জীবন বীমা
(অর্থাৎ জীবনবীমার ভয়ানক চুরি!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
প্রায় দশ বার বৎসর অতীত হইল, এক দিবস দিবা ২টার সময় আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কৰ্ম্মচারী সাহেব আমাকে তাঁহার অফিস ডাকাইয়া পাঠাইলেন। আমি তৎক্ষণাৎ তাঁহার নিকট গমন করিলাম। তিনি, সেই সময় আমাকে অধিক কিছু না বলিয়া, কেবলমাত্র একখানি পত্র আমার হস্তে প্রদান করিলেন, ও কহিলেন, “এই পত্রখানি পাঠ করিয়া ইহার লেখকের সহিত একবার সাক্ষাৎ করিলেন এবং তাঁহাকে যথাসাধ্য সাহায্য করিতে চেষ্টা করিবেন।”
প্রধান কর্মচারীর কথা শুনিয়া ঐ পত্রহস্তে তাঁহার অফিস হইতে বাহিরে আসিলাম। পত্রখানি খোলাই ছিল, উহা কোন বিমা আফিসের প্রধান ইংরাজ-কর্মচারী কর্তৃক ইংরাজীতে লেখা। পত্রখানি ভাল করিয়া পাঠ করিলাম। উহাতে অধিক কথা লেখা ছিল না। যাহা লেখা ছিল, তাহার সারমর্ম্ম, এইরূপ:-
“হরেকৃষ্ণ নামক এক ব্যক্তি আমাদিগের অফিসে দশ হাজার টাকায় তাহার জীবন বীমা করে ও কিছুকাল পরে তাহার জীবনের বীমা-সত্ত্ব ব্রজবন্ধু নামক এক ব্যক্তির নিকট বিক্রয় করে। ইহার কিছু দিবস পরেই হরেকৃষ্ণ মরিয়া যায়, সুতরাং তাহার জীবন বীমার দশ হাজার টাকা এখন ব্রজবন্ধুর প্রাপ্য। ব্রজবন্ধু ঐ টাকা পাইবার নিমিত্ত আমাদিগের অফিসে আবেদন করিয়াছে ও সার্টিফিকেট প্রভৃতির যাহা কিছু আবশ্যক, তাহাও দিয়াছে; আমরাও তাহাকে ঐ টাকা প্রদান করিতে একরূপ সম্মত ইয়াছিলাম, কিন্তু এখন এরূপ প্রকাশ যে, ব্রজবন্ধু জুয়াচুরি করিয়া ঐ টাকাগুলি হস্তগত করিবার চেষ্টায় আছে। আরও শুনিতে পাইতেছি যে, আমাদিগের বীমা অফিসের ন্যায় আরও কয়েকটি বীমা অফিসেও ঐ হরেকৃষ্ণ তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল। ব্রজবন্ধু ঐ সকল অফিস হইতেও অনেক টাকা আদায় করিয়া লইবার চেষ্টায় ছিল। এই সকল কারণে আমি আপনার সাহায্য প্রার্থনা করিতেছি। আপনি একজন উপযুক্ত ও বিশ্বাসী কৰ্ম্মচারীর দ্বারা এই বিষয়ের অনুসন্ধান করিয়া দেখুন যে, ব্রজবন্ধু ঐ সকল টাকা প্রাপ্ত হইবার প্রকৃত পাত্র কি সে প্রকৃতই জুয়াচুরি করিয়া ঐ সকল অর্থ হস্তগত করিতে বিশেষ চেষ্টা করিতেছে। আপনার কর্ম্মচারীর অনুসন্ধানের উপর নির্ভর করিয়া আমরা কার্য্য করিব, অর্থাৎ তাঁহার অনুসন্ধানে যদি সাব্যস্ত হয় যে, ব্রজবন্ধ অসৎ উপায় অবলম্বন করিয়া আমাদিগের নিকট হইতে ঐ টাকা আদায় করিবার চেষ্টা করিতেছে, তাহা হইলে আমরা তাহার উপর ফৌজদারী মোকদ্দমা চালাইয়া যাহাতে ঐরূপ জুয়াচোর বিশেষ দণ্ডে দণ্ডিত হয়, সাধ্যমত তাহার চেষ্টা করিব। আর অনুসন্ধানে যদি ইহাই সাব্যস্ত হয় যে, ব্রজবন্ধু বিধান অনুসারে ঐ টাকা প্রাপ্ত হইবার প্রকৃত অধিকারী, তাহা হইলে তদ্দণ্ডেই আমরা তাহাকে সমস্ত অর্থ এককালীন প্রদান করিব।”
পত্রখানি পাঠ করিয়া সৰ্ব্বপ্রথমেই ঐ পত্র লেখকের সহিত সাক্ষাৎ করিবার আমার প্রয়োজন হইল। কিন্তু তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইবার পূর্ব্বেই আমার মনে হইল যে, ব্রজবন্ধু যখন ঐ টাকা পাইবার নিমিত্ত যে সকল প্ৰমাণ প্রয়োগের প্রয়োজন, তাহার সমস্তই প্রদান করিয়াছে, এবং যখন বীমা অফিসও ঐ টাকা প্রদান করিতে প্রস্তুত ছিলেন বলিতেছেন, তখন ইহা যে জুয়াচুরি ঘটনা, তাহা এখন তাঁহারা কিরূপ জানিতে পারিলেন। অনেকে বলিয়া থাকে যে, যখন বীমা অফিসকে একেবারে অনেক টাকা প্রদান করিতে হয়, সেই সময় কিছু না কিছু গোলযোগ বাহির করিয়া যাহাতে ঐ টাকা প্রদান করিতে না হয়, তাহার চেষ্টা করিতে তাঁহারা ত্রুটী করেন না। দশ হাজার টাকা নিতান্ত কম নহে। এ দেশের কয়জন ব্যক্তি তাঁহার সারা জীবন উপার্জ্জন করিয়া চরমে দশ হাজার টাকার সংস্থান রাখিয়া যাইতে পারেন! সহস্রের মধ্যে এক ব্যক্তি পারেন কিনা সন্দেহ। এতগুলি টাকা একজন দেশীয় লোক সহজে পাইতে বসিয়াছে বলিয়া ত, বিমা কোম্পানি তাহাকে ঐ অর্থ হইতে বঞ্চিত করিবার জন্য আমাদিগের সাহায্য গ্রহণ করিতেছেন না? মনে মনে এইরূপ ভাবেরও একবার উদয় হইয়াছিল, কিন্তু মনের সে ভাব কাহারও নিকট প্রকাশ না করিয়া, আপন মনে রাখিয়াই ঐ অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলাম, ও পরিশেষে দেখিলাম, আমার মনে যে ভাবের উদয় হইয়াছিল, তাহা সম্পূর্ণরূপে ভ্রমাত্মক। পাঠকগণও তাহার প্রমাণ ক্রমে প্রাপ্ত হইবেন।
আমি পূৰ্ব্বকথিত বিমা অফিসের প্রধান ইংরাজ কর্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, ও তাঁহাকে তাঁহার লিখিত পত্রখানিও দেখাইলাম। তিনি পত্র দেখিয়া ও আমার কথা শুনিয়া বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার প্রার্থনামত পুলিসের প্রধান সাহেব আমাকেই তাঁহার প্রস্তাবিত বিষয়ের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত প্রেরণ করিয়াছেন। তখন তিনি আমাকে সঙ্গে করিয়া তাঁহার অফিসের একটি নির্জ্জন প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলেন, ও ঐ বিষয় সম্বন্ধে যাহা কিছু তাঁহার বক্তব্য ছিল, তাহার সমস্তই আমাকে কহিলেন। আমি তাঁহার নিকট হইতে সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপে অবগত হইয়া, পরিশেষে ঐ সম্বন্ধে যে সকল কাগজ পত্র ছিল, তাহা তাঁহার নিকট হইতে চাহিলাম। সাহেবও সমস্ত কাগজ আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি সেই স্থানে বসিয়াই ঐ সমস্ত কাগজ এক একখানি করিয়া পড়িয়া দেখিলাম, ও উহার মর্ম্ম উত্তমরূপে অবগত হইলাম। ঐ সমস্ত কাগজ বা তাহার মর্ম্ম কি, তাহারও পরিচয় আমি পাঠকগণকে বিস্তারিতরূপে পরে প্রদান করিব।
ঐ সমস্ত কাগজ-পত্র দেখিয়া সমস্ত বিষয় অবগত হইলাম সত্য, কিন্তু ব্রজবন্ধু জুয়াচুরি করিয়া ঐ টাকা বাহির করিয়া লইবার চেষ্টা করিতেছে, তাহার কোনরূপ নিদর্শন ঐ সকল কাগজ-পত্র হইতে কিছুমাত্র প্রাপ্ত হইলাম না।
তখন আমি সাহেবকে কহিলাম, “আপনি আমাকে যে সকল কাগজপত্র প্রদান করিলেন, তাহা দেখিয়া বেশ অনুমান হইতেছে যে, ইহার ভিতর কোনরূপ জুয়াচুরি কাণ্ড নাই। কিন্তু ইহা জুয়াচুরি বলিয়া আপনার বিশ্বাস হইল কি প্রকারে?”
আমার কথা শুনিয়া, সেই বীমা অফিসের বড় সাহেব আমার হস্তে আর একখানি পত্র প্রদান করিলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
সাহেব আমাকে পত্রখানি প্রদান করিলেন, তাহার মোড়ক দেখিয়া বুঝিলাম, উহা ডাকে আসিয়াছে; কারণ উহার উপর ডাকের মোহর বর্ত্তমান। পত্রখানি পাড়িলাম, উহাতে লেখকের নাম নাই। পত্রখানি ইংরাজিতে লেখা; উহার সারমর্ম্ম এরূপ,–
“আমি জানি, আপনাদিগের অফিসে একটি ভয়ানক জুয়াচুরি হইয়াছে। কেবল আপনাদিগের অফিসেই বা বলি কেন, কলিকাতায় যে কয়টি প্রধান প্রধান বীমা অফিস আছে, তাহার মধ্যে প্রায় সমস্ত অফিসেই ঐরূপ জুয়াচুরি হইয়াছে। কোন এক অজানিত ব্যক্তির জীবন, ঐ সকল বীমা অফিসে, ব্রজবন্ধু নামক এক ব্যক্তির দ্বারা বীমা করান হয়, ও ঐ বীমাকারী ব্যক্তি মরিয়া গিয়াছে বলিয়া, যত টাকায় তাহার জীবন বীমা করান হইয়াছিল, তাহার সমস্ত এখন ঐ ব্রজবন্ধু লইবার চেষ্টা করিতেছে, ও শুনিলাম, প্রায় কৃতকাৰ্য্যও হইয়াছে। কোন এক বিশ্বাসী কৰ্ম্মচারী দ্বারা অনুসন্ধান করিলেই জানিতে পারিবেন যে, আমার কথা সত্য কি না? ব্রজবন্ধু টাকাগুলি প্রাপ্ত হউক বা না হউক, তাহাতে আমার লাভ বা লোকসান কিছুই নাই, তবে একজন জুয়াচুরি করিয়া নিরর্থক অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করিতে বসিয়াছে দেখিয়া, ভাবিলাম, এই সংবাদ আপনাদিগকে প্রদান করা আমার কর্তব্য কৰ্ম্ম; এই নিমিত্তই আমি আপনাকে এই সংবাদ প্রদান করিতেছি, এখন যেরূপ সঙ্গত মনে করেন, সেইরূপ করিবেন। আমি ব্রজবন্ধুর নিকট পরিচিত বলিয়া আমার নাম এই পত্রে প্রকাশ করিলাম না, একটু বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলেই জানিতে পারিবেন, আমার কথা কতদূর সত্য।” আমি ঐ পত্রখানি পাঠ করিয়া সাহেবকে কহিলাম, “এই পত্র পাইয়াই কি আপনার সন্দেহ হইয়াছে যে, ব্রজবন্ধু জুয়াচুরি করিয়া এতগুলি টাকা আপনাদিগের অফিস হইতে বাহির করিয়া লইতে বসিয়াছে?”
সাহেব। হাঁ।
আমি। এই পত্র ব্যতীত বোধ হয় আর কোন কারণ নাই, যাহাতে আপনি মনে করিতে পারেন, এ সমস্তই জুয়াচুরি কাণ্ড?
সাহেব। না।
আমি। পত্রের লিখিত সমস্ত বিষয়গুলি বোধ হয় সত্য হইলেও হইতে পারে।
সাহেব। সত্য বলিয়াই আমার অনুমান হয়।
আমি। মিথ্যা হইলেও হইতে পারে।
সাহেব। মিথ্য সংবাদ দেওয়ার কারণ?
আমি। শত্রুতা।
সাহেব। চিঠির ভাবে ত বোধ হয় না যে, লেখকের সহিত ব্রজবন্ধুর কোনরূপ শত্রুতা আছে।
আমি। শত্রুতা দেখাইয়া পত্র লিখিলে আপনি সে পত্র বিশ্বাস করিবেন কেন? আমাদিগের দেশে এরূপ ঘটনা হইয়াই থাকে। কাহারও সহিত কাহারও যদি কোনরূপ শত্রুতা থাকে, তাহা হইলে সুযোগ পাইলেই পরস্পর শত্রুতা করিতে কেহই ত্রুটী করে না। তৎব্যতীত আর এক প্রকৃতির লোক সচরাচর এই দেশে দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার কোন ব্যক্তিকে কোনরূপে উপার্জ্জন করিয়া নিজের অন্নকষ্ট দূর করিতে সমর্ত দেখিলেই, তাহাদের চক্ষুশূল হইয়া উঠে ও যাহাতে তাহার সেই উপার্জিত অর্থ কোন না কোনরূপে ব্যয়িত হইয়া যায়, তাহার নিমিত্ত স্বতপরতঃ নানারূপ চেষ্টা করিয়া থাকেও তাহাকে নিরর্থক বিপদে নিক্ষিপ্ত করিতে কোনরূপে পরাঙ্মুখ হয় না। এই নিমিত্তই আমি বলিতেছি যে, এই পত্রের লিখিত বিষয়গুলি সম্পূর্ণরূপ সত্য হইলেও ইহতে পারে অথবা মিথ্যা হইলেও হইতে পারে। সে যাহা হউক, ইহার অনুসন্ধানে যখন হস্তক্ষেপ করিয়াছি, তখন ইহার প্রকৃত তথ্য নিশ্চয়ই বাহির হইয়া পড়িবে।
সাহেব। এই বিষয় উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া যদি দোষী ব্যক্তিকে আপনি দণ্ড প্রদান করাইতে পারেন, তাহা হইলে জানিবেন, আমি আপনাকে বিশেষরূপ পারিতোষিক প্রদান করিব।
আমি। পারিতোষিকের বিষয় আমাকে বলা আপনার কর্তব্য নহে, সে সম্বন্ধে আপনার যদি কোন কথা বলিবার ইচ্ছা থাকে, আপনি আমার সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর নিকট বলিতে পারেন। এখন আমাকে অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে দিউন যে, বেনামা পত্রে যাহা বর্ণিত আছে, তাহা সত্য–কি ব্রজবন্ধু বাবু প্রকৃতই টাকা পাইবার অধিকারী
আমার কথা শুনিয়া সাহেব যেন একটু অপ্রতিভ হইলেন, ও কহিলেন, “আমার নিকট আপনার আর কোন বিষয় জিজ্ঞাস্য আছে কি?”
আমি। আমি এখন সামান্য আর দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি।
সাহেব। কি?
আমি। ব্রজবন্ধুবাবুকে আপনার অফিসের কোন লোক চিনে কি?
সাহেব। চিনে।
আমি। কে চিনে?
সাহেব। আমি নিজে তাহাকে দুই তিনবার দেখিয়াছি, সুতরাং তাহাকে দেখিলেই চিনিতে পারিব।
আমি। আর কেহ চিনে?
সাহেব। অফিসের আরও দুই চারিজন কর্মচারী তাহাকে চিনে।
আমি। তাহারা কি সূত্রে ব্রজবন্ধুকে চিনে?
সাহেব। ব্রজবন্ধু নিজে দুইবার অফিসে আসিয়া প্রিমিয়মের টাকা জমা দিয়া গিয়াছিল, সুতরাং যে সকল কর্ম্মচারীর নিকট টাকা জমা দিতে হয়, তাহারা সকলেই উহাকে চিনে। হরেকৃষ্ণ মরিয়া যাইবার পর, টাকা বাহির করিবার নিমিত্ত ব্রজবন্ধু অনেকবার অফিসে আসিয়াছে, সেই সময় প্রায় সকলেই তাহাকে দেখিয়াছে।
আমি। হরেকৃষ্ণকে কি কেহ চিনিত?
সাহেব। উহার জীবনবীমা যে দালালের মারফৎ হয়, সে উহাকে চিনিত। যে ডাক্তার উহার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়াছিল, সে উহাকে চিনিত, জীবন বীমা করিবার সময় সে অফিসেও দুই চারিবার আসিয়াছিল, সেই সময় যে যে কৰ্ম্মচারী তাহাকে দেখিয়াছে, তাহারা সকলেই তাহাকে চিনিত; এবং ঐ জীবনবীমা ব্রজবন্ধকে বিক্রয় করিবার সময় উহারা উভয়েই অফিসে আসিয়াছিল, সেই সময়ও যে যে কর্ম্মচারী উহাদিগকে দেখিয়াছিল তাহারাও অনায়াসে চিনিতে পারে।
সাহেবের নিকট কেবল মাত্র এই কয়েকটি বিষয় অবগত হইয়া আমি সে দিবস বিদায় গ্রহণ করিলাম। যাইবার সময় বলিয়া গেলাম, আবশ্যকমত আসিয়া তাঁহার সহিত পুনরায় সাক্ষাৎ করিব।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
জীবন বীমা কি, তাহা কলিকাতার পাঠকগণের মধ্যে প্রায় সকলেই অবগত আছেন ও তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকেরই জীবন যে বীমা করা আছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু মফস্বলের পাঠকগণের মধ্যে অনেকে ইহা অবগত নহেন বলিয়া, জীবনবীমার ব্যাপার যে কি, তাহা এই স্থানে সংক্ষেপে একটু বলিতে হইল। এই কলিকাতা সহর ও প্রধান প্রধান নগরীতে জীবন বীমার অনেক অফিস আছে, ইহাদিগের নাম ইংরাজিতে Life Insurence office কহিয়া থাকে। ইহা আজ-কাল একটি প্রধান ব্যবসা কার্য্যের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছে। এই ব্যবসা পূর্ব্বে আমাদিগের দেশে ছিল না, সভ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উহা পাশ্চাত্য প্রদেশ হইতে এখন এদেশে আসিয়া উপনীত হইয়াছে, ও সেই সঙ্গে সঙ্গে অনেক লোক ঐ কার্য্যে দালালরূপে নিযুক্ত হইয়াছে। ঐ কার্য্যের যতগুলি অফিস আছে, প্রত্যেক অফিসের স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র বিস্তর দালাল আছে। তাহারা প্রত্যেকের বাড়ীতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া প্রত্যেককে তাহার জীবন বীমা করাইবার প্রবৃত্তি দিয়া থাকে, ও যাঁহারা তাহাদিগের কথায় সম্মত হইয়া আপনাপন জীবন বীমা করাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তাঁহাদিগকে তাহারা তাহাদিগের অফিসে জীবন বীমা করাইয়া দেয়। মনে করুন, আপনি হাজার টাকায় আপনার জীবন বীমা করিতে ইচ্ছা করিয়া দালালকে কহিলেন। দালাল তাহার অফিস হইতে অমনি কয়েকখানি ফরম আনিয়া উপস্থিত করিল, আপনি ঐ ফরমে যে কথা লিখিবার প্রয়োজন তাহা লিখিয়া পাঠাইয়া দিলেন। ইহার পরেই সেই অফিসের নিয়োজিত ডাক্তারের দ্বারা আপনাকে পরীক্ষা করা হইল। ঐ ডাক্তার আপনাকে উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া আপনার বয়ঃক্রম ও আপনার স্বাস্থ্য প্রভৃতি কিরূপ, তাহা লিখিয়া দিলেন। ঐ ডাক্তারের মতের উপর নির্ভর করিয়া অফিস উহা সাব্যস্ত করিলে, আপনাকে মাসে মাসে বা প্রত্যেক তিন মাস অন্তর কিছু কিছু টাকা জমা দিতে হইবে। আপনি উহাতে সম্মত হইয়া ঐরূপ স্থিরীকৃত টাকা নিয়মমত জমা দিতে লাগিলেন। আপনি যে সহস্র মুদ্রা পাইবার নিমিত্ত টাকা জমা দিতে লাগিলেন, ঐ সহস্র মুদ্রা পাইবার জন্য দুইটি নিয়ম আছে;– অর্থাৎ আপনি আপনার যে বয়ঃক্রমে উপনীত হইলে ঐ টাকা পাইতে ইচ্ছা করেন, আপনি আপনার সেই বয়সে সেই টাকা পাইতে পারেন, অথবা আপনি আপনার জীবিত অবস্থায় ঐ টাকা গ্রহণ না করিয়া উহা আপনার উত্তরাধিকারীর নিমিত্ত রাখিয়া যাইতে পারেন। আপনি যদি প্রথম নিয়মের বশীভূত হইয়া টাকা জমা দিতে প্রবৃত্ত হন, তাহা হইলে, আপনি আপনার সেই নির্দ্দিষ্ট বয়সে উপনীত হইলেই ঐ টাকা প্রাপ্ত হইবেন, আর যদি উহার মধ্যেই, এমন কি, এক মাস টাকা জমা দেওয়ার পরেই আপনার পরলোকপ্রাপ্তি হয়, তাহা হইলে আপনার মৃত্যুর পরই আপনার উত্তরাধিকারী ঐ সহস্র মুদ্রা প্রাপ্ত হইবেন। এইরূপ নিয়মে ক্রমে ক্রমে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত যে টাকা জমা দিতে হয়, হিসাব করিয়া দেখিলে, যে সহস্ৰ টাকা প্রাপ্ত হওয়া যাইবে, তাহার সংখ্যা কোনক্রমেই অতিক্রম করে না, অধিকন্তু টাকা জমা দিতে আরম্ভ করিবার পরেই মৃত্যু হইলে উত্তরাধিকারীর বিশেষরূপ লাভ হইয়া থাকে। আর যদি আপনি দ্বিতীয় নিয়মের বশীভূত হইয়া, মাসে মাসে সামান্য অর্থ জমা দেন, তাহা হইলে আপনার লাভ লোকসান আপনার পরমায়ুর উপর নির্ভর করিবে; অর্থাৎ একমাস বা দুইমাস অথবা কিছুদিবস পর্য্যন্ত টাকা জমা দেওয়ার পর যদি আপনার মৃত্যু হয়, তাহা হইলে আপনার মৃত্যুর পরেই আপনার উত্তরাধিকারী ঐ টাকা প্রাপ্ত হইবেন। মাসিক চাঁদা অল্পদিন দিবার পরেই যাহার মৃত্যু হয়, তাহার উত্তরাধিকারীর পক্ষে বিশেষরূপ লাভ হইয়া থাকে। আর যিনি দীর্ঘকাল বাঁচিয়া মাসে মাসে বা নিয়মিতরূপে নিয়মিত চাঁদা প্রদান করিয়া থাকেন, তাঁহার সমস্ত জীবনে তিনি যে টাকা জমা দেন, সময় সময় তাঁহার প্রাপ্ত টাকা অপেক্ষা চাঁদা জমা দিবার টাকার সংখ্যা অধিক হইয়া যায়। এরূপ অবস্থায় তাঁহার ওয়ারিশগণ তাঁহার জমা দেওয়া টাকা অপেক্ষা কম পাইলেও অর্থটি একেবারে প্রাপ্ত হয়েন বলিয়া বিশেষ লাভ মনে করিয়া থাকেন। কারণ সেই সময় যতগুলি টাকা একেবারে প্রাপ্ত হওয়া যায়, এতগুলি টাকা একস্থানে জমা করা অনেকের পক্ষে সহজ হয় না।
আমি হাজার টাকায় জীবন বীমা রাখার উদাহরণ প্রদান করিলাম। কিন্তু পাঠকগণ মনে করিবেন না যে, হাজার টাকার অধিক জীবন বীমা হয় না, বা এক অফিসে একজনের জীবন বিমা থাকিলে অপর অফিসে তাঁহার জীবন পুনরায় বীমা হয় না। যে কোন ব্যক্তি যত টাকায় ও যত অফিসে আপনার জীবন বীমা করিতে ইচ্ছা করেন, তিনি তত টাকায় ও তত অফিসে ইচ্ছামত আপনার জীবন যে কোন নিয়মে বীমা করিতে পারেন। দেখা গিয়াছে, এই কলিকাতা সহরের মধ্যে অনেকের জীবন হাজার, অনেকের দুই হাজার, অনেকের পাঁচ হাজার, অনেকের দশ হাজার, অনেকের পঁচিশ হাজার, অনেকের পঞ্চাশ হাজার ও অনেকের লক্ষ মুদ্রা পর্যন্ত যে কয় অফিসে ইচ্ছা, সেই কয় অফিসে পৃথক পৃথকরূপে বীমা করা আছে ও তাঁহারা সেইরূপ পরিমাণে চাঁদার টাকা কেহ মাসিক, কেহ ত্রৈমাসিক, কেহ ছয় মাস অন্তর ও কেহ বা বৎসর বৎসর জমা দিয়া আসিতেছেন।
এইরূপ জীবন বীমার কেনা-বেচা ও বন্ধক দেওয়ার কারবারও বাজারে চলিয়া থাকে। যদি কোন ব্যক্তির হঠাৎ কিছু টাকার প্রয়োজন হয়, তিনি ইচ্ছা করিলে তাঁহার সেই জীবন বীমা সেই অফিসে বন্ধক রাখিয়া অনায়াসেই কিছু টাকা পাইতে পারেন, কিন্তু ঐ টাকা প্রাপ্ত হইবার একটি নিয়ম আছে অর্থাৎ যে জীবন বীমা তিনি বন্ধক দিতেছেন, তাহার নিমিত্ত এ পর্যন্ত তিনি যত টাকা ঐ অফিসে জমা দিয়াছেন, তাহারই একটি অংশ তিনি কর্জ্জ স্বরূপ পাইতে পারেন, ইহা ব্যতীত ঐ জীবন বীমা বিক্রয়ও হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি উহা খরিদ করেন, তাঁহাকেও ঐ বীমার নিয়মিত চাঁদা যদি দিবস পর্য্যন্ত যাঁহার জীবন বীমা আছে, বা যত দিবস তিনি জীবিত থাকেন, তত দিবস তাঁহাকে অর্থাৎ জীবন- বীমা খরিদকারীকে জমা দিয়া আসিতে হয়। বীমার সময় উত্তীর্ণ হইলে অথবা বীমাকারীর মৃত্যু হইলে ঐ বীমা অনুযায়ী সমস্ত টাকা যিনি উহা খরিদ করিয়াছেন, তিনি উহা প্রাপ্ত হন।
পাঠকগণের মধ্যে অনেকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন যে, অপরের জীবন বীমা খরিদ করিয়া লাভ কি? উত্তরে ইহা অনায়াসেই বলা যাইতে পারে যে, এরূপ খরিদ বিক্রয় একটি ব্যবসা। ইহাতে সময় সময় লাভালাভও অনেক হইয়া থাকে। মনে করুন, দশ হাজার টাকায় একজনের জীবন বীমা আমি খরিদ করিলাম। খরিদ করিবার অল্প দিন পরেই বীমাকারীর মৃত্যু হইল। মৃত্যুর পর ঐ দশ হাজার টাকা আমি অনায়াসে প্রাপ্ত হইলাম। মনুষ্যের মৃত্যু অনিবার্য্য; তবে সময়ের কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। সুতরাং ইহাও একটি প্রধান ব্যবসায়। সকল ব্যবসাতেই লাভ ও লোকসান আছে। লাভ ও লোকসান আছে বলিয়াই, ব্যবসা কাৰ্য্য চলিয়া থাকে, ইহাও তাহাই। যাঁহাদিগের জীবন বীমা খরিদ করাই ব্যবসা, তাঁহারা সময় সময় (যেখানে বীমাকারীর অল্প পরমায়ু) বিস্তর লাভ করিয়া থাকেন। আর যে সকল বীমাকারী দীর্ঘায়ু, তাহাদিগের জীবন বীমা খরিদ করিয়াও যে তিনি একেবারে লোকসান দিয়া থাকেন, তাহা নহে। পূৰ্ব্বে বলিয়াছি যে, মনুষ্য জীবন চিরস্থায়ী নহে; এক দিবস তাহাকে নিশ্চয়ই মরিতে হইবে, তাহার মৃত্যুর পর তাহার জীবনবীমার টাকা আদায় হইয়া আসিবে। যিনি জীবনবীমা খরিদ করিলেন, তিনি সেই সময় জীবিত থাকেন ভালই, নচেৎ তাঁহার উত্তরাধিকারীগণ যদি ঐ ব্যবসা চালান, তাহা হইলে তাঁহারা নিশ্চয়ই ঐ টাকা প্রাপ্ত হইবেন, সুতরাং ঐ ব্যবসায় লোকসান প্রায়ই হয় না।
জীবন বীমা করিলে বা ঐ জীবনবীমা খরিদ করিলে যে একেবারে কখনও লোকসান হয় না তাহাও নহে। যাঁহারা লব্ধপ্রতিষ্ঠ ও উত্তম অফিসে জীবন বীমা করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগকে কোনরূপে বঞ্চিত হইতে হয় না। কিন্তু এরূপ বীমা অফিসও দেখিতে পাওয়া যায় যে, টাকা প্রদান করিবার সময় উপস্থিত হইলে, কোন না কোন আপত্য উত্থাপন করিয়া যাহাতে ঐ টাকা প্রদান করিতে না হয়, প্রাণপণে তাহার চেষ্টা করিতেও ত্রুটী করেন না।
যে সকল ব্যবসায়ে লাভালাভ আছে, সেই সকল কার্য্যে জুয়াচুরিও অনেক সময় হইয়া থাকে। বীমা অফিস খুলিয়া যাঁহারা বিস্তর লাভ করিয়া থাকেন, সময় সময় জুয়াচোরের হস্তে পড়িয়াও তাঁহাদিগকে বিস্তর ক্ষতি সহ্য করিতে হয়।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
অফিসের কাগজ পত্র দেখিয়া জানিতে পারিলাম, হরেকৃষ্ণ নামক এক ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন বীমা অফিসে এক মাসের মধ্যে তাহার জীবন ত্রিশ সহস্র মুদ্রায় বীমা করিয়াছে। বীমা করিবার পর নিয়মিত চাঁদার টাকা এক মাস প্রদান করিয়াছে, উহার পরেই তাহার সমস্ত বীমা ব্রজবন্ধু নামক এক ব্যক্তির নিকট বিক্রয় করিয়াছে। ব্রজবন্ধু হরেকৃষ্ণের তরফ হইতে দুইবারের চাঁদার টাকা সেই সমস্ত অফিসে জমা দিয়াছে। ইহার পরেই হরেকৃষ্ণ মরিয়া যায়। মরিবার পর ব্রজবন্ধু ত্রিশ সহস্র টাকা পাইবার নিমিত্ত বীমা অফিসে আবেদন করিয়াছে। ঐ আবেদনের সঙ্গে হরেকৃষ্ণের পীড়ার সময় যে ডাক্তার তাহার চিকিৎসা করিয়াছিল, তাহার সার্টিফিকেট আছে। সজ্ঞানে তীরস্থ হইবার পর গঙ্গার ঘাটে যে ডাক্তার তাহাকে দেখিয়াছিল ও যাহার সম্মুখে হরেকৃষ্ণ মরিয়া গিয়াছে, তাহারও সার্টিফিকেট আছে। তৎব্যতীত যাহাদিগের সম্মুখে হরেকৃষ্ণের নিকট হইতে ব্রজবন্ধু জীবন বীমা খরিদ করিয়াছিল, তাহাদিগের নামস্বাক্ষরিত ও বীমা অফিসের অনুমোদিত বিক্রয়-পত্র তাহার সহিত প্রদত্ত হইয়াছে। এই সমস্ত অবস্থা ও কাগজ পত্র দেখিয়া কেহই অনুমান করিতে পারে না যে, ইহার ভিতর কোনরূপ জুয়াচুরি আছে। যে পর্য্যন্ত বেনামা পত্র প্রাপ্ত হওয়া না গিয়াছিল, সেই পৰ্য্যন্ত কাহারও মনে উদয় হয় নাই যে, ইহার ভিতর কোনরূপ জুয়াচুরি আছে।
অনুসন্ধানের ভার আমার উপর প্রদত্ত হইলে ও সমস্ত কাগজ পত্র আমার হস্তগত হইলে, আমারও মনে উদয় হইয়াছিল যে, ইহার ভিতর কোনরূপ জুয়াচুরি নাই। ইহার পরেই আমি ব্রজবন্ধুর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি একটি জমিদার, সহরের নিকটবর্তী কোন স্থানে তাঁহার বাসস্থান। তিনি একজন বড় জমিদার না হইলেও তাঁহার বাৎসরিক পাঁচ, ছয় হাজার টাকা আয় আছে। তৎব্যতীত সময় সময় ব্যবসা বাণিজ্যও করিয়া থাকেন। তিনি অতিশয় মিষ্টভাষী। কোন ব্যক্তি কোনরূপে বিপদাপন্ন হইয়া তাঁহার শরণাগত হইলে, যেরূপে হউক, তিনি তাঁহার ক্ষমতামত তাহার সাহায্য করিতে ত্রুটী করেন না। ঐ স্থানের অধিকাংশ লোকই তাঁহার বশীভূত ও অনুগত। যে গ্রামে তাঁহার বাড়ী, সেই গ্রামে তাঁহারই সমতুল্য আরও একজন জমিদার আছে। তিনিও তাঁহার মত ব্যবসা করিয়া থাকেন। কিন্তু তাঁহার সহিত ব্রজবন্ধু বাবুর বনিবনা নাই। উভয়ে উভয়ের শত্রু। পরস্পর পরস্পরকে বিপদে ফেলিতে কোনরূপ ত্ৰুটী করেন না। উভয়ের মধ্যে কেন যে এরূপ মনোমালিন্য তাহার কারণ গ্রামের কেহই বলিতে পারে না, কিন্তু সকলেই জানে—উভয়ে উভয়ের পরম শত্রু!
ব্রজবন্ধুবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, যে নিমিত্ত আমি সেই স্থানে গিয়াছি, তাহা তাঁহাকে কহিলাম ও ঐ সম্বন্ধে তাঁহার সহিত অনেক কথাবার্তাও হইল; কিন্তু তাঁহার কথাবার্তা শুনিয়া আমি কোনমতেই বিশ্বাস করিতে পারিলাম না যে, এই কার্য্যের ভিতর কোনরূপ জুয়াচুরি আছে। আমি মনে করিয়াছিলাম, ব্রজবন্ধুবাবুর মনে যদি কোনরূপ পাপ থাকে, তাহা হইলে আমার সহিত ঐ সম্বন্ধে কথাবার্তা হইবার সময় তাঁহার ভাব-ভঙ্গি অবলোকন করিয়া, তাঁহার মুখশ্রী পর্যালোচনা করিয়া অনায়াসেই বুঝিতে পারিব যে, ব্রজবন্ধুবাবুর অন্তর পাপে পূর্ণ কি না। কিন্তু তাঁহার সহিত ঐ সম্বন্ধে যতই আমার কথা হইল, ততই তাঁহাকে নিষ্পাপী বলিয়া অনুমান হইতে লাগিল। তাঁহার কথায় কোনরূপ সন্দেহ বা মুখশ্রীর কোনরূপ পরিবর্ত্তন পরিলক্ষিত হইল না। অধিকন্তু কাগজ-পত্র দেখিয়া যাহা কিছু জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত কথাই যে তিনি এক এক করিয়া প্রমাণ করাইতে পারিবেন, তাহা তিনি অকুতোভয়ে কহিতে লাগিলেন। তিনি আরও কহিলেন, হরেকৃষ্ণ যে তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল ও সেই জীবনবীমা যে তাঁহার নিকট বিক্রয় করিয়াছে, এ সম্বন্ধে ভুরি ভুরি অপর প্রমাণ থাকিলেও সেই সকল প্রমাণ বোধ হয় উপস্থিত করিবার প্রয়োজন হইবে না। কারণ যে যে অফিসে হরেকৃষ্ণ তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল, সেই সেই অফিসের কর্ম্মচারীগণ ও কর্ম্মাধ্যক্ষ সাহেব সকল তাহার প্রমাণ দিতে পারিবেন। আবার যখন তাহার জীবন বীমা হয়, ও যখন সে জীবনবীমা বিক্রয় করে,–তখন সেই সকল অফিসের ভিতরেই তাঁহাদিগের সম্মুখে ও তাঁহাদিগের স্বাক্ষর অনুযায়ী হইয়াছিল, সুতরাং এ সম্বন্ধে কোনরূপ সন্দেহই হইতে পারে না। আর হরেকৃষ্ণ যে মরিয়া গিয়াছে, সে বিষয়েও কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। যে বাড়ীতে সে বাস করিত, পীড়িত অবস্থায় যে চিকিৎসক তাহার চিকিৎসা করিয়াছিল, যে চিকিৎসকের সম্মুখে সে মানবলীলা সম্বরণ করে, তাঁহারা সকলেই এখনও বিদ্যমান। তাঁহারা দেশের মধ্যে গণ্যমান্য ও প্রসিদ্ধ লোক। তাঁহাদিগের খ্যাতি সহর বিদিত। তাঁহারা কোনরূপ মিথ্যা কহিবার লোক নহেন। তাঁহাদিগের নিকট জিজ্ঞাসা করিলেই আপনার মনে আর কোনরূপ সন্দেহ থাকিবে না।
ব্রজবন্ধুর কথা শুনিয়া আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তাঁহাদিগের সহিত কোথায় ও কখন দেখা হইতে পারে?” ব্রজ। তাঁহারা সর্ব্ব পরিচিত লোক, ইচ্ছা করেন তো তাঁহাদিগের ঠিকানা আমার নিকট হইতে লইতে পারেন, ও আপনি তাঁহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া সমস্ত বিষয় অবগত হইতে পারেন। আর বলেন ত আমি আপনার সহিত যাইয়া তাঁহাদিগকে দেখাইয়া দিই। আপনি নিশ্চয়ই জানিবেন, এ কার্য্যের ভিতর কোনরূপ প্রতারণা নাই, আমার নিতান্ত সৌভাগ্য যে, আপনার হস্তে ইহার তদন্তের ভার অর্পিত হইয়াছে। কারণ অনুসন্ধানে আপনি জানিতে পারিবেন, ইহা প্রতারণাশূন্য কারবার, সুতরাং আমার টাকা পাইতে আর অধিক বিলম্ব হইবেক না।
আমি। ইহার ভিতর যদি কোনরূপ প্রতারণা না থাকে, তাহা হইলে বীমা অফিস আপনাকে টাকা দিতে গোলযোগ করিতেছে কেন?
ব্রজ। অনেক বীমা অফিস ন্যায্য টাকা দিবার সময় নানারূপ গোলযোগ উত্থাপিত করিয়া যাহাতে ঐ টাকা প্রদান না করিতে হয়, তাহার চেষ্টা করিতে ত্রুটী করে না। যাঁহার টাকা এইরূপে ঐ সকল অফিসে প্রাপ্য হয়, তিনি যদি দুর্ব্বল হয়েন, বা তাঁহার যদি সেরূপ অভিভাবক না থাকে, তাহা হইলে তিনি প্রায় ঐ অর্থে বঞ্চিত হন। এই জন্যই অর্থ প্রদান করিবার সময় উহারা নানারূপ গোলযোগ উঠাইয়া থাকে।
আমি। যদি আপনার টাকা ন্যায্য প্রাপ্য হয়, তাহা হইলে এইরূপ গোলযোগ উঠাইয়া উহারা আপনার কোনরূপ ক্ষতি করিতে পারিবে না, ইহা আপনি নিশ্চয়ই জানিবেন; কিন্তু ইহার ভিতর যদি কোনরূপ জুয়াচুরি থাকে, তাহা হইলে ইহাও আপনি নিশ্চয় জানিবেন যে, ঐ জুয়াচুরিকার্য্যের নিমিত্ত আপনাকে শ্রীঘরে বাস করিতে হইবে।
ব্রজ। আমার এই কার্যে কোনরূপ জুয়াচুরি প্রকাশ পায়, তাহা হইলে আপনি নিশ্চয়ই জানিবেন যে, জেলে যাইতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। একটু অনুসন্ধান করিলেই আপনি অনায়াসে জানিতে পারিবেন যে, বীমা অফিস মিথ্যা গোলযোগ বাধাইয়া আমার প্রাপ্য অর্থ হইতে বঞ্চিত করিবার চেষ্টা করিতেছে।
আমি। সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিত্ত থাকুন, সাধ্যমত আমি নিরপেক্ষ ভাবে অনুসন্ধান করিতে ত্রুটী করিব না। আমার অনুসন্ধানে আপনার প্রাপ্য অর্থ যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে অনায়াসেই উহা প্রাপ্ত হইবেন। এখন আমি আপনাকে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি, আপনি তাহার প্রকৃত উত্তর দিতে প্রস্তুত আছেন কি না?
ব্রজ। কেন উত্তর দিব না, আপনি আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাহার উত্তর অবশ্যই আমার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইবেন।
আমি। আপনি কহিয়াছেন যে, হরেকৃষ্ণ নামক একব্যক্তি তাহার জীবন বীমা করে ও আপনি তাহার জীবন বীমা খরিদ করিয়া লয়েন।
ব্রজ। হাঁ, এ কথা আমি বলিয়াছি।
আমি। হরেকৃষ্ণ কে?
ব্রজ। হরেকৃষ্ণ যে কে, তাহা আমি ঠিক বলিতে পারি না। বাল্যকালে তাঁহার সহিত একত্রে ও এক স্কুলে আমি অধ্যয়ন করিতাম, তখন তিনি একটি বাসায় অপর ছাত্রগণের সহিত বাস করিতেন। স্কুল পরিত্যাগ করিবার পর তিনি যে কি কার্য্য করিতেন, তাহা আমি অবগত নহি; কিন্তু মধ্যে মধ্যে প্রায়ই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইত। তিনি সর্ব্বদাই নিজের গাড়ী চড়িয়া বেড়াইতেন। তাঁহাকে দুই একবার আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছি যে, তিনি কি কার্য্য করিয়া থাকেন। তাঁহার কথার উত্তরে এই মাত্র বুঝিয়াছিলাম যে, তাঁহার স্থাবর বিষয় হইতে যে আয় হইয়া থাকে তাহাই তাহার পক্ষে যথেষ্ট, অপর কোন কার্য্য করিবার প্রয়োজন হয় না। আমি আরও জানিতাম যে, তাঁহার জন্মভূমি বাখরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত কোন একটি পল্লীতে। গ্রামটির নামও আমি তাঁহার নিকট শুনিয়াছিলাম, কিন্তু এখন আমার সে নাম মনে হয় না। আমি তাঁহার জন্মভূমিতে কখনও যাই নাই, তিনিও তাঁহার দেশে খুব কমই যাইতেন। তাঁহার থাকিবার প্রধান স্থান —এই কলিকাতা সহরই ছিল। সময় সময় স্থানে স্থানে বাড়ী ভাড়াও করিয়া তিনি বাস করিতেন। আমি কিন্তু তাঁহার বাগানবাড়ীতে ইতিপূর্ব্বে কখনও যাই নাই। যে সময় তিনি তাঁহার জীবন বীমা আমার নিকট বিক্রয় করেন, সেই সময় তিনি জানবাজারের একটি বাড়ীতে বাস করিতেন। ঐ বাড়ীতে আমি গিয়াছিলাম ও আপনি ইচ্ছা করেন তো আপনাকে সেই বাড়ী দেখাইয়া দিতে পারি।
আমি। আপনি যাহাকে উত্তমরূপে চিনেন না, তাহার জীবন বীমা আপনি খরিদ করিলেন কেন?
ব্রজ। আপনি বোধ হয় অবগত আছেন যে, ব্যবসা কার্য্যে আমি বিশেষরূপে নিযুক্ত। যাহা কিছু আমি বিষয় সম্পত্তি করিয়াছি, তাহার সমস্তই আমার ব্যবসা হইতে; সুতরাং ব্যবসার খাতিরে আমি হরেকৃষ্ণের জীবন বীমা খরিদ করিয়াছিলাম।
আমি। হরেকৃষ্ণ যে সময় তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল, সেই সময় সে কোথায় থাকিত?
ব্রজ। শুনিয়াছি, জানবাজারের বাড়ীতেই তখন তিনি বাস করিতেন।
আমি। যে সময় সে তাহার জীবন বীমা করে, সে সময় আপনি উহা জানিতেন কি?
ব্রজ। না—আমি জানিতাম না। ঐ জীবন বীমা যখন তিনি বিক্রয় করিতে প্রস্তুত হন, তখনি আমি প্রথম জানিতে পারি যে, তাঁহার জীবন বীমা করা আছে।
আমি। আপনার নিজের জীবন বীমা করা আছে কি?
ব্রজ। আছে, কিন্তু অতি অল্প টাকায়!
আমি! কত টাকায়?
ব্ৰজ। পাঁচশত টাকায়
আমি। হরেকৃষ্ণের জীবন বীমা খরিদ করিবার পর হইতে যখন আপনাকে চাঁদার দেয় টাকা প্রদান করিতে হইতেছে, তখন আরও অধিক অর্থে নিজের জীবন বীমা করিতে অনায়াসেই পারিতেন, তাহা না করিয়া পরের জীবন বীমা খরিদ করিলেন কেন?
ব্রজ। আমি সে চেষ্টাও করিয়াছিলাম, কিন্তু তাহাতে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারি নাই। কারণ এখন আমার শরীরের যেরূপ অবস্থা, তাহাতে কোন ডাক্তার আমার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সার্টিফিকেট দিতে পারেন না। বিশেষ আমাদিগের দেশীয় লোকের যে বয়স পর্যন্ত জীবন বীমা হইয়া থাকে, আমার সে বয়ঃক্রম অতীত হইয়া গিয়াছে, সুতরাং নিজের জীবন বীমা করিতে অসমর্থ হইয়া পরের জীবন বীমা খরিদ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি।
আমি। হরেকৃষ্ণের আর কে আছে?
ব্রজ। তাহা আমি বলিতে পারি না। জানবাজারের বাড়ীতে আমি যত বার গিয়াছি, তাঁহাকে একাকীই দেখিয়াছি। পরিবারবর্গের মধ্যে অপর আর কাহাকেও আমি সেই বাড়ীতে দেখি নাই, দেখিবার মধ্যে কেবল দুই একটি ভৃত্যকে ঐ বাড়ীতে দেখিতে পাইতাম।
আমি। মৃত্যুর পূর্ব্বে আপনি তাঁহাকে ঐ বাড়ী হইতে স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন না?
ব্রজ। হাঁ, আমিই তাঁহাকে তীরস্থ করিয়াছিলাম।
আমি। তাহার যে সকল ভৃত্য ছিল, তাহারা এখন কোথায়?
ব্রজ। তাহা আমি বলিতে পারি না, তাঁহার মৃত্যুর পর তাহারা কে কোথায় চলিয়া গিয়াছে।
আমি। আপনি কহিলেন যে, তাহার আর কেহই ছিল না, তাহা হইলে যে সকল দ্রব্যাদি রাখিয়া হরেকৃষ্ণ ইহজীবন পরিত্যাগ করে, সে সমস্ত দ্রব্যাদি কে গ্রহণ করিয়াছে, তাহাও কি আপনি লইয়াছেন?
ব্রজ। না, তাঁহার পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি আমি কিছুই গ্রহণ করি নাই। যাঁহার বাড়ীতে তিনি বাস করিতেন, বাড়ী ভাড়ার নিমিত্ত তাঁহার কিছু অর্থ হরেকৃষ্ণের নিকট পাওনা ছিল, সেই অর্থের জন্য তিনি তাঁহার পরিত্যক্ত সমস্ত দ্রব্য গ্রহণ করিয়াছেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
ব্রজবন্ধুর সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, আমি সে দিবসের মত তথা হইতে প্রস্থান করিলাম। পরদিবস বীমা অফিসে গিয়া অনুসন্ধান করিয়া আমি জানিতে পারিলাম যে, হরেকৃষ্ণের জীবন বীমা করা ও পরিশেষে তাহা ব্রজবন্ধুর নিকট বিক্রয় করা সম্বন্ধে ব্রজবন্ধু আমাকে যাহা যাহা বলিয়াছিল, তৎসমস্তই প্রকৃত অর্থাৎ তাহার জীবন বীমা করিবার সময় অফিসের অনেকেই তাহাকে দেখিয়াছিল, অফিসের ডাক্তার তাহার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়াছিল, ইহাদিগের অনেকের স্বাক্ষর ঐ বীমাপত্রে ও তাহার সংসৃষ্ট কাগজ পত্রে আছে। হরেকৃষ্ণ যে ব্রজবন্ধুর নিকট তাহার বীমা-পত্র বিক্রয় করে, তাহাও ঐ অফিসের কর্ম্মচারীগণের জ্ঞাতানুসারে হয় ও অফিসের প্রধান ইংরেজ কর্মচারীও এই জীবনবীমা বিক্রয়ের একজন সাক্ষী। অফিসের প্রধান ইংরেজ কর্মচারী ও অপরাপর কর্ম্মচারিগণ শপথ করিয়া এখনও বলিতে প্রস্তুত যে, যে হরেকৃষ্ণ তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল, সেই হরেকৃষ্ণই ঐ জীবন বীমা ব্রজবন্ধুর নিকট বিক্রয় করিয়াছে।
এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে অনুসন্ধেয় বিষয়টি আমাকে দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া লইতে হইয়াছিল। প্রথম যে হরেকৃষ্ণ তাহার জীবন-বীমা করিয়াছিল, সেই হরেকৃষ্ণ অর্থাৎ সেই ব্যক্তি ব্রজবন্ধুর নিকট জীবন বীমা বিক্রয় করিয়াছিল কি না?
অফিসে অনুসন্ধান করিয়া আমার অনুসন্ধানের প্রথম অংশ শেষ হইয়া গেল; বুঝিতে পারিলাম, ইহাতে কোনরূপ জুয়াচুরি নাই।
এখন আমি আমার অনুসন্ধানের দ্বিতীয় অংশে হস্তক্ষেপ করিলাম। উহা আর কিছুই নহে, হরেকৃষ্ণ নামে যে ব্যক্তি তাহার জীবন-বীমা করিয়া পরিশেষে ব্রজবন্ধুর নিকট ঐ জীবনবীমা বিক্রয় করে, সেই ব্যক্তিই প্রকৃত মরিয়াছে কি না? আর যদি সে প্রকৃতই মরিয়া না থাকে—তাহা হইলে সে এখন কোথায় আছে?
আমার অনুসন্ধানের দ্বিতীয় অংশে হস্তক্ষেপ করিয়া প্রথমেই জানবাজারের যে বাড়ীতে হরেকৃষ্ণ বাস করিত, সেই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, ঐ বাড়ীতে তালা বন্ধ ও উহাতে লেখা আছে যে, এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, ঐ বাড়ীর সত্বাধিকারী একজন হাইকোর্টের উকিল, ঐ বাড়ীর সন্নিকটেই তাঁহার বাড়ী। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি নিজে আমার জিজ্ঞাস্য বিষয় কিছুই বলিতে পারিলেন না। কহিলেন, তাঁহার সরকারের সহিত সাক্ষাৎ করিলে তিনি সমস্ত কথায় উত্তর দিতে সমর্থ হইবেন। সে দিবস তাঁহার সরকারের সহিত সাক্ষাৎ হইল না, কিন্তু পরিশেষে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইলে জানিতে পারিলাম যে, হরেকৃষ্ণ নামক এক ব্যক্তি ছয় মাসের এগ্রিমেন্ট লিখিয়া দিয়া ঐ বাড়ী ভাড়া লইয়াছিলেন, পরে ব্রজবন্ধু নামক এক ব্যক্তি কখন কখনও ঐ বাড়ীতে হরেকৃষ্ণের নিকট আসিত, ইহাও তিনি দেখিয়াছেন। তিনি শুনিয়াছিলেন, হরেকৃষ্ণ ঐ বাড়ীতে পীড়িত হন, ডাক্তার আসিয়া তাঁহার চিকিৎসা করেন ও পরিশেষে ব্রজবন্ধু তাঁহাকে ঐ বাড়ী হইতে লইয়া যান, কিন্তু তিনি হরেকৃষ্ণের পীড়িত অবস্থায় তাহাকে দেখেন নাই, ডাক্তার আসিবার সময় বা স্থানান্তরিত করিবার সময়ও তিনি উপস্থিত ছিলেন না। হরেকৃষ্ণ ঐ বাড়ী হইতে স্থানান্তরিত হইবার তিন চারি দিবস পরে ব্রজবন্ধুর নিকট হইতে তিনি জানিতে পারেন যে, হরেকৃষ্ণ মরিয়া গিয়াছে। যে ঘরে হরেকৃষ্ণ বাস করিতেন, সেই ঘরে তাঁহার অতি সামান্যই জিনিস পত্র ছিল, ঐ সমস্ত জিনিস ঐ বাড়ী ভাড়ার নিমিত্ত আটক করিয়া রাখা হইয়াছে।
হরেকৃষ্ণের দুইজন ভৃত্য সদা সৰ্ব্বদা ঐ বাড়ীতে বাস করিত। হরেকৃষ্ণের সঙ্গে সঙ্গে তাহারও ঐ বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাহার পর উহাদিগকে আর তিনি দেখেন নাই।
সরকারের নিকট হইতে এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া ঐ বাড়ী ভাড়া লইবার কালীন হরেকৃষ্ণ যে এগ্রিমেন্ট লিখিয়া দিয়াছিল, তাহা তাঁহার নিকট হইতে চাহিয়া লইলাম। দেখিলাম, উহাতে হরেকৃষ্ণের সহি আছে। তাহার জীবন- বীমা ব্রজবন্ধুর নিকট বিক্রয় করিবার কালীন তাহাতে তিনি যে সহি করিয়াছিলেন ও বীমা অফিসের অপরাপর কাগজ পত্রে তাহার যে সকল স্বাক্ষর ছিল, তাহার সহিত উহা মিলাইয়া দেখিলাম। দেখিলাম, উহা এক জনেরই সহি সুতরাং বুঝিতে পারিলাম, যে হরেকৃষ্ণ আপন জীবনবীমা করিয়া পরিশেষে ব্রজবন্ধুর নিকট বিক্রয় করিয়াছিল, সেই হরেকৃষ্ণই জানবাজারের ঐ বাড়ী ভাড়া করিয়া তথায় কয়েক মাস কাল অতিবাহিত করিয়াছিল।
ইহার পর যে ডাক্তার জানবাজারের বাড়ীতে হরেকৃষ্ণের চিকিৎসা করিয়াছিলেন, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি ব্রজবন্ধুর একজন পরিচিত ডাক্তার, তাঁহার বাড়ীতে মধ্যে মধ্যে তিনি চিকিৎসাও করিয়া থাকেন। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া অবগত হইলাম, ব্রজবন্ধুবাবুই তাঁহাকে ডাকিয়া জানবাজারের বাড়ীতে লইয়া যান, সেই স্থানে তিনি হরেকৃষ্ণকে দেখেন ও তাহার ঔষধের ব্যবস্থাও করিয়া দেন। তিনি তিনবার ঐ বাড়ীতে গমন করিয়াছিলেন। ঐ ব্যক্তিকে তিনি ইতিপূর্ব্বে আরও দুই একবার ব্রজবন্ধুর বাড়ীতে দেখিয়াছেন। উহার নাম তিনি পূর্ব্ব হইতে অবগত ছিলেন না, জানবাজারের বাড়ীতেই তিনি প্রথম উহার নাম অবগত হন। হরেকৃষ্ণ তীরস্থ হইবার ঠিক পূর্ব্বে তিনি তাহাকে দেখেন নাই, উহার দুই এক দিবস পরে ব্রজবন্ধু তাঁহাকে ডাকিয়া গঙ্গাতীরে লইয়া যান, সেই স্থান তিনি উপস্থিত হইয়া জানিতে পারেন যে, হরেকৃষ্ণ মরিয়া গিয়াছে, তিনি তাহার মৃতদেহ দর্শন করেন, ও পরিশেষে একখানি সার্টিফিকেট লিখিয়া দেন।
ডাক্তারবাবুর নিকট এই সকল কথা অবগত হইয়া তাঁহাকে বিশেষ করিয়া আরও দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন হইয়া পড়ে। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি কোন স্থানে গিয়া তাহার মৃতদেহ দর্শন করেন?
ডাক্তার। কাশীমিত্রের ঘাটে।
আমি। কাশীমিত্রের ঘাটের যে স্থানে মৃতদেহ দাহ হয়, সেই স্থানে গিয়া কি আপনি উহার মৃতদেহ দর্শন করিয়াছিলেন?
ডাক্তার। না।
আমি। তবে কোথায়?
ডাক্তার। কাশীমিত্রের ঘাটের একটু দূরে যে একটি ঘর আছে, সেই ঘরের ভিতর।
আমি। সেই স্থানে তো অনেক ঘর আছে। উহার কোন্ ঘরে?
ডাক্তার। কোন ব্যক্তির মৃত্যু হইবার পূর্ব্বে যদি তাহাকে তীরস্থ করা হয় ও পরিশেষে দেখা যায় যে, তাহার মরিতে দুই এক দিবস বিলম্ব আছে, তাহা হইলে হিন্দুদিগের মধ্যে প্রায় অনেকেই তাহাকে আর বাড়ীতে ফিরিয়া আনেন না। ঐ সকল ব্যক্তিগণের সেই স্থানে রাখিবার নিমিত্ত একটি ঘর আছে, আমি সেই ঘরের মধ্যেই হরেকৃষ্ণের মৃতদেহ দর্শন করিয়াছিলাম।
আমি। আপনি কোন্ সময় ঐ মৃতদেহ দেখিয়াছিলেন? রাত্রিকালে না দিনে?
ডাক্তার। দিনে নহে, রাত্রিকালে।
আমি। তখন রাত্রি আন্দাজ কত হইবে?
ডাক্তার। বোধ হয় ৯টার কম হইবে না।
আমি। আমি ঐঘরটি ইতিপূর্ব্বে দেখিয়াছি, উহা একটা অন্ধকারময় ঘর, না?
ডাক্তার। সেইরূপ বলিয়াই বোধ হয়, আমি রাত্রিকালে সেই স্থানে গিয়াছিলাম।
আমি। আপনি যখন সেই স্থানে গমন করেন, সেই সময় ঐ মৃতদেহ কিরূপ অবস্থায় দেখিতে পান?
ডাক্তার। উহা একখানি চারি পায়ার উপর রক্ষিত ও একখানি বস্ত্র দ্বারা আবৃত ছিল।
আমি। ঘরে কোন আলো ছিল কি?
ডাক্তার। একটি মেটে প্রদীপ টিপি টিপি করিয়া জ্বলিতে ছিল।
আমি। ঐরূপ অবস্থায় ও ঐরূপ আলোক সাহায্যে আপনি ঐ মৃতদেহ দেখিয়াছিলেন?
ডাক্তার। হাঁ।
আমি। তাহা হইলে আপনি ঠিক বলিতে পারেন কি যে, ইতিপূর্ব্বে আপনি যে হরেকৃষ্ণের চিকিৎসা করিয়াছিলেন, ঐ মৃতদেহ সেই হরেকৃষ্ণের?
ডাক্তার। তাহা ভিন্ন আর কাহার মৃতদেহ হইবে?
আমি। আপনি মনে করিয়া বলুন দেখি, কাহা কর্তৃক ও কিরূপ ভাবে আপনাকে ঐ মৃতদেহ দেখান হয়?
ডাক্তার। ব্রজবন্ধুবাবু আমাকে সঙ্গে লইয়া ঐ ঘরের ভিতর প্রবেশ করেন ও তিনিই তাহার বস্ত্র উদ্ঘাটিত করিয়া আমাকে কহেন, দেখুন মহাশয়! এই হরেকৃষ্ণের মৃতদেহ
আমি। আলোটি যে স্থানে জ্বলিতেছিল, সেই স্থান হইতে আনিয়া আপনি বিশেষরূপ পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছিলেন কি?
ডাক্তার। না, কারণ আমার সন্দেহের কোন কারণ সেই সময় উপস্থিত হয় নাই। বিশেষ ব্রজবন্ধুবাবুর কথায় আমার কোনরূপ অবিশ্বাস করিবার কারণ ছিল না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ডাক্তারবাবুর নিকট হইতে এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া, বুঝিতে পারিলাম যে, তিনি হরেকৃষ্ণ বা ব্রজবন্ধুকে পূর্ব্বে হইতে জানিতেন না, হরেকৃষ্ণকে তীরস্থ করা হইলে পর, ব্রজবন্ধু তাঁহাকে গঙ্গাতীরে ডাকিয়া আনেন ও তাঁহারই অনুরোধক্রমে তিনি হরেকৃষ্ণকে তিন চারিবার দেখিয়া খান। যে ব্যক্তিকে তীরস্থ করা হইয়াছে, তাহার কোনরূপ বাঁচিবার সম্ভাবনা না থাকিলেও, কেবল ব্রজবন্ধুর অনুরোধক্রমে এবং ব্যবসার খাতিরে তিনি হরেকৃষ্ণের জীবিতাবস্থায় ও পরিশেষে তাহার মৃত অবস্থায় তাহাকে দর্শন করেন এবং মৃত্যুর পর ব্রজবন্ধুর অনুরোধে একখানা সার্টিফিকেট এই মর্ম্মে প্রদান করেন যে, তিনি হরেকৃষ্ণকে জীবিত অবস্থায় ও মৃত্যুর পর দেখিয়াছেন এবং তিনি শপথ করিয়া বলিতে প্রস্তুত যে, যে হরেকৃষ্ণকে গঙ্গাতীরে তিনি জীবিত অবস্থায় দেখিয়াছেন, সেই হরেকৃষ্ণের মৃতদেহও তিনি তথায় দর্শন করিয়াছেন।
আমি এ সম্বন্ধে যতদূর অনুসন্ধান করিলাম, তাহাতে আরো বুঝিতে পারিলাম যে, হরেকৃষ্ণ তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল, সেই হরেকৃষ্ণই তাহার জীবন বীমা ব্রজবন্ধুর নিকট বিক্রয় করে, সেই হরেকৃষ্ণই জানবাজারের বাড়ীতে বাস করিত ও তিনিই সেই স্থানে পীড়িত হন। আরও বুঝিতে পারিলাম যে, হরেকৃষ্ণ নামক যে ব্যক্তিকে তীরস্থ করা হইয়াছিল, সে মরিয়া গিয়াছে।
এখন দেখিতে হইবে যে, জানবাজারের সেই হরেকৃষ্ণ ও গঙ্গাতীরের হরেকৃষ্ণ এক ব্যক্তি কি ভিন্ন ব্যক্তি। এই বিষয়টুকু যে পর্য্যন্ত ঠিক জানিতে পারা না যাইবে, সেই পর্যান্ত এই মোকদ্দমার মীমাংসা হইবে না।
আমি পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, ব্রজবন্ধু সহরতলির একজন ব্যবসায়ী ও জমিদার। আরও বলিয়াছি যে, যে স্থানে তাঁহার বাসস্থান, তাঁহার নিকটবর্তী স্থানে আর একজন ব্যবসায়ী ও জমিদার বাস করিতেন। তিনি ব্রজবন্ধুর একজন বিষম শত্রু। সেই জমিদারের সহিত আমি একবার দেখা করিতে বাসনা করিলাম। তাঁহার সহিত আমার দেখা করিবার উদ্দেশ্য এই যে, এই কার্য্যে যদি ব্রজবন্ধুর কোনরূপ জুয়াচুরি থাকে ও সেই জুয়াচুরির কথা যদি এই জমিদার শুনিয়া থাকেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই তিনি তাহা আমার নিকট ব্যক্ত করিবেন। আর যদি তিনি ইহার বিষয় কিছুমাত্র অবগত না থাকেন, তাহা হইলে চেষ্টা করিয়া সমস্ত কথা বাহির করিতে ত্রুটী করিবেন না; কারণ এই সুযোগে তিনি তাঁহার চিরশত্রুর সর্ব্বনাশ সাধন করিতে পারিবেন।
মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, আমি সেই জমিদার মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম ও তাঁহাকে আমি সমস্ত কথা খুলিয়া বলিলাম। আমার কথা শুনিয়া তিনি কহিলেন, “আমি এ সম্বন্ধে এখনও পৰ্য্যন্ত কোন কথা শুনি নাই, কিন্তু ব্রজবন্ধুর অবস্থা দেখিয়া আমার মনে হইতেছে, আজকাল সে যেন কোন একটি গুরুতর বিষয় লইয়া ব্যস্ত আছে।”
আমি। আপনি উহার এমন কি অবস্থা দেখিয়াছেন যে, অনুমান করিতেছেন, উনি কোনরূপ গুরুতর কার্য্যে ব্যস্ত?
জমিদার। সে কথা আমি আপনাকে ঠিক বুঝাইয়া বলিতে পারিব না। যে স্থানে যাহাদিগের সঙ্গে তিনি সদাসর্ব্বদা উপবেশন ও গল্প-গুজব করিতেন, সেই স্থানেও এখন প্রায়ই তাঁহাকে উপবেশন ও গল্প-গুজব করিতে দেখিতে পাই না। যে সকল লোক সদাসর্ব্বদা তাঁহার নিকট আসিত, এখন আর তাহাদিগকেও দেখিতে পাই না। ব্যবসা ও জমিদারিকার্য্য তিনি যেরূপ মনযোগের সহিত করিতেন, এখন তাহারও শৈথিল্য হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। আপনি দুই এক দিবস অপেক্ষা করুন, ইহার সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করিয়া আমি আপনাকে বলিব। আরও এক কথা, এই মোকদ্দমার সমস্ত কাগজ-পত্র আপনার নিকট আছে কি?
আমি। আছে। কাগজ পত্র আপনি কি করিবেন?
জমিদার। ঐ কাগজ-পত্রগুলি আপনি বেশ ভাল করিয়া পড়িয়া দেখিয়াছেন কি?
আমি। হাঁ, দেখিয়াছি।
জমিদার। যে হরেকৃষ্ণ জীবন বীমা করিয়াছিল, তাহার শরীরে কোনরূপ চিহ্নাদি ছিল কি?
আমি। জীবন বীমা করিবার সময় যে ডাক্তার তাহার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়াছিলেন, তিনি উহার আকৃতি সম্বন্ধে দুই একটি কথাও লিখিয়া রাখিয়াছিলেন।
জমিদার। ডাক্তার যাহা লিখিয়া রাখিয়াছেন, তাহা আপনি পড়ুন দেখি?
জমিদারের কথা শুনিয়া আমি কাগজ-পত্রগুলি বাহির করিলাম, ও হরেকৃষ্ণের আকৃতি সম্বন্ধে ডাক্তার যেটুকু লিখিয়া রাখিয়াছিলেন তাহা পাঠ করিলাম। উহাতে লেখা ছিল,,—বয়ঃক্রম চল্লিশ বৎসর, আকৃতি খর্ব্ব, বাম চক্ষুটি দক্ষিণ চক্ষু অপেক্ষা অতি সামান্য ছোট বলিয়া অনুমান হয়।
আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় আমাকে কহিলেন, “আপনি এখন নিজ স্থানে প্রস্থান করুন; আমার বোধ হইতেছে, আপনার কার্য্য সফল হইতে আর অধিক বিলম্ব নাই। কল্য প্রত্যূষেই আমি আপনার বাসায় গিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব ও আমি যাহা জানিতে পারিব, তৎসমস্তই আপনাকে বলিয়া আসিব। ইহার মধ্যে আরও একটু কাজ করিয়া রাখিবেন। যে যে ব্যক্তি হরেকৃষ্ণকে ইতিপূর্ব্বে দেখিয়াছে, বীমা অফিসের লোকই হউন, ডাক্তারই হউন বা অপর কোন ব্যক্তিই হউন, তাহাদিগের নিকট হইতে উহার আকৃতি কিরূপ, তাহার বর্ণন যতদূর সম্ভব সংগ্রহ করিয়া রাখিবেন।”
জমিদারের কথা শুনিয়া আমি সেই স্থানে আর অধিকক্ষণ বিলম্ব করিলাম না। সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া তিনি যে বিষয়টি আমাকে সংগ্রহ করিতে বলিয়াছিলেন, তাহা যতদূর সম্ভব সংগ্রহ করিয়া, আমি আমার বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম।
জমিদার মহাশয় আমাকে যেটুকু আভাস প্রদান করিলেন, তাহাতে একবার আমার মনে হইল, ব্রজবন্ধুর এই কার্য্যে জুয়াচুরি আছে ও যাহা দ্বারা এই জুয়াচুরি হইয়াছে, তাহা জমিদার মহাশয় বুঝিতে পারিয়াছেন। আবার ভাবিলাম, এ বিষয়ে ব্রজবন্ধু হয় তো সম্পূর্ণরূপে নির্দোষী। জমিদার মহাশয় হয় তো এই সুযোগে তাঁহার জমিদারি বুদ্ধি খাটাইয়া আমাদিগের সাহায্যে তাঁহার চির শত্রুকে ভয়ানকরূপে বিপদগ্রস্ত করিতে প্রবৃত্ত হইবেন বলিয়াই আমাকে ঐরূপ কহিলেন। এই বিষয় ভাবিতে ভাবিতে সমস্ত রাত্রি বিনা নিদ্রায় অতিবাহিত হইয়া গেল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
জমিদার মহাশয় যেরূপ বলিয়াছিলেন, ঠিক সেই সময়ে তাঁহার অধীনস্থ অপর আর এক ব্যক্তিকে সঙ্গে লইয়া আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলা বাহুল্য, আমি তাঁহাদিগকে বিশেষ সম্ভ্রমের সহিত বসাইলাম।
জমিদার মহাশয় আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমি যাহা বলিয়াছিলাম, তাহা আপনি জানিয়াছেন কি?”
আমি। হাঁ, সমস্তই ঠিক করিয়া জানিয়া রাখিয়াছি।
জমিদার। উহার আকৃতির বিবরণ, ডাক্তার যে রূপ লিখিয়া রাখিয়াছেন, অপরেও কি সেইরূপ বলে?
আমি। হাঁ। সকলেই ঐরূপ বলিয়াছে। কেফ। য়ে ডাক্তার গঙ্গাতীরে মাত্র দেখিয়াছিলেন, তিনি ঠিক করিয়া কিছুই বলিতে পারেন নাই, তবে ইহা তিনি নিশ্চয়ই বলিয়াছেন যে, যে ব্যক্তিকে তিনি গঙ্গাতীরে দর্শন করিয়াছিলেন, সেই ব্যক্তিই যে মরিয়া গিয়াছে, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
জমি। তিনি ঠিক কথাই বলিয়াছেন। গঙ্গাতীরে তিনি যাহার চিকিৎসা করিয়াছিলেন, সেই ব্যক্তি যে মরিয়াছে, তাহাতে কোনরূপ সন্দেহ নাই।
আমি। তাহা হইলে আপনি কি বিবেচনা করেন যে, যে ব্যক্তি মরিয়াছে সেই ব্যক্তি, এবং যে ব্যক্তি তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল সেই ব্যক্তি এক নহে?
জমি। না। উহারা ভিন্ন ব্যক্তি।
আমি। আপনি কিরূপে জানিলেন, উহারা ভিন্ন ব্যক্তি?
জমি। আমার বোধ হইতেছে যে, যে ব্যক্তি তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল, সেই ব্যক্তি এখনও জীবিত আছে- মরে নাই।
আমি। তাহা হইলে কি আপনি জানিতে পারিয়াছেন, যে ব্যক্তি তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল, সে ব্যক্তি কে? জমি। আমি যাহা অনুমান করিতেছি, বোধ হয় আমার সেই অনুমান সত্য হইবে।
আমি। আপনি কি অনুমান করিয়াছেন?
জমি। আমার বোধ হয়, যে ব্যক্তি তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল, সেই ব্যক্তি ব্রজবন্ধুবাবুর একজন কর্ম্মচারী।
আমি। আপনি উহা কিরূপে জানিলেন?
জমি। যে সময় হরেকৃষ্ণ তাহার জীবন বীমা করে, সেই সময় ব্রজবন্ধুর এক কর্ম্মচারীকে আমি প্রায়ই ব্রজবন্ধুর বাড়ীতে দেখিতাম। কিন্তু এখন আর তাহাকে দেখিতে পাই না। হরেকৃষ্ণের অবয়বের বিবরণ যেরূপ বর্ণিত আছে, তাহার অবয়বও ঠিক সেইরূপ। সেও খর্ব্বাকৃতি, তাহার বাম চক্ষুটি দক্ষিণ চক্ষু অপেক্ষা কিছু ছোট এবং তাহারও বয়ঃক্রম প্রায় ৪০ বৎসর হইবে।
আমি। তিনি কি ব্রজবন্ধুর বাড়ীতেই কার্য্য করিতেন?
আমি। না। তিনি ব্রজবন্ধুর কর্ম্মচারী সত্য, কিন্তু তিনি এই স্থানে থাকেন না, মফস্বলের কোন জমিদারিতে তিনি কর্ম্ম করিয়া থাকেন। বৎসরের মধ্যে দুই একবার জমিদারের বাড়ীতে আসেন, কিন্তু দুই এক দিবস থাকিয়াই চলিয়া যান। এবার কিন্তু তিনি আসিয়া অনেক দিন ছিলেন।
আমি। তাঁহার নাম কি?
জমি। তাঁহার নাম কৃষ্ণরাম।
আমি। তিনি কোন্ দেশীয় লোক?
জমি। তাহা আমি বলিতে পারি না, কিন্তু শুনিয়াছি, তাঁহার পুত্রাদি নাই, কেবল একটি জামাই আছে। সেও ব্রজবন্ধুর কোন জমিদারিতে কার্য্য করিয়া থাকে
আমি। তাঁহাকে আপনি কতদিন দেখেন নাই।
জমি। অনেক দিবস পরে তাঁহাকে এবার ব্রজবন্ধুর বাড়ীতে দেখিয়াছি।
আমি। সে কত দিবসের কথা?
জমি। বোধ হয় ১৫/১৬ দিবসের অধিক হইবে না।
জমিদার মহাশয়ের কথা শুনিয়া আমার মনে হইল, যদি জমিদার মহাশয়ের কথাগুলি সত্য হয়, তাহা হইলে ব্রজবন্ধু কৃষ্ণরামের সাহায্যে যে ভয়ানক জুয়াচুরি করিয়াছে, সে বিষয়ে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। এখন এ বিষয়ে একটু বিশেষরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিবার প্রয়োজন হইতেছে। যদি অনুসন্ধান করিয়া কৃষ্ণরামকে বাহির করিতে পারি, ও সেই কৃষ্ণরামকে অফিসের সমস্ত ব্যক্তি ও ডাক্তারদ্বয় যদি হরেকৃষ্ণ বলিয়া চিনিতে পারে, তাহা হইলেই জানিতে পারিব যে, ইহা একটি ভয়ানক জুয়াচুরি কাণ্ড। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া জমিদার মহাশয়কে কহিলাম, “ব্রজবন্ধুর কোন্ জমিদারিতে কৃষ্ণরাম কর্ম্ম করে ও তাঁহার জামাতাই বা কোথায় থাকে, তাহার ঠিকানা আপনি কিছু বলিতে পারেন কি?”
আমি। এখন বলিতে পারি না। কিন্তু উহার সবিশেষ সন্ধান লইয়া দুই এক দিবসের মধ্যে তাহার সংবাদ আপনাকে প্রদান করিব।
এই বলিয়া জমিদার মহাশয় সে দিবস আমার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন।
দুই দিবস গত হইয়া গেল, জমিদার মহাশয় আমার নিকট না আসায় আমি পুনরায় তাঁহার বাড়ীতে গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমাকে দেখিয়া কহিলেন যে, এখনও পর্যন্ত তিনি তাঁহাদিগের ঠিক ঠিকানা জানিতে পারেন নাই, কিন্তু আশা করেন, আর দুই এক দিবসের মধ্যে তিনি সমস্তই জানিতে পারিবেন; তখন তিনি আপনাকে সংবাদ প্রদান করিবেন।
জমিদার মহাশয়ের কথা শুনিয়া আমি সে দিবস সেই স্থান হইতে চলিয়া আসিলাম সত্য, কিন্তু অপর অপর স্থান হইতে ঐ সংবাদ সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিতেও ভুলিলাম না। কিন্তু কৃষ্ণরাম যে এখন কোথায় আছে, তাহার কোন সংবাদ সংগ্রহ করিতে পারিলাম না। তবে এই মাত্র জানিতে পারিলাম যে, কৃষ্ণরাম নামক এক ব্যক্তি ব্রজবন্ধুর নিকট চাকরি করিয়া থাকে, ও জমিদার মহাশয় তাহার অবয়বের যাহা বর্ণন করিয়াছেন, তিনি দেখিতে ঠিক সেইরূপ।
প্রায় এক সপ্তাহ পরে জমিদার মহাশয় জানিতে পারিলেন যে, ব্রজবন্ধুর কোন জমিদারীতে কৃষ্ণরাম কর্ম্ম করিয়া থাকেন, তাঁহার জামাতাই বা কোথায় কৰ্ম্ম করেন।
ডায়মণ্ডহারবারের অন্তর্গত সুন্দর বনের মধ্যে ব্রজবন্ধুর কয়েকটি আবাদ ছিল। উহারই একটি আবাদে কৃষ্ণরাম থাকিতেন। জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে এই সংবাদ পাইবামাত্র, কৃষ্ণরামকে চিনে এইরূপ একটি লোক, ঐ জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে লইয়া, ও হরেকৃষ্ণকে দেখিলে চিনিতে পারে, এরূপ একটি লোক বীমা অফিস হইতে লইয়া, আমি সেই আবাদে গমন করিলাম, কিন্তু সহজে সেই আবাদের সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। উহার সন্ধান করিতেও দুই এক দিবস অতীত হইয়া গেল। ঐ আবাদের সন্ধান পাইলে আমরা সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম, ও জানিতে পারিলাম, কৃষ্ণরাম এই আবাদের প্রধান কর্ম্মচারী ও সেই স্থানেই তিনি বাস করিয়া থাকেন। কিন্তু আজ ১০/১৫ দিবস হইল তিনি তাঁহার মনিবের বাড়ীতে গিয়াছেন, আজও পর্যন্ত প্রত্যাগমন করেন নাই। তাঁহার বাসা ঘরখানি খালি পড়িয়া রহিয়াছে।
এই স্থান হইতে ঐ আবাদে গমন করিবার পূর্ব্বে কৃষ্ণরাম তাহার মনিবের বাড়ীতে আসিয়াছে কি না, তাহার সন্ধান করিয়াছিলাম ও জানিতে পারিয়াছিলাম যে, তিনি এখানে আসেন নাই। আবাদে গিয়া যাহা জানিতে পারিলাম, তাহাতে মনে দারুণ সন্দেহ উপস্থিত হইল; কারণ কৃষ্ণরামই যদি হরেকৃষ্ণ হন, তাহা হইলে তো ১৫ দিবস পূর্ব্বে তিনি জীবিত ছিলেন। তাহা হইলে যে, হরেকৃষ্ণ মরিয়াছে, সে তো এই হরেকৃষ্ণ বা কৃষ্ণরাম নহে। আরও মনে হইল, বোধ হয় কৃষ্ণরাম জানিতে পারিয়াছে যে, আমরা তাহার কার্য্যকলাপ জানিতে পারিয়াছি, তাই তিনি ঐস্থানে থাকিলে পাছে ধৃত হন, এই ভয়ে ঐ স্থান পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। ঐ স্থানে ও উহার নিকটবর্ত্তী স্থানে আমরা কৃষ্ণরামের বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু তাহাকে কোথাও পাইলাম না।
তাহার জামাতা যে আবাদে কার্য্য করিত, পরিশেষে আমরা সেই স্থানে গমন করিলাম। ঐ স্থান পূৰ্ব্ব বর্ণিত আবাদ হইতে প্রায় ৩০ ক্রোশ ব্যবধান। ঐ স্থানে গিয়া তাহার জামাতাকেও পাইলাম না; তিনিও ঐ সময় হইতে ঐ স্থান পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন, কিন্তু কোথায় যে গিয়াছেন, তাহা কেহই বলিতে পারিল না। সুতরাং তথা হইতে আমরা ক্ষুণ্নমনে প্রত্যাগমন করিলাম।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
ঐ স্থান হইতে প্রত্যাগমন করিয়া সেই জমিদার মহাশয়ের সহিত পুনরায় সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমার নিকট হইতে সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া কহিলেন, আপনি যে বিষয়ের অনুসন্ধান করিতেছেন, সে সম্বন্ধে আপনাকে আর কোনরূপ চিন্তা করিতে হইবেক না। ব্রজবন্ধু কৃষ্ণরামের সাহায্যে যে এই ভয়ানক জুয়াচুরি করিয়াছে, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। আর আপনারা যে কৃষ্ণরামকে হরেকৃষ্ণ স্থির করিয়া তাহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তাহা ব্রজবন্ধু জানিতে পারিয়া, কৃষ্ণরামকে স্থানান্তরে প্রেরণ করিয়াছেন। কৃষ্ণরাম একাকী কোন স্থানে থাকিলে তাহার বিশেষরূপ কষ্ট হইবার সম্ভাবনা, এই ভাবিয়া তাহার জামাতাকে তাহার সঙ্গে দেওয়া হইয়াছে। আপনি যে স্থানে কৃষ্ণরামকে পাইবেন, সেইস্থানেই তাহার জামাতাকেও পাওয়া যাইবে। আপনি সুন্দরবন হইতে প্রত্যাগমন করিবার পূৰ্ব্বেই আমি জানিতে পারিয়াছি যে, কৃষ্ণরাম তাহার বাসা পরিত্যাগ করিয়া ও তাহার জামাতাকে সঙ্গে লইয়া পশ্চিমাঞ্চলে পলায়ন করিয়াছে। কিন্তু কোথায় যে গিয়াছে, তাহা জানিতে পারি নাই। তবে এইমাত্র জানিতে পারিয়াছি যে, তাহারা এক স্থানে থাকিবে না, তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইবে। আরও জানিতে পারিয়াছি যে, তাহারা প্রথমত কোন নিকটবর্ত্তী স্থানে যাইবে না, দূরবর্তী কোন তীর্থ স্থানে কিছু দিবস গুপ্তভাবে অবস্থিতি করিয়া, পরে অন্য স্থানে গমন করিবে। তিনি আরও বলিলেন, তাহাদের পশ্চিমে গমন করিবার অব্যবহিত পূর্ব্বেই আমার একজন পরিচিত লোকের সহিত কৃষ্ণরামের সাক্ষাৎ হয়। তিনি কোন কার্য্যোপলক্ষে সুন্দরবনে গমন করিয়াছিলেন। প্রত্যাগমন করিবার সময় এক রাত্রি তাহাকে কৃষ্ণরামের বাসায় অতিবাহিত করিতে হয়। ইতিপূর্ব্বে ইনি অনেক তীর্থস্থান পৰ্য্যটন করিয়াছিলেন। কথায় কথায় কৃষ্ণরাম তাহাকে পুষ্কর তীর্থ, মথুরা, বৃন্দাবন, কাশী, অযোধ্যা, প্রয়াগ ও নৈমিষারণ্যের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। আরও কথায় কথায়, তাহার নিকট হইতে জানিয়া লইয়াছেন যে, ঐ সকল স্থানে গমন করিলে কিরূপে ও কোথায় থাকিবার সুযোগ হয়। এরূপ অবস্থায় আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে যে, উপরি উক্ত তীর্থের কোন না কোন স্থানে তিনি গমন করিয়া সেই স্থানে লুক্কায়িত আছেন।
জমিদার মহাশয়ের নিকট এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া সরকারি খরচে ঐ সকল তীর্থস্থান ভ্রমন করিতে তাঁহার ইচ্ছা আছে কি না, তাহা জানিবার অভিপ্রায়ে আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসিলাম, যদি ঐ সকল স্থানে কৃষ্ণরামের অনুসন্ধান করিতে আমি গমন করি, আপনি সরকারি খরচে আমার সহিত ঐ সকল স্থানে গমন করিতে প্রস্তুত আছেন কি? তাহা হইলে এক কার্য্যে দুই কাৰ্য্য অনায়াসেই শেষ হইবে।
আমার কথার উত্তরে জমিদার মহাশয় কহিলেন, অন্য সময় ইহলে আমি নিশ্চয়ই আপনার সহিত গমন করিতাম, কিন্তু এ সময় আমার এই স্থান পরিত্যাগ করিবার উপায় নাই। এই সময় আমি যদি এই স্থান হইতে অনুপস্থিত হই, জমিদারী ও ব্যবসা উভয় কার্য্যের আমার বিশেষরূপ ক্ষতি হইবে। আপনি নিজে গিয়া ঐ সকল স্থানে অনুসন্ধান করুন, আর আমি এই স্থানে থাকিয়া যতদূর সম্ভব উহাদিগের সংবাদ সংগ্রহ করিতে থাকি?
জমিদার মহাশয়ের সহিত এই সম্বন্ধে কথা কহিয়া আমার মনে বিশ্বাস হইল যে, তিনি কোনরূপ কপটতা করিয়া আমাকে এই সংবাদ প্রদান করিতেছেন না। তিনি যাহা কিছু জানিতে পারিতেছেন, ব্রজবন্ধুকে জব্দ করিবার নিমিত্তই তাহাই আমাকে প্রদান করিতেছেন। কারণ তিনি বেশ অবগত আছেন যে, কৃষ্ণরাম ওরফে হরেকৃষ্ণকে ধরিতে না পারিলে, ব্রজবন্ধুকে বিশেষরূপে বিপদাপন্ন করা যাইতে পারে না। এই ভাবিয়াই তিনি কৃষ্ণরামের অনুসন্ধানের নিমিত্ত প্রাণপণে এতদূর চেষ্টা করিতেছেন। আমাদিগেরও এখন এই বিশ্বাস যে, তাঁহার চেষ্টাতেই আমরা আমাদিগের কার্য শেষ করিতে সমর্থ হইব।
মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া কৃষ্ণরামের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি পশ্চিম অঞ্চলে গমন করিতে মনস্থ করিলাম। আমার সঙ্গে একটি বিশ্বাসী কনষ্টেবল, কৃষ্ণরাম বা হরেকৃষ্ণ ও তাহার জামাতাকে দেখিলে চিনিতে পারে এইরূপ একটি লোকও সঙ্গে লইয়া সেই দিবস রাত্রির ট্রেনেই পশ্চিম যাত্রা করিলাম।
নবম পরিচ্ছেদ
আমরা প্রথমতঃ বৈদ্যনাথে গমন করিলাম। সেই স্থানে দুই তিন দিবস এক পাণ্ডার বাটীতে যাত্রীভাবে অবস্থান করিয়া পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষরূপে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোথাও কৃষ্ণরাম ও তাহার জামাতার সন্ধান পাইলাম না। অগত্যা সেই স্থান ত্যাগ করিতে বাধ্য হইলাম।
বৈদ্যনাথ হইতে কাশীধামে যাত্রা করিলাম। কাশীধাম বাঙ্গালী পাঠকগণের নিকট যেরূপ পরিচিত, তাহাতে ঐ স্থানের বিস্তৃত বিবরণ এই স্থানে বর্ণনা-করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। আমি ঐ স্থানের জনৈক পাণ্ডার সাহায্য গ্রহণ করিয়া বাঙ্গালীটোলা প্রভৃতি যে যে স্থানে বাঙ্গালীগণ বাস করিয়া থাকে, সেই সেই স্থান উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম। দশাশ্বমেধ, মণিকর্ণিকা, কেদারেশ্বর প্রভৃতি যে সকল ঘাটে সকলকেই স্নান করিবার জন্য আসিতে হয়, যে সকল স্থানে সন্ন্যাসী সাধুগণ অবস্থান করিয়া থাকেন, বিশ্বনাথ, অন্নপূর্ণা, কালভৈরব প্রভৃতি যে সকল দেবতা স্থানে হিন্দুমাত্রেই গমন করিয়া থাকেন, সেই সকল স্থান তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিলাম, কোথাও তাহাদের সন্ধান পাইলাম না। ক্রমাগত চারি পাঁচ দিবস অনুসন্ধানের পর বুঝিতে পারিলাম তাঁহারা ঐ স্থানে আসে নাই; সুতরাং ঐ স্থান হইতে বহির্গত হইয়া অযোধ্যায় উপস্থিত হইলাম।
শ্রীরামচন্দ্রের লীলাভূমি পুণ্যময় অযোধ্যাধামে উপস্থিত হইয়া, যে যে স্থানে শ্রীরামচন্দ্রের কীৰ্ত্তি কলাপ এখনও বর্তমান রহিয়াছে, যে যে স্থানে তীর্থযাত্রী-হিন্দুগণ গমন না করিয়া সেই স্থান হইতে প্রত্যাগমন করিতে পারেন না, যে যে স্থানে অপরদেশবাসীগণ অবস্থিতি করিয়া থাকেন, সেই সকল স্থান তত্রত্য পাণ্ডাগণের সাহায্যে তিন দিবস কাল উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোথাও তাহাদের সন্ধান পাইলাম না। অগত্যা সেই স্থান হইতে প্রয়াগতীর্থে গমন করিলাম।
প্রয়াগে উপস্থিত হইয়া, যেখানে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গমস্থল সেই স্থানে ও তাহার কিয়ৎদূরবর্তী এলাহাবাদ সহরের যে যে স্থানে বাঙ্গালীগণের বাস করিবার সম্ভাবনা, সেই সেই স্থানে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম, কোথাও তাহাদের সন্ধান পাইলাম না।
প্রয়াগ হইতে পুষ্কর তীর্থে গমন করিতে মনস্থ করিয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। ঐ স্থানে গমন করিতে হইলে আগরা হইয়া যাইতে হয়। ঐ আগরায় মুসলমান রাজত্বের চিহ্ন প্রস্তর-নির্ম্মিত কেল্লা, জুম্মা মসজিদ ও দুগ্ধফেনণিভ শ্বেত-প্রস্তর-নির্ম্মিত তাজমহলও এখনও বর্ত্তমান। ঐ স্থান অতিক্রম করিয়া ক্রমে আজমির সহরে উপনীত হইলাম। আজমির ইহতে পুষ্কর পাঁচ ক্রোশ ব্যবধান মাত্র পাহাড়ের উপর দিয়া গমন করিতে হয়। ঐ স্থানে গমন করিবার পথ পূর্ব্বে যেরূপ দুষ্কর ছিল, এখন সেরূপ নাই। ইংরাজ রাজের অনুকম্পায় ঐ পাহাড়ের উপর দিয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া- নামিয়া উঠিয়া এক রাস্তা প্রস্তুত হইয়াছে। ঐ রাস্তা দিয়া এক্কা টাঙ্গা ও ঘোড়ার গাড়ী গমনাগমনের বেশ সুবিধাও হইয়াছে। আজমিরের যে স্থানে এক্কা ও ঘোড়ার গাড়ী প্রভৃতি পুষ্করে যাইবার নিমিত্ত পাওয়া যায়, সেই স্থানে গমন করিয়া একটু অনুসন্ধান করিলাম ও একজন এক্কা-চালকের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, কৃষ্ণরামের আকৃতির ন্যায় একটি লোক অপর আর একজনের সহিত তাহার এক্কায় উঠিয়া কিছু দিবস হইল পুষ্করে গমন করিয়াছিল, কিন্তু তাহাদিগের প্রত্যাগমন করিতে আর সে দেখে নাই। যে স্থানে তাহারা তাহার এক্কা হইতে অবতরণ করে, সে তাহাও দেখাইয়া দিতে পারে।
ঐ এক্কা-চালকের নিকট হইতে এই সংবাদ পাইয়া, তাহারই এক্কা ভাড়া করিয়া উহাতে আরোহণ পূর্ব্বক আমরা পুষ্কর তীর্থে উপস্থিত হইলাম। যে স্থানে ঐ এক্কা-চালক পূৰ্ব্বকথিত লোকদিগকে নামাইয়া দিয়াছিল, আমাদিগকেও সেই স্থানে নামাইয়া দিল। এক্কা হইতে অবতীর্ণ হইবার পূর্ব্বেই, তীর্থ স্থানের নিয়মানুযায়ী অনেক পাণ্ডা আসিয়া আমাদিগকে ঘিরিয়া ফেলিল ও সকলেই আমাদিগের পরিচয় লইতে আরম্ভ করিল। আমি তাহাদিগকে কহিলাম, কিছু দিবস পূর্ব্বে আমার পরিচিত দুই ব্যক্তি এই স্থানে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা এখন এই স্থানে আছেন, কি এই স্থান হইতে চলিয়া গিয়াছেন, তাহা বলিতে পারি না। তাঁহারা এই স্থানে আসিয়া যে পাণ্ডার বাটীতে অবস্থিতি করিয়াছিলেন, আমরাও সেই পাণ্ডার বাড়ীতে অবিস্থিতি করিব। এই বলিয়া কৃষ্ণরাম ও তাহার জামাতার যেরূপ আকৃতি তাহা তাঁহাদিগের নিকট বর্ণন করিলাম, কিন্তু ঐরূপ ব্যক্তি ঐ স্থানে আসিয়া যে কোন স্থানে অবস্থিতি করিয়াছিলেন, তাহা তাহাদিগের মধ্যে কেহই স্থির করিয়া বলিতে পারিল না।
যখন দেখিলাম ঐ সকল পাণ্ডাগণের নিকট হইতে তাহাদিগের কোনরূপ সন্ধান পাওয়া গেল না, তখন আমার পূর্ব্ব পরিচিত এক পাণ্ডার বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। বলা বাহুল্য, সরকারী কার্য্য উপলক্ষে ঐ স্থানে আমি ইতিপূর্ব্বে আরও দুই একবার আসিয়াছিলাম ও ঐ পাণ্ডার বাটীতেই অবিস্থিতি করিয়াছিলাম। যে বাড়ীতে আমাদিগের বাসা ঠিক হইল, তাহা পুষ্কর কুণ্ডের পার্শ্বেই অবস্থিত।
যে গ্রামখানি পুষ্কর গ্রাম বলিয়া বিখ্যাত, তাহার মধ্যে একটি বৃহৎ পুষ্করিণী অথবা ক্ষুদ্র সরোবর আছে। উহাকেই পুষ্করকুণ্ড কহিয়া থাকে। কথিত আছে, ব্রহ্মার যজ্ঞকালীন এই কুণ্ড প্রতিষ্ঠিত হয় ও এই স্থানে বসিয়াই ব্রহ্মা তাঁহার মহাযজ্ঞ সমাপন করেন—এখন ইহাই একটি হিন্দুদিগের মহৎ তীর্থরূপে পরিগণিত। এই কুণ্ডে অবগাহন করিয়া স্নান তর্পণাদি করাই হিন্দুদিগের প্রধান কার্য্য। কিন্তু আজকাল ঐ কুণ্ডের মধ্যে যেরূপ শত সহস্র কুম্ভিরের বাসস্থান হইয়াছে, তাহাতে নির্ভীক চিত্তে ঐ কুণ্ডে অবগাহন করা বড়ই দুঃসাধ্য। যাহা হউক, ঐ স্থানে অবস্থিতি করিয়া আমার পুরাতন পাণ্ডার সাহায্যে কৃষ্ণরাম ও তাহার জামাতার অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। দুই তিন দিবস অনুসন্ধান করিবার পর জানিতে পারিলাম, তাহারা ঐ স্থানে একটি পাণ্ডার গৃহে কয়েক দিবস বাস করিয়াছিল, ও সেই পাণ্ডার নিকট হইতে মথুরা, বৃন্দাবন, ও নৈমিষারণ্যের অবস্থা জানিয়া লয়, কিন্তু তাহারা যে কোথায় চলিয়া গিয়াছে, তাহা কেহই বলিতে পারিল না; এমন কি, সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় তাহারা পাণ্ডাকেও কোন কথা বলিয়া যায় নাই। হঠাৎ এক রাত্রে সেই স্থান হইতে নিরুদ্দেশ হয়। অনুসন্ধান করিয়া ইহাও জানিতে পারা যায় না যে, তাহারা পুষ্কর হইতে বহির্গত হইয়া পুনরায় আজমীরের দিকে গমন করিয়াছে কিনা? কারণ, যে সকল ব্যক্তি তীর্থ বা অপর কোন উপলক্ষে দূরদেশ হইতে পুষ্করে গমন করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগকে আজমীর হইয়া যাইতে হয়ও পুনরায় সেই রাস্তা দিয়া প্রত্যাগমন করিতে হয়। কারণ ঐ রাস্তা ভিন্ন সুবিধাজনক আর রাস্তা নাই। পুষ্কর হইতে তাহাদিগের প্রস্থানের কোনও সংবাদ প্রাপ্ত না হইয়া, উহার নিকটবর্ত্তী স্থান সমুদয় অর্থাৎ যে যে স্থানে সন্ন্যাসী প্রভৃতি মহাত্মাগণ অবস্থান করিয়া থাকেন, সেই সকল স্থানে একবার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম; কোনও ফল হইল না।
নিকটেই সাবিত্রী পাহাড়। ঐ পাহাড়ের উপর মন্দির মধ্যে সাবিত্রী দেবীর মূর্ত্তি স্থাপিত আছে। ঐ পৰ্ব্বতারোহণ করিয়া সেই স্থানে উহাদিগের অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোনরূপ সন্ধান পাইলাম না।
ঐ সাবিত্রী পর্ব্বতের সন্নিকটে গৌতম আশ্রম ও তাহার নিকটবর্ত্তী গঙ্গাকুণ্ড, নাগকুণ্ড, সূৰ্য্যকুণ্ড প্রভৃতি স্থান সকলে তাহাদিগের অনুসন্ধান করিলাম, সমস্তই বৃথা হইল। ঐ সমস্ত স্থান হইতে বহির্গত হইয়া জমদগ্নি আশ্রম, বামদেব আশ্রম, অগস্ত্য আশ্রম, দধিচি আশ্রম, লোমশ আশ্রম প্রভৃতি স্থান সকল দেখিলাম। ঐ সকল পুরাতন আশ্রম গিরিগুহার মধ্যে স্থাপিত। ঐ সকল স্থান দেখিলে বোধ হয়, অতি অল্প দিবস পূর্ব্বে ঐ সকল গুহা মহাত্মাদিগের আশ্রমরূপে পরিগণিত ছিল।
সাবিত্রী পাহাড়ের কিয়দ্দূর দক্ষিণে অজগধেশ্বর মহাদেবের মন্দির। উত্তরে বৈজনাথ মহাদেব। পশ্চিমে নন্দকেশর মহাদেব। এই সকল স্থানও উত্তমরূপে দেখিলাম, নিকটবর্ত্তী নন্দিগ্রাম গকুল প্রভৃতি স্থানেও অনুসন্ধান করিলাম। পাপমোচিনি পাহাড়ের উপর উঠিয়াও তাহাদিগের অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোন স্থানেই তাহাদিগের কোনরূপ সন্ধান পাইলাম না।
পুষ্কর গ্রামের মধ্যবর্তী বাদশা আরঙ্গজেবের প্রতিষ্ঠিত মসজিদের নিকটবর্ত্তী স্থান সকল, গোয়ালিয়র রাজের প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মা মন্দিরের নিকটবর্ত্তী স্থান সকল, বরাহমূর্তি মন্দির ও বদরিনারায়ণ মন্দির প্রভৃতি অপরাপর দেবালয় সকলের সন্নিকটবর্ত্তী প্রদেশ সকলও তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোন স্থানে তাহাদিগের সন্ধান না পাইয়া ক্ষুণ্নমনে আপন স্থানে প্রত্যাবর্তন করিলাম।
ঐ স্থানে আর অধিক কাল বিলম্ব করা নিষ্প্রয়োজন মনে করিয়া, সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম ও ক্রমে মথুরা ও বৃন্দাবনে গমন করিলাম। ঐ সকল স্থানে আমরা সাধ্যমত অনুসন্ধান করিলাম সত্য, কিন্তু কোনরূপ সন্ধান প্ৰাপ্ত হইলাম না। ইহার পর গমন করিলাম নৈমিষারণ্যে। শাণ্ডিলা ষ্টেশনে অবতরণ করিয়া, শকটজানে দুর্গম রাস্তা অতিবাহিত করিয়া, সেইস্থানে গমন করিতে হয়। এইস্থানে চক্রপাণী তীর্থ স্থাপিত আছে। কথিত আছে, জগতের সমস্ত ঋষির একত্র সমাগম হইয়া যে সময় এক মহা সভা হইয়াছিল, সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ তাঁহাদিগের পাণীয় জলের সংস্থানের নিমিত্ত পৃথিবী ভেদ করিয়া এই চক্রপাণী জলাশয় প্রস্তুত করিয়া দেন; ঐ স্থান হইতে এখনও প্রস্রবণের ন্যায় শীতল জল বহির্গত হইয়া, অনবরত প্রবাহিত হইতেছে ও উহা হইতে একটি নদীর সৃষ্টি হইয়াছে। ঐ স্থানের পাণ্ডাগণের নিকট হইতে অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, কৃষ্ণরাম ও তাহার জামাতার আকৃতি অনুযায়ী দুই ব্যক্তি সেইস্থানে আসিয়া পাঁচ, সাত দিবস অতিবাহিত করিয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করিয়াছে। ঐ স্থান হইতে যে তাহারা কোথায় চলিয়া গিয়াছে, তাহা জানিবার নিমিত্ত বিস্তর অনুসন্ধান করিলাম কিন্তু কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত না হইয়া নিতান্ত ক্ষুণ্নমনে সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম ও পথিমধ্যে নানাস্থানে উহাদিগের অনুসন্ধান করিয়া পরিশেষে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।
দশম পরিচ্ছেদ
আমি কলিকাতায় আসিয়া জমিদার মহাশয়ের সহিত পুনরায় সাক্ষাৎ করিলাম। কৃষ্ণরামকে নানাস্থানে অনুসন্ধান করিয়াও তাহাকে প্রাপ্ত হই নাই শুনিয়া, তিনি অতিশয় দুঃখিত হইলেন, ও কহিলেন, তিনিও উহাদিগের অনুসন্ধান পরিত্যাগ করেন নাই, কিন্তু অনুসন্ধান করিয়াও উহারা যে এখন কোথায় আছে, তাহার ঠিক সংবাদ জানিতে পারেন নাই; তবে উহারা যে পশ্চিমের কোন স্থানে অবস্থিতি করিতেছে, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তিনি আরও কহিলেন, উহারা যেখানেই থাকুক, দুই দিনে হউক, দশ দিনে হউক, তাহার সন্ধান তিনি পাইবেনই ও যখন যেরূপ সংবাদ তিনি প্রাপ্ত হইবেন, তখনই সেই সংবাদ তিনি আমাকে প্রদান করিবেন। এই বলিয়া জমিদার মহাশয় সেই দিবস আমার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন।
চারি পাঁচ দিবস মধ্যেই তিনি পুনরায় আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। ও কহিলেন, কৃষ্ণরাম যে এখন কোথায় আছে, তাহা তিনি জানিতে পারেন নাই, কিন্তু তাহার জামাতা যাহাকে তিনি সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন, তিনি গত কলা একাকী ফিরিয়া আসিয়াছেন। অপর লোক দ্বারা তিনি তাহার নিকট হইতে কৃষ্ণরামের সংবাদ গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন কিন্তু কৃতকাৰ্য্য হইতে পারেন নাই। তাহার জামাতা এখন যে স্থানে অবস্থিতি করিতেছেন, তাহা তিনি অবগত আছেন।
জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া আমার মনে অনেক আশার সঞ্চার হইল। ভাবিলাম, তাহার জামাতাকে এখন কোনরূপে হস্তগত করিতে পারিলেই আমাদিগের কার্য্য অনায়াসেই সিদ্ধ হইবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, আমি তখনই সেই জমিদার মহাশয়ের সঙ্গে তাহার উদ্দেশে গমন করিলাম। ব্রজবন্ধুর বাড়ীর নিকটেই কৃষ্ণরামের জামাতা অবস্থিতি করিতেছিলেন, সেইস্থানে গমন করিয়া তাহাকে প্রাপ্ত হইলাম; ও তাহাকে কৃষ্ণরামের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। সে প্রথমত, কৃষ্ণরাম সম্বন্ধে সমস্ত কথাই অস্বীকার করিল, পরে কহিল, তাহার শ্বশুর যে কোথায় আছেন, তাহা তিনি অবগত নহেন। অনেক দিবস তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই। যে স্থানে তিনি কৰ্ম্ম করেন, সম্ভবতঃ সেই স্থানেই তিনি আছেন। কারণ সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া কেবলমাত্র তাঁহার মনিবের বাড়ী ভিন্ন অপর কোনওস্থানে প্রায়ই তিনি গমন করেন না।
জামাতার কথা শুনিয়া বুঝিলাম যে, তিনি আগাগোড়াই সমস্তই মিথ্যা কথা কহিতেছেন। সুতরাং ঐ স্থানে তাহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা উচিত নহে, মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া তাহাকে আমার সঙ্গে থানায় আসিতে কহিলাম। বলা বাহুল্য, প্রথমতঃ তিনি আমার সহিত আসিতে অসম্মত হইলেন, কিন্তু যখন তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, যদি সহজে তিনি আমার সহিত আগমন না করেন, তাহা হইলে আমি তাহাকে ধৃত করিয়া অনায়াসেই লইয়া যাইব, তখন তিনি আমার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, আমার সহিত থানায় আগমন করিলেন।
থানায় আসিয়া আমি তাহাকে অনেক বুঝাইয়া বলিলাম, কিন্তু তিনি আমার কোন কথার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিলেন না। পরিশেষে পুষ্করও নৈমিষারণ্যের যে যে স্থানে তাহারা অবস্থান করিয়াছিলেন, কহিলাম। আরও কহিলাম, ইহাতেও যদি তিনি অস্বীকার করেন, তাহা হইলে তাহাকে সঙ্গে করিয়া পুনরায় সেই সেই স্থানে লইয়া যাইব। এই কথা শুনিয়াও তিনি স্পষ্ট কোন কথা কহিলেন না, কখন একেবারে অস্বীকার করিলেন, কখন বা ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন, কিন্তু সমস্ত দিবসের মধ্যে তাহার নিকট হইতে স্পষ্ট কোন কথা প্রাপ্ত হইলাম না।
যে সময় প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছিল যে, কৃষ্ণরাম এই জুয়াচুরির প্রধান অভিনেতা ও তিনি পলায়ন করিয়া কোন স্থানে লুকাইয়া আছে, সেই সময় তাহাকে ধরাইয়া দিবার নিমিত্ত বীমা অফিস এক সহস্র মুদ্রা পারিতোষিক প্রদান করিতে সম্মত হইয়া আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীকে পত্র লিখিয়াছিলেন; তিনি ঐ মৰ্ম্মে এক বিজ্ঞাপন বাহির করিয়া দেন।
যখন দেখিলাম, জামাতাকে কোনরূপেই হস্তগত করিতে পারিলাম না, তখন তাহাকে ঐ সহস্র মুদ্রার লোভ প্রদর্শন করিলাম ও কহিলাম, কৃষ্ণরাম পলায়ন করিয়া যে স্থানেই থাকুক না কেন, তিনি নিশ্চয়ই ধৃত হইবেন ও উপযুক্ত দণ্ডও প্রাপ্ত হইবেন। কিন্তু লাভের মধ্যে এই হইবে যে, কৃষ্ণরামকে পলায়ন করিবার সহায়তা করা অপরাধে তোমার উপরও এই মোকদ্দমা রুজু হইবে, ও যে যে স্থানে তুমি তাহার সহিত অবস্থিতি করিয়াছিলে, সেই সেই স্থানের সাক্ষ্য দ্বারা অনায়াসেই প্রমাণ করিতে পারিব যে, তুমি তাহার সহিত স্থানে স্থানে গুপ্তভাবে বাস করিয়াছ ও তাহাকে গুপ্তভাবে রাখিবার চেষ্টা করিয়াছ; সুতরাং তুমিও নিষ্কৃতি পাইবে না। কিন্তু তুমি অবগত আছ যে, যে ব্যক্তি কৃষ্ণরামকে ধরাইয়া দিবে, সেই ব্যক্তি সহস্র মুদ্রা পারিতোষিক প্রাপ্ত হইবে। যখন তুমি জানিতে পারিতেছ যে, কৃষ্ণরাম ধৃত হইতে বাকী থাকিবে না, তখন হেলায় ঐ সহস্র মুদ্রা পরিত্যাগ করা তোমার কর্তব্য নহে। তোমার অবস্থা আমি বিশেষ অবগত আছি। কাল কি খাইবে তাহার সংস্থান তোমার নাই। এরূপ অবস্থায় আমার বিবেচনায়, তোমার এই সহস্র মুদ্রা পরিত্যাগ করা কোনরূপেই কৰ্ত্তব্য নহে। তদ্ব্যতীত আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, যদি তুমি আমাদিগকে সাহায্য কর, তাহা হইলে আমরাও তোমার নামে কোন মোকদ্দমা রুজু করিব না। তোমার জেল হইবে না, অথচ এককালীন সহস্র মুদ্রা পাইলে তোমার কত উপকার হইবে।
আমি উহাকে উপরোক্ত রূপ বুঝাইলে পর, সেই গুণধর জামাতা সহস্র মুদ্রার লোভ সংবরণ করিতে না পারিয়া, সমস্ত কথা আমার নিকট স্বীকার করিল, ও যে যে স্থানে উহারা গমন করিয়াছিল, তাহা সমস্তই আমাকে বলিল। আমি দেখিলাম, যে যে স্থানে আমি উহাদিগের সন্ধান পাইয়াছিলাম, উহারা প্রকৃতই সেই সেই স্থানে গমন করিয়াছিল। উহাদিগের যাতায়াতের সমস্ত খরচ ব্রজবন্ধু অর্পণ করিয়াছিলেন, কিন্তু সেই খরচ ফুরাইয়া যাওয়ায়, কৃষ্ণরামকে এক স্থানে রাখিয়া টাকার নিমিত্ত তিনি এই স্থানে আগমন করিয়াছেন। ব্রজবন্ধুর নিকট হইতে উপযুক্ত পরিমাণে অর্থ লইয়া, তাহারা আরও দূরদেশে গমন করিয়া, সেই স্থানে কিছু দিবস লুক্কাইতভাবে বাস করিবেন, এইরূপ স্থির করিয়াছেন। জামাতার নিকট এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া, তাহাকে সঙ্গে লইয়া সেই রাত্রেই আমরা পুনরায় পশ্চিমাভিমুখে গমন করিলাম। গুণধর জামাতা আমাদিগের সহিত আর কোনরূপ কপটতা না করিয়া, অর্থলোভে আমাদিগকে যথাস্থানে লইয়া গিয়া, কৃষ্ণরামকে দেখাইয়া দিল। এটোয়া নামক স্থানের এক প্রান্তে একখানি ঘরভাড়া লইয়া, সেইস্থানে তিনি অপেক্ষা করিতেছিলেন।
বলা বাহুল্য, কৃষ্ণরামকে দেখিবামাত্রই তাহাকে ধৃত করিলাম ও আমার সহিত, অফিসের যে লোক গমন করিয়াছিলেন, তিনি তাহাকে হরেকৃষ্ণ বলিয়া সনাক্ত করিলেন ও সেই স্থান হইতে আমাদিগের প্রধান কর্ম্মচারীর নামে তার প্রেরণ করিলে অপর কর্মচারীর দ্বারা তিনিও ব্রজবন্ধুকে ধৃত করাইলেন।
সময় মত আমিও হরেকৃষ্ণ ওরফে কৃষ্ণরামকে লইয়া কলিকাতায় উপস্থিত হইলাম। অফিসের সকলেই, ও যে ডাক্তার তাহাকে চিকিৎসা করিয়াছিলেন ও জানবাজারের যে বাড়ীতে তিনি বাস করিতেন সেই বাড়ীর সরকার প্রভৃতি সকলেই তাহাকে হরেকৃষ্ণ বলিয়া চিনিতে পারিলেন ও অফিসের সকলেই মৃত হরেকৃষ্ণকে জীবিত অবস্থায় দেখিতে পাইয়া বিস্মিত হইলেন।
বলা বাহুল্য, ব্রজবন্ধু ও কৃষ্ণরাম এই ভয়ানক জুয়াচুরি মোকদ্দমায় আসামী হইয়া ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরিত হইলেন, তিনিও উহাদিগকে দায়রায় পাঠাইয়া দিলেন। সেইস্থান হইতে জুরির বিচারে তাহারা কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইলেন। গুণধর জামাতা এই মোকদ্দমায় শ্বশুরের বিপক্ষে অর্থলোভে সাক্ষ্য প্রদান করিতে ত্রুটী করিলেন না। বলা বাহুল্য, মোকদ্দমা শেষ হইলে তিনি প্রস্তারিত পারিতোষিক প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ধন্য অর্থ!!
[কাৰ্ত্তিক, ১৩১৩]