১
ঝকমারি আর কাকে বলে!
জীবনবাবুর কালঘাম ছুটে গেছে জীবন-জোড়া এই ঝকমারির ধাক্কা সামলাতে। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, নুন আর পান্তা কখনো একসঙ্গে জোটে না।
এই তার প্রতিদিনকার ব্যাপার।
রাগ করে মেয়ে বাসন্তীর উপরই। ধমকে ওঠে,
—কি করিস এত পয়সা? সেদিন তো দিলাম পাঁচ টাকা।
বাসন্তী কথা বলে না, বাবার দিকে চুপ করে একবার তাকাল ডাগর দু’চোখ মেলে। জীবনবাবু তখনও গজগজ করে চলেছে।
—নবাব নন্দিনী, দু’হাতে টাকা ওড়ালে আমি কোথায় পাব? টাকার গাছ আছে নাকি যে, নাড়া দিলেই ঝরঝরিয়ে পাতা ঝরার মতো টাকা ঝরবে।
বাসন্তী বাবাকে কি করে বোঝাবে যে, পাঁচ টাকা দিয়েছিল বাবা তিনদিন আগে। তার থেকেই দুজনের মতো চাল-ডাল-কয়লা-আলু সবই আনতে হয়েছে। বাকি আর কিছুই নেই তার থেকে। এ যেন পাখির বাসা, শুধু মাথা গুঁজে থাকাই যায় কোনোমতে। খাওয়ার ব্যাপারটা এখানে-ওখানে সারতে হবে। খাবার কোনো সংস্থান সেখানে থাকে না।
বাবাকে কিছু বলতে পারে সে?
জানে, বৃদ্ধ বয়সেও বাবার দুঃখ ঘোচেনি।
মা ছিল, সেও অসুখে ভুগে বিনা চিকিৎসায়, বিনা পথ্যে মরেছে ধুঁকতে ধুঁকতে। বাবা ওষুধ-পথ্য কিছুই জোগাড় করতে পারেনি।
অসহায় সংসার-বাতিল একটি মানুষ।
জীবনবাবু দাওয়ায় বসে হাঁপাচ্ছে জোর গলায় ওই কথাগুলো বলে।
বস্তি-বাড়ির একাংশ। মাঝখানে একফালি উঠোন। এককোণে একটা টিনের বেড়া দেওয়া ঘর, মাথার উপরের ছাদও ওই টিনের। পিছনের খোলা নর্দমার পাশে একটু ঠাঁই-এ কচুগাছের জঙ্গল।
জীবনবাবু আনমনে বসে একটা বিড়ি ধরাল। বিড়ি টানতে টানতে হঠাৎ জানলার বাইরে চোখ পড়তেই দেখে জীবনবাবু, বাসন্তী একটা বঁটি হাতে নর্দমার ধারে সেই কচুগাছ কাটছে।
সে জানে, আজকের তরকারির সাশ্রয় ওই বস্তুটিই।
সুন্দর মেয়েটি কিছু বলে না। বাবা বকলেও বড়জোর দু’চোখ জীর্ণ ময়লা শাড়ির আঁচলে মোছে। কি-ই বা দিতে পেরেছে তাকে জীবনবাবু? পড়াশোনা সামান্য করেছিল, পরে তাও বন্ধ হয়ে গেছে বাসন্তীর।
মেয়েকে স্কুলে পাঠাবার খরচও অনেক।
বই-খাতা তো আছেই। স্কুলের মাইনে, তারপর বাইরে বের হতে গেলে দু’চারখানা শাড়ি- জুতো তাও চাই, কি করে এসব জোগাবে জীবনবাবু, বাধ্য হয়েই তাই বাড়িতেই বসে আছে বাসন্তী।
তাকে দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের ভরসাও দিতে পারেনি জীবনবাবু। তাই নিজের উপরই ঘৃণা আসে।
বাসন্তী ইতিমধ্যে ফিরে এসেছে। দাওয়ায় নামাল-কয়েকটা কচুর শাক পাতা। জীবনবাবু উঠে পড়েছে।
বাসন্তী বলে ওঠে—বেরোবে নাকি, বাবা?
জীবনবাবু আড়ালে থেকে দেখেছে সংসারের আজকের সাশ্রয়।
একটা ছোট দালদার টিনে সামান্য কিছু তলানি চাল মাত্র পড়ে আছে। তরকারির চুপড়িতেও কিছু নেই।
জানে, বাসন্তী নিজে না খেয়েই ওই কণা ভাতই ধরে দেবে তার সামনে। জীবনবাবু সেই লজ্জা এড়াবার জন্যই বের হয়ে পড়তে চায়, তবু দু-এক জায়গায় চেষ্টা করলে যদি কিছু মেলে।
মেয়ের কথায় বলে ওঠে জীবনবাবু,
—হ্যাঁ। একটু জরুরি কাজ আছে।
বাসন্তী বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা দুপুরের রোদেই বের হচ্ছে না খেয়েদেয়েই। সারাদিন কোথায় থাকবে কে জানে? আর খাবেই বা কি?
বলে ওঠে বাসন্তী— খেয়ে-দেয়ে বেরিয়ো, এখুনি ভাত হয়ে যাবে।
জীবনবাবু বেশ জানে, বাসন্তীর আজ জুটবে না কিছু।
মেয়েটাকে বঞ্চিত করে ওই গ্রাস মুখে তুলতে বাধে তার। তাই দড়ির আলনা থেকে জীর্ণ-প্যান্ট আর কোটটা নামাতে নামাতে বলে ওঠে জীবনবাবু—দেরি হয়ে যাবে মা, আমি বরং বাইরে খেয়ে নেব। আজ জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, দেরি হলে ভদ্রলোককে পাব না। বুঝলি, বেশ অবস্থাপন্ন লোক, একেবারে সাহেব কিনা— পাংচুয়াল।
এত দুঃখেও হাসি আসে বাসন্তীর।
জীবনবাবুও সাহেব সেজেছে।
ময়লা ছোট হয়ে যাওয়া একটা প্যান্ট, পায়ের দিকটা ছোট হয়ে গেছে, সরু দেখাচ্ছে—টিং-টিং করছে। আর রঙ-ওঠা কোটটাও এইবার অবসর চাইছে। কিন্তু তবু সে তো কেরানির চাকরির বোঝা বওয়ার মতোই বছর বছর এক্সটেনশন নিয়ে পরমায়ু বাড়াবার বৃথা চেষ্টা করে চলেছে। এদিক-ওদিকে পড়েছে দু’একটা তালি।
গলায় ঝুলিয়েছে তেলচিটকেনি একটা টাই, কোন মান্ধাতার আমলের কেনা। শীর্ণ গলার কাছে টিকটিকির ছাঁটা লেজের মতো টিকটিক করে নড়ছে সেটা, ন্যাতা-কানির মতো।
তার বাবাও সাহেব সেজেছে।
যেন বেগুন-খেতের প্রহরী হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
কাঠের বেড়ার গায়ে ঝোলানো ময়লা ছেঁড়া-চামড়ার ব্যাগটা নিয়ে ক্যাম্বিসের জুতোয়-পা
গলিয়ে বের হয়ে যায় জীবনবাবু।
যাবার সময় বলে ওঠে বাসন্তীকে,
—দেরি হবে না, তুই খেয়ে-দেয়ে নিস্।
জীবনবাবু বস্তির সীমানা থেকে বের হয়ে পালাতে পারলে যেন বাঁচে।
বেলা হয়ে গেছে। কলে জল এখন নেই।
তবু সারবন্দি কলসি-বালতি পাতা রয়েছে। জল এলেই ওই বালতি-কলসির মালিকদেরও দেখা মিলবে। জায়গাটা তাদের কলরব আর চিৎকারে ভরে উঠবে।
জীবনবাবু সন্তর্পণে এগিয়ে এসে গলির মুখে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখতে থাকে। না, কেউ নেই বকেয়া পাওনার তাগাদা দেবার জন্য।
ফাঁক বুঝে বের হয়ে সোজা রাস্তা দিয়ে হনহন করে এগিয়ে চলে, শিয়ালদহের দিকে বাসগুলো চলেছে।
রোদে হাঁটতে কষ্ট হয়। জীবনবাবু ভাবছে বাসে উঠবে কিনা। তবু তো একটু আরামে যেতে পারবে। রোদের তাপে ইতিমধ্যেই রাস্তার পিচ গলতে শুরু হয়েছে। পুরনো জুতোর তলা তেতে উঠেছে। কিন্তু পকেটে হাত দিয়ে বাসে চড়ার আশা পরিত্যাগ করতে হয় তাকে। মাত্র কয়েক আনা পয়সা রয়েছে। ও-ই মাত্র সম্বল।
ওতে বাসে চড়ার সৌভাগ্য মিলবে না।
জীবনবাবু হাঁটতে থাকে রাস্তা ধরে, ওই রোদের মধ্যে শিয়ালদহের দিকে। সেখান থেকে যেতে হবে তাকে গড়পাড়ের দিকে, যদি খদ্দেরটা জোটে।
.
বাসন্তী চুপ করে বসে আছে টিনের দাওয়ায়। ওদিকে বস্তির ঘরে কার গানের সুর শোনা যায়। কে পচা মাছ কিনে এনেছে। হোক না পচা, তবু মাছ তো। তাও কেনবার সৌভাগ্য এদের মেলে না অনেকেরই।
সেই মাছের গল্পই কানে ভেসে আসে।
ও-ঘরের কদম পিসি কলতলা থেকেই শোনায়,
—মাছ একা তুই এনেছিস লা রতনবউ, তাই এত ঠ্যাকার। এই তো সেদিন একটা গোটা ইলিশ মাছ আনল পুঁটির বাবা। এই এত্তো বড়, যেমন তেল, আর তেমনি খোসবু। আমরা তো পদ্মাপেরের নই যে, ওই পচা বিটকেলি মাছ খেতে পারব—জ্যান্ত মাছ চাই আমাদের।
কে যেন বলে ওঠে—ইলিশ মাছটাও জ্যান্ত ছিল পিসি?
পিসি আর কথা বলে না।
বাসন্তী এ-সবের মধ্যে থাকে না, একদিকের কোণে তাদের ঘর। নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে সে। এঁটো থালাটা কলতলায় নিয়ে আসতে কদম পিসি বলে ওঠে,
—কি লা, খাওয়া হয়ে গেল? তা রাঁধলি কি? মাছ এয়েছিল নাকি আজ!
বাসন্তী জানে, ওরা সব খবরই রাখে। তবু যেন আসল কথাটা বলতে পারে না, বলে ওঠে, -–বাবা কাজে বের হয়ে গেছেন কিনা, তাই আজ বাজার করিনি।
কদম পিসি, ও-ঘরের মালতী তবু ওর থালার কচুশাকের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই বস্তির অনেকেরই অনেক দিনের গতি ওই কচুশাক, তাই এই দুর্দিনের কথা তাদের অজানা নেই
বাসন্তী দাঁড়াল না, কাজ সেরে চলে গেল।
মালতীর বয়স বেশি নয়, কিন্তু এরই মধ্যে ওর রূপযৌবনে এসেছে ভাঁটার টান। কয়েকটা এন্ডি-গেণ্ডি ছেলে হয়েছে বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই। তাই বাসন্তীর যৌবন-মদির দেহ, আর ওই সুগৌর রঙের উপর ওর একটা হিংসা আছেই।
বস্তির মধ্যে বাসন্তীই সুন্দরী। এক কালে ভালো অবস্থাই ছিল ওদের। ভাগ্যের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে জীবনবাবু এই মেয়েকে নিয়ে এই সতেরো নম্বর বস্তির কন্দরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
অবশ্য সে কথাটা এরা আদৌ বিশ্বাস করে না।
মালতী বলে ওঠে,
—মেয়েটার কথা শুনলে পিসি?
পিসি কি যেন দেখছে বেড়ার ফাঁক দিয়ে একমনে। মালতীর কথার জবাব দেবার সময় তার নেই। বস্তির অনেক ঘরের কাহিনিই তার জানা। এই সতেরো নম্বরের ভূষণ্ডীকাক, অক্ষয় তার পরমায়ু, আর তেমনি তাজা তার চোখ-কান। কি যেন একটা বিস্ময় আর কৌতূহল ফুটে ওঠে বুড়ির চোখে-মুখে।
মালতী বলে চলেছে,
—বুঝলা পিসি, রূপ আমারও ছিল, পাঁচখানা গাঁয়ের লোক আমার বিয়ের আসরে আমাকে দেখে বলেছিল, হ্যাঁ রূপ বটে, কন্যা ভাগ্যবতী। আমাকে রূপের দেমাক দেখায় ওই বাসন্তী। তবু বাবা যদি তেমন সোহাগে রাখত মেয়েকে! এদিকে তো দেখি, পান্টুল পরে বাইরে বের হয় বুড়ো, আর ঘরে মেয়ে গিলছে কচুপাতা সেদ্ধ।
হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দে থামল মালতী।
পিসি কি যেন দেখছে, মালতীও কথা বন্ধ করে ছিটে বেড়ার ফাঁক থেকে তাকিয়ে থাকে। সামনে উঠানের পরেই বাসন্তীদের দাওয়ার নিচে ঢোকবার দরজা, কে যেন ডাকছে।
জমিদার বাড়ির সরকার মশাই নিজে এসেছে আজ পাইক-লস্কর নিয়ে। ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করে নেয় তারা।
বকেয়া ভাড়ার তাগিদেই এসেছে গদাই সরকার।
জমিদারির দাপট এখনও এখানে রয়ে গেছে। এ অঞ্চলের চারিদিকেই ছিটানো ছোট-বড় বস্তি। মাঝে মাঝে কোঠা-দালান–বাগানও ছিটে-ফোঁটা রয়েছে। কিন্তু বিঘের পর বিঘে জুড়ে টানা বস্তি। মাঝে মাঝে দু-একটা ডোবা জঙ্গলেভরা পুকুরও মিলবে। সবই রায় বাহাদুরের জায়গা।
কোনো রকমে টিনের বেড়া, না হয় ছিটে-বেড়া দিয়ে ঘর তুলে ভাড়া বসিয়ে দিয়েছে। এ এলাকায় রায়বাবুদের দাপট এখনও সমানে রয়েছে।
ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট-এর কাজ শুরু হয়েছে। নতুন করে শহর গড়ে উঠেছে পুরনো এঁদো-পচা ডোবা বুজিয়ে—টানা-বস্তি উচ্ছেদ করে। রাস্তা হচ্ছে—কাটা হচ্ছে বিরাট লেক, তৈরি হবে পার্ক। সেইসব নতুন শহর পত্তন হচ্ছে অন্য পাশে। এখানে তাই রায়বাবুদের প্রতাপ এখনও যায়নি।
গদাই সরকার ওই রায়বাবুদের সেরেস্তার পদস্থ কর্মচারী।
কয়েক মাস ধরেই জীবনবাবুর ভাড়া বাকি পড়েছে। তাগাদার পর তাগাদা দিয়েও আদায় করতে পারেনি। দারোয়ান আসে, লস্কর আসে, তা জীবনবাবুর পাত্তাই নেই।
আজ তাই নিজে এসেছে গদাই সরকার একটা হেস্তনেস্ত করতে। ওরা বাকি ভাড়ার জন্য কোর্ট ঘরেও যায় না, মামলা-মোকদ্দমা, উচ্ছেদ, এসব করেও না। জোর করে টেনে বাইরে ফেলে দেয় মালপত্র, আবার নতুন ভাড়াটে এনে বসায়।
বড় কঠিন লোক ওই গদাই সরকার।
এখানের বাস্তঘুঘু নিজেই এসে আজ হানা দিয়েছে।
রোদে তেতে-পুড়ে এসেছে গদাই সরকার।
বাইরে কড়াটা নেড়ে চলে, ভিতরে কোনো সাড়া-শব্দ নেই। তাই মেজাজ তার সপ্তমে চড়েছে। মালতী সরকার মশাই-এর কড়ানাড়া শুনে নিজেই এগিয়ে যায়। জীর্ণ দরজাটা খোলবার মাত্র
ওর হাড়গিল্পের মতো চেহারা দেখে গর্জন করে ওঠে গদাই সরকার।
—গা ঢাকা দিয়ে কদ্দিন থাকবে জীবন এখানে। অ্যাঁ, ভাড়া দিতে হয় তা জানো না?
মালতীর সন্দেহ ঘোচে। বলে ওঠে,
—জীবনবাবুকে খুঁজছেন?
গদাই-এর বয়স হয়েছে। মাথায় টাকও পড়েছে। কড়া-রোদে টাক চিন্ চিন্ করে। বলে ওঠে,
—আজ্ঞে! যতসব ঋণে-ভারাক্রান্ত বাটপাড় জোচ্চোরকে ভাড়া বসিয়েছি, কোথায় সে?
মালতী মজাটা দেখবার জন্যেই বলে ওঠে,
—দাঁড়ান, ওর মেয়েকে ডেকে দিই।
—জীবনবাবু বাড়ি নেই?
বস্তির এদিক-ওদিকের ভাড়াটেরা অনেকেই জুটে গেছে। এমনি ঋণ শোধ না করার জন্য হুঙ্কার দাবড়ানি এখানে নতুন নয়। তবু অসময়ে এমনি তোড়জোড় দেখে তারা কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে।
মালতীর ডাকে বের হয়ে আসে বাসন্তী।
মালতী একটু দরদ-ভরা কণ্ঠেই যেন ব্যঙ্গ করেছে ওকে,
—কে ডাকছেন দেখ।
মালতীর কথায় এগিয়ে আসে বাসন্তী।
সরকার মশাই প্রথমে ওকে দেখে একটু অবাক হয়। বস্তির প্রজা তাদের অনেক। অনেক জায়গাতেই ঠ্যাঙাঠেঙি করে ভাড়া আদায় করতে হয়। মালপত্র ছুড়ে ফেলে উচ্ছেদ করে ভাড়াটেকে। তাদের চেনে, গালমন্দও দেয়, গালিগালাজও খায় গদাই সরকার।
কিন্তু বাসন্তীকে দেখেই মনে হয়, এখানকার পরিবেশে যারা বসবাস করে, ও যেন তাদের থেকে স্বতন্ত্র। সুন্দর-সুশ্রী চেহারা, মুখে! চোখে একটা শান্ত-অসহায় ভাব। ডাগর চোখ দুটো তুলে বাসন্তী তাকাল গদাই সরকারের দিকে!
—আমাদের ডাকছেন?
গদাই সরকার ফতুয়ার হাতা দিয়ে ঘনঘন টাক মুছে চলেছে।
নিজের চোখকেই কেমন যেন মন্দ ঠেকে।
অনেক লোকজন জুটে গেছে চারিপাশে, তাই আপাতত নিজের পৌরুষ বজায় রাখবার জন্যই বেশ মেজাজ দিয়ে বলে ওঠে গদাই,
—তোমার বাবাকে একবার ও-বেলায় কাছারিতে পাঠিয়ে দিও।
—আচ্ছা।
ঘাড় নাড়ে বাসন্তী।
গদাই সরকার কণ্ঠস্বর রুক্ষ করে তুলতে গিয়েও পারে না। বলে চলেছে মাঝারি-গলায়।
—বলো, সরকারমশাই এসেছিলেন। না গেলে আমাকেই আবার আসতে হবে।
বাসন্তী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
সরকার মশাই দলবল নিয়ে চলে যাচ্ছে। গলির মুখ থেকে একবার পিছন ফিরে দেখে মেয়েটাকে। দেখে, তখনও দাঁড়িয়ে আছে সে তার দিকে চেয়ে
অকারণেই গদাই সরকার টাকের চুলগুলোকে একটু চারাবার চেষ্টা করে বের হয়ে গেল।
গোঁফের কোণে ফুটে ওঠে হাসির আভা।
কি একটা মূল্যবান আবিষ্কার করে গেল সে এখানে এসে।
বাসন্তী দাঁড়িয়ে থাকে। বেশ বুঝতে পারে, বাবা ভাড়া দিতে পারেনি এই বাড়ির। তাই সরকার মশাই নিজেই এসেছিল, দু-কথা শুনিয়ে দিয়ে যেত দেখা পেলে।
তাকেও বচন শোনাত, নেহাৎ দয়া করে সেটা করেনি। তবে ভবিষ্যতে শোনাবে তাও বুঝেছে বাসন্তী।
বস্তির বাসিন্দাদের ভিড় কমে আসছে।
হতাশ হয়েছে তারা। গদাই সরকার যেন ঠিক তাদের আশা মতো তর্জন-গর্জন করেনি। মালতীও আশা করেছিল ওই ডাঁটিয়াল মেয়েটার ডাঁট কথার চোটে ভেঙে দিয়ে যাবে সরকার মশাই; কিন্তু সেসব কিছুই হল না।
মেয়েটাকে দেখেই কেমন যেন মিইয়ে গেছে সরকার মশাই। মিনমিন করে কথা বলে সরে পড়েছে। সরকারকে এত ভদ্র হতে তারা দেখেননি, পিছু ফিরতেই বাসন্তী চোখাচোখি হয়ে যায় মালতীর সাথে।
মালতী মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ায়। বলে,
—লোকজন এলে তুমিই এবার থেকে দরজা খুলে দিও বাসন্তী। কে কি তড়পাবে, শাসাবে ওসব শুনতে চাই না। ওসব আমাদের কুষ্ঠিতে লেখেনি।
বাসন্তী কথা না বলে সরে এল নিজের ঘরের দিকে।
মালতী কদম পিসিকে সামনে বলে ওঠে,
—ভাঙবে, তবু মচকাবে না। দেখলে পিসি মেয়ের দেমাক। দিত গদাই সরকার মুখে ঝামা ঘসে, ঠিক হতো। বিনা ভাড়ায় পড়ে থাকিস, খাস তো কচুপাতা সেদ্ধ ভাত, তাতেই অত দেমাক। ধরাকে সরা দেখিস।
কদম পিসি বিজেতার মতো বলে—দেখ লো, দেখবার দিন এলে ধরাকে সবাই সরা দেখে! এ আর নতুন কি!
বাসন্তী জানলায় দেওয়া শাড়ির পর্দাটা টেনে দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। ভাদ্রের দুপুর, সময় কাটে না।
মাঝে মাঝে ওর অতীতের সেই পুরনো ক’খানা বই নিয়ে লেখাপড়া করতে বসে। সেই অপেক্ষাকৃত ভালো দিনগুলোর স্মৃতি-জড়ানো রয়েছে ওই পুরনো বই-খাতার মলিন গন্ধে। বেশ ভালো লাগে নির্জন দুপুরে।
.
জীবনবাবুর বিশ্রাম নেই।
রোদে-তাতা পথে এগিয়ে চলেছে সে, মাঝে-মাঝে ট্রাম-বাসগুলো ছুটে যায়। ওই মহানগরীর ভিড়ে একটি অসহায় মানুষ চলেছে, ঘেমে উঠেছে, তবু চলার বিরাম নেই।
একটা গাছের ছায়ায় একটু দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিয়ে ভদ্রস্থ হবার চেষ্টা করে।
সারাজীবন অনেক কিছুই করেছে জীবনবাবু।
লেখাপড়া তেমন শেখবার সুযোগ পায়নি, তাঁর মন ছিল ব্যবসার দিকেই।
ব্যাবসা করে যেমন করেই হোক প্রতিষ্ঠিত হবে সে।
ট্রেনে ফেরি করেছে হাত-কাটা তেল, বজ্রভাস্কর লবণ। বাড়িতেই আলতা-সিঁদুর এইসব ম্যানুফ্যাকচার করবার চেষ্টা করেছে। টুকিটাকি কারবার চালাবার অনেক চেষ্টা করেছে, আর মার খেয়েছে, মাঝে মাঝে ইসিওরের দালালিও করেছে। অনেকদিন থেকেই ওটা লাগানো আছে। টুকটাক ওতেই যা-কিছু হয়, তাই হয় তো টিকে আছে জীবনবাবু।
কিছু লোক এখনও জীবনের মূল্য বোঝে, তাই জীবনবাবুর ইন্সিওরের দালালিটাই চলে, নইলে নিঠেকাঠা উপোসই দিতে হতো। আজ অনেক আশা নিয়েই চলেছে জীবনবাবু, গিরি গোবর্ধন দত্ত মশায়ের বাড়িতে।
হালি বড়লোক, শ্যামবাজারের খালধারে মস্ত ভূষিমালের আড়ত, তামাকের চালানি কারবারে লাল হয়ে উঠেছে লোকটা। বিশাল বাড়ি হাঁকিয়েছে, ছেলেরাও সকলে কৃতী-সন্তান।
তাদের যদি কেউ ইসিওর করে, তারই চেষ্টায় চলেছে। করলে একেবারে নিদেন দশহাজার টাকার, তার কমে ওরা কেউ কথা বলবে না।
গিরিগোবর্ধন দত্তও বেশ লেখাপড়া জানা লোক।
সুতরাং তাকে বোঝাতে বেগ পেতে হবে না এসব ব্যাপারে।
বৈকাল হয়ে আসছে।
রাস্তার ওদিকেই বাগানওয়ালা মস্ত বাড়িটা উঠেছে। ওর মধ্যে ঢোকবার আগে নিজের কাক-তাড়ানো চেহারাটা একটু ভদ্রস্থ করে নেবার জন্যই জীবনবাবু রাস্তার জলের কলে গিয়ে মাথায়-মুখে জল দিয়ে একটু সাফ-সুতরো হবার চেষ্টা করে।
পেটের ভিতর নীরব জ্বালাটা কেমন মাথা চাগাড় দিয়ে ওঠে। সকাল থেকে এককাপ চা ছাড়া আর পেটে কিছুই পড়েনি। চোঁ-চোঁ করছে নাড়ীগুলো একসঙ্গে।
এদিক-ওদিকে তাকিয়ে দেখে, কেউ নেই। বড় বাড়ি থেকেও কেউ তার দিকে তাকিয়ে নেই। শুধু কলের জল খেয়েই দিন কাটাচ্ছে সাহেব, এই পরম সত্যটা কেউ দেখবার জন্য বসে নেই।
এই সুযোগে কলে মুখ লাগিয়ে বেশ খানিকটা জল গিলে একটু ধাতস্থ হল জীবনবাবু।
হাজার হোক কলের জল। সোডিয়াম, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন—আরও অনেক এমন সব পদার্থ আছে, শরীরের পক্ষে যা পুষ্টিকর। তাই বোধহয় পেটে একটু ভর পেয়ে জীবনবাবু এগিয়ে যায় বড় বাড়িটার দিকে। হাতের ব্যাগটা বগলদাবা করে গিয়ে উঠল মার্বেল পাথর বসানো বারান্দায়।
.
ওদিকেই বাগান। ছোট গ্রিলের ঘেরা দেওয়া মাটিতে জল পেয়ে সবুজ মোলায়েম ঘাস গজিয়েছে। মাঝে মাঝে ফুলের গাছগুলো মাটির গুণে আর যত্নে ফুলে ভরে রয়েছে।
ঘরের ভিতর ভারিক্কি গোছের এক ভদ্রলোক বসেছিলেন। জীবনবাবুকে দেখে বলে ওঠেন—কী চাই আপনার?
জীবনবাবু ওই বাজখাঁই গলার শব্দ শুনে একটু চমকে উঠেছে।
শশব্যস্তে সামনে গিয়ে নমস্কার করে।
ভদ্রলোকের মুখে-চোখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না।
একবার মুখ তুলে চাইলেন মাত্র।
বৈকালের চা-পর্ব সারছেন তিনি। সে সত্যিই একটা পর্ব। বিরাট দশাসই চেহারার পক্ষে ওই পর্ব সমাধা করা স্বাভাবিক ঘটনাই।
একটা প্লেটে খানকয়েক বিস্কুট—দুটো বেশ বিরাট সাইজের সুগোল পুরুষ্ট মর্তমান কলা, আর প্লেটে গোটাকতক বেশ নধর সাইজের তালশাঁস সন্দেশ, পাশে একটি টি-পটে চা।
জীবনবাবু একবার ওঁর দিকে, একবার ওই প্লেটগুলোর দিকে তাকায়। চকিতের মধ্যে নিজের অবস্থাটা মনে পড়ে। পেটের ভিতর একটা চাঞ্চল্যকর অনুভূতি জাগে। সামলে নিয়ে গিরি গোবর্ধনবাবুর দিকে এগিয়ে যায়। একটু থেমে ব্যাগ থেকে কাগজপত্র বের করে বলে ওঠে,
আপনারা দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন বিবেচক মানুষ….
কথা শুনে ভদ্রলোক চামচ দিয়ে কায়দা করে একটা সন্দেশের টুকরো ধরে বিশাল মুখগহ্বরে ঢুকিয়ে ওর দিকে তাকালেন।
মুখের চাপে জলভরা তালশাঁস সন্দেশ থেকে পাতলা ক্ষীর বের হয়ে মুখ দিয়ে গড়াচ্ছে।
জীবনবাবু বলে ওঠে,
—মানে তাই বলছিলাম লাইফ ইন্সিওর করার কথা। এমনিতে বেশি খরচও নয়; অবশ্য আগে করেছেন নিশ্চয়, তবু দু’একটা যদি আর কাউকে দিয়ে করাতেন।
ভদ্রলোক ততক্ষণে সন্দেশের বিশাল টুকরোটাকে অনেকখানি কায়দা করে ফেলেছেন। একটু ধাতস্ত হয়ে বলেন,
—পলিসি!
জীবনবাবু ওঁর কথায় একটু ভরসা পায়। এইবার বোধহয় বসতে বলবেন উনি ওই দামি সোফাটায়, হয়তো সন্দেশ আর চা-ও অফার করবেন।
তার জিভের গায়ে একটা মোলায়েম মিষ্টির অনুভূতি জাগে।
একটু কোমলকণ্ঠে জীবনবাবু মাথা নাড়ে।
—আজ্ঞে হ্যাঁ, স্যার! দি গ্রেট মাদারল্যান্ড ইনসিওর কোম্পানির নাম শুনেছেন নিশ্চয়, বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান—
ভদ্রলোক কথা না বলে আধসেরি কাঁসার-গ্লাসটা থেকে বেশ খানিকটা জল গলায় ঢেলে একটা অতর্কিত আওয়াজ বের করেন।
গল-ল্…গড়র-র…
জীবনবাবু ততক্ষণে বই আর কাগজপত্র বের করেছে, ভরসা করে এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে বসতে যাবে, গিরিগোবর্ধনবাবু জল খেয়ে একটা বোমা ফাটার মত ঢেঁকুর তুলে বলে ওঠেন,
—আপনি এখন আসতে পারেন।
একেবারে সাফ জবাব।
জীবনবাবুর হাত থেকে ভাতের গ্রাসটা যেন কে ছিনিয়ে নিচ্ছে। আর্তনাদ করে ওঠে বৃদ্ধ কাতরস্বরে,
—স্যার! একটা পলিসি—
—বললাম তো, আসুন।
গিরিগোবর্ধনবাবু বজ্রস্বরে জবাব দিয়ে হাঁক পাড়েন—নিরো! নিরো!
কোথা থেকে বিরাট একটা অ্যালসেশিয়ান এসে হাজির হয়। গিরিগোবর্ধনবাবু বাড়তি সন্দেশ দুটো তার দিকে ছুড়ে দেন।
কুকুরটা অভ্যস্ত ভঙ্গিতেই সন্দেশ দুটো ধরে ফেলে মেঝেতে নামিয়ে জীবনবাবুকে দেখে একটা আওয়াজ তোলে।
ওর মনে হয়, ওই লোকটা যেন তার সন্দেশেই ভাগ বসাবে। গিরিগোবর্ধনবাবু দাবড়ে ওঠেন জীবনবাবুকে,
—বললাম তো আসুন। তা দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন সঙের মতো। কথা কানে গেল না?
কুকুরটাও মনিবের ধমকের প্রতিধ্বনি তোলে চাপা-কণ্ঠে।
জীবনবাবু বের হয়ে এসেছেন, পিছনে পিছনে এসেছে কুকুরটাও।
বাইরে এসে তার মূর্তি যেন ফেটে পড়ে।
বড়লোকের বাড়ির আদরের কুকুর। গলার আওয়াজে বাতাস ভরে ওঠে।
পিছনে কুকুরটা গর্জন করে আসছে।
গ্রিলের সুন্দর ফটকটাও বন্ধ।
পিছনে তেড়ে আসছে মারমুখী ওই কুকুর, কামড়েই ধরবে বোধহয়। প্রাণের ভয়েই তরতরিয়ে ফটকের উপর উঠে পড়েছে জীবনবাবু, নিচে কুকুরটা গর্জন করছে তখনও, হাঁচড়-পাঁচড় শুরু করেছে।
কোনো রকমে টপকে এপাশে নামতে পারলে রক্ষা। এপাশে নেমেছে, হঠাৎ গেটটা খুলে যায় তক্ষুনি। কুকুরটাও এবার বের হয়ে আসবে বোধহয়।
জীবনবাবু এপাশে নেমে পড়ে দৌড়োতে থাকে।
রাস্তায় ঠিক সেইসময় একটা গাড়ি এসে পড়েছে।
বিকেলের সময় এখন। ফাঁকা রাস্তা। তাই জোরেই যাচ্ছিল গাড়িখানা। হঠাৎ সামনে জীবনবাবুকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসতে দেখে সশব্দে ব্রেক কষেছে গাড়িখানা!
নিস্তব্ধ রাস্তায় গাড়িখানার ব্রেক কষার তীব্র শব্দ ওঠে। জীবনবাবুও সামনেই সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দেখে দু’চোখ-বুজে সর্বশক্তি একত্রিত করে লাফ দিয়েছে। কেমন সব অন্ধকার ঠেকে দু’চোখের সামনে।
চোখ খুলতেই দেখে, লোকজনরা সব ছুটে এসে গেছে।
পিছনে হকচকিয়ে দেখে, সেই বাঘের মতো কুকুরটা তখনও আসছে কি না।
একটু নিশ্চিন্ত হয়, না, সেটা আসেনি আর।
বোধহয় ও-বাড়ির দারোয়ানরা তাকে দয়া করে ধরে নিয়ে গেছে।
গাড়িখানাও চলে গেছে।
পাড়ার ছেলেরা এদিক-ওদিক আড্ডা মারছিল কোনো রোয়াকে বসে, তারাই এসে জুটেছে।
তারা বলে ওঠে,—উঠতে পারবেন তো স্যার?
জীবনবাবু ততক্ষণে একটু সামলে নিয়েছে। ওরা তাকে ধরে তুলছিল।
কৃত্রিম দরদভরা-কণ্ঠে কে যেন বলে ওঠে,
—হাঁটুটা যে ছড়ে গেছে দাদা।
—ও কিছু নয়।
জীবনবাবু ওই ভিড় থেকে বের হতে পারলে বাঁচে। লেগেছেও বেশ। শুধু হাঁটুতেই নয়, পা-টাও বোধহয় মচকে গেছে। ছিঁড়ে গেছে প্যান্টে-এর পায়ের দিকটা, টাইটা কাঁধ থেকে খুলে গিয়ে ন্যাকড়ার মতো পত্পত্ করে বাতাসে উড়ছে।
জীবনবাবু কোন রকমে ছেঁড়া ব্যাগ আর কাগজপত্র নিয়ে পথ চলতে থাকে।
একটা সিঁটকে মতো ছেলে বলে ওঠে,
—হেঁটে যেতে পারবেন, না রিকশা ডেকে দেব বড়দা?
জীবনবাবুর যে এত ভাই এখানে-ওখানে ছড়ানো ছিল তা জানত না। ওই পেয়ারের ভাইদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলে যেন বাঁচে, তাই আস্তে আস্তে খোঁড়া পা-নিয়েই চলতে থাকে।
ছোঁড়াগুলো আবার নারকেল গাছের নিচে বসে আড্ডা জুড়েছে।
চারিদিকে স্তব্ধতা নামে।
যেন কোনো কিছুই হয়নি।
জীবনবাবু ব্যাপারটা এতক্ষণে বুঝতে পারে। তার কদিন ধরেই একটা আশা ছিল, গিরিগোবর্ধনবাবুর বাড়িতে দু’একটা মোটা কেস পাবে। তাই অনেক আশা নিয়েই এসেছিল, কিন্তু এখানে এমনি শূন্য-হাতে আর কুকুরের তাড়া খেয়ে প্রাণ হারাতে হারাতে ফিরে যাবে কল্পনাও করেনি।
জ্বালা করছে হাঁটুটা।
ছেঁড়া টাইখানা কোনোমতে গলায় লেপটে ধুলো ঝেড়ে একটু ভদ্রস্থ হবার চেষ্টা করে বড় রাস্তার দিকে সে এগিয়ে যায়।
বেশ অনুভব করে, হাঁটবার ক্ষমতা যেন তার ফুরিয়ে আসছে।
অতর্কিত ওই উত্তেজনা আর পেটের মধ্যে নীরব খিদের জ্বালাটা তাকে নিস্তেজ করে দিয়েছে।
একটু কিছু খাওয়া দরকার। একঢোক চা হলেও চলত।
হিসেব করা পয়সা—কত আছে ব্যাগে তাও সে জানে। মাত্র ক’আনা, আর কিছু পাবার আশাও নেই কোথাও।
তবু কোনো রকমে বাড়ি ফেরার শক্তিটুকু সংগ্রহ করার জন্যই একটু চা, দুটো নোনতা বিস্কুটও খেতে হবে।
সামনেই ছোট চায়ের দোকান দেখে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে সেখানে ঢুকল জীবনবাবু।
একটা চেয়ার টেনে বসে ইশারায় দেখিয়ে দেয়— -একটু জল।
গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
দোকানে ছোঁড়াটা নেহাৎ অনিচ্ছাসত্ত্বেও একগ্লাস জল এনে দিতেই জীবনবাবু এক নিশ্বাসে জলটা খেয়ে একটু শান্ত হয়।
ছোঁড়াটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। অমন খদ্দের কি অর্ডার দেবে তা সে জানে, তবু দাঁড়িয়ে থাকে।
—এক কাপ চা। দুটো নোনতা বিস্কুট।
ছোঁড়াটা তবু অভ্যস্ত কণ্ঠে বলে,
—চপ, কাটলেট—ভালো গরম সিঙাড়া আছে।
মাথা নাড়ে জীবনবাবু,
—না, চা দাও একটু কড়া করে।
ছেলেটা ক্ষুণ্নমনে টিনের পার্টিশনের আড়ালে চলে গেল চা বানাতে।
পাড়ার মধ্যে ছোট্ট দোকান।
মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের বৈঠকখানার কাজও চলে যায় ওতে। একখানা ঘরের মধ্যে যাদের সংসার, ভাতের হাঁড়ি থেকে শুরু করে, বিছানা-বালিশ-মশারি অবধি গোটানো থাকে, তাদের ঘরে অতিথি এলে তার আপ্যায়ন করা হয় ওই মনোরমা কেবিনেই।
মনোরমা কেবিনের মালিকও তা জানে।
তাই চা বিস্কুটের বিনিময়ে ওদের জন্য একটা বাসি খবরের কাগজের ব্যবস্থাও থাকে।
দু’চারজন অনবরতই দোকান গুলজার করে রাখে।
তারা সুখ-দুঃখের গল্প করে। আড্ডা জমে।
বৈকালের আলো নিভে আসছে, নামছে সন্ধ্যার অন্ধকার।
দোকানের তাকে-রাখা গণেশের উদ্দেশে সাঁঝ-বাতি জ্বেলে নমস্কার করে দোকানদার। একটা ধুপকাঠি ধরিয়ে গণেশের পদমূলে টেবিলের উপর ঠেকাতে থাকে।
ক্যাশবাক্স বলতে এই টেবিলের ড্রয়ার। সেইখানে বারকতক ধূপকাঠিটা ঘুরিয়ে দু’হাত এক করে নমস্কার করে দোকানদার।
জীবনবাবু তখনও তাকিয়ে তাকিয়ে নোনতা বিস্কুট চিবিয়ে চলেছে, আর একঢোক করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। কেমন যেন শান্ত হয়ে আসে তার দেহ—মনের উত্তেজনা।
এরপর কি করা যায় তাই ভাবছে জীবনবাবু।
বাড়ি ফিরবে, কিন্তু কি নিয়ে ফিরবে?
উপবাস, আর উপবাস।
রাতের আঁধারের মতো নিবিড় কালো আঁধারে-ঢাকা অভাব আর উপবাসের ছায়া নামছে। রাতের আঁধার শেষ হয়ে একসময় আবার দিন হয়ে সূর্য ওঠে।
কিন্তু এই দুঃখ আর অভাবের রাত্রির যেন শেষ নেই।
এত চেষ্টা করেছে—বেঁচে থাকবার জন্য ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত বিপর্যস্ত সেই সংগ্রামময় জীবন, তবু পায়ের নিচে মাটি পায়নি।
সরে গেছে তিল-তিল করে অতল অন্ধকারের মাঝে কোনো গভীর খাদের দিকে।
দোকানে খদ্দের আসতে শুরু হয়েছে। অফিস-ফেরতা বাবুরা বাড়ি ফিরে একটু হাত-মুখে জল দিয়ে এসে হাজির হয়েছে। মাস-কাবারি বন্দোবস্ত ওদের চা আর ঘুগনির খদ্দের ওরা।
তাদের দেখে উঠে পড়েছে জীবনবাবু।
দাম দিতে এগিয়ে যায় মালিকের টেবিলের দিকে।
একটা ছোট রেকাবিতে ছড়ানো রয়েছে চাট্টি মৌরি। তাই দুটো হাতে তুলে নিয়ে চিবুচ্ছে জীবনবাবু।
মালিক হেঁকে ওঠে,
—কত হয়েছে র্যা, বাবুর?
ছোঁড়াটা জবাব দেয়—দু’আনা।
জীবনবাবু দাম দিতে গিয়ে পকেটে হাত দিয়েই কেমন যেন চমকে ওঠে। বুঝতে পারে ছোট ব্যাগটা উধাও হয়ে গেছে।
সামান্য যা-কিছু ছিল ওরই মধ্যে। তার অস্তিত্বও আর নেই।
সে রাস্তার ধারে পড়ে যেতে ছেলেগুলো কেন এত খাতির করে এসে তুলেছিল তাকে—কি সর্বনাশ করে গেছে তারা তা বুঝেছে এবার।
এদিক-ওদিক, এ পকেট ও পকেট সব হাতড়াতে থাকে জীবনবাবু ব্যস্তসমস্ত হয়ে।
দোকানদারও লক্ষ্য করেছে ওকে। ওর ওই পকেট হাতড়ানোও দেখে মন দিয়ে। ওটা যেন তার জানা কথা।
বলে ওঠে—কি স্যার, বলবেন পকেট মারা গেছে, এই তো?
জীবনবাবুর মুখে এক পোঁচ কালি কে যেন লেপে দেয়।
—সত্যি, বিশ্বাস করুন মশাই।
দোকানদার একটু গলা তুলেই জবাব দেয়,
—বিশ্বাস সবই করি মশায়। বলি, দোকানে ঢোকবার আগে পকেটটাও দেখে ঢুকলে পারেন। তা নয়, গট-মট করে ঢুকে একেবারে অর্ডার দেন কেন?
খদ্দেরাও উঠে এসেছে দু’একজন।
কে বলে ওঠে—যত্তো সব ফোরটোয়েন্টির জায়গা। এদিকে আবার সাহেব সাজা হয়েছে। বিশেকে ডাক দাও, মজা টের পাইয়ে দিক। গড়পারে ওসব রংবাজি চলবে না।
জীবনবাবু আমতা আমতা করে।
—মিছে কথা বলছি না। পকেট থেকে পার্স, কাজগপত্র সব—
—আবার পার্স! আরশুলা আবার পাখি। সাহেবের আবার পার্স। পিলিপিলি সাহেব এল রা!
দোকানময় কলরব ওঠে।
কে ধমক দেয়—জগাদা, সাহেবের ব্যাগটাই রেখে দাও।
দোকানদার জগন্নাথ জানে, ভিড়ে ঝামেলায়-লোক জুটবে মিথ্যে-মিথ্যে। দোকানের বদনাম তাছাড়া ভিড়ের মৌকায় কেউ কিছু হাতিয়ে নিয়ে যাবে, ডবল লোকসান।
তাই ভিড় কাটাবার জন্যই বলে ওঠে দোকানদার জীবনবাবুকে—যান মশাই যান। খুব হয়েছে।
জীবনবাবু আমতা-আমতা করে—দিয়ে যাব মশাই।
জগা বলে ওঠে—সবাই অমন দিয়ে যায় মশাই, তাই আপনিও দিয়ে যাবেন, আর এ শম্মাও পাবে। এখন যান দিকি!
জীবনবাবুকে শাসায় দোকানদার।
—হ্যাঁ যান, আবার এ পাড়ায় এলে টেংরি খুলে লিব, বুঝলেন। রংবাজি এ পাড়ায় চালাবেন না।
জগাদা তখনও গজগজ করছে।
—পকেট মারা গেছে! কাকের মাংস আবার কাকে খায়? ওর মারবে পকেট!
দু’আনা লোকসান যাবার দুঃখ তখনও ভোলেনি জগন্নাথ।
জীবনবাবু আবছা আলো-আঁধারির মাঝেই কোনো রকমে চলেছে, পা-টা টনটন করছে। মনের জ্বালা, আর গায়ের জ্বালা অসহ্য হয়ে ওঠে।
তবু পথ চলেছে।
.
আজ কি বার ঠিক ছিল না বাসন্তীর।
বাবা তখনও ফেরেনি। কোথায় গেছে কে জানে। সারাদিন না খেয়েই হয়তো কাজের নেশায় ঘুরছে পথে-পথে।
বিকেলের দিকে স্নান সারবার আয়োজন করে বাসন্তী।
কলের কাছে তখন এগোয় কার সাধ্য।
টিন, বালতি, কলসি নিয়ে তখন চুলোচুলি বাধবার প্রায় উপক্রম হয়েছে। শান্তিরক্ষা করবার
লোকেরও অভাব হয় না।
বস্তির পরেশ আর হাত-কাটা কালীচরণ তখন জুটে গেছে। এসব ব্যাপারে তারা বিশেষ অগ্রণী।
পরেশের অবশ্য দলবল আছে, অনেক কীর্তিই তারা করে থাকে। সদরের এদিক-ওদিকে তাই পাড়ার লোক কেন, ও চাকলার লোক অনেকেই তাদের চেনে, সমীহ করে বাধ্য হয়ে।
সেই পরেশই একে-ওকে টেনেটুনে লাইনে দাঁড় করাচ্ছে।
কালীচরণের ডানহাতটা গোটাই ছিল না। কি মহান উদ্দেশ্যে বোমা তৈরি করতে গিয়ে কি রকম বেকায়দা হয়ে বোমা হাতেই ফেটে যায় এবং খেসারত দিয়েছে ঐ হাতটা। তারপর পুলিশি কৈফিয়ত তো আছেই।
এ-হেন পরেশ আর কালীচরণ আজ বিকেলের করণীয় আর কোনো কাজ না পেয়ে সমাজসেবার কাজে লেগেছে, জলদান-পর্বে যোগ দিয়েছে।
মালতী আর কদম পিসির মধ্যে লেগেছে বচসা।
ও-বেলায় এত ভাব, আর এ-বেলাতেই কদম পিসি মালতীর স্বামীর এবং মালতীর চরিত্র নামক বস্তুটি নিয়ে প্রকাশ্য অধিবেশনে চচ্চড়ি শুরু করেছে।
মালতী কলের দখল ছাড়বার পাত্রী নয়। কদম পিসির কলসিটা টেনে ফেলে দিয়ে নিজের কলসি ভরতে শুরু করেছে।
গজগজ করে কদম পিসি,
—ঢের দেখেছি লা! ওই বলে না—
সোয়ামির চাকরি চৌকিদারি
তায় রেখেছে মোচ।
সেই গরবে মাগের গরব
ঘরে দেয় না ছোঁচ।
এত দ্যামাক কিসের লা? আমার আর জানতে বাকি নেই। সাতাশ বছর এই সতের নম্বরে আছি।
পরেশ ধমকায়,
—চুপ করো পিসি। এই লাইনে দাঁড়াও! কোলে, ওই পুঁচকেটাকে দে তো লাইন থেকে বের করে।
এমনি সময় বাসন্তী এসেছে জল নিতে
এসে দেখে জল পাবার আশা যেন বাবার পয়সা পাবার আশার মতোই মরীচিকা মাত্র। বস্তির ভিতরে যা আছে, তা গঙ্গার কলের জল।
তাতে চান করা যায় কোনোমতে, কিন্তু গায়ে গন্ধ ওঠে।
খাওয়া তো দূরের কথা।
এমন সময় পরেশই এগিয়ে আসে।
—জল চাই?
মাথা নাড়ে বাসন্তী—হ্যাঁ, চাই কিন্তু পাই কী করে?
—দেখি দাও কলসিটা।
পরেশ নিজেই ওর কলসি আর বালতি নিয়ে এগিয়ে গিয়ে মালতীর কলসিটা সরিয়ে দিয়ে বালতিটা বসিয়ে দিল।
মালতী চমকে ওঠে,
—আমার পালা?
পরেশ কোনো কথাই বলে না। সব সময় কথা বলা তার স্বভাব নয়, চুপচাপ কাজ করে যায় সে। মালতী বলছে,
—বিচার-বিবেচনা কিছুই নেই দেখছি?
কদম পিসি বলে ওঠে,
—আছে বাছা, আছে। ওরে ও পরেশ জল নেওয়া হলে আমার কলসিটা বসিয়ে দিস তো বাবা, বেলা পড়ে আসছে।
মালতী রাগে গর-গর করছে দেখে, পরেশ বালতিতে জল ভরে নিয়ে চলে গেল।
ওপাশে বাসন্তী দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতেই তুলে দিল কলসি আর বালতিটা।
কোনো রকমে জল পেতেই বাসন্তী চলে এল, আর দাঁড়াল না সেখানে। জানে, ওরা জিভ দিয়ে অকারণে গরল ছড়াতেই অভ্যস্ত। সে গরমের জ্বালা সইতে অভ্যেস করেও এখনও সয়ে ওঠা শেখেনি বাসন্তী।
.