২
বাড়ি ঢুকেই দেখে রাঙা পিসি বসে আছে।
দূর-সম্পর্কের আত্মীয় হয়। বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুজোর বার; প্রায় রোজই যেতে হয় ওর ওখানে। রাঙা পিসির পুজোর আয়োজন ইত্যাদি করে দিতে হয়।
রাঙা পিসি বলে ওঠে,
—কই, গেলি না? তাই নিজেই এলাম। চল বাসি।
বাসন্তী কি ভাবছে? বাবা এখনও ফেরেনি।
এদিকে রাঙা পিসিকে চটাতেও সাহস নেই তার। জানে দায়ে-অদায়ে এই পিসিই একমাত্র ভরসা। আজ রাত্রে কিছুই নেই ঘরে যে বাবা শুধু হাতে ফিরলেও তাকে কিছু খেতে দিতে পারবে।
রাঙা পিসির অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল, অন্তত তাদের থেকে। পিসিও জানে, এদের অবস্থার কথা। তাই দায়ে-অদায়ে এসে দাঁড়ায়।
বাসন্তী বলে ওঠে,
—বাবা যে এখনও ফেরেনি পিসি।
রাঙা পিসি জাবাব দেয়,
—সন্ধ্যার একটু পরেই এসে পড়বি, তাছাড়া জীবনদাও জানে আমার ওখানে যাস। দেরি হলে সেই-ই না হয় চলে যাবে, কাউকে বলে যা।
বাসন্তী তেমনি একটা ব্যবস্থা করেই বের হয়ে পড়ল রাঙা পিসির বাড়ির দিকে। মনে মনে ভরসা হয়, বাবা জানে, প্রতি বৃহস্পতিবার বাসন্তী ওখানে যায়।
.
সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
সন্ধ্যার পর এদিকের রূপ বদলে যায়। আলো একটা-আধটা মিটিমিটি জ্বলে কি জ্বলে না, এদিক-ওদিক খন্দখানা আর কচুরিপানা ভর্তি বন। ওপাশেই খালের সীমানা। বড় বড় রেইনট্রি গাছগুলো আঁধারে বিরাট ডালপাতা মেলে ঠাঁইটাকে আরও আঁধার করে রেখেছে।
গদাই সরকার মশাই-এর বাড়িটা এই দিকেই।
খালপারের একচ্ছত্র মুকুটহীন সম্রাট ওই গদাইচরণ রায়বাবুদের প্রতাপে প্রতাপশালী। সূর্যের তাপের চেয়ে বালির গরম যেমন তীব্র, ওই গদাইচরণের অবস্থাও তাই।
মুলুক জুড়ে-বস্তি, সদর রাস্তার উপর দু’দিকে দুটো প্রকাণ্ড বাজার। খাজনা-করা বাড়ি, সবকিছুর কর্তা গদাইচরণ কিন্তু বাড়িতে থাকে কেঁচোর মতো।
খাণ্ডার বউ-এর তর্জনে-গর্জনে এ-পাড়া মুখর।
গদাইচরণ যেন তাড়া খেয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে। তাড়া খাবারই কথা।
আজ বেশ-বাস তার বিচিত্র। গিন্নি আধ-বুড়ো মিনসেকে দিশি ধুতি আর আদ্দির পাঞ্জাবি পরতে দেখে একটু আশ্চর্য হয়।
—বলি যাওয়া হবে কোন ঘাটে?
গদাইচরণ চটে ওঠে—মানে? ঘাটে গেলেই কি খুশি হও? অর্থাৎ তুমি চাও যে সত্যি সত্যিই আমি ঘাটে যাই?
জগদ্ধাত্রী চটে ওঠে। লোকটার স্বভাব-চরিত্র তার জানতে বাকি নেই। কেবল লোকের সর্বনাশ করবার পথই খোঁজে, আর তেমনি বেহায়া, হ্যাংলা।
ওর কথার জবাব দেয়,
—অমন সোয়ামি থাকা না থাকা সমান।
গদাই সরকার হাঁ—করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে ওঠে,
—বটে! এতবড় কথা! জানো, এমন স্ত্রী থাকা না-থাকা আমার হাতে।
জগদ্বাত্রী কথা বাড়ায় না।
কিন্তু গজরাতে থাকে গদাইচরণ। রাগে টাকের উপর চিরুনি বোলাতে থাকে, এসব আর ভালো লাগে না।
মনে হয় তার অভাব কিছুই নেই। এই পুরনো সংসারে ওই যাঃ করে দিয়ে আবার নতুন করে মনের মতো সংসার পাতে।
আজই ও-বেলায় দেখা সতেরো নম্বর বস্তির সেই মেয়েটিকে মনে পড়ে।
জগদ্ধাত্রী চা নিয়ে এসেছে।
গদাই সরকারের পুরুষাকার যেন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
—ওতে কী হবে? ঘাটে পাঠাতে চাও এই চা খাইয়ে?
জগদ্ধাত্রীর রাগটা বেড়ে ওঠে।
চায়ের কাপটা নামিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে যাবার মুখে তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে ওঠে,
—ছেলেপুলেদের বাড়ি ফেরবার সময় হল। কথাবার্তা সমঝে কও, বুঝলে?
—বুঝেছি। সার বুঝেছি এবার।
গদাই চা-এর কাপ ফেলে রেখেই হনহনিয়ে বের হয়ে পড়ল বাইরের দিকে।
একা জগদ্ধাত্রীর দোষ নেই, গদাই সরকারও কম যায় না। তাই বোধহয় ওদের ঠোকাঠুকি থামে না।
অধৈর্য হয়ে উঠেছে গদাই সরকার।
মাঝে মাঝে মনে হয় একটা হেস্তনেস্ত করবে। তাই হনহন করে এগিয়ে চলে গদাইচরণ বড় রাস্তা ধরে।
কি মনে করে বাজারের কাছে এসে গোবিন্দ মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানের সামনে এসে সে দাঁড়াল। রায়বাবুদের প্রজা ওই গোবিন্দ।
সরকার মশায়কে দেখে গোবিন্দ আপ্যায়ন করে।
—আসুন, আসুন। ওরে অ বৃন্দাবন, বাবুকে গরম রসগোল্লা দে দিকি।
সরকার মশাইকে চটাতে চায় না ওরা। ওকে হাতে রাখলে লাভ বই লোকসান নেই।
সরকার মশাই একটু খুশিই হয়, বলে—তাই তো হে, আবার রসগোল্লা কেন?
গোবিন্দ গদগদ কণ্ঠে বলে ওঠে,
—গরম তৈরি হচ্ছিল, ভালো জিনিস নিয়ে যান কিছু।
শালপাতা দিয়ে একটা হাঁড়িতেই কিছু রসগোল্লা বেঁধে দেয় বৃন্দাবন গদাই সরকার মশাইকে।
সরকার মশাই রাস্তায় নেমে কী যেন ভাবছে।
বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে নেই এখন। জগদ্ধাত্রীর কঠিন মুখখানা মনে পড়ে, জীবনটাকে যেন সে তেতো করে দিয়েছে। কি ভেবে আনমনে এগিয়ে চলে।
এসে দাঁড়াল সতেরো নম্বর বস্তির সামনে।
টানা বস্তি। এখান-ওখানে দু’একটা আলো জ্বলছে। বস্তির সীমানার ভিতরে আলো নেই। বাবুরা ইচ্ছে করেই বাতি নেয়নি।
গদাই-ই বলেছিল—বাতির গরমে ভাড়াটেদের মেজাজ গরম হয়ে উঠবে। ওসবে কাজ নেই বাবু।
সরকারের কথাটা যেন সত্যি বলেই বোধহয়। এদিক-ওদিক দেখে–না, বিশেষ কেউ নেই।
আঁধারে একটু সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে চলে গদাই সরকার। বাড়িটা চিনতে কষ্ট হয় না তার।
অনেক আশা নিয়েই এগিয়ে যায়। এখুনি দরজা খুলে দেবে সেই মেয়েটি। কি যেন নাম, ও জিজ্ঞাসা করেনি।
তবু ভরসা করে এগিয়ে যায়।
কড়াটা নাড়তে যাবে, দেখে দরজায় তালা-বন্ধ।
কেউ নেই বাড়িতে। থমকে দাঁড়াল সরকার মশাই।
হাতে বিনি পয়সার রসগোল্লা নিয়ে এসেছিল, তবু একরাত্রি একটু ভালো খাওয়া জুটবে, খুশি হবে মেয়েটি।
কিন্তু সেসব খুশির আবেশ মাঠে মারা যায়।
বিরক্ত হয়ে ওঠে গদাই সরকার।
চলে যাবে কিনা ভাবছে। বোধহয় কাছে-পিঠে কোথাও গেছে—না হয় দোকানে গেছে, ফিরবে এখুনি। আঁধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
জলা আর কচুবন ওপাশে, এপাশে থিকথিক করছে নর্দমা। মশার রাজত্ব এখানে। একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঝাঁকবন্দি মশা এসে ওর পায়ে-হাতে কামড়াচ্ছে—দুচারটে আবার মুখ-চোখের ওপর গুনগুন সুরে উড়ে বেড়াচ্ছে।
একহাতে মিষ্টির হাঁড়ি, অন্য হাত দিয়ে এদিক-ওদিক চাপড়ে মশা তাড়াতে থাকে গদাই। সে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে জানে না।
মনে হয়, এখুনি ফিরবে ওই মেয়েটি। ওর হাসির শব্দে নির্জন-নিস্তব্ধ বস্তিটা ভরে উঠবে।
ওর সেই চিমসে বাবাটা বোধহয় এখনও ফেরেনি।
না ফিরলেই ভালো—তবু বাবার সঙ্গে দেখা করে যাবার অজুহাতেই দু’দণ্ড গল্প করতে পারে।
হঠাৎ পাশের ঘরের জানলাটা খুলে যায়। ওর সাদা জামার উপর এসে পড়ে বেশ খানিকটা পানের পিচ। কিছু বলার আগেই টিনের বেড়ার গায়ে ঝুলন্ত জানলাটা আবার বন্ধ হয়ে যায়।
কেউ না, এই ঘরের বাসিন্দারা কেউ জানে না যে, এই আঁধারে জলার ধারে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে এই বস্তির দণ্ডমুণ্ডের মালিক সেই দোর্দণ্ড-প্রতাপ গদাই সরকার মশাই। তাই ওদের দোষ কি?
যা হবার হয়ে গেছে, আদির পাঞ্জাবি একেবারে টকটকে পানের রঙে রঞ্জিত। মেজাজ চটকে যায় গদাই সরকারের।
মনে হয়, মেয়েটা এক নম্বরের বিচ্ছু।
আর তেমনি ওর বাবা। হাড়-শয়তান।
নইলে মাসের পর মাস ভাড়া না দিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে, একেবারে ধরা দেবার নাম নেই।
কখন আসে, কখন যায়, কে জানে?
পাইক-লস্কর অবধি হার মেনে গেছে। আজ গদাই এসেছিল, একটু ক্ষীণ আশা নিয়েই। তবু একটা সমঝোতা করত মেয়েটার মুখ তাকিয়েই। কিন্তু তার চেয়ে ধড়িবাজ ওই মেয়ে, আর তার বাপটা
পানের রস গায়ে মাথায় চুঁইয়ে পড়ছে। বিশ্রী লাগে। হঠাৎ দেখে, বিস্তর রোঁয়া-ওঠা একটা কুকুর কখন দাঁড়িয়ে ওরই হাতের হাঁড়ির গায়ে লেগে থাকা রসটুকু চাটছে।
এখানের সবই অমনি ওই ঘেয়ো কুকুরের মতো।
তাই বিরক্ত হয়ে গদাই হাতের মিষ্টির হাঁড়িটা ছুড়ে ফেলে দেয় নর্দমার দিকে।
কুকুরটাও লাফ দিয়ে কাদায় পড়ে ছিটকে যাওয়া রসগোল্লাগুলো পরমানন্দে খাচ্ছে।
হনহন করে বের হয়ে আসছে গদাই সরকার।
সামনেই একেবারে সাক্ষাৎ জীবনবাবুকে দেখে দাঁড়াল মুখোমুখি। রাগে সারা গা-জ্বলছে। পানের পিচে সাদা কাপড় রঞ্জিত, গায়ে নর্দমার কাদা— গদাই সরকারকে চেনা যায় না।
গলা সপ্তমে তুলে গদাই ওর সামনে এগিয়ে যায়।
—আচ্ছা লোক যা হোক মশায়?
.
জীবনবাবু তেতে-পুড়ে নাজেহাল হয়ে রাত্রে বাড়ি ফিরছে।
সারাদিন উপোস দিয়েই কেটেছে, কার মুখ দেখে যে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল কে জানে? হাঁটুর ঘা-টা জ্বালা করছে।
তার ওপর পেটের মধ্যে খিদের জ্বালায় নাড়ীতে পাক ধরেছে। এমন সময় বাড়ির কাছেই সাক্ষাৎ শমনকে দেখে দাঁড়াল সে।
জবাব দেবার কিছুই নেই।
সরকার মশাই বলে ওঠে,
—অ্যাঁ, বাক্যি বন্ধ হয়ে গেল যে! বলি বাড়িতে থাকেন ভাড়া দিতে হয় তা জানেন না? এটা কি বলে দিতে হবে?
জীবনবাবু আমতা আমতা করে,
—দিয়ে দোব।
—দোব-টোব নয়, সাফ কথা জানিয়ে গেলাম। ভাড়া না পেলে টান মেরে জিনিসপত্র ওই রাস্তায় ফেলে দোব। ধড়িবাজের গুষ্টি। ডাকলে, খোঁজ পাঠালেও দেখা পাবার জো-নেই। গা-ঢাকা দিয়ে যাবেন গুষ্টিশুদ্ধ। গদাই সরকারকে চেনোনি। আপনি যাবেন ডালে-ডালে, তো এ শর্মা যাবে পাতায়-পাতায়। কালই আসছি।
গদাই বের হয়ে গেল।
জীবনবাবু তখনও দাঁড়িয়ে আছে থ মেরে। বস্তির এপাশে-ওপাশে দু’চারজন পুরুষ আর মেয়েছেলে শুনেছে ওর কথাগুলো।
জীবনবাবু চুপ করে এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে।
সারা মন বিষিয়ে ওঠে। চারিদিক থেকে যেন ওকে দমবন্ধ করে চেপে পিষে মেরে ফেলতে চায় ওরা। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত মানুষটার সামনে রাতের নিবিড় অন্ধকারের মতো হতাশার আঁধার বুক-চাপা স্তব্ধতা নিয়ে এগিয়ে আসছে।
বাড়ি ফিরতেই ইচ্ছা হয় না জীবনবাবুর।
কে জানে, গদাই-এর মত নিষ্ঠুর লোক হয় তো বাসন্তীকেও অপমান করেছে। নিজের অপমানের জন্য তার দুঃখ নেই। দুধের মেয়ে তাকে এসব কথা বললে দুঃখ পাবে সে।
হঠাৎ কাকে আসতে দেখে দাঁড়াল জীবনবাবু
রাঙা পিসিমার বাড়ি থেকে লক্ষ্মীপুজোর পর ফিরছে বাসন্তী। হাতে একটা থালায় প্রসাদ। বাবাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে বাসন্তী।
—তুমি কতক্ষণ ফিরেছ বাবা?
জীবনবাবু সামলে নেয়। গদাই সরকার তাহলে বাসন্তীকে কিছু বলেনি। আর বাসন্তী দেখেনি কি চরম অপমান করে গেছে তাকে এই সরকার। জীবনবাবু মনে মনে একটু নিশ্চিন্ত হয়।
সামলে নিয়ে জবাব দেয়,
—এই তো ফিরছি, হাতে ওসব কী?
—রাঙা পিসিমার ওখানে গিয়েছিলাম, বারের লক্ষ্মীপুজো ছিল।
দুজনে এগিয়ে আসে বাড়ির দিকে।
সারাদিন খাওয়া-দাওয়া নেই। একটু জিরিয়ে বসেও তবু শান্তি পায় না জীবনবাবু। একটি মাত্র মেয়ে, তাকেও এতটুকু শান্তি দিতে পারে না। পড়াশোনাও করাতে পারেনি। কাপড়-চোপড়ও ভালো নেই।
বাসন্তী বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে অবাক হয়ে।
জীবনবাবুর ঘুম আসে না।
রাত কত জানে না। বস্তির ঘরে কে কাঁদছে? বোধহয় মালতীই হবে। ওর স্বামী কোনোদিন মাতাল অবস্থায় রাত করে ফেরে। একটু কথাবার্তার পরই শুরু হয় প্রহার-পর্ব।
তামাম দুনিয়াটাকে মালতীর স্বামী বিশু রক্ষিত তখন আর পরোয়া করে না।
মারধোর করে ক্লান্ত হয়ে আবার নেশার ঘোরে লুটিয়ে পড়ে। মালতীর কান্নার জের চলে তারপরও।
এখন সেও চুপ করে গেছে।
জীবনবাবু কি ভাবছে? এ ভাবনার শেষ নেই। কূল-তল নেই। অসীম দুঃখের রাত্রি—কোনো একটি তারার এতটুকু আলোর আশ্বাসও নেই তার সামনে।
কাল সকালেই আসবে গদাই সরকার। তারপরই শুরু হবে কিছু অর্থের সন্ধানে আবার সেই নিষ্ঠুর মহানগরীর পথ-পরিক্রমা। জীবনবাবু ভাবছে।
চারিদিকে ঠকাবার জন্য—দুঃখ দেবার জন্য ওঁত পেতে আছে সন্ধানী-লোকজন। ওরই ভিড়ে বেঁচে-থাকা–খুঁটেখুঁটে দু’মুঠো অন্ন-সংগ্রহের ঝকমারি থেকে সে নিশ্চিন্ত হতে চায়।
মুক্তি চায় সে এই বোঝা টানার থেকে।
বাসন্তীর কথা মনে পড়ে।
অসহায় একটি মেয়ে। জীবনবাবুর মনে হয়, দু’বেলা দুমুঠো ভাত-কাপড়ের ভরসা দেবার সঙ্গতি যার নেই, মেয়ের জন্য চিন্তা করা, তাকে ভালোবাসাও তার অপরাধ
এসব তার কিছুই থাকতে পারে না। সংসার করার, ভালোবাসা-প্রীতি-স্নেহ বিলোবার অধিকারও তার নেই।
ভোর হয়ে আসছে বোধহয়।
রাস্তার গাড়ির শব্দ তখনও ওঠেনি। বস্তির ধারে দু-একটা গাছের মাথায় পাখপাখালির ডাক শুরু হবে এইবার।
জীবনবাবু উঠে পড়ে, কোনোরকমে আস্তে দরজাটা খুলে পথে নামল। তখনও এ-পাড়ার ঘুম ভাঙেনি কারোর।
জ্বলছে দু’একটা আলো নির্জন প্রহরীর মতো।
ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলেছে জীবনবাবু। সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছে সে জনহীন ভোর রাত্রে কলকাতার পথ ধরে।
মরেও শান্তি নেই।
অনেক জ্বালা। দাহ-করবার জন্যেও নিদেন পনেরো বিশ টাকা লাগবে।
ভেবেচিন্তেই এ পথ নিয়েছে জীবনবাবু।
কোনো ভাবনা নেই, আর দাহ-করারও প্রয়োজন নেই।
পাপহারিণী গঙ্গার অতলে লাফ দিয়ে পড়ে সব জ্বালা-যন্ত্রণার শেষ করবে, এই ভেবেই এগিয়ে চলেছে রাতের আবছা অন্ধকারে।
.
হাওড়া ব্রিজের উপর এসে দাঁড়াল জীবনবাবু
জনহীন পথে পরিত্যক্ত ঠাঁই। দিনেরবেলায় যেখানে লোক ধরে না, ট্রাম-বাসের ভিড়ে তিল পা-ফেলবার ঠাঁই নেই, রাতের আঁধারে সেই জায়গাটাকে মনে হয় মৃত্যুপুরী।
এদিকে শুয়ে আছে দু’একজন, আশ্রয়হীন ভিখারিই বোধহয়।
এগিয়ে চলেছে জীবনবাবু।
বহু নিচে গঙ্গার জলধারা বয়ে চলেছে। ওরই বুকে লাফ দিয়ে পড়ে জীবনের-জ্বালা যন্ত্ৰণা থেকে মুক্তি পাবে সে। শীতল একটা অনুভূতি—দমবন্ধ হয়ে আসবে, একটি দুটি মুহূর্ত মাত্র, তারপর আবার সব অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।
এগিয়ে চলেছে জীবনবাবু। দূরে নোঙর-করা জাহাজে জ্বলছে দু’একটা আলো, হঠাৎ ব্রিজের রেলিং-এর উপর কাকে উঠতে দেখে চমকে ওঠে জীবনবাবু।
একটি তরুণ যুবক বলেই বোধহয়।
কি উদ্দেশ্যে রাতের অন্ধকারে ও ব্রিজের রেলিঙে উঠছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না। মুহূর্তের মধ্যে জীবনবাবুর মাথায় রক্ত উঠে গেছে।
দৌড়ে গিয়ে ছেলেটির হাতটা ধরে ফেলেছে জোর করে।
বলে ওঠে জীবনবাবু উত্তেজিত স্বরে,
—কী করছ এখানে? এত রাত্রে?
বাধা পেয়ে ছেলেটিও চমকে উঠেছে।
একটা মস্ত অপরাধ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে সে। একটু সামলে নিয়ে অসহায়-কণ্ঠে বলে,
—আর কোনো পথ না পেয়েই মরতে চলেছি। দোহাই আপনার ছেড়ে দিন, এ জীবন আর রাখব না।
জীবনবাবু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল।
তার মতোই জীবন-যুদ্ধে পরাজিত একটি মানুষ, সেও এসেছে রাতের আঁধারে নিজেকে শেষ করে দিতে, ঠিক ওরই মতো।
কী ভাবছে জীবনবাবু?
বেঁচে থাকা আর মরা—এই দুটোকে নিয়েও বেসাতি করা যায়? পথ পেয়ে যায় তক্ষুনি বলে ওঠে,
—মরতে চাও তুমি?
ছেলেটি জবাব দেয় কম্পিতকণ্ঠে,
—হ্যাঁ। অনেক চেষ্টা করলাম বেঁচে থাকতে। কিন্তু দেখলাম বাঁচা যাবে না, তাই সব আস্থা হারিয়ে এখানে এসেছি। মরা ছাড়া আর আমার পথ নেই, তাই মরতেই চাই।
জীবনবাবু নিজের মরার কথা ভুলে গেছে একেবারে। একটু আশাভরে বলে ওঠে,
-–বেশ মরো, কেউ বাধা দেবে না। নিশ্চিন্তে মরো, তবে সাতদিন পরেই মরো
—সাতদিন পর!
অবাক হয়েছে ছেলেটি। কি যেন পাগলের পাল্লায় পড়েছে সে।
জীবনবাবু বলে,
—হ্যাঁ, সাতটা দিন দেখতে দেখতে কেটে যাবে, তারপর মরো, কেউ কোনো বাধা দেবে না।
এত দুঃখেও হাসি পায় ছেলেটির। বলে ওঠে সে বিরক্তকণ্ঠে,
—একটা বেলা থাকবার ঠাঁই নেই, খাবার সাশ্রয় নেই। সাতটা দিন বাঁচব কী করে মশাই? থাকবই বা কোথায়? সরুন, পথ ছাড়ুন।
আজই, এই মুহূর্তেই সে জীবনের সব বোঝা থেকে নিষ্কৃতি পেতে চায়।
জীবনবাবু বলে ওঠে,
—সে ভার আমার। সাতদিন আমার ওখানে থাকবে, খাবে। ব্যস, কোনো অসুবিধা হবে না, তারপরই মরো। আর মরবেই যখন নিশ্চয় বুড়োর একটা কথা না হয় রেখেই যাও শেষবারের মতো।
ছেলেটি কি ভেবে রাজি হয়। আমতা আমতা করে,
—ঠিক আছে, চলুন। তবে হ্যাঁ, সাতদিন পর আবার কিন্তু বাধা দেবেন না।
মাথা নাড়ে জীবনবাবু,
—না বাবা, কোনো বাধা আর দোব না সেদিন। পাকা ফলের মতো টুপ করে জীবনের বোঁটা থেকে খসে পড়ো। কিছু বলব না।
.
ভোর হয়ে আসছে।
দু’একটা গাড়ি যাতায়াত করতে শুরু করেছে। রাস্তায় জল দেবার জন্য ভিস্তিরাও বের হয়ে পড়েছে—শহরের প্রাণচাঞ্চল্য শুরু হতে আর দেরি নেই।
ওরা দুজনে এগিয়ে আসছে নিজের মহল্লার দিকে।
অনেকটা পথ, ট্রাম-বাস এখনও চলতে শুরু হয়নি। হেঁটেই ফিরছে তারা।
পথে আসতে আসতেই আলাপ জমে ওঠে, ছেলেটির নাম অসীম। জীবনবাবু বলে ওঠে,
—গরিবের বাড়ি, একটু অসুবিধা হবে হয় তো। তবে আমার বাসন্তী খুব ভালো মেয়ে, মাঝে মাঝে ক্যাটক্যাট কথা বলে, কিন্তু বুঝলে খুব লক্ষ্মী মেয়ে।
অসীম ওই বুড়োর দিকে অবাক হয়ে দেখছে মাঝে মাঝে। ওর কথাবার্তাগুলো কেমন যেন বিচিত্র ঠেকে। চেনা নেই, জানা নেই, একটা হতভাগাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখবার কি এমন দরকার পড়ল ঠিক বুঝতে পারে না সে।
জিজ্ঞাসা করে অসীম জীবনবাবুকে,
—আপনি এত রাত্রে হাওড়া ব্রিজে কেন এসেছিলেন?
জীবনবাবু একটু হকচকিয়ে যায়। কে জানে ছেলেটা তার মনের সেই গোপন কথাটাই জেনে ফেলেছে কিনা। সহজ ভাবেই জবাব দেয়,
—মানে, একটু হাওয়া খেতে আর কি। গঙ্গার হাওয়া—বুঝলে, সারা কলকাতার বাতাস পলুটেড—বিষাক্ত হয়ে গেছে। তাই মাঝে মাঝে হাওয়া খেতে আসি।
মাথা নাড়ে অসীম—তা সত্যি!
জীবনবাবু ওকে সঙ্গে করে বড় রাস্তা ছেড়ে ওদের বস্তির দিকে এগোল।
অসীম এই পরিবেশ ঠিক চেনে না। ছোট ছোট টিনের খুপরি একটানা ঘরের ভিড়। কলের সামনে ইতিমধ্যেই প্রাত্যহিক সংকীর্তন শুরু হয়েছে নানা ভাষায়। বেশ রোদ উঠেছে চারিদিকে।
কেমন বিচিত্র লাগে তার। এগিয়ে চলে সে জীবনবাবুর সঙ্গে।
.
ভোরবেলাতেই ঘুম ভাঙে বাসন্তীর।
উঠে দেখে বাবা বাড়িতে নেই। এঘর-বারান্দা—কলতলা-বাবা কোথাও নেই। এদিক-ওদিক খুঁজেও পায় না তাকে।
হয় তো সকাল বেলাতেই কোথায় চায়ের দোকানে গেছে খবরের কাগজ পড়বার জন্য, ফিরে আসবে এখুনি।
নিজের কাজ-কর্ম সারতে থাকে সে।
হাত-মুখ ধুয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তখনও বাবা ফেরেনি।
মনে মনে একটু রাগ হয় বাসন্তীর। না বলে কোথাও বের হয় না বাবা, সাত-সকালে গেল কোথায়?
হঠাৎ কড়া-নাড়ার শব্দে এগিয়ে যায়, বেশ দু’কথা শুনিয়ে দেবে সে বাবাকে।
কড়া নেড়ে চলেছে বাইরে থেকে।
বাসন্তী দরজার কাছে গিয়ে অভিমান-ভরে বলে ওঠে,
—দরজা খুলব না, কোথায় চলে গেলে না বলে, খুব যা হোক?
গদাই সরকার এসেছে সাত-সকালেই। বাজার করতে এসেছিল পাশের বাজারে। পয়সাকড়ি বিশেষ লাগে না তার। জমিদারবাবুর বাজার, সরকার মশাই কেড়ে-কুড়েই বাজার করে, মাছটাও জোটে এমনিই।
বাজার সেরে ফিরতি মুখে একবার ঢুঁ মেরে যেতে মন হয় তার।
কাল রাতে কথাটা জানিয়ে গেছে জীবনবাবুকে। আজ একবার শাসিয়ে যাবে মেয়ের সামনে।
মেয়েও দেখুক, কত হোমরা-চোমরা ওই সরকার মশাই। তাই সমীহ করে চলবে তাকে। তাছাড়া সরকার মশাই-এর কেমন যেন চোখ পড়ে গেছে মেয়েটার উপর।
.
এই ভেবেই এসেছে সে এ-বাড়িতে।
কড়া-নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি অভিমান-ভরা স্বরে বাসন্তীর ওই কথাগুলো শুনে খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠে গদাইচরণ।
গোঁফটা বিড়ালের গোঁফের মতো ফুলে ওঠে খুশিতে।
তাহলে কাল রাতে আসার খবরটা জেনেছে ওই মেয়েটি এবং না জানিয়ে চলে যাওয়াতে ও অভিমান করেছে।
নামটা শুনেছে গদাইচরণ কালই সেই মেয়েটির মুখে—বাসন্তী।
বেশ মিষ্টি নাম, ওর চেহারার মতোই মিষ্টি।
দরজাটা খুলতেই ওকে দেখে চমকে ওঠে বাসন্তী। অজ্ঞাতেই জিভটা বের হয়ে যায়। একটু সামলে বলে ওঠে সে,
—আপনি!
গদাই সরকার ঠেলে তখন রকের উপরই উঠেছে প্রায়।
বলে ওঠে—ওত লজ্জা পাবার কী আছে? আমাকে লজ্জা করো না, আমাকে আবার লজ্জা কিসের?
নিজেই হাসতে থাকে সরকার মশাই।
বাসন্তী ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
লোকটা বেশ জুত করে দাওয়ায় ইতিমধ্যেই চেপে বসেছে। ওঠার নাম নেই।
বাসন্তী লোকটাকে দেখেছে মাঝে মাঝে পথে-বাজারে, সকলকেই যেন ধমকাচ্ছে আর শাসাচ্ছে। এ হেন দোর্দণ্ড-প্রতাপশালী একটি জীবকে কেঁচোর মতো নরম হয়ে যেতে দেখে মনে মনে মজাও অনুভব করে। বলে ওঠে বাসন্তী,
—বাবা তো বাড়িতে নেই।
থাকবে না তা জানত গদাই। ওরা থাকে না, পাওনাদার এড়াবার জন্য ওরা গা-ঢাকা দেবেই। তা দিক গে। সুযোগ বুঝেই এসেছে গদাই সরকার।
গদাই সরকার জাল ফেলতে জানে। একটা বিড়ি ধরিয়ে টান দিয়ে চলেছে। আগে থেকেই বলে ওঠে,
—আচ্ছা পরেই না হয় আসব। তা শোনো বাসন্তী, মাছটা দিয়ে দিল বাজারে জোর করে। এত মাছ নিয়ে কী করব? ভাবলাম, তোমাকে দিয়েই যাই, রাখো এটা।
থলি থেকে একটা বেশ নধর ভেটকি মাছ বের করে নামাল রকে।
তারপর বলে চলেছে গদাই,
—বেশ তাজা ভেড়ির মাছ, দেখবে কেমন স্বাদ হয়। সেই সঙ্গে নতুন ফুলকপিটা রইল। বুঝলে, বাজারে কিছু নিতে চাই না, আরে বাবু এসব প্রবৃত্তি আমার নেই, তা ওরা ছাড়ে কই? আচ্ছা, উঠি তাহলে।
সরকার মশাই ওঠবার জন্য গাওনা গাইতে থাকে।
যদি বাসন্তী চা-খাওয়াবার নেমতন্ন করে, তার জন্য যেন মৌকা দিচ্ছে, কিন্তু বাসন্তীর সংসারে চা-চিনিও বাড়ন্ত, সে খবর গদাই সরকার কী করে জানবে?
তবু ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, দেখছে ওকে গদাই।
বাসন্তী একনজরে ওর দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে যায়। গদাই টাকে হাত বুলিয়ে একটু মুচকি হেসে বলে ওঠে,
—চলি তা হলে, পরে আসব, বাবাকে বলো কিন্তু।
তরকারির থলিটা হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল গদাইচরণ। দরজাটা দিয়ে চাপা-হাসিতে ফেটে পড়ে বাসন্তী। সে ভেটকি মাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে, নধর একটি ভেটকি মাছ।
মাছটার চেহারার সঙ্গে এই গদাই-এর চেহারার যেন বেশ খানিকটা মিল আছে। শুধু আকৃতিই নয়, বোধহয় প্রকৃতিরও মিল আছে অনেকখানি।
হঠাৎ দরজা খুলে বাবাকে ঢুকতে দেখে ফিরে তাকাল বাসন্তী।
কিছু বলবার আগেই কাকে দেখে চুপ করে গেল বাসন্তী। জীবনবাবু একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ঢুকছে। বেশ আপ্যায়ন করে বাড়ি ঢোকাচ্ছে তাকে জীবনবাবু।
—এই যে, এসো বাবা। আর এই আমার মেয়ে বাসন্তী। ওই যে বলেছিলাম।
বাসন্তী একটু অবাক হয়ে নবাগতের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এককালে সুন্দর-সুপুরুষ চেহারাই ছিল ওর, এখন পোশাক-আশাক তেমন ভালো না হলেও খারাপ নয়।
ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকে বাসন্তী। বাবা বলে চলেছে,
—বুঝলি, এ আমাদের অসীম। আমার অনেকদিনের বন্ধু—মানে ছেলেবেলার বন্ধুর ছেলে। কলকাতা দেখতে এসেছে, তা কোথায় আর উঠবে। এইখানেই ধরে নিয়ে এলাম। সাতদিন বই তো নয়। যেমন করে হোক চলে যাবে। কী বলো অসীম?
বড়লোকের ছেলে, সেখানে রাজত্ব কর, আমি কিন্তু গরিব বাবা। দেখছ তো বাড়িঘর — লজ্জা করো না বাবা।
অসীম বাড়িতে পা-দিয়ে হতদারিদ্র্য আর দুঃখের চিহ্নগুলোকেই দেখছিল, আর শুনছিল, জীবনবাবুর ওই গলগলে মিথ্যে কথাগুলো। অবাকই হয়েছে ওকে দেখে, ওর কথাবার্তা শুনে। হয় লোকটা অতিশয় বোকা, ভালোমানুষ, না হয় একেবারে হাড়-শয়তান, দুয়ের মাঝামাঝি কোনো কিছু ও নয়।
অসীম মাথা নাড়ে বাধ্য হয়েই।
—না, না, কোনো অসুবিধাই হবে না।
জীবনবাবু বলে চলেছে—হ্যাঁ, লজ্জা করো না বাবা, ওই তোমার ঘর।
টিনের ওপাশের ছোট্ট খোপটায় নিয়ে গিয়ে ঢুকল। অসীম বসে চারিদিক দেখছে। ওদিকে একটা দড়ির আলনায়, ঝুলছে দু’একখানা সাধারণ শাড়ি, মেয়েদের জামা। একটা আয়না, তাও পিছনের পারা উঠে গিয়ে খেয়ো-খেয়ো লাগছে। বিকৃত হয়ে ওঠে নিজের মুখটাই।
বিছানা বলতে একটা নড়বড়ে তক্তপোশে একটা শতরঞ্চি পাতা। তাতেই বসে পড়ে অসীম, দাঁড়াবার আর সামর্থ্য নেই।
জীবনবাবু বের হয়ে এল ঘর থেকে ওকে বসিয়ে রেখে।
বাসন্তীর সকাল থেকে মেজাজটা ভালো নেই।
কেমন বিশ্রী লাগে। দেখেছে সরকার মশাইকে, ছিনে-জোঁকের মতো লোকটা পিছনে লাগলে ছাড়বে না। বিরক্ত করেই চলবে।
এদিকে সংসারের এই অবস্থা। নিজেরাই খেতে পায় না, বাইরে থেকে কোন এক বড়লোক বন্ধুর ছেলেকে ধরে এনে আপ্যায়ন করার কি দরকার ছিল, ঠিক বোঝে না ও। ওদের জন্য কলকাতায় অনেক হোটেল-বোর্ডিং আছে। গরিবের সংসারে এসে ভার-বাড়ানো কেন? ওরাই বা কেমন! আর তেমনি তার বাবা।
বাবার বে-হিসেবি কাজে চটে উঠেছে বাসন্তী।
জীবনবাবু বাইরে এসে দেখে, দাওয়ায়—চুপ করে বসে আছে বাসন্তী।
ফিসফিসিয়ে ওঠে জীবনবাবু।
—উনুনে আগুন-টাগুন দে, একটু, চা, জলখাবার—
বাসন্তীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। বাবাকে সে সইতে পারে, কিন্তু অচেনা একটা ছেলে, ওকে বাড়িতে এনে তোলবার কি থাকতে পারে জানে না?
বাবার কথায় ফোঁস করে ওঠে বাসন্তী।
—টাকা-পয়সা কিছু আছে যে, পিণ্ডির জোগাড় হবে? আপনি ঠাঁই পায় না, শঙ্করাকে বলে এর মধ্যে শো।
তবু আজ জীবনবাবু যেন ভরসা পায়; সেই হতাশার জড়তা তার মন থেকে মুছে গেছে। একটু গলা ভিজিয়ে বলে ওঠে,
—কুছ পরোয়া নেই বাসি, তুই উনুন ধরা। হ্যাঁ, চা–কিছু গরম সিঙাড়া আনি। মানে, বড়লোকের ছেলে কিনা?
ফোঁস করে ওঠে বাসন্তী।
—বড়লোকের ছেলে তো সেইখানে গিয়েই বড়লোকি করুক গে। বস্তি বাড়িতে কেন?
জীবনবাবু মেয়েকে সামলাতে থাকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে।
—আঃ, চুপ কর বাসি। ও শুনতে পাবে যে। এই নে টাকা, আর হ্যাঁ আমি একটু ঘুরে আসছি।
জীবনবাবু একটু এগিয়ে গিয়েই ফিরে এসে গলার স্বর নামিয়ে মেয়েকে চুপিচুপি বলে,
—দেখিস, মানে, বড়লোকের ব্যাটা তো, অযত্ন-অবহেলায় যেন রাগ করে না চলে যায় আবার এখান থেকে।
বাসন্তীর রাগ তখনও পড়েনি। বলে ওঠে,
—তবে কি পায়ে ধরে দিনরাত মাথা ঠুকতে হবে?
জীবনবাবু মেয়ের উল্টো-পাল্টা কথায় অপ্রস্তুতে পড়ে। সব চাল যেন বানচাল করে দেবে মেয়েটা। বলে ওঠে জীবনবাবু,
—না, না, মানে একটু চোখে-চোখে রাখবি আর কি! আর জিভের ধারটা একটু ভোঁতা করিস। যা ট্যাকাস-ট্যাকাস কথা তোর—তাই বলছিলাম।
বাসন্তী গুম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
জীবনবাবু আজ বের হয়েছে একটু গূঢ় উদ্দেশ্য নিয়ে। অনেক ভেবে-চিন্তেই এছাড়া উপায় আর দেখেনি। মৃত-স্ত্রী দু’একখানা গহনা ছিল তা কয়েক ভরি হবে, এতদিন দুঃখ-কষ্টেও তা হাতছাড়া করেনি।
আজ সেইগুলো নিয়েই বের হয়েছে।
ওগুলো বিক্রি করে কয়েক শো’ হবে, বাকি শ’দুয়েক টাকার দরকার। আরো পাঁচশো টাকা হলেই এই কাজ হাসিল হয়ে যাবে। দি গ্রেট মাদারল্যান্ড ইসিওর কোম্পানির একটা হাজার তিরিশেক টাকার পলিসি—তার পিছনে শ’চারেক টাকা, আর শতখানেক টাকা হাতে রাখবে, ছেলেটা কদিন বাড়িতে থাকবে, তার জন্য একটু ভালোমন্দ খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আহা, শেষ দিন ক’টা খেয়ে যাক।
সাতদিন বৈ তো নয়, এই ক’দিন পরমায়ু। ততদিন একটু সুখে-আরামে থাকুক। সারাজীবন দুঃখ পেয়েছে অসীম, জীবনের শেষ দিন-ক’টা একটু আরামে কাটিয়ে যাক।
তারপরই ওর গত হবার সঙ্গে সঙ্গেই জীবনবাবুর হাতে আসবে ওর পলিসির কড়কড়ে তিরিশ হাজার টাকা। এক-দুশো নয়—তিরিশ হাজার টাকা!
ছোট্ট একটা বাড়ি করবে, মাথা গোঁজার-ঠাঁই। আর সেই সঙ্গে স্নো-আলতা-পাউডারের কারবারটাও জাঁকিয়ে নিয়ে বসবে। তখন জীবনবাবুকে পায় কে?
মনে মনে ভাবতে ভাবতে চলেছে।
জীবনবাবু স্বর্ণকারের দোকানে গিয়ে ঢুকল।
ওই গহনাগুলো এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল, আজ এই বিশেষ কাজে লেগে গেল। মনে মনে খুশিই হয়েছে জীবনবাবু।
একটি প্রদীপ জ্বেলে তার সামনে কষ্টি-পাথরে সোনার গহনা এ-পিঠ ও-পিঠ নিক্তিতে টুকরো-টুকরো সিকি আধুলি আর কয়েকটা কুঁচ চাপিয়ে স্বর্ণকার ভদ্রলোক দরদাম করতে থাকে, আর মাঝে মাঝে জীবনবাবুর ওই কাক-তাড়ানো পোশাকের দিকে তাকিয়ে দেখে আড়চোখে ওই চেহারার সঙ্গে এই সোনাটুকু। সম্পর্ক কি-কে জানে।
জীবনবাবু চুপচাপ বসে আছে।
স্মৃতি, আর কত স্পর্শ-মেশানো সেই কয়েক টুকরো গহনা আগুনের তাপে গলছে, আর ক্রমশ আকার পরিবর্তিত হয়ে সেগুলো গলিত একটি পদার্থে পরিণত হল।
জীবনবাবু তাগাদা দেয়,
— দাদা, দামটা?
স্বর্ণকার ভদ্রলোক অ্যাসিড দিয়ে সোনার খাদ মারতে মারতে বলে—হয়ে গেছে দাদা, জানেন তো ঝামেলার কথা; কার সোনা–কেনা, না টানা, তাই ওটা গলিয়েই দাম দিই। আড়ালে-আবডালে চোরা কাজ-কারবার করি না মশাই; আপনিও দেখে-শুনে নিন। দাম নিয়ে যান ওটা গলে গেলেই।
চুপ করে বসে থাকে জীবনবাবু। স্বর্ণকার ভদ্রলোক দাম কষছে।
শ’তিনেক টাকার কিছু বেশি হয়েছে, এতদিন সেগুলো তার সম্পত্তি বলেই গণ্য ছিল। আশা করেছিল জীবনবাবু বাসন্তীর বিয়েতে ওগুলো লাগবে। আজ তার থেকে বড় কাজেই লেগে যাবে ওগুলো।
ঠিকমতো জাল গুটিয়ে তুলতে পারলে সারাজীবন আর খাবার ভাবনা ভাবতে হবে না, সুতরাং জীবনবাবু আজ শেষ সম্বলই ঘুচিয়ে দিল অনায়াসেই।
টাকাগুলো ভালো করে ভিতরের পকেটে গুঁজে বেরিয়ে এল, আরও দুশো টাকার দরকার। কোথায় খাবলানো যায় তাই ভাবছে, সামনেই বাজারের ওদিকে ‘আগা সাহেব’কে দেখে দাঁড়াল।
মুখচেনা কাবুলবাসী। এ পাড়ায় তার খদ্দের, কারবারও আছে। দু’চার জনকে চেনে। তাই ভরসা করেই আজ এগিয়ে যায় জীবনবাবু ওর কাছে। ব্যবসা করেছে অনেকদিন, হোক না সে-সব লোকসানের ব্যবসা। তবু জানে, ঝুঁকি না নিলে ব্যবসা করা যায় না।
তিরিশ হাজার টাকার জন্যে দরকার হয় কিছু ঝুঁকি সে নেবে।
ওই টাকা তো হাতের মুঠোর মধ্যে এসে গেছে।
তাই ভরসা করে খাঁ-সাহেবের কাছে কথাটা পাড়ে।
—কিছু টাকার দরকার ছিল আগা সাহেব।
আগা সাহেব ওর দিকে তাকাল। সরু-মোটা গলার সুর-মেশানো কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
—কাঁহা রতা হ্যায়?
সামনের বড় বস্তিটাই দেখিয়ে দেয় জীবনবাবু। ওদের সঠিক ঠিকানা দেওয়া নিরাপদ নয়। বলে ওঠে জীবনবাবু ওই বস্তির দিকে তাকিয়ে,
—ওইখানে সাহেব।
পকেট থেকে অকারণেই নোটগুলো বের করে দেখিয়ে বেশ গোছগাছ করে রাখে জীবনবাবু, যেন বোঝাতে চায় একেবারে ফালতু আদমি নয় জীবনবাবু, তার কাছেও দু’চারশো টাকা হরবকত থাকে। বলে চলেছে বেশ গড়গড় করে জীবনবাবু।
—কাজ-কারবার আছে কিনা! দাঁও-এ মাল কিনতে পারলে কয়েক শো টাকা মুনাফা হবে। হঠাৎ তাই টাকার দরকার—বেশি নয়, শ’দুয়েক।
আগা সাহেব খাটিয়ার ছারপোকা মারছিল লাঠি দিয়ে ঠুকেঠুকে। ওর কথায় বলে ওঠে,
—আড়াই শো লিখনে হোবে। পঁচাশ টাকা আগাম সুদকে লিয়ে কাটনে হোগা! দো-শো রুপেয়া তব মিলেগা।
কথাটা শুনে আঁতকে ওঠে জীবনবাবু।
একেবারে গলাকাটার ফন্দি; ক’দিনেই ওর দু’শো টাকার জন্য দিতে হবে পঞ্চাশ টাকা খেসারত। তাও আগাম, হাতে পেয়েই কেটে নেবে। কি সাংঘাতিক কাণ্ড রে বাবা!
কিন্তু কোনো উপায় নেই। তাতেই রাজি হতে হবে জীবনবাবুকে।
—তাই দেগা আগা সাহেব।
আগাসাহেব ওর দিকে সুর্মা-পরা কুতকুতে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। ছারপোকা-মারা বোম্বা লাঠিখানি খাটিয়ার গায়ে হেলান দিয়ে রেখে আগা সাহেব আমন্ত্রণ জানায় সেই উদারা আর তারা-মেশানো গলায়।
—বৈঠিয়ে।
জীবনবাবু ভয়ে ভয়ে বসল।
বাবা বের হয়ে যেতে চুপ করে বসে থাকে বাসন্তী। একা বাড়িতে রয়েছে সে, আর ওই অচেনা একটি মানুষ। খুব ভালো করে তাকে দেখেছে, একনজর দেখেই দৃষ্টি নামিয়েছিল।
বাবার শেষ সম্বল আধুলি একটা দিয়ে সামান্য চা আর কিছু সুজি, চিনি নিয়ে এসে উনুনটা জ্বেলেছে বাসন্তী।
এ-পাড়ায় সুজি করার একটা উপলক্ষের দরকার।
কদম পিসি তক্কে তক্কে ছিল। সব দিকে তার নজর।
কড়াই-এ দালদা চাপিয়ে সুজি বানাতে বসেছে, এমন সময় কদম পিসিকে আসতে দেখেই একটু অবাক হয় বাসন্তী।
পিসি এসে জুত করে বসেছে দাওয়ায়।
কাল থেকে দেখেছে বাড়িতে রান্নাও চড়েনি, বাড়িওলার সরকার লোকজন নিয়ে এসে হানা দিয়েছে বাকি ভাড়ার তাগিদে।
বাবা তো পালিয়ে বেড়ায়, এদিকে ঘরে সুজি-ভালোমন্দের বেশ জোগান চলে। বুড়ি হরিনামের মালায় হাতঘোরান বন্ধ করে বলে ওঠে,
—তা, ওই শকুনি মিন্সে কেন আসে র্যা? ওই সরকারটা? বাড়ি ভাড়া বাকি কি কারো নাই যে, এসে হুজ্জুতি বাধাবে?
বাসন্তী চুপ করে থাকে।
বুড়িই বলে ওঠে একটু রহস্যভরা সুরে,
—সুজি হচ্ছে, মিষ্টিও দেখছি! তা, বাবাকে দেখলাম বাজারে।
বুড়ি এখুনি নানা কথা শুরু করে চেপে বসবে।
বাসন্তী বুড়িকে কি করে ওঠানো যায় তাই ভাবছে।
ঘরের ভিতর একটি ছেলে রয়েছে। হোক অচেনা, অজানা,—আর কেউ নেই এ-বাড়িতে। ব্যাপারটা বুড়ির চোখে পড়লে এখুনি নানা ডালপালা গজিয়ে তা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে।
বাসন্তী কথার জবাব না দিয়ে খুন্তি নেড়ে চলে, যেন কথাটা সে শুনতেই পায়নি। কথার পিঠে কথা বললে বুড়ি কথা বাড়িয়েই চলবে। তাই চুপ করে থাকাই ভালো।
বুড়ি গজগজ করে চলেছে,
—জল নেই, কল নেই, বিজলিও না থাকা, আর বাতাস-রোদের সঙ্গে তা ভাসুর-ভাদ্দর-বউ সম্বন্ধ, এই তো বাড়ি! তার ভাড়ার জন্য মিনসেদের চোখে ঘুম নাই। এলে এইবার দিবি শুনিয়ে গদাই সরকারকে, বিষ ঝেড়ে দিবি। বুড়ি দম নিচ্ছে কথা বন্ধ করে, তবু ওঠবার নাম নেই।
এদিকে সুজি নামিয়ে বাসন্তী চায়ের জল চাপিয়েছে।
ঘরের মধ্যে বসেছিল অসীম।
কয়েকদিন কোনদিকে কেটে গেছে জানে না। এখনও বুঝতে পারছে না, ক’দিন যেন আশ্রয় হারিয়ে, সব হারিয়ে, পথে-পথে ঘুরে জীবনের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে মরতে যাচ্ছিল, হঠাৎ সে আবার বেঁচে উঠেছে—আশ্রয়ও পেয়েছে।
হোক না বস্তির এঁদো বাড়ি, তবু মাথায় উপর একটু ছাদ আছে। দু’বেলা দুমুঠো খাওয়াও জুটবে।
ক’দিন শ্রান্তি-ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়েছিল, আজ আশ্রয় পেয়ে এখানে এসেই টানটান হয়ে শুয়ে পড়েছে। চোখ বুজে আসে।
নিবিড় উত্তেজনার পর শরীরটাও অসাড় হয়ে এসেছে।
কতক্ষণ তন্দ্রার মতো এসেছিল জানে না, চট্কা ঘুম ভাঙতেই শুনতে পায় বুড়ির ওই খনখনে গলা।
বাড়িওয়ালার কোন্ গদাই সরকারের মুণ্ডুপাত করে চলেছে। অসীম বেশ বুঝতে পারে, ও বাড়ির অবস্থা তুফানে-পড়া ফুটো নৌকার মতোই টলমল করছে, যে কোনো অসতর্ক মুহূর্তে একেবারে বানচাল হয়ে তলিয়ে যাবে। তার জীবনের সঙ্গে একটা নিবিড় মিল খুঁজে পায় সে এই পরিবেশের। তাই ভালো লাগে–
কাশি আসছে, তবু কাশতে পারে না, দেখতে পায় বাসন্তী। কী কাজে রান্না চলাকালীন এদিকে একবার এসে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যায়।
ওই বুড়ি যেন জানতে না পারে এখানে কেউ আছে।
বুড়ি তবু ওঠে না।
নাক সুড়সুড় করে অসীমের।
ছোট্ট জানলার ফাঁক দিয়ে দেখতে পায় বাসন্তীর ছট্ফটানি। বুড়ি সেই যে গল্প ফেঁদেছে তো ফেঁদেছেই। ওঠবার নাম নেই।
হাঁচিটা সামলাবার চেষ্টা করেও পারে না অসীম।
কোনো রকমে বালিশ দিয়ে মুখ বন্ধ করে হাঁচিটার শব্দ থামাবার চেষ্টা করে।
ফলে একটা বিকৃত গুরুগম্ভীর আওয়াজ ওঠে।
একটার পর আর-একটা হাঁচি আসে, শব্দটা বেড়ে ওঠে আরও।
বাসন্তী চমকে ওঠে, যেন এইবার হাতে-নাতে ধরা পড়ে যাবে।
কেলেঙ্কারির শেষ, মুখ-বিবর্ণ হয়ে যায় আতঙ্কে।
কদম বুড়ি একটু অবাক হয়ে গল্প থামায়।
হাঁচে কে লা? তোর বাবা তাহলে বাড়িতেই আছে?
কি জবাব দেবে বাসন্তী। হাঁ-না মুখ ফুটে কিছু বলে না, মাথা নাড়ে মাত্র।
কদম বুড়ির দাঁত-পড়া মুখে হাসি ফুটে বলে চলেছে,
—গদাই সরকারকে তালে জব্দ করেছিস বল? ঠিক করেছিস! ঘুরঘুর করুক বাছাধন, টাকা পাওয়া এত সোজা!
বুড়ি গা-তুলে বের হয়ে গেল একটু ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে।
জীর্ণ দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে একটু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে বাসন্তী।
মনে মনে রাগই হয়, বুড়ি যদি ধরে ফেলত! মনে হয়, এই ছেলেটার হাঁচিটা একটা বদমায়েসি। ইচ্ছে করেই বাসন্তীকে বিপদে ফেলতে তাকিয়েছিল সে।
একটা কলাই-করা থালাতে হালুয়া আর হাতল ভাঙা কাপে চা নিয়ে ঘরে ঢোকে বাসন্তী। কঠিন কণ্ঠে বলে ওঠে,
—আপনার চা।
অসীম ওর দিকে তাকাল। বাসন্তীর মনে একটা চাপা-রাগ তখনও ফুটে রয়েছে। বাসন্তী বলে ওঠে,
—বাবা চা-খাবার দিতে বলে গেলেন। আমরা গরিব। এসব খাওয়া অভ্যেস নেই আপনার, কিন্তু এখানে এর বেশি জুটছে কই?
হাসে অসীম!
এত দুঃখেও হাসি পায়। ক’দিন যে কিভাবে তার দিন কেটেছে পথে-পথে কলের জল খেয়ে, তা মেয়েটি জানে না। মিষ্টি-কচি চেহারা, চোখ দুটোয় তবু রাগের গম্ভীর ছায়া কালো মেঘের মতো নেমেছে। ওর দিকে তাকিয়ে থাকে অসীম।
ওর কথায় বলে ওঠে,
—না, না, কোনো অসুবিধেই হবে না।
হাত বাড়িয়ে প্লেটটা টেনে নিয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকে সুজিটা! বাসন্তী ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়! হাত বাড়িয়ে ইশারা করে অসীম।
একটু জল।
বাসন্তী জলের গ্লাসটা এগিয়ে দেয়। অসীম গ্লাসে মুখ লাগাবার দরকার বোধ করে না। গলার কাছে জলটা শুধু ঢেলে চলে, একটা শব্দ ওঠে। নিমেষের মধ্যে জলটা শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে।
বাসন্তীর কেমন ভালো লাগে না ওর খাওয়ার ভঙ্গিটা; চায়ের কাপটা একদম শেষ করে বলে ওঠে অসীম, ইচ্ছে করে ওকে চটাবার জন্যই।
—ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সুজিটা মন্দ নয়। তবে ঠিক হালুয়া বলতে যা বোঝায় এ তা নয়। হাতে ঘি লেগে থাকবে—
বাসন্তী চটে-ওঠে ওর মেজাজি কথাবার্তায়।
—বললাম তো গরিব লোক আমরা!
—অ! তা, মুখশুদ্ধি কিছু আছে? চা-খাবার পর মুখটা কেমন টক মেরে গেছে। বাসন্তী গুম হয়ে বাইরে গিয়ে একটা কৌটো হাতড়ে চাট্টি মৌরি এনে দেয়। অসীম মুখে পুরে চিবোতে থাকে।
এদিক-ওদিক হাতড়ে বলে ওঠে,
—সিগ্রেট!
বাসন্তী থাকতে পারে না। জবাব দেয়,
ওটা তো আমরা খাই না।
—আপনি খেতে যাবেন কেন? বাড়িতে আছে কিনা, তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম।
—না নেই।
অসীম গম্ভীরভাবে বলে ওঠে,
—না থাকলে এক প্যাকেট আনিয়ে রাখবেন দয়া করে। ক্যাপস্টেন-
বাসন্তী চায়ের কাপ আর কলাই-করা থালাটা নিয়ে বের হয়ে এল গুম হয়ে। হাসছে অসীম।
বাসন্তীর গা-জ্বালা করে ওঠে।
জীবনবাবু বাড়ি ঢুকছে, থলিতে বাজার-পত্র। একটা ঠোঙায় কিছু কচুরি আর জিলাপি। মুখে হাসির-আভা
বাসন্তী বাবাকে দু’হাতে খরচ করতে দেখে একটু অবাক হয়। কাল পর্যন্ত সংসারের কি হাল ছিল, তা বাবাও জানে। হঠাৎ ওকে দরাজ হাতে টাকা খরচ করতে দেখে একটু অবাক হয়েছে। জীবনবাবু টাকার ব্যবস্থা করে এসেছে। সব কাজ চুকিয়েও এই ক’দিন ভালোভাবে চলবার মতো টাকা থাকবে।
তারপরেই এসে যাবে মাদারল্যান্ড কোম্পানি থেকে তিরিশ হাজার টাকার চেকখানা। কড়কড়ে টাকা।
সারাজীবন আর এমনি উঞ্ছবৃত্তি করে বাঁচতে হবে না! ঘরে তার টাকা তুলে দিতে এসেছে ওই অপরিচিত ছেলেটি।
—চা-টা দিয়েছিস তো অসীমকে? নে, খাবারটা ধর। আর একটু চা কর দিকি, ভালো চা এনেছি। ওকে দে এককাপ, আমাকেও দে। তা হ্যাঁরে, কিছু বলছিল নাকি ও?
বাসন্তী ফোঁস করে ওঠে,
—গুরু-পুত্রকে তুমি সামলাও গে। বলে কি, হালুয়ায় ঘি-চপচপ করবে! আর সিগ্রেট চাই—ক্যাপস্টেন।
হাসে জীবনবাবু।
—তা আর বলবে না? ওরে, ওর বাবা বেনারসের মস্ত রহিস্ আদমি। ওরা কি যা-তা খায়! ডালের বাটিতে আঙুল চুবিয়ে দেখবে ঘিউ কতখানি আছে, তারপর খাবে কিনা ভাববে।
—তা, গরিবের বাড়িতে এসেছে কেন?
বাসন্তীর-রাগ তখনও যায়নি।
মাথা নাড়ে জীবনবাবু। বলে,
—এসেছে আমাদের পরম ভাগ্যি। আর অসীমও খুব ভালোছেলে—ওসব বিশেষ গায়ে মাখে না সে। হ্যাঁ, কি সিগ্রেট বললি?…ক্যাপস্টেন।
বুড়ো নিজেই উঠে বের হয়ে গেল গলির মুখ থেকে সিগ্রেট আনতে। বাসন্তী বাজারের থলিটা ইতিমধ্যে ঢেলেছে দাওয়ায়।
তার সঙ্গে দুটো সাবান—একটা কেশরঞ্জন তেলও রয়েছে, টুথপেস্টও এনেছে।
সেগুলো তুলে নিয়ে মুখ ভার করে বাসন্তী ছেঁড়া শাড়ির পর্দা-দেওয়া টিনের ঘরে ঢুকে একটা নড়বড়ে টেবিলের উপর নামিয়ে রাখে।
—এইগুলো রইল।
অসীম বাইরে থেকে জীবনবাবুর কথাগুলো শুনছিল। বাসন্তী যে রেগে আছে তা বেশ বুঝতে পারে সে। ওর পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে, বাসন্তী ওগুলো রাখছে টেবিলে। প্রশ্ন করে অসীম,
—কী হবে ওতে?
বাসন্তী বলে ওঠে—এ দিয়ে লোক কী করে? অবশ্য আপনাদের মতো বড়লোকের কাছে এর দাম কী?
হাসে অসীম। বলে,
—খুব রেগে আছেন দেখছি?
বাসন্তী জবাব দেয়,
—রাগ আমাদের শরীরে নেই।
হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে জীবনবাবুকে ঢুকতে দেখে অসীম উঠে বসল। জীবনবাবু বাসন্তীর চড়া-গলার আওয়াজ শুনেছে বাড়ি ঢুকেই। মেয়েটার কথাবার্তাই অমনি। দেবে বোধহয় ছেলেটাকে চটিয়ে। তাই তাড়াতাড়ি এসে হাজির হয়েছে ঘরের মধ্যেই। মেয়েকে দাবড়ে ওঠে,
—লাগিয়েছিস ঝগড়া? একদণ্ড তোকে রেখে গিয়ে স্বস্তি নেই। কাকে কি বলবি কে জানে?
বাসন্তী বলে চলে,
—আমি তো ঝগড়াটেই।
জীবনবাবু বলে ওঠে অসীমকে,
—তুমি কিছু মনে করো না। মানে, জানো তো ওর মাথাটা—
বাসন্তী বের হয়ে যাচ্ছিল, বাবা অসীমকে কি যেন ইশারা করে দেখাচ্ছে। হঠাৎ সেটা চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়িয়েছে সে। ধরা পড়ে গিয়ে জীবনবাবু অপ্রস্তুতের মতো নিজের মাথার কদম-ছাঁট চুলগুলোয় হাত বোলাতে থাকে। ব্যাপারটা নিয়ে বাসন্তী আর কথা বাড়াতে চায় না। তাই দাঁড়াল না সে, বের হয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে।
জীবনবাবু এগিয়ে আসে।
এদিক-ওদিক দেখে ব্যাগের ভিতর থেকে কাগজ-পত্র ফর্মগুলো বের করতে থাকে। অসীম ওর ব্যাপার-স্যাপার দেখে একটু বিস্মিত হয়।
—ওসব কী?
জীবনবাবুর, দাঁত-পড়া মুখে হাসির আভা ফুটে ওঠে।
—মানে, ওসব কিছুই নয়। একটা সই করে দাও, ব্যস। গলা নামিয়ে প্রশ্ন করে জীবনবাবু,
—ইংরেজি জানো?
অসীম ওর মজা দেখছে। ইসিওরের ফর্মগুলো দেখেই বুঝতে পেরেছে। ওকে মিথ্যা কথাটাই বলে।
—তেমন জানি না। লেখাপড়া শেখবার সুযোগ পেলাম কই? ছেলেবেলা থেকেই তো না খেয়ে পথে দিন কেটেছে।
জীবনবাবু ওকে থামিয়ে দেয়। কে জানে, ওই কথাগুলো যদি বাসন্তীর কানে যায়, সব প্ল্যান উল্টে যাবে। কথা না বাড়িয়ে বলে ওঠে জীবনবাবু—ঠিক আছে, বাংলাতেই সই করে দাও। এইখানে, আর এইখানে। তাহলে নিশ্চিন্ত।
অসীম তাই করতে থাকে।
দেখে নেয় কাগজগুলো ভালো করে। বেশ কয়েক হাজার টাকার লাইফ ইসিওর করাল বুড়ো তাকে, দি গ্রেট মাদারল্যান্ড কোম্পানিতে, আর সব টাকার নমিনি করে নিল নিজের নামে।
অর্থাৎ তার অবর্তমানে এই তিরিশ হাজার টাকা মবলক পাবে ওই জীবনবাবু।
বিনা বাধায় সই-সাবুদের ব্যাপার ঢুকে যেতে একটু নিশ্চিন্তবোধ করে জীবনবাবু; অনেকটা ঝামেলা মিটল তাহলে! আজই মেডিকেল রিপোর্ট জমা দিয়ে টাকা জমা করে দেবে।
—তুমি স্নান-আহার করে একটু জিরিয়ে নাও অসীম। দুপুরে যা-রোদ আর বেরিয়ো না। যাই দেখিগে, ওদিকে আবার কি হল।
বের হয়ে যায় জীবনবাবু।
অসীম সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে হাসছে আপন মনে।
ব্যাপারটা বেশ বিচিত্র ঠেকে।
মজাও লাগে মন্দ নয়।
জীবনবাবু খেয়ে-দেয়েই বের হয়ে পড়েছে খুশি মনে। অফিসে কাগজগুলো আর টাকা জমা দিতে হবে। ক’টা দিন এখন আর ভাবনা-চিন্তা নেই, খাবার-দাবার, বাজার সব করে এনেছে। এই কটা দিন আরামেই কাটবে, তারপর মবলক থোক টাকা হাতে আসবে বেশ কিছু।
তার গতি-ব্যবস্থার কথাও ভাবছে জীবনবাবু।
ফণী দালালই তাকে বলছিল কয়েকদিন আগে, লেকের ধারে কিছু জমির কথা। এককালে এদিকটা ছিল কলকাতার এঁদো অঞ্চল। লোকজনও তেমন কেউ ছিল না। চারিদিকে বস্তি, আর মেটে-খোলার বাড়ি। পানা-ভর্তি ডোবা ছড়ানো রয়েছে চারিদিকে। মাঝে মাঝে দু’একটা ভালো বাগান-বাড়িও ছিল। ফুল-ফলের গাছের চারিদিকে সুপারি গাছের বাগান।
এরপরেই শুরু হয়েছে নোনা বাদা—জলা, আর জলা। এই এঁদো অঞ্চলের রূপ হঠাৎ বদলাতে শুরু হয়েছে। শহর গড়ে উঠছে নতুন করে। মহানগরীর মেদস্ফীত কলেবর ঠেলে এগিয়ে আসছে এই এলাকার দিকে। ভেঙে পড়েছে বস্তি। বড়-বড় রাস্তার প্ল্যান-নকশা তৈরি হচ্ছে। চারিদিকে একটা নতুন রূপ।
অনেক পুরনো বাসিন্দা চলে যাচ্ছে গৃহহারা, বাস্তুহারা হয়ে। অনেক নতুন লোক আসছে। বাড়ি-গাড়ি হাঁকিয়ে তারা এই এলাকায় নয়া-বালিগঞ্জ গড়ে তুলেছে।
এদিক-ওদিকের জলা-ডোবা সব জায়গা কেটে একত্রিত করে লেক গড়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে থাকবে বাগান। সুন্দর পাহাড়ের পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। রকমারি ফুলের গাছগাছালিও পোঁতা হচ্ছে।
এই সঙ্গে শুরু হয়েছে ওখানের আশপাশের জমির বাজারেও ফটকাবাজি। যে-যা দামে পারছে জমি কিনছে, আর ছাড়ছে একগুণ-দ্বিগুণ থেকে আটগুণ দরে।
জীবনবাবু সেই মওকাই নিতে চায়!
টাকাটা পেতে আর কয়েক মাস মাত্র। এখন থেকেই জমি-জায়গা দেখে শুনে রাখতে চায় সে।
সুবিধা মতো হলে বায়না করে নেবে। এইবার আর বস্তিতে পড়ে থাকবে না। যেমন করেই হোক ভাগ্য বদলাবে। এখন থেকেই তার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে জীবনবাবু।
জীবনবাবু অফিসের কাজকর্ম-চুকিয়ে বাজারে এদিক-ওদিক ঘুরেছে দু’একটা পার্টির ওখানে। আজ হঠাৎ দিন বদলাচ্ছে বলেই মনে হয়।
এক জায়গাতেই এককথায় পাঁচ হাজারের একটা প্রপোজাল হয়ে গেল। কাগজপত্র গুটিয়ে রাস্তায় নামল জীবনবাবু।
এবার একটু চা খেতে হবে। –
মনে পড়ে, দু’দিন আগেকার সেই মনোরমা কেবিনের কথা। জুতো মারতে বাকি রেখেছিল তারা। আজ সেই অপমানের জবাব দেবে জীবনবাবু।
নেহাত সেদিন পকেটমারই হয়ে গিয়েছিল। নইলে সে ধাপ্পাবাজ নয়। এই কথাটা বুঝিয়ে দেবার জন্যই আজ ওইদিকে একটু এগিয়েই চলে, শিয়ালদা থেকে রাজাবাজারের ওপার অবধি।
দোকানদার ঝিমোচ্ছে, বৈকালের খদ্দেরদের ভিড় তখনও লাগেনি।
পাখা খুলে কারেন্ট পোড়াবার সময়ও নয়। তাই চেয়ারে বসে একটা পিজবোর্ডের টুকরো দিয়ে হাওয়া খাচ্ছে, আর ঝিমোচ্ছে দোকানদার। জীবনবাবু এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে দু’আনা পয়সা বের করে বলে ওঠে,
—পরশু বাকি ছিল, এই নিন পয়সাটা।
পয়সাটা টেবিলের ওপর নামিয়ে দিয়ে একটু কঠিন স্বরেই বলে,
—দু’আনা পয়সার জন্যে সেদিন জুতো মারতে বাকি রেখেছিলেন মশাই!
দোকানদার আমতা-আমতা করে।
—মানে, অনেকেই অমন করে স্যার, তাই ভালোমন্দ বুঝতে পারি না। থাকগে বসুন। ওরে অ’ ভজা, ভালো করে ডবল হাফ চা দে।
জীবনবাবু দাঁড়াল না।
—থাক, থাক!
বের হয়ে এল দোকান থেকে। মুখের মতো জবাব দিয়ে বের হয়ে আসতে পেরে আজ বেশ খুশি হয়েছে।
একে-একে সবাইকে সে দেখে নেবে! মুখের মতো জবাব দেবে, টাকাটা একবার হাতে এলে হয়।
ওই গদাই সরকারকেও ছেড়ে কথা কইবে না।
তবু যদি নিজের বাড়ি হতো ওর। ও কর্মচারী মাত্র, তার মেজাজই সহ্য-করা দায়। কথায় বলে না, রামের বাণ সহ্য-করা যায়, তবু হনুমানের দাঁত খামচি অসহ্য। ওই গদাইচরণের দাঁত-খামচি অসহ্য হয়ে উঠেছে জীবনবাবুর কাছে।
দেখাবে ওদের সবাইকে—তার দিনও বদলাবে।
সেই দিন-বদলের সাধ, স্বপ্নের আভাস, এখন থেকেই পাবার চেষ্টা করছে সে। তাই বস্তির মধ্যে এখন থেকে না ঢুকেই ফণী দালালের বাড়ি হয়ে দু’ একটা জায়গা দেখে যাবে লেকের ওদিকে।
এখন থেকেই ফণী দালালও জানুক, বস্তিতে পড়ে থাকলেও জীবনবাবু বস্তি-ক্লাসের লোক নয়। এখানে থাকবেও না সে চিরকালের জন্য।
বাস থেকে নেমে তাই ফণীর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তাকে সঙ্গে নিয়ে বের হবে এই মুলুকে জমির সন্ধানে। জমি কিনুক আর না কিনুক, ঘোরাঘুরি করছে এই কথাটা মনে করেই আনন্দ পায় সে।
অসীম এ-বাড়িতে এসে বেশ বুঝতে পেরেছে এদের সত্যিকার অবস্থাটা। এত অভাবের মাঝেও বাঁচতে ইচ্ছে করে বেঁচে আছে ওরা।
কাল রাতে কি একটা উত্তেজনার ঘোরে সে মরবার জন্যই হাওড়ার ব্রিজে উঠেছিল, না উঠে উপায়ও ছিল না। জীবনে এসেছিল নিদারুণ হতাশা, আর অসহায়-ভাব।
আজ সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে কয়েকটি অসহায় প্রাণীর তবু বেঁচে থাকার চেষ্টায়, অন্ধকারেও পথ চলার আশায় অসীমও মনে মনে যেন জোর পায়। মরতে গিয়েছিল কাল রাতে যে মানুষ, আজ সে মনের গহনে আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখে।
.