জীবনে যাহারা বাঁচিল না
জীবন থাকিতে বাঁচিলি না তোরা মৃত্যুর পরে রবি বেঁচে বেহেশ্তে গিয়ে বাদশার হালে, আছিস দিব্যি মনে এঁচে! হাসি আর শুনি! – ওরে দুর্বল, পৃথিবীতে যারা বাঁচিল না, এই দুনিয়ার নিয়ামত হতে – নিজেরে করিল বঞ্চনা, কিয়ামতে তারা ফল পাবে গিয়ে? ঝুড়ি ঝুড়ি পাবে হুরপরি? পরির ভোগের শরীরই ওদের! দেখি শুনি আর হেসে মরি! জুতো গুঁতো লাথি ঝাঁটা খেয়ে খেয়ে আরামসে যার কাটিল দিন, পৃষ্ঠ যাদের বারোয়ারি ঢাক যে চাহে বাজায় তাধিন ধিন, আপনারা সয়ে অপমান যারা করে অপমান মানবতার, অমূল্য প্রাণ বহিয়াই মল, মণি-মাণিক্য পিঠে গাধার! তারা যদি মরে বেহেশ্তে যায়, সে বেহেশ্ত তবে মজার ঠাঁই, এই সব পশু রহিবে যথা, সে চিড়িয়াখানার তুলনা নাই! খোদারে নিত্য অপমান করে করিছে খোদার অসম্মান, আমি বলি – ওই গোরের ঢিবির ঊর্ধ্বে তাদের নাহি স্থান! বেহেশ্তে কেহ যায় না এদের, এরা মরে হয় মামদো ভূত! এইসব গোরু ছাগলে সেবিবে হুরিপরি আর স্বর্গদূত? এই পৃথিবীর মানুষের মুখে উঠিল না যার জীবনে জয়, ফেরেশ্তা তার দামামা বাজাবে, ভাবিতেও ছিছি লজ্জা হয়! মেড়াতেও যারা চড়িতে ডরায়, দেখিল কেবল ঘোড়ার ডিম, বোররাকে তারা হইবে সওয়ার, - ছুটোইবে ঘোড়া! ততঃকিম! সকলের নীচে পিছে থেকে, মুখে পড়িল যাদের চুনকালি, তাদেরই তরে কি করে প্রতীক্ষা বেহেশ্ত শত দীপ জ্বালি? জীবনে যাহারা চির-উপবাসী, - চুপসিয়া গেল না খেয়ে পেট, উহাদের গ্রাস কেড়ে খায় সবে, ওরা সয় মাথা করিয়া হেঁট, বেহে্শতে যাবে মাদল বাজায়ে কুঁড়ের বাদশা এরাই সব? খাইবে পোলাও কার্মা কাবাব! আয় কে শুনিবি কথা আজব! পৃথিবীতে পিঠে সয়ে গেল সব বেহেশ্তে পেটে সহিলে হয়! অত খেয়ে শেষে বাঁচিবে তো ওরা? ফেসে যাবে পেট সুনিশ্চয়! হাসিছ বন্ধু? হাসো হাসো আরও এর চেয়ে বেশি হাসি আছে, যখন দেখিবে বেহেশ্ত বলে ওদেরে কোথায় আনিয়াছে! শহরের বাসি আবর্জনা ও ময়লা, চড়িয়া ‘ধাপামেলে’ ভাবে, চলিয়াছে দার্জিলিঙ্গে – হাওয়া বদলাতে চড়ে রেলে! বদলায় হাওয়া রেলেও তা চড়ে, তার পরে দেখে চোখ খুলে স্তূপ করে সব ধাপার মাঠেতে আগুন দিয়াছে মুখে তুলে! ডুবুরি নামায়ে পেটেতে যাদের খুঁজিয়া মেলে না ‘ক’ অক্ষর, তারাই কি পাবে খোদার দিদার, পুছিবে ‘মাআরফতি’ খবর! পশু জগতেরে সভ্য করিয়া নিজেরা আজিকে বুনো মহিষ, বুকেতে নাহিকো জোশ তেজ রিশ, মুখেতে কেবল বুলন্দ রীশ, তারাই করিবে বেহেশ্তে গিয়ে হুরপরিদের সাথে প্রণয়! হুরি ভুলাবার মতোই চেহারা, গাছে গাছে ভূত আঁতকে রয়! দেহে মনে নাই যৌবন-তেজ ঘূণ-ধরা বাঁশ হাড্ডিসার, এইসব জরাজীর্ণেরা হবে বেহেশ্ত-হুরির দখলিকার! নেংটি পরিয়া পরম আরামে যাহারা দিব্য দিন কাটায়, জিজ্ঞাসে যারা পায়জামা দেখে – ‘কী করিয়া বাবা পর ইহায়? পরিয়া ইহারে করেছ সেলাই অথবা সেলাই করে পর?’ এরাই পরিবে বাদশাহি সাজ বেহেশ্তে গিয়ে নবতর? বন্ধু, একটা মজার গল্প শুনিবে? এক যে ছিল বুনো! পুণ্য করিতে করিতে একদা তুলিল পটল হয়ে ঝুনো! জগতের কোনো মানুষের কোনো মঙ্গল কভু করেনি সে, কেবলই খোদায় ডাকিত সে বনে বুনো পশুদের দলে মিশে। শিখেনিকো কভু সভ্যতা কোনো, আদব-কায়দা কোনো দেশের, বেহেশ্তে যাবে ভরসায় শুধু ভুলিয়া পুণ্য করিল ঢের! মরিল যখন, গেল বেহেশ্তে; দলে দলে এল হুরপরি, এল ফেরেশ্তা, বস্তা বস্তা এল ডাঁসা ডাঁসা অপ্সরি। রং-বেরঙের সাজপরা সব, − বুকে বুকে রাঙা রামধনু; চলিতে চলকি পড়িছে কাঁকাল যৌবন-থরথর তনু। সারা গায়ে যেন ফুটিয়া রয়েছে চম্পা-চামেলি-জুঁই বাগান, নয়নে সুরমা, ঠোঁটে তাম্বুল, মুখ নয় যেন আতর-দান! যেন আধ-পাকা আঙ্গুর, করে টলমল মরি রূপ সবার, পান খেলে – দেখা যায়, গলা দিয়ে গলে গো যখন পিচ তাহার। দলে দলে আসে দলমল করে তরুণী হরিণী করিণী দল, পান সাজে, খায়, ফাঁকে ফাঁকে মারে চোখা-চোখা তির চোখে কেবল! বুনো বেচারার ঝুনো মনও যেন ডাঁসায়ে উঠিল এক ঠেলায়, হ্যাঁকচ-প্যাঁকচ করে মন তার চায় আর শুধু শ্বাস ফেলায়! পড়িল ফাঁপরে, কেমন করিয়া করিবে আলাপ সাথে এদের! চাহিতেই ওরা হাসিয়া লুটায়, হাসিলে কী জানি করিবে ফের! উসখুস করে, চুলকায় দেহ, তাই তো কী বলে কয় কথা, ক্রমে তাতিয়া উঠিতেছে মন আর কত সয় নীরবতা! ফস করে বুনো আগাইয়া গিয়া বসিল যেখানে পরিরা সব হাসে আর শুধু চোখ মারে, সাজে পান, আর করে গল্পগুজব। পানের বাটাতে হঠাৎ হেঁচকা টান মেরে বলে, ‘বোন রে বোন আমারে দিস তো পানের বাটাটা, মুইও দুটো পান খাই এখন।’ যত হুরিপরি অপ্সরিদল – বেয়াদবি দেখে চটিয়া লাল! বলে, ‘বে-তমিজ! কে পাঠাল তোরে, জুতা মেরে তোর তুলিব খাল! না শিখে আদব এলি বেহেশ্তে কোন বন হতে রে মনহুশ? এই কি প্রণয়-নিবেদন রীতি জংলি বাঁদর অলম্ভুশ! বলেই চালাল চটাপট জুতি; বুনো কেঁদে কয়, ‘মাওই মাও, আর বেহেশ্তে আসিব না আমি চাহিব না পান, ছাড়িয়া দাও!’ আসিল বেহেশ্ত-ইনচার্জ ছুটে, বলে পরিদেরে, ‘করিলে কী? ও যে বেহেশ্তি!’ পরিদল বলে, ‘ওই জংলিটা? ছিছি ছিছি! এখনই উহারে পাঠাও আবার পৃথিবীতে, সেথা সভ্য হোক, তারপর যেন ফিরে আসে এই হুরিপরিদের স্বর্গলোক!’ সকল পুণ্য তপস্যা তার হইল বিফল, আসিল ফের নামিয়া ধুলার পৃথিবীতে, হায়, দেখিয়া দোজখে হাসে কাফের! বন্ধু, তেমনই স্বর্গ-ফেরতা ভারতীয় মোরা জংলি ছাগ, পৃথিবীরই নহি যোগ্য, কেমনে চাহিতে যাই ও বেহেশ্ত বাগ! পিষিয়া যাদেরে চরণের তলে ‘দেউ’ ‘জিন’ করে মাতামাতি, দৈত্য পায়ের পুণ্যে তারাই স্বর্গে যাবে কি রাতারাতি? চার হাত মাটি খুঁড়িয়া কবরে পুঁতিলে হবে না শাস্তি এর, পৃথিবী হইতে রসাতল পানে ধরে দিক ছুড়ে কেউ এদের! আগাইয়া চলে নিত্য নূতন সম্ভাবনার পথে জগৎ ধুঁকে ধুঁকে চলে এরা ধরে সেই বাবা আদমের আদিম পথ! প্রাসাদের শিরে শূল চড়াইয়া প্রতীচী বজ্রে দেখায় ভয়, বিদ্যুৎ ওদের গৃহ-কিংকরী নখ-দর্পণে বিশ্ব বয়। তাদের জ্ঞানের আরশিতে দেখে গ্রহ শশী তারা – বিশ্বরূপ, মণ্ডুক মোরা চিনিয়াছি শুধু গণ্ডুষ-জলবদ্ধ-কূপ! − গ্রহ গ্রহান্তে উড়িবার ওরা রচিতেছে পাখা, হেরে স্বপন, গোরুর গাড়িতে চড়িয়া আমরা চলেছি পিছনে কোটি যোজন। পৃথিবী ফাড়িয়া সাগর সেঁচিয়া আহরে মুক্তা-মণি ওরা, ঊর্ধ্বে চাহিয়া আছি হাত তুলে বলহীন মাজা-ভাঙা মোরা। মোরা মুসলিম, ভারতীয় মোরা এই সান্ত্বনা নিয়ে আছি মরে বেহেশ্তে যাইব বেশক জুতো খেয়ে হেথা থাকি বাঁচি! অতীতের কোন বাপ-দাদা কবে করেছিল কোন যুদ্ধ জয়, মার খাই আর তাহারই ফখর করি হরদম জগৎময়। তাকাইয়া আছি মূঢ় ক্লীবদল মেহেদি আসিবে কবে কখন, মোদের বদলে লড়িবে সে-ই যে, আমরা ঘুমায়ে দেখি স্বপন! যত গুঁতো খাই, বলি, ‘আরও আরও, দাদা রে আমার বড়োই সুখ! মেরে নাও দাদা দুটো দিন আরও আসিছে মেহেদি আগন্তুক!’ মেহেদি আসুক না আসুক, তবে আমরা হয়েছি মেহেদি-লাল মার খেয়ে খেয়ে খুন ঝরে ঝরে – করেছে শত্রু হাসির হাল! বিংশ শতাব্দীতে আছি বেঁচে আমরা আদিম বন-মানুষ, ঘরের বউঝি-সম ভয়ে মরি দেখি পরদেশি পর-পুরুষ! ওরে যৌবন-রাজার সেনানী নয়া জমানার নওজোয়ান, বন-মানুষের গুহা হতে তোরা নতুন প্রাণের বন্যা আন! যত পুরাতন সনাতন জরা – জীর্ণেরে ভাঙ, ভাঙ রে আজ! আমরা সৃজিব আমাদের মতো করে আমাদের নব-সমাজ। বুড়োদের মতো করে তো বুড়োরা বাঁচিয়াছে, মোরা সাধিনি বাদ, খাইয়া দাইয়া খোদার খাসিরা এনেছে মুক্তি-ষাঁড়ের নাদ। আমাদের পথে আজ যদি ওই পুরানো পাথর-নুড়িরা সব দাঁড়ায় আসিয়া, তবু কি দু-হাত জুড়িয়া করিব তাদের স্তব? ভাঙ ভাঙ কারা, রে বন্ধহারা নব-জীবনের বন্যা-ঢল! ওদেরে স্বর্গে পাঠায়ে, বাজা রে মর্তে মোদের জয় মাদল! চিরযৌবনা এই ধরণির গন্ধ বর্ণ রূপ ও রস আছে যতদিন, চাহি না স্বর্গ! চাই ধন, মান, ভাগ্য, যশ! জগতের খাস-দরবারে চাই – শ্রেষ্ঠ আসন, শ্রেষ্ঠ মান, হাতের কাছে যে রয়েছে অমৃত তাই প্রাণ ভরে করিব পান।