জীবজন্তু (১)
জীবজন্তু নিয়ে রসিকতার গল্পগুলি অধিকাংশই নেহাতই আজগুবি।
রূপকথা কিংবা ঠাকুমার ঝুলির জন্তুজানোয়ারেরা যেমন মানুষের মতো কথা বলতে পারে, হালকা গল্পের পশুপাখিও তাই।
তবে আমরা আপাতত সরাসরি শুধু পশুপাখির গল্পে যাচ্ছি না। যেসব গল্পে পশুপাখির সঙ্গে মানুষ জড়িত আছে, সে গল্পগুলোকেই বলছি।
প্রথমে গল্প নয়, একটা সাবেকি ধাঁধা স্মরণ করি।
উটপাখির গলা অত লম্বা কেন?
এই প্রশ্নের সরলতম উত্তর হল উটপাখির মাথাটা শরীর থেকে এত দূরে যে তার গলা অত লম্বা না হলে শরীরের সঙ্গে মাথা জুড়ে থাকত না।
যেমন এক ধরনের বেঁটে জাতের কুকুর আছে যাদের পা খুব ছোট ছোট। এই কুকুরের ব্যাপারটা উটপাখির ঠিক উলটো। কচ্ছপের মতো ছোট পা। তাই দেখে কুকুরের মালিককে একজন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার কুকুরের পা এত ছোট যে নেই বললেই চলে।’
কুকুরের মালিক গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, ‘তা বলছেন কেন? যতটুকু লম্বা হওয়া প্রয়োজন তা তো আছে, পাগুলো মেঝে তো ছুঁয়েছে।’
এই কুকুরটিই একবার হারিয়ে গিয়েছিল। প্রিয় কুকুরের জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে কুকুরের প্রভু এপাশে-ওপাশে চারিদিকে সেটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
অবশেষে যখন কিছুতেই কুকুরের খোঁজ পাওয়া গেল না, এক শুভানুধ্যায়ী পরামর্শ দিলেন, ‘আপনি একটা কাজ করুন, খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে দেখুন।’
কুকুরের মালিক ভদ্রলোক বিরাগকণ্ঠে বললেন, ‘তাতে আর লাভ কী হবে? আমার কুকুর তো আর পড়তে পারে না।’
ঠিক এই জাতের আর-একটা গল্প আছে।
সে গল্পে এক ভদ্রমহিলা তাঁর বেড়ালের দুধ খাওয়ার জন্যে একটা কাঁসার বাটি কিনতে গিয়েছিলেন দোকানে। তিনি অনেক বাছাই করে চমৎকার একটি পদ্মকাটা রেকাবি কিনলেন তাঁর বেড়ালের জন্যে। দোকানদারকে একথা বললেন যে, ‘এই রেকাবিটা কিনেছি আমার পোষা বেড়ালের জন্য।’
দোকানদার তাই শুনে বললেন, ‘আপনার এত আদরের বেড়াল, নিশ্চয়ই তার একটা নাম আছে।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তা থাকবে না কেন? আমার বেড়ালের নাম পুঁটিরানি।’
তখন দোকানদার বললেন, ‘চমৎকার নাম আপনার বেড়ালের। পুঁটিরানি নামটা রেকাবির গায়ে লিখিয়ে দেব। পঞ্চাশ পয়সা করে চার অক্ষরে মাত্র দু’টাকা লাগবে।’
ভদ্রমহিলা কী যেন চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, ‘না। নাম লেখার দরকার নেই। আমার বেড়াল তো পড়তে-টড়তে মোটেই পারে না।’
কুকুর-বেড়াল কেন, কোনও জন্তুই পড়তে পারে না। লেখাপড়া জানে না, কিন্তু গৃহপালিতই হোক অথবা বুনো জন্তুই হোক, তাদের অশিক্ষিত বলা যাবে না। তাদের জীবনচর্চা মানুষের চেয়ে বহুক্ষেত্রেই অনেক পরিচ্ছন্ন।
ওয়ালট হুইটম্যান বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় জীবজন্তুর সঙ্গে আমি বেশ বসবাস করতে পারব, থাকতে পারব। তারা কেমন নির্লিপ্ত ও আত্মনির্ভর। আমি অনেক সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের লক্ষ করি। তারা কখনও কী হবে, কী হতে পারে—তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে অন্ধকার বিছানায় জেগে থাকে না, নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে পরিতাপ করে না। তারা কখনওই অসন্তুষ্ট নয়, তারা কিছু জমায় না, কিছু নেই বলে তারা দুঃখিত নয়।’
এতখানি জ্ঞানগর্ভ কথার পরে এবার ঘোড়ার গল্পে যাই। ঠিক ঘোড়া নয়, বলা উচিত মানুষের গল্প।
এক ঘোড়ার মালিকের পোষা ঘোড়াটি বুড়ো হয়ে যাওয়ার জন্যেই তোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক, কিছুতেই চলতে চায় না। ঢিমিয়ে ঢিমিয়ে টুকুস টুকুস করে চলে। ওই যাকে বেতো ঘোড়া বলে তাই আর কী।
অবশেষে একদিন ঘোড়ার মালিক ঘোড়াকে নিয়ে গেল পশুচিকিৎসকের কাছে। পশুচিকিৎসক জানতে চাইলেন, ‘এর হয়েছেটা কী?’ ঘোড়ার মালিক বলল, ‘তা আমি বলতে পারছি না। একটু বয়েস হয়েছে বটে, কিন্তু তা ছাড়া আর-কিছু অসুখ তো দেখতে পাচ্ছি না।’
পশুচিকিৎসক বললেন, ‘ঠিক আছে, কোনও চিন্তা করবেন না, আমি দেখছি। আমি একটা স্পেশাল টনিক বানিয়েছি, সেটা এক চামচে খাওয়ালেই ভাল হয়ে যাবে।’
যে কথা সেই কাজ। দশ সেকেন্ডের মধ্যে এক চামচে স্পেশাল টনিক মুখে পড়ামাত্র ঘোড়াটা চিঁহিহি হ্রেষাধ্বনি করে বিদ্যুৎবেগে ছুট লাগাল। সে তার যৌবনেও কোনওদিন এত জোরে ছোটেনি।
ঘোড়ার মালিক সেই দৃশ্য দেখে চমৎকৃত হয়ে পশুচিকিৎসককে বলল, ‘আপনার ওষুধের দাম কত?’
পশুচিকিৎসক বললেন, ‘এক চামচে টনিক দশ টাকা লাগবে।’
ঘোড়ার মালিক পকেট থেকে তিরিশ টাকা বার করে পশুচিকিৎসককে দিয়ে বলল, ‘আর দু’ চামচ আপনার ওই স্পেশাল টনিক আমাকে দিন, আমাকে যে এখন ছুটে গিয়ে ঘোড়াটা ধরতে হবে। এর মধ্যে সেটা কতদূর চলে গেল কে জানে। ওর ডবল জোরে দৌড়তে হবে।’
অবশেষে ভেড়ার গল্প। এ গল্পটাও পুরানো।
একটি ছেলে তার বাবার সঙ্গে কলকাতার ময়দানে বেড়াতে গেছে। যেমন হয়, এক জায়গায় দলবেঁধে অনেকগুলো ভেড়া চরছে।
ছেলে অনেকক্ষণ ধরে নানারকম বায়নাক্কা করছিল। আইসক্রিম খাব, বাদাম কিনব, বাঁদরনাচ দেখব ইত্যাদি। ছেলেকে অন্যমনস্ক করার জন্য বাবা বললেন, ‘গোনো তো ক’টা ভেড়া আছে।’
ছেলে মন দিয়ে গুনছে তো গুনছেই, গোনা আর শেষ হয় না। বাবা বিস্মিত হলেন, ভেড়ার সংখ্যা তো বেশি নয়, এত সময় লাগছে কেন গুনতে।
অবশেষে ছেলেটি বলল, ‘একত্রিশটা ভেড়া আছে।’
বাবা বললেন, ‘মাত্র একত্রিশটা ভেড়া গুনতে তোমার এত সময় লাগল?’
ছেলে বলল, ‘আগে ভেড়াগুলোর পায়ের সংখ্যা গুনে বার করলাম একশো চব্বিশটা। তার পরে সেটাকে চার দিয়ে ভাগ করে পেলাম একত্রিশটা ভেড়া।’