জীবনের পরে

জীবনের পরে

দয়াল যখন ট্রেন থেকে নামল, থ্যাবড়াপানা চাঁদটা উঠে গিয়েছে আকাশের মাঝ বরাবর। এই টাইমে চাঁদের আলো হয় ম্যাড়ম্যাড়ে, খেটা। দেখলে বিরক্তি লাগে। আজ বেশি বিরক্ত লাগল। মনে হল, দিই শালার গলা টিপে। চাঁদের আলোর গলা টেপা যায় না। বিরক্ত হলেও যায় না।

দয়াল আকাশ থেকে মুখ নামাল মাটিতে। ট্রেন আর প্ল্যাটফর্মের ফাঁক বরাবর টিপ করে থুতু ছুঁড়ল। অনেকটা থুতু। সেই ট্রেনে ওঠবার আগে থেকে জমছে। মুখ একেবারে নোনতা কাঠ। একসময় মনে হচ্ছিল, এক মুখ রক্ত নিয়ে বসে আছে। গা ঘিনঘিন করছিল। পথ তো কম নয়, হাওড়া থেকে কমবেশি সোয়া তিন ঘণ্টা। লাইন ক্লিয়ার না থাকলে আরও লাগে। অতটা সময় ধরে মুখে থুতু জমলে গা ঘিনঘিন তো করবেই। এখন ফেলতে পেরে হালকা লাগছে। জল দিয়ে কুলি করতে হবে। কোনদিকে টিউকলটা রয়েছে যেন? গেটের দিকে? নাকি টিকিট ঘরের পাশে? মনে পড়ছে না। কতদিন পর এল? কতদিন? পাঁচ বছর? সাত বছর? নাকি তারও বেশি? দিনক্ষণ মনে নেই, তবে বেশিই হবে। মনে আছে, সে বছর নদী ভাসল।

চাদরটা ভালো করে গায়ে পেঁচিয়ে নিল দয়াল। তারপরেও ঝুলে রয়েছে একপাশে। থাকারই কথা। এই ফ্যাকাশে সবুজ চাদর তো গায়ে দেওয়ার নয়, বিছানার। তাও আবার নিজের বিছানার নয়, হাসপাতাল থেকে চুরি করা চাদর। চুরিও ঠিক নয়, তুলে আনা। হাসপাতালের সবকিছুতে মানুষ মরা গন্ধ। লোহার খাট, চাদর, বালিশ সবেতে। এই চাদরে গন্ধ নেই এটাই যা নিশ্চিন্তি। দয়াল সব গন্ধ সহ্য করতে পারে মানুষ মরা গন্ধ সহ্য করতে পারে না। গা গুলোয়। সেই ছোটবেলা থেকে এই সমস্যা। বাবা মারা যাওয়ার পর শশ্মানে গিয়ে বমি করে ভাসিয়েছিল। বড় পিসেমশাই গম্ভীর হয়ে গেলেন।

‘এ কেমন কথা! এই লক্ষণ তো ভালো নয় বাপু। বাপ-মায়ে মরলে সন্তানে কাঁদে। চোখের শুদ্ধ জলে আত্মাকে বিদায় জানায়। এই ছেলে বমি করে কেন? কেন করে? এ তো ভয়ংকর! পিতার আত্মাকে অপমান অপমানিত আত্মা কি আর চলে যেতে পারবে? পারবে না। অমঙ্গলের জন্য ঘুরে বেড়াবে চারপাশ। সুযোগ পেলেই দেবে ছোবল। এ তুই কী অঘটন ডেকে আনলি বাছা!’

সেই সময় এই কথার মানে কিছু বোঝেনি দয়াল। আজ মনে হচ্ছে, তবে কি সেই ছোবল এখন হল? এতদিন পর?

দয়ালের রক্ত-থুতু মাড়িয়ে লাস্ট ট্রেন চলে গেল হুসহাস আওয়াজ করে। শিরশিরে বাতাস বইছে। উত্তর থেকে বাতাস এলে যেমন হয়। ফাঁকফোকোর দিয়ে গায়েও ফুটছে যেন। ঠান্ডা লাগছে দয়ালের। আজ কার্তিক মাসের পাঁচ না ছয় তারিখ? নাকি আরও দু-একদিন কম? এত তাড়াতাড়ি কি উত্তর থেকে বাতাস বয়? দয়াল মনে করবার চেষ্টা করল। মনে পড়ছে না। আজ দুপরের পর থেকে মনের ভিতরটা ঢকঢক করে। জানলা দরজার কবজা, নাট বল্টু ঢিলে হলে যেমন হয়। মনেরও কি এসব থাকে? কবজা, নাট বল্টু? দয়াল মনে মনেই খুনখুনিয়ে হাসে। শালা ভিখিরি, শালা চোর, তুই হারামজাদা বড় চিন্তা করিস কোন মুখে! মনের দরজা, জানলা? মনের কবজা, নাট বল্টু? শালা, লাথি খেলে বড় হাই চিন্তা পিছনে ঢুকিয়ে দিতে।

ট্রেনহীন প্ল্যাটফর্ম সবসময়ই শুনশান। বুকের ভিতর হু হু করে। খালি মনে হয়, কে যেন চলে গিয়েছে…কে যেন চলে গিয়েছে। কিন্তু কে চলে গিয়েছে সেটা আর মনে পড়ে না। এত রাতে প্ল্যাটফর্ম আরও শুনশান। দয়াল ভাবল, ভালোই হয়েছে। কেউ না থাকাই ভালো। সুযোগ যদিও কম, তারপরেও যদি চিনে ফেলে সে এক চিত্তির হত। হাজার ভ্যানভ্যানানি। হাজার প্রশ্ন।

‘কে? দয়াল না? আরে দয়ালই তো। আমাদের গুপ্তিপাড়ার দয়াল। এসো এসো আলোর তলায় এসো, মুকটা দেকি একবার। ভালো করে দেকি। আরে এতদিন ছিলে কই! গাঁয়ে তো আসোই না মোটে। কলকাতায় ঠাঁই গেড়েছ নাকি? কাজকাম কর কিছু? চাকরিবাকরি পেয়েছ? নাকি ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াও? চেহারা দেখে তো মনে হয় না খাওয়াদাওয়া জোটে। গাল তো সিঁটিয়ে গেছে হে, কণ্ঠার হাড়ও দেকচি উঁচু। চাদরটা সরাও দিকিনি, পাঁজরের হাড়গুলো গুনে ফেলি। আরে বাপু গাঁ ছেড়ে শহরে ছুটলেই কি আর ভালো থাকা যায়? আমারও সুযোগ কম আসেনি। আমি যাইনি। শহরের ময়লা গায়ে লাগবেই লাগবে। যাক, এসেই যখন পড়েছ একটা কতা বলি দয়াল, ওই মেয়েছেলে একদিন তোমার ভাঙা ঘরে এসেছিল। তালা ভেঙে বাক্স পেটরা যেটুকু যা ছিল, নিয়ে গেল। রং ঢং মোটে ভাল না। কিছু মনে করও না বাপু, গাঁয়ের একটা মানসম্মান আছে। সবাই বল্লে পুন্নিমে নাকি আর তোমার বউ নেই। কার জানি বাঁধা মেয়েছেলে হয়েছে। সে হোক। বাঁধা হোক, ছাড়া হোক। কত কতাই তো শুনি, সবে কি কান দিলে চলে? তোমাকে বলতে চাইনে, তুমি এসেছ পড়েছ তাই বললুম…।’

দয়াল দম ফেলল। ভাগ্যিস এসব বলার কেউ নেই। ফের মুখটা নোনতা লাগে। আবার কি থুতু আসে? টিউবয়েলের কাছে গিয়ে এক হাতে হ্যান্ডেল টেনে আঁজলা ভরে জল নিল দয়াল। মুখে ফেলে কুলি করল। প্রাণ ভরে জল খেল অনেকটা সময় ধরে। আহা! বড় শান্তি…বড় শান্তি। শেষ কখন জল খেয়েছিল? মনে পড়ে না। সকালে? বিকেলে? নাকি আরও পরে? কাল? পরশু? নাকি তারও আগে? অনেক আগে? অন্য কোনও জন্মে? মনে পড়ে না। মন যে ঢকঢক করে।

এবার আর বকুনি নয়, মনে মনেই নিজের গালে থাবড়া লাগাল দয়াল। ফের বকবকানি? শালা, গাঁয়ে এসেছিস ভাঙা ঘর দেখতে, দেখে চলে যা। লাস্ট ট্রেনে এসেছিস, ফার্স্ট ট্রেনে ফিরে যাবি। এতো কতা কীসের? শালা ভিখিরি। শহরে তো থাকিস এর বারান্দায়, তার গ্যারাজে, নইলে বন্ধ দোকানের ঝাঁপের তলায়। ফাইফরমাস খেটেখুটে যেকটা পয়সা জোটে তাতে দুবেলা পেট ভরে না। পার্কের গ্রিল, নতুন বাড়ির সিমেন্ট—বালি, ল্যাম্পপোস্টের বাল্ব চুরি আর বড়বাজারের আলু পিঁয়াজ সরিয়ে বাকিটা চালাস। তোর আবার কতা কী? অ্যাঁ কতা কী! একদম চুপ থাক হারামজাদা যে বাড়িতে জন্মছিস, পিতা মাতার কু-পুত্র হয়েছিস যে চুলোয়, পুকুর পাড়ের একফালি জমির ওপর এক ঘরের টিনের চালা, মাটির দাওয়ার সেই বাড়ি দেখতে মনে চেয়েছে, ছুটে এসেছি সেই কলকাতা থেকে, ভিটে দেখে চুপিচুপি কেটে পড়। কতা কেন বলিস? না, নিজের মনেও বলবি না। তোর আবার মন কী রে শালা? চোরের মন হল ভিখিরির ধনের মতো। ভিখিরির যেমন ধন সম্পত্তি হয় না, চোরেরও মন বলে কিস্যু হয় না।

দয়াল সাবধানে এগোল। খানিকটা অগোছালো, খানিকটা টলোমলো পায়ে। চেনা পথও সময় পেরিয়ে গেলে অচেনা ঠেকে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে প্যান্টের পকেট হাতড়ে বিড়ি পেল একটা। দোমড়ানো মোচড়ানো, খানিকটা ভিজেও গিয়েছে। সেই বিড়ি ঠোঁটে নিয়ে ফের পকেট হাতড়াল। দেশলাই কই? নেই। একটু আগুন কি পাওয়া যায়? স্টেশনের চারপাশে দু-চারটে যে দোকান ছিল সব ঝাঁপ ফেলেছে। নিঝুম গাঁয়ে এই রাতে দোকান খুলে কে বসে থাকবে? ভালোই হয়েছে। সামান্য বিড়ির সামান্য আগুন দিতে গিয়ে আবার কে না কে দেখে ফেলে।

‘আরে দয়াদা না? আছ কেমন? তোমার ভিটে তো এখন জঙ্গল। বাড়ি গেছে ভেঙে। সাপ খোপের বাস। তুমি যাও কই?’

এর থেকে বিড়ি না খাওয়া ভালো। দয়াল ভাঙা পথ ধরে এগোয়। খানাখন্দ, ঝোপঝাড় টপকে এগিয়ে। ফেলে যাওয়া বাড়ির পথ কি সে চিনতে পারবে?

সেবার জোর বন্যা হয়েছিল। কালিয়া, হেঁড়েল, পানেরবাড়ি সবকটা নদী ভাসল। মাঠ ভাসল, ক্ষেত ভাসল, সন্ধে হব হব টাইমে উঠোন ভাসল, আর রাতে ভাসল ঘর। পূর্ণিমা হাইরোডের ওপারে চান্দু মাকালের চালকলে গিয়ে উঠল। যাবার আগে তার সঙ্গে কথা হয়েছিল দয়ালের।

‘যাও কই?’

পূর্ণিমা শান্ত ভাবে বলল, ‘চান্দুবাবুর কাছে যাই, সে খবর করেছে।’ দয়াল অবাক হয়ে বলল, ‘এ কেমন কথা পূর্ণিমা! তুমি ওখানে যাবে কেন? ঘরে আমি আছি না?’

পূর্ণিমা আরও শান্ত ভাবে বলল, ‘সে তো থাকবেই। তোমার ঘরে তুমি থাকবে না তো কে থাকবে? এই ভাঙা ঘর পাহারা দিতে হবে না? আর তুমি যাবেই বা কোথায়? তোমার মতো বেরোজগেরে মানুষকে বসে বসে খাওয়াবে কে?’

দয়াল বলল, ‘এখন কাজ নেই তো কী হয়েছে? বাউড়ি বলেছে, বর্ষা গেলে কাজে নেবে। একশো দিনের কাজ। নদীর ধারে ঘাট হবে। এ অঞ্চলে বাউড়ি তো কম লোকেরে কাজ দেয়নি।’

পূর্ণিমা নিরুত্তাপ গলায় বলে, ‘রাখো তোমার বাউড়ির কথা। একশো, দুশো, পাঁচশো কোনওদিনের কাজই তোমায় দেবে না। গেল বর্ষায়েও একই কথা বলেছিল। বলেনি? খালি এসে আমায় দেখার জন্য ছুকছুকানি করে।’

দয়ালে মিনমিনে গলায় বলে, ‘সে তুমি সুন্দর বলে করে। সুন্দর মেয়েমানুষের জন্য পুরুষের ছুকছুকানি তো হবেই। এতে এত রাগ করো কেন?’

পূর্ণিমা ঠান্ডা গলায় বলে ‘রাগ করি না। মুকে ঝাঁটা মারি। দেকবি যদি, নান্দুবাবুর মতো খরচাপাতি করে দেখ। ঘরের লোক কাজ না করে ঘরে বসে থাকে, দুটো পেট চালাতে হয়। বিনি পয়সায় দেকব বললে হবে?’

দয়ালে গলা, ‘তা’ বলে এই জলে তুমি আমায় ফেলে চলে যাবে? সকাল থেকে জ্বর জ্বর লাগে যে।’

পূর্ণিমা বলে, ‘আরে আমি কি বেবাক চলে যাচ্ছি নাকি? জল নামলে ফিরে আসবক্ষণ।’

ঘরে গোড়ালি ডোবা কালো জল। সেই জল বাড়ছে। পূর্ণিমার ফর্সা পায়ের গোছ ডুববে একটু পরেই। তার মধ্যেই পূর্ণিমা কুপির টিমটিমে আলো হাতে ঘুরে ঘুরে সাজগোজ করছিল। সে যাত্রাদলে নাচ করে। একা করে না দলে করে। একেকবার একেক পালা। কোনও বার ঠাকুরদেবতার, কোনও বার হিস্টরি, কোনও বার সতী—সাবিত্তি। গেলবার ছিল শমাজিক। জবরদস্ত নাম। সিঁথির সিদূরে মুছে দাও কান্না। পালা যাই হোক না, সবেতেই নাচ লাগে, গান লাগে। তার জন্য লোক লাগে। পূর্ণিমা নাচ তেমন পারে না, গলায় সুরও নেই। সেই জন্যই দলে নাচে। চেহারায় জৌলুষ আছে। গায়ের রঙ ফ্যাকাসেপানা ফর্সা, গোলপানা গড়ন, ঢলঢলে শরীর, ভারী বুক। নাচের সময় সেই বুক কাঁপলে পাবলিকের আলাদা করে চোখে পড়ে। তার ওপর আবার সময় সুযোগ বুঝে ওড়না, আঁচল, উড়নি ফেলে দেওয়া রপ্ত করেছে। কোমর দোলাতে পারে।

এই কাজটা পূর্ণিমার জুটেছিল একেবারে হুট করে। একদিন মানিক এসে হাজির। দয়ালের ছেলেবেলার বন্ধু। শহরে গিয়ে নানা ধান্ধা করে। পূর্ণিমাকে দেখে বললে, ‘এই যে মেয়ে, নাচ গান কিছু জান? জানলে বল, যাত্রাপার্টিতে চান্স করে দেব। ওরা আমায় বলে রেখেছে, পছন্দের কাউকে হলে নিয়ে আসবেন।

পূর্ণিমা ঘরে এসেছিল স্বামীর বন্ধুকে চা-মুড়ি দিতে। সঙ্গে টসটসা কাঁচা লঙ্কা। মানিকের কথা শুনে তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে বলেছি, ‘ওমা, আমি ওসব জানি নে। গরিব ঘরের মেয়ে বউয়ের আবার নাচ গান কী!’

মানিক মুঠো করে তোলা মুড়ি মুখে ফেলে, চোখ আধ বোজা করে বলল, ‘কিস্যু জানতে হবে না। দল ভারী করতেও লোক লাগে। তুমি গ্রুপে থাকবে। রাজি কিনা বল। ভালো পয়সা পাবে। দয়াল তো দেখছি কোনও কাজকম্মই করে না। বেটা চিরকালের অকম্মার ধাড়ি। ঘরে বসে খুঁটে খাবার ধান্দা। বেটাছেলে এরকম হলে ঘরের মেয়েছেলেকে তো বেরোতে হবে। রান্নাবান্না লাগে, খেতে লাগে। আর তোমার যখন ঠাকুরের কল্যাণে চেহারাপত্তর ভালো। তুমি মরতে মাঠে ঘাটে গিয়ে গায়ের রঙ নষ্ট করবে কেন?’

পয়সার কথায় মন লাগে পূর্ণিমার। টানাটানি চরমে। নিচু গলায় বলে, ‘শুনেছি, ওসব জায়গায় গেলে মেয়েদের বদনাম হয়।’

লঙ্কায় কচ করে কামড় মেরে মানিক বলল, ভুল শুনেছ কন্যে। ওসব পুরোনো দিনের কথা। এখন যাত্রা হল প্রফেশনাল জায়গা। হিরোইনই হও, আর এক্সট্রাই হও, সম্মান থাকবে। মেয়েদের আলাদা ঘর, আলাদা বাথরুম, আলাদা গাড়ি। শহরের বাঘা বাঘা ভদ্দোরলোকের জায়গায় মেয়েমানুষের মান সম্মান নিয়ে টানাটানি হয়, এইসব লাইনে কোনো কমপ্লেন নেই। এখানে শ্লোগান হল, কাজ করো, পয়সা নাও, কেটে পড়ো।’

পূর্ণিমা অনেকটাই আশ্বস্ত হয়। বলে, ‘কী করতে হবে?’

মানিক বলল, ‘কিস্যু নয়। আমার ফোন নম্বর রাখো। রাজি হলে খবর দেবে। কলকাতায় আসবে। সব কথা পাকা করে দেব। প্রথম মাসে যে টাকা পাবে সেটা পুরো আমার নেবার কথা। আমার দালালি। তুমি দয়ালের বউ, তোমার কাছে নেব হাফ।’

ব্যস্, পূর্ণিমার নতুন জীবন শুরু হয়ে গেল। মানিক ঠিকই বলেছিল, যাত্রাদলে অসম্মানের কিছু হল না। তবে বছর ঘুরতে না ঘুরতে চান্দু মাকালের নজর পড়ল। গভীর নজর। চালকলের মালিক চান্দু। চালকলের ওপরে ঘর করেছে। সেখানে নরম বিছানা করেছে, বরফ জমার মেশিন করেছে। চান্দুর নেশা ভাঙের দোষ নেই। মদ খায় না, বরফ দেওয়া দইয়ের ঘোল খায়। পূর্ণিমা গরমের দুপুরে সেই ঘোল নিজের হাতে বানাতে চালকলে যাতায়াত শুরু করল। চান্দু বলল, ‘এতো সুন্দর করে ঘোল বানাও পুন্নি, তাও তো গরম কমে না। খরচাপাতি কিছু নয়, তুমি গরম কমানোর ব্যবস্থা করও।’

পূর্ণিমা মুচকি হাসে। চান্দুর ‘গরম’ কমাতে নিজের গা খালি করে চান্দুর সামনে ঘোল বানাতে বসে। ব্যবসায়ী হলে কী হবে, মেয়েমানুষের ব্যাপারে চান্দুর টাকা পয়সায় কার্পণ্য নেই। পূর্ণিমা গা খালি করেছে, সেও তার গলা খালি রাখেনি। তিনদিনের মাথায় সোনার চেন দিয়েছে।

পূর্ণিমা চকচকে চোখে বলেছে, ‘এটা কী?’

চান্দু হেসে বলেছে, ‘প্রাইজ।’

পূর্ণিমা বলেছে, ‘কীসের পেরাইজ? ঘোলের না আমার গায়ের।’

চান্দু বলেছে, ‘দুটোই।’

পূর্ণিমা ঘোলের ঘটি চান্দুর মুখের কাছে ধরে বলে, ‘শুধু সোনায় হবে না। নগদও লাগবে। বাড়িতে ঘরে বসা স্বামী আছে না?’

চান্দু বলে,’কাজ চাই?’

পূর্ণিমা গালায় পরা সোনার চেন দুলিয়ে বলে, ‘পারবে না। বুকে অসুখ অল্প খাটনিতেই কাশাকাশি করে মরে। ওষুধ লাগে, ভালো-মন্দ খাওয়া লাগে। যাত্রাদলে নেচে চলে না।’

চান্দু হাত বাড়িয়ে বলে, ‘আচ্ছা পয়সাই দেব। এবার থেকে যখন ডাকব চলে আসবে।’

বন্যার সেই রাতে চুমকি লাগানো ব্লাউজ পরেছিল পূর্ণিমা। কুপির আলো চুমকিতে ঠিকরে ঘরের জলে টলমল করছিল। বড় সুন্দর লাগছিল। দয়াল ভাবছিল, ওইটুকু তো আলো, হারামজাদার মায়া কত! দুনিয়াটাই শালা মায়ার সে পা গুটিয়ে বসেছে ভাঙা তক্তাপোষে। জল যেভাবে বাড়ছে, আর ঘণ্টাখানেক বাদেই হ্যাঁচোড়পাঁচোড় করে চালে গিয়ে উঠতে হবে। বন্যার জলে চালে ওঠা কোনও সমস্যা নয়। আগেও উঠছে সে। তুচ্ছ জীবনকে আঁকড়ে বসে থেকেছে। একদিন, দুদিন, তিনদিন…। মানুষ তো তাই করে। আসলে পোকামাকড়ের মতোই সে। জীবন যতই অর্থহীন, অকিঞ্চিৎকর হোক বেঁচে থাকার জন্য হাঁকপাঁক করে চলেছে। বারবার ভাবে বেঁচে থেকে কী হবে? তারপরেও বাঁচতে চায়। ঘরের চাল বেয়ে, দেয়াল বেয়ে, এমনকী অন্য মানুষ বেয়েও বেঁচে থাকতে চেষ্টা করে। তবে এখন ঘরের চালে ওঠবার থেকেও বেশি সমস্যা হল বিড়ি। বিড়ি রয়েছে মোটে দুটো। কতদিন জলে আটকা থাকতে হয় তার কোনও ঠিক নেই। দুটো বিড়িতে কী হবে?

‘তুমি কি সত্যি চললে নাকি?’

পূর্ণিমা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘বারবার এক কথা বল কেন? সত্যি না তো মিত্যে? এখানে থেকে সাপখোপের কামড়ে মরব?’

দয়াল বলল, ‘তাহলে আমিই বা থেকে কী করি? আমিও যাই। চান্দুবাবুর চালকাল বড়। তুমি বললে, একটা খাঁজেখোঁজে জায়গা হয়ে যাবে। হবে না? জ্বর গায়ে এখানে একা পড়ে থাকা ঠিক হবে না। অসুখ বাড়লে মরি যদি।’

পূর্ণিমা চোখ কপালে তুলে বলেছিল, ‘খেপেচো নাকি! চান্দুবাবু কি লঙ্গরখানা খুলেচেন যে ঘরে জলে ঢুকলে আর গাঁ শুদ্ধু সবাই ওখানে গিয়ে খিচুড়ি খেতে লেগে গেলে? চালকলে একটাই তো মোটে ঘর। সেখানে আমি হাত পা ছড়িয়ে থাকব। যাই আর দেরি করব না, এরপর সাঁকো ভাঙলে আর যেতে পারব না। জল যেমন বাড়চে বাঁশের সাঁকো ভাঙতে দেরি নেই। চিন্তা করো না, এতদিন যখন রোজগার করে তোমায় খাইয়েচি, বাকি দিনেও খাওয়াব।’

পূর্ণিমা হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে, জল ঠেলে রওনা দিল। পাকা রাস্তা পর্যন্ত গেলেই হবে। ভ্যান পাঠিয়েছে চান্দুবাবু। ‘পেরাইভেট ভ্যান’। যাওয়ার সময় পূর্ণিমা বলে গেল, ‘সাবধানে থেকো। রাতবিরতে জলে বেশি নেমোনি। চাল, ডাল, আলু রেখে গেলাম। ফুটিয়ে নিও। ওষুধ খাবে মনে করে। জল নামলেই ফিরে আসব।’

জল নামল,পূর্ণিমা ফিরল না। নাকি ফিরল? ফিরে আবার গেল? ধস্ ফেরেই নি তো। সবকিছু ঠিকমতো মনে পড়ছে না। পড়বার কথাও নয়। দুপুরে যা কাণ্ড হয়েছে! শালার, মন যে এখনও আছে এই যথেষ্ট। মনের এই হল মজা। হাড় ভেঙে দুরমুশ করে দেওয়া যায়, কিন্তু মন যতক্ষণ না চায়, তাকে ভাঙে কার সাধ্যি? আস্ত থাকবে ভাবলে সে আস্তই থাকে।

দয়াল মনে মনে ভাবল, তার মন কি আস্ত রয়েছে? আস্ত আছে কিনা কোন শালায় জানে? তবে মন যে আছে তা বোঝা যাচ্ছে। নইলে এই অসময়ে পূর্ণিমার জন্য মন অমন কেমন করে উঠল কেন? আর উঠল বলেই না সে কলকাতা থেকে এতদূর ছুটে এসেছে। ভিটেমাটি দেখার কথা তো ছুতো। নিজের মনকে মিথ্যে বলা। বউকে দেখতে চাওয়া বুড়ো বয়েসে একটা লজ্জা না? বড় লজ্জা। তাও আবার এমনি বউ নয়, পালিয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া বউ। পূর্ণিমা শুধু বন্যার সময় বরকে ছেড়ে পালায়নি, বারো দিন পর জল নামতে, অসুস্থ, অভুক্ত দয়াল যখন ধুঁকতে ধুঁকতে পূর্ণিমার খোঁজে চালকলে যায় চান্দু মাকাল আকাশ থেকে পড়ল।

‘বলো কী দয়াল! এ তো সব্বনেশে কথা গো। পুন্নিমে বাড়ি নেই! সে গেল কই? কই গেল? পুলিশে খবর দাও বাপু। না না, আমার এখানে সে আসেনি। আসবেই বা কেন? সে একবার এখানে যাত্রাপার্টি এলে, ওদের একবেলা এখানে ডেকে খাইয়েছিলাম বটে। সে তো বছর খানেক আগের কথা গো। নাকি বেশিই হবে? বাইশ না ছাব্বিশ জনে এসে কবজি ডুবিয়ে ভাত মাংস খেয়ে গেল। শেষে মাটির খুড়িতে ঘোল। ঘোলের ওপর সর। যাত্রা, সার্কাস, মেলা বসলে আমি একবেলা সবেরে নেমন্তন্ন করি। কিন্তু তুমি আমায় বড় চিন্তায় ফেলল দয়াল। শুনেছি, বউ তোমার লক্ষ্মীমন্ত, সুন্দরী। ভালো নাচ গান পারে। সে কেন নিঁখোজ হবে? হ্যাঁগো জলে ভেসে-টেসে যায়নি তো? বলো তো থানায় ফোন করি।’

এরও দশদিন পর কালিয়া নদীর চরে, কাদা মাখা চরে পূর্ণিমার লাশ পাওয়া গেল। ফর্সা গা খালি। জলে ফুলে ফেঁপে ওঠা শরীর নিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। দু’হাতে ভেজা মাটি আঁকড়ে আছে। যেন মাটির কানে ফিসফিস করে কিছু বলে। পুলিশ এসে লাশ চালান করল। বন্যায় মৃতের সংখ্যা বাড়ল আর একজন।

ভাঙা ঘরে খিড়কি দিয়ে গাঁ ছাড়ল দয়াল। খাবে কী? নিজের গাঁয়ে তো ভিক্ষে করা যায় না। লোকে গাল দেবে। বলবে, ‘এতকাল নষ্ট বউয়ের পয়সায় ঘরে বসে খেত, এখন বউ মরেচে, আমাদের পয়সায় খাবে বলে এবার বেটা ভিখিরি হয়েছে।’

এর থেকে ভিটে ছাড়া ভালো।

আজ বহুদিন পরে এই নিশুতি রাতে, ঝোপঝাড়ে ঢাকা ভিটেতে ফিরে, বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে থমকে দাঁড়াল দয়াল।

ওকি! ভাঙা ঘরে আলো কীসের? কুপি জ্বলে না? ঝুলে দরমা বেড়ার ওপাশে কে কে নড়াচড়া করে? কে?

ভাঙা তক্তাপোশে কাত হয়ে বসে আছে দয়াল। পূর্ণিমা ভেজা কাপড় দিয়ে তার শরীরের রক্ত মুচছে আর অবিশ্রান্ত ধারায় কেঁদে চলেছে। দয়াল তার কাঁধে হাত রাখে। ফিসফিস করে কথা বলে।

‘এতো কাঁদে না পূর্ণিমা, এতো কাঁদে না। ঠিকই তো হয়েছে। ওরা এক চোরকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। তবে আমার লাগেনি বেশি। লাথি, কিল, ঘুষি সহ্য করতে হয়নি বেশিক্ষণ। ওরা বুঝতে পারে নি, তার আগেই চুপচাপ মরে গিয়েছি। মরা মানুষের ওপর মার দিয়েছে ওরা। এই দুনিয়ায় সবাই তাই ভালোবাসে পূর্ণিমা। মরা মানুষকে মারতে ভালোবাসে। আর কেঁদো না পূর্ণিমা। মন শক্ত করো। তুমি যখন মরেছিলে আমি কি কেঁদেছি এত? কেঁদেছি বলো? তবে? এসো, কাছে এসো। কতদিন তোমাকে আদর করিনি।’

পূর্ণিমা হাতের তালুতে চোখের জল মুছে স্বামীর কাছে ঘন হয়ে আসে। তার জামায় লাগানো চুমকি থেকে কুপির আলো ঠিকরে এসে পড়ে। দয়াল চোখ বোজে। এই মায়াভরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে ভেবে তার খুবই দুঃখ হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *