জীবন্ত প্রস্তর
১
তখন গভীর রাত৷ যতদূর চোখ যায় শুধু অন্ধকারের একচ্ছত্র বিস্তৃতি৷ কেমন যেন থমথমে পরিবেশ৷ কোথাও একবিন্দু আলো নেই, কোনো শব্দ নেই! নেই জীবনের বিন্দুমাত্র প্রকাশও! রাতচরা পাখির ডাক, কিংবা কুকুরের ঘেউ ঘেউ এমনকী গাছের পাতা খসে পড়ার খসখস; কোনো জাগতিক আওয়াজই শোনা যায় না! এ কেমন নিস্তব্ধতা! কেমন অন্ধকার! যেন কেউ একটা কালো পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখেছে সমস্ত দৃশ্য, সমস্ত শব্দ! পর্দার ওপ্রান্তে যা আছে তা যেন প্রকাশ্যে আসতে চায় না৷
ডঃ ইথান ওলসেন সতর্কদৃষ্টিতে একবার চতুর্দিকটা দেখে নিলেন৷ আজ অমাবস্যা৷ আকাশে জমাট অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই৷ আশেপাশে শুধু হাড়-পাঁজর বের করা ধ্বংসস্তূপের কঙ্কাল! শূন্য চক্ষুকোটরের মতো হাঁ করে আছে জানলাগুলো! বেশির ভাগ বিল্ডিংগুলোই ধসে পড়েছে৷ বিশেষ কিছুই বাকি নেই৷ সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, বুঝি রস-রূপ-গন্ধ ভরা পৃথিবী থেকে বহুদূরে এসে পড়েছেন তিনি৷ সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে! যেখানে নৈঃশব্দ্যও বড় বিষণ্ণ৷
ইথানের মনের মধ্যেও যেন সেই বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে৷ বিশ্বের অন্যতম সেরা প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর হিসাবে তিনি পৃথিবীখ্যাত৷ দুনিয়ায় এমন কোনো কুখ্যাত ভৌতিক স্থান নেই, যেখানে তিনি তদন্ত করতে যাননি৷ অভিশপ্ত অ্যাসাইলাম থেকে শুরু করে রহস্যময় টানেল, মেট্রো স্টেশন, ভূতুড়ে বাড়ি ও ম্যানসন; এমনকি কুখ্যাত ঐতিহাসিক জায়গাগুলোকেও ছাড়েননি৷ কোথাও প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিটির প্রমাণ পেয়েছেন, আবার কোথাও বা পাননি৷ কিন্তু তাঁর বহুদিনের অভিজ্ঞতা বলছিল যে এই অভিশপ্ত দুর্গের কাহিনি হয়তো অন্যরকম৷ আপাতদৃষ্টিতে কোনো কিছুই অস্বাভাবিক মনে হয় না৷ সঙ্গে আনা সেন্সরগুলোও কোনোরকম অতিলৌকিকের উপস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে না৷ অথচ তাঁর দেহ ও মন বলছে, এই কেল্লার ছত্রে ছত্রে অস্বাভাবিকতা রয়েছে৷ এবং যথেষ্ট পরিমাণেই রয়েছে৷ শুধু ধরা দিচ্ছে না!
ইথান যখনই প্রথম এই দুর্গের সিঁড়িতে পা রেখেছিলেন, তখনই এক অদ্ভুত শৈত্যে ছ্যাঁত করে উঠেছিল তাঁর দেহ! অথচ এমন হওয়ার কথা নয়! এখন গরমের মরশুম চলছে৷ ফোর্টের বাইরে যখন দাঁড়িয়েছিলেন, তখনও বেশ গরমই লাগছিল৷ খণ্ডমুহূর্তের মধ্যেই সেই ভ্যাপসা গরম ভাব এমন অস্বাভাবিক শীতলতায় রূপান্তরিত হতে পারে না! তাঁর দেহ সেই মুহূর্তেই বলে উঠেছিল; ‘সামথিং ইজ রং উইথ দিস প্লেস!’
কিন্তু আশ্চর্য বিষয়! তাঁর ইনফ্রারেড থার্মোমিটার এখনও কোনোরকম অস্বাভাবিকতা দেখায়নি! ইথান প্রত্যেকটি জায়গায় গিয়ে তাপমাত্রা পরীক্ষা করেছেন৷ তবুও থার্মোমিটার কোনো ইঙ্গিত দেয়নি৷ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ডিটেক্টরও কোনো অদৃশ্য উপস্থিতির কথা জানায়নি৷ ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডারও ব্যর্থ হয়েছে৷ ইথান দুর্গের প্রত্যেকটি ভাঙাচোরা ঘরে ঢুকে কোনো অলৌকিক মানুষের উদ্দেশে বারবার প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন৷ যাকে বলে ‘ইলেক্ট্রনিক ভয়েস ফেনোমেনা’ সেশন৷ কিন্তু গোটা ইভিপি সেশনেও রেকর্ডারে কিছুই রেকর্ড হয়নি! কোনো কথা তো দূর, সামান্য শব্দও নয়! অর্থাৎ তাঁর প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়নি কেউ৷ দুর্গের প্রতিটি নির্জন কোনায়, সিঁড়িতে, আশেপাশের ফাঁকা ঘরে ছড়িয়ে রেখেছেন ‘মোশন অ্যান্ড ভাইব্রেশন ডিটেক্টর’৷ কোনোরকম অস্বাভাবিক বা আপাতঅদৃশ্য গতিবিধি অনুভব করতে পারলেই অ্যালার্ম বেজে উঠবে! কিন্তু এখনও পর্যন্ত সব চুপচাপই আছে৷
অন্য কেউ হলে, হতাশ হয়ে এতক্ষণে হাল ছেড়ে দিত৷ অথবা ঘোষণা করে দিত ‘এই অভিশপ্ত দুর্গে কোনোরকম অস্বাভাবিকতা নেই৷’ কিন্তু ইথান সে পথে হাঁটেননি৷ তাঁর সেন্সর ও গ্যাজেটগুলো বলছে যে এখানে কোনো প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিটি নেই৷ কিন্তু তিনি নিজে দেহে ও মনে যা অনুভব করছেন, তাকে অস্বীকার করেন কী করে! যে স্থির শৈত্য তাঁকে ছুঁয়ে আছে, যে নৈঃশব্দ্য তাঁকে নিজের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটুকুও শুনতে দিচ্ছে না, যে অজ্ঞাত কারণে তাঁর মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে; এক বহু শতাব্দীর পাথরচাপা দীর্ঘশ্বাস গুমরে মরছে বুকে; তা মোটেই স্বাভাবিক নয়৷ গ্যাজেট ভুল করতে পারে৷ কিন্তু দেহ ও মন ভুল করে না৷
ইথানের কপালে চিন্তার ভাঁজ৷ তাঁর সেন্সর ও গ্যাজেটগুলো কি ঠিকমতো কাজ করছে না? নাকি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে গ্যাজেটগুলোকে বিভ্রান্ত করছে? তাদের সঠিক নির্দেশ দিতে কেউ বাধা দিচ্ছে কি? নাকি এখনও সময় হয়নি? তিনি নিজের ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালের দিকে তাকালেন৷ রাত্রি তিনটে বেজে তিরিশ মিনিট৷ সূর্যোদয় হওয়ার আগে তাঁকে সেই প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে যা আজ পর্যন্ত বিজ্ঞান দিয়ে উঠতে পারেনি৷ খুঁজতে হবে সেই অজানাকে যার জন্য এই দুর্গের কপালে ‘মোস্ট হন্টেড প্লেস’-এর তকমা জুটেছে৷
আস্তে আস্তে আরও কিছুটা সময় কাটল৷ অন্ধকার, নিঃশব্দ রাত এখনও মৌনতাভঙ্গ করেনি৷ ইথানও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন৷ দুর্গের ভাঙাচোরা সিঁড়িতে বসে কখন যে অজান্তেই দু-চোখের পাতা লেগে এসেছিল তাঁর, তা নিজেও বুঝতে পারেননি৷ আচমকাই ঘুম ভাঙল একটা তীব্র শব্দে!
তৎক্ষণাৎ লাফ মেরে উঠে বসলেন তিনি৷ মুহূর্তের মধ্যেই কানে এল ‘মোশন অ্যান্ড ভাইব্রেশন ডিটেক্টরের’ প্রবল চিৎকার! কোথাও কোনো রহস্যময় গতিবিধি ধরা পড়েছে! অবশেষে! এত প্রতীক্ষার পর শেষ পর্যন্ত একটা ইঙ্গিত এল তবে! কিন্তু আওয়াজটা আসছে কোথা থেকে! ইথান তড়িৎগতিতে ছুটে গেলেন এম ভি ডিটেক্টরের আওয়াজ লক্ষ্য করে৷ তাঁর হাতের টর্চ দুর্গের আঁকাবাঁকা পাথুরে রাস্তার ওপর আলো ফেলছে৷ ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে, কখনও হোঁচট খেয়ে, কখনও লাফ মেরে সিঁড়ি টপকে তিনি দৌড়লেন শব্দের উৎসের দিকে৷
কিন্তু দৌড়তে দৌড়তেই আচমকা চমকে উঠলেন ইথান৷ এতক্ষণ মোশন অ্যান্ড ভাইব্রেশন ডিটেক্টর স্বাভাবিক আওয়াজেই অ্যালার্ম দিচ্ছিল৷ হঠাৎই সেই একঘেয়ে অ্যালার্ম থেমে গিয়ে চতুর্দিক কাঁপিয়ে হাসির শব্দ ভেসে এল৷ তিনি স্তম্ভিত হয়ে শুনলেন, সেটা কোনো নারীর হাসি! কোনো নারী যেন তীব্রস্বরে খিলখলিয়ে হেসে উঠেছে৷ আর সেই হাসি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে দুর্গের প্রতিটি ভাঙা দেওয়ালে! নারীর হাসিই বটে; কিন্তু যেন অসম্ভব নিষ্ঠুর!
সামান্যই এক নারীর হাসি! কিন্তু আসছে মোশন অ্যান্ড ভাইব্রেশন ডিটেক্টরের মধ্য থেকেই! তার স্বাভাবিক অ্যালার্ম টোনের বদলে বাজছে এই ভয়ংকর হাসি! ইথান বুঝতে পারলেন তিনি দরদরিয়ে ঘামছেন! নিস্তব্ধতাকে চিরে আসা সেই তীব্র তীক্ষ্ণ হাসি শুনে রক্ত হিম হয়ে গেল তাঁর৷ কোনোমতে স্খলিত স্বরে বললেন—
‘ওঃ! ক্রা-ই-স্ট!’
২
‘শেষ পর্যন্ত ভানগড় ফোর্ট! ইউ মিন, আলোয়াড়, রাজস্থানের ভানগড়! নো ওয়ে! তুই আর কোনো জায়গা পেলি না?’
সুজনের প্রস্তাবটা শুনে ওর সঙ্গীদের প্রাথমিক অভিব্যক্তি এটাই ছিল৷ দেবযানী তো প্রায় লম্ফ মেরে উঠে বলেছিল, ‘জাস্ট ফরগেট ইট! তোর কোনো ধারণা আছে? তুই ঠিক কী করতে চাইছিস? রাতের বেলা ভানগড় ফোর্টে ঢুকে মূর্তি ভেঙে নিয়ে আসতে হবে! হালুয়া-পুরি নাকি! আমি এই প্রোজেক্টে নেই!’
সুজন ওর দিকে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল৷ সে জানত দেবযানী শুরুতেই চেঁচামেচি জুড়ে দেবে৷ প্রত্যেকটা কন্ট্র্যাক্টের শুরুতেই ও এরকম তা-না-না-না করে৷ কিন্তু টাকার অঙ্কটা শুনলে কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজি হয়ে যায়৷ সুজন তাই একটুও উত্তেজিত না হয়ে বলল, ‘কী করব বল৷ কাজটা তো দিনের আলোয় করা সম্ভব নয়! তা ছাড়া এরকম অনেক ফোর্টে, অনেক মন্দিরে আমরা গভীর রাতে ঢুকে কাজ করেছি৷ করিনি কি?’
সুরেশ বেশি কথা বলার মানুষ নয়৷ সে একটা কিংসাইজ সিগারেট ধরিয়ে বলে, ‘করেছি৷ কিন্তু ভানগড় ফোর্টের ব্যাপারটা আলাদা৷’
‘এগজ্যাক্টলি!’ দেবযানী চোখ গোলগোল করেছে; ‘তুই এমন একটা জায়গার কথা বলছিস যেটা ইন্টারন্যাশনালি কুখ্যাত৷ শুধু ভারতের নয়, গোটা বিশ্বের অন্যতম অভিশপ্ত জায়গা! ইন্টারনেটে সার্চ করে দ্যাখ৷ ওয়ার্লডের মোস্ট হন্টেড প্লেসের তালিকায় প্রথম পাঁচটার মধ্যেই ভানগড় ফোর্টের নাম আসবে! আর তুই কিনা সেই জায়গায় গিয়ে মূর্তি কাটার কথা ভাবছিস! তাও আবার রাতে! আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ওখানে বিরাট নোটিশ বোর্ড টাঙিয়ে রেখেছে৷ সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় অবধি কেউ ওখানে ঢুকতে পারে না৷ গেটে একটা মস্ত তালা ঝোলে! কোনো নাইটগার্ডও ওখানে থাকতে চায় না! আজ পর্যন্ত যারা ওখানে রাতে ঢুকেছে, বেশির ভাগ লোকই ফেরেনি! আশেপাশের গ্রামগুলোর লোকেরা ভুলেও সন্ধ্যার পর ভানগড়ের ছায়াও মাড়ায় না৷ এমনকি বিশ্ববিখ্যাত প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর ইথান ওলসেনের অভিজ্ঞতা পড়েছিস? ভাইরাল হয়ে গিয়েছে তাঁর লেখাটা৷ দিস ইজ নট আ ম্যাটার অফ জোক সুজন! ভানগড় ফোর্ট এমনি এমনি আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাত হয়নি! ওটা আপাদমস্তক একটা ভৌতিক জায়গা!’
‘আই নো!’ সুজন হাসল, ‘ভানগড় যে অভিশপ্ত ও হন্টেড সেটা পৃথিবীর সবাই জানে৷ কিন্তু ডেঞ্জারাস বলেই তার দামটাও ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে আকাশছোঁওয়া! ভানগড়ের একটা মূর্তি আন্তর্জাতিক বাজারে কীরকম শোরগোল ফেলে দেবে তার ধারণা আছে তোদের? মিঃ ও’ কোনরও ভানগড়ের হিস্ট্রি জানেন৷ ক্রেডিট গোজ টু ইথান৷ এবং সেইজন্যই তিনি যে টাকা দেবেন তাতে আমরা কেন, আমাদের পরবর্তী চোদ্দপুরুষ ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে বিরিয়ানি- পোলাও খেতে পারবে৷’
দেবযানী হাত তুলে দেয়, ‘দ্যাখ ভাই, বেঁচে থাকলে তবে তো বিরিয়ানি পোলাও খাবো! আমি নেই!’
সুরেশ একমুখ ধোঁওয়া ছেড়ে বলল, ‘তা ছাড়া ভানগড়ে মূর্তি কোথায়? গোটা ফোর্টটাই তো ভেঙেচুরে গিয়েছে! সেটার কারণও অবশ্য কেউ জানে না৷ অতবড় শক্তপোক্ত দুর্গটা কী করে একরাতের মধ্যেই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল, ভেতরের লোকগুলোই বা কোথায় গেল; আজ পর্যন্ত কেউ সেটা বলতে পারেনি৷ গোটা ব্যাপারটাই মিস্টিরিয়াস! আর ঐ ধ্বংসস্তূপের ভেতরে তুই মূর্তি কোথায় পাবি?’
সুজন হেসে ফেলল৷ সে রিসার্চ না করে কোনো কথাই বলে না৷ মৃদু হেসে বলল, ‘মূর্তি আছে৷ ভানগড় ফোর্টটা একরাতের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ঠিকই৷ কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে ফোর্টের ভেতরের মন্দিরগুলোর গায়ে সামান্য আঁচড়ও পড়েনি! মন্দিরগুলো এখনও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে৷ তার ভেতরে বিগ্রহ নেই ঠিকই, তবে মন্দিরের দেওয়ালে খোদাই করা আছে সব অসাধারণ মূর্তি! বিশেষ করে পুরোনো গোপীনাথ মন্দিরের দেওয়ালে অপূর্ব সব যক্ষিণী মূর্তি, নানা দেবী ও দেবতার মূর্তিতে ভরা৷ সবাই বলে, যক্ষিণী মূর্তিগুলো সব তৎকালীন সুন্দরী নর্তকীদের মডেল করে তৈরি করা হয়েছিল৷ আর তাদের মধ্যে প্রধান ও সবচেয়ে বড় যে দেবীমূর্তিটি, সেটি নাকি ভানগড়ের কিংবদন্তি সুন্দরী রাজকন্যা রত্নাবতীর আদলে তৈরি! ভানগড়ের অভিশপ্ত হওয়ার পেছনের গল্পে যে আসল নায়িকা; সেই রত্নাবতী! ঐ মূর্তিটা কাটতে পারলে কী হবে ভাবতে পারছিস?’
সুরেশের ভুরু কুঁচকে যায়৷ রাজকন্যা রত্নাবতীর গল্পটা সে জানে৷ রাজকন্যার দাসী যখন বাজারে সুগন্ধি তেল কিনতে যায়, এক দুষ্ট তান্ত্রিক সিঙ্ঘিয়া ছলে- বলে-কৌশলে সেই তেলকে মন্ত্রপূত করে দেয়৷ কিন্তু রত্নাবতী নিজেও তন্ত্রচর্চা করতেন৷ চক্রান্তটা বুঝতে পারেন এবং সেই তেল একটি বিরাট পাথরের ওপর ফেলে দেন৷ সঙ্গে সঙ্গে সেই পাথর ছুটে যায় সিঙ্ঘিয়ার দিকে৷ তান্ত্রিক সেই পাথরের নীচে চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল৷ কিন্তু মারা যাওয়ার আগে অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিল যে এই নগর ধ্বংস হবে৷ মৃত্যুপথযাত্রী তান্ত্রিকের অভিশাপেই নাকি ভানগড় রাতারাতি ধ্বংস হয়ে যায়!
সুজনের কথা সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত৷ ওরা জানে কাজটা নিষিদ্ধ এবং আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও এটাই ওদের পেশা৷ আসলে ওরা ‘ভ্যান্ডালস ভ্যানডালস’! আর যে কাজটা করে, তাকে বলে ‘ভ্যান্ডালিজম’৷ কোনো শিল্পকীর্তিকে ধ্বংস করে দেওয়া অনৈতিক কাজ৷ ধরা পড়লে কঠোর থেকে কঠোরতম সাজা হবে৷ তবু পেটের দায়ে, প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে প্রাচীন মন্দিরের গা থেকে কেটে নিয়ে আসে অপূর্ব সব প্রাচীন মূর্তি৷ ওরা সে কাজে রীতিমতো এক্সপার্ট৷ মাখন তোলার মতো পাথুরে দেওয়ালের গা থেকে একদম অবিকৃতভাবে মূর্তি কেটে নেয়৷ বিদেশের বাজারে সেসব কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয়৷ আর ওদের এ কাজে সাহায্য করেন মিঃ জেমস ও’ কোনর৷ উনিই ওদের প্রোজেক্ট দেন৷ যেমন এবার ভানগড়ের কাজটা দিয়েছেন৷ সুজন যা বলছে তা মিথ্যে নয়৷ অভিশপ্ত ভানগড়ের ইতিহাসে রাজকন্যা রত্নাবতী ‘মিথ’৷ তাঁর মূর্তির দাম যা হবে সেটা ওরা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না৷ তা সত্ত্বেও এবারের প্রোজেক্টটা ঠিক ভালো লাগছে না সুরেশের৷ এতদিন ধরে ওরা বহু মন্দির বা গুম্ফা থেকে মূর্তি এনেছে৷ সেক্ষেত্রেও ঝুঁকি ছিল৷ কিন্তু ভানগড় সম্পর্কে যা শুনেছে, তাতে দিনের বেলাতেই সেখানে ঢুকতে ভয় লাগে! রাতে ঢোকা তো দূর!
সে আস্তে আস্তে বলে, ‘তুই যাই বলিস৷ এবার রিস্ক ফ্যাক্টর অনেক বেশি৷’
‘রিস্ক ফ্যাক্টর বেশি বলেই তো টাকাটাও কয়েকগুণ বেশি হবে৷’ সুজন নাছোড়বান্দা, ‘তা ছাড়া ঐ অভিশপ্ত হওয়ার বদনাম থাকার ফলে দুর্গের ত্রিসীমানায় রাতে কেউ আসবে না৷ পাহারাদারও সন্ধে হতে না হতেই কেটে পড়ে৷ পুরো ফাঁকা মাঠ৷ আমাদের বাধা দেওয়ার কেউ নেই!’
‘সত্যিই কি কেউ নেই?’ সুরেশ অন্যমনস্কভাবে বলে, ‘সুজন, ওখানে কিছু তো আছে! সামথিং মিস্টিরিয়াস, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই! তা ছাড়া কারণ যাই হোক, ভূমিকম্প, তান্ত্রিকের অভিশাপ বা মোগল মোঘল আক্রমণ—যেখানে অত মজবুত রাজপ্রাসাদ, দোকান-পাট, রাস্তা-ঘাট সব একরাতের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেল; সেখানে মন্দিরগুলোর কিচ্ছু হল না! ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয়? তাছাড়া ইথান ওলসেনের লেখাটা পড়েছিস? উনিও কিন্তু স্পষ্ট বলেছেন, মন্দিরের মধ্যেই নেগেটিভ এনার্জি সবচেয়ে বেশি মাত্রায় আছে!’
‘তুই বিশ্বাস করবি কিনা জানি না…!’ দেবযানী ফিসফিস করে বলে, ‘কিন্তু অনেকেই বলে যে ভানগড় ফোর্টের মন্দিরের পাথর নাকি জীবন্ত! ওরা নিজেরাই নিজেদের ঠিক করে নিয়েছিল৷ যার জন্য ঐ শতাব্দীপ্রাচীন মন্দিরগুলোয় আজ পর্যন্ত একটা চিড়ও ধরেনি৷ মন্দিরগুলোর পাথর নিজেরাই নিজেদের রিকনস্ট্রাক্ট করতে পারে৷ কোনোভাবে ভেঙে গেলে বা ফাটল ধরলে নিজেই সেসব সারিয়ে তোলে৷’
কথাটা শুনে সুজনেরও দেহে মুহূর্তের মধ্যে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল৷ কিন্তু সেটা কাটিয়ে উঠে সে সজোরে হেসে বলল, ‘জীবন্ত মন্দির! কীভাবে একটা পাথরের দেওয়াল নিজেকেই নিজে জোড়া দিতে পারে? অপারেশন করে?’
‘তা জানি না৷’ দেবযানী সন্দিগ্ধভাবেই জানায়, ‘কিন্তু কিছু তো রহস্য আছেই৷ নয়তো ভানগড় ফোর্টকে ইথানের মতো একজন বিখ্যাত বিশারদ ‘মোস্ট ডেঞ্জারাস প্লেস’ বলতেন না৷’
শব্দটা শুনে সুজনের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়ে৷ মোস্ট ডেঞ্জারাস প্লেস! সে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল, ‘ননসেন্স৷’
৩
‘ননসেন্স নয় স্যার৷’
ছেলেটার চোখ দুটো কোটরাগত৷ মুখটা চোঁয়াড়ে৷ একটা ডবল ডেকার বাস বোধহয় ওর নাকের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছে৷ কান দুটো ইঁদুরের মতো খাড়া খাড়া! সব মিলিয়ে দেখতে মোটেই ভালো নয়৷ তবু ওর বিড়ালের মতো পিঙ্গল ক’টা চোখে কী যেন আছে! না, ভুল হল! বলা ভালো, ওর চোখে যা থাকা উচিত তার কোনোটাই নেই! প্রথম প্রথম ওর দিকে তাকালেই অদ্ভুত একটা অস্বস্তি টের পাচ্ছিল সুজন৷ বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ করার পর বুঝল যে লোকটার চোখ আছে ঠিকই, কিন্তু দৃষ্টি নেই! সে চোখ ভীষণ শীতল ও অভিব্যক্তিহীন৷ ও হাসছে ঠিকই, কিন্তু সে হাসির লেশমাত্রও ছায়া পড়ছে না ওর চোখে৷ চট করে দেখলে ভ্রান্ত ধারণা হয় যে, ওর চোখ দুটো বুঝি পাথরের! অথচ সে আদৌ অন্ধ নয়! এই ভানগড় ফোর্টের একজন গাইড৷ ওর নাম অতুল৷ বেশ হাসিখুশি, আলাপী ছেলে৷ তা সত্ত্বেও সুজন ওর উপস্থিতিতে অস্বস্তি বোধ করছিল৷
‘আপনারা আধুনিকমনস্ক মানুষ সাহেব৷ তাই এসব কথায় বিশ্বাস করেন না৷ ভাবেন গাঁজাখুরি৷’ অতুল ভানগড় ফোর্টের ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে হাঁটছে৷ ‘নাচন কী হাভেলি’ তথা নর্তকীদের বাড়ি ছাড়িয়ে জহুরিবাজারের জহুরিবাজার বানান স্থানে স্থানে আলাদা৷ দুটোই ব্যবহার্য৷ যে কোনো একটায় থাকা উচিত রাস্তায় চলতে চলতে বলল, ‘কিন্তু বাই’সা যা শুনেছেন, তা আমরাও সত্যি বলেই জানি৷ ভানগড়ের মন্দিরগুলোর মধ্যে কোনো অলৌকিক শক্তি নিশ্চয়ই আছে৷ নয়তো একরাতের মধ্যে রীতিমতো মজবুত একটা কেল্লা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল, অথচ মন্দিরগুলো একদম অটুট থাকল কী করে?’
সুজন, সুরেশ এবং দেবযানীর সামনে এখন টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে চির-রহস্যময়, অভিশপ্ত ভানগড় দুর্গ৷ প্রথম দর্শনেই গা ছমছম করে উঠেছিল ওদের৷ যখন দূর থেকে পাহাড়ের ওপরে ভানগড়ের টানা পাথরের বিরাট পাঁচিল দেখতে পেল, তখনই মনে হয়েছিল যে এক অতিকায় সরীসৃপ বুঝি কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে পাহাড়কে পেঁচিয়ে ধরে৷ যে মুহূর্তে তার ঘুম ভাঙবে, সেই মুহূর্তেই তার শ্লথ, বিরাট দেহ গিলে খাবে সবকিছু৷ অদ্ভুত এক রহস্যময়তা কুয়াশার মতো ঘিরে আছে দুর্গটাকে৷ সেই ইতিহাসের কুয়াশা ভেদ করে ভানগড়ের বাস্তবতাকে আজ পর্যন্ত কেউ উদ্ধার করে উঠতে পারেনি৷ কী ঘটেছিল সেই অভিশপ্ত রাতে! ভূমিকম্প, তান্ত্রিকের অভিশাপ না মোঘল আক্রমণ! কী করে একটা আলোকোজ্জ্বল, অপূর্ব সুন্দর নগর একরাতেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল? তার বাসিন্দাদের পরিণতিই বা কী হয়েছিল; কেউ তা আজও ঠিক করে বলতে পারেনি৷ আর রাজকন্যা রত্নাবতী? তিনিই বা কোথায় গেলেন?
এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পায়নি ওরা৷ গাড়িতে আসার পথে ভানগড়ের নিকটবর্তী গ্রামগুলোয় জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করছিল৷ কিন্তু ভানগড় ফোর্টের নাম শুনলেই স্থানীয় বাসিন্দারা কোনো কথা না বলে স্রেফ দ্রুত পায়ে কেটে পড়ে৷ যেন ঐ অভিশপ্ত দুর্গের নামোচ্চারণ করলেই বিপদ অনিবার্য৷ দু-একজন সাহসী মানুষ অবশ্য ওদের বারবার সতর্ক করেছে৷ বলেছে, ‘ওটা বহুশতাব্দীর অভিশপ্ত ‘কিলা’ সাহেব৷ ওর থেকে দূরে থাকাই ভালো৷’
সুজন কৌতুহলী, ‘কেন বলুন তো! কী এমন আছে ওখানে!’
‘কী আছে, তা দেখিনি সাব৷ দেখার সাহস কোনোদিন হয়নি৷’ অত্যন্ত সন্তর্পণে উত্তর এল, ‘কিন্তু কিছু তো আছে৷ ভানগড় দিনে একরকম, রাতে অন্যরকম৷ আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে শুনেছি যে রাত্রে নাকি ভানগড় জেগে ওঠে৷ বহু মানুষের চেঁচামেচি শোনা যায়৷ মেয়েদের খিলখিল হাসি, ঘুঙুরের শব্দ; আরও অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসে ‘কিলা’র ভেতর থেকে৷’
সুরেশ জানতে চায়; ‘এসব গল্প তো তোমাদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতা৷ কিন্তু নিজের কানে কিছু শুনেছ বা দেখেছ?’
‘রাম! রাম!’
‘সদিযেঁসে বো সবসে শাপিত কিলা হ্যয় সাব৷ উসসে দূর রেহেনাই আকল কা কাম হোগা৷’
সুজন কৌতূহলী—‘কিঁউ? ইতনা ক্যয়া হ্যায় উসমে?’
‘ক্যয়া হায় বো দেখনে কী কোশিশ কভি কি নাহি৷ উতনা সাহস ভী হ্যায় নাহি৷’ অত্যন্ত সন্তর্পণ উত্তর এল—‘লেকিন কুছ তো হ্যায় জরুর৷ ভানগড় দিন মে কুছ হ্যায়, রাত কো আউর কুছ৷ হামারা বুজুর্গ সে সুনে হ্যায় কী ভানগড় রাত কো জাগ উঠতি হ্যায়৷ বহোত সারে আদমীয়োঁ কা একসাথ চিখনে কা আবাজ সুনাই দেতা হ্যায়৷ ঔরতোঁ কী চিখতি হুই হাসি কী আবাজ, পায়াল কী ঝঙ্কার, অউর ভী সব ভ্যয়ঙ্কর আবাজ সুনাই দেতে হ্যায় কিলে সে৷’
সুরেশ জানতে চায় ‘ইয়ে সব বাতেঁ আপ বুজুর্গ সে সুনে হ্যায়, লেকিন আপ খুদ কভি কুছ দেখে হ্যায় ইয়া সুনে হ্যায় ক্যয়া?’
‘রাম! রাম!’
লোকগুলো তৎক্ষণাৎ যেন পালিয়ে বাঁচল! ওরা প্রত্যেকেই বুঝল যে এর বেশি আর কোনো কথা গ্রামবাসীরা বলবে না৷ অভিশপ্ত দুর্গের ভয় ওদের ভেতরে এতটাই প্রবল যে কোনোমতেই তার সম্পর্কে কিছুই বলতে চায় না৷ সুজন অবশ্য ওদের ভয় দেখে অনেকটাই আশ্বস্ত হয়েছে৷ ভালোই হয়েছে৷ একটা মূর্তিকে কেটে বের করতে গেলে রীতিমতো শব্দ হয়৷ ম্যানুয়াল হ্যাক শ’, চিজেল বা ছেনি-হাতুড়ির আওয়াজ নির্জন দুর্গে বেশ জোরে শোনা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ কিন্তু যেহেতু রাতে ভানগড়ের ত্রিসীমানায় কেউ আসে না, সুতরাং আওয়াজ হলেও ধরা পড়ার চান্স একেবারেই নেই৷ যদি দৈবাৎ কেউ শুনেও ফেলে, তবে ভৌতিক শব্দ ভেবে পিটটান দেবে৷ ফলস্বরূপ ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো কাজটা অতি সহজেই হয়ে যাবে৷
‘এখানে কি একটা বিল্ডিংও আস্ত নেই?’
দেবযানী অতুলের পেছন পেছন হাঁটছিল৷ চতুর্দিকে খালি হাড়-পাঁজর বের করা ধ্বংসাবশেষ আর পাথুরে দেওয়াল দেখতে দেখতে মেয়েটা বিরক্ত হয়ে উঠেছে৷ নর্তকীদের ‘হাভেলি’তে স্রেফ কয়েকটা মজবুত থাম আর ভাঙা পাথরের চাঁই ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই৷ জহুরিবাজার হয়তো কোনোসময়ে জমজমাট কোনো বাজার ছিল৷ এখন শুধু ভাঙা পাথরের অবশেষ সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়৷ দেবযানী যথারীতি প্রথমে আপত্তি করলেও টাকার অঙ্কটা শুনে রাজি হয়ে গিয়েছে৷ তবে সুজনকে এ-ও বলে রেখেছে যে এই কাজটা করার পর সে এ পেশা ছেড়ে দেবে৷ যে টাকাটা ও পাবে, তা দিয়ে কোনো ব্যবসা শুরু করবে৷ সুরেশেরও প্ল্যানিং তেমনই৷
‘আছে তো! এই দেখুন, ‘মোরোঁ কী হাভেলি৷’
ওদের গাইড অতুল সামনের একটি দালান দেখিয়ে বলল, ‘রাজকন্যা রত্নাবতী ময়ূর পুষতেন৷ সেজন্য ময়ূরদের একটা হাভেলিই তৈরি করা হয়েছিল৷ এখন অবশ্য ওখানে ময়ূর থাকে না৷ বাদুড়-চামচিকেরা ওখানেই ঘাঁটি বানিয়েছে৷’
দেবযানীর ঠিক পেছনেই সুরেশ হাতে হাই ডেফিনিশন ক্যামকর্ডার নিয়ে হাঁটছিল৷ সে এখন ভানগড়ের দৃশ্য ক্যামেরায় তুলতে ব্যস্ত৷ কথাটা শুনেই ফোড়ন কাটল, ‘রাজকীয় শখ! মানুষের জায়গা হয় না; আবার ময়ূরের জন্য আস্ত হাভেলি!’
‘তা বটে স্যার!’ বলতে বলতেই অতুল মূল রাজপ্রাসাদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে, ‘ঐটা ছিল রাজপ্রাসাদ৷ এখন তো দেখছেনই, তেমন কিছুই নেই! শুধু রত্নাবতীর মহলটা কোনোমতে টিঁকে আছে৷’
সুজনের অবশ্য অত মহল-টহল নিয়ে বিশেষ উৎসাহ নেই৷ সে মন্দিরগুলোকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছিল৷ ভানগড়ের চতুর্দিকে মন্দিরের ছড়াছড়ি! এবং আশ্চর্যভাবে সেগুলো সম্পূর্ণ অক্ষত! মেইন গেট দিয়ে ঢোকার সময়ই শ্বেতপাথরের তৈরি হনুমান মন্দির দেখেছে৷ সেখানে একজন পূজারিও আছেন৷ কিন্তু শ্বেতপাথরের হনুমানের বিগ্রহ তাকে তেমন আকর্ষণ করেনি৷ এ ছাড়াও দেখেছে সোমেশ্বরের মন্দির, মঙ্গলাদেবী মন্দির, নবীন মন্দির এবং গণেশমন্দির৷ পরের মন্দিরগুলো এখন ফাঁকা৷ বিগ্রহও নেই৷ দেওয়ালে কিছু ভাস্কর্য আছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো তেমন জাঁকালো কিছু নয়৷ সে সতর্ক দৃষ্টিতে চতুর্দিকটা দেখছিল৷ অর্জুনের পাখির চোখের মতো তারও এখন একটাই লক্ষ্য৷ গোপীনাথ মন্দির ও রত্নাবতীর আদলে তৈরি দেবীমূর্তি!
বেশ কিছু সঙ্কীর্ণ পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে রত্নাবতীর মহলে ঢুকতে না ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা ও চামচিকের চিমসে গন্ধ ওদের ঘিরে ধরল৷ মহলের ভেতরে কয়েকটি ঘর এখনও অবশিষ্ট আছে৷ পাথরের মজবুত মহলগুলো কিছু গোপন ইতিহাস বুকে নিয়ে টিঁকে রয়েছে৷ বাকিটা ধ্বংসস্তূপ৷ দেখলেই কেমন যেন অলৌকিক অনুভূতি হয়! হাড়-পাঁজর বের করা দেওয়াল, কালো কালো ছোপওয়ালা ছাত যেন কিছু বলতে চাইছে! সুরেশ দুর্গটাকে যত দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে! আপাদমস্তক পাথরে তৈরি এই দুর্গকে কামানের গোলাও ভাঙতে পারত না৷ তবে কী এমন শক্তি এই মজবুত দুর্গকে একেবারে আগাপাশতলা দুমড়ে মুচড়ে দিল কে জানে!
দেবযানী লক্ষ করল, রত্নাবতীর ঘরে একটি পাথরের তাকের ওপরে সাজানো রয়েছে প্লাস্টিকের চিরুনি, কাচের চুড়ি, পুঁতির হার আর ঝাঁঝর! অতুল তার কৌতূহলী দৃষ্টি লক্ষ করে হাসল৷
‘ওগুলো স্থানীয় বাসিন্দারা রেখে গিয়েছে বাই’সা৷ ওদের বিশ্বাস রাজকন্যা রত্নাবতীর আত্মা এখনও এই দুর্গে ঘুরে বেড়ায়৷ তাই তাঁর শৃঙ্গারের সরঞ্জাম রেখে যায় ওরা৷’
সুরেশ ক্যামকর্ডার দিয়ে এতক্ষণ ভিডিও তুলতেই ব্যস্ত ছিল৷ কথা নেই, বার্তা নেই আচমকা তার নাকের সামনে দেবযানী এসে হাজির! পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে খোলা জানলা দিয়ে কী যেন দেখছে সে! ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়েছে তার অপূর্ব ঘন কালো লম্বা চুল! হাওয়ায় সেই রেশমী চুল অল্প অল্প উড়ছে! বেচারি সুরেশ মন দিয়ে মহলের ভিডিও তুলছিল, এরকম বাধা পেয়ে বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, ‘অ্যাই দেবযানী, সামনে থেকে সর! তোর এলোকেশী রূপ তোলার জন্য আমি মোটেও ভিডিও তুলছি না!’
‘কীসব ভুলভাল বকছিস!’ সুরেশের পেছন থেকে শোনা গেল দেবযানীর শাণিত কন্ঠস্বর, ‘আমি তো তোর পেছনে৷ তা ছাড়া এলোকেশী মানে? আমি রীতিমতো টপনট বেঁধে রেখেছি৷’
‘হো-য়া-ট!’
সুরেশ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো পেছনে ঘোরে! তার দু-চোখে গভীর বিস্ময়! তাই তো! দেবযানী আদৌ তার সামনে নেই, বরং ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ক্যামেরায় ওর ইমেজ আসা সম্ভবই নয়৷ তবে একটু আগে সে ক্যামেরায় যাকে দেখল, সে মেয়েটি কে! সে তৎক্ষণাৎ সামনের দিকে ফিরল! কই! সামনে কেউ নেই তো! কোথায় সেই এলোকেশী যে একটু আগেই লেন্সের একদম সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল! নেই!
সুরেশ তার বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত ভয় টের পেল৷ তার বিস্মিত দৃষ্টি ছুঁয়ে গেল দেবযানীর মাথার চুল৷ সত্যি! সে একদম শক্ত করে টপনট বেঁধেছে৷ তবে সেই মেয়েটি কে যে একেবারে কোমর ছাপানো ঘন মেঘের মতো একরাশ কাজলকালো চুল নিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল! অথচ দেবযানী ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কোনো নারী এ ঘরে নেই! অন্য ট্যুরিস্ট পার্টির কোনো সদস্যা হতে পারত৷ কিন্তু সেকেন্ডের ভগ্নাংশে সে তবে গেল কোথায়! হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি!
সুজন দেখল সুরেশের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে৷ সে জানতে চায়, ‘কী হল রে! আর ইউ ওকে?’
সুরেশ তখন রীতিমতো ঘামছে৷ সে রিওয়াইন্ড করে একটু আগের তোলা ভিডিও ফুটেজটা দেখল! আশ্চর্য! সেখানে কোনো নারীই নেই! পাগলের মতো ফুটেজের মধ্যে সেই অদেখা মেয়েটিকে খুঁজছে যার শুধু পেছনটাই ধরা পড়েছিল তার চোখে৷ কিন্তু কোথায়! কেউ নেই! শুধু রত্নাবতীর মহলের দৃশ্যই রয়েছে৷ আর কেউ নেই! কিছু নেই!
সে ঘাবড়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই চেপে গেল৷ যদিও তখন তার বুকের ভেতরে হূৎস্পন্দন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে, তবু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল সে৷ ঢোঁক গিলে বলল, ‘আই অ্যাম ফাইন৷’
তার অবস্থা দেখে গাইড অতুল যেন একটু ব্যঙ্গবঙ্কিম হাসল৷ তার হাসিটা বেশ অর্থপূর্ণ ও রহস্যময়৷ সে আস্তে আস্তে বলে, ‘চলুন স্যার৷ এবার গোপীনাথ মন্দিরটা দেখে নিন৷ ওটা অবশ্য তালা দেওয়া থাকে৷ ভেতরের গর্ভগৃহে যেতে পারবেন না৷ তবে বাইরে থেকে দেখতে পাবেন৷ তাছাড়া সন্ধ্যা হয়েও আসছে৷ আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়৷’
‘ভেতরে কেন যাওয়া যাবে না?’ সুজন আগ্রহ চেপে রাখতে পারে না,‘অন্যান্য মন্দিরগুলো তো খোলা ছিল৷’
অতুল মৃদু হাসে, ‘আসলে গোপীনাথ মন্দিরে রাজকন্যা রত্নাবতীর আদলে তৈরি একটি অতুলনীয় দেবীমূর্তি আছে৷ অনেক মূর্তিচোরের ওর ওপর নজর ছিল৷ বেশ কয়েকবার মূর্তিটা ভেঙে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও হয়েছে৷ তাই সরকার থেকে মন্দিরটাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷’
‘কেউ মূর্তিটাকে চুরি করতে পারেনি?’
‘নাঃ!’ সে বলল, ‘চেষ্টা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বললাম না—এ মন্দিরগুলো সব জাগ্রত! চোরেরা ভাঙার চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু মন্দিরের পাথরগুলো নিজেই সেইসব ভেঙে যাওয়া অংশ মেরামত করে নিয়েছে৷ এ পাথর মেরামতি করার ওষুধ জানে স্যার৷ এ পাথরে প্রাণ আছে৷’
সুজন স্থিরদৃষ্টিতে গাইডের দিকে তাকায়৷ ওর হঠাৎ মনে হল, এই ছেলেটা বোধহয় জানে যে ওরা কী উদ্দেশ্যে এসেছে! ওর ঠোঁটের কোণের হাসিটা ভীষণ রহস্যময়! তা ছাড়া মুখটাও কেমন যেন চেনা চেনা৷ সে চোখ কুঁচকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকায়৷ আগে কোথাও ওকে দেখেছে কি?
‘একটা কথা বলব?’ অতুল তার পাথরের মতো শীতল চোখ দুটো সুজনের চোখের ওপর রাখল৷ তারপর গলা নামিয়ে আস্তে আস্তে অনুরোধের সুরে বলল, ‘আর যাই করুন, মূর্তির গায়ে ভুলেও হাত দেবেন না স্যার৷ প্লিজ, ওটা করবেন না৷’
‘মানে?’
তিনজনই একসঙ্গে যেন তড়িদাহতের মতো কেঁপে ওঠে৷ কী বলতে চাইছে অতুল! ও কী অন্তর্যামী! সুজন নিজেকে সামলে নিয়ে রুক্ষ কণ্ঠস্বরে বলে,‘কী সব উলটোপালটা বলছ! হাউ ডেয়ার ইউ!’
অতুল তখনও তাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে৷ দেবযানীর গা শিরশিরিয়ে ওঠে৷ ও লক্ষ করল, ছেলেটা একবারও চোখের পলক ফেলে না! ওর দৃষ্টি একদম স্থির! অবিকল পাথরের চোখের মতো!
‘চলুন৷ গোপীনাথ মন্দিরটা দেখে নিই৷’ অতুল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; ‘সন্ধে হয়ে আসছে৷ রাত হয়ে গেলে আবার কী হয় ঠিক নেই!’
৪
ভানগড় ফোর্ট থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ওরা কোনো কথা বলল না৷ দেবযানী তার স্বভাবগত প্রগলভতা যেন ভুলে গিয়েছে৷ সুরেশ তখনও বারবার রানি রত্নাবতীর মহলের ভিডিওটা দেখছে৷ আর সুজনের কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ৷ তার চোখ দুটো অন্যমনস্ক৷ নিবিষ্ট চিত্তে কী যেন ভেবে চলেছে সে৷
ওদের গাড়ির ড্রাইভারের নাম দীননাথ৷ সে ভানগড় ফোর্ট থেকে তিন কিলোমিটার দূরের একটা গ্রামে থাকে৷ ওরা তিনজন দীননাথের বাড়িতেই থাকবে৷ তেমনই ব্যবস্থা হয়েছে৷ দীননাথও মিঃ ও’ কোনরেরই লোক৷ একরকম এজেন্টই৷ এমনিতে সাধারণ দর্শন এক যুবকই বটে, কিন্তু অত্যন্ত চটপটে ও বুদ্ধিমান৷ দুর্গ থেকে ফেরার পথে সে-ই ওদের মধ্যে প্রথম মুখ খুলল৷ হেঁড়ে গলায় জানাল, ‘স্যার, ম্যাডাম; আপনাদের থাকার ব্যবস্থা আমার বাড়িতেই হয়েছে ঠিকই, কিন্তু হোটেলের আরাম, বিলাস-ব্যসন কিন্তু পাবেন না৷ জলের অভাব আছে৷ আর খাওয়াদাওয়া আমার বাড়িতেই হবে, তবে খাওয়ার খরচ আলাদা৷ আগেই বলে রাখলাম৷ পরে বাহানা করবেন না৷’
সুজন কথাটা শুনেও পাত্তা দিল না৷ ওরা এখানে বেড়াতে আসেনি৷ বরং একটা গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন কাজে এসেছে৷ ফাইভ স্টার হোটেলের অ্যাকোমোডেশন না পেলেও চলবে৷ সুরেশ কথাটা শুনল কিনা কে জানে! সে তখনও ভিডিও ফুটেজটাই বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে চলেছে৷ খুব নিস্পৃহভাবে একটা আলগা ‘হুঁ’ বলে ফের ফুটেজে মন দিল৷ একমাত্র দেবযানীরই ভুরু অসন্তাোষে বেঁকে যায়৷ সে যথারীতি বিরক্ত, ‘কেন? আশেপাশে কোনো ভালো হোটেল নেই?’
‘হোটেল?’ দীননাথ ফিক করে হাসল, ‘এ কী গোয়ার সমুদ্র পেয়েছেন বাই’সা যে হাতের কাছেই হোটেল পাবেন? দিল্লি থেকে দুশো পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে রয়েছেন আপনি৷ এটা ভানগড় ফোর্ট! হোটেল তো দূর;এর ত্রিসীমানায় কোনো গ্রামই নেই! সব শুনশান!’
‘সে কী!’ দেবযানী অবাক, ‘ফোর্টের আশেপাশেই তো কিছু ঘর দেখলাম যেন মনে হল!’
সে বিষণ্ণভাবে মাথা ঝাঁকায়, ‘হ্যাঁ৷ শুধু ঘরই আছে৷ কিন্তু লোক দেখেছেন কি? দেখবেন না৷ কারণ লোক নেই৷ ঘরগুলোও সব ভাঙা ও পরিত্যক্ত!’
‘সে কী! কেন?’
দীননাথ একমুহূর্তের জন্য কী বলবে ভেবে পায় না৷ তারপর একটু দ্বিধাজড়িত স্বরে বলে, ‘কী জানি বাই’সা৷ বেশ কয়েকবার কিছু মানুষ ফোর্টের ধারেকাছে গ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু কোনোবারই টেঁকেনি৷ গ্রামের সব ঘর হয় আচমকা ভেঙে পড়ে; নয়তো মহামারিতে গাঁ উজাড় হয়ে যায়! শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়ে প্রাণের দায়ে মানুষেরা এখান থেকে চলে গিয়েছে৷ ঘরগুলো বহুবছর ধরে পরিত্যক্তই পড়ে রয়েছে৷ ওখানে কেউ থাকে না৷’
‘কেন?’ দেবযানী কৌতূহলী, ‘হঠাৎ কোথাও কিছু নেই, আচমকা ঘর ভেঙে যাবে কেন? ঝড়-টড় বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ…৷’
‘কিচ্ছু না বাই’সা৷’ দীননাথ সংশয়ান্বিত; ‘বিশ্বাস করুন৷ আজ পর্যন্ত এখানে কেউ বাস করতে পারেনি৷ যেমন ভানগড় কী কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল,সেটা আজও অজানা রয়ে গিয়েছে, তেমনি তার আশেপাশের গ্রামগুলোও কীভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, তাও কারোর জানা নেই৷ সবাই বলে যে ভানগড়ের অভিশাপের ছায়া নাকি আজও গ্রামগুলোর ওপর কায়েম আছে৷’
‘কার অভিশাপ?’
খুব অন্যমনস্কভাবে প্রশ্নটা করল সুজন৷ তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একঝলক দেখে নিল দীননাথ৷ আস্তে আস্তে বলল, ‘কী বলব স্যার, অনেকরকম কথাই আছে৷ কিন্তু যত গল্প আছে তার সবক’টার মধ্যে একটা জিনিসই এক৷ অভিশাপ আর ব্ল্যাক ম্যাজিক৷ যেটা সবচেয়ে ফেমাস সেটা তো জানেনই৷ রত্নাবতী আর তান্ত্রিক সিঙ্ঘিয়ার কালোজাদুর গল্প৷ সিঙ্ঘিয়া পাথর চাপা পড়ে মরেছিল৷ আর তার অভিশাপেই নাকি ভানগড় ধ্বংস হয়৷ অনেকেই বলে, সিঙ্ঘিয়া আর রত্নাবতীর আত্মা এখনও ঘুরে বেড়ায়৷ এখনও ওঁদের মুক্তি হয়নি৷ এ ছাড়াও আরেকটা গল্পও আছে৷’
‘কীরকম?’ দেবযানী কৌতূহলী৷
দীননাথ আস্তে আস্তে বলে, ‘ভানগড়ের প্রতিষ্ঠাতা মাধো সিং যেখানে ভানগড় দুর্গ তৈরি করছিলেন তার একটু কাছেই গুরু বালুনাথ নামের এক সন্ন্যাসী থাকতেন৷ মাধো সিং গুরু বালুনাথের কাছে ফোর্ট তৈরি করার অনুমতি চান৷ বালুনাথ অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর একটা শর্ত ছিল৷ তিনি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, দুর্গ তৈরি হলেও রাজপ্রাসাদের ছায়া যেন তাঁর সাধনপীঠে না পড়ে৷ যদি কোনোভাবে মহলের ছায়া তাঁর ধ্যান করার জায়গায় এসে পড়ে, তবে তৎক্ষণাৎ ভানগড় ধুলোয় মিশে যাবে৷’ বলতে বলতেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘মাধো সিং কথা রেখেছিলেন৷ কিন্তু তাঁর পরবর্তী শাসকেরা গুরু বালুনাথের কথা ভুলে গিয়েছিলেন৷ রাজমহল বহরে বাড়তে থাকে৷ আর যথারীতি তার ছায়া গুরু বালুনাথের সাধনপীঠের ওপর পড়ল৷ সেই রাতেই নাকি ভানগড় শেষ হয়ে গিয়েছিল৷’
‘রিয়েলি?’ সুজনের কথায় ব্যঙ্গের সুর মিশল, ‘তাহলে আসল অভিশাপের মালিক কে? সিঙ্ঘিয়া না বালুনাথ?’
দীননাথ হাসল, ‘সেটা বলা মুশকিল স্যার! লোকে অনেকরকম কথাই বলে৷ আমি নিজেই ছোটবেলা থেকে অন্তত দু-তিনটে গল্প শুনে এসেছি যার মধ্যে এ দুটোই ফেমাস৷ গুরু বালুনাথের কথা সত্যি হলেও হতে পারে৷ কারণ ঐ ভাঙা দুর্গে তাঁর সমাধিও আছে৷ তবে আরও দুটো কারণ শুনেছি৷’
‘মোঘল আক্রমণ; রাইট?’
সে মাথা ঝাঁকায়, ‘হ্যাঁ স্যার৷ কেউ কেউ বলে মোঘল আক্রমণের ফলে ভানগড়ের সর্বনাশ হয়৷ আবার কেউ বলে ভানগড়ের প্রতিবেশী রাজ্য আজবগড়ের সঙ্গে যুদ্ধে ভানগড় বিলুপ্ত হয়৷ কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক জানি না!’
‘থ্যাঙ্ক গড!’ সুজন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ‘অন্তত দুটো কারণ তো পাওয়া গেল যা যুক্তিযুক্ত৷ নয়তো ব্ল্যাক ম্যাজিক, অভিশাপ আর জ্যান্ত মন্দিরের ঠ্যালাতেই তো চোখে অন্ধকার দেখছিলাম!’
‘হাল্কাভাবে নেবেন না স্যার৷’ দীননাথ চাপাস্বরে বলে, ‘আমাদের গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা বলেন, রাত হলেই নাকি ভানগড় জেগে ওঠে৷ আবার সেই অতীতে ফিরে যায়৷ যা যা ভেঙে গেছে, সব গড়ে ওঠে৷ রাজমহল সেজে ওঠে৷ সেজে ওঠে জহুরিবাজারও৷ আর প্রেতাত্মারা নাকি ঘুরে বেড়ায়! বাইরে থেকে অনেকেই নাকি মেয়েদের হাসি, গান-বাজনা, ঘুঙুরের আওয়াজ শুনেছে!’
সুজন এককথায় উত্তর দিল, ‘রাবিশ!’
‘কিন্তু ভানগড়ের সামনে ঐ বোর্ড? আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ঐ বিরাট নিষেধাজ্ঞাটা তবে কেন আছে? কেন সন্ধে না হতেই সরকার ফোর্টের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়?’
দেবযানীর সংশয় তবু কাটে না৷ সুজন মৃদু হাসল, ‘সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? ভানগড়ের লোকেশনটা দ্যাখ! ফোর্টটা আরাবল্লির ‘সরিস্কা টাইগার রিজার্ভের’ বর্ডারে! ফোর্টের চতুর্দিকে এত জঙ্গল যে সেখান থেকে বন্যপ্রাণী যখন-তখন চলে আসতে পারে! আর সন্ধের পরেই সচরাচর বাঘ বা অন্যান্য মাংশাসী প্রাণীরা বেরোয়৷ সেজন্যই ট্যুরিস্টদের সেফটির কথা ভেবেই বোর্ড আর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে৷ ভূতের জন্য নয়! বুঝেছিস? ভানগড়ের আশেপাশের গ্রামগুলোও গড়ে উঠতে পারেনি সম্ভবত ঐ কারণেই৷ নিরাপত্তার অভাব৷ কোনো অভিশাপ-টাপ নয়৷ ওসব স্রেফ গল্প৷’
দেবযানী কী বুঝল কে জানে৷ তবে তার মুখ দেখে খুব আশ্বস্ত হয়েছে বলে মনে হল না৷ সুরেশ এতক্ষণ ভিডিও ফুটেজ দেখতেই ব্যস্ত ছিল৷ এবার মুখ তুলে বলল, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি এখন?’
‘গোলা কা বাস৷’ দীননাথ উত্তর দেয়, ‘আমার গ্রামে৷ ওখানেই আজকের দিনটা রেস্ট নেবেন৷ যা করার কাল রাত থেকে শুরু করবেন৷ তবে আমি আর আপনাদের গাড়ি করে পৌঁছে দিতে পারব না৷ গোলা কা বাস থেকে পায়ে হেঁটেই আপনাকে ভানগড় দুর্গে আসতে হবে৷ ট্যুরিস্টরাও বেশিরভাগ তাই-ই আসে৷’
‘হুঁ৷’
একটা আলতো উত্তর দিয়ে ফের চিন্তামগ্ন হয়ে গেল সুরেশ৷ সে তখনও ভেবে চলেছে; ক্যামেরায় যে মেয়েটাকে সে পেছন থেকে দেখেছিল সে কে! কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেল! আদৌ ঠিক দেখেছে? না পুরোটাই ভ্রান্তি! যদি সত্যিই ওখানে কোনো মেয়ে থাকত তাহলে রেকর্ডেড ফুটেজে তাকে নিশ্চয়ই দেখা যেত৷ কিন্তু ফুটেজে কেউ নেই! তবে?
দেবযানী আড়চোখে তাকিয়ে দেখল সুজনের মুখের হাল্কা হাসিটাও মিলিয়ে গিয়েছে৷ সে ও বাইরের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে৷ তার মনেও একটা চিন্তাই বারবার ঘাই মেরে উঠছে৷
অতুলকে অত চেনা চেনা লাগছিল কেন? আগে কোথাও দেখেছে কি? কোথায়!
৫
আজ পূর্ণিমার রাত৷ রুপোলি জ্যোৎস্নায় চতুর্দিক ভেসে যাচ্ছে৷ পূর্ণ চাঁদের আলো মায়াবী আভায় ধুইয়ে দিচ্ছে ভানগড় ফোর্ট সংলগ্ন অরণ্যকে৷ আরাবল্লির পাথুরে দেহও চিকচিক করে ওঠে জ্যোৎস্নার ইশারায়৷ আকাশ সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত৷ গাঢ় নীল প্রেক্ষাপটে টুপটুপ করে চোখ মেলছে নক্ষত্রের দল৷ দেখলেই মনে হয়, একরাশ অভ্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আকাশের বুকে৷ তাদের জ্যোতি যতটা শান্ত, ঠিক ততটাই রহস্যময়! যেন বহু আলোকবর্ষের মন্তব্য, আলোকবর্ষ দূরত্বের মাপ সময়ের নয় অভিজ্ঞতা নিয়ে উদগ্র কৌতূহলে তাকিয়ে আছে! বুকের মধ্যে চাপা আশঙ্কার আগুন জ্বলছে তাদের; কে জানে, কী হয়!
আপাতত চতুর্দিকে ছায়া ছায়া মহিরুহের নিশ্চুপ উপস্থিতি৷ প্রাচীন গাছগুলো যেন রাজকীয় দম্ভভরে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ কখনও কখনও মৃদু হাওয়া শিরশির করে উঠে তাদের পাতায় পাতায় দুর্বোধ্য কিছু সংলাপ বিনিময় করছে৷ এ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই! চারিদিক থমথম, নিশ্চুপ! কখনও কখনও মনে হয় গাছের ফাঁক দিয়ে বুঝি কোনো ছায়া সাঁত করে সরে গেল! আশঙ্কা হয়, এই নিঃঝুম রাত্রির পেছনে হয়তো কোনো রহস্যাবৃত অন্ধকার ওঁত পেতে আছে! এখনই সমস্ত নীরবতাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে বেরিয়ে আসবে! সে এক প্রবীণ অন্ধকার৷ যে সব কিছু জানে, সব কিছু দেখেছে!
ঠিক তার মাঝখানেই প্রাগৈতিহাসিক দৈত্যের মতো বিরাট কলেবর নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কুখ্যাত ভানগড় ফোর্ট৷ দাম্ভিক, রহস্যময় অথচ ভীষণ বিষণ্ণ! দুর্গ নয়, ইতিহাসের হাহাকার! ভানগড়ের রাজমহলের ঠিক মাথার ওপরেই রুপোর থালার মতো ষোড়শী চাঁদ দেখা দিয়েছে৷ কিন্তু দেখলেই মনে হয়, সে বড় ভয়ে ভয়ে উঁকি মারছে৷ চাঁদের আলো এসে ছুঁয়েছে ভানগড়ের ভাঙাচোরা দেহ৷ পেশিবহুল হাতের মতো পাথুরে প্রাচীর এলিয়ে আছে হতাশায়৷ জ্যোৎস্নাও যেন তার স্বভাবগত চাপল্য হারিয়ে ফেলেছে ভানগড়ের রাজমহলকে স্পর্শ করে৷ তার উচ্ছ্বাসিত আলো দুর্গের কাছে এসেই বিষণ্ণতায় হারিয়ে গিয়েছে৷ জ্যোৎস্না নয়, যেন এক ফ্যাকাশে পিঙ্গল বিষণ্ণতা চুঁইয়ে পড়ছে ভানগড় ফোর্টের পাথুরে শরীর থেকে৷ চতুর্দিকে শুধু খাঁ খাঁ করা শূন্যতা! ধ্বংসস্তূপগুলো এক বিরাট কঙ্কালের হাড়-পাঁজরের মতো পড়ে রয়েছে৷ পাথরের জানলা, দরজাগুলো হাঁ করে রয়েছে ক্ষুধার্ত মানুষের মতো৷ অপেক্ষা করছে একবিন্দু সুখের৷ পেলেই যেন গিলে নেবে গোটা বিশ্ব-চরাচরের সমস্ত সুখ, সমস্ত আনন্দকে৷ অথচ শূন্যতা ছাড়া তার পাওয়ার আর কিছুই নেই! সেই শূন্যতাকে পূর্ণতা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে জ্যোৎস্নার আলো! কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে৷ তার স্তিমিত আভা গিলে নিচ্ছে জমাট অন্ধকার৷ চতুর্দিকের থমথমে নৈঃশব্দ্য যেন মুখর হয়ে বলে উঠতে চাইছে, ‘এ দুনিয়া জীবিত মানুষের জন্য নয়! এ দুনিয়া জাগতিক কোনো অনুভব বা বস্তুর জন্য নয়! এ অন্য পৃথিবী!’
‘লুকস ক্রিপি!’ সুরেশ একটা শ্বাস টেনে বলল, ‘কেমন অদ্ভুত লাগছে না দুর্গটাকে? হরর মুভি শু্যট করার জন্য আইডিয়াল!’
ওরা তিনজন এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুর্গের মেইন গেটে৷ দেবযানী একঝলক ভানগড়ের বিরাট বহরটাকে মেপে নিল৷ দিনের বেলাতেই দুর্গটা দেখলে খুব অস্বস্তি হয়৷ এখন অস্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা ভয়ও অনুভব করল সে৷ এই সেই ভানগড়! সেই কুখ্যাত ঐতিহাসিক স্থল, যেখানে নাকি আজও অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়ায়! এই সেই অভিশপ্ত কেল্লা যার সম্পর্কে স্বয়ং ডঃ ইথান ওলসেন লিখেছেন; ‘মোস্ট ডেঞ্জারাস প্লেস!’
সুজনের অনুভূতিটা অবশ্য অন্যরকম৷ তার বুকের মধ্যে একটা অজ্ঞাত গভীর বেদনা জমেছে৷ এই বেদনার কোনো উৎস নেই! ভানগড়ের দৃশ্যটা দেখে হঠাৎই তার মনে হল; দুনিয়ায় আনন্দ বলে আসলে কিছুই নেই! ‘সুখ’, ‘আশা’, ‘স্বপ্ন’ নামের কোনো বস্তু আসলে হয় না! ওসব মরীচিকা!
অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়! একটু আগেও সে অর্থপ্রাপ্তির কথা ভেবে উত্তেজিত ছিল৷ কিন্তু আচমকাই সেই উত্তেজনার বদলে এক অদ্ভুত হতাশা ঘিরে ধরল তাকে৷ কেন? কারণটা অজ্ঞাত!
সুরেশ ফস করে একটা সিগারেট ধরাল৷ দেবযানী ও সুজন ভানগড়ের দিকে তাকিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল৷ লাইটারের আলোর ঝিলিকে সম্বিত ফিরে পেল৷ সুরেশ আয়েশ করে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল; ‘কাজ শুরু করা যাক৷’
‘শিওর৷’
এতক্ষণে সুজন নিজেকে পুরোপুরি ফিরে পেয়েছে৷ সে তার হাতের এমার্জেন্সি লাইটটাকে মাটিতে নামিয়ে রেখে দুর্গের গেটের তালা খুলতে মন দিল৷ বলাই বাহুল্য যে এই ডুপ্লিকেট চাবিটা ওদের দীননাথ এনে দিয়েছে৷ এমনকি গোপীনাথ মন্দিরের তালার চাবিও সে দিয়ে দিয়েছে৷ কোথায় পেল জিজ্ঞাসা করতেই মৃদু হেসেছিল সে৷ মুচকি হেসে জানিয়েছিল, ‘টাকা ছড়ালে বাঘের দুধও পাওয়া যায় স্যার; এ তো সাধারণ কয়েকটা চাবি!’
ওরা আর কথা বাড়ায়নি৷ স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে মিঃ জেমস ও’ কোনর এই প্রোজেক্টের জন্য প্রচুর টাকা ছড়িয়েছেন৷ দীননাথও সেই হরির লুট থেকে বাদ যায়নি৷ চাবিগুলো সেই ইনভেস্টমেন্টেরই ফলাফল৷ তাই নির্বিবাদে দুটো চাবিই নিয়ে নিয়েছিল৷
গেটের তালা খুলতে অবশ্য বেশি বেগ পেতে হল না৷ সুজন তালায় চাবিটা ঢোকাতে না ঢোকাতেই প্রাচীন ও বিরাট তালাটা সশব্দে কড়াৎ করে খুলে গেল! দেবযানী অবাক হয়ে বলল, ‘ওয়াও! সো ফাস্ট! এত তাড়াতাড়ি তো আমার বাড়ির তালাও খোলে না! আর এটা তো বহু পুরোনো তালা! ফ্র্যাকশন অব সেকেন্ডে খুলে গেল!’
এমার্জেন্সি লাইটের আলোয় সুজনের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল৷ সে নিজেও কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছে৷ সুরেশ সেটা লক্ষ করেই বলে, ‘কী হল? এনিথিং রং?’
সুজন একটু ইতস্তত করে বলল, ‘বুঝতে পারছি না তালাটা এত তাড়াতাড়ি খুলল কী করে!’
‘মানে!!!’
দেবযানী ও সুরেশ দুজনেই একসঙ্গে শব্দটা বলে ওঠে৷ ওদের দিকে তাকিয়ে একটু নার্ভাস হাসি হাসল সুজন, ‘নট আ বিগ ডিল! কিন্তু আমি সবে চাবিটা ঢুকিয়েছিলাম৷ ঘোরাইনি৷ ঘোরানোর আগেই তালাটা এরকম শব্দ করে খুলে গেল! স্ট্রেঞ্জ!’
ওরা তিনজনেই তিনজনের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে৷ তারপর সুরেশ সশব্দে হেসে ওঠে, ‘এর মধ্যে স্ট্রেঞ্জের কিছু নেই৷ তালাটা দেখেছিস? বহুদিনের মরচে পড়া তালা৷ দেখতেই অমন জগদ্দল, আসলে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গিয়েছে৷ ওটার জন্য চাবি লাগে না৷ আমার ধারণা তুই স্রেফ একটা টান মারলেই ওটা খুলে যেত৷ চাবির দরকারই ছিল না৷’
‘হয়তো৷’
সুজন আর বিশেষ পাত্তা দিল না৷ চাবি সমস্যার সমাধান করা ছাড়া তার এখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে৷ যে কাজটা ওরা করতে এসেছে সেটাতেই মনোনিবেশ করা ভালো৷ এমনিতেই এ জাতীয় দুর্গে মূর্তি কাটার কাজটা যথেষ্টই পরিশ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ৷ ড্রিল বিটস বা গ্রাইন্ডিং স্টোনের মতো অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার উপায় নেই৷ কারণ ওগুলো ব্যবহার করতে হলে ইলেকট্রিসিটির প্রয়োজন হয়৷ এই জাতীয় পরিত্যক্ত দুর্গে যা সম্ভবই নয়৷ আর জেনারেটর ঘাড়ে করে নিয়ে মূর্তি কাটতে যাওয়ার কনসেপ্ট নিতান্তই হাস্যকর! সুতরাং ওদের পুরোনো ও সনাতন পদ্ধতিই অবলম্বন করতে হবে৷ অর্থাৎ ছেনি-হাতুড়িই ভরসা৷
আপাতত তিনজনের কাঁধেই তিনটে ভারী ব্যাক-প্যাক ঝুলছে৷ তার মধ্যে রয়েছে চিজেল বা ছেনি, হাতুড়ি, এচিং টুলস, মার্কার, ম্যানুয়াল হ্যাক শ’-এর মতো ‘ভ্যান্ডালস টুলস’৷ এ ছাড়াও আছে টর্চলাইট, মেজারিং টেপ, নাইট ভিশন হাই ডেফিনিশন গগলস, ডাস্ট মাস্ক, সেফটি গগলসের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র৷ সুজনের ব্যাকপ্যাকে অবশ্য এসব ছাড়াও একটি লাইসেন্সড গান রয়েছে৷ রাত্রে কোনো প্রেতাত্মা আসবে কি না জানে না, কিন্তু বন্যপশুর আসার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে৷ আজ রাতে ওদের দীননাথ পৌঁছে দেয়নি৷ গোলা কা বাস থেকে তিন কিলোমিটার হেঁটেই এসেছে ওরা৷ হেঁটে আসাটা খুব বড় ব্যাপার নয়৷ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওদের হেঁটেই অপারেশনে যেতে হয়৷ কিন্তু ভানগড় ফোর্টের পথটা একটু আলাদা৷ একেই শুনশান পাহাড়ি রাস্তা, তার ওপর বন্যজন্তুর ভয়৷ তাই লাইসেন্সড রিভলবারটা সঙ্গেই নিয়েছে সুজন৷
ভানগড় ফোর্টের পাথুরে রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল সুজন৷ পেছনে সুরেশ আর দেবযানী৷ সুজনের স্মৃতিশক্তি প্রায় কম্পিউটারের মতো৷ কোনো জায়গা একবার দেখলে সে ভোলে না৷ অতুল যখন ওদের গোপীনাথ মন্দিরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সে গোটা রাস্তাটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জরিপ করে নিয়েছে৷ অবশ্য সঙ্গে ভানগড়ের ম্যাপটাও আছে৷ অতুল ওদের হনুমান গেট দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল৷ একটু এগোতেই হনুমান মন্দিরটাও চোখে পড়ল৷ তবে এখন মন্দির বন্ধ৷ অর্থাৎ পূজারিও অনুপস্থিত৷ অতুলই জানিয়েছিল, সন্ধে ছ’টার পর এখানে আর কেউ থাকে না৷ এমনকী গেটকিপারও নয়৷ তাই ভানগড় এখন সম্পূর্ণ জনশূন্য৷
অতুল ওদের একটু ঘুরপথে নিয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু সুজন সোজা পথটাই ধরল৷ হনুমান মন্দির একটু ছাড়িয়ে যেতেই ডানদিকে পড়ল সেই ভগ্নস্তূপ৷ এখানে কী ছিল, ভগবানই জানেন৷ কোনো মহল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি৷ কিন্তু আগের দিন যেটা তেমন প্রকটভাবে অনুভব করেনি, রাতের বেলায় সেটাই প্রবলভাবে দেখা দিল! একটা চূড়ান্ত দুর্গন্ধ এসে ঝাপ্টা মারল ওদের নাকে! প্রথমদিকে অতটা বোঝা যায়নি, কিন্তু যত এগোচ্ছে, দুর্গন্ধটা ততই বাড়ছে৷ বাঁ দিকে ‘মোরোঁ কী হাভেলি’ এসে পড়তেই সেই পচা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল ওদের৷ পাকস্থলীর ভেতরটা যেন পাক দিয়ে উঠল!
‘ওঃ!’ দেবযানী আর থাকতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গেই মুখে রুমাল চাপা দেয়, ‘কী জঘন্য গন্ধ! এ তো ক্রমশই বাড়ছে! আগে জানলে পারফিউম নিয়ে আসতাম!’
সুরেশ হাতের সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে নাক কুঁচকোয়, ‘এ কীরকম দুর্গন্ধ রে! কাল দিনের বেলায় তো পাইনি!’
‘আশেপাশে কোনো ইঁদুর বা অন্য কোনো প্রাণী মরেছে বোধহয়!’ সুজন কিন্তু নিস্পৃহ, ‘তারই পচা গন্ধ পাচ্ছিস৷’
‘টেরিব্ল স্মেল! মরা ইঁদুরের গন্ধ এত মারাত্মক!’ দেবযানী কোনোমতে নিজেকে সামলায়, ‘আমার অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসছে৷’
সুরেশ আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, ‘উঁহু! কোনো মরা ইঁদুর বা অন্য কোনো প্রাণীর পচনের গন্ধ এরকম হয় না৷ আমি এই গন্ধটা চিনি! মনে হয় যে…!’
‘কী মনে হয়?’
সুজনের প্রশ্নে সে একটু থমকে গেল৷ তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘যদিও প্র্যাকটিক্যালি ব্যাপারটা অসম্ভব, তবু মনে হয় যে এক নয়, একাধিক মানুষ মারা গিয়েছে৷ আর তারই এত দুর্গন্ধ! আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে একটা গোটা ফ্যামিলি আত্মহত্যা করেছিল৷ প্রথমে কেউ নোটিশ করেনি৷ তোর মতোই সবাই ভেবেছিল যে কোনো জীব-জন্তু মরেছে৷ কিন্তু দু-দিন পরেই দুর্গন্ধের চোটে সবার টনক নড়ল৷ তখন পাশের ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে…!’
‘তুই বলতে চাইছিস যে এটা মরা মানুষের পচা গন্ধ?’ সুরেশকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বলল সুজন, ‘পুরো ইল্লজিক্যাল! এখানে মানুষ কোথা থেকে আসবে!’
সুরেশ চুপ করে যায়৷ দেবযানী একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘মানুষ তো ছিল একসময়ে! তাদের কী হয়েছিল কেউ জানে না! ভানগড় যেদিন ধ্বংস হয়েছিল, সেদিন কত মানুষ এই ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়েছিল কে জানে!’
বলতে বলতেই সে সামনের ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকায়৷ রহস্যময় জ্যোৎস্নায় নীলাভ হয়ে আছে সেই ধ্বংসস্তূপ! ইট আর পাথরের পেল্লায় চাঁইগুলো দেখলেই ভয় করে! ওর নীচে কী আছে কে জানে! কয়েকশো বছর কেটে গিয়েছে, কেউ এই পাথরগুলোকে সরায়নি৷ হয়তো কোনোদিন ওর নীচেই চাপা পড়ে দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল হাজার হাজার হতভাগ্য মানুষ৷ কেউ তাদের সাহায্য করেনি! কেউ তাদের উদ্ধার করতে আসেনি৷ কে জানে! আজও হয়তো তারা ওখানেই সমাধিস্থ হয়ে আছে…!
ইতিহাসের ভগ্নস্তূপের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল দেবযানী৷ আচমকা একটা কনকনে ঠান্ডা দমকা হাওয়া তাকে ছুঁয়ে গেল! কেঁপে উঠল সে!
‘দেবযানী!’ সুজন পরম বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে, ‘তুই কি ভয় পাচ্ছিস? কাঁপছিস কেন?’
ততক্ষণে এক অদ্ভুত শীতলতা ঘিরে ধরেছে দেবযানীকে৷ সে নিজেও আবহাওয়ার এই আকস্মিক পরিবর্তনে অবাক হল৷ আশ্চর্য বিষয়! একটু আগেও তো রীতিমতো গরম লাগছিল! প্রচণ্ড ঘামছিল বলেই জ্যাকেটটা খুলে ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে৷ তবে হঠাৎ করে এই বরফশীতল হাওয়া এল কোথা থেকে! দেবযানী টের পেল, তার প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগছে৷ কিন্তু সুজন কোনোরকম দুর্বলতা পছন্দ করে না৷ না মানসিক, না শারীরিক৷ তাই কোনোমতে সামলে নিয়ে বলল, ‘না, তেমন কিছু নয়৷ সামান্য ঠান্ডা লাগছে৷’
‘ঠা-ন্ডা!’ সুজন তাকে এমনভাবে দেখছে যেন দেবযানী এই মুহূর্তে মঙ্গলগ্রহ থেকে এল৷ অদ্ভুত সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘এই ভয়ংকর গরমে তোর ঠান্ডা লাগছে! জ্বর-টর বাঁধাসনি তো? তুই লাস্ট মোমেন্টে ডোবাবি দেখছি!’
‘না…না!…’ দেবযানী একটু কুণ্ঠিত হয়ে কিছু বলতেই যাচ্ছিল, তার আগেই সুরেশ এগিয়ে এল তার দিকে৷ কোনো কথা না বলে দেবযানীর পিঠের ব্যাকপ্যাক ঘেঁটে বের করে আনল জ্যাকেটটা৷ তারপর তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,‘এটা পরে নে৷ আর দুর্গন্ধ বেশি মনে হলে আমার কাছে থ্রি এম সিক্স থাউজ্যান্ড ওয়ান অর্গানিক ভেপার কার্টরিজ আছে, নিয়ে নে৷ মরা জন্তু-জানোয়ারের গন্ধ আমারও সহ্য হয় না৷ সুজন তো সবাইকেই নিজের মতোই ভাবে!’
দেবযানী সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে সুরেশের দিকে তাকিয়ে জ্যাকেটটা গায়ে পরে নিল৷ সুরেশ মৃদু হেসে মাস্কটাও এগিয়ে দেয়৷ সুজন ভ্রূভঙ্গি করে ব্যাপারটা দেখল৷ মুখভঙ্গিতেই স্পষ্ট যে ব্যাপারটা আদৌ তার পছন্দ হয়নি৷ যে কোনোরকম দুর্বলতাকে সে অপছন্দ করে৷ তার মতে ‘পাথরের কারবারিকে পাথরের মতোই শক্ত হতে হয়৷ ঝড়, জল, রোদ—কোনোরকম দুর্যোগই তাকে টলাতে পারে না’৷ সে নিজেও সেই নিয়মই মেনে চলে৷ রোগ, প্রতিকূল পরিস্থিতি, ভয়— কোনোকিছুই তাকে আটকাতে পারেনি৷ এই সামান্য দুর্গন্ধে পিছু হটার পাত্র সে নয়৷ তাই এবার একটু বিরক্ত হয়েই বলল, ‘হয়েছে? তাহলে এগোনো যাক?’
রাতের ভানগড়ের রাস্তা দিয়ে ফের হেঁটে চলল ওরা তিনজন৷ অন্ধকার গায়ে মেখে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল গন্তব্যের দিকে৷ সুজনের একহাতে টর্চ, অন্যহাতে এমার্জেন্সি লাইট৷ এমার্জেন্সিটা অবশ্য এখন অফ করা রয়েছে৷ বেশি আলো জ্বেলে এখন কাজ নেই৷ মানুষ যদি ভূতের ভয়ে নাও আসে, কোনো বন্যপ্রাণী আসবে না এমন গ্যারান্টি নেই৷
সুজনের ঠিক পেছনেই দেবযানী৷ তার হাতেও টর্চ৷ সুরেশ যথারীতি তার হাই ডেফিনিশন ক্যামকর্ডার নিয়ে রাতের ভানগড়ের দৃশ্য তুলছে৷ ওর ক্যামকর্ডারটা আবার নাইট-ভিশন৷ সে এখন বাঁদিকে জহুরিবাজারের ছবি তুলতে ব্যস্ত৷ একসময়ে এখানে এক আলো ঝলমলে, জনবহুল ও ব্যস্ত বাজার বসত৷ এখন শুধুই কতগুলো চৌকো ইট আর পাথরের ভগ্নাবশেষ পড়ে রয়েছে৷ প্রাচীন হলেও গাঁথুনি দেখলেই বোঝা যায় ঠিক কতখানি শক্ত-পোক্ত ছিল! কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ হওয়ার দরুন শ্যাওলার কালশিটে পড়েছে শুধু৷ বাকিটা এখনও মজবুত কাঠামোর ওপরে দাঁড়িয়ে আছে৷
সে আস্তে আস্তে দূরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা অন্ধকার রাজমহলের দিকে ক্যামেরা জুম করল! এখনও দেখলে আন্দাজ করা যায় কোনো-সময়ে কী রাজকীয় গরিমা ছিল তার৷ আজ কিছুই নেই! তবু দেখামাত্রই গা শিরশিরিয়ে ওঠে৷
সুরেশ চলতে চলতেই টের পেল, পেছনে নিঃশ্বাসের শব্দ৷ ঠিক তার পিছনেই লঘু পায়ের আওয়াজ পেয়ে বুঝল, দেবযানী নির্ঘাৎ পিছিয়ে পড়েছে৷ সে ক্যামেরা থেকে চোখ না সরিয়েই হাসল, ‘দেবযানী, একটু পা চালিয়ে৷ নয়তো সুজনের ঝাড় তোর কপালে নাচছে!’
‘ঝাড় তো তুই খাবি মড়া!’
সুরেশের কিছুটা সামনে থেকেই দেবযানীর হাসিমাখা কণ্ঠস্বর ভেসে এল৷ সুরেশ চমকে সেদিকেই তাকাল! স্তম্ভিত হয়ে দেখল, দেবযানী তার পেছনে নয়, বরং বেশ খানিকটা এগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! সে হাসতে হাসতেই বলল,‘ভিডিওর চক্করে তুই-ই আমাদের থেকে পিছিয়ে পড়েছিস! তাড়াতাড়ি আয়৷’
‘তুই সামনে! তবে…! ’
বিদ্যুৎবেগে পিছনদিকে ফিরল সুরেশ৷ কিন্তু সেখানে শুধুই আবছা অন্ধকার আর শূন্যতা! আর কেউ নেই! এবার বিস্ময়ের ধাক্কাটা এত জোরালো মাত্রার ছিল যে বেশ কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে বাকশক্তি হারাল৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিহ্বলভাবে বলল, ‘তবে…. তবে পেছনে কে?’
‘স্বপ্ন দেখছিস নাকি?’ সুজন এবার রেগে যায়, ‘কখনও দেবযানীকে সামনে দেখছিস, কখনও পেছনে! শুরুটা করেছিস কী?’
‘কিন্তু আমি স্পষ্ট পায়ের শব্দ শুনেছি!…নিঃশ্বাসের শব্দও পেয়েছি… কেউ ছিল! কেউ পিছনে ছিল!’
সুরেশ টের পেল তার স্নায়ুকে কাঁপিয়ে একটা ভয়ের স্রোত উঠে আসছে৷ সে আরেকবার বিভ্রান্তদৃষ্টিতে পেছনের দিকে তাকায়৷ সুজন তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হাতের টর্চ তুলে ধরে সেদিকেই আলো ফেলল৷ কঠিন গলায় বলল, ‘দ্যাখ, আছে কেউ?’
টর্চের আলোয় শুধু ভানগড়ের পাথর বাঁধানো রাস্তা দেখা গেল৷ আর ভাঙা কালো কালো পাথরের চাঁই! জহুরিবাজারের ছাতহীন দালানগুলো যেন মুন্ডুহীন কবন্ধের মতো কৌতুকে ‘হো হো’ করে হেসে উঠল!
আর কেউ নেই! কিছু নেই!
৬
গোপীনাথ টেম্পল সম্ভবত ভানগড় ফোর্টের বৃহত্তম মন্দির৷ অন্যান্য মন্দিরগুলোর তুলনায় অনেকটা জায়গা ছড়িয়েও আছে৷ দিনের বেলায় আপাদমস্তক হলুদ পাথরে তৈরি মন্দিরটি সূর্যের সোনালি আভায় ঝলমল করে৷ সামনে অগুনতি পাথরের সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে মন্দির অবধি৷ ওরা দিনের বেলায় মন্দিরটিকে দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিল৷ যেখানে গোটা দুর্গটাই প্রায় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ধুলোয় মিশে গিয়েছিল, সেখানে গোপীনাথ মন্দির এখনও সম্পূর্ণ অক্ষত ও অবিকৃত অবস্থায় আছে! মন্দিরচূড়ার সূক্ষ্ম কারুকার্য ও স্থাপত্যশিল্প দেখলে হতবাক হয়ে যেতে হয়৷ মন্দিরটির সর্বমোট তিনটি গর্ভগৃহ৷ যার মধ্যে দুটো গর্ভগৃহ ওরা দেখেছে৷ তৃতীয়টিই প্রধান ও অভ্যন্তরীণ৷ সেটাই এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ এখন আর দেখা যায় না৷ কিন্তু বাইরের দুটো গর্ভগৃহ দেখলেই বোঝা যায় যে সেটি কী বস্তু হবে! সরকার সম্ভবত ভানগড় ফোর্ট সম্বন্ধে উদাসীন৷ তাই অন্যান্য দুর্গের মতো এই দুর্গটির পুনর্নির্মাণ হয়নি৷ আর সেই উদাসীনতার কারণেই গোপীনাথ মন্দিরের গর্ভগৃহগুলির ছাতের সৌন্দর্য ও সৌকর্য খানিকটা নষ্ট হয়েছে৷ প্রধান স্তম্ভের গায়ে চমৎকার এক নৃত্যরতা যক্ষিণীমূর্তির ভাস্কর্য ছিল৷ তবে অবহেলায় আর কালের আঘাতে মূর্তিটির মাথা ও দুই হাত ভেঙে গিয়েছে৷ নষ্ট হয়েছে ভাস্কর্য৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও যা রয়েছে, তাও যথেষ্টই বিস্ময়কর! দেবযানী তো দেখেই রীতিমতো উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠেছিল৷ বলেছিল, ‘ফ্যান্টাস্টিক আর্কিটেকচার! অনেকটা সাউথ ইন্ডিয়ার বিজয়নগরের মন্দিরগুলোর মতো না? এক্সোটিক ওয়ার্ক উইথ রাজপুতানা আর্কিটেক্ট!’
সুজন সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেও তার সতর্ক চোখের নিষেধাজ্ঞা পড়তে পেরেছিল দেবযানী৷ তারা যে মন্দিরের স্থাপত্য ও সৌন্দর্য সম্পর্কে রীতিমতো ওয়াকিবহাল তা সে প্রকাশ করতে চায় না৷ বিশেষ করে অতুলের সামনে৷ অগত্যা দেবযানী চুপ করে গিয়েছিল৷ কিন্তু মনে মনে গোপীনাথ মন্দিরের অভ্যন্তরীণ গর্ভগৃহটি দেখার জন্য আরও বেশি ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল৷ যা প্রকাশ্যে আছে তাতেই যদি এত কারুকাজ হয়, না জানি অপ্রকাশ্য শিল্পটি আরও কতগুণ সুন্দর হবে! অতুল অবশ্য মৃদু হেসে বলল, ‘গোপীনাথ কৃষ্ণের আরেক নাম৷ আগে শ্রীরাধিকার সঙ্গে বংশীধারী কৃষ্ণের চমৎকার যুগলমূর্তি ছিল শুনেছি৷ তবে এখন নেই৷ হয়তো কোনো মূর্তিচোর ফাঁকেতালে সরিয়ে নিয়েছে৷’
বলতে বলতেই তার মুখে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ বঙ্কিম হাসি ভেসে উঠল৷ সুজন দাঁতে দাঁত পিষে চাপা গলায় বলেছিল, ‘পারলে এই ব্যাটার মাথাতেই ছেনি আর হাতুড়ি ছুড়ে মারি! অসহ্য!’
এই প্রথম সুজনের কথায় সম্পূর্ণ একমত হয়েছিল দেবযানী৷ সত্যিই অসহ্য! তার থেকেও অসহ্য ওর এই নিষ্পলক চাউনি! একেবারে মরা মাছের মতো চোখ! সে লক্ষ করে দেখেছে, লোকটা একবারের জন্যও চোখের পলক ফেলে না! আশ্চর্য!
ওরা সেদিন দিনের আলোয় দেখেছিল মন্দিরটাকে৷ আর আজ, গভীর রাতে…!
নরম জ্যোৎস্না অলৌকিক ইশারায় গলে গলে পড়ছিল গোপীনাথ মন্দিরের চূড়া বেয়ে৷ দিনের আলোয় এর রহস্যময়তা বোঝা যায়নি৷ কিন্তু রাতের আলো-আঁধারিতে মন্দিরটাকে দেখে কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল দেবযানীর! কোনো এক দৈবীশক্তি যেন মাথা উঁচু করে ঘুমিয়ে আছে! পাথরের স্তম্ভগুলোর কারুকাজ যেন আরও জীবন্ত৷ চাঁদের আলো ছলকে ছলকে পড়ছে পাথরের মসৃণ গায়ে! ভেতরের অন্ধকার গর্ভগৃহ যেন ইশারায় কাছে ডাকছে ওদের৷ কী যেন এক অব্যক্ত সম্মোহনী শক্তি চুম্বকের মতো টানছে!
‘সুরেশটা আবার কোথায় গেল?’
সুজন একটু বিরক্তিমিশ্রিত গলায় বলল, ‘আমাদের পেছন পেছনই তো আসছিল৷ এখন কোথায় গায়েব হল!’
দেবযানী প্রমাদ গোনে৷ সুরেশের এই এক বদভ্যাস৷ একবার ভিডিও তুলতে শুরু করলে তার আর হুঁশ থাকে না৷ নির্ঘাৎ জ্যোৎস্নালোকিত ভানগড় ফোর্টের ভিডিও তুলতে তুলতে পিছিয়ে পড়েছে! এই প্রথম নয়, এর আগেও সে এরকম কাণ্ড করেছে৷ একবার এক প্রাচীন গুম্ফায় ঢুকে ঠিক এভাবেই হারিয়ে গিয়েছিল৷ শেষ পর্যন্ত দেবযানী আর সুজন যখন তাকে গোরুখোঁজা খুঁজে হতক্লান্ত, তখনই ক্যামেরা হাতে বাবু এসে হাজির! এসেই ভারী নিরীহ গলায় বলেছিল, ‘আমায় খুঁজছিলি?’
সেদিন সুজন তাকে মারতে বাকি রেখেছিল৷ আজও বিরক্ত হয়েই বলল,‘এই ছেলেটা কিছুতেই সিরিয়াস হবে না! ওর কী মনে হয়? এইসব জায়গা রাতের বেলা খুব সেফ? ও কি কনডাক্টেড ট্যুরে এসেছে নাকি! সব জোগাড়-যন্ত্র মাটি করবে দেখছি! প্রত্যেকবারই এই এক কেস…!’
রেগেমেগে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল সুজন৷ কিন্তু একটা অস্বাভাবিক শব্দ শুনে থেমে গেল! ওটা কীসের আওয়াজ! জলের নয়? স্থির নৈঃশব্দের মধ্যে একটা জোরালো ছলছল শব্দ কানে আসতেই চমকে উঠল ওরা! মন্দিরের ডানদিকে একটা ড্রেইন আছে৷ তাতেই জলের শব্দ হচ্ছে! কিন্তু জলের শব্দ হচ্ছে কেন! যে মন্দির পরিত্যক্ত, যেখানে বিগ্রহ নেই, বিগ্রহকে স্নান করানো হয় না বা পুজো করা হয় না; সেখানে জল যাওয়ার এমন কুলকুল আওয়াজ হতেই পারে না! এক প্রাচীন ধ্বংসস্তূপের ভেতরে এত রাত্রে তবে কাকে স্নান করানো হচ্ছে! সে কি কোনো দেবতা? না…!
‘শুনলি?’
দেবযানীর কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল৷ তার হূৎপিণ্ড এখন প্রায় টারবাইনের গতিতে চলতে শুরু করেছে৷ সুজনের মুখেও এই প্রথম সামান্য ভয়ের আভাস দেখা গেল৷ সে আস্তে আস্তে বলল, ‘শুনলাম!’
‘এত রাতে হন্টেড ফোর্টে জলের আওয়াজ! মন্দিরে কেউ আছে!’ দেবযানী উত্তেজিত, ‘সুজন, আমি তোকে আগেই বলেছিলাম, এটা হন্টেড প্লেস! ইথানও বলেছিলেন….!’
‘সে তো দীননাথও বলেছিল যে রাত হলে ভানগড় জেগে ওঠে, প্রাচীন ভগ্নস্তূপ মেরামত হয়ে যায়, ভূতেরা মিটিং করতে আসে, নাচে-গায়; তেমন কিছু দেখেছিস কি?’
সুজনের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে৷ সে এবার টর্চটা রেখে দিয়ে ফট করে জোরালো এমার্জেন্সি লাইটটা জ্বেলে দিল৷ দেবযানী ভয়ার্ত ও বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টিতে দেখল তার লাইসেন্সড গানটাও হাতে উঠে এসেছে৷ তারপরই একদম গটগট করে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে, ‘আমার ধারণা কেউ আমাদের সঙ্গে গেম খেলছে৷ আমি এর শেষ দেখেই ছাড়ব৷’
দেবযানী প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, ‘যাস না সুজন৷ কেউ…কিছু তো আছেই! দাঁড়া!’
সুজন শুনল না৷ বরং একহাতে এমার্জেন্সি লাইট ও অন্যহাতে উদ্যত বন্দুক নিয়ে একরকম দৌড়েই উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে৷ দেবযানী সভয়ে দেখল, সুজন মিলিয়ে গেল সার সার স্তম্ভের মাঝখান দিয়ে৷ প্রাথমিকভাবে শুধু তার এমার্জেন্সি লাইটের আলো দেখা যাচ্ছিল৷ কিন্তু মন্দিরের অভ্যস্তরস্থ জমাট অন্ধকার বুঝি হাঁ করেই ছিল৷ সে একেবারে দানবের মতো গ্রাস করতে শুরু করল আলোকে৷ এমার্জেন্সির আলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে মিলিয়েই গেল অন্ধকারের মধ্যে৷
দেবযানীর বুকের ভেতরের কাঁপুনিটা আরও বাড়ছে৷ সুজন কোথায় গেল! এখন তার হাতের আলোটাও আর দেখা যাচ্ছে না৷ সুরেশও কোথায় কে জানে! অপরিসীম অন্ধকারের মধ্যে, নিঃসঙ্গ মেয়েটির মনের মধ্যে আঁচড় কাটছে ভয়! সে একবার গোপীনাথ মন্দিরের চূড়ার দিকে তাকাল৷ এখন এই পাথুরে স্থাপত্যকেও ভীষণ জীবন্ত মনে হচ্ছে৷ অতুল বলেছিল, মন্দিরগুলো জীবন্ত! তার কথাকে প্রায় হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল সুজন৷ কিন্তু এখন সেই কথাটাকেই চরম সত্যি বলে মনে হচ্ছে৷ দেবযানীর চোখ একবার ছুঁয়ে গেল চতুর্দিকের ধ্বংসপ্রাপ্ত দালানগুলোকে৷ চাঁদের আলোয় কেমন যেন রহস্যময় ছায়ামূর্তি মনে হচ্ছে তাদের৷ এত শক্তিশালী, এত দাম্ভিক দুর্গকে কোন বিধ্বংসী শক্তি এমনভাবে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল! অথচ মন্দিরগুলোর কিছুই হল না! কেন?
হঠাৎই তার মনে পড়ল অতুলের কথা৷ সে বলেছিল, ‘ভানগড়ের মন্দিরগুলোর মধ্যে কোনো অলৌকিক শক্তি নিশ্চয়ই আছে৷ নয়তো একরাতের মধ্যে রীতিমতো মজবুত একটা কেল্লা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল, অথচ মন্দিরগুলো একদম অটুট থাকল কী করে?…’
কথাটাকে চিরসত্য বলেই মনে হল দেবযানীর৷ সে ভয়ার্ত, ব্যাকুলস্বরে ডাকল, ‘সু-জ-ন!’
কিন্তু তার ডাকের কোনো প্রত্যুত্তর এল না৷ মন্দির নিশ্চুপ! দেবযানীর মনের মধ্যে আশঙ্কার মেঘ গুড়গুড়িয়ে ওঠে৷ তার মনে হল, শীতটা যেন ক্রমশই বাড়ছে৷ তার সঙ্গে বাড়ছে দুর্গন্ধের প্রকোপও৷ তার মুখের মাস্কও সে প্রাণান্তিক দুর্গন্ধকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না! গলা শুকিয়ে যাচ্ছে৷ তা সত্ত্বেও সে সমস্ত শক্তি নিংড়ে দিয়ে আবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘সু-জ-ন!’
তাও কোনো উত্তর নেই! সে নিরুপায় হয়ে এগিয়ে গেল মন্দিরের সিঁড়ির দিকে৷ সুজনকে সে এভাবে ছেড়ে যেতে পারে না৷ ওরা বহুবছর ধরে একসঙ্গে একই কাজ করে আসছে৷ আজ এই চূড়ান্ত মুহূর্তে তাকে একলা ছেড়ে দেবযানী পালিয়ে যেতে পারে না৷
গোপীনাথ মন্দিরের সামনে সারসার পাথরের প্রাচীন সিঁড়ি জ্যোৎস্নায় ঝকমক করছে৷ সে আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করল৷ সিঁড়ির সংখ্যা খুব বেশি হওয়া উচিত নয়৷ সর্বসাকুল্যে পঁচিশ কী ত্রিশটি সিঁড়ি রয়েছে৷ কিন্তু আজ বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙেই হাঁফ ধরে গেল দেবযানীর! নিজের অবস্থা দেখে সে নিজেই বিস্মিত! এ তো কিছুই নয়; এরকম খাড়া, পাথুরে কয়েকশো সিঁড়ি ভেঙে ওরা কত মন্দিরে ঢুকেছে অনায়াসেই৷ হাঁফ ধরা তো দূর, সামান্য ক্লান্তিও বোধ করেনি৷ অথচ আজ মাত্র কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল!
দেবযানী অপরিসীম জেদে দাঁতে দাঁত পিষল৷ সে-ও এর শেষ দেখেই ছাড়বে৷ গোঁয়ারের মতো একের পর এক সিঁড়ি ভেঙে উঠতেই থাকল মন্দিরের দিকে৷ দম ধরে আসছে, হাত-পা ভারী হয়ে আসছে, বুকের ওপর একটা প্রচণ্ড ভার টের পাচ্ছে; যেন কেউ একটা পাথর বসিয়ে দিয়েছে বুকের ওপরে; তবু থামছে না৷ আর তো মাত্র কয়েকটা সিঁড়ি… তারপরেই….!
কিন্তু সামনের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল সে! একী! এখনও তো সামনে অদম্য, উদ্ধত সিঁড়ির অগুনতি ধাপ! পঁচিশ কী ত্রিশটা নয়! এ একেবারে সীমাহীন! গোপীনাথ মন্দিরের সামনে এত সিঁড়ি কবে এল! কখনই বা এল! এর যে শেষই দেখা যায় না! কোথায় গিয়ে থেমেছে এ সিঁড়ি? দেখলে তো মনে হয় একেবারে নিরুদ্দেশের পথে চলেছে! কোথায় মন্দিরের কারুকার্যমণ্ডিত চূড়া! কোথায় পাথরের স্তম্ভ! কিছুই দেখা যায় না৷ সামনে শুধু সারে সারে পাথরকাটা সিঁড়ি যার শেষ নেই! তবে শুরু কোথায়?
নীচের দিকে দেখতেই রক্ত হিম হয়ে যায় দেবযানীর! এ কী! তার পেছনেও তো অগুনতি সিঁড়ি ধাপ কেটে কেটে নেমে গেছে! সে আপ্রাণ নীচের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করে৷ কিন্তু পরিস্থিতি দেখে তার মাথা ঘুরতে শুরু করল! কী সর্বনাশ! এ সিঁড়ির যেন শুরুও নেই! কয়েকশো নয়, অন্তত কয়েকহাজার তো বটেই! এতগুলো সিঁড়ি সে কখন ভাঙল! কখন থেকেই বা হেঁটে চলেছে! নীচের কোনো দৃশ্যই চোখে পড়ছে না! কিচ্ছু নেই! শুধু সামনে আর পেছনে ধাপে ধাপে সিঁড়ির সার ব্যঙ্গ করে চলেছে! না এগোনোর উপায় আছে, না পেছোনোর!
দেবযানীর মনে হচ্ছিল তার হাত-পা ক্রমাগত ভারী হয়ে আসছে! যেন এ তার নিজস্ব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নয়৷ ভারি পাথরের তৈরী হাত-পা! বুকের ভিতরে ভীষণ কষ্ট! মনে হয়, হূৎপিণ্ডটাও ক্রমশ পাথর হয়ে যাচ্ছে! সে যেন আপাদমস্তক পরিণত হচ্ছে এক পাথরের মূর্তিতে যাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব! যত এগোচ্ছে ততই যেন একটু একটু করে তাকে গ্রাস করছে পাষাণ! প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত ভারী হয়ে উঠছে তার দেহ৷ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে৷ সে বুঝতে পারল, তার দেহের তাপমাত্রা ক্রমাগতই কমছে৷ শিরার মধ্যে রক্তসঞ্চালন ধীর হয়ে আসছে আস্তে আস্তে৷ শীত করছে, অসম্ভব শীত করছে তার!
জ্যোৎস্নার আলো একঝলক এসে পড়ল দেবযানীর দুই হাতের ওপর৷ সেই সামান্য আলোতেও সে ভয়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল, তার হাত দুটো আস্তে আস্তে হলুদবর্ণ ধারণ করছে! অবিকল সেই হলুদ পাথরের মতো, যে পাথর দিয়ে বানানো হয়েছে গোটা গোপীনাথ মন্দির! দেবযানী ভয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ কিন্তু তার পা একচুলও নড়ল না! যেন চিরকালের জন্য গেঁথে গিয়েছে পাথরের মধ্যে৷
সে ভয়ে চিৎকার করে উঠতে চায়! কিন্তু আশ্চর্য; একটু শব্দও বেরোল না তার মুখ থেকে৷ শুধু এইটুকু বুঝতে পারল, সে আস্তে আস্তে পাথরের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!
পাথরের মতো হিমশীতল!
.
৭
সুরেশ রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল৷
এমনিতেই সে অসম্ভব ভয় পেয়েছিল৷ সুজনকে সেকথা বারবার বলেছে, বোঝানোর চেষ্টা করেছে, সত্যিই তার পেছনে কেউ ছিল! কোনো মানুষের দ্রুত নিঃশ্বাসের শব্দ, হেঁটে আসার আওয়াজ সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে! কোনো সন্দেহই নেই, যে কেউ তাদের ফলো করছে!
কিন্তু সুজন তার একটা কথাও বিশ্বাস করেনি৷ উলটে হেসে বলেছে; ‘ওসব পাব্লিকের পাবলিকের গাঁজাখুরি গল্পের এফেক্ট! তুই হ্যালুসিনেট করছিস!’
সুরেশের কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হয়, হয়তো সুজনই ঠিক বলছে৷ ভানগড় সম্পর্কে নানারকম ভৌতিক ও অলৌকিক গল্প শুনতে শুনতে তার উত্তপ্ত মস্তিষ্ক উদ্ভট উদ্ভট কল্পনা করছে৷ হয়তো তার পেছনে সত্যিই কেউ ছিল না৷ অন্য কোনো প্রাকৃতিক শব্দ শুনে সে খামোখাই চমকে উঠছে৷ ব্যাপারটার একটা যুক্তিসঙ্গত সমাধান খুঁজে পেয়ে তখনকার মতো সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল৷ আশ্বস্তও হয়েছিল৷
কিন্তু দেবযানী আর সুজনের পিছনে যেতে যেতেই হঠাৎ থমকে গেল সে! আবার! আবার সেই শব্দ! শুধু পায়ের শব্দই নয়, এবার যেন কারোর পায়ে ধাক্কা লেগে নুড়ি-পাথরের গড়িয়ে যাওয়ার আওয়াজ! শুধু তাই নয়, পোশাকের খসখসও একদম পরিষ্কার শুনতে পেল সে! না, কোনোরকম ভ্রান্তি নয়৷ পেছনে কেউ আছে! কেউ তাদের অজান্তেই ফলো করছে!
‘কে?’
সে তৎক্ষণাৎ সপাটে পিছনে ফিরল৷ নাঃ, তার সন্দেহ অমূলক নয়! ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে কেউ! তার আবছায়া সিল্যুয়েট রাতের প্রেক্ষাপটে একদম পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে৷ সে যেই হোক, এবার আর লুকিয়ে পড়ার সুযোগ পায়নি৷
‘কৌন হো আপ? কিউঁ মুঝে ফলো কর রাহে হো?’
হিন্দিতে ধমকে উঠল সুরেশ৷ কিন্তু ছায়া কোনো উত্তর দিল না৷ সে চুপ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে৷
সুরেশ ক্যামকর্ডারটাকে মাটিতে রেখে তাড়াতাড়ি ব্যাকপ্যাক থেকে নিজের টর্চটা বের করল৷ সেটা অন করে আলো ফেলতেই আবার একটা বিস্ময়ের ধাক্কা! যেখানে ছায়াটা দাঁড়িয়েছিল, সেখানে এখন কেউ নেই! টর্চের সাদা আলো শুধু পাথুরে পথ আর ইতস্তত ছড়ানো দুর্গের ভাঙাচোরা অবশেষটুকুই দেখাল৷
পালিয়ে গেল! সুরেশ রীতিমতো অবাক হল৷ ক্যামকর্ডার রেখে টর্চটা বের করতে তার এমন কিছু সময় লাগেনি৷ তার মধ্যেই একটা আস্ত মানুষ কোথায় হাওয়া হয়ে গেল! দৌড়ে যাওয়ার ধুপধাপ শব্দও তো কানে আসেনি তার! সে টর্চের আলো ইতস্তত ফেলে দেখার চেষ্টা করল যে মানুষটা এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই কোথাও লুকিয়েছে কি না৷ কিন্তু কাউকেই আশেপাশে দেখা গেল না!
সুরেশের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে৷ আস্ত মানুষটা নিমেষে এমন লোপাট হয়ে গেল কী করে! নাকি আবার তারই ভুল হল! ভাবতেই সে মাথা নাড়ে৷ নাঃ, এতখানি ভুল করতেই পারে না৷ স্পষ্ট দেখেছে একটা ছায়ামূর্তি তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে! কোনো চতুষ্পদ নয়, কোনো বন্যজন্তুও নয়৷ নিঃসন্দেহে সে মানুষ৷ আর ও যে তাদের ফলো করছিল, সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই৷
সুরেশ নিজের অজান্তেই একবার তার জ্যাকেটের পকেটটা স্পর্শ করল৷ ওখানে একটা ফোল্ডিং নাইফ রয়েছে৷ ওদের কাজটা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ৷ তাই আত্মরক্ষার্থে সবসময়ই ছুরিটাকে পকেটে রাখে৷ সেটার উপস্থিতি টের পেতেই যেন একটু শান্তি পেল৷ তারপর ক্যামকর্ডারটাকে তুলে নিয়ে ব্যাগে ভরে এগোনোর জন্য পা বাড়াল৷ আবার যদি সেই আগন্তুক এসে হাজির হয়, তবে দেখা যাবে৷ এবার ওকে দেখে নেবে সে৷
কিন্তু এগোতে গিয়েই ফের চমক! সুজন আর দেবযানী কোথায় গেল! একটু আগেও তো সামনেই হাঁটছিল ওরা দুজন! কিন্তু এখন তার দৃষ্টিপথের মধ্যে ওরা কেউ নেই! সুরেশ বিপন্ন বোধ করল! এতক্ষণ সুজনই ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছিল৷ ভানগড় ফোর্টের ম্যাপটাও ওরই কাছে৷ অথচ ওরা কেউ ধারেকাছে নেই! এমনকি ওদের টর্চের আলোও দেখা যাচ্ছে না! সুজন তো কোনোকালেই কেয়ার করে না, কিন্তু দেবযানীও কি ভুলে গেল সুরেশের কথা! একবারও কি পিছু ফিরে দেখেনি যে সে সঙ্গে নেই!
সুজন আর দেবযানীর এরকম ব্যবহারে স্বাভাবিকভাবেই রাগ হয়ে গিয়েছিল তার৷ কিন্তু আস্তে আস্তে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনে৷ এখন মান-অভিমানের সময় নয়৷ হয়তো কাজের উত্তেজনায় ওরা লক্ষই করেনি যে সুরেশ ওদের থেকে পিছিয়ে পড়েছে৷ অনেক সময় লক্ষ করেও না৷ দুর্গের রাস্তা একদম সোজাই চলে গিয়েছে৷ নাক বরাবর দ্রুত হাঁটলে হয়তো খুঁজেও পাওয়া যাবে ওদের৷ খুব বেশিদূর এগিয়ে গিয়েছে বলে মনে হয় না৷ যাই হোক, এখন উত্তেজিত হওয়ার সময় নয়৷ বরং ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে৷
সুরেশ এবার নিজের টর্চ জ্বালিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল৷ তার পাশাপাশি চলেছে জহুরিবাজারের কালো ছোপ ছোপ ইট-পাথর! বহুবছরের শ্যাওলা জমে রয়েছে ভগ্নাবশেষের গায়ে৷ বহুবছরের রহস্যও বটে…!
‘খস খখসখখস!’
আবার! আবার সেই আওয়াজ! সূক্ষ্ম রেশমি কাপড় ঘষা খেলে যেমন শব্দ করে ঠিক তেমনই একটা খসখস ধ্বনি! তার সঙ্গে পায়ের শব্দ এবার আরও বেশি পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে! ফলো করছে! সে আবার ফলো করছে! সুরেশ টের পেল তার ঠিক ঘাড়ের কাছে কেউ যেন বরফশীতল নিঃশ্বাস ফেলল! অর্থাৎ আগন্তুক এবার আরও কাছে! তার হিমশীতল নিঃশ্বাসে কেঁপে উঠল সে!
‘কৌন হ্যায়! হু দ্য হেল আর ইউ…!’
বলতে বলতেই সে অ্যাবাউট টার্ন নিয়ে বিদ্যুৎবেগে টর্চের জোরালো ফোকাস ফেলল ঠিক তার পেছনেই! কিন্তু! ছায়ামূর্তিটাকে এখনও দেখা যাচ্ছে৷ অন্ধকারের মধ্যে তার দেহরেখা স্পষ্ট! মাথা, কাঁধের আউটলাইন, দুটো হাতের রেখাও স্পষ্ট দৃশ্যমান! কিন্তু যেখানে টর্চের আলো ফেলেছে সুরেশ সেখানে ছায়ার মালিকের বুক বা পেটের অংশ থাকা উচিত! অথচ সেরকম কিছুই নেই! টর্চের তীব্র আলো যেন ছায়ামূর্তিটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে গিয়ে পড়ল শূন্য দুর্গের চারিদিকে! অথবা কোনো অজ্ঞাত সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে গিয়ে আলোটা মিশে গেল শূন্যতায়!
ভয়ে সুরেশের রক্ত হিম হয়ে যায়৷ সে বুঝতে পেরেছে, ওটা কোনো মানুষ নয়! হাড়-মাংস-পেশিযুক্ত কোনো প্রাণীই নয়৷ বরং ও শুধুমাত্রই একটা ছায়া! যাকে অনায়াসে ভেদ করে চলে যাচ্ছে টর্চের আলো! এ কী করে সম্ভব! অসম্ভব ব্যাপার! একটা ছায়া তার পেছন পেছন আসছিল! অবিশ্বাস্য!
একমুহূর্তের জন্য শ্বাস টানল সুরেশ! পরক্ষণেই প্রবল গতিতে দৌড়তে শুরু করল৷ যে করেই হোক, এই অলৌকিক ছায়ার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতেই হবে তাকে! ছুটতে ছুটতেই সে টের পেল পেছনের পায়ের আওয়াজও ক্রমাগত জোরালো হচ্ছে! অর্থাৎ সেই ছায়ামূর্তি যে-ই হোক না কেন, এখনও তাকে দুরন্ত গতিতে ধাওয়া করছে৷ সেই ছায়াও হাল ছাড়েনি!
সুরেশের মনে হল তার দেহের সমস্ত রক্ত বুঝি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে! এ কী অদ্ভুত ছায়া! এর থেকে বরং কোনো দৈত্য তেড়ে এলেও সে এত ভয় পেত না৷ ভানগড় ফোর্টের কিংবদন্তিতে যেসব ভূত-দর্শনের কথা আছে, তেমন কেউ সামনে এসে দাঁড়ালেও বোধহয় এর চেয়ে ভালোই হত! অন্তত তাদের একটা মূর্তি থাকত; কায়া থাকত৷ কিন্তু যার কোনো মূর্তিই নেই; যে সম্পূর্ণ কায়াহীন, সেই আতঙ্কের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করবে কী করে!
পেছনে ছুটে আসার শব্দ এখন আরও জোরে শোনা যাচ্ছে৷ নিরুপায়, বিপন্ন সুরেশ সামনেই যে রাস্তা পেল তাতেই দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করল৷ যে আতঙ্ক তাকে চেজ করে চলেছে, তার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অন্য কোনো উপায় জানা নেই তার৷ মানুষ হলে ছুরি কাজে আসত৷ কিন্তু ছায়া…!
দাঁতে দাঁত চেপে সুরেশ তার গতিবেগ বাড়াল৷ জোরে, আরও জোরে! আরও আরও বেশি জোরে দৌড়ে চলেছে সে৷ ভাঙা ভাঙা সিঁড়ি টপকে, কখনও চড়াই ভেঙে, কখনও উৎরাই বেয়ে দৌড়চ্ছে৷ কিন্তু কোথায় চলেছে সে নিজেই জানে না! কখনও পায়ের তলায় পাথুরে রাস্তা, কখনও বা নরম ঘাস দলিত মথিত করে এগোচ্ছে৷ এই মুহূর্তে তার পাশ দিয়ে সাঁত সাঁত করে চলে যাচ্ছে ভাঙাচোরা মহল, মাথাকাটা ভেঙে পড়া দালান, বিপর্যস্ত ধ্বংসস্তূপ! আর চলেছে ভানগড়ের শক্তিশালী পেশল দেওয়াল! প্রাচীন এক বিরাট সরীসৃপের মতো সেও এঁকেবেকে সুরেশের পাশাপাশি দৌড়চ্ছে৷ সুরেশের মনে হল, ওগুলো নেহাত ধ্বংসস্তূপ নয়; এ প্রাচীন দেওয়ালও আসলে নিছক দেওয়াল নয়! এরা প্রত্যেকেই এক একটা জীবন্ত ছায়া৷ যে কোনো মুহূর্তে ওরাও ‘রে রে’ করে তেড়ে আসবে তার দিকে!
দেহের সব শক্তিটুকু জড়ো করে দৌড়তে দৌড়তেই আচমকা পাথরে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সুরেশ৷ তার হাত থেকে টর্চ ছিটকে পড়ে গড়গড় শব্দ তুলে কোথায় গড়িয়ে গেল কে জানে! চতুর্দিকে এখন শুধু অন্ধকার আর নৈঃশব্দ্য! যে ছায়া তার পেছনে আসছিল, তাকেও আর দেখা গেল না! সে যেন অন্ধকারের মধ্যেই আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেছে!
পড়ে গিয়েই ভয়ের চোটে চোখ বুজে ফেলেছিল সে! কোনো এক অজানা ও ভয়ংকর পরিণামের জন্য দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছিল৷ কিন্তু নিঃশব্দ কিছু মুহূর্ত চলে যাওয়ার পরে কিছুটা স্বস্তি পেল সুরেশ৷ সেই ছায়া হয় তাকে অতিক্রম করে অন্যদিকে চলে গিয়েছে, নয়তো তার পিছু করা ছেড়ে দিয়েছে৷
সে এবার কোনোমতে উঠে বসে৷ হাতের তলায় ঠান্ডা পাথরের স্পর্শ৷ অর্থাৎ ও পাথরের ওপরেই পড়েছিল৷ মাথায় প্রবল যন্ত্রণা! মাথাটা পাথরে ঠুকে গিয়েছে৷ সুরেশ হাত দিয়ে কপালে একটা চটচটে তরল অনুভব করল! রক্ত পড়ছে! কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এখন সে আছে কোথায়?
অন্ধকারটা চোখে একটু সয়ে আসতেই সুরেশ এদিক-ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল লোকেশনটা৷ এবং আবিষ্কার করে হতচকিত হল যে তার ঠিক সামনেই ভানগড়ের রাজপ্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে৷ এখানেই রত্নাবতীর মহল দেখতে এসেছিল ওরা৷ কিন্তু যতদূর সে জানে, রয়্যাল প্যালেসটা গোপীনাথ টেম্পল ছাড়িয়ে গেলে দেখা যায়৷ অর্থাৎ সে কাণ্ডাকাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে দৌড়তে দৌড়তে ঘুরপথে অনেকটা এগিয়ে এসেছে৷ এখান থেকে একটু পিছিয়ে গেলেই গোপীনাথ মন্দিরটা পাওয়া যাবে৷ পাওয়া যাবে দেবযানী ও সুজনকেও৷
সুরেশ আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়৷ তার ব্যাকপ্যাকটা একটু দূরেই পড়েছিল৷ সে সযত্নে সেটাকে তুলে নিল৷ এই মুহূর্তে ভয়ে তার বুক রীতিমতো কাঁপছে! অসহায় ছেলেটার কাছে টর্চটাও নেই৷ সেটা কোথায় গেছে কে জানে! সুরেশ বাঁদিকের হিপপকেট থেকে বের করে আনল লাইটার৷ কাঁপা কাঁপা হাতে লাইটারটাকে জ্বালানোর চেষ্টা করছে৷ প্রথমবার চেপে ধরতেই নীলাভ শিখা দপ করে জ্বলে উঠল৷ কিন্তু সে ক্ষণস্থায়ী! লাইটারের দুর্বল শিখাও কাঁপতে কাঁপতে ঝুপ করে নিভে গেল৷ ভয়ার্ত মানুষটা বার বার চেষ্টা করল৷ কিন্তু লাইটার আর জ্বলে না!
ভয়ে সুরেশের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার জোগাড়৷ সে কী করবে, কোথায় যাবে; কিছুই বুঝতে পারছে না৷ তার প্রায় কান্না পেয়ে গেল! সুজন আর দেবযানী কি এখনও তাকে খুঁজছে না! এই নিঃসঙ্গ দুর্গে কতক্ষণ অলৌকিক শক্তির সঙ্গে একা যুদ্ধ করবে সে? কার সঙ্গেই বা করবে? প্রতিপক্ষ যেখানে অদৃশ্য, সেখানে তার কী করার আছে? এখন তো এক পাও এগোতে ভয় করছে তার!
হঠাৎই একটা প্রবল গড়গড় শব্দে সচকিত হয়ে উঠল সে! কীসের শব্দ ওটা! কোথা থেকে আসছে? কী প্রচণ্ড আওয়াজ! যেন ভয়ংকর কোনো প্রলয় ছুটে আসছে তারই দিকে! কিন্তু জিনিসটা কী!
শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই তার চোখে পড়ল জিনিসটা! একটা বিরাট জমাট অন্ধকার ওপরের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে আসছে নীচের দিকেই! শুধু কি অন্ধকার! না৷ অন্ধকার নয়; ওটা বিরাট একটা পাথর! দুর্নিবার, অদম্য বেগে ছুটে আসছে তাকে লক্ষ্য করে!
সেই ক্ষণেই তার একটাই নাম মনে পড়ল! তান্ত্রিক সিঙ্ঘিয়া! যে লোকটা কালো জাদুর মাধ্যমে রাজকন্যা রত্নাবতীর প্রসাধনীকে মন্ত্রপূত করে দিয়েছিল৷ তার মূল্য সে নিজে দিয়েছিল নিজের প্রাণ দিয়ে! আর সুরেশরাও সেই রত্নাবতীর মূর্তিকেই ভাঙতে এসেছে৷ আজ আবার সেই পাথর তার প্রতিশোধ নেবে৷ পাথরের কারবারিদের বিরুদ্ধে স্বয়ং পাথরেরাই রুখে দাঁড়িয়েছে! কেউ বাঁচবে না! সুরেশ, দেবযানী এমনকি সুজনও রক্ষা পাবে না পাথরের প্রতিশোধের হাত থেকে! কেউ বাঁচবে না!
বিশালাকৃতি কালান্তক পাথরটা উল্কার বেগে ছুটে আসছে সুরেশের দিকে৷ আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এসে পড়বে তার ওপরে৷ সেই অন্তিম মুহূর্তে মনে পড়ে গেল অতুলের কথা৷ বাক্যটা ভেবেই পাগলের মতো মর্মান্তিকভাবে হেসে উঠল সুরেশ!
‘এ পাথরে প্রাণ আছে!’
৮
গোপীনাথ মন্দিরের মূল গর্ভগৃহটা দেখে চমকে গেল সুজন৷ কী আশ্চর্য ভাস্কর্য! কী অদ্ভুত সব মূর্তি! দেখেই তার চক্ষুস্থির৷ অতুল ঠিকই বলেছিল৷ গর্ভগৃহে পাথরের বেদি রয়েছে৷ কিন্তু কোনো বিগ্রহ নেই৷ কিন্তু থাকারই বা দরকার কী! যা রয়েছে তার মূল্য বিদেশের বাজারে কয়েকশো কোটি অবধি হতে পারে৷ এক একটা যক্ষিণী মূর্তিই দেখার মতো৷ কী তাদের অবয়ব, কী তাদের ভঙ্গিমা! কে জানত যে এই পরিত্যক্ত, ভগ্ন দুর্গের মধ্যে এমন রাজৈশ্বর্য লুকিয়ে আছে!
জল পড়ার আওয়াজ শুনে তার মনে হয়েছিল, হয়তো ভেতরে কেউ আছে! সেজন্যই সে দেবযানীকে ওখানে রেখেই তড়িঘড়ি ভেতরে চলে গিয়েছিল৷ কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করার পরও কোনো মানুষের অস্তিত্ব টের পায়নি৷ এমনকী জলের শব্দটাও আচমকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ তাই আর তদন্ত না করে সে সরাসরি ঢুকে গিয়েছে প্রধান ও অভ্যন্তরীণ গর্ভগৃহে৷ ডুপ্লিকেট চাবি তার কাছে আগেই ছিল৷ তাই দরজা খুলতে কোনো অসুবিধে হয়নি৷
এমার্জেন্সি লাইটের আলোয় চতুর্দিকটা দেখতে দেখতে তার দৃষ্টি স্থির হয়ে দাঁড়াল দেওয়ালের ঠিক কেন্দ্রে৷ সেখানে এক নারীমূর্তির ভাস্কর্য! কিন্তু সে ভাস্কর্যের সৌন্দর্য বর্ণনা করা অসম্ভব! হলুদ পাথরের ওপর ভাস্কর নারীমূর্তি খোদাই করেননি, বরং পৃথিবীর যাবতীয় সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়েছেন! নারীটি শৃঙ্গাররতা৷ পদ্মের মতো দুটি হাত একঢাল চুলে ফুল গুঁজতে ব্যস্ত! দেহবল্লরী যেন চরম লাস্যের মূর্ত প্রকাশ! যদিও মুখটা ঠিক স্পষ্ট নয়! বদ্ধ ঘরে থাকার দরুন ধুলোও জমেছে৷ তবু তার অভ্যস্ত চোখ দেখামাত্রই বলে দিল—এ মূর্তি ওদের সবাইকে আরবপতি করার ক্ষমতা রাখে! কোনো সন্দেহই নেই যে এটাই রাজকন্যা রত্নাবতীর মূর্তি!
মনে মনে মিঃ ও’ কোনরের রুচির প্রশংসা না করে পারল না সুজন৷ সে আর একমুহূর্তও দেরি করতে চায় না৷ রত্নাবতীর মূর্তিটাকে যতক্ষণ না কেটে বের করছে, ততক্ষণ শান্তি নেই৷ সে এমার্জেন্সিটা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এল বাইরে৷ দেবযানী আর সুরেশের সহায়তা ছাড়া এ মূর্তি ভাঙা যাবে না৷ এতক্ষণে নিশ্চয়ই সুরেশও এসে হাজির হয়েছে৷ এরকম প্রাচীন মূর্তি অবিকৃতভাবে কাটা অসম্ভব যদি না ওদের দুজনের প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ হাত না থাকে৷
কিন্তু ত্রস্তব্যস্ত পায়ে মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে গেল সুজন৷ দেবযানী সেখানে নেই! এমনকী সুরেশও এসে উপস্থিত হয়নি! শূন্য মন্দিরপ্রাঙ্গণ যেন তার বোকাটে মুখটা দেখে নিঃশব্দ হাসি হাসল! সুজন মনে মনে একটু বিরক্ত হয়৷ সুরেশ তো চিরকালীন ভ্যাগাবন্ড৷ কিন্তু দেবযানী গেল কোথায়! পাঁচমিনিটও হয়নি তাকে রেখে সে মন্দিরে ঢুকেছে৷ শেষ যতটুকু মনে পড়ছে, দেবযানী মন্দিরের সিঁড়ির নীচেই দাঁড়িয়েছিল৷ ভেতরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছিল৷ কিন্তু এখন সে গেল কই! সুজন পাঁচমিনিটের জন্য একটু চোখের আড়াল হওয়া মাত্রই কি সে একা একা অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছে না কি! এ বেলায় আর ভয় লাগল না!
এক অসহনীয় রাগে মস্তিষ্কের প্রতিটি কোনা উত্তপ্ত হয়ে উঠল সুজনের৷ এরা পেয়েছেটা কী! শুরু থেকেই দেখছে এই ভানগড়ের অ্যাসাইনমেন্টটা নিয়ে দেবযানী ও সুরেশ—দুজনেরই সমান অ্যালার্জি! ভানগড়ে এসে ঐ ইডিয়ট অতুল আর স্টুপিড দীননাথের উলটোপালটা গল্প শুনে দুজনেরই মাথা গেছে! একজন দিনদুপুরে ভুলভাল দেখছে, অন্যজন কথায় কথায় ভয় পাচ্ছে৷ এদের দিয়ে কাজ হয়? ড্যাম ইট!
সে মন্দিরের ভেতর থেকেই চেঁচিয়ে ডাকল, ‘দেবযানী, অনেক হয়েছে৷ এখানে আয় বলছি৷’
কথাগুলো যথারীতি মন্দিরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে হতে মিলিয়ে গেল৷ কিন্তু কোনো উত্তর এল না৷
তার চোয়াল শক্ত হল৷ নির্ঘাৎ সুরেশ আবার ফিরে এসে দেবযানীকে নিয়ে গোটা ফোর্ট ‘এক্সপ্লোর’ করতে গিয়েছে! এর আগেও অন্য একটি দুর্গে অবিকল এমনই ঘটেছিল৷ এসব দুর্গে মোবাইল কাজ করে না কারণ টাওয়ার নেই৷ যোগাযোগ করার উপায়ও নেই৷ ওরা কিছুতেই বুঝবে না যে প্রত্যেকটা মুহূর্ত সুজনের কাছে মূল্যবান৷ এটা ওদের পেশা, রুজি-রুটি; ফাজলামি নয়!
কিন্তু পরক্ষণেই দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল সুজনের মুখে৷ ওরা কি সত্যিই কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে? কোনোরকম বিপদ হয়নি তো? দুর্গের অলৌকিক বা ভৌতিক ইতিহাসে বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস নেই তার৷ তবে বন্যপ্রাণীকে ভয় আছে৷ তেমন কিছু অঘটন…!
ভাবতে ভাবতেই মাথা নাড়ল সে৷ নাঃ, তেমন কিছু হলে দেবযানীর ভয়ার্ত চিৎকার নিশ্চয়ই কানে আসত তার৷ কিংবা সুরেশের গলা পেত৷ অথচ তেমন কোনো শব্দই পায়নি! তার মানে দুটোই সম্ভাবনা রয়েছে৷ হয় সুরেশ এসে দেবযানীকে নিয়ে ‘এক্সপ্লোর’ করতে গিয়েছে, নয়তো দুটো ভীতুর ডিমই ষড়যন্ত্র করে তাকে একলা রেখে পালিয়েছে৷ সুজন হতাশা-জনকভাবে মাথা ঝাঁকায়৷ এর অর্থ, আজ রাতে তাকে একাই কাজ করতে হবে! সুরেশ আর দেবযানী ফিরে এলে ভালো, নয়তো কাল সকালে ওদের দেখে নেবে!
সে বিড়বিড় করে বলল, ‘ওয়ার্থলেস পাবলিক পাবলিক!’ তারপর ফের ধীরপায়ে হাঁটা দিল মূল গর্ভগৃহের দিকে৷ তার হাতের এমার্জেন্সির আলো একঝলক পিছলে পড়েছিল মন্দিরের প্রধান স্তম্ভের গায়ে৷ সেদিকে তাকিয়েই একটু যেন বিস্মিত হল সুজন৷ আরে! এই নৃত্যরতা যক্ষিণীমূর্তিটা ভাঙা ছিল না? যতদূর মনে পড়ছে, কালকেই এই মূর্তিটা ভালো করে দেখেছিল ওরা৷ তখন সুন্দরীর মাথা আর দুটি হাত ভাঙা ছিল৷ অথচ এখন একদম অক্ষত, নতুন ভাস্কর্যের মতো চকচক করছে৷ যেন রাতারাতিই কেউ মেরামত করে দিয়েছে৷ এত তাড়াতাড়ি কী করে মেরামত হয়ে গেল মূর্তিটা! কে-ই বা করল!
সুজন একটু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল৷ যক্ষিণীমূর্তিটা কি আদৌ এরকম ছিল? কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকছে না? মাথার চুল চুড়ো চুড়ো করে বাঁধা, মুখের সুডৌল গড়নটাও যেন বড় পরিচিত৷ এরকম মূর্তি আগে কোথাও দেখেছে কি?
‘সু-জ-ন!’
পাথরের ভেতর থেকে ভেসে এল পরিচিত কণ্ঠের বুকফাটা হাহাকার! ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়ে সুজন লাফিয়ে দু-কদম পিছিয়ে গেল৷ কী হচ্ছে! এসব কী হচ্ছে! আওয়াজটা কোথা থেকে এল! এই স্তম্ভের ভেতর থেকে কি! ইমপসিবল! অসম্ভব!
সুজনের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে! এইমাত্র যা শুনল তা কি সত্যি? না কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে! এক অদ্ভুত সন্দেহ তার মনের মধ্যে ঘনিয়ে এল! অব্যক্ত এক আশঙ্কায় সে এমার্জেন্সি লাইটটার আলো ফেলেছে নৃত্যরতা যক্ষিণীর দিকে৷ আর যক্ষিণীর মুখ স্পষ্ট হতেই যেন কয়েকহাজার ভোল্টের বৈদ্যুতিক ছ্যাঁকা খেল সুজন! এ তো অবিকল দেবযানীর মূর্তি! নিঃসন্দেহে সে—ই! সেই টপনট, সেই মুখের আদল, এমনকি চিবুকের কাটা দাগটাও হুবহু এক! দেবযানী!
‘সুজন!’
পাথরের ভেতর থেকে ভেসে এল দেবযানীর কান্না—‘আমায় এখান থেকে বের কর! আমার ভয় করছে…!’
‘দেবযানী!’ সুজন ব্যাকুলভাবে যক্ষিণীমূর্তির ওপর হাত রাখল, ‘কোথায় তুই! অ্যাঁ?’
‘আমি জানি না৷’ কান্নাবিকৃত কণ্ঠে জবাব এল—‘এখানে ভীষণ অন্ধকার!’
সুজন কী করবে বুঝে পায় না! দেবযানী কোথায় আছে, মূর্তিটা তার মতো দেখতে কী করে হল, কিংবা স্তম্ভের মধ্য থেকে তার কণ্ঠস্বর কীভাবে ভেসে আসছে তা সমস্ত যুক্তি ও বুদ্ধির বাইরে৷ কিন্তু জীবনে এই প্রথম সে ‘আতঙ্ক’ কাকে বলে তা টের পেল! সুজনের কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘামের বিন্দু দেখা দিয়েছে৷ সে বিহ্বল, বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে সেই যক্ষিণীমূর্তির দিকে৷
‘আমি আগেই বলেছিলাম স্যার, এ মন্দিরগুলো জীবিত! বলেছিলাম, এ পাথরে প্রাণ আছে৷ আপনারা শোনেননি৷’
সারা মন্দির কাঁপিয়ে ভেসে এল শব্দগুলো৷ কিন্তু কণ্ঠস্বরটা চিনতে ভুল হল না সুজনের৷ অতুল!
সে অসহ্য রাগে, ভীষণ অসহায়তায় হিসহিস করে বলল, ‘তাহলে এসব তোমার ষড়যন্ত্র! কোথায় রেখেছ দেবযানীকে?’
কন্ঠস্বর হেসে উঠল৷ তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘দেবযানীকে যেখানে দেখছেন, ও সেখানেই আছে৷ এবং চিরদিন সেখানেই থাকবে৷’
‘বাজে কথা৷’ সুজন গর্জন করে ওঠে, ‘এসব লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোয়ের কারিকুরি৷ নির্ঘাৎ কোনো সাউন্ডবক্স বসানো আছে আশেপাশেই৷ সব তোমার চক্রান্ত!’
অতুল আবার সজোরে হেসে ওঠে, ‘এই ভাঙা দূর্গে কষ্ট করে কে আর লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো করবে স্যার! আর দিনের বেলা আপনি গোটা দুর্গ, গোটা মন্দির দেখেছেন৷ কোথাও এমনকিছু আপনার চোখে পড়েছে কি?’
সুজন এবার আলো ফেলে গোটা মন্দিরটা দেখে নেয়৷ কোথা থেকে আসছে এই কণ্ঠস্বর! অতুল কোথা থেকে কথা বলছে? দেবযানীর কান্না এখন আর শোনা যাচ্ছে না৷ কিন্তু এবার অবাক হয়ে আবিষ্কার করল সে, অতুলের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে মন্দিরের পাথুরে দেওয়াল থেকে!
‘আপনি আমাকে বোধহয় চিনতে পারেননি!’ অতুল গম্ভীরভাবে বলল, ‘কিন্তু মিঃ ও’ কোনর আমাদের দুজনের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন৷ মনে আছে?’
মস্তিষ্কের ভেতরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল সুজনের৷ এবার পরিষ্কার মনে পড়ল মুহূর্তটা! হ্যাঁ; তাই তো! অতুল মিঃ ও’ কোনরের অফিসেই বসেছিল৷ জেমস ওদের দুজনের আলাপও করিয়ে দিয়েছিলেন৷ বলেছিলেন, ‘ও হচ্ছে অতুল মেহতা৷ এখনও পর্যন্ত ওর আনা মূর্তিই নিলামে হায়েস্ট রেট এনেছে৷ ওর স্টাইলই হচ্ছে বিপজ্জনক জায়গা থেকে মূর্তি তোলা! মেইনলি হন্টেড হাউস অ্যান্ড দ্য ফোর্টস! এমনকী ও পুতুলবাড়ি থেকেও একটা স্কাল্পচার নিয়ে এসেছে! ক্যান ইউ বিলিভ ইট?’
মনে পড়ছে৷ একদম স্পষ্ট মনে পড়ছে! কিন্তু তখন অতুল যেন একটু অন্যরকম দেখতে ছিল৷ হ্যাঁ! ওর চোখ দুটো! ওর চোখ দুটো এমন ভয়াবহ ছিল না! বরং স্বাভাবিক গাঢ় বাদামি রঙের চোখ ছিল৷ কিন্তু এখন তো পিঙ্গল! অবিকল এই মন্দিরের পাথরের মতো…!
‘আমি আপনাকে সাবধান করেছিলাম স্যার!’
দেওয়াল থেকে ভেসে এল কথাগুলো, ‘বারবার সতর্ক করেছিলাম! আপনারা শুনলেন না!’
‘তার মানে তোমাকেও ভানগড়ের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন মিঃ ও’ কোনর!’ বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করল সুজন, ‘তুমিও একজন ভ্যান্ডাল!’
‘হ্যাঁ’৷ কণ্ঠস্বর উত্তর দিল, ‘যেদিন আপনি অ্যাসাইনমেন্টটা পেয়েছিলেন, তার পনেরো দিন আগে আমিও…!’
‘ও!’ তার কথা শেষ হওয়ার আগেই উত্তেজিতভাবে বলে উঠল সে, ‘তার মানে তুমি আমাদের এভাবে ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করতে চাও! মিঃ ও’ কোনরের অফারের চেয়েও বড় টাকার অফার পেয়েছ, তাই না?’
দেওয়াল বেয়ে একটা জোরালো দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এল৷ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা৷ তারপর শোনা গেল একটাই শব্দ, ‘না!’
‘ড্যাম লায়ার!’ উন্মত্তের মতো চেঁচিয়ে উঠল সুজন, ‘তুমি কীভাবে এসব ট্রিক করছ জানি না! কিন্তু এভাবে আমায় ভয় দেখানো যাবে না! রত্নাবতীর মূর্তি আমিই এখান থেকে নিয়ে যাব! যেভাবেই হোক, নিয়েই ছাড়ব! কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না৷ তুমিও না!’
কণ্ঠস্বর নিরুত্তর! দেওয়াল থেকে আর কোনো প্রত্যুত্তর ভেসে এল না৷ সুজন আর উত্তরের অপেক্ষাও করল না৷ তার মাথায় যেন রক্ত চড়ে গিয়েছে৷ চুলোয় যাক দেবযানী, গোল্লায় যাক সুরেশ৷ সে কারোর পরোয়া করে না! একজন মূর্তিচোর বা ভ্যান্ডালের কোনো আত্মীয় নেই৷ কোনো বন্ধু নেই! তার বন্ধুত্ব একমাত্র টাকার সঙ্গে! তার একমাত্র আত্মীয় মোটা অঙ্কের চেক৷ আর কেউ নয়!
সে নিজের ব্যাকপ্যাক নিয়ে দৌড়ে গেল মূল গর্ভগৃহে৷ এমার্জেন্সি লাইটটাকে মেঝেতে রেখে দ্রুত হাতে বের করতে শুরু করল ভ্যান্ডালস টুলস! সচরাচর কোনো মূর্তি কাটার আগে সযত্নে সেটাকে ব্রাশ দিয়ে মুছে নিতে হয়৷ তারপর মেজারিং টেপ দিয়ে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মেপে নিয়ে মার্কার দিয়ে আউটলাইন এঁকে নেওয়া জরুরি৷ কিন্তু এতদিনের সমস্ত শিক্ষা, সমস্ত পদ্ধতি ভুলে গেল সুজন৷ কথা নেই বার্তা নেই, পাগলের মতো ছেনি বসিয়েই হাতুড়ির এক জোরালো ঘা মেরে দিল৷
মন্দিরের দেওয়াল থেকে একটুকরো পাথর ভেঙে ছিটকে পড়ল তার সেই ভীষণ আঘাতে! সুজন টের পেল, তার হাত কাঁপছে৷ তবু সে নিজের জেদে অনড়৷ পাগলের মতো হাতুড়ির বাড়ি মেরেই যাচ্ছে৷ ঘা-এর পর ঘা! যেন পণ করেছে, যতক্ষণ না মূর্তিটা খুলে বেরিয়ে আসছে, ততক্ষণ হাল ছাড়বে না! আঘাতে আঘাতে মূর্তিটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে! চলটা উঠে যাচ্ছে৷ তবু থামছে না সুজন! আজ হয় এই মূর্তি ধ্বংস হবে, নয়তো এটাকে সঙ্গে নিয়েই ফিরবে সে৷ এসপার কী ওসপার!
হঠাৎ যেন এমার্জেন্সিটা অলৌকিকভাবে একটু সরে গেল! অথবা তার সোজা আলো কীভাবে যেন বক্ররেখায় গিয়ে পড়ল রাজকন্যা রত্নাবতীর মূর্তির মুখে! জোরালো আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ভাস্কর্যের মুখ! সেদিকে চোখ পড়া মাত্রই ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠে সুজন৷ তার হাত থেকে নিমেষে পড়ে যায় ছেনি ও হাতুড়ি!
এই সুন্দরীর দেহে এ কার মুখ! এই মুখ পরমাসুন্দরী রাজকন্যা রত্নাবতীর হতেই পারে না! আদতে এ কোনো নারীর মুখই নয়! এ এক পুরুষের মুখ! কোটরাগত চোখে পিঙ্গল আভা, চোয়াড়ে মুখ! নাকটা যেন আধখানা বসে গিয়েছে! এই মুখের মালিক তার পরিচিত! এই মূর্তির মুখ হুবহু অতুলের মতো!
ঠিক তখনই দপ করে নিভে গেল এমার্জেন্সিটা! অন্ধকার গর্ভগৃহ কাঁপিয়ে খলখলিয়ে হেসে উঠল এক নারী! তার হাসির দমকে লাস্য আছে৷ তার চেয়েও বেশি আছে নিষ্ঠুরতা!
এ সেই হাসি যা এক অন্ধকার রাত্রে ইথান ওলসেন শুনেছিলেন! নিষ্ঠুর, বড় নিষ্ঠুর!
৯
ভানগড় ফোর্টের মূল প্রবেশপথে দাঁড়িয়েছিল দুই যুবক৷ সূর্যের প্রখর রশ্মিতে ভানগড় ফোর্টের ধ্বংসস্তূপ দেখে বেড়াচ্ছে কৌতূহলী পর্যটকেরা৷ যুবক দুটি একটু সন্তর্পণে মেপে নেয় চারদিক৷ সতর্কতা তাদের চোখের চাউনিতেই স্পষ্ট৷ ইতিউতি তাকিয়ে কিছু যেন খুঁজছে! সম্ভবত গাইডের সন্ধানে আছে৷
একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিল একটি একলা মানুষ৷ তার দৃষ্টিও যুবক দুটির ওপরেই নিবদ্ধ৷ একটু ইতস্তত করে অবশেষে সে এগিয়ে গেল ওদের দিকে৷ ইংরেজিতে জানতে চাইল, ‘আপনারা কি গাইড খুঁজছেন?’
যুবকেরা তাকে একটু বিস্মিতদৃষ্টিতে দেখল৷ মানুষটাকে কী অদ্ভুত দেখতে! আপাতদৃষ্টিতে অবশ্য কোনো অস্বাভাবিকতা নেই৷ কিন্তু ওর চোখ দুটো অদ্ভুত! পিঙ্গল কটা চোখ, নিষ্পলক দৃষ্টি! মানুষটি হাসছে ঠিকই, কিন্তু তার চোখে সে হাসির আভাসমাত্রও নেই৷ যেন ওর চোখ দুটো পাথরের তৈরি!
একজন যুবক একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘হ্যাঁ৷ গাইডই খুঁজছি৷ আপনি?’
মানুষটি আবার রহস্যময় হাসল৷ মাছের মতো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আমি সুজন৷ আপনাদের গাইড৷’
.
সমাপ্ত