জীবনশিল্পী রবীন্দ্রনাথ
এমন অনেক শিল্পীর কথা আমরা জানি যাঁদের হাতের ছোঁয়া লেগে পাষাণ হয়েছে অহল্যার মতো শাপমুক্তা সুন্দরী, কিন্তু যাঁদের নিজেদের জীবনের বেলায় তাঁদের শিল্পিত্ব খাটেনি। সেক্ষেত্রে তাঁরা অবস্থার দাস এবং তাঁদের জীবনের আদর্শও দুর্বল। অথচ শিল্পী নন এমন কোনো কোনো মানুষের জীবন এক-একখানি শিল্পসৃষ্টির মতো সযত্নরচিত, সুসংগত, অবান্তরতাবিহীন।
রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব এইখানে যে, তিনি তাঁর অপরাপর কাব্যের মতো করে তাঁর জীবনকালকেও ছন্দে মিলে উপমায়, ব্যঞ্জনায়, কল্পনার প্রসারে ও অনুভূতির গভীরতায় একখানি গীতিকাব্যের ঐক্য দিয়েছেন। সেটি বেশ একটি গোটা জিনিস হয়েছে, ভাঙা ভাঙা বা অসম্বন্ধ হয়নি, অন্তর্বিরোধসম্পন্ন বা অসংগতিবহুল হয়নি। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠকীর্তি তাঁর জীবন। তাঁর অন্যান্য কীর্তি বিস্মৃত হয়ে যাবার পরও তাঁর এই কীর্তিটি জীবিত মানুষের আন্তরিক যে জিজ্ঞাসা—‘কেমন ভাবে বাঁচব?’—সেই জিজ্ঞাসার একটি সত্য ও নিঃশব্দ উত্তর হয়ে চিরস্মরণীয় হবে।
দেশের অতি বড়ো দুর্গতির দিনে যখন পরিপূর্ণ জীবনের আদর্শকে লোকে যুগপৎ উপহাস, ভয় ও সন্দেহ করছে তখন রামমোহন রায়ের জন্ম। এই মহাপুরুষ শাশ্বত ভারতবর্ষকে আবিষ্কার করে তাকে একটি বৃহত্তর পরিধির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেন। এঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ পেলেন দেশকালের অতীত হয়ে বাঁচবার দৃষ্টান্ত। আধুনিক ভারতবর্ষের জনক-ঋষি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের জনক। তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ পেলেন ঋষি-দৃষ্টি ও মহত্ত্বের প্রতিনিয়ত আকাঙ্ক্ষা। ঠাকুর পরিবারে প্রাচীন ভারতবর্ষ ও আধুনিক পৃথিবীর সমন্বয় ঘটেছিল। যৌবনারম্ভে মহর্ষি উপনিষদের পৃষ্ঠা কুড়িয়ে পান ও মৃত্যুর অল্পকাল পূর্বে তাঁকে Geology-র গ্রন্থ পড়তে দেখা গেছিল। এই দুটি ঘটনা থেকে ঠাকুর পরিবারের আবহাওয়া অনুমান করা যায়। ধর্মে ও কর্মে, ত্যাগে ও ভোগে, কলায় ও বিদ্যায়, স্বাজাত্যে ও বিশ্বমানসিকতায় ঠাকুর পরিবারের শিক্ষা আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ ছিল। স্কুল-কলেজের অপেক্ষা রাখেনি। এই পরিবারের কাছে ও মধ্যে রবীন্দ্রনাথ পেলেন তাঁর বাল্য ও কৈশোরের শিক্ষা।
স্কুল-যন্ত্রের কবল থেকে অক্ষত দেহ-মন নিয়ে বেরোতে পারা রবীন্দ্রনাথের মতো শক্তিধর ব্যক্তির পক্ষেও অসম্ভব হত। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন, রুটিন ও এগজামিনের যুগল হস্তের ঘন ঘন চপেটাঘাতে কল্পনাবৃত্তি অসাড় হয়ে যায় ও পাঠ্যপুস্তকে নিবদ্ধ হয়ে পর্যবেক্ষণশক্তি হয় আড়ষ্ট। পাছে প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটে ও তার ফলে বিক্ষেপ জাত হয় তার দরুন স্কুলঘরের চারদিকে চারদেওয়াল প্রহরীর মতো খাড়া। ‘যঃ পলায়তি সঃ জীবতি।’ রবীন্দ্রনাথ স্কুল পালিয়ে নিজের শিক্ষার দায়িত্ব নিজের হাতে নিলেন। আজও সে-দায়িত্বে ঢিলে দেননি। তাঁর মতো বহুবিদ্য ব্যক্তি যেকোনো দেশে বিরল। কিন্তু অধীত বিদ্যা প্রচার করার চেয়ে বিদ্যার সৌরভ বিকিরণ করাই যথার্থ পান্ডিত্য। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাকে রসায়িত করে কাব্যে, নাটকে, উপন্যাসে পরিবেশন করেছেন, তা নিয়ে থিসিস লেখেননি। তাঁর লঘুতম রচনাতেও মার্জিত বুদ্ধির যে দীপ্তি দেখতে পাই সে-দীপ্তি অশিক্ষিত পটুত্বের নিদর্শন নয়। প্রতিভাশালী ব্যক্তিদের সম্বন্ধে আমাদের একটা ভ্রান্তি আছে—তাঁরা বিনা সাধনায় সাফল্যলাভ করেন, যেহেতু তাঁরা দৈবশক্তিসম্পন্ন। রবীন্দ্রনাথ ডায়েরি রাখেননি, কিন্তু তাঁর ছিন্নপত্র থেকে জানি তিনি যেমন সব্যসাচী লেখক তেমনি সর্বভুক পাঠক এবং তাঁর পর্যবেক্ষণশীলতা ও কল্পনাকুশলতা কী প্রকৃতির সংসার, কী মানবের সংসার, উভয়ের অন্তর-বাহির পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুধাবন করেছে।
স্কুল-কলেজে না গেলে ভদ্রসমাজে একঘরে হতে হয় এবং জীবিকা সম্বন্ধে অতি বড়ো ধনী সন্তানেরও ভয় থাকে। রবীন্দ্রনাথ অল্প বয়সে স্কুলত্যাগ করে তাঁর নিজের দিক থেকে ঠিক করলেও অন্য সকলে নিশ্চয়ই তাঁকে নিরস্ত করবার চেষ্টা করেছিলেন ও তিনি ভুল করলেন বলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলেন। জীবনশিল্পী এমনি করেই নিজের পরিচয় দেন। পশুপক্ষীর ইনস্টিংক্টের মতো শিল্পীপ্রকৃতি মানুষের মধ্যেও ইনটুইশনের ক্রিয়া অমোঘ। কোন পথে মহতী বিনষ্টি তা ওঁরা লাভ-লোকসান তৌল না করে যুক্তিতর্কের মধ্যে না নেমে আপনার অপ্রবৃত্তি থেকেই উপলব্ধি করেন এবং আত্মহত্যার পথকে সমগ্র শক্তির সহিত পরিহার করেন।
রবীন্দ্রনাথের যৌবনোদগমে বিলাতযাত্রা তাঁর স্কুল পরিত্যাগেরই মতো একটি অর্থপূর্ণ ব্যাপার। তখনও আমাদের সমাজে সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ ও অপ্রচলিত ছিল। অথচ বহির্বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় কেবলমাত্র বিদেশি গ্রন্থ পাঠের দ্বারা হবার নয়। পৃথিবীতে এসে পৃথিবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হল না, এর মতো দুঃখের কথা অল্পই আছে। বিশেষত যে-মানুষকে একদিন মানব মাত্রের বন্ধু হতে হবে, প্রতিভূ হতে হবে, মানব সম্বন্ধে তুলনামূলক জ্ঞান তাঁর সাধনার অত্যাবশ্যক অঙ্গ। গার্হস্থ্য আশ্রমে প্রবেশ করবার পূর্বে স্বদেশের সঙ্গে বিদেশকে ও নিকটের সঙ্গে দূরকে মিলিয়ে দেখা পূর্ব ও পশ্চিম উভয় মহাদেশের বহুকালীন আদর্শ। তার ফলে মাত্রাজ্ঞান জন্মায়, অহংকার ও মোহ কিছু কমে এবং নিজের ও পরের মাঝখানকার সত্যকার সীমারেখাটি আবিষ্কৃত হয়।
রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে শোনা গেছে যে, তিনি জমিদার হিসেবেও বিচক্ষণ ছিলেন। কিন্তু বিচক্ষণ জমিদার হবার দরুন তাঁর বাণী তিক্ত, উদ্ধত বা বিষয়ীসুলভ হয়নি। পরন্তু বিচক্ষণ জমিদার হবার দরুন তাঁর রচনা রুগণ আদর্শবাদ ও গলদশ্রু ভাবালুতা থেকে মুক্ত। পরোপকার করতে চাইলেও করা উচিত নয়, যদি তার ফলে পরের আত্মসম্মান ও আত্মনির্ভরতা হয় বিড়ম্বিত। আমাদের দরিদ্রনারায়ণসেবা, কাঙালিভোজন ইত্যাদি আদর্শ এমন অস্বাস্থ্যকর যে, যথার্থ করুণা ও লোকপ্রীতির পৌরুষ তাতে নেই।
প্রাচীন ভারতবর্ষের গার্হস্থ্যের আদর্শই হচ্ছে সর্বদেশের সর্বকালের পূর্ণবয়স্ক মানুষের আদর্শ। তার মধ্যে ভোগ ও ত্যাগ, আনন্দ ও সংযম পাশাপাশি স্থান পেয়েছে। কেবল বিপন্নকে অভয়দান ও আতুরের সেবা নয়, অন্যায়কারীকে আঘাত ও অশিষ্টকে শাসনও তার অন্তর্গত। বিষয়সম্পত্তিকে উক্ত আদর্শ বিষের মতো পরিহার করতে বলেনি, বৃদ্ধি করতে রক্ষা করতে ও বিজ্ঞের মতো ব্যবহার করতে বলেছে। এই সম্পূর্ণতার আদর্শ সেকালে তথা একালে বহু মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তাই সেকালে লোকে সন্ন্যাসী হয়ে যেত, একালে সোশ্যাল সার্ভিস নিয়ে মাতে। বিচিত্র সংসারের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ কর্তব্যগুলোর প্রত্যেকটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করাতে চরিত্রের প্রতি অঙ্গের চালনা হয়। এই চালনাই স্বাস্থ্যকর। দুনিয়ার দুঃখদৈন্য দূর হল কি না সেটা ভাবতে যাওয়া অস্বাস্থ্যকর।
রবীন্দ্রনাথের গৃহস্থাশ্রমের দৃশ্য আমরা তাঁর সঙ্গে জগদীশচন্দ্রের পত্রবিনিময়ের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাই। ক্রমে ক্রমে যখন অন্যান্য চিঠিপত্রের বাতায়নদ্বার মুক্ত হবে তখন পূর্ণ দৃশ্যটি উদ্ঘাটিত হবে। সেটির এটা-ওটা করে অনেক রেখা ও রং আমাদের অপছন্দ হলেও আমাদের কাছে সমগ্র চিত্রখানির মূল্য কমবে না। রবীন্দ্রনাথ কাঁচা বা পাকা যা-কিছু লিখেছেন, হাতের লেখার দিক থেকে প্রত্যেকটি সুন্দর এবং সাহিত্যের দিক থেকে প্রত্যেকটি স্বকীয়। এর থেকে অনুমান হয় যে, তুচ্ছ বা মহৎ কোনো কাজই তাঁর পক্ষে হেলাফেলার যোগ্য নয় এবং তাঁর অন্তঃপ্রকৃতি সর্বমুহূর্তে সতর্ক থাকে পাছে তাঁর বহিঃপ্রকৃতিতে কিছুমাত্র কুশ্লীলতা বা মামুলিয়ানা প্রকটিত হয়ে পড়ে।
একালের মানুষ দিন দিন পল্লিকে ছেড়ে নগরে জুটছে। নগরের প্রধান আকর্ষণ তার নিত্যনতুন চমক, নিত্যনতুন খবর, নিত্যনতুন শিক্ষা, নিত্যনতুন সঙ্গ। এ আকর্ষণকে উপেক্ষা করা যায় না। কত অঞ্চলের কত দেশের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের অভ্যস্ত আচার ও মনগড়া বিচারকে আমরা আর একটু উদার করি। কিন্তু হৃদয়বৃত্তির বিচিত্র চরিতার্থতার জন্যে পল্লিই ছিল ভালো এবং পল্লিতে আমরা প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে পশুপক্ষী-বৃক্ষলতা-নদী-পর্বতের বৃহত্তর সমাজে ছিলুম। নগর যেমন নিত্যনতুন, পল্লি তেমনি চিরন্তন। দুটোই সত্য এবং দুটোকে জড়িয়েই সত্য। রবীন্দ্রনাথ পল্লির প্রতি পক্ষপাত করলেও নগরকে বর্জন করলেন না। প্রকৃতির সুধা ও জনসংঘাত-মদিরা পান করে তিনি উভয় সত্যের স্বাদ গ্রহণ করলেন। পদ্মাবক্ষে নৌকাবাসের দিনগুলি আধুনিক যুগের নাগরিক মানুষের কাছে কেমন রোমান্সের মতো লাগে। অতটা নির্জনতা আমাদের সয় না। তাতে আমাদের আধ্যাত্মিক অগ্নিমান্দ্যের সূচনা করছে। পল্লি ও নগর উভয়কেই উপভোগ করতে পারা চাই। শুধু একবার চোখ বুলিয়ে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়া উপভোগ করা নয়। একান্তভাবে সভ্য ও আধুনিক হতে গিয়ে যা সৃষ্টি করব তা আধুনিকতার মতো অচিরস্থায়ী ও সভ্যতার মতো অগভীর হবে। অবিমিশ্র নাগরিক অভিজ্ঞতার উপদ্রব আমরা সাহিত্যে পোহাচ্ছি। চিড়িয়াখানায় গিয়ে জীবচরিত্র অধ্যয়ন করার মতো নগর থেকে কী মানবচরিত্র, কী বিশ্ব ব্যাপার, কোনোটার ঠিকমতো নিরিখ হয় না। বাস্তব বলে যাকে চালাই সেটা একটা বিশেষ অবস্থায় বাস্তব। বদ্ধঘরে প্রতিধ্বনির মতো জীবনের হাহাকারকে নগর অতিরঞ্জিত করে। জীবনের দুঃখদৈন্যগুলোকে অপরিমিত কালের পটভূমিকায় প্রসারিত করলে তাদের সত্যিকারের পরিমাণ উপলব্ধি করি এবং মানুষের সংসারকে অপরিমিত প্রাণলোকের অধিকারভুক্ত বলে জানলে যা নিয়ে উত্তেজিত পীড়িত ও ক্ষতিগ্রস্ত বোধ করছি তার দিকে সুদূরের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আনন্দ পাই।
রবীন্দ্রনাথের যৌবনের দিনগুলি অল্প পরিসরের মধ্যে সত্য ছিল, সম্পূর্ণ ছিল। সাংসারিক উচ্চাভিলাষ তাঁর ছিল না এবং সাহিত্য তাঁকে দেশের সর্বত্র পরিচিত করলেও দেশের কর্মপ্রবাহ থেকে তিনি দূরেই ছিলেন। হঠাৎ একদিন দেশে নবযুগের প্রাণস্পন্দন এল, সে যে কী অপূর্ব জন্মলক্ষণ ঘরে-বাইরে-তে তার বর্ণনা আছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিভৃত সাধনা ছেড়ে সকলের সঙ্গে যোগ দিলেন। বৃহৎ সংসারের প্রতি কর্তব্য একদিন না একদিন করতেই হবে—দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি, পৃথিবীর প্রতি। কিন্তু সেই কর্তব্য যার প্রতি, সে যে-পরিমাণে বৃহৎ, কর্তব্যের পূর্বাহ্নের সাধনাও যেন সেই পরিমাণে বিপুল হয়। দেশের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা কেবলমাত্র পণ্যনিবদ্ধ ছিল না; দেশের ধর্ম, সমাজ, ইতিহাস, সাহিত্য, সংগীত ইত্যাদি ঠাকুর পরিবারের অন্যান্যদের মতো তাঁরও অনুরাগের সামগ্রী ছিল। দেশের শিল্পদ্রব্যের পৃষ্ঠপোষকতা এঁরা স্বদেশি আন্দোলনের চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে থেকেই করে আসছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ প্রমুখ জন কয়েক মিলে একটি স্বদেশি বস্ত্রের দোকানও খুলেছিলেন। দেশে জন্মেছি বলে দেশ আমার নয়, দেশকে নিজের তনুমন দিয়ে সৃষ্টি করেছি বলে দেশ আমার, পেট্রিয়টিজমের এই সূত্রটি দেশকে রবীন্দ্রনাথ ধরিয়ে দিলেন। দেশ এর মর্যাদা তখন বুঝল না, এতদিন পরে আজ বুঝছে।
দেশের প্রাচীন শিক্ষাকে আধুনিক কালের উপযুক্ত করে দেশকে একদিক থেকে সৃষ্টি করার ব্রত নিলেন তিনি নিজে। এই উদ্দেশ্যে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা। আধুনিক কালে ‘আশ্রম’ কথাটির অর্থ বদলে গেছে। এখন আমরা ‘আশ্রম’ বলতে সাধনাপীঠ বুঝে থাকি। যথা, শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম। রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত আশ্রম প্রাচীন অর্থের আশ্রম অর্থাৎ অবস্থা। রবীন্দ্রনাথের গার্হস্থ্যাশ্রম ও তাঁর শিষ্যগণের ব্রহ্মচর্যাশ্রম পরস্পরের পরিপূরকতা করল। এর আরম্ভ অতিসামান্য আকারে। এর দ্বারা রাতারাতি দেশের দুঃখমোচনের আশা ছিল না। নিরক্ষরতা দলন নয়, অর্থকরী বিদ্যাবিস্তার নয়, জনসেবা বা রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়। জীবনের সর্বাঙ্গীণতার প্রতি দৃষ্টি রেখে জীবনের প্রথম অঙ্গের অনুশীলন, পরিপূর্ণরূপে বালক হওয়া। আজ যারা পরিপূর্ণরূপে ফুল হতে পেরেছে তারাই কাল পরিপূর্ণরূপে ফল হতে পারে, অপরে নয়। ব্রহ্মচর্যাশ্রমী বালকের দেহ-মনকে নানা দিকে স্ফূর্তি দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ খেলা, অভিনয়, গান ও উপাসনা এগুলিকে বিদ্যাশিক্ষার মতোই প্রযোজনীয় বলে গোড়া থেকে জেনেছিলেন। বিদ্যাশিক্ষা বা নীতিশিক্ষাকে স্ফীত হতে দেননি এবং অপরগুলিকে ওর কোনোটার বাহন করেননি। বিদ্যার্জনই বালকের একমাত্র বা প্রধান করণীয়, সভ্যসমাজ থেকে এই বদ্ধমূল কুসংস্কার যদি কোনোদিন ঘোচে তবে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর দেশ ও জগৎ আর-একটু ভালো করে বুঝবে।
অল্প সময়ের ব্যবধানে একাধিক প্রিয়জনের মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের দারুণ দুর্ভাগ্য। কিন্তু এই করুণ অভিজ্ঞতাকে রবীন্দ্রনাথ অপচিত হতে দেননি। তাঁর খেয়া ও গীতাঞ্জলি এই বেদনার রূপান্তর। তাঁর জীবন ও তাঁর কাব্য যেন এমন একটা পরিণতির প্রতীক্ষা করছিল। ফলের পক্বতার পক্ষে প্রখর রৌদ্রের প্রয়োজন ছিল। তাঁর মধ্যে কারুণ্যের সঞ্চার না হলে তিনি সকলের সর্বকালের কবি ও প্রতিভূ হতে পারতেন না। প্রিয়বিয়োগের প্রভাব রবীন্দ্রনাথের প্রৌঢ়ত্বকে একান্ত mystic-ভাবাপন্ন করলে। তিনি ভগবানের মধ্যে হারানো প্রিয়দের সঙ্গ পেলেন, তাই ভগবান হলেন তাঁর প্রিয়তম। যিনি এতদিন পিতা ছিলেন, তিনি হলেন সখা ও প্রেমিক। ‘গীতিমাল্য’ ও ‘গীতালি’ রচিত হল।
অকস্মাৎ রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীব্যাপী খ্যাতির অধিকারী হন। ইতিহাসে অনুরূপ ঘটনার উল্লেখ নেই। রোগশয্যা বিনোদনের জন্যে কয়েকটি বাংলা রচনার ইংরেজি তর্জমা করেছিলেন, সেগুলি কী মনে করে লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইরিশ কবি ইয়েটসকে পড়তে দেন। একদা যেমন দুর্ঘটনার ভিড় জমেছিল একদিন তেমনি যশ, অর্থ ও সম্মান বন্যার মতো দিগদিগন্ত ব্যাপ্ত করে এল। দুঃখের সময় যিনি অভিভূত হননি সুখের দিনেও তিনি অভিভূত হলেন না। বঙ্গের কবি বিশ্বের অর্ঘ্য সহজভাবে নিলেন। ছিন্নভিন্ন পরাধীন দীনদরিদ্র দেশের মানুষ সাধনা করেছিলেন দিগবিজয়ীর মতো, আরম্ভ করেছিলেন রাজকীয় ধরনে। হাতে রেখে দান করেননি, হাতে হাতে ফল চাননি। যাঁর অধিক মূলধনের কারবার, তাঁর বিরাট ক্ষতি, বিরাট লাভ, তাঁর লাভের জন্যে ত্বরা নেই। প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় ও ব্যাপক যোগাযোগ, মানুষের গভীরতম চরিত্রে আস্থা, ভগবানের কল্যাণবিধানে সংশয়হীন বিশ্বাস, সৌন্দর্যের রসায়নে ব্যাবহারিক জীবনকেও রসায়িত করা—এতগুলো বড়ো বড়ো জিনিস কি ছোটো একটি দেশে আবদ্ধ থাকতে পারত? দু-দিন আগে না হলে দু-দিন পরে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ত। তারপর রবীন্দ্রনাথ চিরদিন up-to-date। বিশ্বসাহিত্য তাঁর ভালো করে জানা, বিশ্বের আধুনিকতম ভাবনাগুলো তাঁরও ভাবনা। বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে নৌকাবাস করবার সময় তিনি বিশ্বের কেন্দ্রস্থলেই বাস করেছেন।
বিশ্ববিখ্যাত হবার পর থেকে তাঁর দায়িত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি পেল। বৃহত্তর মানবসংসারের ব্যাপারে তাঁর ডাক পড়ল। গত মহাযুদ্ধের বিনষ্টির ক্ষণে Nationalism সম্বন্ধে তাঁর নির্ভীক উক্তি তাঁকে তখনকার মতো অপ্রিয় করলেও আজ সভ্যজগতের বহু মনীষী ব্যক্তি তাঁরই মতে মত মিলিয়েছেন। মানুষের নতুন ভবিষ্যতের তিনি অন্যতম স্রষ্টা, সেই ভবিষ্যতের প্রতি বাৎসল্য তাঁর স্বদেশবাৎসল্যকেও ছাড়িয়ে যায়, তাই তাঁকে আমরা ভারতবর্ষের নেশন হওয়ার দিনে পাচ্ছিনে। কিন্তু যখনই ধর্ম আমাদের পক্ষে, তখনই তিনি আমাদের পক্ষে। জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রতিবাদ করতে তিনি মুহূর্তমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি।
মহাযুদ্ধের পর ইউরোপখন্ডে লিগ অব নেশনস-এর প্রতিষ্ঠায় Nationalism-এর জড় মরল না। যা যেমন ছিল তা প্রায় তেমনি থাকল। মানুষের চরিত্রে যা শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে নেশনও নয়, লিগ অব নেশনসও নয়। স্বার্থের ঊর্ধ্বে না উঠতে পারলে মিলন সত্যকার হতে পারে না। হাট-বাজারকে আমরা মিলনস্থলী বলিনে। মানুষ যেখানে জ্ঞানবিনিময় প্রীতিবিনিময় করে সেইখানে তার মিলনতীর্থ। রবীন্দ্রনাথ একপ্রকার বেসরকারি লিগ স্থাপন করলেন, অব নেশনস নয়—অব কালচারস। তাঁর বিশ্বভারতী বিশ্বের সকলের ভারতী। মহাযুদ্ধের মহাপ্রলয়ের পর এই একটি সৃষ্টির মতো সৃষ্টি! আজ যথেষ্ট মর্যাদা পাচ্ছে না এ। বটবৃক্ষের বীজের মতো এর আকার ক্ষুদ্র, আয়োজন অল্প। কিন্তু বিপুল সম্ভাবনা যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের থাকে তবে এরই আছে। আমাদের গৌরব এই যে, ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’ এমন একটি পুণ্যতীর্থের প্রতিষ্ঠা হল।
রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘজীবী হয়ে, শতায়ু হয়ে, তাঁর জীবন-শতদলের অপরাপর দলগুলি উন্মোচন করতে থাকুন। সেই তো তাঁর মুক্তি। একটি মুক্তপুরুষের দৃষ্টান্ত লক্ষ মুক্তপুরুষের আবাহন করে। কাল নিরবধি, পৃথিবীও বিপুলা। রবীন্দ্রনাথের উত্তরপুরুষরা এই বলে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন যে, মানুষের যা চরম উত্তরাধিকার তা-ই তিনি দিয়ে গেলেন। সেটি হচ্ছে ‘কী ভাবে বাঁচব’ এই জিজ্ঞাসার নিঃশব্দ উত্তর।