জীবন্ত প্রস্তর

জীবন্ত প্রস্তর

তখন গভীর রাত। যতদূর চোখ যায় শুধু অন্ধকারের একচ্ছত্র বিস্তৃতি। কেমন যেন থমথমে পরিবেশ। কোথাও একবিন্দু আলো নেই, কোনও শব্দ নেই! নেই জীবনের বিন্দুমাত্র প্রকাশও! রাতচরা পাখির ডাক, কিংবা কুকুরের ঘেউ ঘেউ এমনকী গাছের পাতা খসে পড়ার খসখস, কোনও জাগতিক আওয়াজই শোনা যায় না! এ কেমন নিস্তব্ধতা! কেমন অন্ধকার! যেন কেউ একটা কালো পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখেছে সমস্ত দৃশ্য, সমস্ত শব্দ! পর্দার ও প্রান্তে যা আছে তা যেন প্রকাশ্যে আসতে চায় না।

ড. ইথান ওলসেন সতর্কদৃষ্টিতে একবার চতুর্দিকটা দেখে নিলেন। আজ অমাবস্যা। আকাশে জমাট অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। আশপাশে শুধু হাড়-পাঁজর বের করা ধ্বংসস্তূপের কঙ্কাল! শূন্য চক্ষুকোটরের মতো হাঁ করে আছে জানলাগুলো! বেশিরভাগ বিল্ডিংগুলোই ধ্বসে পড়েছে। বিশেষ কিছুই বাকি নেই। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, বুঝি রস-রূপ-গন্ধ ভরা পৃথিবী থেকে বহুদূরে এসে পড়েছেন তিনি। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে! যেখানে নৈঃশব্দও বড় বিষণ্ণ

ইথানের মনের মধ্যেও যেন সেই বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বের অন্যতম সেরা প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর হিসাবে তিনি পৃথিবীখ্যাত। দুনিয়ায় এমন কোনও কুখ্যাত ভৌতিক স্থান নেই, যেখানে তিনি তদন্ত করতে যাননি। অভিশপ্ত অ্যাসাইলাম থেকে শুরু করে রহস্যময় টানেল, মেট্রো স্টেশন, ভুতুড়ে বাড়ি ও ম্যানসন, এমনকি কুখ্যাত ঐতিহাসিক জায়গাগুলোকেও ছাড়েননি। কোথাও প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিটির প্রমাণ পেয়েছেন, আবার কোথাও বা পাননি। কিন্তু তাঁর বহুদিনের অভিজ্ঞতা বলছিল যে, এই অভিশপ্ত দূর্গের কাহিনি হয়তো অন্যরকম। আপাতদৃষ্টিতে কোনও কিছুই অস্বাভাবিক মনে হয় না। সঙ্গে আনা সেন্সরগুলোও কোনওরকম অতিলৌকিকের উপস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে না। অথচ তাঁর দেহ ও মন বলছে, এই কেল্লার ছত্রে ছত্রে অস্বাভাবিকতা রয়েছে। এবং যথেষ্ট পরিমাণেই রয়েছে। শুধু ধরা দিচ্ছে না!

ইথান যখনই প্রথম এই দুর্গের সিঁড়িতে পা রেখেছিলেন, তখনই এক অদ্ভুত শৈত্যে ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল তাঁর দেহ! অথচ এমন হওয়ার কথা নয়। এখন গরমের মরশুম চলছে। ফোর্টের বাইরে যখন দাঁড়িয়েছিলেন, তখনও বেশ গরমই লাগছিল। খন্ডমুহূর্তের মধ্যেই সেই ভ্যাপসা গরমভাব এমন অস্বাভাবিক শীতলতায় রূপান্তরিত হতে পারে না! তাঁর দেহ সেই মুহূর্তেই বলে উঠেছিল,

“সামথিং ইজ রঙ উইথ দিস প্লেস!”

কিন্তু আশ্চর্য বিষয়! তাঁর ইনফ্রারেড থার্মোমিটার এখনও কোনওরকম অস্বাভাবিকতা দেখায়নি! ইথান প্রত্যেকটি জায়গায় গিয়ে তাপমাত্রা পরীক্ষা করেছেন। তবুও থার্মোমিটার কোনও ইঙ্গিত দেয়নি। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ডিটেক্টরও কোনও অদৃশ্য উপস্থিতির কথা জানায়নি। ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডারও ব্যর্থ হয়েছে। ইথান দুর্গের প্রত্যেকটি ভাঙাচোরা ঘরে ঢুকে কোনও অলৌকিক মানুষের উদ্দেশে বারবার প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। যাকে বলে ‘ইলেক্ট্রনিক ভয়েস ফেনোমেনা’ সেশন। কিন্তু গোটা ইভিপি সেশনেও রেকর্ডারে কিছুই রেকর্ড হয়নি! কোনও কথা তো দূর, সামান্য শব্দও নয়! অর্থাৎ তাঁর প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয়নি কেউ। দূর্গের প্রতিটি নির্জন কোণায়, সিঁড়িতে, আশপাশের ফাঁকা ঘরে ছড়িয়ে রেখেছেন ‘মোশন অ্যান্ড ভাইব্রেশন ডিটেক্টর’। কোনওরকম অস্বাভাবিক বা আপাতঅদৃশ্য গতিবিধি অনুভব করতে পারলেই অ্যালার্ম বেজে উঠবে! কিন্তু এখনও পর্যন্ত সব চুপচাপই আছে। অন্য কেউ হলে, হতাশ হয়ে এতক্ষণে হাল ছেড়ে দিত। অথবা ঘোষণা করে দিত এই অভিশপ্ত দূর্গে কোনওরকম অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু ইথান সে পথে হাঁটেননি। তাঁর সেন্সর ও গ্যাজেটগুলো বলছে যে, এখানে কোনও প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিটি নেই। কিন্তু তিনি নিজে দেহে ও মনে যা অনুভব করছেন, তাকে অস্বীকার করেন কী করে! যে স্থির শৈত্য তাঁকে ছুঁয়ে আছে, যে নৈঃশব্দ তাঁকে নিজের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটুকুও শুনতে দিচ্ছে না, যে অজ্ঞাত কারণে তাঁর মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে, এক বহু শতাব্দীর পাথরচাপা দীর্ঘশ্বাস গুমরে মরছে বুকে—তা মোটেই স্বাভাবিক নয়। গ্যাজেট ভুল করতে পারে। কিন্তু দেহ ও মন ভুল করে না।

ইথানের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তাঁর সেন্সর ও গ্যাজেটগুলো কি ঠিকমতো কাজ করছে না? নাকি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে গ্যাজেটগুলোকে বিভ্রান্ত করছে? তাদের সঠিক নির্দেশ দিতে কেউ বাধা দিচ্ছে কি? নাকি এখনও সময় হয়নি? তিনি নিজের ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালের দিকে তাকালেন। রাত্রি তিনটে বেজে তিরিশ মিনিট। সূর্যোদয় হওয়ার আগে তাঁকে সেই প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে যা আজ পর্যন্ত বিজ্ঞান দিয়ে উঠতে পারেনি। খুঁজতে হবে সেই অজানাকে যার জন্য এই দূর্গের কপালে ‘মোস্ট হন্টেড প্লেস’-এর তকমা জুটেছে।

আস্তে আস্তে আরও কিছুটা সময় কাটল। অন্ধকার, নিঃশব্দ রাত এখনও মৌনতাভঙ্গ করেনি। ইথানও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। দূর্গের ভাঙাচোরা সিঁড়িতে বসে কখন যে অজান্তেই দু’চোখের পাতা লেগে এসেছিল তাঁর, তা নিজেও বুঝতে পারেননি। আচমকাই ঘুম ভাঙল একটা তীব্র শব্দে!

তৎক্ষণাৎ লাফ মেরে উঠে বসলেন তিনি। মুহূর্তের মধ্যেই কানে এল ‘মোশন অ্যান্ড ভাইব্রেশন ডিটেক্টর’ এর প্রবল চিৎকার! কোথাও কোনও রহস্যময় গতিবিধি ধরা পড়েছে! অবশেষে! এত প্রতীক্ষার পর শেষপর্যন্ত একটা ইঙ্গিত এল তবে! কিন্তু আওয়াজটা আসছে কোথা থেকে! ইথান তড়িৎগতিতে ছুটে গেলেন এম ভি ডিটেক্টরের আওয়াজ লক্ষ্য করে। তাঁর হাতের টর্চ দূর্গের আঁকাবাঁকা পাথুরে রাস্তার ওপর আলো ফেলছে। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে, কখনও হোঁচট খেয়ে, কখনও লাফ মেরে সিঁড়ি টপকে তিনি দৌড়ালেন শব্দের উৎসের দিকে।

কিন্তু দৌড়াতে দৌড়াতেই আচমকা চমকে উঠলেন ইথান। এতক্ষণ মোশন অ্যান্ড ভাইব্রেশন ডিটেক্টর স্বাভাবিক আওয়াজেই অ্যালার্ম দিচ্ছিল। হঠাৎই সেই একঘেয়ে অ্যালার্ম থেমে গিয়ে চতুর্দিক কাঁপিয়ে হাসির শব্দ ভেসে এল। তিনি স্তম্ভিত হয়ে শুনলেন, সেটা কোনও নারীর হাসি! কোনও নারী যেন তীব্রস্বরে খিলখলিয়ে হেসে উঠেছে। আর সেই হাসি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে দূর্গের প্রতিটি ভাঙা দেওয়ালে! নারীর হাসিই বটে; কিন্তু যেন অসম্ভব নিষ্ঠুর!

সামান্যই এক নারীর হাসি! কিন্তু আসছে মোশন অ্যান্ড ভাইব্রেশন ডিটেক্টরের মধ্য থেকেই! তার স্বাভাবিক অ্যালার্ম টোনের বদলে বাজছে এই ভয়ঙ্কর হাসি! ইথান বুঝতে পারলেন তিনি দরদরিয়ে ঘামছেন! নিস্তব্ধতাকে চিরে আসা সেই তীব্র তীক্ষ্ণ হাসি শুনে রক্ত হিম হয়ে গেল তাঁর। কোনওমতে স্খলিত স্বরে বললেন, “ওঃ! ক্রা-ই-স্ট!”

— “শেষপর্যন্ত ভানগড় ফোর্ট! ইউ মিন, আলোয়াড়, রাজস্থানের ভানগড়! নো ওয়ে! তুই আর কোনও জায়গা পেলি না?”

সুজনের প্রস্তাবটা শুনে ওর সঙ্গীদের প্রাথমিক অভিব্যক্তি এটাই ছিল। দেবযানী তো প্রায় লম্ফ মেরে উঠে বলেছিল, “জাস্ট ফরগেট ইট! তোর ধারণা আছে, তুই ঠিক কী করতে চাইছিস? রাতের বেলা ভানগড় ফোর্টে ঢুকে মূর্তি ভেঙে নিয়ে আসতে হবে! হালুয়া-পুরী নাকি! আমি এই প্রোজেক্টে নেই!”

সুজন ওর দিকে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। সে জানত দেবযানী শুরুতেই চেঁচামেচি জুড়ে দেবে। প্রত্যেকটা কন্ট্রাক্টের শুরুতেই ও এরকম তা-না-না-না করে। কিন্তু টাকার অঙ্কটা শুনলে কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজি হয়ে যায়। সুজন তাই একটুও উত্তেজিত না হয়ে বলল, “কী করব বল? কাজটা তো দিনের আলোয় করা সম্ভব নয়! তাছাড়া এরকম অনেক ফোর্টে, অনেক মন্দিরে আমরা গভীর রাতে ঢুকে কাজ করেছি। করিনি কি?”

সুরেশ বেশি কথা বলার মানুষ নয়। সে একটা কিংসাইজ সিগারেট ধরিয়ে বলে, “করেছি। কিন্তু ভানগড় ফোর্টের ব্যাপারটা আলাদা।”

—“এগজ্যাক্টলি!” দেবযানী চোখ গোলগোল করেছে, “তুই এমন একটা জায়গার কথা বলছিস যেটা ইন্টারন্যাশনালি কুখ্যাত। শুধু ভারতের নয়, গোটা বিশ্বের অন্যতম অভিশপ্ত জায়গা! ইন্টারনেটে সার্চ করে দ্যাখ। ওয়ার্ল্ডের মোস্ট হন্টেড প্লেসের তালিকায় প্রথম পাঁচটার মধ্যেই ভানগড় ফোর্টের নাম আসবে! আর তুই কিনা সেই জায়গায় গিয়ে মূর্তি কাটার কথা ভাবছিস! তাও আবার রাতে! আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ওখানে বিরাট নোটিস বোর্ড টাঙিয়ে রেখেছে। সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় অবধি কেউ ওখানে ঢুকতে পারে না। গেটে একটা মস্ত তালা ঝোলে! কোনও নাইটগার্ডও ওখানে থাকতে চায় না! আজ পর্যন্ত যারা ওখানে রাতে ঢুকেছে, বেশিরভাগ লোকই ফেরেনি! আশপাশের গ্রামগুলোর লোকেরা ভুলেও সন্ধ্যার পর ভানগড়ের ছায়াও মাড়ায় না। এমনকি বিশ্ববিখ্যাত প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর ইথান ওলসেনের অভিজ্ঞতা পড়েছিস? ভাইরাল হয়ে গিয়েছে তাঁর লেখাটা। দিস ইজ নট আ ম্যাটার অফ জোক সুজন! ভানগড় ফোর্ট এমনি এমনি আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাত হয়নি! ওটা আপাদমস্তক একটা ভৌতিক জায়গা!”

—“আই নো!” সুজন হাসল, “ভানগড় যে অভিশপ্ত ও হন্টেড সেটা পৃথিবীর সবাই জানে। কিন্তু ডেঞ্জারাস বলেই তার দামটাও ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে আকাশ ছোঁওয়া! ভানগড়ের একটা মূর্তি আন্তর্জাতিক বাজারে কীরকম শোরগোল ফেলে দেবে তার ধারণা আছে তোদের? মি. ও’কোনরও ভানগড়ের হিস্ট্রি জানেন। ক্রেডিট গোজ টু ইথান। এবং সেইজন্যই তিনি যে টাকা দেবেন— তাতে আমরা কেন, আমাদের পরবর্তী চোদ্দো পুরুষ ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে বিরিয়ানি-পোলাও খেতে পারবে।”

দেবযানী হাত তুলে দেয়, “দ্যাখ ভাই, বেঁচে থাকলে তবে তো বিরিয়ানি পোলাও খাব! আমি নেই।”

সুরেশ একমুখ ধোঁওয়া ছেড়ে বলল; তাছাড়া ভানগড়ে মূর্তি কোথায়? গোটা ফোর্টটাই তো ভেঙেচুরে গিয়েছে! সেটার কারণও অবশ্য কেউ জানে না। অতবড় শক্তপোক্ত দুর্গটা কী করে একরাতের মধ্যেই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল, ভেতরের লোকগুলোই বা কোথায় গেল— আজ পর্যন্ত কেউ সেটা বলতে পারেনি। গোটা ব্যাপারটাই মিস্টিরিয়াস! আর ওই ধ্বংসস্তূপের ভেতরে তুই মূর্তি কোথায় পাবি?”

সুজন হেসে ফেলল। সে রিসার্চ না করে কোনও কথাই বলে না। মৃদু হেসে বলল, “মূর্তি আছে। ভানগড় ফোর্টটা একরাতের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে ফোর্টের ভেতরের মন্দিরগুলোর গায়ে সামান্য আঁচড়ও পড়েনি! মন্দিরগুলো এখনও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। তার ভেতরে বিগ্রহ নেই ঠিকই, তবে মন্দিরের দেওয়ালে খোদাই করা আছে সব অসাধারণ মূর্তি! বিশেষ করে পুরোনো গোপীনাথমন্দিরের দেওয়ালে অপূর্ব সব যক্ষিণী মূর্তি, নানা দেবী ও দেবতার মূর্তিতে ভরা। সবাই বলে, যক্ষিণী মূর্তিগুলো সব তৎকালীন সুন্দরী নর্তকীদের মডেল করে তৈরি করা হয়েছিল। আর তাদের মধ্যে প্রধান ও সবচেয়ে বড় যে দেবীমূর্তিটি, সেটি নাকি ভানগড়ের কিংবদন্তী সুন্দরী রাজকন্যা রত্নাবতীর আদলে তৈরি! ভানগড়ের অভিশপ্ত হওয়ার পেছনের গল্পে যে আসল নায়িকা, সেই রত্নাবতী। ওই মূর্তিটা কাটতে পারলে কী হবে ভাবতে পারছিস?”

সুরেশের ভুরু কুঁচকে যায়। রাজকন্যা রত্নাবতীর গল্পটা সে জানে। রাজকন্যার দাসী যখন বাজারে সুগন্ধি তেল কিনতে যায়, এক দুষ্ট তান্ত্রিক সিঙ্ঘিয়া ছলে-বলে-কৌশলে সেই তেলকে মন্ত্রপূত করে দেয়। কিন্তু রত্নাবতী নিজেও তন্ত্র চর্চা করতেন। চক্রান্তটা বুঝতে পারেন এবং সেই তেল একটি বিরাট পাথরের ওপর ফেলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই পাথর ছুটে যায় সিঙ্ঘিয়ার দিকে। তান্ত্রিক সেই পাথরের নীচে চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল। কিন্তু মারা যাওয়ার আগে অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিল যে, এই নগর ধ্বংস হবে। মৃত্যুপথযাত্রী তান্ত্রিকের অভিশাপেই নাকি ভানগড় রাতারাতি ধ্বংস হয়ে যায়!

সুজনের কথা সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত। ওরা জানে কাজটা নিষিদ্ধ এবং আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটাই ওদের পেশা। আসলে ওরা ‘ভ্যান্ডালস্’! আর যে কাজটা করে, তাকে বলে ‘ভ্যান্ডালিজ্ম’। কোনও শিল্পকীর্তিকে ধ্বংস করে দেওয়া অনৈতিক কাজ। ধরা পড়লে কঠোর থেকে কঠোরতম সাজা হবে। তবু পেটের দায়ে, প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে প্রাচীন মন্দিরের গা থেকে কেটে নিয়ে আসে অপূর্ব সব প্রাচীন মূর্তি। ওরা সে কাজে রীতিমতো এক্সপার্ট। মাখন তোলার মতো পাথুরে দেওয়ালের গা থেকে একদম অবিকৃতভাবে মূর্তি কেটে নেয়। বিদেশের বাজারে সেসব কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয়। আর ওদের এ কাজে সাহায্য করেন মি. জেমস্ ও’কোনর। উনিই ওদের প্রোজেক্ট দেন। যেমন এবার ভানগড়ের কাজটা দিয়েছেন। সুজন যা বলছে তা মিথ্যে নয়। অভিশপ্ত ভানগড়ের ইতিহাসে রাজকন্যা রত্নাবতী ‘মিথ’। তাঁর মূর্তির দাম যা হবে সেটা ওরা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। তা সত্ত্বেও এবারের প্রোজেক্টটা ঠিক ভালো লাগছে না সুরেশের। এতদিন ধরে ওরা বহু মন্দির বা গুম্ফা থেকে মূর্তি এনেছে। সেক্ষেত্রেও ঝুঁকি ছিল। কিন্তু ভানগড় সম্পর্কে যা শুনেছে, তাতে দিনের বেলাতেই সেখানে ঢুকতে ভয় লাগে! রাতে ঢোকা তো দূর!

সে আস্তে আস্তে বলে, “তুই যা-ই বলিস, এবার রিস্ক ফ্যাক্টর অনেক বেশি।”

—“রিস্ক ফ্যাক্টর বেশি বলেই তো টাকাটাও কয়েকগুণ বেশি হবে।” সুজন নাছোড়বান্দা, “তাছাড়া ওই অভিশপ্ত হওয়ার বদনাম থাকার ফলে দুর্গের ত্রিসীমানায় রাতে কেউ আসবে না। পাহারাদারও সন্ধে হতে না হতেই কেটে পড়ে। পুরো ফাঁকা মাঠ। আমাদের বাধা দেওয়ার কেউ নেই!”

—“সত্যিই কি কেউ নেই?” সুরেশ অন্যমনস্কভাবে বলে, “সুজন, ওখানে কিছু তো আছে! সামথিং মিস্টিরিয়াস, যার কোনও ব্যাখ্যা নেই! তাছাড়া কারণ যাই হোক, ভূমিকম্প, তান্ত্রিকের অভিশাপ বা মোগল আক্রমণ, যেখানে অত মজবুত রাজপ্রাসাদ, দোকান-পাট, রাস্তা-ঘাট সব একরাতের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেল; সেখানে মন্দিরগুলোর কিচ্ছু হল না! ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয়? তাছাড়া ইথান ওলসেনের লেখাটা পড়েছিস? উনিও কিন্তু স্পষ্ট বলেছেন, মন্দিরের মধ্যেই নেগেটিভ এনার্জি সবচেয়ে বেশি মাত্রায় আছে!”

—“তুই বিশ্বাস করবি কিনা জানি না…” দেবযানী ফিসফিস করে বলে,–“কিন্তু অনেকেই বলে যে, ভানগড় ফোর্টের মন্দিরের পাথর নাকি জীবন্ত! ওরা নিজেরাই নিজেদের ঠিক করে নিয়েছিল। যার জন্য ওই শতাব্দী প্রাচীন মন্দিরগুলোয় আজ পর্যন্ত একটা চিড়ও ধরেনি। মন্দিরগুলোর পাথর নিজেরাই নিজেদের রিকনস্ট্রাক্ট করতে পারে। কোনওভাবে ভেঙে গেলে বা ফাটল ধরলে নিজেই সেসব সারিয়ে তোলে।”

কথাটা শুনে সুজনেরও দেহে মুহূর্তের মধ্যে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল। কিন্তু সেটা কাটিয়ে উঠে সে সজোরে হেসে বলল, “জীবন্ত মন্দির! কীভাবে একটা পাথরের দেওয়াল নিজেকেই নিজে জোড়া দিতে পারে? অপারেশন করে?”

—“তা জানি না,” দেবযানী সন্দিগ্ধভাবেই জানায়, “কিন্তু কিছু তো রহস্য আছেই। নয়তো ভানগড় ফোর্টকে ইথানের মতো একজন বিখ্যাত বিশারদ ‘মোস্ট ডেঞ্জারাস প্লেস’ বলতেন না।”

শব্দটা শুনে সুজনের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়ে। মোস্ট ডেঞ্জারাস প্লেস! সে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল, “ননসেন্স।”

—“ননসেন্স নয়, স্যার,”

ছেলেটার চোখদুটো কোটরাগত! মুখটা চোঁয়াড়ে। একটা ডবল ডেকার বাস বোধহয় ওর নাকের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছে। কান দুটো ইঁদুরের মতো খাড়া খাড়া। সব মিলিয়ে দেখতে মোটেই ভালো নয়। তবু ওর বিড়ালের মতো পিঙ্গল কটা চোখে কী যেন আছে! না, ভুল হল। বলা ভালো, ওর চোখে যা থাকা উচিত তার কোনওটাই নেই! প্রথম প্রথম ওর দিকে তাকালেই অদ্ভুত একটা অস্বস্তি টের পাচ্ছিল সুজন। বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ্য করার পর বুঝল যে লোকটার চোখ আছে ঠিকই, কিন্তু দৃষ্টি নেই! সে চোখ ভীষণ শীতল ও অভিব্যক্তিহীন। ও হাসছে ঠিকই, কিন্তু সে হাসির লেশমাত্রও ছায়া পড়ছে না ওর চোখে। চট করে দেখলে ভ্রান্ত ধারণা হয় যে, ওর চোখদুটো বুঝি পাথরের! অথচ সে আদৌ অন্ধ নয়! এই ভানগড় ফোর্টের একজন গাইড। ওর নাম অতুল। বেশ হাসিখুশি, আলাপি ছেলে। তা সত্ত্বেও সুজন ওর উপস্থিতিতে অস্বস্তি বোধ করছিল।

—“আপনারা আধুনিকমনস্ক মানুষ সাহেব। তাই এসব কথায় বিশ্বাস করেন না। ভাবেন গাঁজাখুরি,” অতুল ভানগড় ফোর্টের ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে হাঁটছে। ‘নাচন কি হাভেলি’ তথা নর্তকীদের বাড়ি ছাড়িয়ে জহুরিবাজারের রাস্তায় চলতে চলতে বলল, “কিন্তু বাই’সা যা শুনেছেন, তা আমরাও সত্যি বলেই জানি। ভানগড়ের মন্দিরগুলোর মধ্যে কোনও অলৌকিক শক্তি নিশ্চয়ই আছে। নয়তো একরাতের মধ্যে রীতিমতো মজবুত একটা কেল্লা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল, অথচ মন্দিরগুলো একদম অটুট থাকল কী করে?”

সুজন, সুরেশ এবং দেবযানীর সামনে এখন টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে চির-রহস্যময়, অভিশপ্ত ভানগড় দূর্গ। প্রথম দর্শনেই গা ছমছম করে উঠেছিল ওদের। যখন দূর থেকে পাহাড়ের ওপরে ভানগড়ের টানা পাথরের বিরাট পাঁচিল দেখতে পেল, তখনই মনে হয়েছিল যে এক অতিকায় সরীসৃপ বুঝি কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে পাহাড়কে পেঁচিয়ে ধরে। যে মুহূর্তে তার ঘুম ভাঙবে, সেই মুহূর্তেই তার শ্লথ, বিরাট দেহ গিলে খাবে সবকিছু। অদ্ভুত এক রহস্যময়তা কুয়াশার মতো ঘিরে আছে দুর্গটাকে। সেই ইতিহাসের কুয়াশা ভেদ করে ভানগড়ের বাস্তবতাকে আজ পর্যন্ত কেউ উদ্ধার করে উঠতে পারেনি। কী ঘটেছিল সেই অভিশপ্ত রাতে! ভূমিকম্প, তান্ত্রিকের অভিশাপ না মোগল আক্রমণ! কী করে একটা আলোকোজ্জ্বল, অপূর্ব সুন্দর নগর একরাতেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল? তার বাসিন্দাদের পরিণতিই বা কী হয়েছিল, কেউ তা আজও ঠিক করে বলতে পারেনি। আর রাজকন্যা রত্নাবতী? তিনিই বা কোথায় গেলেন?

এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর পায়নি ওরা। গাড়িতে আসার পথে ভানগড়ের নিকটবর্তী গ্রামগুলোয় জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ভানগড় ফোর্টের নাম শুনলেই স্থানীয় বাসিন্দারা কোনও কথা না বলে স্রেফ দ্রুত পায়ে কেটে পড়ে। যেন ওই অভিশপ্ত দুর্গের নামোচ্চারণ করলেই বিপদ অনিবার্য। দু-একজন সাহসী মানুষ অবশ্য ওদের বারবার সতর্ক করেছে। বলেছে, “ওটা বহুশতাব্দীর অভিশপ্ত, কিলাণ সাহেব। ওর থেকে দূরে থাকাই ভালো।”

সুজন কৌতূহলী, “কেন বলুন তো! কী এমন আছে ওখানে?”

—“কী আছে, তা দেখিনি সাব। দেখার সাহস কোনওদিন হয়নি,” অত্যন্ত সন্তর্পণে উত্তর এল, “কিন্তু কিছু তো আছে। ভানগড় দিনে একরকম, রাতে অন্যরকম। আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে শুনেছি যে, রাত্রে নাকি ভানগড় জেগে ওঠে। বহু মানুষের চেঁচামেচি শোনা যায়। মেয়েদের খিলখিল হাসি, ঘুঙুরের শব্দ; আরও অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসে ‘কিলা’র ভেতর থেকে।”

সুরেশ জানতে চায়, “এসব গল্প তো তোমাদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতা। কিন্তু নিজের কানে কিছু শুনেছ বা দেখেছ?”

—“রাম! রাম!”

লোকগুলো তৎক্ষণাৎ যেন পালিয়ে বাঁচল। ওরা প্রত্যেকেই বুঝল যে এর বেশি আর কোনও কথা গ্রামবাসীরা বলবে না। অভিশপ্ত দূর্গের ভয় ওদের ভেতরে এতটাই প্রবল যে, কোনওমতেই তার সম্পর্কে কিছুই বলতে চায় না। সুজন অবশ্য ওদের ভয় দেখে অনেকটাই আশ্বস্ত হয়েছে। ভালোই হয়েছে। একটা মূর্তিকে কেটে বের করতে গেলে রীতিমতো শব্দ হয়।ম্যানুয়াল হ্যাক স’, চিজেল বা ছেনি-হাতুড়ির আওয়াজ নির্জন দুর্গে বেশ জোরে শোনা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যেহেতু রাতে ভানগড়ের ত্রিসীমানায় কেউ আসে না, সুতরাং আওয়াজ হলেও ধরা পড়ার চান্স একেবারেই নেই। যদি দৈবাৎ কেউ শুনেও ফেলে, তবে ভৌতিক শব্দ ভেবে পিঠটান দেবে। ফলস্বরূপ ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মত কাজটা অতি সহজেই হয়ে যাবে।

—“এখানে কি একটা বিল্ডিঙও আস্ত নেই?”

দেবযানী অতুলের পেছন পেছন হাঁটছিল। চতুর্দিকে খালি হাড়-পাঁজর বের করা ধ্বংসাবশেষ আর পাথুরে দেওয়াল দেখতে দেখতে মেয়েটা বিরক্ত হয়ে উঠেছে। নর্তকীদের ‘হাভেলি’তে স্রেফ কয়েকটা মজবুত থাম আর ভাঙা পাথরের চাঁই ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। জহুরিবাজার হয়তো কোনও সময়ে জমজমাট কোনও বাজার ছিল। এখন শুধু ভাঙা পাথরের অবশেষ সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়।দেবযানী যথারীতি প্রথমে আপত্তি করলেও টাকার অঙ্কটা শুনে রাজি হয়ে গিয়েছে। তবে সুজনকে এ-ও বলে রেখেছে যে এই কাজটা করার পর সে এ পেশা ছেড়ে দেবে। যে টাকাটা ও পাবে, তা দিয়ে কোনও ব্যবসা শুরু করবে। সুরেশেরও প্ল্যানিং তেমনই।

—“আছে তো! এই দেখুন, মোরোঁ কি হাভেলি।

ওদের গাইড অতুল সামনের একটি দালান দেখিয়ে বলল, “রাজকন্যা রত্নাবতী ময়ূর পুষতেন। সেজন্য ময়ূরদের একটা হাভেলিই তৈরি করা হয়েছিল। এখন অবশ্য ওখানে ময়ূর থাকে না। বাদুড় চামচিকেরা ওখানেই ঘাঁটি বানিয়েছে।”

দেবযানীর ঠিক পেছনেই সুরেশ হাতে হাই ডেফিনিশন ক্যামকর্ডার নিয়ে হাঁটছিল। সে এখন ভানগড়ের দৃশ্য ক্যামেরায় তুলতে ব্যস্ত। কথাটা শুনেই ফোড়ন কাটল, “রাজকীয় শখ! মানুষের জায়গা হয় না; আবার ময়ূরের জন্য আস্ত হাভেলি!”

—“তা বটে স্যার!” বলতে বলতেই সে মূল রাজপ্রাসাদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে, “ওইটা ছিল রাজপ্রাসাদ। এখন তো দেখছেনই, তেমন কিছুই নেই! শুধু রত্নাবতীর মহলটা কোনওমতে টিকে আছে।”

সুজনের অবশ্য অত মহল-টহল নিয়ে বিশেষ উৎসাহ নেই। সে মন্দিরগুলোকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছিল। ভানগড়ের চতুর্দিকে মন্দিরের ছড়াছড়ি! এবং আশ্চর্যভাবে সেগুলো সম্পূর্ণ অক্ষত! মেইন গেট দিয়ে ঢোকার সময়ই শ্বেতপাথরের তৈরি হনুমান মন্দির দেখেছে। সেখানে একজন পূজারীও আছেন। কিন্তু শ্বেতপাথরের হনুমানের বিগ্রহ তাকে তেমন আকর্ষণ করেনি। এছাড়াও দেখেছে সোমেশ্বরের মন্দির, মঙ্গলাদেবী মন্দির, নবীন মন্দির এবং গণেশমন্দির।পরের মন্দিরগুলো এখন ফাঁকা। বিগ্রহও নেই। দেওয়ালে কিছু ভাস্কর্য আছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো তেমন জাঁকালো কিছু নয়। সে সতর্ক দৃষ্টিতে চতুর্দিকটা দেখছিল। অর্জুনের পাখির চোখের মতো তারও এখন একটাই লক্ষ্য। গোপীনাথ মন্দির ও রত্নাবতীর আদলে তৈরি দেবীমূর্তি!

বেশ কিছু সঙ্কীর্ণ পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে রত্নাবতীর মহলে ঢুকতে না ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা ও চামচিকের চিমসে গন্ধ ওদের ঘিরে ধরল। মহলের ভেতরে কয়েকটি ঘর এখনও অবশিষ্ট আছে। পাথরের মজবুত মহলগুলো কিছু গোপন ইতিহাস বুকে নিয়ে টিঁকে রয়েছে। বাকিটা ধ্বংসস্তূপ। দেখলেই কেমন যেন অলৌকিক অনুভূতি হয়! হাড়-পাঁজর বের করা দেওয়াল, কালো কালো ছোপওয়ালা ছাত যেন কিছু বলতে চাইছে! সুরেশ দুর্গটাকে যত দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে! আপাদমস্তক পাথরে তৈরি এই দুর্গকে কামানের গোলাও ভাঙতে পারত না। তবে কী এমন শক্তি এই মজবুত দুর্গকে একেবারে আগাপাশতলা দুমড়ে মুচড়ে দিল—কে জানে!

দেবযানী লক্ষ্য করল, রত্নাবতীর ঘরে একটি পাথরের তাকের ওপরে সাজানো রয়েছে প্লাস্টিকের চিরুনি, কাচের চুড়ি, পুঁতির হার আর ঝাঁঝর! অতুল তার কৌতূহলী দৃষ্টি লক্ষ্য করে হাসল।

—“ওগুলো স্থানীয় বাসিন্দারা রেখে গিয়েছে বাইসা। ওদের বিশ্বাস রাজকন্যা রত্নাবতীর আত্মা এখনও এই দুর্গে ঘুরে বেড়ায়। তাই তাঁর শৃঙ্গারের সরঞ্জাম রেখে যায় ওরা।”

সুরেশ ক্যামকর্ডার দিয়ে এতক্ষণ ভিডিও তুলতেই ব্যস্ত ছিল। কথা নেই, বার্তা নেই আচমকা তার নাকের সামনে দেবযানী এসে হাজির! পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে খোলা জানলা দিয়ে কী যেন দেখছে সে! ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়েছে তার অপূর্ব ঘন কালো লম্বা চুল! হাওয়ায় সেই রেশমী চুল অল্প অল্প উড়ছে! বেচারি সুরেশ মন দিয়ে মহলের ভিডিয়ো তুলছিল, এরকম বাধা পেয়ে বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, “অ্যাই দেবযানী, সামনে থেকে সর! তোর এলোকেশী রূপ তোলার জন্য আমি মোটেও ভিডিয়ো তুলছি না”

—“কীসব ভুলভাল বকছিস!” সুরেশের পেছন থেকে শোনা গেল দেবযানীর শাণিত কণ্ঠস্বর, “আমি তো তোর পেছনে। তাছাড়া এলোকেশী মানে? আমি রীতিমতো টপনট বেঁধে রেখেছি।”

—“হো-য়া-ট!”

সুরেশ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো পেছনে ঘোরে! তার দু’চোখে গভীর বিস্ময়! তাই তো! দেবযানী আদৌ তার সামনে নেই, বরং ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্যামেরায় ওর ইমেজ আসা সম্ভবই নয়। তবে একটু আগে সে ক্যামেরায় যাকে দেখল, সে মেয়েটি কে! সে তৎক্ষণাৎ সামনের দিকে ফিরল! কই! সামনে কেউ নেই তো! কোথায় সেই এলোকেশী যে একটু আগেই লেন্সের একদম সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল! নেই!

সুরেশ তার বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত ভয় টের পেল। তার বিস্মিত দৃষ্টি ছুঁয়ে গেল দেবযানীর মাথার চুল। সত্যি! সে একদম শক্ত করে টপনট বেঁধেছে। তবে সেই মেয়েটি কে যে একেবারে কোমর ছাপানো ঘন মেঘের মতো একরাশ কাজলকালো চুল নিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল! অথচ দেবযানী ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কোনও নারী এ ঘরে নেই! অন্য ট্যুরিস্ট পার্টির কোনও সদস্যা হতে পারত। কিন্তু সেকেন্ডের ভগ্নাংশে সে তবে গেল কোথায়! হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি?

সুজন দেখল সুরেশের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। সে জানতে চায়, “কী হল রে! আর ইউ ওকে?”

সুরেশ তখন রীতিমতো ঘামছে। সে রিওয়াইন্ড করে একটু আগের তোলা ভিডিও ফুটেজটা দেখল! আশ্চর্য! সেখানে কোনও নারীই নেই! পাগলের মতো ফুটেজের মধ্যে সেই অদেখা মেয়েটিকে খুঁজছে যার শুধু পেছনটাই ধরা পড়েছিল তার চোখে। কিন্তু কোথায়! কেউ নেই! শুধু রত্নাবতীর মহলের দৃশ্যই রয়েছে। আর কেউ নেই! কিছু নেই!

সে ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই চেপে গেল। যদিও তখন তার বুকের ভেতরে হৃৎস্পন্দন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে, তবু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল সে। ঢোঁক গিলে বলল, “আই অ্যাম ফাইন।”

তার অবস্থা দেখে গাইড অতুল যেন একটু ব্যঙ্গবঙ্কিম হাসল। তার হাসিটা বেশ অর্থপূর্ণ ও রহস্যময়। সে আস্তে আস্তে বলে, “চলুন স্যার। এবার গোপীনাথ মন্দিরটা দেখে নিন। ওটা অবশ্য তালা দেওয়া থাকে। ভেতরের গর্ভগৃহে যেতে পারবেন না। তবে বাইরে থেকে দেখতে পাবেন। তাছাড়া সন্ধ্যা হয়েও আসছে। আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়।”

—“ভেতরে কেন যাওয়া যাবে না?” সুজন আগ্রহ চেপে রাখতে পারে না, “অন্যান্য মন্দিরগুলো তো খোলা ছিল।”

অতুল মৃদু হাসে, “আসলে গোপীনাথ মন্দিরে রাজকন্যা রত্নাবতীর আদলে তৈরি একটি অতুলনীয় দেবীমূর্তি আছে। অনেক মূর্তিচোরের ওর ওপর নজর ছিল। বেশ কয়েকবার মূর্তিটা ভেঙে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও হয়েছে। তাই সরকার থেকে মন্দিরটাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”

—“কেউ মূর্তিটাকে চুরি করতে পারেনি?”

—“নাঃ,” সে বলল, “চেষ্টা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বললাম না, এ মন্দিরগুলো সব জাগ্রত! চোরেরা ভাঙার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মন্দিরের পাথরগুলো নিজেই সেইসব ভেঙে যাওয়া অংশ মেরামত করে নিয়েছে। এ পাথর মেরামতি করার ওষুধ জানে স্যার। এ পাথরে প্রাণ আছে।”

সুজন স্থিরদৃষ্টিতে গাইডের দিকে তাকায়। ওর হঠাৎ মনে হল, এই ছেলেটা বোধহয় জানে যে ওরা কী উদ্দেশে এসেছে! ওর ঠোঁটের কোণের হাসিটা ভীষণ রহস্যময়! তাছাড়া মুখটাও কেমন যেন চেনা চেনা। সে চোখ কুঁচকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকায়। আগে কোথাও ওকে দেখেছে কি?

—“একটা কথা বলব?” অতুল তার পাথরের মতো শীতল চোখদুটো সুজনের চোখের ওপর রাখল। তারপর গলা নামিয়ে আস্তে আস্তে অনুরোধের সুরে বলল, “আর যাই করুন, মূর্তির গায়ে ভুলেও হাত দেবেন না স্যার। প্লিজ, ওটা করবেন না।”

—“মানে?”

তিন জনই একসঙ্গে যেন তড়িদাহতের মতো কেঁপে ওঠে। কী বলতে চাইছে অতুল! ও কী অন্তর্যামী! সুজন নিজেকে সামলে নিয়ে রুক্ষ কণ্ঠস্বরে বলে, “কী সব উলটোপালটা বলছ! হাউ ডেয়ার ইউ?”

অতুল তখনও তাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। দেবযানীর গা শিরশিরিয়ে ওঠে। ও লক্ষ্য করল, ছেলেটা একবারও চোখের পলক ফেলে না! ওর দৃষ্টি একদম স্থির! অবিকল পাথরের চোখের মতো!

—“চলুন। গোপীনাথ মন্দিরটা দেখে নিই। অতুল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সন্ধে হয়ে আসছে। রাত হয়ে গেলে আবার কী হয় ঠিক নেই।”

ভানগড় ফোর্ট থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ওরা কোনও কথা বলল না। দেবযানী তার স্বভাবগত প্রগলভতা যেন ভুলে গিয়েছে। সুরেশ তখনও বারবার রাণী রত্নাবতীর মহলের ভিডিয়োটা দেখছে। আর সুজনের কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ। তার চোখদুটো অন্যমনস্ক। নিবিষ্ট চিত্তে কী যেন ভেবে চলেছে সে।

ওদের গাড়ির ড্রাইভারের নাম দীননাথ। সে ভানগড় ফোর্ট থেকে তিন কিলোমিটার দূরের একটা গ্রামে থাকে। ওরা তিন জন দীননাথের বাড়িতেই থাকবে। তেমনই ব্যবস্থা হয়েছে। দীননাথও মি. ও’কোনরেরই লোক। একরকম এজেন্টই। এমনিতে সাধারণ দর্শন এক যুবকই বটে, কিন্তু অত্যন্ত চটপটে ও বুদ্ধিমান। দূর্গ থেকে ফেরার পথে সে-ই ওদের মধ্যে প্রথম মুখ খুলল। হেঁড়ে গলায় জানাল, “স্যার, ম্যাডাম, আপনাদের থাকার ব্যবস্থা আমার বাড়িতেই হয়েছে ঠিকই, কিন্তু হোটেলের আরাম, বিলাসব্যসন কিন্তু পাবেন না। জলের অভাব আছে। আর খাওয়াদাওয়া আমার বাড়িতেই হবে, তবে খাওয়ার খরচ আলাদা। আগেই বলে রাখলাম। পরে বাহানা করবেন না।”

সুজন কথাটা শুনেও পাত্তা দিল না। ওরা এখানে বেড়াতে আসেনি। বরং একটা গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন কাজে এসেছে। ফাইভ স্টার হোটেলের অ্যাকোমোডেশন না পেলেও চলবে। সুরেশ কথাটা শুনল কিনা কে জানে! সে তখনও ভিডিও ফুটেজটাই বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে চলেছে। খুব নিস্পৃহভাবে একটা আলগা ‘হুঁ’ বলে ফের ফুটেজে মন দিল। একমাত্র দেবযানীরই ভুরু অসন্তোষে বেঁকে যায়। সে যথারীতি বিরক্ত, “কেন? আশপাশে কোনও ভালো হোটেল নেই?”

হোটেল?” দীননাথ ফিক্ করে হাসল, “এ কি গোয়ার সমুদ্র পেয়েছেন বাইসা, যে হাতের কাছেই হোটেল পাবেন? দিল্লী থেকে দু’শো পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে রয়েছেন আপনি। এটা ভানগড় ফোর্ট! হোটেল তো দূর, এর ত্রিসীমানায় কোনও গ্রামই নেই! সব শুনশান!”

— “সে কী!” দেবযানী অবাক, “ফোর্টের আশপাশেই তো কিছু ঘর দেখলাম যেন মনে হল!”

সে বিষণ্ণভাবে মাথা ঝাঁকায়, “হ্যাঁ। শুধু ঘরই আছে। কিন্তু লোক দেখেছেন কি? দেখবেন না। কারণ লোক নেই। ঘরগুলোও সব ভাঙা ও পরিত্যক্ত!”

—“সে কী! কেন?”

দীননাথ একমুহূর্তের জন্য কী বলবে ভেবে পায় না। তারপর একটু দ্বিধাজড়িত স্বরে বলে, “কী জানি বাই’সা। বেশ কয়েকবার কিছু মানুষ ফোর্টের ধারেকাছে গ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনওবারই টেকেনি। গ্রামের সব ঘর হয় আচমকা ভেঙে পড়ে, নয়তো মহামারীতে গাঁ উজাড় হয়ে যায়! শেষমেষ হাল ছেড়ে দিয়ে প্রাণের দায়ে মানুষেরা এখান থেকে চলে গিয়েছে। ঘরগুলো বহুবছর ধরে পরিত্যক্তই পড়ে রয়েছে। ওখানে কেউ থাকে না।”

—“কেন?” দেবযানী কৌতূহলী, “হঠাৎ কোথাও কিছু নেই, আচমকা ঘর ভেঙে যাবে কেন? ঝড়-টড় বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ…

— “কিচ্ছু না বাই’সা। দীননাথ সংশয়ান্বিত, “বিশ্বাস করুন। আজ পর্যন্ত এখানে কেউ বাস করতে পারেনি। যেমন ভানগড় কী কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল; সেটা আজও অজানা রয়ে গিয়েছে, তেমনি তার আশপাশের গ্রামগুলোও কীভাবে ধ্বংস হয়ে যায়;তাও কারোর জানা নেই। সবাই বলে যে ভানগড়ের অভিশাপের ছায়া নাকি আজও গ্রামগুলোর ওপর কায়েম আছে।”

—“কার অভিশাপ?”

খুব অন্যমনস্কভাবে প্রশ্নটা করল সুজন। তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একঝলক দেখে নিল দীননাথ। আস্তে আস্তে বলল, “কী বলব স্যার, অনেকরকম কথাই আছে। কিন্তু যত গল্প আছে তার সবকণটার মধ্যে একটা জিনিসই এক। অভিশাপ আর ব্ল্যাক ম্যাজিক। যেটা সবচেয়ে ফেমাস সেটা তো জানেনই। রত্নাবতী আর তান্ত্রিক সিঙ্ঘিয়ার কালোযাদুর গল্প। সিঙ্ঘিয়া পাথর চাপা পড়ে মরেছিল। আর তার অভিশাপেই নাকি ভানগড় ধ্বংস হয়। অনেকেই বলে, সিঙ্ঘিয়া আর রত্নাবতীর আত্মা এখনও ঘুরে বেড়ায়। এখনও ওঁদের মুক্তি হয়নি। এছাড়াও আরেকটা গল্পও আছে।”

—“ কীরকম?” দেবযানী কৌতূহলী।

দীননাথ আস্তে আস্তে বলে, “ভানগড়ের প্রতিষ্ঠাতা মাধো সিং যেখানে ভানগড় দূর্গ তৈরি করছিলেন, তার একটু কাছেই গুরু বালুনাথ নামের এক সন্ন্যাসী থাকতেন। মাধো সিং গুরু বালুনাথের কাছে ফোর্ট তৈরি করার অনুমতি চান। বালুনাথ অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর একটা শর্ত ছিল। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, দুর্গ তৈরি হলেও রাজপ্রাসাদের ছায়া যেন তাঁর সাধনপীঠে না পড়ে। যদি কোনওভাবে মহলের ছায়া তাঁর ধ্যান করার জায়গায় এসে পড়ে, তবে তৎক্ষণাৎ ভানগড় ধুলোয় মিশে যাবে।” বলতে বলতেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “মাধো সিং কথা রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর পরবর্তী শাসকেরা গুরু বালুনাথের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। রাজমহল বহরে বাড়তে থাকে। আর যথারীতি তার ছায়া গুরু বালুনাথের সাধনপীঠের ওপর পড়ল। সেই রাতেই নাকি ভানগড় শেষ হয়ে গিয়েছিল।”

—“রিয়েলি?” সুজনের কথায় ব্যঙ্গের সুর মিশল, “তাহলে আসল অভিশাপের মালিক কে? সিঙ্ঘিয়া না বালুনাথ?”

দীননাথ হাসল, “সেটা বলা মুশকিল স্যার! লোকে অনেকরকম কথাই বলে। আমি নিজেই ছোটবেলা থেকে অন্তত দু-তিনটে গল্প শুনে এসেছি, যার মধ্যে এ দুটোই ফেমাস। গুরু বালুনাথের কথা সত্যি হলেও হতে পারে। কারণ ওই ভাঙা দুর্গে তাঁর সমাধিও আছে। তবে আরও দুটো কারণ শুনেছি।”

—“মোগল আক্রমণ, রাইট?”

সে মাথা ঝাঁকায়, “হ্যাঁ স্যার। কেউ কেউ বলে মোগল আক্রমণের ফলে ভানগড়ের সর্বনাশ হয়। আবার কেউ বলে ভানগড়ের প্রতিবেশী রাজ্য আজবগড়ের সঙ্গে যুদ্ধে ভানগড় বিলুপ্ত হয়। কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক জানি না!”

—“থ্যাঙ্ক গড!” সুজন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, “অন্তত দুটো কারণ তো পাওয়া গেল যা যুক্তিযুক্ত। নয়তো ব্ল্যাক ম্যাজিক, অভিশাপ আর জ্যান্ত মন্দিরের ঠ্যালাতেই তো চোখে অন্ধকার দেখছিলাম!”

—“হালকাভাবে নেবেন না স্যার,” দীননাথ চাপাস্বরে বলে, “আমাদের গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা বলেন, রাত হলেই নাকি ভানগড় জেগে ওঠে। আবার সেই অতীতে ফিরে যায়। যা যা ভেঙে গেছে, সব গড়ে ওঠে। রাজমহল সেজে ওঠে। সেজে ওঠে জহুরীবাজারও। আর প্রেতাত্মারা নাকি ঘুরে বেড়ায়! বাইরে থেকে অনেকেই নাকি মেয়েদের হাসি, গান-বাজনা, ঘুঙুরের আওয়াজ শুনেছে!”

সুজন এককথায় উত্তর দিল, “রাবিশ!”

—“কিন্তু ভানগড়ের সামনে ওই বোর্ড? আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ওই বিরাট নিষেধাজ্ঞাটা তবে কেন আছে? কেন সন্ধে না হতেই সরকার ফোর্টের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়?”

দেবযানীর সংশয় তবু কাটে না। সুজন মৃদু হাসল, “সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? ভানগড়ের লোকেশনটা দ্যাখ! ফোর্টটা আরাবল্লির ‘সরিস্কা টাইগার রিসার্ভের’ বর্ডারে! ফোর্টের চতুর্দিকে এত জঙ্গল যে সেখান থেকে বন্যপ্রাণী যখন তখন চলে আসতে পারে! আর সন্ধের পরেই সচরাচর বাঘ বা অন্যান্য মাংশাসী প্রাণীরা বেরোয়। সেজন্যই ট্যুরিস্টদের সেফটির কথা ভেবেই বোর্ড আর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ভূতের জন্য নয়! বুঝেছিস? ভানগড়ের আশেপাশের গ্রামগুলোও গড়ে উঠতে পারেনি সম্ভবত ওই কারণেই। নিরাপত্তার অভাব। কোনও অভিশাপ-টাপ নয়। ওসব স্রেফ গল্প।”

দেবযানী কী বুঝল কে জানে! তবে তার মুখ দেখে খুব আশ্বস্ত হয়েছে বলে মনে হল না। সুরেশ এতক্ষণ ভিডিয়ো ফুটেজ দেখতেই ব্যস্ত ছিল। এবার মুখ তুলে বলল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি এখন?”

—“গোলা কা বাস।” দীননাথ উত্তর দেয়, “আমার গ্রামে। ওখানেই আজকের দিনটা রেস্ট নেবেন। যা করার কাল রাত থেকে শুরু করবেন। তবে আমি আর আপনাদের গাড়ি করে পৌঁছে দিতে পারব না। গোলা কা বাস থেকে পায়ে হেঁটেই আপনাকে ভানগড় দূর্গে আসতে হবে। ট্যুরিস্টরাও বেশিরভাগ তাই-ই আসে।”

একটা আলতো উত্তর দিয়ে ফের চিন্তামগ্ন হয়ে গেল সুরেশ। সে তখনও ভেবে চলেছে; ক্যামেরায় যে মেয়েটাকে সে পেছন থেকে দেখেছিল সে কে! কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেল! আদৌ ঠিক দেখেছে? না পুরোটাই ভ্রান্তি! যদি সত্যিই ওখানে কোনও মেয়ে থাকত তাহলে রেকর্ডেড ফুটেজে তাকে নিশ্চয়ই দেখা যেত। কিন্তু ফুটেজে কেউ নেই! তবে?

দেবযানী আড়চোখে তাকিয়ে দেখল সুজনের মুখের হাল্কা হাসিটাও মিলিয়ে গিয়েছে। সে ও বাইরের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে। তার মনেও একটা চিন্তাই বারবার ঘাঁই মেরে উঠছে।

অতুলকে অত চেনা চেনা লাগছিল কেন? আগে কোথাও দেখেছে কি? কোথায়!

আজ পূর্ণিমার রাত। রুপোলি জ্যোৎস্নায় চতুর্দিক ভেসে যাচ্ছে। পূর্ণ চাঁদের আলো মায়াবী আভায় ধুইয়ে দিচ্ছে ভানগড় ফোর্ট সংলগ্ন অরণ্যকে। আরাবল্লির পাথুরে দেও চিকচিক করে ওঠে জ্যোৎস্নার ইশারায়। আকাশ সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত। গাঢ় নীল প্রেক্ষাপটে টুপটুপ করে চোখ মেলছে নক্ষত্রের দল। দেখলেই মনে হয়, এক রাশ অভ্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আকাশের বুকে। তাদের জ্যোতি যতটা শান্ত, ঠিক ততটাই রহস্যময়! যেন বহু আলোকবর্ষের অভিজ্ঞতা নিয়ে উদগ্র কৌতূহলে তাকিয়ে আছে! বুকের মধ্যে চাপা আশঙ্কার আগুন জ্বলছে তাদের; কে জানে, কী হয়!

আপাতত চতুর্দিকে ছায়া ছায়া মহীরুহের নিশ্চুপ উপস্থিতি। প্রাচীন গাছগুলো যেন রাজকীয় দম্ভভরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কখনও কখনও মৃদু হাওয়া শিরশির করে উঠে তাদের পাতায় পাতায় দুর্বোধ্য কিছু সংলাপ বিনিময় করছে। এছাড়া আর কোনও শব্দ নেই! চারিদিক থম্, নিশ্চুপ! কখনও কখনও মনে হয় গাছের ফাঁক দিয়ে বুঝি কোনও ছায়া সাঁৎ করে সরে গেল! আশঙ্কা হয়, এই নিঃঝুম রাত্রির পেছনে হয়তো কোনও রহস্যাবৃত অন্ধকার ওঁত পেতে আছে! এখনই সমস্ত নীরবতাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে বেরিয়ে আসবে! সে এক প্রবীণ অন্ধকার। যে সব কিছু জানে, সব কিছু দেখেছে!

ঠিক তার মাঝখানেই প্রাগৈতিহাসিক দৈত্যের মতো বিরাট কলেবর নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কুখ্যাত ভানগড় ফোর্ট। দাম্ভিক, রহস্যময় অথচ ভীষণ বিষণ্ণ! দূর্গ নয়, ইতিহাসের হাহাকার! ভানগড়ের রাজমহলের ঠিক মাথার ওপরেই রুপোর থালার মতো ষোড়শী চাঁদ দেখা দিয়েছে। কিন্তু দেখলেই মনে হয়, সে বড় ভয়ে ভয়ে উঁকি মারছে। চাঁদের আলো এসে ছুঁয়েছে ভানগড়ের ভাঙাচোরা দেহ। পেশীবহুল হাতের মতো পাথুরে প্রাচীর এলিয়ে আছে হতাশায়। জ্যোৎস্নাও যেন তার স্বভাবগত চাপল্য হারিয়ে ফেলেছে ভানগড়ের রাজমহলকে স্পর্শ করে। তার উচ্ছ্বসিত আলো দূর্গের কাছে এসেই বিষণ্ণতায় হারিয়ে গিয়েছে। জ্যোৎস্না নয়, যেন এক ফ্যাকাশে পিঙ্গল বিষণ্ণতা চুঁইয়ে পড়ছে ভানগড় ফোর্টের পাথুরে শরীর থেকে। চতুর্দিকে শুধুখাঁ খাঁ করা শূন্যতা! ধ্বংসস্তূপগুলো এক বিরাট কঙ্কালের হাড়-পাঁজরের মতো পড়ে রয়েছে। পাথরের জানলা, দরজাগুলো হাঁ করে রয়েছে ক্ষুধার্ত মানুষের মতো অপেক্ষা করছে একবিন্দু সুখের। পেলেই যেন গিলে নেবে গোটা বিশ্ব-চরাচরের সমস্ত সুখ, সমস্ত আনন্দকে। অথচ শূন্যতা ছাড়া তার পাওয়ার আর কিছুই নেই! সেই শূন্যতাকে পূর্ণতা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে জ্যোৎস্নার আলো! কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে। তার স্তিমিত আভা গিলে নিচ্ছে জমাট অন্ধকার। চতুর্দিকের থমথমে নৈঃশব্দ যেন মুখর হয়ে বলে উঠতে চাইছে, “এ দুনিয়া জীবিত মানুষের জন্য নয়। দুনিয়া জাগতিক কোনও অনুভব বা বস্তুর জন্য নয়! এ অন্য পৃথিবী!”

—“লুকস্ ক্রিপি!” সুরেশ একটা শ্বাস টেনে বলল, “কেমন অদ্ভুত লাগছে না দূর্গটাকে? হরর মুভি শ্যুট করার জন্য আইডিয়াল!”

ওরা তিন জন এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে দূর্গের মেইন গেটে। দেবযানী একঝলক ভানগড়ের বিরাট বহরটাকে মেপে নিল। দিনের বেলাতেই দূর্গটা দেখলে খুব অস্বস্তি হয়। এখন অস্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা ভয়ও অনুভব করল সে। এই সেই ভানগড়! সেই কুখ্যাত ঐতিহাসিক স্থল, যেখানে নাকি আজও অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়ায়! এই সেই অভিশপ্ত কেল্লা যার সম্পর্কে স্বয়ং ড. ইথান ওলসেন লিখেছেন, ‘মোস্ট ডেঞ্জারাস প্লেস!’

সুজনের অনুভূতিটা অবশ্য অন্যরকম। তার বুকের মধ্যে একটা অজ্ঞাত গভীর বেদনা জমেছে।এই বেদনার কোনও উৎস নেই! ভানগড়ের দৃশ্যটা দেখে হঠাৎই তার মনে হল, দুনিয়ায় আনন্দ বলে আসলে কিছুই নেই! ‘সুখ, ‘আশা’, ‘স্বপ্ন’ নামের কোনও বস্তু আসলে হয় না! ওসব মরীচিকা!

অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়! একটু আগেও সে অর্থপ্রাপ্তির কথা ভেবে উত্তেজিত ছিল। কিন্তু আচমকাই সেই উত্তেজনার বদলে এক অদ্ভুত হতাশা ঘিরে ধরল তাকে। কেন? কারণটা অজ্ঞাত!

সুরেশ ফস্ করে একটা সিগারেট ধরাল। দেবযানী ও সুজন ভানগড়ের দিকে তাকিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। লাইটারের আলোর ঝিলিকে সংবিত ফিরে পেল। সুরেশ আয়েশ করে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “কাজ শুরু করা যাক।”

—“শিওর।”

এতক্ষণে সুজন নিজেকে পুরোপুরি ফিরে পেয়েছে। সে তার হাতের এমার্জেন্সি লাইটটাকে মাটিতে নামিয়ে রেখে দুর্গের গেটের তালা খুলতে মন দিল। বলাই বাহুল্য যে এই ডুপ্লিকেট চাবিটা ওদের দীননাথ এনে দিয়েছে। এমনকি গোপীনাথ মন্দিরের তালার চাবিও সে দিয়ে দিয়েছে। কোথায় পেল জিজ্ঞাসা করতেই মৃদু হেসেছিল সে। মুচকি হেসে জানিয়েছিল, “টাকা ছড়ালে বাঘের দুধও পাওয়া যায় স্যার; এ তো সাধারণ কয়েকটা চাবি!”

ওরা আর কথা বাড়ায়নি। স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে মি. জেমস ও’কোনর এই প্রোজেক্টের জন্য প্রচুর টাকা ছড়িয়েছেন। দীননাথও সেই হরির লুট থেকে বাদ যায়নি। চাবিগুলো সেই ইনভেস্টমেন্টেরই ফলাফল। তাই নির্বিবাদে দুটো চাবিই নিয়ে নিয়েছিল।

গেটের তালা খুলতে অবশ্য বেশি বেগ পেতে হল না। সুজন তালায় চাবিটা ঢোকাতে না ঢোকাতেই প্রাচীন ও বিরাট তালাটা সশব্দে কড়াৎ করে খুলে গেল! দেবযানী অবাক হয়ে বলল, “ওয়াও! সো ফাস্ট! এত তাড়াতাড়ি তো আমার বাড়ির তালাও খোলে না! আর এটা তো বহু পুরনো তালা! ফ্র্যাকশন অব সেকেন্ডে খুলে গেল!”

— “কী হল?”

এমার্জেন্সি লাইটের আলোয় সুজনের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সে নিজেও কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। সুরেশ সেটা লক্ষ্য করেই বলে, এনিথিং রং?”

সুজন একটু ইতস্তত করে বলল, “বুঝতে পারছি না তালাটা এত তাড়াতাড়ি খুলল কী করে!”

—“মানে!”

দেবযানী ও সুরেশ দু’জনেই একসঙ্গে শব্দটা বলে ওঠে। ওদের দিকে তাকিয়ে একটু নার্ভাস হাসি হাসল সুজন, “নট আ বিগ ডিল! কিন্তু আমি সবে চাবিটা ঢুকিয়েছিলাম। ঘোরাইনি। ঘোরানোর আগেই তালাটা এরকম শব্দ করে খুলে গেল! স্ট্রেঞ্জ!”

ওরা তিন জনেই তিনজনের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর সুরেশ সশব্দে হেসে ওঠে, “এর মধ্যে স্ট্রেঞ্জের কিছু নেই। তালাটা দেখেছিস? বহুদিনের মরচে পড়া তালা। দেখতেই অমন জগদ্দল, আসলে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গিয়েছে। ওটার জন্য চাবি লাগে না। আমার ধারণা তুই স্রেফ একটা টান মারলেই ওটা খুলে যেত। চাবির দরকারই ছিল না।”

—“হয়তো।”

সুজন আর বিশেষ পাত্তা দিল না। চাবি সমস্যার সমাধান করা ছাড়া তার এখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। যে কাজটা ওরা করতে এসেছে সেটাতেই মনোনিবেশ করা ভালো। এমনিতেই এই জাতীয় দুর্গে মূর্তি কাটার কাজটা যথেষ্টই পরিশ্রমসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ। ড্রিল বিট্স বা গ্রাইন্ডিং স্টোনের মতো অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার উপায় নেই। কারণ ওগুলো ব্যবহার করতে হলে ইলেকট্রিসিটির প্রয়োজন হয়। এই জাতীয় পরিত্যক্ত দূর্গে যা সম্ভবই নয়। আর জেনারেটর ঘাড়ে করে নিয়ে মূর্তি কাটতে যাওয়ার কনসেপ্ট নিতান্তই হাস্যকর! সুতরাং ওদের পুরোনো ও সনাতন পদ্ধতিই অবলম্বন করতে হবে। অর্থাৎ ছেনি-হাতুড়িই ভরসা।

আপাতত তিন জনের কাঁধেই তিনটে ভারি ব্যাকপ্যাক ঝুলছে। তার মধ্যে রয়েছে চিজেল বা ছেনি, হাতুড়ি, এচিং টুলস, মার্কার, ম্যানুয়াল হ্যাক স এর মতো ‘ভ্যান্ডালস টুলস্’। এছাড়াও আছে টর্চলাইট, মেজারিং টেপ, নাইট ভিশন হাই ডেফিনিশন গগল্স, ডাস্ট মাস্ক, সেফটি গগল্সের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। সুজনের ব্যাকপ্যাকে অবশ্য এসব ছাড়াও একটি লাইসেন্সড গান রয়েছে। রাত্রে কোনও প্রেতাত্মা আসবে কি না জানে না, কিন্তু বন্যপশুর আসার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে। আজ রাতে ওদের দীননাথ পৌঁছে দেয়নি। গোলা কা বাস থেকে তিন কিলোমিটার হেঁটেই এসেছে ওরা। হেঁটে আসাটা খুব বড় ব্যাপার নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওদের হেঁটেই অপারেশনে যেতে হয় কিন্তু ভানগড় ফোর্টের পথটা একটু আলাদা। একেই শুনশান পাহাড়ি রাস্তা, তার ওপর বন্যজন্তুর ভয়। তাই লাইসেন্সড রিভলবারটা সঙ্গেই নিয়েছে সুজন ভানগড় ফোর্টের পাথুরে রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল সুজন। পেছনে সুরেশ আর দেবযানী। সুজনের স্মৃতিশক্তি প্রায় কম্পিউটারের মতো কোনও জায়গা একবার দেখলে সে ভোলে না। অতুল যখন ওদের গোপীনাথ মন্দিরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সে গোটা রাস্তাটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জরিপ করে নিয়েছে। অবশ্য সঙ্গে ভানগড়ের ম্যাপটাও আছে। অতুল ওদের হনুমান গেট দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। একটু এগোতেই হনুমান মন্দিরটাও চোখে পড়ল। তবে এখন মন্দির বন্ধ। অর্থাৎ পূজারীও অনুপস্থিত। অতুলই জানিয়েছিল, সন্ধ্যে ছ’টার পর এখানে আর কেউ থাকে না। এমনকী গেটকিপারও নয়। তাই ভানগড় এখন সম্পূর্ণ জনশূন্য।

অতুল ওদের একটু ঘুরপথে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুজন সোজা পথটাই ধরল। হনুমান মন্দির একটু ছাড়িয়ে যেতেই ডান দিকে পড়ল সেই ভগ্নস্তূপ। এখানে কী ছিল, ভগবানই জানেন। কোনও মহল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু আগেরদিন যেটা তেমন প্রকটভাবে অনুভব করেনি, রাতের বেলায় সেটাই প্রবলভাবে দেখা দিল! একটা চূড়ান্ত দুর্গন্ধ এসে ঝাপ্টা মারল ওদের নাকে! প্রথমদিকে অতটা বোঝা যায়নি, কিন্তু যত এগোচ্ছে, দুর্গন্ধটা ততই বাড়ছে। বাঁ দিকে ‘মোরোঁ কী হাভেলি’ এসে পড়তেই সেই পচা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল ওদের। পাকস্থলীর ভেতরটা যেন পাক দিয়ে উঠল!

—“ওঃ!” দেবযানী আর থাকতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গেই মুখে রুমাল চাপা দেয়, “কী জঘন্য গন্ধ! এ তো ক্রমশই বাড়ছে! আগে জানলে পারফিউম নিয়ে আসতাম!”

সুরেশ হাতের সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে নাক কুঁচকোয়, “এ কীরকম দুর্গন্ধ রে! কাল দিনের বেলায় তো পাইনি!”

—“আশপাশে কোনও ইঁদুর বা অন্য কোনও প্রাণী মরেছে বোধহয়!” সুজন কিন্তু নিস্পৃহ, “তারই পচা গন্ধ পাচ্ছিস।”

—“টেরিল স্মেল! মরা ইঁদুরের গন্ধ এত মারাত্মক!” দেবযানী কোনওমতে নিজেকে সামলায়, “আমার অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসছে।” সুরেশ আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, “উঁহু! কোনও মরা ইঁদুর বা অন্য কোনও প্রাণীর পচনের গন্ধ এরকম হয় না। আমি এই গন্ধটা চিনি। মনে হয় যে…”

—“কী মনে হয়?”

সুজনের প্রশ্নে সে একটু থমকে গেল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “যদিও প্র্যাকটিক্যালি ব্যাপারটা অসম্ভব, তবু মনে হয় যে এক নয়, একাধিক মানুষ মারা গিয়েছে। আর তারই এত দুর্গন্ধ! আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে একটা গোটা ফ্যামিলি আত্মহত্যা করেছিল। প্রথমে কেউ নোটিস করেনি। তোর মতোই সবাই ভেবেছিল যে কোনও জীব-জন্তু মরেছে। কিন্তু দু’দিন পরেই দুর্গন্ধের চোটে সবার টনক নড়ল। তখন পাশের ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে…”

—“তুই বলতে চাইছিস যে এটা মরা মানুষের পচা গন্ধ?” সুরেশকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বলল সুজন, “পুরো ইললজিক্যাল! এখানে মানুষ কোথা থেকে আসবে!”

সুরেশ চুপ করে যায়। দেবযানী একটু চুপ করে থেকে বলে, “মানুষ তো ছিল একসময়ে! তাদের কী হয়েছিল কেউ জানে না! ভানগড় যেদিন ধ্বংস হয়েছিল, সেদিন কত মানুষ এই ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়েছিল কে জানে!”

বলতে বলতেই সে সামনের ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকায়। রহস্যময় জ্যোৎস্নায় নীলাভ হয়ে আছে সেই ধ্বংসস্তূপ! ইঁট আর পাথরের পেল্লায় চাঁইগুলো দেখলেই ভয় করে! ওর নীচে কী আছে কে জানে! কয়েকশো বছর কেটে গিয়েছে, কেউ এই পাথরগুলোকে সরায়নি। হয়তো কোনওদিন ওর নীচেই চাপা পড়ে দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল হাজার হাজার হতভাগ্য মানুষ। কেউ তাদের সাহায্য করেনি! কেউ তাদের উদ্ধার করতে আসেনি। কে জানে! আজও হয়তো তারা ওখানেই সমাধিস্থ হয়ে আছে!

ইতিহাসের ভগ্নস্তূপের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল দেবযানী। আচমকা একটা কনকনে ঠান্ডা দমকা হাওয়া তাকে ছুঁয়ে গেল! কেঁপে উঠল সে!

দেবযানী!” সুজন পরম বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে, “তুই কি ভয় পাচ্ছিস? কাঁপছিস কেন?”

ততক্ষণে এক অদ্ভুত শীতলতা ঘিরে ধরেছে দেবযানীকে। সে নিজেও আবহাওয়ার এই আকস্মিক পরিবর্তনে অবাক হল। আশ্চর্য বিষয়! একটু আগেও তো রীতিমতো গরম লাগছিল! প্রচন্ড ঘামছিল বলেই জ্যাকেটটা খুলে ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তবে হঠাৎ করে এই বরফশীতল হাওয়া এলো কোথা থেকে! দেবযানী টের পেল, তার প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে। কিন্তু সুজন কোনওরকম দুর্বলতা পছন্দ করে না। না মানসিক, না শারীরীক। তাই কোনমতে সামলে নিয়ে বলল, “না, তেমন কিছু নয়। সামান্য ঠান্ডা লাগছে।”

—“ঠা-ন্ডা!” সুজন তাকে এমনভাবে দেখছে যেন দেবযানী এই মুহূর্তে মঙ্গলগ্রহ থেকে এল। অদ্ভুত সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল, “এই ভয়ংকর গরমে তোর ঠান্ডা লাগছে! জ্বর-টর বাঁধাসনি তো? তুই লাস্ট মোমেন্টে ডোবাবি দেখছি!”

— “না না…” দেবযানী একটু কুণ্ঠিত হয়ে কিছু বলতেই যাচ্ছিল, তার আগেই সুরেশ এগিয়ে এল তার দিকে। কোনও কথা না বলে দেবযানীর পিঠের ব্যাকপ্যাক ঘেঁটে বের করে আনল জ্যাকেটটা। তারপর তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা পরে নে। আর দুর্গন্ধ বেশি মনে হলে আমার কাছে থ্রি এম সিক্স থাউজ্যান্ড ওয়ান অর্গানিক ভেপার কার্টরিজ আছে, নিয়ে নে। মরা জন্তু জানোয়ারের গন্ধ আমারও সহ্য হয় না। সুজন তো সবাইকেই নিজের মতোই ভাবে!”

দেবযানী সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে সুরেশের দিকে তাকিয়ে জ্যাকেটটা গায়ে পরে নিল। সুরেশ মৃদু হেসে মাস্কটাও এগিয়ে দেয়। সুজন ভ্রূ ভঙ্গি করে ব্যাপারটা দেখল। মুখভঙ্গিতেই স্পষ্ট যে ব্যাপারটা আদৌ তার পছন্দ হয়নি। যে কোনওরকম দুর্বলতাকে সে অপছন্দ করে। তার মতে, পাথরের কারবারিকে পাথরের মতোই শক্ত হতে হয়। ঝড়, জল, রোদ— কোনওরকম দুর্যোগই তাকে টলাতে পারে না। সে নিজেও সেই নিয়মই মেনে চলে। রোগ, প্ৰতিকূল পরিস্থিতি, ভয়, কোনওকিছুই তাকে আটকাতে পারেনি। এই সামান্য দুর্গন্ধে পিছু হটার পাত্র সে নয়। তাই এবার একটু বিরক্ত হয়েই বলল, “হয়েছে? তাহলে এগোনো যাক?”

—“আয়ে আয়ে স্কিপি!” সুরেশ হেসে ফেলে, “আফটার ইউ।” রাতের ভানগড়ের রাস্তা দিয়ে ফের হেঁটে চলল ওরা তিন জন। অন্ধকার গায়ে মেখে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল গন্তব্যের দিকে। সুজনের একহাতে টর্চ, অন্য হাতে এমার্জেন্সি লাইট। এমার্জেন্সিটা অবশ্য এখন অফ করা রয়েছে। বেশি আলো জ্বেলে এখন কাজ নেই। মানুষ যদি ভূতের ভয়ে না ও আসে, কোনও বন্যপ্রাণী আসবে না এমন গ্যারান্টি নেই।

সুজনের ঠিক পেছনেই দেবযানী। তার হাতেও টর্চ। সুরেশ যথারীতি তার হাই ডেফিনিশন ক্যামকর্ডার নিয়ে রাতের ভানগড়ের দৃশ্য তুলছে। ওর ক্যামকর্ডারটা আবার নাইট-ভিশন। সে এখন বাঁ দিকে জহুরি বাজারের ছবি তুলতে ব্যস্ত। এক সময়ে এখানে এক আলো ঝলমলে, জনবহুল ও ব্যস্ত বাজার বসত। এখন শুধুই কতগুলো চৌকো ইট আর পাথরের ভগ্নাবশেষ পড়ে রয়েছে। প্রাচীন হলেও গাঁথুনি দেখলেই বোঝা যায় ঠিক কতখানি শক্ত-পোক্ত ছিল! কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ হওয়ার দরুণ শ্যাওলার কালশিটে পড়েছে শুধু। বাকিটা এখনও মজবুত কাঠামোর ওপরে দাঁড়িয়ে আছে।

সে আস্তে আস্তে দূরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে-থাকা অন্ধকার রাজমহলের দিকে ক্যামেরা জুম করল! এখনও দেখলে আন্দাজ করা যায় কোনওসময়ে কী রাজকীয় গরিমা ছিল তার। আজ কিছুই নেই! তবু দেখামাত্রই গা শিরশিরিয়ে ওঠে।

সুরেশ চলতে চলতেই টের পেল, পেছনে নিশ্বাসের শব্দ। ঠিক তার পিছনেই লঘু পায়ের আওয়াজ পেয়ে বুঝল, দেবযানী নির্ঘাত পিছিয়ে পড়েছে। সে ক্যামেরা থেকে চোখ না সরিয়েই হাসল, “দেবযানী, একটু পা চালিয়ে। নয়তো সুজনের ঝাড় তোর কপালে নাচছে!”

—“ঝাড় তো তুই খাবি মড়া!”

সুরেশের কিছুটা সামনে থেকেই দেবযানীর হাসিমাখা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সুরেশ চমকে সেদিকেই তাকাল! স্তম্ভিত হয়ে দেখল, দেবযানী তার পেছনে নয়, বরং বেশ খানিকটা এগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! সে হাসতে হাসতেই বলল, “ভিডিয়োর চক্করে তুই-ই আমাদের থেকে পিছিয়ে পড়েছিস! তাড়াতাড়ি আয়।”

—“তুই সামনে! তবে!” বিদ্যুৎবেগে পিছনদিকে ফিরল সুরেশ। কিন্তু সেখানে শুধুই আবছা অন্ধকার আর শূন্যতা! আর কেউ নেই! এবার বিস্ময়ের ধাক্কাটা এত জোরালো মাত্রার ছিল যে বেশ কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে বাকশক্তি হারাল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিহ্বলভাবে বলল, “তবে… তবে পেছনে কে?”

—“স্বপ্ন দেখছিস নাকি?” সুজন এবার রেগে যায়, “কখনও দেবযানীকে সামনে দেখছিস, কখনও পেছনে! শুরুটা করেছিস কী?”

—“কিন্তু আমি স্পষ্ট পায়ের শব্দ শুনেছি! নিঃশ্বাসের শব্দও পেয়েছি, কেউ ছিল! কেউ পিছনে ছিল!”

সুরেশ টের পেল, তার স্নায়ুকে কাঁপিয়ে একটা ভয়ের স্রোত উঠে আসছে। সে আরেকবার বিভ্রান্তদৃষ্টিতে পেছনের দিকে তাকায়। সুজন তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হাতের টর্চ তুলে ধরে সেদিকেই আলো ফেলল। কঠিন গলায় বলল, “দ্যাখ, আছে কেউ?”

টর্চের আলোয় শুধু ভানগড়ের পাথর বাঁধানো রাস্তা দেখা গেল। আর ভাঙা কালো কালো পাথরের চাঁই! জহুরিবাজারে ছাতহীন দালানগুলো যেন মুন্ডুহীন কবন্ধের মতো কৌতুকে ‘হো হো’ করে হেসে উঠল!

আর কেউ নেই! কিছু নেই!

গোপীনাথ টেম্পল সম্ভবত ভানগড় ফোর্টের বৃহত্তম মন্দির। অন্যান্য মন্দিরগুলোর তুলনায় অনেকটা জায়গা ছড়িয়েও আছে। দিনের বেলায় আপাদমস্তক হলুদ পাথরে তৈরি মন্দিরটি সূর্যের সোনালি আভায় ঝলমল করে। সামনে অগুনতি পাথরের সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে মন্দির অবধি। ওরা দিনের বেলায় মন্দিরটিকে দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিল। যেখানে গোটা দূর্গটাই প্রায় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ধুলোয় মিশে গিয়েছিল, সেখানে গোপীনাথ মন্দির এখনও সম্পূর্ণ অক্ষত ও অবিকৃত অবস্থায় আছে! মন্দিরচূড়ার সূক্ষ্ম কারুকার্য ও স্থাপত্যশিল্প দেখলে হতবাক হয়ে যেতে হয়। মন্দিরটির সর্বমোট তিনটি গর্ভগৃহ। যার মধ্যে দুটো গর্ভগৃহ ওরা দেখেছে। তৃতীয়টিই প্রধান ও আভ্যন্তরীণ। সেটাই এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন আর দেখা যায় না। কিন্তু বাইরের দুটো গর্ভগৃহ দেখলেই বোঝা যায়যে সেটি কী বস্তু হবে! সরকার সম্ভবত ভানগড় ফোর্ট সম্বন্ধে উদাসীন। তাই অন্যান্য দুর্গের মতো এই দুর্গটির পুনর্নির্মাণ হয়নি। আর সেই উদাসীনতার কারণেই গোপীনাথ মন্দিরের গর্ভগৃহগুলির ছাতের সৌন্দর্য ও সৌকর্য খানিকটা নষ্ট হয়েছে। প্রধান স্তম্ভের গায়ে চমৎকার এক নৃত্যরতা যক্ষিনীমূর্তির ভাস্কর্য ছিল। তবে অবহেলায় আর কালের আঘাতে মূর্তিটির মাথা ও দুই হাত ভেঙে গিয়েছে। নষ্ট হয়েছে ভাস্কর্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও যা রয়েছে, তাও যথেষ্টই বিস্ময়কর! দেবযানী তো দেখেই রীতিমতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, “ফ্যান্টাস্টিক আর্কিটেকচার! অনেকটা সাউথ ইন্ডিয়ার বিজয়নগরের মন্দিরগুলোর মতো না? এক্সোটিক ওয়ার্ক উইথ রাজপুতানা আর্কিটেক্ট!”

সুজন সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেও তার সতর্ক চোখের নিষেধাজ্ঞা পড়তে পেরেছিল দেবযানী। তারা যে মন্দিরের স্থাপত্য ও সৌন্দর্য সম্পর্কে রীতিমতো ওয়াকিবহাল তা সে প্রকাশ করতে চায় না। বিশেষ করে অতুলের সামনে। অগত্যা দেবযানী চুপ করে গিয়েছিল। কিন্তু মনে মনে গোপীনাথ মন্দিরের আভ্যন্তরীণ গর্ভগৃহটি দেখার জন্য আরও বেশি ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। যা প্রকাশ্যে আছে তাতেই যদি এত কারুকাজ হয়, না জানি অপ্রকাশ্য শিল্পটি আরও কতগুণ সুন্দর হবে! অতুল অবশ্য মৃদু হেসে বলল, “গোপীনাথ কৃষ্ণের আরেক নাম। আগে শ্রী রাধিকার সঙ্গে বংশীধারী কৃষ্ণের চমৎকার যুগলমূর্তি ছিল শুনেছি। তবে এখন নেই। হয়তো কোনও মূর্তিচোর ফাঁকেতালে সরিয়ে নিয়েছে।”

বলতে বলতেই তার মুখে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ বঙ্কিম হাসি ভেসে উঠল। সুজন দাঁতে দাঁত পিষে চাপা গলায় বলেছিল, “পারলে এই ব্যাটার মাথাতেই ছেনি আর হাতুড়ি ছুঁড়ে মারি। অসহ্য!”

এই প্রথম সুজনের কথায় সম্পূর্ণ একমত হয়েছিল দেবযানী। সত্যিই অসহ্য! তার থেকেও অসহ্য ওর এই নিষ্পলক চাউনি! একেবারে মরা মাছের মত চোখ! সে লক্ষ্য করে দেখেছে, লোকটা একবারের জন্যও চোখের পলক ফেলে না! আশ্চর্য!

ওরা সেদিন দিনের আলোয় দেখেছিল মন্দিরটাকে। আর আজ, গভীর রাতে!

নরম জ্যোৎস্না অলৌকিক ইশারায় গলে গলে পড়ছিল গোপীনাথ মন্দিরের চূড়া বেয়ে। দিনের আলোয় এর রহস্যময়তা বোঝা যায়নি। কিন্তু রাতের আলো-আঁধারিতে মন্দিরটাকে দেখে কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল দেবযানীর! কোনও এক দৈবীশক্তি যেন মাথা উঁচু করে ঘুমিয়ে আছে! পাথরের স্তম্ভগুলোর কারুকাজ যেন আরও জীবন্ত। চাঁদের আলো ছলকে পড়ছে পাথরের মসৃণ গায়ে! ভেতরের অন্ধকার গর্ভগৃহ যেন ইশারায় কাছে ডাকছে ওদের। কী যেন এক অব্যক্ত সম্মোহনী শক্তি চুম্বকের মত টানছে!

—“সুরেশটা আবার কোথায় গেল?”

সুজন একটু বিরক্তিমিশ্রিত গলায় বলল, “আমাদের পেছন পেছনই তো আসছিল। এখন কোথায় গায়েব হল!”

দেবযানী প্রমাদ গোণে। সুরেশের এই এক বদভ্যাস। একবার ভিডিয়ো তুলতে শুরু করলে তার আর হুঁশ থাকে না। নির্ঘাৎ জ্যোৎস্নালোকিত ভানগড় ফোর্টের ভিডিয়ো তুলতে তুলতে পিছিয়ে পড়েছে! এই প্রথম নয়, এর আগেও সে এরকম কাণ্ড করেছে। একবার এক প্রাচীন গুম্ফায় ঢুকে ঠিক এভাবেই হারিয়ে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত দেবযানী আর সুজন যখন তাকে গরুখোঁজা খুঁজে হতক্লান্ত, তখনই ক্যামেরা হাতে বাবু এসে হাজির! এসেই ভারি নিরীহ গলায় বলেছিল, “আমায় খুঁজছিলি?”

সেদিন সুজন তাকে মারতে বাকি রেখেছিল। আজও বিরক্ত হয়েই বলল, “এই ছেলেটা কিছুতেই সিরিয়াস হবে না! ওর কী মনে হয়? এইসব জায়গা রাতের বেলা খুব সেফ? ও কি কনডাক্টেড ট্যুরে এসেছে নাকি! সব জোগাড়যন্ত্র মাটি করবে দেখছি! প্রত্যেকবারই এই এক কেস।”

রেগেমেগে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল সুজন। কিন্তু একটা অস্বাভাবিক শব্দ শুনে থেমে গেল! ওটা কীসের আওয়াজ? জলের নয়? স্থির নৈঃশব্দের মধ্যে একটা জোরালো ছলছল শব্দ কানে আসতেই চমকে উঠল ওরা! মন্দিরের ডান দিকে একটা ড্রেইন আছে। তাতেই জলের শব্দ হচ্ছে! কিন্তু জলের শব্দ হচ্ছে কেন! যে মন্দির পরিত্যক্ত, যেখানে বিগ্রহ নেই, বিগ্রহকে স্নান করানো হয় না বা পুজো করা হয় না, সেখানে জল যাওয়ার এমন কুলকুল আওয়াজ হতেই পারে না! এক প্রাচীন ধ্বংসস্তূপের ভেতরে এত রাত্রে তবে কাকে স্নান করানো হচ্ছে? সে কি কোনও দেবতা? না!

—“শুনলি?”

দেবযানীর কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল। তার হৃৎপিণ্ড এখন প্রায় টারবাইনের গতিতে চলতে শুরু করেছে। সুজনের মুখেও এই প্রথম সামান্য ভয়ের আভাস দেখা গেল। সে আস্তে আস্তে বলল, “শুনলাম!”

— “এত রাতে হন্টেড ফোর্টে জলের আওয়াজ! মন্দিরে কেউ আছে!” দেবযানী উত্তেজিত, “সুজন, আমি তোকে আগেই বলেছিলাম, এটা হন্টেড প্লেস! ইথানও বলেছিলেন।”

—“সে তো দীননাথও বলেছিল যে রাত হলে ভানগড় জেগে ওঠে, প্রাচীন ভগ্নস্তূপ মেরামত হয়ে যায়, ভূতেরা মিটিং করতে আসে, নাচে-গায়; তেমন কিছু দেখেছিস কি?”

সুজনের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। সে এবার টর্চটা রেখে দিয়ে ফট্ করে জোরাল এমার্জেন্সি লাইটটা জ্বেলে দিল। দেবযানী ভয়ার্ত ও বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টিতে দেখল তার লাইসেন্সড গানটাও হাতে উঠে এসেছে। তারপরই একদম গট্ করে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে, “আমার ধারণা কেউ আমাদের সঙ্গে গেম খেলছে। আমি এর শেষ দেখেই ছাড়ব।”

দেবযানী প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, “যাস না সুজন। কেউ, কিছু তো আছেই! দাঁ-ড়া!”

সুজন শুনল না। বরং একহাতে এমার্জেন্সিলাইট ও অন্য হাতে উদ্যত বন্দুক নিয়ে একরকম দৌড়েই উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। দেবযানী সভয়ে দেখল, সুজন মিলিয়ে গেল সার সার স্তম্ভের মাঝখান দিয়ে। প্রাথমিকভাবে শুধু তার এমার্জেন্সি লাইটের আলো দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু মন্দিরের অভ্যস্তরস্থ জমাট অন্ধকার বুঝি হাঁ করেই ছিল। সে একেবারে দানবের মত গ্রাস করতে শুরু করল আলোকে। এমার্জেন্সির আলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে মিলিয়েই গেল অন্ধকারের মধ্যে।

দেবযানীর বুকের ভেতরের কাঁপুনিটা আরও বাড়ছে। সুজন কোথায় গেল! এখন তার হাতের আলোটাও আর দেখা যাচ্ছে না। সুরেশও কোথায় কে জানে! অপরিসীম অন্ধকারের মধ্যে, নিঃসঙ্গ মেয়েটির মনের মধ্যে আঁচড় কাটছে ভয়! সে একবার গোপীনাথ মন্দিরের চূড়ার দিকে তাকাল। এখন এই পাথুরে স্থাপত্যকেও ভীষণ জীবন্ত মনে হচ্ছে। অতুল বলেছিল, মন্দিরগুলো জীবন্ত! তার কথাকে প্রায় হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল সুজন। কিন্তু এখন সেই কথাটাকেই চরম সত্যি বলে মনে হচ্ছে। দেবযানীর চোখ একবার ছুঁয়ে গেল চতুর্দিকের ধ্বংসপ্রাপ্ত দালানগুলোকে। চাঁদের আলোয় কেমন যেন রহস্যময় ছায়ামূর্তি মনে হচ্ছে তাদের। এত শক্তিশালী, এত দাম্ভিক দূর্গকে কোন্ বিধ্বংসী শক্তি এমনভাবে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল! অথচ মন্দিরগুলোর কিছুই হল না! কেন?

হঠাৎই তার মনে পড়ল অতুলের কথা। সে বলেছিল, “ভানগড়ের মন্দিরগুলোর মধ্যে কোনও অলৌকিক শক্তি নিশ্চয়ই আছে। নয়তো একরাতের মধ্যে রীতিমতো মজবুত একটা কেল্লা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল, অথচ মন্দিরগুলো একদম অটুট থাকল কী করে?”

কথাটাকে চিরসত্য বলেই মনে হল দেবযানীর। সে ভয়ার্ত, ব্যাকুলস্বরে ডাকল, “সু-জ-ন!”

কিন্তু তার ডাকের কোনও প্রত্যুত্তর এল না। মন্দির নিশ্চুপ। দেবযানীর মনের মধ্যে আশঙ্কার মেঘ গুড়গুড়িয়ে ওঠে। তার মনে হল,

শীতটা যেন ক্রমশই বাড়ছে। তারসঙ্গে বাড়ছে দুর্গন্ধের প্রকোপও। তার মুখের মাস্কও সে প্রাণান্তিক দুর্গন্ধকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না! গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও সে সমস্ত শক্তি নিংড়ে দিয়ে আবার চেঁচিয়ে উঠল, “সু-জ-ন!”

তাও কোনও উত্তর নেই! সে নিরূপায় হয়ে এগিয়ে গেল মন্দিরের সিঁড়ির দিকে। সুজনকে সে এভাবে ছেড়ে যেতে পারে না। ওরা বহুবছর ধরে একসঙ্গে একই কাজ করে আসছে। আজ এই চূড়ান্ত মুহূর্তে তাকে একলা ছেড়ে দেবযানী পালিয়ে যেতে পারে না।

গোপীনাথ মন্দিরের সামনে সারসার পাথরের প্রাচীন সিঁড়ি জ্যোৎস্নায় ঝকমক করছে। সে আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করল। সিঁড়ির সংখ্যা খুব বেশি হওয়া উচিত নয়। সর্বসাকুল্যে পঁচিশ কী ত্রিশটি সিঁড়ি রয়েছে। কিন্তু আজ বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙেই হাঁফ ধরে গেল দেবযানীর! নিজের অবস্থা দেখে সে নিজেই বিস্মিত! এ তো কিছুই নয়, এরকম খাড়া, পাথুরে কয়েকশো সিঁড়ি ভেঙে ওরা কত মন্দিরে ঢুকেছে অনায়াসেই। হাঁফ ধরা তো দূর, সামান্য ক্লান্তিও বোধ করেনি। অথচ আজ মাত্র কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল!

দেবযানী অপরিসীম জেদে দাঁতে দাঁত পিষল। সেও এর শেষ দেখেই ছাড়বে। গোঁয়ারের মতো একের পর এক সিঁড়ি ভেঙে উঠতেই থাকল মন্দিরের দিকে। দম ধরে আসছে, হাত-পা ভারি হয়ে আসছে, বুকের ওপর একটা প্রচণ্ড ভার টের পাচ্ছে, যেন কেউ একটা পাথর বসিয়ে দিয়েছে বুকের ওপরে, তবু থামছে না। আর তো মাত্র কয়েকটা সিঁড়ি, তারপরেই…

কিন্তু সামনের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল সে! একী! এখনও তো সামনে অদম্য, উদ্ধত সিঁড়ির অগুনতি ধাপ! পঁচিশ কী ত্রিশটা নয়! এ একেবারে সীমাহীন! গোপীনাথ মন্দিরের সামনে এত সিঁড়ি কবে এল! কখনই বা এল!এর যে শেষই দেখা যায় না! কোথায় গিয়ে থেমেছে এ সিঁড়ি? দেখলে তো মনে হয় একেবারে নিরুদ্দেশের পথে চলেছে! কোথায় মন্দিরের কারুকার্যমন্ডিত চূড়া! কোথায় পাথরের স্তম্ভ! কিছুই দেখা যায় না। সামনে শুধু সারে সারে পাথরকাটা সিঁড়ি যার শেষ নেই! তবে শুরু কোথায়?

নীচের দিকে দেখতেই রক্ত হিম হয়ে যায় দেবযানীর! এ কী! তার পেছনেও তো অগুনতি সিঁড়ি ধাপ কেটে কেটে নেমে গেছে! সে আপ্রাণ নীচের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে তার মাথা ঘুরতে শুরু করল! কী সর্বনাশ! এ সিঁড়ির যেন শুরুও নেই! কয়েকশো নয়, অন্তত কয়েকহাজার তো বটেই! এতগুলো সিঁড়ি সে কখন ভাঙল! কখন থেকেই বা হেঁটে চলেছে! নীচের কোনও দৃশ্যই চোখে পড়ছে না! কিচ্ছু নেই! শুধু সামনে আর পেছনে ধাপে ধাপে সিঁড়ির সার ব্যঙ্গ করে চলেছে! না এগোনোর উপায় আছে, না পিছোনোর!

দেবযানীর মনে হচ্ছিল তার হাত-পা ক্রমাগত ভারি হয়ে আসছে! যেন এ তার নিজস্ব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নয়। ভারি পাথরের তৈরি হাত-পা! বুকের ভিতরে ভীষণ কষ্ট! মনে হয়, হৃৎপিণ্ডটাও ক্রমশ পাথর হয়ে যাচ্ছে! সে আপাদমস্তক পরিণত হচ্ছে এক পাথরের মূর্তিতে যাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব! যত এগোচ্ছে ততই যেন একটু একটু করে তাকে গ্রাস করছে পাষাণ! প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত ভারি হয়ে উঠছে তার দেহ। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে বুঝতে পারল, তার দেহের তাপমাত্রা ক্রমাগতই কমছে। শিরার মধ্যে রক্তসঞ্চালন ধীর হয়ে আসছে আস্তে আস্তে। শীত করছে, অসম্ভব শীত করছে তার!

জ্যোৎস্নার আলো একঝলক এসে পড়ল দেবযানীর দুই হাতের ওপর। সেই সামান্য আলোতেও সে ভয়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল, তার হাতদুটো আস্তে আস্তে হলুদবর্ণ ধারণ করছে! অবিকল সেই হলুদ পাথরের মতো, যে পাথর দিয়ে বানানো হয়েছে গোটা গোপীনাথ মন্দির! দেবযানী ভয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তার পা একচুলও নড়ল না! যেন চিরকালের জন্য গেঁথে গিয়েছে পাথরের মধ্যে।

সে ভয়ে চিৎকার করে উঠতে চায়! কিন্তু আশ্চর্য, একটু শব্দও বেরোল না তার মুখ থেকে। শুধু এইটুকু বুঝতে পারল, সে আস্তে আস্তে পাথরের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!

পাথরের মতো হিমশীতল!

সুরেশ রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল।

এমনিতেই সে অসম্ভব ভয় পেয়েছিল। সুজনকে সেকথা বারবার বলেছে। বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, সত্যিই তার পেছনে কেউ ছিল! কোনও মানুষের দ্রুত নিঃশ্বাসের শব্দ, হেঁটে আসার আওয়াজ সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে! কোনও সন্দেহই নেই, যে কেউ তাদের ফলো করছে!

কিন্তু সুজন তার একটা কথাও বিশ্বাস করেনি। উলটে হেসে বলেছে, “ওসব পাবলিকের গাঁজাখুরি গল্পের এফেক্ট! তুই হ্যালুসিনেট করছিস।”

সুরেশের কয়েকমুহূর্তের জন্য মনে হয়, হয়তো সুজনই ঠিক বলছে। ভানগড় সম্পর্কে নানারকম ভৌতিক ও অলৌকিক গল্প শুনতে শুনতে তার উত্তপ্ত মস্তিষ্ক উদ্ভট উদ্ভট কল্পনা করছে। হয়তো তার পিছনে সত্যিই কেউ ছিল না। অন্য কোনও প্রাকৃতিক শব্দ শুনে সে খামোখাই চমকে উঠছে। ব্যাপারটার একটা যুক্তিসঙ্গত সমাধান খুঁজে পেয়ে তখনকার মতো সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। আশ্বস্তও হয়েছিল।

কিন্তু দেবযানী আর সুজনের পিছনে যেতে যেতেই হঠাৎ থমকে গেল সে! আবার! আবার সেই শব্দ! শুধু পায়ের শব্দই নয়, এবার যেন কারোর পায়ে ধাক্কা লেগে নুড়ি-পাথরের গড়িয়ে যাওয়ার আওয়াজ! শুধু তাই নয়; পোষাকের খসখসও একদম পরিষ্কার শুনতে পেল সে! না, কোনওরকম ভ্রান্তি নয়। পেছনে কেউ আছে! কেউ তাদের অজান্তেই ফলো করছে!

—“কে?”

সে তৎক্ষণাৎ সপাটে পিছনে ফিরল। নাঃ, তার সন্দেহ অমূলক নয়! ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে কেউ! তার আবছায়া সিল্যুয়েট রাতের প্রেক্ষাপটে একদম পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। সে যেই হোক, এবার আর লুকিয়ে পড়ার সুযোগ পায়নি।

—“কে আপনি? আমাদের ফলো করছেন কেন?”

হিন্দিতে ধমকে উঠল সুরেশ। কিন্তু ছায়া কোনও উত্তর দিল না। সে চুপ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

সুরেশ ক্যামকর্ডারটাকে মাটিতে রেখে তাড়াতাড়ি ব্যাকপ্যাক থেকে নিজের টর্চটা বের করল। সেটা অন করে আলো ফেলতেই আবার একটা বিস্ময়ের ধাক্কা! যেখানে ছায়াটা দাঁড়িয়েছিল, সেখানে এখন কেউ নেই! টর্চের সাদা আলো শুধু পাথুরে পথ আর ইতস্তত ছড়ানো দুর্গের ভাঙাচোরা অবশেষটুকুই দেখাল।

পালিয়ে গেল! সুরেশ রীতিমতো অবাক হল। ক্যামকর্ডার রেখে টর্চটা বের করতে তার এমন কিছু সময় লাগেনি। তার মধ্যেই একটা আস্ত মানুষ কোথায় হাওয়া হয়ে গেল! দৌড়ে যাওয়ার ধুপধাপ শব্দও তো কানে আসেনি তার! সে টর্চের আলো ইতস্তত ফেলে দেখার চেষ্টা করল যে মানুষটা এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই কোথাও লুকিয়েছে কি না। কিন্তু কাউকেই আশপাশে দেখা গেল না!

সুরেশের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। আস্ত মানুষটা নিমেষে এমন লোপাট হয়ে গেল কী করে! নাকি আবার তারই ভুল হল! ভাবতেই সে মাথা নাড়ে নাঃ, এতখানি ভুল করতেই পারে না। স্পষ্ট দেখেছে একটা ছায়ামূর্তি তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে! কোনও চতুষ্পদ নয়, কোনও বন্যজন্তুও নয়। নিঃসন্দেহে সে মানুষ। আর ও যে তাদের ফলো করছিল, সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই।

সুরেশ নিজের অজান্তেই একবার তার জ্যাকেটের পকেটটা স্পর্শ করল। ওখানে একটা ফোল্ডিং নাইফ রয়েছে। ওদের কাজটা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আত্মরক্ষার্থে সবসময়ই ছুরিটাকে পকেটে রাখে। সেটার উপস্থিতি টের পেতেই যেন একটু শান্তি পেল। তারপর ক্যামকর্ডারটাকে তুলে নিয়ে ব্যাগে ভরে এগোনোর জন্য পা বাড়াল। আবার যদি সেই আগন্তুক এসে হাজির হয়, তবে দেখা যাবে। এবার ওকে দেখে নেবে সে।

কিন্তু এগোতে গিয়েই ফের চমক! সুজন আর দেবযানী কোথায় গেল! একটু আগেও তো সামনেই হাঁটছিল ওরা দুজন! কিন্তু এখন তার দৃষ্টিপথের মধ্যে ওরা কেউ নেই! সুরেশ বিপন্ন বোধ করল! এতক্ষণ সুজনই ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছিল। ভানগড় ফোর্টের ম্যাপটাও ওরই কাছে। অথচ ওরা কেউ ধারে কাছে নেই! এমনকী ওদের টর্চের আলোও দেখা যাচ্ছে না! সুজন তো কোনওকালেই কেয়ার করে না, কিন্তু দেবযানীও কি ভুলে গেল সুরেশের কথা! একবারও কি পিছু ফিরে দেখেনি যে সে সঙ্গে নেই!

সুজন আর দেবযানীর এরকম ব্যবহারে স্বাভাবিকভাবেই রাগ হয়ে গিয়েছিল তার। কিন্তু আস্তে আস্তে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনে। এখন মান-অভিমানের সময় নয়। হয়তো কাজের উত্তেজনায় ওরা লক্ষ্যই করেনি যে সুরেশ ওদের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। অনেক সময় লক্ষ্য করেও না। দূর্গের রাস্তা একদম সোজাই চলে গিয়েছে। নাক বরাবর দ্রুত হাঁটলে হয়তো খুঁজেও পাওয়া যাবে ওদের। খুব বেশিদূর এগিয়ে গিয়েছে বলে মনে হয় না। যাই হোক, এখন উত্তেজিত হওয়ার সময় নয়; বরং ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে।

সুরেশ এবার নিজের টর্চ জ্বালিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। তার পাশাপাশি চলেছে জহুরী বাজারের কালো ছোপ ছোপ ইট-পাথর! বহু বছরের শ্যাওলা জমে রয়েছে ভগ্নাবশেষের গায়ে। বহু বছরের রহস্যও বটে…

—“খস… খস… খস!”

আবার! আবার সেই আওয়াজ! সূক্ষ্ম রেশমী কাপড় ঘষা খেলে যেমন শব্দ করে ঠিক তেমনই একটা খসখস ধ্বনি! তার সঙ্গে পায়ের শব্দ এবার আরও বেশি পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে! ফলো করছে! সে আবার ফলো করছে! সুরেশ টের পেল তার ঠিক ঘাড়ের কাছে কেউ যেন বরফশীতল নিঃশ্বাস ফেলল! অর্থাৎ আগন্তুক এবার আরও কাছে! তার হিমশীতল নিঃশ্বাসে কেঁপে উঠল সে!

— “কৌন হ্যায়! হু দ্য হেল আর ইউ?”

বলতে বলতেই সে অ্যাবাউট টার্ন নিয়ে বিদ্যুৎবেগে টর্চের জোরালো ফোকাস ফেলল ঠিক তার পিছনেই! কিন্তু…

ছায়ামূর্তিটাকে এখনও দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে তার দেহরেখা স্পষ্ট! মাথা, কাঁধের আউটলাইন, দুটো হাতের রেখাও স্পষ্ট দৃশ্যমান! কিন্তু যেখানে টর্চের আলো ফেলেছে সুরেশ সেখানে ছায়ার মালিকের বুক বা পেটের অংশ থাকা উচিত! অথচ সেরকম কিছুই নেই! টর্চের তীব্র আলো যেন ছায়ামূর্তিটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে গিয়ে পড়ল শূন্য দূর্গের চারদিকে! অথবা কোনও অজ্ঞাত সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে গিয়ে আলোটা মিশে গেল শূন্যতায়!

ভয়ে সুরেশের রক্তহিম হয়ে যায়।সে বুঝতে পেরেছে, ওটা কোনও মানুষ নয়! হাড়-মাংস-পেশীযুক্ত কোনও প্রাণীই নয়। বরং ও শুধুমাত্রই একটা ছায়া! যাকে অনায়াসে ভেদ করে চলে যাচ্ছে টর্চের আলো! এ কী করে সম্ভব! অসম্ভব ব্যাপার! একটা ছায়া তার পেছন পেছন আসছিল। অবিশ্বাস্য!

একমুহূর্তের জন্য শ্বাস টানল সুরেশ! পরক্ষণেই প্রবল গতিতে দৌড়তে শুরু করল। যে করেই হোক, এই অলৌকিক ছায়ার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতেই হবে তাকে! ছুটতে ছুটতেই সে টের পেল পিছনের পায়ের আওয়াজও ক্রমাগত জোরালো হচ্ছে! অর্থাৎ সেই ছায়ামূর্তি যে-ই হোক না কেন, এখনও তাকে দুরন্ত গতিতে ধাওয়া করছে। সেই ছায়াও হাল ছাড়েনি! সুরেশের মনে হল তার দেহের সমস্ত রক্ত বুঝি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে! এ কী অদ্ভুত ছায়া! এর থেকে বরং কোনও দৈত্য তেড়ে এলেও সে এত ভয় পেত না। ভানগড় ফোর্টের কিংবদন্তীতে যেসব ভূত-দর্শনের কথা আছে, তেমন কেউ সামনে এসে দাঁড়ালেও বোধহয় এর চেয়ে ভালোই হত! অন্তত তাদের একটা মূর্তি থাকত, কায়া থাকত। কিন্তু যার কোনও মূর্তিই নেই, যে সম্পূর্ণ কায়াহীন, সেই আতঙ্কের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করবে কী করে!

পেছনে ছুটে আসার শব্দ এখন আরও জোরে শোনা যাচ্ছে। নিরূপায়, বিপন্ন সুরেশ সামনেই যে রাস্তা পেল তাতেই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করল। যে আতঙ্ক তাকে চেজ করে চলেছে, তার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অন্য কোনও উপায় জানা নেই তার। মানুষ হলে ছুরি কাজে আসত। কিন্তু ছায়া…

দাঁতে দাঁত চেপে সুরেশ তার গতিবেগ বাড়াল। জোরে, আরও জোরে, আরও আরও বেশি জোরে দৌড়ে চলেছে সে। ভাঙা ভাঙা সিঁড়ি টপকে, কখনও চড়াই ভেঙে, কখনও উৎরাই বেয়ে দৌড়চ্ছে। কিন্তু কোথায় চলেছে সে নিজেই জানে না! কখনও পায়ের তলায় পাথুরে রাস্তা, কখনও বা নরম ঘাস দলিত মথিত করে এগোচ্ছে। এই মুহূর্তে তার পাশ দিয়ে স্যাৎ স্যাৎ করে চলে যাচ্ছে ভাঙাচোরা মহল, মাথাকাটা ভেঙে পড়া দালান, বিপর্যস্ত ধ্বংসস্তূপ! আর চলেছে ভানগড়ের শক্তিশালী পেশল দেওয়াল! প্রাচীন এক বিরাট সরীসৃপের মতো সেও এঁকেবেকে সুরেশের পাশাপাশি দৌড়োচ্ছে। সুরেশের মনে হল, ওগুলো নেহাত ধ্বংসস্তূপ নয়; এ প্রাচীন দেওয়ালও আসলে নিছক দেওয়াল নয়! এরা প্রত্যেকেই এক একটা জীবন্ত ছায়া। যে কোনও মুহূর্তে ওরাও ‘রে রে’ করে তেড়ে আসবে তার দিকে!

দেহের সবশক্তিটুকু জড়ো করে দৌড়াতে দৌড়াতেই আচমকা পাথরে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সুরেশ। তার হাত থেকে টর্চ ছিটকে পড়ে গড়গড় শব্দ তুলে কোথায় গড়িয়ে গেল কে জানে! চতুর্দিকে এখন শুধু অন্ধকার আর নৈঃশব্দ! যে ছায়া তার পেছনে আসছিল, তাকেও আর দেখা গেল না! সে যেন অন্ধকারের মধ্যেই আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেছে!

পড়ে গিয়েই ভয়ের চোটে চোখ বুজে ফেলেছিল সে! কোনও এক অজানা ও ভয়ঙ্কর পরিণামের জন্য দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু নিঃশব্দ কিছু মুহূর্ত চলে যাওয়ার পরে কিছুটা স্বস্তি পেল সুরেশ। সেই ছায়া হয় তাকে অতিক্রম করে অন্যদিকে চলে গিয়েছে, নয়তো তার পিছু করা ছেড়ে দিয়েছে।

সে এবার কোনওমতে উঠে বসে। হাতের তলায় ঠান্ডা পাথরের স্পর্শ। অর্থাৎ ও পাথরের ওপরেই পড়েছিল। মাথায় প্রবল যন্ত্রণা! মাথাটা পাথরে ঠুকে গিয়েছে। সুরেশ হাত দিয়ে কপালে একটা চটচটে তরল অনুভব করল। রক্ত পড়ছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এখন সে আছে কোথায়?

অন্ধকারটা চোখে একটু সয়ে আসতেই সুরেশ এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল লোকেশনটা। এবং আবিষ্কার করে হতচকিত হল যে তার ঠিক সামনেই ভানগড়ের রাজপ্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। এখানেই রত্নাবতীর মহল দেখতে এসেছিল ওরা। কিন্তু যতদূর সে জানে, রয়্যাল প্যালেসটা গোপীনাথ টেম্পল ছাড়িয়ে গেলে দেখা যায়। অর্থাৎ সে কান্ডজ্ঞানহীনভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে ঘুরপথে অনেকটা এগিয়ে এসেছে। এখান থেকে একটু পিছিয়ে গেলেই গোপীনাথ মন্দিরটা পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে দেবযানী ও সুজনকেও।

সুরেশ আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। তার ব্যাকপ্যাকটা একটু দূরেই পড়েছিল। সে সযত্নে সেটাকে তুলে নিল। এই মুহূর্তে ভয়ে তার বুক রীতিমতো কাঁপছে! অসহায় ছেলেটার কাছে টর্চটাও নেই। সেটা কোথায় গেছে কে জানে! সুরেশ বাঁ দিকের হিপপকেট থেকে বের করে আনল লাইটার। কাঁপা কাঁপা হাতে লাইটারটাকে জ্বালানোর চেষ্টা করছে।প্রথমবার চেপে ধরতেই নীলাভ শিখা দপ্ করে জ্বলে উঠল। কিন্তু সে ক্ষণস্থায়ী! লাইটারের দুর্বল শিখাও কাঁপতে কাঁপতে ঝুপ করে নিভে গেল। ভয়ার্ত মানুষটা বার বার চেষ্টা করল। কিন্তু লাইটার আর জ্বলে না!

ভয়ে সুরেশের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সে কী করবে, কোথায় যাবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। তার প্রায় কান্না পেয়ে গেল! সুজন আর দেবযানী কি এখনও তাকে খুঁজছে না! এই নিঃসঙ্গ দুর্গে কতক্ষণ অলৌকিক শক্তির সঙ্গে একা যুদ্ধ করবে সে? কার সঙ্গেই বা করবে? প্রতিপক্ষ যেখানে অদৃশ্য, সেখানে তার কী করার আছে? এখন তো এক পাও এগোতে ভয় করছে তার।

হঠাৎই একটা প্রবল গড়গড় শব্দে সচকিত হয়ে উঠল সে! কীসের শব্দ ওটা! কোথা থেকে আসছে? কী প্রচণ্ড আওয়াজ! যেন ভয়ংকর কোনও প্রলয় ছুটে আসছে তারই দিকে। কিন্তু জিনিসটা কী!

শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই তার চোখে পড়ল জিনিসটা! একটা বিরাট জমাট অন্ধকার ওপরের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে আসছে নীচের দিকেই! শুধু কি অন্ধকার! না, অন্ধকার নয়; ওটা বিরাট একটা পাথর! দুর্নিবার, অদম্য বেগে ছুটে আসছে তাকে লক্ষ্য করে!

সেই ক্ষণেই তার একটাই নাম মনে পড়ল! তান্ত্রিক সিঙ্ঘিয়া! যে লোকটা

কালো যাদুর মাধ্যমে রাজকন্যা রত্নাবতীর প্রসাধনীকে মন্ত্রপূত করে দিয়েছিল। তার মূল্য সে নিজে দিয়েছিল নিজের প্রাণ দিয়ে! আর সুরেশরাও সেই রত্নাবতীর মূর্তিকেই ভাঙতে এসেছে। আজ আবার সেই পাথর তার প্রতিশোধ নেবে। পাথরের কারবারিদের বিরুদ্ধে স্বয়ং পাথরেরাই রুখে দাঁড়িয়েছে! কেউ বাঁচবে না! সুরেশ, দেবযানী এমনকি সুজনও রক্ষা পাবে না পাথরের প্রতিশোধের হাত থেকে! কেউ বাঁচবে না!

বিশালাকৃতি কালান্তক পাথরটা উল্কার বেগে ছুটে আসছে সুরেশের দিকে। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এসে পড়বে তার ওপরে। সেই অন্তিম মুহূর্তে মনে পড়ে গেল অতুলের কথা। বাক্যটা ভেবেই পাগলের মতো মর্মান্তিকভাবে হেসে উঠল সুরেশ!

—“এ পাথরে প্রাণ আছে!”

গোপীনাথ মন্দিরের মূল গর্ভগৃহটা দেখে চমকে গেল সুজন। কী আশ্চর্য ভাস্কর্য! কী অদ্ভুত সব মূর্তি! দেখেই তার চক্ষুস্থির। অতুল ঠিকই বলেছিল। গর্ভগৃহে পাথরের বেদী রয়েছে। কিন্তু কোনও বিগ্রহ নেই। কিন্তু থাকারই বা দরকার কী! যা রয়েছে তার মূল্য বিদেশের বাজারে কয়েকশো কোটি অবধি হতে পারে। এক একটা যক্ষিণী মূর্তিই দেখার মতো। কী তাদের অবয়ব, কী তাদের ভঙ্গিমা! কে জানত যে এই পরিত্যক্ত, ভগ্ন দূর্গের মধ্যে এমন রাজৈশ্বর্য লুকিয়ে আছে!

জল পড়ার আওয়াজ শুনে তার মনে হয়েছিল, হয়তো ভেতরে কেউ আছে! সেজন্যই সে দেবযানীকে ওখানে রেখেই তড়িঘড়ি ভেতরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করার পরও কোনও মানুষের অস্তিত্ব টের পায়নি। এমনকী জলের শব্দটাও আচমকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তা-ই আর তদন্ত না করে সে সরাসরি ঢুকে গিয়েছে প্রধান ও অভ্যন্তরীণ গর্ভগৃহে। ডুপ্লিকেট চাবি তার কাছে আগেই ছিল। তাই দরজা খুলতে কোনও অসুবিধে হয়নি।

এমার্জেন্সি লাইটের আলোয় চতুর্দিকটা দেখতে দেখতে তার দৃষ্টি স্থির হয়ে দাঁড়াল দেওয়ালের ঠিক কেন্দ্রে। সেখানে এক নারীমূর্তির ভাস্কর্য! কিন্তু সে ভাস্কর্যের সৌন্দর্য বর্ণনা করা অসম্ভব! হলুদ পাথরের ওপর ভাস্কর নারীমূর্তি খোদাই করেননি, বরং পৃথিবীর যাবতীয় সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়েছেন! নারীটি শৃঙ্গাররতা। পদ্মের মতো দুটি হাত একঢাল চুলে ফুল গুঁজতে ব্যস্ত! দেহবল্লরী যেন চরম লাস্যের মূর্ত প্রকাশ! যদিও মুখটা ঠিক স্পষ্ট নয়! বদ্ধ ঘরে থাকার দরুন ধুলোও জমেছে। তবু তার অভ্যস্ত চোখ দেখামাত্রই বলে দিল, এ মূর্তি ওদের সবাইকে আরবপতি করার ক্ষমতা রাখে! কোনও সন্দেহই নেই যে এটাই রাজকন্যা রত্নাবতীর মূর্তি!

মনে মনে মি. ও’কোনরের রুচির প্রশংসা না করে পারল না সুজন। সে আর একমুহূর্তও দেরি করতে চায় না। রত্নাবতীর মূর্তিটাকে যতক্ষণ না কেটে বের করছে, ততক্ষণ শান্তি নেই। সে এমার্জেন্সিটা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এল বাইরে। দেবযানী আর সুরেশের সহায়তা ছাড়া এ মূর্তি ভাঙা যাবে না এতক্ষণে নিশ্চয়ই সুরেশও এসে হাজির হয়েছে। এরকম প্রাচীন মূর্তি অবিকৃতভাবে কাটা অসম্ভব যদি না ওদের দু’জনের প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ হাত না থাকে।

কিন্তু ত্রস্তব্যস্ত পায়ে মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে গেল সুজন। দেবযানী সেখানে নেই! এমনকী সুরেশও এসে উপস্থিত হয়নি! শূন্য মন্দিরপ্রাঙ্গণ যেন তার বোকাটে মুখটা দেখে নিঃশব্দ হাসি হাসল! সুজন মনে মনে একটু বিরক্ত হয়। সুরেশ তো চিরকালীন ভ্যাগাবন্ড। কিন্তু দেবযানী গেল কোথায়! পাঁচ মিনিটও হয়নি তাকে রেখে সে মন্দিরে ঢুকেছে। শেষ যতটুকু মনে পড়ছে, দেবযানী মন্দিরের সিঁড়ির নীচেই দাঁড়িয়েছিল। ভেতরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু এখন সে গেল কোথায়! সুজন পাঁচমিনিটের জন্য একটু চোখের আড়াল হওয়া মাত্রই কি সে একা একা অ্যাডভেঞ্চারে বেড়িয়েছে নাকি! এ বেলায় আর ভয় লাগল না!

এক অসহনীয় রাগে মস্তিষ্কের প্রতিটি কোণা উত্তপ্ত হয়ে উঠল সুজনের। এরা পেয়েছেটা কী! শুরু থেকেই দেখছে এই ভানগড়ের অ্যাসাইনমেন্টটা নিয়ে দেবযানী ও সুরেশ; দু’জনেরই সমান অ্যালার্জি! ভানগড়ে এসে ওই ইডিয়ট অতুল আর স্টুপিড দীননাথের উল্টোপাল্টা গল্প শুনে দু’জনেরই মাথা গেছে! একজন দিনদুপুরে ভুলভাল দেখছে, অন্যজন কথায় কথায় ভয় পাচ্ছে। এদের দিয়ে কাজ হয়? ড্যাম ইট!

সে মন্দিরের ভেতর থেকেই চেঁচিয়ে ডাকল, “দেবযানী, অনেক হয়েছে। এখানে আয় বলছি।”

কথাগুলো যথারীতি মন্দিরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে হতে মিলিয়ে গেল। কিন্তু কোনও উত্তর এল না।

তার চোয়াল শক্ত হল। নির্ঘাৎ সুরেশ আবার ফিরে এসে দেবযানীকে নিয়ে গোটা ফোর্ট ‘এক্সপ্লোর’ করতে গিয়েছে! এর আগেও অন্য একটি দূর্গে অবিকল এমনই ঘটেছিল। এসব দূর্গে মোবাইল কাজ করে না কারণ টাওয়ার নেই। যোগাযোগ করার উপায়ও নেই। ওরা কিছুতেই বুঝবে না যে প্রত্যেকটা মুহূর্ত সুজনের কাছে মূল্যবান। এটা ওদের পেশা, রুজি-রুটি; ফাজলামি নয়!

কিন্তু পরক্ষণেই দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল সুজনের মুখে। ওরা কি সত্যিই কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে? কোনওরকম বিপদ হয়নি তো? দূর্গের অলৌকিক, বা ভৌতিক ইতিহাসে বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস নেই তার। তবে বন্যপ্রাণীকে ভয় আছে। তেমন কিছু অঘটন…!

ভাবতে ভাবতেই মাথা নাড়ল সে। নাঃ, তেমন কিছু হলে দেবযানীর ভয়ার্ত চিৎকার নিশ্চয়ই কানে আসত তার। কিংবা সুরেশের গলা পেত। অথচ তেমন কোনও শব্দই পায়নি! তার মানে দুটোই সম্ভাবনা রয়েছে। হয় সুরেশ এসে দেবযানীকে নিয়ে ‘এক্সপ্লোর’ করতে গিয়েছে, নয়তো দুটো ভীতুর ডিমই ষড়যন্ত্র করে তাকে একলা রেখে পালিয়েছে। সুজন হতাশাজনকভাবে মাথা ঝাঁকায়। এর অর্থ, আজ রাতে তাকে একাই কাজ করতে হবে! সুরেশ আর দেবযানী ফিরে এলে ভালো, নয়তো কাল সকালে ওদের দেখে নেবে!

সে বিড়বিড় করে বলল, “ওয়ার্থলেস পাবলিক!” তারপর ফের ধীর পায়ে হাঁটা দিল মূল গর্ভগৃহের দিকে। তার হাতের এমার্জেন্সির আলো একঝলক পিছলে পড়েছিল মন্দিরের প্রধান স্তম্ভের গায়ে। সেদিকে তাকিয়েই একটু যেন বিস্মিত হল সুজন। আরে! এই নৃত্যরতা যক্ষিণীমূর্তিটা ভাঙা ছিল না? যতদূর মনে পড়ছে, কালকেই এই মূর্তিটা ভালো করে দেখেছিল ওরা। তখন সুন্দরীর মাথা আর দুটি হাত ভাঙা ছিল। অথচ এখন একদম অক্ষত, নতুন ভাস্কর্যের মতো চকচক করছে। যেন রাতারাতিই কেউ মেরামত করে দিয়েছে। এত তাড়াতাড়ি কীকরে মেরামত হয়ে গেল মূর্তিটা! কে-ই বা করল!

সুজন একটু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল। যক্ষিণীমূর্তিটা কি আদৌ এরকম ছিল? কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকছে না? মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা, মুখের সুডৌল গড়নটাও যেন বড় পরিচিত। এরকম মূর্তি আগে কোথাও দেখেছে কি?

—“সু-জ-ন!”

পাথরের ভেতর থেকে ভেসে এল পরিচিত কণ্ঠের বুকফাটা হাহাকার! ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়ে সুজন লাফিয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেল। কী হচ্ছে! এসব কী হচ্ছে! আওয়াজটা কোথা থেকে এল! এই স্তম্ভের ভেতর থেকে কি! ইম্পসিবল! অসম্ভব!

সুজনের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে! এইমাত্র যা শুনল তা কি সত্যি? না কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছে! এক অদ্ভুত সন্দেহ তার মনের মধ্যে ঘনিয়ে এল! অব্যক্ত এক আশঙ্কায় সে এমার্জেন্সি লাইটটার আলো ফেলেছে নৃত্যরতা যক্ষিণীর দিকে। আর যক্ষিণীর মুখ স্পষ্ট হতেই যেন কয়েকহাজার ভোল্টের বৈদ্যুতিক ছ্যাঁকা খেল সুজন! এ তো অবিকল দেবযানীর মূর্তি! নিঃসন্দেহে সে-ই! সেই টপনট, সেই মুখের আদল, এমনকি চিবুকের কাটা দাগটাও হুবহু এক! দেবযানী!

—“সুজন!”

পাথরের ভেতর থেকে ভেসে এল দেবযানীর কান্না, “আমায় এখান থেকে বের কর! আমার ভয় করছে!”

—“দেবযানী!” সুজন ব্যাকুলভাবে যক্ষিণীমূর্তির ওপর হাত রাখল;

–“কোথায় তুই! অ্যাঁ?”

—“আমি জানি না।” কান্নাবিকৃত কণ্ঠে জবাব এল, “এখানে ভীষণ অন্ধকার!”

সুজন কী করবে বুঝে পায় না! দেবযানী কোথায় আছে, মূর্তিটা তার মতো দেখতে কী করে হল, কিংবা স্তম্ভের মধ্য থেকে তার কণ্ঠস্বর কীভাবে ভেসে আসছে তা সমস্ত যুক্তি ও বুদ্ধির বাইরে। কিন্তু জীবনে এই প্রথম সে ‘আতঙ্ক’ কাকে বলে তা টের পেল! সুজনের কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘামের বিন্দু দেখা দিয়েছে। সে বিহ্বল, বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে সেই যক্ষিণীমূর্তির দিকে।

— “আমি আগেই বলেছিলাম স্যার, এ মন্দিরগুলো জীবিত! বলেছিলাম, এ পাথরে প্রাণ আছে। আপনারা শোনেননি।”

সারা মন্দির কাঁপিয়ে ভেসে এল শব্দগুলো। কিন্তু কণ্ঠস্বরটা চিনতে ভুল হল না সুজনের। অতুল!

সে অসহ্য রাগে, ভীষণ অসহায়তায় হিসহিস করে বলল, “তাহলে এসব তোমার ষড়যন্ত্র! কোথায় রেখেছ দেবযানীকে?”

কণ্ঠস্বর হেসে উঠল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “দেবযানীকে যেখানে দেখছেন, ও সেখানেই আছে। এবং চিরদিন সেখানেই থাকবে।”

—“বাজে কথা,” সুজন গর্জন করে ওঠে, “এসব লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোয়ের কারিকুরি। নির্ঘাৎ কোনও সাউন্ডবক্স বসানো আছে আশপাশেই। সব তোমার চক্রান্ত!”

অতুল আবার সজোরে হেসে ওঠে, “এই ভাঙা দূর্গে কষ্ট করে কে আর লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো করবে স্যার! আর দিনের বেলা আপনি গোটা দূৰ্গ, গোটা মন্দির দেখেছেন। কোথাও এমনকিছু আপনার চোখে পড়েছে কি? “ সুজন এবার আলো ফেলে গোটা মন্দিরটা দেখে নেয়। কোথা থেকে আসছে এই কণ্ঠস্বর! অতুল কোথা থেকে কথা বলছে? দেবযানীর কান্না এখন আর শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু এবার অবাক হয়ে আবিষ্কার করল সে, অতুলের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে মন্দিরের পাথুরে দেওয়াল থেকে!

—“আপনি আমাকে বোধহয় চিনতে পারেননি!” অতুল গম্ভীরভাবে বলল, “কিন্তু মি. ও’কোনর আমাদের দু’জনের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। মনে আছে?”

মস্তিষ্কের ভেতরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল সুজনের। এবার পরিষ্কার মনে পড়ল মুহূর্তটা! হ্যাঁ, তা-ই তো! অতুল মি. ও’কোনরের অফিসেই বসেছিল। জেমস্ ওদের দু’জনের আলাপও করিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “ও হচ্ছে অতুল মেহতা। এখনও পর্যন্ত ওর আনা মূর্তিই নিলামে হায়েস্ট রেট এনেছে। ওর স্টাইলই হচ্ছে বিপজ্জনক জায়গা থেকে মূর্তি তোলা! মেইনলি হন্টেড হাউস অ্যান্ড দ্য ফোর্টস! এমনকী ও পুতুলবাড়ি থেকেও একটা স্কাল্পচার নিয়ে এসেছে! ক্যান ইউ বিলিভ ইট?”

মনে পড়ছে। একদম স্পষ্ট মনে পড়ছে! কিন্তু তখন অতুল যেন একটু অন্যরকম দেখতে ছিল। হ্যাঁ, ওর চোখদুটো। ওর চোখদুটো এমন ভয়াবহ ছিল না! বরং স্বাভাবিক গাঢ় বাদামি রঙের চোখ ছিল। কিন্তু এখন তো পিঙ্গল! অবিকল এই মন্দিরের পাথরের মতো।

—“আমি আপনাকে সাবধান করেছিলাম স্যার!”

দেওয়াল থেকে ভেসে এল কথাগুলো, “বারবার সতর্ক করেছিলাম! আপনারা শুনলেন না!”

—“তার মানে তোমাকেও ভানগড়ের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন মি. ও’কোনর!” বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করল সুজন, “তুমিও একজন ভ্যান্ডাল!”

— “হ্যাঁ,” কণ্ঠস্বর উত্তর দিল, “যেদিন আপনি অ্যাসাইনমেন্টটা পেয়েছিলেন, তার পনেরোদিন আগে আমিও…”

–“ও!” তার কথা শেষ হওয়ার আগেই উত্তেজিতভাবে বলে উঠল সে, “তার মানে তুমি আমাদের এভাবে ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করতে চাও! মি. ও’কোনরের অফারের চেয়েও বড় টাকার অফার পেয়েছ, তা-ই না?”

দেওয়াল বেয়ে একটা জোরালো দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এল। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। তারপর শোনা গেল একটাই শব্দ, ‘না!’

—“ড্যাম লায়ার!” উন্মত্তের মতো চেঁচিয়ে উঠল সুজন, “তুমি কীভাবে এসব ট্রিক করছ জানি না! কিন্তু এভাবে আমায় ভয় দেখান যাবে না! রত্নাবতীর মূর্তি আমিই এখান থেকে নিয়ে যাব! যেভাবেই হোক, নিয়েই ছাড়ব! কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না। তুমিও না!”

কণ্ঠস্বর নিরুত্তর! দেওয়াল থেকে আর কোনও প্রত্যুত্তর ভেসে এল না। সুজন আর উত্তরের অপেক্ষাও করল না। তার মাথায় যেন রক্ত চড়ে গিয়েছে। চুলোয় যাক দেবযানী, গোল্লায় যাক সুরেশ। সে কারোর পরোয়া করে না! একজন মূর্তিচোর বা ভ্যান্ডালের কোনও আত্মীয় নেই। কোনও বন্ধু নেই! তার বন্ধুত্ব একমাত্র টাকার সঙ্গে! তার একমাত্র আত্মীয় মোটা অঙ্কের চেক। আর কেউ নয়!

সে নিজের ব্যাকপ্যাক নিয়ে দৌড়ে গেল মূল গর্ভগৃহে। এমার্জেন্সি লাইটটাকে মেঝেতে রেখে দ্রুত হাতে বের করতে শুরু করল ভ্যান্ডালস টুলস! সচরাচর কোনও মূর্তি কাটার আগে সযত্নে সেটাকে ব্রাশ দিয়ে মুছে নিতে হয়। তারপর মেজারিং টেপ দিয়ে দৈর্ঘ্য প্রস্থ মেপে নিয়ে মার্কার দিয়ে আউটলাইন এঁকে নেওয়া জরুরি। কিন্তু এতদিনের সমস্ত শিক্ষা, সমস্ত পদ্ধতি ভুলে গেল সুজন। কথা নেই বার্তা নেই, পাগলের মতো ছেনি বসিয়েই

হাতুড়ির এক জোরালো ঘা মেরে দিল।

মন্দিরের দেওয়াল থেকে একটুকরো পাথর ভেঙে ছিটকে পড়ল তার সেই ভীষণ আঘাতে! সুজন টের পেল, তার হাত কাঁপছে। তবু সে নিজের জেদে অনড়। পাগলের মতো হাতুড়ির বাড়ি মেরেই যাচ্ছে। ঘা এর পর ঘা! যেন পণ করেছে, যতক্ষণ না মূর্তিটা খুলে বেরিয়ে আসছে, ততক্ষণ হাল ছাড়বে না! আঘাতে আঘাতে মূর্তিটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে! চটলা উঠে যাচ্ছে। তবু থামছে না সুজন! আজ হয় এই মূর্তি ধ্বংস হবে, নয়তো এটাকে সঙ্গে নিয়েই ফিরবে সে। এস্পার কী ওস্পার!

হঠাৎ যেন এমার্জেন্সিটা অলৌকিকভাবে একটু সরে গেল! অথবা তার সোজা আলো কীভাবে যেন বক্ররেখায় গিয়ে পড়ল রাজকন্যা রত্নাবতীর মূর্তির মুখে! জোরালো আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ভাস্কর্যের মুখ! সেদিকে চোখ পড়া মাত্রই ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠে সুজন। তার হাত থেকে নিমেষে পড়ে যায় ছেনি ও হাতুড়ি!

এই সুন্দরীর দেহে এ কার মুখ! এই মুখ পরমাসুন্দরী রাজকন্যা রত্নাবতীর হতেই পারে না! আদতে এ কোনও নারীর মুখই নয়! এ এক পুরুষের মুখ! কোটরাগত চোখে পিঙ্গল আভা, চোয়াড়ে মুখ! নাকটা যেন আধখানা বসে গিয়েছে! এই মুখের মালিক তার পরিচিত! এই মূর্তির মুখ হুবহু অতুলের মতো!

ঠিক তখনই দপ্ করে নিভে গেল এমার্জেন্সিটা! অন্ধকার গর্ভগৃহ কাঁপিয়ে খলখলিয়ে হেসে উঠল এক নারী! তার হাসির দমকে লাস্য আছে। তার চেয়েও বেশি আছে নিষ্ঠুরতা!

এ সেই হাসি যা এক অন্ধকার রাত্রে ইথান ওলসেন শুনেছিলেন! নিষ্ঠুর, বড় নিষ্ঠুর!

ভানগড় ফোর্টের মূল প্রবেশপথে দাঁড়িয়েছিল দুই যুবক। সূর্যের প্রখর রশ্মিতে ভানগড় ফোর্টের ধ্বংসস্তূপ দেখে বেড়াচ্ছে কৌতূহলী পর্যটকেরা। যুবকদুটি একটু সন্তর্পণে মেপে নেয় চারদিক। সতর্কতা তাদের চোখের চাউনিতেই স্পষ্ট। ইতিউতি তাকিয়ে কিছু যেন খুঁজছে! সম্ভবত গাইডের সন্ধানে আছে।

একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিল একটি একলা মানুষ। তার দৃষ্টিও যুবকদুটির ওপরেই নিবদ্ধ। একটু ইতস্তত করে অবশেষে সে এগিয়ে গেল ওদের দিকে। ইংরেজিতে জানতে চাইল, “আপনারা কি গাইড খুঁজছেন?”

যুবকেরা তাকে একটু বিস্মিতদৃষ্টিতে দেখল। মানুষটাকে কী অদ্ভুত দেখতে! আপাতদৃষ্টিতে অবশ্য কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু ওর চোখদুটো অদ্ভুত! পিঙ্গল কটা চোখ, নিষ্পলক দৃষ্টি! মানুষটি হাসছে ঠিকই, কিন্তু তার চোখে সে হাসির আভাসমাত্রও নেই। যেন ওর চোখদুটো পাথরের তৈরি!

একজন যুবক একটু আমতা আমতা করে বলল, “হ্যাঁ। গাইডই খুঁজছি। আপনি?”

মানুষটি আবার রহস্যময় হাসল। মাছের মতো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমি সুজন। আপনাদের গাইড।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *