জীবন্ত মৃতদেহ
সুরমা সমুদ্র দেখেনি। এবার পুজোর সময়ে সুরেশের কাছে ধর্না দিয়ে পড়ল, ‘দাদা আমাকে সমুদ্র দেখাও।’
সুরেশ মাথা নেড়ে বললে, ‘এ-যাত্রায় হল না বোন!’
‘কেন?’
‘পূজার ছুটি পাব বটে, কিন্তু ছুটিতে কলকাতায় কাজও আছে। আমি বড়ো জোর হপ্তা খানেক বাইরে থাকতে পারি। কিন্তু সমুদ্র দেখতে গেলে পুরীতে যেতে হয়। হপ্তা খানেকের জন্য পুরীতে গিয়ে কী হবে? মজুরীতে পোষাবে না।’
সুরেশের বন্ধু দীপক সেখানে বসেছিল। সে বললে, ‘সমুদ্র দেখবার জন্য উড়িষ্যা মুল্লুকে ছুটতে হবে কেন?’
‘কারণ বাঙালির পক্ষে সেইটেই হচ্ছে শর্ট-কাট!’
‘দেখ সুরেশ, আমরা প্রায় ভুলেই যাই, সমুদ্রের স্পর্শ থেকে বাংলাদেশও বঞ্চিত নয়।’
‘হ্যাঁ দীপক, আমিও তা জানি। কিন্তু কাছাকাছির ভিতরে পুরীর মতন অন্য কোথাও যাত্রীদের থাকবার ব্যবস্থা নেই।’
দীপক বললে, ‘সুরমা, পুরীর চেয়ে ঢের কাছে তুমি সমুদ্রকে পেতে পারো।’
সুরমা সাগ্রহে বললে, ‘কোথায়, দীপুদা?’
‘কাঁথিতে। আমাদের দেশ কাঁথির কাছে।’
‘সেখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়?’
‘নিশ্চয়ই, নইলে আর বলছি কেন? আমরা এখন কলকাতার বাসিন্দা হয়েছি বটে, কিন্তু দেশের বাড়িখানা আছে আমাদের পুরোনো চাকর সনাতনের জিম্মায়। সুরেশ, দিন পাঁচ-ছয়ের ভিতরে যদি সুরমাকে নিয়ে সমুদ্র দেখে আবার কলকাতায় ফিরতে চাও, তবে বাঁধো মোট, কেনো টিকিট, চলো আমাদের দেশ! তোমাদের রাজভোগ দিতে পারব না বটে, তবে অনাহারেও থাকতে হবে না। কী বলো? রাজি?’
হয়তো অদৃষ্টেরই কারচুপি। নারাজ হবার মতো বুদ্ধি খুঁজে না-পেয়ে সুরেশ বলতে বাধ্য হল, ‘আচ্ছা, রাজি।’
‘তাহলে ষষ্ঠীর দিনই আমরা যাত্রা করব।’
‘হ্যাঁ। দশমীর পরেই আমাকে আবার কলকাতায় ফিরতে হবে। জরুরি কাজ।’
দুই
কিন্তু দশমীর পরেই সুরেশ ফিরতে পারলে না কলকাতায়। দেবতা সাধলেন বাধ।
সুরমার ভাগ্যে সমুদ্র দর্শন হল— ভালো করেই হল। সেই অনন্ত নীল সৌন্দর্যের দিকে প্রথমটা সে তাকিয়ে রইল অবাক বিস্ময়ে। তারপর কচি মেয়ের মতো সকৌতুকে হাসতে হাসতে নাচের তালে তালে ছুটোছুটি করে বেড়াতে লাগল সাগর-সৈকতের বালুকা শয্যার উপর দিয়ে।
সুরেশ বললে, ‘কলকাতার এত কাছে সমুদ্র, অথচ আমরা জেনেও জানি না। সমুদ্র দেখবার কথা উঠলেই পুরীর কথা মনে হয়।’
দীপক বললে, ‘এটা অভ্যাসের দোষ ভায়া। বাংলাদেশের কত জায়গা থেকেই সমুদ্রের নাগাল পাওয়া যায়। ”সমতট” বা দক্ষিণ বাংলার বাসিন্দাদের তো সমুদ্রের ছেলে বললেও অত্যুক্তি হয় না। যুগে যুগে বাঙালি বাংলার সমুদ্রপথ দিয়ে যাত্রা করেছে পৃথিবীর দিগ্বদিকে। বাংলার প্রথম বন্দর তাম্রলিপ্ত বা তমলুক থেকে খ্রিস্টপূর্ব যুগে শত শত জাহাজ যাত্রা করত সমুদ্রের ভিতরে। বাংলার বীর ছেলে বিজয় সিংহ আর চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন তমলুক থেকেই সমুদ্র যাত্রা করেছিলেন। আজও সমুদ্রগামী জাহাজে অগুন্তি বাঙালি নাবিক কাজ করে। সমুদ্রের সঙ্গে যে বাঙালির নাড়ির যোগ আছে।’
সুরমা বললে, ‘আমার মনে হচ্ছে দাদা, সমুদ্রকে দর্শন করাও যেন মস্তবড়ো একটা ”অ্যাডভেঞ্চার”! ও দীপুদা একখানা নৌকা ভাড়া করো না।’
‘কেন?’
‘একবার সমুদ্রের বুকে ভাসতে ইচ্ছে করছে।’
সুরেশ ধমক দিয়ে বললে, ‘না না অতটা বাড়াবাড়ি ভালো নয়! সমুদ্র কী পুকুর, না খাল? ঢেউয়ের ধাক্কায় দৈবগতিকে নৌকা যদি ডুবে যায় কী বানচাল হয়, তাহলে শখের ”অ্যাডভেঞ্চার” -এর মজাটা ভালো করেই টের পাবি! যত-সব ছেঁদো কথা!— ”অ্যাডভেঞ্চার”।’
তা ‘অ্যাডভেঞ্চার’-এর মজাটা হাড়ে হাড়ে টের পেতে সুরমাকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না।
আকাশ ছেয়ে গেল কালো কালো মেঘে। মেঘের-পর-মেঘ, মেঘের ভিতরে মেঘ। দেখতে দেখতে আরম্ভ হল বারিপাত। ক্রমে বৃষ্টি জোর পড়তে লাগল। দিন গেল রাত এল, রাত গেল দিন এল, আবার দিনের পর এল রাত; তবু প্রবল বৃষ্টি ঝরছে অবিশ্রান্ত। ঝুপ ঝুপ ঝুপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে জলে আর স্থলে। তার সঙ্গীরূপে জাগ্রত হল ঝোড়ো হাওয়া।
এমন বিস্ময়কর বৃষ্টি সুরমা আর কখনো দেখিনি। বাড়ি থেকে এক পা বেরুবার জো নেই। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে কেবল দেখা যায় বৃষ্টির ধারায় চিকের ভিতর দিয়ে দূরের অস্পষ্ট সমুদ্র এবং দিকে দিকে ঝাপসা বনজঙ্গল, আর শোনা যায় থেকে থেকে পাগলা ঝড়ের হাহাকার!
তারপর আচম্বিতে এক ভয়ঙ্কর কোলাহল— তার মধ্যে যেন ডুবে গেল জল-স্থল-শূন্যের সমস্ত।
দীপক, সুরেশ ও সুরমা স্তম্ভিতনেত্রে দেখলে, সমুদ্র আকাশমুখো হয়ে লক্ষ লক্ষ সফেন তরঙ্গ জাদু বিস্তার করে লাফিয়ে উঠেছে ঊর্ধ্বে, ঊর্ধ্বে, ঊর্ধ্বে আরও ঊর্ধ্বে! সর্বাঙ্গ তার ক্রুদ্ধ হুঙ্কারময়!
পৃথিবীর বুকের উপরে মহাশব্দে ভেঙে পড়ে সেই বিপুল জলরাশি ধেয়ে এল উগ্র বেগে! তারপর দিকে দিকে উঠল অগণ্য মানুষ ও জন্তুর কণ্ঠ থেকে আর্তনাদ আর আর্তনাদ আর আর্তনাদ!
এ সেই চিরস্মরণীয় বন্যার আরম্ভ, যার কাহিনি শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সারা ভারতবর্ষ!
সুরমা অভিভূত কণ্ঠে বললে, ‘মনে হচ্ছে, এ যেন প্রবল পয়োধি জল!’
দীপক ভয়ার্তস্বরে বললে, ‘এখন আর কাব্য নয় সুরমা! হ্যাঁ, এ হচ্ছে সাক্ষাৎ মৃত্যুস্রোত! সমুদ্রের বন্যা ছুটে আসছে পৃথিবীর মাটিকে গ্রাস করতে।’
অজস্র ধারায় ঝরছে আকাশ প্রপাত, হা-হা-হা-হা অট্টহাসি হাসছে দুর্দান্ত ঝটিকা, তাণ্ডব নৃত্যে ছুটে আসছে বন্যা, বন্যার উত্তাল তরঙ্গদল, কর্ণভেদী মৃত্যুক্রন্দন তুলেছে অসংখ্য অসহায় মানব, হুড়মুড় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে শত শত ঘর-বাড়ি এবং বনস্পতি। যেন পৃথিবীর অন্তিমকাল উপস্থিত।
তিন
আমরা বন্যার ইতিহাস লিখতে বসিনি, যেটুকু ইঙ্গিত দিলুম সেইটুকুই যথেষ্ট।
বন্যা যখন বিদায় নিলে চারিদিকে দেখা গেল এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য, ভালো করে যা বর্ণনা করতে গেলে ভাষাও বোবা হয়ে যায়; সুতরাং সে অসম্ভব চেষ্টা করব না।
এইটুকু বললেই চলবে যে কয়েক দিন ব্যাপী ঝড়-বৃষ্টি-বন্যার পর সূর্যদেব মেঘ সরিয়ে এসে দেখলেন, এ অঞ্চলের বাইরে অধিকাংশ ঘরবাড়ি একেবারে বিলুপ্ত কিংবা জলময় হয়েছে এবং অনেক জায়গায় গ্রাম বা অঞ্চল ডুবিয়ে থই থই করছে অগাধ জলরাশি এবং তার উপরে দলে দলে ভাসছে গণনাতীত নর-নারী ও অন্যান্য জীবজন্তুর মৃতদেহ। যে দিকে তাকাও, দৃষ্টিসীমা জুড়ে এই-একই দৃশ্য!
দীপকদের এবং অন্যান্য কারুর বাড়ি ছিল উচ্চ ভূমির উপরে, তাই তারা কোনোক্রমে আত্মরক্ষা করতে পেরেছে। কিন্তু দীপকদের বাড়িও একেবারে অক্ষত ছিল না। তার পিছন দিকের যে অংশটা ছিল বেশি পুরাতন তা অদৃশ্য হয়েছে। উঁচু জমির উপরে থাকলেও বাড়ির এক তলায় ঢুকেছে বেনো জল, সকলে তাই বাস করছে দোতলায়। কারুর এক তলায় নামবার কোনো উপায়ই নেই। কিন্তু তবু তো তাদের বলতে হবে ভাগ্যবান, কারণ জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, কত লোক বাস করছে মুক্ত আকাশের তলায়, জলমগ্ন ঘরবাড়ির ছাদের উপরে বা বনস্পতির শাখায়-শাখায় এবং এইভাবে উপবাস করে তাদের যে কতদিন থাকতে হবে তা কেউ জানে না।
সুরেশ বললে, ‘দীপক, আমাদের যখন আসবার জন্যে নিমন্ত্রণ করেছিলে তখন কী বলেছিলে, মনে আছে? তোমাদের অনাহারে থাকতে হবে না। কিন্তু এখন কী বলতে চাও? আমি সাঁতার জানি না, সুরমাও তাই। বাড়ির নীচে চারিদিকে সমুদ্রের জল বয়ে যাচ্ছে কলকল করে। এই জলরাশি ভেদ করে যে আবার কবে ডাঙা দেখা দেবে, ভগবান জানেন। এর মধ্যে আমরা জঠরজ্বালা নিবারণ করব কেমন করে?’
দীপক বললে, ‘ভয় নেই ভায়া! অন্তত দিন তিন-চার আমাদের অনাহারের ভয় নেই। কিছু চাল, কিছু ডাল আর কিছু শাকসবজি আমি রক্ষা করতে পেরেছি।’
‘কিন্তু দিন তিন-চার পরে?’
‘খুব সম্ভব জল তখন সরে যাবে। ভগবান আমাদের সহায়।’
‘এই যে কত শত মানুষ বানের তোড়ে ভেসে গেল, ভগবান কি তাদের সাহায্য করেছিল? ভগবান আমাদের সহায়! ওসব বাঁধা গৎ ছেড়ে দাও।’
‘বাঁধা গৎ নয় বন্ধু, বাঁধা গৎ নয়! ভগবানের উপর বিশ্বাস কখনো হারিয়ো না। যারা বানের জলে ভেসে গেল নিশ্চয়ই তাদের কাল পূর্ণ হয়েছিল, ভগবান তাই তাদের সাহায্য করেননি। কিন্তু এত বড়ো দৈবদুর্বিপাকেও আমরা যখন এখনও বেঁচে আছি, তখন আমাদের কাল পূর্ণ হতে দেরি আছে।’
‘বেশ, দেখা যাক।’
খাবার গেল ফুরিয়ে। কিন্তু বিপদের উপর বিপদ, জলাভাব। জল যা আছে, তা আজকের পক্ষেও অপ্রচুর। মানুষ অনাহারে থাকতে পারে দিন কয়, কিন্তু জলাভাব সহ্য করা অসম্ভব।
অথচ চারিদিকে এত জল! মাটির উপরে এখানে এত জল কেউ কোনোদিন দেখেনি। কিন্তু তা হচ্ছে সমুদ্রের লবণাক্ত জল— জীবের গলা দিয়ে গলে না।
দীপক জানালার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে বাহিরটা একবার দেখে নিয়ে বললে, ‘সুরেশ, কোনো দিকে এখনও জ্যান্ত মানুষের সাড়া পাচ্ছি না। আমার বাড়ির চারপাশ থেকে জল এখন সরে গিয়েছে বটে, কিন্তু খুব সম্ভব গ্রাম এখনও জনহীন। যারা বন্যাকে ফাঁকি দিতে পেরেছে তারা পালিয়েছে প্রাণ নিয়ে। এমন অবস্থা এখানে হাট-বাজারও বসবে না। রেলপথও হয়তো এখনও জলের তলায়, সুতরাং ট্রেনও চলবে না। কলকাতার যখন যাবার উপায় নেই, তখন আমাদের কী করা উচিত বলো দেখি?’
‘তোমার দেশ, তুমি বলো।’
‘নন্দীগ্রামে আমার মামার বাড়ি। এখান থেকে মামার বাড়ি পনেরো মাইলের কম হবে না। যদিও চারিদিকের অবস্থা দেখে সন্দেহ হচ্ছে, জলমগ্ন জমি এড়িয়ে সেখানে যেতে হলে আমাদের হয়তো পঁচিশ-ত্রিশ মাইল পথ পার হতে হবে। সেখানে যাবার চেষ্টা করব কি?’
‘নন্দীগ্রামের অবস্থাও যদি এখানকার মতো হয়ে থাকে?’
‘হয়তো হয়েছে। হয়তো হয়নি। হয়তো সেখানে গেলে পানাহারের অভাব হবে না। প্রাণ বাঁচাবার জন্যে একবার চেষ্টা করা উচিত নয় কি?’
‘বোধ হয় উচিত। এখানে থাকলে খাবার আর জলের অভাবে আমরা মারা পড়ব সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই।’
সুরমা সভয়ে বললে, ‘উঃ! পায়ে হেঁটে পঁচিশ-ত্রিশ মাইল!’
সুরেশ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললে, ‘হ্যাঁ, তাই! তোর জন্যেই তো এই বিপদ! তোর জন্যেই তো বাংলাদেশে বসে সমুদ্র দেখতে এলুম! এই বাংলা দেশ হচ্ছে ঈশ্বরবর্জিত দেশ। পুরীতে গিয়ে কেউ এমন বিপদে পড়ে না— সেখানকার সমুদ্র হিংসুক রাক্ষসের মতো নয়, তাই সবাই যেতে চায় সেখানে!’
সুরমা খিল-খিল করে হেসে উঠে বলল, ‘রাগ করো না দাদা, কিন্তু তুমি কথা কইছ ঠিক একটি আস্ত বোকার মতন!’
সুরেশ আরও রেগে উঠে বললে, ‘তুই অ্যাডভেঞ্চার চেয়েছিলি না? এখন দ্যাখ, কত ধানে কত চাল!’
দীপক বললে, ‘শান্ত হও বন্ধু, শান্ত হও! এখন মাথা গরম করবার সময় নয়। সনাতন, নিরেট খাবার তো খতম। এখন যেটুকু জল আছে একটা ‘ফ্লাস্কে’ ভরে নাও। তারপর চলো, আমরা দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়ি।’
চার
চোখের সামনে তারা যে মর্মান্তিক দৃশ্য দেখলে, সেই ভীষণতা ও সেই বীভৎসতার পূর্ণ বর্ণনা না দেওয়াই ভালো। কবি দান্তে নরকের যেসব ছবি এঁকেছেন তাও এমন ভয়াবহ নয়।
জনহীনতার মধ্যে বিরাজ করছে যেন এক বিরাট সমাধি ভূমির শ্বাসরোধকারী নিস্তব্ধতা। জনহীনতাই বা বলি কেন, যেখানে-সেখানে রয়েছে মনুষ্য-মূর্তি— একক, জোড়া-জোড়া বা দলে-দলে; তাদের সংখ্যা গোনা অসম্ভব। কিন্তু তারা সকলেই মৃত। এ হচ্ছে মৃত জনতার দেশ! কত দেহ জলে ভাসছে, কত দেহ পুঞ্জীভূত ও আড়ষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে মাটির ওপরে।
মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে জলমগ্ন জলের উপর অংশ। সে-সব গ্রামে যারা থাকত তাদের অনেকেই ভেসে গিয়েছে বন্যাস্রোতে, বাকি সবাই করেছে প্রাণ নিয়ে পলায়ন।
থেকে থেকে সুদূর বা অল্প দূর থেকে ভেসে আসছে ‘বলো হরি হরি বোল’ ধ্বনি। আত্মীয়েরা যে-সব দেহের সন্ধান পেয়েছে তাদের নিয়ে চলেছে শ্মশানের দিকে।
সব আগে দীপক, তারপর সুরেশ, তারপর সুরমা এবং সব শেষে মোটঘোট নিয়ে পথ চলছে বৃদ্ধ ভৃত্য সনাতন। তাদের মনের ভিতর কী হচ্ছিল জানি না, কিন্তু তাদের মুখের পানে তাকালে বোধ হয়, তারা যেন এগিয়ে যাচ্ছে চোখ থাকতেও অন্ধের মতো।
সত্যই তাই। ইচ্ছে করেই তারা এদিকে-ওদিকে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখছিল না, কারণ তা দেখলে হয়তো বন্ধ হয়ে যেত তাদের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া।
প্রত্যেকেই পদচালনা করছে কলের পুতুলের মতো। কারুর মুখে কথা নেই বললেও চলে। এই মড়ার মুলুকের মৌন ব্রতের মধ্যে কথা কইতে যেন ভয় হয়, শিউরে ওঠে প্রাণ! মনে হয় পরিচিত জীবনের বাণী শুনলে দেহহীন আত্মারা আবার ফিরে আসতে চাইবে আপন-আপন দেহের মধ্যে।
পথ ধরে সোজা চলতে পারলে হয়তো তারা সন্ধ্যার আগেই গন্তব্যস্থলে গিয়ে পৌঁছতে পারত। কিন্তু পথ ও মাঠের অধিকাংশই এখনও জলমগ্ন। যেখানে জল নেই সেখান দিয়ে অনেক ঘুরে তবে তারা অগ্রসর হতে পারছে।
অবশেষে সন্ধ্যা হল। চাঁদ উঠল— শুক্লপক্ষের উজ্জ্বল চাঁদ। কিন্তু মানুষ যে চোখে দেখে, চাঁদকে মনে হয় সেইরকম। তারা ভাবলে, এ চাঁদের মুখ যেন মড়ার মতো হলদে।
জ্যোৎস্নার আলোতে তফাতের সব দৃশ্য আর স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না— এ তবু মন্দের ভালো। অন্তত খানিকটা কমল ভয়াবহতা।
সুরমা কাতরস্বরে বললে, ‘দাদা, জল!’
সুরেশ বললে, ‘এইতো একটু আগে জল খেলি!’
‘কী করব দাদা, আজ আমার গলা যে খালি শুকিয়ে যাচ্ছে!’
‘শুকিয়ে গেলে কী করব বোন, ”ফ্লাস্কে” যে আর এক ফোঁটাও জল নেই!’
একটা অস্ফুট আর্তধ্বনি করে সুরমা চুপ মেরে গেল।
দীপক বললে, ‘পচা মড়ার দুর্গন্ধ ক্রমেই বেড়ে উঠেছে! আর যে নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে!’
সুরেশ বললে, ‘পথের আর কত বাকি?’
‘আমাদের এখনও মাইল সাত-আট হতে হবে।’
‘ওঃ!’
আবার সবাই নীরব। কিন্তু রাত্রি আজ নীরব নয়। একটানা শোনা যেতে লাগল শৃগাল কুকুরের চিৎকার ধ্বনি। মড়ার অধিকার নিয়ে তারা ঝগড়া করছে পরস্পরের সঙ্গে।
খানিক পরে সুরমা আর পারলে না, অবশ হয়ে বসে পড়ল এবং সঙ্গে-সঙ্গে ‘দা গো’ বলে চেঁচিয়ে উঠে এলিয়ে পড়ল একদিকে।
দীপক ও সুরেশ ছুটে এসে তাকে তুলে দাঁড় করালে। দেখা গেল, সুরমা বসে পড়েছিল একটা নারীর মৃতদেহের উপরে।
সুরমা কাঁদতে লাগল।
সুরেশ বললে, ‘এখানে দাঁড়িয়ে কাঁদলে কী হবে বোন? চল যত তাড়াতাড়ি পারি এই নরকের বাইরে পালাই চল!’
‘তেষ্টায় আমার ছাতি ফেটে যাচ্ছে, আর আমি হাঁটতে পারব না দাদা।’
‘তাহলে তোকে কি আমাদের কোলে করে নিয়ে যেতে হবে?’
এত দুঃখেও ম্লান হাসি হেসে সুরমা বললে, ‘কী যে বলো দাদা!’
‘তবে এগিয়ে চল।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরমা আবার অগ্রসর হল।
চাঁদের আলো আরও জ্বলজ্বলে। ওদিকে তেপান্তরের মাঠটাকে দেখাচ্ছে অপার সমুদ্রের মতো। চন্দ্রকিরণ তার বুক জুড়ে খেলছে যেন লাখো লাখো হিরা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা।
এদিকে খানিকটা খোলা জমি। তার এখানে-ওখানে অস্বাভাবিক সব ভঙ্গিতে নিশ্চেষ্টভাবে পড়ে রয়েছে কতকগুলো দেহ— কেউ নর, কেউ নারী, কেউ শিশু। তিন-চারদিন আগেও তারা ছিল এই উৎসবময়ী ধরণীর গর্বিত প্রাণী। স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি নিজেদের এমন ভয়ানক পরিণাম।
পাশের বনের ভিতরে উঠছে ঘনঘন হরিধ্বনি। শবযাত্রীরা যাচ্ছে শ্মশানের দিকে।
হঠাৎ সনাতন আঁতকে উঠে বললে, ‘বাবু!’
দীপক ফিরে বললে, ‘কী রে সনাতন?’
সনাতন ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘মড়া জ্যান্ত হয়ে উঠেছে!’
‘মড়া জ্যান্ত হয়েছে কী রে?’
‘ওই দেখুন, ওই দেখুন!’ সে সেই খোলা জমির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে।
ফিরে দেখে সকলেরই বুক শিউরে উঠল।
জমির উপরে যে মৃতদেহেগুলো ছিল, তাদের একটা শুয়ে শুয়েই অগ্রসর হচ্ছে।
সুরমা ভয়ে চোখ মুদে ফেলল।
সনাতন বললে, ‘পালিয়ে আসুন বাবু, পালিয়ে আসুন! মড়াটাকে দানোয় পেয়েছে!’
খুব তীক্ষ্ন চোখে চলন্ত মূর্তিটাকে দেখে দীপক বললে, ‘ধেৎ। অসম্ভব কখনো সম্ভব হয়? ওটা কুমির।’
‘কুমির?’
‘হাঁ, এখানে এসেছিল মড়ার লোভে। আমাদের দেখে জলের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। এমনি করেই আমরা ভূত দেখি।’
পাঁচ
অত্যন্ত ক্ষীণস্বরে সুরমা বললে, ‘জল, জল!’
সুরেশ বললে, ‘সুরো জল যখন নেই তখন ”জল জল” করে মিছে কেঁদে কেন আমাদের কষ্ট দিচ্ছিস?’
‘জল জল করছি কী সাধে দাদা? আমি যে আর পারছি না!’
দীপক বললে, ‘ভয় নেই সুরমা, পথের আর মাইল তিন বাকি।’
‘মাগো, সে অনেক দূর!’
কেউ আর কিছু বললে না।
কিছু দূরে দেখা গেল দুটো লণ্ঠনের আলো। একজন মানুষকেও দেখা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে।
দীপক বললে, ‘ওখানে একটা শ্মশান আছে।’
সুরেশ বললে, ‘একটা কথা মনে হচ্ছে। যারা শ্মশানে এসেছে তারা এখানকার পানীয় জলের অভাবের কথা নিশ্চয়ই জানে। ওরা কি সঙ্গে পানীয় জল আনেনি!’
‘আনা তো উচিত।’
‘সুরমার অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। একবার জলের খোঁজে ওদের কাছে যাব নাকি?’
‘চলো।’
সকলে শ্মশানের দিকে অগ্রসর হল।
যখন তারা শ্মশানে এসে উপস্থিত হল তখন কয়েক জন লোক চিতায় আগুন জ্বালাবার চেষ্টায় নিযুক্ত ছিল। তারা তফাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
চিতা জ্বলল। আগুনের রক্তশিখা ক্রমেই উঠতে লাগল উপর দিকে।
হঠাৎ এক অভাবিত কাণ্ড।
প্রথমেই জাগল যন্ত্রণা বিকৃত নারীকণ্ঠের তীব্র আর্তনাদ।
তারপরেই দেখা গেল, চিতার উপরকার কাঠগুলো ঠেলে ফেলে দিয়ে চিতার উপরে বিদ্যুতবেগে দাঁড়িয়ে উঠল এক শীর্ণ-বিশীর্ণ জীবন্ত নারী-মূর্তি— তার পরনের কাপড়ে, তার এলান চুলে-চুলে দংশন করছে ক্রুদ্ধ সর্পশিশুর মতন অগ্নিশিখারা।
আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সে তীক্ষ্ন স্বরে বললে, ‘জ্বলে মলুম, পুড়ে মলুম!’
মূর্তি চিতার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ল। যারা দাহ করতে এসেছিল তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করলে প্রাণপণে।
সেই ভয়ঙ্করী অগ্নিময়ী মূর্তির চোখ দুটো ঠিকরে পড়ছে। সে দুই হাত বিস্তার করে বেগে দৌড়ে আসতে আসতে চেঁচিয়ে উঠল, ‘জ্বলে মলুম, পুড়ে মলুম! রক্ষা করো, রক্ষা করো!’
দীপক, সুরেশ, সুরমা ও সনাতন দ্রুতপদে না পালিয়ে পারলে না।
ছয়
অনেক দূর ছুটে এসে তারা থামল।
খানিকক্ষণ হাঁপ ছাড়বার পর দীপক বললে, ‘কী কাপুরুষ আমরা। কার ভয়ে পালিয়ে এলুম? জ্যান্ত মানুষকেও মারা গেছে ভেবে ভুল করে শ্মশানে নিয়ে আসার কথা তো আগেই শুনেছি। এ-ও নিশ্চয় সেই ব্যাপার!’
সুরেশ বললে, ‘আমারও সেই সন্দেহ হচ্ছে। চলো, শ্মশানের দিকে আর একবার গিয়ে দেখে আসি।’
সরমা সভয়ে কেঁদে উঠে বললে, ‘ওরে বাবা, আমি পারব না!’
‘কে তোকে যেতে বলেছে! তুই সনাতনের কাছে বসে থাক।’
কিন্তু তাদের বিফল হয়ে ফিরে আসতে হল। সেই অদ্ভুত মূর্তি একেবারেই অদৃশ্য।
সনাতন মাথা নেড়ে মত জাহির করলে, ‘যে মূর্তি দুনিয়ার নয়, তাকে কি আর দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যায়?’