জিরো জিরো জিরো
আমার বৃদ্ধ বন্ধু প্রকৃতিবিজ্ঞানী কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ঘরে ঢুকেই আমি হতবাক। তিনি চাঁদের হাট বসিয়ে মৌজ করছেন। এ যে জলে শিলা ভেসে যায়, বানরে সঙ্গীত গায়, দেখিলেও না হয় প্রত্যয়!
না, কর্নেল মোটেও বদমেজাজী মানুষ নন। কিংবা প্রেমে ব্যর্থ, তাই নারী বিদ্বেষী গোঁয়ার গোবিন্দও নন। বরং সুরসিক বলে খ্যাতি আছে ওঁর। বিশেষ করে সুন্দরী যুবতীদের প্রতি ওঁর পক্ষপাতদুষ্ট স্নেহ সুপ্রচুর। কিন্তু, আমার বিস্ময়ের কারণ অন্য। ইলিয়ট রোডের এই অ্যাপার্টমেন্টে অনেকদিন ধরে যাতায়াত করছি, কখনও কোনও সুন্দরী যুবতীকে এখানে পদার্পণ করতে দেখিনি, তা নয়। সচরাচর বেশি যাঁরা আসেন, তাঁরা রাশভারি মানুষ সব। বিষয়ী এবং কেজো প্রকৃতির লোক। কোনও না কোনও গূঢ় মতলব নিয়েই তারা আসেন।
আজ যাদের দেখছি, এরা একেবারে উল্টো প্রকৃতির। এক পলকেই আন্দাজ করেছি–খবরের কাগজের রিপোর্টারের অভ্যাসলব্ধ চাতুর্যেই, এরা সংখ্যায় তিন এবং আঠারো থেকে বাইশটি বসন্ত ঋতু দেখেছে। প্রত্যেকেরই চেহারায় উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর চিকণ মেদ ও শ্রী পরিস্ফুট। এরা কথায় কথায় প্রচুর হাসছে। প্রচুর কথা বলার চেষ্টা করছে। এবং কর্নেল হংস মধ্যে বক যথা বসে আছেন।
আমাকে দেখেই অবশ্য কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধতা জাগল। তারপর কর্নেল খুব খুশি দেখিয়ে বলে উঠলন–হ্যাল্লো ডার্লিং! এসো, এসো তোমার কথাই ভাবছিলুম।
নিছক মিথ্যা, তাতে ভুল নেই। গম্ভীর হয়ে সামান্য দূরে একটা গদীআঁটা চেয়ারে বসে পড়লুম। তারপর বললুম–আমার কথা ভাববার ফুরসৎ পাচ্ছিলেন এতে সন্দেহ আছে।
কর্নেল হাততালি দিয়ে উচ্চহাসি হাসলেন। ব্র্যাভো জয়ন্ত! ঠিকই বলেছ।
যুবতী তিনটি আমাকে দেখছিল। আমি সামনের টেবিলে চোখ রাখলুম। তারপর কর্নেলকে বলতে শুনলুম–মাই ডিয়ার লেডিস অ্যাণ্ড জেন্টলমেন……
একজন মেয়ে বলে উঠল কর্নেল কর্নেল! এখানে জেন্টলম্যান কিন্তু একজনই।
অন্য একজন বলল–সোনালী, তুই কিছু বুঝিস না। কর্নেল নিজেকেও কাউন্ট করছেন যে!
আবার প্রচুর হাসিতে ঘর ভরে গেল। কর্নেল গলা ঝেড়ে শুরু করলেন–যাই হোক, পরিচয় করিয়ে দেওয়া গৃহকর্তা হিসেবে আমার কর্তব্য ইনি হচ্ছেন, দৈনিক সত্যসেবকের স্বনামধন্য জয়ন্ত চৌধুরী।
আমার চোখের ভুল হতেও পারে, হয়তো ইচ্ছাকৃত চিন্তা বা উইশফুল থিংকিং গোছের কিছু মনে হলো ওদের চোখে বিস্ময় মেশানো শ্রদ্ধা ফুটে উঠল।
–আর জয়ন্ত, ইনি সোনালী ব্যানার্জি, ইনি রত্না চ্যাটার্জি–সোনালীর মাসতুতো বোন। আর ইনি দীপ্তি চক্রবর্তী। দুজনের বন্ধু, সহপাঠিনী। এঁরা কিন্তু কেউ কলকাতার বাসিন্দা নন। রানীডিহি নামে প্রখ্যাত পার্বত্য শিল্পাঞ্চলে সম্প্রতি একটি তৈলশোধনাগারও গড়ে তোলা হয়েছে। শ্রীমতি সোনালীর বাবা শ্ৰীঅনিরুদ্ধ ব্যানার্জি তার ডিরেক্টর। আমার বিশেষ স্নেহভাজন বন্ধু। এবং…..।
সোনালী হাত তুলে হাসতে হাসতে বললকর্নেল, যথেষ্ট হয়েছে। আমরা কেউই জয়ন্তবাবুর মতো খ্যাতিমান নই। অত বলার কিছু নেই।
কর্নেল হতাশ ভঙ্গিতে বসে পড়লেন এবং চুরুট ধরালেন। কর্নেলের ভাষণের মধ্যেই আমরা পরস্পর নমস্কার পর্ব সেরে নিয়েছি। এবার আমিও সিগারেট ধরালুম। এই সময় চোখে পড়ল, ওরা মহিলাসুলভ সতর্ক ভঙ্গিতে কিছু বলাবলি করছে–সেটা চোখের ভাষাতেই, এবং তাদের লক্ষ্য যে আমি, তাতে কোনও ভুল নেই। তারপর সোনালী কর্নেলের দিকে তাকাল, ঠোঁটে চাপা কুণ্ঠিত হাসি কর্নেল! জয়ন্তবাবু যদি কিছু মনে না করেন… ।
ধুরন্ধর বৃদ্ধ খুশি হয়ে বলে উঠলেন–কিচ্ছু মনে করবে না ও। সোনালী, তুমি ওকে স্বচ্ছন্দে তোমার জন্মদিনের নেমন্তন্নটা করতে পারো। বরং জয়ন্তের মতো একজন প্রাণবন্ত যুবক থাকলে তোমাদের অনুষ্ঠানের ষোলোকলা পূর্ণ হবে।
আবার হাসির ধূম পড়ল। সোনালী তার ব্যাগ থেকে একটা সুদৃশ্য কার্ড এবং খাম রে করে সযত্নে আমার নাম লিখল। লিখে আমার কাছে এসে বিনয় দেখিয়ে বলল–হয়তো অডাসিটি হচ্ছে, তবু আপনাকে পেলে আমি–আমরা সবাই খুব খুশি হবো। প্লীজ, আসতে ভুলবেন না।
একটু দ্বিধা দেখিয়ে বললুম–কিন্তু মুশকিল কি যানেন? রিপোর্টারের চাকরি করি। কখন কোথায় কোন অ্যাসাইনমেন্ট এসে কাঁধে চাপে বলা যায় না!
কর্নেল প্রায় ধমক দিয়ে বলে উঠলেন–জয়ন্ত, বাজে বকোনা! রানীডিহি এবং আমার কন্যাবৎ এই মেয়ে দুটোই মর্ত্যের এক দুর্লভ বস্তু। সুতরাং কোনওরকম বাচালতা না করে কার্ডটি পকেটেস্থ করো। এবং তোমার ক্ষুদে রিপোর্টিং বহিটি বের করে তারিখটা লিখে রাখো। লেখ, ১৭ সেপ্টেম্বর, সকাল সাড়ে সাতটায় হাওড়ায় ট্রেন। দশ নম্বর প্লাটফর্ম। আমার বাসায় আসার দরকার নেই। কারণ, তাহলে তুমি ট্রেন ফেল করবেই। তারও কারণ, তুমি লেটরাইজার।…..
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে ওরা চলে গেল। তখন কর্নেলের কাছে গিয়ে বসলুম। বললুম–হ্যালো ওল্ড ম্যান! এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কী?
–কিসের?
–এই নিছক একটি মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের তিনশো কিলোমিটার ভ্রমণের?
কর্নেল চোখে মুগ্ধতা ফুটিয়ে বললেন–জয়ন্ত, ডার্লিং! রানীডিহির সৌন্দর্য তুলনাহীন। মর্ত্যের স্বর্গ।
–হাতি! আমি শুনেছি, রানীডিহি শিল্পনগরী। আকাশ বাতাস কুচ্ছিত ধোঁয়া আর গ্যাসে ভরা। নরক বিশেষ।
কর্নেল মৃদু হেসে বললেন–হ্যাঁ। কিন্তু সোনালীদের কোয়ার্টার যেখানে অবস্থিত, সেখানে গেলে পৃথিবীর যাবতীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নমুনা তুমি পাবে। নদী, পর্বতমালা, অরণ্য…
–এবং দুর্লভ প্রজাপতি পাখি কীটপতঙ্গ!
–ডার্লিং, আমি কথা দিচ্ছি, এবার আমি প্রকৃতিবিদ হিসাবে রানীডিহি যাবো না। যাবো…
ওঁকে থামতে দেখে বললুম–হুঁ, বলুন।
–যাবো আমার আসল মূর্তিটা পোশাকের তলায় লুকিয়ে নিয়ে।
–তার মানে?
–প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার হিসেবেই।
চমকে উঠে বললুম–সে কী! কেন?
কর্নেল চোখ বুজে দুলতে দুলতে বললেন–একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে জয়ন্ত। এটা না ঘটলে শ্রীমতী সোনালীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমি অতদূরে কিছুতেই যেতুম না। স্বীকার করছি, জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খ্যাতি আছে। কিন্তু তার চেয়েও একটা জরুরী বিষয় সম্প্রতি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তোমাকে আগাগোড়া সবটা বলছি। ভাল করে শোনো।
কর্নেল আমাকে যা শোনালেন, তা সংক্ষেপে এই: এক সপ্তাহ আগে অর্থাৎ ৩রা সেপ্টেম্বর সোনালীর বাবা অনিরুদ্ধবাবু কর্নেলের সঙ্গে দেখা করেন। তারও দুদিন আগে রানীডিহিতে ওঁর কোয়ার্টারে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে, তাই কর্নেলের পরামর্শ চাইতে আসেন। সেদিন ছিল রবিবার। বেলা একটায় লাঞ্চের পর উনি অভ্যাস মতো গড়াচ্ছেন, পরিচারিকা এসে খবর দেয় যে এক ভদ্রলোক জরুরী ব্যাপারে দেখা করতে এসেছেন। অনিরুদ্ধবাবু বিরক্ত হন। এটা দেখা করার সময় নয়। তাছাড়া উনি কোয়ার্টারে অপরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা করেন না। অফিসেই যেতে বলেন। পরিচারিকা সব জানে এবং বুঝিয়ে বলা সত্ত্বেও সেই লোকটি শোনেনি। বলেছে, দেখা না করলেই চলবে না। এবং এই দেখা করার পিছনে নাকি অনিরুদ্ধবাবুরই বিশেষ স্বার্থ আছে। অনিরুদ্ধবাবু বিরক্ত হলেও কৌতূহল দমন করতে পারেননি। তাই বলেন–ঠিক আছে, তুমি আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে বলল। এই আধঘণ্টা ভাতঘুম বাঙালীর মজ্জাগত এবং অনিরুদ্ধবাবু মনে মনে ভীষণ বাঙালী। যাইহোক, পরিচারিকা গিয়ে তাকে অপেক্ষা করতে বললে সে ততক্ষণ সময় কাটানোর জন্যে একটা বই চায়। এটাই অদ্ভুত যে সে অন্য কোনও বই পছন্দ করেনি। আলমারিতে পশ্চিম এশিয়ার অর্থনীতি নামে প্রকাণ্ড ইংরেজি বই ছিল, সেটাই চায়। তারপর পরিচারিকা বইটি তাকে দিয়ে চলে আসে। আধঘণ্টা পরে অনিরুদ্ধবাবু ড্রয়িং রুমে যান। কিন্তু লোকটিকে দেখতে পান না। টেবিলে সেই বইটি পড়ে থাকতে দেখেন। বইটি রাখতে গিয়ে হঠাৎ লক্ষ্য করেন, একটা ভাজ করা কাগজ উঁকি মারছে ফাঁকে। কাগজটা খুলে পড়ার পর হতভম্ব হয়ে যান উনি। তাতে ডটপেনে ইংরেজিতে লেখা আছে : যা বলতে এসেছিলুম, বলা হলো না। ওরা আমাকে ফলো করে এসেছে টের পেলুম। তাই চলে যাচ্ছি। আজ রাত এগারোটায় আপনি জলের ট্যাংকের পিছনে আমার সঙ্গে দেখা করুন। আমি সেখানে থাকব। আপনি কাকেও দেখামাত্র বলবেন–জিরো নাম্বার? সে যদি বলে–জিরো জিরো জিরো, তাহলে জানবেন সে আমিই। অন্য কিছু ঘটলে তখুনি পালিয়ে আসবেন। জিরো জিরো জিরো। ভুলবেন না।
নামের বদলে তিনটে শূন্য বসানো। বলা বাহুল্য, অনিরুদ্ধ এই অদ্ভুত চিঠি পেয়ে খুব উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। ভাবেন, পুলিশের কাছে যাবেন। কিন্তু শেষ অব্দি কৌতূহল তার সব মতলব দাবিয়ে রাখে। যথাসময়ে সেই জলের ট্যাংকের কাছে যান। জায়গাটা খেলার মাঠ ও বড় রাস্তার সঙ্গমে রয়েছে। কিছু ঝোপঝাড় ও পাথরও আছে। উনি গিয়ে একটা লাশ দেখতে পান। পিঠে ছুরিমারা হয়েছে। তখনও রক্ত তাজা। সুতরাং ভীষণ ভয় পেয়ে পালিয়ে আসেন।
সকালে লাশটার খবর পেয়ে পুলিশ আসে। অনিরুদ্ধবাবু নিজেকে এ ব্যাপারে জড়াতে চাননি। লোকটাকে সনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। যাইহোক, অনিরুদ্ধবাবুর মনে পড়ে যায় কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের কথা। পরদিনই কলকাতা এসে দেখা করেন। সেই চিঠিটাও নিয়ে আসেন।
কর্নেল এই সাতটা দিন কি সব করেছেন, আমাকে কোনওরকম আভাস দিলেন না। শুধু বুঝলাম, হঠাৎ এই প্রখ্যাত ব্যক্তিটি রানীডিহি হাজির হলে পুলিশমহলে ঔৎসুক্য জাগতে পারে এবং সম্ভাব্য শত্রুপক্ষ–যারা সেই অজ্ঞাতনামা লোকটিকে খুন করেছে, তারাও সতর্ক হয়ে যায়–তাই সোনালীর জন্মদিনের অছিলা। অবশ্য, সোনালী এসব ব্যাপার জানেই না। সে তার জন্মদিনে আর সবাইকে নেমতন্ন করার জন্য কলকাতা এসে বাবার কথামতো কর্নেলকেও নেমতন্ন করে গেল।…..
কর্নেল চুপ করলে বললুম–ব্যাপারটা রহস্যময়। আমার মনে হচ্ছে, সেই সঙ্গে বিপজ্জনকও বটে। সচরাচর আপনি যে সব ব্যাপারে নাক গলান এবং কৃতিত্ব অর্জন করেন, এটা তত সহজ মোটেও নয়। আপনার লাইফ রিক্সের কথা ভেবেছেন তো?
কর্নেল একটু হাসলেন। কিছু বললেন না।
বললুম–এসব ব্যাপারে নাক না গলানোই উত্তম, আমার মতো সরকারী লোকেরা যা পারে, করুক! আপনি গোয়েন্দাবিদ্যায় যত ধুরন্ধরই হোন, ভুলে যাবেন না যে এই কেসে খুনী কোনও ব্যক্তিবিশেষ নয়, সম্ভবত একটা দল এবং এতে কোনও ব্যক্তিগত অভিসন্ধি কাজ করছে না। কে বলতে পারে, কুখ্যাত মাফিয়া দলের মতো কোনও আন্তর্জাতিক গুপ্তদল এর পেছনে আছে কি না? তাদের কী উদ্দেশ্য, তাও তো আপাতত আপনার জানা নেই।
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন–তোমার পরামর্শ খুব উৎকৃষ্ট জয়ন্ত। যুক্তি আছে। তোমার অনুমানও সম্ভবত ঠিক।
উৎসাহে বললুম–আলবাৎ ঠিক। একটা ব্যাপার তো পরিষ্কার বোঝা যায়, লোকটা সেই দলেরই লোক। কোনও কথা ফাঁস করে দিতে চেয়েছিল অনিরুদ্ধবাবুকে। তা টের পেয়ে তাকে মেরে ফেলল ওরা। তাছাড়া….
কর্নেল সায় দিয়ে বললেন–বলে যাও ডার্লিং!
–অনিরুদ্ধবাবু কে? না–উনি এক তৈল শোধনাগারের ডিরেক্টর। দ্বিতীয় পয়েন্ট লক্ষ্য করুন : লোকটা যে বই বেছে নিয়ে চিঠি রেখেছিল, সেটা পশ্চিম এশিয়ার অর্থনীতি। এবং পশ্চিম এশিয়ার অর্থনীতি একান্তভাবে তৈলশিল্পকেন্দ্রিক। এই যোগাযোগ কি আপনি আকস্মিক মনে করছেন?
কর্নেল সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–অপূর্ব জয়ন্ত! এজন্যেই সব কেসে আজকাল তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাই। ব্রিলিয়ান্ট! বলে যাও ডার্লিং!
সবার আগে সেই বইটা আপনার পরীক্ষা করা দরকার!
–হ্যাঁ!
–অনিরুদ্ধবাবুর উচিত ছিল, রিফাইনারিতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করা।
কারণ?
–আমার ধারণা, ওখানে কোনও অন্তর্ঘাত ঘটাবার ষড়যন্ত্র চলেছে। সে কথাটাই লোকটা বলতে এসেছিল। সুযোগ পায়নি। তাই দেখা করতে বলে ওইভাবে। এবং খুন হয়ে যায়।
–রিফাইনারিতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা তখনই করেছেন অনিরুদ্ধবাবু।
–আমার আরও ধারণা, রিফাইনারির অফিসার ও কর্মীদের মধ্যে ওই দলের লোক আছে।
–অসম্ভব নয়, জয়ন্ত।
আমি আরও কিছু তত্ত্ব খুঁজছি, দেখি কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন এবং মেঝেয় কয়েকপা হেঁটে আমার দিকে হঠাৎ ঘুরে হো হো করে হেসে উঠলেন। বললুম– আমাকে তাচ্ছিল্য করতে পারেন, কিন্তু আমি বাজী রেখে বলতে পারি–একচুলও অযৌক্তিক কথা বলিনি।
কর্নেল বললেন–তাহলে জয়ন্ত, সব রহস্য ফাঁস হয়ে গেছে বলা যায়। কিন্তু একটা পয়েন্ট তুমি আমল দিচ্ছ না যে যদি কোনও অন্তর্ঘাত সম্পর্কে অনিরুদ্ধবাবুকে কেউ সতর্কই করতে চাইত, তাহলে চিঠি বা ফোনেই জানাতে পারত! দেখা করতে আসা, ওই বিশেষ বইটা চেয়ে নেওয়া এবং…জয়ন্ত, শুধু তাই নয়, যে পাতায় চিঠিটা ছিল, তার পেজমার্ক কত জানো? থ্রি জিরো–মানে তিরিশ!
বলেন কী!
–ওই পাতায় কী আছে, তাও জেনে নিয়েছি। চ্যাপ্টারটা পুরো লেখা হয়েছে সেই সুবিখ্যাত টি. ই. লরেন্স সাহেবকে নিয়ে। অর্থাৎ লরেন্স অফ অ্যারাবিয়ার কার্যকলাপ। আশা করি, লরেন্স সম্পর্কে তুমি বিশদ জানো। এমনকি সিনেমাতেও তার ক্রিয়াকলাপ দেখে থাকবে।
হাত তুলে বললুম–দেখেছি। আশ্চর্য ছবি!
.
ষোলো সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ সোনালীর জন্মদিনের একদিন আগেই আমরা দুজনে রানীডিহি পৌঁছলুম। রিফাইনারি থেকে দূরে চমৎকার পাহাড়ী এলাকায় ডিরেক্টর সায়েবের বাংলো এবং অন্যান্য অফিসারদের কোয়ার্টার। ছবির মতো দেখাচ্ছিল ঘরবাড়িগুলো। প্রাকৃতিক দৃশ্যও অপূর্ব।
সবে শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠেছে। কর্নেল ড্রয়িং রুমে গল্প করছে। আমি দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে বসলুম। টিলার ওপর বাংলোটা। তাই জ্যোৎস্নায় নীচের উপত্যকাটা ভাগ্নি রহস্যময় দেখাচ্ছিল। বারান্দার ওপরে একটা হাল্কা আলোর বাল্ব রয়েছে। আলোটা নিভিয়ে দিলে বাইরের সৌন্দর্য পুরোপুরি ফুটত ভেবে সুইচ খুঁজছি, এমন সময় সোনালী, রত্না, দীপ্তি আর একটি অচেনা যুবক এল। সোনালী বলল–আলাপ করিয়ে দিই জয়ন্তবাবু। রত্নার দাদা দিব্যেন্দু। মানে আমারও মাসতুতো দাদা। দির্য, তোমাকে তো এঁর কথা বলেছি। জয়ন্ত চৌধুরী ….
দিব্যেন্দু নমস্কার করল হাসিমুখে।–দৈনিক সত্যসেবকে আপনার রিপোর্টগুলো আমি কিন্তু মন দিয়ে পড়ি। খুব ইন্টারেস্টিং!
রত্না বলল–তার চেয়েও ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা এবার আলোচনা করা যাক দিব্য। সোনালী, তুই শুরু কর।
চারটি মুখে ষড়যন্ত্রসঙ্কুল হাসি দেখছিলুম। বললুম–কী ব্যাপার?
সোনালী দ্রুত এদিক ওদিক দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলল–জয়ন্তবাবু, ভয়ে বলব, না নির্ভয়ে? আপনি নিশ্চয় ওই গোয়েন্দা ভদ্রলোকের অ্যাসিস্ট্যান্টের রোলেও কাজ করেন?
হেসে ফেললুম। ব্যাপার কী? অবশ্য, আমি ওঁর নিছক ভ্রমণসঙ্গী।
সোনালী ফিসফিস করে বলল-কর্নেলকে নিয়ে আমরা একটু মজা করলে মানে জাস্ট এ ফান–আপনার আপত্তি হবে না তো?
–মোটেও না। বরং আমি আপনাদের দলে ঢুকে পড়ব। কিন্তু সাবধান, বুড়ো ভারি ধুরন্ধর।
রত্না বলল, –এত নাম ডাক শুনেছি। এত অদ্ভুত ব্যাপার নাকি করতে পারেন! এবার দেখা যাক্ হাতে নাতে!
সোনালী বলল–আমরা একটা মার্ডার কেস সাজাব, বুঝলেন?
হ্যাঁ, বলে যান।
এই সময় ড্রয়িং রুমের দরজা থেকে একটি মুখ উঁকি মারল চিনলুম। একটু আগেই আলাপ হয়েছে। অনিরুদ্ধের পি. এ. রণধীর চোপরা! বেশ স্মার্ট হাসিখুশি যুবক। এসে বিশুদ্ধ বাংলায় বলল–ডিসটার্ব করলুম না তো?
সোনালী উৎসাহ দেখিয়ে বললব্যস, মেঘ না চাইতেই জল। রণধীরদা, তোমাকে দলে নিলুম তাহলে। ব্যস, আমরা মোট ছ’জন ব্যাপারটা জানলুম। এবার প্ল্যানটা বলি। আমরা একটা চমৎকার মার্ডার কেস সাজাব। কিছু ক্লু রাখব। দেখব, কর্নেলের গোয়েন্দা বুদ্ধি কতখানি।
রত্না বিরক্ত হয়ে বলল–আহা, বলেই ফেল না বাবা। শুধু ভূমিকা করছিস।
সোনালী সিরিয়াস হয়ে চাপা গলায় বলতে শুরু করল–ওই যে গেট রয়েছে, তার বাইরে ঝোপঝাড়গুলোর মধ্যে একজায়গায় আমরা একটা ডেডবডি রাখব।
চোপরা বিস্ময়মেশানো আতঙ্কে বলল–সর্বনাশ! ডেডবডি?
সোনালী ধমক দিয়ে বলল–ভ্যাট, কিস্যু বোঝে না! রিয়েল ডেডবডি নয় নকল। আমরা দীপ্তিকে ডেডবডি করব। আমাদের থিয়েটার ক্লাবের একটা টিনের ছোরা আছে। ছোরাটার ডগাটা চাপ দিলে ভেতরে ঢুকে যায় এবং বডিতে আটকে পড়ে। কেমন? দীপ্তির বুকে সেটা আটকে থাকবে।
দীপ্তি এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার বলে উঠল–না, না! পিঠে!
–বেশ, পিঠেই। পিঠে আটকে দিয়ে লাল রঙ ছড়িয়ে দেব। সে আমি ম্যানেজ করব’খন। একেবারে টাটকা দল-দলা রক্তের মতো দেখাবে। দীপ্তি মড়া সেজে পড়ে থাকবে। এবার ক্লু। ক্লু থাকবে একটা পোড়া দেশলাই কাঠি, আধপোড়া সিগারেট তিন চারটে…
দিব্য বলল–তাহলে আমাকে ধরে ফেলবে। আমি চেইন স্মোকার।
চোপরা বলল–আমাকেও। আমিও চেইন স্মোকার।
সোনালী বলল–তাহলে অন্য ক্লুর কথা ভাববো। জয়ন্তবাবু কী বলেন?
বললুম–কিন্তু তার আগে বলুন, আপনারা খুনী হিসেবে একজনকে নিশ্চয় ধরে রাখছেন! সে রোলটা কে নিচ্ছেন?
–দিব্য। দিব্য, তুমি রাজী তো?
দিব্যেন্দু আমতা হেসে বলল–বেশ। কিন্তু…
সোনালী বলল–কোনও কিন্তু নয়। তুমিই কিলার। এবার জয়ন্তবাবু বলুন।
বললুম–ক্লু খুব সহজ হওয়া চাই। কারণ, এটাতো জাস্ট এ গেম। নিছক খেলা! কর্নেলের যা স্বভাব, প্রথমে সত্যিকার খুন ভেবে খুব সিরিয়াস হয়ে পড়বেন এবং তক্ষুণি পুলিশ ডাকতে বলবেন। ফোরেন্সিক বিশেষজ্ঞ আসতে বলবেন। এবং অ্যাম্বুল্যান্স ইত্যাদি এসে যাবে।
সোনালী ব্যস্তভাবে বলল–সর্বনাশ! তাহলে তো ওঁকে…
বাধা দিয়ে বললুম–উনি ডেডবডি দেখে তেমন কিছু করার আগেই আপনারা দৌড়ে গিয়ে তখন বলবেন, আপনিই হত্যাকারীকে খুঁজে বের করুন! দেখি, আপনি কেমন গোয়েন্দা! না পারলে পুলিশ তো আছেই।
সবাই হেসে উঠল। সোনালী বলল–ইউরেকা! একটা ক্লু আমার মাথায় এসেছে। নীচের দিকে নদীতে এখন ফ্লাডটা কমেছে। কিন্তু পলি জমে আছে পাড়ের জঙ্গলে। দিব্যর পায়ে জুতোর সেই কাদা লেগে থাকবে। এবং দীপ্তির ডেডবডির কাছে কিছু কাদা ফেলে রাখা হবে। যতক্ষণ খেলা চলবে, দিব্য সেই জুতোই পরে থাকবে। কেমন? জয়ন্তবাবু, কর্নেল অত খুঁটিয়ে কি লক্ষ্য করবেন?
বললুম–কে জানে! তবে বুড়ো বড্ড সেয়ানা।
দিব্যকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। বলল–তাহলে সন্দেহ তো একজনের ওপরেই পড়ার মতো ক্লু রাখা হচ্ছে। এমন সব চিহ্ন রাখো, যাতে কর্নেল প্রত্যেককেই সন্দেহ করেন।
রত্না সায় দিয়ে বলল–এই! দাদা কিন্তু ঠিকই বলেছে রে! রণধীরদা, তোমাকে সন্দেহ করার মতো কী চিহ্ন রাখা যায় বলে তো?
চোপরা একটু ভেবে নিয়ে বলল–আমার লাইটারটা ফেলে রাখব কোথাও। ডেডবডির কাছাকাছি। তার মানে, আমি ও দীপ্তি ধরো কথা বলছিলুম ওখানে। আমি চলে এলুম, দীপ্তি থাকল। তারপর খুন হয়ে গেল ও।
সোনালী বলল–চমৎকার। আমরা সাক্ষী দেব, মানে আমিই বলব যে দীপ্তি আর রণধীরদার ঝগড়া হচ্ছিল ওখানে। বাংলোর এই বারান্দা থেকে শুনেছি।
চোপরাকেও এবার নার্ভাস দেখাল। সে বলল–তাহলে দুজন মোটে সাসপেক্ট?
সোনালী বলল–আরেকজন হলে ভাল হতো। কর্নেলকে গোলমালে ফেলা যেত। কিন্তু পুরুষমানুষ ছাড়া মার্ডারার হয় না। মানায়ও না!
দিব্য আপত্তি করে বলল–মোটেও না। মেয়েরাও ছোরা চালায়।
সোনালী, রত্না, দীপ্তি একসঙ্গে বলে উঠল–না, না! মোটেও না।
আমি একটু হেসে বললুম–হ্যাঁ, ছোরাটোরা মেয়েদের মার্ডার উইপন নয় সচরাচর। রিভলবার বরং চালাতে শুনেছি। তবে সেটা বিরল কেস। সচরাচর বিষই মেয়েদের মার্ডার উইপন! এক্সকিউজ মি, এ কিন্তু স্বয়ং কর্নেলেরই সিদ্ধান্ত।
চোপরা বলল–মহিলা গোয়েন্দাকাহিনীকার আগাথা ক্রিস্টিরও এই মত।
মেয়েরা একসঙ্গে সায় দিয়ে হেসে বলল–খানিকটা কারেক্ট।
সোনালী বলল–তৃতীয় পুরুষমানুষ অবশ্য জয়ন্তবাবু আছেন। কিন্তু…
বললুম– কর্নেল আমাকে হিসেবে ধরবেনই না। সুতরাং আমারই খুনী হবার স্কোপ ছিল এবং আপনারা কর্নেলকে পরাস্ত করতে পারতেন।
দিব্যেন্দু অমনি ব্যস্ত হয়ে উঠল। বলল–সোনালী! তোমরা বরং জয়ন্তবাবুকেই খুনী করো।
সোনালী রত্না ও দীপ্তির দিকে তাকাল। ইতিমধ্যে ওদের ফানটা আমার দারুণ ভাল লেগে গেছে। কর্নেলকে নিয়ে এমন মজা করার সুযোগ কখনও পাইনি। তাই বলে উঠলুম-ঠিক আছে। আমিই খুনী হলুম। নদীর পলিতে হেঁটে আসব আমিই। আর দিব্যবাবু বরং অন্যতম সাসপেক্টেড হয়ে ওঠার জন্য অন্য কোনও ক্লু রাখবেন।
দিব্যেন্দু বলল–আমি…আমি ওখানে আমার একটা বিশেষ ব্ৰাণ্ডের সিগ্রেটের টুকরো ফেলে আসব। এই সিগ্রেট জয়ন্তবাবু বা রণধীর খান না। খান কি?
আমি ও চোপরা ওর ব্রাণ্ড দেখে বললুম–না।
সোনালী খুব খুশি হয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল-এবার কফি খাওয়া যাক। এতক্ষণ তৈরি নিশ্চয়। কফি খেতে-খেতে আরও ডিটেলস আলোচনা করা যাবে।
ওকে সতর্ক করে দিয়ে বললুম–দেখবেন, কর্নেল যেন এদিকে না এসে পড়েন! কী অবস্থায় আছেন, দেখে আসবেন কিন্তু।
সোনালী মাথা দুলিয়ে চলে গেল। আমি দীপ্তির দিকে তাকালুম। দীপ্তি কি নার্ভাস হয়ে পড়ছে ক্রমশ? তাকে কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। হেসে বললুম– ভয় পেয়েছেন দীপ্তি?
দীপ্তির হাসিতে শুকনো ভাবটা ঢাকা গেল না। রত্ন বলল-ও ভয় পাবে কী? আপনি তো জানেন না, আমাদের থিয়েটার ক্লাবের সবচেয়ে পাকা অভিনেত্রী ও। নাচতে গাইতেও পারে। কাল সোনালীর জন্মদিনে ওর কীর্তি দেখে আপনার তাক লেগে যাবে।
দীপ্তি যেন বিরক্ত হলো। বললবাজে বকিসনে, রত্না। জয়ন্তবাবু কলকাতায় থাকেন, ভুলে যাস্ নে। আদাড়ে গাঁয়ে শেয়াল রাজা আমি।
কথা কেড়ে রত্না বলল-রানী বলো, দীপ্তি।
সবাই হাসল। চোপরা বলল–কাল ফাংশানের প্রোগ্রাম কি এখনও আমায় জানানো হয়নি কিন্তু। একেবারে লাস্ট মোমেন্টে বলবে, তখন ম্যানেজ করতে পারব না বলে দিচ্ছি। প্রোগ্রাম ডিরেক্টর নিশ্চয় রত্না?
রত্নাকে একটু বিরস দেখাল। বলল–বেশি কিছু করা যাবে না। মেসোমশাই বলেছেন–খুব ধুমধাম করা হবে না। বেশি কেউ আসছেনও না। লোকাল লোক আর বাইরের মিলে বড় জোর জনা দশ বারো। অবশ্য ড্রইংরুমটা বড়ো। স্টেজ হবে না। দীপ্তিই নাচবে-গাইবে!
দীপ্তি বলল–এবং তুমিও।
রত্না কী বলতে যাচ্ছিল, সোনালী ও একজন পরিচারিকা ট্রে নিয়ে এল। সোনালী ফিসফিস করে বলল-কর্নেল গম্ভীর মুখে কী একটা প্রকাণ্ড বই পড়ছেন। বাবা পাশে তেমনি গম্ভীর মুখে বসে আছেন। কিন্তু মুশকিল হয়ে গেছে। মা জানতে পেরেছেন সব। বারণ করেছিলেন। আমার ভয় করছে বাবার কানে না তোলেন!
রত্না বলল-এই রে! সেরেছে! মাসিমাকে জানাল কে?
দিব্য বলল–আমি তো কিছু বলিনি। নিশ্চয় দীপ্তি বলেছে।
কাঁচুমাচু হয়ে দীপ্তি বলল–মানে, ওঘরে যখন সোনালী আর রত্নার সঙ্গে এনিয়ে আলোচনা করছিলুম, মাসিমার কানে গিয়েছিল। আমি বেরোলে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন–মার্ডার-টার্ডার কী সব বলছি? উনি যা মানুষ, হইচই করে ফেলবেন–এই ভয়ে বলতে হলো। উনি আমাকে নিষেধ করছিলেন।
চোপরা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল–তাহলে দি গেম ইজ ফিনিশ। উনি বাধা দেবেন। আই নো ইট।
সোনালী একটু ভেবে বলল–এক কাজ করা যাক। টাইমটা পাল্টে সকাল ন’টার বদলে ভোর ছটা। অত সকালে মায়ের ঘুম ভাঙবে না। রণধীরদা, তুমি কিন্তু ভোর পাঁচটায় আসছ। দিব্য, রত্না, দীপ্তি–সবাই ঠিক ওই সময়ে। জয়ন্তবাবু, আপনার ঘুম ভাঙবে তো?
বললুম–হ্যাঁ। তবে কর্নেলেরও ভাঙবে। এবং উনি অভ্যাসমত বেড়াতে বেরোবেন।
সোনালী বলল–বাঃ! তাহলে তো চমৎকার সুযোগ। উনি ফিরলেই আমরা ঝটপট দীপ্তিকে ওখানে রেখে চলে আসব। খবর দেবে–এই রে! মার্ডারটা কার প্রথম চোখে পড়বে ঠিক করা হয়নি যে!
রত্না বলল-দাদাই দিক না। দাদাও ধরো মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছিল। ফিরে এসে চোখে পড়েছে! ব্যস!
দিব্য বলল–বেশ। কিন্তু মোটিভ কী রাখছ খুনের? বলে সে দীপ্তির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকল।
রত্না মুখ টিপে হেসে বলল–মোটিভ ইজ প্রেমের প্রতিহিংসা। দাদা, চোপরা এবং জয়ন্তবাবু তিনজন প্রেমিক, একজন প্রেমিকা।
দীপ্তি হইচই করে বলল–যাঃ!
তার মুখ রাঙা দেখাচ্ছিল। বললুম–এতে সংকোচের কী আছে মিস দীপ্তি? জাস্ট এ গেম। অভিনয়। আপনি নিশ্চয় প্রেমিকার ভূমিকায় থিয়েটারে অভিনয় করেছেন।
সোনালী বলল–একশোটা করেছে। তুলনাহীন অভিনয়।
দীপ্তি হঠাৎ ঘুরে বলল–আচ্ছা, ধরুন যদি এমন হয়–মানে, আপনারা তিনজনের একজন কোনও গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন এবং আমি সেটা টের পেয়েছিলুম বলেই আমাকে… মানে…
চোপরা হো হো করে হেসে বলল–চমৎকার! কিন্তু ষড়যন্ত্র কিসের?
ধরুন, এখানে অয়েল রিফাইনারিতে কোনও সাবোটাজ করার জন্য …..
দিব্য বাধা দিল–এক মিনিট। ব্যাপারটা খুব জটিল আর কষ্টকল্পিত।
দীপ্তি যেন জেদ ধরল। কেন? এমন হচ্ছে না আজকাল? সরকারী প্রজেক্টে বিদেশী এজেন্টের লোকেরা অন্তর্ঘাত করার চেষ্টা করেছে না?
চোপরা বলল–ব্রিলিয়ান্ট! খুব স্বাভাবিক মোটিভ। কিন্তু তার তো ক্লু থাকা চাই।
দীপ্তি বলল–ধরুন, আমার কাছে কোনও টুকরো কাগজ থাকবে এবং তাতে কোনও সাংকেতিক কিছু লেখা থাকবে! ভাববেন না, সে আমি নিজেই ম্যানেজ করব’খন। কাগজটা ছেঁড়া হবে এবং আমার মুঠোর মধ্যে লুকানো থাকবে।…
সোনালী হাসতে হাসতে বলল-বুঝেছি। দীপ্তি এই তিনজনের প্রেমিকা হতে চায় না! পছন্দ হচ্ছে না। তাই বাপস! অয়েল রিফাইনারিতে সাবোটাজ! বাবাকেও জড়াচ্ছে! তবে এই মোটিভটা খুব সিরিয়াস। গেমটা আরও জমবে। কর্নেলের বুদ্ধি গুলিয়ে যাক্ না!
আমি কিন্তু চমকে উঠেছিলুম। দীপ্তির মুখে কী একটা টের পাচ্ছিলুম। সেটা ঠিক কী, বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। একটা দৃঢ়তাই কি দেখলুম? অস্বস্তি হলো। সেই মুহূর্তে কর্নেলকে দেখা গেল দরজায়। আমরা তাকালুম। কিন্তু কর্নেল ফের ঢুকে গেলেন। সোনালী চাপা হেসে সন্দিগ্ধ মুখে বলল–শুনলেন না তো কিছু?
.
সে-রাত শুতে গিয়ে দেখি কর্নেল বেজায় গম্ভীর। আমি শুয়ে পড়লুম। উনি টেবিল ল্যাম্পের সামনে বসে একটা প্রকাণ্ড বই পড়তে থাকলেন। বললুম–ব্যাপার কী? সরাদিন ট্রেনজার্নির পর ওই বুড়ো হাড়ের ভেল্কি দেখানো কেন? আলোয় আমার ঘুম আসে না।
কর্নেল বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই বললেন–এক মিনিট, জয়ন্ত। টি ই লরেন্স চ্যাপটারটার আর এক প্যারা বাকি। তুমি প্লীজ একটুখানি ধৈর্য ধরো। লাভবান হবে।
–আমার কিসের লাভ?
–থ্রি জিরোর তত্ত্ব আঁচ করেছি ডার্লিং! দৈনিক সত্যসেবক-এ এটা ছাপা হলে কাগজের বিক্রি বাড়বে এবং তোমারও বেতনের ইনক্রিমেন্ট হবে। লাভটা তো তোমারই।
অতএব ধৈর্য ধরলুম। কিন্তু সকাল-সকাল ঘুমিয়ে না পড়লে ভোর পাঁচটায় ওঠা কঠিন হবে। মনে মনে হাসলুম। ওঁকে নিয়ে সোনালীরা যা মজা করতে যাচ্ছে, উনি তো টেরও পাচ্ছেন না। মার্ডার গেমটা যে নিছক ফান, তা টের পাবার মুহূর্ত অব্দি উনি ওই থ্রি জিরোর তত্ত্বের সঙ্গে দীপ্তির এই অদ্ভুত হত্যাকাণ্ড জড়িয়ে কী না নাজেহাল হবেন! মাথায় একটা মতলব গজালো। দীপ্তি কর্নেল যাওয়ামাত্র যেন ধরা না দেয়। অন্তত আধঘণ্টা ওঁকে নাজেহাল করা যাবে। তারপর ফাঁস করা হবে যে ব্যাপারটা ফান। ভোরে এই প্রস্তাবটা ওদের দেব।…
চোখ খুলতেই দেখি আমার বৃদ্ধ বন্ধুটি কখন নিঃশব্দে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং আমাকে দেখছেন। বললেন–তুমি চোখ বুজে হাসতে অভ্যস্ত, তা তো জানতুম না ডার্লিং! নিশ্চয় তেমন কিছু ব্যাপার ঘটেছে। আর শোন, তোমার ওই হাসিটুকুর মধ্যে দুষ্টু ছেলের আদল লক্ষ্য করছিলুম। নিশ্চয় কোনও মতলব ভাঁজছিলে।
গম্ভীর হয়ে বললুম–ভাঁজছিলুম। আপনি তো গোয়েন্দা– নাকি মনের চিন্তার আভাস মুখেও বুঝতে পারেন। আপনিই বলুন, কী মতলব ভাঁজছিলুম?
কর্নেল আমার পাশেই খাটে পা ঝুলিয়ে বসলেন। তারপর বললেন-জয়ন্ত, আমি অন্তর্যামী নই। তবে এটুকু টের পাচ্ছি যে তোমরা কজন যুবক যুবতী মিলে একটা কিছু ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যাক্ গে–এবার শোনো থ্রি জিরোর ব্যাপারটা। পশ্চিম এশিয়ার অর্থনীতি বইটার তিরিশ পাতায় লরেন্সের কাহিনী আছে। খুব মন দিয়ে পড়ছিলুম আর মনে হচ্ছিল, সত্যি-বড় বিচিত্র মানুষ ওই লরেন্স! কী বিপুল ইচ্ছাশক্তি! কী সাহস আর ধৈর্য! পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতাও কী অসাধারণ! ওঃ!
ওঁর যেন ভাবাবেগের ঘোর লেগে গেল। চোখ বুজে যেভাবে মাথা নাড়া দিলেন, বারকতক, মনে হলো রোমাঞ্চ সামলাচ্ছেন। অবাক হয়ে বললুম–ব্যাপারটা কী? হঠাৎ লরেন্সকে নিয়ে এত উচ্ছ্বাস কেন?
কর্নেল চোখ খুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–তুমি জানো না জয়ন্ত! একটা প্রচণ্ড প্রাণশক্তি না থাকলে তুরস্ক সরকারের অস্ত্রশস্ত্র আর রসদবাহী মালগাড়ির ওপর মাত্র জনাকতক বেদুইন গ্যাংস্টার নিয়ে হামলা করা যায় না। বোঝে ব্যাপারখানা। মালগাড়িতে সশস্ত্র সেনারাও ছিল। তাদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের বিরুদ্ধে লরেন্স নিতান্ত সাধারণ অস্ত্র নিয়ে লড়লেন! এবং…
বাধা দিয়ে বললুম–শুনেছি, মানে ছবিতে দেখেছি–আগে থেকে ডিনামাইট পোঁতা হয়েছিল লাইনের তলায়। যাই বলুন, এটা নিছক সাবোটাজ! এমন অন্তর্ঘাতমূলক কাজ যেকোনও বাচ্চাই করতে পারে। লরেন্সের মহিমাটা টের পাচ্ছি না।
কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–পাচ্ছ না বুঝি?
নাঃ।
কর্নেল হঠাৎ হাসলেন একটু। তারপর মাথা নেড়ে বললেন-হ্যাঁ, তা ঠিক। সাবোটাজ করতে খুব একটা বীরত্ব লাগে না! রাইট, রাইট! সাবোটাজ!
কর্নেল বারবার সাবোটাজ শব্দটা আওড়াতে-আওড়াতে ফের টেবিলে গিয়ে বসলেন। বইটা খুললেন। তখন বিরক্ত হয়ে বললুম–আবার পড়তে বসলেন নাকি?
কর্নেল বইটা খুলে কী দেখে নিয়েই বন্ধ করলেন এবং টেবিল-বাতির সুইচ অফ করে বললেন-জয়ন্ত, আশা করি এবার তোমার সুনিদ্রা হবে।
ওঁর ছোট টর্চটা জ্বলতে জ্বলতে কোণের অন্য বিছানার দিকে এগোল। একটা চাপা শব্দ হলো অন্ধকারে। বুঝলুম, উনি শুয়ে পড়লেন।
এবং কয়েক মিনিট পরেই ওঁর নাক ডাকা শুরু হলো। কী অদ্ভুত মানুষ!….
.
অচেনা জায়গায় আমার ঘুম হয় না। তাতে ভোরে ওঠার তাগিদ ছিল। রাতটা প্রায় জেগেই কাটালুম। পাশের ড্রইং রুমের দেয়ালঘড়ির ঘণ্টা প্রত্যেকবারই শুনেছি। যখন তিনবার বাজল, তখন টের পেলুম ঘুমের টান আসছে। অমনি সিগ্রেট ধরালুম। কর্নেলের নাক ডাকা মাঝে মাঝে বন্ধ হচ্ছে। অস্ফুট কী যেন বলছে–হয়তো ঘুমের ঘোরে। আবার নাক ডাকছে। সিগ্রেট খাওয়ায় কাজ হলো। ঘুম আর এলও না। চারটেয় আমি উঠে বাথরুমে ঘুরে এলুম, তারপরে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলুম। পাঁচটায় কর্নেল উঠলেন। বাথরুমে গেলেন। তারপর যথারীতি টুপি ও ছড়ি নিয়ে বেরোলেন। দরজাটা আস্তে বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিলেন। ওঁকে খুব ঠকাচ্ছি ভেবে আমার মনটা খুশি।
পাঁচটায় বাইরের (দক্ষিণে) সেই বারান্দায় পায়ের শব্দ পেলুম। কোথায় গাড়ির আওয়াজ হলো। বেরিয়ে দেখি, সোনালী রত্না দিব্য তৈরি হয়ে আমার অপেক্ষা করছে। বারান্দায় কফি খেতে খেতে চোপরা এল। কথামতো সে দীপ্তির বাসা থেকে দীপ্তিকে সঙ্গে এনেছে। কফি খাওয়া শেষ হলে সোনালী বলল-জয়ন্তবাবু! কুইক! চলুন, আমরা সাইট সিলেকশনটা করে ফেলি।
সোনালী একটা ব্যাগে থিয়েটারের ছোরা আর পেন্টের সরঞ্জাম নিয়েছে। আমরা তক্ষুণি গেট পেরিয়ে ছোট একটা রাস্তায় গেলুম। তার ওধারে ঘন গাছপালা ঝোপঝাড় ঢালু হয়ে নীচের উপত্যকায় নেমে গেছে। রাস্তা থেকে আন্দাজ পনের ফুট দূরে ঝোপের মধ্যে একটা বড় পাথর পাওয়া গেল। গাছপালা ঘাস এবং পাথরটা শিশিরে চবচবে হয়ে আছে। আমি ভেবেই পেলুম না, কীভাবে দীপ্তি মড়া হয়ে এখানে শোবে। দীপ্তির দিকে তাকালুম। এখন দেখি, সে যেন মরীয়া। তার মুখেচোখে দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ পাচ্ছে। সে বসে পড়ল এবং সোনালী তার পিঠে ছুরিটা সেট করতে থাকল। দিব্য বলল–জয়ন্তবাবু! আপনি সোজা এই রাস্তা দিয়ে এগোলে ঘুরতে ঘুরতে নদীর ধারে পড়বেন। সেখান থেকে পলি এনে ছড়িয়ে বাংলোয় যাবেন নিজের ঘরে। রণধীর, তুমি বরং পূর্বে এগিয়ে ওই বড় রাস্তায় যাও। আমি যাচ্ছি পশ্চিমে বড় রাস্তায় ঘুরতে। সোনালী আর রত্না যাবে বারান্দায়। সবাই বাংলোয় ফিরে আধঘণ্টা অপেক্ষা করবে। তারপর এখানে আসবে একেবারে কর্নেলকে নিয়েই।
দীপ্তি ওই অবস্থায় বসে খুঁতখুঁতে গলায় বলল–এতক্ষণ পড়ে থাকতে হবে এই ঠাণ্ডায়?
সোনালী ধমক দিয়ে বলল– প্রোপাজালটা কিন্তু তোমারই। ভুলে যেও না।
দীপ্তি করুণ মুখে ফের বলল–যদি কর্নেলের ফিরতে অনেক দেরী হয়ে যায়।
আমি বললুম– হবে না। ঠিক ছটায় আজকাল উনি যোগাসন করেন।
সোনালী কাজ করতে করতে বলল কুইক! দেরী হয়ে যাচ্ছে। পাঁচটা পঁয়ত্রিশ হয়ে গেল।
দিব্য ও চোপরা পরস্পর উল্টোদিকে চলে গেল। আমি পা বাড়িয়ে একবার ঘুরে দেখে নিলুম–দীপ্তির পিঠে ছোরাটা অদ্ভুত কৌশলে বসানো হয়েছে এবং সোনালী অশেষ যত্নে টকটকে লাল রঙ মেশাচ্ছে–অবিকল টাটকা রক্ত যেন! আমার গা শিউরে উঠল। কী ভয়ঙ্কর দৃশ্যই না দেখাচ্ছে! ..
ছোট্ট রাস্তাটা একটু পুবে এগিয়ে রাস্তার গা ঘেঁষে দক্ষিণে ঘুরেছে এবং নীচের দিকে নেমেছে। বিস্তৃত সবুজ উপত্যকা ও ভরা নদী চোখে পড়ল বাঁক থেকে। ভোরের ধূসর আলো কুয়াশায় নীল রঙ ছড়াচ্ছে। একটু শীত লাগছিল। কিন্তু চারপাশে পাখির ডাক, এই সবুজ সুন্দর বনভূমি নেশা ধরিয়ে দিচ্ছিল।
হাঁটছিলুম বেশ জোরে। কারণ খুব শিগগির ঘুরে আসতে হবে। জুতোর তলায় পলি নিয়ে সেই পলি ছড়িয়ে আসতে হবে অকুস্থলে। তারপর যেন কিছু জানিনে এইভাবে নিজের ঘরে বসে কর্নেলের অপেক্ষা করতে হবে। প্ল্যানটা নির্ভর করছে প্রত্যেকের সময় জ্ঞান এবং দক্ষ অভিনয়ের ওপর।
দশ মিনিটের মধ্যেই নদীর ধারে পৌঁছলুম। পাহাড়ী নদী। স্রোত বইছে প্রচণ্ড। পাড়ে যেখানে পলি জমেছে, সেখানে বার কতক হাঁটলুম। যখন জুতোর রবারের সোলে যথেষ্ট পলি জমল, তখন ফেরা শুরু হলো।
ওঠার সময় হঠাৎ বাঁদিকে দূরে একটা টিলা থেকে কর্নেলকে নেমে আসতে দেখে থমকে দাঁড়ালুম। কর্নেল নীচে অদৃশ্য হলেই হুঁশ হলো যে সময় চলে যাচ্ছে। বেশ জোরে হাঁটা শুরু করলুম।
অকুস্থলে পৌঁছে একটু অস্বস্তি হলো। কিন্তু এ সবই তো নিছক ফান ভেবে হাসতে হাসতে জুতোর তলা থেকে খানিকটা পলি ছড়িয়ে দিলুম। তারপর ঝোপের ফাঁকে উঁকি মেরে পাথরটার কাছে দীপ্তিকে দেখতে পেলুম। দৃশ্যটা মারাত্মক। তাই ফের অস্বস্তি জাগল। দীপ্তি কাত হয়ে পাথরে হেলান দেওয়ার মতো মাটিতে বসেছে–মাটিতে ঘাস নেই। ওর শাড়িটা পাথরে ও মাটিতে এমন কায়দায় রাখা যে ওকে শিশিরের ঠাণ্ডাটা পেতে হচ্ছে না। পিঠে বাঁদিকে ছোরার বাঁট এবং অবিকল রক্ত চবচব করছে! দীপ্তি চোখ বুজে মুখ নামিয়ে পাথরে মাথাটা ঠেকিয়ে রেখেছে। ফিসফিস করে ডেকেছি–হঠাৎ শিসের শব্দ হলো। ঘুরে দেখি, রাস্তা থেকে সোনালী হাত নাড়ছে। কিছু পলিমাটি দীপ্তির কাছে ছড়িয়ে তক্ষুণি ওর কাছে গেলুম। সোনালী বলে উঠল-কুইক! কর্নেল ফিরছেন–ওই দেখুন!
পশ্চিমে বাংলোর গেট। ফুল গাছের আড়ালে ওঁর টুপি চোখে পড়ল। আমরা দুজনে গেট দিয়ে প্রায় দৌড়ে বারান্দার উঠলুম। দিব্য ও চোপরাকে বসে থাকতে দেখলুম। রত্না মুখে দুষ্টু-দুষ্টু ভাব ফুটিয়ে বসে আছে।
সোনালী বলল-জয়ন্তবাবু! আপনি আর ঘরে যাবেন না! এখানে থাকুন। প্রথমে আমিই কিন্তু হইচই জুড়ে দেব। রেডি! পাঁচ গোনার পর গেম শুরু হবে। রেডি! ওয়ান…টু…থ্রি…ফোর…
পাঁচ বলার সঙ্গে সঙ্গে দিব্যেন্দু উঠল এবং বিকট ভঙ্গি করে চেঁচিয়ে উঠল– খুন! খুন!
একই মুহূর্তে আমার চোখ গেল সোনালীর দিকে। সোনালী যেন হতভম্ব হয়ে পড়েছে কারণ এখানে তার ভূমিকাই প্রথম এবং মূল ছিল। অবাক আমিও। দিব্যেন্দুর মতো ভব্য ছেলে এই সুন্দর শারদীয় ভোরবেলাটাই যেন খুন করে ফেলল!
তারপর সোনালী একঝিলিক হেসেছে এবং ভুরু কুঁচকে দিব্যেন্দুকে যেন ধমকই দিয়েছে। দৌড়ে গেছে কর্নেলের উদ্দেশে। দিব্যেন্দু সমানে চেঁচাচ্ছে–খুন! খুন! এবং চোপরাও গলা মেলাল। রত্না হাসি চাপছে দেখলুম। দিব্যেন্দু আমার দিকে হাত নেড়ে তার সঙ্গে গলা মেশাতে ইশারা দিল। আমি ঘাবড়ে গেছি।
মাত্র কয়েকটি সেকেণ্ড এসব ঘটল।
বাবুর্চি-চাকর-দারোয়ান-মালী-পরিচারিকাপ্রমুখ ভৃত্যগোষ্ঠী যেন দুপাশের উইংস থেকে স্টেজে প্রবেশ করল। তারপর রাতের গাউনপরা এবং আরক্ত চোখ নিয়ে স্বয়ং অনিরুদ্ধ বেরিয়ে এলেন।
এও কয়েক সেকেণ্ডের ঘটনা।
তারপর কর্নেলকে বেরুতে দেখলুম। তার পাশে সোনালী হাতমুখ নেড়ে কী বলতে বলতে এগোচ্ছে। কর্নেলের ভঙ্গিতে প্রচণ্ড ব্যস্ততা। সত্যিসত্যি খুনের গন্ধ পেয়ে যেন শকুনের মতো ওঁর স্বভাবসিদ্ধ রীতিতে এগিয়ে আসছেন। সোনালী অদ্ভুত অভিনয় করছে বলা যায়। সে হাত তুলে ওদিকটা দেখিয়ে ভয়ার্ত স্বরে চেঁচাল-ওদিকে! ওখানে-ওখানে!
অনিরুদ্ধের মুখেও ভীষণ আতঙ্কের ছাপ। ঠোঁট কাঁপছে দেখলুম। বাকশক্তি রহিত।
এরপর সোনালী ও কর্নেলের পিছন পিছন আমরা লন পেরিয়ে গেট দিয়ে ছোট রাস্তায় পড়লুম। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিলুম বারান্দায় রত্না রয়ে গেছে এবং অনিরুদ্ধকে কিছু বলছে। দ্বিতীয়বার ঘুরে দেখলুম, অনিরুদ্ধ ঘরে ঢুকছেন–অর্থাৎ মজাটা জেনে গেছেন। রত্না দৌড়ে আসছে।
ঝোপ ঠেলে পাথরটার সামনে কর্নেল দাঁড়ালেন এবং দীপ্তিকে ওই অবস্থায় দেখে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন–এ কী!
ওঁর পিছনে দাঁড়িয়ে চোপরা এবার নিঃশব্দে হাসতে থাকল। দিব্যেন্দু ভুরু কুঁচকে ওকে ধমকাল বটে, নিঃশব্দে চুপিচুপি নিজেও হাসতে শুরু করল। সোনালী কান্নার গলায় বারবার বলতে থাকল–বেঁচে আছে তো কর্নেল? দীপ্তিকে কে খুন করল?
সত্যি, বড় চমৎকার অভিনয় করতে পারে মেয়েটি।
হঠাৎ কর্নেল ঘুরে আমাদের সবাইকে যেন একবার দেখে নিলেন। তারপর পা বাড়িয়ে দীপ্তির কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়লেন। আমরা সবাই চুপ। মজার চরম মুহূর্ত উপস্থিত।
কর্নেল যেই দীপ্তির একটা হাত তুলে নাড়ি পরীক্ষা করতে গেলেন, অমনি রত্না আর নিজেকে সামলাতে পারল না। সব নিষেধ ভুলে খিলখিল করে হেসে উঠল। সোনালীও নিঃশব্দ ধমক দিতে গিয়ে তাল হারাল। এবং সেও হেসে ফেলল। দেখাদেখি আমিও হো হো করে হেসে উঠলুম। দিব্যেন্দু আমার পাঁজরে চিমটি। কাটল। চোপরা একটু পিছনে দাঁড়িয়ে হাসছে। ভৃত্যগোষ্ঠী আমাদের হাসি দেখে প্রথমে হতবাক, স্তম্ভিত–পরে মজাটা টের পেয়ে গেছে। তাদেরও দাঁতগুলো ভোরের লালচে আলোয় ঝকমক করতে দেখলুম।
রত্নার হাসি শুনেই কর্নেল ঘুরেছিলেন। কিন্তু ওঁর মুখে কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। উনি সিরিয়াস হয়েই নাড়ি পরখ করছেন। এবং ওঁর চোখে সেই সুপরিচিত তীক্ষ্ণতা লক্ষ্য করে আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলুম।
সোনালী হাসতে হাসতে বলে উঠল দীপ্তি! দি গেম ইজ ওভার! উঠে পড়!
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। রত্না হাসতে হাসতে বলল কর্নেল! এবার কিন্তু মার্ডারারকে আপনার খুঁজে বের করা চাই। অনেক ক্লু আছে!
সোনালী দীপ্তির দিকে এগিয়ে ধমকের সুরে বলল–আঃ! ওঠ না! এই দীপ্তি! ওঠ!
কর্নেল গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন দীপ্তি উঠবে না।
সোনালী বললে উঠবে না মানে?
–ওর ওঠার ক্ষমতা আর নেই।..বলে কর্নেল আমার দিকে দ্রুত ঘুরলেন। জয়ন্ত, শীগগির যাও। অনিরুদ্ধবাবুকে খবর দাও। এবং ফোনে থানায় জানাতে বলো।
বাধা দিয়ে দিব্যেন্দু বলল–কিন্তু স্যার, পুলিশ এলে ফানটা মাঠে মারা যাবে।
কর্নেল হঠাৎ গর্জন করে উঠলেন–নো, নো মাই ইয়ং ফেণ্ড! ইট ইজ নো ফান! এটা সত্যিকার খুন। দীপ্তিকে কেউ সত্যিকার ছোরা দিয়ে খুন করেছে।
দিব্যেন্দু, রত্না ও চোপরা একসঙ্গে বলে উঠল–অসম্ভব! আমিও বলে উঠলুম– কর্নেল! কী বলছেন! এ তো নিছক মজা করার জন্যে…
কর্নেল ফের গর্জে উঠলেন শাট আপ! যা বললুম– করো গিয়ে। কুইক!
আমি যন্ত্রের মতো পা বাড়ালুম। পিছনে স্তব্ধতা। এতক্ষণে টের পেয়েছি, কর্নেল সত্যি রসিকতা করছেন না এবং দীপ্তি সত্যি সত্যি খুন হয়ে গেছে। আমার পা কাঁপতে লাগল। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে টাল সামলালুম।
বারান্দায় উঠে এবার পিছু ফিরে দেখি, দলটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।..
.
কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে থেকে অনেক হত্যাকাণ্ড দেখেছি আমি এযাবৎ। কিন্তু এটি সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং অদ্ভুত। পনের মিনিটের মধ্যে রানীডিহির পুলিশ এসে গিয়েছিল। এখানে একটা অয়েল রিফাইনারি থাকায় কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর লোকজনও ছিল। আর ছিল রাজ্যের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের কুশলী অফিসারগোষ্ঠী। পরবর্তী আধঘণ্টায় তারা সবাই এসে পড়লেন। কর্নেল এই হত্যাকাণ্ডকে সাধারণ খুন বলে গণ্য করেননি, তা বোঝা যাচ্ছিল।
যেখানে মানুষ খুন হয়, সেখানে অফিসাররা কী পদ্ধতিতে রুটিন তদন্ত করেন– আমার দেখা আছে। এখানে তার ব্যতিক্রম ঘটল না। নীচের উপত্যকাটাও একদল অফিসার ঘুরে দেখলেন। অকুস্থলের তদন্তে যা দেখা গেল তা অদ্ভুত। সোনালী থিয়েটার ক্লাবের যে ছোরাটা দীপ্তির পিঠে আটকে দিয়েছিল, তা পাওয়া গেল দীপ্তির বুকের তলায়। সেই লাল রঙ আর সত্যিকার রক্ত একাকার হয়ে গেছে। সত্যিকার ছোরাটার বাঁটের গড়ন দেখেই অবাক হতে হয়–একেবারে হুবহু নকল ছোরাটার মতন। নকল ছোরাটা ছিল ফলার দুভাগ করা…ভেতরে ফাঁপা এবং স্প্রিং আছে। ডগাটা একেবারে ভোঁতা ভিজে মাটিতেও ঢোকানো যায় না। বাঁট ধরে কোথাও রেখে চাপ দিলে ডগাটা ভেতরে ঢুকে যায় এবং ভাগকরা জায়গা থেকে একটা ক্লিপ বেরিয়ে শরীরে আটকে যায়! তখন দেখে মনে হয়, আধখানা শরীরে ঢুকে গেছে। ভেতরে স্পঞ্জে রং থাকে। স্পঞ্জে চাপ পড়ামাত্র ছিটকে রঙটা বেরিয়ে আসে। থিয়েটারের খুনখারাপিতে ভারি চমৎকার কাজ দেয়। এক্ষেত্রে খুনী ওটা দীপ্তির পিঠ থেকে খুলেছে। খোলার পর আসল ছোরাটা মেরেছে এবং নকলটা বুকের তলায় লুকিয়ে রেখেছে।
কর্নেলের সঙ্গে ডিটেকটিভ অফিসার কিষাণ সিংয়ের কথাবার্তা আমি শুনেছি। দুজনেই একমত যে খুনী আমাদের দলেরই কেউ। দীপ্তিকে ফেলে রেখে সরে যাওয়ার পর সে ওর কাছে ফের যায় এবং সম্ভবত বলে যে ছোরাটা খুলে যাবে মনে হচ্ছে। তাই ওটা ভালভাবে আটকানো দরকার। এই অছিলায় সে হত্যার কাজটি সেরে ফেলেছে। কর্নেলের মতে–খুবই যুক্তিসিদ্ধ এটা। অপরিচিত লোক হলে অমনটা সম্ভব হতো না।
আমরা ক্লু রেখেছিলুম : পলিমাটি, দিব্যেন্দুর ব্রাণ্ডের সিগ্রেটের টুকরো এবং চোপরার লাইটার। এসবই আছে। কিন্তু সবটা শোনার পর ডিটেকটিভ অফিসাররা এসব আর আমল দেননি। শুধু কর্নেল সেগুলো সযত্নে কাগজে মুড়ে পকেটে রেখেছেন। ও দিয়ে কী হবে কে জানে!
অকুস্থল থেকে ফিরে ব্যানার্জি সায়েবের বাংলোয় আমাদের ডাকা হলো। দীপ্তির মা বাবা কেউ নেই–মামার কাছে মানুষ হচ্ছিল। মামা ভবেশ চক্রবর্তী রিফাইনারি অফিসের হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট। দীপ্তির মামা-মামী সবাই এসেছেন। ওঁরা শোকে ভেঙে পড়েছেন। সোনালীর মা সোনালী ও রত্নাকে ক্রমাগত ভর্ৎসনা করে যাচ্ছেন। অনিরুদ্ধ স্তম্ভিত। খুব ভয় পেয়েছেন মনে হলো। সোনালীর জন্মদিনের আনন্দটাও মাঠে মারা গেল!
ড্রয়িং রুমে কর্নেল ও একদঙ্গল অফিসার বসার পর প্রথমে ডাক পড়ল আমার। স্মার্ট হয়ে ঢোকার চেষ্টা করলুম। কিন্তু বুক কাঁপছিল। চেয়ারে বসার পর প্রশ্ন শুরু হলো। কর্নেল চুপচাপ চুরুট টানছেন।
আমার নাম-ধাম, কর্নেলের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি শেষ হলো। তারপর গত রাতের ঘটনা নিয়ে জেরা চলল। আমি যা যা জানি, জবাব দিয়ে গেলুম। ওঁরা নোট করে নিলেন। তারপর কর্নেলের কাশির শব্দ হলো–এক মিনিট। উইথ ইওর কাইণ্ড পারমিশান প্লিজ!
কিষাণ সিং বললেন–হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন কর্নেল।
–আমি জয়ন্তকে কিছু প্রশ্ন করব।
–অবশ্যই করবেন।
জয়ন্ত! তাহলে তুমি বলছ যে সোনালীর মুখেই তুমি শুনেছ মার্ডার ফানের প্রস্তাবটা দীপ্তিই তুলেছিল?
-হ্যাঁ।
–তুমি বলছ যে গত রাতে দীপ্তির মুখে খুব নার্ভাসনেস দেখেছিলে!
–হ্যাঁ।
এবং আজ তার উল্টো অর্থাৎ মরীয়া মনে হচ্ছিল ওকে?
হ্যাঁ
দীপ্তিই তাহলে মার্ডার ফানের মোটিভ হিসেবে…
বিরক্ত হয়ে বললুম–বলেছি তো! রিফাইনারির সাবোটাজের কথা বলেছিল।
–ওক্কে। এবং দীপ্তিই বলেছিল, মোটিভের ক্লু হিসেবে একটুকরো কাগজ হাতে ধরে থাকবে–তাতে সংকেত বাক্যে সাবোটাজের উল্লেখ পাওয়া যাবে?
–সবই তো বলেছি।
–কিন্তু আমরা ওর হাতে তেমন কোনও কাগজের টুকরো পাইনি!
–সেজন্য কী আমি দায়ী?
সবাই হেসে উঠলেন আমার জবাব শুনে। কর্নেল বললেন–আচ্ছা, আচ্ছা! মাত্র আর একটা প্রশ্ন! তুমি যখন নদীর ধারে যাও, কিংবা সেখান থেকে ফিরে আসো, তখন কোনও শব্দ শুনেছিলে?
–হুঁ। অনেক শব্দ।
অফিসাররা নড়ে উঠলেন। কর্নেল ব্যর্থ হয়ে বললেন–অনেক শব্দ? কিসের?
–পাখিটাখির।
সবাই হাসলেন। কর্নেল বললেন–কাকেও দেখেছিলে, জঙ্গলে অথবা খুনের জায়গায়?
–হুঁউ। তবে খুনের জায়গায় নয়। পশ্চিমের একটা টিলায়।
ফের সবাই নড়ে বসলেন। কর্নেল বললেন–দেখেছিলে? চিনতে পেরেছিলে?
হুঁউ
কিষাণ সিং বললেন–কে সে? চোপরা না দিব্যেন্দু?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। বায়ুসেবনে বেরিয়েছিলেন।
কর্নেল গোমড়ামুখে কী অস্ফুট বললেন। কিষাণ সিং দরজার দিকে ইশারা করে কাকে বললেন–সোনালী ব্যানার্জি! জয়ন্তবাবু, আপনি প্লীজ ওখানটায় বসুন।
কোণের সোফায় গিয়ে বসলুম। বুঝলুম, এখন বেরুনো যাবে না। সিগ্রেট ধরিয়ে টানতে থাকলুম। সোনালী পাথরের মূর্তির মতো ঘরে ঢুকল এবং নমস্কার করে ওঁদের সামনের চেয়ারে বসল।
নামধাম পরিচয় পর্ব হলো। তারপর জেরা চলতে থাকল।
মিস ব্যানার্জি, ঠিক কখন প্রথমে আপনারা মার্ডার ফানের কথাটা ভেবেছিলেন এবং প্রথম কে ভেবেছিল?
দীপ্তি। কদিন আগে কর্নেলকে বাবা আমার জন্মদিনে নেমন্তন্ন করতে পাঠালেন। রত্না আমার সঙ্গে যেতে চাইল। দীপ্তিও তা শুনে যাবে বলল। কর্নেলের বাড়ি থেকে ফেরার সময় রাস্তায় ট্যাক্সিতে দীপ্ত বলল–এই ভদ্রলোক তাহলে গোয়েন্দা? ওকে নিয়ে তোর জন্মদিনে একটা ফান করলে কেমন হয়? তারপর …
–ডেডবডি সাজতে কি দীপ্তিই চেয়েছিল?
–হ্যাঁ। ট্যাক্সিতে বসেই সব ঠিক হয়ে যায়।
হঠাৎ কর্নেল বললেন–ট্যাক্সির নাম্বারটা কি লক্ষ্য করেছিলে সোনালী?
–আমি করিনি। ওসব কেই বা লক্ষ্য করে? কেন বলুন তো?
–জাস্ট এ চান্স! যদি দৈবাৎ করে থাকো।
করিনি।… বলেই সোনালী নড়ে উঠল। হ্যাঁ, আমি করিনি। কিন্তু …।
–কিন্তু দীপ্তি…।
দীপ্তি করেছিল?
–হ্যাঁ ব্যাপারটা এখন মনে হচ্ছে, ভারি অদ্ভুত। জানেন? হাওড়া স্টেশন থেকে ট্যাক্সি করে আমরা ভবানীপুরে মামার বাসায় গেলুম, সেটাই আমাদের ইলিয়ট রোডে কর্নেলের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার সময়ও একই ট্যাক্সি। দীপ্তি এটা লক্ষ্য করেছিল। বলেছিল ব্যাপার কী রে? এই একটা ট্যাক্সিই পাচ্ছি খালি? আমি অবশ্য ট্যাক্সিওয়ালাকে লক্ষ্য করিনি। বলেছিলুম–তোর চোখের ভুল। বাইরের লোক তো তুই, তাই সব ট্যাক্সিওয়ালাকে একই লোক বলে ভুল করছিস! যেমন সব চীনেম্যানকে দেখে একই লোক। মনে হয়!
কিষাণ সিং বললেন–বেশ ইন্টারেস্টিং তো!
কর্নেল বললেন হাওড়া স্টেশনের ট্যাক্সি ভবানীপুরে নিয়ে যায় তোমাদের। তারপর সম্ভবত ওই ট্যাক্সিটাই তোমার মামার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছিল এবং তোমরা রাস্তায় নামতেই নিজে থেকে অফার দেয়।….
সোনালী সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ। লোকটা আমাদের ডেকে বলল-আইয়ে মেমসাব! দীপ্তি বলল–সেই ট্যাক্সিঅলা না? আমি আর রত্না গ্রাহ্য করিনি। ট্যাক্সি পাওয়াই বড় কথা।
-রাইট। তোমরা যখন আমার বাসায় গেলে, আমি অভ্যাসমতো জানালায় দাঁড়িয়েছিলুম। দেখলুম ট্যাক্সিটা তোমাদের নামিয়ে দিয়েই ফিরল। কিন্তু চলে গেল না। ওধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নাম্বারটা আমার মনে আছে।..বলে কর্নেল পকেট থেকে নোটবই বের করলেন। বললেন–লিখে নিন মিঃ সিং। এক্ষুণি কলকাতায় খোঁজ নিতে হবে। এটা বিশেষ জরুরী।
কিষাণ সিং একজন অফিসারকে তক্ষুনি ফোনের কাছে পাঠালেন। তারপর কর্নেল বললেন–সোনালী, দীপ্তির ব্যক্তিগত জীবনের দু-একটা কথা তোমার মুখেই শুনতে চাই।
বলুন। যা জানি, বলব।
–ইয়ে, ওর কি কোনও প্রেমিক ছিল? লজ্জার কারণ নেই, বলো।
সোনালী মুখ নামিয়ে বলল–দিব্যের সঙ্গে একসময় ওর ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাছাড়া দিব্যের সঙ্গেই ওর বিয়ের কথাও চলছিল। দিব্য রিফাইনারিতে চাকরিটা পেয়ে গেলেই বিয়েটা হতো।
–আই সী! কিন্তু ঘনিষ্ঠতাটা একসময় ছিল বলছ কেন?
–ইদানিং দীপ্তি যেন দিব্যকে এড়িয়ে চলছিল। আর…
বলো!
–আর রণধীরদার সঙ্গে একটু বেশি মেলামেশা করছিল।
–মানে তোমার বাবার প্রাইভেট অ্যাসিস্ট্যান্ট ছেলেটির সঙ্গে?
–হ্যাঁ। তবে এ নিয়ে দিব্যর সঙ্গে কোনওরকম মনকষাকষি দেখেনি। আমরা একসঙ্গেই বেশিরভাগ সময় থাকি। তেমন কিছু ঘটলে টের পেতুম। দিব্যও এসব মাইণ্ড করার ছেলে না।
ইদানিং দীপ্তির মধ্যে কোনও বিশেষ ভাবান্তর টের পাচ্ছিলে কি?
সোনালী একটু ভেবে বলল–তেমন কিছু দেখেনি। তবে…
-তবে?
মাঝে মাঝে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকত। জিগ্যেস করলে কিছু বলবে মনে হতো–কিন্তু শেষ অব্দি বলত না। শুধু বলত–শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।
–আচ্ছা, ওকথা থাক। আজ সকালে তুমি দীপ্তিকে ওভাবে রেখে বারান্দায় চলে এলে! তখন বারান্দায় রত্না ছিল। তাই না?
-হ্যাঁ। আমরা দু’জন ছিলুম।
–ওদিক থেকে কোন শব্দ শুনতে পেয়েছিলে? কিংবা কাকেও যেতে দেখেছিলে?
না।
–ভেবে বলো।
সোনালী জোরের সঙ্গে মাথা দোলাল। আমরা দুজনেই ওদিকে তাকিয়েছিলুম।
তারপর প্রথমে দিব্য না চোপরা ফিরে এল?
–চোপরা।
–কোনদিক থেকে?
পুবদিক।
–তার মধ্যে কোনও ভাবান্তর ছিল?
নাঃ। হাসতে হাসতে এল।
–ভেবে বলো। কারণ তোমার উইশফুল থিংকিং হতে পারে।
সোনালী ভেবে নিয়ে জবাব দিল-মনে হচ্ছে, হাসতে দেখেছি। তারপর একটু গম্ভীর হয়েছিল মনে পড়ছে। একটু…হ্যাঁ কর্নেল, ওকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। কারণ রত্না ওকে ডাকলে শুনতে পেল না। তখন রত্না বলল, খুব ঘাবড়ে গেছ মনে হচ্ছে! ও যেন চমকে উঠে আবার হাসতে লাগল।
দিব্য এল কোনদিক থেকে? কতক্ষণ পরে?
–পশ্চিমদিক থেকে। মিনিট তিন-চার পরে। দিব্যকে কিন্তু খুব নার্ভাস মনে হচ্ছিল। এখন মনে পড়ছে। ও এসেই বলল–খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে যেন!..বলেই সোনালী নড়ে উঠল। কর্নেল! মনে পড়ছে, দিব্য যেন হাঁফাচ্ছিল।
বলো কী!
-হ্যাঁ। রত্না ওকে ধমক দিয়ে বলল–দাদা সবতাতেই নার্ভাস হয়ে পড়ে। আমি ঠাট্টা করে বললুম–হবু ব্রাইড ইজ মার্ডারড। কষ্ট হচ্ছে না বুঝি? তা শুনে দিব্য রাগ দেখিয়ে বলল–খুব ডেঁপো মেয়ে হচ্ছ। সেই সময় দেখি জয়ন্তবাবু ঝোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বোকার মতো। পলিমাটিগুলো ছড়িয়ে চলে আসার কথা। অথচ উনি যেন কী দেখছেন। তাই আমি দৌড়ে গেটে গেলুম ওকে ডাকতে।
তার মানে জয়ন্তকে তুমি ফিরতে দেখনি?
না। মানে, তখন আমরা নিজেদের মধ্যে ওইসব কথাবার্তা বলছি তো। তাই ওদিক আর তাকাচ্ছিলুম না!
-রত্না আর তুমি বারান্দায় থাকার সময়ও কেউ ওখানে গেলে তাহলে তোমার চোখে পড়ার চান্স বেশি ছিল না।
সোনালী ব্যস্ত হয়ে বলল না না, ছিল। তখন…
–অবশ্য দক্ষিণের ঢালু থেকে ঝোপ ঠেলে কেউ এলে তাকে পেতে না।
হ্যাঁ। তা পেতুম না।
-ঠিক আছে সোনালী। তুমি জয়ন্তের কাছে গিয়ে বসো। নাকি মিঃ সিং কিছু প্রশ্ন করবেন?
সবাই মাথা দোলালেন। সোনালী আমার পাশে এসে নিঃশব্দে বসে গেল। কিষাণ সিং ডাকলেন–দিব্যেন্দু চ্যাটার্জিকে ডাকো..
.
দিব্যেন্দুর প্রাথমিক পরিচয়পর্ব শেষ হবার পর যথারীতি জেরা শুরু হলো। আমি ও সোনালী দুজনেই তাকিয়ে রইলুম দিব্যের দিকে।
কিষাণ সিং বললেন–মার্ডার ফানের কথা কখন কোথায় প্রথম কার কাছে শোনেন?
কাল রাত্রে সোনালী রত্না আর দীপ্তি তিন জনের কাছেই।
–তিনজনের কাছে? দিস ইজ অ্যাবসার্ড। নিশ্চয় প্রথমে একজনই বলেছিল। কে?
দিব্য ভড়কে গিয়ে বলল–হ্যাঁ, মানে তখন বারান্দায় তিনজনই ছিল। প্রথমে অবশ্য সোনালীই বলল।
–শুনে আপনি কী বললেন?
বাধা দিলুম। বললুম– এ বড্ড বাজে ব্যাপার। অন্য কোনও ফানের প্ল্যান করা যাক। ওরা শুনল না। অগত্যা আমি মত দিলুম।
–কেন বাধা দিয়েছিলেন?
ব্যাপারটা..ব্যাপারটা আমার কাছে উদ্ভট মনে হয়েছিল।
–ফান মানেই উদ্ভট কিছু।
–তাহলেও দীপ্তিকে আমি ডেডবডি করাটা পছন্দ করিনি।
কর্নেল বলে উঠলেন দীপ্তিকে তো তুমি ভালবাসতে দিব্য? না–না, লজ্জার কারণ নেই। আমরা আধুনিক যুগের মানুষ।
দিব্য মাথাটা একটু দোলাল।
–তোমার সঙ্গে তো ওর বিয়ের কথা ছিল?
–হ্যাঁ। কিন্তু…
–বলো, বলো!
ইদানিং দীপ্তি আমাকে এড়িয়ে থাকতে চাইত যেন। আমি অবশ্য তাতে কিছু মাইণ্ড করিনি। ও বড্ড খামখেয়ালি মেয়ে ছিল। আমার ধারণা, শিল্পীরাই খামখেয়ালী।
দীপ্তি ইদানিং চোপরার সঙ্গে মেলামেশা করত কি?
দিব্য মুখ নামিয়ে বলল–হ্যাঁ। আজ ভোরেও চোপরা ওকে গাড়ি করে এখানে পৌঁছে দেয়। অথচ কথা ছিল, আমিই ওকে নিয়ে আসব। তাই বেরুতে যাচ্ছি, দেখি চোপরার গাড়িতে ও আসছে। মানে গাড়িটা তখন গেটে ঢুকছিল।
কিষাণ সিং বললেন–মিঃ চ্যাটার্জি! গত আগস্টে রানীডিহির ইভনিং লজ নামে একটা বাড়ি থেকে আপনাকে জুয়াখেলার জন্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তখন আপনি মাতাল অবস্থায় ছিলেন। খবর পেয়ে মিঃ ব্যানার্জি–মানে আপনার মেসোমশাই আপনাকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। শুধু এই নয়–আরও দুবার আপনাকে মারামারির অভিযোগে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল এবং আপনার মেসোমশাইয়ের হস্তক্ষেপে ছাড়া পান। এসব কারণেই রিফাইনারিতে আপনার চাকরি পাবার অসুবিধা হচ্ছে। দিস ইজ দা রেকর্ড। এবার বলুন, ঠিক এসবের জন্যেই কি দীপ্তির সঙ্গে আপনার ছাড়াছাড়ি হয়েছিল?
সোনালী মুখ ফিরিয়েছে। আমি অবাক। কর্নেল দিব্যের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঘরটা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকল। কিষাণ সিং আবার বললেন–জবাব দিন মিঃ চ্যাটার্জি।
দিব্য ঠোঁট কামড়ে বলল–না।
–আপনার বাবা মা কলকাতায় থাকেন। তাই তো?
—হ্যাঁ।
–আপনাকে মিঃ অনিরুদ্ধ ব্যানার্জি কাছে এনে রেখেছেন আপনার স্বভাব শোধরাতে। অস্বীকার করে লাভ নেই। অনিরুদ্ধবাবুর কাছেই আমরা সব শুনেছি।
না। মেসোমশাই আমার চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন বলে ডেকেছিলেন। আমার বোন রত্নার কাছে জানতে পারেন।
–আপনার বোন রত্নার নামেও কিছু রেকর্ড আছে দিব্যবাবু।
দিব্য মুখ তুলল। সাদা হয়ে গেছে মুখটা।
রত্না একসময় নকশালপন্থীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। তাই ওকেও আপনার বাবা এখানে পাঠিয়ে দেন। আমাদের ধারণা, আপনারা ভাইবোন দুজনেই সেই দলের সঙ্গে এখনও যুক্ত। অস্বীকার করতে পারেন?
দিব্য হাঁফাতে হাঁফাতে বলল–মিথ্যা। একেবারে মিথ্যা। কে বলল এসব?
রেকর্ড। আচ্ছা, এবার বলুন, গত সপ্তাহে মিঃ চোপরা আর আপনি সান ভিউ রেস্তোঁরায় ঘুষোঘুষি করেছিলেন। আপনাদের সঙ্গে আরও একজন ছিল। তাই না?
–হ্যাঁ। চোপরা আমাকে জাত তুলে গাল দিয়েছিল।
–আপনাদের তৃতীয় লোকটির নাম বলুন।
ও আমার বন্ধু। দিল্লিতে থাকত। নাম রাজীব শেরগিল। এখানে বেড়াতে এসেছিল। ওর কথাতেই তর্ক বাধে। শেষে ঝগড়া হয় চোপরার সঙ্গে। প্রভিন্সিয়ালিজম নিয়ে।
–আমরা জানি রাজীব শেরগিলের বয়স চল্লিশের ওপারে। আপনি তিরিশের নীচে। বন্ধুতার অবলম্বনটা কী?
দিল্লিতে আলাপ হয়েছিল। আলাপ থেকেই বন্ধুতা। কেন? ওই জয়ন্তবাবু যদি এই বৃদ্ধ কর্নেলসায়েবের বন্ধু হতে পারেন–আমার বেলা দোষ হবে কেন?
কর্নেল হো হো করে হেসে উঠলেন। কিষাণ সিং বললেন–আপনি নিশ্চয় জানেন, ওয়াটারট্যাংকের কাছে যে লোকটির লাশ পাওয়া গেছে–সে লোকটাই সেই রাজীব শেরগিল?
দিব্য মুখ নামিয়ে বলল–হ্যাঁ।
–আমরা আপনাকে ওই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে গ্রেফতার করতে পারি।
দিব্য হাঁফাতে হাঁফাতে বলল–কেন? আমি ওকে খুন করিনি। কেন ওকে খুন করব?
কিষাণ সিং একটু হেসে বললেন ঠিক আছে। এবার বলুন, এই সিগ্রেটের টুকরো দুটো মার্ডার ফানের ক্লু হিসেবে আপনিই কি ফেলে রেখেছিলেন ওখানে?
কাগজের মোড়ক খুললে দিব্য দেখে নিয়ে বলল–আমি তো মোটে একটা টুকরো ফেলেছিলুম। আর…এ কী! দুটোই যে আমার ব্রাণ্ডের!
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–বোঝা যাচ্ছে, খুনী ক্লুর ওপর গুরুত্ব দিতে চেয়েছে।
কিষাণ সিং বললেন–ছোরার বাঁটে আঙুলের ছাপ থাকবে।
দিব্য বলে উঠল–হাতে দস্তানা পরলে?
অমনি কিষাণ সিং একটু ঝুঁকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন–আপনি বলছেন! মাই গুডনেস! কীভাবে জানলেন? পরেছিলেন তাই না?
দিব্য থতমত খেয়ে বললে-জাস্ট কমনসেন্স!
এনা! আপনি ওখানে গিয়ে বসুন। অ্যাণ্ড নেক্সট মিঃ রণধীর চোপরা।
.
রণধীর স্মার্ট হয়ে হাসিমুখে ঢুকল। নমস্তে করে বসল। কিষাণ সিং তার প্রাথমিক পরিচয় যথারীতি নিয়ে জেরাপর্বে চলে গেলেন। লক্ষ্য করলুম, দিব্যর সঙ্গে ওর ঝগড়া বা দীপ্তিসংক্রান্ত কোনও প্রশ্নই করছেন না। আজ সকালের ঘটনাই তুলছেন।
–আচ্ছা মিঃ চোপরা, আপনি যখন পুবদিকে বড় রাস্তায় গেলেন, সেখান থেকে আপনাদের মার্ডার ফানের জায়গাটা কি দেখা যচ্ছিল?
-হ্যাঁ। কারণ ওখানটা উঁচুতে। এই টিলার দক্ষিণ অংশ ওটা। আর আমি ছিলুম অনেকটা ফাঁকা বড় রাস্তায়। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল জায়গাটা।
কাকেও দেখতে পেয়েছিলেন। মানে–আপনি চলে আসার পর?
–হ্যাঁ।
কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন। কিষাণ সিং বললেন–দেখতে পেয়েছিলেন?
–হ্যাঁ।
–সে কে?
-চিনতে পারিনি। সবুজ ফুলহাতা জামা ছিল গায়ে। প্যান্ট দেখা যাচ্ছিল না ঝোপের আড়ালে। মুখটা ওপাশে ছিল বলে দেখতে পাইনি। বেশ মোটাসোটা লোক।
-মানে ফ্যাটি?
–হ্যাঁ। প্রকাণ্ড। তবে বেঁটে বলেই মনে হচ্ছিল।
–তাকে দেখে আপনার কিছু মনে হয়নি?
হয়েছিল। ভাবলুম, খেলাটা বরবাদ হয়ে গেল হয়তো। এক্ষুণি হুলুস্থুল বাধবে। কিন্তু লোকটা ঝোপের আড়ালে ডুবে গেল। তখন ভাবলুম, কেউ বেড়াতে বেরিয়েছে। উপত্যকার দিকে সোজাসুজি নেমে গেল। তারপর আর তাকে দেখিনি।
-সবুজ ঝোপঝাড়ের মধ্যে সবুজ জামা! চোখে পড়া তো অস্বাভাবিক!
চোপরা একটু ইতস্তত করে বলল–না, মানে–তখন আমার ওখানেই মন পড়ে ছিল কি না! দ্যাটস ন্যাচারাল। তাই না স্যার?
কিষাণ সিং জবাব দিলেন না। কর্নেল বললেন রাইট, রাইট।
তাছাড়া স্যার, ব্যাপারটা আমার খুব গোলমেলে লাগছিল।
কর্নেল বললেন–কেন বলুন তো?
দীপ্তির মার্ডার মোটিভটা শুনে যদিও খুব ফানি মনে হয়েছিল। পরে মনে হলো–দীপ্তি কি কোনও ইঙ্গিত দিচ্ছে। মানে আমাকেই যেন
–ইঙ্গিত? কিসের?
–মানে, অয়েল রিফাইনারিতে সাবোটাজের। দ্যাটস অলসো ন্যাচারাল।
–ঠিক বলেছেন। কিন্তু দীপ্তির সঙ্গে তো আপনার ইদানিং ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল?
–হ্যাঁ। একটু একটু। আই লাইকড হার।
–দুজনে একসঙ্গে ঘুরেছেন, কিংবা নিভৃতে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছেন?
–হুঁউ। দ্যাটস ন্যাচারাল।
-ওইসব সময় দীপ্তি আপনাকে অনায়াসে তেমন কিছু গুপ্ত ব্যাপার থাকলে জানাতে পারত?
–তা তো পারতই।
কিন্তু জানায়নি। তাই না?
না। সম্ভবত গত রাতেই ও তেমন কিছু আঁচ করে থাকবে। তাই…।
–এক মিনিট। তাহলে তো আজ ভোরে ওকে যখন নিয়ে এবাড়ি এলেন, তখন বলতে পারত আপনাকে?
ও চাপা মেয়ে ছিল। কিংবা হয়তো সাবোটাজকারীদের কেউ গতরাতে বারান্দায় আমাদের মধ্যে উপস্থিত ছিল। তাকেই দীপ্তি সতর্ক করতে চেয়েছিল।
মিঃ চোপরা! আপনি বয়সে তরুণ হলেও খুব বুদ্ধিমান। খুবই যুক্তিপূর্ণ কথা বলেছেন। কিন্তু ভেবে দেখুন, কারা উপস্থিত ছিল তখন? জয়ন্তবাবু, দিব্য, রত্না আর সোনালী। এখন বলুন–আপনার ধারণা অনুযায়ী কে সাবোটাজকারী দলের লোক হতে পারে? খুব ভেবে বলবেন কিন্তু।
চোপরা একটু ভেবে নিয়ে বললে–আমি কিন্তু স্ট্রেটকাট কথাবার্তা বলা পছন্দ করি। এজন্যই দিব্যের সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে বেধে যায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস দিব্যকেই সতর্ক করতে চেয়েছিল দীপ্তি। এই সঙ্গে লক্ষ্য করবেন, দিব্যের সঙ্গে ওর বিয়ে প্রায় ঠিক। অথচ ও দিব্যকে এড়িয়ে চলছিল ইদানিং। অতএব আমার ডিসিশানে দাঁড়াচ্ছে, দীপ্তি দিব্যের কার্যকলাপ টের পেয়েই ঘৃণা করে সরে এসেছিল।
এবং আপনার ঘনিষ্ঠ হয়েছিল!
–কারেক্ট স্যার। ভেরি ভেরি কারেক্ট। দিব্যের উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আমি। আমি ছাড়া দিব্যের সঙ্গে লড়ার তাকত এখানে কারো নেই, দীপ্তি জানত। কিংবা এও হতে পারে, আমি অয়েলরিফাইনারির ডিরেক্টরের পি.এ.। আমার সঙ্গে মেশার মধ্যে দীপ্তির একটা উদ্দেশ্য থাকতেও পারে। তা হলো- দিব্যকে সতর্ক করে দেওয়া সাবধান, জানি কর্তৃপক্ষের কানে তুলে দিতে পারি! ইজ ইট ইল্লজিক্যাল?
কর্নেল সায় দিয়ে বললেন রাইট, রাইট। মিঃ সিং! এবার আপনি কিছু জানতে চাইলে প্রশ্ন করুন।
কিষাণ সিং বললেন না। আমার প্রশ্ন নেই। নেক্সট রত্না চ্যাটার্জি।…
.
রত্না সাদা মুখে এল। যন্ত্রের মতো হাত তুলে নমস্কার করল। দেখলুম ওর পায়ের কাছে শাড়ির পাড় থরথর করে কাঁপছে।
–আপনি রত্না চ্যাটার্জি?
হুঁ।
বাবার নাম, ঠিকানা, পেশা এসব কিছুই ওকে জিজ্ঞেস করা হলো না, এতে অবাক হলুম। কিষাণ সিংয়ের কাছে একটা ফাইল ছিল। ফাইলটা খুলে আধ মিনিট কী দেখার পর উনি মুখ তুললেন। তারপর বললেন-দীপ্তির সঙ্গে গত ১৩ই সেপ্টেম্বর সকালে আপনি পাতালকালীর মন্দিরে গিয়েছিলেন কি?
রত্না মাথা দোলাল।
-কেন?
রত্না একটু ইতস্তত করে আস্তে বলল–যে জন্যে সবাই যায়!
মন্দিরে যাবার কথা কে তুলেছিল? আপনিনা দীপ্তি?
–দীপ্তি।
দীপ্তি ভক্তিমতী মেয়ে ছিল–এমন কথা আমরা এখনও কারো কাছে শুনিনি। ওর মামা-মামী এবং মামাতো ভাই-বোন বরং বলেছেন, দীপ্তির ওসব বিশ্বাস ছিল না। আপনি কী বলেন?
হ্যাঁ। ও নাস্তিকটাইপ ছিল। বরাবর ধর্মটর্ম নিয়ে ঠাট্টা করত।
–তাহলে বলুন দীপ্তি পাতালকালীর মন্দিরে নিছক বেড়াতে গিয়েছিল?
আমাকে তাই বলেছিল। পরে অবশ্য…
–হুঁ, বলুন।
পরে আমার সন্দেহ হয়েছিল, ওর যেন অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে।
–সেটা কী?
কারও সঙ্গে দেখা করা।
–কেন এমন মনে হলো আপনার?
–ওর চোখমুখের ভাব দেখে। খুব খুঁজছিল–মানে ভিড়ের সব মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। তা লক্ষ্য করে আমি ওকে বলেছিলুম, কাকেও খুঁজছিস নাকি রে? ও জবাব দিয়েছিল, না, এমনি। চেনা কেউ আছে নাকি দেখছি। কিন্তু কারও সঙ্গে ও কথা বলেনি শেষ পর্যন্ত। অবশ্য, আমার খটকাটা থেকেই গিয়েছিল। ফেরার পথে যখন ওকে চেপে ধরলুম, ও কবুল করল না। আগের মতোই নিছক বেড়াতে আসার কৈফিয়ত দিল। তখন বললুম– তোর কি হঠাৎ দেবদেবতায় বিশ্বাস ফিরে এসেছে? দীপ্তি হাসল শুধু। ভাবলুম, দাদার সঙ্গে একটা কিছু গণ্ডগোল হয়েছে, তাই হয়তো। মনে অশান্তি চলছে বড্ড। পাতালেশ্বরীর কাছে মনে মনে তাই প্রার্থনা করে গেল। অবশ্য খটকাটা আমার থেকেই গেল।
একটু ভেবে ও ফাইলটা দেখে কিষাণ সিং বললেন বাড়ি থেকে মন্দির এবং মন্দির বাড়ি সারাক্ষণ আপনি ওর সঙ্গে ছিলেন?
-হ্যাঁ।
যাবার সময় কিসে গেলেন?
–রিকশোয়।
–ফিরলেন কিসে?
রণধীরদার গাড়িতে। হঠাৎ পেয়ে গেলুম। ও স্টেশন থেকে আসছিল।
–আমরা সেটা জানি। রণধীর চোপরার গাড়িটা আপনাকে আগে নামিয়ে দিয়ে পরে দীপ্তিকে পৌঁছে দিতে যায়। অথচ আগেই দীপ্তির মামার বাসাটা পড়ে। তাই না?
–হ্যাঁ। ব্যাপারটা আমার খারাপ লেগেছিল নিশ্চয়। চোপরার সঙ্গে ইদানীং ওর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। দাদার জন্যে আমার কষ্ট হত। কিন্তু এসব তো দীপ্তিকে বলা যায় না।
যাকগে, এবার বলুন, গাড়িতে আপনারা কী আলোচনা করেছিলেন?
–সোনালীর জন্মদিনের কথা। রণধীরদা বরাবর সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দেয়। ন্যাচারালি ওর সঙ্গে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল।
–আপনারা কলকাতা গিয়ে কর্নেল সরকারকে নেমন্তন্ন করবেন, একথাও নিশ্চয় উঠেছিল?
হুঁ।
-চোপরা কর্নেল সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেছিলেন?
না। মানে জিগ্যেস করল যে ভদ্রলোক কে? আমরা ওঁর পরিচয় দিলে ও খুব উৎসাহ দেখিয়ে বলল, দারুণ জমবে! গোয়েন্দাদের কখনও দেখিনি। তারপর কথায় কথায় ফাংশানের ডিটেলস এসে পড়ল। তখন রণধীরদা বলল, এক কাজ করা যায়। অ্যাজ ইউ লাইক ইট খেলার বদলে অন্য কোনও ফান হোক না? মার্ডার ফান! গোয়েন্দা ভদ্রলোককে নিয়ে মজা করা যাক।
ঘরের সবাই নড়ে বসলেন। আমরা কজন, সোফায় বসে আছি যারা, তারাও ঘুরে টেবিলের দিকে তাকালাম। আড়চোখে দেখি, চোপরা শুকনো হাসছে, কর্নেল হেসে উঠলে ওই ভাবটা ঘুচে গেল।
কর্নেল বললেন–তাহলে দীপ্তির মাথায় মার্ডার ফানের প্রস্তাবটা প্রথম ওঠেনি, বোঝা গেল।
আমাদের পাশ থেকে চোপরা বলে উঠল–দ্যাটস ন্যাচারাল! আমি আগাথা ক্রিস্টি প্রচুর পড়েছি। তা থেকেই ওটা মাথায় এসেছিল। নিশ্চয় এটা কোনও ক্রাইম নয়!
কিষাণ সিং হাত তুলে বললেন–আপনি কোনও কথা বলবেন না, প্লীজ।
রত্না ক্রমশ আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠেছে। সে বলল–কিন্তু এটা সত্যি যে দীপ্তি নিজেই ভিকটিম হতে চেয়েছিল।
–ওই গাড়িতে বসেই কি ভিকটিম হবার প্রস্তাব দীপ্তি দিয়েছিল?
রত্না জোরে ঘাড় নাড়ল। না, না। ও তখন জোর আপত্তি করেছিল। এসব বাজে খেলা–অন্য কিছু ভাবো। দীপ্তি বলেছিল। পরে বাসায় ফিরে সোনালীকে মার্ডার ফানের কথা বললে সোনালীও আপত্তি করেছিল। কিন্তু শেষে দেখি, দীপ্তিই মার্ডার ফানের ব্যাপারে জেদ ধরেছে।
–আপনি যে প্রথমে সোনালীকে মার্ডার ফানের কথা বলেছিলেন, তা সোনালী কিন্তু আমাদের বলেনি।
আমার পাশ থেকে সোনালী বলল, ভুলে গিয়েছিলুম। এখন মনে পড়ছে, রত্না বাইরে থেকে ফিরে ওই প্রোপোজালটা দিয়েছিল।
কিষাণ সিং ফের হাত তুলে বললেন কথা বলবেন না, প্লীজ।
হঠাৎ কর্নেল একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করলেন–ইয়ে রত্না, তোমার দাদা দিব্যেন্দুর কি কোনও সবুজ পাঞ্জাবি আছে?
রত্না বলল–হ্যাঁ। কেন?
অমনি একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। দিব্যেন্দু আমাদের কাছ থেকে তড়াক করে এক লাফ দিয়ে উঠে দরজার দিকে এগোল। একজন পুলিশ অফিসার ওর কলার ধরে ফেললেন। দিব্য ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছিল। পারল না।
এই সময় কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–মিঃ সিং! আমার মনে হচ্ছে আপাতত এ পর্যায় এখানেই শেষ। অবশ্য আপনার ইচ্ছে করলে এগোতে পারেন। আমি একটু বাইরে যেতে চাই।
কিষাণ সিং একটু হেসে বললেন–ক্ষমা করবেন কর্নেল। দিস ইজ দা অফিসিয়াল প্রসিডিওর। আমরা এখানেই থামতে পারি না। বাড়ির সারভ্যান্টদের প্রশ্ন করা বাকি আছে।
কর্নেল জিভ কেটে বললেন–সরি, ভেরি সরি মিঃ সিং। দ্যাটস কারেক্ট। বলে টেবিল থেকে উঠে এসে আমার দিকে তাকালেন। তারপর কিষাণ সিং-এর দিকে ঘুরে বললেন মিঃ সিং! আমার এই হতভাগ্য বন্ধুটিকে কি বাইরে যাবার অনুমতি দেবেন?
কিষাণ সিং হেসে বললেন–অবশ্যই।
–এস জয়ন্ত, আমরা একবার বাইরে খোলা হাওয়ার গিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করি।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। বাইরে লনে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে বললুম–কর্নেল, তাহলে দিব্যকে মনে হচ্ছে গ্রেফতার করা হলো।
কর্নেল আনমনে জবাব দিলেন তাই মনে হচ্ছে। দিব্যেন্দুর ওই সবুজ জামাটাই ভাইটাল এ কেসে। অবশ্য যদি চোপরার কথাটা সত্যি হয়, তবেই। যাক গে, এস– আমরা একবার নদীর ধারটা ঘুরে আসি।
নদীর ধারে যেতে হলে এই ছোট রাস্তা ধরে যেতে হবে, কিন্তু কর্নেল ওদিকে গেলেন না। সোজা অকুস্থলের পাথরটার কাছ দিয়ে ঝোপঝাড় ভেঙে চললেন। দেখলুম, দীপ্তির লাশটা সরানো হয়েছে। পাথরের একধারে কিছু রক্ত লেগে আছে। ঘাসে ও মাটিতেও আছে। সেটা সত্যিকার রক্ত হতেও পারে, আবার সোনালীর পেন্টও হতে পারে। কিন্তু একবার তাকিয়েই চোখ ফেরালুম। যেন দীপ্তিকে দেখতে পাচ্ছিলুম–একটু ঝুঁকে পাথরে গাল রেখে শুয়েছে। তাজা ফুলের মতো একটা মেয়ে–স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য নিয়ে জন্মেছিল এই কুৎসিত পৃথিবীতে। খুব কষ্ট নিয়েই পা বাড়ালুম। জানতুম কর্নেল বিস্তর পাহাড়ে চড়েছে। তাই এই ঢালু দুর্গম জায়গায় ওঁর কোনও কষ্ট না হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু আমার মতো আনাড়ির পক্ষে মারাত্মক। একখানে পাথরে পা স্লিপ করে গড়িয়ে পড়লুম এবং গড়াতে গড়াতে প্রায় পনের কুড়ি ফুট নীচে একটা গর্তে গিয়ে আছাড় খেলুম। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছি, শুনি কর্নেল ওপরে দাঁড়িয়ে হাসছে।
রেগে বললুম–আর কখনও কোথাও যাব না আপনার সঙ্গে। গেলেই খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ব এবং বিদঘুটে কাণ্ড ঘটবে! ভ্যাট!
ওপর থেকে নেমে এসে কর্নেল একটু হেসে বললেন–ডার্লিং, মাঝে মাঝে আছাড় খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। ছেলেবেলায় মানুষ প্রায়ই আছাড় খায়। এতেই বোঝা যায় প্রকৃতি ওইভাবে তাকে স্বাস্থ্য আয়ু সাহস ও সহ্যশক্তি যোগান দেন। বড় হয়ে আছাড় খাবার ব্যাপারে সতর্ক হয় মানুষ। এটা প্রকৃতির বিরুদ্ধতা। এ জন্যেই তো প্রকৃতি সুযোগ পেলেই মনে করিয়ে দেন যে… ।
কর্নেল প্রায়ই উদাত্তকণ্ঠে লেকচার দিচ্ছিলেন, হঠাৎ থেমে কি যেন দেখতে থাকলেন কুঞ্চিত ভুরু। তারপর বাইনোকুলারটি চোখে তুললেন। কিন্তু সর্বনাশ! নির্ঘাৎ বাতিকগ্রস্ত প্রকৃতিবিদ কোনও বিরল প্রজাপতি অথবা পাখি দেখতে পেয়েছেন এবং তার মানে এবার নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে হয়তো গোটা দিনটাই পাখিটার পিছনে বনবাদাড় নালা ডিঙিয়ে ঘোরাঘুরি করবেন–আমাকেও হন্যে করবেন!
কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে সম্মোহিত মানুষের মতো–নিশির ডাকে মানুষ যেমন যায়, এগোতে থাকলেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলুম। বাংলোয় ফিরব। শরীর ক্লান্ত। মনও ভাল নেই। সেই ঢাল জায়গা বেয়ে অনায়াসে লেজে ভর করে দাঁড়ানো গিরগিটির মতো কর্নেল ফাঁকা বরাবর অন্তত একশো ফুট এগোলেন। তারপর একটা প্রকাণ্ড পাথরের সামনে হাঁটু ভাজ করলেন। ওই অবস্থায় ওঁকে প্রায় তিন মিনিট চুপচাপ থাকতে দেখলুম। তারপর ঘুরে আমার দিক হাত নেড়ে বললেন–জয়ন্ত, দেখে যাও।
পৌঁছানো আমার পক্ষে বেশ কষ্টকরই হলো। কিন্তু কৌতূহল আমাকে টেনে নিয়ে গেল। গিয়েই যা দেখলুম, অবাক হয়ে গেলুম। রণধীর চোপরার কথা মিথ্যে নয়–একটা সবুজ পাঞ্জাবি সাবধানে পাথরের ফাটলে রাখা হয়েছে।
কর্নেল বললেন–দিব্যের বাঁচা কঠিন হয়ে গেল। চোপরা বলেছে একটা বেঁটে মোটাসোটা নোক দেখেছিল। আসলে একটা জামা পরা অবস্থায় এই পাঞ্জাবি পরলে দূর থেকে তাই-ই দেখাবে। জয়ন্ত, দেখতে পাচ্ছ। পাঞ্জাবিতে রক্তের ছোপ লেগে আছে।
দেখে আঁতকে উঠলুম। বললুম–দিব্য এমন বোকার মতো কাজ করে ফেলল?
কর্নেল বললেন-সবুজ পাঞ্জাবি পরে খুন করার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছ? সবুজ ঝোপঝাড় বা গাছের মধ্যে ক্যামোফ্লেজের কাজ করবে। কারো হঠাৎ নজরে পড়বে না। দ্বিতীয়ত…বলে উনি থেমে গেলেন। সাবধানে পাঞ্জাবিটার পকেটের দিকটায় আঙুলের চাপ দিলেন।
বললুম–কী? ·
–সিগ্রেটের প্যাকেট। মার্ডার ফানের ক্লু হিসেবে একটা টুকরো ফেলা হয়েছিল। কিন্তু দুটো পাওয়া গেছে। তার মানে পকেটে সিগ্রেট থাকায় আরেকটা সিগ্রেটের টুকরো ফেলে রাখা সম্ভব হয়েছে। খুনী যেন একটা খেলার ক্লু রেখে দিতে চেয়েছে। কেন?
প্রশ্নটা কর্নেল আপন মনেই করলেন। বিরক্ত হয়ে বললুম–খুনী-খুনী করছে কেন এখনও? দিব্য বললেই আমার কাছে আপনার জটিল কথাবার্তার মানে বোঝা সহজ হয়ে ওঠে।
কর্নেল ঘুরে বললেন–দ্যাট ডিপেণ্ডস্ ডার্লিং!
অন হোয়াট?
–আরও সাক্ষ্য-প্রমাণ।
–যেমন?
–দিব্য এই পাঞ্জাবিটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, নাকি পরে পশ্চিমের দিকে ঘুরতে যাবার সুযোগে বাংলোয় ঢুকে নিয়ে এসেছিল?
ভেবে বললুম–পশ্চিমেই তো বাংলো বাড়ির সদর গেট। কারো চোখে পড়া স্বাভাবিক।
কর্নেল বললেন–ঠিক আছে। এটা এখানেই থাক। আমরা আপাতত বাংলোয় ফিরি। একটা কথা জয়ন্ত, তুমি ঘুণাক্ষরে একথা কারো কাছে প্রকাশ করবে না।
নিশ্চয় নয়।
হাঁটতে হাঁটতে কর্নেল একটু হেসে বললেন–আমার ভয় হয় জয়ন্ত! যুবতী, স্ত্রীলোকদের প্রতি তুমি সময়ে খুবই পক্ষপাতিত্ব দেখাও।
হো হো করে হেসে বললুম–দ্যাটস ন্যাচারাল!
–ওটা চোপরার মুদ্রাদোষ, তাই না জয়ন্ত?
কী কথায় কী! বললুম–হ্যাঁ। এবং আমার ক্ষেত্রে সঙ্গদোষ। চোপরার কাছে শুনে এই হয়েছে।…
আন্দাজ ফুট বিশেক ওপরে উঠেছি, হঠাৎ কর্নেল দাঁড়ালেন। তারপর ফিস ফিস করে বললেন–উঁহু, হয়তো খুবই ভুল করছি। তুমি এক কাজ কোরো জয়ন্ত। এখানে ঝোপের আড়ালে বসলে পাঞ্জাবিটার ওপর লক্ষ্য রাখা যায়। তোমার রিভলভারটা কি কাছে আছে?
না। ওসব নিয়ে ঘোরাঘুরি করি নাকি? কী দরকার?
–ঠিক আছে। কোনও দরকার নেই। তুমি প্লীজ একটু সাহায্য করো আমাকে। এখানে বসে চুপচাপ লক্ষ্য রাখো। কেউ এসে যদি দেখ পাঞ্জাবিটা সরাচ্ছে– কিংবা কিছু করছে–তুমি কিছু করবে না। সে যাই করুক, শুধু তাকে চিনে রাখবে। ব্যস!
বেশ।
–ভয়ের কোনও কারণ নেই ডার্লিং! যথাসময়ে আমি ফিরে আসব।
–অত বলার কী আছে? আজ তো নতুন আপনার চেলাগিরি করছি নে। বলে একটু হাসলুম। অবশ্য আমার বুকে কাঁপুনি শুরু হয়েছে ঠিকই।
কর্নেল কাঁধে থাপ্পড় মেরে স্নেহ প্রকাশ করে চলে গেলেন। আমি ওৎ পেতে বসলুম। কর্নেল না বলে দিলেও বুঝেছি, সিগ্রেট খাওয়া চলবে না। সকালের রোদ বেয়াড়া রকম বেশি তাপ ছড়াচ্ছে। ছায়ায় বসে আছি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে মন দিতেও পারছি না–এ এক অদ্ভুত অবস্থা। প্রায় আধ ঘণ্টা কেটে গেল।
হঠাৎ দেখি নীচরে একটা ঝোপের মধ্যে রত্না দাঁড়িয়ে আছে। ভীষণ চমকে উঠলুম। ভুল দেখছি না তো?
ও এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। মনে হলো, কিছু খুঁজছে। তারপর পা বাড়াল। বুঝলুম, ওদের জেরা শেষ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। হয়তো দিব্যকেই শুধু আটকে রেখেছে। রত্না কি পাঞ্জাবিটা খুঁজতেই এসেছে? ও কীভাবে জানল যে পাঞ্জাবিটা এখানেই লুকানো আছে? একটু পরেই বুঝলুম, পাঞ্জাবিটা কোথায় আছে, রত্না জানে না। কারণ সে ওটার পাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করল। তারপর আরও নীচে নামতে থাকল। মিনিট পাঁচেক পরে সে ঘুরল এবং সোজা আমার দিকে ওঠা শুরু করল। আমি একটু সরে বসলুম। কিন্তু সে সোজাসুজি উঠে এসে যেই ডানদিকে ঘুরেছে, আমার মধ্যে হঠকারী ঝোঁক এসে গেল। কর্নেলের নিষেধ ভুলে গেলুম। আসলে আমার মধ্যে গোয়েন্দাসুলভ কৌতূহলের তাগিদ চাগিয়ে উঠেছিল সম্ভবত। আমি গম্ভীর স্বরে ডেকে উঠলুম-মিস চ্যাটার্জি।
রত্না ভীষণ চমকে গেল। তারপর অপ্রস্তুত হেসে বলল–এই মানে…একটু ঘু ঘুরতে বেরিয়েছি। আপনি কী করছেন? নিশ্চয় আমার মতো ঘুরতে?
খুবই গোমড়ামুখে বললুম–মোটেও না। অন ডিউটিতে আছি।
রত্না হাসবার চেষ্টা করে বলল–তাই বুঝি? আচ্ছা চলি।
–মিস চ্যাটার্জি, শুনুন!
রত্না দাঁড়াল। সে ভীষণ ঘামছে। ঠোঁট কাঁপছে। মনে হলো, ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলবে এক্ষুণি। তারপর অতিকষ্টে বলল-বলুন।
কী খুঁজতে এসেছেন?
–দাদার পাঞ্জাবিটা।
কীভাবে জানলেন যে আপনার দাদার পাঞ্জাবিটা এখানে লুকোনো আছে?
–আমি পাঞ্জাবি-পরা দাদাকে দেখতে পেয়েছিলুম দীপ্তির কাছে।
-চোপরাও দেখেছিল। যাক গে, ওটা দিয়ে কী হবে এখন? আপনার দাদার বিরুদ্ধে তো অন্য সব প্রমাণ আছে।
না কিছু নেই। শুধু এটা ছাড়া। …বলে রত্না হু হু করে কেঁদে উঠল।
একটু পরে বললুম–আপনি এত সহজে ভেঙে পড়তে পারেন। অথচ পুলিশের রেকর্ডে আছে, আপনি নাকি নকশালপন্থী ছিলেন?
রত্না ফোঁস করে উঠল–একসময় ছিলুম। এখন আর নেই।
এই সময় চোখে পড়ল ওপরের দিকে ঝোপের কাছ থেকে কর্নেলের টুপিপরা মুণ্ডুটা দেখা যাচ্ছে। তখনি রত্নাকে চুপ করতে এবং সরে যেতে ইশারা করলুম। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে ততক্ষণে। কর্নেল গুম হয়ে গুঁরি মেরে এগোচ্ছেন– রত্নাও দেখতে পেল। কাছে এসে কর্নেল হঠাৎ দুজনকে টেনে বসিয়ে দিলেন এবং ফিস ফিস করে বললেন–চুপ!
পাঞ্জাবির কথা ভুলেই গিয়েছিলুম, অর্থাৎ ওদিকে এতক্ষণ চোখ ছিল না। এবার দেখি, ওখানে রণধীর চোপরা বসে রয়েছে। হতভম্ব হয়ে গেলুম। সে ব্যস্তভাবে পাঞ্জাবির পকেট হাতড়াচ্ছিল রত্না হিস হিস করে উঠল বাস্টার্ড!
মেয়েদের মুখে বাস্টার্ড শুনে আমার হাসি পেল।
তারপর কর্নেল আচমকা উঠে বিকট গর্জন করলেন–চোপরা! নড়ো না! নড়লেই গুলি করব।
চোপরার দুপাশের ঝোপ ও পাথরের আড়াল থেকে ততক্ষণে কয়েকজন পুলিশ অফিসার উঠে দাঁড়িয়েছেন।
.
এরপর যা হবার তাই হল–অর্থাৎ রণধীর চোপরা চালান গেল। এখন ওসব ব্যাপার কানুনের এক্তিয়ারে। তা সব দেখার জন্য এবং তদারক করার জন্য সরকার যথেষ্ট লোকজন রেখেছেন। কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সেখানে কোনও ভূমিকা অবান্তর এবং উনি ওতে নাক গলাবেনও না। বাংলোয় আমাদের ঘরে, অর্থাৎ যে ঘরে আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে, আমি কর্নেল, সোনালী এবং তার বাবা অনিরুদ্ধ ব্যানার্জি ও জয়ন্তী দেবী বিকেলের চায়ের মজলিশ জমাচ্ছিলুম। দিব্য এল না। রত্না এসে বলল-দাদা চুপচাপ শুয়ে আছে।
সেটা স্বাভাবিক। বেচারা ভীষণ আঘাত পেয়েছে মনে।
সবার চোখে মুখে কৌতূহল ফুটে উঠেছিল। সুতরাং মুখপাত্র হয়ে আমিই প্রথম তুললুম– কর্নেল, চোপরা সবুজ পাঞ্জাবিতে কী খুঁজতে গিয়েছিল?
কর্নেল একটু হেসে জবাব দিলেন দীপ্তির হাতের মুঠোয় একটুকরো কাগজ ছিল। খুন করার পর চোপরা সম্ভবত তাড়তাড়িতে সেটা পকেটে ঢুকিয়েছিল। তখন তো ওর নার্ভাস অবস্থা। কে দেখে ফেলবে এই আতঙ্কে রয়েছে। তাই পাঞ্জাবি রেখে পালাবার সময় কাগজটা বের করে নেয়নি। ভেবেছিল, পরে এসে নেবে। এমন না হলে পাঞ্জাবিটা সে প্রকাশ্যে কোথাও ফেলে রাখত। কারণ তার উদ্দেশ্য দিব্যের কাঁধে দায়টা চাপানো। আসলে খুন করার পর খুনীর খানিকটা হতবুদ্ধি অবস্থা থাকে বলেই তাদের ধরা সম্ভব হয়। কোনও না কোনও ক্ষেত্রে একটু ভুল করবেই। আজ পর্যন্ত আমি খুনী দেখিনি, যে কোনও ভুল করেনি, অর্থাৎ কোনও ক্লু রাখেনি।
অনিরুদ্ধ বললেন কাগজটাতে কী ছিল? দীপ্তি তা পেল কোথায়?
বিশেষ কিছুই ছিল না। ছিল তিনটে জিরো লেখা। এটা একটা বিদেশী শত্রুরাষ্ট্রের দেশীয় গুপ্তচর এজেন্সির সাংকেতিক নাম। চোপরাকে তারাই মিঃ ব্যানার্জির পি. এ. করে পাঠাতে পেরেছিল।
অনিরুদ্ধবাবু কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করলেন। কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন জানি, আপনার দোষ নেই। আপনি কী করতে পারেন? যাক গে, যা বলছিলুম। হতভাগিনী দীপ্তি তার বোকামির জন্যই কিন্তু খুন হলো। ও যেভাবেই হোক জানতে পেরেছিল যে চোপরা থ্রি জিরো দলের মেম্বার। কিন্তু কথাটা সরাসরি অনিরুদ্ধবাবুর কানে তুলতে পারত। তা না করে সে সম্ভবত চোপরাকে নিয়ে একটু মজা করতে চেয়েছিল। সে বোঝেইনি চোপরা যে দলের মেম্বার, তাদের সঙ্গে রসিকতা করার পরিণাম বড় সাংঘাতিক।
রত্না বলে উঠল–আমার মনে পড়েছে! দীপ্তি চোপরাকে দেখলেই বলত কী মশাই, তিন শূন্যের অঙ্ক মিলল? চোপরার মুখটা কেমন সাদা হয়ে যেত যেন।
তা শুনে সোনালীও বলে উঠল–হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমিও শুনেছি। ভাবতুম, নিছক, জোক করছে।
কর্নেল বললেন–চোপরা ভেবেছিল, দীপ্তির মুঠোর কাগজটা সত্যি সত্যি কোনও সাংঘাতিক দলিল–হয়তো কোনও সুত্রে দীপ্তির হাতে এসেছে। অদৃশ্য কালিতে নিশ্চয় কিছু লেখাটেখা আছে। কারণ তিনটে জিরো কোনও কাগজে দেখলেই তাকে সতর্ক হতে হবে। দীপ্তি সত্যি বড় বোকামি করেছে। তবে একটা কথা ঠিক যে ও হাতের মুঠোয় কাগজটা না রাখলেও তাকে খুন করত। কারণ হত্যার পরিকল্পনাটা সেই মন্দিরে যাবার দিনই সে করে নিয়েছে। কাজেই দীপ্তিকে একদিন না একদিন খুন হতেই হতো।
সোনালী বলল কলকাতায় ট্যাক্সির ব্যাপারটা কী হলো, কর্নেল?
কর্নেল হাসলেন। বললেন–শুধু দীপ্তিকে ফলো করা হচ্ছিল সারাক্ষণ। চোপরার দলের লোকেরা কত তৎপর, তারই প্রমাণ ওটা। আজকালের মধ্যেই সেই ট্যাক্সি চালক ধরা পড়ে যাবে। আরও অনেক তথ্য বেরিয়ে পড়বে। দীপ্তি মন্দিরে যাবার দিনও যথারীতি চোপরার দলের লোক ওকে ফলো করেছিল। তা না হলে চোপরা হঠাৎ গাড়ি নিয়ে মন্দিরের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত না।
রত্না বলল কিন্তু মন্দিরে তো দীপ্তি কারও সঙ্গে দেখা করেনি।
-ওটা সম্ভব হয়নি। কারণ, রাজীব শেরগিল তখন অলরেডি নিহত।
আমি চমকে ওঠে বললুম– বুঝতে পারছিনে কর্নেল। রাজীব শেরগিলের সঙ্গে দীপ্তির আলাপ হলো কীভাবে? রাজীব কেন তাকে ওখানে যেতে বলবে?
কর্নেল জবাব দিলেন–সবটা দিব্যের মুখেই শোনা ভাল। কিন্তু সে কি এখন আসবে?
রত্না মাথা দুলিয়ে বলল–মনে হয় না। আপনিই বলুন কর্নেল।
–দিব্য পরে পুলিশকে একটা লং স্টেটমেন্ট দিয়েছে। হয়তো চেপেই যেত সব। কিন্তু তারই পাঞ্জাবি চুরি করে চোপরা তার ঘাড়ে খুনের দায় চাপাতে চেয়েছিল। এতে ওর ভীষণ রাগ হয়ে গেছে। তাই সব বলে দিয়েছে। সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলি।…চোপরার সঙ্গে যেদিন একটা রেস্তোরাঁয় তার মারামারি হয়না, ভুল বলছি, প্রকৃতপক্ষে মারামারি হয়নি–হবার উপক্রম হয়েছিল এবং রাজীব সেটা থামিয়ে দেয়, সেদিন কিন্তু দীপ্তিও সেখানে উপস্থিত ছিল। চোপরার সঙ্গে আগে থেকেই দীপ্তি ওখানে গিয়েছিল। ইদানিং ওরা ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল, তোমরা তা জানো। যাই হোক, স্টেশন থেকে রাজীবকে নিয়ে দিব্য দৈবাৎ ওখানে ঢোকে। বলাবাহুল্য, দীপ্তিকে চোপরার সঙ্গে দেখে মনে মনে জ্বলে ওঠে। সুযোগ খোঁজে চোপরাকে পিটুনি দেবার।
চোপরার ভঙ্গিতে আমি গম্ভীর মুখে বলে উঠলুম–দ্যাটস ন্যাচারাল।
কেউ তাতে হাসল না। কর্নেল ছাড়া। কর্নেল বললেন–দ্যাটস রাইট। তা, দিব্যও ঠিক রত্না বা সোনালীর মতো দীপ্তিকে, কী মশাই, জিরো জিরোর অঙ্ক মিলল?–চোপরার উদ্দেশ্যে এই জোক করতে শুনেছে। সেদিন ওখানে দীপ্তি, মারামারি থামাতে বলে ওঠে–এই থ্রি জিরোটিকে নিয়ে আর পারা যায় না। দিব্য লক্ষ্য করেনি কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি রাজীব শেরগিল খুবই চমকে উঠেছিল। সে থ্রি জিরো দলের লোক। কিন্তু কোনও কারণে সম্ভবত দলের ওপর ক্রুদ্ধ হয়েই হোক, অথবা নিছক অর্থের লোভে রানীডিহি এসেছিল। অর্থাৎ চোপরাকে ব্ল্যাকমেল করতে অথবা প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে অয়েল ডিরেক্টরের কানে সব তুলে দিতে। আমার ধারণা, চোপরাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সে অনিরুদ্ধবাবুর কাছে সব ফাঁস করতে চেয়েছিল। যাইহোক, রাজীব বা দীপ্তি এখন বেঁচে নেই। কিন্তু দীপ্তির ঘরে একটা চিঠি পুলিশ আবিষ্কার করেছে। রাজীব শেরগিলের হাতের লেখার সঙ্গে মিলে যায়। নীচে নামের বদলে তিনটে জিরো নেই অনিরুদ্ধবাবুকে লেখা সেই চিঠির মতো। সোজা নামসই রয়েছে চিঠিতে। বলাবাহুল্য ইংরাজিীতে লেখা : …থ্রি জিরোর রহস্য কি জানেন? না জানা থাকলে ১৩ তারিখে সকাল নটায় পাতালকালীর মন্দিরে আসুন। কিন্তু দীপ্তি একা যেতে সাহস করে নি। রত্নার বুদ্ধি ও সাহসে তার আস্থা ছিল স্বাভাবিক। তাই রত্নাকেই সঙ্গে নেয়। দীপ্তি জানত না যে ট্যাঙ্কের কাছে পাওয়া লাশটা রাজীবের।
সোনালী বলল-ওদিন আমার একটু জ্বর মতো হয়েছিল।
আনলাকি থার্টিন নিহত রাজীবের কাছে ওই দিনকার দিল্লীর রিজার্ভেশন টিকিট পাওয়া গেছে। তার মানে, দীপ্তির সঙ্গে দেখা করে এবং সম্ভবত সদুপদেশ দিয়ে সে নিরাপদে দিল্লী চলে যাবে ভেবেছিল। সদুপদেশ দেবার কারণ, দিব্য তাকে বলেছিল যে দীপ্তির সঙ্গে তার বিয়ের কথা ছিল। কিন্তু বিয়েটা আর করা যাবে না। তখন রাজীব বলে, আমি বুঝিয়ে বলব। তুমি ভেবো না। চোপরাকে আমি চিনি। ও খুব খারাপ লোক। দীপ্তিকে সতর্ক করা দরকার। চোপরার হালহদিশ সব ওকে বাতলে দিয়ে যাবো।
এতক্ষণে জয়ন্তীদেবী মুখ খুলে বললেন–এত সব কাণ্ড ভেতর-ভেতর!
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। এ খুব জটিল কেস। কিন্তু খুনের প্রসঙ্গে এলে বলব, এত সহজ এমন চমৎকার মোডস অফ অপারেণ্ডি খুব কমই দেখেছি। আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, চোপরা পুবের রাস্তায় গিয়ে বাগান হয়ে এই বাংলোর পূর্ব-উত্তর কোণে দিব্যের ঘরে ঢোকে এবং সবুজ পাঞ্জাবিটা নিয়ে চলে যায়। চোখে পড়ে শুধু পরিচারিকার। তার চোখে না পড়লেও চোপরাকে আমরা ধরে ফেলতুম। সে পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। তারপর কী ঘটেছে, তাও দেখতে পাচ্ছি। সে দীপ্তিকে বলছে–তোমার ছুরিটা খসে যাচ্ছে যে! ঠিক করে দিই। তারপর…থাক। বড় বীভৎস ঘটনা।
রত্না আস্তে বলল–আমি ওকে দেখে দাদা ভেবেছিলুম!
কর্নেল বললেন–দিব্যও দেখেতে পেয়েছিল। সবুজ পাঞ্জাবিটা তার মনে কিছুটা সন্দেহ জাগিয়াছিল কিন্তু জড়িয়ে পড়ার ভয়ে সে চুপ করে গিয়েছিল।
বললুম–সব তো বুঝলুম! কিন্তু লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া?
কর্নেল চুরুট বের করে বললেন–ওই পাতায় একটা সাবোটাজের বিবরণ আছে। অনিরুদ্ধবাবুকে সাবোটাজের ভয়াবহতা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিল রাজীব।
অনিরুদ্ধ শিউরে উঠে শুধু বললেন হ্যাঁ।