০৬-১০. জীবনের মহত্ত্ব

০৬. জীবনের মহত্ত্ব

প্রায় ৩২ বৎসর আগে খুলনার এক স্টীমার থেকে একজন বুড়ো আর একটি ছোট মেয়ে নামলেন। ঠিক তাদের সঙ্গে একটি যুবক অবতরণ করলেন। যুবকটি খুব সম্ভব বাগেরহাটের উকিল, সবে বারে যোগ দিয়েছেন।

বুড়ো দুর্বল, কুঁজো হয়ে হাঁটছিলেন। একটু পথ হেঁটে আর একখানি স্টীমারে চড়তে হবে, বালির চরায় নদী ভরাট হয়ে গেছে, তাই স্টীমার কোম্পানী দু’ধারে দু’খানা স্টীমারের ব্যবস্থা করেছেন। ৮/৯ বৎসরের ছোট্ট মেয়েটি একটা বৃহৎ বোঝা এক হাত দিয়ে পিঠে তুলে নিচ্ছিল অন্য হাত দিয়ে বুড়োর দুর্বল হাত চেপে ধরেছিল।

বুড়ো সস্নেহে বলছিলেন, “তুই কি অত বড় বোঝা নিতে পারবি, আমায় দে।”

মেয়ে ততোধিক স্নেহে বলছিল, “দাদা, তুমি দুর্বল, হাঁটতে পারছ না, তোমাকে আমি শক্ত করে ধরছি। এ বোঝাটা তুমি নিতে পারবে না, আমিই বেশ পারব।” বোঝার ভারে মেয়েটি কাঁপছিল, কিন্তু স্নেহ প্রদর্শনে তার ক্লান্তি নেই।

এই স্বর্গীয় দৃশ্যটি যুবক চেয়ে দেখলেন, তারপর নিকটে এসে বললেন, “মা লক্ষ্মী, দেখ, আমার গায়ে অনেক বল আমার হাতে ঐ বোঝাটি দাও; আমি বয়ে নিয়ে দেবো, তুমি তোমার দাদার হাতখানি শক্ত করে ধর।”

মেয়েটি যুবকের দিকে সকরুণ নেত্রে চেয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। যুবক তৎক্ষণাৎ ভারী বোঝাটা দৃঢ়-বাহুর একটানে পিঠের উপর ফেলে চলতে লাগলেন। বুড়ো যুবককে প্রাণভরে দোয়া করলেন।

জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজে আমরা যে দয়া ও মহত্ত্বের পরিচয় দিতে পারি, তা একটা সুবর্ণ মুদ্রার মতোই মূল্যবান এবং উজ্জ্বল! তা একেবারে খাঁটি সোনা–আঘাত করলে তার মাঝে একটুখানিও নকল পাওয়া যায় না।

কৃপণ জীবন ভরে এক একটা মুদ্রা প্রাণের রক্তের মতো সঞ্চয় করে। আমরা কি সুন্দর সুন্দর মহৎ কাজ করে, কৃপণের মতো জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজের সুবর্ণ মুদ্রাগুলি সঞ্চয় করতে পারি না? তাতে যে আমাদের জীবনের মূল্য কত বেড়ে যাবে?পার্থিব ধন-সম্পদ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিনষ্ট হবে।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহৎ কাজগুলি যেমন আমাদের চিত্তকে প্রসন্ন করে, তেমনি অক্ষয় সুবর্ণরেখার মতো চিরদিন মনুষ্য আত্মাকে সম্পদশালী করে।

পুলিশের নাম শুনলে মানুষ বিরক্ত হয়, থানা-ঘর দেখলেই সেইখান থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষ ঘৃণায় সরে যায়। মানুষ থানা-ঘরের মর্যাদা নষ্ট করছে, কিন্তু যে স্থানে পীড়িত মানুষ নিজের মর্মব্যথা নিবেদন করে, যেখানে অত্যাচারিত দীন-দুঃখী আশ্রয় পায়, সেই স্থান কি সত্যই অপবিত্র? মানুষ নিজের দোষে থানা-ঘরের মর্যাদা নষ্ট করেছে। পবিত্র বিচারস্থানের মূল্য এবং মর্যাদা প্রকৃত খোদাভক্ত এবং ধার্মিক লোকদের কাছে চিরদিনই অক্ষুণ্ণ থাকবে–তারা থানা-ঘরের সংস্রবেই বা বাইরের লোকই হন।

আলী নামক এক পুলিশ কর্মচারী একদা এক রেল স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন, এক অনিন্দ্যসুন্দরী মহিলা স্টেশনে কাউন্টারের কাছে এসে খুব ব্যস্ততার সঙ্গে টিকেট চাইল। স্টেশন মাস্টার বললেন, এখানে অপেক্ষা করুন, রাত্রিকালে গাড়ি আসবে, সেই গাড়িতে যাবেন।

যুবক দেখলেন–মাস্টারের ব্যবহার সন্দেহজনক। মহিলাটি ভদ্রঘরের বলেই মনে হয়; মাস্টারের কথায় সন্দেহ করে মহিলাটি আর বিলম্ব না করে বিনা টিকেটেই গাড়িতে উঠে পড়ল। পুলিশ যুবকটিও তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মহিলাটির উপর রেখে মহিলার গাড়িতেই এক প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন।

তারপর গাড়ি ছেড়ে দিল। মাহিলাটির হাতে একটা পোটলা ছিল, খুব সম্ভব তাতে কতকগুলি দামি গহনা ছিল। পুলিশ যুবকটি তাকে লক্ষ্য করে বসেই আছেন। ২/৪ স্টেশন যেতেই একটা লোক হঠাৎ গাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে মহিলার সঙ্গে ভারি আলাপ শুরু করে দিলো। এমন কি কয়েক মিনিটের আলাপে মহিলাটি যে তার অনেক জন্মের মা, এই কথা প্রকাশ করে ফেলল। পুলিশ-যুবক লোকটির সব কথা লক্ষ্য করেছেন। তারপর এক স্টেশনে এসে লোকটি মহিলাটিকে লক্ষ্য করে বলল, “আপনি যেখানে যাবেন, আমিও সেখানে যাব। আজ গরিব সন্তানের বাড়িতে বিশ্রাম করুন, কাল আপনাকে একেবারে নিজে গিয়ে বাসায় রেখে আসব।” ভদ্রমহিলা হচ্ছেন এক উঁকিলের বউ, শাশুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করে রাগের মাথায় এক কাপড়ে স্বামীর কাছে যাবে বলে বেরিয়ে এসেছে; বেরিয়ে যখন পড়েছে তখন আর উপায় নাই। পথে এসে অন্তরে তার বিলক্ষণ ভয় হয়েছে। লোকটির কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে, সেখানেই নেমে পড়ল, পুলিশ-যুবকটিও সেখানে নেমে পড়লেন। নেমে পড়েই তিনি মহিলাটিকে আটকে রাখবার জন্যে টিকেট কলেকটরকে বললেন, “এই মহিলাটির কাছে টিকেট নাই, একে আটক করুন।” জুয়াচোর লোকটি তাকে মহাবিপদে ফেলবার চেষ্টা করছিলো তা সে বুঝতে না পেরে কাঁদতে লাগল। সেই বদমায়েশ লোকটি ইত্যবসরে সরে পড়েছিল। মহিলাটি তখন আরও বেশি করে হাউ-মাউ করে কাঁদতে লাগল। পুলিশ যুবক তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, “আপনার কোনো ভয় নাই।” তার স্বামীর ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে, যুবক তৎক্ষণাৎ সেখানে একটি টেলিগ্রাম করে দিলেন। তারপর মহিলাটিকে গার্ড সাহেবের জিম্মা করে বললেন, “এর জন্যে আপনি দায়ী, কোনো বিপদ হলে আপনাকে সেজন্য জবাবদিহি করতে হবে।” গন্তব্যস্থানের স্টেশন মাস্টারের কাছেও তিনি একটা তার করে দিলেন, মাহিলাটিকে যেন সযতে স্টেশনে অপেক্ষা করবার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয় এবং তার স্বামী উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত যেন তিনি তাকে আপন হেফাজতে রেখে দেন।

এর কয়েক দিন পরেই ভদ্রমহিলার স্বামী ‘বেঙ্গল’ পত্রিকায় এক দীর্ঘ প্রবন্ধে এই কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনাটি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন, সহৃদয় পুলিশ যুবকটির সাহায্য না পেলে তার যে কী বিপদ হত, তা চিন্তা করাও কঠিন।

মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্বের পরিচয় দেবার সুযোগ পুলিশ কর্মচারীদের যেমন আছে তেমন আর কারো নাই।

দুর্বলের যারা রক্ষক, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে যাদের জীবন, তারা কি লোভের সম্মুখে বিচলিত হবেন? শুধু অবস্থা ভালো করে কি হবে? মনুষ্যত্বের কাছে আর কি অধিকতর গৌরবের বিষয় আছে?

কয়েক বৎসর আগে একজন লোককে একটা জাল টাকা নিয়ে কলিকাতার এক মিঠাইওয়ালার দোকানে গিয়ে কিছু মিঠাই চাইতে দেখেছিলাম। দোকানদার মিষ্টান্নগুলি একটা পাতায় বেঁধে লোকটির হাতে দিয়েছে, আর ডান হাতে টাকা ধরেই চিৎকার করে বলে উঠল–শয়তান! পাজী’–আরও অনেক অশ্লীল ভাষায় সে গাল দিল। গোলমাল শুনে,আমি এগিয়ে গিয়ে শুনতে পেলাম, পথিক সবিনয়ে বলছে, “ওটি জাল টাকা তা আমি জানি নে, তুমি মাফ কর। আমার কাছে আর পয়সা নাই। তোমার মিঠাই তুমি ফিরিয়ে নাও।” মিঠাইওয়ালা বললে, “তোমার ছোঁয়া জিনিস আর ফিরিয়ে নেবো না–পয়সা ফেলো, নইলে জুতো খাবে।” পথিক ভারি অপ্রস্তুত হল! তার হাতে সত্য সত্যই আর পয়সা ছিল না। টাকাটি জাল তা পথিক জানত বলেই মনে হল, অভাবগ্রস্ত বলে ক্ষুধায় কাতর হয়ে মিঠাইওয়ালাকে ফাঁকি দিতে চেয়েছিল। তার চোখে-মুখে অপরাধীর দীনতা, আমি দেখতে পেলাম। এমন সময় হঠাৎ একটি ভদ্রলোক এসে তার পকেট হতে পয়সা তুলে মিঠাইওয়ালার দাম চুকিয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে সে স্থান ত্যাগ করলেন। অপরাধী লোক। তার আন্তরিক কমতোজ্ঞতা কিছুতেই চেপে রাখতে পারল না; সে ভদ্রলোকের পেছনে পেছনে ছুটল, আমিও তার পেছনে পেছনে চলোম–লোকটি কী বলে, আর ভদ্রলোকই বা কী বলেন, তাই শোনার জন্যে।

অনেক দূর দৌড়িয়ে গিয়ে ভদ্রলোকটির সম্মুখে দাঁড়ালাম। অপরাধী পথিকটি তখনও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করছিল। আমি দেখলাম সেই ভদ্রলোকের মুখে খোদার জ্যোতি। খোদাকে চোখে দেখি নাই, কিন্তু মানুষের মুখে তার ছায়া দেখলাম।

নিম্নস্তরের লোক, যাদের কৃষক বলে অবজ্ঞা করি, তাদের ভিতর খোদায়ি (Divine) ভাব কেমনভাবে ফুটে উঠে, তা নিম্নলিখিত আর একটি ঘটনায় বেশ জানা যাবে।

অনেক বছর আগে একদা চুয়াডাঙ্গা হতে ঝিনাইদহ মহকুমা পর্যন্ত যে রাস্তা এসেছে, ঐ রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলাম। তখন হেঁটে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। রাস্তা দীর্ঘ ৪০ মাইল। পথের মাঝখানে একটা পুকুরের ধারে বসে এক কৃষককে বিড়ি খেতে দিয়েছিলাম। তখন আমার বাল্যকালের ধূমপানের কুঅভ্যাসটি ছিল।

এক দু’বছর পর আর একদিন আমি চুয়াডাঙ্গা হতে রওয়ানা হই। রাস্তা অতিশয় বিপজ্জনক–দুই ধারে বিরাট মাঠ। ১৬ মাইল আসার পর সন্ধ্যা হয়ে গেল, পাগুলিও অবশ হয়ে এসেছিল; কোথাও আশ্রয় চাইবার অভ্যাস আমার ছিল না। এদিকে ওদিকে না চেয়ে অতিকষ্টে অগ্রসর হতে লাগলাম। ক্রমে রাত্রি অনেক হল, আমিও আর পথ চলতে পারি না। যতই অগ্রসর হই পথ ততই দীর্ঘ বলে মনে হতে লাগল। ঝিনাইদহের প্রায় ৬ মাইল দূরে যখন এসে পৌঁছলাম, তখন দুই ধারে বিরাট দৈত্যাকার গাছের সারি–মনে হতে লাগলো, গাছের ডালে ডালে ভূতেরা সব হেসে বেড়াচ্ছে, জনমানবশূন্য রাস্তা। চাঁদের আলো ঘনসন্নিবিষ্ট গাছের ভিতর দিয়ে অস্পষ্টভাবে এখানে-ওখানে উঁকি মারছিল।

পা আর চলে না, তবুও এগোচ্ছিলাম, কারণ তখন আর কোনো উপায় ছিল না। ভয় যা হচ্ছিল, তো খোদাই জানেন। এর উপর সম্মুখে রাস্তার পার্শ্বে গভর্নমেন্টের মরা কাটবার (Post mortem) ঘর।

এমন সময় দেখতে পেলাম, দুটি লোক অপর দিক থেকে আসছে। ভাবলাম এরা এখনই আমায় অতিক্রম করে চলে যাবে। আমি যে অবস্থায় আছি, সেভাবেই এগোতে হবে। আর উপায় কী?

একজন জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কে?” আমি উদাসীনভাবে বললাম–”পথিক!” পা টেনে টেনে হাঁটছিলাম, তা সে লক্ষ্য করেছিল। বললে, “এত রাতে একা একা–এখনও অনেক পথ বাকি।”

আমি ভীতকণ্ঠে বললাম, “তা হলে, আর কী করি? কোনো উপায় দেখি না”।

এমন সময় লোকটি বললে, “আমি তো আপনাকে চিনি, (কী একটা স্থানের নাম করে সে বলল) দু’বছর আগে আপনি অমুক স্থানে আমাকে বিড়ি খেতে দিয়েছিলেন–কেমন, না?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ!” একটা বন্ধুর দেখা পেয়েছি বলে আমার মনটি একটু আশান্বিত হয়ে উঠলো।

সে বললো, “চলুন, নিকটেই রাস্তার ধারে বাড়ি। রাত্রিতে আমার বাড়ি থাকবেন। ভোরে উঠেই রওয়ানা হবেন। কী মহাবিপদ আপনার যে, এ অবস্থায় এই রাত্রিতে আপনি একা এতদূরে চলেছেন।” আমি লমিতো হয়ে বললাম, “আমার হাঁটবার ক্ষমতা নেই; বেশি দূরে হলে কী করে যাবো?”

সে বললে, “আচ্ছা, তা হলে নিকটেই এক বাজার আছে, সেখানে কোনো দোকান ঘরে আপনাকে শুয়ে রেখে দি, প্রাতে উঠে চলে যাবেন।” আমি দ্বিরুক্তি না করে ফিরলাম। কিছু দূরে হেঁটেই একটা বাজার পাওয়া গেল। বাজারের সবাই দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কৃষক প্রত্যেক দোকানীকে আমার কথা জানিয়ে আশ্রয় চাইল। কেউ অপরিচিত লোককে স্থান দিতে স্বীকৃত হল না। অগত্যা কৃষক বন্ধুটি আশ্বাস দিয়ে বললে, “অনেক দূরে হেঁটে এসেছেন, আর কিছুদূর গেলেই আমার বাড়ি। একটু কষ্ট করে আস্তে আস্তে চলুন।” অগত্যা স্বীকৃত হলাম।

অনেক কষ্টে তার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। সে আমায় অতি উত্তম খাদ্যসামগ্রী দিয়ে আহার করালে এবং উৎকৃষ্ট বিছানা দিয়ে আমাকে শুয়ে রাখলে। এই কৃষকের কথা যতবারই ভাবি, ততবারই আমার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠে।

ভাবি, তার সঙ্গে আর কোনো দিনও দেখা হবে না, তার কোনো উপকার করি নাই। নিঃস্বার্থ প্রেমের পরিচয় মানুষ খোদার ভাবে অভিভূত হয়েই দেয়।

মানুষের একদিক পশুর অন্যদিক তার খোদাময় প্রভাত-সৌন্দর্যের মতো নির্মল, মধুর জননীর বুকের মতো সরল। খোদায়ীভাবে মনুষ্য মনুষ্যের নমস্য।

নিরক্ষর মানুষের মধ্যে আমরা অনেক সময় আশ্চর্য ত্যাগ ও মহত্ত্বের পরিচয় পাই, সেরূপ মহত্ত্ব শিক্ষিত লোকেরাও দেখাতে পারেন না। আমরা এখানে পল্লীগ্রামের একটা সামান্য মানুষের দৃষ্টান্ত দিতে চাই যার হৃদয়ের বিশালতা অনেক মানুষের ঈর্ষার বিষয় হতে পারে। মাগুরা মহকুমার হাজীপুরের জরদার বংশের তমিজুদ্দীন জরদার নিজ জীবনে প্রায় ৮ হাজার টাকার সম্পত্তি ক্রয় করেন। এর মধ্যম ভ্রাতা তার একমাত্র শিশুপুত্রকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তমিজুদ্দীনের হাতে সমর্পণ করে এর পূর্বেই অকালে প্রাণ ত্যাগ করেন। তমিজুদ্দীনের আর একটি ভ্রাতা ছিলেন তিনি সর্বকনিষ্ঠ। জীবনের সঞ্চিত সমস্ত ধনই এই কনিষ্ঠ ভ্রাতার হাতে তিনি রাখতেন এবং তার হাত থেকে খরচ হত। তমিজুদ্দীন ভ্রাতাকে এতই স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন যে, তিনি খরচের বা রাশি রাশি জমান টাকার কোনো হিসাবই রাখতেন না। এত করেও তমিজুদ্দীন শেষ জীবনে নিঃস্ব অবস্থায়, বিনা চিকিৎসায় প্রাণত্যাগ করেন। মৃমতো মধ্যম ভ্রাতার পুত্রকে তিনি আপন অর্জিত ভূসম্পত্তির শ্রেষ্ঠ অংশ দান করে যান। আপন পুত্রদ্বয়কে সংসারের জমান টাকার কিছুই দেন নাই, স্থাবর সম্পত্তির অতি সামান্য অংশই এরা পেয়েছিল। এই উদার হৃদয় ব্যক্তি নিরক্ষর ছিলেন; তার ত্যাগ ও মহত্ত্ব শিক্ষিত লোকদেরও বিস্ময় উৎপাদন করে।

মনুষ্য যখন মহত্ত্বের পরিচয় দেয়, তখন আর সে মানুষ থাকে না। তখন খোদায়ি ভাব তার মাঝে প্রকাশ পায়। জগতের সমস্ত হীনতা অতিক্রম করে মানুষ তখন মহাগৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হয়।

.

০৭. স্বভাব-গঠন

বাক্যবাগীশ, কথায় চতুর ও তার্কিক হওয়া খুব সহজ, কিন্তু তিল তিল করে নিজের স্বভাবকে গঠন করে তোলা বড় কঠিন। প্রত্যেক মানুষের শ্রেষ্ঠ কাজই হচ্ছে নিজের স্বভাবকে গঠন করে তোলা।

ইহাই মানুষের কাছে শ্রেষ্ঠ কাজ, মানুষের কাছে ইহা অপেক্ষা আল্লাহর বড় আদেশ আর নাই। এই পরম আদেশের উপর যারা কথা বলে, তারা নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী। মনুষ্য আপন স্বভাবকে খোদার অনুযায়ী গঠন করে তুলবে, এই-ই খোদার উপাসনা। নিজের স্বভাবকে পরিবর্তন না করে, আল্লাহ্ আল্লাহ্ করবার কোনো সার্থকতা নাই। যে আল্লাহকে ভালোবেসেছে, সেই আপন স্বভাবকে সংযত করেছে, মিথ্যা পরিহার করেছে, খোদার জীবনকে ভালোবেসেছে, পশুকে আঘাত করতেও সে থমকে ভেবেছে।

খোদার জন্য যে তর্ক করে, তার মূল্য খুব কম। ইসলাম শ্রেষ্ঠ এই কথা বলবার জন্য যে মহাআস্ফালন করে, তারও মূল্য খুব কম। যে মিথ্যা পরিহার করে, আপন স্বভাব গঠন করে, সেই প্রকৃত খোদা-ভক্ত, সেই পরম শান্তিতে আছে, সেই মুসলমান। মুসলমানের অর্থ তর্ক নয়, আস্ফালন নয়, এর অর্থ নীরবে নিজকে গঠন করে তোলা। ইসলাম মানে কাজ–বাক্য নয়।

আল্লাহ চান না তোমরা শুধু ইসলামের মহিমা কীর্তন কর, তিনি চান তোমরা মুসলমান হও, নিজ নিজ স্বভাব খোদায়ি ভাবে গঠন কর।

হযরত মোহাম্মদ (দঃ) সম্বন্ধে বলা হয়েছে–”নিশ্চয়ই তোমার স্বভাব উত্তম।” যে নিজ স্বভাবকে উত্তমরূপে গঠন করেছে, সেই প্রকৃত নবীভক্ত; যে শুধু মুখে চিৎকার করে দরূদ পাঠ করে, সে নবী-ভক্ত নয়।

হযরত মোহাম্মদ (দঃ) বলেছেন–”আমি নীতিশাস্ত্রকে পূর্ণ করতে এসেছি।” ইসলাম নীতিময় জীবন।

মানুষের সুন্দর মুখ দেখে আনন্দ্রিত হয়ো না। স্বভাবে যে সুন্দর নয় দেখতে সুন্দর হলেও তার স্বভাব, তার স্পর্শ তার রীতি-নীতিকে মানুষ ঘৃণা করে। দুঃস্বভাবে মানুষ মানুষের হৃদয়ে জ্বালা এবং বেদনা দেয়, তার সুন্দর মুখে মনুষ্য তৃপ্তি পায় না। অবোধ লোকেরাই মানুষের রূপ দেখে মুগ্ধ হয় এবং তার ফল তারা ভোগ করে।

যার স্বভাব মন্দ, সে নিজেও দুষ্ক্রীয়াশীল মিথ্যাবাদী দুর্মতিকে ঘৃণা করে। মানুষ নিজে স্বভাবে সুন্দর না হলেও সে স্বভাবের সৌন্দর্যকে ভালোবাসে।

স্বভাব-গঠনে কঠিন পরিশ্রম ও সাধনা চাই, নইলে শয়তানকে পরাজিত করা সম্ভব নয়।

যে স্বভাব-গঠনে চেষ্টা করে, চিন্তা করে, সে এবাদত করে।

মানুষের পক্ষে একদিনে ফেরেস্তা হওয়া সম্ভব নয়। ধীরে, অতি ধীরে, বহু বৎসরের সাধনায় এমন কি সমস্ত জীবন ধরে নিজেকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে হবে। মন্দের সঙ্গে আমাদের জীবন এমনিভাবে জড়িত আছে যে, একে ত্যাগ করে আপন স্বভাবকে বিশুদ্ধ করা এক মহাকঠিন সাধনা। দিনের প্রতি কাজে, বাক্যে আমরা পতিত হই। প্রতিদিনকার রহস্য এবং আলাপে আমরা গোপনে গোপনে হীন এবং মূঢ় হই। কে আমাদের জীবনের এই শত গোপন কলঙ্ক হতে রক্ষা করবে?

জীবন গঠন করবার জন্যে ধীরে ধীরে চেষ্টা কর, কখনও ভীত হয়ে পশ্চাদপদ হয়ে না। সংসারে যারা কাপুরুষ তারাই স্বভাব গঠনের কঠিন কর্তব্য শক্তিহীনের শৈথিল্যে ত্যাগ করে পলায়ন করে। বীরের মতো সাহসী হয়ে সম্মুখে দাঁড়াও। ভয় পেয়ো না–পালিও না। পালালেই সর্বনাশের গভীর কূপে পতিত হবে। চিরদিনের জন্যে জীবনের অফুরন্ত গৌরব রাজ্য হয়ে ফিরে আসবে। দুর্গ জয় করতেই হবে, মানব জীবনের সুমহান সাধনা ত্যাগ করে পশুদের একজন হয়ো না।

এখানেই মানুষের সমস্ত শক্তি, সমস্ত জ্ঞানের পরীক্ষা হয়–কে কতখানি নিজকে গঠন করতে পেরেছে।–মিথ্যা, লোভ, দ্বেষ, হিংসা, দুর্বলতা কে কতখানি জয় করতে শিখেছে। তুমি কি মিথ্যা বলে থাক? তা হলে চেষ্টা কর–পুনঃ পুনঃ চেষ্টা কর–মিথ্যাকে পরিহার করে চলবার জন্যে। তুমি কি অন্তরে মিথ্যা গোপন করে মানুষের সঙ্গে কথা বল? তা হলে সাবধান হও। গোপনে আপন মনে লমিতো হও–শতবার লমিলতা হও। জীবনের গৌরব রক্ষা করবার জন্যে সর্বদাই চেষ্টা কর; মনুষ্য তোমায় বুঝতে পারুক আর না পারুক।

তোমার প্রবৃত্তি কি নীচ? তা হলে সাবধান হও–চিন্তা কর, নিজেকে সংশোধন কর, কারণ পশুর স্বভাব মনুষ্যের পক্ষে ইহা লজ্জাজনক।

যৌবনের উষ্ণ রক্তে তুমি কি মানুষের উপর হঠাৎ তোমার বজ্রমুষ্টি উত্তোলন কর? ক্ষান্ত হও, সহিষ্ণু হয়ে আপন কাজের তুমি সমালোচনা কর। শীঘ্রই মানুষের রক্ত নিস্তেজ হয়ে যায়, বার্ধক্যে শরীরের পেশীসমূহ দুর্বল হয়ে পড়ে। তুমি যাকে আঘাত করতে যাচ্ছ সেও এক সময় তোমারই মতো শক্তিশালী ছিল।

তুমি কি টাকার গর্বে মানুষের সঙ্গে উপহাসের সঙ্গে কথা বল? তা হলে সাবধান হও। কারণ তোমার চাইতে বড় মানুষ এ জগতে বহু এসেছিল–তারা ধুলায় মিশেছে।

তুমি কি নিষ্ঠুর? ইহা পশুর স্বভাব। মনুষ্য হয়ে কেমন করে তুমি নিষ্ঠুর হবে? তুমি আপন নিষ্ঠুর স্বভাবের জন্য লমিতো হও।

বয়য়াজ্যেষ্ঠ ও প্রবীণ ব্যক্তিকে সম্মান করতে কি তোমার লজ্জা হয়? গর্বে তোমার সমস্ত মানুষকেই অবজ্ঞা করতে ইচ্ছা হয়? তা হলে অনুতপ্ত হও–কারণ বিনয়ই মানুষের ভূষণ।

গর্বিত শয়তান চিরদিনই আল্লাহ্ এবং মনুষ্যের ঘৃণার পাত্র। মনুষ্যের গর্ব করবার কিছুই নাই। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বিনয়ই গৌরব করেন, গর্বে তাঁরা মর্যাদাশীল নন।

তোমার কি অনবরত পরের নিন্দা করতে ইচ্ছা হয়? নিন্দুককে সমস্ত জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিই ঘৃণা করেন। নিন্দুক সমস্ত মানুষের শত্রু-নিন্দাই তার ব্যবসা। সে মানুষের গুণকে শ্রদ্ধা করে না, মানুষের মূল্য তার কাছে কিছুই নয়।

মনুষ্য রাজাকে ভক্তি করে না। কিন্তু উত্তম স্বভাবকে সে আন্তরিক ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে। মানুষের কাছে যদি লমিলতা ও নিন্দিত হয়ে বেঁচে থাকতে হয়, তার চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?

উত্তম স্বভাবের অর্থ–অন্যায়কে সমর্থন করা নয়, শুধু মানুষের প্রশংসা লাভের সাধনাও নয়। কারণ, যে সবাইকে তুষ্ট করতে চায়, সে কাউকেও সন্তুষ্ট করতে পারে না।

স্বভাব যার উত্তম, সে সর্বদাই নীতিবান, মিথ্যাকে সে আন্তরিক ঘৃণা করে, প্রাণ গেলেও সে মানুষকে তুষ্ট করবার জন্যে অন্যায় ও মিথ্যাকে স র্থন করে না। সে মিথ্যাকে সাক্ষ্য দেয় না। অন্তরে পাপ, মুখে তার মধু নয়। সে বিনয়ী, ভদ্র এবং সহিষ্ণু। সে মানুষের দাবীকে নষ্ট করে না, সে কখনও অভদ্রের মতো কথা বলে না। মানুষকে ইতর ছোটলোক বলে উপহাস করে চলা তার স্বভাব নয়। সে জ্ঞানবান, কারণ জ্ঞানী ব্যতীত সূক্ষ্মভাবে জীবনের অন্যায় এবং ন্যায় কোনোমতে অনুভব করা যায় না। সকলের প্রতিই তার সহানুভূতি আছে। সে আত্মসর্বস্ব নয়। শুধু নিজের সুখের চিন্তাতে সে ব্যস্ত থাকে না। মানুষ তার যতটুকু দেখে, সে ততটুকুতেই শুদ্ধ এবং সুন্দর নয়। নিজের চোখে সে আপনাকে যতটুকু দেখে, ততটুকুতেই সে সুন্দর। সে যেমন নিজের সম্মান বোঝে, অন্যের সম্মানও সে। তেমনি বোঝে। তার দৃষ্টি অতিশয় তীক্ষ্ণ, সে হৃদয়তা প্রদর্শনে কোনো সঙ্কোচ করে না।

একদা কানাডা শহরে এক বিশিষ্ট ব্যক্তি সমস্ত বোঝা তার দুর্বল পত্নীর ঘাড়ে চাপিয়ে গর্বিতের ন্যায় যাচ্ছিলেন। স্যার এডওয়ার্ড তাড়াতাড়ি সেই নারীর বোঝাটি নিজের পিঠে নিয়ে তাঁকে ভারমুক্ত করলেন। বস্তুত উত্তম স্বভাবের মানুষ দুর্বল এবং শক্তিহীনের উপর কষ্টের ভার চাপিয়ে নিজে সুখ পান না। নিজে শুয়ে বসে দুর্বল নারীকে দিয়ে সংসারের যাবতীয় কাজ করিয়ে নেওয়া হৃদয়হীনতার পরিচায়ক।

মানুষের মধ্যে ছোটলোক এবং ভদ্রলোক বলে কোনো কথা নাই। স্বভাব যার উত্তম, সেই ভদ্রলোক। নীচ বংশে জন্মেও যদি মানুষ স্বভাবে উত্তম এবং উন্নত হয়, সে মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। যে নমস্কার করে, মাটির আসনে বসে আছে, সে হয়তো অনেক সময় যে উচ্চাসনে বসে আছে তার চাইতে শ্রেষ্ঠ এবং উত্তম।

.

০৮. জীবন সাধনা

জাগতিক অভাব মানুষের বেদনা উপহাসের জিনিস নয়। জাগতিক দুঃখ ও দৈহিক অভাবের ভিতর দিয়েই আল্লাহ্ তার মহিমা এবং গুপ্ত ভাব প্রকাশ করেন। সুতরাং দেহের অভাবকে উপহাস করলে চলবে না, দেহের কথা ভাবতে হবে।

এই দেহের অভাবের জন্য মানব-সংসারে কত পাপই না অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আল্লাহ্ যে প্রতিজ্ঞা করেছেন, সে প্রতিজ্ঞায় মনুষ্য বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে নাই। হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেন, ক্ষেতের পুষ্প কেমন সুন্দর, পক্ষীরা আহারের চিন্তায় ব্যস্ত হয় না অথচ গলা ভর্তি করে সন্ধ্যাকালে তারা কুলায় ফিরে আসে। আল্লাহ্ মানুষের কথা কি ভুলে যাবেন? মানুষকে তিনি আরও বেশি ভালোবাসেন, মানুষকে কি তিনি আরও বেশি সুশোভিত করবেন না?

আল্লাহ্ আর এক জায়গায় বলেছেন, আমার বান্দার কাছে মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করি নাই।

তবু মানুষ আল্লাহকে বিশ্বাস করে নাই। অবৈধ মিথ্যা পথে সে অন্ন এবং বস্ত্রের সন্ধানে ফিরেছে। অন্ন এবং বস্ত্রের জন্যে মানুষ কী পাপই না করেছে, তা ভাবতেও মন। অস্থির এবং ভীত হয়ে ওঠে। আত্মাকে বিনষ্ট করে সে বেশ্যা নারীর শুভ্র পোশাকে দেহকে সমিতো করেছে, অবৈধ অন্ন মুখে তুলে দিয়েছে।

কেন জীবনের পথ এত জটিল করে নিলে তোমরা? কে তোমাদের এই সর্বনেশে শিক্ষা দিয়েছে? আত্মাকে অপবিত্র করে, প্রাণঘাতী দারিদ্র্য-দুঃখকে বরণ করে জীবনকে ব্যর্থ করে দেবে? এরই নাম কি দ্ৰতা? এ ভদ্রতা কে শিখিয়েছে তোমাদের? পরিশ্রম করতে লজ্জাবোধ কর? শ্রমকে তোমরা সম্মান করতে জান না? চৌর্য, হীন দাসত্ব, কাপুরুষতা, আত্মার দীনতা ও মিথ্যার পোশাক তোমাদের কাছে ভদ্রতা? ৬০ টাকা বেতনে চাকরি করে অসৎ উপায়ে মাসিক ২০০ টাকা আয় করতে তোমাদের মনুষ্যত্ব লমিতো হয় না? আর এই চুরি করার সৌভাগ্য কয়জনের হবে? এ যে বিনষ্ট হবার পথ।

পরিশ্রমকে তোমরা সম্মান করলে বুঝতে পারবে, কয়লার মধ্যে, কল-কারখানার ধুলা বালির মাঝে, মাঠের কাদায়, কামার ঘরে অগ্নিস্ফুলিঙ্গে তোমাদের মনুষ্যত্ব ও শক্তি লুকিয়ে আছে। দুর্বল, কাপুরুষ, শক্তিহীন, ধর্মহীন, দুঃখী হয়ে তোমরা মরো না। চাকরি ক’টি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে? চাকরির নেশা ত্যাগ করে তোমরা দিকে দিকে ছুটে পড়। পাশ্চাত্য দেশে মানুষ শিল্প ও দৈহিক পরিশ্রমকে সম্মান করতে শিখেছে–কত প্রতিভা কত স্থানে আপন আপন জীবনকে সার্থক করেছে। তারা মানুষ, তাদের শক্তিতে সমস্ত জাতির দেহে অফুরন্ত শক্তি সঞ্চিত হয়েছে, তারাই জাতির মেরুদণ্ড এবং প্রাণ। কয়েকজন কেরানি ইংরেজ জাতিকে গিরি লঙ্ঘন করতে, আকাশে উড়তে, সমুদ্র অতিক্রম করতে শিক্ষা দেয় . নাই। কী অফুরন্ত বিরাট শক্তি সমস্ত জাতির দেহে রক্ত প্রবাহের কর্ম প্রেরণা ঢেলে দিয়েছে।

জাহাজ-নির্মাণ, কামান-বন্দুক তৈরি, অসংখ্য কলকজা, তালা-চাবি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, ছাপাখানা, কৃষি, অস্ত্র-সরঞ্জাম, স্থপতি শিল্প, ভূ-তত্ত্ব, খনি, চারুশিল্প, বস্ত্র তৈরি, সুঁই, সূতা, বাদ্যযন্ত্র, শিশি-বোতল, ধাতুর পাত্র, বাসন ও কাঁচ নির্মাণ প্রভৃতি লক্ষ্য করার কাজে নিজেদের প্রতিভা তাঁরা নিয়োগ করেছেন–শুধু চাকরির সন্ধানে তাঁরা তাঁদের জীবন। ব্যর্থ করে দেন নাই। জাতির অভাব চাকরিতে পূরণ হবে না। এর ফলে দেশে পরস্পর বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ বেড়েই উঠবে অভাবে দেশের মানুষের মনুষ্যত্ব থাকবে না।

জ্ঞান ও বিদ্যালোচনা চাকরির জন্য নয়। জ্ঞান মানুষের জীবনকে অসংখ্য প্রকারে সফল করবার সুযোগ ও সুবিধা করে দেয়। জ্ঞানকে দাসত্বের কাজে নিয়োগ করে জ্ঞানের মর্যাদা নষ্ট করো না। জীবনে ঘুমন্ত শক্তি, মস্তিষ্কের সহস্র লুকান ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলবার অমোঘ উপায় হচ্ছে জ্ঞান।

এ দেশে কি শিল্প চর্চা ছিল না? দেশের মানুষ কি কোনো কালে শিল্প প্রতিভার পরিচয় দেয় নাই? আল্লাহর সৃষ্টি এদেশে মানুষের সঙ্গে ইউরোপের মানুষের কি কোনো পার্থক্য আছে? যদি জাতি চাকরির নেশা ত্যাগ করে তার সমস্ত শক্তি বিবিধ পথে নিয়োগ না করে, তা হলে আবার বলি, জাতির দুঃখ বেড়েই যাবে। অভাব ও দুঃখের অন্ত থাকবে না। যে জাতি অভাব ও দুঃখ ভোগ করে, জগতে তাদের অস্তিত্ব থাকে না। পরিশ্রমকে অশ্রদ্ধা করো না। এম,এ, পাস করে তোমরা কখনো বাবুটি হয়ো না, এই হচ্ছে সর্বনাশের কথা। হাতের ক্ষমতোকে অবহেলা করো না। কুলির মতো সর্বত্র কাজ কর, কাজই জগতের প্রাণ। জগৎ বাবু হওয়ার, বসে বসে শুধুই চিন্তা করবার ক্ষেত্র নয়। জগৎ চায় কাজ। এই যে দেশে কৃষক, কামার, তাঁতী, জেলে, স্বর্ণকার, কাঠের মিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রী, মালী, চিত্রকর, শিল্পী, ভাস্কর–এরা কি অশ্রদ্ধার পাত্র? লেখাপড়া জানে না বলেই এরা মানুষের অশ্রদ্ধা ভোগ করছে। জাতির বাচবার যন্ত্রপাতি এদেরই হাতে। যেদিন এরা লেখাপড়া শিখবে, সেদিন জাতির পরিচালক হবে এরাই। এদের ইচ্ছায় জাতি উঠা-বসা করবে। যদি বাঁচতে চাও দেশের যুবক সম্প্রদায়কে বলি, লেখাপড়া শিখে সর্বপ্রকার হীনতাকে উপহাস করে তোমরা তোমাদের দুইখানি হাতকে নমস্কার করে নাও। তোমাদের ভিতর যে শক্তি আছে, সে শক্তিকে ভাড়া না দিয়ে স্বাধীনভাবে নিজের এবং জাতির মঙ্গলের পথে নিযুক্ত কর, সকল দেশের সকল জাতির মুক্তির পথই এই। প্রাচীন এবং বর্তমান সমস্ত উন্নত জাতির পানে তাকাও–দেখতে পাবে, তারা কখনও পরিশ্রমকে অশ্রদ্ধা করে নাই।

দীর্ঘদিনের পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং সহিষ্ণুতা ব্যতীত কোনো কাজে সফলতা লাভ হয়। মানুষ ইচ্ছা করে, তাই সম্ভব। চাই একাগ্রতা, বিশ্বাস এবং সাধনা। আন্তরিকতা ব্যতীত কোনো কাজেই সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয়। জগতে যে সমস্ত উত্তম উত্তম কাজ দেখতে পাচ্ছ, তা কঠিন পরিশ্রম, ত্যাগ এবং দুঃখের ফল। ইংরেজ জাতিকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় এরা বড্ড বাবু; আমরা এত খাঁটি, তার প্রতিদানে পাই এক মুষ্টি ছাতু, আর এরা ছায়ায় বসে এত সুখ ভোগ করে। এরা যে কত দুঃখ করেছে, উন্নতির সাধনায় এরা কত ত্যাগ স্বীকার করেছে, কত প্রাণ দিয়েছে, তার সীমা নাই। তোমরাও এইভাবে ত্যাগ স্বীকার কর, দুঃখ বরণ কর, হৃদয়ের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এবং নিজের ও জাতির কল্যাণ অর্জন করতে হবে।

কাজের ডাকে, কর্তব্যের ডাকে কাজ কর; শুধু অর্থলোভেই কাজে অগ্রসর হয়ো না। শুধু অর্থলোভে মানুষকে শ্রেষ্ঠ এবং পূর্ণ করে না। অর্থের মীমাংসা হলেই অর্থলোভীর সাধনায় জড়তা এবং শৈথিল্য আসে। শুধু অর্থ-লোভ জাতির শক্তিকে খর্ব করে দেয়। সমস্ত কর্ম-প্রেরণার অন্তরালে কর্তব্য বৃদ্ধি এবং জাতির প্রতি প্রেম মানুষকে শক্তিশালী এবং বিজয়ী করে। অর্থ যদি লাভ হয়, তবে তা কাজ করতে করতে ঘটনাক্রমে হয়ে উঠে।

সার জসুয়া রেনল্ডস্ বলেছেন, “যদি কোনো কাজে সফলতা চাও, তা হলে যখন ঘুম থেকে ওঠ, তখন থেকে নিদ্রা যাওয়া পর্যন্ত সেই কাজে সমস্ত চিন্তা, সমস্ত মন ঢেলে দাও।” বাস্তবিক ইহাই সফলতার পথ। কর্মী ও সাধকের কাছে সকাল নাই, দুপুর নাই, সন্ধ্যা নাই, কাজকে সর্বাঙ্গসুন্দর করবার জন্যে তিনি কাজের মধ্যে একেবারে ডুবে যাবেন। সাধনায় সিদ্ধি লাভের ইহা গুপ্ত রহস্য। অভাব, দারিদ্র অসুবিধা মানুষের সাধনার পথে কোনো কালেই বাধা হয় না।

বাধা অনেক সময় সাধকের জীবনকে দুঃখময় করে তোলে বলে দুঃখ করো না, যেহেতু জীবনের প্রতি চিরদিনই এমনি জটিল ও সমস্যাপূর্ণ। তোমাদের দুঃখ ও ত্যাগের ফলে যদি ভবিষ্যৎ মানব-সমাজ দুঃখ, কুসংস্কার, মূর্খতা ও অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পায়, সেই কথা চিন্তা করে মনে মনে আনন্দ কর। আজকাল এই দুঃখ নীরবে আঁখিজলে সয়ে যাও, আল্লাহর দয়ার কথা ভেবে কাজ করতে থাক। যদি সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয়, সেই দিন সমস্ত দুঃখের প্রতিদান পাবে। মানব-সমাজ তোমার কাছে একদিন কৃতজ্ঞ হবেই।

কোনো কাজ একবারে হয় নাই, আবার কর। আবার কর–যতবার না হয়, ততবারই কর। এর শেষে সিদ্ধি। প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিরা হয়তো কোনো কাজ হঠাই করে ফেলেন, কিন্তু পরিশ্রম, চিন্তা ও পর্যবেক্ষণ সফলতার পথ।

স্বর্ণকার, চিত্রকর, ভাস্কুর এবং ইঞ্জিনিয়ার সেলিনীর জীবন বড়ই চমৎকার। তাঁর পিতা ফ্লোরেন্সের রাজ দরবারে বেতনভুক্ত গায়ক ছিলেন। তার চাকরি গেলে পুত্রকে এক স্বর্ণকারের কাছে কাজ শিখতে পাঠান। অতি অল্পদিনের মধ্যেই বালক অনেক কাজ শিখে ফেলল। বাপের জিদে কিছুদিন তাকে এই সময় আন্তরিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাঁশি বাজানো শিখতে হয়েছিল। এর কিছুদিন পর সেলিনী পোপের অধীনে স্বর্ণকার গায়করূপে চাকরি পান। তার সোনা, রূপা এবং ব্রোঞ্জ ধাতুর কাজ অতি আশ্চর্য। কারো সাধ্য ছিল না, তেমন কাজ করতে পারে। কোনো সুন্দর কারিগরের সংবাদ পেলেই সেলিনী তার কাজ দেখতেন এবং যাবৎ না দক্ষতা গুণে তাকে অতিক্রম করতে পারতেন, তাবৎ তার শান্তি থাকত না, তাঁকে পরাস্ত করা চাই, তার পর অন্য কথা। তাঁর কর্মশক্তি ছিল অসাধারণ।

শিল্পী চাট্র শিল্প-সাধনায় কতদিন মগ্ন থেকে যশের আসন লাভ করেছিলেন, তা পড়লে বিস্মিত হতে হবে। খুব ছোট বেলাতেই তার বাপ মারা যান। মা দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করেন। এই অবস্থায় তাকে গাধার পিঠে শেফিল্ড শহরে দু’বেলা ঘরে ঘরে দুধ যোগান দিতে হতো। তারপর কিছু দিন এক মুদির দোকানে তাঁকে কাজ করতে হয়। একদিন রাস্তার পার্শ্বে তিনি কতকগুলি অতি সুন্দর খোদাই কাঠের কাজ দেখতে পান। এই কাজ শেখবার তাঁর আন্তরিক আগ্রহ হল। বলে-কয়ে কোনোরকমে মুদির কবল হতে রক্ষা পেয়ে সেই মিস্ত্রীর কারখানায় ভর্তি হলেন। সেখানে তিনি সাত বৎসর কাজ করেন। ঐকান্তিক আগ্রহ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, প্রাণঢালা সাধনায় তাঁর কাজের তুলনা নাই। সাত বৎসরে তিনি একজন সুদক্ষ কারিগর হলেন। তাঁর অবসর সময় বিনা কাজে ব্যয় হত না। কাজের পূর্ণতা এবং চারুতার জন্যে কখনও চিত্র আঁকছেন, কখনও মাপজোক নিচ্ছেন–সঙ্গে সঙ্গে আত্মোন্তির জন্যে বইপুস্তক পড়াও কামাই নাই। এর কিছুকাল পরে আরও উন্নত জ্ঞান-লাভের জন্যে তিনি লণ্ডনে রয়েল একাডেমীতে ভর্তি হন। জীবন্ত মানুষের মূর্তি নির্মাণ, চিত্রবিদ্যা প্রভৃতি কার্যে তিনি অতিশয় খ্যাতি অর্জন করেন। সহিষ্ণুতা, সাধনা, অধ্যবসায় এবং কঠিন পরিশ্রম আর তার সঙ্গে তাঁর প্রতিভা তাকে বড় করেছিল। তিনি অতিশয় দানশীল ছিলেন, কিন্তু সে কথা কেউ জানত না।

যে কোনো কাজই কর–বাইরের উপদেশে বিশেষ কিছু লাভ হয় না। মানুষ মানুষকে কিছু শিখাতে পারে না। মানুষ মানুষকে একটু দেখায় মাত্র, নিজের ওস্তাদ নিজেকেই হতে হবে। পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে জগতের কোনো কাজেই কৃতিত্ব লাভ করা যায়। সাধনায় প্রাণ বিশ্বাস এবং আত্মনির্ভরতা কোথা থেকে বুদ্ধি যোগায়, পথ পরিষ্কার হয়ে আসে, তা ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। আল্লাহ মানুষকে এমনি পূর্ণ করে গঠন করেছেন যে, তার পরের কাছে হাত পাতবার আবশ্যকতা খুব অল্পই আছে।

শিল্পকে জীবনে অনেক সময় অপরিসীম দুঃখ ভোগ করতে হয়েছে তা, ভেবে সাধক তার কাজ ত্যাগ করেন নাই। কত কর্মী মানুষের অশ্রদ্ধা এবং অবহেলায় প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছেন–তাঁদের সমাপ্ত সাধনায় নতুন নতুন সাধক পূর্ণতা এনে দিয়েছেন।

স্টকিং মেশিন–নির্মাতা রেভারেণ্ড উইলিয়াম লী এক নারীকে ভালোবাসতেন। লী ধর্মপ্রচারক ছিলেন। তিনি প্রায়ই প্রেম-প্রার্থী হয়ে তার প্রিয়তমার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। কিন্তু সেই নারী তাকে ভালোবাসত না, হাতে স্টকিং তৈরি করত, আর তার সহকর্মী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলত। লী প্রিয়তমার এই ব্যবহারে অতিশয় মনঃক্ষুণ্ণ হন। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন এমন এক যন্ত্র তৈরি করতে হবে যাতে আর কেউ হাতে স্টকিং তৈরি করতে না পারে। প্রিয়তমাকে শাস্তি দেবার মানসে তিনি চিন্তা আরম্ভ করলেন। একটা অতি লাভজনক ব্যবসায় এই প্রেমের দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়। লী প্রচারকার্য ত্যাগ করে যন্ত্রের সফলতার দিকে মন দিলেন। ঐকান্তিক সাধনার ফলে তিনি কয়েক বছরেই এই আশ্চর্য কৌশলময় যন্ত্রটি তৈরি করতে সক্ষম হলেন। তার উদ্ভাবিত যন্ত্রটি নিয়ে তিনি প্রদর্শনের জন্য রানী এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা করলেন। দরিদ্রের অন্ন মারা যাবে, এই কথা বলে রানী তাকে অশ্রদ্ধা করলেন। লী অতঃপর দুঃখে সে স্থান ত্যাগ করলেন। এই সময় ফ্রান্সের চতুর্থ হেনরী তাকে নিমন্ত্রণ করেন। তিনি কয়েকজন সহযোগী নিয়ে যন্ত্রপাতিসহ রুয়েন শহরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। রুয়েন একটা প্রধান হস্তশিল্পের কেন্দ্র। সেখানে তিনি বিশেষ সমাদর লাভ করলেন। এখানে তার কাজের আদর হতে লাগল। দুর্ভাগ্যবশত এই সময়। একদল ধর্মান্ধ গোঁড়া সম্প্রদায় সম্রাটকে হত্যা করে। ফলে লীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। তিনি রুয়েন ছেড়ে প্যারিস শহরে গেলেন। সেখানে সবাই তাকে ধর্মহীন এবং বিদেশী বলে অবজ্ঞা করলেন। একটি বিশেষ লাভজনক যন্ত্রশিল্পের উদ্ভাবক অতঃপর বিদেশে মনের কষ্টে, অবহেলায়, রোগে, দুঃখে প্রাণত্যাগ করেন। অতঃপর তার ভাই কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে স্বদেশে পালিয়ে আসেন। এই সময় আল বলে আর একজন সুদক্ষ শিল্পী তার সঙ্গে যোগ দিয়ে যন্ত্রটিকে সর্বাঙ্গ সুন্দর এবং সফল করে তুললেন। ক্রমে দেশের সর্বত্র স্টকিং মেশিনের সমাদর হল।

মানুষের কাজ এইভাবেই সমাদর লাভ করে। মানুষ প্রথম প্রথম কোনো কথা, কোনো সাধনার দিকে ফিরে তাকায় না। মানুষের এ স্বভাব, তা বলে ভাবনা করলে চলবে না।

জগতে এখনও অনেক কিছু নতুন করে তৈরি করবার আছে। জগতের যা কিছু প্রয়োজন তা মানুষের ত্যাগের ফলে তৈরি হয়ে থাকে–তারপর কাজে নেমে পড়লেই হয়। জাতির ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করবার জন্যে, পল্লীর দুঃখ দূর করবার জন্য এখন দেশের মানুষের অগ্রসর হওয়া মাত্র বাকি। হাত-পা গুটিয়ে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা না করে হাত-পা খাঁটিয়ে শক্তি ও মনুষ্যত্বের সদ্ব্যবহার করে নিজের এবং জাতির মঙ্গল চেষ্টা করাই উত্তম। জাতির না হোক, সমাজের না হোক, দেশের ছেলেরা যদি আপন আপন মা-বোনের সেবা করতে পারে, সাধু জীবন-যাপন করে প্রতিবেশীদের স্বার্থে আঘাত না করে, তা হলেই যথেষ্ট।

আর্থার হ্যাঁলাস বলেছেন–”ইংরেজ জাতির ভিতর থেকে শ্রমিক, শিল্পী, মিস্ত্রী ফেলে দাও, সমস্ত জাতিটা অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়বে। সমস্ত জাতির দেহটা তাদের ঘরের মতো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে পড়বে। তাই বলছি কয়েকজন রাজ কর্মচারী এবং দেশের ভদ্রলোক এরাই জাতির শক্তি এবং প্রাণ, এ কথা পাগল ছাড়া আর কেউ মনে করে না। কোনো মানুষের কৃতিত্ব বিশেষত্ব এবং গুণ চাপা থাকবে না–সে ছুতোরই হোক, আর রাজমিস্ত্রী, গায়ক, কামার স্বর্ণকার, শিল্পী যাই হো–মানুষের অন্তনিহিত ক্ষমতো তার কাজের ভিতর দিয়ে তাকে শ্রেষ্ঠত্ব এবং সম্মান দান করবেই।

জর্জ কেম্প একজন সামান্য লোক ছিলেন। তাঁর পিতার সম্পত্তি ছিল কতকগুলি গরু ও ছাগল। প্রথম জীবনে তিনি সামান্য একজন মিস্ত্রীর কাছে শিক্ষানবীশি করেন। স্থাপত্য শিল্পে তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল। ভালো উল্লেখযোগ্য নতুন, পুরাতন সুদৃশ্য অট্টালিকা দেখলেই তিনি তার চিত্র গ্রহণ করতেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ইউরোপ পরিভ্রমণ করতে মনস্থ করেন। তিনি পায়ে হেঁটে ইউরোপের বৃহৎ বৃহৎ প্রাচীন অট্টালিকা, দুর্গ এবং গীর্জা পরিদর্শন করেন এবং সেগুলির নক্সা হাতে গ্রহণ করেন। এডিনবরা শহরে স্কট মনুমেন্টের নক্সা প্রস্তুত করবার প্রতিযোগিতায় তিনিই প্রথম স্থান অধিকার করেন। তাঁরই নক্সা অনুযায়ী এডিনবরায় এই বিখ্যাত সাহিত্যিক স্মৃতিমন্দির নির্মিত হয়।

অসংখ্য প্রকারে মানুষ নিজ নিজ জীবনকে উল্লেখযোগ্য করে তুলতে পারে। যে দেশের মানুষ এ বুঝে না, সে দেশের লোক দাস ও গোলামের জাতি ছাড়া আর কী? চাকরিকেই সম্মানের মাপকাঠি মনে করা যার পর নাই ভুল। জাতিকে সমৃদ্ধশালী করে তোলবার পথ এ নয়। জাতির শক্তির পশ্চাতে অনন্ত বিচিত্র জীবন ধারা দেশের শিরায় শিরায় খেলে যাচ্ছে। মিশর, পারস্য, ব্ৰহ্মদেশ, এশিয়া মাইনর প্রভৃতি ছোট ছোট দেশেও ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা অর্থাগমের বিবিধ পন্থা আছে। আমাদের দেশেও থাকা চাই। একজন আর একজনের নাড়ী ছিঁড়ে খেলে কয়েকজন লোক ছাড়া বাকি সকল লোকই মারা যাবে। মিথ্যা ও মূর্খতার বিরুদ্ধে যুবক সমাজকেই বিদ্রোহী হতে হবে। অত্যাচারী মরুব্বীর দল যে চাকরিকেই সম্মানের জীবন মনে করে নিষ্ঠুর হস্তে সে মানসিকতাকে ভেঙ্গে না দিলে আর উপায় নাই। পরের গলগ্রহ হয়ে অসাধু পথে দাসত্বের লৌহচাপে, অভাবের অভিশাপে মানুষের জীবনীশক্তি এবং মনুষ্যত্ব দুই-ই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে। শ্রমকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ কর। কালি-ধুলার মাঝে, রৌদ্র-বৃষ্টিতে কাজে নেমে যাও। বাবু হয়ে ছায়ায় পাখার তলে থাকবার কোনো দরকার নাই। এ হচ্ছে মৃত্যুর আয়োজন। কাজের ভিতর কু-বুদ্ধি, কু-মতলব মানবচিত্তে বাসা বাঁধতে পারে না। কাজের শরীরের সামর্থ্য জন্মে, স্বাস্থ্য, শক্তি, আনন্দ, কূর্তি সবই লাভ হয়। মদ খেয়ে আনন্দ করবার কোনো প্রয়োজন হয় না। পরিশ্রমের পর যে অবকাশ লাভ হয়, তা পরম আনন্দের অবকাশ। শুধু চিন্তার দ্বারা জগতের হিত সাধন হয় নাই। মানব জাতির সমস্ত কল্যাণ বাহুর শক্তিতেই সাধন হয়েছে। মানুষের বাহু অত্যাচারিত মনুষ্য, পীড়িত-লাঞ্ছিত মনুষ্যকে উদ্ধার করছে, জগতের জালিমকে বিনষ্ট করেছে; রাক্ষসের মুখ থেকে নির্দোষ দুর্বল মানুষকে বাঁচাচ্ছে। কাপুরুষ ছাড়া মানুষের বাহুকে অন্য কেউ অশ্রদ্ধা করে না।

শুধু চিন্তা করে মানুষ পূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হয়। মানব-সমাজে, মনুষ্যের সঙ্গে কাজে, রাস্তায়, কারখানায়, মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে মানুষ নিজেকে পূর্ণ করে। চিন্তা এবং পুস্তক মানবচিত্তের পাপড়ি খুলে দেয় মাত্র, বাকি কাজ সাধিত হয় সংসারের কর্মক্ষেত্রে।

কয়েক বৎসর আগে ব্রিটেন এবং রাশিয়া পারস্যকে দুই লক্ষ পাউন্ড ধার দেয়, একটা এঙ্গলোফ্রেন্স কোম্পানিও পারস্যকে ৬০ লক্ষ পাউণ্ড কর্জ দেন। প্রফেসার জ্যাকসন। বলেছিলেন, “বিদেশীর এই সমবেদনার সঙ্গে সঙ্গে পারস্যকে কুসুমের সুবাস এবং বুলবুলের সঙ্গীত ত্যাগ করে কাস্তে-কোদাল নিয়ে শস্য-ক্ষেত্রে নামতে হবে।” যে জাত শ্রমকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে না, সে জাত জগতে বড় আসন পায় না।

.

০৯. বিবেকের বাণী

যার মাঝে বিবেকের বর্তিকা নাই, যে অন্তরস্থ প্রজ্ঞা দেবতার কথা শুনতে পায় নাই, তার ভরা শুকনোয় তল হবে। তার জীবন-জাহাজ শুকনা গাঙে ডুবে যাবে; মনুষ্য অন্তরে বিবেক আল্লাহর বাক্যরূপে মনুষ্যকে সর্বদাই চালিত করে সাবধান করে। যে সে-কথা শোনে, সেই জয়লাভ করে। যে তা শোনে না, যে তা গ্রাহ্য করে না, বিবেকের কথা তার কাছে চিরদিনের জন্য মৌন হয়ে যায়। সে দিন দিন অধঃপতিত হতে থাকে।

আমি যখন হুগলিতে পরীক্ষা দেই, তখন অতিশয় সাধু ধার্মিক বলে সমাজে পরিচিত একজন মৌলবী সাহেব চুপে চুপে আমাকে কতকগুলি প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়ে গেলেন।

আর একজন মৌলবী সাহেবকে জানি, তিনি পরীক্ষা-মন্দিরে ছেলেদের চুরি করে লিখবার সুবিধা দিতেন। যখন ধর-পাকড় আরম্ভ হতো, তখন তিনি তাদের কাছ থেকে গোপনে টেবিলের উপর বইগুলি এনে রেখে দিতেন।

বলতে কী, এদের এই কাজের পেছনে কিছু যুক্তি আছেই। বিপন্নকে সাহায্য করলে খোদা সন্তুষ্ট হন, হয়তো এই কথা ভেবেই এরা ছেলেদের এই গোপন অসাধু কার্যে উৎসাহ দিতেন। এ যে কত বড় অন্যায়, ছেলেদের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতি কত বড় নিষ্ঠুর আঘাত, তা তারা চিন্তা করতেন না, চিন্তা করাও দরকার মনে করতেন না। বস্তুত ধর্মের অনুশাসন অন্ধভাবে মেনে চললে পদে পদেই পতন এবং বিপদের সম্ভাবনা; বিবেক যার সঙ্গে কথা বলে না, বিবেক যাকে চালিত করে না, জীবনের বহু বৎসরের ধার্মিকতা তার কাছে। নিরর্থক।

অন্ধকারে যেমন আলো মানুষের কাছে বিবেকও তদ্রূপ বর্তিকার মতো সর্বদা পথ দেখায়। বিবেকই মনুষ্যকে ধার্মিকতা শিক্ষা দেয়। যদি বিবেকের অনুশাসন অনুভব করতে পারে, কোনো ধর্মগ্রন্থ, কোনো বাইরের উপদেশ তাকে পথ দেখাতে পারে না। বিবেক মানব-জীবনের পরম বন্ধু, ইহা বন্ধুর ন্যায় জননীর ন্যায়, পিতার ন্যায় মনুষ্যকে পথ দেখায়; সান্ত্বনা দেয়। বিবেক কোনো সময় মনুষ্যকে প্রতারণা করে, কিন্তু সেজন্য দুঃখিত হবার কোনো কারণ নেই। আজ তোমাকে সে যদি ভুল পথ দেখায়, দশ বৎসর পর তোমাকে গন্তব্যস্থানে সে পৌঁছে দেবেই; অপরিপক্ক মানুষ, জ্ঞানবুদ্ধি পূর্ণভাবে বিকশিত হয় নাই তার বিবেক এবং প্রজ্ঞাবান মানুষের বিবেকের মধ্যে অনেক পার্থক্য হতে পারে; তাতে দোষ নাই। মানুষ যদি আপন অন্তরস্থ বিবেকের বাণী পালন করতে যেয়ে মহা অন্যায় করে, তজ্জন্য তাকে অপরাধী করা চলে না। স্বামীর অনুগত হওয়াই নারীর ধর্ম, তার কাজের কোনো জবাবদিহি নাই। তেমনি প্রত্যেকে আপন আপন বিবেক অনুযায়ী চল, ফলাফলের জন্য তুমি দায়ী নও। বিবেকের অনুগত থাকাই তোমার কাজ।

বিবেক আল্লাহর আসন, এই আসনের সম্মুখে মানুষ আজ্ঞাবহ ভৃত্য। জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক সমস্ত বিষয়ের অভিজ্ঞতা আমরা বিবেকের সাহায্যে লাভ করি। মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি আমাদের কী কর্তব্য, মানব-জীবনের গুরুত্ব এবং দায়িত্ব, পাপের জঘন্য রূপ, ধার্মিকতার বিমল চিত্র আমরা বিবেকের সাহায্যে আপন আপন আত্মায় অনুভব করি।

বিবেকবান মনুষ্য সর্বদাই ভীত। সব সময় তিনি চিন্তা করেন–তার দ্বারা কোনো অন্যায় হয়েছে কিনা? মানুষ তাকে নিরাপরাধ বলে মুক্তি দিলেও তিনি বিবেকের বিচারে নিজকে মুক্তি দেন না। তিনি আপনার শাস্তি আপনি গ্রহণ করেন। ইহা মানব-হৃদয়ে অমর অক্ষয় চির-সুন্দর, চির-সমুজ্জ্বল চেতনাময় প্রদীপ।

বিবেকের সাহায্যে মানুষ জেনেছে, তার জীবনের এক মহাসার্থকতা আছে। চিন্তাহীন বিবেকবর্জিত জীবন তার কাছে অসহ্য। পশুর বিবেক নাই। ভালো-মন্দ জ্ঞান নাই। মানুষ ভালো-মন্দ বোঝে, বিবেক তাকে সর্বদা সতর্ক করে, ভীত করে, জীবন্ত দেবতা হয়ে তাকে এস্ত, কর্তব্যপরায়ণ, লমিতো ও সজাগ করে। বিবেকের সম্মুখে সে অস্থির হয়, বিশ্বকে উপেক্ষা করে সে আত্মার দেবতার সম্মুখে করজোড়ে দাঁড়ায়।

সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য মানুষের অন্তরস্থ এই বিবেক দেবতাকে জানিয়ে দেওয়া, তেজস্বী, নির্ভীক, পুষ্ট এবং সবল করে তোলা। যদি সে জ্ঞান, মানুষের উপদেশ, পুস্তক এবং সাহিত্য মানুষের অন্তরকে না জাগাতে পারে–তবে বুঝতে হবে তার পাষাণ প্রাণে সমস্ত জ্ঞান ব্যর্থ হয়েছে, মরুভূমিতে বৃক্ষ রোপণের মতো সমস্ত প্রচেষ্টা নিরর্থক হয়েছে বিবেকের জাগরণের নামই আত্মবোধ। বিবেক অপেক্ষা আরও একটি মহা জিনিস আছে, তার নাম প্রজ্ঞা। বিবেক মনুষ্যকে প্রতারণা করে না। প্রজ্ঞা দিবালোকের মতো উজ্জ্বল, তার দৃষ্টির সম্মুখে কোনো কুয়াশা নাই। সন্দেহ নাই–প্রজ্ঞা ধ্রুব সত্যকে দর্শন করে। যিনি এই প্রজ্ঞার সন্ধান পেয়েছেন, তিনি পরম চেতনা লাভ করেছেন, তিনি মনুষ্যের নমস্য। অতি অল্প লোকই এই প্রজ্ঞার সন্ধান পায়।

.

১০. মিথ্যাচার

যে জাতির লক্ষ্য ‘সত্য নহে, সে জাতির কোনো সাধনাই সফল হবে না। সত্যবর্জিত জাতির জীবন অন্ধকার। জাতির উন্নতির জন্য তারা বৃথাই শরীরের রক্ত ক্ষয় করে।

সত্যই শক্তি। ইহা সকল কল্যাণের মূল। ইহাতে মানুষের সর্বপ্রকার দুঃখের মীমাংসা হয়। সত্যকে ত্যাগ করে কোনো জাতি বড় হয় নাই, হবে না। মানব-জীবনের লক্ষ্যই সত্য। ইহাই শান্তি ও ঐক্যের পথ। সত্যের অভাব–বিরোধী ও দুঃখ সৃষ্টি করে। মানুষে মানুষে, বন্ধুতে বন্ধুতে, আত্মীয়ে আত্মীয়ে, পরস্পরে মনান্তর উপস্থিত হয়। সত্য বর্জন করে তোমরা কোনো কাজ করতে যেও না–এর ফল পরাজয়।

জনৈক কোম্পানির ডিরেক্টরকে জানি, তিনি মনুষ্যত্ব ও দেশসেবার নামে, মানুষের সঙ্গে কেবলই মিথ্যা ব্যবহার করতেন। মনুষ্যত্বের নামে দেশ-সেবককে সর্বপ্রকার মিথ্যা পরিহার করেই চলতে হবে। যদি মিথ্যাকে পরিহার করে না চলতে পার, তবে দেশসেবকের আসন ত্যাগ করে বরং পল্লীর একজন অজ্ঞাত মানুষ হও। ছোট জীবনের ক্ষুদ্র কর্তব্যগুলি পালন কর। মিথ্যার সাহায্যে যদি কোনো বড় কাজ করতে অগ্রসর হয়ে থাক, বুঝতে হবে তুমি সে কাজের যোগ্য নও। সবিনয়ে সরে যাও। ( গ্রন্থকার এক সময় তার উন্নত জীবন’ বইখানি নিয়ে কোনো এক সম্পাদকের কাছে গিয়ে সমালোচনা বের করতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি স্বীকার করলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনোদিন সে পুস্তকের সমালোচনা বের হয় নাই। আর এক প্রবীণ সম্পাদকের কাছে তিনি দু’মাস ঘুরেছিলেন, প্রত্যেক বারই তিনি বলতেন, এইবার সমালোচনা বের হবে–তার সে কথা মিথ্যা।

এই সমস্ত কথা লেখবার উদ্দেশ্য দেশের ছোট বড় (?) কারো সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা নেই। তাঁদের প্রাণ দেশ প্রেমে এত পরিপূর্ণ (?) যে জীবনের ছোট ছোট কাজে তারা সত্য লক্ষ্য করতে পারেন না। অনেক সময় সাধারণ মনুষ্যের স্তর থেকে তারা এত ঊর্ধ্বে (?) উঠে যান যে, জীবনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কর্তব্যের কথা তাঁদের মনেই থাকে না। সত্য বলছি আদর্শ জীবনের ভাব ইহা নয়। জগৎ এই শ্রেণীর লোককে অশ্রদ্ধায় আসন ছেড়ে উঠে যেতে বলবেই।

জনৈক ইসলামের সেবক তিন বৎসর ধরে প্রতি সপ্তাহে লিখতেন, আগামী বারে আপনার কাজ হবে, কোনো দিন কাজ হয় নাই। এরূপ অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। কিন্তু তা দিয়ে কী হবে? যদি জীবনকে সার্থক করে তোলবার ইচ্ছা হয়, মানুষের সাধুবাদ ও প্রশংসা অপেক্ষা যদি নিজের বিবেক ও মনকে তৃপ্ত করবার বাসনা থাকে যদি সত্যই মানব-সমাজের কল্যাণ করতে চাও, যদি যথার্থ মানুষ হয়ে জগতের সামনে আসন নিতে চাও, তবে সত্যকে শ্রদ্ধা করতে শেখ। ইহাই ব্যক্তি এবং জাতির সিদ্ধি ও সফলতার পথ, ইহা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নাই। শ্রীরামকে ১৪ বৎসরের জন্য বনে পাঠিয়ে ঋষি বাল্মিকী জানাতে চেয়েছেন কথার মূল্য কী? সত্য রক্ষার জন্য রামকে সিংহাসন ত্যাগ করে কী কঠিন দুঃখই না বরণ করতে হয়েছিল; বস্তুত সত্য পালনের জন্য এইভাবে কঠিন দুঃসহ দুঃখই বরণ করতে হবে। কথায় কথায় মিথ্যাচারণ, বাক্যের মূল্যকে অশ্রদ্ধা করা, এসব সত্যনিষ্ঠ জাতির লক্ষণ নয়। স্বাধীনতা পাবার জন্যে সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধহীন জাতি যতই চেষ্টা করুক, তাদের স্বাধীনতার মন্দির দ্বার থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হবে। যে জাতির অধিকাংশ ব্যক্তি মিথ্যাচারী, সেখানে দু-একজন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিকে জীবনে বহু বিড়ম্বনা সহ্য করতে হবে, কিন্তু মানব কল্যাণের জন্য, সত্যের জন্য সে বিড়ম্বনা ও নিগ্রহ সহ্য করতেই হবে।

ক্রয়-বিক্রয়ে, পারিবারিক কার্যে, অফিস-আদালতে, কাজ-কারবারে, পরস্পর বাক্যালাপে, রেল স্টীমারে সর্বত্রই জাতির মুক্তির জন্য যতই চিৎকার করি না কেন, জাতি যতক্ষণ না জাতির সর্ব প্রকার গ্লানি-মুক্ত হতে চেষ্টা করে, তাবৎ তার কল্যাণের কোনো আশা নাই। জাতির ও দেশের বড়াই যতই করি জগৎ সে বড়াই-এর দিকে ফিরে তাকাবে না।

সত্য মনুষ্যত্ব, মহানুভবতা ও ত্যাগই জাতীয় শক্তির মূল উপাদান। কার্থেজ যুদ্ধের বন্দি রেগুলাস (Regulas) তার বাক্যের মর্যাদা রক্ষা না করলেও পারতেন। তিনি সন্ধির জন্য কার্থেজ হতে রোমে এসে সিনেটরকে (Senator) বললেন, কার্থেজবাসীদের সঙ্গে কখনও নত হয়ে সন্ধি করো না। রোম সন্ধি না করলে তিনি আবার কার্থেজে ফিরে যাবেন, এই প্রতিজ্ঞা করে এসেছিলেন। তিনি যখন প্রত্যাবর্তন করতে প্রস্তুত হলেন, তখন। সিনেটরেরা বললেন–শত্রুর কাছে প্রতিজ্ঞার কোনো মূল্য নাই। রেগুলাস (Regulas) বললেন, তোমরা আমার আত্মাকে অপমান করতে চাও? কার্থেজে ফিরে গেলে আমার দণ্ড হবে, কিন্তু কোনোমতে আমি নীচ হতে পারব না। যে জাতির মধ্যে এই ধরনের মানুষ জন্মে, তারাই প্রাতঃস্মরণীয় জাতি। অট্টালিকা বিলাস-বাসনাশক্তি সভ্যতার নিদর্শন নয়। ত্যাগ, দুঃখবরণ এবং সত্যনিষ্ঠাই জাতির মুক্তির পথ প্রস্তুত করে। ধাপ্পাবাজিতে জগৎ টিকে নাই। ফাঁকি দিয়ে জয়লাভ সম্ভবপর নয়।

জাতির বড় কাজে বরং মিথ্যাকে সমর্থন করা যায়, কিন্তু জীবনের ছোট ছোট কাজে মিথ্যাচারণ কখনও সমর্থনযোগ্য নহে। জলো দুধ বিক্রয় করা, ভেজাল দ্রব্য বিক্রয় করা, মিথ্যা বিজ্ঞাপনে লোক ভুলিয়ে পয়সা উপায় করা, ঘৃতের নামে চর্বি বিক্রয় করা, স্টেশনে জন-সাধারণের কাছ থেকে কৌশলে টাকাটা-সিকিটা আদায় করা, জমিদারি সেরেস্তায় ৫ টাকা বেতনে চাকরি করে কৌশলে মাসিক ১০০ টাকা উপায় করা, ৫০ টাকা বেতনের কেরানি হয়ে মাসিক ২০০ টাকা উপায় করা, এ সব কাজ জীবনের লজ্জা এবং হীনতার সূচনা করে। ধার্মিকতা শুধু মুখের কথা নয়, জীবনের কাজ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *