জীবন ও সাহিত্য
সাহিত্যের শ্রেণি-বিচারে হাসি আর কান্না, এই বিভাজন বড় মোটা দাগের। সাহিত্য হল জীবন। জীবন থেকে উত্থিত। জীবন দুপায়ে চলে। এক পা হল, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, হাসি চপলতা। অন্য পা হল, দু:খ, বঞ্চনা, বেদনা, বিচ্ছেদ, মৃত্যু। আলো আর অন্ধকার এই হল জীবন। কখনও আলোছায়া। একটা দিনের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত্রি। আবার ঋতুচক্রের উপমাও আনা যায়, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ। হেমন্ত, শীত, বসন্ত। জীবন এইরকম একটা মিশ্রণ। রুল-টানা কাগজের মতো। একটু হাসি, একটু কান্না। এক ছটাক প্রেম, আধপো, বিরহ। আজ যার হাত ধরে ফুলের বাগানে বেড়াচ্ছি, কাল সে হয়তো হাত ছেড়ে চলে যাবে। সকালে যে হাহা করে হাসছে, রাতে সে হয়তো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠবে।
একটা হাসির উপন্যাস লিখুন, এমন ফরমায়েস রাখা এক অসম্ভব ব্যাপার। একটা জীবন শুধু হাসি আর হাসির মধ্য দিয়ে গোটা একটা উপন্যাসের পরিসরে হেঁটে চলেছে, তা কি কখনও হয়! অথবা, একের পর এক চরিত্র আসছে আর পাঠককে হাসিতে লুটোপুটি খাইয়ে চলে যাচ্ছে, তা কি সম্ভব! সম্ভব হলেও সে হাসি কেমন হবে! একজন মানুষকে চিৎ করে ফেলে অনন্ত কাতুকাতু দিলে, তিনি আর হাসবেন না, কাঁদবেন।
বরং বলা যেতে পারে, আপনি একটা উপন্যাস লিখুন। স্বাভাবিক জীবনের কাহিনি মানুষের বেঁচে থাকার কাহিনি। সেই সব চরিত্র আনুন, যাদের আমরা চিনি। কাহিনির জালে আমাদের জড়িয়ে ফেলুন। লেখক হল বাঁশির ফুটোর মতো। সাতটা সুরের খেলা। জীবন ফুঁ দেবে, বাঁশির ফুটো দিয়ে বাতাস বেরোবে। লেখকের মেজাজ, মনের ছাঁচের ঢালাই অনুসারে কাহিনির রূপ ফুটবে। রোমান্টিক ছিদ্র দিয়ে আসবে গোলাপি জীবন-কাহিনি, প্রেমের ধারাপাত। পোড়খাওয়া বাস্তববাদী মন মানুষের ক্ষত-বিক্ষত জীবনের কথা বলবেন। জীবনের গোটা ব্যাপারটাকে কেউ দেখবেন লাগাতার একটা তামাশা। নাথিং সিরিয়াস, অল পান। কিছুই যখন থাকবে না, কিছুই যখন যাবে না সঙ্গে, তখন এই কামড়া-কামড়ি, আঁচড়া-আঁচড়ির কী মানে! জীবনকে যারা পাগলের মতো, ভাল্লুকের মতো জড়িয়ে ধরতে চায় তারা বোকা। দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, শেক্সপিয়ার আর বার্নাডর্শ। দুজনের দুই মানসিকতা। দুজনেই একই জীবন দেখছেন। দেখার ধরন কত আলাদা। একেই বলে সাহিত্যের মেন্টাল অ্যালকেমি। শেক্সপিয়ার দার্শনিক। শ’ স্যাটায়ারিস্ট, হিউমারিস্ট। শেক্সপিয়ার দেখছেন এই ভাবে :
And so, from hour to hour we ripe and ripe
And then from hour to hour we rot and rot
And thereby hangs a tale.
অনেকটা আমাদের বৈদান্তিক শঙ্করাচার্যের মতো। জীবনকে তিনি যেভাবে পরিণতির দিকে যেতে দেখেছেন, তা হল :
অঙ্গং গলিতং পলিতং মুণ্ডুং, দর্শনবিহীনং জাতুং তুণ্ডম।
বৃদ্ধো যাতি গৃহীত্বা দণ্ডং, তদপি ন মুঞ্চত্যাশাপিণ্ডম।।
from hour to hour we ripe and ripe. এই হল জীবনের জীবনদর্শন।
দার্শনিক জন জীবনের সত্য এইভাবেই আত্মস্থ করেন; আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজনটা কোথায়। প্রাদেশিকতা, সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবোধ ও সাম্প্রাদায়িকতার গ্লানি রোধে আধ্যাত্মিক চেতনার জাগৃতির প্রয়োজন সর্বাধিক।
আধ্যাত্মিক তত্ব বা দর্শনের ব্যবহারিক প্রায়োগপন্থাই ধর্মপদবাচ্য। যা সমস্ত গতিশীলতাকে ধারণ করে রাখে, তাই হল ধর্ম। ফলে দর্শনতত্বের পরিবর্তন না থাকলেও ধর্মের অনুশাসনে যুগোপযোগী পরিবর্তন অবশ্যই ঘটতে পারে। ধর্ম কোনও অনড় পন্থা নয়। বর্হিমুখী জীবনচর্যার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অর্ন্তমুখী লক্ষ্যে চিত্তকে পরিচালিত করতে ধর্মের প্রয়োগগত সুপরিবর্তনও অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। এইটি না ঘটলে স্বাভাবিক ভাবেই সাম্প্রদায়িকতা, আচার সর্বস্বতা আদি মালিন্য ধর্মের ব্যবহারিক দিক গ্লানি ময় করে তুলতে পারে। কিন্তু সেটা আধ্যাত্মিকতার বা ধর্মতত্বের দোষ নয়। তা হল ধর্মের নামে মৌলবাদী গোঁড়ামির কুফল। বাস্তবিকই ধর্মের মূল্য কোথায়, যদি না তা মানুষকে বিবেকবাণ করে তোলে, ঐক্যবোধসম্পন্ন উদার করে তোলে, আধ্যাত্মিক চেতনায় জাগ্রত করে তোলে? শুধু নিয়মকানুন ধরে পূজা বা সভায় ধর্মের জয়গান করে ধর্মের শাশ্বত দিকটিকে ধরা যায় না। অন্তর্মুখী মূল্যবোধহীন যে ধর্ম, সে সত্যিই যার-যার ব্যক্তিগত বিলাসের ব্যাপার।
কিন্তু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী আমরা অনেকেই যান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সামনে রেখে তার নিরিখে ধর্মদর্শনকে অবহেলা করি। ভুলে যাই যে, জাতিভেদ, বর্ণভেদ, নরনারীর আধিকারভেদ, ধনবৈষম্য বা কুসংস্কারসমূহ ধর্ম নয়। নি:সন্দেহে ওগুলি যত তাড়াতাড়ি অবলুপ্ত হয়, ততই কল্যাণ। কিন্তু প্রকৃত ধর্ম অর্থাৎ জীবনের ভিত্তিতত্ব উপলব্ধির পন্থা এবং সেই সত্যবোধের আলোকে জীবনাদর্শ গঠন তো ব্যক্তিগত ব্যাপার বা বর্জনীয় বিষয় হতে পারে না। তাতে সামিল হতেই হবে প্রগতিকামী সকল মানুষকে।
যুগ যুগ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মপ্রবক্তা ও তাঁদের আন্তরিক অনুগামী সাধক-সাধিকাগণ আপন জীবন দিয়ে মানবকুলকে যে দ্বন্দ্বাতীত আত্মবোধ-সচেতন করেছেন, নির্দায় চিত্তে অখন্ড চিন্ময় প্রবাহে নিত্যলীলার যে সন্ধান দিয়েছেন, লোক কল্যাণের ব্রতে বিবর্তনের যে ধারা দেখিয়েছেন, আপাত জটিলতার অন্তরালে যে দিব্যজীবনের বার্তা ঘোষণা করেছেন, তা তো কারোর ব্যক্তিগত বিষয় নয়, তা একান্তই সর্বজনীন। তাকে অস্বীকার অবশ্যই সামাজিক অপরাধ। মানবজীবনের সার্থকতা তো পাশবিকতার প্রযত্নে নয়, এমনকী মানবিকতার সীমানায়ও নয়; সে সার্থকতা দীপ্তিমান হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিকতার অনুশীলনে ও ব্যবহারিক জীবনে তার সুষ্ঠু প্রয়োগে—সত্য-দিব্য-সুন্দর-শান্ত-পরমের আলোকে সর্বজনীন সংহতি ও সম্প্রীতির জয়যাত্রায়।
যাঁরা হিউমারিস্ট যেমন বার্নার্ড শ,’ তিনি জীবনকে দেখছেন অন্য চোখে—
Life is brief candle to me. It is a sort of splendid torch which I have got hold of for the moment and I want to make it burn as brightly as possible before handing it on to future generations.
একই জীবন, যে যেভাবে দেখবেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, জীবন একটা খেলা, ইট ইজ এ প্লে; কিন্তু, হোয়েন প্লে বিকামস এ টাস্ক, তখন খেলা আর খেলা থাকে না, মানুষ আষ্টেপৃষ্ঠে সেঁটে যায় জীবনের সঙ্গে, তখনই দু:খ। কামনা, বাসনা, লোভ সব একসঙ্গে ঘাড়ে চেপে বসে। রবীন্দ্রনাথ শাজাহানকে উদ্দেশ্য করে যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, তা এক মহাসত্যঃ কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমান। তবু, মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে। একটা দার্শনিক সত্তা নিয়ে জীবনের মধ্যে থেকে জীবনকে উপভোগ করতে চাই। লং ফেলোর মতো বলতে চাই,
Life is real! Life is earnest!
And the grave is not its goal;
Dust thou art, to dust returnest
Was not spoken of the soul.
জীবনের এই দর্শনে হাসি আছে, তামাশা আছে, পরোটার মতো পরতে পরতে। মাটির স্তরে অভ্রের ঝিলিকের মতো। আগুনের লিকলিকে শিখার মতো ক্রোধ আছে। ইলেকট্রিক ওয়্যারিং-এর শর্ট সারকিটে যেমন চিড়চিড়ে আগুন জিভ বের করে, সেই রকম আমাদের নার্ভাস সিস্টেম সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্রে জ্বলতে থাকে। মানুষের চরিত্রের অসঙ্গতি দেখে আমাদের ঠোঁটে যে হাসি ফোটে, সেটা হাসির হাসি নয়, ক্ষোভের হাসি। একটি ছেলেকে হতাশ হয়ে তার পিতা যখন বলেন, ‘ তোমার আর কিছু হবে না, ইউ আর ফিনিশড’, তখন তিনি এক ধরনের হাসি মেশাতে পারেন, সে হাসির চরিত্র হল সন্তানকে ঘিরে পিতার যে স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাওয়ার শূন্যতা। গিরিশবাবু ‘প্রফুল্ল’ নাটকের শেষ দৃশ্যে—’আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’ —বলেছিলেন হাসতে হাসতে। সে হাসি কান্নার চেয়েও ভয়ঙ্কর। সকালে বাজার থেকে বেরিয়ে এসে যখন কেউ অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বলেন, ‘বার্নল আছে?’
‘কেন, কী হল?’
‘আঙুলে ফোস্কা পড়ে গেল ভাই। আলু পটল, বেগুন, ঢেঁড়স সব যেন জ্বলন্ত কয়লার টুকরো।’
উত্তর শুনে প্রশ্নকারী হেসে উঠতে পারেন। এ হাসি আনন্দের হাসি নয়। হিউমার অফ লাইফ। সর্বাঙ্গীর এক সর্বনাশের চিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় মানুষের আত্মসমর্পণের হাসি। এই মনের যে ক্রোধ, তা বেরিয়ে আসতে পারে ‘স্যাটয়ার’ হয়ে। যেমন, কলকাতার বিকল টেলিফোন ব্যবস্থায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে, টেলিফোনের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়েছিল। তির্যক মজা। ইন্টেলেকচুয়াল প্রতিবাদ। সমস্ত পরিকাঠামো যখন ভেঙে পড়ে তখন একদল মানুষ বিক্ষোভে ভাঙচুর করে, আর একদল করেন স্যাটয়ার, জ্ঞানী হয়ে যান দার্শনিক, ফিরে তাকান ইতিহাসের দিকে, প্রবহমান মহাকালের দিকে। ক্ষমতার পদলেহন ছাড়া সাধারণের বাঁচার পথ কবেই বা খোলা ছিল! গালিব দুটি পথ দেখিয়েছেন,
‘গালিব বাজিফাখবার হো, দো শাহ কো, দু আ।
যো দিন গয়ে কি কহতে থে নৌকর নহী হুঁ মৈঁ।।’
গালিব, তুমি বেতনভোগী, বাদশাহের জয়ধ্বনি তোলো। সেদিন, গেছে, যেদিন তুমি বলতে আমি কারো চাকর নই। দাসত্ব থেকে মুক্তি কোথায়! অর্থাৎ মোসাহেবি করো। একালের ভাষায়, চামচা হয়ে যাও। ভেতরটা খুব ছোট হবে যাবে। সঙ্কীর্ণ হয়ে যাবে। আত্মপুরুষের কান্না শুনতে পাওয়া যাবে; কিন্তু উপায় নেই।
মানুষের এই অবস্থা দেখে তুলসীদাস বলছেন,
তুলসী ইয়ে সংসারমে, কাহাঁসে, ভক্তি ভেট।
তিন বাতসে লটপাট হ্যায় দামড়ি চিমড়ি পেট।।
ধন, শিশ্ন আর জঠর, এই তিন চিন্তাতেই জীবন গেল, ভক্তিভাব আসবে কোথা থেকে! তুলসীর এই দোঁহা চাবুকের মতো। এর নাম শ্লেষ। জৈব চিন্তা থাকলে দাসত্বই জীবের অনিবার্য পরিণতি। তুলসীদাস আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। বললেন,
উদর ভরণকে কারণে, প্রাণী ন করতয়ি লাজ।
নাচে বাচে রন ভিটর, বাছে না কাজ অকাজ।।
উদরের জন্যে লাজলজ্জা বিসর্জন। কেউ সভায় নাচছে, কেউ ভয়ঙ্কর নদীতে বাইচ খেলছে। কারও শরীরে বল নেই, তবু সে যুদ্ধে যাচ্ছে। কাজ অকাজের বাছবিচার নেই।
জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে জ্ঞানী মানুষের সত্য আবিষ্কার ও সেই কঠিন বাস্তবকে সাহিত্যের মোড়কে মুড়ে মানুষের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া। ভুক্তভোগী সেই দর্শন থেকে আনন্দের উপাদান খুঁজে পাচ্ছেন। নিজের অবস্থা উপলব্ধির আধ্যাত্মিক আনন্দ। এই হল মানুষের ইন্টেলেক্ট। এর পাশেই জীবনের সঙ্গে একটা রফায় আসার আনন্দ। চলে এসো দু:খ। তোমার সঙ্গে হাতমেলাই, কারণ,
সুখমে বাজ পঁড় দুখকে বলিহারি যাই।
অ্যায়সে দুখ আওয়ে যে ঘড়িঘড়ি হরিনাম সোঁরাই।।
সুখে আমার বাজ পড়ুক; কারণ সুখ আমাকে আত্মবিস্মৃত করবে। ভোগী করবে। আমার অনুভূতি ভোঁতা করে দেবে। দু:খ আসুক। দু:খই আমাকে উত্তরণের পথ দেখাবে। গালিব আর তুলসী দুজনেই একই রকম মনের অধিকারী। গালিব বলছেন,
রনজ সে খুগর হুয়া ইনসান তো মিটজাতা হৈ রনজ।
মুশকিলেঁ ইতনি পড়ঁ মুঝপর কি আসান হোগয়ী।।
দু:খে রপ্ত হলেই মানুষের আর দু:খবোধ থাকে না। ভীষণ মুশকিলে পড়েছি তাই সমাধানও মিলছে।
সাধু সেন্ট লরেন্স-এরও সেই এক কথা—দু:খ যদি তিনি দেন, দু:খ সহ্য করার শক্তিও তিনি দেবেন। ভক্ত মানুষের সাহিত্যে এক ধরনের অভিমান থাকে। নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন চলে। যেমন রামপ্রসাদ। তাঁর গীত অভিমানীর মন দিয়ে লেখা। মায়ের কাছে ছেলের অভিমান। একটি গানে লিখেছেন রামপ্রসাদ,
করুণাময়! কে বলে তোরে দয়াময়ী।
কারো দুগ্ধেতে বাতাসা, ( গো তারা)
আমার এম্নি দশা, শাকে অন্ন মেলে কৈ।।
কিছু পরেই রামপ্রসাদ হিউমারিস্ট। লিখছেন,
মা গো, আমি কি তোর পাকা খেতে দিয়েছিলাম মই।।
দ্বিজ রামপ্রসাদ বলে, আমার কপাল বুঝি অম্নিঅই।
ওমা আমার দশা দেখে বুঝি, শ্যামা হলে পাষাণময়ী।
এক পাগলের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। সেই পাগল যেদিন অনাহারে থাকত সেদিন বলত, ‘ভগবানের যেমন বরাত, ভোমলার আজ কিছুই জুটল না।’ যেমন রামপ্রসাদ লিখছেন—আমার দশা দেখে বুঝি, শ্যামা হলে পাষাণময়ী। কত প্রচ্ছন্ন বৈদান্তিক এই দেশে বিচরণ করছেন।
এত কথার সার কথা হল, আমাদের জীবনের দেশলাইয়ের সঙ্গে মনের বারুদ-কাঠির সংঘর্ষে যে আগুন জ্বলে, সে আগুন ত্যাগের, ভোগের নয়। ভোগ একটা আছে, সেটা দুর্ভোগ। এ দেশ ভোগের দেশ নয়। দু:খ, কান্না, যন্ত্রণা, বঞ্চনা, অসীম দারিদ্র, এই মাটিতেই মিশে আছে চিকচিকে চোখের জল, ফিনফিনে হাসি। মোটা দাগের হাসি নয়। সূক্ষ্ম হাসি, বিদ্রূপের হাসি। মানুষের চরিত্রের যাবতীয় অসঙ্গতিকে একটু দূর থেকে রসিকতার চাবুক মারা।
বঙ্কিম থেকে ত্রৈলোক্যনাথ, রবীন্দ্রনাথ থেকে পরশুরাম, যে ধারা প্রবাহিত হয়ে এসেছে, সে ধারার উৎস হল বাঙালির ইন্টেলেক্ট। ইংরেজের সঙ্গে মেলামেশা, ভিক্টোরিয়ান আদর্শের ছোঁয়া, ইংরেজি শিক্ষা তৈরি করেছিল একটা মানসিকতা। একদিকে ঘৃণা, একদিকে শ্রদ্ধা; স্বাজাত্যাভিমান, তার সঙ্গে হীনমন্যতা মিশে তৈরি হল মধ্যবিত্ত মেধা। একদিকে সংস্কৃত অন্যদিকে ইংরেজি, একদিকে গ্রাম্যতা, কুসংস্কার, অন্যদিকে ইংরেজের শহুরে সভ্যতা, গতি প্রগতি, মানবিকতা, উদারতা, এর মাঝে, বাঙালি কলমের যৌথ দায়িত্ব। যে দায়িত্বের একটি হল মনোরঞ্জন নয়, মনোবিশ্লেশন, মেধার ছুরি চালিয়ে নীচতা, হীনতা, কুসংস্কারের ডালপালা কর্তন। ভাগ্যবিশ্বাস থেকে পুরুষকারে বিশ্বাসী করে তোলা। এই প্রবাহে সবচেয়ে বড়—অতি প্রবল তরঙ্গ তুলেছিলেন ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন কেশবচন্দ্র, জোঁড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। গোপালের ভাঁড়ামি, অসংখ্য জমিদার মোসায়েবদের অসভ্য রসিকতার পঙ্ককুণ্ড থেকে বেরিয়ে এল—উইট, হিউমার, স্যাট্যায়ার। জোরোম কে জেরোম, ডিকেন্স, মার্ক টোয়েন, বার্নার্ড শ’, একটু পরেই পার্কিনসন, সব মিলিয়ে একটা আদল। এই ধারায় আমাদের কেদারনাথ, বিভূতিভূষণ, শিব্রাম। কিন্তু? ইদানিং? জীবন চটকে হাসি তৈরি করতে গিয়ে, তৈরি হচ্ছে শ্রাদ্ধের পিণ্ড; কারণ হাসানো যায় না, হাসি পায়, হাসি আসে।