1 of 2

জিরো জিরো গজানন

জিরো জিরো গজানন

ত্রিশূল এর আমন্ত্রণ

জিরো জিরো গজানন পরপর দুটো ট্যাবলেট মুখে ফেলে দিয়ে বললে পুঁতিবালাকে, লাশটা কোথায়?

পুঁতিবালা তখন হাঁফাচ্ছে। অনেকটা পথ ছুটে আসতে হয়েছে খবরটা দিতে। একে তো এই পাহাড়ি রাস্তা। ওঠো আর নামো, ওঠো আর নামো। ধুস! দম বেরিয়ে যায়!

বললে জোরে-জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার ফাঁকে-ফাঁকে–এখন ও রাস্তায়…মানে, বস্তির দিকে যে সিঁড়িটা নেমে গেছে, তার ওপর।

ট্যাবলেট দুটো ততক্ষণে জিভের তলায় মিলিয়ে গেছে। বেশ চাঙ্গা লাগছে গজাননের। আমেরিকান বড়ি। ব্রেনটাকে আঁকুনি মেরে সজাগ করে দেয় চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে।

মোষের শিংয়ের নস্যাধার খুলে এক টিপ নস্যি নিয়ে নাসিকা গহ্বরে সশব্দে চালান করে দিয়ে ভারিক্তি গলায় বললে গজানন, মানে জিরো জিরো গজানন, ওরফে সুপার স্পাই ট্রিপলজি– পুঁতিবালা, যে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছি, মনে হচ্ছে, এবার তার ভেতরে প্রবেশ করব। এ সময়ে তোমার এই ভয়ংকর হাঁপানিটা সব বানচাল করে দিতে পারে।

পুঁতিবালা নামটা গেঁইয়া হতে পারে, কিন্তু মেয়েটি খাসা। সুপার মডার্ন গার্ল বললেই চলে। গজানন একে আবিষ্কার করেছিল হিন্দ সিনেমার সামনে থেকে। কলগার্ল পুঁতিবালা ষোড়শী বালিকার মতোই ডাগর চোখে উৎসুক পথচারীদের প্রাণে পুলক জাগিয়ে চলেছিল। গোধূলির লাল আভা গণেশ এভিনিউ বেয়ে তার মুখে পড়েছে। চৌমাথায় ট্রাফিক পুলিশ যথারীতি কথাকলি নৃত্য করে যানবাহন জট রুখে দিচ্ছে। পুঁতিবালাকে সে রোজই দেখে। ছেলেছোকরা থেকে আরম্ভ করে প্রৌঢ়রা পর্যন্ত হেসে-হেসে তার সঙ্গে কথা বলে স্কুটার অথবা গাড়িতে চাপিয়ে হু-উ-উ-স করে উধাও হয়। কনস্টেবল পুঙ্গব তা দেখেও দেখে না। আহা, মেয়েটা রোজগার করছে, করুক।

কিন্তু জিরো জিরো গজাননের চোখের কোয়ালিটিই আলাদা। মেন্টাল হোমে থাকতে থাকতেই তার চোখের আর মনের ধার বেড়েছে। ম্যাচুইরিটি এসেছে। ইনটেলেকচুয়াল ম্যাচুইরিটি।

তারপরেই বেপারিটোলা লেনে ভোলা হাউসের ঠিক পেছনের লাল বাড়িটায় পেয়ে গেল একটা ঘর। আশেপাশে কালোয়ারদের আড্ডা। পুরোনো মাল নীলামে কিনে এনে খুলে রকমারি পার্টস চড়া দামে বেচেই এরাই এখন লাখোপতি কোটিপতি। শুধু নীলামে নয়, চোরাই মালও আসছে এই তল্লাটে। সুতরাং এসপায়োনেজ অ্যাকটিভিটির পক্ষে জায়গাটা উপযুক্ত।

মেন্টাল হোম থেকে বেরোনোর আগেই গজানন ঠিক করেছিল সে স্পাই হবে। নিক কার্টার পড়েছে বিস্তর। জেমস বন্ড তার প্রিয় হিরো। ব্রুস লীর পরম ভক্ত। এই সবগুলো মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে যাওয়ার ফলেই যেতে হয়েছিল মেনটাল হোমে। কঁকড়া চুল নেড়ে একদিন লরির ওপর লাফিয়ে উঠে লাথি মেরে উইন্ডস্ক্রিন ভেঙে দিতেই পা কেটে গেছিলজুক্ষেপ করেনি। কিন্তু লরির ভেতর স্মাগলার তিনজন যখন ছুরি হাতে বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গজাননের ওপর–টনক নড়েছিল তখনই।

একটা বাচ্চা মেয়েকে ঠিকরে ফেলে দিয়ে উধাও হওয়ার ফিকিরে ছিল বলেই অসম সাহসিকতাটা দেখিয়ে ফেলেছিল গজানন। নিমেষের মধ্যে আত্মবিস্মৃত হয়েছিল। বেঞ্চিতে বসা ইয়ারবন্ধুদের সঙ্গে গল্প করা মাথায় উঠেছিল। হুঙ্কার ছেড়ে লাফিয়ে উঠেই নক্ষত্রবেগে ধেয়ে গিয়ে ঠিকরে গেছিল লরির ওপর।

তারপরেই প্রচণ্ড লাথি। ঝনঝন করে ভেঙেছে কাঁচ। থেমেছে লরি। পরমুহূর্তেই ভাঙা কাঁচে রক্তরক্তি ড্রাইভারের পাশে বসা তিন মস্তান বেরিয়ে এসে খোলা ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গজাননের ওপর।

বেলেঘাটা মেন রোডের ওপর বোমা নিয়ে দু-দলে মারামারি নতুন দৃশ্য নয়। কিন্তু সে দিনের সেই দৃশ্য ছিল একেবারে অন্যরকম। তিন-তিনটে ঝকঝকে ছুরি তিনদিকে ঝলসে উঠতেই গজাননের মাথার মধ্যে কী যেন ঘটে গেল। মনে হল পটাং করে একটা টান করে বাঁধা তার ছিঁড়ে গেল। সেতারের তার ছেঁড়ার মতো আওয়াজটা মাথার মধ্যে মিলিয়ে যেতে না যেতেই গজানন হয়ে গেল আর এক মানুষ।

তিন-তিনটে ছুরিধারী মস্তানকে কীভাবে রুখেছিল গজানন, তা তার কিছু মনে নেই। পটাং করে তার ছিঁড়ে যাওয়ার পর থেকেই কী-কী ঘটেছিল, কিসসু মনে নেই।

রাস্তার লোকে দেখেছিল যেন স্বয়ং জেমস বন্ড, ব্রুস লী আর অমিতাভ বচ্চন একইসঙ্গে মিলেমিশে গেছে গজাননের বিদ্যুৎ গতি ক্ষিপ্রতার মধ্যে। ক্যারাটে, মার, লাথি, ঘুসি চলছে এত দ্রুত পরম্পরায় যে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না কী ঘটে চলেছে। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে তিন তিনটে হাত-পা-মাথা ভাঙা জোয়ান ঠিকরে পড়ল বেলেঘাটা মেন রোডের খোলা ড্রেনে পাঁকের মধ্যে।

আর রক্তাক্ত দেহে দাঁড়িয়ে সুন্দরবনের আহত বাঘের মতো সমানে গর্জে চলল গজানন। তিনটে ছুরির একটা তার পেটের চামড়া এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত কেটে দিয়েছে, আর একটা গোটা পিঠটাকে কোণাকুণিভাবে চিরে দিয়েছে, তৃতীয়টায় কেটেছে ডান গাল।

বীভৎস মূর্তি নিয়ে তাই হুঙ্কারের পর হুঙ্কার ছেড়ে চলেছে গজানন। চোখ ঘুরছে বনবন করে। দাঁত খিঁচিয়ে রয়েছে হিংস্র হায়নার মতো।

বন্ধুরাই ওকে জাপটে ধরে এবং দশ-দশটা বন্ধু নাকানিচোবানি খেয়ে যায় তাকে মেনটাল হোমে নিয়ে যেতে। স্ট্রেটজ্যাকেট পরিয়ে সেল-এ রাখতে হয়েছিল কিছুদিন। মাথায় শক দিতে হয়নি– স্রেফ শক থেরাপিতেই কাজ হয়েছিল। মাস কয়েক পরে ডাঃ রাঘব বক্সীর চেম্বার থেকে যখন বেরিয়ে এল, তখন আর গজাননকে চেনা যায় না। বাবরি প্যাটার্নের অসুর মার্কা চুল ওর বরাবরই। কিন্তু শরীর আরও মজবুত হয়েছে। গায়ের রং আগে ছিল ফরসা, এবং লালচে। চোখ-মুখ-নাকের ধার আরও বেড়েছে। সব মিলিয়ে ঝকঝক করছে চেহারাটা।

ডাঃ বক্সী তাকে পিটিয়ে শক্ত করে দিয়েছেন। লোহা থেকে ইস্পাত। আসবার সময়ে চোখে চোখ রেখে কঠোর কাটা কাটা স্বরে শুধু বলেছিলেন, গজানন, আর যাই করো, কুপথে যেও না, তোমার মধ্যে যে সম্পদ আছে, তা দেশের কাজে লাগিও।

তাই স্পাই কোম্পানি খুলে বসেছিল গজানন ওরফে ট্রিপল-জি ওরফে জিরো জিরো গজানন।

উদ্দেশ্য একটাই, দুর্নীতির অবসান। কালোবাজারি হটাও, দেশকে বাঁচাও–এই হচ্ছে জিরো জিরো গজানন কোম্পানির পলিসি।

বেপারিটোলা লেনের অফিস থেকে বেরিয়ে একদিন হিন্দ সিনেমার সামনে ট্যাক্সির জন্যে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে দেখেছিল কলগার্ল পুঁতিবালাকে। দেখেই বুঝেছিল, এমন মেয়েকেই তার দরকার সাগরেদ হিসেবে। ন্যাতাজোবরা মেয়েদের দিয়ে এ লাইনে কিছু হবে না। চাই শার্প, ডেয়ারিং, বডি অ্যাফেয়ার্স নিয়ে সনাতনী ধারণাহীন বলগা ছাড়া মেয়ে। যার তেরচা চাহনি, বুকের ইশারা আর নিতম্বের দুলুনি দেখে পার্টি মজবে, পথ পরিষ্কার হবে দরকার হলে বডিলাভেও পার্টিকে ঘায়েল করবে–মনে কিন্তু দাগ পড়বে না। ইমোশন-টিমোশন নিয়ে এ কারবার চলে না। টিট ফর ট্যাট।

পুঁতিবালাকে অফিসে নিয়ে এসেছিল গজানন। তিনকুলে কেউ নেই শুনে, বউবাজারের হাড়কাটা গলির ডেরা তুলে দিয়ে ঠাই দিয়েছিল অফিস ঘরেরই পাশের ঘরে। পুঁতিবালার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল শার্দুল-চরিত্র ট্রিপল-জি।

ট্রেনিং? বেলেঘাটার রাস্তার ধারে বসে আর পাড়ায়-পাড়ায় মস্তানি করে যে ট্রেনিং পেয়েছে গজানন, তা কম কী? যে-কোনও টেররিস্ট বর্তে যাবে এই জাতীয় কলকাত্তাই ট্রেনিং পেলে। কথায় বলে যা নেই কলকাতায় তা নেই…..

যাক সে কথা। গজানন কোম্পানি দু-বছরেই গাড়ি কিনে ফেলেছে। অফিস চেম্বারটিকেও মডার্ন করে ফেলেছে। এই কলকাতারই বেশ কয়েকটা বড় কোম্পানি তাকে দিয়ে অনেক কালো কারবার ধরে ফেলেছে। লোকসান কমতেই কোম্পানির লাভের অঙ্ক বেড়েছে। গজাননের কোনও নির্দিষ্ট দক্ষিণা নেই। যত লোকসান বাঁচিয়ে দেবে তার ফাইভ পারসেন্ট দিতে হবে।

তাতেই এই অবস্থা। যার জীবনের ভয় নেই, রাতদুপুরেও যে খিদিরপুর ডকে গিয়ে বিদেশি মাল চুরি হচ্ছে দেখে, লুকিয়ে থেকে, বিদেশি জাহাজ থেকে নৌকোয় আউটরাম ঘাটে প্যাকেটে দামি বস্তু হস্তান্তরের সময়ে সাহেব পার্টিকেও খপাত করে চেপে ধরতে দ্বিধা করে না–এমন ডাকাবুকো মূর্তিমান যমকেই তো চায় বড়-বড় কোম্পানিরা।

বর্তমান কাহিনির শুরু বেশ কিছুদিন আগে। এয়ারকন্ডিশনড ঘরে বসে নস্যিও নিচ্ছে, পাইপও খাচ্ছে গ্রেট গজানন। পুঁতিবালা বেরিয়েছে একটা ধুরন্ধর অ-বাঙালি স্মাগলারের পেট থেকে কথা বার করতে। তৈরি হয়েই বেরিয়েছে। হয়তো রাত্রে নাও ফিরতে পারে। বেশ আছে চুড়ি। মজাও লুটছে, কাজও করছে। গজানন অবশ্য এই সময়গুলোয় বেশ উদ্বেগের মধ্যেই থাকে পুঁতিবালার জন্যে। হাজার হোক মেয়েছেলে তো। গজানন ওকে দেখে নিজের বোনের মতো। তাই….

এমন সময়ে বাজল টেলিফোন। লাল টকটকে রিসিভার তুলে নিল গজানন। তারের মধ্যে দিয়ে ভেসে এল সুমিষ্ট নারীকণ্ঠ জিরো জিরো গজানন?

বলছি।

একটু ধরুন।

সেকেন্ড কয়েক পরেই ভারি গলা ভেসে এল তারের মধ্যে দিয়ে।

মিঃ ট্রিপল জি, আমি ত্রিশূল বলছি। একটু থেমে–চিনতে পারছেন?

আন্তর্জাতিক দুর্নীতি প্রতিরোধ সঙ্ঘ?

রাইট, মিঃ ট্রিপল-জি আপনার সাহায্য দরকার।

আমি তো পিঁপড়ে আপনাদের কাছে। টিপে মেরে ফেললেই পারেন।

আরে ছিঃ ছিঃ। উদ্দেশ্য আমাদের একই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। যাক, টেলিফোন ট্যাপিং হতে পারে।

হয়ে গেল বোধ হয় এতক্ষণে।

পাবলিক টেলিফোন থেকে কথা বলছি ওই কারণেই। আমাদের প্রেজেন্ট অ্যাড্রেস জানেন?

অতবার ঠিকানা পালটালে জানব কী করে?

নোট ডাউন। থ্রি লেটার্স–সিক্স–-টোটাল লাইন। মাইনাস থ্রি। ফাইন্যাল সিক্স। সুপ্রভাত।

লাইন কেটে গেল।

সুপ্রভাত দৈনিকটা সামনেই পড়ে। সুপ্রভাত বলে শুভেচ্ছা জানানো হল না গজাননকে, সেটুকু বোঝবার বুদ্ধি ওর ব্রেনে আছে। কোড মেসেজে বলা হল সুপ্রভাত কাগজটা দেখতে দেখতে হবে সম্পাদকীয় পাতা। এইটাই নিয়ম। সম্পাদকীয় বার করে প্রথম প্যারাগ্রাফের প্রতি ষষ্ঠ শব্দ বেছে নিয়ে কাগজে লিখল গজানন। লেখাটা দাঁড়াল এই :।

দিলদার ভবন। অরুণাভ। পঁয়ত্রিশ।

পাইপ নিভে গেছে। নস্যির ডিবে পেঁচিয়ে খুলতে খুলতে হাতঘড়ি দেখে নিল গজানন। ঠিক পনেরো মিনিটেই পৌঁছে যাবে দিলদার ভবনের পঁয়ত্রিশ নম্বর ফ্ল্যাটে অরুণাভর কাছে।

.

যন্ত্রদানবের সামনে

অরুণাভ লোকটা যে এত কালো আর বেঁটে, এত মোটা আর কদাকার হবে, গজানন ভাবতেই পারেনি।

কালো জুনোয় কালো পালিশ লাগিয়ে বুরুশ দিয়ে ঘষলে যা দাঁড়ায়, শ্রী অরুণাভর মুখের কান্তি সেই রকম। তার ওপর মাথাজোড়া টাক। গদিমোড়া কালো রিভলভিং চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই চেয়ার বেচারি যেন স্বস্তির নিশ্বেস ফেলে পিঠঠাকে একটু সিধে করল। মোটা বটে। কী খায়? এত চর্বি আসে কোত্থেকে?

বলুন গজাননবাবু, কালো মুখে সাদা দাঁত বার করে ভারি অমায়িক হাসি হাসল অরুণাভ। ওই হাসি আর কথাগুলোর মধ্যে দিয়েই প্রকট হল লোকটার ভেতরে সচল রয়েছে বুঝি একটা ডায়নামো। শক্তির ডায়নামো। ঝকঝকে কিন্তু ছোট-ছোট দুই চোখে যেন তারই স্পার্ক।

সতর্ক হল গজানন। বেলেঘাটার রাস্তা থেকে আজ সে উঠেছে যেখানে, এই ত্রিশূল সঙঘ কিন্তু সেখান থেকে অনেক উঁচুতে। পৃথিবী জুড়ে জাল পেতে খপাখপ ধরছে রাঘববোয়ালদের। তার মতো চুনোপুটিকে কী দরকারে তলব পড়ল, ঠিক ভেবে ওঠা যাচ্ছে না। খতম-টতম করে দেবে না তো? সিক্রেট এজেন্টদের পক্ষে সবই সম্ভব। এই লাইনে প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ রাখতে চায় না।

বসল গজানন। একটু ঝুঁকেই বসল। যাতে বাঁ-দিকের কোমরে হোলস্টারটা টেবিলে ঠেকে যায়। বুশ শার্টের তলায় থেকেও খাপে গোঁজা নাইন এম এম লুগারটা অনেকটা ধাতস্থ করে তোলে ট্রিপল জিকে। শক্তির আধার তারও হাতের কাছে। এক থেকে তিন গুনতে যেটুকু সময় লাগে, তার মধ্যেই লুগার চলে আসবে হাতে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে চক্ষের নিমেষে।

চোখে-চোখে চেয়ে মিটিমিটি হাসছিল অরুণাভ। যেন গজাননের মনের কথা টের পেয়েছিল। ড্রয়ার টেনে একটা চকচকে উইলহেলমিনা বার করে রাখল সাড়ে পাঁচ মিলিমিটার পুরু কাঁচ দিয়ে ঢাকা টেবিলের ওপর।

বলল, আপনারটাও এখানে রাখতে পারেন।

বিনা বাক্যব্যয়ে নাইন এম এম লুগার বের করে উইলহেলমিনা-র পাশে রেখেছিল গজানন। দুটো আগ্নেয়াস্ত্রই প্রায় একই রকম দেখতে। দুটোই প্রাণ-প্রদীপ নিভিয়ে দিতে মোক্ষম।

এবার কাজের কথায় আসা যাক, বলেছিল অরুণাভ আপনি রিসেন্ট সুইসাইড কেসগুলো নিয়ে ভেবেছেন?

কাজের লোক বটে এই অরুণাভ। এক্কেবারে আসল পয়েন্টে চলে এসেছে। মাস দুয়েকের মধ্যে তিনটে সুইসাইডের রহস্য গজাননের মগজেও আলোড়ন তুলেছে। এদের মধ্যে একজন ছিল তারই পার্টি। হরেন জোয়ারদার। কোটিপতি। উলটোডাঙায় গেঞ্জির কল আছে। মিজোরামে নিজের জমিতে ঔষধি গাছের চাষবাসও করত। মিজোরামের হার্বস এক্সপোর্ট করে যখন কোটিপতি, ঠিক তখন ভদ্রলোক দ্বারস্থ হয়েছিল গজাননের। কারা যেন তাকে সমানে হুমকি দিয়ে চলেছে টেলিফোনে আর চিঠিতে। ওখানে অত টাকা রাখো, এখানে এত টাকা রাখোনইলে বোমা মেরে দেব খুলি উড়িয়ে।

গজানন নেমে পড়েছিল মাঠে। নেমে, কাজটা টেক-আপ করেই ধড়াধড় এগিয়ে গেছিল বেশ খানিকটা। হাতেনাতে ধরেও ফেলেছিল হুমকি দেনেওলাকে। হ্যাঁ, একজনই। জোয়ারদারের গেঞ্জির কলের ইউনিয়ন লিডার।

সে কেস মেটবার মাসখানেক পরেই একটা টেলিফোন এল গজাননের কাছে। ফোন করছে জোয়ারদার স্বয়ং।

গজাননবাবু? ভারী বিমর্ষ স্বর–এসব কী হচ্ছে?

কী হচ্ছে মানে? ঘাবড়ে গেছিল গজানন। অন্যায়-টন্যায় করে ফেলল না কি? ডাঃ বক্সীর কাটা-কাটা কথা এখনও কানে লেগে রয়েছে–অন্যায় পথে যেও না। জ্ঞাতসারে তো যায়নি গজানন। তবে?

জোয়ারদারের বিষণ্ণ কণ্ঠস্বর হঠাৎ বিষম উত্তেজিত হয়ে ওঠে–ওই…ওই শুনুন আবার ওরা শাসাচ্ছে …।

কারা? কারা? কারা? চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে গজানন–কোন শয়তানের বাচ্চারা?

ওই তো–ওই তো দলে-দলে দরজা দিয়ে ঢুকছে আর জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমাকে ডাকছে, গজাননবাবু, আমাকে ডাকছে, বলছে–শান্তি, শান্তি, এই পথেই শান্তি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তার শান্তি এইখানে, এই জানলার বাইরে। গজাননবাবু, ও গজাননবাবু বেরিয়ে যাব জানলা দিয়ে?

না, না, না, এমন জোরে সেদিন গজানন চেঁচিয়েছিল যে তিনদিন ভোকাল কর্ড ভালো কাজ দেয়নি–ভাঙা গলায় কথা বলতে হয়েছে–চোদ্দোতলার জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাবেন কী? আপনার মাথা কি খারাপ হয়েছে?

আমার মাথা খারাপ? হাঃ হাঃ হাঃ! হাঃ হাঃ হাঃ! হাঃ হাঃ হাঃ! আমার মাথা খারাপ বলার আগে গজাননবাবু আপনার মাথাটা মনের ডাক্তার দিয়ে দেখিয়ে নিন। ওই ওই ওই কটমট করে আবার তাকাচ্ছে, শাসাচ্ছে–বলছে, চলে আয় চলে আয় চলে আয়–ওরে আয়, ওরে আয়, ওরে আয়! যাই গজাননবাবু, এত করে ডাকছে।

দড়াম করে টেলিফোন আছড়ে পড়ার শব্দ ভেসে এসেছিল। মনশ্চক্ষে গজানন দেখতে পেয়েছিল, টেলিফোন ক্রেডল-এ রিসিভার বসানো হয়নি। ঝুলছে। তাই শোনা যাচ্ছে জোয়ারদারের জোরাল গলায় অট্টহাসি দূর হতে দূরে সরে যাচ্ছে। তারপরেই–নৈঃশব্দ্য!

মনের চোখে বাকি দৃশ্যটুকুও কল্পনা করে শিউরে উঠেছিল গজানন। ধাঁই করে রিসিভার নামিয়ে রেখে ধড়মড় করে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। উল্কাবেগে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের চোদ্দোতলা বাড়িটার সামনে পৌঁছেই দেখেছিল কাতারে কাতারে লোক জমে রয়েছে রাস্তা পর্যন্ত।

জোয়ারদার তার কথা রেখেছিল। এই বহুতল অট্টালিকার কোনও ঘরেই জানলায় গরাদ নেই। জানলায় বাইরে তাই পাটাতন পেতে ফুলের টব রাখা হয়। এই রকমই জানলা গলে হাসতে হাসতে শূন্যে লাফ দিয়ে–আছড়ে পড়েছে একতলায়।

থ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল গজানন। আচমকা শক খেয়েই স্থাণু হয়ে গেছিল। মস্তিষ্ক একদম কাজ করেনি।

তারপরেই বিদ্যুৎ খেলে গেছিল কোষে-কোষে। জোয়ারদারকে কি ভূতে পেয়েছিল? নাকি পাগল হয়ে গেছিল? মনের ডাক্তারকে দিয়ে গজাননের মাথাটা দেখাতে বলছিল। ভদ্রলোকের জানা ছিল না, ও কাজটি সেরেই এ লাইনে এসেছে গজানন। তাহলে, তাহলে

দি আইডিয়া। মনের ডাক্তারের কাছেই ছোটা যাক।

বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড থেকে বাঁই-বাই করে গাড়ি চালিয়ে একেবারে ইন্দ্র দত্ত রোড এক কোণে ডাঃ বক্সীর কেয়ার ক্লিনিক। লোহার গেটের ভেতরে চাবি হাতে বসেছিল নেপালি দারোয়ান। গজাননকে দেখেই একগাল হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল?

–কী খবর?

ডাক্তারবাবু–ডাক্তারবাবু আছেন?

গজাননের মুখের চেহারা আর কথার ধরন দেখে হাসি মিলিয়ে গেছিল দারোয়ানের মুখ থেকে। কেস গড়বড় মনে হচ্ছে? অনেকেই এরকম ফিরে আসে বটে। কিন্তু এভাবে নিজে থেকে–

তাড়াতাড়ি তালা খুলে গজাননকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছিল দারোয়ান।

–বসুন, খবর দিই।

একটু পরেই ডাক এসেছিল ওপর থেকে। বাইরের ঘরে গদিমোড়া চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছিলেন দীর্ঘদেহী অতীব সুপুরষ ডাঃ বক্সী। ফরসা দুই চোখে যেন ঈগলের চাহনি।

কী ব্যাপার, গজানন?

ব্যাপার কী তা ব্যক্ত করেছিল গজানন। শুনেটুনে হা-হা করে হেসে ডাঃ বক্সী বলেছিলেন– না, না ভূত নয়, প্রেত নয়, দত্যি নয়, দানো নয়, পিশাচ নয়–কিসসু নয়। গজানন, ব্যাপারটা তোমার বোঝা উচিত ছিল।

কী, স্যার?

অডিটরি হ্যাঁলিউসিনেশন। অপটিক্যাল হ্যাঁলিউসেনশন। কর্ণ বিভ্রম আর দৃষ্টি বিভ্রম। এরকম কেস তো এখানেই ছিল–তুমি যখন ছিলে। এখনও আছে। মনে হয় যেন দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্রসঙ্গীত অবিরাম শুনে যাচ্ছে। অথবা চোখের সামনে সায়রা বানুকে দেখতে পাচ্ছে। ইডিয়ট!

অরুণাভ চেয়েছিল গজাননের দিকে। দুই চোখে সেই স্পার্ক। এখন বললে–বুঝতে পারছেন কেন আপনাকে ডাকা হয়েছে? আপনারই একজন ক্লায়েন্ট পাগল হয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ঠিক একইভাবে পাগল হয়ে গিয়ে একজন চলন্ত লরির সামনে লাফিয়ে পড়েছে হাসতে-হাসতে।

আর একজন হাওড়ার পোল থেকে। গজাননবাবু, এই দুজনেই ছিল আমাদের ক্লায়েন্ট।

অ্যাঁ।

আজ্ঞে হ্যাঁ। কুচক্রীদের হাত থেকে বাঁচতে এই তিনজনেই শরণ নিয়েছিল আমাদের। এই ঘটনা পরপর ঘটে যেতে থাকলে কেউ আর আমাদের কাছে আসবে না। কুচক্রীদের কারবার ফলাও চলবে। আপনি কি তাই চান?

কক্ষনও না।

তাহলে শুনুন এখনও যা জানেন না। জোয়ারদার আপনার মক্কেল ছিল–কারেক্ট?

সব খবরই তো রাখেন।

একটু বেশিই রাখি। জোয়ারদার কিছুদিন নিউইয়র্কে ছিল জানেন?

জানি। বেড়াতে গেছিল।

আজ্ঞে না। কারবার করতে গেছিল। কুল ড্রিঙ্কস-এর নাম শুনেছেন?

নিশ্চয়।

দীর্ঘ কুড়ি বছর পরে পৃথিবী বিখ্যাত এই কোম্পানি আবার ইন্ডিয়ায় ব্যবসা করার জন্যে লাইসেন্স চেয়েছে। এখন ইন্ডিয়ায় সফট ড্রিঙ্কস এর যা টোটাল মার্কেটতার সবটুকু মিটোনোর মতো প্ল্যান্ট ক্যাপাসিটি চেয়ে দরখাস্ত করেছে। অথচ ইন্ডিয়ায় এই টোটাল মার্কেটটা ধরে রেখেছে। তিনটে কোম্পানি। তাদের নাম বলার দরকার আছে কি?

না। বলে যান।

বলে গেল অরুণাভ, এই তিনটে কোম্পানির তিন ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যাপ্রোচ করেছে গভর্নমেন্টকে, লাইসেন্স যেন ইস্যু করা না হয়। পেল্লায় আমেরিকান কোম্পানির দাপটে ধুলোয় মিশে যাবে তিন-তিনটে ইন্ডিয়ান কোম্পানি। ক্লিয়ার?

ও ইয়েস, তারপর? নস্যি নিল গজানন।

নস্যির ডিবের দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে চেয়ে অরুণাভ বললে, আমাকেও দিন।

খুশি হল গজানন। নস্যি কালচার সিক্রেট এজেন্ট মহলেও তাহলে ঢুকে পড়েছে! গুড! বাড়িয়ে দিল ডিবেটা-তারপর?

তারপর-এর কথাটা নস্যি নেওয়ার পরে বলল অরুণাভ। এই তিন জনের দুজন সুইসাইড করেছে। কাগজে ছবিও বেরিয়েছে।

কিন্তু জোয়ারদার তো এসবের মধ্যে ছিল না।

মশায় গজানন, আই মীন, মাই ডিয়ার গজাননবাবু, হার্বস বেচতে জোয়ারদার নিউইয়র্কে গেছিল ঠিকই, কিন্তু তাকে মোটা রকমের শেয়ার অফার করা হয়েছিল কুল ড্রিঙ্কস-এর তরফ থেকে যাতে ইন্ডিয়ায় জবর ঘাঁটি গড়ে তোলা যায়। জোয়ারদারের আসল জোর কোথায় ছিল জানেন তো?

সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টে।

রাইট। জোয়ারদার অফার অ্যাকসেপ্ট করেনি। তিন-তিনটে ইন্ডিয়ান কোম্পানির সর্বনাশ করতে চায়নি, এই তার অপরাধ।

কিন্তু জোয়ারদার তো পাগল হয়ে গেছিল।

বেঁটে মোটা কালো শরীরখানা দুলিয়ে-দুলিয়ে কিছুক্ষণ ধরে অট্টহাসি হাসল অরুণাভ। হাসির মধ্যেও যেন ব্যাটারির চার্জ।

বললে, ইন্ডিয়ায় পয়লা সারির বিজনেস ম্যাগনেটগুলো হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করছে, মনে একটুও ধন্দ লাগছে না?

তা ইয়ে…খটকা একটু লাগছে বইকী।

সফট ড্রিঙ্কস ম্যানুফাঁকচারারদের তিন ম্যানেজিং ডিরেক্টরদের মধ্যে বাকি আছে একজন, রাম সিং। এই মুহূর্তে দার্জিলিংয়ে।

আই সী।

ইয়েস, নাউ ইউ সী। হাসল অরুণাভ। যেন কালো মেঘের মধ্যে থেকে ঝিলিক দিল বিদ্যুৎ। এই রাম সিংকে প্রোটেকশন দিতে হবে আপনাকে। তক্‌কে-তকে থাকলে মিস্ট্রিটা সলভ করে ফেলতেও পারেন।

বাট, বাট আপনাদের এত বড় সংগঠনের কাউকে না পাঠিয়ে হোয়াই আমাকে…

বিকজ আপনার একজন ক্লায়েন্টের মুখ চিরকালের মতো বন্ধ করা হয়েছে বলে। বিকজ আরও অনেকের মুখ এভাবে বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে বলে। বিকজ আপনাকে কাউন্টার স্পাই হিসেবে লাগাতে চাই বলে।

কাকাউন্টার স্পাই!

ইয়েস মাই ডিয়ার মিস্টার গজানন। ত্রিশূল সংগঠনের কেউ ওখানে নেই, একবারও কি আপনাকে তা বলেছি? বলিনি। তা সত্ত্বেও আপনাকে পাঠাতে চাই–ডবল এজেন্ট হিসেবে। আপনি তার ওপরেও নজর রাখবেন রাম সিংকেও দেখবেন। হাসল অরুণাভ লাইনটা খারাপ জানেন তো। টাকার টোপ বড় সাংঘাতিক জিনিস। কিন্তু আপনার সম্বন্ধে আমাদের রিপোর্ট অন্যরকম। আপনি জান দেবেন, তবু মান দেবেন না।

থ্যাংক ইউ ফর দ্য কমপ্লিমেন্টস, ডাঃ বক্সীর কাছে শেখা উচ্চারণে চোস্ত ইংরেজিটা ঝেড়ে দিল গজানন। এ রকম গোটা বারো বাঁধা গৎ তার মুখস্থ। বিজনেস চালাতে গেলে একটু দরকার বইকী।

বললে–ত্রিশূল এজেন্টের নাম?

চেহারাটাই দেখিয়ে দিচ্ছি। চিনতে সুবিধে হবে, বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল অরুণাভ। ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে লাগানো ছোট ড্রয়ার ক্যাবিনেটের ওপরের ড্রয়ারটা খুলল চাবি ঘুরিয়ে। ভেতর থেকে বার করল ছোট্ট একটা রূপোর কার্ড। কমপিউটার কার্ড যেভাবে পাঞ্চ করা থাকে, রূপোর এই কার্ডও সেইভাবে পাঞ্চ করা। কার্ডটা হাতে নিয়ে গেল পেছনের দেওয়ালে লাগানো ফাইলিং ক্যাবিনেটের সামনে। রূপোর কার্ডটা ঢুকিয়ে দিলে ক্যাবিনেটের গায়ে সরু ফোকর দিয়ে। কালো ইস্পাত ক্যাবিনেট মসৃণগতিতে সরে গেল একপাশে দেখা গেল দেওয়ালের ভেতরে বসানো চৌকো স্টিল সিন্দুক।

গজাননের চোখ তখন ছানাবড়া সিন্দুকের ঠিক মাথার লেন্সটা দেখে। শরীরের প্রতিটি পেশি টান-টান হয়ে উঠেছে আপনা থেকেই। এ দৃশ্য সে আগেও দেখেছে এবং দেখেছে বলেই প্রবল ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তে টেনে লম্বা দেওয়ার। ত্রিশূল সঙেঘর টপ-সিক্রেট ডকুমেন্টস আছে এই সিন্দুকে। সেই সঙ্গে আছে বিস্তর বিস্ফোরক। শুধু এই ঘরখানা কেন, পুরো বাড়িটাকে পাউডার করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ত্রিশূল সঙেঘর প্রতিষ্ঠাতারা ভারতের বড় বড় সংস্থার মালিক। সারা পৃথিবীতে ছাড়ানো ব্যবসার জাল। দুর্নীতিচক্র রোধ করার জন্যে নিজেদের স্বার্থে বেসরকারি এই সিক্রেট-এজেন্ট অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানী করে আশ্চর্য কৌশলে।

ত্রিশূল তাই একটা বিভীষিকা-ভারত-শত্রুদের কাছেও।

সিন্দুকের পাশে একটা লিভারে অরুণাভ চাপ দিতেই আচমকা ফ্ল্যাশে চোখ ধাঁধিয়ে গেল গজাননের। পিলে চমকে উঠলেও স্বস্তি পেল প্রাণটা এখনও যায়নি দেখে। সিন্দুকের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা অরুণাভর ফটো তুলে নিল লেন্স। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল গজানন তফাতে। দাঁড়িয়ে আছে। অরুণাভও। লেন্স তার কাজ করে চলেছে। কমপিউটারের মেমারি ব্যাঙ্কে গচ্ছিত অরুণাভর ফটোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখছে। দাঁড়িয়ে থাকা অরুণাভর ফটোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখছে। দাঁড়িয়ে থাকা অরুণাভর শরীরের প্রতিটি লাইনের সঙ্গে ফটোর অরুণাভর প্রতিটি লাইন মিলে যাওয়া চাই। না মিললেই অনর্থ ঘটবে। কমপিউটারের সঙ্গে সরাসরি লাগানো রয়েছে ডিটোনেটর যন্ত্রপাতি বিস্ফোরণ ঘটবে এক্ষুনি।

এত আধুনিকতা ভালো নয়, মনে-মনেই বলে গজানন। আরে বাপু, অরুণাভর একটা চুলও যদি পেকে গিয়ে থাকে এবং সেই পাকা চুলের চিহ্ন যদি ফটোতে না পাওয়া যায়, বেআক্কেলে যন্ত্রদানব বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বসবে এখুনি। অথবা যদি তাড়াহুড়োয় দাড়ি কামাতে ভুলে যায়, তাহলেও রক্ষে নেই।

তাই ভেতরে-ভেতরে ঘেমে ওঠে গজানন দ্য গ্রেট।

কিন্তু সন্তুষ্ট হয়েছে কমপিউটার। নিঃশব্দে খুলে গেল সিন্দুকের পাল্লা। ভেতর থেকে একটা ফাইল বার করে আবার লেন্সের সামনে দাঁড়াল অরুণাভ। চাপ দিল লিভারে। আবার দেখা গেল ফ্ল্যাশ। বন্ধ হয়ে গেল পাল্লা। ফাইলিং ক্যাবিনেট পিছলে এল সিন্দুকের সামনে।

চেয়ারে এসে বসল অরুণাভ। ফাইল খুলে মেলে ধরল গজাননের সামনে।

ভারি মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ের দিকে অপলকে চেয়ে রইল ট্রিপল জি। পরনে টাইট জিনস প্যান্ট। হাফ হাতা ঢিলে শার্ট। গলায় একটা লকেট। ছোট করে ছাঁটা চুল। অনেকটা ছেলে ছেলে চেহারা হলেও মুখের লাবণ্যের জন্যে বোঝা যায় মেয়ে। ঠোঁট দুটো কিন্তু পুরু এবং শক্ত। ওই ঠোঁট আর বেশবাস দেখে গজাননের ধারণা হয়ে গেল, এ মেয়ে লবঙ্গলতিকা নয় মোটে– রীতিমতো ব্যায়াম বীরাঙ্গনা।

সে অভিজ্ঞতাও হয়েছিল যথাসময়ে।

বললে চোখ তুলে–চিনে নিলাম। কিন্তু সে আমাকে চিনবে কী করে?

আপনার চেহারার ডেসক্রিপসন একটু পরেই ওয়্যারলেসে চলে যাবে।

নাম?

অনিমা।

বাঙালি?

অবাক হচ্ছেন কেন? আপনার সাগরেদ পুঁতিবালাও তো বাঙালি।

তা ঠিক। তবে আপনাদের তথ্যের একটু ভুল আছে। পুঁতিবালা নামটা যাচ্ছেতাই বলে ওর একটা বেটার নেম আমি দিয়েছি।

প্রীতিবল।

মাই গড! চোখ কপালে তুলে ফেলে গজানন–তাও জানেন? হাসল অরুণাভ। সেই ব্যাটারি চার্জড় শক্তিমানের হাসি।

বললে, কত নেবেন?

কত দেবেন?

এখন বিশ হাজার। ক্যাশ। অন্য খরচ আমাদের।

কাজ শেষ হলে?

কাজের শেষটা কী হয় দেখা যাক, আবার সেই ব্যাটারি চার্জড হাসি। এবারে রীতিমতো নিগূঢ়। অর্থাৎ বেঁচে ফিরে আসো কিনা দেখি? এক লাখেও পৌঁছতে পারে।

খুব কম।

ডোন্ট বারগেন, একটু কর্কশ শোনায় অরুণাভর স্বর। চোয়ালও কঠিন। চোখের স্পার্ক দ্বিগুণ ত্রিশূলের একটা কাজ করলেই সারাজীবন পায়ের ওপর পা তুলে বসে কাটিয়ে দেওয়া যায়।

জানি, হাসল গজাননও। বেলেঘাটাই হাসি বাজিয়ে নিলাম। ডোন্ট মাইন্ড।

.

বাঘের গুহায়

কিন্তু বাঁচানো গেল না রামসিংকে। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পুঁতিবালা ওরফে প্রীতিল যে খবর দিল তা সাংঘাতিক।

লাশ দেখে আর লাভ কী? বিশ হাজার নগদ নিয়ে ত্রিশূলের পয়সায় দার্জিলিং-এর মতো জায়গায় এত লপচপানি করে শেষে এই হল? অরুণাভ যা টেটিয়া লোক, এবার জানে না মেরে দেয়।

মুখের ভেতরটা বেশ গরম-গরম লাগছে। আমেরিকান ট্যাবলেটের কারবারই আলাদা। মাথার ভেতরকার ভোঁ-ভোঁ ভাবটাও একটু কেটেছে। মনে-মনে ডাঃ বক্সীকে স্মরণ করল গজানন। লোকটা নির্ঘাত দেবতা। আপদে-বিপদে অলক্ষিতে এমন বাঁচিয়ে দেয়। এই ট্যাবলেট যদি সঙ্গে না থাকত, মেন্টাল শকেই আবার মেন্টাল হোমে দিন কাটাতে হত।

মেজাজ খিঁচড়ে গেলে গ্রেট গজানন পুঁতিবালার ওপরেই ঝাল ঝাড়ে। পুঁতিবালা যদিও এখন আর সেই পুঁতিবালা নেই। অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়েছিল বলে শরীরেও গ্লানি জমা হয়েছিল। এখন তার চেহারা ঝকঝকে, চোখ চকচকে, রং টকটকে। তবুও গজাননের কাছে আগুনের শিখা এই প্রীতিবল-নুয়ে পড়ে আগেকার পুঁতিবালার মতোনই।

তেড়ে বললে গজানন, তোকে যে বলেছিলাম, রাম সিং-এর সঙ্গে ফ্লার্ট করতে। করেছিলি?

মুচকি হেসে পুঁতিবালা বললে, তা আর করিনি। মনে রং ধরিয়ে তবে ছেড়েছি।

তবে মরতে গেল কেন?

পাগল হয়ে যাচ্ছিল যে।

হয়ে যাচ্ছিল! চোখ বড় হয়ে যায় গজাননের।–এতদিন বলিসনি কেন?

মুখের সামনে দু-হাত ঘুরিয়ে বুড়ি খুকির মতো বললে পুঁতিবালা কখন বলব গো? যখনই অমি একা হই, তখনই দেখি তুমি দোকা।

শাট আপ।

ফিক করে হেসে ফেলে পুঁতিবালা–বেড়ে মেয়েটা, না দাদা? বিয়েই করে ফ্যালো না।

আমাদের লাইনে কেউ বিয়ে করে না। করলেই ফাঁস–গলায় ছুরির কোপ দেখানোর ভঙ্গিমা দেখিয়ে।অথবা দুম! রগে পিস্তল ছোঁড়ার অভিনয় করে।–তোকেই বলছি, বিয়ে ফিয়ের কথা মনেও আনবি না। বুঝেছিস?

দাদা গো দাদা, তা আর বুঝিনি। হাড়ে হাড়ে বুঝছি। কিন্তু দাদা, প্রথম দিন যেদিন ম্যালে গিয়ে ঘোড়া নিলে। অনিমা বউদি–।

বউদি!

মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। অনিমাদির ঘোড়ায় চড়াটা লাভলি, তাই না?

গেছো মেয়ে নাম্বার ওয়ান।

গোছো মেয়েই আমার ভাল্লাগে, মুখ গোল করে বললে পুঁতিবালা–তা দুটিতে জলাপাহাড়ে গিয়ে কী করলে গো?

গেট আউট!

পুঁতিবালা তো গেট-আউট হলই না, উলটে আরও বেশি ইন হয়ে গেল। অর্থাৎ সোফায় ঝপ করে শুয়ে পড়ে পায়ের ওপর পা তুলে নাচাতে লাগল। আড়চোখে কিন্তু তাকিয়ে রইল গজাননের দিকে।

গজাননের মাথায় তখন চিন্তার তুফান। প্রথম দিনেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট মতো ম্যালেতে চিনে ফেলেছিল অনিমাকে। ঘোড়ায় চড়ে জলাপাহাড়ে যেতে-যেতে কথাও হয়েছে। ঠিক হয়েছে গোপনে দেখাশুনো হবে বোটানিক্যাল গার্ডেনে, দিনের আলোয়, গাছপালার আড়ালে। প্রতিদিনই দুপুর দুটোর সময়ে একবার দেখা হবেই।

তা দুদিন দেখা হয়েছে বইকী। জানা গেছে অনেক কথা। গজানন আর পুঁতিবালা টুরিস্টের ভিড়ে এখনও মিশে আছে বলে রক্ষে, কিন্তু বেশিদিন থাকলেই সজাগ হবে অদৃশ্য চক্ষুরা। অনিমার সে ভয় নেই। স্কুলের শিক্ষয়িত্রী সে। থাকে লেডিজ হোস্টেলে। প্রতি সন্ধ্যায় যায় ভিডিও গেমের জুয়োর আসরে। এবং ওইখানেই রয়েছে সন্দেহজনক কিছু লোকের আনাগোনা।

ভাবতে-ভাবতেই মতলব স্থির হয়ে যায় গজাননের। প্রাণ নিয়ে টানাটানির গেম-এ নেমে প্রাণটাকেই পণ করে এবার খেলায় নামা যাক। মরতে ভয় পায় না গজানন। কিন্তু কোন…বাচ্চারা রাম সিং এবং আরও তিনজনকে পাগল বানিয়ে আত্মহত্যা করাচ্ছে, কীভাবে পাগল বানাচ্ছে, তা ্না জানলে গজানন নিজেই তো ফের পাগল হয়ে যাবে। তার চাইতে বাঘের গুহাতেই ঢোকা যাক। যা থাকে কপালে।

পুঁতিবালা, আই মীন, প্রতিবল–গম্ভীর স্বর গজাননের। দ্বিধা কাটিয়ে উঠেছে। সঙ্কল্পে পৌঁছেছে। গলার স্বর পালটে গেছে।

বুঝল পুঁতিবালাও। গজাননকে সে চিনে ফেলেছে। অসম্ভব ডেয়ারিং। আর অসম্ভব গোঁয়ার। গজানন নিজেও বলেছিল একদিন, ওর নাকি অবসেসন্যাল পার্সোনালিটি আছে। যা ধরবে, তা করে তবে ছাড়বে। পুঁতিবালা বলেছিল, শুয়োরের গোঁ বললেই হয়। খেপে গেছিল গজানন।

কিন্তু আজকে আর টিটকিরি দেওয়ার সাহস হল না পুঁতিবালার। গ্রেট গজাননের মুখ থমথম করছে। ভুরু কুঁচকে গেছে। চোখ আর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। বেলেঘাট্টাই গজানন জাগছে ট্রিপল জি-এর মধ্যে।

বলো দাদা–মিনমিনে গলায় বললে পুঁতিবালা।

রিভলভারটা দে।

সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল পুঁতিবালা। সুবোধ বালিকার মতো বালিশের তলা থেকে হোলস্টার সমেত রিভলভার এনে দাঁড়াল গজাননের সামনে। গজানন ততক্ষণে বুশশার্ট খুলে ফেলেছে। দু হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। নিপুণ হাতে কাঁধে আর বগলের তলা দিয়ে চামড়ার বেল্ট বেঁধে আগ্নেয়াস্ত্র ঝুলিয়ে দিল পুঁতিবালা। হাত নামিয়ে বুশশার্ট পরে নিল গজানন। ঘড়ি দেখল। দুপুর একটা।

বলল–দুটোর সময়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে দেখা হবে অনিমার সঙ্গে। সন্ধ্যায় যাব ভিডিও গেমের আড্ডায়। খুঁচিয়ে ঘা করে ধরা দেব। নিয়ে যাক ওদের ঘাঁটিতে। তারপর এসপার কি ওসপার। দাঁত কিড়মিড় করে গজানন শালা-বাচ্চা! দেখি তোদের কত মুরোদ।

গজাননের চেহারা এক্কেবারে পালটে গেছে। প্রমাদ গণে পুঁতিবালা। গান ডুয়েলের জন্যে তৈরি হয়েই বেরোচ্ছে গজানন। রক্ত ঝরাবে। নিজেও মরতে পারে। তারপর?

আমার কী হবে? ককিয়ে ওঠে পুঁতিবালা।

শাট আপ! সন্ধ্যার পর নজর রাখবি ভিডিও গেমের আড্ডায়। ভেতরে ঢুকবি না। খবরদার! আমাকে নিয়ে গেলে পেছন নিবি না। চোপরাও। কোনও কথা না। কাল সকালে না ফিরলে পুলিশে খবর দিবি। নিজে থেকে ওস্তাদি মারতে যেও না, বুঝেছ? গেছো মেয়ে অনিমা থাকছে সঙ্গে, ভয় কী? সস্নেহে পুঁতিবালার মাথা চাপড়ে দেয় গজানন, এ লাইনে সে অনেক বেশি এক্সপার্ট। বায় বায়, মাই সিস্টার। বলেই ঝড়ের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল গজানন দ্য গ্রেট। কিন্তু হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে-পড়তে বেঁচে গেল বাইরে গিয়েই। টুরিস্ট এসেছে। মালপত্র নামাচ্ছে। একটা বড় প্যাকেট ছিল গজাননের গমন পথে। বেশ বড় প্যাকেট। ট্রিপল-জি তাতেই হোঁচট খেয়েছে।

এমনিতেই মেজাজ সপ্তমে চড়ে। তার ওপর এই প্যাকেট। বেরোচ্ছে একটা শুভ কাজে, প্রথমেই বাধা। গজানন আবার এগুলো মেনে চলে। হাঁচি, কাশি, টিকটিকির সঙ্কেতকে বিলক্ষণ পাত্তা দেয়। তাই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেও সুড়সুড় করে ফিরে এল ঘরে। এসেই দেখল সোফায় শুয়ে খবরের কাগজ পড়তে-পড়তে চোখ বড়-বড় করে উঠে বসেছে পুঁতিবালা।

গজাননকে ব্যাজার মুখে ফিরে আসতে দেখেও চোখ নামিয়ে নিয়ে খবরের কাগজ পড়ে যাচ্ছে দেখে ট্রিপল-জি-এর আর সহ্য হল না। দুন্দুভি কণ্ঠে হুঙ্কার ছেড়ে বললে, সিনেমার পেজ নাকি?

পড়া হয়ে গেছিল পুঁতিবালার। বিস্ফারিত চোখে কাগজখানা দিল গজাননের দিকে, পড়েছ?

পুঁতিবালা এরকম করে কেন? মরতে চলেছে গজানন, এখন কি খবরের কাগজ পড়ার সময়? কিন্তু কী আছে কাগজটায়?

হ্যাঁচকা টানে কাগজ টেনে নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল গজানন। কোন খবরটা? কাগজটা তো দেখা যাচ্ছে বাংলা। কলকাতার অফসেটে পি টি এস টাইপে ছাপা।

সোফা ছেড়ে পুঁতিবালা উঠে এসে আঙুল দিয়ে দেখাল–এই বিজ্ঞাপনটা।

পড়ল গজানন।

মানুষের মগজে দশহাজার কোটির ওপর নিউরোণ রয়েছে। কিন্তু এগুলোর দশ ভাগের এক ভাগেরও বেশি নিষ্ক্রিয় থাকে। এই নিষ্ক্রিয় নিউরোণগুলোর মধ্যে মানুষের পূর্বজন্ম আর অতীতের বহু জন্মের পঞ্চেন্দ্রিয় আর মন দিয়ে অর্জিত সমস্ত অভিজ্ঞতা স্মৃতির আকারে ধরা থাকে। নিষ্ক্রিয় নিউরোণগুলোকে সক্রিয় করলেই পূর্বজন্মের ও অতীতের বহু জন্মের স্মৃতি সক্রিয় হয়ে ওঠে।

মাত্র তিনমাসের মধ্যে যে-কোনও মানুষের পূর্বজন্মের স্মৃতিকে সক্রিয় করা হয়। সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যয় পঞ্চাশ হাজার মার্কিন ডলার। অগ্রিম দশ হাজার ডলার। বুকিং চলছে। যোগাযোগঃ

নিচের নাম ঠিকানার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল গজানন। এ যে কলকাতার ঠিকানা। কলকাতায় এজেন্ট বসিয়ে আমেরিকার এক্সপার্ট ব্রেনসেলে অ্যাকটিভিটি জাগিয়ে মানুষকে জাতিস্মর করে তুলছে।

ব্রেন সেল! আমেরিকাব এক্সপার্ট! অকস্মাৎ বিজনেস ম্যাগনেটদের পাগল হয়ে আত্মহত্যার হিড়িক। প্রত্যেকেই আমেরিকাব কুল ড্রিঙ্কস কোম্পানির বিষনজরে ছিল।

ফ্যালফ্যাল করে বিজ্ঞাপনটার দিকে চেয়ে থাকে গজানন। দশহাজার কোটিরও বেশি নিউরোণ এর দশ ভাগের নভাগ নিষ্ক্রিয়। তাদের খাঁটিয়ে নিলে পূর্বজন্মের স্মৃতি ফিরে পাওয়া যায়। কোটি কোটি নিষ্ক্রিয় নিউরোণের মধ্যে আরও অনেক ক্ষমতা নিশ্চয়ই আছে, যা এই জন্মেরই ব্যাপার। পূর্বজন্মের স্মৃতি জাগানোর আগে এই জন্মের অকল্পনীয় সেই শক্তিগুলো কি জেগে উঠছে না? সেই শক্তি দিয়ে একটার-পর-একটা সুস্থ মানুষকে পাগল করে দেওয়া কি খুব কঠিন?

বোঁ-বোঁ করে মাথা ঘুরতে লাগল গজাননের। কাগজটা মাটিতে ফেলে দিয়ে আস্তে-আস্তে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বাধা পেলে যে একটু বসে যেতে হয়, তাও ভুলে গেল।

.

অ্যাকশন

ঠিক দুটোর সময়ে বিশাল পাইন গাছটার তলায় পৌঁছল গজানন। দূরে দূরে কিছু কপোত-কপোতী প্রেমালাপে বিভোর। গজাননের মাথার মধ্যে তখন এমনই গোলমাল চলছে যে, এদিকে ওদিকে কৌতুকী চাহনি নিক্ষেপ করবার মতো মেজাজও নেই।

কিন্তু অনিমা মেয়েটা গেল কোথায়? পরপর দুদিন এল, আজকেই আরও বেশি করে আসা দরকার। কেননা রাম সিং পটল তুলেছে। রহস্য আরও বেশি গম্ভীর হয়েছে। চোখের সামনে অরুণাভর কালো পাথরের চকচকে মুখ আর বিরাট টাক ভেসে উঠছে। দু-চোখের স্পার্ক যেন কলকাতা থেকে ছুটে এসে গায়ে ছ্যাকা দিচ্ছে। মনের অবস্থা খুবই খারাপ। অনিমাটার সঙ্গে শলাপরামর্শ করে নেওয়া খুবই দরকার। কিন্তু বেআক্কেলে মেয়েটা ঠিক আজকেই ডুব দিল?

ত্রিশূলের কারসাজি নয় তো? নির্দেশ বেতারে–অ্যাসাইনমেন্ট ফেলিওর লিকুইডেট গজানন!

আপনা থেকেই হাতটা চলে যায় বগলের তলায়। কে জানে এই মুহূর্তে কোন ঝোপে রিভলভার তাগ করছে অনিমা। অথবা সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল। গোর্খাল্যান্ড নিয়ে যে হাঙ্গামা হয়ে গেল সম্প্রতি, বোটানিক্যাল গার্ডেনে একজনের লাশ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না।

গাছের গুঁড়ির দিকে সরে যায় গজানন। গুঁড়িতে পিঠ লাগিয়ে বাঘের মতো তাকায় আশেপাশে। ঠিক এই সময়ে পায়ের তলায় কী খচমচ করে উঠতেই লাফিয়ে ওঠে হরিণের মতো।

রিভলভার চলে এসেছে হাতে, গুলিও বেরিয়ে যেত আর একটু হলে। কিন্তু কাকে গুলি করবে গজানন? ওই খবরের কাগজটাকে? পা দিয়ে মাড়িয়ে ফেলেছে বলে?

কিন্তু একটুকরো পাথর দিয়ে কাগজটা চাপা দেওয়া কেন? পাছে উড়ে যায় বলে? এত যত্ন করে কে কাগজ রেখে গেল এখানে?

গুটিগুটি এগিয়ে গেল গজানন। বলা যায় না কাগজের তলায় হয়তো বিস্ফোরক আছে। কাগজ তুললেই ফাটবে প্রলয়ঙ্কর শব্দে। ত্রিশূলের অসাধ্য কিছু নেই।

কাছে এসে হেঁট হল গজানন। আরে, এ যে সেই বাংলা কাগজটা, একটু আগেই পড়তে দিয়েছিল পুঁতিবালা। পাথরটা যেখানে চাপা দেওয়া রয়েছে, তার ওপরের লাইন কটা পড়া যাচ্ছে  মানুষের মগজে দশহাজার কোটির বেশি নিউরোণ…

নিচের ঠিকানাটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

তবে কী, তবে কী, এই খবরটাতেই দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে এক কপি খবরের কাগজ এখানে চাপা দিয়ে রেখে যাওয়া হয়েছে? রেখেছে কে?

নিশ্চয় অনিমা। ত্রিশূল এজেন্ট।

বিদিগিচ্ছিরি এই কেসটার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কি তাহলে কোটি-কোটি নিউরোণ-এর রহস্য?

মাথা ঘুরে যায় গজাননের। আস্তে-আস্তে বসে পড়ে ঘাসের ওপর। পাখির ডাক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে এক সময়ে। এটা ওর একটা গ্রেট ক্যাপাসিটি। মনের সেফটি মেক্যানিজম। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা চরমে পৌঁছালে আপনিই ঘুম এসে যায়। মন শান্ত হয়ে যায়।

.

ঘণ্টাখানেক দিবানিদ্রা দিয়েই ধড়মড় করে উঠে পড়ল গজানন। আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছতে হবে ভিডিও গেম-এর আসরে।

এবং পৌঁছল ঘড়ি ধরেই। তখন রোদ্দুর একটু-একটু করে মুছে যাচ্ছে দার্জিলিং-এর বুক থেকে। বড়-বড় ছায়া এগিয়ে আসছে একটার-পর-একটা পাহাড়ের ওপর দিয়ে।

আচ্ছা এর মধ্যেই সরগরম। ঘর বুঝি ফেটে যাচ্ছে অনেকগুলো ভিডিও গেম-এর সম্মিলিত মিউজিক আর আওয়াজে। এক কোণে চলছে জুয়া।

তার পাশেই ওই হট্টগোলের মধ্যে চেয়ার টেবিল পেতে মদ্যপান করে চলেছে কিছু লোক। আজকের সাজগোজ আরও উগ্র। কামনা জাগানো। নিতম্ব কামড়ে ধরা ব্লু জিনস-এর তলায় টাইট গেঞ্জি গোঁজা। কোমরে চওড়া চকচকে বেল্ট। গেঞ্জির ওপর লেখা আই লাভ ইউ। দুই বক্ষ চূড়ার ওপর ঢেউ খেলানো অবস্থায় লেখাটা যেন জীবন্ত হয়ে দুলে-দুলে হাতছানি দিচ্ছে লুব্ধ পুরুষদের।

পুরুষগুলো কেউ নিচু ক্লাসের নয়। এই ধরনের জুয়োর আড্ডায় আর মদের আসরে পকেট ভারি না থাকলে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। গজাননকেও দশ টাকার টিপস দিতে হয়েছে। গেটম্যানকে। তাছাড়া ওর চালচলনেও যে এখন নবাবিয়ানা–যে লাইনের যে দস্তুর।

অনিমার দিকে তাকানো, তাকে নিয়ে হাসাহাসি করা, এমনকী তার সঙ্গে কথাও বলা হচ্ছে। পুরু ঠোঁট বেঁকিয়ে অনিমাও হাসছে এবং লাস্যময়ীর মতোই অভিনয় করে চলেছে। কে বলবে এই মেয়ে স্কুলের শিক্ষয়িত্রী।

গজানন গুটিসুটি গিয়ে বসে পড়ল মদের আড্ডায়। অনিমা ওকে দেখেও দেখল না। প্রথমে হুইস্কির অর্ডার দিল। যে-সে হুইস্কি নয়–ভুটানি হুইস্কি হওয়া চাই। যার জোর আরও বেশি। পরপর তিন পেগ যখন শেষ হয়েছে, পাশের টেবিল থেকে কালো চশমা পরা মজবুত চেহারার লম্বামতো

একটা লোক এসে বসল ওর টেবিলে। লোকটার কালো গোঁফ দু-দিকে পাকানো এবং ছুঁচাল। গজাননের দিকে তাকিয়ে সে হাসতেই গজাননও হাসল। ভুটানি মদ্য রক্তে এনেছে বেপরোয়া ভাব। হেসেই বললে ইংরেজিতে, রাত্রে কেউ গগলস পরে? চোখের দোষ আছে বুঝি?

ঠিক ধরেছেন। একটা চোখ কানা। চশমা খুলে দেখাল লোকটা নতুন এসেছেন?

হ্যাঁ।

গেমস খেলবেন?

জানি না কী করে খেলতে হয়।

শিখিয়ে দিচ্ছি। আসুন।

এইটাই চাইছিল গজানন। তক্ষুনি উঠে গেল জুয়োর আড্ডায়। সবকটা খেলাতেই সে পোক্ত। কিন্তু এমন ভান করে গেল যেন এক্কেবারে আনাড়ি। ফলে হারতে লাগল প্রতি গেমে। আধঘণ্টাও গেল না। পাঁচ হাজার দশ টাকা হেরে বসল গজানন।

কাগজে হিসেব রাখছিল কালো চশমাধারী। স্পষ্টত খেলানো এবং খেলিয়ে পথে বসানোই এর কাজ। সব জুয়োর আড্ডায় এরকম একজন বুদ্ধিমান মাল্লম্যান থাকে। কাগজের হিসেব দেখে সে বললে–পাঁচহাজার দশ। মিস্টার, টাকাটা রাখুন, তারপর খেলবেন।

আকাশ থেকে পড়ল গজানন–অত টাকা কোথায় পাব?

তবে খেলতে এলেন কেন? শক্ত গলা কালো চশমাধারীর।

টাকা চাইলেই পাব বলে।

চাইলেই পাবেন? কে দেবে?

রাম সিং, জড়িত স্বর গজাননের, একটা কাগজ দিন চিঠি লিখে দিচ্ছি। গিয়ে নিয়ে আসুন। না পারলে আমার সঙ্গে চলুন। জ্বালাবেন না মাইরি।

কালো চশমার আড়ালে একটা চোখ ঈষৎ চমকে উঠলেও মুখের ভাবে তা প্রকাশ পেল না। গজাননের ডাইনে-বাঁয়ে পেছনে তিনজন গাঁট্টাগোট্টা নেপালি এসে দাঁড়িয়ে গেল সঙ্গে-সঙ্গে।

কালো চশমাধারী চেয়ে আছে তো আছেই। গজাননের মুখের প্রতিক্রিয়া দেখছে। না, লোকটা খবরই রাখে না রাম সিং সুইসাইড করেছে আজই সকালে। মুখ ভাবলেশহীন, বরং একটু ক্ষুব্ধ টাকা নিয়ে চাপ দেওয়ায়। কিন্তু রাম সিং-এর সঙ্গে যার এত দোস্তি, তাকে তো চট করে ছাড়া যায় না।

রাম সিং আপনার কে হন?

দুম করে রেগে যায় গজানন (মানে রাগার ভান করে)–তাতে আপনার দরকার কী?

কালো চশমাধারী আর কথা বাড়ায় না। কলম আর প্যাডটা এগিয়ে দিয়ে বলে, লিখুন।

ঝড়াঝড় করে ইংরেজিতে লিখে দিল গজানন:

মাই ডিয়ার রাম সিং,

আই অ্যাম ইন এ ফিক্স। কাইন্ডলি হ্যান্ডওভার ফাইভ থাউজ্যান্ড টু দ্য বেয়ারার অফ দিজ লেটার। আই শ্যাল মীট ইউ টুমরো। ইওরসজ্ঞানপান।

প্যাড থেকে চিঠি ছিঁড়ে নিয়ে কালো চশমাধারী পকেটে পুরতে-পরতে বললে, কোথায় আছেন আপনার রাম সিং?

মনে-মনে বলল গজানন, শালা, বাজিয়ে নিচ্ছ আমাকে? মুখে বললে–লোহিয়া প্যালেস, জলাপাহাড়। কুইক। বেরিয়ে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল কালো চশমাধারী। গজানন তখনও চেঁচিয়ে চলেছে–হেই, গেট মী মোর ড্রিঙ্কস। আই ওয়ান্ট টু ড্যান্স। হু উইল ড্যান্স উইথ মী?

বলেই এদিক-ওদিক চাইল গজানন। হাত বুলিয়ে নিলে বাঁ-গালের কাটা দাগটার ওপর। বডি থ্রো করার আগে এটা করা ওর স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। ক্রিকেট মাঠে বল করার আগে প্যান্টে বল ঘষে নেওয়ার মতো। গজাননের হাতে-পায়ে বিদ্যুৎশক্তির আধারগুলো পটাপট ছিপিখোলা হয়ে যায় গালের ওই পুরোনো ক্ষতস্থানে হাত বুলোলেই।

অনিমা ঘাড় বেঁকিয়ে চেয়ে আছে ওর দিকে; চোখে বিজাতীয় দৃষ্টি। বন্ধুত্বর বাষ্পটুকুও নেই। ঘর থেকে সটকান দেওয়ার একটাই পথ। দরজার ঠিক পাশেই দু-হাত বুকের ওপর জড়ো করে দাঁড়িয়ে যেন পাথরপ্রতিমা, শরীরী বিস্ময়।

গাল থেকে হাত নামাল গজানন এবং দুহাতের দুই ঝটকায় ডাইনে-বাঁয়ের দুই নেপালী পুঙ্গবকে দশ হাত দূরে ছিটকে ফেলে দিয়ে কামানের গোলার মতো ধেয়ে গেল দরজার দিকে।

গজানন দ্য গ্রেটের এ হেন আচমকা ছিটকে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত ছিল না কেউই। সেই ফাঁকেই দরজায় পৌঁছে গেল গজানন। চাপা গলায় অনিমার দিকে না চেয়ে শুধু বললে–ল্যাং মার আমাকে।

অনিমা মেয়েটি সাঙ্ঘাতিক ধুরন্ধর। মুখখানায় একটু মঙ্গোলিয়ান ধাঁচ আছে বলেই মনের কথা মুখে ফোটে না। কিন্তু চকিতের মধ্যে বুঝে নিল একঘর বিমূঢ় শত্রুর আস্থা কুড়োতে গেলে গজাননের নির্দেশ অতি উত্তম।

অতএব অতি উত্তমভাবে ডান পা-টা সামনে বাড়িয়ে ল্যাং মারল অনিমা। লিখতে যেটুকু সময় গেল, তার অনেক কম সময়ের মধ্যে ঘটে গেল সমস্ত ব্যাপারটা। এক ফুট দূর থেকে গজানন বললে ল্যাং মারতে, এক ফুট এগিয়ে আসতেই ল্যাং মারল অনিমা এবং দশ ফুট দূরে মুখ থুবড়ে পড়ল ট্রিপল-জি।

হই-হই করে তেড়ে এল পেছনকার জুয়ারিরা। লাফিয়ে পড়ল গজাননের ওপর। গোলমালের মধ্যে দরজা দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল অনিমা।

ঘা কতক খেয়ে মনে হল নেশা ছুটে গেছে গজাননের। বিরাশি সিক্কা ওজনের একটি চড় পড়ল কাটা গালটার ওপর ব্লাইটার। যার গাল এরকম কাটা, সে যে সাধুপুরুষ নয়, আগেই বুঝেছিলাম। বল তুই কাদের এজেন্ট?

এজেন্ট? ককিয়ে ওঠে গজানন, কারবার-টারবার কিছুই নেই আমার, এজেন্সি নিতে যাব কেন? কেক! ঘুসি পড়েছে তলপেটে। দম আটকে আসে গ্রেট গজাননের। মনে কিন্তু খুশির ফেয়ারা। কাজ ভালোই এগুচ্ছে। এবার বডি সার্চ করুক। রিভলভারটা বেরিয়ে যাক। নিয়ে যাক ওদের ঘাঁটিতে…

ঠাস।

মাথা ঘুরে যায় গজাননের। সেই সঙ্গে ছিটকে পড়ে চেয়ার থেকে। বুকের ওপর জুতোর হিল ঘষছে একজন। আর একজন ঠিক কণ্ঠার ওপর। আর একজন দ্রুত বড়ি সার্চ করে হোলস্টার থেকে বার করে ফেলেছে রিভলভারটা।

রিভলভার এখন কালো চশমাধারীর হাতে। মুখ তার ক্রুর, করাল। কণ্ঠে শঙ্খচূড়ের রক্ত হিম করা গজরানি, আগেই বুঝেছিলাম। থাক এখানে। আসছি আমি।

গজাননও তাই চায়!

.

মনের শক্তি

দার্জিলিং শহর থেকে যে রাস্তাটা নেপালের পশুপতি মন্দিরের দিকে গেছে, যে পথ দিয়ে অবাধে নেপাল থেকে বিদেশি সামগ্রী কিনে আনে পর্যটকরা, সেই পথের বেশ কয়েক জায়গায় দু-পাশে গভীর পাইন অরণ্য নেমে গেছে ঢালু পাহাড় বেয়ে, কোথাও বা উঠে গেছে মেঘলোকের দিকে।

কালো চশমাধারী হেঁটেই বেরিয়ে এল শহর থেকে। হাঁটছে লম্বা-লম্বা পা ফেলে। অন্ধকারে আর কুয়াশায় বেশি দূর দেখা যাচ্ছে না। পেছন ফিরে তাকালেও তাই সে দেখতে পেত না অনিমাকে। চিতাবাঘের মতো নিঃশব্দে সে আসছে পেছন-পেছন।

জঙ্গলে ঢুকে পড়ল কালো চশমাধারী। বড়-বড় গাছের তলা দিয়ে সরু পায়ে-চলা রাস্তা। শেষ হয়েছে একটা দোতলা কটেজ প্যাটার্নের বাড়ির সামনে।

ফ্যান-লাইটের তলায় গিয়ে দাঁড়াতেই খুলে গেল সদর দরজা। ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিতেই সামনে এসে দাঁড়াল সুবেশ সুন্দর এক পুরুষ। গালে চাপ দাড়ি। চোখে বুদ্ধির দীপ্তি। কিন্তু সারা মুখে যেন নিষ্ঠুরতা মাখানো। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটাও নির্মম।

নিমর্ম হাসি হেসেই বললে লোকটাসমসের, কী ব্যাপার? হঠাৎ এলে কেন?

রাম সিং-এর এজেন্ট জালে পড়েছে। গেমস-এর আড্ডায় এসেছিল। আনব এখানে?

ম্যাডামকে জিগ্যেস করতে হবে। একা এসেছ?

হ্যাঁ।

ইউ ফুল। স্পাই এনেছ পেছন-পেছন।

স্পাই!

ওই দ্যাখো। দেওয়ালের গায়ে ক্লোজড সার্কিট টিভি স্ক্রিনের দিকে আঙুল তুলে দেখায় নিষ্ঠুর বদন ব্যক্তি। রঙিন পরদায় দেখা যাচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে থেকে পা টিপেটিপে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বেরিয়ে আসছে চাবুক চেহারা একটি মেয়ে। টাইট গেঞ্জিতে বুকের ওপর লেখা–আই লাভ ইউ।

অনিমা ভাবতে পারেনি শহরের এত কাছে স্কাউড্রেলগুলো ঘাঁটি গেড়েছে। এই পথ দিয়ে গাড়ির স্রোত বয়ে যায় সকাল সন্ধ্যা। কিন্তু রাস্তা থেকে দেখাই যায় না জঙ্গলের ভেতরকার এই নিরালা বাড়িটাকে।

ভেতরে কোনওমতে যদি ঢুকতে পারা যেত…

আগে বাড়িটাকে এক পাক ঘুরে দেখে নেওয়া যাক। পথ নিশ্চয় আছে। জঙ্গলের মধ্যে পাহারার কড়াকড়ি নাও থাকতে পারে।

পেছন দিকে এসে কিন্তু ভুলটা ভাঙল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল কালো চশমাধারী সেই লোকটা। হাতে রিভলভার। মোলায়েম গলায় বললে–ভেতরে এসো সুন্দরী। বাইরে বড় ঠান্ডা।

বড় ঘরটায় চেয়ারে বসে অনিমা। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। টাইট গেঞ্জি লুটোচ্ছে মেঝেতে। নিষ্ঠুর বদন ব্যক্তির একটা হাত তার বাম স্তনে মোচড় দিচ্ছে, এখনও বলো মহারানি তুমি কাদের এজেন্ট?

বলব না।

খুব মিষ্টি স্বর ভেসে এল করিডরের দরজার কাছ থেকে, রূপকুমার, ওকে আমার হাতে ছেড়ে দাও। তোমরা পাবে পরে।

দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস্য রকমের স্থূলকায়া এক মহিলা। চর্বি ঝুলে পড়েছে সারা দেহে, গালে চিবুকে। মাথার চুল ঝুঁটি করে ওপরে বাঁধা। আরও কুৎসিত দেখাচ্ছে ঠোঁটে লাল রং মেখে থাকায়। ফরসা গাল এমনিতেই লালচে। শুধু একটা ব্লাউজ আর স্কার্ট শরীরের কদাকার মেদবহুল অংশগুলোকে প্রকটতর করে তুলেছে।

থপথপ করে অতি কণ্ঠে গুরুভার দেহটাকে অনিমার সামনে নিয়ে এল চর্বির এই সচল পাহাড়টি। লাল ঠোঁট বেঁকিয়ে গা ঘিনঘিনে হাসি হেসে বললে, তুমি কাদের বাড়ির মেয়ে গো?

যমের বাড়ির–গা রি-রি করছে অনিমার। বুকটাও টনটন করছে শয়তানটার কদর্য হাতের নিষ্পেষণে। মুখ দিয়ে ভালো কথা বেরোয়?

নোংরা হাসি আরও একটু নোংরা হল প্রৌঢ়ার মুখে, বড় কষ্ট দিচ্ছে এরা, না? মেয়ে মানুষই মেয়ে মানুষের দুঃখ বোঝে। রূপ থাকা বড় জ্বালা, বাছা। হাত ধরে অনিমাকে চেয়ার থেকে উঠাল চর্বির পাহাড়। অনিমাও টুক করে মেঝে থেকে উলের গেঞ্জিটা কুড়িয়ে নিয়ে পরে নিল মাথা গলিয়ে। বুকে ঢেউ খেলে গেল লেখাটা–আই লাভ ইউ।

সে কী হাসি প্রৌঢ়ার, ইয়েস, ইয়েস, ইয়েস, আই লাভ ইউ। কাম উইথ মী। সমসের, রূপকুমার, তোমরা এখানেই থাকো।

ম্যাডাম, আর একজন রয়েছে গেমস-এর আড্ডায়।

সমসেরের কথায় কান দিল না ম্যাডাম।

ছোট ঘর। প্রায় অন্ধকার বললেই চলে। একটা শুধু ঘেরাটোপ দেওয়া টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে বড় সোফার পাশে।

অনিমাকে নিয়ে পাশাপাশি বসে আছে ম্যাডাম। দৃশ্যটা বিচিত্র। একজনের দেহের যৌবনের বন্যাকে আঁটসাঁট পোশাকে বাগে রাখার চেষ্টা; আরেকজনের চেষ্টা চর্বির বোঝাকে বেঁধেসেঁধে রাখার।

ম্যাডাম চেয়ে আছে অনিমার দিকে। কৌতুকভরা ছোট চোখ। অনিমার কিন্তু কেন জানি অস্বস্তি লাগছে চোখে-চোখে চাইতে। চোখ নামিয়ে নিতেই অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে গলায় হাসল ম্যাডাম নাম কী তোমার?

বলব না।

আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছ না কেন?

ঘেন্না হচ্ছে বলে।

তাকাও–আচম্বিতে কর্কশ হয়ে ওঠে ম্যাডামের স্বর। আরও শক্ত হয়ে যায় অনিমা।

তাকাও–অদ্ভুত একটা অনুভূতি জাগে অনিমার মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজেকে এলিয়ে দিতে ইচ্ছে যাচ্ছে, আলগা হয়ে যেতে ইচ্ছে যাচ্ছে।

তাকাও। অদৃশ্য একটা শক্তি ওর চাহনিকে টানছে, টানছে, টানছে, ম্যাডামের দিকে!

চোখ তোলে অনিমা।

ম্যাডাম চেয়ে আছে। ছোট চোখ দুটো এখন অগ্নিগর্ভ। যেন দু-দুটো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। ভলকে ভলকে অদৃশ্য শক্তিধারা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এ শক্তি চোখে দেখা যায় না। শক্তির উৎস কিন্তু এই দুটো চোখ। চোখ না চুম্বক? দৃষ্টি সরাতে পারছে না কেন অনিমা? শুধু ওই চোখ ছাড়া আশেপাশে যেন আর কিছুই নেই। অনিমা নিজেও যেন আর নেই। ওই চোখ। ওই চোখ তাকে গিলে নিয়েছে।

ভালো লাগছে?–অনেক দূর থেকে যেন ভেসে-ভেসে আসে ম্যাডামের মধুর স্বর। ঠিক যেন মা কথা বলছে। অনেক, অনেক বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মা।

হ্যাঁ।

প্রাণ খুলে কথা বলোএককেবারে গোড়া থেকে বলো। যখন স্কুলে পড়তে, যখন ছোট্ট ছিলে, তখন থেকে।

বলব, সব বলব, মানসিক চাপ, ভীষণ, অসহ্য, মন খুলে কথা বলার কেউ ছিল না।

আমাকে বলো।

বলছি।

.

গজাননের পরীক্ষা

গজানন গ্যাঁট হয়ে বসেছিল চেয়ারে। গেমস-এর আড্ডা এখন খালি। মেশিনগুলো নিস্তব্ধ। ছজন ভদ্রবেশি গুন্ডা তাকে ঘিরে বসে সিগারেট টানছে। আর সকৌতুকে দেখছে গজাননের নস্যি নেওয়া। নৈঃশব্দ্য খান-খান হয়ে যাচ্ছে এক-একটা টিপ নেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে।

কালো চশমাধারী ঢুকল ঘরে। মুখভাব অনেক নরম–চলো হে টিকটিকি।

টিকটিকি! আশেপাশে তাকায় গজানন; কোথায় টিকটিকি?

এতক্ষণ যারা নস্যি নেওয়ার ধরন দেখে অতিকষ্টে হাসি চেপে রেখেছিল, এবার তারা হেসে উঠল ঘর ঝাঁপিয়ে।

মুখ শক্ত হয়ে যায় কালো চশমাধারীর, মস্করা হচ্ছে? এসো।

কোথায়?

আমার বস্-এর কাছে।

ও! চলো! যেন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাল ছেড়ে দিয়ে কাঁধ নাচায় গজানন। মনটাও নেচে ওঠে সঙ্গে-সঙ্গে। তখন যদি জানত অদৃষ্টে ওর কী আছে, কুরুক্ষেত্র কাণ্ড ঘটিয়ে পিঠটান দিত ওইখান থেকেই।

জঙ্গলের মধ্যে নিরালা বাড়িটার সদর দরজা খুলেই দাঁড়িয়েছিল রূপকুমার। যেন যাত্রার হিরো। পেছনে থেকে আচমকা গজাননের কাঁধে রাম রদ্দা মারল সমসের। হুড়মুড় করে ভেতরে ঠিকরে গেল ট্রিপল-জি।

সঙ্গে-সঙ্গে অবশ্য সামলে নিল নিজেকে। কণ্ঠে জাগল চিল-চিৎকার, বলি, ব্যাপারটা কী? এইটুকু রাস্তা গাড়ি করে জামাই-আদরে এনে–

কথা আটকে গেল বিদ্রূপতরল একটি কণ্ঠস্বরে। বিদ্রুপের সঙ্গে মেশানো রয়েছে বেশ খানিকটা পৈশাচিকতার গরল।

গজানন নাকি? এসো, এসো, আমি বলেছিলাম বলেই তো অত খাতির করে এনেছে তোমাকে?

লাটুর মতো ঘুরে যায় গজানন। থিরথির করে কঁপে গালের কাটা দাগটা।

দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে মেদবিপুলা এক প্রৌঢ়া। দু কানের লতিতে দুটো সোনার রিঙ। ঠোঁটে থ্যাবড়া করে লাগানো লাল রং। মাথার চুল উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। ডাইনি নাকি? মনে-মনে বলে গজানন।

মুখে বলে বিষম বিস্মিত স্বরে–আপনি?

নিরীহ একটি মেয়েছেলে, বাবা। সাতে নেই, পাঁচে নেই।

কিন্তু এই গুন্ডাগুলোর ব্রেন আপনিই?

রক্ত মাখানো ঝুলে পড়া ঠোঁট দুটো অদ্ভুত ভঙ্গিমায় বেঁকে যায় হাসতে গিয়ে।

হ্যাঁ, আমি। শুনলাম, তুমি নাকি কি সব দুষ্টুমি করেছ। এসো, এসো, কাছে এসো।

দুষ্টুমি? পকেটে পয়সা নেই বলে রাম সিং-এর কাছে চিঠি পাঠানো–

তুলতুলে নরম হাতে গজাননের দু-হাত চেপে ধরে ম্যাডাম। ছোট চোখে আর ভিজে ঠোঁটে দুজ্ঞেয় সেই হাসি–রাজপুত্তুরের মতো চেহারা! আহা! মেয়েরা নিশ্চয় জ্বালাতন করে?

নরম ছোঁয়াটার মধ্যে কী যেন ছিল। গা শিরশির করে ওঠে গজাননের। কণ্ঠস্বর স্থলিত হয়, জুয়ো, আনাড়ি তো, তাই–

কথা বলতে গেলেই চোখের দিকে তাকাতে হয়। গজাননও তাকিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে শরীরের প্রতিটি অণুপরমাণু দিয়ে অনুভব করল অদৃশ্য শক্তির একটা ঝাঁপটা যেন ওকে টলিয়ে দিয়ে গেল। ভয়াবহ শক্তি। চোখে দেখা যায় না, কিন্তু যেন দুরমুশের ঘা লাগল সমস্ত সত্তায়।

মিহি গলায় বিমূঢ় গজাননের চোখে চোখ রেখে বললে ম্যাডাম সত্যি? বুড়িকে মিথ্যে বলতে নেই, বাবা।

নিস্তেজ গলায় বলে গজানন–সত্যি।

ছোট চোখ দুটোকে আরও কাছে নিয়ে আসে ম্যাডাম। তারকা-রন্ধ্রে ও কীসের শিখা। আচমকা বিস্ফারিত হয়ে ওঠে দুই চক্ষু। গজাননের দৃষ্টিপথে এখন কেবল ওই চোখ, ভয়াল, ভয়ংকর, পৈশাচিক, মোহময়!

গজানন, ও গজানন, মন খুলে বলো; সব কথা বলো।

ব-বলেছি তত; জুয়ো খেলতে এসেছিলাম, পকেটে..পকেটে…

আচমকা শিথিল হয়ে গেল ম্যাডামের চাহনির বজ্র আঁটুনি। গজাননের হাত ছেড়ে দিয়ে বললে কর্কশ গলায়–মিথ্যে কথা! জুয়ো খেলাটা তো একটা দুর্বলতা। অনেক বেশি শক্তিমান তুমি।

মা-মানে?

তোমার চোখের মধ্যেই রয়েছে অনেক কথা। অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ তুমি, গজানন। গজানন, গজানন, তোমার চোখেই দেখেছি যে আমার প্রতিবিম্ব।

অত কথার দরকার কী? রাম সিং-র কাছে চিঠিটা পাঠান, টাকা এসে যাবে। আমাকে রেহাই দিন।

সোফায় বসল ম্যাডাম। দু-হাত একত্র করে থলথলে মুখখানা ফিরিয়ে রইল গজাননের দিকে, ইন্টারেস্টিং। অনেক কিছুই জানো দেখছি।

হ্যাঁ, জানি, হঠাৎ খেপে যায় গজানন, কী জানি বলুন তো? মুরোদখানা দেখা যাক।

মুরোদ দেখতে চাও? হাসছে ম্যাডাম। সেই রকম শিথিল ঠোঁট বেঁকিয়ে বিকৃত হাসি, গা ঘিনঘিন করে গজাননের বৎস গজানন, যদি বলি তুমি একটা জঘন্য নোংরা স্পাই? এসেছ আমার কাজে নাক গলাতে?

বললেই হল?

কিম্ভুতকিমাকার ম্যাডাম শুধু ইশারা করল হাত নেড়ে। সমসের খুলে দিলে একটা দরজা। পায়ে-পায়ে ঘরে ঢুকল অনিমা।

আচ্ছন্ন অবস্থাটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে গজানন প্রাণপণে। দু-হাত দু-পাশে ঝুলিয়ে অমন পুতুলের মতো হাঁটছে কেন অনিমা? টগবগে ঘোটকীর মতো যে তেজস্বিনী, তার আপাদমস্তকে এ ধরনের আড়ষ্টতা কেন?

বিদ্রুপের ছুরি ঝলসে ওঠে ম্যাডামের তীক্ষ্ণ স্বরে,–চেনা-চেনা মনে হচ্ছে তাই না? একই দলের দুই স্পাই, তাই না?

তুখোড় গজানন তখন নির্নিমেষে চেয়ে আছে অনিমার দারুপুত্তলিকার মতো দেহবল্লরীর পানে। তাই চাবুকের মতো জবাবটা জিভে এসেও জড়িয়ে গেল,জীবনে দেখিনি।

মেপে-মেপে পা ফেলে আরও একটু এগিয়ে এল অনিমা। মিশরের মামী নাকি? গজানন চোখ কুঁচকে চেয়ে আছে। কোথায় যেন বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার ঘটে গেছে! অনিমা অমন শূন্য চাহনি মেলে রয়েছে কেন তার দিকে? চোখের মণি দুটো দু-টুকরো আয়নার মতো চকচক করছে

তো, ঠিক যেন ঘষা কাঁচ!

গজাননের বুকে বুক ঠেকিয়ে বললে অনিমা, যে স্বরে বললে তাতে উত্থান নেই, পতন নেই, প্রাণ নেই, উত্তাপ নেই; ঠিক যেন একটা যন্ত্র কথা বলে গেল যান্ত্রিক স্বরে–চিনি, একে আমি চিনি, ত্রিশূলের এজেন্ট। এর সঙ্গেই দেখা করতে বলা হয়েছিল আমাকে।

গজানন কি অজ্ঞান হয়ে যাবে?

সোফায় বসে মিটিমিটি হাসছে ম্যাডাম।

না, অজ্ঞান হয়ে যায়নি গজানন। সে পাত্রই সে নয়। ব্রেনটা কিন্তু নিমেষে তরতাজা হয়ে উঠেছিল। বুঝে ফেলেছিল কীসের প্রভাবে অনিমা আর নেচে বেড়াচ্ছে না, হেঁকে-হেঁকে কথা বলছে না, তেড়েমেড়ে ল্যাং মারছে না!

হিপনোটিজম্! ম্যাডাম ডাইনি তার ওপরেও সম্মোহনের ম্যাজিক দেখাতে গেছিল। ল্যাজেগোবরে হয়েছে। অনিমা বেচারা হাজার হোক মেয়ে তো, ডাইনির খপ্পরে পড়েছে।

নিবিড় চোখে অনিমা চেয়ে রয়েছে ওর দিকে, ঈষৎ ঘাড় বেঁকিয়ে। চাহনির মধ্যে নেই সেই প্রাণময়তা।

সোফার বসে মাথা তুলে বললে ম্যাডাম, কী গো গজানন, এবার কথা শোনো, খুলে বলো কী মতলবে আসা হয়েছে? মিছে বলে লাভ নেই দেখতেই তো পাচ্ছ।

চোয়ালের হাড় কঠিন হয়ে ওঠে গজাননের,যা বলবার তা বলা হয়ে গেছে। অত সহজে আমাকে ঘায়েল করা যাবে না।

ঘড়ঘড় শব্দে হেসে ওঠে ম্যাডাম। হাসির আওয়াজ যে এমন বিকট বিদিগিচ্ছিরি হয়, জানা ছিল না গজাননের।

ম্যাডামের চোখ আবার ছোট হয়ে এসেছে। ভিজে লাল ঠোঁটের ফাঁকে সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছে–সবাই তাই বলে, গজানন। তারপর ন্যাতা হয়ে পড়ে থাকে আমার কাছে। বিরাট পাঁজর খালি করা দীর্ঘশ্বাসে যেন ভেঙে খানখান হয়ে যায় ম্যাডাম,–বেচারারা!

অবাক হয় গজানন। একই গলায় কতরকমই আওয়াজ শোনা গেল এইটুকু সময়ের মধ্যে। একটু আগেই কদর্য হাসি আর কর্কশ হুমকি। আবার এখন তা মখমল কোমল, কবোষ্ণ, স্নেহময়।

রূপকুমার আর সমসের মিটিমিটি হাসছে গজাননের দিকে চেয়ে। অনিমার চোখের পাতা পড়ছে না। চর্বির পাহাড় দুলিয়ে অনামিকা নাড়িয়ে বলছে ম্যাডাম–গজানন, কী চাও। মেয়েমানুষ

মদ? ক্ষমতা না টাকা? খারাপ চাও তো, তাও পাবে। সব ব্যাপারেই সাহায্য পাবে আমার। মনের গোপনে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নগুলোকে যদি ভোগ করতে চাও

কিছু চাই না। যা বলবার বলেছি, বলেই ঘুরে দাঁড়ায় গজানন। পা বাড়ায় সদরের দিকে। কিন্তু রূপকুমার আর সমসের তো সেখানে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভোলা দরজা দিয়ে আরও এক মস্তান চেহারার মাসলম্যান এসে লোলুপ চোখে তাকিয়ে রয়েছে গজাননের দিকে। যেন কতদিন পেটাই-কর্ম হয়নি। হাত নিশপিশ করছে। সারা মুখে বসন্তর ক্ষত, চোখ দুটো কটা আর বাঘের চোখের মতো পাশবিক।

পেছন থেকে ভেসে আসে ম্যাডামের মোলায়েম হাসি-উচ্ছল স্বর।

গজানন, জানি না কেন তোমাকে দেখেই আমার ভালো লেগে গেছে। নিশ্চয় একটা-না একটা দুর্বলতা তোমার ভেতরেও আছে। যদি না-ও থাকে, বানিয়ে দেব আমি। রূপকুমার, বেরোতে দিও না।

রাইট, ম্যাডাম, এগিয়ে আসে তিন চক্রী এক সাথে।

গজানন এখন কী করবে?

.

ছুঁচের মহিমা

ছোট্ট ঘরটায় শুইয়ে ফেলা হয়েছে গজাননকে। পাশবিক হাসি হাসতে হাসতে বসন্ত ক্ষতআকীর্ণ লোকটা চেপে রয়েছে ওর দুটো হাত। রূপকুমার ধরেছে দুটো পা। মাথাটা ঠুসে ধরেছে সমসের। গজানন নিরুপায়। চোখের কোণ দিয়ে দেখল, টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একটা অ্যাম্পুল থেকে হাইপোডারমিক সিরিঞ্জে ওষুধ টেনে নিচ্ছে ম্যাডাম।

গর্জে ওঠে গজানন–এই মুরোদ! হিপনোটিজমের ক্ষমতা নেই, আরক দিয়ে ঘুম পাড়াতে চান?

জলহস্তীকে কখনও হাসতে দেখা যায় শব্দ না করে? না। পশুরা হাসতে পারে না। কিন্তু মানুষ পারে। ম্যাডামের মুখে এখন যে হাসিটা দেখা গেল, তা জলহস্তীরা দেখলে তাজ্জব হয়ে যেত।

বৎস গজানন, তোমার মতো কুঁচো চিংড়িকে আমার পুরো মুরোদটা দেখাতে চাই না, তাই এই ইঞ্জেকশন। ঠান্ডা মেরে আনবে, বড় ক্ষতি হবে না।

বড় ক্ষতি মানে?

অব্যাহত রইল জলহস্তী হাসি মানে, তোমার ইচ্ছেটাকে জোর করে যদি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিই–তা হলে, তা হলে পাগল হয়ে যাবে, গজানন। আমি চাই তোমাকে আমার গোলাম, আমার প্রেমিক, আমার পুত্র বানিয়ে রাখতে। নানাভাবে তোমার ওই মজবুত শরীরটাকে চাই কাজে লাগাতে।

শয়তানী! তুই-ই তাহলে জোয়ারদারকে পাগল করেছিস?

বেশি জেনে ফেলেছ, গজানন।

তুই পারিস আমাকে জাতিস্মর করে তুলতে?

চমকে উঠল ম্যাডাম। চমকে উঠেছে সমসেরও। হাত শিথিল হয়ে গেছে। গজানন ঘাড় বেঁকাতে পারছে। গনগনে চোখে ম্যাডাম চেয়ে আছে তার দিকে।

গজানন, জাতিস্মর হতে চাস?

হ্যাঁ, চাই।

কিন্তু কীভাবে জানলি আমার সে ক্ষমতা আছে?

আছে না কচু। আমেরিকায় গিয়ে পঞ্চাশ হাজার ডলার খরচ করলেই ব্রেনের নহাজার কোটি নিষ্ক্রিয় নিউরোণকে সক্রিয় করতে গিয়ে হয়তো মনের শক্তি একটু বেড়ে গেছে। পূর্বজন্মের স্মৃতি ফিরিয়ে আনা অত সোজা নয়। পারে শুধু মুনি-ঋষিরা।

গজানন!

চোপরাও মাগী! গজানন এবার ফ্রি ল্যাংগুয়েজ ছাড়তে থাকে–আমেরিকায় কোটিপতিদের টাকা খেয়ে ইন্ডিয়ার লাখোপতি কোটিপতিদের খতম করে চলেছিস একে-একে। তোর মুখে থুথু দিতে ইচ্ছে যাচ্ছে।

তাই নাকি? তাই নাকি? টকটকে লাল হয়ে ওঠে ম্যাডামের মুখমণ্ডল সমসের! রূপকুমার। পঞ্চানন! কিল হিম! কিল হিম! খুব বেশি জেনে গেছে! অ্যাট ওয়ান্স!

.

ত্রিশূল

অন্য ঘরে খাবার টেবিলে বসেছিল অনিমা। ছুরি কাঁটাচামচের দিকে চেয়ে রয়েছে নির্নিমেষে। পুতুলের মতো হাত বাড়িয়ে তুলে নিল। এক হাতে ছুরি, আর এক হাতে কাঁটা চামচ। এবার কেক কাটবে। খাবে।

কিন্তু চোখ আটকে গেল কাঁটা চামচে। চেয়েই রইল। চোখ আর সরে না। চোখের পাতাও পড়ে না।

ঈষৎ সঙ্কুচিত হল চক্ষুতারকা। সম্মোহিত হওয়ার পর এই প্রথম চোখ কুঁচকোচ্ছে সে। কারণ কঁটাচামচের তিনটে মাত্র কাঁটার গড়নটা তার যেন চেনা-চেনা লাগছে।

কোথায় যেন দেখেছে…।

মন ছেয়ে ফেলছে ওই তিনটে কাটা, মিলেমিশে যাচ্ছে আরও তিনটে সূচীতীক্ষ্ণ শলাকার সঙ্গে।

ত্রিশূল!

যেন বজ্রালোকে ঝলকিত হল অনিমার মস্তিষ্কের অভ্যন্তর। অব্যাখ্যাত এক দীপ্তি নিমেষ মধ্যে ঘুচিয়ে দিল সম্মোহনের নিরন্ধ্র তমসা।

ত্রিশূল।

কাটাচামচটা দেখতে ত্রিশূলের মতো।

সে ত্রিশূলের এজেন্ট।

এখন কোথায়? শত্ৰুপুরীতে। ত্রিশূলের আর একজন এজেন্ট গজানন কোথায়? শত্রুদের হাতে!

কঁটাচামচ টেবিলে রেখে উল্কাবেগে দরজা দিয়ে করিডরে বেরিয়ে গেল অনিমা। সামনেই সেই ছোট ঘর। ঘরের মধ্যে বিদিগিচ্ছিরি গলায় চেঁচাচ্ছে ম্যাডাম কিল হিম! কিল হিম! খুব বেশি জেনে গেছে। অ্যাট ওয়ান্স!

অনিমা যেন সাইক্লোন হয়ে গেল মুহূর্তে। দমকা বাতাসের মতো ঢুকল ঘরে। রূপকুমার রিভলভার বার করেছে, তুলছে গজাননের খুলি লক্ষ্য করে।

শূন্যপথে ধেয়ে গেল অনিমার পেটাই শরীর। দু-পায়ের মধ্যে রিভলভারটা মুঠো থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অবতীর্ণ হল খাটের ওপাশে, পরমুহূর্তেই পায়ের ফাঁক থেকে রিভলভার তুলে নিয়ে বিনা দ্বিধায় পরপর গুলি করে গেল সমসের, পঞ্চানন আর রূপকুমারকে। হতভম্ব তিনজনেরই খুলি গেল উড়ে, নিষ্প্রাণ দেহগুলো লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।

লুটিয়ে পড়ার আগেই অবশ্য তড়িৎ গতিতে শয্যা থেকে উঠে পড়েছে গজানন। একটি মাত্র হনুমান লম্ফ দিয়ে গিয়ে পড়েছে ম্যাডামের ওপর। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শূন্যপথে উড়ন্ত মানবী, গুলিবর্ষণ এবং হনুমান লম্ফ দেখে জলহস্তিনী ম্যাডাম ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছিল। হাত থেকে সিরিঞ্জটা কেড়ে নিয়ে পাট করে বাহুমূলে বিঁধিয়ে দিল গজানন।

বললে আকৰ্ণ হেসে-ঘুম, ঘুম, টানা ঘুম এবার। ম্যাডাম, চোখ মেললেই দেখতে পাবে খাঁচাঘর। গুড নাইট।

ঘুমিয়ে পড়ল ম্যাডাম।

তারপর?

গোপন সে কাহিনি এখানে লেখা যাবে না।

* ঘরোয়া পত্রিকায় প্রকাশিত। (শারদীয় সংখ্যা)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *