষ্টি; তাও যে দিতে হয় জানিস না? আর জানবি কি করে? কত ভাগ্য আমাদের—রাজপুত্তুর এসেছে ভাঙা ঘরে। 

অসীম বলে ওঠে, 

—আপনি ব্যস্ত হবেন না। 

—হব না মানে? খাওয়া-দাওয়ার ত্রুটি আমি সইতে পারি না। অসীম বলে—সেসব ঠিক আছে। 

জীবনবাবুর তবু চিন্তা যায় না, বলে ওঠে, 

—দেখো, ফিরতে দেরি কোরো না যেন। 

গলা নামিয়ে এদিক-ওদিক দেখে বলে ওঠে জীবনবাবু অসীমকে, 

—কথাটা মনে আছে তো বাবাজি, তাহলে আর তিন-চারদিন বাকি! ওই সাতদিনের মাথায়—

অসীম হাসছে,—হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, ওর আর হেরফের হবে না।

জীবনবাবু খুশি হয়। বলে, 

—তা জানি। তবে—মানে, দু’একদিন আগেও ভগবানের আশীর্বাদে শুভ কাজটা চুকে গেলে ভালোই হয়। এই ধর, ট্রামে কি ডবল-ডেকার বাসের নিচে,—মানে, চাকাটা একেবারে ঢুকে গেলেই ভালো, বুঝলে না? জখম হয়ে হাত-পা কেটে যাওয়া সে একটা অভিশাপ, বুঝতে পারছ তো? 

মাথা নাড়ে অসীম বেশ সহজ ভাবেই। জবাব দেয় 

—তাতো বটেই, ওভাবে জখম হয়ে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। 

—ঠিক কথা। আর হ্যাঁ, শোনো! 

জীবনবাবু অসীমের কাছে এগিয়ে গিয়ে গলা নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, 

—এসব কথা যেন বাপু কাকপক্ষীতেও টের না পায়—তাহলে তুমি, আমি দু’জনেই একেবারে শ্রীঘরে। জানোই ত, যা সব ব্যাপার চারিদিকে ঘটছে, দশটা চোখ যেন সবকিছু সন্ধান করে ফিরছে। ওই বাসি—ও হতচ্ছাড়িও যেন টের না পায়। 

হাসে অসীম, –না, কেউ জানতে পারবে না। 

জীবনবাবু খুশিই হয়েছে। বের হয়ে গেল অসীম। 

যাক্, ব্যাপারটা ভালোয়-ভালোয় চুকে গেলেই নিশ্চিন্ত। তারপর ওসব টাকা-কড়ি ঘরে এনে একটু শান্তিতে বাঁচবার পথ দেখবে। 

দাওয়ায় বসে হুঁকোটা ধরিয়ে জুত করে টানতে থাকে জীবনবাবু। 

বাসন্তী বাজারের থলি থেকে বিরাট মাছের মুড়োটা বের করে খুশিই হয়। এতবড় মাছ এ বাড়িতে আসেনি কখনো। বলে ওঠে বাসন্তী, 

—এতবড় মাছ এনেছ কেন? 

হাসে জীবনবাবু। আসল কথাটা বলতে গিয়ে চেপে গেল কি ভেবে! বাসন্তী খুশিই হয়েছে।

হুঁকো টানতে-টানতে বলে জীবনবাবু বড়লোকি চালে, 

—পেলাম, তাই নিয়ে এলাম। 

বাসন্তী বাবাকে ক’দিন দরাজ হাতে খরচ করতে দেখে অবাক হয়েছে! 

প্রশ্ন করে,–তোমার কি হয়েছে বল দিকিন? এত খরচ করছ, পয়সাই-বা আসছে কোত্থেকে?

মাথা নাড়ে জীবনবাবু। বলে, 

—হুঁ হুঁ, জানিস না তো? যে খায় চিনি, তাঁকে জোগান চিন্তামণি। দেখ না, কটা দিন যেতে দে। জমানা বদলে দেব, বুঝলি—স্রেফ বদলে দেব। 

বাসন্তী বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর কথাবার্তার বিশেষ কোনো অর্থ খুঁজে পায় না। এত সহজে এই দিন যে-কি করে বদলাবে তাও জানে না সে। 

বাবাকে তাগাদা দেয়, 

—যাও, চান করে এসো। আমার রান্নার আর দেরি নেই। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *