জীবন একটা বেয়াড়া ভাল্লুক

জীবন একটা বেয়াড়া ভাল্লুক

একটি চিঠি

 ‘আশা করি কুশলে আছেন।

 আপনার স্ত্রী-বিয়োগের খবর অত্যন্ত মর্মান্তিক। এই বয়সে আবার বিবাহ করা অশোভন। পুত্র আর পুত্রবধূর ওপর নির্ভর করে যতদিন চলে। একালের ছেলে-মেয়েদের ওপর অধিক আস্থা না রাখাই ভালো। তাদের ঘাড়ে একটা বোঝার মতো পড়ে থাকা খুব লজ্জার, অস্বস্তির। তাড়াতাড়ি বিদায় হওয়ার চেষ্টা করাই ভালো। এই পৃথিবীর কাছ থেকে দামিদামি নানারকম ওষুধ ছাড়া আর কোনও প্রত্যাশা নেই। ‘সুগার’ ছাড়া আপনার আর কোনও উৎপাদন-ক্ষমতা নেই। সত্য কথা বলতে কি, আপনি এখন বোঝা। ইংরেজি শব্দটা অতি অসম্মানজনক—’বার্ডন।’

প্রথম-প্রথম কিঞ্চিৎ মুহ্যমান থাকবেন। অনেক স্মৃতি মনে ভিড় করবে। উলটেপালটে দেখতে গিয়ে লজ্জিতই হবেন। স্ত্রীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়নি। অকারণ হম্বি-তম্বি। চোখের জল। প্রেম দিতে পারেননি। ছড়ি ঘুরিয়ে স্বামীর দাবি আদায় করেছেন। এইবার বুঝবেন। জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধুর চলে যাওয়ার খাঁ খাঁ শূন্যতা।

সংসারে এইবার আপনার অবস্থা হবে লেজনাড়া কুকুরের মতো। তবু আপনি বেঁচে থাকার চেষ্টা করবেন। জীবন একটা বিশ্রী রকমের চ্যাটচেটে, স্টিকি পদার্থ। শোক বেশিদিন স্থায়ী থাকে না। সাবানের ফ্যানার মতো। জীবন-সমুদ্রের ঢেউ শোকের পদচিহ্ন নিমেষে মুছে দেবে।

তুমি কুশলে থাকার চেষ্টা করো। দাঁত নিশ্চয় ভোগাচ্ছে। এইবার একে-একে যাবে। অনেক মুরগি, ছাগল চিবিয়েছ। নিজের ভবিষ্যতও চিবিয়েছ। অত:পর ক্ষান্তি দাও। এখন আলুভাতে আর ভাত। সাদা তরল, যাকে দুধ বলা হয়, এক কাপ যদি জোটে, পান করতে পারো। চোখে ছানি যদি না এসে থাকে, আসবে, প্রস্তুত থাকো। হাঁটুর জোর কমবে। মুখের ভাত নেমে আসবে হাঁটুতে। টাক তো পড়বেই। দুপুরের রোদে ছাদে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কাক তোমাকে কাকতাড়ুয়া ভাববে।

রাগ দেখাবার মানুষটি চলে গেছেন, এখন তোমাকে অভিমান নিয়েই থাকতে হবে। অভিমান হল ভড়ভড়ে ডোবা। সবাই পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। মান-অভিমান একজনের সঙ্গেই চলে, তিনি হলেন স্ত্রী। কত যন্ত্রণাই না তাঁকে দিয়েছ। তিনি মরে বেঁচেছেন। এখন তোমার ছানি পড়া চোখে চোখের জল দেখতে তিনি আসবেন না। বুঝেছিস গাধা। স্ত্রীকে কষ্ট দেওয়াটা যেন স্বামীদের ‘বার্থ রাইট।’ এইবার ঠ্যালা বোঝো। সংসারের তারে তোয়ালের মতো ঝুলে থাকো। কেউ মুখ মুছবে, কেউ মুছবে পা।

 লোভ বাড়বে। নিজের পেট না বুঝে এটা-ওটা খেতে ইচ্ছে করবে। তারপরে বাথরুম-বাস। শুনতে পাবে সবাই বলছে, ‘বুড়ো ব্যাটা গিলে মরেছে।’ ব্রংকিয়াল ট্রাবল আসবে। ভোরবেলা ঘুম ভাঙবে কাশতে কাশতে। একালের যুবকরা আটটার আগে বিছানা ছাড়ে না। তুমি তোমার কাশির ফাঁকে ফাঁকে পরিষ্কার শুনবে, ‘ওই শুরু হল অ্যালার্ম বেল। কত ভাগ্য করলে এমন হয়, কাশী না গিয়েই কাশি-বাস!’ আরও শুনবে, ‘ওয়াশ-বেসিনটার বারোটা বাজল।’

এক সময় কর্তা ছিলে, সে-কুসংস্কার তো যাওয়ার নয়। সেই বশে মাঝেমধ্যে আদেশ, উপদেশ করার চেষ্টা করবে। খুব লাগবে, দেয়ালে মাথা ঠুকে গেলে যেরকম লাগবে, ঠিক সেইরকম। দেখবে শ্রোতারা প্রথমে শুনতেই পাবে না। মানে শুনেও শুনবে না। তারপর মুখ বাঁকাবে। তারপর অত্যন্ত তুচ্ছ বিষয় গুরুতরভাবে আলোচনা করতে থাকবে। নমুনা : বুঝলে শিবানী, কাল খাটের তলায় একটা আরশোলা ঘুরছিল। বেশ বড় গো!

ম্যা গো! আমি আজই বাপের বাড়ি চলে যাব। খিটখিটে শ্বশুর, ঘিনঘিনে শাশুড়ি আর তেল চুকচুকে আরশোলা, তিনটেই আমার অসহ্য।

এইবার একটি সংস্কৃত শ্লোক শোনো : মূর্খো দ্বিজাতি : স্থবিরো গৃহস্থ : / কামী দরিদ্রো ধনবাংস্তপস্বী / বেশ্যা কুরূপা নৃপতি : কদর্যো / লোকে ষড়োতালি বিড়ম্বিতানি / / শাস্ত্রজ্ঞানহীন ব্রাহ্মণ, বার্ধক্যজর্জরিত গৃহস্থ, কামাসক্ত দরিদ্র, ধনবান সন্ন্যাসী, কুশ্রী বেশ্যা, আর কদর্য রাজা, এদের জীবন হল বিড়ম্বনা !

ভাই ! তোমার ভেতরে বসেই তোমাকে এই চিঠি লিখছি। তাই পোস্ট করার প্রয়োজন হল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *